0

প্রবন্ধ - চিত্তরঞ্জন হীরা

Posted in


জন্মের মধ্যেই রয়েছে মহাবিস্ফোরণের ঘনঘটা। তাকে কি ইতিহাস বলবো! পৃথিবী পেরিয়ে এসেছে এভাবেই আরও অনেক অনেক সৃষ্টি এবং প্রলয়মুহূর্ত। কিন্তু ইতিহাস এবং সম্যক উপলব্ধির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। ইতিহাস অনেকটা গল্পের মতো। শুনতে শুনতে শিহরিত হওয়া যায়, কখনও উল্লসিত হওয়া যায়। কিন্তু এখন এমন একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি, যা নিয়ে বোধহয় গল্পগাছা হয় না। প্রকৃতির কাছে মানুষ বড়ো অসহায়। শুধু স্পর্শ দিও না, অন্তরে রেখো। এভাবেই বললেই কি নিরাময় হয়! চারপাশে শুধু নীরবতা আর নীরবতা।

হয়তো এই সময়ে লেখা নয় তবু ভীষণ প্রাসঙ্গিক মনে হল। একজন তরুণ কবি লিখছেন, – 

"পাখির কণ্ঠে বাজছে শোন গীতবিতান
নামিয়ে রাখা বিষাদগুলি উড়ন্ত খই" 
(সৌরভ চট্টোপাধ্যায়) 

তখনই মনে এল কথাটা। একমাত্র পাখিই কি পারে! আমরা কেন পারি না! ওই তো বিষাদগুলো উড়ছে। উড়ছে এবং পুড়ছে। দিনান্তের চুল্লিটাতে নিখাদ হচ্ছে। পড়ে থাকছে গোধূলিরঙের ছাই। তাকে গায়ে মেখে সন্ধ্যা সেজে উঠছে হাসতে হাসতে অপরূপ রাত্রির সাজে। অন্ধকার আজ তার হাত ছাড়বে না। 

তো এখন এমন একটা সময়, মনে হচ্ছে পৃথিবীটা যেন ঘুরছে না। থেমে আছে আশ্চর্য এক বিন্দুতে। কখনও মনে হচ্ছে আমরা সবাই একই বৃত্তে অথচ কেন্দ্রহীন হয়ে ভয়ঙ্কর এক শূন্যতার মধ্যে দাঁড়িয়ে জীবনের অর্থ খুঁজছি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে – আছি তো! কারণ জীবন যখন স্তব্ধ হয়ে যায়, বেঁচে থাকাটাও তখন অনুভব করা কঠিন হয়ে পড়ে। বা এই যে থাকা, একে কি সেই বেঁচে থাকা বলে! প্রতিটি দিনের মধ্যে এক গভীর অনিশ্চয়তা। পৃথিবী ঘুরছে আর আমরা নাকি ঘরে বসে লড়াই করছি অজানা অচেনা এক শত্রুর সঙ্গে। ঘরে থাকলেই জয় করা সম্ভব। সে যুদ্ধের শেষ কোথায় আমরা জানি না। কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাস তো বইছে। সে বলছে – তুমি আছো। বিষাদ-বেদনা মাঝে মাঝেই জেগে ওঠে নিজস্ব নিদ্রা থেকে। সে বলছে – তুমি আছো তো! ক্রোধ-কান্না আশ্বিনের মেঘের মতো, আসে যায়, এঘর ওঘর করে। প্রেম-বিরহ, শুদ্ধ শ্বাস, শুদ্ধ রাগ তারাও। বলছে – তুমি আছো তো !

অথচ এই থাকা-নাথাকার দ্বন্দ্বগুলো যখন বড় বেশি পেয়ে বসে তখন অবসাদ আসে। জড়িয়ে ধরে। তারও তো একটা মুক্তি চাই! কোথায় যেন বেজে উঠলো, – "অরূপ, তোমার বাণী/অঙ্গে আমার চিত্তে আমার মুক্তি দিক্ সে আনি।।" তখনই মনে হলো এই তো আমার নিরাময়। সকল দুঃখ মাঝে আমার উছলে ওঠা জীবন বাইছে যে সুর, যে সুরলহরীর তরী, সেই তো আমার সকল দুঃখহরা। এইটুকু অন্তত বাঁচা। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, – "গানের সুর যেন অসীমের সঙ্গে একমুহূর্তে একটা যোগাযোগ ঘটে যায়। এমনটি আর কিছুতে হয় না।"( রাণী চন্দকে এক চিঠিতে )।

তো এভাবেই ভেসে ভেসে আমরা একটু নিরাময় খুঁজছি। একটু একটু করে অসীমের দিকে হাত বাড়িয়ে জীবনের অনিশ্চয়তাকে ভুলে থাকতে চাইছি। তাহলে যে গাইতে পারে না, তার কী হবে! তিনি বললেন– ওরে তার জন্যেই তো রয়ে গেল আমার বাণী। সেই বাণীর মধ্যে নির্মোহ ডুবে যেতে যেতে কখন যেন মনে প্রশ্ন এল– মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে প্রাণের সূচনা হয় কীভাবে! মহাবিশ্বের এক বিস্ময় নিয়ে সেও তো বেঁচে আছে। আমরা কেন পারবো না! দেখো মৃত্যুই লালন করছে জীবনকে অথচ জীবন জানতেই পারে না মৃত্যুকে কেমন দেখতে! এই আশ্চর্য ঘোরের মধ্যে পড়ে জীবন নাহয় আরেকটু মর্মে বাঁচুক। বলছেন, – "শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু, হে প্রিয়,/মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো।।" এইতো। স্পর্শে জেগে উঠছে প্রাণ। ব্যক্তিগত শোকের স্রোত পেরিয়ে কখন যেন ভেসে উঠলো তার ছায়া। তাকে জড়িয়েই কেটে গেল একটা গোধূলি। জীবন থেকে মৃত্যু হল খেয়া পারাপারের খেলা। একটি নক্ষত্রের খেয়া। তিনি পেরিয়ে গেলেন আর আমাদের রেখে গেলেন এপারে। কিন্তু খেয়াকে বাইছে কে! এই গূঢ় প্রশ্নের উত্তর মেলে না। শুধু বয়ে যাওয়া। বইতে বইতে, বাইতে বাইতে নদীটি আকাশ হয়ে যায়। আকাশের ঘর বাড়ি বংশ পরিচয় নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা অবশ্য নেই। শুধু মাঝে মাঝে প্রাণের পরশটুকু দিও। এই তো সামান্য চাওয়া।

মৃত্যুকে নিয়ে কেন যে মন এমন খেলা খেলতে বসে! আসলে সত্যের খোঁজ যখন আমরা করতে বসি তখনই কেউ যেন বলছেন – এ এক মহাবিস্ময়। মৃত্যুকে বাদ দিয়ে জীবন কখনও বাঁচে না। এর মধ্যে দাঁড়িয়েই নানারকম উপলব্ধি। তাদের নিয়েই নিরাময় খোঁজা। ঠিক বিষাদ নয়, এমন একটা অবস্থা, থেকে থেকে যেন নিজেকে খোঁজা। খুঁজতে খুঁজতে বর্তমানের মুখোমুখি হওয়া। কে এই বর্তমান! আচ্ছা, অতীত এবং ভবিষ্যতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন যিনি, তিনিই কি বর্তমান! তাঁকে কি ঠিক চেনা যায়! কবি বলছেন– যা নেই, তাকে সাজাতে আমাদের কখনও উপকরণের অভাব হয় না। যার একখানি ছেঁড়া কাপড়, সেও ওই নেইকে গয়না পরাতে বসে। তার তখন যে কি অফুরন্ত ঐশ্বর্য! এতো সবার বোঝার বিষয় নয়। একমাত্র তিনিই জানেন। 

এই প্রহেলিকার মধ্যে পড়ে দিশাটাই গেল। আবার পাখির কাছে গেলাম। যে পাখির কণ্ঠে থেমে থেমে বেজে চলেছে মুহূর্তের অনিবার্যগুলো। বেজে চলেছে – "ধীরে বন্ধু, ধীরে ধীরে/চলো তোমার বিজনমন্দিরে।।" এই বিজনে ওই বর্তমানের একটা ঝলক, অথবা তার একাংশ। ইনি অতীতের গর্ভ থেকে বেরিয়ে যেই না পা ফেললেন বিশ্ব চরাচরে, ভবিষ্যৎ তাকে বিচ্ছিন্ন করলো। এমন একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে মানুষের ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত হতে পারে। যার মধ্যে ওড়ার বাসনা যখন জন্ম নেয় বুঝে নিতে হবে এ হল পাখিত্ব। যখন হিংস্রনখ বেরিয়ে আসে বিদ্যুতের ফলার মতো, বুঝে নিতে হবে এ হল পশুত্ব। এভাবেই মানুষের ব্যক্তিত্বে বিচিত্র সব আচরণের সমাহার। – আপনি কি এবার একটু নৈঃশব্দ্যের গন্ধ পাচ্ছেন! তাহলে ওই দেখুন কালের মুখর বাঁশিটি বেজে চলেছে আরও নীরব সুরে। রাত্রির গূঢ়তা, আঁধারের মাহাত্ম্য, মধ্যে আরও আরও কত প্রাচীন অন্ধকার! দেখুন তার পরশখানি কেমন লাগছে!

আত্মজনেরা বললো – পাতার ভাঁজে তোমার জন্যে একটা কাগজের নৌকো রাখা আছে। আমি ভাবলাম গীতবিতানের খাঁজে আমার তো শৈশব রাখা ছিল, তাকে কে কখন নৌকো বানিয়ে তুললো! তাদের খুঁজতে একবার মাটিতে একবার অন্তরীক্ষে তাকাতেই শূন্য থেকে চোখ নাচালো সেই শৈশব। তাকে লালন করতে করতে বুকের মধ্যে একটা ছলাৎ, বেজে উঠলো নদীর অতলও। তাহলে কি শৈশব এখন বার্ধক্য পেরোবে! শৈশবের জল থই থই জীবন একটা নৌকোয় উঠে আজও ভেসে যেতে চায়। জীবন এমন, মাঝে মাঝে কীকরে যে বয়সকে তুচ্ছ করা শিখে নেয়, বুঝতেই পারি না। আর সে নৌকো যদি কাগজের হয়, তাহলে তো কথাই নেই। সেই নৌকো নিয়ে বয়স পেরিয়ে গেল আরও কিছুটা সময়। স্মৃতি উপচে ভেসে যাচ্ছে নৌকোর সঙ্গে মন। ভাসতে ভাসতে গেয়ে চলেছে – "আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ আপনারই আবরণ !/খুলে দেখ্ দ্বার, অন্তরে তার আনন্দনিকেতন।।" এই ভাসমান জলের উপর ছোট ছোট ঢেউগুলো মধ্যবিত্ত। খুলবো খুলবো করে সবটুকু কি আর খোলা যায়! ঢেউ নিয়ে খেলা, খেলার মধ্যে ঢেউ ঢেউ আরও কত প্রহর কেটে যায়! অন্তরের দরজা খোলার প্রয়াস চলতেই থাকে। আগন্তুক হাওয়া এসে দোলা দেয়। দোলাচলকে একটু নাড়িয়ে একটু দুলিয়ে দিয়ে দেখছে– কেউ কি এল! কে এল না! "বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছ, কেমনে দিই ফাঁকি!/আধেক ধরা পড়েছি গো, আধেক আছে বাকি।।"

তো সেই আধেক নিয়েই পাতার শিরায় একটা শিরশির এসে বসলো, বলছে গন্ধবিতান। আমার বিতানঘরে তখন বায়না ধরেছে ইচ্ছেকুসুম। বাকল খুলে বসা এক গানপরি। গীত হচ্ছে আরও হলদে বাটা হাতের চেটোয় অরূপ নির্জনতা। এভাবেই একফালি জমি ছিন্নপাতায় ভরে ওঠে।। মর্মর ধ্বনি ওঠে ফুঁপিয়ে। কিছুটা কান্নার মতো। কান্না বললে আবার অশ্রুনদীটা চলে আসে। আমার নির্জন কুলুকুলু বয়। অন্ধকারে আমার শরীরও নির্জন। অন্তঃপুরের নির্জনতা ছুঁয়ে রচনা করে ফেলে একখানি মহাসঙ্গীত – "আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে/ আমার ভয় ভাঙা এই নায়ে।।" ছেঁড়া পালে বুক ফুলিয়ে তো চলেছি। মারের সাগর পাড়ি দিচ্ছি। মাভৈঃবাণীর ভরসাটুকু ঢেউ হয়ে বুকে এসে লাগছে। ভয় ভেঙে যাচ্ছে। অভয়নগর, অভয়ারণ্য পেরিয়ে ছায়াবটের দাঁড় বেয়ে। 

নির্জনতার কোনও ছলনা থাকতে পারে কি! পারে না, এমন বিশ্বাস নিয়েই একটু বাঁচতে চেয়েছি। আদিগন্ত মায়াভরা নক্ষত্র, তাদের কোলে একটু মাথা রেখে বিদ্যুতের ছক টানা দেখছি। তখনই মেঘে মেঘে ছলনার ছল ছলকে ছলকে উঠলো। আরও বিচিত্র হল অনন্তের সেই বৃষ্টিবিলাস। যে জালের মতো বিস্তার করে জড়িয়ে ধরছে মোহতাপ। মন তাকে উপেক্ষা করতে চায়। মন চায় এই চরাচর আরও বিস্তৃত হোক। "আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে" আজ এই মুহূর্তে নিবেদন করতে চাই তার কাছে নিজেকেই। চরে এসে বসলো নিরাবরণ বেলাশেষের যাপনটুকু। সে কী অসামান্য তার গায়ের রঙ, রূপের বিভা একেবারে ব্যাখ্যাতীত। তবুও যে ব্যথার পূজা শেষ হবার নয়! কারণ যাপন তার দীর্ঘ চুলে এখন বিলি কাটছে। সে সুগন্ধি নিয়ে সাজাতে বসেছে কবেকার বিদিশাকে। শ্রাবস্তীর সবুজ শরীর অবুঝ হয়ে উঠছে কারুকাজ দেখে। সুর লয় তালহারা বাঁশিটা কেন যে বারবার দূরে সরে যায়! তাকে ছেড়ে বাঁচবো কীকরে! 

আমার বিজনঘরে নিশীথতারে অঘুমের বসত দেখেও অবাক হতে হয়। এসেছিল সে শূন্য হাতে। তার পরিজন সংসার ব্যক্তিত্বের অভাব বুঝতে দেয় না। কিছুই সে আগলে রাখছে না। শূন্য থেকে আরও শূন্যে আমাদের জেগে থাকা মুহূর্তগুলো বাঁধন খোলা কণ্ঠে বারবার গেয়ে উঠছে – "জানি জানি বন্ধু, জানি –/ তোমার আছে তো হাতখানি।।" সেই হাত দিয়েই জীবন ও মৃত্যু দুদিক থেকে আমাকে টানছে। তোমার সঙ্গে নাহয় কাটবে আমার এই আকাশ অন্ধ করা আরও কিছুটা নির্জনতার বেলা। কাটতে কাটতে দিন হয়ে উঠবে হৃদয় আপন করা। তোমার সঙ্গে এসব আয়োজন পূর্বনির্ধারিত। এমনটাই বাতাস জানে। বলেছিলাম তাকে। কিন্তু ওই যে নির্ভরতার খাঁজে কোলাহলকে ডেকে বসলাম, সে আর বারণ মানছে না। জীবনপুরের গল্প শোনাবে বলে অনন্তকে সাবানজলে ধুয়ে গন্ধ এবং ধ্বনি জুড়ে স্বরূপ করে তোলে। এটাই যে তার রূপ-অরূপের খেলা, সে ছাই কে জানতো! 

এখন আপনি মায়ায় আপনি রসের গুনে রাত্রি এসে বসে। তার সাফল্য, তার ব্যর্থতা, সে শোনাবে। আমরা মুগ্ধ হবো বলে বেদনার রুদ্ধদল নদীর কূলে রেখে আসি লুকিয়ে। নদীটি বইছে কিন্তু আপন খেয়ালে। কবি বললেন – এই নদীটি আমার রচনা। হা পোড়া কপাল, এ বিশ্বের সবকিছু যার নিজের রচনা তার আবার আলাদা একটা নদী কী ! তবু আমরা কান পেতে শুনি – "আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।।" আমরা রয়েছি সেই অনন্তের দিকে চেয়ে। বসন্ত একটা পাতার কুড়েঘর বানিয়ে রেখেছে মনাঞ্চলে। রেখেছে রাত্রির মতো বিচিত্র সব রাগের সমাহার দিয়ে। যেন অমৃত সুধাপাত্র সব। মনের যত তরঙ্গ এখানে এসে বনতরঙ্গের সঙ্গে মেশে। এর কোনও ক্ষয় নেই, শেষ নেই। "অনন্ত আলয় যার কিসের ভাবনা তার–"! এই নির্ভাবনায় ঘরের মধ্যে বিশ্বটি রচনা করি। আর মন্তব্যে লিখে রাখি নিজের নামহীন গোত্রহীন আশ্চর্য আত্মপরিচয়।

লিখে তো রাখছি, কিন্তু একে কি লেখা বলে! অনেকদিন ধরেই তিনি বলছেন – এই যে পৃথিবীর উপর তোমাদের এত মোহ, এর পরিণাম জানো! কী মুসকিল, আমাদের কাজ আমরা করেছি, মোহ আবরণ নিয়ে ভাবনার কাজ শুরু হল কবে! জীবনকে কেমন করে দেখবো, বাইরে থেকে না ভেতরে দাঁড়িয়ে! আবার বাইরে যে দাঁড়াবো, তার তো একটা পথ চাই। এই সামাজিক জীবনের সঙ্গে বিশ্বের যে যোগ তাকে বুঝবো কেমন করে! পথ কোথায়! যখন খুঁজতে বসেছি সব পথ নিপথ হয়ে গেল! কিন্তু থেমে থাকলে তো চলবে না। 

এক অমীমাংসিত দুঃখের মধ্যে দাঁড়িয়ে আনন্দকে আহ্বান করি। সে আসে কিন্তু আসে না, কারণ জগতে যে যেমন আছে, যার যেমন আছে তাকে সেভাবে মেনে নেওয়া তো আমাদের স্বভাব নয়। একটু তাকে মেনে নিতে পারলেই আত্মার সঙ্গে মন, মনের সঙ্গে বস্তু-অবস্তুর সম্পর্ক নিবিড় হয়ে উঠতো। একজন চালক বারবার নিপথে চালিয়ে দিচ্ছেন আমাদের, আরেকজন চালক পথ দেখাচ্ছেন আঁধারে-ইঙ্গিতে। এই দুই চালকের মধুর খেলায় আমাদের রাত্রিধর্ম বিচ্যুত হতে বসে। তবু থামলে তো চলবে না। দীর্ঘ জীবনপথে নিরাময়ের সুর যেখানে বাজে সেখানে একটা পান্থনিবাস আছে। আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন তাকে! চলুন না একসঙ্গে একটু খুঁজে দেখি! কিন্তু আমাদের খোঁজাটা কেমন হবে! রবীন্দ্রনাথ "জীবনস্মৃতি"তে বলছেন –

"আমার গঙ্গাতীরের সেই সুন্দর দিনগুলি গঙ্গার-জলে-উৎসর্গ-করা পূর্ণ বিকশিত পদ্মফুলের মতো একটি একটি করিয়া ভাসিয়া যাইতে লাগিল। কখনো বা ঘনঘোর বর্ষার দিনে হারমোনিয়াম যন্ত্র-যোগে বিদ্যাপতির 'ভরা বাদর মাহ ভাদর' পদটিতে মনের মতো সুর বসাইয়া বর্ষার রাগিনী গাহিতে গাহিতে বৃষ্টির মুখরিত জলধারাচ্ছন্ন মধ্যাহ্ন খ্যাপার মতো কাটাইয়া দিতাম।"

দেখুন কখনও সূর্যোদয়ের প্রথম আলো এসে পড়ছে, কখনও পূরবী থেকে বেহাগ হয়ে সূর্যাস্তের নরম গোধূলি মেখে নদীটি প্রবাহিত হচ্ছে, আর আমাদের সুরে সুরে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে আশ্চর্য নিরাময়ের দিকে। সেই থেকে আমরা ভেসে চলেছি। ভেসে উঠছে আকাশে সোনার খেলনার মতো পুতুলের ঘর-গৃহস্থালি। ভেসে উঠছে ডুবে যাওয়া গানতরীখানি, ঢেউ খেলছে চাঁদের সঙ্গে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন না ! 

হৃৎপিণ্ডের ঘড়িটি এখনও বাজছে। তরঙ্গ যেখানে বইতে পারে না সেখানে একটা আর্তনাদ থাকে। জটিল ভাষা তার, কিন্তু হৃৎপিণ্ড সে কথা বলে না। সে বলছে সময়। সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হবে এই বাঁধনকে। বর্ণহীন যে অন্ধকার, তার উপর আছড়ে পড়ছে প্রবহমান দুঃখগুলো, সঙ্গে রয়েছে দু'টুকরো জ্যোৎস্নার মিনতি। কে যে কখন কার সঙ্গী হবে এভাবে কি বলা যায়! যেতে যেতে যেতে সেই অকল্পের সঙ্গে দেখা। বলছে – 

"মনে করো চতুর্দিকে মৃত্যুর নষ্ট আবরণ নিয়ে,
হাজার মাইল স্পিডে, আমি
দৌড়চ্ছি প্রেমের অস্পষ্ট সীমারেখার দিকে।" 
(শ্যামল জানা)

তারপর যেতে যেতে যেতে মনে করুন, মৃত্যুর আবরণটা। ধরা যাক সরীসৃপ হয়ে উঠল সেই মৃত্যুও। সেও খোলস ছাড়াতে ছাড়াতে আবার নিজের মতো একটা রঙের পোশাক! আচ্ছা এই রঙ কি ভেষজ! রঙে রঙে ভরে উঠছে মৃত্যুনিকেতন। মেলা বসেছে হৃৎপিণ্ডের মাঠে। তাহলে কি এই প্রেম আবার মহার্ঘ্য হয়ে উঠবে! তাহলে কি অস্পষ্ট সীমারেখাটা আবার! খসে পড়তে পড়তে ভূপৃষ্ঠের অতীত বরাবর গেয়ে উঠবে,– "তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর/ তুমি তাই এসেছ নীচে –/আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর,/তোমার প্রেম হত যে মিছে।।" আমরা আবার একটা নিরাময়ের সূত্র ধরে স্নান বিষয়ক জ্যামিতির ভেতর নেমে যাবো নিশ্চিন্তের শ্বাস নিতে নিতে। মধ্যে পুরে দেবো আমাদের ভূভারত সুধাময় সাঁতারের কলিগুলো।

আনারকলির ঝরে পড়া রোদ্দুর আর এই সত্য। কেউ আড়াল করছে তাকে, কেউ শিল্প করে তুলছে মিথ্যার মিথ জড়িয়ে। আলোয়ানটা কবে যে জীর্ণ হয়ে গেছে তা ভেবেও দেখছে না। আরও নতুন এক মিথ্যের জন্যে আরও মিথ, আরও মিথিকাল কান্নার প্রয়াসে তীব্র করোনার গন্ধ, গন্ধহীন ফসফরাসের যুদ্ধ, ছড়িয়ে পড়ছে শরীর থেকে আশরীর দৃষ্টির মধ্যে। মাঝে মাঝে কেউ কেউ বলে উঠছে – দূরে থাকুন, দূরে থাকুন। অথচ ভীষণ ইচ্ছে করছে ইচ্ছেকে জড়িয়ে ওম নিই। ইচ্ছে করছে আরও কিছু সত্যকে আড়াল করার নিমিত্তে এই স্পর্শকাতর ঠোঁট জীবন্ত হয়ে উঠুক আনন্দরূপ অমৃতের উপর। ভাবছি সেই বেশ ভালোর দিনগুলো থেকে টুপ টুপ পেড়ে নেওয়া দীর্ঘের চেয়ে কিছুটা ছোট অথচ মনে হবে ভিক্ষার ঝোলা হাতে রাজা ও ভিখারি …।

কালখণ্ডে এই মৃত্যুর এখন আর কোনও রঙ হয় না। এখন নৈঃশব্দ্য থেকে শব্দের ভ্রূণ খুন করে আনা ভাষা সৃষ্টি করছে যে বিশ্বজগৎ, তার একটাই রঙ – পিঙ্গল বর্ণের ভয়। ভয়ে ভয়ে বলিপ্রদত্ত জন্মের লীলাগুলো লতার মতো ঝুলছে। ঝুলন্ত পায়ের কাছে বিস্ময়। কবি হাসছেন। তাঁর হাসির মধ্যে এক উজ্জ্বল উদ্ভাস। এখানেই মনেহয় দেখা হয়েছিল একদিন। তাঁর কথা আজ খুব মনে পড়ে। বুকে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে তিনি যে বলতেন – 

"মনুষ্যের সকল উপলব্ধি তাহার মনুষ্য অস্তিত্বের কথনভুবনের নহে। ইহার মধ্যে পক্ষীর কুজন, নদীর বহিয়া যাওয়া, আঁধারের গাঢ়ত্ব, নক্ষত্রের ফিসফিসানি, মৃত্যুর নৈঃশব্দ্য, অগ্নির দহন, স্মৃতি বিস্মৃতির দিগন্ত, অশরীরীদের আবেদন, তৃপ্তি অতৃপ্তি, রঙ নিঃরঙ, কারণ অকারণ, লক্ষাধিক বছর আগেকার এক সান্ধ্যবৃষ্টিপাত, জোনাকি ইত্যাদি সকলকিছু মিলিয়া রহিয়াছে।" (অপাবৃণু ‌।। নারায়ণ মুখোপাধ্যায়) 

এই মহামিলনের মধ্যে মহামাননীয় নিরাময় আমাদের যে ঘোর ধাঁধায় ফেললেন। আমাদের সামান্য উপলব্ধির যে জ্ঞান সেখানে লোভ, কাম, স্বাচ্ছন্দ্য, সাফল্য ইত্যাদি ভোগের কোনও ব্যবস্থা না রেখেই তিনি হাসতে হাসতে চলে যেতে চাইছেন! এ কোন্ অমীমাংসিত দুঃখের মধ্যে আমাদের দিশা খুঁজে ফেরা! তাহলে এই যে আমরা, আমরা কেউ কারো নই এমনই এক আমরা, মনুষ্যপ্রজাতির মহা ঘোর সংকট লইয়া কাতর হইতেছি, ইহা কি ব্যক্তিসুখের অভাবজনিত কারণেই উদ্বেলিত হওয়া নয়! মহামান্য বিবেক ক্ষমা করিবেন। সত্য বড় নির্মম ও নিষ্ঠুর।

অবচেতনার জ্যোৎস্নায় ভাসছে সেই প্রত্নবীজ। বীজের আধার হল রাত্রি। রাতের গরিমা ফুঁসে উঠছে বুদবুদে। নীল বুদবুদ ভরে উঠছে চেতনার শিস জড়িয়ে। কালের অনন্ত প্রবাহ, বয়ে চলেছে এক একটা জন্মের ভেতর। প্রতিটি জন্ম অদৃশ্য তরঙ্গের মতো। নিষিক্ত রাত্রির তেজ দেখে নতমুখ মৃত্যু এবার ফিরে যেতে চায় কালের গহ্বরে। যেখানে এই চোখ এই দৃষ্টি এই অভ্যাস দিয়ে সব কিছু অনুভব করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর বাইরেই রয়েছে সেই প্রাণপ্রবাহ, সেই সংসার ও ধর্ম , সেই রূপ, সেই অবয়ব,স্বপ্নমায়া। শুধু কি তাই! সেখান থেকেই ধ্বনিত হচ্ছে আরেক উচ্ছ্বাস – "ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর প্রভাত-অম্বর-মাঝে,/দিকে দিগন্তরে ভুবনমন্দিরে শান্তিসঙ্গীত বাজে।।" আমরা যে তাকেই শুনতে চাই। অরূপসুন্দরে পৃথিবী ভরে উঠুক, নিখিল সংসার আবার মিলন-অঙ্গন হয়ে উঠুক। কলুষমুক্ত হোক এই বিশ্বসমাজ। পাখিরা গেয়ে উঠুক তরঙ্গে মিলনের স্বর তুলে।

তো চিরদিন কি এমনই কাটবে! তা তো নয়। তবু যেন মন মানছে না। ভেতরের অস্থিরতা বাইরে এসে পড়ছে। বাইরে থেকে প্রকাশ-অপ্রকাশের মধ্যে এসে পড়ছে নিতান্ত অন্তর্গত অনুভবগুলো। তিনি বলছেন – দ্যাখো বাপু, সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর মতের কোনও মিল নেই। সংসারে স্বামী-স্ত্রী একমতে চললে সংসার কি চলবে! কক্ষনো না। সংসার হল বিরোধের মধ্যে সৃষ্টির এক লীলাক্ষেত্র। এই যে পৃথিবীর এত এত কবিতা, গান কে রচনা করে! কান পেতে শোনো, তোমাদের নিত্য ঝগড়া তার শেষে ওই মিলনরাগটিই বাজছে। "অসীম আকাশ নীল শতদল তোমার কিরণে সদা ঢলঢল,/তোমার অমৃতসাগর-মাঝারে ভাসিছে অবিরামে।।" এই হল আনন্দধাম।

মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের সঙ্গে তিনি এক আশ্চর্য আঁধার নিয়ে খেলছেন! আমার আমির সঙ্গে যেমন আমি, আরেক আমি। এই যে ছায়া ছায়া দৃশ্য-অদৃশ্যের এক আধা বাস্তব আধা কল্পনা এর মধ্যেও একধরনের শুশ্রূষা রয়েছে। নিজেকে অতল জলের আহ্বানে ছেড়ে দিতে পারলেই হল। সে তো আবহের ছড় টেনেই চলেছে। একে নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় না, আবার এই সংশয়টুকু নিয়ে আর কিছুটা পেরিয়ে যেতে পারলেই কালের হাতে ছেড়ে দেওয়া। ঘাট দেখা দিল কি দিল না কী এসে যায় ! –

"ঘোর অন্ধকারে আর সীমানা সরে না
পারাপারে শুধু তার নীরব বিস্তার
থেকে থেকে জলজ বাতাস
আর ঠায় বৃষ্টি ও বিদ্যুৎ
ধেয়ে আসে, কেঁপে আসে–নিজস্ব মর্জিতে…"
(মন্দার মুখোপাধ্যায়) 

এরপরও কবি বলছেন মনের সীমানার কথা, সীমানা ভাঙার কথা। ভাঙে! ভাঙা যায় নাকি? বাতাসের বিপ্রতীপে একটা বিরল উজান উঠছে। ভেসে যাওয়ার আগে অন্তর ভাসমান...।

ঠিক এই সময়ে অনেককেই দেখছি নানাভাবে বন্ধনের মুক্তি খুঁজছেন। আসলে একে ঠিক নিরাময় বলা যাবে কি! মানুষের ভেতরে নিয়ত বন্ধন এবং বাঁধনহারার টান রয়েছে। মানুষ ভাবছেন এ এক বন্দিদশা। এই বন্ধন থেকে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারলেই মুক্তি, সেই মুক্তিকে খুঁজছেন। কিন্তু আমরা আত্মার মুক্তির কথা যদি বলি, তা কি এভাবে সম্ভব! প্রতিদিন যারা মানবিকতার নামে নানারকম উস্কানি দিচ্ছেন, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ছড়াচ্ছেন, চেতনার কথা বলে নানারকম বন্ধনের বেড়া বাঁধছেন সেটাও কি বন্দিদশা নয়! তাহলে আজ কেন মানুষ ছটফট করছেন! এই প্রসঙ্গে ভীষণ ভাবতে ইচ্ছা করছে, তিনি বলেছিলেন – 

"মনুষ্যত্বের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই দেবতার উপলব্ধি মোহমুক্ত হতে থাকে, অন্তত হওয়া উচিত। হয় না যে তার কারণ, ধর্ম সম্বন্ধীয় সব-কিছুকেই আমরা নিত্য বলে ধরে নিয়েছি।… সম্প্রদায় আপন মতকেই বলে ধর্ম, আর ধর্মকেই করে আঘাত। তার পরে যে বিবাদ, যে নির্দয়তা, যে বিচারবুদ্ধিহীন অন্ধসংস্কারের প্রবর্তন হয় মানুষের জীবনে আর-কোনো বিভাগে তার তুলনা হয় না ।" (মানুষের ধর্ম ।। রবীন্দ্রনাথ)

কেউ বলছেন, স্নেহের মধ্যে যে অ-মুক্তি তার মতো বন্ধন আর নেই। তাহলে স্নেহ থেকে তাকে মুক্ত করতে হবে তো! এই বিলিকাটা দিনের কোনও কোনও মুহূর্তে কোথাও কোথাও গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। চলতেই থাকে। নীরবতার মধ্যেও যেমন কোলাহল। মানুষের প্রেমে এত অপ্রেম, এত সন্ত্রাস! আমরা দেখছি মহাসংকটের কাল এখন, তো প্রাণে প্রাণ মিলিয়ে গাইতে হবে এমন একটি মহামিলনের গান যা আমাদের সমস্ত সংকীর্ণতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আত্মার মুক্তি সেখানেই। আপনি আমাদের শোনালেন – "বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা।।/বাজে অসীম নভোমাঝে অনাদি রব,/জাগে অরণ্য রবিবারচন্দ্রতারা।।" দুঃখের মাঝে আনন্দকে অনুভব করা খুবই কঠিন,তবু আমাদের বাগানে নিত্য যে ফুল ফোটে তা দিয়েই সমস্ত আরাধনা। আর কান পেতে শুনতে থাকা সেই অমোঘ মূর্ছনা, – "যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি বিশ্বতানে/ মিলাব জীবনগানে।।" আহা ! তুমি কি শুনতে পাচ্ছো ! 

কিন্তু সমাজের গায়ে আট হয়ে বসে আছে মিথ্যে অহংকার। তিমিরঘন অবিশ্বাস। জ্বলজ্বল করছে বিশ্বসংসার, গ্রহ-তারা। সে পোশাক খুলবে কে! খিদের কি কোনও শেষ আছে! বা ভালোবাসা! সে আসলে কোথায়! আমরা কতটুকু বুঝি! চাঁদ ওঠার ভাষা বুঝি! জ্যোৎস্নার স্বরলিপি দেখে গাইতে পারি! এই যে – "মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে/আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে।।" এই বিস্ময়েরও কি কোনও শেষ আছে! অসীম রহস্যের মধ্যে জীবন যখন পথ হাঁটতে শুরু করে তখন এই একার মধ্যে আর কোনও বিভেদ নেই, কোনও হিংসা নেই, দ্বেষ নেই, ক্রোধও নেই। সব কিছুর মধ্যে থেকে সব কোলাহল স্তব্ধ করে বহুর মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া। 

অবশ্য পুরোটাই নির্বোধের বয়ান। জীবনে অতি মহৎ ও অতি চালাকের চেয়ে একটু নির্বোধের মতো বাঁচা। এর মধ্যে যে কি আনন্দ আছে সহজে বোঝানো যাবে না। নির্বোধ হতে কোনও প্রতিযোগিতায় নামতে হয় না। কোনও যুদ্ধ নেই, হত্যা নেই, ষড়যন্ত্র নেই। যেমন করে আকাশ গায়, যেমন করে বাতাস বয়, অনেকটা সেভাবেই নির্বোধের ধারা। প্রবাহিত হতে চায় উন্মুক্ত চরাচরে। কিন্তু সেখানেও যে কত বাঁধা! এই যে মন বলছে – "আজি মম অন্তরমাঝে সেই পথিকেরই পদধ্বনি বাজে,/ তাই চকিতে চকিতে ঘুম ভাঙিল রে।।" এর মধ্যে যে আনন্দ, সেখানে চমকটা হল ভেতরের আলোড়ন। পাতায় পাতায় হিল্লোল। কিন্তু নির্ঘুমের কি ঘুম কখনও ভাঙে !

হচ্ছিল নির্বোধের কথা, তার নিজস্ব কিছু কান্না আছে। সে চোখের জল তার অন্তরের ভালোবাসা। সে যখন ঝরে তখন প্রবাহিত করুণার মতো নিজেই নিজের। কেউ মুছিয়ে দিতে আসবে না। কারণ নির্বোধের কান্না বৃষ্টিতে ঝরে। নির্বোধের গান শুধু বাতাস শুনেছে। আমরা আলাদা করে তাকে চিনতে পারিনি বলে সহমর্মিতা জানানোর ভাষা কোথায় পাবো! কোন্ ছন্দে তাকে দোলাতে দোলাতে বলবো - ভালো থেকো, সুস্থ থেকো, ঘরে থেকো! আমাদের সে হৃদয় কোথায়, যে বলতে পারে – 

অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত আলো
সেই তো তোমার আলো!
সকল দ্বন্দ্ববিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো
সেই তো তোমার ভালো।।

পথের ধুলোয় বুক পেতে রয়েছে যে গৃহখানি সেই-ই তোমার একান্ত আশ্রয়। তবু কেন নিজেকে নিঃস্ব ভাবছো! সব ফুরিয়ে গেলেও অদৃশ্য এক দান ঠিক তোমার সামনে। তুমি দুহাত পেতে গ্রহণ করতে পারছো না বলে নিজেকে নিঃস্ব লাগছে। মৃত্যু আপন পাত্রে ভরে যে প্রাণকে বহন করে নিয়ে চলেছে সে তো তোমারই প্রাণ, তুমি অস্তিত্বে সাড়া দিতে পারছো না বলে নিষ্প্রাণ ভাবছো। সবার মাঝে সকলকে নিয়ে তুমি আছো, সেই তো তুমি!

যেন ভোর এসে রাতের পাতলা চাদর সরালো। আর আমরা একটু একটু করে স্বপ্নগুলো প্রশ্নচিহ্নে রেখে ভোরের শিশির ভেজা মুখ দেখবো বলে চোখ মেলছি। এক নীরব অথচ সপ্রভ নীরবতা ঘসে ঘসে তুলে দিচ্ছে রাতের ব্যর্থতাগুলো। নিত্য তোমার ভেতরে এক তুমি ফুল হয়ে ফুটে উঠতে চাইছে, অথচ তাকে তুমি প্রকাশ হতে দিচ্ছো না। কেন ! নিত্য তোমার ফুলবনে তুমি তারই সুগন্ধ হয়ে আছো। বুঝতে পারছো না। পখি ডাকছে। পাখির কণ্ঠে বেজে উঠছে সেই গীতবিতান। বিতানের তান আনন্দের সঙ্গে সঙ্গত করছে। মিশ্ররাগে বেজে উঠছে সুরবাহার। শুধু বেজে ওঠা, আর বাজিয়ে তোলা। সুদূর পারের ডাক এসে কানের কাছে রাত্রির বর্ণনা দিচ্ছে। যেন সে আমার আকাঙ্খার চাঁদ, সর্বাঙ্গ সাজিয়ে আতর ঢেলে বসে আছে খোলাপিঠ নিয়ে। এঘর ওঘর করছে তার বহুজন্মের ঘ্রাণ। তবু যেন মনে হয় তার ইশারা টপকে অন্য আরেকজন, আরও রমণীয়। বলছে –

আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,
বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।।

দরজা খুলে একটা একটা সিঁড়ি। আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে শূন্যের দিকে। কিছুটা মহাশূন্যের মতো। হয়তো ছাদ পেরোলেই তাকে ধরে ফেলা যাবে। কিন্তু ভয়। ঘর-সংসার ঢলঢল ইচ্ছা-অনিচ্ছা মান-অভিমান পেরিয়ে সমস্ত ডাক গ্রাস করতে থাকে। এসব ছেড়ে যাওয়াই হল না। তাহলে বিশ্বলোকের সাড়া মিলবে কীকরে! শুধু রাত্রির অপেক্ষায় এক একটা দিন পেরিয়ে যাওয়া। মাঝে মাঝে দ্বিধা লাগে, রাত্রি না রজনী! মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অচেনা লাগে, মনে হয় চাঁদের কুঁড়ি থেকে শৈশব ফুটে সেই যে হারালো তাকে আর রচনা করতে পারি না। চাঁদ জ্যোৎস্না হয়ে গেল, আর জ্যোৎস্না হল মায়া। দরজা খুলে ছাদ থেকে আর একপাও সামনে এগুনো হল না।

সাতকাহন প্রলাপের মধ্যে যদি সংকটকে একটু ভুলে থাকা যায় সেও কম কীসে! নিরন্নের নির্জনতার মতো গাঢ় শোক বুকে নিয়ে কারও ডাকবাক্সে চিঠি হতে মন আর সায় দেয় না। প্রেম ছিল প্রথম কৈশোরের খেলা। যৌবনে তাকে কত রঙে দেখা! এখন কি আর কেউ ভলোবাসার কথা বলবে যে অমরত্ব পণ করে বসবো! এই তো ফুরিয়ে এল। একপাশে অপাবৃণু, অন্যপাশে গীতবিতান আর সামনে সুদূর বিস্তৃত পথ ও পথের ইশারা। সঙ্গে জুটে যাচ্ছে ঝরাপাতার আপ্যায়নগুলো। বিষাদের সুরে লাগছে গোধূলির ঝিরিঝিরি দোলা। যেন মনপবনের আপনি পেখম মেলা। ছেঁড়া ছেঁড়া গ্রাম পেরোতেই আবার পিছুডাক। দূরে টিমটিমে সেই কৈশোরের আলো, আমাকে ডাকছে। ইশারার মধ্যে কেমন এক ঘোলাটে রঙ। আর ফিরে যেতে ইচ্ছা হয় না। এখন অন্ধকারকে বড় চেনা মনে হয়, আর বারবার মনে পড়ে – 

ফুল দিয়ে বড়ো সহজ বলানো মিথ্যা
মায়ারঙ তার ভণিতায় অভিষিক্তা
ফুলটুল নয়, জ্বালো আগুনের ফুলকি
আগুনের নেই প্রসাধনী রঙ
ছায়ার ঘোমটা আড়াল, বরং
পুড়ে খাক হয়ে জানাবে ঠিক কি ভুল কি।
(পল্লববরন পাল)

এই ঠিক ভুলের মধ্যেও যেন বারবার মনে হচ্ছে একা একা পুড়ে নিখাদ হচ্ছে সময়ের নীলাভতা। মেঘের কোল ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছে সন্ধ্যার দিকে। সঙ্গে চলেছে বৃষ্টি বৃষ্টি খোলা গায়ের নিবিড় কৈশোর। রোমান্স জাগে। ওকে কি তেমন চেনা চেনা লাগে! হয়তো না। তবু চেনা-অচেনার দোদুলে মনটা দুলতেই থাকে। এমন একটা ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ মনে হল বাইরে কি নিশীথ এসে দাঁড়ালো! না নিশীথিনী! সেকি বৃষ্টির সঙ্গে চোখাচোখি খেলছে! কবি ডাকলেন – কে? কে ওখানে? – নিরুত্তর। 

কবি আবার বললেন – কি ? তোমার চাই কি?

হিম হিম জ্যোৎস্নার মতো একটা ঠাণ্ডা হাওয়া জানলায় গলা বাড়িয়ে দিয়ে কী এক মায়াময় কণ্ঠে হাসতে হাসতে বললো – তোমায় দেখতে এসেছি গো!

কবি আবার বললেন – কেন?

সে চুপ করে থাকে। বৃষ্টি এসে জড়িয়ে ধরছে তাকে। এক মহামিলনের দৃশ্য ভেসে ওঠে।

কবি ভাবছেন – নক্ষত্রের সঙ্গম।

কবি নিজের সঙ্গে কথা বলতে বসেন। কথোপকথন চলতেই থাকে। যতক্ষণ কথারা জীবিত ততক্ষণই সত্তার আলোড়ন। আমাদের নিজের মধ্যে নিজের বেঁচে থাকা। দূর থেকে একটা বাঁশির সুর ভেসে আসছে অন্ধকারের পাতা সরিয়ে। আমি কান পেতে থাকি, যেন বাঁশিটি বলছে – 

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না?

তাঁকে দেখার জন্যে চোখছুট দৃষ্টির বুলেট গিয়ে বিঁধলো হাওয়ায় ওড়া আঁচলের বুকে। চেয়ে থাকার বয়স বাড়তে বাড়তে একঢাল ঘনচুল অরণ্য আর বাউলপনার গল্প নিয়ে বসলো। ‌ঝাউ ঝিরঝির পাতার কাব্যে সুর বসবে কি বসবে না ভাবতে ভাবতে সুজাতার পায়েস হাতের উপর গড়িয়ে লজ্জাবতী লতার মতো জড়িয়ে ধরলো উৎসর্গ। গাছকোমরে ঝনঝন করে উঠলো বন্ধ ঘরের চাবির তোড়া। এই বুঝি তিমিরঘন অন্ধকার কেটে নক্ষত্রের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে পৃথিবীর নরম শুশ্রূষা! নাহলে…!

এখানে স্রষ্টার আর কোনও ভূমিকা নেই। সৃষ্টিই নিজের হাতে তুলে নিয়েছে সংসারের নিয়মবিধি, কিছুটা নিয়তি। নিজের অস্ত্রে নিজেই কেটে কেটে ফালাফালা করছে ইতিহাস, ইতিহাসের পদাবলি। পদে পদে যার এলানো খোঁপার মতো পড়ে রইলো শব্দের অনুভূতি। সংকোচের কোনও বিহ্বলতা নেই। ঊরুতে বাজছে অনতিদূরের সন্ধ্যাতারা। সারা শরীরে নূপুর বাজিয়ে ফিরে যাওয়া সেই একই গোধূলি। স্বর্ণচাঁপা রঙের আদর জমা হচ্ছে পদ্মপাতায়। লগ্ন আসন্ন। এরমধ্যেই শুরু হবে আমাদের বিবাহপর্বের ইহকাল পরকাল। আপনার কিন্তু আসা চাই-ই চাই। না এলে…!

নীরব নিঃসঙ্গতার মধ্যে আমাদের সেই আবার একা হয়ে পড়া। একান্তের কত বিচিত্র কাহিনি।

0 comments: