3

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয় 




ভারতের পূর্বশেষে
আমি বসে আজি; যে শ্যামল বঙ্গদেশে
জয়দেব কবি, আর এক বর্ষাদিনে
দেখেছিলা দিগন্তের তমালবিপিনে
শ্যামচ্ছায়া, পূর্ণ মেঘে মেদুর অম্বর।…

এসেছে নব যৌবনা বরষা। শহুরে সভ্যতার ইঁদুর দৌড়ে এমন করে বর্ষা উপভোগ করার সুযোগ হয়ত একটু কম। তবুও, বৃষ্টিতে ভেজা নরম হৃদয় নিয়ে এই বেশ ভাল আছি।

আজকাল দেখি, এই নগর কেন্দ্রিক সভ্যতায় যৌথপরিবার ভেঙে যাওয়া, মানুষের ‘আত্মকেন্দ্রিক’ হয়ে ওঠা, ইত্যাদি নিয়ে বিদগ্ধজন বেশ বিমর্ষ। আসলে ঘটনাগুলোকে অন্য একটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মনে হয় একটু স্বস্তি পাওয়া যায়। বস্তুত, এই যৌথপরিবারের ধারণাটা এখন কালের নিয়মেই অবলুপ্তির পথে। এই ধারণাটিকে promote করতে গিয়ে অন্ধের মত শুধু তার ভাল দিক উল্লেখ করলেই চলবে কি? খুব ছোটবেলায় আমিও এক যৌথ পরিবারেরই অংশ ছিলাম। আমার তো মনে হয়, তখনকার চেয়ে এক বৃহত্তর বিশ্বপরিবারের অংশ হিসাবে এখন অনেক বেশী ভাল আছি। আর ‘আত্মকেন্দ্রিক’ শব্দটাও এখন অচল। পরিবর্তে ‘আত্মসচেতন’ শব্দটি অধিক ব্যবহার্য ও গ্রহণীয়। সভ্যতার অগ্রগতির নিজস্ব কারণেই আত্মসচেতনতার প্রয়োজন ছিল। এই আত্মকেন্দ্রিকতা, মানসিক বিকারগ্রস্ততা, ইত্যাদি স্বভাবের নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ও তার বহুল ব্যবহার সর্বকালে সর্ব যুগে একই ছিল, সঠিক বলতে কি, আগে বেশী ছিল। আধুনিক মানুষ বরঞ্চ অনেক বেশী balanced । এখন প্রচারের আলোয় আসছে, তাই জানা যাচ্ছে, আগে যেতো না, এইই পার্থক্য মাত্র। যাঁরা বলেন, আগে ভাল ছিলাম – এখন খারাপ আছি, তাঁদের অসম্মান না করেই বলি, তাঁরা সুবিধাভোগী। উন্নতির সুবিধা এবং নিজের সময়ের স্বপ্নসুখ – একই সঙ্গে দুটোই উপভোগ করেন। মেনে নিতেই হবে, আসলে আমরা আগের চেয়ে অনেক ভাল আছি।

এবার একটু অন্য কথা। আগামী মাসে প্রকাশিত হতে চলেছে ঋতবাক বর্ষপূর্তি সংখ্যা। সাহিত্যপ্রেমী বন্ধুরা লেখার বিষয় নির্বাচনে সচেতন ও যত্নশীল, জানি। তবুও দুটি বিষয়ে আরো একটু যত্নশীল হওয়ার জন্য বিশেষ অনুরোধ জানাচ্ছি – সেদুটি হল, বানান এবং যতি চিহ্নের ব্যবহার। যেকোন যতি চিহ্নের পরে space, কমা-র সঠিক ব্যবহার, বাক্যের মধ্যে বিন্দু চিহ্নের (dot) যথেচ্ছ ব্যবহারের লোভ সম্বরণ, ইত্যাদি বিষয়ে অনেক বেশী সচেতন হতে হবে। বানানের ক্ষেত্রে অভিধানের সাহায্য নেওয়াই যেতে পারে। অতিরিক্ত বানান ভুল লেখার মানহানি ঘটায়। সর্বোপরি বলি, লেখা পাঠানোর আগে নিজেই proof check করুন। আপনার নির্ভুল লেখা আপনার নিজের সৃষ্টির প্রতি যত্নশীলতার পরিচায়ক।

ভাল থাকবেন, সঙ্গে থাকবেন।

শুভেচ্ছান্তে

সুস্মিতা বসু সিং

3 comments:

2

প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ




বাঙ্গালির বিনোদন শিল্প ও বারাঙ্গনা কন্যারা
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



আচ্ছা, যদি এরকম কল্পনা করিযে, আমাদের বিনোদন জগতে যদি পুরুষেরই একাধিকার থাকতো, তবে কেমন হ’ত ? নাট্যাভিনয়, সঙ্গীত কিংবা চলচ্চিত্রে যদি শুধু পুরুষেরই অধিকার থাকতো তবে কেমন চেহারা হত আমাদের বিনোদন জগতের ? অথচ এমনটাই তো ছিল আজ থেকে মাত্র দেড়শ’ বছর আগেও ।

উনিশ শতকের বাঙালির বিনোদন মানেইছিল বারবণিতা বিলাস । বিনোদন তখন অবশ্য আম মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে । জমিদারবাবুরা নানান উপলক্ষ্যে বাঈজী নাচ, আখড়াই, ঝুমুর, কবিগানের আসর আয়োজন করতেন দেদার টাকা উড়িয়ে আর প্রজারা তার ছিটফোঁটা ভাগ পেতেন মাঝেমধ্যে । উনিশ শতকের বাঙ্গালিবাবুদের বারাঙ্গনা বিলাস, রক্ষিতা পোষা,উপ-পত্নী রাখা এইসব কদর্য বৃত্তান্ত আমরা ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’, ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’, ‘নববাবু বিলাস’ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে জেনেছি । উপ-পত্নীর সংখ্যা দিয়েই নাকি জমিদার বাবুদের মর্যাদার পরিমাপ হত । সেই অন্ধকার জগতের মেয়েদের কথা ইতিহাস কদাচই মনে রেখেছে অথচ আমাদের বিনোদন জগতের ইতিহাস নির্মাণ করেছেন অন্ধকার জগতের বা নীচের মহলের মেয়েরাই । আমাদের বিনোদনের তিন প্রধান অঙ্গ – থিয়েটার, সংগীত ও চলচ্চিত্র আজ বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বা উচ্চতর শিক্ষার অঙ্গণে পঠন-পাঠনের বিষয় । কিন্তু উনিশ শতকতো বটেই বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্তসম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েদের নাচ, গান, থিয়েটার করা সমাজেররক্তচক্ষুতে নিষিদ্ধই ছিল ।

আধুনিক কালে বাঙালির বিনোদন জগতে প্রথম আসে থিয়েটার, আঠেরো শতকের একদম শেষ লগ্নে ১৭৯৩এ । ব্যক্তিগত সঙ্গীত চর্চার স্তর অতিক্রম করে সঙ্গীত বিপনন সামগ্রী হয়ে উঠলো আরো ১১০ দশ বছর পরে ১৯০২এ, আর চলচ্চিত্র বাঙালির বিনোদন তালিকায় এলোএই সে দিন – আজ থেকে মাত্র একশ’ বছর আগে১৯১৩তে ।রুশ যুবক গেরেসিম লেবেডফ ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় এসে বাংলাভাষার প্রেমে পড়েন । ইংরাজি নাটক ‘দি ডিসগাইস’ বাংলায় অনুবাদ করে বাঙালি অভিনেতা অভিনেত্রীদের দিয়ে মঞ্চস্থ করেছিলেন । ১৭৯৫এর ২৭শে নভেম্বর । সেটিই বাঙালির প্রথম নাট্যাভিনয় । লেবেডফের ভাষা শিক্ষক গোলকনাথ দাস কলকাতার বারাঙ্গণা পল্লী থেকে অভিনেত্রী সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন । লেবেডফের থিয়েটার সম্পর্কে বেশি কিছু আর জানা যায় না। কারা ছিলেন প্রথম বাংলা নাট্যাভিনয়ের অভিনেতা-অভিনেত্রী ? ইতিহাস তার কোন লেখাযোখা রাখেনি । লেবেডফের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত ইংরাজরা তার থিয়েটারে আগুন লাগিয়ে ধ্বংশ করে দেয়, আইনের জালে জড়িয়ে দেউলিয়া করে তাকে ভারত থেকে বহিস্কার করে । কিন্তু ইতিহাসকে মুছবে কি করে ? গেরেসিম লেবেডফের নাম অক্ষয় হয়ে থাকলো বাংলা ভাষায় প্রথম নাট্যাভিনয়ের সূচনাকর্তা হিসাবে । আরো একটি কারণে সেই থিয়েটার ঐতিহাসিক স্বীকৃতির দাবি রাখে তাহ’ল বাংলা নাট্যাভিনয়ে মেয়েদের অভিনয়ের অপরিহার্যতা,যার জন্য পরবর্তী আশি বছর সমাজপতিদের রক্তচক্ষুর বিরুদ্ধে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছিল ।

কেমন ছিল বাঙালির সেই প্রথম অভিনয় ? জানার কোন উপায় নেই । শুধু এ’টুকু জানাযায় যে, সর্বস্বান্ত হয়ে ভারত থেকে বিতাড়িত হবার পর বন্ধু সাম্বারাস্কিকে একটা চিঠিতে লেবেডফ লিখেছিলেন “আমার বহুবিধ পরিশ্রমের মধ্যেও আমি নিরুৎসাহী ভণ্ড ও বন্য প্রকৃতির বাঙালিদের হাস্যরসাত্মক অভিনয় শিক্ষার আয়োজন করিয়াছিলাম।... দর্শকবৃন্দ অকপটভাবে ইহাতে পরিতৃপ্তি পাইয়াছিল...”।

লেবেডফের থিয়েটার বাংলা নাট্যাভিনয়ের ক্ষেত্রে কোন ধারাবাহিকতার সৃষ্টি করলো না বটে, কিন্তু থিয়েটারে নারী অভিনেত্রীর প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নটি স্থায়ী ছাপ রেখে গিয়েছিল, যার নান্দীমুখ করে গিয়েছিলেন লেবেডফ নিয়োজিত সেই বারাঙ্গণা কন্যারা । এর পর ৩৮বছর বাংলা নাট্যাভিনয়ের কোন সংবাদ পাওয়া যায় না।১৮৩৫এর ৬ই অক্টোবর শ্যামবাজারের জমিদার নবীনচন্দ্র বসুর বাড়িতে ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাট্যাভিনয় আয়োজিত হয় । নবীনচন্দ্র লেবেডফের মতই সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে বারাঙ্গণা পল্লী থেকে নারী চরিত্রের অভিনেত্রী সংগ্রহ করেছিলেন । বারাঙ্গনা মেয়েদের নাট্যাভিনয়ে সুযোগ দেওয়ায় তখনকার রক্ষণশীল সমাজে নিন্দা-মন্দের ঝড় উঠলো, প্রবল আক্রমণাত্মক সমালোচনায় বিদ্ধ হলেন বাবু নবীনচন্দ্র । তবুও এই প্রয়াসের মধ্যে সমাজসংস্কারের যে বার্তা ছিল তা চিহ্নিত করতে পেরেছিল সেই সমাজেরই একটা অংশ । ‘হিন্দু পাইওনিয়ার’ পত্রিকা তার প্রতিবেদনে লিখেছিল “... এই নাটকে বিশেষ করিয়া স্ত্রী চরিত্রের অভিনয় খুব চমৎকার হইয়াছিল ...।আমাদের সমাজের স্ত্রীলোকদের মানসিক শক্তির এই মহান ও নূতন দৃষ্টান্ত দেখিয়াও যদি লোকে স্ত্রী-শিক্ষায় অবহেলা প্রদর্শন করেন, তবে তাঁহাদের হৃদয় কঠিন ও চিত্ত আবেগহীন বলিতে হইবে ...। এই সকল প্রশংসনীয় কিন্তু ভ্রমে পতিত স্ত্রীলোকদের চারিত্রিক উন্নতি করিবার এই প্রচেষ্টার জন্য নাট্যশালার স্বত্বাধীকারী বাবু নবীনচন্দ্র বসু ধন্যবাদের পাত্র” ।

এমন প্রশংসা সত্তেও রক্ষণশীলদের প্রবল নিন্দাবাদের চাপে নাট্যাভিনয়ে মেয়েদের নিয়োগের সাহস করলেননা কেউ, নাটকের নারীচরিত্রগুলির অভিনয় পুরুষের দখলেই থেকে গেলো । কিন্তু নাট্যাভিনয়ে মেয়েদের স্বাভাবিক অধিকারের প্রশ্নটিকে চাপা গেলো না, প্রবলভাবে উঠে এলো আরো ৩৮ বছর পরে, যখন আসরে নামলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত । ইতিমধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী থিয়েটার সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছে, ধনাঢ্য জমিদারবাবুদের নাটমঞ্চ থেকে উদ্ধার করে থিয়েটার উন্মুক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে ন্যাশানাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে, বাংলা নাট্যাঙ্গণে প্রবল উপস্থিতি হয়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখের ।

১৮৭২এ বাঙালির প্রথম রঙ্গালয় ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’প্রতিষ্ঠার পরের বছর ধনকুবের আশুতোষ দেব বা ছাতু বাবুর দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ নামে একটি রঙ্গালয় খুললেন আর তাদের জন্য নাটক লিখে দেবার জন্য মাইকেল মধুসূদন দত্তকে অনুরোধ করলেন । মাইকেল সম্মত হলেন একটি শর্তে যে তাঁর নাটকের নারী চরিত্রগুলি মেয়েদের দিয়েই অভিনয় করাতে হবে । বেঙ্গল থিয়েটারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাতেও মাইকেল থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগের প্রস্তাব করেন । মধুসূদনের সমর্থন পেয়ে বেঙ্গল থিয়েটার কর্তৃপক্ষ বারাঙ্গনাপল্লী থেকে জগত্তারিণী, গোলাপসুন্দরী, এলোকেশী ও শ্যামাসুন্দরী নামে চারজন অভিনেত্রীকে নিয়োগ করলেন । ১৮৭৩এর ১৬ই অগস্ট মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার তার যাত্রা শুরু করলো আরনাট্যাভিনয়ে পুরুষের একচেটিয়া অধিকার খর্ব করে সেইদিন থেকে শুরু হল থিয়েটারে নারীদের অংশগ্রহণের ধারাবাহিকতাও । থিয়েটারে নারীর অংশগ্রহণের প্রথম প্রবক্তা মধুসূদন দত্ত এই যুগান্তকারী ঘটনা দেখে যেতে পারেননি । গোলাপসুন্দরীদের পথচলা শুরু হবার দেড় মাস আগেই তাঁর দেহাবসান হয় (২৯শে জুন ১৮৭৩) । রক্ষণশীলদের প্রবল নিন্দাবাদ সত্তেও নাট্যাভিনয়ে মেয়েদের স্বাভাবিক অধিকারকে আর ঠেকানো যায়নি । পরবর্তী ষাট বছরগিরিশচন্দ্র ঘোষ, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, অমৃতলাল বসু,অমরেন্দ্রনাথ দত্ত,‌ দানিবাবু, অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শিশির কুমার ভাদুড়ী, অহীন্দ্র চৌধুরীদের সঙ্গে গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনী, তারাসুন্দরী, তিনকড়ি দাসী, কুসুমকুমারী, কৃষ্ণভামিনী, ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালা, প্রভা দেবীরা বাঙালির থিয়েটার ভুবনকে আলোকিত করে গেছেন। তাঁদের অবিস্মরনীয় অভিনয় ও সংগীত প্রতিভার ঐশ্বর্য ইতিহাস হয়ে আছে । 

বিনোদন বিপণন সামগ্রী হয়ে ওঠার পর সম্ভ্রান্ত পরিবারের আলোকপ্রাপ্তা নারীরা বিনোদনের সৃষ্টিশীল জগতে এলেন । কিন্তু তার আগে থিয়েটার, সংগীত ও চলচ্চিত্র জগৎকে সমৃদ্ধ করেছিলেন সমাজের অন্ধকার অংশ থেকেআসা মেয়েরা । থিয়েটারের কথাই প্রথমে বলতে হচ্ছে, কারণ সংগীতের বিপণন হওয়ার শুরুতে এবং চলচ্চিত্র শিল্পের উদ্ভবের শুরুতে নারী শিল্পীদের সরবরাহ হ’ত থিয়েটার থেকেই ।সংগীতে পারদর্শিতা ছাড়া থিয়েটারে জায়গা হত না । বিশ শতকের একদম শুরুতে এদেশে সংগীতের বিপনন শুরু হলে তাই থিয়েটারের মেয়েরাই আমাদের বিনোদনের এই নতুন মাধ্যমে ব্যবহৃত হলেন । তখনও মেয়েদের গান গাওয়া সমাজ অনুমোদন করতো না । ১৮৭৭এ টমাস আলভা এডিসনের বিস্ময়কর উদ্ভাবন ফোনোগ্রাফ যন্ত্র । কন্ঠস্বর ধ্বনিবদ্ধ করে আবার শোনার বন্দোবস্ত । তেরো বছর পরে ১৮৯০এ বিজ্ঞানী এমিল বার্লিনার কন্ঠস্বর ধ্বনিবদ্ধ করা ও শোনার পদ্ধতির আরো উন্নতি ঘটিয়ে উদ্ভাবন করলেন গ্রামফোন বা কলের গান । ১৮৯৮এ কলের গান ভারতে চলে এলো । কলকাতায় গ্রামফোন কোম্পানী বাংলাগান বিপণনের জন্য রেকর্ড করতে চাইলেন । কিন্তু গাইবে কে ?গ্রামফোন কোম্পানী প্রখ্যাত নাট্যাভিনেতা ও পরিচালিক অমরেরেন্দ্রনাথ দত্তর স্মরণাপন্ন হলেন । অমেরেন্দ্রনাথ সংগ্রহ করে দিলেন তাঁর থিয়েটারের দুইজন নাচের শিল্পী শশিমুখী ও ফণীবালাকে । থিয়েটারের নাচ-বালিকা, এই দুই বারাঙ্গণা কন্যাই বাংলা গানের প্রথম রেকর্ডশিল্পী । তারপর ২৫/৩০ বছর নীচের মহল থেকে উঠে আসা এইসব শিল্পীরা – গহরজান, কৃষ্ণভামিনী, হরিমতি, কমলা ঝরিয়া, আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা থেকে কানন দেবীরা বাংলা গানের ভুবনকে ঐশ্বর্যমন্ডিত করে গেছেন ।শিল্পীর মর্যাদায় এঁরা সঙ্গীতজগতে লিজেন্ড হয়ে আছেন । আজ থেকে সত্তর পঁচাত্তর বছর আগে আঙ্গুরবালা গেয়েছিলেন ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা আমি যে পথ চিনিনা’ । তারও চল্লিশ বছর পরে ‘ছুটি’ ছায়াছবিতে প্রয়াতা প্রতীমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রিমেক করা সেই গান আজও আমাদের আচ্ছন্ন করে । খ্যাতিরশীর্ষ স্পর্শ করেও অন্ধকার জগৎ থেকে উঠে আসা এইসব শিল্পীরা কোনদিন মাটি থেকে পা সরিয়ে নেন নি । সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী ইন্দুবালাখ্যাতির শিখরে উঠেছিলেন, গ্রামোফোন কোম্পানীর ‘গোল্ডেন ডিস্ক’, ‘সঙ্গীত নাটক আকাডেমি সম্মাননা’ পেয়েছেন । কলকাতার রূপবাণী প্রেক্ষাগৃহের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর পদপ্রান্তে দাঁড়িয়ে উদ্বোধনী সঙ্গীত গেয়েছিলেন ইন্দুবালা । দেশজোড়া খ্যাতি সত্তেও তিনি রামবাগানের নিষিদ্ধ পল্লী ছেড়ে অন্যত্র চলে যান নি । বলতেন ‘আমি রামবাগানের মেয়ে ... রামবাগানই তো আমায় সব কিছু দিয়েছে । অর্থ, সম্মান ভালোবাসা সব...’ । একদিকে দেশজোড়া খ্যাতির আলো আর অন্যদিকে রামবাগানের নিষিদ্ধ পল্লীর অন্ধকার । এই দুইএর মাঝেই সুরের আকাশে উজ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন ইন্দুবালা ।

এ দেশে যখন চলচ্চিত্র বা সিনেমা এলো, প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্রর নির্মাণ শুরু হ’ল তখন আমাদের সমাজ অনেক এগিয়েছে, বাঙালির রুচিবোধের অনেক পরিবর্তন হয়েছে, নিষেধের বেড়া অনেক ক্ষেত্রেই ভেঙেছে । ১৯১৩তে দাদাসাহেব ফালকে তৈরি করলেন ভারতের প্রথম কাহিনী চিত্র ‘রাজা হরিশচন্দ্র’। কিন্তু তার দশ বছর আগে ১৯০৩-এ এক বাঙালি যুবক হীরালাল সেন এমারেল্ড থিয়েটারের অমরেন্দ্রনাথ দত্তর উদ্যোগে ‘আলিবাবা’ নাটকটি সম্পূর্ণ চলচ্চিত্রায়িত করেছিলেন । মর্জিনার ভুমিকায় ছিলেন তখনকার প্রখ্যাত অভিনেত্রী কুসুমকুমারী । নটী কুসুমকুমারীই অতএব এদেশের প্রথম চলচ্চিত্র অভিনেত্রী । সে ছিল নির্বাক সিনেমার যুগ । সেলুলয়েডেশব্দ ধারণের কৌশল তখনও আয়ত্ত হয় নি । ১৯১৯এ তৈরি হল প্রথম বাংলা সিনেমা ‘বিল্বমঙ্গল’ ।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত, স্বাধীনতা আন্দোলন এবং বদলে যাওয়া আন্তর্জাতিক ঘটনাবলিবাঙ্গালির মনন ও যাপনভাবনায় বদল আনছিল ধীরে ধীরে ঠিকই, কিন্তু তখনও সিনেমা ছিল অন্ত্যজ, বাঙালি মেয়েরা সিনেমায় অভিনয়ের কথা ভাবতেই পারতেন না । নির্বাক চলচ্চিত্র, সংলাপের ভাষা শোনার ব্যাপার নেই । সুতরাং প্রথম প্রথমঅ্যাংলো ইন্ডিয়ান তরুণীরা অভিনয় করতেন বাংলা সিনেমায় । মেমসাহেবদের অভিনীত ‘নল দময়ন্তী’, ‘বিষ্ণু অবতার’, ‘কপালকুণ্ডলা’ দেখতে নাকি ‘হাউসফুল’ হয়ে যেত । বাঙালি দর্শক বেশিদিন সিনেমায় মেমসাহেবদের বাঙালি ললনা ভাবতে রাজি হবেন কেন? অতএব থিয়েটারে নীচের মহলের মেয়েরা ছাড়া আর গতি ছিল না। বাংলা সিনেমার সেই শৈশবে সিনেমায় এলেন মঞ্চের অভিনেত্রীরা – কুসুমকুমারী, শিশুবালা, নীরজাসুন্দরী, প্রভাদেবী প্রমুখ অনেকে ।

১৯৩১এ বাংলা সিনেমা কথা বলতে শুরু করলো । বাংলাচলচ্চিত্রের নির্বাক ও সবাক যুগের সন্ধিলগ্নে বাংলা চলচ্চিত্র পেয়েছিল নীচের মহল থেকে আসা এক নিঃসম্বল, অসহায়া বালিকাকে, নাম তার কাননবালা, পরবর্তীতে যিনি কানন দেবী – বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম মহা নায়িকা । নির্বাক সিনেমার যুগে পাঁচ টাকা পারিশ্রমিক পাওয়া কানন বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে দীর্ঘ ষাট বছরেরও বেশি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থেকে এর অভিভাবিকা হয়ে উঠেছিলেন । নিষ্ঠা, সততা আর তন্ময় সাধনায় অবহেলার অন্ধকার থেকে দীপ্তিময়ী ব্যক্তিত্বে নিজের উত্তরণ ঘটিয়েছিলেন কানন দেবী ।

বিনোদন শিল্পে মেয়েদের আসা শুরু হয়েছিল সেইদিন, যেদিন মাইকেল মধুসূদন দত্তর পরামর্শে বেঙ্গল থিয়েটারের দ্বার মেয়েদের জন্য উন্মুক্ত হয়েছিল । সে কথা আগেই বলেছি । সমাজের রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে কোন প্রাপ্তির আশায় আমাদের বিনোদন শিল্পের সূচনাপর্বে এসেছিলেন এইসব বারাঙ্গনা কন্যারা ?তাঁরা এসেছিলেন অন্ধকার জগতের গ্লানি অগ্রাহ্য করে মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার তাগিদে । বাঙালির প্রথম বিনোদন মাধ্যম থিয়েটার সেইসব বারাঙ্গনা কন্যাদের কাছে অন্ধকার জগতের গ্লানিমুক্তির একটা অবলম্বন হয়ে দেখা দিয়েছিল । তাদের একটা তাগিদ ছিল – মুক্তির তাগিদ । থিয়েটারকে তাই তারা নিজেদের মুক্তিতীর্থ মনে করলেন, থিয়েটারকে ভালোবেসে পবিত্র হতে চাইলেন । এই পথ ধরেই থিয়েটারে এসেছিলেন গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনী, কুসুমকুমারী, তারাসুন্দরী, কৃষনভামিনী, প্রভাদেবীরা । বস্তুত নাট্যাভিনয়ে তাঁদের যোগদানের কারণেই বাংলা থিয়েটার পুরোমাত্রায় পেশাদারী হয়ে ওঠার দিকে পা বাড়িয়েছিল । গিরিশচন্দ্র স্বীকার করেছেন বিনোদিনী না থাকলে তিনি ‘গিরিশচন্দ্র’ হতে পারতেন না । কিংবা, পেশাদারী থিয়েটারের শেষ লগ্নে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর নাট্যকীর্তিতে অভিনেত্রী প্রভা দেবীর অবদান কে অস্বীকার করবে ? তাঁর ‘দুই পুরুষ’ নাটকের অভিনয় দেখে সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন “গিরিশচন্দ্র গেছেন, কিন্তু আর এক সূর্যের আবির্ভাব হল – নাট্যাচার্য শিশিরকুমারের । আর এক নতুন ধারার সৃষ্টি হল । সেই থেকে এই ধারারই বাহিকা হয়ে আবির্ভূতা শ্রীমতী প্রভা” । গিরিশচন্দ্র থেকে নাট্যাচার্য শিশিরকুমার – বাংলা থিয়েটার শিল্পের নির্মাণে ঐতিহাসিক গুরুত্ব দাবী করেন নীচের মহল থেকে আসা এইসব অভিনেত্রীরা । গোলাপসুন্দরী থেকে পরবর্তী ৭০/৮০ বছরবাংলা থিয়েটারকে সমৃদ্ধ করেছেন, আলোকিত করেছেন এঁরাই ।

উনিশ শতকের ধনী বাবুদের পরস্ত্রী গমন,রক্ষিতা পোষা তখনকার সমাজ অনুমোদন করতো,তাঁদের নারীলোলুপতা আর অনৈতিক জীবনযাপনের ক্লেদাক্ত বৃত্তান্ত আমরা জানি । কলকাতার নাগরিক জীবনের অঙ্গ স্বরূপ তখন কলকাতায় গণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় । সম্ভ্রান্ত বাবুদের লালসার শিকার গর্ভবতী হয়ে অনেক তরুণী বিধবা আশ্রয় নিতেন গণিকালয়ে । ধনাঢ্য ব্যক্তির রক্ষিতারাও গর্ভবতী হয়ে পড়তেন । বারাঙ্গণা নারীরা স্বপ্ন দেখতেন, তাঁদের কন্যারা যেন এই গ্লানিময় জীবনের স্পর্শ না পায় । থিয়েটার তাদের সামনে গ্লানিমুক্তির পথ হয়ে দেখা দিল ।তখনকার সমাজের একটা ছোট অংশের সহানুভুতি তাঁরা পেয়েছিলেন । বিদ্যাসাগরের অনুগামী উপেন্দ্রনাথ দাস গোলাপসুন্দরীর বিবাহ দিয়ে সংসার পাতিয়েছিলেন ।

গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনী থেকে ইন্দুবালা, কাননদেবী । সময়ের ব্যবধান বিস্তর । সমাজ মানসিকতাতেও বদল হয়েছে অনেক । কিন্তু অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরনের কাহিনী একই । সমাজের নিচের মহল থেকে বিনোদন শিল্পে আসা মেয়েদের তন্ময় সাধনা, অন্ধকার জগতের সব গ্লানি মুছে দিয়ে দীপ্তিময়ী ওয়ে ওঠার কাহিনি যুগে যুগে একই থেকেছে । 

আজ একুশ শতকের স্যাটেলাইট জগতে অতীতকে ফিরে দেখার আগ্রহ আমরা হারিয়েছি, সত্য । তবু এটাও সত্য যে আমাদের বিনোদন শিল্পের তিন প্রধান অঙ্গ থিয়েটার, সঙ্গীত ও চলচ্চিত্র শিল্পের নির্মাণে সমাজের নীচের মহল থেকে আসা শিল্পীদের অবদান অবিস্মরণীয়, এই কথাটা আমাদের মনে রাখতেই হবে ।


















2 comments:

0

প্রবন্ধঃ মনোজিৎকুমার দাস

Posted in

প্রবন্ধ



নজরুল -বাংলা সঙ্গীতাকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
মনোজিৎকুমার দাস



বাংলা সঙ্গীতজগতের পঞ্চরত্নের মধ্যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯ -১৯৭৬) অন্যতম। বাংলা গান সৃজন, বিকাশ ও সমৃদ্ধিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), দ্বিজেন্দ্রনাথ রায় (ডিএলরায়), অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন ও নজরুল ইসলামের অবদান স্বমহিমায় ভাস্বর। এঁরা বাংলা সঙ্গীতে নবতর মাত্রা সংযোজন করেন। এছাড়াও বংলা গানের জগতে রামপ্রসাদ সেন, দাশরথি রায়, রামনিধি গুপ্ত, লালন শাহ, হাসন রাজা, বিজয় সরকার প্রমুখ বাংলা গানে নিজস্বধারার প্রবর্তন করেন। তাঁরা তাঁদের গানকে নিজস্বধারার গন্ডির মধ্যেই আবদ্ধ রাখেন। অন্যদিকে বাংলা গানের জগতের এ পঞ্চরত্ন রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত ও নজরুল ইসলাম বাংলা গানের নানা শাখায় বিচরণ করে সম্পূর্ণ নিজস্ব সৃজনশীলতার মাধ্যমে বাংলা সঙ্গীত জগতকে বিশেষভাব ঋদ্ধ করেন।

বাংলা সঙ্গীত সৃজনে কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনন্যসাধারণ প্রতিভাকে স্বল্পপরিসরে উপস্থাপনের চেষ্টা করবো। বাংলা সঙ্গীতাকাশে নজরুল ইসলামের আবির্ভাব ধ্রুবতারার মতো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি সঙ্গীত ও অভিনয় জগতে একাধারে গীতিকার, সুরকার, গায়ক ও অভিনেতা। একজন মানুষের মধ্যে এতগুলো গুণের সমাবেশ খুব বেশি দৃষ্ট হয় না। 

নজরুলের স্বদেশীগান ব্রিটিশের শৃঙ্খল মোচনে অজেয় শক্তি যুগিয়েছিল। আমাদের একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামেও তার জাগরণীমূলক গান প্রেরণার উৎস ছিল। তাঁর লেখা “ চল চল উর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল---” আমাদের রণ সঙ্গীত। 

গানের জগতে নজরুলের আগমন বালক বয়সে। রাঢ় বাংলার চুরুলিয়া গ্রামের ছেলে দুখু মিয়ার লেটোর দলে গান লেখা আর অভিনয়ের মাধ্যমে যাত্রা শুরু। শৈশবে রাঢ় বাংলা বর্ধমানের চুরুলিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক লেটো গানের যে পাঠ তিনি তাঁর চাচা কাজী বজলে করিম ও অন্যান্যদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলেন তা হৃদয়ে ধারণ করে সৃজনশীলতায় বাংলা সঙ্গীতজগতকে ঋদ্ধ করেন। স্কুলে পড়াকালে তিনি তাঁর শিক্ষক সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল তাঁকে সঙ্গীতে অনুপ্রাণিত করেন। করাচী পল্টনের সৈনিকজীবন, কলকাতার গ্রামোফোন কোম্পানীর সাথে সম্পৃক্ততা তাকে সঙ্গীতজগতের উচ্চাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। ওস্তাদ জমির উদ্দিন খাঁর সাহচর্যে তিনি তাঁর সঙ্গীত প্রতিভাকে প্রস্ফুটিত করার সুযোগ পান। তাছাড়াও ওস্তাদ কাদের বখশ, দবীর খাঁ, জ্ঞানপ্রকাশ গোস্বামী প্রমুখের সান্নিধ্যও তাঁকে সঙ্গীতে বিশিষ্টতা দান করে। 

এক পর্যায়ে কলকাতার গ্রামোফোন কোম্পানির সাথে সম্পৃক্ত হবার সুবাদে নজরুল ইসলাম লঘু হাসির গান থেকে শুরু করে ধ্রুপদী সঙ্গীত রচনা শুরু করেন। বাংলা গানে এমন কোন শাখা নেই যেখানে তাঁর পদচারণা নেই। তিনি বাংলা গানের যে সব নব নব মাত্র যোগ করেছেন সেগুলো হচ্ছে- ভজন, কীর্তন, শ্যামা সঙ্গীত, জারি-সারি, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, মুর্শিদি, মারফতি, হামদ, নাত, আধুনিক আঙ্গিকের প্রেম পর্যায়ের গান, গজল, রাগ সঙ্গীত, দেশাত্মবোধক গান, বাউল সঙ্গীত, ঝুমুর, গণসঙ্গীত, হাসির গান ইত্যাদি। 

বাংলা সঙ্গীতজগতে নজরুল ইসলাম ছাড়া অন্য কোন সঙ্গীজ্ঞ গানের জগতে এতটা বৈচিত্রপূর্ণ অবদান রাখতে পারেননি। তিনি হিন্দুস্থানী ভজন আঙ্গিকের গানকে নিজস্ব সৃজনশীলতার মাধ্যমে বাংলা ভজন সঙ্গীতের সফল গীতিকার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রসঙ্গক্রমে তাঁর লেখা ও সুরারোপিত হিন্দুধর্মীয় ভজন আঙ্গিকের ভক্তি সঙ্গীতের দু’এক কলি এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। ‘ হে গোবিন্দ রাখো চরণে,’‘সখি সে হরি কেমন বল, খেলিছ এ বিশ্ব লইয়ে বিরাট শিশু আনমনে,’ ‘ অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে ’, মন জপনাম শ্রী রঘুপতি রাম’ ‘ আজি মনে মনে লাগে হরি’ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

নজরুল ইসলামকে ইসলামী ধর্মীয় হামদ, নাত আঙ্গিকের একছত্র সম্রাট। এ প্রসঙ্গেও তাঁর লেখা ও সুরারোপিত ইসলাম ধর্মবিষয়ক হামদ ও নাতের উদারহণ দিতে হয়। ‘ ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়’, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ে কোলে’,‘রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ,’ ‘ মসজিদের পাশে আমার কবর দিও ভাই,” ইত্যাদি নি:সন্দেহে এ আঙ্গিকে গানে নবতর সংযোজন ।

হিন্দুধর্মীয় ভজনাঙ্গিকের কীর্তন ছাড়াও তিনি শ্যামাসঙ্গীতে নতুনমাত্র দান করেন। রামপ্রসাদ সেনের শ্যামা সঙ্গীতের কথা ও সুরকে পরিশীলিত করে নতুন শব্দাবলী, নতুন ভাব ও ঘরাণায় নজরুল ইসলাম নিজস্ব ধারায় শ্যামাসঙ্গীত রচনা করে ভক্তিমিশ্রিত ধারায় সুরারোপ করেন। ভাবলে অবাক হতে হয় , ‘বলরে জবা বল, কোন সাধনায় পেলি রে তুই মায়ের চরণতল’, ‘ শ্যামা নামের লাগলো আগুন’, ‘ আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়,’ শ্মশানকালীর রূপ দেখে যা’ ইত্যাদি শ্যামাসঙ্গীতগুলো নজরুল ইসলামের রচিত ও সুরারোপিত।

নজরুল জাতপাতের অনেক উর্ধে ছিলেন তার প্রমাণ মেলে তাঁর কবিতা, গান ও অন্যান্য রচনায়। পুত্র বুলবুলে মৃত্যুর পর নজরুল মানসে বিষাদ ও আধ্যাত্মিকতা আসন গেড়ে বসে। তিনি হিন্দু মুসলিম দু’সম্প্রদায়ের ভক্তিসঙ্গীত রচনা, সুরারোপে মনোনিবেশ করেন। কীর্তনাঙ্গিকের প্রাচীন পদাবলী সাহিত্যে পরিশীলিত বাংলা রূপ দিতে নজরুল ইসলাম বিশেষ অবদান রাখেন। 

রবীন্দ্রনাথ তার পূজা পর্যায়ের গানে নতুন মাত্র দান করেন। অন্যদিকে, নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথের মতো বিমূর্তধারার পূজা আঙ্গিকের গানের পরিবর্তে মধ্যযুগের বৈষ্ণবপদাবলীকে শ্রীকৃষ্ণের কীর্তনের আঙ্গিকে নতুনমাত্র দান করেন কথা আর সুরের নবতর ধারায়। তাঁর এ ধারার গানের সংখ্যা প্রচুর এবং শ্রেষ্ঠত্বেও ঋদ্ধ। ‘হৃদিপদ্মে চরণ রাখো বাঁকা ঘনশ্যাম’, এলো নন্দের নন্দন নবঘনশ্যাম,’কৃষ্ণজী, কৃষ্ণজী’, ‘বজ্রগোপী খেলে হরি,’ ইত্যাদি।

চিরায়ত বাংলার মাটি- মানুষ- নদীর গান জারি, সারি, ভাটিয়ালি ও পল্লীগীতি। নজরুল এসব গানেও নবতর মাত্র যোগ করেন তাঁর নিজস্ব কথা ও সুরে। ‘ বাঁশি বাজায় কে কদম তলায়’, ‘ওগাললিতে, নদীর এ কূল ভাঙ্গে ও কূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা।’, ‘পদ্মার টেউরে, মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যারে,’ ইত্যাদি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। 

প্রেম পর্যায়ের গানে নজরুল ইসলাম উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলাসঙ্গীত জগতের নজরুলের প্রেমের গান কালজয়ী অনুষঙ্গে হৃদয়গ্রাহী। তাঁর প্রেমের গানের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় গানগুলোর আবেদন চিরন্তন । তাঁর প্রেমের গানগুলোর কয়েকটি কথা এখানে না বললেই নয়। ‘শাওনো রাতে যদি‘ তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়,’ ‘যার হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই,’ ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী’ ইত্যাদি । তাাঁর প্রেমের গানে রোমান্টিকতা বিশেষ ভাবে উঠে উঠেছে। ‘তোমার হাতের সোনার রাখি,’ ‘আমি বনফুল গো’, ‘দূরদ্বীপবাসিনী চিনি তোমারে চিনি’, রুমঝুম ঝুমঝুম নূপুর পায়ে’, ‘চেয়না সুনয়না আর চেয় না এ নয়ন পানে’, ‘পর পর চৈতালী সাঝে কুসুমী শাড়ি,’ 

নজরুল ইসলাম রাগ সঙ্গীতেও অনন্যসাধারণ। তিনি রাগাশ্রিত ধ্রুপদ, খৈয়াল, টপ্পা, ঠুংরী, গজল, পিলু, খাম্বাজ, আঙ্গিকের বহু বাংলা গান রচনা করেন। তিনি নিজস্ব সৃজনশীলতার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাগেরও সৃষ্টি করেন। সেই সমস্ত রাগগুলোকে বাংলা সঙ্গীতে নতুন ধারার জন্ম দিতে সক্ষম হন। উদাহরণ হিসাবে তার লেখা ও সুরকরা ‘কুহু কুহু কুহু কুহু কোয়েলিয়া (খাম্বাজ), ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর ফিরে আয়’, (ছায়ানট), অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারী (আহির ভৈরব), 

হিন্দুস্থানী রাগ সঙ্গীতের আঙ্গিকে রচিত ‘ আলগা করো খোঁপার বাঁধন, কোন সুরে তুমি গান শোনালে ভিনদেশী পাখি’, ‘শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না,’ ‘ চেওনা সুনয়না , আর চেওনা,’‘ সই ভাল করে বিনোদবেণী বাঁধিয়া দে,’ ইত্যাদি গানগুলো বাংলা গানের জগতের অপূর্ব সম্পদ।

ঝুমুরের ঢঙে লেখা ‘ হলুদ গাঁদার ফুল’, এই রাঙা মাটির পথে লো’, ‘ ও কন্যারে পায়ের নূপুর বাজারে’ প্রভৃতি গানগুলো বাংলা গানের জগতে নজরুলের অনন্য সংযোজন। সবাক চলচ্চিত্রের জন্য তিনি যে সব গান রচনা করেন তা কালজয়ী আসন লাভ করে। তার লেখা চলচ্চিত্রের গানগুলোর মধ্যে ‘ গভীর নিশীতে ঘুম ভেঙে যায়,’ ‘ তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়,’ যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারে নাই,‘ মোর প্রিয়া হবে এসো রানী’ ইত্যাদি গানগুলো আজও সমান জনপ্রিয়। বাউল সঙ্গীতের আঙ্গিকে লেখা গানগুলো বাংলা সঙ্গীতে নবতর সংযোজন। বাউল আঙ্গিকের গানের মধ্যে ‘ আমি ক্ষ্যাপা বাউল’, ‘ আমি বাউল হলাম ধূলির পথে লয়ে তোমার নাম’ ইত্যাদি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার মতো।

নজরুল ইসলামের তাঁর নিজের গানের প্রতি চরম আত্মবিশ্বাস ছিল। তিনি তাঁর গানের প্রসঙ্গে বলেছিলেন,“ সাহিত্যে দান আমার কতটুকু তা আমার জানা নেই। তবে এইটুকু মনে আছে সঙ্গীতে আমি দিতে পেরেছি।” নজরুলের এ কথার কোন প্রকার অত্যুক্তি নেই।

পরিশেষে নজরুল ইসলামের গানের প্রচার প্রসার ইত্যাদি প্রসংগে বলতে হয় তাঁর হাজার হাজার গানের সংরক্ষণ, প্রচার, প্রসার যেমন ভাবে হওয়া উচিত সেভাবে কিন্তু হচ্ছে না। তারঁ গানের সুরবিকৃতি রোধের জন্য তেমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে মনে হয় না। এ সত্ত্বেও বলা যায়, তিনি বাংলা সঙ্গীতাকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দীপ্যমান থাকবেন চিরকাল।






0 comments:

1

বিশেষ প্রতিবেদনঃ জয়িতা সরকার

Posted in

বিশেষ প্রতিবেদন 




সমাজের পট বদল ও আমরা
জয়িতা সরকার 




সারথি বৃহন্নলা:

একটু পেছনের দিকে হাঁটি আসুন। চলুন যাই বিরাট রাজসভায়। সেখানে গভীর চিন্তায় মগ্ন সকলে। বিষয় কি? কৌরবেরা বিরাট রাজার গোধন চুরির নিমিত্ত বিরাট রাজ্য আক্রমন করেছে। বয়োজ্যেষ্ঠ কেউই সেইসময় রাজ্যে নেই। রাজকুমার উত্তর, অস্থির ভাবে পদচালনা করছেন অন্ত:পুরে। উপস্থিত পুরনারী দের বলছেন....

' মম পরাক্রম মত পাইলে সারথি।
মুহূর্তেক জিনিবারে পারি কুরুপতি।।'

সেইসময় পাণ্ডবেরা অজ্ঞাতবাসে আছেন বিরাট রাজ্যে। যাজ্ঞসেনী সৈরিন্ধ্রী ছদ্মবেশে আছেন রানীর সহকারিনী হিসেবে, অন্ত:পুরে সব শুনে তিনি শীঘ্র অর্জুনরূপী বৃহন্নলা কে সব জানালেন। তারপর রাজপুত্র উত্তর কে এসে বললেন....

' নর্তকী যে বৃহন্নলা আছয়ে আমার।
সৈরিন্ধ্রী কহিল সব পরাক্রম তার।।
খান্ডব দহিয়া পার্থ তুষিল অনলে।
বৃহন্নলা সারথি যে ছিলো সেই কালে।। '

সৈরিন্ধ্রীর বাক্যে প্রীত হয়ে রাজকুমার উত্তর, বৃহন্নলারূপী অর্জুন কে বললেন.........

' সৈরিন্ধ্রীর বাক্য মিথ্যা নহে কদাচন।
উঠ শীঘ্র মোর রথে কর আরোহণ।।
অর্জুন বলেন মানি তোমার বচন।
সারথি নহি যে তবু করিব গমন।।
কেবল আমার এক আছয়ে নিয়ম।
যথা যাই শত্রু যদি হয় যম সম।।
না জিনিয়া বাহুড়ি না আসে মম রথ।
সর্বথা প্রতিজ্ঞা মম জানিবে এমত।।'

এরপরের ঘটনা সবার জানা। যুদ্ধক্ষেত্রে উত্তরের ভয়ে পলায়ন, বৃহন্নলার তাকে ফিরিয়ে আনা, যুদ্ধে জয়লাভ, কৌরব দের পলায়ন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনের নিজ আত্মপরিচয় দান সবটুকুই।(শ্লোক: কাশিরাম দাসের মহাভারত)।



বিশ্ব রজ:স্রাব স্বাস্থ্য দিবস :

" বিশ্ব রজ:স্রাব স্বাস্থ্য দিবসের" প্রাক্কালে 'Menstruation Matters' আন্দোলনে সারা দিয়েছেন অগণিত নারী-পুরুষ। তিলোত্তমা কলকাতার বুকে ঘটে গেছে নি:শব্দ বিপ্লব। ভেন্ডিং মেশিনে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রির ব্যবস্থা করে নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পথিকৃত হয়েছে ভবানীপুর এডুকেশন সোসাইটি কলেজ।

যেখানে আমরা আধুনিক নারীরাও প্রকাশ্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে কুন্ঠা বোধ করি, সেখানে এমন একটা উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। এই মেশিনে সঠিক দাম দিয়ে নির্দিষ্ট বোতামে চাপ দিলেই প্রয়োজন অনুযায়ী ন্যাপকিন মিলবে। প্রকাশ্যে কেনার অস্বস্তি দূর করতে এই মেশিন অব্যর্থ।

২০১১ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিলো। মাত্র ১২% ভারতীয় মহিলা এটি ব্যবহার করেন। যেখানে এত সাঙ্ঘাতিক অচেতনতা, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন যুক্তিবোধ, অশিক্ষা, হাইজিনের সম্পর্কে অজ্ঞতা বিদ্যমান। সেখানে নারী পুরুষ নির্বিশেষে এগিয়ে এসে এমন একটা পরিকল্পনা কে সার্থক রূপদান নিশ্চয়ই সাধুবাদের দাবী রাখে।(সূত্র : এইসময়)



কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজ ও অধ্যক্ষা মানবী:

এই খবরে আন্তরিক খুশি কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, অধ্যাপক, অধ্যাপিকা ও পরিচালন সমিতির সদস্য সহ বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ। যুগ বদলেছে তাই আজ পুরুষ- মহিলা, রূপান্তরকামী বা বৃহন্নলা নয় তার শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব, উন্নত শীর, সুগঠিত মেরুদন্ড, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা, মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার ক্ষমতা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার একান্ত পরিচয় বাহক। অন্য কিছু নয়।

মহাভারতে বৃহন্নলা সারথি কে সঙ্গে নিয়ে উত্তরের জয়লাভ ঘটেছিলো। মানবীর সুনিপুন পরিচালনায় হয়ত বদলাবে অনেককিছু, আমরা আশাবাদী। ভারতে মানবীই প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের কোনো ব্যক্তি যিনি শিক্ষা ক্ষেত্রে এমন শীর্ষপদে আসীন হলেন। আমরা তাকিয়ে মানবীর মত আরো অনেকের দিকে। যাদের ঋজু ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব দান বদলে দেবে অনেক কিছুকেই। বদলাবো আমরাও।

সেদিন আর এমন কোনো ঘটনা খবরের কাগজের পাতায় আলাদা বিশেষ স্থান করে নেবেনা। আমরা জানব এটাই স্বাভাবিক। যোগ্য ব্যক্তি যোগ্যতর স্থানে যাবে এটাই যেন নিয়ম হয় তার লিঙ্গভেদ নয়।

শেষ করার আগে একটাই কথা। এত বদলের মধ্যে একদিন যদি দেখি... ফর্ম ফিল আপ করতে গিয়ে - SEX, RELIGION, CAST - এগুলোর উল্লেখ কমতে কমতে মিলিয়ে যাচ্ছে। সেখানে অগ্রাধিকার পাচ্ছে মেধা, যোগ্যতা, মানবতা...

জানব, " জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন" নিতে "ভারতের " আর বেশি দেরি নেই।



1 comments:

1

প্রাচীন কথাঃ সৌরেন চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রাচীন কথা 




উত্তরাপথের পথে 
সৌরেন চট্টোপাধ্যায় 





= ২য় পর্ব =



পিছনে ধূসরবর্ণা নাতিউচ্চ পর্বতমালা আর কালচে সবুজ বনভূমির বিস্তীর্ণ চালচিত্র। উচ্ছল-স্রোতা, সদা চঞ্চলা তমসা নদী বনভূমির উপত্যকাকে তার অবিরাম নূপুরনিক্বণে আমোদিত করে নেমে এসেছে শান্ত জনপদ প্রীতিকূটে। স্বাধীনচেতা তমসার স্রোতধারা উপল ও ছোট-বড় প্রস্তরখণ্ডে ব্যহত হয়েও জনপদটিকে অশ্বখুরাকৃতিতে বেষ্টন করে বয়ে চলেছে কোন এক অজানা নদের বক্ষলগ্না হতে। শৌর্য, কলা, বৈভবের সঙ্গে রিরংসা, ব্যাভিচার, নিষ্ঠুরতার রঙে রঙিন উত্তরাপথের মানচিত্রে আপন গন্ধে মত্ত কস্তুরী মৃগের মত নিরন্তর জ্ঞানের চর্চায় মগ্ন স্নিগ্ধ-শীতল ছায়াঢাকা ছোট্ট জনপদ প্রীতিকূট। ছোট বড় কুটির ও সংলগ্ন বাগিচার মধ্য দিয়ে কংকর-সমাচ্ছন্ন রাঙ্গা মাটির বীথিকা; আশপাশের স্বচ্ছ জলের তরাগ ও দীর্ঘিকাগুলিতে পাদপশ্রেণীর প্রতিবিম্ব, পত্র-পুষ্প-ফলভারে আনত তরুশোভিত মনোরম উদ্যান, প্রস্তর-নির্মিত দেবদেউলে সকাল-সন্ধ্যা শঙ্খ-ঘন্টাধ্বনি --- ইত্যাদি সবই যেন এক অনাবিল অপরূপ শিল্প-সুষমায় প্রীতিকূটকে সাজিয়ে রেখেছে। 

প্রীতিকূটের মধ্যস্থিত ব্রাহ্মণাধিবাসের গৃহগুলি সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি বটুকদের অধ্যয়ন ধ্বনিতে উপাসনালয়ের মত মুখরিত থাকে। ব্রাহ্মণাধিবাসকে কেন্দ্র করে পল্লীর সীমানা অবধি নানা পেশা ও বর্ণের মানুষের বাস। তাদের গৃহগুলি অনাড়ম্বর অথচ পরিচ্ছন্ন। লোকালয়ের মাঝে মাঝে চণক ও সোমলতার ছোট ছোট ক্ষেত, কোথাও বা গোময়লিপ্ত প্রাঙ্গণে কিশোরীরা পাখিদের জন্য ছড়িয়ে দিয়েছে নীবারের কণা, কোথাও কৃষ্ণাজিনের উপরে বিছানো শ্যামাক শুষ্ক হচ্ছে রৌদ্রাতপে; শুকনো হলে তা থেকে তৈরি হবে পুরোডাশ। 

কামসূত্র প্রণেতা মহর্ষি বাৎস্যায়নের বংশজাত প্রীতিকূটের সর্বজনশ্রদ্ধেয় আচার্য চন্দ্রভানু ভট্ট বেদাদি চতুর্দশবিদ্যায় সুপণ্ডিত। তাঁর গৃহটি যেন কোন প্রাচীন ঋষির আশ্রম। পুষ্প-লতার প্রাচীরবেষ্টিত প্রশস্ত সমচতুষ্কোণ ভূমির উপর পত্রাচ্ছাদিত মৃন্ময় কক্ষগুলি সুচারুভাবে সংস্থাপিত। প্রবেশপথের দুইপাশে ঔষধি ও ছোট পুষ্পবাগিচা। প্রাঙ্গণের মাঝামাঝি একটি ছোট আটচালায় আচার্যর চতুষ্পাঠী, সেখানে নিত্য প্রভাতে বটুকরা বিদ্যাশিক্ষা লাভ করতে আসে। একদিকে সারিবদ্ধ ভাবে পাকশালা, ঢেঁকিশালা ও ভাণ্ডার ঘর; অন্যদিকে পাশাপাশি দুটি শয়নকক্ষ; কক্ষগুলির তিন অরত্নি পরিমাণ উঁচু দাওয়া থেকে সোপানশ্রেণী নেমে এসেছে গোময়লিপ্ত পরিচ্ছন্ন প্রাঙ্গণে। কক্ষদুটির মধ্যে একটি সঙ্কীর্ণ পথ বাটীর পিছনের দিকে চলে গিয়েছে। সেখানে অনেকখানি জায়গা জুড়ে নিম্ব, বদরী, বিল্ব, পনস, হরীতকি, আমলকী, বিভীতকী ইত্যাদি নানা ধরণের বৃক্ষের সমাবেশে আচার্যদেবের গৃহটি নিবিড় ছায়াচ্ছন্ন ও শান্তিময়। 

শরৎ ঋতুর স্বর্ণাভ প্রভাতকাল। সূর্যালোকের সোনারঙ ক্রমশঃ স্ফটিকবর্ণে রূপান্তরিত হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই বটুকদের সম্মিলিত সুললিত কণ্ঠের সামগীত সমাপ্ত হয়েছে। পাঠ সমানাপন্তে তারা পাততাড়ি, কুশাসন ইত্যাদি গুছিয়ে মৃদুমন্দ কলধ্বনিতে আচার্যের গৃহপ্রাঙ্গণ বৈকালিক বলাকার মত মুখরিত করে বিদায় নিল। ওরা চলে যাবার পর চন্দ্রভানু তাঁর পুঁথিপত্র সযত্নে যথাস্থানে গুছিয়ে রেখে ধীর পদক্ষেপে অঙ্গনে এসে দাঁড়ালেন। পিছনের উদ্যান থেকে ভেসে আসা একটি মাত্র ডাহুকের ডাক গৃহের নৈঃশব্দ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। 

আচার্যদেবের বয়স পঞ্চাশোর্ধ হলেও তাঁর দীর্ঘ মেদহীন শরীর এখনো সর্জবৃক্ষের মতই ঋজু ও সবল। গাত্রবর্ণ পক্ক গোধূমের ন্যায়, প্রশস্ত ললাট, মুণ্ডিত মস্তকের পশ্চাদ্ভাগে পুরুষ্টু শিখা, চক্ষুদ্বয় জ্ঞান ও মেধার আলোকে উজ্জ্বল। তাঁর পরণে দুগ্ধশুভ্র ধৌতি ও উত্তরীয়। 

চন্দ্রভানু চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বান বা মালতি কাউকেই দেখতে পেলেন না। মনে পড়ল, আজ থেকে বাথান পর্ব শুরু হচ্ছে। ভগ্নী মালতি নিশ্চয় অন্যান্য পুরবাসিনীদের সঙ্গে গো-বাথানে গিয়েছে। আর বান! তাঁর প্রকৃতির মতই স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও ভাবুক কিশোর একমাত্র পুত্রটি যে কখন কোথায় থাকে, আর কি যে ভাবে, তা নিয়ে চিন্তা করাই বৃথা। 

প্রাঙ্গণের এক কোণে একটি শেফালী গাছের নীচে প্রস্তর ও মৃত্তিকা-নির্মিত বেদী, তার চারিপাশে ভোরের ঝরে পড়া ফুলরাশির মিষ্টি মধুর গন্ধে স্থানটি আমোদিত। আচার্যদেব বেদীতে এসে বসলেন। সেই মুহূর্তে তাঁর মন থেকে পার্থিব সমস্ত চিন্তা অপসারিত হয়ে উপনিষদের একটি শ্লোক অনুরণিত হতে লাগল। 

--- ‘দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে।

তয়োরন্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত্যনশ্নন্নন্যোহভিচাকশীতি।।’ --- শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ

[সর্বদা সংযুক্ত সমান-স্বভাব দুইটি পক্ষী (জীবাত্মা ও পরমাত্মা) একই দেহবৃক্ষকে আশ্রয় করে রয়েছে। তাদের মধ্যে একটি (জীবাত্মা) বিচিত্র স্বাদ-বিশিষ্ট সুখদুঃখরূপ কর্মফল ভোগ করেন, অপরটি (পরমাত্মা) কিছুই ভোগ না করে কেবল দেখে যান।] 

প্রীতিকূটের একেবারে পূর্বপ্রান্তে অনেকখানি জায়গা জুড়ে গো-বাথান। জনপদের ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ সকল সম্প্রদায়ের সকল মানুষই তার মালিক। গো-বাথানের সব রকম গব্যে সকলেরই সমান অধিকার। শতাধিক গোপালক ও শূদ্র রাখাল বালক বাথানের গোরুগুলির রক্ষণাবেক্ষণে সর্বক্ষণের জন্য নিযুক্ত আছে। বাথানেরই একপাশে তাদের বসবাসের জন্য সারিবদ্ধ পর্ণকুটির ও একটি পানীয় জলের কূপ রয়েছে। একপাশে দুগ্ধবতী গাভী, স্বাস্থবতী বকনা ও বাছুরগুলির জন্য গোশালা, অন্য পাশে পৃথক গোশালায় সতেজ ষণ্ড এবং বলদগুলির আস্তানা, সব মিলিয়ে গরুর সংখ্যা প্রায় সহস্রাধিক। গোপালকদের তত্বাবধানে গোশালাগুলি অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। বাথানের বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গনে অনেকগুলি শাল্মলী, কিংশুক, তিন্তিড়ি, তমাল, ছাতিম জাতীয় ঘন পত্রাচ্ছাদিত বড় বড় গাছ স্থানটিকে ছায়াচ্ছন্ন করে রেখেছে। মোটা মোটা কাঠের গুঁড়ি ও বাঁশের মজবুত বেড়া দিয়ে বাথানের সীমানাটি ঘেরা। সীমানার বাইরে একটি বিশাল দীর্ঘিকা, সেটিরও চারপাশের তীরে নানা ধরণের গাছ থাকায় জল শীতল ও নির্মল। গোপালক ও রাখাল বালকেরা দীর্ঘিকার জলে গরুগুলিকে নিয়মিত স্নান করায়, নিজেরাও করে। তারপরেই দিগন্তব্যাপী তৃণক্ষেত্র, প্রীতিকূটের গোচারণভূমি। প্রতিদিন সকালে ও বৈকালে রাখালেরা গরুগুলিকে সেখানে চারণ করায়। 

গো-বাথানে উৎসব শুরু হয়েছে। পক্ষকালব্যাপী এই উৎসবের আনন্দ প্রীতিকূটের নিস্তরঙ্গ জীবনকে হিল্লোলিত করে তোলে। গতকাল ছিল গো-পার্বন। এই দিন অতি প্রত্যুষে গ্রামের শুচিস্নাতা এয়োস্ত্রীরা নতুন কাপড় পরে পোড়া মাটির পাত্রে লাক্ষারস, সিন্দুর, হরিদ্রা ইত্যাদি নিয়ে এসে গাভীগুলির দেহ রঞ্জিত এবং ষণ্ড ও বলদগুলির শৃঙ্গে ফুলের মালা জড়িয়ে দিয়ে বরণ করেছে। কয়েকদিন আগে থেকেই প্রীতিকূটের যুবাপুরুষেরা গোপালকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাথান-প্রাঙ্গনের লতাগুল্মাদি পরিষ্কার ও গোময় লিপ্ত করে তকতকে করেছে। মাঝে মাঝে বংশদণ্ড এবং পত্র-পুষ্পে সাজিয়ে তোরণও রচিত হয়েছে। তোরণগুলির মাথায় নানা রঙের বস্ত্রখণ্ডের নিশান মৃদু বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে। বাথান উৎসব গোমাতার পূজা; জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে অঞ্চলের সকল মানুষই এই বৎসরকালীন উৎসবে মহানন্দে সামিল হয়। ভোর থেকেই আশপাশের গ্রামগুলি থেকে বড় বড় ডালা, ঝুড়ি ও বাঁকে করে নতুন ফসল, ফল-মূল, আনাজপাতি প্রভৃতি নিয়ে মানুষ আসতে শুরু করেছে। গাভীমাতাকে তুষ্ট করতেই তাদের এই উপাচার। পূজার পরে এই সবই রান্না হবে। উৎসবের প্রথম ও শেষ দুটি দিন প্রীতিকূটের প্রতিটি ঘরেই অরন্ধন, গো-বাথান প্রাঙ্গনেই পঙক্তি ভোজন। একপাশে বড় বড় অগ্নিকুণ্ড প্রজ্জলিত করে রন্ধন বিশারদরা ইতিমধ্যেই রন্ধনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পূজা-পাঠ ইত্যাদি প্রথম প্রহরেই সমাপ্ত হয়েছে, দিনের দ্বিতীয় প্রহরে মূল উৎসবের সূচনা তারপরে ভোজন পর্ব। শবর ও কিরাত সম্প্রদায়ের লোকেরা গত দু দিন ধরে তমসার তীরবর্তী জঙ্গল ও পিছনের টিলায় ফাঁদ রচনা করে প্রচুর হরিণ, ময়ূর, খরগোশ, বন্য-কুক্কুট ধরেছে। তারা প্রীতিকূটের সীমানার বাইরে গোষ্টিবদ্ধভাবে বাস করলেও এই সার্বজনীন উৎসবে সামিল হতে কোন বাধা নিষেধ নেই। তারা এখন নারী-পুরুষ মিলে বাথানের বাইরে তরাগের পাশে বসে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাদের শিকার করা প্রাণীগুলির মাংস পরিস্কার ও খণ্ডিত করছে। একটি লতাকুঞ্জের আড়ালে বিশালদেহী কৃষ্ণকায় এক অনার্য পুরুষ মাধ্বী, সীধু, পৈষ্টী, ইত্যাদি নানা ধরণের সুরাভাণ্ড নিয়ে বসেছে। তার মুখের হাসিটি শিশুর মতই অনাবিল। বয়ঃপ্রাপ্ত পুরুষেরা অনেকেই কর্মের অবসরে দু-এক ভাণ্ড সেবন করে যাচ্ছে। 

বাথান উৎসবে সব চেয়ে আনন্দ সদ্য যুবক-যুবতীদের। এই কয়টি দিনে তাদের উপর অভিভাবকদের অনুশাসনের তর্জনি উত্তোলিত হয় না। বয়স্করা পুজা ও উৎসবের নানা অনুসঙ্গের তত্বাবধান করতে, আর হয়ত বা কিছুটা ইচ্ছাকৃত ভাবেই তাঁদের শাসনের বন্ধনকে কিছুটা শৈথিল্য দেন। সুতরাং সারা বছর ধরে তরুণ-তরুণীরা যে এই ক’টি দিনের জন্য বিশেষ উন্মুখ হয়ে থাকবে তাতে আর আশ্চর্য কি! 

উৎসবের সময়ে আর একটি প্রয়োজনীয় কর্ম হয়। সেটি হল, কাঠের ইক্ষু মর্দন যন্ত্র দিয়ে ইক্ষু-রস নিষ্কাশন। তারপর বড় বড় অয়স-কটাহে সেই রস জ্বালিয়ে গৌড়দেশীয় পদ্ধতিতে গুড় তৈরী হয়। সকাল থেকেই বান তার সঙ্গীদের সঙ্গে ইক্ষুমর্দন যন্ত্রের পাশে বসে আছে। তাদের প্রত্যেকের হাতেই একটি করে ছোট মাটির ভাণ্ড। মর্দনকারীরা যন্ত্রটিকে ধুয়ে পরিষ্কার করছে, গো-শকটে ইক্ষুদণ্ডের বোঝা আনা হচ্ছে, কয়েকজন সেগুলিকে নামিয়ে হাতের কাছে গুছিয়ে রাখছে। রস নিষ্কাশন হতে এখনও যথেষ্ট বিলম্ব থাকলেও বালকগুলির কোন তাড়া নেই। তারা উৎসুক চোখে ওদের কাজ দেখছে এবং যন্ত্র থেকে ইক্ষুরস নির্গত হওয়ার কাঙ্খিত সময়টির জন্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে। যন্ত্রচালকদের নিয়ামক বৃদ্ধ মানুষটি শ্রদ্ধেয় আচার্য চন্দ্রভানুর এই কন্দর্পকান্তি পুত্রটিকে ভালরকম চেনে। সে কাজের ফাঁকে একবার এসে বানের ঘন কুঞ্চিত চুলে আদরের হাত বুলিয়ে বলে গিয়েছে, বাছারা একটু অপেক্ষা কর, রস বেরোলেই আগে তোমাদের ভাঁড়গুলো ভরে দেব। বালকেরা বৃদ্ধের কথায় বিশ্বাস করেছে। 

পিতৃস্বসা মালতি সেই সময় তার সঙ্গিনীদের সঙ্গে গো-বাথানের একটি পত্র-পুষ্পবহুল কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে বেদীতে পা ঝুলিয়ে বসে তরুণীসুলভ নানা রসিকতায় মগ্ন। মালতির সাজ-পোশাক সাধারণ হলেও সে অত্যন্ত রূপবতী ও সুরসিকা কিন্তু প্রগলভা নয়। মাত্র কিছুদিন আগেই তার পুষ্পোৎসব হয়ে সে কৈশোর– যৌবনের সন্ধিক্ষণে পা রেখেছে। সৈন্ধব লবণ আর কাঁচা মরিচ সহযোগে করঞ্জক ও তিন্তিড়ি খেতে খেতে পাশে বসা সখীর কি একটা কথায় মুক্তাবিনন্দিত দন্তে অধর দংশন করে মরালগ্রীবাটি বামদিকে ঈষৎ হেলিয়ে ষণ্ডদের গোহালের দিকে তাকালো। দেখল, বাদলের ঘন মেঘবর্ণ একটি যুবক বিশালাকৃতি ষণ্ডগুলিকে গোহাল থেকে গো-বাথানের চত্বরে বের করে আনছে। যুবকটির ঘাড় পর্যন্ত লোটানো চুল কপালের কাছে একটা লাল ফেট্টি দিয়ে বাঁধা, পুরু ঠোঁট, নাক কিঞ্চিৎ চাপা, কিন্তু চোখদুটির বড় মায়াময়। ওর সঙ্গিনীরা তখন কি একটা রসিকতায় এ ওর গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। মালতি অপাঙ্গে আর একবার যুবকটিকে দেখল, সে নির্বিকার ভাবে ষণ্ড ও বলদগুলিকে বাথান-প্রাঙ্গনের খুঁটিতে বাঁধতে ব্যস্ত। তার পেশল তাম্রাভ শরীরের দিক থেকে চোখ ফেরানোর আগেই প্রিয় সহচরী দীপিকা হেসে বলল, কি রে মালতি, শেষ পর্যন্ত ওই অনার্য পুরুষটিই যে তোর কঞ্চুলিকার ভিতরে ভূকম্প বাঁধিয়ে দিল! 

--- যাঃ, কি যে বলিস! তুই ভারী অসভ্য! মালতি ছদ্মকোপে উষ্মা প্রকাশ করল। 
--- ওহে গোপালক, একবার এদিকে এসো তো! দীপিকার কথা শুনে প্রগলভা রোহিণী যুবকটিকে লক্ষ্য করে উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠল। 

গোপালক তার হাতে ধরা ষণ্ডের রজ্জুটি একটি খুঁটিতে বেঁধে এগিয়ে এলো। তার শরীর ও মনের কুন্ঠিত ভাব দেখে রসিকারা নিজেদের সংবরণ করতে না পেরে খিলখিল করে হেসে উঠল। মালতি কিন্তু সঙ্গিনীদের কলহাস্যে সামিল না হয়ে নিজেকে ছদ্ম গাম্ভীর্যের আবরণে ঢেকে অন্য দিকে একটি পত্র-পুষ্পশোভিত তোরণের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। 

--- কি নাম গো তোমার? দীপিকা হাসিমুখে শুধালো। 

--- আজ্ঞে বিধু, যুবক লজ্জা-কুন্ঠিত গলায় উত্তর দিল। 

--- বিধু! বিধু মানে তো চাঁদ! পাশ থেকে এক রসিকা যুবতী সহাস্যে বলল। 

--- এই মাটির কৃষ্ণচন্দ্র যে সদ্য প্রস্ফুটিত মালতিকেও তার চন্দ্রমায় মাতোয়ারা করে দিয়েছে, দীপিকা বলল। 

--- যাঃ, তোরা যে কি বলিস! মালতি অস্ফুটে বলতে গেল, আড়চোখে সে বিধুকে দেখছে, আশ্চর্য এক অনুভূতির স্রোতধারা তার অনাঘ্রাতা কুমারী শরীর ছুঁয়ে প্লাবিত হয়ে চলেছে। 

--- আমি যাই গো ঠাকরুণরা, অনেক কাজ বাকি আছে যে! বিধু এই উদ্ভিন্নযৌবনা রসিকাদের হাত থেকে যেন মুক্তি পেলে বাঁচে!

--- যাও, তবে ডাকলে এসো বাপু কালাচাঁদ, দীপিকা বলল, কি জানি মালতির যদি বিশেষ কোন দরকার পড়ে। 

--- যে আজ্ঞে, বিধু চলে গেল। মালতি ও তার সহচরীদের মরালীর মত কলহাস্যে গো-বাথানের প্রাঙ্গণ সকালের নির্মল সূর্যালোকের মত উদ্ভাসিত করে তুলল। 

ইতিমধ্যেই গো-বাথানে প্রীতিকূট ও অন্যান্য জনপদবাসীদের বেশ ভিড় জমে গিয়েছে। সকলেরই পরণে নতুন পোশাক। কিশোরী, যুবতী ও অল্পবয়স্কা বধূদের সাজ-সজ্জায় বিশেষ ঘটা; পুরাতনীদের অঙ্গেও অন্যান্য দিনের আটপৌরে সাজের বদলে মানানসই পোশাক। এমনকি আচার্য চন্দ্রভানুর মত রাশভারী বিদগ্ধ মানুষও তাঁর সমবয়সী কয়েকজন শ্রদ্ধেয় পণ্ডিতদের সমভিব্যহারে উৎসব-প্রাঙ্গনে এসে উপস্থিত হয়েছেন; এঁদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা। একটি ছায়াচ্ছন্ন গাছের নীচে বেদীতে তাঁরা বসা মাত্র ইক্ষু-মর্দনের বৃদ্ধ নিয়ামক নিজে এসে তাঁদের প্রণাম জানিয়ে রসপূর্ণ ভাণ্ড দিয়ে অভ্যর্থনা করেছে। পণ্ডিতেরাও আজ আর নিজেদের অহংকার বা গাম্ভীর্যের আবরণে নিজেদের ধরে রাখেন নি, নিজেদের মধ্যে রসালাপ ও হালকা রসিকতায় বেশ মেতে আছেন। 

বান ও তার সঙ্গী-সাথীরা প্রাণ ভরে ইক্ষুরস পান করে নতুন নতুন খেলা উদ্ভাবন করে সমস্ত প্রাঙ্গণ জুড়ে ছুটোছুটি করছে। তাদের বালসুলভ চপলতা ও কৌতুকক্রীড়ায় সারা গো-বাথান মুখরিত। এরই মধ্যে তারা একটি সুবৃহৎ রসাল বৃক্ষের শাখায় রজ্জু ও কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে একটি দোলনাও ঝুলিয়ে ফেলেছে। 

বয়স্ক কয়েকজন এরই মধ্যে মাধ্বী পান করে কিঞ্চিৎ প্রগলভ। নিজেদের বয়স ও আভিজাত্য ভুলে যেন ফেলে আসা যৌবনের দিনগুলিতে ফিরে গিয়েছেন, তাঁদের কথাবার্তার মধ্যে অসংলগ্নতা ও চটুলতার প্রকাশ। 

আচার্য চন্দ্রভানু বয়স্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে গো-বাথানের চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাঁর কৈশোর-যৌবনের দিনগুলির কথা স্মরণ করে মনে মনে আমোদিত হলেন। কিছুক্ষণ সঙ্গীদের সঙ্গে কাটিয়ে এক সময় উঠে দাঁড়ালেন, প্রীতিকূট ও সংলগ্ন জনপদবাসীদের এই মিলন উৎসবের আনন্দময় পরিবেশে তাঁর মুখমণ্ডল প্রশান্ত। তিনি অলস পদবিক্ষেপে গোশালার পাশ দিয়ে বাথানের উত্তর সীমানার দিকে এগিয়ে গেলেন। অদূরে অনার্যরা মাংস প্রস্তুত করতে ব্যস্ত; তাদের পাশ দিয়ে সামনের ফসলের ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে একটি পায়ে চলা পথের বঙ্কিম রেখা দূরে মিলিয়ে গেছে। অন্য পাশে দুটি গাছের মাঝখানে মাধবীলতা কুঞ্জ থেকে উচ্ছল নারী-কন্ঠের কলধ্বনি শুনে একটু হাসলেন তিনি। মেয়েদের কাকলির মধ্যে তাঁর প্রিয় ভগ্নীর কন্ঠস্বর চিনতে তাঁর ভুল হল না। দেখলেন গোশালাটি সেই মুহূর্তে অরক্ষিত, কোন গোপালক চোখে পড়ল না। গাভী ও ষণ্ড-বলদগুলি যথাস্থানে বাঁধা রয়েছে, কেবল দুটি গোবৎস ইতস্ততঃ ছোটাছুটি করছে। একটি সদ্যঃপ্রসূত গোবৎস নব পদবিক্ষেপের উৎসাহে সীমানার কাছে কদলিকা-বাগিচার দিকে চলে গিয়েছে দেখে পরম মমতায় সেটিকে ফিরিয়ে আনতে কয়েক পা এগিয়ে চিত্রবৎ স্থির হয়ে গেলেন আচার্য চন্দ্রভানু। তাঁর কূর্চভাগ-এর রেখাটি গভীরতর হল, ওষ্ঠাধর দৃঢ় সংযুক্ত। সামনের দিগন্তব্যাপী জনহীন ফসলের ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা পায়েচলা পথটি যেখানে মিশেছে সেখানে একটি ধূলিঝড় ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে। আচার্য স্থির দৃষ্টিতে একটু সময় সেই দিকে তাকিয়ে বুঝলেন সেটি একটি মানুষের দল। এত দূর থেকে সঠিক বোধগম্য না হলেও অনুমানে বুঝলেন তারা সংখ্যায় শতাধিক তো হবেই! চন্দ্রভানু প্রথমে ভেবেছিলেন তারা গ্রামান্তরের মানুষ, গো-বাথান উৎসবে যোগ দিতে আসছে। কিন্তু তাদের পরণের কৃষ্ণ বর্ণের পোশাকটাই তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছে। কারণ, বাথান উৎসবে কেউই কখনো কাল রঙের পোশাক পরে না, তা অমঙ্গলের প্রতীক। আগন্তুকরা এখনও যথেষ্ট দূরে আছে, তাদের গতি বেশ দ্রুত হলেও পদব্রজে তাদের বাথানে পৌঁছাতে অন্ততঃ দুই দণ্ড লাগবে। এই সময় বাথানের সকলেই নিশ্চিন্তে উৎসবের আনন্দে মেতে রয়েছে, তাঁর অনুমান যদি সত্য হয় তাহলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা। তিনি তীব্র-গম্ভীর স্বরে ‘ধানুউউক’ বলে ডাক দিলেন। চন্দ্রভানুর মত স্থিতধী মানুষের হঠাৎ এ ধরণের চীৎকার শুনে কাছাকাছি যারা ছিল, তারা সকলেই বিস্মিত ও স্তম্ভিত হয়ে গেল। অন্যান্যরা আসার আগেই একজন কালো কষ্টি পাথরে খোদাই করা মূর্তির মত মধ্য বয়স্ক মানুষ যেন মাটি ফুঁড়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালো। লোকটির মাথায় কাঁচাপাকা ঘন কুঞ্চিত বাবরি চুল, মেদহীন, পেশী ও শিরাবহুল শরীরের প্রতিটি কোষে যেন এক অফুরন্ত শক্তি সংরক্ষিত হয়ে আছে। তার হাতে মানুষ-প্রমাণ একটি মোটা বেত্রযষ্টি, নিয়মিত পরিচর্যায় সেটি তার ধারকের মতই তৈল-চিক্কণ। এ অঞ্চলের লোকেরা জানে ধানুকের হাতে ঐ বেত্রদণ্ডটি থাকলে বিশ জন পুরুষও তার সমকক্ষ হতে পারে না; দণ্ডটি সে এমন বেগে ঘোরায় যে দূর-নিক্ষিপ্ত তীরও তাতে প্রতিহত হয়ে যায়। 

অল্পক্ষণের মধ্যেই বাথানের বেশীরভাগ প্রৌঢ় ও যুবা পুরুষেরা ছুটে এল। চন্দ্রভানু দূরের দৃশ্যটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, আমার অনুমান যদি সঠিক হয়ে তাহলে ঐ লোকগুলি এই ধূমল প্রদেশের সামন্ত রাজা দুর্জয়ের আজ্ঞাবহ দুর্বৃত্ত। ধন-সম্পদের চেয়েও কিশোরী ও যুবতী নারী এবং গো-সম্পদের ওপরেই ওদের বেশী লোভ, আর স্বার্থসিদ্ধির জন্য ওরা যে চরম নিষ্ঠুর, শিশু-বৃদ্ধ-নারী কেউই ওদের নৃশংসতার হাত থেকে রক্ষা পায় না, এবং সব রকম অমঙ্গল কাজ করতে সিদ্ধহস্ত তা তো সকলেরই জানা, সম্ভবতঃ সেই কারণেই প্রীতিকূট অরক্ষিত থাকা সত্ত্বেও ওরা আমাদের গো-বাথানে আজকের এই উৎসবের দিনটিকেই বেছে নিয়েছে। 

--- ওরা তো শক্তিশালী ও সশস্ত্র, একজন সভয়ে শুধালো, ওদের মত নৃশংস লুন্ঠকদের সঙ্গে কি করে আমাদের নারী-শিশুদের রক্ষা করব আচার্যদেব? 

--- শক্তি বা যুদ্ধ-কৌশলে আমরা যে ওদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারব না তা আমিও জানি, চন্দ্রভানু গম্ভীর গলায় বললেন, আমাদের বুদ্ধি ও চাতুর্যের সঙ্গে ওদের প্রতিহত করতে হবে। 

--- আপনি আমাদের আদেশ দিন ও পরিচালিত করুন আচার্যদেব, ধানুক বলল, উপস্থিত অন্যরাও তার কথার সমর্থন জানালো। 

--- দ্যাখো আমরা এখানে উৎসব করতে এসেছি, সংঘাতের জন্য প্রস্তুত হয়েও আসিনি, তাছাড়া আমাদের হাতে সময়ও বেশি নেই, সুতরাং অবস্থার বিচার করে কৌশলের দ্বারাই ওদের প্রতিহত করতে হবে, চন্দ্রভানু সামান্য সময় চিন্তা করে বললেন, সাধারণ ভাবে যা অস্ত্র নয় সেগুলিকেই অস্ত্রে পরিণত করে নিজেদের রক্ষার ব্যবস্থা করাই এখন বুদ্ধিমানের কাজ। 

গোপালকদের দলপতি শ্রীনিবাসকে ডেকে বললেন, তুমি আমাদের গোধন ও গোশালা রক্ষার ভার নাও। বাথানের সব গরুগুলিকে গোশালার ভিতরে ঢুকিয়ে তোমার দলের লোকজনদের নিয়ে পাহারা দাও, প্রত্যেকের হাতে লাঠি বা যে কোন অস্ত্র অবশ্যই রেখো। শ্রীনিবাস ঘাড় নেড়ে নির্দেশ পালন করতে চলে গেল। 

প্রিয় বয়স্য বিনোদ ভট্টর কাঁধে হাত রেখে আচার্য বললেন, বন্ধু তুমি কয়েকজন শক্তিশালী যুবককে নিয়ে মেয়েদের সুরক্ষার দায়িত্ব নাও। গোশালার পিছনের যে অকর্তিত ইক্ষু ক্ষেতটি আছে, তার অন্তরালে আত্মগোপন করাই শ্রেয় হবে। এখন তো ওদের নিয়ে প্রীতিকূটে যাওয়া ঠিক হবে না, কারণ দুর্জয়ের হানাদাররা হয়ত সেখানে ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছে! বিধু পাশেই দাঁড়িয়েছিল, সেও নিঃশব্দে বিনোদ ভট্টর অনুগামী হল। 


--- ধানুক, তুমি ওই শবর, কিরাত আর বাথানের বাকি সব সমর্থ পুরুষদের দুভাগে ভাগ করে একাংশকে চারিদিকের বড় বড় গাছের ঘন পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে বল, শবরদের নিত্যসঙ্গী তির-ধনুক ইত্যাদি ছাড়া বেশি শস্ত্র তো আমাদের সঙ্গে বেশি নেই! তাই ওদের সবাই যেন যতটা সম্ভব প্রস্তর খণ্ড সঙ্গে রাখে। আর তুমি নিজে সবচেয়ে বলশালী এবং লাঠি চালনায় দক্ষ সৈরিকদের নিয়ে বাথানের অনেকটা আগে দুর্বৃত্তদের আগমন পথের দুপাশে একটু দূরত্ব রেখে শস্যক্ষেত্রের মধ্যে সরীসৃপের মত বুকে হেঁটে ঢুকে নিশ্চল কিন্তু সজাগ হয়ে আত্মগোপন করে থাকবে। 

--- কিন্তু ধরুন ওরা যদি কোন দুস্কৃতি না হয়? আচার্যর এক বয়স্য চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করলেন। 

--- এ বিষয়টিও আমি চিন্তা করেছি বন্ধু, চন্দ্রভানু উত্তর দিলেন, আমি নিজে সবার পুরোভাগে ওই যে ঐ ঘন নিচুল-এর ছোট ঝোপটি রয়েছে সেখানে প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থান করব; আমি দক্ষিণ হস্ত উত্তোলন করলেই ধানুক বুঝবে ওরা আক্রমণকারী। ওরা অতিক্রম করে এলেই বাথানে প্রবেশের আগেই সে সৈরিকদের নিয়ে ওদের পিছন থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করবে, তারপর গাছের উপর থেকে বাকিরা --- শেষে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। কিন্তু সাবধান! খুব অপারগ না হলে দেখো যেন অযথা কোন প্রাণহানি না হয়। 

--- কিন্তু ওরা সামন্ত দুর্জয়ের নির্দয় ঘাতক বাহিনী হলে তো আপনার জীবন সংশয় হতে পারে! 

--- আচার্য চন্দ্রভানু প্রিয় সঙ্গীর এ কথার উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসলেন। 

আচার্যদেবের পরিকল্পিত ব্যুহ অনুযায়ী ধানুকের তত্ত্বাবধানে সকলেই অত্যন্ত দ্রুত আসন্ন বিপদের সম্মুখীন হতে প্রস্তুত হল। মাংস ও অন্যান্য খাদ্য সম্ভারগুলি মাধ্বী বিতরণকারী সেই বিশালদেহী অনার্যের কাছে সরিয়ে এনে রাখা হয়েছে। সেখানেও দশজন বলবান পুরুষ পাহারায় আছে। উৎসবমুখর প্রাঙ্গনটিতে এখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। তাঁর নির্দেশে বয়স্করা চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছেন, এবং বাহ্যত রন্ধনকার্যও যথারীতি চলতে থাকল। কিন্তু রন্ধন বিশারদরা এখন কেবল বিশাল বিশাল পাত্রে জল ভর্তি করে উনানে চাপিয়ে দিয়ে তাদের লোহার ভারি ভারি হাতা-খুন্তি ও জ্বালানির জন্য আনা মোটা মোটা কাষ্ঠখণ্ডগুলিকে হাতের কাছে সাজিয়ে রাখছে। চন্দ্রভানু আর একবার সব কিছু ভাল করে দেখে নিয়ে সন্তুষ্ট মনে দৃঢ় পদক্ষেপে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। 

শুধু বান ও তার সঙ্গীদের কোথাও দেখা গেল না। ---- (ক্রমশঃ প্রকাশ্য)

1 comments:

1

প্রাচীন কথাঃ সুবীর দাস

Posted in


প্রাচীন কথা 


রাক্ষসনামা
সুবীর দাস





প্রথমেই বলে নিই ফুল, বেলপাতা, নৈবেদ্য নিবেদন; আমার কাছে ধর্ম নয়। ধর্ম বলতে জীবনের ধর্মই বুঝি, যেখানে সমস্ত বিপরীত গুণ সমাহারে থাকা সত্ত্বেও শুভবোধের উত্তরণ সুস্থ, সুন্দর, ভেদহীন সমাজের দিকে মানব মননকে চালিত করে, সেই আমার ধর্ম। কাজেই মহাভারতের কাহিনী আমার কাছে ততটাই ধর্ম যতটা জীবনের ধর্মের কথা বলা হয়েছে। অন্যায় করে কেউই পার পাননি। একমাত্র যুধিষ্ঠির বাদে সবাইকেই মনুষ্য যন্ত্রণাতেই মরতে হয়েছে। কৃষ্ণের মৃত্যুও অপঘাতে, গান্ধারীর অভিশাপ এখানে যতটা না বাস্তব তার চেয়ে ঢের বেশি রূপক, কারণ রচয়িতা ব্যাসদেবের কলম বড় নির্মোহ। তাঁর সৃষ্ট জীবন গুলিতে তিনি ন্যায়-অন্যায় সমস্ত দেখিয়েছেন এবং দেখিয়েছেন অন্যায়ের পথে অভীষ্ট সিদ্ধ হলেও, শেষ পর্যন্ত অন্যায়কারী বান্ধবহীন। কুরুক্ষেত্রের পর একমাত্র পরীক্ষিৎ ছাড়া ওই বংশে আর উত্তরাধিকার ছিলনা। যাইহোক, সাহায্য নিয়েছি রাজশেখরবসু, কালীপ্রসন্নসিংহ, নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী, সুকুমারী ভট্টাচার্য্য, বঙ্কিমচন্দ্র, সুখময় ভট্টাচার্য্য প্রমুখ যশস্বী লেখক আলোচকদের। আফশোষ, অশোক রুদ্র, বিমল কৃষ্ণ মতিলাল এঁদের লেখা এখনও পাঠ করার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি।

পুরাণের কথা লিখতে গিয়ে উৎসাহিত করেছে প্রায় প্রত্যেক বন্ধুই, তাই আলাদা করে উল্লেখ করছিনা। আমার বহু কলহের সঙ্গী জয়িতা, তার কথা বলতেই হয়। কারণ সে যদি তার কল্পরূপ মিশিয়ে মহাকাব্যের নতুন কাব্যিক দিক তুলে ধরতে পারে তার অর্জিত ও সহজাত দক্ষতায়, আমি কেবল সামান্য অর্জিত সঞ্চয় সম্বল করে এবং অগ্রজ সনৎদা-র পরামর্শেই নিজের বোধের দ্বারা পরিচালিত হয়ে কেবল তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে চেষ্টা করব। আমার বন্ধুরা, আমার ভুলগুলিতে সতর্ক করলে ও সঠিক দিশা দেখালে এই ফেসবুকীয় প্রয়াস সার্থক বলে মনে করব।

ঘটোৎকচ, পাণ্ডব কুলের সর্বজ্যেষ্ঠ পুত্র। তৎকালীন সমাজে সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল, ক্ষেত্রজ সন্তান সমাজে ব্রাত্য ছিলেন না। অর্থাৎ কানীন পুত্র সমাজে অসম্মানিত হন' নি। কুন্তী, সত্যবতী কুমারী অবস্থায় কর্ণ এবং রচনাকার ব্যাসদেবের জন্ম দিয়েছিলেন। যেহেতু ব্যাসদেব থেকেই ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুরের জন্ম এবং সত্যবতীর সাহস এবং অসঙ্কোচের কাছে কুন্তী ঠিক ততখানি জড়তাগ্রস্ত ছিলেন বলে মহাভারতের আখ্যান অন্যভাবেই রচিত হয়েছে। অথবা, বলা ভাল ব্যাসদেব যে মহান দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে রচনা করেছেন, সেই 'জীবনের ধর্মের' পাঠ দিতে গিয়ে কর্ণকে অপ্রকাশ্য রেখেছেন যুদ্ধ শেষ না হওয়া অবধি। কারণ, কৃষ্ণের কাছে যদি যুধিষ্ঠির জেনে যেতেন যে কর্ণই তাঁর অগ্রজ, তাহলে এই যুদ্ধই হত না।

এর স্বপক্ষেই দেখি যখন ঘটোৎকচ মারা যান, তখন কৃষ্ণ যে যুক্তি দেখিয়ে ছিলেন সেখানে তিনি কৃষ্ণের ওপর সন্তুষ্ট হতে পারেননি। এখন দেখা যাক কৃষ্ণ কি কি যুক্তি দেখিয়েছেন।

এক, একাঘ্নী অস্ত্রতে পঞ্চপাণ্ডবের যে কোন একজন মারা যেতেনই। সেক্ষেত্রে এই অস্ত্র অর্জুনের ওপর প্রয়োগ এক স্বাভাবিক বিষয়। তাই যুদ্ধের মূল সেনা অর্জুনকে বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব দরকার। দুই, ঘটোৎকচের দেবদ্বিজে ভক্তি ছিলনা এবং যাগযজ্ঞের বিরোধী ছিলেন।

এই দ্বিতীয় বিষয়ের মধ্যেই সামাজিক প্রেক্ষিত কিন্তু লুকিয়ে রয়েছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষিতও রয়েছে। সে বিষয় কেবল ছুঁয়ে যাব শেষে। ঘটোৎকচ কিন্তু কৌরব পক্ষীয় রাক্ষস অলায়ুধকে হত্যা করেছিলেন। অর্থাৎ, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলে বাকি কাঁটাকেও কার্যসিদ্ধি শেষে ছেঁটে ফেলা। খাণ্ডব দহন শেষে কেবল মাত্র ছয়জনই বেঁচেছিলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, রাক্ষস এমন এক অরণ্যচারী জনজাতি, যারা ব্রাহ্মণদের প্রতি অনুকুল ছিলেননা কিম্বা বলা ভালো ভক্তিশ্রদ্ধা ছিলনা। তাহলে এই রাক্ষস টিকিয়ে রাখা মানে এক, ব্রাহ্মণদের অধিকার খর্ব হতে থাকা এবং দুই, বংশের নিয়ম অনুযায়ী ঘটোৎকচ জ্যেষ্ঠ্পুত্র হিসাবেই পাণ্ডবদের সিংহাসনে বসার অধিকারী। আর তা যদি হয়, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের যে পরস্পরের গা ঘেঁষাঘেঁষি থাকা সেটি কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ত। আবার অন্যভাবে ভাবলে রচয়িতা নিজে ব্রাহ্মণ বলেই ব্রাহ্মণ দের প্রতি অবজ্ঞা মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু জীবনের ধর্ম যদি বলি, তাহলে বেদজ্ঞ মানুষের মহিমাই ছিল সেই ধর্মের মুখ। বিষয়ান্তরে যাবনা। যে প্রসঙ্গে আসতে চাইছিলাম সামাজিক অবস্থান।

তিন হাজার বছর আগে হোমোস্যাপিয়েন্স ছিল অভিব্যক্তির চূড়ান্ত। তাই রাক্ষস মানে বীভৎস চেহারার মনুষ্যেতর অস্বাভাবিক জীব, একথা মনে করার কোন যৌক্তিকতা নেই। বলা যেতে পারে অরণ্যে বসবাসের ফলে সেই মানুষদের অভিযোজনগত বৈশিষ্ট্য নগর জীবনের থেকে আলাদা হবার দরুণ অস্বাভাবিক মনে করা হত। আজও যেমন প্রান্তিক, অন্ত্যজ মানুষরা উপেক্ষিত হয়েই থাকেন। ট্র্যাডিশন কোথায় যাবে! রাজশেখর বসু তাই মজা করে হিড়িম্বার মুখ দিয়ে 'পুনর্মিলন' গল্পে বলিয়েছেন যে, ভালো করে সাঁতলে নিলে ঋষি আর অন্য মানুষের স্বাদে তফাৎ কোথায়! তাহলে অনুমেয়, রাক্ষসদের কাছে ও তেমনি ব্রাহ্মণ কিম্বা ক্ষত্রিয়ের আলাদা মর্যাদা ছিলনা। সমদৃষ্টি কেবল নয়,এক বিপরীত তাচ্ছিল্যও রাক্ষসদের নিকট হতে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়েরা পেতেন। ঠিক আজকের দিনেও সামাজিক অবস্থানের কথা ভেবে দেখুন।

হিড়িম্বা সেজেগুজে সূক্ষ্ম বসন পরে মধ্যম পান্ডবের মনে যে মিলনের ইচ্ছা জাগিয়ে দেননি এমনতো নয়। কিন্তু কর্তব্যবোধে ভীম তাঁর ইচ্ছাকে অবদমন করতে পারছেন। কিন্তু হিড়িম্বা পারছেননা। সভ্য ও অ-সভ্যের তফাৎ দেখানো হচ্ছে। দেখুন, বিধবা উলুপী(নাগকন্যা), অনার্যা হিড়িম্বা, এঁরা ইচ্ছা প্রকাশে অ-সভ্য হয়ে যান কিন্তু পরাশর থেকে শান্তনু, এঁরা কামেচ্ছা প্রকাশেও মহান থাকেন। একমাত্র ব্যতিক্রম উর্বশী। অর্জুনের প্রত্যাখানে অর্জুনকে ক্লীব হবার অভিশাপ দিচ্ছেন। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, উর্বশী কিন্তু স্বর্গের অপ্সরী। তাঁর জাত হিড়িম্বা তুল্য নয়। বিচক্ষণ কুন্তী। অরণ্যে বাস করে শত্রুর চেয়ে মিত্র ভাবে থাকাই বিবেচ্য মনে করলেন। হিড়িম্ব কিন্তু নিহত। এখন যদি হিড়িম্বাকেও নিহত বা প্রত্যাখাত হতে হয় তাহলে হিড়িম্বা যদি রেগে গিয়ে সমস্ত রাক্ষসদের একত্রিত করে আক্রমণ করে কিম্বা দুর্যোধন কে খবর করে দেয়। তার চেয়ে হিড়িম্বার সাথে থাকাই ভালো। এখানে মনে রাখতে হবে, শর্ত ছিল হিড়িম্বার সন্তান হলেই ভীম ফিরে আসবে। অনার্যদের অবস্থান আরও স্পষ্ট।

একটু ইতিহাস ছুঁয়ে যাই। যদি এই যুগকে বৈদিক যুগ বলি, তাহলে ঋগ্বেদের ভাষা কাদের ভাষা বা কোন অঞ্চলের সঙ্গে সাযুজ্য, তার উপর একটু আলোকপাত প্রয়োজন। প্রথমত ভাষাবিজ্ঞান বিচারে ঋগবেদের সঙ্গে ইরানীয় ধর্মগ্রন্থ "আবেস্তা"র বেশ আত্মীয়তার সম্পর্ক। অর্থাৎ ইন্দো- ইরানীয়(আর্য) এবং যাদের ধর্ম গ্রন্থে গৃহপালিত এবং ঘোড়ায় টানা রথের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেখানে অশ্ব এক গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কেত এবং এই খুরের চিহ্ন ধরেই, উত্তর পশ্চিমের খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০-১৪০০ সোয়াটের ঘালিঘাই এবং উত্তর- পূর্ব বেলুচিস্তানে খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০-১৪০০ এবং তৃতীয় দশায় খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০-৮০০ সিন্ধুনদের পশ্চিমে উপস্থিত হয়ে সেই অঞ্চল থেকে এই ভারতভূমির বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল।

কে না বলতে পারে এই ছড়িয়ে পড়া এবং ছড়িয়ে পড়তে গেলে অধিকার করা – এরই মূল কারণ ছিল 'মহাভারতের যুদ্ধ' (কেবল এটিই একমাত্র নয়)। কারণ এর আগেও উত্তর পশ্চিমে নগর সভ্যতা ছাড়াও পূর্বে এবং দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে একেবারে সম্পর্কহীন না হলেও এক প্রাগার্য সভ্যতা গড়ে উঠেছিল যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল 'মগধ' এবং যার রাজা ছিলেন জরাসন্ধ। এর মিত্র বা অনুগত শক্তি ছিলেন শিশুপাল যিনি চেদি বংশীয় এবং পুন্ড্রবর্ধনের রাজা পৌন্ড্রবাসুদেব। জরাসন্ধের জামাই কৃষ্ণের মামা কংস, যিনি মথুরায় জরাসন্ধেরই প্রতিনিধি। আর জরাসন্ধের জন্মবৃত্তান্ত থেকে জানা যায় কোন এক রাক্ষসি(জরা) তাঁকে জন্মকালীন বিকলাঙ্গতা থেকে মুক্ত করেছিলেন। তাহলে অনুমেয় রাক্ষসদের সঙ্গে এদের সু-সম্পর্কই ছিল। তাহলে রাক্ষস সহ এই ত্রয়ীকে নিকেশ করতে না পারলে ভারতবর্ষ আর্যাবর্ত হবে কি করে! অন্যদিকে মুনিঋষিরাও অরণ্যচারী (বেদ থেকেই জানা যায়)।

অপর দিকে, রাক্ষসদের অত্যাচারে মুনিঋষিরা অতিষ্ঠ। তাহলে দেখা যাচ্ছে আর্যদের স্বাভাবিক মিত্র অবশ্যই অরণ্যের এই ব্রাহ্মণ। তাহলে রাক্ষস নিধন যেমন স্বাভাবিক তেমন স্বাভাবিক রাক্ষসদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কৌশলও।
যদি উপরিচরের আখ্যান থেকে মহাভারতের শুরু ধরে নিই সমগ্র কাহিনীতে প্রথম ক্ষত্রিয়-রাক্ষস সমন্বয়ে এই সন্তান - ঘটোৎকচ। যিনি কেবল এই বংশের প্রথম সন্তান নয়, রাক্ষস ও আর্যদের প্রতিভূ। যাকে খুব প্রয়োজনমত ব্যবহার করে শেষে মেরে ফেলা হয়েছে কর্ণের সামনে লেলিয়ে দিয়ে। আর্যদের কলঙ্কের ভাগীদার হতে হলনা। কারণ কুন্তীর জ্যেষ্ঠ্য সন্তান যাকে তখন অন্তজ সম্প্রদায়ের অর্থাৎ সূত পুত্রের হাতেই সেই বংশেরই দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রথম সন্তান ঘটোৎকচের হত্যা। এ ভারি মজার বিষয়।

সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়াতে গিয়ে দেখি এক বিশাল রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে দাঁড়িয়ে গেছি। কৃষ্ণের শত্রুদমন করতে হলে পাণ্ডবদের সঙ্গে এবং ব্রাহ্মণদের সঙ্গে মিত্রতা জরুরী। খাল কেটে কুমীর আনার মত উত্তর-পশ্চিমের আধিপত্য বিস্তার, সেই সাথে আধিপত্য বিস্তারে পূর্ণ নিয়ামক কৃষ্ণ, সঙ্গে ক্ষমতাহীন দায়িত্বে যুধিষ্ঠির এবং প্রবল পরাক্রমী অর্জুনের ড্রাইভার (সারথি) তিনি নিজেই (আমরা যখন গাড়ি চড়ি জানি ড্রাইভারের হাতেই আমাদের জীবন থাকে)।

আধুনিক ভারতে এই কিংমেকার যাকে বলা হয়, মহাভারতে সেই কিংমেকার হলেন কৃষ্ণ। এই রাজনীতির প্রেক্ষাপটেই দাঁড়িয়ে সামাজিক অবস্থানও ঘটোৎকচকে যে ভাবে সামাজিক- রাজনৈতিক ব্যবহার করা হয়েছিল একবার দেখে নেব।

মহাভারত লেখা হয়েছে খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে (রেফঃ সুকুমারী ভট্টাচার্য – মহাকাব্য মহাভারত) এবং যদি কখনও যুদ্ধ হয়ে থাকে পণ্ডিতদের অনুমান খ্রীস্টপূর্ব নবম শতকে। সুতরাং রচনাকালে প্রায় পাঁচশো' বছর পূর্বের কাহিনী প্রত্যক্ষ যে করেননি এ বলাই বাহুল্য। রচয়িতা "জীবনের ধর্ম" বোঝাতে গিয়েই এ মহাকাব্য রচনা করেন যা কালক্রমে "ধর্ম" হয়ে ওঠে। আমার আলোচনা কেবল কাব্যে উল্লেখিত ঘটোৎকচের সময়ে সামাজিক পটভূমি উল্লেখ করা, যেটুকু আমার মনে হয়েছে। এও আমার কল্পনা মাত্র।

ঘটোৎকচকে আমরা দেখতে পাই "আদিপর্বে, বনপর্বে, ভীষ্মপর্ব এবং দ্রোণপর্বে।" ফলে এর মধ্যে কি ঘটেছে বা ঘটতে পারে সে কাব্য-কল্পনা কিম্বা পণ্ডিত, গবেষকরা ক্রোনোলজি ধরে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করতে পারেন। যেটুকু জায়গায় এই কুরুবংশের জ্যেষ্ঠ উত্তরাধিকারকে দেখতে পেয়েছি কেবল সেই অংশটুকুই তুলে ধরব।

মোহিনী হিড়িম্বাকে দেখে ভীম আকৃষ্ট। ভীম সদ্য বয়োঃপ্রাপ্ত (১৪বছরে তাঁরা প্রথম ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভায় এসেছিলেন কুন্তীর সঙ্গে; পাণ্ডু ও মাদ্রীর মৃত্যুর পর। তার কিছুকাল পরেই বারাণবতে জতুগৃহ এবং সেইসময় বনে অবস্থানকালে এইঘটনা)। যখন এই বরবর্ণিনী, সুরকন্যাতুল্য, সুক্ষ্ম বসনে সালংকারা হয়ে এসে আপন ইচ্ছা অকপটে জানাতে পারে তখন আকৃষ্ট হয়ে পড়া বিচিত্র কিছু নয়। কারণ, হিড়িম্বের সাথে যুদ্ধের প্রারম্ভে ভীম হিড়িম্বকে বলছেন, 'তোমার ভগিনীর দোষ কি, ইনি নিজের বশে নেই, শরীরের ভিতর যে অনঙ্গদেব আছেন তাঁরই প্রেরণায় ইনি আমার প্রতি আসক্ত হয়েছেন।' অর্থাৎ, আসক্তি ভীমেরও এসেছিল কিন্তু শিক্ষা ও কর্তব্যবোধ তাঁকে সংযত রেখেছিল (এখনও এই বিষয় ঘটতে দেখা যায়)। যাই হোক, শর্ত সাপেক্ষে ভীম স্নান আহ্নিক শেষে হিড়িম্বার সঙ্গে মিলিত হবেন এবং সন্ধ্যার পূর্বেই ভাই-মায়ের কাছে ফিরে আসবেন। কূটনৈতিক ভাবে রাতের প্রহরাতে ভীম এবং দিনের আলোতে যা পারো কর। আমার বাবা ছাত্রজীবনে বলতেন, সারা দিন যা পারো করো কিন্তু সন্ধ্যের আগে ফিরে এসো। দুটোকে মেলাচ্ছি না, তবুও কথাটার মধ্যে কোথাও যেন এক নাগরিক সুর আছে। ধরে নেওয়াই যায়, ভীম ও হিড়িম্বা কাছে পিঠেই থাকতেন। কবি কিন্তু বলেছেন, আকাশ পথে নিয়ে গেলেন কিম্বা কিছুকাল পরেই এক ভীষণ বলবান পুত্র হল, পুত্র জন্মাবার পরেই যৌবন প্রাপ্ত হয়ে সর্ব প্রকার অস্ত্র প্রয়োগে দক্ষ হল – আমার মনে হয় কবির লক্ষ্য যেহেতু যুদ্ধের কাহিনীতে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া, তাই এদিকে অধিক মন দেননি। আমার মতে, হিড়িম্বা-পুত্র ঘটোৎকচকে নিয়ে পাণ্ডবদের থেকে খুব দূরে ছিলেননা। এমন সন্দেহ হবার কারণ একটি কথায় হয়েছে, আর কথাটা হল এই, 'আমাকে মনে মনে ভাবলেই উপস্থিত হব কিম্বা প্রয়োজন হলেই উপস্থিত হব' । এখানেই অতি মানবীয়তা, সুরিয়েলিসটিক ভাবনার সৃষ্টি। নচেৎ, ওই শিক্ষা দীক্ষা পাণ্ডবদের তত্ত্বাবধানেই হয়েছিল। কিন্তু সামনে কখনও আনতোনা। যেহেতু, তিনি অনার্যা নারীর পুত্র। এমন সন্দেহের আরও কারণ আছে এই যে, যুদ্ধ পর্বে উল্লেখ আছে পাণ্ডব পক্ষের তিনবীর, অর্জুন, ভীম/সাত্যকি(সাত্যকি উল্লেখ করার কারণ যুধিষ্ঠিরকে দ্রোণ যখন বন্দী করতে চাইছেন তখন অর্জুন সংসপ্তকদের সঙ্গে যুদ্ধে যাবার সময় সাত্যকিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাই সাত্যকিকে সংযোজন করেছি ভীমের সাথে) এবং ঘটোৎকচ। সাত্যকি যদি অর্জুন-শিষ্য হতে পারে তাহলে ঘটোৎকচ বা নয় কেন? এছাড়া ঘটোৎকচের মৃত্যুর পর যুধিষ্ঠির যেভাবে ব্যাকুল হয়ে কৌরবদের মধ্যে দ্রোণ ও কর্ণকে প্রধান শত্রু রূপে চিহ্নিত করে তেড়ে গিয়েছিলেন, বোঝা যায় এই জ্যেষ্ঠ্য সন্তানের প্রতি তাঁর অপত্য স্নেহ অপরিসীম অথচ কৃষ্ণের ঠিক তার বিপরীত। এই জায়গাতেই যুধিষ্ঠির, কৃষ্ণের চেয়ে নিষ্কলুষ ও মহান। অবশ্য সে আলোচনা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

এরপর দেখি, বনপর্বে যেখানে গন্ধমাদন পর্বতে প্রবল ঝড় বৃষ্টিতে দ্রৌপদীসহ সবাই খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখন ভীমের স্মরণ মাত্রেই অনুচরসহ পুত্র ঘটোৎকচ হাজির। তার আগে, ঘটোৎকচ শিক্ষান্তে উত্তরদিকে চলে গেছেন। সে জায়গায় কি দেখলাম মাতা দ্রৌপদী কিন্তু পুত্র ঘটোৎকচের কাঁধে। আর বাকিরা, অনুচরদের। কিন্তু লোমশ মুনি আপন বলে সিদ্ধমার্গে আগে আগে চললেন। ব্রাহ্মণ্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারের এক চরম নিদর্শন। অথচ মিশ্র রক্তের ঘটোৎকচ কিন্তু তার পরিবারের কাছে ব্রাত্য তো নয়ই বরঞ্চ অমিশ্ররক্তদের (অনুচরদের) নিয়ে ত্রাতার ন্যায় উপস্থিত। দেখবেন, রাস্তা ঘাটের সংস্কারে অন্ত্যজ লোকেরাই কাজ করে। ব্রিটিশ আমলে যখন এই রেললাইনের কাজ শুরু হয় তখন অরণ্য ধ্বংস এবং এই রাস্তার কাজ করানোর জন্যে বিদ্রোহ পর্যন্ত হয়েছিল। তাহলে দেখতে পাই, কায়িক পরিশ্রমের এবং কঠিন কাজ গুলোতেই এই অন্ত্যজ কিম্বা অরণ্যচারীদের কথাই তথা কথিত সভ্যদের স্মরণে আসে।।

বন পর্বের পর ঘটোৎকচের কোনও খবর নেই। তবে পাণ্ডব দের সঙ্গে যে নিবিড় না হলেও যোগাযোগ ছিল এ বোঝা যায়। কারণ ভীষ্মের সৈন্যাপত্যে চতুর্থদিনেই যখন ভীম ভগদত্তের আঘাতে মূর্ছিত হলেন তখন তিনি অন্তর্হিত হয়ে মায়া রূপ ধারণ করে কৌরব সৈন্যদের সংহার করতে শুরু করলেন। সেই সময় তাঁর অনুচর রাক্ষসগণও (অঞ্জন, যামন ও মহাপদ্ম) হাজির হলেন। এখানে দুটি বিষয় পরিস্কার। এক, যুদ্ধের শুরু থেকেই তিনি ছিলেন পিতা ভীমের কাছাকাছি। দুই, প্রথমেই অনুচরদের আনেননি। পিতা আক্রান্ত হতে তিনি তাঁর অনুচরদের হাজির করেছেন। তাহলে বোঝা যায় অত্যন্ত পিতাভক্ত এই সুসন্তান ভীষ্মের শত তাচ্ছিল্য, গঞ্জনা সত্ত্বেও তিনি পিতাসহ পাণ্ডবদের তার সাধ্য মত আগলে রেখেছেন। এবং কোথাও তাঁর মুখ দিয়ে কোনও কথা শোনা যায়নি। এর মানেই, নীরবে পিতৃকুলের সেবা তার জীবন দিয়ে করে যেতে চেয়েছেন। যেখানে ভীষ্ম বলছেন, "দুরাত্মা হিড়িম্বা-পুত্রের সঙ্গে আমি এখন যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করিনা.... ।" লক্ষ্য করুন, "দুরাত্মা" শব্দের ব্যবহার কিভাবে ভীষ্ম করছেন। তিনি জানতেন এ তাঁরই বংশধর। কিন্তু, অনার্য রাক্ষস মায়ের জন্যে সে দুরাত্মা। অদ্ভুত, ভীমের বীর্যও সেখানে অবহেলিত।

এরপর, দেখি অষ্টম দিনের যুদ্ধ। তখনও ভীষ্ম কৌরব পক্ষের সেনাপতি। ইরাবানের মৃত্যু দেখে ঘটোৎকচ ক্ষিপ্ত হয়ে দ্রোণসহ কৌরবপক্ষকে প্রায় পরাস্ত করে ফেললেন। কে এই ইরাবান! অর্জুন-উলূপীপুত্র। ইনিও অন্ত্যজ। নাগকন্যা উলূপী। নাগ, নিঃসন্দেহে অনার্য গোষ্ঠী ভুক্ত হবেনই। আমার মতে বেদে সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও হতে পারে। ইরাবান, তার ভাই এবং অনার্য মাতার পুত্র। এখানেও দুটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। ভ্রাতৃপ্রেম, স্ব-জাত্যাভিমান এবং দুজনেই মহান বংশের দ্বারা উপেক্ষিত। সুতরাং, ঘটোৎকচ বিক্রম ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে কৌরবদের সামনে উপস্থিত।

এরপর দেখতে পাই চতুর্দশ দিবসে। ঘটোৎকচ-পুত্র অঞ্জনপর্বা নিহত অশ্বত্থামার হাতে। বাবা ঘটোৎকচ আক্রমণ করছেন তাঁর পুত্রহন্তারককে। কিন্তু অশ্বত্থামা বললেন, 'বৎস, আমি তোমার পিতার তুল্য, তোমার উপর আমার অধিক ক্রোধ নেই।" অশ্বত্থামা কিন্তু ব্রাহ্মণ। কিন্তু কোথাও যেন এক ক্ষীণ অনুকম্পা। আসলে অশ্বত্থামার চরিত্র বিশ্লেষণে বোঝা যায় তিনি প্রচ্ছন্ন ভাবে পাণ্ডবদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। একদম শেষ অংশটুকু বাদ দিলে। না হলে সেই বিরাট পর্ব থেকে তিনি ন্যায়ের পক্ষেই কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে ঘটোৎকচকে পুত্রতুল্য মনে করায় অশ্বত্থামার উদারতাই প্রমাণিত হয়, যদিও তা বিক্ষিপ্ত। এখনও তো কেউ কেউ তেমনই হন।

এই চতুর্দশদিনেই কিন্তু যুদ্ধ শর্ত লঙ্ঘিত হয়ে অন্ধকার নেমে আসার পরেও যুদ্ধ চলেছিল। জয়দ্রথবধের পর কৌরবেরাই এই শর্ত উপেক্ষা করেন। কর্ণ সেদিন অপরাজেয়ের মত পাণ্ডব সৈন্যহত্যা করে চলেছে। যুধিষ্ঠির ভয়ার্ত হয়ে কৃষ্ণকে কর্ণবধের জন্যে অনুরোধ জানালে, অর্জুন কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইলেন। তখন কৃষ্ণ বললেন, "তুমি অথবা রাক্ষস ঘটোৎকচ ভিন্ন আর কেউ কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবে না।" এখানেও কৃষ্ণ "রাক্ষস" কথা ব্যবহার করলেন। কেন? পাণ্ডু পৌত্র সম্পর্কে তাঁর এই হীন মন্তব্য কেন? সেই ছোট থেকেই দেখি ইনি রাক্ষসদের প্রতি বিরূপ। তাহলে, তাঁর মনে এই রাক্ষস তথা অনার্যদের পরাস্ত কিম্বা নিশ্চিহ্ন করার স্পৃহা ছিল? যাক সেকথা। এটা স্বীকারে তিনি বাধ্য হলেন যে, ঘটোৎকচ অর্জুন-তুল্য যোদ্ধা। কিন্তু কি নিষ্ঠুর তার সঙ্গে এও জানাচ্ছেন যে অর্জুনকে মারবার জন্যেই ইন্দ্র-দত্ত শক্তি কর্ণ সব সময়েই কাছে রাখেন। আবার এও স্তোক দিচ্ছেন ঘটোৎকচের কাছে যে অস্ত্র-শস্ত্র আছে কর্ণকে পরাজিত করবেই। অর্থাৎ সুকৌশলে কর্ণের সামনে এগিয়ে দেওয়া। আর সেদিন যেন সংহারক হয়ে পাণ্ডব পক্ষের ত্রাতার ভূমিকায় নেমেছেন ঘটোৎকচ। অনন্যোপায় কর্ণ।

এরপরের ঘটনাতো জানা সবার। মরতে মরতেও কৌরবদের সেনা তিনি সংহার করে চলেছেন। শেষ নিঃশ্বাস ফেলা পর্যন্ত পিতার কুল রক্ষা করে চলেছেন চির লাঞ্ছিতা মায়ের চির লাঞ্ছিত রাক্ষস পুত্র ঘটোৎকচ। রথ থামিয়ে কৃষ্ণের নৃত্যে যে গাথা সেদিন রচিত হয়েছিল তার ধারা আজও বহমান।

হে বীর, হে নিঃস্বার্থ, হে চিরবঞ্চিত, লাঞ্ছিত, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে সংগ্রামের বীজ সেদিন পুঁতে দিয়ে গিয়েছিলে সেই সংগ্রাম আজও চলছে। অন্ত্যজের, প্রান্তিকের অধিকারের দাবীতে, অনার্য এই শব্দের ঘাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সময়ের সাথে একদিন তোমরা স্বীয় আসনে প্রতিষ্ঠা পাবেই, সেদিন অন্য এক মহাকাব্য রচিত হবে অন্য এক ব্যাসদেবের কলমে।।

হে বীর, প্রণাম তোমায়।।


(আমার এই বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ ভাবে আমার। কৃতজ্ঞতা পূর্বেই স্বীকার করেছি, রাজশেখর বসু, নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ি, সুকুমারী ভট্টাচার্য, সুখময় ভট্টাচার্য, ইরফান হাবিব এবং আমার এই হাবিজাবিকে সমর্থন, সমালোচনা ও উৎসাহ দিয়ে চলেছেন, সেই বন্ধুদের।)

1 comments:

3

ধারাবাহিকঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক 



বানরায়ণ, পর্ব ৭
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়





সৈন্যশিবিরের দ্বিতীয় দিনে বুঝতে পারলাম কেন এদের এরকম রীতিনিয়মহীন ভাবে শিকার করতে হয়। এখানকার যেটা সব চাইতে উপভোগ্য ব্যাপার, সেটা হলো খাওয়াদাওয়া। এই সব খাবার আমরা কস্মিনকালে খাইনি। কত রকমের যে মাংস, তার ইয়ত্তা নেই। হরিণ, বনবরা, বনকুঁকড়ো, ময়ূর, গোরু, মোষ, ভেড়া, ছাগল... যার যেমন পছন্দ, যার যেমন রুচি খাও। যেমন তাদের স্বাদ, তেমনি তাদের খোশবাই! কি যে মশলা দিয়ে তৈরি, কে জানে? সঙ্গে যে চালের ভাত, তেমন চাল আমরা চোখেও দেখিনি কখনও। সাদা ধবধবে, আর কি সুগন্ধ। প্রত্যেকটা ভাতের দানা আলাদা করে ফেলা যায়। সঙ্গের অন্যান্য নিরামিষ পদগুলোও অনবদ্য!

যারা কিছুদিন আগে থেকে আছে শিবিরে, তারা বলছিলো এরা যেমন খাওয়ায়, তেমনি খাটায়। সেটাও দ্বিতীয় দিনই টের পেলাম। ভোর থেকে উঠেই শুরু হয়ে গেলো ব্যায়াম। প্রথমে দৌড়, লাফ, গাছ বাওয়া। তাতে তো আমার মহা ফূর্তি। সবার আগে আগে ছুটে, লাফিয়ে, গাছের মগডালে চড়ে আবার তরতর করে নেমেও এলাম, অনেকে গাছ অবধি পৌঁছনোরও আগে। পরিদর্শকদের কাছ থেকে বাহবাও পেলাম।

কিন্তু তারপর যেটা আরম্ভ হলো, সেটা আমার পক্ষে রীতিমতন কষ্টকর। এদের ভাষায়, অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ। যে যেমন অস্ত্রে স্বচ্ছন্দ, তাই নিয়ে অনুশীলন। আমার সমস্যা হলো, আমি কোনও অস্ত্রেই খুব একটা পটু নই। একটু আধটু তীর ছুঁড়তে জানি। আমার শরীরে যতটুকু শক্তি, তাতে বর্শা খুব বেশি দূরে যায় না। আর বাদবাকি যা সব নতুন অস্ত্র এরা দিচ্ছিলো, সে সব আমার ব্যবহার করার প্রশ্নই ওঠে না, কারণ সেগুলো চালাতে প্রচুর শক্তি প্রয়োজন। তবে সেই সব অস্ত্রের মধ্যে কয়েকটা আমার মনোযোগ আকর্ষণ করলো। আমরা সাধারণত যে কাঠ বা পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করতে অভ্যস্ত, এগুলো তা দিয়ে তৈরি নয়। কয়েকটা বর্শা দেখলাম, আমাদের বর্শার থেকে অনেক বড়, আর ফলাগুলো পাথরের নয়। কি যেন এক মসৃণ, চকচকে পদার্থ দিয়ে তৈরি। দেখেই বোঝা যায় পাথরের থেকে ধার অনেক বেশি। আর কয়েকটা অস্ত্র দেখলাম, দেখতে অনেকটা আমাদের মাংস কাটার পাথরের ছুরির মতন। তবে আকারে অনেক বড়। প্রায় চার-পাঁচটা ছুরি লম্বালম্বি বসালে যত বড় হয়, তত বড়। সেই বর্শার ফলার মতন চকচকে মসৃণ বস্তু দিয়ে তৈরি। দেখেই বোঝা যায়, ফলাটা অসম্ভব ধারালো। তখনও জানতাম না, একে বলে অসি। আর যা দিয়ে ওই বর্শার ফলা আর এই অসি তৈরি, সে পদার্থ জাতে ধাতু। তার নাম ইস্পাত।

ওই সব অস্ত্র অবশ্যই আমাদের ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছিলো না। ওগুলো যাদের হাতে ছিলো, তারা প্রশিক্ষিত সৈনিক। আমাদের দেওয়া হয়েছিলো কাঠের তৈরি ছোট ছোট অসির সংস্করণ। সেই অসি নিয়ে আমি মাহারুর সঙ্গে খানিকক্ষণ ছদ্ম যুদ্ধ করার পর বুঝতে পারলাম, এ জিনিস আমার জন্য নয়। মাহারুর শরীর আমার চেয়ে বড়, গায়ে জোরও আমার চাইতে ঢের বেশি। তার অসির ঘা গুলো যখন আমার গায়ে পড়ছিলো, ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছিলাম। মাহারুই একটু পরে বললো, ‘‘তুই যা ঋচিক। এ তোর কম্মো নয়।’’

এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে ব্যথার জায়গা গুলোতে হাত বোলাতে বোলাতে দেখলাম, মাঠের এক্কেবারে মধ্যিখানে যে লাল রঙের বিশাল তাঁবুটা, সেখান থেকে বেরিয়ে আসছেন এক বিরাটকায় পুরুষ। সঙ্গে আরও কয়েকজন আছে। তারাও নেহাৎ ছোটখাট নয়। কিন্তু ইনি যে তাদের সবার থেকে আলাদা, সেটা বলে দিতে হয় না। পোশাক-আষাক ছাড়াও চেহারা আর ব্যক্তিত্বেও স্বতন্ত্র। দেখলাম, ইনি বাইরে আসতেই সবাই কেমন তটস্থ হয়ে উঠলো। যারা অনুশীলন করছিলো, তারা আরও মনোযোগ দিয়ে করতে লাগলো। যারা পরিদর্শন করছিলো, তারা আরও সতর্ক হয়ে উঠলো।

আমরা নতুন লোক। কাউকে চিনি না ভালো করে। সেটা সবাই বুঝতে পারছিলো। তাই পাশ থেকে একজন নীচু স্বরে বললো, ‘‘ইনি সেনাধ্যক্ষ গবাক্ষ। এই শিবিরের কর্তা।’’

শুনে আমরাও তটস্থ হয়ে গেলাম। সেনাপতিরই এমন চেহারা, তো রাজা না জানি কেমন হবেন। সম্ভ্রমে মনটা ভরে উঠলো। যত পারি, যা পারি শিখে নিতে হবে এই সুযোগে, এই সব মানুষদের সান্নিধ্যে। অবশ্য আমাদের মতন চুনোপুঁটিরা এঁদের সান্নিধ্য কতখানি পাবে, সেটাই প্রশ্ন।



সেনাশিবির আমার ভালোই লাগছিলো। নিয়মিত ব্যায়াম, অনুশীলন, অস্ত্রাভ্যাস, প্রচুর গল্পগুজব, নতুন নতুন জিনিস জানা, আর এন্তার চর্ব্য-চোষ্য‌-লেহ্য-পেয়।

আমরা সৈন্যদলে যোগদান করার পর যে পাঁচ দিন শিবিরে ছিলাম, সেই পাঁচ দিনে অনেক কিছু জানতে পারলাম। জানতে পারলাম, বিন্ধ্যপাহাড়ের এপাশে, যেদিকে আমরা থাকি, সেই গোটা অঞ্চলটাকে এদের ভাষায় বলে দাক্ষিণাত্য। সেই দাক্ষিণাত্য যেখানে শেষ হয়েছে, সেই কুমারিকা থেকে শুরু অথৈ জলের পারাবার, সমুদ্র। সেই সমুদ্রের মাঝখানে রাবণরাজার লঙ্কাদ্বীপ। রাবণ যে সে রাজা নয়। তার ভয়ে গোটা দাক্ষিণাত্য কম্পমান। বিন্ধ্যের উত্তরে, যে জায়গাটাকে এরা আর্যাবর্ত বলে, সেখানেও তার প্রবল প্রতিপত্তি। সে জ্ঞানী, গুণী, প্রবলপরাক্রম যোদ্ধা। কিন্তু সে অত্যাচারী, নারীলোলুপ। বহু নারীর নাকি সে সর্বনাশ করেছে। বলাৎকার করেছে তাদের উপর।

এই ব্যাপারটা খুব ভালো বুঝলাম না আমরা। কোনও মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সঙ্গমের জন্য তার উপর জবরদস্তি করা যায় নাকি? কই, অরণ্যের প্রাণীরা তো করে না এমন! আমরা তো তাদের চাইতে বুদ্ধিমান বেশি...

সে যাই হোক, একটা বেশ অদ্ভূত কথা শুনলাম। এই রাবণ নাকি কিষ্কিন্ধ্যার পূর্বতন রাজা বালীর বন্ধু ছিলো। দুজনেই মহাশক্তিধর, বলদর্পী। বালী আর তার ভাই, এখনকার রাজা সুগ্রীবের মধ্যে যে বিবাদটা কি নিয়ে হয়েছিলো, সেটা ঠিক বুঝলাম না। শুধু জানলাম, নির্বাসিত, অত্যাচারিত সুগ্রীবের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় আরেক নির্বাসিত রাজপুত্র রামচন্দ্রের, এবং রামচন্দ্র বালীকে হত্যা করে সুগ্রীবকে কিষ্কিন্ধ্যার রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করেন। তারপর সুগ্রীব সেই সাহায্যের প্রতিদান দেন নিজের লোক পাঠিয়ে সীতাকে লঙ্কায় খুঁজে বার করে, এবং এখন সসৈন্য চলেছেন বন্ধুপত্নীকে উদ্ধার করার জন্য।

আরও শুনলাম, সীতার মতন আরও অনেক নারী নাকি বন্দিনী আছেন রাবণের অবরোধে। এতদিন কারও ক্ষমতা হয়নি তাঁদের উদ্ধার করে আনার। কিন্তু এইবার রাবণ বিরাট বড় ভুল করেছে। যাঁকে হরণ করেছে, তিনি নাকি স্বয়ং জগজ্জননী, ত্রিভুবনের প্রভু রামচন্দ্রের প্রাণপ্রিয়া সীতা। এই পাপেই রাবণের বিনাশ হবে। তার সোনার লঙ্কা ছারখার হবে... ইত্যাদি, ইত্যাদি।

কেন যে এরা বারবার রামচন্দ্রকে ত্রিভুবনের প্রভু বলছে, সেটা শুধু বুঝতে পারলাম না। অযোধ্যার নির্বাসিত রাজপুত্র, যিনি নিজের স্ত্রীকে পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেননি, তিনি ত্রিভুবনের প্রভু? হবেনও বা হয়তো। আর্যাবর্তের সভ্য মানুষদের রীতিনীতি আমি কতটুকুই বা বুঝি?



শিবিরে তৃতীয় দিন একটা ঘটনা ঘটলো। বিন্ধ্যারণ্যের বহু গ্রাম, বহু নগর থেকে প্রচুর লোক এসেছে রাজকীয় বাহিনীতে যোগ দিতে। তারা কেউ কেউ সুসজ্জিত, বোনা কাপড়ের পোষাক পরা। আমাদের পরণে চামড়ার কৌপীন। বোনা কাপড় যে আমাদের গাঁয়ে কেউ পরে না, তা নয়। সর্দারের আছে একখানা। ঠাকুর্দারও আছে একটা। বচ্ছরকার দিনে পরে। কিন্তু ওই অবধিই। আর কারও নেই। তাই এই সব সাজগোজ করা সভ্য মানুষদের চোখে আমরা জংলী, অসভ্য।

তা, তাতে আমাদের আপত্তি ছিলো না। কারণ আমাদের মতনই বেশি। তাই দু’একবার ‘‘জংলী ভূত’’ জাতীয় কথা কানে ভেসে এলেও আমরা পাত্তা দিইনি। গণ্ডগোলটা হলো তৃতীয় দিন, রাতে খাওয়ার সময়। সেদিন আরও অনেক কিছুর সঙ্গে ছিলো সজারুর মাংস। সজারু মারা সহজ নয়, তাই এ মাংস দুর্লভ... এবং অতি সুস্বাদু। আমাদের জঙ্গলের মানুষদের খুব প্রিয়। তো সেই মাংস অল্পই ছিলো। আমাদের পাহান পেটুক মানুষ। প্রথম থেকেই নজর রেখেছিলো ওটার উপর। যখন নিতে গেলো, কোথা থেকে এক বোনা কাপড় পরা শহুরে বাবু এসে পট করে বাকি সবটা ঢেলে নিলো নিজের পাতে।

ব্যস! আর যায় কোথায়! পাহান পাগলা হলে কি হয়? চোখ-কান খুব খোলা। ও নিশ্চই খেয়াল করেছিলো, এই লোকটা ওই সব কথা বেশি বলে। এবার একেবারে চড়াও হয়ে গেলো লোকটার উপর। চিৎকার চেঁচমেচি, গালাগালির ফোয়ারা! মারামারি এই লাগে কি সেই লাগে! আমরা জঙ্গলের লোকরা অন্যের ঝগড়ায় খুব একটা মাথা গলাই না। জঙ্গলের সেই রকমই নিয়ম। কিন্তু যখন দেখলাম ও লোকটার সঙ্গে আরও কতগুলো কাপড় পরা লোক এসে জুটেছে, আর সবাই মিলে পাহানকে ঠ্যাঙানোর উদ্যোগ করছে, তখন আমরাও গিয়ে দাঁড়ালাম পাহানের পিছনে। অবশ্যই আমরা দলে ভারি।

ব্যাপারটা মারামারি অবধি পৌঁছলো না। তার আগেই লাঠিধারী পাথুরে মুখ পাহারাওয়ালারা এসে হাজির হলো। কিন্তু ততক্ষণে কাপড় পরা শহুরে বাবুরা এটা বুঝে গেছে, যে আমাদের ঘাঁটালে বিপদ আছে। এবং গোটা বিষয়টা যে শিবিরের কর্তৃপক্ষ খুব উদার মনে গ্রহণ করেনি, সেটা বুঝলাম পরের দিন সকালে। আমাদের সবাইকে কড়া ভাষায় সাবধান করে দেওয়া হলো। এর পর আর কোনও গোলমাল হলে তাতে জড়িতদের কঠিন শাস্তি হবে। সৈন্য শিবিরে শৃঙ্খলাই প্রথম এবং শেষ কথা, ইত্যাদি, ইত্যাদি...

সেই সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হলো, পরের দিন শিবির গুটিয়ে ফেলা হবে এখান থেকে, এবং রওনা হওয়া হবে কুমারিকার উদ্দেশ্যে। পথে কিষ্কিন্ধ্যার উপকন্ঠে দু’দিনের বিরতি নেওয়া হবে। সেখান থেকে সোজা সমুদ্রের উপকূলে।

খানিকক্ষণ আগের বকুনি ভুলে উত্তেজনায় বুক কেঁপে উঠলো! সেই প্রথম অনুভব করলাম সুদূরের হাতছানি কাকে বলে। সামনে অজানা ভবিষ্যৎ। একা হলে হয়তো একটু ভয় করতো। কিন্তু আমাদের গ্রামের চিরপরিচিত মুখগুলোর পাশাপাশি আছে আমাদের নতুন বন্ধুরাও। এই দীর্ঘ যাত্রায় যে আমরা একে অন্যের ভরসা, সহায়, সে কথা গত রাত্রে্ প্রমাণ হয়ে গেছে। আর আমাদের ভয় কি? যা বিপদ আসবে, একসঙ্গে বুক চিতিয়ে মোকাবিলা করবো!

সে রাতেও উত্তেজনায় আমাদের কারও ঘুম আসলো না।








3 comments: