0

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in





(এক)
শীতের সকাল এ গ্রামে সবেমাত্র আড়মোড় ভাঙছে। এখনো কারো কারো হাতে ঘুঁটের ছাই, কারো কারো হাতে খেঁজুর বা নিম ডাল। কলতলায় বসে কেউ কেউ অবিচলিত ভাবে দাঁত ঘোষেই চলেছে।অঢেল সময় হেন তাদের হাতে। গায়ের চাদর এখনো জড়িয়ে রয়েছে অনেকেই।রোদের তেজ নেই বটে। কিন্তু বেলা প্রায় ন'টা বাজে বাজে। কারো কোনো ব্যস্ততাও নেই। কলসি কাঁখে নিয়ে পাড়ার ঝি-বউরা কলের দিকে আসছে।
……তাড়াতাড়ি চল। জল রেখেই দেখতে যাবো। নিয়ে চলে গেলে আর কি দেখতে পাব?
……দাঁড়া।তোর জন্য হোঁচট খাব নাকি? তারপর পড়ে গিয়ে কলসিটাও ভাঙুক? আর তোরা হ্যঁ হ‍্যঁ করে হাস।
……দেখ না। কত লোক ঐ স্কুল মাঠের দিকেই যাচ্ছে। দেরি করলে হবে না। চ তাড়াতাড়ি।
……শীলাদির কপালটা খারাপ জানিস। নইলে এত বছর পর ওরা খোঁজ পেল কি করে?
……ও মনে হয় আবার পাগলি হয়েও যাবে রে?

পাড়ার মেয়েদের এই এসব কথা কলতলায় বসা লোকগুলোর কানে আসছিল বটে। তারা তা শুনেও খুব একটা বিচলিত হয়নি। কিন্তু যতন খুড়ো একটু দূরে আমতলায় একা বসে তামাক দিয়ে বেশ করে দাঁত মাজছিল। শুনেই বলে ফেলল
……বলি, এই মেয়েরা শীলার কি হয়েছে রে? আবার পাগলী হয়ে যাবে না, গেছে? কি যেন বললি ?
……না,খুড়ো। পাগলি হয়নি এখনো। তবে মনে হয় আগের মতো হয়ে যাবে?
……কেন রে? কি হলো আবার?
……ঐ মানিকদাকে কারা যেন নিতে এসেছে। নাকি ওরা ওর বাবা-মা!
সবাই নিমেষে চমকে ওঠে।কি শুনছে তারা? মানিককে নিতে এসেছে? দাঁতন করা ছেড়ে সবাই দল বেঁধে এগোতে লাগল সরকারি স্কুলমাঠের দিকে।

মাঠের মধ্যে লোকজন বেশ জড়ো হয়েছে। একটা বড় গাড়িও রয়েছে সেখানে। মাঠের পাশেই শীলার বাড়ি। ছোটো থেকে তার মাথায় নাকি একটু ছিট আছে। সেই থেকেই সে সবার কাছে শীলা পাগলি বলে পরিচিত। সেই ডাকে সে মনে কিছু করে না। তবে তার বাবা কি মনে করে তাকে বেশি দূরে বিয়ে না দিয়ে গ্রামের মধ্যে এ পাড়ায় বিয়ে দেয়।

এখন তার বাড়ির উঠোনেও কয়েকজন অচেনা মানুষ। তিন জন মেয়ে সঙ্গে আরও দুজন পুরুষও আছে।
মানিকের হাত তাদের একজনের হাতে। বেশ শক্ত করে ধরা।
মানিক ছটফট করছে সেই নাগপাশ থেকে নিজেকে ছাড়াতে।
……ছাড়ো বলছি। হাতে লাগছে।ছাড়ো।
তার সঙ্গে শীলা পাগলিও তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। আর মানিকের হাত ধরে টানছে।
……ছাড় বলছি। ছাড়। আমার ছেলেকে নিয়ে টানাটানি? ছাড়।
মাঝবয়সী এক মহিলা খাঁ খাঁ করে উঠল।
……ছাড়বে কেন? আমার ছেলেকে আমি নিয়েই যাবো ।
……তোর ছেলে? আমি ওকে ছোটো থেকে মানুষ করেছি। ও আমার ছেলে। তুই কে লো?
……ছোটো থেকে মানুষ করেছি! বলি, ওকে পেলি কোথায়?ও তোর নিজের পেটের ছেলে কিনা বল না? যদি নিজের পেটে ধরতিস, তাহলে বলতে পারতিস যে ও তোর ছেলে। বল সবাইকে বল, ও তোর ছেলে?
চারদিকে এত লোক। এত মানুষের কৌতূহল যেন আর তর সইছে না। সবার সন্দিহান চোখ হোঁচট খাচ্ছে।এরা বা কারা? এল কোথা থেকে? আর মানিককে নিয়েই বা এত টানাটানি কেন?

না জল্পনা, না কল্পনা কোনো কিছুই এ ঘটনার সঙ্গে খাপ খাইয়ে উঠতে পারছে না। নানান কথা নানান জনের মধ্যে উঁকি মারছে। কোথাও কোথাও দলে দলে প্রশ্নোত্তরে জট পাকিয়ে ঘুরে ফিরে আসছে।
……মনে হয় মানিক ওদের ছেলে। তা না হলে ওরা এমন করে জোর করবে কেন?
……তুই থাম দিকি। ওরা ওর বাবা হোক আর মা হোক, এতদিন ছিল কোথায় শুনি?
……শোনা শুনির কি আছে? এতদিন পরে হয়তো জানতে পেরেছে।তাই নিতে এসেছে। তাতে দোষের কি? এমন করছিস পৃথিবীতে কেউ যেন তার হারানো ছেলেকে কোনোদিন খুঁজে পায়নি !
……মানিক যে ওদের ছেলে তা ওরা জানল কি করে?

সত্যিই তো ওরা জানবে কি করে? এতদিন বা কোথায় ছিল ওরা? যাকে তাকে ছেলে বললে তো আর সে ওদের ছেলে হয়ে যাবে না।
এ প্রশ্ন যেমন মেয়েদের তেমনি পাড়ার পুরুষদেরও। তাদের মধ্যেও নানান প্রশ্ন উঁকি মারছে। যতন খুড়ো এগিয়ে গেল তাদের কাছে।
……তা বলি, তোমরা কারা বাপু? কোথা থেকে এলে?
গ্রামের অন্য পুরুষদের আর যেন আটকানো গেল না। মুখ খুলল যে যার মতো। যতন খুড়োর কথার সঙ্গে সঙ্গে তারাও শুরু করে দিল।
……শালা মামদোবাজি পেয়েছে আরকি? ছেলে ওনাদের? বললেই হলো?
……কে খবর দিল যে এই মানিক ঐ মানিকদের রত্ন?
……বুঝলি না, উড়ে এসে জুড়ে বসা যাকে বলে। পেয়ে পড়ি ধন ষোলো আনা।
……এই ছাড় বলছি মানিকের হাত। নইলে.....
পাড়ার নগেন মাতব্বরকে দেখেই কেমন যেন থেমে গেল তারা।
নগেন মাতব্বর তখনই এসে পড়েছিল বলে তাদের কথা থামল।নইলে বেড়েই চলত নিশ্চিত। শীলার পাশের বাড়ির একজন মাতব্বরকে ডেকে আনতে গিয়েছিল। পথে যেটুকু সে সময় পেয়েছে এ বিষয়ে শোনাতে শোনাতে এসেছে।
……থাম তোরা সব। কি ব্যাপার আপনাদের? মানিক আপনাদের ছেলে তার প্রমাণ কী?
এখানে প্রমাণ দেওয়া তো সহজ ব্যাপার নয়। আর সে কবেকার কথা কে মনে রেখেছে? মানিক এখন এ গ্রামের জল-বাতাসে-মাঠে-ঘাটে, ছেলে-বুড়োয় মিশে গেছে। আর সে কিনা অন্যের ছেলে? বললেই হল? কে মানবে তা? সারা গ্রাম তা মেনে নেবে?
না,মেনে নিতে কেউ পারছে না। তবে সংশয় কিন্তু অনেককেই কাবু করে ফেলছে।
……দেখ,ঐ শীলা কিন্তু পাগলি গোছের। কার বাছা তুলে নিয়ে এসেছে? তা আমরা তো আর সম্পূর্ণ জানি নে।
……জানার কথা বা আসে কি করে? ও তো কলকাতায় কোথায় থাকে। সপ্তায় বা মাসে একবার বড়জোর দুবার আসে। কলকাতায় শুনি যেখানে সেখানে ছেলে ফেলে রেখে লোক পালায়। এরা সেই রকম করেছিল কিনা কে জানে?
……তাছাড়া ও নিজেই তো বলেছে যে ও মানিককে ফুটপাত থেকে পেয়েছে। মানিক তো আর ওর নাড়ি ছেঁড়া নয়।
……তা ঠিক। কথায় বলে না......
'পরের সোনা না দিবে কানে 
কেড়ে নেবে সে হ্যাঁচকা টানে.'
নে,এবার ছেলে কেড়ে নিয়ে যাবে। বোঝ এবার।
……তবে যাই বল, খুব খারাপ লাগছে শীলাকে দেখে। কেমন মুচড়ে পড়েছে দেখ।
যতন খুড়ো এগিয়ে গেল নগেন মাতব্বরের কাছে।
……এ কি বিপদ বলো দিকি ভাই। কার ছেলে কে বিচার করবে?
মাথা চুলকাত লাগল মাতব্বর। কি ভেবে বলে উঠল
……উপায় তো কিছু কিছু বাতলাতে হবে।
প্রমাণ তো কিছু দিতেই হবে। নইলে পুলিশ ডাকবো আমরা। এমনি এমনি তো আর ছেড়ে দিতে পারি না।
যারা মানিককে নিতে এসেছে তারা আর এমনি আসেনি। কোমর বেঁধেই এসেছে। ব্যাগের থেকে কয়েকটা ফটো বের করে নিয়ে একজন মাতব্বরের দিকে এগিয়ে দিল।
……দেখে নিন। এসব ওর ছোটো বেলার ছবি। মিলছে কি দেখুন।
……আর আমরা দরকার হলে পুলিশকে আমরা ডেকে নেব।আপনিই ডাকবেন কেন? আমরা নিজেরাই যাবো সেখানে।
একজন সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে একটা কাগজ বের করে দিল।
……এই তার মিসিং ডাইরির কপি। নিন দেখুন।

সবাই সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেখতে চাইল সেই ছবি ও কাগজ।বেশ কয়েকটা পুরানো ছবি। সঙ্গের লোকগুলোর দু'একজনের সঙ্গে তোলা। মুখের মিলও আছে তাদের একজনের সঙ্গে। তবে কি মানিক ওদের ছেলে? অস্বীকার করতে চাইলে গায়ের জোরেই করতে হয়।
তবুও নগেন মাতব্বর গলা খাঁকড়ে বলেই ফেলল
……তোরা দেখ দেখি এর সঙ্গে মানিকের
মিল পাস কিনা? মানে....ঐ....যেটা...
আরকি.......ছোটোবেলায় সব বাচ্চাদের মুখ প্রায় একই রকম দেখতে হয়...কি বলো যতনদা? এতে আর কি প্রমা.......
হটাৎ সেই অপরিচিত মহিলাদের একজন কেমন লুটিয়ে পড়ল।
নগেন মাতব্বর ফটোতে দেখা মহিলার মুখের সঙ্গে ঐ মহিলাকে মিলিয়ে দেখছে।
......ফটোতে ঐ মহিলার কোলেই তো মানিক বসে আছে না? হয়তো ঐ মহিলাই ওর মা হতে পারে! মুখের মিলও তাই যেন বলতে চাইছে।এ কি বিপদ বল দিকি?
……শর্মিতা, চোখ খোলো। তাকাও শর্মিতা। এতদিন পরে আমরা আমাদের ছেলের খোঁজ পেয়েছি। আমরা ঠিক নিয়ে যাবোই।
কেউ আমাদের আটকাতে পারবে না। কেউ একটু জল এনে দিন না।শর্মিতা ওঠো, তাকাও।
……ওরে কেউ একটা জল নিয়ে আয়। ওনাকে ধরে বারান্দায় নিয়ে আসুন।পাশের বাড়ির একজনের বারান্দায়
মহিলাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গেল।

সেই ফাঁকে যত লোক জড়ো হয়েছে।তত কথা বাতাসে ভেসেছে।সে সব কথা কি তা কমবেশি অনেকের জানা থাকার কথা।

কিন্তু শীলা কোথায়?

সে সবার নজর এড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে গেল ঘরের দিকে।সেদিকে কারোর নজর সেভাবে পড়ল না। খটাস করে ঘরের মধ্যে শব্দ হলো একটা। ভেতর থেকে খিল পড়ল দরজায়।

(দুই)

একাকীত্বকে মানুষ সুখের চেয়ে দুঃখের সময় বেশি করে আঁকড়ে ধরে।খুঁজে খুঁজে দেখে নিতে চায় তার ফেলে আসা হিসেব নিকেশ।একাকীত্বের এই বদ্ধ ঘরে শীলা নিজেকে খুঁজে খুঁজে দেখছে সেই দিনগুলোতে। চলুন না আমরা শীলার সঙ্গে এক হয়ে খুঁজে দেখি সেই দিনগুলো।

……....সেদিন চৈত্রের চড়া রোদ। খাঁ খাঁ করছে মাঠ। বাতাস যেন আগুন মেখে রয়েছে সারা গায়ে। দুপুরটা আরো রেগে গায়ে জ্বালা ধরাচ্ছে।শীলা মেঠো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলেছে। সামনে তার স্বামী মধু। মধু সুঠাম পুরুষ। কিন্তু বেরোজগেরে। কলকাতায় এক হোটেলে কাজ করে। সে ন'মাসে ছ'মাস। কাজ করে ঠিকই কিন্তু একবার কলকাতা থেকে গ্রামে ফিরলে আর সে সেমুখ হতে চায় না।হাতের টাকা উড়িয়ে উড়িয়ে যতক্ষণ না পেটে টান পড়ছে ততক্ষণই তো না। যেমন বিড়ি সিগারেট টানে তেমনি টানে মালও। ছ'মাস হল তাদের বিয়ে হয়েছে। এখন হাতে টান পড়েছে। টান পড়েছে পেটেও। তাই বাধ্য হয়ে সে আবার এই দুপুরে কলকাতামুখী হয়েছে।

মায়ের কাছে শীলাকে রেখে যেতে পারত।কিন্ত মন চাইলো না।অগত্যা সঙ্গে নিল তাকে। শীলা এই গ্রাম ছেড়ে, এমনকি তার শাশুড়ীকে ছেড়ে যেতে চাইছিল না। তবুও সে পা ফেলল মধুর ইচ্ছের সঙ্গে অনিচ্ছায়, যে কোনো দিন গ্রামের বাইরের পা রাখেনি।
তাই গ্রাম ছেড়ে যেতে তার মনটা হু হু করে কাঁদছে। তার বাবার কথা মধুও শোনেনি। পাড়ার কয়েকজন তাকে যেতে দেখে কেঁদেছেও।সেও কেঁদেছে তাদের সঙ্গে। কিন্তু মধু তাকে ছাড়েনি। এক কাপড়ে হাত ধরে টানতে টানতে গ্রামের সীমানা পার করে এনেছে সে। এখন হাত ছেড়ে দিয়েছে। রাস্তার গাছের ছায়ায় ছায়ায় হেঁটে চলেছে সে।গ্রামকে ছেড়ে, বাবাকে ছেড়ে যাওয়ার শোকে তার পা যেন মাটি ছেড়ে উঠতেই চাইছে না। চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে ওকে নাগাড়ে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে বারবার। তবুও আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সে পা টেনে টেনে চলেছে।

মধু সারা রাস্তায় কোনো কথা বলেনি। ভরতপুর স্টেশনে এসে এক বোতল সোডা জল কিনে ধরিয়ে দিল তার হাতে। খানিকটা খেয়ে চুপ করে বসে রইল সে। মধু টিকিট কেটে এসে দেখে জলটুকু সবটা খায়নি। চোখ লাল হয়ে গেছে তার। মধু নিজে সেই বোতলের বাকিজলটুকু একঢোকে গিলে নিয়ে দোকানে বোতলটা দিয়ে একটা পান নিয়ে এসে দিল শীলাকে।
……নে এটা খা। মন খারাপ করছে তো?আমিও যেদিন গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় যাই, আমারও খুব মন খারাপ করেছিল। তবে তোর মতো এত ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদিনি।

শীলা এত মন খারাপের মধ্যেও শেষের কথাটা শুনে একটা কিল কষিয়ে দিল মধুর পিঠে। মধুও তার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে উঠল।

ট্রেন হুইসেল বাজাতে বাজাতে স্টেশনে ঢুকল।

দুপুরের ট্রেন বেশ ফাঁকা ফাঁকা। শীলা মধুর পাশে বসে নানান কথা ভাবতে লাগল। গ্রামের ছবি এখন তার কাছে আর ধরা দিচ্ছে না। যে জায়গায় যাচ্ছে তা কেমন? সে সেখানে কি করবে?কোথায় থাকবে ?রান্না করবে কোথায়? নানান নানান কৌতূহলের বাতাবরণ তার মাথায় কিলবিল করছে এখন। ভাবতে ভাবতে কখন সে মধুর কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে টের পায়নি।
……কিরে ওঠ।এবার নামতে হবে। ট্রেন আর যাবে না। চল রে নামবো।
শীলা চমকে ওঠে। তাইতো ট্রেন থেকে সবাই নেমে যাচ্ছে। ধাক্কাধাক্কি করে তারাও নামল।

আলোয় ঝলমল করছে স্টেশন। লোকজন বেশ। কেউ দৌড়চ্ছে, কেউ হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ ব্যাগপত্তর নিয়ে থ হয়ে বসে।কেউ কেউ জটলা পাকিয়ে। মাঝে মাঝে দু'একটা ফেরিওয়ালার ডাক জনতার মাঝখান থেকে জোরে জোরে ভেসে আসছে।
……হ্যাগো, এটা কোথায় এলুম গো। কত লোক সব যাবে কোথায়?আমরা কোথায় যাচ্ছি?
……এটা শিয়ালদা। যে যার বাড়ি ফিরবে তাই বসে আছে তাদের ট্রেনের জন্য।
আমরা যেখানে যাচ্ছি তোকে বললে চিনবি না। আমার সঙ্গে আয়।

শীলা কোনো দিন কলকাতা দেখেনি। এমনকি তার এত অলিগলি, বা বড়বড় বাড়ি, লোকজন, এত মোটর গাড়ি এসবের কিছুই দেখেনি।

অবাক হয়ে গেছে সে। মধু তার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে। সে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে মধুর হাতের টানে পা ফেলে চলেছে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে কিছুই ঠাওর করতে পারছে না।রাস্তার এত লোকজন, গাড়ি, কলাহল, চোখ ধাঁধানো ঝলমলে আলোতে সে খেই হারিয়ে ফেলেছে।

সে যেখানে গিয়ে উঠল তা আর কিছুই না কলকাতার ছোটো ছোটো দর্মার বেড়া দেওয়া ঘুপচি ঘুপচি বাড়ি। সারি সারি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই ঘরগুলো। প্রতিটা ঘরের সামনে বালতি, ঘামলাভরা জল,কাঠের ভাঙ্গাচরা নানান আসবাবপত্র, আর ছোটো ছোটো লোহার খুঁটির মাথায় টিমটিমে আলো।কোনো কোনো ঘর থেকে লোকজনের কথার আওয়াজ, কারো কারো ঘর থেকে পড়ার শব্দ, কারো কারো ঘর থেকে বক্সের থেকে গান পাড়া মাত করে দিচ্ছে।কেউ কেউ হাত পা ছড়িয়ে বসে রয়েছে পথের দিকে মুখ করে।এক মহিলা তাকে দেখেই বলে উঠল
……এ কাকে সঙ্গে করে আনছ মধু? তা এতদিন পর কি ব্যাপার?
……না, মানে এই আরকি? নিয়ে এলাম। পরে কথা হবে মাসি।আসি।
শীলার মন কু গাইতে শুরু করল। মনে মনে সে ভাবছে
……বউদি মনে হয় ঠিকই বলেছিল যে আর হয়তো তাকে আর কেউ খুঁজে পাবে না। কোথায় নিয়ে যাাচ্ছে আমায়?আমাকে বেচে দেবে না তো?

পথটা এখানেই শেষ। একটি ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো তারা।কোমর থেকে চাবি বের করে মধু ঘরের তালা খুলে ভেতরে ঢুকে আলো জ্বেলে দিল।
……আয় ঘরে আয়। এটাতে আমি থাকি। ঐ যে ফুট দিয়ে এলাম সেখান থেকে একটু দূরেই আমি হোটেলে কাজ করি।
ঐ খাটের উপর বস। ধুলো ভরে গেছে রে।দেখে বসিস।
দাঁড়া আমি চালটাল আছে কিনা দেখে নেই। স্টোভে তেল আছে কিনা জানি না।
হেঁট হয়ে বসে মধু চালের ড্রামটা একটু নাড়িয়ে দেখল।
……চাল আছে। কিন্তু সবজি কিছুই নেই।দেখি স্টোভটা।
সেটা নাড়াতে নাড়াতে বলল
……আজ রাতের মতো হয়ে যাবে। কিন্তু বাজারে যেতে হবে। আমি যাই কিছু কিনে আনি। রাতে ডিম ভাত হোক।কি বলিস? 

মধু এতক্ষণ তার দিকে তাকায়ওনি। শীলা আগের মতোই ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরটার সবদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কিসের যেন জরিপ করছে সে। মধু তার দিকে মুখ ফিরিয়ে আবার জিগ্যেস করল
……কি দেখছিস? খারাপ লাগছে না? জানি তো কষ্ট হবে! কি করব বল? তোকে রেখে এলে কি খাবি সেখানে? তোকে তো সবাই পাগলি পাগলি বলে খ্যাপাবে। তার চেয়ে তুই আমার কাছে আমার পাগলি হয়ে থাকবি। কিরে পারবি না?
মধু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। আবার বলে
……এটুকু কষ্ট তুই করতে পারবি না?
শীলা কিসের ঘোরে যেন আটকে ছিল। মধুর কোনো কথা তার কানে গেছে কিনা জানা নেই। তবে সে শেষের কথায় কি বুঝে মাথা নেড়ে যেন সম্মতি জানালো।
……বেশ তাহলেই তো মিটে গেল। এই ঘরের সামনে কল আছে।এটাতে সব সময় জল পড়ে। তুই এটা থেকে জল ভরে চালটা চড়া।আমি এখনই আসছি।

শীলা হাঁড়িতে চাল চড়িয়ে বসে রইল দরজার দিকে মুখ করে।
মাথাটা তার ব্যথা ব্যথা করছে। সত্যিই কি ঠিক জায়গায় এসেছে সে?নাকি......ভাবতে গেলেই তার মাথার ভেতর কেমন যেন কিলবিল করে উঠছে।
পাশের বাড়ির এক মহিলা এসে উঁকি দিয়ে গেছে।
……ও আবার তোমাকে এনেছে বুঝি?
বলেই চলে গেল।
শীলার বুকটা ধড়াস করে উঠল। মনে মনে ভয় দানা বেঁধে উঠল তার। বুড়ির কথাটা তাকে আরো ভাবিয়ে তুলল 'আবার তোমাকে এনেছে বুঝি?'
……আগেও কাউকে এনেছিল নাকি? ও আর ফিরবে তো? সত্যিই যদি না ফেরে সে কোনো দিন ঐ রাস্তা চিনে গ্রামে ফিরতে পারবে না।
চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে তার কোলের কাপড়ে।

অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। মধু আর ফেরে না।
ভাত গড়িয়ে দরজা ভেজিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল সে।
ঘুম আসছে না তার। চোখের জল বন্ধ হচ্ছে না। খিদের জ্বালা কখন যেন শান্ত হয়ে গেছে।

হটাৎ হুট করে দরজা খোলার আওয়াজ হল। বুকটা কেঁপে উঠল তার।
……কে কে?
……আরে আমি রে আমি। আলো বন্ধ করে দিয়েছিস কেন?
মধু আলো জ্বালিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে খিল খিল করে হেসে উঠে।
……ভয় পেয়েছিস না? এখনো কাঁদছিস? ভেবেছিস আমি কোথায় চলে গেলাম তোকে এখানে ফেলে রেখে? আর যদি না ফিরি? তাই তো? 
……আমার ভয় করে না বুঝি?
……নে ওঠ। এখানে বাজার আছে।ডিম এনেছি। আর এটার মধ্যে তোর জন্য শাড়ি নিয়ে এলাম। কাল পড়বি কি?
……টাকা পেলে কোথায়?
……হোটেলে গেলাম। আমার আগের পাওনা টাকা নিয়ে তবেই বাজার করলাম।
নে ওসব পরে শুনবি। রান্না কর।

সে রাতে তারা ঘুমিয়ে পড়েছিল ঠিকই কিন্তু শীলার ভেতরকার ভয় কুঁরে কুঁরে খাচ্ছিল তাকে।

(তিন)

না, ভয়ের মেঘ একটু একটু করে সরে গিয়েছিল। শীলার এই মাস দেড়েকের বস্তি জীবন সেজে উঠছিল নতুন করে। এই মহল্লা যাকে এদের ভাষায় বস্তি বলে তা তার জীবনে নিজের পাড়া হয়ে উঠেছিল।
ক্রমে এখানকার লোকজনের সঙ্গে পাতানো সম্পর্ক সদ্য সদ্য জন্ম নিচ্ছিল নিজস্ব মহিমায়। গ্রামের স্বজন ছেড়ে আসা,বা ঐ ঘরবাড়ি ফেলে আসার ব্যথায় এই জীবন একটু একটু করে সহানুভূতির মলম লাগিয়েও দিচ্ছিল। কিন্তু কাল বাঁধল ঠিক তার পরই।

একদিন মধু সঙ্গে করে একটা মেয়ে নিয়ে এল সেই ঘরে। বেশ মনে ধরা সেই মেয়ে। মাথায় সিঁদুর লেপা, কপালে বড় লাল টিপ। না ডানা কাটা পরী নয়, তবে অন্যের ডানায় বসে বেশ দোল দিতেও পারে।
……এ পম্পা। আজ থেকে এ এখানে থাকবে। তুই নিচে শুবি।
মধুর মুখ থেকে ভুর ভুর করে মদের গন্ধ বেরিয়ে আসছে।
……কিরে, কি দেখছিস? বুঝতে পারলি না? ও আজ থেকে এখানে থাকবে।
মেয়েটাকে দেখে এমনিতেই তার মাথা জ্বলছিল। সঙ্গে মধুর এই কথা তাতে যেন ঘি ঢেলে দিল। মাথাটা তার চিড় চিড় করে উঠল।মনে হল মাথায় কেউ যেন আগুন জ্বালিয়ে দিল। রাগে হাতের কাছেই ছিল খুন্তি সেটা দিয়ে পেটাতে লাগল মধুকে।
ঘরময় সেই কেলেঙ্কারির চোটে ভাতের হাঁড়ি গেল ছিটকে। ভাত গেল ছড়িয়ে। মধুর মাথাটা গেল বিগড়ে।তবুও
মধু আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হতে হতে তাকে সামলাতে লাগল।
……আরে পাগলি থাম। থাম....
কিন্তু শীলাকে আটকানো গেল না।
……কচি মেয়ে দেখে আর লোভ সামলাতে পারোনি না। একেবারে বিয়ে করে নিয়ে এসেছো। আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন।
মধুকে বেকায়দায় দেখে পম্পা গেল থতমত খেয়ে। সেও থাকাতে চাইল। কিন্তু এবার শীলা মধুকে ছেড়ে মারতে শুরু করল তাকে। মধু বেগতিক দেখে এবার শীলার চুলের মুঠি ধরে দিল হ্যাঁচকা টান।হ্যাঁচকা টানে তার মাথাটা গিয়ে লাগল খাটের কোনায়। নিমেষে তার মুখ থেকে গোঁঙানি বের হতে লাগল। মাথা ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে তার চোখ বেয়ে।তান্ডব গেল থেমে। লোকজন জড়ো হয়ে গেল।

না, শীলা মরেনি। তবে মধু সেদিন অনেক ডেকে অনুরোধ করেও তাকে সেই দুপুর থেকে খাওয়াতেও পারেনি। চুপ করে সে পড়ে রয়েছে ঘরের এক কোণে। পাশের বাড়ির অনেকের ডাকেও একবার মুখ ফিরেও তাকায়নি। দাঁতে কুটটিও কাটেনি।

কত রাত এখন কে জানে? শীলা তা বুঝে উঠতে পারেনি। তবে মাথাটা তার ব্যথায় যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। খাটের কোনায় লেগে রক্ত খানিকটা বেরিয়ে ছিল। তারপর তার হুঁশ ছিল না। মাথায় ফেটি বাঁধা। কে তার মাথায় এই ফেটি বাঁধল সে জানে না। পেটে যেন তার খিদে নেই। গা গুলিয়ে উঠছে। তবুও বেড়া ধরে উঠে দাঁড়াল।  ঘরের আবছা আলোয় সে দেখলমধু ও পম্পা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। দেখেই তার গা ঘিন ঘিন করে উঠল। তার মনে হল কেরোসিন ঢেলে এই রাতে দুজনকে যেন জ্বালিয়ে দেয়। আগুনে পুড়ে মরুক তারা। কিন্তু মাথাটা আবার ছোটো বেলার মতো হু হু করে উঠল। ব্রহ্মতালু যেন জ্বলে যাচ্ছে। মাথার মধ্যে কি যেন কিলবিল করছে।

দরজা খুলে সে পা ফেলল রাস্তায়। মিটমিট করে জ্বলছে রাস্তার আলোগুলো। এখানে আসা শুদ্ধু শীলা কোনোদিন বাইরে পা রাখেনি।আজ এই রাতে সে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ছে। সারা পাড়াটা চুপ করে আছে। যেন সারা পাড়াটাও অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে। দু-একটা বাড়ির থেকে ফ্যানের কোঁকানির আওয়াজ আসছে। কিন্তু কোন দিকে যাবে সে? আর যাবেই বা কোথায়?

মাথাটা তার বোঁ বোঁ করছে। চওড়া রাস্তায় এসে পড়ল। শুনশান রাস্তা দুদিকে কোথায় চলে গেছে সে জানে না। রাস্তার একটা কুকুর থেকে থেকে ঘেউ ঘেউ করছে। হলুদ আলোয় গাছের পাতা গুলো কেমন বুড়িয়ে গেছে। টানা রিক্সার টং টং আওয়াজ কোনদিক থেকে ভেসে আসছে ঠাওর করা যাচ্ছে না। দোকানপাট বন্ধ। ফুটের উপর কোথাও কোথাও কেউ খালি গায়ে, কেউ কেউ মশারি খাটিয়ে শুয়ে রয়েছে। একটা ছোটো গাড়ি হুশ করে বেরিয়ে গেল।

মনে হল ভোরের আলো ফুটে উঠবে। কিন্তু শীলা এই অবসন্ন শরীর নিয়ে যাবে কোথায়? তার পা যেন মাটিতে পড়ে আটকে যাচ্ছে।কতদূর সে এল তা সে খেয়াল করতে পারছে না। একটা চার মাথার মোড়ও টলতে টলতে পার হচ্ছে। একটা লরি তাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। নইলে সে গাড়ির ধাক্কায় এতক্ষণে পিষে যেত। আরো কিছুটা গিয়ে ধপাস করে পড়ল কিসের উপর।

ভোরের আলো কমে এসেছে।এখানকার ফুটপাতের কয়েকটা বিছানা থেকে দু একজন বেরিয়ে আসছে। দূরের একটা চায়ের দোকান আঁচে আগুন ধরিয়েছে। ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে উপরের দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে। এক বয়স্ক মহিলা হাতে একটা লোহার আংটা নিয়ে সবেমাত্র জঞ্জালের স্তুপে নামতে যাবে শীলাকে দেখে থতমত খেয়ে গেল।বুকটা দুরদুর করে উঠল।
……এই মেয়ে ওঠ বলছি।ওঠ। একি সাড়া দিচ্ছিস না যে? ওঠ। মরার আর জায়গা পেলি না। ভাগ এখান থেকে।
লোহার আংটাটা দিয়ে একটু নাড়িয়ে দিয়ে আবার বলল
……ওঠ রে।ওঠ। এই জঞ্জালের উপর পড়ে থাকলে হবে? এই পাপ্পু.......পাপ্পু, দেখ তো, ও আছে না গেছে?
বছর তেরোর ছেলেটা ভয়ে ভয়ে তার কাছে গেল।
……কি মাসি?
মুখ বিকৃত করে সেই মহিলা বলল
……কি মাসি! দেখতে পাচ্ছিস না। এটাকে দেখ না। আছে, না গেছে?
এ এলাকার জঞ্জাল ফেলার জায়গা এটা। সারা দিনের রাশি রাশি জঞ্জাল এখানে জড়ো হয়। সকালে আবার গাড়ি করে কোথায় নিয়ে যায় কে জানে?তারা এসব ঘেঁটে ঘেঁটে যেমন বোতল, গাড়ু, টাকা, পয়সা, বাসন-কোশন পায়, তেমনি এই জঞ্জালের সঙ্গে আবার মাঝে মাঝে কত ছোটো ছোটো বাচ্চার লাশও ঢুকে থাকতে দেখে।ভাগাড়ের মতো এখানে কাউকে কাউকে মেরে ফেলে দিয়ে যেতে দেখেছে তারা।এসব তাদের যেন মুখস্থ। তাই পাপ্পু ভয়ে ভয়ে শীলার গায়ে হাত দিল। গায়ে হাত দিয়ে দেখে চমকে গেল সে।
……মাসি,গা তো গরম। এখনও বেঁচে আছে।
……আরে ও সবিতা এদিকে আয় না। ময়লা পরে ঘেঁটে দেখবি। ধর ধর ওকে টেনে নিয়ে যাই আমার ওখানে।

সবিতা, পাপ্পু আর সেই বুড়ি শীলাকে টানাটানি করে নিয়ে গেল তাদের ফুটপাতের বিছানায়। পোটলা করে বাঁধা ছিল তা। কোনো রকমে তাকে নিয়ে গিয়ে হেলান দিয়ে শুইয়ে দিল সেই পোটলা করা বিছানায়।
তার চোখে-মুখে জল ছিটিয়ে দিল। একবার তাকিয়ে শীলা আবার চোখ বন্ধ করে নিল। বুড়ি তার মাথায় জল পট্টি দিতে দিতে বলল
……যা, এবার তোরা যা। ঐ ওষুধ দোকান খুললে ওকে ওষুধ এনে খাইয়ে দেব।
……কিন্তু মাসি ও কে না জেনে এসব করা কি ঠিক হবে? যদি আমরা আবার কোনো কেস খাই? তখন কি হবে?
……সে আমি দেখে নেব। যা এখন।
সবিতা গজগজ করতে করতে পাপ্পুকে ডেকে নিয়ে যেতে যেতে বলল
……ও বুড়ি ওকে নিয়ে মরুক গে। তুই একটা বস্তা নিয়ে চ অনেক প্লাস্টিক জড়ো করেছি, ভরে নিবি। পাপ্পুও তার মা'র পিছু নিল বস্তা হাতে।

