অন্তরমহল - রুমঝুম ভট্টাচার্য
Posted in অন্তরমহল
সেথা এক পড়শী বসত করে
মনের কারবারি আমি। মন নিয়েই আমার কাজ। কতো মনের গোপন খবর আমার কাছে জমা আছে। কতো ব্যথা বেদনা, উদবেগ, রাগ, হিংসার কথা আমার কাছে গভীর বিশ্বাসে মানুষ গচ্ছিত রেখে গেছে। বদলে নিয়ে গেছে শান্তি আর ভালো থাকা। আমিও সেসব যত্ন করে রেখেছি। আমাদের জীবনের মুহূর্তগুলো এই সব আবেগের রঙে রাঙানো। ভাল লাগার অনুভূতিগুলোর পাশে পাশে ভালো না লাগার অনুভূতিগুলোও সমান জরুরী। কেবল গোল বাঁধে যখন সেই সব আবেগ অনুভূতি মাত্রা ছাড়িয়ে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনকে ব্যহত করে। এই যেমন শান্ত নদীটি যখন তার নিরন্তর বহমানতায় এগিয়ে চলে তখন তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা পরিবেশ শৃঙ্খলও নিয়ম মাফিক চলতে থাকে। হঠাৎ যদি সে নদীর জল ফুলে ফেঁপে উঠে দুকূল প্লাবিত করে বন্যার আকার ধারণ করে তবে কি হয়? আমাদের আবেগগুলোও যেন ঠিক তাই। যখন তারা ছন্দে বাঁধা তখন সমস্যা নেই কিন্তু যদি তারা বাঁধনছাড়া হয়ে পড়ে তখনই হয় সমস্যা। তখন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে তার প্রভাব পড়তে থাকে। কাজ করতে অসুবিধা হয়, বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা যায়, ঘুম, খিদে ইত্যাদির ওপরও তার প্রভাব পড়ে। আপনারা বলবেন ঘুমের সঙ্গে খিদের সঙ্গে কিংবা পেটের গণ্ডগোলের সঙ্গে অথবা ব্যথা বেদনার সঙ্গে আবেগের কি সম্পর্ক? আমার বোধ হয় সবার গচ্ছিত ধন সামলাতে সামলাতে নিজেরই মাথার তার কেটে যাচ্ছে। আজ্ঞে না। আমি যা বলছি পূর্ণ জ্ঞানে বলছি। ওই যে বললাম আবেগ যখন ফুলে ফেঁপে আমাদের সিস্টেমকে প্লাবিত করে তখন মন কি শরীর কি সবখানেই সমস্যা শুরু হয়। আসলে তো মন আর শরীর ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এই দেখুন না, আমাদের বাড়ির কারও বিপদ হয়েছে বা কোন পরম আত্মীয় বিয়োগ হয়েছে এমন খবর শুনলে মন খারাপ হয়ে যায়। তখন আমাদের আর খিদে পায় না। কিন্তু খিদে তো একটা শারীবৃত্তীয় ব্যাপার, তা হলে মন খারাপ হলে খিদে না পাওয়ার কোন যুক্তি নেই। আবার ঠিক উল্টোটাও সত্যি। যদি শরীর খারাপ থাকে তখন কোন আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দিতেও আমাদের ভাল লাগে না। তাই বলি বাড়ির কাছে আরশি নগর সেথা এক পড়শী বসত করে... আর মন নামের সেই পড়শীর সাথে আপনাদের আলাপ করাবো বলে আমার হাতে কলম ধরা থুড়ি কি বোর্ডে টক টক করে টক(Talk) করা।
হচ্ছিল আবেগের কথা। আবেগ যখন লাগামছাড়া বল্গা ঘোড়া তখন আমাদের কি অবস্থা হতে পারে তার উদাহরণ দিই আপনাদের। আসুন আপনাদের এক হতভাগিনীর গল্প শোনাই। সে সময়ে আমি কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করবো বলে মনস্থির করেছি। অবশ্যই আমার আগ্রহের বিষয় হল মনোরোগ।কলকাতার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের মনোররোগ বিভাগে ঘুরে ঘুরে রোগী দেখা এবং তাদের কেস হিস্ট্রি নেওয়া ছিল আমার কাজ। সেই সুবাদে বহু ধরনের মানুষের বহুমুখী মানসিক সমস্যা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করার সুযোগ হয়েছে। সে আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। একদিন এইরকম রোগী দেখছি। এন আর এসের মনোরোগ বিভাগের প্রধান ডঃ নায়েক একটি কেস পাঠালেন আমার কাছে। মলিন চেহারার রুগ্ন একজন মহিলা, তার সঙ্গে আছেন তাঁর স্বামী। বয়স বছর পঁয়ত্রিশ হবে। দুজনের চোখে মুখে একরাশ ক্লান্তি। এমন মুখ যাঁরা সরকারি হাসপাতালে কাজ করেন তাঁরা দেখতে অভ্যস্ত। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কত যে মানুষ চিকিৎসার জন্য প্রতিদিন এই সব হাসপাতালে ছুটে আসতে বাধ্য হন তার ইয়ত্তা নেই। বাড়ির কাছে বড়ো জোর ছোট স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে, কোন কোন জায়গায় তো তাও নেই। দেখে বোঝাই যাচ্ছে এনারাও অনেক দূর থেকে এসেছেন। বসতে বললাম দু'জনকেই। হাতে দেখি মস্ত এক প্যাকেট। প্যাকেটের ওজন বেশ ভারি। সমস্যার কথা জানতে চাইলে মহিলা খুব অসন্তোষের সঙ্গে জানালেন ওর মাথার কোনও সমস্যা নেই অথচ ডাক্তারবাবুরা অযথা মাথার অসুখের ডিপার্ট্মেন্টে ঠেলে পাঠিয়ে দিল। জানতে চাইলাম বেশ এখন কি অসুবিধা হয়। “কি বলব দিদিমণি, জানটা কেমন করে। আর মাথা ভীষণ দপ দপ করতে থাকে। আর কিছু? হাতে পায়ে জ্বালা জ্বালা করে, আর? গ্যাস অম্বল খুব হয় গো।” আমি থামি না। আমার পুঁথিগত বিদ্যা বলছে ক্লাসিক কেস অফ…। “আরও আছে গো, প্রায়ই বুক ধড়ফড় করে, রাতে ঘুম আসে না। মাথা ঘোরে, সারা শরীর জ্বালা করে। আমি কি আর ঠিক হবো না গো?” আপনারা ভাববেন সত্যিই তো ওনার সব উপসর্গই তো শরীরে তবে মনোরোগ ডিপার্ট্মেন্টে পাঠানো কেন রে বাবা! সরকারী হাসপাতালের ব্যাপার! পাঁঠা ডাক্তারগুলো আসলে কেউ চিকিৎসা করতেই চায় না। কেবল এখান থেকে ওখান চালাচালি করতেই থাকে। সত্যি বলতে কি হাতের ওই মোটা প্যাকেটে রয়েছে অনেক অনেক রিপোর্ট। কার্ডিওলোজি, গ্যাস্ট্রো-এন্ট্রোলজি, মেডিসিন সব ডিপার্ট্মেন্টের কিছুই বাদ নেই। চিকিৎসার নথিপত্র সব ভরা আছে তাতে। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেও শরীরে কোনও সমস্যা সেরকমভাবে পাওয়া যায় নি বলে ডাক্তারবাবুরা সাইকিয়াট্রিতে রেফার করেছেন। “বুঝুন ব্যাপার দিদিমণি। আমরা গরীব নোক কত দূর থেকি আসতে হয়”… এবার স্বামী বলে ওঠেন। নাহ, কোনও ভুল নেই ডাক্তারবাবুদের। এ হল ক্লাসিক কেস অফ সোমাটোফর্ম ডিসর্ডার। কি হয় তাতে? এক বা একের থেকে বেশী শারীরিক সমস্যার উপসর্গ থাকে যার কোনও শারীরবৃত্তীয় ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না, রোগীর মনে নিজের শরীর খারাপ সম্বন্ধে ভীষণ উদবেগ তৈরি হয়। মাত্রা ছাড়া উদবেগের কারণে শরীরের বিভিন্ন উপসর্গ আরও বেড়ে চলে। আমি বিস্তারিত কেস হিস্ট্রি নিয়ে দেখলাম, ওনার ঘুমের সমস্যা আছে তা ছাড়া প্রায়ই বুক ধড়ফড় করে, চিন্তা হয়, খুব সামান্য সমস্যাতেই খুব উদবিগ্ন হয়ে পড়েন, মেজাজও খিটখিটে হয়ে থাকে।
তা হলে বুঝতে পারছেন তো আবেগ মাত্রা ছাড়া হলে শরীরের কতো সমস্যা হতে পারে। ওনার চিকিৎসা সাইক্রিয়াট্রিতে শুরু হয়। মাস ছয়েক কেটে গেছে। একদিন আমি বাসে উঠবো বলে দাঁড়িয়ে আছি হঠাত দেখি দুইজনে হন হন করে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আমি একটু দ্বিধায় পড়ে যাই। মনে মনে বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়ি। তবে কাছে আসতে স্বামী মানুষটা হাত জোড় করে জানান স্ত্রী এখন চিকিৎসা করে অনেক ভাল আছেন। তাঁর শরীরের সমস্যা অনেক মিটেছে। মনও অনেক শান্ত থাকে। খুব সরলভাবে বলে উঠলেন, ‘না দিদিমণি আমি সেদিন ভুল কথা বলেছি। সরকারি হাসপাতাল মানেই ডাক্তাররা চিকিৎসা করেন না এই ধারণা ভুল। আমার স্ত্রী কিন্তু এখানে চিকিৎসা করে এখন অনেক ভাল আছে।‘ শুনে ভাল লাগল। আস্থা আর বিশ্বাস হল চিকিৎসার গোড়ার কথা। আমার দেশের প্রতিটা সাধারণ মানুষ যেন উন্নত মানের চিকিৎসা পরিষেবা পেতে পারেন। একমাত্র সরকারই পারেন সে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে। সবার জন্য স্বাস্থ্য এই হোক আমাদের আগামীর দাবী।
খুব দরকারি একটা লেখা | সবার পড়া দরকার
ReplyDelete