0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in


পর্ব - 

ভারতী পত্রিকায় 'বড়দিদি'র প্রকাশের পর শরতের নাম এখন কলকাতার সাহিত্যিক মহলে একটু আধটু গুঞ্জনের মত ভেসে বেড়াচ্ছে। অবশ্য কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাড়া তাঁর আসল চেহারাটার সাথে যদিও সারস্বত সমাজ এখনো পরিচিত নন মোটেও। অনেকেই মনে করেন 'শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়' আসলে রবীন্দ্রনাথ বা ঠাকুর পরিবারের কোন কৃতী সাহিত্যসেবীরই ছদ্মনাম। ভিন্ন স্বাদের গল্প লেখার একটি মহৎ প্রচেষ্টা মাত্র। সবার চোখের আড়ালে থেকেও বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে নিয়মিত পাওয়া চিঠিতে এইসব উদ্ভট খবরে শরৎও নিজে বেশ মজা পান। এরই মধ্যে যমুনা পত্রিকার ফণিবাবু আর ভারতবর্ষ পত্রিকার উপদেষ্টা প্রমথনাথের সাথে শরতের বেশ সখ্যতা হয়েছে। বেশ কয়েকটি গল্প ও উপন্যাস যথাক্রমে এই দুটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। পাঠকপাঠিকা মহলেও শরৎের লেখা নিয়ে ধীরে ধীরে ঔৎসুক্য বাড়ছে। দু একটি রচনা তার মধ্যে আবার পুস্তক আকারেও প্রকাশ পেতে চলেছে। তাদের কাটতিও নেহাৎ খারাপ হবে বলে মনে হয় না। 

শরৎ অবশ্য নিজের সাহিত্যসাধনার ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি দ্বিধায় থাকেন সর্বদাই। নিজের প্রিয় কাজটি এখন লেখালেখি হলেও তার থেকে আয় আপাতত অনিয়মিত। অথচ অফিসের দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে একটা স্থায়ী বেতন আছে। দেশে বিধবা মা ও ভাইবোনদের পরিচর্যার জন্য সেই অর্থটিকে উপেক্ষা করার মত স্বচ্ছল এখনো তিনি নন। এরকমভাবেই আরো কয়েকবছর দু নৌকায় পা দিয়েই চলতে হবে তাঁকে এই যা একমাত্র আক্ষেপ। 

রবিবার দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে লেখার টেবিলে এসে বসলেন। কদিন ধরেই একটা লেখা মাথার মধ্যে ঘুরছে, কিন্তু শুরুটা ঠিক মনোমত হচ্ছে না বলে কয়েকটি দোমড়ানো কাগজ মাটিতে এদিক ওদিক পড়ে আছে। চুরুটটা একমনে টানতে টানতে যন্ত্রচালিতের মত কলমটা তুলে নিয়ে কাগজের ওপর ধরলেন। হঠাৎ যেন ভূতে পেল তাঁর অতি পছন্দের শেফার্স কলমটিকে। তরতর করে কলমটি কাগজের ওপর এক অনাস্বাদিত আবেগের বর্ষণ করে তাঁর এতদিনকার ভাবনাটির সেই কাঙ্খিত সূচনাটি করল। 

শরৎ লিখতে শুরু করলেন তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃজিত উপন্যাসটি যেটিতে কোথাও প্রচ্ছন্ন আবার কোথাও প্রকট হয়ে রইলেন স্বয়ং স্রষ্টাই। 

"আমার এই 'ভবঘুরে' জীবনের অপরাহ্ন বেলায় দাঁড়াইয়া ইহারই একটা অধ্যায় বলিতে বসিয়া আজ কত কথাই না মনে পড়িতেছে..."

গল্পের চরিত্র আর লেখকের যখন সামনাসামনি হঠাৎ দেখা হয়ে যায়,তখন আর তা নিছক খেয়ালের সৃষ্টিতে আটকে থাকে না। আত্মপরিচয়ের সাথে ঘটে শিল্পের সুচারু মেলবন্ধন। 

'শ্রীকান্তর ভ্রমণকাহিনী' ভারতবর্ষ পত্রিকায় একটি মাইলফলক হিসাবে চিহ্নিত হল। বাংলা সাহিত্যে এতদিনে ঠিকমত ভাবে এল চিরদিনের 'শরৎ'কাল। সুদূর কলকাতার সারস্বতসমাজ তাঁকে যেন পুনরাবিষ্কার করল এখন। 

এরই মধ্যে দুটি ঘটনা শরৎের জীবনে একটা বিরাট বদল আনলো। হঠাৎ প্লেগরোগটি মহামারীর মত রেঙ্গুনে ছড়িয়ে পড়ল। শরৎের সাহিত্যচক্র, অফিস, বন্ধুবান্ধব সবই অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। আস্তে আস্তে গোটা শহর একটা পরিত্যক্ত নরকের মত বীভৎস হয়ে উঠেছে। মণীন্দ্র এখন বাসা বদল করে একটু দূরে চলে গেছে। অগত্যা সুরেশ, মহিম আর কয়েকজন সঙ্গী জুটিয়ে শরৎ আর্তের সেবায় নামলেন। হোমিওপ্যাথির বিদ্যাটা এখন কাজে লাগছে খুব। কোথাও কোথাও রোগাক্রান্ত মানুষটিকেই হয়তো ত্যাগ করে চলে গেছে তার পরিবার,তেমন অনেকেরই অন্তিম সময়ে হয়তো শেষ জলটুকুই দিতে পেরেছেন শরতরা। 

বোটাটং পোজুংডাং এলাকাটি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তশ্রেণীর লোকের ভীড়ে ঠাসা। এটি বর্মী, চীনা ও মালয়ী শ্রমিক ও মিস্ত্রী প্রধান এলাকা বলে এখানে জিনিসপত্রের দাম একটু সস্তা। কয়েকঘর বাঙালির সাথে শরৎ নিজেও এ পল্লীরই বাসিন্দা। বিস্তীর্ণ এলাকাটিতে প্রতিদিনই কাতারে মৃত্যু হচ্ছে মানুষের আর সরকারী গণচিতার অনির্বাণ অগ্নিতে হচ্ছে তাদের দলবদ্ধ সংস্কার। মৃত্যুর এই অবহেলিত রূপ শরৎ আগেও দেখেছেন অনেক। তাই আর নতুন করে আহত হননা ঠিকই তবে বুকের মধ্যে হাহাকারটা ফুকরে ওঠেই। 

দা'ঠাকুর বলে এখন একটা পরিচিতি হয়েছে সেটাএই চিকিৎসার সুবাদেই। প্লেগের প্রাদুর্ভাব কমে আসতে লোকজন আবার শহরমুখী হল। নীচের ঘরের ভাড়াটে মাদ্রাজী ছেলেটি প্লেগের দরুণ ঘর ছেড়ে চলে গেছে। এবার সেখানে থাকতে এল একটি মাঝবয়সী বাঙালি মিস্ত্রি ও তার সতের বছরের মেয়ে শান্তি। যজ্ঞেশ্বর মানুষটি ঘোর মদ্যপ। তার বন্ধুবৃত্তটিও সুবিধার নয়। রাতবিরেতে মাতালের হল্লা শরৎকে বিব্রত করে যদিও তবু ভদ্রতায় কিছু বলতে বাধে। তেলের কোম্পানি সামান্য মজুরিতে যা সাংঘাতিক খাটানি খাটায় অস্থায়ী মিস্ত্রিদের তা বলার নয়। সেই হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর যদি একটু নেশা করলে ক্ষণিকের স্বর্গবাস সাধিত হয় তাতে শরৎ বাধা দেওয়ার মত নীতিবাগীশ নন। কিন্তু ভয় হয় উঠতি বয়সের শান্তির জন্যই। আর সে ভয় যে একদম অমূলক নয় তার প্রমাণ পেলেন কদিন পরেই বিধাতার কোনো এক অলীক খেয়ালেই। 

একদিন রাত্রে ঘরে ঢোকার সময় মেয়েটি তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়লো। তার বাপ নেশার জন্য টাকা ধার করেছিল বৃন্দাবন ঘোষালের থেকে। নির্দিষ্ট সময়ে তা শোধ না করতে পারায় বৃন্দাবনকে বিয়ে করার জন্য তাকে রোজই মারধর করছে তার বাপ। এদিকে আজ মদ্যপ অবস্থায় বৃন্দাবন শান্তির ওপর চড়াও হতেই সে কোনওমতে বাড়ি ছেড়ে বেরোতে গিয়েই শরৎকে সামনে পেয়ে এ বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করতে আর্তি জানায়। পিছনে দুই মাতালের বচসা ক্রমে উচ্চগ্রামে পৌঁছোয়। শরৎের তখন সেই চকমানিকপুরের সাবিত্রীর কথা আবার মনে পড়ে যায়। যজ্ঞেশ্বরকে বোঝাতে বসেন মা মরা শান্তির এভাবে সর্বনাশ না করতে আর ঘোষালের সাথে মেয়ের বিয়ে না দিতে। সে লম্পট ও মদ্যপ। যজ্ঞেশ্বর অকপটে জানায় সে গরিব, এর চেয়ে ভাল পাত্রের সংস্থান করতে সে অপারগ। তখন শরৎই তাকে আশ্বস্ত করেন সুপাত্রের বন্দোবস্ত তিনিই করবেন না হয়। 

আসলে শান্তির বিপদটি তাঁর বুকে বাজে। অনেক চেনাশুনো বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে শান্তির জন্য পাত্রের সন্ধান করলেন। শুধুমাত্র গরীব বলে আর বংশকৌলীন্যের অভাবে একটি অসহায় নারীকে আর চোখের সামনে এভাবে মরতে দেবেন না তিনি। সেই রাতের শান্তির হরিণচোখে আশ্রয়প্রার্থনার আর্তিটুকু যে কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। অবশেষে নিজেই মনস্থির করলেন শান্তিকে বিবাহের। 

কোন বৈভবময় ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াই শান্তিকে স্ত্রীর পূর্ণ মর্যাদা দিয়েই গ্রহণ করলেন শরৎ। এদিকে মিস্ত্রিপল্লীর এক নীচ বংশীয়া মেয়েকে হঠাৎ এমন বিবাহের খবরে কুৎসিত গুজব আর কদর্যতার পাঁক ঘুলিয়ে উঠতে দেরী লাগলো না এই সুদূর বিদেশেও। পরিচিত অনেকেই তাতে সংশ্রব ত্যাগ করল তাঁর। কিন্তু শরৎ যে চিরদিনই অন্যধাতুতে গড়া। 

শান্তির সুচারু গৃহিণীপনার অনুপম সৌন্দর্যের পরশ শরতের এতদিনকার নারীবর্জিত ভবঘুরে বাউন্ডুলের জীবনে একটা সাময়িক ইতি টানল।

0 comments: