প্রাচীন কথা - ঋত্বিক ঘটক আর সৌহার্দ্য সেন
Posted in প্রাচীন কথা
এক শূদ্রাণীর জারজ সন্তানের জ্ঞানের কাছে হেরে যাচ্ছেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দেবতা স্বয়ং, মহাভারত রচনার এই গল্পটি কোনও অজ্ঞাত কবির সংযোজন হলেও এই রূপকটির গুরুত্ব মহাভারতের পাঠকদের জন্য অপরীসিম। মহাভারতের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আট হাজার ব্যসকূটের কথা ছেড়ে দিলেও যা পরে থাকে তা পাঠককে বারংবার ভাবায়, প্রতিবার পড়ার সাথে সাথেই যেন বদলে যায় পঞ্চমবেদ। এর চরিত্রগুলিও ক্রমশ অলৌকি্কত্ব ছেড়ে মানবিক হয়ে ওঠে পাঠকের কাছে। হয়তো তাই মহাভারতের আদিকবি নিজেই বলে গিয়েছেন ‘ন্য মনুষাৎ শ্রেষ্টতর হি কিঞ্চৎ’ অর্থাৎ মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর আর কিছুই নেই।
ভারতের যুগযুগ থেকে চলে আসা গল্প-উপকথাগুলির এক অনবদ্য সঙ্কলন এই মহাকাব্য, বিভিন্ন সময় মহাভারতের বিভিন্ন অজ্ঞাত কবি ব্যস নামের আড়ালে এই গ্রন্থটির শ্রীবৃদ্ধি করে গেছেন। শ্রদ্ধেয় লেখক রাজশেখর বসুর মতে মহাভারতেকে পঞ্চমবেদ বলা হলেও এটি আসলে সংহিতা। উনি মহাভারতকে তৎকালিন সমাজ, ধর্ম, অর্থ ও বিচারব্যবস্থার জীবন্ত ইতিহাস বর্ণনা করে প্রত্নবিদদের অধ্যয়নের বিষয় বলতেও দ্বিধা করেননি। মহাভারত সম্পর্কে বলতে গিয়ে কবিগুরুও বলেছেন- ‘ইহা কোনো ব্যক্তিবিশেষের রচিত ইতিহাস নহে, ইহ একটি জাতির স্বতস্ফূর্ত স্বাভাবিক ইতিহাস’। তাই এখানে আমরাও চেষ্টা করেছি মহাভারতকে অলৌকিকত্বের বাইরে গিয়ে যথাসম্ভব মানবিক দৃষ্টিতে দেখার। মহাভারতে লৌকিক ও অলৌকিক ঘটনাগুলি ও বিভিন্ন রূপক এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে তার মধ্যে থেকে আসল ঘটনাগুলি খুঁজে বের করার চেষ্টাটা বেশ কঠিন হওয়ায় সমসাময়িক আরও কিছু পুরাণ ও কাব্যের সহায়তা নিতে হয়েছে। রূপকের আড়ালের অর্থ বুঝে মূল রচনাটিকে বার্ডস আই ভিউ থেকে দেখার চেষ্টায় হয়তো কিছু অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি থেকে যেতে পারে যার জন্য অগ্রীম ক্ষমাপ্রার্থী আমরা।
সমাজপর্ব:
মহাভারতের সময়ের সমাজ পর্যালোচনা করার জন্য আমাদের শুধু মহাভারত না, তার সাথে সমকালীন অন্য গ্রন্থগুলি যেমন ভাগবত পুরাণ, বৈবস্বত পুরাণ ও মহাভারতের অংশ বলে স্বীকৃত হরিবংশ পুরাণ-সহ আরও কিছু গ্রন্থের তুলনামূলক পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সে যুগে বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রতিষ্ঠিত ছিলো, কিন্তু তখনকার ব্রাহ্মণ্যবাদ আর আমাদের এখনকার ব্রহ্মণ্যবাদের ধারণা আদৌ এক ছিলো কি? নাকি মহাভারতের সময়ের সমাজ আমাদের ধারণার চেয়ে অনেকবেশি উদার ও আধুনিক ছিলো? পাঠক হিসেবে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেশ কিছু ঘটনা আমাদের ফিরে দেখা আবশ্যক।
শ্রুতি নামক ঘন্টটির মধ্যে থেকে যখন ঋষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ মন্ত্রাংশগুলি নিয়ে ঋক, গেয় অংশগুলি নিয়ে সাম, যজ্ঞপদ্ধতি এবং আহূতির মন্ত্রগুলি নিয়ে যর্জু আর অবশিষ্ট মারণ, উচাটন, বিভিন্ন অভিচার, আচার এবং রাজধর্মের খুঁটিনাটিগুলি নিয়ে অথর্ববেদ ভাগ করলেন তখন তিনি চেয়েছিলেন বেদ সর্বসাধারণের জন্য হোক। মহাভারতের ভারত মনুমহারাজের কাম্য ভারতের চেয়ে ছিলো বেশ কিছুটা আলাদা। মনুমহারাজের আদেশানুসারে যে ব্রাহ্মণ শূদ্রের অধররস(বৃষলীফেন) পান করেছে বা তার গর্ভে সন্তান উৎপন্ন করেছে সহস্র প্রায়শ্চিত্তেও তার পাপমুক্তি নেই। শূদ্রাণীর গর্ভে নিজ জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করার সময়েই যেন মহাভারতের আদিকবি বুঝিয়ে দিয়েছেন তার এই গ্রন্থে তিনি অনেক অচলায়তন ভাঙ্গতে চলেছেন। পরবর্তিতে এমন আরও অনেক ঘটনা আমাদের সামনে আসবে যেখানে বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে কবি বর্ণাশ্রমের এক সম্পূর্ণ নূতন সংজ্ঞা দিয়েছেন। আদিকবির মধ্যে ঋষি পরাশরের সাগ্নিক ঋষিসুলভ প্রাজ্ঞতার পাশাপাশি শূদ্রা জননীর সমাজভয়, বেদহীনতার আক্ষেপ মিশে গেছে বলেই হয়তো তিনি এত মানবিকভাবে লিখতে পেরেছেন তাঁর পঞ্চমবেদ। যে বেদে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার অধিকার।
বেদকে বিভাজন করার পর যখন চার প্রিয় শিষ্যকে চর্তুবেদ দান করলেন ব্যস তখনও তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি সরাসরি ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা করা কিন্তু তাঁর নিজস্ব পঞ্চমবেদের ক্ষেত্রে তিনি নিয়ম শিথিল করলেন। ব্রাহ্মণদের একে বারে অগ্রাহ্য করার সাহস না দেখিয়েও নারী ও শূদ্রদের দিলেন পাঠ ও শ্রবণের অধিকার। নিজের জন্মের মধ্যে কৌলিন্য না থাকায় ব্যস বারবার প্রশ্ন তুলেছেন প্রকৃত ব্রাহ্মন কে? আর তার উত্তর ও তিনি নিজেই বলে গেছেন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়ে। মহাভারতের কবি জানতেন ভবিষ্যৎ বারংবার প্রশ্ন তুলবে সমাজব্যবস্থার এই বিতর্কিত বিষয়টি নিয়ে তাই তিনি বারবার বিভিন্ন জায়গায় এর উত্তরে বলেছেন ব্রাহ্মণ পিতার ঔরসে ব্রাহ্মণীর গর্ভজাত হলেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না, তার জন্য প্রয়োজন ব্রাহ্মণের গুণ- আত্মত্যাগ, দয়া, ধর্ম ও চরিত্র। লক্ষণীয় যে এইসব প্রশ্নগুলি এসেছে মহাভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাথে জড়িয়ে, যেখানে মিথ্যাচারের অবকাশ নেই। ধরা যাক, বকযক্ষরূপ ধর্মের সাথে যুধিষ্ঠিরের কথোপকথন। মৃত চারভাই এর জীবন বাঁচাতে তাঁকে যে প্রশ্নগুলির মুখোমুখি হতে হয়েছিলো সেগুলি আসলে সেই সময়কার সমাজে বারবার ওঠা প্রশ্নগুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। তার সাথে এও লক্ষণীয় যে ধর্ম স্বয়ং শত্রুর ছদ্মবেশে নিজপুত্রের পরীক্ষা নিচ্ছেন, যে পুত্র আবার স্বয়ং ধর্মরাজ্য স্থাপন করবেন ভবিষ্যতে। এখানে যেন ভবিষ্যতের সম্রাট সমাজের প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন এবং তার উত্তরের ওপর নির্ভর করছে তাঁর ভাইদের জীবন তথা ভবিষ্যৎ ধর্মরাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন। মহাভারতের এই পর্বেই যক্ষ প্রশ্ন করছেন যে বংশ, চরিত্র, বেদপাঠ নাকি গুরুর থেকে পাওয়া বেদার্থবোধ কোনটি দিয়ে ব্রাহ্মণত্বের নির্ণয় হবে? যার উত্তরে ধর্মপুত্র বলেন বংশ নয়, কুল নয়, নিয়ত বেদ পাঠ বা বা সদগুরুর বেদার্থ ব্যখ্যা শুনেও প্রকৃত ব্রাহ্মণত্ব লাভ হয় না। ব্রাহ্মণত্ব তৈরি করে সদগুণ এবং চরিত্র। এখানেই মহাভারতের কবি যেন ঠিক করে দিলেন ভবিষ্যত ধর্মরাজ্যে যে ব্রাহ্মণ্যবাদ ছড়িয়ে পরবে তার আধারগুলি কেমন হবে। যে ব্রাহ্মণ সবার অনুকরণীয় হবে তার সম্পর্কে যুধিষ্ঠিরের জবানীতেই বলেছেন-‘চর্তুবেদাপি দুর্বৃত্তঃ স শূদ্রাদ অতিরিয্যতে’, অর্থাৎ চর্তুবেদ পড়ার পরেও যে ব্রাহ্মন দুবৃত্ত,দুঃশ্চরিত্র সে শূদ্রেরও অধম। এই জটিল প্রশ্নের স্বীকৃত উত্তর দিয়েছেন মহাভারতের কবি আরও অনেক পরে, মহাযুদ্ধের শেষে। শান্তিপর্বের ভৃগু-ভরদ্বাজ সংবাদের মাধ্যমে ব্যাস ব্যাখ্যা দিয়েছেন ব্রাহ্মণত্ব আর চর্তুবর্ণের। উল্লেখ্য ভার্গবরা চিরকাল প্রশ্ন করে এসেছেন বেদ ও তার চিরাচরিত মতগুলিকে। এখানে প্রশ্নকর্তার ভূমিকায় দুর্বিণিত ভৃগুকে বসিয়ে ব্রাহ্মণ ও ঋষিশ্রেষ্ঠ ভরদ্বাজের জবানীতে সমাজের প্রশ্নগুলির উত্তর দিয়েছেন ব্যাস স্বয়ং। বনপর্বে যুধিষ্ঠিরের উত্তরে ধর্ম সন্তুষ্ট হলেও ব্যস সন্তুষ্ট হননি তা পরিষ্কার হয়ে যায় মহর্ষি ভৃগুর প্রশ্নগুলিতেই।ভৃগু প্রথম প্রশ্নেই বলছেন, বর্ণের ভিত্তিতে যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়াদি বিভাগ তা অত্যন্ত বিপদজনক কারণ সংকর বিবাহ আকছার ঘটছে এবং একবর্ণ আরেক বর্ণের সাথে মিশে যাচ্ছে- ‘সর্বেষাং খলু বর্নানাং দৃশ্যতে বর্নশঙ্করঃ’, তাহলে এসব ক্ষেত্রে জাতি কিভাবে নির্ধারিত হবে। নিজ জন্মকথা মাথায় রেখে ব্যস যে এরকম প্রশ্ন তুলবেন তা অতি স্বাভাবিক, যাঁর উত্তরে ব্রাহ্মণ্যবাদের সবচেয়ে বড় প্রচারক ঋষি ভরদ্বাজ অবধি স্বীকার করতে বাধ্য হন এভাবে বর্ণ নির্ধারণ করা অদপেই সম্ভব নয়, কাজকর্ম, সংস্কার, বৃত্তি, পাল্টে ব্রাম্ভন প্রয়োজনে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এমনকি শূদ্রও হয়ে যায়। তার্কিক ভৃগুর থেকে এরপরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি এসেছে, ব্যসের হয়ে ভৃগু জানতে চেয়েছেন এত হলো ব্রাহ্মণের শূদ্রগতি বা জ্ঞাতি ব্রাহ্মনের শূদ্র সংজ্ঞা। একজন ব্রাহ্মণ যে বৃত্তিই গ্রহণ করুক সে নিজের পরিচয় দেবে ব্রাহ্মণ বলেই, এখন একজন শূদ্র কিভাবে ব্রাহ্মণ হবে? ব্যসকূটের আক্রমণে বিপর্যস্ত ভরদ্বাজ ব্রাহ্মণত্বের আবশ্যক গুণগুলি বর্ণনা করে বলেন ত্যাগ, তিতিক্ষা, ক্ষমা, সত্য, দান, অদ্রোহ ও সমদৃষ্টি এই কটি সদগুণ যার মধ্যে থাকবে তিনিই প্রকৃত ব্রাহ্মণ। যদি মানুষটি জাতি জন্মে শূদ্র হন কিন্তু তার মধ্যে এই গুণগুলি থাকে এবং ব্রাহ্মণ সন্তানের মধ্যে এই গুণগুলি না থাকে তবে শূদ্রজও ব্রাহ্মণ এবং ব্রহ্মজও শূদ্র। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে সমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রধান হলেও বর্ণ নির্ধারণের মাপকাঠি ছিলো যোগ্যতা। উল্লেখ্য ব্যস ও বিদূর উভয়েই ব্রাহ্মণের ঔরসে শূদ্রাণীর গর্ভজাত হলেও একজন ব্রাহ্মণ, অপরজন শূদ্র। পরবর্তিতে ধর্ম ও শিক্ষা পর্বে এই বিষয়ে আরও আলোচনার অবকাশ থাকবে। পরিশেষে এই সকল ঘটনার আগে স্বয়ং মহাভারতের ভগবান বাসুদেব কৃষ্ণ এককথায় সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেছেন- ‘চার্তুবর্ণ ময়া সৃষ্টং গুণ কর্ম বিভাগশ্চঃ’ অর্থাৎ আমি গুণ ও কর্মের বিচারে চর্তুবর্গ সৃষ্টি করেছি। স্বয়ং ভগবানের মুখে এহেন উক্তি প্রমাণ করে মহাভারত ব্রাহ্মণ্যবাদ নয় সমবাদের আদর্শের প্রচারক এবং তৎকালীন সমাজও ছিলো সমবাদের।
মহাভারতের সমাজে রাজার স্থান ছিলো বেদজ্ঞের পরেই। সমাজে ব্রাহ্মণের ক্ষমতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠলেও রাজার ক্ষমতা ছিলো প্রশ্নাতীত। সর্বত্র রাজতন্ত্র না থাকলেও গোষ্ঠিপতিরাও রাজার তুল্য সম্মান পেতেন। মহাভারতের মূলকাহিনি সিংহাসন দখলের দ্বন্দ হওয়ায় সমাজে বিভিন্ন রাজার চরিত্রগুলি ও তার নিরিখে আদর্শ রাজা বা শাষকের চরিত্র কেমন হওয়া উচিত তার একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। রাজা ও তার কর্তব্যের বিষয়ে আমরা প্রথম উল্লেখ পাই পাণ্ডবদের পণ্ডিত ধৌমের মুখে। এই বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ জতুগৃহ দাহের পর থেকেই পাণ্ডবদের সঙ্গী এবং সুখ-দুঃখে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছেন তাদের।
ইন্দ্রপ্রস্থে অভিষেকের পরেই নারদাদী ঋষিরা যুধিষ্ঠিরকে রাজসূয় যজ্ঞের পরামর্শ দিলে ধৌম্য যুধিষ্ঠিরকে মনে করিয়ে দেন রাজ্য সদ্য স্থাপিত তাই রাজার উচিত এখন প্রজাপালনে মন দেওয়া। যজ্ঞ ও দেবসেবা রাজধর্ম হলেও রাজার প্রাথমিক কর্তব্য প্রজাপালন। এরথেকে একটা বিষয় মহাভারতের কবি বোঝাতে চেয়েছেন রাজার কাছে প্রজাপালন সবচেয়ে বড় ধর্ম। পরবর্তীতে এই ধৌম্যয় বিরাট পর্বের প্রাক্কালে যধিষ্ঠিরকে মনে করিয়ে দিয়েছেন তাকে এবার একজন রাজকর্মচারীর ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে যা রাজার ভূমিকার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই পর্বে ধৌম্য আদর্শ রাজকর্মচারীর চরিত্র ব্যখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন- “ যখন তুমি রাজার সঙ্গে দেখা করতে যাবে তখন প্রথমে তার দ্বারপালের সাথে দেখা করবে, রাজার হাজার প্রিয়পাত্র হলেও কখনও রাজ সমীপে সরাসরি যাবে না। আমিই রাজার প্রিয়পাত্র ভেবে কখনও তাঁর হাতি, ঘোড়া, রথ বা অস্ত্রাদি ব্যবহার করবে না। যতক্ষণ না জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে নিজে থেকে কোনও উপদেশ দেবে না। রাজার অন্দরমহলের সাথে বন্ধুত্ব করবে না এবং রাজার অপছন্দের ব্যক্তির থেক দুরে থাকবে। রাজাকে তার মর্যাদা উল্লঙ্ঘন করতে দেখলে নিজেকে জন্মন্ধ মনে করে রাজাকেই সমর্থন করবে। রাজসভায় নির্দিষ্ট আসন ছাড়া যত্রতত্র বসবে না”। এইসব উপদেশ দিয়ে ধৌম্য বলেছেন এগুলি যারা পালন করতৈ সক্ষম তারা অযোগ্য হলেও নির্বিঘ্নে রাজবাড়িতে বাস করতে সক্ষম।
তখনকার পুরোহিতদের কাজ যে কেবল পৌরহিত্য ছিলো না এবং মর্যাদাও পূজারী বামুনের চেয়ে অনেক ওপরে প্রায় মন্ত্রীতুল্য ছিল তা এর পরের ঘটনা থেকে আরও পরিষ্কার। তিনি এরপর বলেছেন- “কখনও রাজার সামনে অট্টহাস করবে না, অতিরিক্ত স্তাবকতা করবে না, রাজার কাছে অকারণে দণ্ড পেলেও প্রকাশ্যে তার নিন্দা করবে না, রাজাকে অনুশোচনার সুযোগ দেবে”।
এছাড়া তিনি আরও বলেছেন- “রাজার কোনও কাজের জন্য উৎকোচ আশা করবে না বা দরিদ্র প্রজার থেকে কখনও ঘুষ নেবে না”। ঘুষ আর কমিশনের মতো প্রথা যে সে যুগেও ছিলো তার প্রমাণ আমরা পরবর্তী পর্বে আবার পাবো।
সেযুগের রাজপ্রাসাদগুলির সৌন্দর্য ও বিশালতার বর্ণনা শুনে সেগুলিকে কেবল রাজার পারিবারিক বাসস্থান বা বিনোদন কেন্দ্র ভাবলে ভুল হবে। স্টাফ কোয়ার্টার, গেস্টহাউস, মাল্টিকিচেন, ক্যান্টিন সহ এই রাজপ্রাসাদগুলি আধুনিক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর হেড অফিস বা রাজনৈতিক ভবনগুলির সাথে এর তুলনা করা যেতেই পারে।
লক্ষণীয় অজ্ঞাতবাসের আগে যুধিষ্ঠির ধৌমসহ সকল সাথী ব্রাহ্মনদের দ্রূপদ ও দ্বারকায় গিয়ে তার নাম করে ভরণপোষনের অর্থ ও আশ্রয় নিতে বলেছেন। রাজ্য থাক বা না থাক রাজার কর্তব্য কি এবং তাদের কর্তব্যবোধ কত প্রবল এই ঘটনা তার প্রমাণ। পরবর্তীতে শাসন পর্ব আলোচনার সময় এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ থাকবে ।
মহাভারতের অস্ত্র কথা
সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রত্যেকটি প্রাণী বেঁচে আছে লড়াই করে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এই লড়াই আবশ্যক। কালের নিয়মে প্রায় প্রতিটি প্রাণীই নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নিজেকে পরিবর্তণ করেছে, যারা পারেনি, তারাই বিলুপ্তির পথে যাত্রা করেছে।
প্রাণীদেহের পরিবর্তণের সাথে সাথেই, টিকে থাকার লড়াইয়েরও পরিবর্তণ হয়েছে যথেষ্ট। প্রতিটি প্রাণীই নিজ দেহে লড়াই করার উপযুক্ত কিছু অস্ত্র নিয়ে জন্মায়, যেমন বাঘ সিংহ ইত্যাদি বড়ো প্রাণী প্রচুর দৈহিক শক্তি, ধারালো নখ-দাঁত আর প্রবল গতি ব্যবহার করে আত্মরক্ষার খাতিরে, বাজ, চিল, শকুন প্রভৃতি পাখি অসাধারণ দৃষ্টি, শক্ত নখ আর ঠোঁট ব্যবহার করে, তেমনই সাপ, ব্যাঙ, টিকটিকি প্রত্যেকটি প্রাণী কখনও নিজের বিষ, কখনও বা ক্ষীপ্রতা ব্যবহার করে..
মানুষ নামক প্রাণীটি কিন্তু এগুলির প্রায় একটিও পায়নি, সে পেয়েছে ক্ষুরধার একটি মস্তিষ্ক। আর নিজ দেহের এই অংশটি ব্যবহার করেই সে হয়ে উঠেছে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম প্রাণী। অস্তিত্বের সংগ্রামে টিকে থাকতে সে প্রাকৃতিক সম্পদকে প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে শিখে নিয়েছে।
সে ধারালো নোখ বা দাঁত পায়নি, তাই ছোট পাথর ভেঙে বানিয়ে নিয়েছে ধারালো অস্ত্র, ক্ষিপ্রতার অভাব মিটিয়েছে চাকা, ও তারপর চাকা চালিত গাড়ি ব্যবহার করে, পাশবিক ক্ষমতা নেই তার, কিন্তু আছে মানবিক বুদ্ধিমত্তা, তাই মানুষ পাহাড়ের উপর থেকে বড়ো পাথর ঠেলে দিয়ে আঘাত করেছে শত্রুকে।
বোঝাই যাচ্ছে যে, লড়াই জিনিসটার শুরু কিন্তু আত্মরক্ষার খাতিরে, তা সে ব্যক্তিগত আত্মরক্ষা হোক বা পরবর্তীকালে গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের গোষ্ঠীরক্ষার চেষ্টা।
প্রস্তর যুগের শুরু থেকেই গুহাবাসী মানুষ নিজের খাদ্য ও সুরক্ষার জন্যই অস্ত্রের ব্যবহার করেছে। কিন্তু কালক্রমে গুহাবাসী মানুষ প্রথমে গোষ্ঠীবদ্ধ ও পরে সমাজবদ্ধ হতে শিখেছে, তারা গোষ্ঠীর সুরক্ষায় মনযোগ দেওয়ার পাশাপাশি গোষ্ঠী-বিস্তার ও পরাক্রমশীলতাও রপ্ত করেছে। একই সঙ্গে বেড়েছে নিজের বা গোষ্ঠীর সম্পত্তি রক্ষার চেষ্টায় অপর গোষ্ঠীর উপর আক্রমণের প্রবণতা। এই পরাক্রমশীলতা আর খাদ্যের সন্ধানেই মানুষ জন্ম দিয়েছে পাথর বা গাছের ডাল ভেঙে তৈরি ছোট বড়ো ধারালো অস্ত্রের। মানুষের জ্ঞানের পরিধি বাড়তে থাকলে তার তৈরি হাতিয়ারেরও উন্নতি হতে লাগলো।
কালক্রমে মানুষের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা আর বুদ্ধির বিকাশ হয়েছে বিস্তর। তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা হাতিয়ারের মতো প্রায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসেও নিজেদের বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা এবং কলার পরিচয় রাখে। অস্ত্রের মাধ্যমে শুধুমাত্র বুদ্ধি, শিল্প বা ক্ষমতাই প্রকাশ পায় না, এগুলি নির্দিষ্ট সময়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যারও পরিচায়ক। একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর তৈরি অস্ত্রশস্ত্র ওই জনগোষ্ঠীর বিজ্ঞান চর্চা, প্রযুক্তি, চারুবিদ্যা, এমনকি সামরিক ইতিহাসেরও পরিচয় বহন করে।
খুব সাধারণ নিয়মেই প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ তার বাসস্থানের আশপাশ থেকেই হাতিয়ার তৈরির উপকরণ সংগ্রহ করে, তাই প্রতিটি অঞ্চলে তথা দেশে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের অস্ত্র শস্ত্র তৈরি হয়েছে। এমনকি বড়ো দেশগুলির মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ঘরানার হাতিয়ার পাওয়া যায়। এখানে আমরা আলোচনা করবো মহাভারতে উল্লিখিত অঞ্চলগুলিতে ওই সময় উপলব্ধ ও ব্যবহৃত হাতিয়ারগুলি সম্বন্ধে।
বিশাল এই ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচুর ছোট বড়ো আদিবাসী গোষ্ঠীর বসবাস ছিল, এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় বেশ কিছু বৈদেশিক জনগোষ্ঠী এই ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে। ফলে এই ভূখণ্ডের প্রায় সমস্ত অংশেই বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে সামরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি নানা কারণে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত এমনকি রাষ্ট্রগত দ্বন্দ্ব যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে। ভারতীয়দের মধ্যে অস্ত্রশস্ত্র শুধুমাত্র যুদ্ধ বা আত্মরক্ষার ভূমিকাই নেয় না, এখানকার বহু আদিবাসী গোষ্ঠী তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচার আচরণেও হাতিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বীকার করে। ভারতের প্রায় প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মধ্যেই হাতিয়ার পূজার প্রচলন আছে।
যেমন, শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে কৃপাণ বহন ও পূজার প্রচলন সর্বজনবিদিত, ভীল জাতির মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন উৎসবে তাদের ঐতিহ্যমণ্ডিত অস্ত্র টাঙ্গি পুজো করা হয়, দশেরা উৎসবের প্রধান আকর্ষণ রাবণ দহনের আগে তীর ধনুক পূজার প্রচলন আছে, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি রাজ্যের কিছু কিছু অঞ্চলে খড়্গ বন্দনা প্রসিদ্ধ। অথচ ভারতের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গবেষণার ক্ষেত্রে অস্ত্র বিষয়ক গবেষণা আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় ব্রাত্য থেকে গেছে!
কয়েকটা মাত্র বইতে খ্রীষ্টের জন্মের আগের ভারতীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, তাও নামমাত্র।
তাই পুরাতাত্ত্বিক ভারতের অস্ত্র নিয়ে জানতে গেলে প্রথমেই স্মরণাপন্ন হতে হয় বিভিন্ন পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, অর্থশাস্ত্র ইত্যাদি বইগুলির উপর। তথ্যসন্ধানে সমস্যা বেড়েছে এই বইগুলোর বেশিটাই কবিতাধর্মী হওয়ায়। কবিরা কাব্য করেন, আর আলোচক আলোচনা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। আলোচকে কাব্য করলে যে কি ভয়াবহ জিনিস হয় তা আজকের দিনে সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে কারো অজানা নয়, কিন্তু আরো বড়ো সমস্যা তখনই হয়, যখন কবি চান কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে! তাঁদের সৃষ্টিশীল কলমের খোঁচায় অতি সাধারণ ঘটনাও হয়ে ওঠে অবিশ্বাস্য অকল্পনীয় কোনও ঘটনা! ফলায় আগুন জ্বালানো সাধারণ তীর হয়ে ওঠে "অগ্নি বর্ষণকারী দৈব কালদণ্ড!" আসল পাণ্ডুলিপি হারিয়ে বছরের পর বছর আমরা নিজেদের সুবিধা, পছন্দ বা স্বার্থ অনুযায়ী এই বইগুলির কাহিনী লিখে চলেছি, হ্যাঁ, যেমন এই বইটি লেখা হচ্ছে তেমনই..
ফলে প্রতিটি ঘটনা, চরিত্র বা বস্তুর আসল বর্ণনা হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। বদলে তার উপর জমেছে অতিরঞ্জনের ধুলো। বাঙালীরা কথায় কথায় বলেন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল! অথচ এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে আমরা যে মহাভারতগুলো পড়তে পাই, সেগুলো এতটাই অশুদ্ধ, যে পুনর্বার অশুদ্ধির ক্ষমতা আমাদের নেই হয়তো! সেই অশুদ্ধির পাহাড় খুঁড়ে উদ্ধার করা তথ্যগুলি যতটুকু সম্ভব লৌকিক উপায়ে উপস্থাপন করাই আমাদের লক্ষ্য। তাই আমরা মহাভারতের অস্ত্রাদির কথা বলতে গিয়ে, দিব্যাস্ত্রের দিব্য বিবরণ এড়িয়ে গেছি, তাকে বাস্তবের মাটিতে ফেলে নতুনভাবে তাদের বর্ণনা করতে চেষ্টা করেছি।
পৌরাণিক মতামতকে সমর্থন করলে মহাভারত যে সময়ের ঘটনা বলে ধারণা করা হয়, বিজ্ঞান বলে সেই সময় লাঠি, জীবদের আর পাথর ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে মানুষের অস্ত্র তৈরি হওয়া প্রায় অসম্ভব! কিন্তু এই ধারণা মেনে নিলে মহাভারতের প্রায় প্রতিটি ছোট বড়ো যোদ্ধার হাতে লাঠিসোঁটা ধরাতে হয়, তাহলে আবার গোটা গল্পটাই পাল্টে যায়! তাই অতবড়ো ঝুঁকি না নিয়ে আমি ধরে নিলাম, লোহা আবিস্কারের পরপরই এই ঘটনা ঘটেছে। তখনও অবশ্য পাথর, গাছের ডাল বা জীবদেহকে অস্ত্র রূপে ব্যবহার করার প্রথা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। গাছের ডাল ভেঙে বা শক্ত, ছোট কোনও গাছ মূলশুদ্ধ উপড়ে নিয়ে কাছাকাছি অবস্থিত শত্রুকে প্রতিহত করা যেত। মহাভারতের আদিপর্বে এ ধরনের যুদ্ধকে "বৃক্ষ যুদ্ধ" বলা হয়েছে। মহাভারতে বারবার এই ধরনের যুদ্ধ পদ্ধতির বর্ণনা পাওয়া যায়। তুলনামূলক বলশালী যোদ্ধারা এই যুদ্ধ পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। ভীম, বলরামের মতো যোদ্ধা এই ধরণের যুদ্ধে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। হিড়িম্ব বধকালে বা দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর থেকে ফেরার সময় ভীমকে এইভাবে গাছের ডাল বা গাছ উপড়ে নিয়ে যুদ্ধ করতে দেখা যায়।
কিন্তু এই গাছ বা ডাল তো ছুঁড়ে মেরে শত্রুকে ভালো মতো কাবু করা যায় না, তাই মানুষ ক্ষেপণযোগ্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতো ছোট-বড়ো পাথর। অর্থাৎ মানুষের ব্যবহৃত প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র এই পাথর।
মহাভারতে বহুবার পাথর ছুঁড়ে যুদ্ধের বর্ণনা আছে। আমরা মহাভারতে প্রস্তর, শিলা, উপল, লোষ্ট্র প্রভৃতি নামে পাথরের তৈরি নানা অস্ত্রের উল্লেখ পাই। দ্রোণপর্বে উল্লিখিত অশ্মগুড় নামক এক অস্ত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে পণ্ডিত হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ বলেন, এটি একটি গোলাকার পাথর, যা দিয়ে বিপক্ষের হাড়(অশ্ম) গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল।
খাণ্ডবদহন কালে কৃষ্ণার্জুন ও ইন্দ্রের যুদ্ধের সময় ইন্দ্র অর্জুনকে বিশালাকার পাথর ছুঁড়ে মারেন বলে কথিত আছে।
তবে শুধু হাত দিয়ে পাথর ছুঁড়েই যুদ্ধ হতো এমনটাও না। ওই সময়ের মানুষ পাথরকে ভেঙে বা ঘষে ছুঁচালো করে ছুরি বা ক্ষুর হিসেবেও ব্যবহার করতো। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, ছোট ও ছুঁচালো পাথর কে তীর বা বল্লমের বলা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। নল, কঞ্চি প্রভৃতি ঋজু, শক্ত অথচ হালকা ডালের মাথায় ছুঁচলো ও ছোট পাথরের তৈরি ফলক লাগিয়ে তীর ও তুলনামূলক মোটা বাঁশের মাথায় ছুঁচলো ও বড়ো পাথরের ফলা লাগিয়ে বানানো হতো বল্লম, বর্শা বা হার্পুণ জাতীয় অস্ত্র।
কচ-গ্রহ-বিক্ষেপ - কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ প্রস্তুতির বর্ণনায় এই শস্ত্রটির কথা বলা হয়। বর্ণনা থেকে মনে হয় বাঁশ বা ধাতুর ছোট লাঠির মাথায় প্রাণীর স্নায়ু বা পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা মারাত্মক আঠার পিণ্ড। এটি শত্রুর চুলে আটকে টেনে দিলে মাথার চামড়া সহ উঠে আসতে পারে! সাধারণত ঘোড়সওয়ার, সারথী প্রমুখ এটি ব্যবহার করতেন।
প্রাস- এটিকে আধুনিক ল্যাসোরই মহাভারতীয় প্রতিরূপ বলা যায়। প্রাস তৈরি হত, পাটের দড়ি বা প্রাণীর স্নায়ু দিয়ে। এটি ছুঁড়ে শত্রুকে সহজেই ধরাশায়ী করা যেত।
এছাড়াও, বালি, জল, ঝোলাগুড় এমনকি নষ্ট হয়ে যাওয়া অস্ত্রের ধাতু পর্যন্ত গলিয়ে ছোঁড়া হতো শত্রুর গায়ে! এসব গলিয়ে ছোঁড়ার জন্য কুরুক্ষেত্রের ময়দানে প্রচুর বড়ো বড়ো হাঁড়ি, কড়া, হাতা প্রভৃতি জড়ো করা হয়েছিল। এই সময় আধুনিক স্মোক বম্বের মতো ধুনো জ্বেলে শত্রুকে তাড়ানোর কাজেরও উল্লেখ পাওয়া যায়।
পাথর বা গাছের ডাল দিয়ে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তৈরির সময়ই মানুষ তার সৃষ্টির ইতিহাস ও ভবিষ্যতের সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটি করে, আগুন।
তারা বুঝতে শেখে, অন্যান্য যে কোনও প্রাণী আগুনকে ভয় পায়। ফলে তারা আগুন ব্যবহার করে হিংস্র প্রাণীদের দূরে রাখা বা আক্রমণ করার কৌশল অবলম্বন করে। পরবর্তীতে শুধু বন্যপ্রাণী নয়, অপর মানব শত্রুকেও আক্রমণ করতে আগুনের ব্যবহার শুরু হয়।
লাঠির মাথায় আগুন জ্বেলে বিপক্ষকে ভয় দেখানো বা আক্রমণ করা, দুটো কাজই করা যেত। ভীষ্ম পর্বে অগ্নিদণ্ড নামক একটি অস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ ছাড়াও দ্রোণ ও শল্যপর্বে অলাতচক্র নামক একটি অস্ত্রের উল্লেখ করা হয়। আদতে এটি দিয়ে বিপক্ষের তাড়নকার্যই করা হতো। কারণ এর গঠন বর্ণনা দেখলে বোঝা যায়, আক্রমণ সহায়ক অস্ত্র হিসেবে এটি বেশ দুর্বল। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র শাস্ত্রী বলেছেন, একটি লাঠির দুদিকে আগুন জ্বেলে ঘোরানো হতো, তাতে যে অগ্নিগোলক তৈরী হতো, সেটিই অলাতচক্র।
আজও বেশ কিছু উপজাতি সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অলাতচক্রের ব্যবহার দেখা যায়।
প্রাচীন কালে শুধু লাঠির মাথায় আগুন জ্বেলেই তা ব্যবহার হতো এমন কিন্তু না। বিভিন্ন দাহ্য পদার্থে আগুন জ্বালিয়ে, তা শত্রুর দিকে ছুঁড়ে মারা হত মাঝেমধ্যে। গন্ধক, কাঠকয়লা, গালা, লাক্ষা, বিভিন্ন দাহ্য তেল ইত্যাদি এই কাজে ব্যবহার করা হতো। জতুগৃহে পাণ্ডব র পুড়িয়ে মারার জন্য ঘর তৈরির সময় লাক্ষা, গালা ইত্যাদির ব্যবহার করা হয়েছিল।
এরপর বলতে হয় তীর জাতীয় অস্ত্রের কথা, যা আবিস্কারের পর আগুন জ্বেলে তা দূরে ছুঁড়ে দেওয়া বহুগুণে সহজ হয়েছিল। তীরের ফলায় শন, খড় ইত্যাদি, বা দাহ্য তেলে ভেজা ন্যাকড়া জড়িয়ে, তাতে আগুন জ্বালিয়ে ছোঁড়া হতো দূরে। প্রধানত যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর তাঁবু জ্বালিয়ে দেওয়া বা শত্রু সৈন্যকে পর্যুদস্ত করতে এই পন্থা অবলম্বন করা হতো।
মহাভারতে ভার্গবাস্ত্র, ব্রহ্মশির, ব্রহ্মাস্ত্র, উল্কা ইত্যাদি অস্ত্রের সাধারণ বর্ণনা থেকে এদের আগুন যুক্ত তীর বলেই মনে হয়।
আগুনের পর মানুষের আরেকটি কৃতিত্ব ছিল খনিজ ধাতুর আবিষ্কার। সম্ভবত মাটি খুঁড়ে চাষাবাদ করতে গিয়েই প্রথম খনিজ ধাতুর সন্ধান পায় আদিম মানুষ।
তাদের প্রথম আবিষ্কৃত ধাতু ছিল তামা। তবে তামা জিনিসটা খুব একটা সহজলভ্য আর শক্ত আর না হওয়ায়, তামার অস্ত্রের প্রচলন বেশ কম ছিল। ছুরি, জাঁতি জাতীয় ছোট ছোট অস্ত্রে তামার ব্যবহার থাকলেও যুদ্ধাস্ত্রে এর ব্যবহার সেরকম ছিল না।
তবে সম্ভ্রান্ত পরিবারের যোদ্ধাদের তামার তৈরী বর্ম, মুকুট বা অলঙ্কার পরতে দেখা যেত, মহাভারতে তামার তৈরি বাসনের উল্লেখ ও পাওয়া যায়।
বনপর্বে ধৌম্য দ্রৌপদীকে তামার হাঁড়ি উপহার দেন।
আমার অনুমান কর্ণের বর্ম এবং কুণ্ডল ও তামার তৈরি ছিল। এই তিনটি বস্তুকেই সূর্যদত্ত বলা হলেও তামার সপক্ষে কিছু যুক্তি দেওয়াই যায়। সম্ভবত প্রাচীন মানুষ তামার মতো দুষ্প্রাপ্য ধাতু সম্পর্কে বিশেষ অবগত ছিল না, আর এই হাঁড়ি, বর্ম ও কুণ্ডল যেহেতু সূর্যের আলোয় চকমক করতো, সেইহেতু ওগুলি সূর্যের বরপ্রাপ্ত বলে মনে করা হতো।
তামা দিয়ে শক্ত অস্ত্র বানাতে বিফল মানুষ কিছুকালের মধ্যেই বুঝলো, ওই ধাতুর সঙ্গে টিন মেশালে কাঁসা তৈরি করা সম্ভব, যা তুলনামূলক শক্তিশালী। এই কাঁসা দিয়েও সম্ভ্রান্ত পরিবারের গয়না, বাসন ইত্যাদি তৈরি হতো। তবে খুব বেশি শক্তিশালী না হওয়ায় যুদ্ধক্ষেত্রে কাঁসা খুব কম ব্যবহার করা হতো।
ঘটোৎকচের বর্ণনায় দেখা যায়, সে কাঁসার তৈরি বর্ম ব্যবহার করতো।
যেকোনও রকম অস্ত্রশস্ত্রের ইতিহাস আমূল বদলে দেয় লোহার আবিষ্কার। প্রথম দিকে শুধু লোহা দিয়েই অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হতো, পরে লোহার সঙ্গে অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে ইস্পাত তৈরি করা হয়।
লোহা বা ইস্পাতের তৈরি হাতিয়ার গুলি কে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়- (১) ভোঁতা শস্ত্র, (২) ধারালো শস্ত্র ,আর (৩) ধারালো অস্ত্র।
১) ভোঁতা শস্ত্র- এই শ্রেণীর শস্ত্র ব্যবহার করে বিপক্ষকে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করা যেত। শত্রুর হাড় ভেঙে দেওয়া বা গভীর শারীরিক ক্ষতিসাধনে এই ধরণের শস্ত্র বিশেষ কার্যকরী ছিল।
গদা- মহাভারতে তীর ধনুকের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার বোধহয় এই গদা। সাধারণত গোল, চৌকো বা শাঙ্কবাকার মাথা ও সরু হাতল বিশিষ্ট শস্ত্রই গদা নামে পরিচিত ছিল। ধরার সুবিধার জন্য এর হাতলে পাটের সুতো জড়ানো হতো। এর দৈর্ঘ্য মোটামুটি দেড় থেকে দুই হাত হতো। প্রচণ্ড ভারী হওয়ায় শক্তিশালী যোদ্ধা ছাড়া কেউ গদার ব্যবহার করতেন না।
সাধারণত লোহা দিয়ে তৈরি এই শস্ত্রের মাথা ছিল বর্তুলাকার। এর মাথায় বেশ শক্ত ও ছুঁচলো কিছু ধাতব কাঁটা লাগানো থাকতো।
উদ্যোগ পর্বে ভুশুণ্ডি নামক একপ্রকার অষ্টভূজাকার মাথা বিশিষ্ট গদার উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও, দ্রোণপর্বে অস্থিসন্ধি নামক একপ্রকার গদা দেখা যায়। শত্রুর হাড় ভেঙে দেওয়ার কাজে এই গদা ব্যবহার করা হতো।
মহাভারত সহ, প্রায় সমস্ত সংষ্কৃত গ্রন্থেই মুষল নামক এক প্রকার গদার উল্লেখ পাওয়া যায়, হামান-দিস্তার দণ্ডের মতো দেখতে তুলনামূলক হালকা এই গদা যদু-বৃষ্ণীদের বেশী ব্যবহার করতে দেখা যায়।
যুদ্ধ প্রস্তুতি, ব্যায়াম ইত্যাদি কাজে মুদ্গর নামক একপ্রকার গদার ব্যবহার করা হত। নীম্নশ্রেণীর যোদ্ধারা এই গদা যুদ্ধক্ষেত্রেও ব্যবহার করতেন। সম্ভবত আজকের মুগুর এই মুদ্গরেরই রূপান্তর।
দ্রেণপর্ব ও কর্ণপর্বে পরিঘ নামের এক গদার উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী, ভারী ও মোটা এই গদার মাথা ছিল ছুঁচলো।
২) ধারালো শস্ত্র- এই তীক্ষ্ণধার হাতিয়ারগুলি সাধারণত হঠাৎ প্রচণ্ড আঘাত করে বা সজোরে খোঁচা দিয়ে আঘাত করে বিপক্ষের শরীরের কোনো অংশ ছেদন করতে ব্যবহৃত হতো। দূর ও নিকট দুই যুদ্ধেই এই হাতিয়ার ব্যবহার করা হলেও, নিকট যুদ্ধে এগুলি ছিল অমোঘ। এই শ্রেণীর অস্ত্র ও শস্ত্র আলাদা করে বর্ণনা করা হলো-
তীক্ষ্ণ ধার শস্ত্রের কথা বললে প্রথমেই আমাদের মাথায় আসে তরোয়ালের কথা। কাঠ বা লোহার হাতলের মাথায় লাগানো লম্বা লোহা বা ইস্পাতের পাতকে তরোয়াল বলা হয়। অবশ্য বাঁকা, সরু, মোটা, ছুঁচলো, চওড়া ইত্যাদি নানা ধরণের তরোয়াল দেখা যায়। এই শস্ত্র দিয়ে বিপক্ষের অঙ্গ কেটে ফেলা, খুঁচে দেওয়া বা প্রয়োজনে অস্ত্রের মতো ছুঁড়ে মারাও যেত।
মহাভারতের সময় তরোয়ালের ব্যবহার কিন্তু বেশ কম ছিল। রাজা, সেনাপতি বা বড়ো যোদ্ধা ছাড়া ছোট সৈনিকরা তরোয়াল ব্যবহার করতেন না। মহাভারত প্রভৃতি সংষ্কৃত গ্রন্থগুলিতে তরোয়ালের বিভিন্ন নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন তরবারি, সায়ক, অসি, খড়্গ, কৃপান, নিস্ত্রিংশ, ঋষ্টি, ক্রকচ ইত্যাদি।
সংষ্কৃত গ্রন্থগুলিতে অসির বর্ণনা থেকে জানা যায়, এটি ছিল সোজা, লম্বা, ছুঁচলো ও একদিক ধার বিশিষ্ট ফলা যুক্ত তরোয়াল।
খুব চওড়া ফলক বিশিষ্ট তরোয়ালগুলি খড়্গ নামে পরিচিত। শান্তিপর্বের ১৬৬তম অধ্যায়ে খড়্গকে উৎপত্তিগত দিক থেকে পবিত্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই একই অধ্যায়ে বিশসন, খড়্গ, বিজয়, ধর্মপাল, তীক্ষ্ণধার প্রভৃতি নামের খড়্গের উল্লেখ পাওয়া যায়।শান্তিপর্বে নকুল বলেছেন, হাতে খড়্গ থাকলে সে যেকোনও পরাক্রমশালী শত্রুর মোকাবেলা করতে পারে! দ্রোণ পর্বেও খড়্গ ব্যবহারের একুশটি পদ্ধতি ব্যক্ত করা হয়েছে।
ভীষ্ম পর্বে কৃপাণ ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়।
বন, ও দ্রোণপর্বে নিস্ত্রিংশ নামের এক তরোয়াল এর উল্লেখ আছে। কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে বলেছেন, এই তরোয়ালগুলি লম্বা কুকরির মতো, ফলার ভিতরের অংশ ধারালো।
মহাভারতে ক্রকচ নামক আরেকটি তরোয়ালের উল্লেখ আছে। এই লম্বা ও ঋজু তরোয়াল এর ফলায় করাতের মতো খাঁজকাটা থাকতো।
রণকুঠার- ভারতীয় পুরাণে রণকুঠার বা Battle Axe একটি গুরুত্বপূর্ণ শস্ত্র। গণেশ, পরশুরাম, কর্ণ প্রমুখ পৌরাণিক চরিত্রের প্রিয় শস্ত্রগুলির মধ্যে রণকুঠার অন্যতম। মহাভারতে রণকুঠারের নাম পাই পরশ্বধ বা পরশু হিসেবে। পরবর্তীতে রণকুঠার আর পরশু আলাদা হয়ে গেলেও, মহাভারতে পরশুর বর্ণনা থেকে তা রণকুঠার বলেই মনে হয়। এর ফলক হতো মোটা, উজ্জ্বল ধার বিশিষ্ট ও অর্ধচন্দ্রাকৃতি। পরশুর ফলক ধাতব হলেও, হাতল কাঠ বা ধাতু যেকোনো উপাদানেরই হতে পারতো। কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে বলেছেন এটি প্রায় চব্বিশ আঙ্গুল লম্বা লৌহময় ক্ষুরযন্ত্র (ধারালো) বিশেষ।
সম্ভ্রান্ত পরিবারের যোদ্ধারা পরশুর ধাতব হাতল বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য ধাতু, মণিমুক্তা দিয়ে সজ্জিত করতেন। কর্ণ পর্বে কর্ণের ব্যবহৃত পরশুর হাতলে সোনার উপস্থিতি বর্ণনা করা হয়েছে।
শক্তি- মহাভারতীয় সমাজের একটি সহজলভ্য ও জনপ্রিয় শস্ত্র ছিল এই শক্তি। শক্তি কতকটা আধুনিক বল্লম বা বর্শা জাতীয় শস্ত্র। তবে শক্তি শুধুমাত্র শস্ত্র না, অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। শক্তি ছিল লোহার বা কাঠের লম্বা হাতলের মাথায় লোহার ছুঁচলো ফলক লাগানো শস্ত্র। বাঁকা লাঠির জন্য অনেক সময় সাপের মতো বাঁকা শক্তিও দেখা যায়। শক্তি সাধারণত চার থেকে পাঁচ হাত লম্বা হতো। সময়ে সময়ে ধরার সুবিধার জন্য আলাদা করে হাতলও লাগানো হতো। অর্থশাস্ত্রে বলা হয়, করবীর পাতার ন্যায় ফলা যুক্ত শক্তিই সর্বশ্রেষ্ঠ।
গোরু বা মহিষের শিং-এর তৈরী ফলা লাগানো বর্শাগুলি গোশীর্ষ নামে পরিচিত ছিল।
এছাড়াও মহাভারতে কুপন নামে একপ্রকার ছোট, সম্পূর্ণ লোহার তৈরি বর্শার উল্লেখ আছে, যার দুদিকের মাথাতেই ত্রিকন্টকাকার ফলা লাগানো থাকতো।
কুন্ত- মহাভারতে ছয়দিক বিশিষ্ট কাঁটাওয়ালা ফলক যুক্ত এক ধরনের বল্লমের উল্লেখ আছে, এটাই কুন্ত। সাধারণ শক্তি জাতীয় বল্লমের থেকে বড়ো ও ভারী এই বল্লম পুরোপুরি লোহার তৈরি হতো। পণ্ডিত রাধাগোবিন্দ বসাক বলেছেন, কুন্ত প্রায় ছয়-সাত হাত লম্বা হতো।
শূল- মহাভারতে বহুবার এই শস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। শূল সাধারণত এক, দুই ও তিনটি মুখযুক্ত হতো। এর মধ্যে এক ও তিনটি মুখওয়ালা শূল সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল। শূলগুলি সাধারণত সম্পূর্ণ লোহার তৈরি হতো। কুরুক্ষেত্রে শূল নিয়ে যুদ্ধের বর্ণনা আছে, এ ছাড়াও শিবের হাতে ত্রিশূল দেখা যায়।
তোমর- তোমর নামক শস্ত্রটি সাধারণত ঘোড়সওয়ার, রথী প্রমুখ ব্যবহার করতেন। এই শস্ত্রে একটি ধাতব বা কাঠের দণ্ডের মাথায় ধাতব শিকল দিয়ে বাঁধা থাকতো এক বা একাধিক ধাতব বল। এই বলগুলি অধিকাংশ সময়েই কাঁটা যুক্ত হতো।
ঠিকঠাক পদ্ধতি মেনে ব্যবহার করলে তোমার দিয়ে শত্রুর দেহে ক্ষত ও হাড় ভেঙে দেওয়া, দুটো কাজই করা যেত।
ভল্ল- মহাভারতে উল্লিখিত ভল্ল নামক শস্ত্রটি নিয়ে বহু পণ্ডিতের মতভেদ রয়েছে, তবে সেগুলিকে একত্র করলে মনে হয়, ভল্ল ছিল ভারী ও চওড়া ফলক বিশিষ্ট ছোট বল্লম, যা প্রয়োজনে বড়ো ধনুকে লাগিয়ে তীরের মতোও ব্যবহার করা যেত।
ধাত্র- কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বর্ণনায় এই ধাত্র-র উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্ণনা থেকে মনে হয়, আধুনিক দা এর পূর্বসূরি ছিল এই ধাত্র। সাধারণত ছোট সৈনিক রা এই শস্ত্রের ব্যবহার করতেন।
৩) ধারালো অস্ত্র- ধারালো শস্ত্র অর্থাৎ ছুঁড়ে মারার উপযুক্ত ধারালো হাতিয়ার মহাভারতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মাত্র দুটি ধারালো অস্ত্র একপ্রকার আচ্ছন্ন করে রেখেছে- তীর ও চক্র।
মহাভারতে তীরের ব্যবহার নিয়ে অনেক গবেষকই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের কথায় ওই সময় আর্য্যরা প্রধাণত লাঠি,পাথর ও গদাযুদ্ধ করতো। তীরের ব্যবহার ছিল স্থানীয় আদিবাসীদের মধ্যে। প্রধানত হড় কিংবা সাঁওতাল গোষ্ঠীর মধ্যে তীরের ব্যবহার প্রচলিত ছিল।
মহাভারতে তীরের ব্যবহার নিয়ে সন্দেহ করার প্রচুর কারণ আছে-
ধাতুর তীর প্রায় তিন থেকে চারশো গজ দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। সেখানে প্রতিটি যুদ্ধের শুরুতে দুই তীরন্দাজ পরস্পরের সঙ্গে বাকযুদ্ধে জড়ায়; ছুটে গিয়ে প্রণাম করে! আবার তীর লেগে কুরুক্ষেত্রে কারো চোখ নষ্ট হয়নি! যেখানে তীরের ভীড়ে আকাশ আচ্ছন্ন হয়ে যায়, সেখানে একজন যোদ্ধারাও চোখে তীর গাঁথে না?!
কিন্তু মহাভারতের পরতে পরতে আছে তীরন্দাজির প্রমাণ। তাই আমরা ওই গবেষক দের ধারণার সঙ্গে মহাভারতের প্রচলিত ধারণা মিশিয়ে বলার চেষ্টা করছি।
সাঁওতাল জাতির আবাসস্থল প্রধাণত পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, বর্ধমান, পুরুলিয়া ও ঝাড়খণ্ড ইত্যাদি অঞ্চলে। ড. অতুল সুর পাঞ্চাল রাজ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম ও সাঁওতাল পরগণার কাছাকাছি এর অবস্থান ছিল। আর এই পাঞ্চালেই জন্মান মহাভারতের সবচাইতে বিখ্যাত অস্ত্রগুরু দ্রোণ। তিনি সম্ভবত ওই আদিবাসীদের থেকেই তীরন্দাজি শিখেছিলেন। তারপর, হস্তিনাপুরে এসে তীরচালনা শেখান সারা ভারতের প্রচুর রাজপুত্রকে। মহাভারতের উল্লেখযোগ্য ছোট বড়ো প্রায় সমস্ত তীরন্দাজই দ্রোণের শিষ্য, নয়তো তাঁর শিষ্যদের শিষ্য।
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, ভীষ্ম, পান্ডু বা বিচিত্রবীর্য কিভাবে তীর চালনা শিখলেন?
এর উত্তরে বলা যায়, ভীষ্মের যৌবনকালে সম্ভবত আর্যদের সাম্রাজ্য বিস্তারের স্পৃহা ততটাও দানা বাঁধেনি, বড়োজোর ছোট ছোট যুদ্ধ করে বা বৈবাহিক সম্পর্কের দ্বারা রাজ্য অধিগ্রহণ হয়েছে। ফলে ওই সময় প্রতিটি গোষ্ঠীপতি নিজেকে রাজা বলতে পারতেন। শান্তনুর রাজত্বকালে তাই ইন্দ্র থেকে শুরু করে জেলে, কাঠুরিয়া, নিষাদ পর্যন্ত সব গোষ্ঠীর নেতারাই রাজার সম্মান পেতেন। এই সময় আর্য্যরা ততটা সম্মান ও লাভ করেনি হয়তো। তাই জেলে সম্প্রদায়ের "রাজা"র সামনেও আর্য্য রাজ শান্তনু করজোড়ে দাঁড়ান। যাইহোক, খুব সম্ভবত এই সময়ে রাজপুত্ররা স্বচ্ছন্দে আদিবাসী বা অন্য যে কোনও সম্প্রদায়ের যে কোন ব্যক্তির কাছে শিক্ষা লাভ করতে পারতেন। এভাবেই হয়তো ভীষ্ম তীরন্দাজ হয়েছিলেন। আর জেঠুর থেকে অস্ত্র বিদ্যা লাভ করবে ভাইয়ের ছেলেরা.. এ ভাবেই হয়তো পান্ডু বা বিচিত্রবীর্য তীরন্দাজী শেখেন।
কৃষ্ণের কাছে শার্ঙ্গধনু থাকলেও গোটা মহাভারতে তা ব্যবহার করতে দেখা যায় না। শার্ঙ্গধনু কয়েকবার ব্যবহার করা হলেও, তা করেছেন বিষ্ণু। আর বিষ্ণু সেই আদিবাসীদের নেতাই ছিলেন।
যাইহোক, এইবার মহাভারতে ব্যবহৃত তীর-ধনুকের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যাক..
তীর-ধনুক- মানুষের আবিষ্কার করা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলির মধ্যে প্রাচীনতম হাতিয়ার এই তীর। মহাভারতের সময় সবথেকে জনপ্রিয় ও সহজলভ্য হাতিয়ার ছিল এই তীর-ধনুক।
আর্যদের আগমনের আগে থেকেই অবশ্য ভারতীয় আদিবাসীদের মধ্যে তীরের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। অন্য যেকোনও গোষ্ঠীর থেকে হড় কিম্বা সাঁওতাল গোষ্ঠীর মধ্যে তীর ধনুকের প্রচলন বহু পুরনো।
প্রথম দিকে লম্বা বা বেঁটে ও সরু লাঠির মাথায় পাথরের ধারালো টুকরো লাগিয়ে তৈরি হতো তীর। পরবর্তীতে ধাতুর আবিষ্কার হলে, প্রধাণত লোহার ছুঁচলো ফলা যুক্ত সম্পূর্ণ লৌহময় তীর বানানো হতে থাকে। তীরের পিছনে পালক, পাতলা কাঠের শাঙ্কবাকার টুকরো বা পরের দিকে ধাতুর পাতলা পাত লাগিয়ে তীরটিকে বাতাসের মধ্যেও অনুভূমিক রাখার উপযুক্ত বানানো হতো। পুচ্ছ-বিহীন তীরগুলি বেশী দূর যেতে পারতো না, তাই এদের নিম্নশ্রেণীর তীর বলা হয়েছে। এগুলি বিশিখ নামে পরিচিত।
মহাভারতে একটি তীর কে তিনটি অংশে ভাগ করা হয়- ফলক, দণ্ড ও পুচ্ছ।
তীরের ফলক লোহা, হাড়, পাথর বা কাঠের ধারালো টুকরো দিয়ে তৈরি হতো। এই ফলক নানা আকৃতির হতে পারে। মহাভারতে উল্লিখিত তীরগুলি ফলকের আকার ও প্রকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত, যেমন-
ভল্ল- ভল্লের ফলকের মতো দেখতে লক লাগানো, অর্ধচন্দ্র- অর্ধেক চাঁদের আকৃতির ফলা, বৎসদন্ত- বাছুরের দাঁতের মতো খাঁজকাটা ফলক, সূচীমুখ- সূচের মতো সরু, ছুঁচলো ফলক, তোমর- ফলকের বদলে থাকতো তোমরের কন্টকাকার গোল অংশটি।
পাথরের ফলা বিশিষ্ট তীরগুলি শিলিমুখ নামে পরিচিত ছিল, আর যেসব তীরের ফলায় শন, শুকনো ঘাস বা তেলে ভেজানো কাপড়ের টুকরো জড়িয়ে আগুন লাগানো হতো, তাদের নাম ছিল অগ্নিমুখ। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল ফলায় উদ্ভিজ্জ বা প্রাণীজ বিষ মাখানো তীরগুলি।
তীরের দণ্ড বাঁশ, নল বা ওই জাতীয় গাছের সরু, হালকা অথচ শক্ত শলাকা দিয়ে বা ধাতু দিয়ে তৈরি হতে পারে। যেসব তীর সম্পূর্ণ লোহার তৈরি, তাদের নাম ছিল নারাচ।
যোদ্ধা রা অনেক তীর নিয়ে যুদ্ধে যেতে, ফলে আধারের প্রয়োজন ও ছিল, এই আধারগুলি তূণ, তূণীর ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল। তূণ তৈরী হতো চামড়া, বাঁশ, কাঠ, বা লোহা দিয়ে। অর্জুন, কর্ণ, ভীষ্ম প্রমুখ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির তূণ রত্নখচিত ছিল বলে জানা যায়। তীর ছোঁড়ার জন্য প্রধানতম মাধ্যম ছিল ধনুক। ধনুক তৈরীর বিভিন্ন উপকরণ অনুযায়ী একে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়-
চাপ- বেণু জাতীয় নরম অথচ অভঙ্গুর বাঁশ ছুলে তৈরি হতো এই ধনুক।
দারুময়- কাঠের তৈরি ধনুকগুলি এই নামে পরিচিত। সাধারণত চন্দন, শাল প্রভৃতি কাঠে তৈরি হতো এই ধনুক।
শার্ঙ্গ- প্রাণীর শিং দিয়ে তৈরি ধনুক গুলি শার্ঙ্গধনু নামে পরিচিত। সাধারণত বড়ো মহিষ, শরভ, রুরু প্রভৃতি হরিণের শিং দিয়ে তৈরি হতো শার্ঙ্গধনু। এই ধনুক তুলনামূলক ছোট আকৃতির হতো। তীরের দূরত্ব ও অন্য ধনুকে ছোঁড়া তীরের থেকে কম হতো। মহাভারতে কৃষ্ণ, ভগদত্ত প্রমুখ এই ধনুক ব্যবহার করতেন।
এ ছাড়াও নানা প্রাণীর হাড় দিয়েও ধনুক তৈরি হতো। অর্জুন গন্ডারের পাঁজরের হাড় দিয়ে তৈরী ধনুক গাণ্ডীব ব্যবহার করতেন।
পরের দিকে ধাতুর তৈরি ধনুকও ব্যবহার করা হতো। সম্ভবত কর্ণের ব্যবহৃত বিজয় ধাতব ছিল।
ধনুকের গুণকে বলা হতো জ্যা। মহাভারতে প্রধানত দুই রকম জ্যা এর কথা জানা যায়- পট্টসূত্র ও স্নায়ু।
পট্টসূত্র- পাট, শন প্রভৃতি গাছের পাতলা ও শক্ত আঁশ দিয়ে তৈরি জ্যা পট্টসূত্র নামে পরিচিত।
স্নায়ু- হরিণ, মহিষ প্রভৃতি প্রাণীর স্নায়ু অর্থাৎ নালীকা দিয়ে এই জ্যা তৈরি হতো।
এছাড়াও, চামড়ার ফিঁতে দিয়ে জ্যা তৈরির কথাও জানা যায়।
চক্র- মহাভারতের মহাযুদ্ধ ঘটার যতগুলি প্রধান কারণ আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে চক্র। ভারতীয় পুরাণ ও ইতিহাস ঘাঁটলে চক্রের প্রচুর ব্যবহার দেখা যায়, কিন্তু মহাভারতে শুধুমাত্র কৃষ্ণ ছাড়া কাউকে চক্র ব্যবহার করতে দেখা যায় না। তার মানে কি কৃষ্ণ খুব আধুনিক এবং অসাধারণ কোনও অস্ত্র ব্যবহার করতেন? উত্তর হলো.. না। মহাভারতে কৃষ্ণ ছাড়াও অন্য কয়েকজনের হাতে চক্র দেখা যায়।
হস্তিনাপুরের পশ্চিমি রাজ্যগুলির মধ্যে চক্রের ব্যবহার বহুকাল আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। প্রধানত শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে চক্রের ব্যবহার বিশেষ ধর্মীয় গুরুত্ব বহন করে। তাঁরা এটিকে চক্রম্ নামে অভিহিত করেন। শিখ যোদ্ধারা সাধারণত ছোট আকারের চক্রম্ কোমরে, ও বড়ো চক্রম্গুলি পাগড়ীতে বেঁধে রাখতেন। অভিজ্ঞ যোদ্ধারা বলেন, ঠিকভাবে ছুঁড়তে পারলে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও এই অস্ত্র বুমেরাং এর মতো ব্যবহারকারীর কাছে ফিরে আসতে পারে।
এই চক্র বেশ কয়েক ধরনের হয়ে থাকে, যেমন নিরেট, মাঝখানে ফাঁকা অবলম্বন বিহীন ও মাঝখানে এক বা একাধিক হাতল যুক্ত চক্র।
হাতল যুক্ত চক্রগুলি সাধারণত হাতে ধরে শস্ত্রের মতো ব্যবহার করা হতো। তবে প্রয়োজনে ছুঁড়েও ব্যবহার করতে দেখা যায়।
নিরেট চক্রগুলির মাঝে একটি ফুটো থাকে, এখানে তর্জনী গলিয়ে ধরতে হয়।
তবে সবচাইতে ভয়ঙ্কর হলো মাঝখানে ফাঁকা ও অবলম্বন বিহীন চক্র। বর্তমানে প্রচলিত ছবি ও মূর্তিতে কৃষ্ণের হাতে এই ধরনের চক্র ও নিরেট চক্র, দুটোই দেখা গেলেও, মহাভারতে তাঁর চক্র ব্যবহারের বর্ণনা দেখলে এই হালকা ধাতব পাতের তৈরি অবলম্বন বিহীন চক্রের কথাই মাথায় আসে। এগুলি তর্জনী বা অন্য কোনো একটি আঙুলের চারদিকে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিতে হয়। এগুলি ঠিকভাবে ছুঁড়তে পারলে বিপক্ষের অঙ্গহানী অসম্ভব নয়। আর কাছ থেকে ছুঁড়ে অভিজ্ঞ যোদ্ধা বিপক্ষের গলা কাটতেই পারে, তবে এই অস্ত্র দিয়ে সম্ভবত মুণ্ডচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। এইভাবেই রাজসূয় যজ্ঞের সময় কৃষ্ণ শিশুপালকে হত্যা করেন।
উল্লেখযোগ্যভাবে দেখা যায়, শুধুমাত্র যাদব বীররা বা তাঁদের কাছে প্রশিক্ষণ পাওয়া যোদ্ধারাই যুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য চাকা জাতীয় দ্রব্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কৃষ্ণ নিজেও কিন্তু শুধু ধাতব চক্র নিয়েই যুদ্ধ করেননি। ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে কৃষ্ণ হাতে তুলে নেন রথের ভাঙা চাকা।
আসলে চক্র জিনিসটা ডুয়েল জাতীয় স্বল্পদূরত্বের যুদ্ধে কার্যকর হলেও, বড়ো ও বিধ্বংসী যুদ্ধে এ জিনিস একদমই ব্যবহার করা যায় না। তাই নিরস্ত্র শিশুপাল কে চক্র দিয়ে সামনে থেকে হত্যা করলেও, ভীষ্মের বিরুদ্ধে কৃষ্ণের হাতে উঠে আসে রথের চাকা।
শুধু কৃষ্ণ কেন, চক্রব্যুহের মধ্যে বিপদে পড়ে অভিমন্যুকেও ভাঙা রথের চাকা তুলে নিতে দেখা যায়। আর তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই অভিমন্যু কিন্তু পিতা মাতার অনুপস্থিতিতে কৃষ্ণের বাড়িতেই শিক্ষালাভ করেছিলেন।
চক্রব্যুহের কথাই যখন উঠলো, এর সঙ্গে চাকার মিলটা খেয়াল করুন। কুরু সৈন্যের বাইরে যাঁরা এই চক্রব্যুহের ভিতর ঢোকা-বেরোনোর কৌশল জানতেন, তাদের অধিকাংশই কোনও না কোনও ভাবে যাদব বংশের সঙ্গে যুক্ত। মহাযোদ্ধা হিসেবে কৃষ্ণ বা তাঁর বন্ধু অর্জুন যে চক্রব্যুহের রহস্য জানবেন, এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তুলনামূলক ছোট যোদ্ধা সাত্যকি, শাম্ব এমনকি বালক শিক্ষানবিশ অভিমন্যুও জানতো চক্রব্যুহে প্রবেশের গোপন রহস্য। অর্থাৎ একথা বলাই যায় যে, চক্র জাতীয় অস্ত্র ও যুদ্ধরীতির কৌশল যদুবংশে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় লালিত হয়েছিল।
দিব্যাস্ত্র- মহাভারত তথা প্রায় সমস্ত পৌরাণিক গ্রন্থেই এমন কিছু হাতিয়ারের কথা পাওয়া যায়, যার তথাকথিত প্রচলিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা বিবরণ কোনোটিই পাওয়া যায় না। সংষ্কৃত গ্রন্থগুলিতে এই অস্ত্রকে 'দিব্যাস্ত্র' বলা হয়েছে। এই হাতিয়ারের প্রয়োগে নানা অলৌকিক ঘটনা ঘটার উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলি নিক্ষেপ করার পর নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা প্রতিপক্ষের একসঙ্গে বহু মানুষের শারীরিক ক্ষতিসাধনের বিবরণ দেয় এই গ্রন্থগুলি। মহাভারতের প্রায় প্রতিটি যুদ্ধেই কোনও না কোনও দিব্যাস্ত্রের ছোট বড়ো ব্যবহার আছেই। তাই এর উল্লেখ ছাড়া মহাভারতে ব্যবহৃত অস্ত্রের বর্ণনা করা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে দিব্যাস্ত্রের কোনও যুক্তিসঙ্গত মিল পাওয়া যায়নি আজও। এ ছাড়াও মানুষের সৃষ্টির ইতিহাস ও বিবর্তনের সূত্র খেয়াল করে লৌহযুগে দাঁড়িয়ে মানুষের দিব্যাস্ত্র ব্যবহার নিয়ে প্রচুর গবেষক সন্দেহ প্রকাশ করেন। তাঁদের মতে, গতানুগতিক হাতিয়ারের মাঝে অদ্ভুত ও বিধ্বংসী কোনও অস্ত্র দেখে, তৎকালীন মানুষ সেগুলিকে নিজের মতো কল্পনা করে বর্ণনা করতো। কালক্রমে কবিদের হাতে ইতিহাস লেখার কাজ এলে কাব্য, কল্পনা আর ইতিহাস মিলে দিব্যাস্ত্রের মতো এক অদ্ভুত বস্তুর সৃষ্টি হয়েছে।
আমরা সেরকমই কিছু দিব্যাস্ত্র ও তাদের বাস্তবায়নের সম্ভাবনার কথা বলবো-
বজ্র- বজ্র ইন্দ্রের অস্ত্র। মহাভারত ও অন্যান্য পৌরাণিক গ্রন্থের প্রধানত ইন্দ্রকেই এটা ব্যবহার করতে দেখা গেলেও, ইন্দ্রাণী, চণ্ডী, ঘন্টাকর্ণ প্রমুখ দেবদেবীকে এই অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যায়। পৌরাণিক বর্ণনা অনুযায়ী বজ্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম ছিল, এবং সেই বিদ্যুৎ শত্রুর দিকে ছুঁড়েও দেওয়া যেত। নর্স পুরাণ বর্ণিত বজ্রের দেবতা থরের হাতুড়ির সঙ্গে এর বিশেষ মিল দেখা যায়।
পণ্ডিত হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ বলেন, মহাভারতের আদি, বন ও দ্রোণপর্বে বর্ণিত 'অশনি' নামক অস্ত্রটিই আসলে বজ্রের নামান্তর। বনপর্বে অশনিকে বিদ্যুৎ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।
উল্লেখযোগ্যভাবে "শতপথ ব্রাহ্মণ" গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ইন্দ্র যে বজ্র দিয়ে বৃত্তাসুরকে হত্যা করেন, সেটিতে ১০০০টি কীলক ও ১০০টি কিনারা ছিল।
অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে, এই বজ্র বহু ধার বিশিষ্ট বর্শা বা হার্পুণ জাতীয় কোনও প্রকার অস্ত্র ছিল। অধ্যাপক সর্বদমন সিং বলেছেন, বজ্র অস্ত্রটির দেহে অসংখ্য সন্ধি, কিনারা ও খাঁজ ছিল, যা থেকে বোঝা যায়, এই অস্ত্রতির ফলক তৈরি হতো মানুষ সহ বিভিন্ন প্রাণীর হাড় দিয়ে। অধ্যাপক পাটিলের মতে, প্রথম দিকে পাথর, ও পরে হাড় দিয়ে বজ্র নির্মিত হতো।
মহাভারতে ভীষ্ম, দ্রোণ, অশ্বত্থামা প্রমুখ যোদ্ধাকে ঐন্দ্রাস্ত্র নামের এক অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যায়। এগুলির প্রয়োগ কৌশল থেকে এদের বজ্রের ন্যায় ফলক বিশিষ্ট কোনও বল্লম বা তীর বলে মনে হয়।
পণ্ডিতরা বলেন, বজ্রের আকৃতির সঙ্গে প্রাকৃতিক বজ্রপাতে দেখা যাওয়া আলোর অনেক মিল দেখেই পুরোনো মানুষ এই দুটিকে এক বলে ভাবতো।
আগ্নেয়াস্ত্র- নাম থেকেই বোঝা যায়, এই অস্ত্র ছিল অগ্নিদেবের। মহাভারতে দ্রোণ ও কর্ণপর্বে বলা হয়েছে, এই অস্ত্র নিক্ষেপ করলে আগুনের স্রোত এসে বিপক্ষ সৈন্যদলকে জ্বালিয়ে দিত।
অস্ত্রটির প্রয়োগ কৌশল দেখলে মনে হয় মাথায় আগুন জ্বালানো সাধারণ তীর এটি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মহাভারতে বারবার তীর বৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মেই একজন মানুষ একা অত তাড়াতাড়ি আকাশ আচ্ছন্ন করে ফেলার মতো প্রচুর পরিমাণে তীর ছুঁড়তে পারে না। তাই আমাদের ধরে নিতে হবে, কর্ণ তীর বৃষ্টি করছেন মানে, কর্ণের বাহিনী একসঙ্গে একই নিশানায় তীর ছুঁড়ছে।
একই বর্ণনা মেনে বলা যায়, কোনও যোদ্ধার আগ্নেয়াস্ত্র ছুঁড়ে হাজার হাজার সৈন্য কে দাবদাহের কবলে ফেলার অর্থ হচ্ছে, তাঁর বাহিনী একসঙ্গে অনেক অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করছে।
ব্রহ্মাস্ত্র- প্রায় সমস্ত ভারতীয় পৌরাণিক গ্রন্থের মতোই মহাভারতের দ্রোণ ও সৌপ্তিক পর্বেও এই শ্রেণীর অস্ত্রের বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও গোটা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বারংবার ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহৃত হতে দেখি। সমস্ত দৈবাস্ত্রগুলির মধ্যে অন্যতম বিধ্বংসী অস্ত্র দুটি এই শ্রেণীর মধ্যেই পড়ে- ব্রহ্মাস্ত্র ও ব্রহ্মশির। নাম থেকেই বোঝা যায়, ব্রহ্মার নিজস্ব অস্ত্র ছিল এগুলি।
মহাভারতে দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী বলা যায়, এগুলি নিক্ষেপ করা হলে, এর মধ্যে থেকে শয়ে শয়ে অগ্নিময় শলাকা বেরিয়ে আসে। আর তার প্রভাবে আগুন জ্বলে উঠে বহু সৈন্য একসঙ্গে মারা যায়।
মৎস্য পুরাণে উল্লিখিত সৌর অস্ত্রের সঙ্গেও এর বেশ মিল পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, ব্রহ্মশির অস্ত্র প্রয়োগ করলে এটি থেকে অসংখ্য ছোট ছোট উল্কা নির্গত হয়ে বাতাসের তাপমাত্রা প্রচণ্ড বাড়িয়ে দেয় ও শত্রু সৈন্যকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
সুতরাং বর্ণনা থেকে ধরে নেওয়া যায়, ব্রহ্মাস্ত্র গোত্রের অস্ত্র হিসেবে অগ্নিময় ফলক যুক্ত নয়, বরং গোটা তীরেই পাটের দড়ি বা উদ্ভিজ্জ তেল দিয়ে আগুন জ্বেলে নিক্ষেপ করা হতো। এবং একসঙ্গে বহু ধনুক এরকম তীর থেকে নির্গত হয়ে উল্কার মতো শত্রুর শরীরে, তাঁবুতে ঝরে পড়ে তা জ্বালিয়ে দিত।
রাজতরঙ্গিণী গ্রন্থে যুদ্ধের সময় অগ্নিময় তীর থেকে শত্রু শিবিরে আগুন লাগার কথা বলা হয়েছে।
মহাভারতে অবশ্য ব্রহ্মশিরকে বেশি বিধ্বংসী বলা হলেও, ব্রহ্মাস্ত্রের সম্মান ও ক্ষমতা তুলনামূলক কম ছিল। আর সেজন্যই ছোট বড়ো যোদ্ধারা যখন খুশি এটি ব্যবহার করেছে। এখানে অর্জুন কখনও অশ্বত্থামা আবার কখনও সংশপ্তকদের বিরুদ্ধে ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করেন। আবার দ্রোণের বিরুদ্ধে যুধিষ্ঠির ও এই অস্ত্র প্রয়োগ করেন।
নারায়ণাস্ত্র- মহাভারত, নীতিপ্রবেশিকা প্রভৃতি গ্রন্থে এই অস্ত্রের উল্লেখ আছে। ছলনার দ্বারা ধৃষ্টদ্যুম্নের হাতে দ্রোণের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ক্ষুব্ধ অশ্বত্থামা পাণ্ডব সৈন্যদের বিরুদ্ধে এই অস্ত্র প্রয়োগ করেন। বলা হয়েছে, এটি প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বজ্রপাত ও ভূমিকম্প হয়েছিল। এর প্রভাবে চারিদিক অন্ধকার হয়ে সূর্যও মলিন হয়ে গিয়েছিল। আর পরমুহূর্তেই এর ভিতর থেকে অসংখ্য অগ্নিমুখ তীর, উল্কা প্রভৃতি ছুটে এসে শত্রু সৈন্যকে আক্রমণ করেছিল।
অতয়েব বোঝাই যাচ্ছে, নারায়ণাস্ত্র কোনও ভয়ঙ্কর বিস্ফোরক ছিল, যা থেকে প্রচুর শব্দ, ধোঁয়া ও আগুন বেরিয়ে আসতো!
ভার্গবাস্ত্র- ভৃগুমুনির অনুগামী রা ভার্গব নামে পরিচিত ছিলেন। প্রধানত ব্রাহ্মণ হলেও, এই ভার্গব গোষ্ঠীতে প্রচুর যোদ্ধাও জন্মেছিলেন। ভৃগু মুনি নিজেই একাধারে ব্রাহ্মণ, যোদ্ধা ও সূত ছিলেন। তবে তাঁর অনুগামীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা পরশুরাম। অবতারবাদের আগমনের পর যিনি বিষ্ণুর অবতার রূপে অবতীর্ণ হন। জমদগ্নী পুত্র রামের নাম পরশুরাম হওয়ার কারণ পরশু বা কুঠার চালানোয় তাঁর দক্ষতা। এই পরশুরাম ভার্গবদের মধ্যে প্রচলিত সমস্ত প্রাণঘাতী অস্ত্রের ক্ষমতা একত্রিত করে তৈরি করেন ভার্গবাস্ত্র। তবে তাঁর প্রতিজ্ঞা ছিল নিজের ছাত্র অর্থাৎ ভার্গব ব্রাহ্মণ ছাড়া এই অস্ত্রের ব্যবহার কাউকে শেখাবেন না।
পরবর্তীতে কর্ণ এই অস্ত্র চালনায় শিক্ষা লাভ করেন। কর্ণপর্বে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি পাঞ্চাল ও অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে এই অস্ত্রের প্রয়োগ করেন। মহাভারতে বলা হয়েছে, এটি প্রয়োগের ফলে শত শত উল্কা শত্রুর উপর ঝরে পড়ে তাদের ভষ্ম করে দেয়। একই সঙ্গে ভার্গবাস্ত্র শত্রুর দেহাংশ ছিন্ন করেও তাকে হত্যা করতে পারে।
বর্ণনা থেকে মনে হয়, ভার্গবাস্ত্র ছিল ভার্গব যোদ্ধাদের দ্বারা ব্যবহৃত সমস্ত অস্ত্রের মিলিত রূপ। এটি আদতে কোনও বিশেষ অস্ত্র নয়, একটি বিদ্যা। অস্ত্র চালনার বিদ্যা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে জামদগ্ন্য নামক একপ্রকার যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে একসঙ্গে অনেকগুলো তীর রেখে একবারে নিক্ষেপ করা যেত।
তাই ধরে নেওয়া যায়, পরশুরামই এই যন্ত্র বানিয়ে নিজের বাবার নামে এর নামকরণ করেন, আর যন্ত্রচালনার বিদ্যাটির নাম হয় ভার্গবাস্ত্র। সম্ভবত এটি থেকে তীর, বর্শা, বল্লম, পরশু প্রভৃতি নানা রকম ধারালো অস্ত্র একসঙ্গে ছোঁড়া যেত। তাই ভার্গব বংশের সমস্ত শক্তি একত্রিত করার কথা বলা হয়েছে।
পশুপাত অস্ত্র- এটি পশুপতি শিবের অস্ত্র। পৌরাণিক গ্রন্থগুলি তে এটিকে বিধ্বংসী গণসংহারক অস্ত্র রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। পৌরাণিক অস্ত্রগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত হচ্ছে এই পশুপাত। এর বর্ণনার সঙ্গে পরমাণু অস্ত্রের প্রচুর মিল পাওয়া যায়। ত্রিপুর দুর্গ ধ্বংসকালে মহাদেব এই অস্ত্রের প্রয়োগ করেন। এই অস্ত্র অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে বেশ কড়াকড়ি সুরক্ষা ব্যবস্থায় রাখা হতো। এর ব্যবহার হতো বিস্ফোরক হিসেবে এবং বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য প্রধাণত অগ্নিময় বাণের ব্যবহার করা হতো। পশুপাতের বিস্ফোরণ হলে ব্যাঙের ছাতার ন্যায় অগ্নিশিখা আকাশের দিকে উঠে যেত এবং এর বিস্ফোরণস্থলের আশপাশের বেশ কিছুদূর পর্যন্ত অঞ্চল এক মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যায়। বনপর্বে কিরাতবেশী মহাদেব অর্জুনকে এই অস্ত্র দান করেন। এই সময় তাঁর কথা থেকে বোঝা যায়, পশুপতি অস্ত্রকে নির্দিষ্ট স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে ব্যবহার করা যেত। অর্থাৎ পশুপাত পরমাণু অস্ত্র হলেও, এর ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করা যেত।
তবে এই ধরনের নরসংহারক মারণাস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল এই সময়। তাই চরমতম সংকট উপস্থিত হলেও কুরুক্ষেত্রের ময়দানে অর্জুন কখনও এই অস্ত্র তুলে নেননি।
সুদর্শন- মহাভারতে ব্যবহৃত দৈব অস্ত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে যে অস্ত্রের কথা না বললে সম্পূর্ণ রচনাটিই ব্যর্থ হয়ে যায়, তাই হলো সুদর্শন।
পৌরাণিক ধারণা অনুযায়ী "সুদর্শন" একটি দৈব্য চক্রের নাম বলে মনে হলেও মহাভারত-সহ বহু আনুষাঙ্গিক পৌরাণিক গ্রন্থে এর বর্ণনা চক্রের যুক্তিকে কিছুটা টলিয়ে দেয়। সুদর্শনের অলৌকিক গুণাবলীর কথা মাথায় রেখে আমরাও তাই চক্রের বর্ণনা থেকে বেরিয়ে এসে সুদর্শনকে এক ব্যতিক্রমী শক্তি হিসেবে দেখাতে চেষ্টা করছি।
খাণ্ডব দহন পর্বে অগ্নিদেবের থেকে এই ভয়ঙ্কর অস্ত্র লাভ করেন কৃষ্ণ। কিন্তু তার পরেই তিনি এই চক্র ব্যবহার করে প্রথম যে কাজটি করেন, সেটি স্বাভাবিকভাবেই কোনও চক্রের কাজ নয়। খাণ্ডব বনের সমস্ত প্রাণীকে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলেন কৃষ্ণ!
আবার কুরুক্ষেত্রের ময়দানে এই শক্তি ব্যবহার করে কৃষ্ণকে কখনও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন করতে আবার কখনও অকাল সন্ধ্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে দেখা যায়, যদিও কিছুক্ষণের মধ্যেই এই অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে যায়!
এ থেকে প্রাচীন শাক্ত ও তন্ত্রসাধনায় প্রচলিত দেহতত্ত্বের মূল ষড়চক্রের কথা উল্লেখ করা যায়। মূলাধার, স্বাধীষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা মানব দেব ভাণ্ডের এই ষড়চক্র সুষুম্না কাণ্ডের দ্বারা পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত, আর এদের যোগসূত্র রক্ষা করে মূলাধার থেকে আজ্ঞা পর্যন্ত বিস্তৃত কুণ্ডলীনি চক্র। কঠিন সাধনা, যোগ বা প্রাণায়ামের দ্বারা এই ছয়টি চক্রকে জয় করা সম্ভব। এদের প্রত্যেকটিকে জয় করতে পারলে কুণ্ডলীনিকেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর সাধনালব্ধ এই বিদ্যার নামই সুদর্শন।
দেহতত্ত্ব সাধক যা বলেন, এই বিদ্যার দ্বারা মানুষ তার এবং অপরের মস্তিষ্কে অনবরত ঘটতে থাকা বিদ্যুৎ তরঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অর্থাৎ সুদর্শনের অধিকারী অপর ব্যক্তির চিন্তাকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
হয়তো এভাবেই কৃষ্ণ সুদর্শন ব্যবহার করে কখনও অকাল সন্ধ্যা আনতেন, আবার কখনও নিজের বিশ্বরূপ দেখাতেন। কৃষ্ণের মৃত্যুকালে সুদর্শনের মাটিতে লীন হয়ে যাওয়া দেখে এই যুক্তিকে পোক্ত করে।
আবার বেশ কিছু পৌরাণিক গ্রন্থ অনুযায়ী অগস্ত্যের শাপে দেবতারা লক্ষ্মী হারা হলে, দেবী লক্ষ্মী পাতালে আশ্রয় নেন। তখন তাঁর রক্ষার্থে বিষ্ণু সহস্র সুদর্শন পাঠান। এই বর্ণনা থেকে সুদর্শনকে একটি বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী বলেও মনে হয়। রামায়ণে সুদর্শন ও হনুমানের মধ্যে দ্বন্দ্ব এই যুক্তিকেই সমর্থন করে।
রামায়ণে রামকে আবার বিদ্যুন্মালীর বিরুদ্ধে সুদর্শন নামের একটি বাণ ব্যবহার করতে দেখা যায়!
তবে সুদর্শন যাই হোক না কেন, একটি বিষয় পরিষ্কার করেই বলা যায়, এই সুদর্শন বিদ্যা রপ্ত করতে পারলেই বিষ্ণু হয়ে ওঠা যায়। আর তাই শিশুপাল, পৌণ্ড্র্যক বাসুদেব প্রমুখ নিজেদের আসল বৈষ্ণব অবতার ঘোষণা করলেও বিষ্ণু হয়ে উঠতে পারেননি। এবং পরবর্তী কল্কি অবতারকেও এই সুদর্শন বিদ্যা শিখেই প্রকাশ্যে আসতে হবে।
উপরোক্ত অস্ত্রাবলী ছাড়াও কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে আরও বহুবিধ অস্ত্রের প্রয়োগ হয়েছে। বহু মৃত্যুর সাক্ষী সেইসব অস্ত্র আজ হারিয়ে গেছে বিস্মৃত ইতিহাসের পাতায়।
আসলে কোথায় এই ইতিহাসের শুরু আর কোথায় শেষ, তা আজ আমাদের অজানা। তাই শুধু কল্পনায় ভর করে সেই সব হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলিকে আমরা সম্মান জানাতে পারি, যারা রপ্ত করেছিলেন প্রাকৃতিক ও অতিপ্রাকৃতিক শক্তি কে নিয়ন্ত্রণ করার আশ্চর্য উপায়, অত্যাধুনিক বিজ্ঞানকে রপ্ত করেছিলেন কঠিনতম সাধনার দ্বারা এবং তৈরি করেছিলেন নানা মহাস্ত্র নির্মাণের গোপন কৌশল।
খুব খুব ভাল লেগেছে।
ReplyDeleteKhuuub vlo lege6e dada
ReplyDelete