0

someপ্রতীক - রীতা পাল

Posted in

‘হাসির কথা শুনলে বলে হাসবো না না না না’ - আমি মোটেও এই প্রজাতির লোক নই। তাই বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতেও হেসে ফেলছি। 

বর্তমানের বিশ্ব করোনা বিপর্যয়ে বেশ কিছু মানুষ বলতে আরম্ভ করেছেন – সব খারাপেরই কিছু ভালো দিকও থাকে – লকডাউনের ফলে দূষণের মাত্রা অনেক কমে গেছে, আকাশ যে নীল তা নতুন করে উপলব্ধি করা যাচ্ছে, সর্বোপরি মানুষ তার পরিবারের সাথে ‘কোয়ালিটি টাইম’ কাটাতে পারছে। কথাগুলো শুনে আনন্দে আত্মহারা হওয়ারই কথা, কিন্তু আমার কেন জানি না মানুষের এ হেন বোধোদয়েও হাসি পাচ্ছে। 

‘আমার তো চব্বিশ গুণ সাত আর আমার স্ত্রীও তো দারুন ব্যস্ত – তাই বাচ্চাকে একেবারেই সময় দিতে পারি না’ – এ কথা বলতে এতোকাল যারা একটুও লজ্জা পায়নি, তারাই আজ ‘কোয়ালিটি টাইম’ কাটানোর জয়গান গাইছে। আসলে প্রকৃতি মানুষের ঘাড় ধরে বলছে – ‘না বুঝবি তো মগজে তোর গজাল মেরে গোঁজাবো’। 

আমাদের আগের প্রজন্ম কৃষিনির্ভর হওয়ায় নিশ্চিন্তে পরিবার বাড়িয়ে গেছে। তারপর শিল্প আসায় বিপুল পরিবর্তন হলো। আমাদের মতো দেশে সরকারকে পরিবার পরিকল্পনা শুরু করতে হলো। অথচ বেঁটে খাটো ঋজু মানুষটি বুঝতে পেরেছিলেন যে, অর্থের মাধ্যম হিসেবে শিল্প আসতে চলেছে – এর ফলে যৌথ পরিবার ভেঙে পড়বে এবং সংসারে বড়ি-আচার-আমসত্ত্ব বানানো বিধবাকূল অপাংক্তেয় হয়ে পড়বে। তাই কর্মবীর ঈশ্বরচন্দ্র নারীশিক্ষা ও বিধবাবিবাহের প্রচলনের মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসনে নেমে পড়লেন কোমর বেঁধে। এ হেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টার কপালে কী সম্মান জুটেছিলো, সে আমরা জানি। 

যৌথ পরিবারের ভাঙনের মতো আমাদের দেশে কম্প্যুটারের প্রবেশও ছিলো অনিবার্য। বামপন্থীরা বলেছিলেন - এর ফলে দেশে বেকারি বাড়বে। কথাটা পুরোপুরি ভুলও নয়। ক্রিয়া মাত্রেরই প্রতিক্রিয়া থাকবে। তার জন্য ক্রিয়াকে রোখার চিন্তা অযৌক্তিক। দরকার ছিলো উদ্বৃত্ত কর্মীদের কিভাবে কোন কোন কাজে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, তার পরিকল্পনার কথা বলা। পরিবর্তে বেকারি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিজ্ঞানের দান কম্প্যুটারকেই তারা ভিলেন বানিয়ে বসলেন। কম্প্যুটার এলো, কিন্তু আর্থিক ও মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকা এলাকায় আশীর্বাদ হিসেবে নয়, ভোগান্তি হিসেবে। অনেক এলাকাতেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে পাশবই আপডেট করার মেশিন সহ বেশ কিছু কম্প্যুটার বিভিন্ন তুচ্ছ কারণে দিনের পর দিন অচল পড়ে থাকে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ কর্মী না অর্থ – অভাবটা কিসের জানি না। 

এই প্রসঙ্গে অন্য একটি উদাহরণ মাথায় আসছে – বিভিন্ন জায়গায় ব্র্যান্ডেড কোম্পানির শোরুম বা আউটলেটগুলো লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, তারা শোরুম খোলার আগে এলাকার আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার ওপর রীতিমতো গবেষণা করে নেয়। তাই তাদের বিভিন্ন জায়গার শোরুম একইরকম ঝাঁ-চকচকে এবং একইরকম সম্ভারে সজ্জিত থাকে না। মুনাফাই মূল উদ্দেশ্য হওয়ায় পরিকল্পনা ও প্রয়োগে অভ্যস্ত তারা। মুনাফার মতো মানবকল্যাণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ, নতুন পণ্যের ক্ষেত্রে সরকারি না বেসরকারি, সামাজিকভাবে অগ্রসর না অনগ্রসর আর্থিকভাবে সক্ষম না অক্ষম এলাকা – এই তথ্যগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই যে কোনো জিনিসেরই সফল রূপায়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা দরকার। বলার কথা এটাই – প্রকৃতির ভাণ্ডার বিবিধ উপাদানে ভরপুর। যন্ত্রের শক্তি, মানুষের শক্তি, প্রাকৃতিক শক্তি, অর্থ সবই আছে। কোথায় কোন শক্তিকে কাজে লাগালে মানবসভ্যতার সবচেয়ে বেশি উপকার, সেটা ভেবে দেখতে হবে। অবশ্য মানুষের উন্নতি বা মঙ্গলই যদি আমাদের একমাত্র বিবেচ্য হয়, তবেই।

এবার একটা পারিবারিক ঘটনার কথা বলি। আমার দেওর আমার চেয়ে দেড় বছরের ছোটো। তার মেয়ে আমার ছেলের থেকে আবার আট বছরের ছোটো। তিন বছরের ছোট্টো এ হেন মেয়েটি একদিন আমাকে বললো – ‘জানো জেম্মা, তুমি আর বাবা সমবয়সী’। আমি তো আপ্লুত। বললাম – ‘একদম ঠিক বলেছো’। আমার উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে এবার সে বলে উঠলো – ‘আর আমার মা আর তুতানদাদা(আমার ছেলে) সমবয়সী’। বলা বাহুল্য, এবারে আর উৎসাহ দিতে পারলাম না। তিন বছরের একটা শিশু ‘সমবয়সী’ শব্দটা বিভিন্নভাবে প্রয়োগ করতে করতেই একদিন সঠিক প্রয়োগ শিখে যাবে। চিন্তা নেই। কিন্তু, আমরা যারা লকডাউনে বন্দী অবস্থায় নিজেদের সচেতন হিসেবে প্রমাণ করার জন্য দূষণ, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো নিয়ে অনেক কথা বলছি, লকডাউন কেটে গেলেও এই সচেতনতা কি বজায় রাখতে পারবো?

আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে ভোপালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কলোনীতে এক আত্মীয়ের কোয়ার্টারে বেড়াতে গিয়ে দেখেছিলাম – সেখানে প্রায় প্রত্যেক অফিসারেরই বাইক ছিলো। কিন্তু রোজ প্রত্যেকে বাইক বের করতেন না। দুজন করে জোট বেঁধে একজনের বাইকে অন্যজন এবং পরদিন অন্যজনের বাইকে আগেরজন সওয়ার হতেন। অর্থাৎ যে কলোনী থেকে ৪০টা বাইক রোজ রাস্তায় নামার কথা, সেখানে ২০টা বের হতো। একথা ঠিক যে, বসবাসের স্থান, গন্তব্যস্থল এবং কাজের সময় এক হওয়াতেই এটা সম্ভব হয়েছিলো। করোনা যুদ্ধে জয়ী মানব সমাজ দূষণ কমাতে এরকম কোনো ভাবনা কি ভাববে? এখন আমরা যেভাবে জলের মতো জল খরচ করছি, সে সম্পর্কে সচেতন হবো কি? ভারতের অনেক শহরেই কিন্তু জলকষ্ট শুরু হয়ে গেছে। 

কাজের লোক বা পরিচারিকা ছাড়া এই লকডাউনের মধ্যে আমরা সকলেই দিব্যি সংসার চালাচ্ছি। অবশ্য এর পেছনে কাজ করছে মৃত্যুভয়। কিন্তু মৃত্যুভয় কাটলে করোনা যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর আমরা এই মানুষগুলোকে এবং তাদের কাজকে সম্মান দিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সপ্তাহের নির্দিষ্ট একটা দিন কি ছুটি দিতে পারবো?

মানুষ হিসেবে আমরা মুক্ত চিন্তার ধারক এবং সাহসী না হতে পারলে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়। এ কাজ কোনো রাজনীতিক, বা ধর্মগুরু বা এনজিওর নয়। কারণ, এদের পায়ে অনেক ধরণের বেড়ি বাঁধা। উচ্চশিক্ষিত মানবিক ও সচেতন কেজরিওয়ালকে ভোট বৈতরণী পার হতে জনদরদী কাজকর্মের পরেও হনুমান চালিশা মুখস্থ বলতে হয়। বিপক্ষ দল ‘জয় শ্রীরাম’ বললে মাথা খাটিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ‘জয় হনুমান’ ধ্বনি দিতে হয়। একই কারণে কেজরিওয়ালের মহিলাদের জন্য বাস ও মেট্রোতে ভাড়া মকুবে আমার মতো সামান্য গৃহবধুর প্রতিবাদ উগরে দিতে বাধা নেই। যে দেশে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে মহিলা সমাজ কাঁধ দিয়েছে, যে নারীশক্তির মহিমা উপলব্ধি করে স্বয়ং নেতাজী মহিলা সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলেছেন – স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সেই দেশে সত্তর বছর ধরে চলা নারী পুরুষের সমানাধিকারের লড়াইয়ে এই কুঠারাঘাত মেনে নেবো না। সরকার হিসেবে জননেতা হিসেবে সমাজে নারীর সুরক্ষার নামে সংরক্ষণ বরদাস্ত করবো না। সবিনয়ে বলতে চাই, নারী কিন্তু আজ ঘরেও কম লাঞ্ছনার শিকার হয় না। তাই বাসভাড়া মকুব নয়, দরকার নারীর প্রতি পুরুষের মনোভাবের পরিবর্তন। সম্ভব হলে সেটা করুন। না হলে ছেড়ে দিন। ঘরে বাইরে দৈনন্দিন লড়াইটা নারীকে নারীর মতো করেই লড়তে দিন। বিকাশ ভট্টাচার্যের মতো নেতা যদি বলেন ‘আমি তো গরুর মাংস খাই’, তাহলে ভোটযুদ্ধে তাঁর জামানত জব্দ হতে বাকি থাকে মাত্র। আর গরুর কুঁজে সোনা ফলানো নেতা ড্যাঙডেঙিয়ে লোকসভায় নির্বাচিত হন। আসলে একথা তো ঠিক যে, নির্ভীক সাহসী মানুষ যদি নেতৃত্বই দিতে না পারেন, লাভ কি? যে সমস্যা ডিরোজিওপন্থী শিক্ষিত ছাত্র সমাজের ছিলো না। তারা অনায়াসে ব্রাহ্মণদের গায়ে বিভিন্ন জন্তুর হাড়কে গরুর হাড় দাবি করে ছুঁড়ে মারতে পেরেছিলেন। 

আজ যখন এই লকডাউনে রামনবমী উপলক্ষ্যে এবং আরো কিছু ধর্মীয় জমায়েত সম্পর্কে টিভিতে অনুষ্ঠান দেখতে বসি, সেখানে ডাক্তারবাবুদের বলতে শুনি, লকডাউনের সময়ে দয়া করে ঘরে বসে প্রার্থনা বা ধর্ম পালন করুন, মন্দিরে বা মসজিদে প্রার্থনা করলে যদি ভগবান শোনেন, তাহলে ঘরে বসে প্রার্থনা করলেও ভগবান শুনবেন। ডাক্তারবাবুদের বলি, আপনারা তো সমাজের প্রিভিলেজড্‌ ক্লাশ, এতো ভয় কিংবা বিনয়ের সাথে সত্য গোপন কেন? সর্বহারাদের না হয় হারাবার জন্য শৃঙ্খল রয়েছে, আপনাদের তো হারাবার কিছুই নেই। উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাধু-ভণ্ড, নেতা-ক্যাডার সকলেই জানে, আপনারাই আসল ভগবান। সোজা কথা সোজা করেই বলুন না – একজন কেন, একশোজন মিলে ভগবানকে ডাকলেও উনি শুনবেন না। আটদিন ধরে মন্দিরের মধ্যে গণধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত আট বছরের বাচ্চা মেয়ের ডাকও ঐ মন্দিরে অধিষ্ঠিত ভগবান শোনেননি। কাজেই মন্দিরে মসজিদে অথবা ঘরে, কোথাওই বসে ডাকলে ঈশ্বর শোনেন না। তাই নিজেদের ও অপরের প্রাণ বিপন্ন করতে বাইরে বেরোবেন না। তাও যদি ডাকতে হয়, আত্মসন্তুষ্টির জন্য ঘরে বসে ডাকুন।

হ্যাঁ, কিছু ভাবনা কিছু পরিবর্তন এই দুঃসময়ে গৃহবন্দী থাকা অবস্থাতেই ভাবতে ও করতে হবে। কারণ এ কথা তো ঠিক - ‘একদিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে’। সবাই মিলে দিন বদলের স্বপ্ন দেখার কাজটা এই দুঃসময়েই শুরু করাটা খুবই জরুরি।

0 comments: