2

অনুবাদ সাহিত্য - অংকুর সাহা

Posted in

অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা -- ৯ 

এবারের অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতায় নির্বাচিত একজন কবির মৃত্যু হলো ২৭ এপ্রিল, ২০২০, যদিও করোনার প্রকোপে নয়, ৭৫ বছর বয়েসে স্ট্রোক হয়ে। তিনি আয়ারল্যান্ডের কবি এইভান বোলান্ড, আমেরিকার অধিবাসী হলেও কাব্যভাবনায় আপাদমস্তক আয়ারল্যান্ডের। ২০১৬ সালে হোয়াইট হাউসে সেন্ট প্যাট্রিক দিবসের উৎসবের উদযাপনের সময় রাষ্ট্রপতি ব্যারাক ওবামা উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন তাঁর কবিতা থেকে। দেশটির জাতীয় অভিজ্ঞান এবং এবং সেই দেশের জাতীয় জীবনে নারীর ভূমিকা তাঁর কবিতার উপজীব্য। ১৯১৮ সালে নারীরা ভোটাধিকার পেয়েছিলেন আয়ারল্যান্ডে -- তার শতবার্ষিকী উদযাপনে লেখা তাঁর আর একটি কালজয়ী কবিতা। প্রেমের কবিতা লেখার ফুরসৎ তাঁর নেই, কিন্তু ১৮৪৭ সালের দুর্ভিক্ষের কাহিনীই প্রেমের রূপ ধারণ করে তাঁর রচনায়। সেই দুর্ভিক্ষের কালে অনাহারে এবং টাইফাস জ্বরে মৃত্যু হয়েছিল দশ লক্ষের বেশি মানুষের। সংকলিত কবিতাটির নাম “কোয়ারান্টিন” -- আমরা এখন যে সময়ে বাস করছি তাতে খুবই প্রাসঙ্গিক। 

শুরু করেছি আরেকজন নোবেলজয়ী কবিকে দিয়ে -- যে শহর থেকে প্রতি বছর নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা ঘটে, সেই শহরের বাসিন্দা টোমাস ট্রান্সট্রোমার। প্রতি বছরই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাহিত্যিক বন্ধুরা আসতেন স্টোকহোম শহরে তাঁদের নোবেল পুরস্কারষ্কার নিতে; তাঁরা গল্পগুজব করতে আসতেন কবির বাড়িতে। প্রতি বছরই গুজব ছড়াত যে এবার তাঁর পালা। শেষ পর্যন্ত সেই ঘটনাটি ঘটলো ২০১১ সালে। কিন্তু তার দুদশক আগেই তিনি এক মর্মান্তিক অসুখে বাকশক্তি হারিয়েছেন। তাঁর মুখনি:সৃত ধ্বনিগুলির মর্মোদ্ধার করতে পারেন একমাত্র তাঁর স্ত্রী মনিকা; সে বছর ডিসেম্বর মাসে নোবেল পুরষ্কার বিতরণের সভায় নোবেল বক্তৃতার বদলে তিনি এক হাত দিয়ে পিয়ানো বাজিয়ে শোনালেন। ৮৩ বছরের জীবনে মাত্র কয়েকশো কবিতা লিখেছিলেন তিনি -- তার একটি সংকলিত এখানে।

গ্রামের সাধারণ চাষাভুষো মানুষদের দৈনন্দিন জীবন যাত্রা নিয়ে কবিতা লেখেন নরওয়ের কবি নুট ওডেগার্ড, তাঁর অন্তরে বাস করেন করুনাময় যীশু। সম্প্রতি সেই দেশের রাজধানী অসলোর এক জনপ্রিয় সংবাদপত্রে তাঁর বিষয়ে লেখা হয়েছিল, “Norway does not have a court poet. But Norway does have a poet of European stature in Knut Odegard.” গভীর ধর্মভাবনা সমৃদ্ধ করেছে তাঁর মরমী কবিতাকে। নরওয়ের রমসডাল অঞ্চলটিতে শৈশব কেটেছে তাঁর এবং এখনো তিনি পাখা মেলে উড়ে যান সেখানকার জেলেদের গ্রামগুলির আকাশ বেয়ে স্বপ্নে।

আরো পাঁচজন কবি আছেন এবারের প্রেমের কবিতার সমারোহে -- একজন ইংল্যান্ডের, বাকি চারজন মার্কিন: কেউ সৃজনশীল সাহিত্যের অধ্যাপক, কেউ নারীবাদী নেত্রী; কিভাবে কবিতা পড়তে হবে, সেই নিয়ে পুরো একটি গ্রন্থ লিখেছেন একজন; “তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা এক শুক্কুরবারের বিকেলে, আর সেইদিন আমার জীবনে এলো প্রেম,” লিখেছেন অন্য একজন।

কত বিচিত্রভাবেই যে গড়ে ওঠে প্রেমের কবিতা -- করোনার দিনগুলিতে প্রেম -- আসুন এবার কবিতাগুলি উপভোগ করি: 

টোমাস ট্রান্সট্রোমার (সুইডেন, ১৯৩১-২০১৫)

দম্পতি 

আলো নেভায় তারা, রাতের গেলাসে ট্যাবলেটের মতন 
শেষ রশ্মিটুকু মিলিয়ে যাবার আগে চকচক করে 
রূপালি বাতিদান। তারপরে মত্ত হয় দুজনে।
আকাশে শোঁ করে উড়ে যায় দেওয়াল।

সোহাগের গতি কমতে থাকে আর তারা ঘুমোয়,
কিন্তু তাদের গোপন চিন্তাভাবনাগুলো মিশতে চায়,
যেভাবে স্কুলের ছাত্রের আঁকা ছবির ভেজা কাগজে 
দুটো রং দুদিক থেকে গড়িয়ে আসে ও মিলিত হয়।

নিথর ও অন্ধকার ধরিত্রী। কিন্তু সংঘবদ্ধ হয় 
শহরের ইঁটকাঠ। জানালাগুলি কোঁচকানো। গৃহগুলি 
সব এসে হাজির। দাঁড়িয়ে থাকে তারা দল বেঁধে,
জড়োসড়ো, নির্বিকার মুখের অপেক্ষমান জনতা।

[সুইডেনের শীর্ষস্থানীয় কবি এবং মনোবিদ চিকিৎসক। এক দশকের বেশি সময় নোবেল পুরষ্কারের সম্ভাব্য তালিকায় পরে শেষ পর্যন্ত সাহিত্যে নোবেল পেলেন ২০১১ সালে। ১৯৯০ সালে এক মর্মান্তিক অসুখে তিনি বাকশক্তি হারান। কথা বলতে না পারলেও তিনি কবিতা লিখে চলেন। হুইলচেয়ারে বসে তাঁর এক হাতে পিয়ানো বাজানোর ভিডিও দেখেছি। কবিতাটি ১৯৬২ সালে প্রকাশিত “অসমাপ্ত স্বর্গ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। সুইডিশ ভাষা থেকে কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন মে সোয়ানসেন।] 

অড্রি লর্ড (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৩৪-১৯৯২)

বিনোদন 

সম্মিলিতভাবে
কাজ করার সুবিধে হবে
আগে যদি
মিলিত হয়
একজোড়া গতর আমাদের
কাগজের ওপরে কলম
না কোনো পরোয়া না কোনো মুনাফা
আমরা লিখি কিংবা না লিখি 
যখন তোমার শরীর নড়াচড়া করে
আমার হাতের আবরণে
ছিলেটান আর অপেক্ষমান 
আমি তাদের বন্ধন কেটে দিই 
তোমার ঊরুর বিপরীতে আমায় সৃষ্টি করো তুমি
পাহাড়-পর্বতে আকীর্ণ সেই প্রতিমা
শব্দময় ভুবনগুলোর ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
আমার শরীর নিয়ে যে খেলা
খেলতে চাও তুমি
তার কবিতা লিখি আমি
তোমার মাংসকে বিদ্ধ করে।

তোমাকে ছুঁয়ে মধ্যরাতের স্পর্শ পাই
কণ্ঠনালীতে আগুন জ্বালায় চাঁদ
তোমার মাংস থেকে ফুল ফোটা দেখে চোখ জুড়োয়
তোমাকে নির্মাণ করে
নির্মিত তোমাকে
মেশাই আমার অভ্যন্তরে। 

[নারীবাদী মার্কিন কবি, প্রাবন্ধিক, গ্রন্থাগারিক এবং মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী। নিজেকে বর্ণনা করেছেন “black, lesbian, mother, warrior, poet” হিসেবে। কালো মানুষের ওপরে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম তাঁর। মাত্র ৫৮ বছর বয়েসে কর্কটরোগে অকালমৃত্যু। কবিতাটি নেওয়া হয়েছে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত “কবিতাসমগ্র” থেকে।]

নিকি জিওভানি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪৩- )

তুমি আছো

আমার কবিতাগুলো যত্ন করে রাখবো
আমার স্বপ্নের শীতকালের জন্যে
দোলচেয়ারে দুলতে দুলতে
জড়িয়ে ধরবো আমার জীবনকে
অবাক লাগে -- কী ভাববো তখন 
পুরানো প্রেমিকদের কথা -- অনেককেই 
আর মনে পড়ে না আমার 
তবে জানি আমার নিজের জীবনকে আর 
জানি তুমি আছো 

গভীর শীতের দিনে তুমি থাকবে সঙ্গে 
হাঁটুর ওপরে শ্যামদেশের বেড়ালের মতন 
গায়ে হাত বোলালেই গুর গুর আওয়াজ 

বৃষ্টির দিনেও থাকবে তুমি 
মাথার ওপরে বিশাল একটা ছাতার মতন 
আর্দ্র কুয়াশায় মিশে যেতে দেবে না আমায় 

রাতের আঁধারেও সঙ্গ দেবে তুমি 
ঝড়ের রাতে লাইটহাউসের মতন 
পথ দেখাবে কূলের নিরাপত্তার দিকে

গ্রীষ্ম দ্বিপ্রহরের উষ্ণতাতেও পাশে থাকবে তুমি 
আমার নগ্ন পিঠে মালিশ করবে নারকেল তেল 
যাতে রোদে না পুড়ে তামাটে হয়ে যাই আমি 

যত্ন করে রেখে দেব একটা কবিতা 
কেবল তোমার মুখে শুনবো বলে
তোমার কণ্ঠস্বর হাসি ফোটায় আমার মুখে 
যদিও আমি নিয়মিতই কেঁদে উঠি 
তুমি বলেছো যে তুমি ভালো করেই জানো 
নিরাশ করবো না তোমায় আমি 

তুমি চলে গেলেও হতাশ হবে না 
বারান্দার দোলচেয়ার অথবা আমি 
শীতের শূন্যতা আমি 
জমা করে রেখে দেব 
এই কথা জেনে --
তুমি সর্বদা থাকবে আমার সঙ্গে 

টীকা:
শ্যামদেশের বেড়াল: সিয়ামিজ ক্যাট (Siamese Cat), ঘিয়ে রঙের ছোটো ছোটো লোমওয়ালা বাদামি মুখের বেড়াল।

সম্মোহন 

একদিন 

তুমি দরজা খুলে ঢুকবে আমার ঘরে 
আমি পরে থাকবো লম্বা 
আফ্রিকান গাউন 
তুমি বসতে না বসতেই বলবে “ওই কালো …..”
সঙ্গে সঙ্গে হাত ধরবো আমি তোমার 
দেখেও দেখবে না তুমি, বলবে “ওই দাদার 
কথা কিছু শুনেছো …..”
তোমার হাত দিয়ে জড়াবো গলা 
তুমি ঘ্যান ঘ্যান করেই চলবে “এই বিপ্লব…..”
আমি তোমার হাতের স্থান করে দেব আমার তলপেটে 
তুমি আগের মতোই বলে চলবে 
“আমি বুঝতে পারি না …..”
আমি তোমার হাত নিয়ে সংগোপনে বোলাবো ওপর থেকে নিচে 
এবং ধীরে ধীরে খুলে ফেলবো তোমার দাশিকি 
তুমি বলতে চাইবে “এখন আমাদের প্রয়োজন…”
আমি জিভ দিয়ে চাটবো তোমার বাহু 
কথা থামবে না তোমার “আমার মনে হয় এখন চাই…..”
এর মধ্যে আমি বেল্ট খুলে নামিয়ে ফেলেছি তোমার প্যান্ট
“বিপ্লবের এখন যা পরিস্থিতি…..” 
এদিকে তোমার আন্ডারপ্যান্ট নেমে গিয়েছে হাঁটুর নিচে 
সম্বিৎ ফিরবে তোমার তখন 
দেখবে নিজের অসম্বৃত অবস্থা 
তোমায় জানি বলেই বলছি 
তুমি তখন বলবে 
“নিকি,
এ তো প্রতিবিপ্লবী আচরণ, তাই না…….?

টীকা: 
দাশিকি: পশ্চিম আফ্রিকার জাঁকজমকপূর্ণ রঙিন জামা।

[আফ্রিকান-আমেরিকান প্রতিবাদী কবি, রাজনৈতিক কর্মী এবং ভার্জিনিয়া টেক এর অধ্যাপক; 2007 সালের 16 এপ্রিল তাঁর কবিতার ক্লাসের ছাত্র সিউং-হুই চো অটোমেটিক রাইফেলের গুলিতে হত্যা করে বত্রিশ জন ছাত্রছাত্রীকে; পরের দিনের স্মরণসভায় মর্মস্পর্শী বক্তৃতা দেন তিন -- “We know we did nothing to deserve it. But neither does a child in Africa dying of AIDS. Neither do the invisible children walking the night awake to avoid being captured by a rogue army. Neither does the baby elephant watching his community being devastated for ivory. Neither does the Mexican child looking for fresh water....We are Virginia Tech.... We will prevail.” কবিতাদুটি ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত “প্রেমের কবিতা” (“Love Poems”) সংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে।]

এইভান বোলান্ড (আয়ারল্যান্ড, ১৯৪৪-২০২০)

কোয়ারান্টিন 

সমগ্র মানবজাতির ঘোর দু:সময়ে 
সবচেয়ে বাজে বছরের, সবচেয়ে বাজে ঋতুর, সবচেয়ে বাজে প্রহরে,
একজন মানুষ তার কর্মশালা ছেড়ে রওনা দিল বৌকে সঙ্গে নিয়ে।
হাঁটছিল সে -- হাঁটছিল তারা দুজনে -- গন্তব্য উত্তর দিকে।

অনাহারে গায়ে জ্বর এসেছে বৌটার, হাঁটতে অপারগ হলে
স্বামী তাকে তুলে নিল নিজের কাঁধে।
এভাবেই চললো তারা -- পশ্চিমে, আরও পশ্চিমে, তারপর উত্তরে।
সূর্য ডুবে গেলে নক্ষত্রদের থেকে ধরায় নামে তুষারের শীতলতা।

ভোরবেলায় তাদের দুজনকেই পাওয়া গেল মৃত।
শৈত্যে, খিদেয়, আর মানবজাতির সমস্ত বিষ শরীরে নিয়ে;
বউটার পাদুটোর চেটো রাখা ছিল স্বামীর বুকের গায়ে।
তার হৃৎপিণ্ডের অন্তিম উষ্ণতাটুকু দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল নারীকে।

এদের চৌকাঠ পার হবে না পৃথিবীর কোনো প্রেমের কবিতা।
বেফাঁস কোনো কথা বলার ফুরসৎ নেই এখানে।
সহজ সৌন্দর্যের প্রশংসা অথবা শারীরিক কামনা-বাসনা
হৃদয়হীন হিসেব-নিকেশের সময় এখন:

তাদের যুগলমৃত্যু ঘটেছিল ১৮৪৭ সালের শীতকালে।
কেমনভাবে বাঁচতো তারা; কেমন দারিদ্র তাদের জীবনে।
আর কোন সেতু জুড়ে রাখতো তখনকার পুরুষ আর নারীকে।
আর কোন গভীর অন্ধকারে সেটা প্রমাণ করা সম্ভব।

[প্রথা-বিরোধী এই প্রেমের কবিতার লেখক আয়ারল্যান্ডের কবি, বাস করতেন আমেরিকাতে, অধ্যাপনা করতেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। মারা গেলেন ২৭ এপ্রিল, ২০২০; না, করোনার প্রকোপে নয়, স্ট্রোক হয়ে। বয়েস ৭৫। তাঁর কবিতা পড়ানো হয় আয়ারল্যান্ডের স্কুলে। ২০০১ সালে প্রকাশিত কবিতার বই এর নাম “প্রেমের কবিতার বিরুদ্ধে”। কবিতাটি “সংকেত” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া।]

ক্যারোল সি গ্রেগরি : (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪৫- ) 

প্রেমপত্র 

প্রিয় স্যামসন,
তোমার চুলগুলো 
একটা জারে ভরে 
ওর কাছে 
ন্যাসপাতি গাছের গোড়ায় রেখেছি।

আমার কৃতকর্মের কথা 
কয়েকদিন ধরেই ভাবছি এবং
আমি এখনও মনে করি না 
ঈশ্বর তোমায়
অমিতশক্তি দিয়েছেন বলেই
তুমি আমাদের লোকজনকে
ধরে ধরে মারবে;

ভালোবাসা নিও -

ডিলাইলা; 

[আফ্রিকান-আমেরিকান কবি এবং ম্যানহাটান কমিউনিটি কলেজের সৃজনশীল সাহিত্যের অধ্যাপিকা। কবিতাটি “কন্ডিশন ৫” কবিতাপত্র থেকে নেওয়া হয়েছে। ]

নুট ওডেগার্ড (নরওয়ে, ১৯৪৫- )

সব কিছু 

থরজাৰ্দুর এর জন্যে 
যখন আমরা বৃদ্ধ হই, হে প্রিয়ে 
কাকের দল আসে আমাদের নিতে 
(কা: কা:, তারপর ডানার তুমুল ঝাপটে সোজা আকাশে,)
কোথায় যাবে আমাদের প্রেম তখন?

যে হাসিমুখ এখন বলে যায় ভাঙা কফি-মেশিনের কথা,
গাড়ির গায়ের মরচে, হৃদরোগ-বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দেখা করা,
খসে পড়েছে দাঁতের ফিলিং, ফোনের বিল দেবার দিন এলো,
অথবা সোনালি চাঁদ দেখার সোহাগ এবং ফুলে ফেঁপে ওঠা 
পাহাড়ি গোলাপ, যাতে ব্যাখ্যা করা যায় সব ডাহা মিথ্যে 
আর অন্য ছলচাতুরি, কিন্তু বলতে পারে না আমাদের না-পাওয়া 
সন্তানের কথা এবং যে চুম্বনে আমি গলে যাই তোমার সঙ্গে,
তার কী হবে তখন?

অথবা যে চোখজোড়া কমপিউটারের সবুজ পর্দায় চেয়ে থাকে 
দিনের পর দিন এবং সন্ধের সময় তুমি জামাকাপড় ছাড়লে 
তাড়িয়ে তাড়িয়ে দ্যাখে তোমায়: লজ্জায় আলো নেভাও তুমি,
দাঁড়াও সিল্যুয়েট হয়ে -- সুপক্ব স্তন আর নিতম্বে আইসল্যান্ডের 
কোবাল্ট -- নীল সমুদ্র থেকে আলো চুঁইয়ে আসে জানালার 
খড়খড়ি বেয়ে।

অথবা যে হাত পাতার পর পাতা লিখে যায় আর তুষার-ঝাড়ু
গুছিয়ে রাখে তার জায়গায়, আদর করে তোমার গতরে,
যতক্ষণ না আগুন হয়ে জ্বলে ওঠো তুমি, আর
আমাকে চাও তোমার মধ্যে নিতে --
বাঁধভাঙা স্রোতের মতন আমি ঝাঁপাই তোমার অভ্যন্তরে আর
জলপ্রপাত হয়ে নামি তোমার জরায়ুতে, যেটা সেদিন
কেটে আলাদা করলেন রিকিয়াভিকের শল্য-চিকিৎসক?

এই সব, সব কিছু, যাকে আমরা বলি প্রেম--
কাকেদের আগমনের সময় কোথায় লুকাবে তাকে?
আমাদের দুজনকে তারা একসঙ্গে নেবে না। আমাদের মধ্যে
একজনকে আগে গিয়ে শুতে হবে তুষারপাতে নোংরা হওয়া জমিতে
সমুদ্রের পাশে (গত গ্রীষ্মের হলুদ ঘাস, এখন সজীব তুষার-জলে),
তারপর কাকেরা এসে ঠোকরাবে তার ঠোঁটে,
চোখে, হাতে, অথবা যৌনাঙ্গে।

আর অন্যজন দাঁড়িয়ে থাকবে, হে প্রিয়ে, জানালার পেছনে,
ঘুম ভেঙে উঠবে ভোরবেলা এবং চালিয়ে যাবে চির চেনা
দিনগত পাপক্ষয় -- চিঠির বাক্স থেকে তুলে আনবে 
সকালের টাটকা মর্গ্যানব্লাদিদ। বাথরুমের কল থেকে 
নিজের মুখ দেখবে আয়নায়: সেখানে কি নিজের মুখ ছাড়া 
অন্য কিছু দেখা যাবে? অন্যজনের মুখও কি তখন 
ঝিকমিক করবে আরশিতে, যখন পরিত্যক্ত গৃহগুলি 
সৈকতে দাঁড়াবে আলোঝলমল? 

টীকা:
পাহাড়ি গোলাপ (Rowan-tree) -- উত্তর ইয়োরোপের পাহাড়ি অঞ্চলের গাছ, বৈজ্ঞানিক নাম Sorbus Acuparia. একই ধরণের গাছ জন্মায় হিমালয় অঞ্চলে: Sorbus Cashmiriana.

মর্গ্যানব্লাদিদ (Morganbladid ) -- রিকিয়াভিকের জনপ্রিয় সংবাদপত্র।
[গভীর ধর্মভাবনার অনুপ্রেরণায় কবি। নরওয়ের দৈনন্দিন জীবনের ছবি ফুটে ওঠে তাঁর কবিতায়। গ্রামের কৃষক দম্পতি, তাঁদের ট্র্যাক্টর ও পোষা কুকুর, মাঝিদের মাছ ধরার জেলে ডিঙি, স্থানীয় গির্জার ধর্মযাজক -- সাধারণ মানুষ, কেজো মানুষের কেজো কথা নিয়ে মুখর তিনি। যীশুর সহচর জুডাস ইস্কারিয়ট এর কাহিনী অবলম্বনে লিখেছেন দীর্ঘ কবিতা -- প্যালেস্টাইনের পটভূমিতে প্রাচীন কাহিনীর নতুন কাব্যরূপ। নরওয়ের ভাষা থেকে কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ব্রায়ান ম্যাকনিল।] 

জোন আই সিগেল (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪৬- )

মেরি ক্যাসাট: চিঠি (১৮৯০-১৮৯১)

সারাদিন চিঠিটা গানের মতন তার সঙ্গে ঘরে 
যখন সে ছুরি দিয়ে কাটে প্রাতঃরাশের কমলালেবু,
চুলে বুরুশ চালায়, বা 
জানালা বন্ধ করে।

সারাক্ষণ সে তার কথা শোনে 
যখন বন্ধুরা বেড়াতে আসে আর 
সে গতকালের খোশখবর নিয়ে 
গল্পগুজব চালায়,
চা ঢালে,
বিদায় জানাতে দরজায় এসে দাঁড়ায়।

তারপর তার সঙ্গে একলা হয়ে 
শেষ বিকেলে,
তাকে নামিয়ে রাখে লেখার টেবিলে,
ফুলদানিতে ফুলের মতন করে 
সাজায় তাকে।

তারপর তাকে খামের মধ্যে ভরে দিয়ে 
জিভ ছুঁইয়ে আশ্লেষে খাম বন্ধ করে।

টীকা:
মেরি ক্যাসাট (১৮৪৪-১৯২৬) অংকিত “চিঠি” তৈলচিত্রটি ফিলাডেলফিয়া মিউজিয়াম অফ আর্ট” এ রক্ষিত আছে।

[জোন আই সিগেল এর কবিতা আমেরিকার বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিউ ইয়র্কের অরেঞ্জ কাউন্টি কমিউনিটি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপিকা। “ওয়ার্ডস্মিথ” নামে একটি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। কবিতাটি “দি আটলান্টিক মান্থলি” সাময়িকপত্র থেকে নেওয়া হয়েছে।]

এডওয়ার্ড হার্শ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৫০- )

দুটি (পান্ডিত্যপূর্ণ) প্রেমের কবিতা 

১. মৃত সাগরের পুঁথিসমূহ 

কুমরানের অন্ধকার গুহায় দীর্ঘকাল বন্দী
প্যাপিরাসের পাতায় লেখা গোপন শিক্ষার পুঁথির
অচেনা অক্ষর হয়ে লুকিয়ে ছিলাম আমি,

আর তুমি হলে সেই পণ্ডিত গবেষক
এক নিবিড় পাঠক, যার জন্যে
আমার সারা জীবনের অপেক্ষা

যে আমাকে খুলে ফেলবে প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে
আর গভীর অধ্যয়নে বুঝে নেবে আমার ভাষা
আর আকণ্ঠ অভিনিবেশে উন্মোচন করবে তার রহস্য। 

২. পরমানন্দের সন্দর্ভ 

তোমার নগ্ন শরীর ছুঁয়েছিলাম আমি 
পণ্ডিত রাবাই যেমন দুবেলা 
কামনার প্রাচীন পুঁথিগুলো খুলে 
তার অক্ষরের রহস্য বুঝে নিতে চায় 

মনে আছে আমাদের প্রলাপী চিত্তবিভ্রম 
যখন আমার আঙ্গুল গুলো সামনে আর পিছনে 
পৃষ্ঠা থেকে পৃষ্ঠা, বর্ণ থেকে বর্ণ, অক্ষর থেকে অক্ষর,
বাক্য থেকে বাক্য -- সরে সরে যেতে থাকে।

আমি ছিলাম নিবেদিত পাঠক 
দিনের পর দিন ছুঁয়েছি তোমার রহস্য 
গোপন পুঁথির গোপন বাক্যগুলিতে।
আমাদের শয়নকক্ষ এক পবিত্র মন্দির 

কেঁপে ওঠে আমার দুহাত 
আশংকায় বেপথু আমার কণ্ঠস্বর 
আউড়ে যাই সে পুঁথির আশীর্বাদ 
যা ঝলসে উঠবে খানিকটা পরেই।

টীকা:
কুমরান: প্যালেস্টাইনের ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের যে গুহায় লুকানো ছিলো মৃত সাগরের পুঁথি (“Dead Sea Scrolls”); সেগুলো প্রথম খুঁজে পান বেদুইন মেষপালকেরা।

গোপন শিক্ষার পুঁথি: গ্রিক ভাষায় আপোকৃফন (“Apocryphon”); প্রাচীন ইহুদি ও খৃষ্টান ধর্মগ্রন্থ।

রাবাই: ইহুদি ধর্মযাজক (“Rabbi);

[নামকরা মার্কিন কবি -- ৯ টি কাব্যগ্রন্থ; কিন্তু “কীভাবে কবিতা পড়তে হয় এবং কবিতার প্রেমে পড়তে হয়” (১৯৯৯) নাম একটি বেস্টসেলার গদ্যগ্রন্থ লিখে জনপ্রিয়। সৃজনশীল সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন দু দশক; কবিতা দুটি ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত “প্রেম বিষয়ক” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।]

গ্রেস নিকোলস: (ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ইংল্যান্ড, ১৯৫০- )

অভিযাত্রী 

পুরুষ নারীকে দিলো ইয়োরোপ -- পুরো 
মহাদেশটির রূপরেখা।

নারীর জবাব -- উপচানো তোতারঙ্গের মেঘ।
পুরুষ আনলো সিধে সোনালী চুল আর 
শাদা চামড়ার পাগলামি।

নারী দিলো কালো পশম। তার 
যুগ্ম নিষিদ্ধ ফলের অন্ধকার।

পুরুষ বয়ে আনে ইউরেনিয়াম, প্ল্যাটিনাম, এলুমিনিয়াম 
আর কনকর্ড।

নারী এগিয়ে দেয় তার ধূসর নিতম্ব।

পুরুষ বলে, দারুচিনির গন্ধ তোমার ত্বকে।

নারী গায় ঘুমপাড়ানি গান আর 
পিঠ চুলকে দেয় তার।

পুরুষটি কলম্বাসের মতন --
অসংবৃত নৌকো ভেড়ালো তার
ঘুমঘুম জটপাকানো বাগিচায়।

নারী তার কাছে সমর্পণ করলো 
পুরো ইন্ডিজ আবার -- তবে এবার 
আস্তে আস্তে প্রসারিত ঊরুদ্বয় জড়ো করলো 
সম্রাটের মাথার দুপাশে।

[কবির জন্ম গিয়ানায়; ১৯৭৭ সাল থেকে বাস করেন ইংল্যান্ডে; ১৯৮৩ সালে কমন ওয়েলথ কবিতা পুরস্কার পেয়েছিলেন; বারোটি কাব্যগ্রন্থ; কবিতাটি ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত “অলস নারীর অলস ভাবনা” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।] 

মে ২০২০ [ক্রমশ:]

2 comments:

  1. অসাধারণ ! মন ভরে গেল কবিতাগুলি পড়ে ।
    অনুবাদককে ধন্যবাদ..
    সিদ্ধার্থ সাঁতরা ।

    ReplyDelete
  2. অসামান্য কিছু কবিতা পড়লাম।

    ReplyDelete