শহরের রাশিকৃত জঞ্জালের স্তুপ ঘেঁটে ঘেঁটে তারা উপার্জনের রসদ খুঁজতে লাগল ।

(চার)

মানুষই পথ তৈরি করে।আর পথ থাকে পথেরই মতো। আবার সেই পথে মানুষ পথ হারায়। আবার কেউ পথ খুঁজে পায়। আসলে মানুষ তো পথ হারায় না, সে শুধু ভিন্ন পথে গিয়ে পড়ে। আর ঐ... পথ থাকে পথেরই মতো। তবে শীলা ভিন্ন পথে এসেও বেঁচে গিয়েছিল।তার জীবিকাও খুঁজে পেয়েছিল ঐ জঞ্জালের স্তুপে। গামবুট পরে হাতে লোহার আংটা নিয়ে সেও উপার্জনের রসদ খোঁজে সবিতাদের মতো। কিন্তু মধুকে সে আর খোঁজে না। মধু তার জীবনের সব মধু হরণ করে তাকে যেন রাস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এখানকার সবার সঙ্গে তার বেশ ভাব জমে গেছে। ঐ বুড়িই তার মায়ের আসন নিয়েছে। আর সবিতা তার বোনের মতো।

সবই চলছিল ঠিকঠাক। কিন্তু দুর্গাপুজোর কদিনে ঘটে গেল তার জীবনের ভিন্ন জীবন লিপি। নবমীর রাত। আলোর রোশনাই শহরকে ডুবিয়ে রেখেছে। চারদিকে নানান পোশাকের ঝলকানি। বাতাসে পুজোর সানাই আর খাবারের গন্ধ। কিন্তু এসবের আড়ালে মাথায় কখন কালো মেঘ জমে উঠেছিল তা সবাই খেয়াল করেনি। হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি নামল। গভীর রাত। লোকজন ছিটকে গেল যে যার মতো। ধাক্কাধাক্কিতে কে কার হাত ছেড়ে কোথায় গিয়ে পড়ল তা যার গেল সে ছাড়া অন্য কেউ অনুধাবন করতে পারল না।

শীলারাও পোটলা নিয়ে গিয়ে উঠল সেই ওষুধ দোকানের সামনে শেড দেওয়া চওড়া ফুটপাতে।ঘন্টা দুয়েক পরেই বৃষ্টি থামল।সানাইও আর বাজল না। লোকজন যে যার বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। রাস্তার জল ঠেলে ঠেলে যে যার মতো দিল পাড়ি।

……ও শীলা, ওঠ মা। জল নেমে গেছে। ভোরের আলো ফুটছে। চল আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে যাই। নইলে ঐ ওষুধবাবু দোকানের সামনে এসব দেখলে আবার রাগারাগি করবে। ওঠ। বুড়ি এতক্ষণ খেয়াল করেনি। শীলার কোলের কাছে একটা বাচ্চা শুয়ে আছে। চমকে উঠে বুড়ি।
……ওলো তোর কোলের কাছে এটা কে শুয়ে আছে?এই কে,কে রে এটা? ওঠ বলছি। ওঠ।

শীলা ধড়ফড় করে ওঠে পড়ে। সত্যিই তো, তার কোলের কাছে একটা বছর চারের বাচ্চা তাকে ধরে শুয়ে ছিল। শীলা তাকে টেনে তুলতেই দু'হাতে চোখ ঘোষতে ঘোষতে আঁ আঁ আঁ করে কেঁদে ওঠে।
……আমি মায়ের কাছে যাবো। আমি মায়ের কাছে যাবো......
সবিতা তাদের পাশেই শুয়ে ছিল। বুড়ির ডাকাডাকিতে ঘুম গেল ভেঙে। রেগে গিয়ে উঠে পড়ল সে।
……হে ভগবান যত আপদ কি আমাদের এখানেই এসে জোটে? এই ছোঁড়া চুপ, চুপ কর বলছি।
এবার দাঁত মুখ বাঁকিয়ে আবার বলতে লাগল
…… 'মায়ের কাছে যাবো। মায়ের কাছে যাবো'.....যা কোথায় যাবি যা না। যেন আমরা ওর মাকে চিনি। তোর মা'র ঠিকানা আমরা নিয়ে রেখেছি না?
……আ সবি, তুই থামবি? দেখতো সে ভয়ে কেমন কুঁকড়ে আছে। মা মা করছে। তোর একটু দয়া মায়া নেই?
……দেখ শীলাদি, আমি কিন্তু এসব বরদাস্ত করবো না। যত সব ন্যাকামি। তোর এই আদিখ্যেতা দেখলে আমার গা জ্বালা করে বুঝলি! ওকে তাড়িয়ে দে এখান থেকে। যে চুলোয় যায় যাবে।
……কাঁদে না বাবা, কাঁদে না। আমি তোকে তোর মার কাছে দিয়ে আসব। এস তো বাবু তুমি আমার সঙ্গে এসো।
বলেই একহাতে তাকে ধরল আর অন্য হাতে বিছানার বোঁচকা। নিয়ে চলল তাদের সেই ফুটপাতের ঠিকানায়।
বুড়ির মনটা কেমন ভারী হয়ে গেল। কাউকে কিছু বলতে পারল না।না সবিতাকে, না শীলাকে।
তবু শীলার উদ্দেশ্যে একবার বলেই উঠল
……ওর মনে হয় খিদে পেয়েছে শীলা। কিছু খেতে দে। ওর চোখ মুখ কেমন ছোটো হয়ে গেছে দেখছিস না? তোরা যা দেখি আমি কিছু পাই কিনা?

না, তার মা'র ঠিকানা তারা কেউ খুঁজে পায়নি। এমনকি তারা তাকে পুলিশের কাছেও নিয়ে যায়নি। কিছু দিনেই সে তার মা-বাবাকে ভুলে যেতে লাগল। শীলা যখন ঐ নোংরা আবর্জনা ঘাঁটে সে ওর আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। থেকে থেকে সেও বস্তা ধরে। আবার বোতল-প্লাস্টিক ভরে। আর রাতে শীলাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। শীলা তাকে বুকের কাছে জাপ্টে ধরে তার মাথায় হাত বোলায় আর গুন গুন করে গান করে।
……আয় রে সোনা চাঁদের কোনা
ঘুম দিয়ে যা
ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি
ঘুম দিয়ে যা।
গাছের ডাল কেটে নিলে সেই কাটা মুখে আবার কচি কচি পাতা জন্মায়। আবার নতুন নতুন শাখা হয়ে উন্মুক্ত বাতাসে খোলা রোদে দুলতে থাকে। তাতে ফুল হয়,ফল হয়।ডালে ডালে পাতায় পাতায় শিহরণ লাগে। শীলার মাতৃত্বের শাখায় যেন স্নেহের শিহরণ দুলে উঠল। শীলার স্নেহশীল কোলে সেও খেলতে খেলতে সে তার নাম হারিয়ে মানিক নামে বড় হয়ে উঠল। 

এখন মানিক দশ বছরের। হাতে বালা। ঘাড়ের চুল কাঁধ ছুঁয়েছে।মাঝখানে সিতে। মিঠুনের মতো ঝুলফি কাটা। রকে বসে আড্ডা মারে। এ পাড়ায় ও পাড়ায় মারপিট করে আসে।
দেখতে দেখতে একদিন শীলার পাতানো মাও মারা গেল। শিলার মাথাও আজকাল ঠিক কাজ করে না। কোথায় কোথায় চলে যায়।মাঝে মাঝে মানিককে জড়িয়ে ধরে বলে
……কিরে মানিক, তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি না তো?
……দূর, তুমি কি যে বলো না। আচ্ছা মা, আমাদের দেশের বাড়ি গেলে হয় না? পটাই দাদাদের দেশের বাড়ি আছে। আমাদের নেই কেন?
শীলার চোখ খিলখিল করে ওঠে।দুহাতের তালুতে মানিকের মুখটা নিয়ে বলে
……আছে রে, আছে। যাবি খোকা? চল না, তুই আর আমি ফিরে যাই সেই গ্রামে! কিন্তু কিসে করে যাবি? আমি তো এখানকার রাস্তা চিনি না।
……ও তুমি ভেবো না। শুধু গ্রামের নাম বলো। আর কোন স্টেশন থেকে ট্রেনে করে এসেছিলে সেটা জানো তো?
……হ্যাঁ জানি। তুই নিয়ে যাবি আমায়?
বলতে বলতে শীলার দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে অবিরল ধারায়।
মানিকেরও চোখ ছলছল করছে। মাকে জড়িয়ে ধরে সেও কাঁদে।

একদিন সবিতাকে সঙ্গে নিয়ে শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে গ্রামে ফেরে শীলা।

গ্রামে ঢোকার মুখে কেঁদে ফেলে সে।পুরনো ভিটেতে পা দিয়ে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারল না।হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে।জরাজীর্ণ ঘরবাড়ি। শাশুড়ি এখনো কোনোক্রমে বেঁচে আছে।গাছপালা, জমিজমা বিক্রি করে তার দিন চলে যায়। শীলাকে দেখে বুড়ি কেঁদে উঠল। টপটপ করে জল শুকনো চিবুক বেয়ে মাটিতে পড়ছে।
……এতদিন পরে এলি। আমার মধু কোথায়? সে আসেনি বুঝি? তা আসবে কেন?
সবিতা তার কাছে গেল। কি বলবে সে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। তবুও সে দূর থেকে বলে উঠল।
……আসবে মাসিমা। আসবে। এখন তার খুব কাজ পড়ে গেছে কিনা। তাই আসতে পারেনি।
শীলা তাকে বাধা দিতে চাইল। সবিতা বুঝতে পেরেছে সে কি বলতে চাইছে। কিন্তু সেদিনের কথা সে আজও ভোলেনি। তার স্পষ্ট মনে আছে .......নানারকমভাবে মধুর খোঁজ নিয়ে তারা সেদিন অন্ধকারে দুজন সেই বস্তিতে গিয়েছিল। গিয়ে জানতে পারে যে শীলা চলে যাওয়ার পর মধু নাকি খুব মদ খেত। দিন দিন কেমন বিষণ্ণ হয়ে ঘুরে বেড়াত। হোটেলে খুব একটা যেত না। প্রায়ই বাড়িতে পড়ে থাকত। একদিন সেই বউটাও নাকি এ পাড়ার কার সঙ্গে পালিয়ে গেল। সেবারে খুব শীত পড়ল। সেই শীতের এক রাতে মধুর ঘরের সামনে মধুর মরা দেহটা পড়ে ছিল। ঠাণ্ডায় কাঠ হয়ে উঠেছিল তার শরীর। বুড়ি মাকে কি এ কথা জানিয়ে সে আঘাত দেবে? তাই সবিতা নিজে সে কথা বলল, না শীলাকে কোনো কিছু বলতে দিল। সে সোৎসাহে বলল
……এই তোমার নাতি এসেছে দেখো। তোমার বংশের একমাত্র সলতে।
বুড়ির চোখের জ্যোতি কমে গেছে। বুদ্ধির ধারও কমেছে। নইলে মানিককে দেখে বুঝতে আর বাকি থাকতো না যে এতদিনে মধুর ছেলে এতবড় হল কি করে?
……কোথায় আমার দাদুভাই, কোথায়? আয় আমার কাছে আয়।
মানিক কাছে যেতেই ঘনঘন চুমু খেল তার গালে। আর তার গায়ে মাথায় হাত এমনভাবে বোলাতে থাকল, মানিকের পাতানো দিদার কথা মনে পড়ে গেল। তাই সে চুপ করে রইল।
……কত বড় হয়েছিস রে। আর তোকে আমি পাঠাবো না।তুই এখানেই থাকবি।
বুড়ির চিবুক বেয়ে আবারও চোখের জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।

তারপর থেকে শীলা ও মানিক গ্রামে যায়, আসে। এখন তারা একা একা যেতে পারে আসতেও পারে। একদিন মানিক এ গ্রামের স্কুলে ভর্তি হয়। শীলা সপ্তাহে কখনও বা মাসে মাসে আসে। এখন তার মাথাটা আবার বেশি বেশি কিলবিল করে। কারো সঙ্গে ঠিক করে কথা বলতে পারে না। মাঝে মাঝে ভুল বকে। যেখানে সেখানে চলে যায়।আবার ফিরে আসে। এখন মানিক আর তাকে কলকাতায় যেতে দেয় না।

মানিক এখন এ গ্রামের ছেলে। সে পাড়ার সবার সঙ্গে মিশে এ গ্রামের হয়ে গেছে। সে এখন আর যেন শীলার কুঁড়িয়ে পাওয়া মানিক নয়, যেন সে শীলার নারী ছেঁড়া ধন.....এক শীলার এক মানিক।
শীলাকে কেউ আর ডাকেনি। পুলিশ আসে। সবিতাকে তারা সঙ্গে করে আনে।কিভাবে এসব সম্ভব হল তা কেউ কোনোদিন হিসেব মিলিয়ে নিতে পারেনি। পাঠকও হয়তো তা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠবে। তবুও সে ইতিহাস কেমনে যেন গোপন থেকে গেল তা কারো কাছে সহজবোধ্য হয়নি। তা পাঠককেরও কাছে খানিকটা কৌতূহল রেখে গেল।

কিন্তু তারা খোঁজ নিয়েই তবে এসেছে।

কিন্তু মানিক কি করবে? এই বারো বছরে তার সেই মা বাবার মুখ ঠিক করে মনে নেই। যার মুখ মনে আসে সে আর কেউ না.....সে শীলার মুখ। সে পাগলি হোক আর যাই হোক সেই শীলাই তার মা।
আজ এই অপরিচিতদের সে মা-বাবা বলে ডাকবে কি করে? আর মেনে নেবেই বা কেমন?

তবে গ্রামের সবাই কেমন যেন মেনে নিল, এমনকি মাতব্বরও, যে সে শীলার ছেলে নয়, সে এদেরই ছেলে। তাই তারা পুলিশকে আর বাধা দিল না। বুড়িও এক বছর আগে মারা গেছে। শীলার বাবাও নেই। পাড়া প্রতিবেশী আর কেউ শীলার উপর ভরসা করতে পারল না।
বউঝিরা নানান কথা বলতে লাগল।
……আমি আগেই বলেছিলুম, ও কারো ছেলেকে চুরি করে নিয়ে এসেছে।
……ঠিকই বলেছ দিদি, কত বছর ওর বিয়ে হয়েছে যে ছেলের বয়স ওর বিয়ের বছরের চেয়ে বেশি?
এক বুড়িই তাদের কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলল
……পরের সোনা না দিবে কানে
কেড়ে নেবে সে হ্যাঁচকা টানে।
……ঠিকই বলেছ গো পিসি। পরের পুত আর ঝোরের মুত কোনোটাকে আটকে রাখা যায় না।নে এবার ঠেলা সামলা?

ঠেলা সামলে ছিল শীলা, সে দরজার ঠেলা। মানিক কাঁদতে কাঁদতে দরজায় অনেক ঠেলাঠেলি করে শীলাকে বাইরে বের করতে পারেনি। এমনকি মানিকের আসল মা'র ডাকের বেদনাতুর আকুতিও তাকে ভেঙে চুরমার করে দিলেও সে দরজা খোলেনি।যতবার মানিক মা মা বলে ডেকেছে ততবার কেউ যেন তার বুকে পাথর দিয়ে ঠুকেছে। তীব্র বেদনায় তার মাতৃত্বের হাহাকার কান্নায় ঘরের চাল ফুঁড়ে বেরিয়ে যেতে চেয়েছে। আর সে তখন মুখে কাপড় দিয়ে তাকে আটকে রেখেছে প্রাণপণে।
……মা একবার, একবার দরজাটা খোলো। মাগো একবার দরজাটা খোলো। মাগোওও..........
দরজায় মাথা ঠুকতে ঠুকতে সে ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে।
শীলার উঠোনে দাঁড়ানো সবাই তার কান্নায় কেউ আর চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। কেউ মাটিতে, কেউ কোনো গাছে, কেউ দূরে কারো বাড়ির দোয়ালে হেলান দিয়ে মাথা নিচু করে চোখের জল মুছছে। সবার গলা অস্ফুট কান্নায় যেন ভারি হয়ে আসছে এসব দেখতে দেখতে।
……চল বাবা, তুই আমাদের সঙ্গে যাবি। তোর মন চাইলে এখানে আসিস। আমি তোর মা হয়ে বলছি বাবা, আমি তোকে নিয়ে আসবো। কে-কেউ, কে-কেউ বাধা দিতে পারবে না। এমনকি তোর বাবাও না। তুই এদের মানিক হয়ে থাকিস। আমরা তোকে তোর আগের নামেও ডাকবো না।
বলেই মহিলা নিজের কান্না আর চেপে রাখতে পারল না। বারান্দায় বসে আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে লাগল।
……দেখ সোমেন, আমরা সবাই তোকে নিতে এসেছি। ও তুই তো এখন আর সোমেন নস, তুই তো এখন মানিক। দেখ না, অনেক অনেক খুঁজে তোকে তবে আমরা পেয়েছি। তোর ঠাকুমা তোর পথ চেয়ে বসে থাকে......তুই কবে আসবি? আমরা আর কেউ পুজো দেখতে যাই না রে। তোকে কথা দিচ্ছি তুই ফিরে গেলেও আমরা কোনোদিন আর ঠাকুর দেখতেও যাবো না।
কথা তার আর গলা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে না। কিছু কথা এত এত ভারি হয়ে যাচ্ছে যে তার গলায় তারা বসে যাচ্ছে আর বেরিয়ে আসতে পারছে না। তবুও শেষের কথাটা সঙ্গের লোকেদের উদ্দেশ্যে না বলে পারল না।
……এই তোরা ওকে বল না, অন্তত একটিবারের জন্য ও যদি যায়।তুই না গেলে তোর মাকেও আমি বাকি জীবন কিভাবে বাঁচবো বলতো?
মানিকের মাও সুর মিলিয়ে বলতে লাগল
….…চল না খোকা। একটাবারের জন্য.....তোর ওখানে ভালো না লাগলে আবার এখানে ফিরে আসিস।

মানিক চোখের জল মুছতে মুছতে দরজার সামনে একবার মাথা ঠুকে বলল
……ঠিক আছে মা। তুমি মুখ দেখাবে না তো? বেশ, আমি চললাম।আর আর কোনোদিন এমুখো হবো না।
বলেই সবার মাঝখান দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে গাড়িতে গিয়ে উঠল।

সবাই কেমন থ হয়ে দেখল সেই দৃশ্য।ওদের গাড়ি কাঁচা রাস্তার ধুলো উড়িয়ে সোঁ সোঁ করে চলে গেল সবার চোখের আড়ালে।কয়েকটা ছেলে সেই গাড়ির পিছু পিছু ছুটে ব্যর্থ হয়ে ফিরতে লাগল।

পুরো গ্রামটা কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল।শীলাকে কেউ আর ডাকল না।

রাত গড়িয়ে গেল।প্যাঁচা ডাকছে শীলাদের
তেঁতুল গাছের কোটর থেকে।শীলাও বের হল একটা বুচকি বগলে করে।

ভোরের ট্রেন ধরে এল তার সেই চির পরিচিত জঞ্জালের স্তুপে।আলুথালু চুল,চোখমুখ লাল,হাতে সেই লোহার আংটা,পায়ে গামবুট।আংটা দিয়ে জঞ্জাল গুলো তন্ন তন্ন করে টেনে টেনে ফেলছে। আর থেকে থেকে হাতে করে তুলে ওদিক ওদিক ছড়াচ্ছে। সকাল হতেই সবিতা আংটা আর বস্তা নিয়ে সেই স্তুপের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু শীলাকে দেখেই চমকে ওঠে।
……একি তুমি এখানে কখন এলে? এ কি করছ দিদি? নোংরাগুলো এভাবে ছুঁড়ছ কেন?
শীলা যেন আর নিজের মধ্যে নেই। চোখ দুটো তার গাঢ় লাল হয়ে গেছে। মুখের উপর অবিন্যস্ত চুল ছিটিয়ে রয়েছে। সামনের দিকে ঝুঁকে আংটা দিয়ে ময়লা টানতে টানতে তার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করছে
……এই, তু-তুই আমার মানিককে দেখেছিস? মা-মানিককে?
বলেই একথাবা নোংরা হাতে তুলে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে তীব্র আর্তনাদে কেঁদে উঠল
.……মানিক রে। মানিক আমার...

0 comments: