0

প্রবন্ধ - শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী

Posted in



২৩শে এপ্রিল, ১৯৯২। কলকাতায় বাংলা চলচ্চিত্র জগতে ইন্দ্রপতন। প্রয়াত সত্যজিৎ রায়। তার কিছুদিন আগেই তিনি ভূষিত হয়েছেন লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অস্কারে। এর পর পরই তৎকালীন ভারত সরকার তাঁর হাতে তুলে দেয় ‘ভারত রত্ন’; হাতে তুলে দেয় বলা ভুল, কারণ সত্যজিৎ ততদিনে একপ্রকার কোমায়। অতএব, তাঁর অজ্ঞাতেই তাঁকে ভূষিত করা হয়। এত অব্দি এসে যদি ব্যাপারটি থেমে যেত, তাহলে আজ আমার এই প্রবন্ধটি লেখার সুযোগ হতো না, প্রয়োজনও পড়তো না। কিন্তু, ‘ভারত রত্নে’ থেমে না থেকে সরকার বাহাদুর সত্যজিতের মৃত্যুর পর তাঁকে সম্মানিত করলেন ‘ভারতীয় রেনেসাঁর শেষ প্রতিনিধি’ উপাধিতে।

কাট টু ১৫ই মে, ১৯৯২। দিল্লীতে আয়োজিত হয়েছে একটি সেমিনার, সত্যজিতের উপর; সাহিত্য, সঙ্গীত নাটক, এবং ললিত কলা অকাদেমির যুগ্ম পরিচালনায়। এই মুহূর্তে বক্তব্য রাখছেন স্বনামধন্য নাট্যকর্মী এবং চলচ্চিত্রাভিনেতা উৎপল দত্ত। তাঁর বক্তব্যটির শিরোনাম ছোট একটি প্রশ্ন, ‘Ray, Renaissance Man?’ বক্তব্যের শুরুতেই নিজের স্পষ্টভাষে উৎপল বাবু প্রশ্ন রাখছেন, সত্যজিতকে যে ভারতীয় রেনেসাঁর প্রতিনিধি বলা হল, এই ‘ভারতীয়’ রেনেসাঁ শুরু হয়েছিল ঠিক কবে? বা এই ‘ভারতীয়’ রেনেসাঁ আর কোন কোন ক্ষেত্রে ঠিক দেখা যেতে পারে? হয়তো রাম মন্দির – বাবরি মসজিদ কাজিয়াতে রেনেসাঁ বাস করে? বা রাজস্থানে কোনও বিধবাকে জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়াতে? বা নিদেনপক্ষে আমাদের দারিদ্র ও অশিক্ষা তার মুকুট? 

প্রবন্ধের মূল বিষয়ে প্রবেশ করার মুখে এই অবতারণাটুকুর প্রয়োজন ছিল। আমার এই আলোচনা কথা বলবে উৎপল বাবুর উপরোক্ত ওই সন্দর্ভটি নিয়ে। তাঁর ক্ষুরধার উইট এবং শ্লেষ দিয়ে উৎপল দত্ত একটি সরকারি আলোচনাসভার মধ্যেই আক্রমণ করেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারকে, সত্যজিৎ বিষয়ে। যদিও তাঁর এই ভাষণের মূল প্রেক্ষিত ছিল সত্যজিতের মৃত্যুপরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘শ্রদ্ধাজ্ঞাপন’, সামগ্রিকভাবে বক্তব্যে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে –

১। ভারতীয় চলচ্চিত্র ও শিল্পমাধ্যম বিষয়ে সরকারি উদাসীনতা

২। ‘ভারতীয় রেনেসাঁ’ কথাটির অপ্রাসঙ্গিকতা

৩। সত্যজিতের ছবিতে যে বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা যায়, তাদের আদৌ ‘রেনেসাঁ-ফিচার’ বলা যায় কিনা।

বলাই বাহুল্য, উৎপল বাবুর পুরো আলোচনাটিই সত্যজিৎ রায়কে কেন্দ্র করে। আমার প্রবন্ধটি সেই ভাষণের একটি পাঠ বলতে পারেন। উৎপল দত্তের বক্তব্যটি কেবল একটি সেমিনারের পেপার হয়েই থেকে যাবে, এতে আমার বিশেষ আপত্তি। আজকের দিনেও শিল্পচর্চায়, চলচ্চিত্রপাঠে, এবং সর্বোপরি, সত্যজিৎ রায়ের চর্চায় আমরা যারা নিযুক্ত, তাদের কাছে সহজ ভাষায় এই আলোচনাটি ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন বোধ করেছি, তাই লিখছি। 

নিজের জীবনের শেষদিকে একটি সাক্ষাৎকারে ভারতীয় দর্শক এবং সাধারণ জনমানসে তাঁর ছবির প্রতি যে মনোভাব, তা নিয়ে হতাশার সুর শোনা গিয়েছিল সত্যজিতের কণ্ঠে। নিজের দেশে সম্মানিত হওয়া থেকে সত্যজিৎ বরাবরই ব্রাত্য ছিলেন। কলকাতা বা বিভিন্ন বড় শহরে তাঁর ছবির মুগ্ধ দর্শক যথেষ্টই ছিলেন বটে, বিভিন্ন ফিল্ম সোসাইটি তাঁর ছবির প্রচার এবং তাঁকে ঘিরে উন্মাদনা দেখিয়েছে বটে, কিন্তু ভারতের মতো বিরাট দেশে তাদের পরিসর আর কতটুকু? বরং, সরকারের পক্ষ থেকে কোনও সম্মাননা, বা নিদেনপক্ষে তাঁর ছবিগুলিকে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার যে উদ্যোগ, তা কিছুই দেখে যেতে পারেন নি সত্যজিৎ। ভারতে এমন ইতিহাস নতুন নয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দশকেও রবীন্দ্রনাথ ব্রাত্য ছিলেন এই দেশে, এই বাংলায়। তবু বলা যায়, বিদেশে তাঁর নোবেল-প্রাপ্তি এই বঞ্চনার অবসান ঘটিয়েছিল। সত্যজিতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ইউরোপীয় পুরস্কারও – কান, ভেনিস, বার্লিনের প্রাপ্তি, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রদত্ত ডক্টরেট, ফ্রান্সের লিজিয়ন অফ অনর – কিচ্ছু করতে পারে নি। কারণ ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্করক্ষা বা প্রতিযোগিতায় ভারত সরকারের কোনও বিশেষ লাভক্ষতি নেই। এই সমীকরণ একমাত্র বদলাতে পারে আমেরিকা, এবং হয়ও তাই। অস্কার ঘরে আসার পরেই বদলে যায় দৃষ্টিভঙ্গি; বর্ষিত হয় ‘ভারতীয় রেনেসাঁর প্রতিনিধি’ এবং ‘ভারত রত্ন’। উৎপল বাবু কথাতেই বলি, “Men in coma cannot refuse awards”!

সত্যজিতের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে ভারত ও আমেরিকার মিল আরও একটি জায়গায় – তাদের দ্বিচারিতায়। চলচ্চিত্রে এবং চলচ্চিত্র-প্রদর্শনে বিখ্যাত দেশগুলির মধ্যে আমেরিকাই সম্ভবত একমাত্র দেশ, যা সত্যজিতের প্রায় কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজই সে’দেশের দর্শকদের দেখায় নি (অন্তত সে সময় অব্দি) ‘কমার্শিয়াল’ভাবে। বরং তাদের বোঝাপড়া খুব সহজ – ‘আমরা আপনার কদর করি, সম্মাননাও জানাচ্ছি। তবে আপনার কাজের বিশেষ প্রয়োজন নেই এখানে। এবার আসুন।’ রাজনৈতিক ও সামাজিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ উৎপল বাবুর মতো শিল্পী যাকে ‘trash’ বলছেন, আমেরিকার জনসাধারণও খাচ্ছে সেসবই। অস্কার আসছে সেই বিরাট পপুলিস্ট ফিল্মের বাজারের তুলনায় খুবই ছোট একটি সংস্থা থেকে। 

ভারত সরকারও সে’ সময়ে এই ধরণের ‘শ্রদ্ধা’ প্রদর্শনে প্রায় অজাতশত্রু। এদিকে ‘ভারত রত্ন’, ‘নবজাগরণের প্রতিনিধি’; ওদিকে ‘সিকিম’ ছবিটি ব্যানড তখনও। সত্যজিৎ প্রয়াণে সরকারি টিভি চ্যানেলে তাঁরা সত্যজিৎ-নির্মিত ছবি দেখিয়ে যে অঞ্জলির ব্যবস্থা করলেন, তাতেও পদে পদে ডায়ালগ কাটা, সিন উড়িয়ে দেওয়া। ‘তিন কন্যা’ হয়ে গেল ‘Two Daughters’, ‘ঘরে বাইরে’র বহু সংলাপ একধারসে বাদ। এবং আরও মজার, সরকারের পক্ষ থেকে ‘সদ্গতি’র স্ক্রিনিং বন্ধ করতে চাওয়া হয়েছিল, কারণ ছবিতে নাকি বহুবার ‘চামার’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। মনে পড়ে যায় বার্নার্ড শ’য়ের কথা, যিনি বেচারা তাঁর একটি নাটকে ‘bloody’ শব্দটি ব্যবহার করায় নীতিবাগীশ ইংরেজ মঞ্চে নাটকটি প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় ছিল ব্যানড ছিল। ‘সদ্গতি’র ‘চামার’ নিয়েও ভারত সরকার প্রেমচন্দ এবং সত্যজিৎ, দুজনেরই উপর দিয়ে যাচ্ছিলেন প্রায়। কাজেই ব্যক্তিপুজা, অথচ সেই ব্যক্তির কাজের প্রতি ঔদাসীন্য, এমনকি বিরুদ্ধতা – এ’ই বারবার পরিলক্ষিত হয়েছে আমাদের দেশে। এখনও অবস্থা পাল্টেছে কি? 

সত্যজিতের সঙ্গে সরকারের এই সংঘাত খুব নতুন কিছু নয় অবশ্য। ১৯৫৫ সালে ‘পথের পাঁচালী’র প্রিমিয়ার দেখতে এসে এক সরকারি একজেকিউটিভ সত্যজিতকে তাঁর উদ্বেগ জানিয়েছিলেন, ভারতের এই দারিদ্র বিদেশে দেখালে আপনার আবার শেষটায় সম্মানহানি হবে না তো? সত্যজিতের উত্তর ছিল, যদি দেশের এই দারিদ্র সহ্য করতে আপনার কোনও সম্মানহানি না হয়ে থাকে, তাহলে তা দেখাতে আমার সম্মানহানির কোনও প্রশ্নই নেই। সত্যজিতের সামাজিকভাবে সচেতন ছবিগুলিকে সরকারের পক্ষ থেকে এর পরেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি দেশের বিভিন্ন চ্যানেলে, সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার। শুধু সত্যজিৎ কেন, প্রায় কোনও সচেতন পরিচালকই সেই সমাদর পান নি যা পেয়েছে বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ‘হিট’ ছবিগুলি, ‘মেনস্ট্রীম’ ছদ্মনাম নিয়ে। যে-কোনো উঠতি পরিচালকের ক্ষেত্রেই সরকার সমান ‘উদারতা’য় বলেছে, তিনি স্বাধীনভাবে বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে পারেন, কোনও বাধা নেই। কিন্তু এই উদাসীন উদারতাই যে মূল বাধা, প্রযোজনা থেকে শুরু করে প্রচার থেকে হলে এবং টিভি চ্যানেলে জায়গা পাওয়া – সবেই যে সরকার পরাঙ্মুখ হয়ে থাকলে (এবং সেই ঔদাসীন্য ‘মেনস্ট্রীম’কে না দেখালে) প্রতিযোগিতা অসম হয়ে ওঠে, বলার অপেক্ষা রাখে না। 

প্রসঙ্গান্তরে, আমরা চলে আসি আমাদের আলোচনার দ্বিতীয় ধাপে – বস্তুত, যে অবান্তর একটি সম্মানসূচক শব্দবন্ধকে কেন্দ্র করে উৎপল দত্ত তাঁর এই বক্তব্য পেশ করেছিলেন, তাতে – ‘ভারতীয় রেনেসাঁ’। এটি একটি ‘মিসনোমা’। উৎপল বাবু তা-ই প্রমাণ করছেন, এবং সেই সূত্র ধরে আমরাও যদি একটু খতিয়ে দেখি, এই শব্দবন্ধের প্রাথমিক পরিসরই অত্যন্ত ঘোলাটে। সাহিত্য-শিল্পের সঙ্গে পরিচিত থাকার সুবাদে হয়তো আমাদের অনেকেরই মনে এই ধারণা জন্ম নেয়, যে ‘রেনেসাঁ’ ধারণাটি মূলতঃ এই বৌদ্ধিক পরিসরেই প্রযোজ্য। কিন্তু আদপে তা নয়। সমাজের বৌদ্ধিক বা শৈল্পিক পরিসরটি বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক খোলনলচে বদল ও নবজাগরণের একটি প্রকাশ মাত্র। উল্লেখ্য, ‘রেনেসাঁ’র মূলে থাকে একটি বৈপ্লবিক বুর্জোয়া শ্রেণীর ক্ষমতায় উত্থান, কুক্ষিগত ‘ফিউডাল’ ক্ষমতার অবসান এবং একটি গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি। রামমোহন-ডিরোজিও খ্যাত যে বিখ্যাত বাংলার নবজাগরণ, তাকেই ঐতিহাসিকরা একটা সময়ের পর রেনেসাঁ না বলে রিফর্ম মুভমেন্ট বলা শুরু করেছিলেন, কারণ ইংরেজ সরকার তাদের শাসনকালে বুর্জোয়ার উত্থান ঘটতে দেয় নি মোটেই ( সাধারণের যে উত্থান ইংল্যান্ডে দেখা যায় চার্চের একচ্ছত্র আধিপত্যের বিরুদ্ধে, সামাজিক তথা রাজনৈতিক পরিসরে, এবং শুধুমাত্র বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে নয়)। সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে তাই ‘রেনেসাঁ’ শব্দটি যে আরোই অপ্রযোজ্য, একধরণের ‘idle talk’, অন্ততঃ এই যুক্তিতে তা কিছুটা আন্দাজ করতে পারি আমরা। 

তবু, প্রশ্ন থেকেই যায় – বাংলার ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি সত্যজিতের মৃত্যুর পর তাঁর সূত্রে যে ‘রেনেসাঁ’র ব্যবহার করা হয়েছে, তার তো নিশ্চয়ই কোনও কারণ থাকবে। সেটি কী? উৎপল বাবু তাঁর আলোচনায় সন্ধানান্তে এই ধারণাতেই উপনীত হন, ‘রেনেসাঁ’র মধ্য দিয়ে হয়তো বা সরকার যে কাজটি সহজে সারতে চাইছিল, তা হল, সত্যজিতের এই বহুমুখী প্রতিভাকে এক কথায়, সহজে, একটি মাত্র বিশেষণে বেঁধে ফেলা। রেনেসাঁ’র এ হেন ব্যাখ্যা অজ্ঞতার ফসল হলেও, ভেবে দেখুন, খুব অসম্ভব নয় সাধারণ মস্তিষ্কের পক্ষে। সৃষ্টির, সৃজনশীলতার ঘূর্ণাবর্ত দেখলেই তাকে সর্বগ্রাসী একটা লেবেলে দাগিয়ে দিতে ‘রেনেসাঁ’র মতো মুখরোচক শব্দ মেলা ভার! আমরা নিজেদের অজ্ঞানতায় কতবারই এমন আলগাভাবে ‘রেনেসাঁ’র ব্যবহার করেছি, তাকে সম্যক না জেনেও। উৎপল দত্তের রাজনৈতিক, সামাজিক সচেতনতার সামনে অবশ্য সে গুড়ে বালি। 

সত্যি কথা বলতে, ‘রেনেসাঁ’র কোনও আংশিক প্রকাশ বা অভিব্যক্তি হয় না। হয় তা সামগ্রিক, না হয় তা নেই। পাশ্চাত্যের রেনেসাঁ আদর্শ মেনে ধর্মের কাঠগড়া ছেড়ে ব্যক্তিমানুষের স্বাধীন অভিব্যক্তিকেও যদি আমরা রেনেসা’র একটি খুঁটি হিসেবে ধরি, ভারতে আজও হয়ে চলা ধর্মীয় দলাদলি, কুসংস্কার, অন্ধ ভক্তির সামনে সে নিমেষে বানচাল হয়ে যায়, বাকি খুঁটির কথা তো বাদই দিলাম। কাজেই, সত্যজিতের প্রেক্ষিতে ‘ভারতীয় রেনেসাঁ’ শব্দবন্ধটি আমরা নির্দ্বিধায় সরিয়ে রাখতে পারি। 

পড়ে থাকে ব্যক্তি সত্যজিৎ পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলি। নিঃসন্দেহে সেগুলি ব্যক্তিমানুষকে আখ্যানের কেন্দ্রে রাখার (রেনেসাঁর একটি বৈশিষ্ট্য) কিছু উৎকৃষ্টতম নিদর্শন। ‘অপু ট্রিলজি’ হোক, বা ‘দেবী’র সেই নববধূই হোক, ‘জন অরণ্য’র সোমনাথ, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র সিদ্ধার্থ, ‘সীমাবদ্ধ’র শ্যামলেন্দু – যেই হোক, কেন্দ্রে ব্যক্তিমানুষ এবং তার ‘ফ্রী উইল’-এর একটি আভাস থাকে সত্যজিতের কাহিনীতে। অনেক সময়েই হয়তো সেই ‘ফ্রী উইল’ পরিহাসের বস্তু হয়ে ওঠে। এবং এখানেই সত্যজিৎ তাঁর চরিত্রদের সমাজবিচ্ছিন্ন স্বাধীন না দেখিয়ে সমাজব্যবস্থার ফসল, বা অনেক্ষেত্রে শিকার হিসেবেও দেখিয়েছেন। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার নিচে নিচে চোরাস্রোতের মতো সত্যজিৎ গড়ে তোলেন এক নিরবচ্ছিন্ন ‘পলিটিকাল ন্যারেটিভ’। ‘জলসাঘরে’ যেমন বিশ্বম্ভর রায়কে স্বাধীন একটি চরিত্র হিসেবেও পাঠ করা যায়, তেমনই পাঠ করা সম্ভব জমিদারী-শাসনের পতন ও নববিত্তবানদের উত্থান। ‘গণশত্রু’তে ইবসেনের মতো সত্যজিৎ তাঁর ডাক্তারকে গল্পের শেষে সমাজের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা একজন একাকী চরিত্র হিসেবে দেখান না; বরং কিছু মানুষ একজোট হচ্ছে তাঁর লড়াইয়ের সাথী হতে, তার আভাসই পাওয়া যায়। ‘শাখা প্রশাখা’র বিত্ত ও নীতির সংঘাত হোক, কি ‘আগন্তুক’এর সভ্যতার সংকট, মানুষ কোথাও একা বা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় সত্যজিতের চলচ্চিত্রে। আধুনিক সমাজের চিত্রকর হিসেবে একজন শিল্পীর দায়িত্ব ও কর্তব্য দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন সত্যজিৎ বারবার। 

নিজের সৃষ্টিতে মানুষের অবস্থা ও অবস্থানের বিষয়ে তাঁর যে সচেতনতা, তা নিঃসন্দেহে ‘হিউম্যানিস্ট’; তবে তাঁর দেশের বা সমাজের সামগ্রিক জাগরণের অভাবে ‘রেনেসাঁ’র মতো এক না-ঘটা আন্দোলনের প্রতিনিধি হিসেবে সত্যজিৎ রায়কে বাঁধা অমূলক, ভিত্তিহীন; এমনকি ‘রেনেসাঁ’ শব্দটির ভুল ধারণা ও প্রয়োগে হিতে বিপরীত হতে পারে – সত্যজিতের ছবিগুলি পরিণত হতে পারে মিউজিয়ামের শো-পিসে, বাঙালীর ‘নস্টালজিয়া’ পার্বণের একটি বিষয়। এমনটাই মনে করেছিলেন উৎপল দত্ত। তাঁর মতে, “Renaissance is an inadequate term for Ray. He was a moment in the conscience of man.” মানুষের বিবেকের চিরজাগ্রত একটি মুহূর্ত। 

(লেখাটির মূল সুত্রঃ উৎপল দত্ত রচিত ‘Ray, Renaissance Man?’ শীর্ষক ইংরাজি প্রবন্ধ; সীগাল থেকে প্রকাশিত ‘On Cinema’ বইটির অংশ।)

0 comments: