8

ইতিহাসের কথা ইতিহাসের কাহিনি - অভীক মুখোপাধ্যায়

Posted in

কালিদাস, আপনাকে খুব মনে পড়ে



মাঝেমধ্যেই কালিদাসকে মনে পড়ে যায়।

কোন কালিদাস?

কোন কালিদাস আবার? কালিদাস বললে যে একজনকেই বোঝায়!

মহাকবি কালিদাস?

হ্যাঁ। মেঘদূত-এর রচয়িতা কালিদাস। অভিজ্ঞানশকুন্তলম্-এর প্রণেতা কালিদাস। রঘুবংশ-এর কাব্যকার কালিদাস।

উনিই তো চিদগগনচন্দ্রিকা-এর অভিলেখক ছিলেন, তাই না?

একদম সঠিক। পরম শৈব এবং মহাকালের স্থিরভক্তিযোগের প্রতিপাদক কালিদাস।

কালিদাস মহাবিখ্যাত। তাঁর কাব্যরসের স্বাদ নেওয়ার সাধ আম জনতার একটা বড় অংশের মনে থাকলেও সাধ্য নেই। তবুও তিনি আলোচনার বিষয়বস্তু। শিক্ষনীয় এক চরিত্র। হাইটেক জমানায় মা-বাবারা কালিদাসের কিংবদন্তী নিয়ে নিজেদের ছেলেপুলেদের কাছে গল্প বলেন কিনা জানা নেই, আমাদের বাপ-মায়েরা তো বলতেন।

লোকশ্রুতিতে একটা নির্ধারিত স্থান আছে কালিদাসের। বোকা কালিদাসের। বোকা থেকে ঘষটে ঘষটে বুদ্ধিমান হয়ে ওঠা কালিদাসের। এ-ই তো জীবন—সারল্য হারিয়ে চাতুর্যের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া মানেই সাফল্য।

কিন্তু আমার কালিদাসের কথা এত বেশি মনে পড়ে কেন? সে কথা বলতে গেলে কুমারদাসের গল্পটাও বলতে হয়। অনেকেই হয়তো জানেন। তবুও মনে যখন পড়ছে, তখন আরেকবার ঝালিয়ে নিই।

কে কুমারদাস?

বলা হয় যে সিংহল দ্বীপের, এখনকার শ্রীলঙ্কার, তৎকালীন (কালিদাসের সময়ের) শাসক ছিলেন কুমারদাস। তিনি নিজে একজন কুশল-কবি ছিলেন। এবং ছিলেন মহাকবি কালিদাসের পরম মিত্র।

কুশল-কবি? কবি আবার কুশল হয় নাকি?

এ কেমন শব্দ-ব্যবহার হল? কুশল শব্দটার দুরভিসন্ধি দেখে মাঝে মাঝে আমি নিজেও চমকে উঠি। লিখতে-লিখতে আঙুল সরে না, সত্যিই তো—কবি কখনও কুশল হয় কি? এমন কথা কখনও শুনেছেন?

কুশল শব্দের এক অর্থ, আর কবিতা লেখা অন্য এক বিষয়। একেবারে পৃথক।

বৈদিককালে একজন ছাত্র যখন গুরুকুলে অন্ত্যেবাসী থেকে পড়াশোনা করত, তখন কুশাসনে বসার প্রচলন ছিল। এবার চলে আসা যাক সেই কুশের আসন তৈরি কথায়। তা তৈরি করতে যে কষ্ট ভোগ করতে হতো তা বলে বোঝানো মুশকিল।

আগে জোগাড় করতে হতো কুশ। আর কুশ জড়ো করার সময় আঙুলের ডগাগুলো ভয়ানক ভাবে ক্ষতবিক্ষত হতো। কাঁটামুখগুলো খুঁজে খুঁজে ঠিক বের করে নিত ত্বকের নীচে থাকা রক্তজালিকাদের ঠিকানা। 

কিন্তু যে ছাত্র কুশ তোলার সময় আহত না-হয়ে কুশাসন বানিয়ে ফেলতে পারত, তাকে দেখে গুরুরা ধন্য ধন্য করতেন। বলতেন—‘তুই, খুব কুশল ছাত্র!’

দেখুন বন্ধু, কোথা থেকে কীভাবে উৎপন্ন হয়ে আজ একটি শব্দ কোথায় এসে পৌঁছে গেছে। আজ একজন কবিও কুশল, একজন বাচিক শিল্পীও কুশল, একজন লেখকও কুশল আবার একজন যোদ্ধাও কুশল। 

যাই হোক, আমরা বলছিলাম কুশল-কবি কুমারদাসের কথা।

তিনি সিংহল দ্বীপের নিবাসী ছিলেন। লিখে ফেলেছিলেন ‘জানকীহরণ’-এর মতো যশস্বী একটি মহাকাব্য।

তাঁর এক প্রেমিকা ছিল। সে ছিল গণিকা। তার নাম কামিনী। প্রণয় পর্ব চলছিল দুজনের। কামিনী জিজ্ঞেস করল—‘কুমার, আপনি আমাকে বিয়ে কবে করছেন?’

এই প্রশ্নের উত্তর কুমার মুখে দিলেন না। খসখস করে লিখে দিলেন একটি সংস্কৃত শ্লোকের প্রথম দুটি পঙক্তি—‘নাও। এই শ্লোকটাকে যেদিন পূর্ণ লিখে আনতে পারবে, আমি সেদিনই তোমাকে বিয়ে করে নেব।’

কথা শেষ করে কুমারদাস আর সেখানে অপেক্ষা না-করে নিজের মহলে ফিরে এলেন। কামিনী তখন সেই কাগজখানা হাতে নিয়ে চিন্তায় মগ্ন। কামিনীর মা রাজাম্মা মেয়ের এমন বিভোর দশা দেখে জানতে চাইলেন—‘কী হয়েছে, কামিনী? মন এমন উচাটন কেন?’

কামিনী সব কথা মা’কে জানাল। উপায় বলতে বলল।

রাজাম্মা বললে—‘কুমারদাসের লেখা এই শ্লোকটাকে পূর্ণ করার ক্ষমতা একজনেরই রয়েছে। তিনি হলেন কালিদাস।’


কামিনীর এবার কালিদাসের শরণাগত হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না। সে সঙ্গে সঙ্গে কালিদাসকে পত্র লিখল—

হে মহাকবি,

আপনিই তো যক্ষ – যক্ষিণীর বিরহ বেদনার কথা কুবেরের সামনে রেখেছিলেন। আপনিই প্রেমের দূত রূপী মেঘকে পাঠিয়েছিলেন। আপনিই আপনার কাব্যে অজ-ইন্দুমতী, দুষ্মন্ত-শকুন্তলা, অগ্নিমিত্র-মালবিকা আর হর-পার্বতীর মিলন ঘটিয়েছেন। দয়া করে পত্রে লেখা শ্লোকটিকে পূর্ণ করে কামিনী-কুমারদাসের মিলন ঘটিয়ে দিন। এর জন্য আমি আপনাকে সিংহল দ্বীপে আমন্ত্রণ করছি।

আপনার অপেক্ষায় রইলাম। 

ইতি— কামিনী। 


কামিনীর পত্র পাঠ করা মাত্রই কালিদাসের মনে পড়ে গেল যে তাঁর বন্ধু কুমারদাসও আগেই বহুবার তাঁকে সিংহল দ্বীপে যাওয়ার জন্য সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কালিদাস এবারে রওনা দিলেন। 

কালিদাস সিংহল দ্বীপে পা-রাখলেন বটে, কিন্তু কুমারদাসকে তা জানালেন না। এখন কুমারদাসকে চমক দেওয়া নাকি কামিনীকে সাহায্য করাই তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল একথা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।

প্রথমেই গেলেন কামিনীর বাসগৃহে। কিছুক্ষণে মধ্যেই শ্লোক সম্পূর্ণ করে দিলেন। তারপর কুমারদাসের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা বললেন। 

কুমারদাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা তুলতেই রাজাম্মার মনে শঙ্কা দেখা দিল। যদি কালিদাস গিয়ে কুমারদাসকে বলেন যে এই শ্লোক তিনিই সম্পূর্ণ করেছেন, তাহলে বিয়ে তো দূরে থাক এবার হয়তো কুমারদাস তাঁদের মহাদণ্ডে দণ্ডিত করবেন।

তাহলে উপায়?

কুটিল রাজাম্মা উপায়ও বের করলেন। কালিদাসের মুখ চিরতরের জন্য বন্ধ করে দিতে হবে। তাঁর মরণ চাই।

আপ্যায়ণের সময় কালিদাসের পেয় তক্রে মিশিয়ে দেওয়া হল কালকূট বিষ। বিষের তেজে কালিদাসের মৃত্যু ঘটল।

তবে রাজাম্মা এসব চক্রান্ত করলেও কামিনী কিন্তু তা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি। তাই যখন সে সবকিছু জানল, তখন গ্লানিতে আর থাকতে না-পেরে সে-ও ওই একই পানীয়ের বাকিটুকু পান করে মৃত্যুকে বরণ করে নিল। 

খবর এসে পৌঁছল কুমারদাসের কানেও। সিংহল দ্বীপের শাসক কুমারদাস অবসাদে আত্মদাহ করে বসলেন।


এই জন্যই কালিদাসকে বড় মনে পড়ে। আমার মন নিজেকেই প্রশ্ন করে:কালিদাসের মৃত্যুর জন্য তাহলে কে দায়ী ছিল?

এক, কালিদাস নিজেই দোষী ছিলেন। তিনি নিজের বন্ধুকে না-জানিয়ে সিংহল দ্বীপে গিয়ে নিজের সঙ্গেই একটা গুরুতর অপরাধ করেছিলেন। তাঁকে প্রথম আতিথেয়তা করার অধিকার এক এবং একমাত্র কুমারদাসেরই ছিল।

দুই, রাজাম্মার মতো অপরাধীর কথা অস্বীকার করার জায়গাই নেই। সে একজন হত্যাকারী ছিল।

তিন, এবং সম্ভবত সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল কালিদাসকে নাকি তাঁর স্ত্রী বিদ্যোত্তমা অভিশাপ দিয়েছিলেন। 

কোন অভিশাপ?

কালিদাস নিজের মহাকাব্য ‘কুমারসম্ভব’-এ শিব আর পার্বতীর সাংসারিক ভোগ বিলাসের কথা লেখায় বিদ্যোত্তমা বলেছিলেন—‘আপনি যখনই কোনো নারী-পুরুষের প্রেমের জন্য নিজের লেখনী এবং মেধার ব্যবহার করবেন, তখন তা আপনার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’

এই অভিশাপের নিদান বের করার জন্যই নাকি তিনি ‘রঘুবংশ’ রচনা করেন, কিন্তু পতিব্রতা নারীর অভিশাপকে নষ্ট করতে পারেননি। যদি সেদিন শাপ নষ্ট হয়ে যেত, তাহলে কামিনীর পত্র পেয়ে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠতেন না। 

মন আর মস্তিষ্কের মধ্যে কালিদাস সর্বদাই মনকে প্রাধান্য দিয়েছেন। অভিজ্ঞানশকুন্তলম্-এ তিনি লিখেছেন—‘সন্তা হি সন্দেহপদেষুবস্তুষু, প্রমাণমন্তঃকরণপ্রবৃত্তয়ঃ’। মানেটা দাঁড়ায়— জীবনে যখনই সন্দেহাস্পদ অবস্থা সৃষ্টি হবে, তখন মনের কথা শোনাই ভালো। 

আর এভাবেই, হ্যাঁ এভাবেই হৃদয়ের কথা শুনে তিনি কামিনী-কুমারদাসের মিলনের জন্য চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর প্রবেশদ্বারও পেয়ে গেলেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। 

রাজাম্মাকে হত্যাকারী হিসেবে কারাগারে বন্দি করা হয়েছিল। সে হয়তো বলেছিল—‘আমরা কালিদাসের কথা বলি, বলবও। কোথাও কুমারদাসের কথা এলে কিংবা কালিদাসের মৃত্যুপ্রসঙ্গ উঠলে কুমারদাসের কথাও হয়তো বলব। কিন্তু কালিদাসের মৃত্যু নিয়ে কি বিদ্যোত্তমা বা কামিনীর কথা উঠবে?’

সত্যিই তো, কিছু প্রশ্ন অনুত্তরিত থাকলেই ভালো হয়, যেমন সাপের ফণাকে যতক্ষণ অবধি স্পর্শ না-করছেন, ততক্ষণ অবধি তাকে দেখতে সুন্দর লাগে। তাই না?

8 comments:

  1. একটা নতুন ইতিহাস জানতে পারলাম তো...

    ReplyDelete
  2. Abaro samridho holam tomar lekha pore.. Dhanyobad bandhu.. Anek ajana tathyo janye pari tomar lekhay.

    ReplyDelete
  3. জাস্ট অসাধারণ একটা লেখা... খুব ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে... কালিদাস কে নিয়ে খুবই ইন্টারেস্টিং একটা ইতিহাস নির্ভর লেখা পড়লাম... খুব সমৃদ্ধ হলাম এটা পড়ে, অনেক অজানা জিনিস জানতে পারলাম...

    ReplyDelete
  4. অনেক অজানা জিনিস আবারো জানতে পারলাম

    ReplyDelete
  5. ভালো লাগলো অভীক।

    ReplyDelete
  6. কত কী জানার বাকি আমাদের

    ReplyDelete