0

সম্পাদকীয়

Posted in







একই অঙ্গে এত রূপ? সইবে তো? দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশে জারি করা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাম্প্রতিক একটি নির্দেশিকা ঘিরে এই সংশয়। এই প্রথম অবশ্য নয়। নানান বিষয়ে বিভ্রান্তি-সৃষ্টিকারী সরকারি বিজ্ঞপ্তি আর তুঘলকি, একনায়কতন্ত্রী সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে অনেকটাই গা - সওয়া হয়ে গিয়েছে আমাদের। কিছুতেই তেমন আর কিছু এসে যায় না।হেঁয়ালি সরিয়ে বিষয়টির অভ্যন্তরে একটু প্রবেশ করা যাক এখন।

২১ ফেব্রুয়ারি তারিখটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে সারা বিশ্বে স্বীকৃত। ভারত তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল কোনও অজ্ঞাত বিশেষ কারণে ১১ ডিসেম্বর দিনটিকে সমগুরুত্ব দিয়ে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার প্রয়াস শুরু হয়েছে। আমাদের জানা আছে ওই বিশেষ তারিখটি তামিল মহাকবি সুব্রহ্মণ্য ভারতীর জন্মদিন। ওই নির্দেশিকায় বলা হল, এখন থেকে দিনটিকে 'বাধ্যতামূলকভাবে' ভারতীয় ভাষা দিবস হিসাবে পালন করতে হবে। এবং শুধু তাতেই শেষ হচ্ছে না। প্রমাণস্বরূপ অনুষ্ঠানের ভিডিও এবং স্থিরচিত্র আপলোড করতে হবে সরকারি পোর্টালে। অকস্মাৎ এই টনক নড়ার কারণ কী হতে পারে? আর কেনই বা মাতৃভাষা দিবসের প্রতিপক্ষরূপে সুচারুভাবে এক বিশেষ ভাষাগোষ্ঠীর প্রধান এক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে শিখন্ডি করে তোলার এই নির্লজ্জ অপপ্রয়াস? রাজনীতির কুনাট্যমঞ্চের অংশগ্রহণকারীরা এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবেন।

তাঁদের সেই সঙ্গে একথাও স্মরণে রাখতে হবে যে স্বতঃস্ফূর্ত মানবিক আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও ইতিহাসকে আপন তাঁবেতে নিয়ে আসার চেষ্টা এর আগেও ইতিহাসের অনেক খলনায়ক করেছেন। তাঁদের একজনের নাম আডলফ হিটলার। যাঁর পরিণতি ভালো হয় নি।

শারদীয় শুভেচ্ছা আপনাদের সকলকে।

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in




















বর্ষার পর রসসিক্ত ধরিত্রী শস্যপ্রসবিনী হয়ে, নদীধারা পুষ্ট হয়ে যখন মানবের শারীরিক ও মানসিক স্ফূর্তি ঘটায় তখন এই উপমহাদেশে বহু প্রাচীন কাল থেকেই শক্তি আরাধনা বা মাতৃ আরাধনা প্রচলিত হয়েছিল। শরতের আরম্ভে শুরু হয় মাতৃপূজা। শেষ হয় বসন্তের অন্তে। বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন ভাবে আমরা স্মরণ করি আমাদের মাতাকে। প্রথমে আলোচনায় আসুক মাতৃ আরাধনার প্রাচীন ঐতিহ্যটি। প্রাগৈতিহাসিক যুগেও আমরা দেখেছি বেশ কিছু পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন, যেগুলিতে দেবীমূর্তি যেন আরাধ্যা প্রতিমার মতই ছিলেন সমাজে। সিন্ধু সভ্যতার কালে এই শক্তি আরাধনার প্রচলন ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। মাতা আমাদের জননী। তাঁর থেকে আমরা এই দেহ পাই। তিনি আমাদের শুধু জন্ম দেন না, সঙ্গে লালন পালন ও করেন। এই দেহ দিয়েই আমরা সব কিছু সাধন করে থাকি। সে সিদ্দি জাগতিক হোক, বা আধ্যাত্মিক। এই দেহ মায়ের থেকে পাই। তাই দেহই মা। এই বিশ্বাসের মুলে আছে মায়ের আর একটি বিশ্বব্যপী ধারণা। যেখানে মা আমার এই ক্ষুদ্র দেহ ছাপিয়ে জগদাত্মক হয়ে উঠছেন। এই ধরিত্রীই মা। এই প্রকৃতিই মা। প্রকৃতির পঞ্চভূত থেকে আহরণ করে দেহ জন্ম নেয়। জন্মানোর পর প্রকৃতিই যোগান দেয় যাবতীয় দৈহিক চাহিদার। পিতার প্রত্যক্ষ ভূমিকা এত নগণ্য থাকে, যে পিতৃপুজার কথা কেউ ভাবেননি।

পিতৃপূজা আর্যদের দান। বেদের যুগে পিতৃপুজার শুরু। যদিও অনেকে মনে করেন হরপ্পার পশুপতি মূর্তি শিবের বিগ্রহ। কিন্তু সেখানে শিবের পশুপতিনাথ হিসেবে, প্রকৃতির রক্ষক হিসেবে একটা ধারণা পাওয়া যায়। অর্থাৎ পিতা রক্ষক। জনক যে, সেকথা কিন্তু মূর্তির গঠনে কোথাও নেই। লিঙ্গপূজা বহু পরের ঘটনা। বেদে আমরা নির্গুণ ব্রহ্মের ধারণা পাই। নির্গুণ, কেননা অজ্ঞাত। যিনি জ্ঞানের আলোয় নেই তিনিই নির্গুণ। পিতাকে আমরা জানিনা তখনও। এ বেশ চমৎকার। আমার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির আওতায় তিনি নেই। সুতরাং তিনি নির্গুণ, অন্ধকার। এবার সৃষ্টির সূত্রপাত। তিনি ধীরে ধীরে জ্ঞানের আলোয় আসছেন। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হচ্ছেন। সগুণ ব্রহ্ম। যতটা জ্ঞানের আলোয় আসছেন তিনি, ততটাই সগুণ। আলোকিত। এই সগুণ ব্রহ্মই সাংখ্যের মতে প্রকৃতি। নারীরূপা। মাতা। যদিও মাতৃপূজা বেদের চেয়েও প্রাচীন, তবু পরবর্তী কালে ব্রাহ্মণ্য আগ্রাসনের সময়, বৌদ্ধ ধর্মের উৎপত্তির আগে, শক্তিপূজার ধারণাটি বৈদিক শাস্ত্রে আত্তীকৃত করা হয়। বিশদ আলোচনায় যাবনা। শুধু দেখে নিই কিভাবে বৈদিক সমাজকর্তারা মাতৃশক্তির ধারণাটিকে শাস্ত্রে আনলেন। বিশেষত দুর্গা। যে দেবী সরস্বতী বা বাক ঋকবেদে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন, তাঁর মধ্যেই পরবর্তী কালের রণদেবী দুর্গারও আভাস পাওয়া যায়। ঋকবেদের একাধিক মন্ত্রে দেবী সরস্বতীর সাহায্য প্রার্থনা করা হয়। একটি মন্ত্রে আছে ঘোররূপা দেবী হিরন্ময় রথে আরোহণ করে শত্রু নিধন করেন। উত স্যা নঃ সরস্বতী ঘোরা হিরণ্যবর্তনিঃ। বৃত্রঘ্নী বষ্টি সুষ্টুতিম্। (ঋকবেদ ৬/৬১/৭)

শক্তিদেবী হিসেবে এখানে অদিতিকে আরাধ্যা মহাদেবীর আদিরূপ মনে করা হয়। বাক ও আদিতি অভিন্ন। দুর্গা এই মহাদেবীরই রূপভেদ। বাক বা সরস্বতীর দুর্গাতে পরিবর্তিত হওয়ার একটি কাহিনী শতপথ ব্রাহ্মণে আছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে বাক দেবী ক্রুদ্ধ হয়ে সিংহীরূপ ধারণ করছেন। অতিপ্রাচীন কালে দেবতার পশুরূপ কল্পনা করা হত। পরবর্তী কালে সেই সেই পশু সেই সেই দেবতার বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিক দিয়ে আমরা সমাজতাত্ত্বিক বিবর্তনের একটা প্রমাণ পাই। মানবের পাশবিক প্রাণচেতনা ধীরে ধীরে সভ্যতার সংস্পর্শে মানবিক হল। পাশবিক চেতনা শুধুই তখন বাহ্যিক জীবনযুদ্ধে বাহন মাত্র। সনাতন হিন্দু ধর্মে পরবর্তীতে সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা, আর সরস্বতী হংসবাহিনী। যদিও বৌদ্ধ শাস্ত্রে সরস্বতী সিংহবাহনাই বটে। অনেক পড়ে, মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে আবার লক্ষ্মীই হলেন মহিষমর্দিনী। শাক্তদের আরাধ্যা মহাদেবী হলেন মহালক্ষ্মী। তিনি সগুনা নির্গুণা জগতপ্রপঞ্চ ব্যপ্ত করে অবস্থান করছেন। দেখা যায় সেসময়ে শাস্ত্রকারেরা দেবীর নির্দিষ্ট রূপ ও ধারণা খুঁজে পাননি। অম্বিকা কখনও রুদ্রে ভগ্নী (শুক্ল যজুর্বেদ ও তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ), কখনও রুদ্রের পত্নী (তৈত্তিরীয় আরণ্যক)। শেষ পর্যন্ত তৈত্তিরীয় আরণ্যকের একটি মন্ত্রে দেবী দুর্গার নামল্লেখ করা হয়েছে। মন্ত্রটির ভাবার্থ হল – যিনি অগ্নিবরনা, যিনি তপস্যার দ্বারা জ্যোতির্ময়ী, যিনি বৈরোচনী, করমফলের নিমিত্ত যিনি উপাসিতা, সেই দেবী দুর্গার শরণ নিলাম। বিরোচন হলেন সূর্য। অতএব দুর্গা অগ্নিকন্যা বা সূর্যকন্যা। এই বেশ একটি সমন্বয় সাধন হল। অবৈদিক শক্তিপুজার সঙ্গে বৈদিক পূজা মিলিয়ে নেওয়া হল। ব্রাহ্মণ গণ প্রীত হইলেন অতএব।

এবার দুর্গার রূপ এবং বর্তমান ধারণার বিশ্লেষণ করা যাক। দুর্গা দুর্গতিনাশিনী। কেমন দুর্গতি? না, আধিভৌতিক, আধিদৈবিক, এবং আধ্যাত্মিক। সেই দুর্গতি নাশে তাঁকে বিপুল শক্তির অধিকারিণী হতে হয়। তাই তাঁর দশটি হাত। স্বাভাবিক মানবের চেয়ে অন্ততপক্ষে পাঁচগুণ বেশি শক্তি ধরেন। এই দশটি হাতে তাঁর দশটি আয়ুধ। এবার ভিতরে প্রবেশ করা যাক। দশটি হাত দশেন্দ্রিয়। পাঁচ কর্মেন্দ্রিয় পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়। এই ইন্দ্রিয় অন্তর্মুখ হলে আলোকবরনী দেবী আলোক দেন। শক্তি দেন অজ্ঞান নাশের। সেই দশ আয়ুধ। প্রতিটি আয়ুধের নিজস্ব কর্ম পদ্ধতি আছে। তিনি নাশ করেন অসুর কে। মহিষাসুর। মহিষ এখানে রিপুর সমার্থক। রিপু মধ্যে আবার কাম প্রবল। এই রিপুর নাশই লক্ষ। চলিত কথায়ও আমরা শত্রুকে রিপু বলে থাকি। এখন নাশ যখন, তখন তা হতে রক্তপাত স্বাভাবিক। কিন্তু এসবই যখন মানসিক বা আত্মিক দুঃখ হরনের আয়োজন মাত্র, তখন তা থেকে যে রক্তপাত তারও ভাবার্থ মায়াসঞ্জাত শোকধারা। অন্তিমে মা অবশ্য আমাদের মোক্ষ দেন। সঙ্গে আনন্দময়ী আনন্দও দেন। সে আনন্দের ভেদ আছে। অধিকারী ভেদ নয়। চাওয়ার ভিন্নতা।

দুর্গা রূপের এই বিশ্লেষণ একান্তই অনুভুতিলব্ধ। অনেকেই এখন দুর্গাপূজা সম্বন্ধে নানা বিরূপ মন্তব্য করেন। মুক্তচিন্তার ফসল। তবে নিজের জননী এবং জগজ্জননীকে যদি কেউ শ্রদ্ধার চোখে দেখেন তাঁর পক্ষে এই উক্তি সম্ভব হয়না।

দুর্গাপূজা একান্ত ভাবেই বৃহৎ বঙ্গের একটি ঐতিহ্য। কামরূপ থেকে পশ্চিমে পূর্ব বিহার পর্যন্ত। উত্তরে তরাই থেকে দক্ষিণে সাগর সঙ্গম পর্যন্ত। কেউ কি সাংখ্যর এলাকার সঙ্গে সাদৃশ্য পাচ্ছেন? সাংখ্যের প্রকৃতিই যে দুর্গা! আর সাংখ্য যে বৃহৎ বঙ্গেরই এক মুনি। কপিল মুনি।

এই শারদ লগ্নে আরও একবার তাই জননীকে, আদি জননীকে স্মরণ করি। তিনি আমাদের অজ্ঞান নাশ করুন।

[শব্দের মিছিল, শারদীয়া ২০১৭]

0 comments:

3

প্রবন্ধ - অরিন্দম ব্যানার্জী

Posted in








দিব্যি সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় চায়ের কাপ আর কাগজটা নিয়ে বসেছি, আচমকা কোত্থেকে একটা ঝোড়ো হাওয়া এসে কাগজটাগজ উড়িয়ে দিয়ে, কাপ থেকে চা চলকে ফেলে আমাকে একেবারে ব্যতিব্যস্ত করে দিল। কোনক্রমে নিজেকে সামলে সম্মুখপানে ঠাওর করে দেখি, বাগানে একটা ইয়াব্বড় উড়ন্ত চাকতি নেবেছে! আর তার ভেতর থেকে বড় বড় জানলার মত চোখওয়ালা, ঢ্যাঙা লম্বা, বিকটদর্শন এক জোড়া জানোয়ার বেরিয়ে আমার দিকেই থপ্ থপ্ করে এগিয়ে আসছে। আমি তো দেখেই থরহরিকম্প! জন্তু দুটো ক্রমশঃ আমার কাছ অবধি এসে কি একটা ইশারা করে বলল, "হিজিবিজিবিজিহিজি!" অমনি আমি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ভিরমি খেয়ে ধড়াম করে পড়ে গেলাম।

জ্ঞান ফিরতে দেখলাম, কোথাও কিচ্ছু নেই। চেয়ার, কাগজ, চায়ের কাপ সব যে যার মতই আছে, আমিই শুধু বোকার মত মেঝেতে শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছি। মনে কেমন একটা সন্দেহ হল। ধড়ফড় করে উঠে এক ছুটে বসার ঘরের আলমারি থেকে স্টিফেন হকিংয়ের একটা বই ধুলো ঝেড়ে তুলে নিলাম। অনেক বছর আগে রাজীব বলে আমার এক শ্যালক বইটা আমায় উপহার দিয়েছিল। ব্যাটা বড্ড জ্ঞান বিজ্ঞান আওড়াত; ভেবেছিল এইসব বই পড়িয়ে আমাকেও দলে টানবে। আমিও কম নই। বইটাকে সেই যে শো-পিস্ বানিয়ে তাকে তুলে রেখেছি, এই এতো বছরে ধুলোটা পর্যন্ত ঝাড়ি নি। আজকে ওই ঘটনার পর কেন জানিনা এই বইটার কথাই সবার আগে মনে হল। দেখি তো হকিং সাহেব এই বিষয়ে কোন আলোকপাত করতে পারেন কিনা! ইটি বলে সত্যি কিছু হয় কি? বইটার নাম: Brief Answers to the Big Questions। দেখলাম বইটাতে দশখানা পরিচ্ছেদ আছে। ঈশ্বর আছেন কিনা, কি করে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছিল, ব্ল্যাক হোলের ভিতরে কি আছে, সময়ভ্রমণ সম্ভব কিনা, এই সব বিষয় নিয়ে এক একটা অধ্যায়। ধুত্তোর এতো কে পড়ে? লাফ দিয়ে চলে গেলাম তৃতীয় পরিচ্ছেদে যেখানে হকিং আলোচনা করেছেন অন্য গ্রহে বুদ্ধিমান জীব থাকার সম্ভাবনা নিয়ে। তাতে যা পড়লাম তা মোটের উপর এইরকম:

প্রাণ বলতে আমরা যা বুঝি তা নির্ভর করে কার্বন পরমাণুর ওপর। অথচ এই কার্বন পরমাণু সৃষ্টি হওয়ার প্রক্রিয়াটি মোটেই সোজা ছিল না। ১৩৮০ কোটি বছর আগে যখন বিগ-ব্যাঙের মধ্যে দিয়ে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয় তখন অকল্পনীয় উষ্ণতার কারণে মহাবিশ্বে কোন মৌল উপাদান সৃষ্টি হয়নি। তখন ছিল শুধু প্রোটন এবং নিউট্রনের একটা স্যুপ। এরপরে ব্রহ্মাণ্ড একটু ঠাণ্ডা হলে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম সৃষ্টি হল। এই দুটি উপাদান থেকেই প্রথম নক্ষত্রের সৃষ্টি হল। এবং এই দুটি উপাদানকে জ্বালানি হিসেবে পুড়িয়েই প্রথম কার্বন, অক্সিজেন এবং লৌহ পরমাণুর সৃষ্টি হল ওই নক্ষত্রগুলিতে। হিসেবের সামান্য এদিক-ওদিক হলেই কার্বন পরমাণু সৃষ্টি হত না, আর তাই প্রাণও সৃষ্টি হতে পারত না। যাই হোক, প্রথম প্রজন্মের নক্ষত্রগুলি কিছু সময় পরে সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে সেই মৌলগুলিকে ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দিল এবং সেই উপদানগুলি থেকেই ক্রমশঃ নতুন নক্ষত্রের সৃষ্টি হতে থাকলো। আমাদের সূর্যের এবং সৌরমণ্ডলের গ্রহগুলির সৃষ্টি হল বেশ কিছুটা পরে, বিগ-ব্যাঙের প্রায় সাড়ে ন'শো কোটি বছর পরে। কিন্তু গ্রহের সৃষ্টি হলেই ত হল না, প্রাণ সৃষ্টির জন্য আদর্শ পরিবেশও তো দরকার। পৃথিবী যখন সৃষ্টি হয়েছিল তখন পরিবেশ এত বেশি উত্তপ্ত ছিল যে জীবন্ত কোষিকা তৈরি হওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। ধীরে ধীরে পৃথিবী শীতল হলে কার্বন এবং অক্সিজেনের পরমাণু কোন এক অজানা প্রক্রিয়ায় এমন এক ধরনের যৌগের সৃষ্টি করলো যারা নিজেদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সক্ষম ছিল। এদের বলা হয় RNA । এই সরলাকৃতির RNA থেকে আবার কাকতালীয়ভাবে উৎপন্ন হল জটিলতর গঠনের DNA, জীবনের মূল উপাদান। DNA অণুগুলো ভাঙাগড়া, পুনর্বিন্যাস এবং সংমিশ্রণের মাধ্যমে নানা রকমের এককোষী প্রাণীর সৃজন করলো। অনেক পরে এই এককোষী প্রাণী থেকেই বহুকোষী প্রাণীর সৃষ্টি হয়। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়াটিই ঘটেছে একের পর এক চান্স বা সমাপতনের মধ্যে দিয়ে। বিজ্ঞানীদের একাংশ মনে করেন এই রকম কাকতালীয়ভাবে পর পর ঠিক ঠিক পরিস্থতি উৎপন্ন হওয়ার সম্ভাব্যতা খুবই কম তাই পৃথিবীতে আদিম প্রাণ নিশ্চয়ই অন্য কোন গ্রহ কিংবা গ্রহাণু থেকে এসেছিল। হকিং অবশ্য তাঁদের যুক্তিকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন যে, মহাবিশ্বের ভয়ংকর বিকিরণের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘকাল টিকে থেকে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে যাওয়া DNA র পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়, তাই প্রাণ নিশ্চয়ই পৃথিবীতেই সৃষ্টি। কোনভাবে অনুকূল পরিস্থিতি তৈরী হয়ে গিয়ে পৃথিবীতেই জীবনের সৃজন হয়ে থাকবে। কিন্তু সেই একই রকমের পর পর সমাপতন অন্য গ্রহে ঘটা খুবই অস্বাভাবিক।

এই বিষয়ে, হকিং দু'টি আশ্চর্য যুক্তি উত্থাপন করেছেন: উনি মনে করেন, যদি নিম্নস্তরের এককোষী বা বহুকোষী জীবন সৃষ্টির কথা ছেড়েও দেওয়া হয়, পৃথিবীতে বুদ্ধিমান প্রাণীর উদ্ভব কিন্তু আরো বেশি আশ্চর্য একটা ব্যাপার। সূর্যের মতো কোন নক্ষত্রের সৃষ্টি আর ধ্বংসের মধ্যে সময়টা মোটামুটি ১০০০ কোটি বছর ধরা হয়। এই সময়কাল পৃথিবীর মত কোন গ্রহে উন্নত বুদ্ধির জীব সৃষ্টি হওয়া এবং সেই সৌরমণ্ডল ধ্বংসের আগে সেই বুদ্ধিমান জীবের অন্য কোন বাসযোগ্য নক্ষত্রলোকে বসতি স্থাপন করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু পৃথিবীতে এককোষী প্রাণী সৃষ্টি হয় সাড়ে তিনশো কোটি বছর আগে, অর্থাৎ সৌরমণ্ডল সৃষ্টি হওয়ার মাত্র পঞ্চাশ কোটি বছর পর। যদি পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টি আপনা আপনি হঠাৎ করে না হয়ে থাকে তাহলে উপলব্ধ সময়ের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ সময়ের মধ্যেই এককোষী প্রাণ উদ্ভূত কেন হলো? এদিকে কিন্তু এক কোষ থেকে বহুকোষী জীব সৃষ্টি হতে সময় লেগে গেল আরো প্রায় ২৫০ কোটি বছর। যেই একবার বহুকোষী প্রাণ সৃষ্টি হয়ে গেলো অমনি আবার আকস্মিকভাবে জীব সৃষ্টির পক্রিয়াটি ভয়ঙ্কর রকম ত্বরান্বিত হয়ে গেলো। কিছু লক্ষ বছরেই অগুন্তি রকমের প্রাণীতে পৃথিবী ছেয়ে গেলো। মানুষের মত বুদ্ধিমান প্রাণী সৃষ্টি হতে লাগলো আরো মাত্র ১০ কোটি বছর — মহাজাগতিক সময়ের হিসেবে যা এক পলকের সমান। প্রশ্ন হল — যদিবা এককোষী জীব কোনক্রমে সৃষ্টি হল, বহুকোষী জীব আসতে এতখানি সময় কেন লাগলো? তাও যদি এলো তাহলে মানুষের মত এত জটিল জীব মোটে ১০ কোটি বছরের মধ্যে কি করে এসে গেলো? এসব সঙ্গতিহীন ব্যাপারস্যাপার দেখে হকিং সাহেব বিধান দিলেন: পৃথিবীতে প্রাণসৃষ্টি পূর্বনির্ধারিত কোন ঘটনা নয় বরং আচমকা ঘটে যাওয়া একটা কাকতালীয় ব্যাপার। যেহেতু বুদ্ধিমান জীবের উদ্ভব আরো কঠিন তাই অন্য কোন গ্রহে ব্যাকটেরিয়া জাতীয় প্রাণী থাকলেও উন্নত সভ্যতার জীব থাকার আশা ক্ষীণ। এখানেই শেষ নয়, হকিংয়ের দ্বিতীয় যুক্তিটিকে বলা চলে দাবার মোক্ষম চাল। ওঁর মতে, যে কোন গ্রহকেই যে উৎপাত থেকে থেকে সহ্য করতে হয় তা হল asteroid বা গ্রহাণুদের হানা। পৃথিবীও এর ব্যতিক্রম নয়। সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে এরকমই এক গ্রহাণুর সংঘাতে বিলুপ্ত হয়ে গেছিল ডায়নোসর সহ অসংখ্য প্রাণী। বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে দেখেছেন এইরকম একটা মহাবিধ্বংসী গ্রহাণু হানা অন্যান্য গ্রহের ক্ষেত্রে গড়ে দুই কোটি বছরে একবার ঘটে। তার মানে, পৃথিবীর ক্ষেত্রে আমরা উদ্বৃত্ত সময়ে বেঁচে আছি, যেটা একটা লাকি চান্স মাত্র। কিন্তু অন্য গ্রহের ক্ষেত্রেও যে এই চান্স কাজ করবে এমন কোন কথা নেই। অন্য কোন গ্রহ উচ্চ মেধার ইটি তৈরি করার মত সময় নাও পেয়ে থাকতে পারে। এই অবধি বলে থেমে গেলে বেশ নিশ্চিন্ত হতে পারতাম। কিন্তু শেষে হকিং সাহেব কেন যে দুধে একটু চোনা রেখে দিলেন বুঝলাম না। এতো কিছু বলেও পরিচ্ছেদের ঠিক শেষে উনি বলে বসলেন, "আমার আশা করি যে অন্য গ্রহে মানুষের মতোই উচ্চ সভ্যতার প্রাণী আছে। শুধু তারা এখনও পর্যন্ত আমাদের খুঁজে পায়নি এই যা।" আচ্ছা, এইভাবে ভয় দেখানোর কোন মানে হয়? মনের অস্বস্তিটা যেতে যেতেও গেলো না। সকালে যা দেখলাম, সেটা হ্যালুসিনেশনই ছিল তো? নাকি সত্যি তেনারা এসেছিলেন? গুটি গুটি পায়ে আবার বারান্দায় ফিরে গিয়ে ইজিচেয়ারে গা ছেড়ে দিলাম। বেশ ফুরফুরে একটা হাওয়া দিচ্ছে। চোখ বুজে শুয়ে শুয়ে মনের মধ্যে নানা কথা চলতে লাগলো। হকিং শেষে ওরকম কেন বললেন? উনি কি কোন ইঙ্গিত দিলেন? ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো, রাজীব একবার বলেছিল ফার্মি প্যারাডক্সের কথা। বিখ্যাত পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মির নাকি বলেছিলেন, মহাবিশ্বে কোটি কোটি নক্ষত্র আছে, তাদের আবার কত কত পৃথিবীর মত গ্রহ আছে। যদি সেইসব গ্রহের মধ্যে সামান্য সংখ্যক গ্রহেও উন্নত সভ্যতার জীব থাকত তাহলে এতদিনে তারা আমাদের নিশ্চয় খুঁজে নিত। কথাটা হকিং সাহেবের ভয় ধরানো বাক্যগুলোর ঠিক উল্টো। যাক, অকারণেই ভয় পাচ্ছিলাম তাহলে। ইটি ফিটি বলে নিশ্চয়ই কিছু হয় না। মনে মনে বলছি বটে কিন্তু তেমন জোর পাচ্ছিনা, মনটা সেই খুঁতখুঁত করেই চলেছে। এতো বড় বড় সব বিজ্ঞানী, এঁরা কি আর ভুল বলবেন? কি জানি, হতেও তো পারে যে আমরা যেমন আমাদের সৌরজগতের সব গ্রহে এখনও পৌঁছতে পারিনি, ইটিরাও তেমনি তাদের সৌরমণ্ডল কিংবা নীহারিকাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি! আবার এমনও হতে পারে যে এতো বড় ব্রহ্মাণ্ডের কোন দিক থেকে তারা শুরু করবে তাই নিয়ে খেউখেই করে কোনো দিকেই আর তারা এগোতে পারেনি। আরে বাবা, ইটি হলেও, মানুষ তো!

"বাবু, আরেক কাপ চা দেব?" হঠাৎ বিশ্রী খ্যানেখ্যানে গলায় হাবুলের ডাকে আঁতকে উঠলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে মিটিমিটি হাসছে। দেখে গা-পিত্তি একেবারে জ্বলে গেল, "চা দিবি তো দে না! খামোখা ওরম চেঁচানোর কি আছে!" সে বেচারা থতমত খেয়ে চা বানাতে ছুটলো। আসলে, সকালের ওই ঘটনার পর মাথাটা বেশ গরম হয়ে আছে। দ্বিতীয় রাউন্ড চা খেয়ে পায়ে জুতোটা গলিয়ে একটু হাঁটতে বেরোলাম। একটু হাওয়া খাওয়া যাক। শরতের সকালে পাড়াগাঁয়ের মেঠো পথ দিয়ে, পুকুরের পাশ ঘেঁষে, আকন্দের ঝোপে ফুলের হাসি দেখতে দেখতে মনটা ভাল হয়ে গেল। হেরোম্ব ডাক্তারের পরিত্যক্ত বাড়িটা পার করে ভটচাজ্জি পাড়ার দিকে পা বাড়াতেই দেখি আকাশে এক ঝাঁক নীলকন্ঠ পাখি, শরতের নরম আলোয় তাদের ডানাগুলো ঝিকমিক করছে। ছেলেবেলায় বাবা বলতেন, "বর্ষার পর নীল আকাশে তুলোমেঘ আর নীলকন্ঠ পাখি একসাথে দেখা গেলেই বুঝবি দুগ্গা পুজোর আর দেরি নেই।" চেয়ে থাকতে থাকতে ভাবলাম, প্রকৃতির সব কিছুই কেমন ঘড়ি ধরে নিয়ম করা। সবই যেন খোপে খোপে বসানো । নিয়মের সামান্য হেরফের হলেই পৃথিবীটা আর এইরকম হতে পারতো না। এই কথাটা যেই ভেবেছি, মনের মধ্যে যেন একটা আলোর ঝিলিক দিয়ে গেলো। তাই তো! এই সহজ কথাটা এতক্ষণ মাথায় কেন আসেনি! এই চেনা পৃথিবীতে এবং পুরো ব্রহ্মাণ্ডেই একটা প্যাটার্ন আছে। এই প্যাটার্নগুলোকেই আমরা বিজ্ঞানের সূত্র বলি। মানুষ ছাড়া প্রকৃতির সেই ভাষা কেউ পড়তে পারে না। মানুষ হিসেব কষে, ফর্মুলা বাঁধে, পরে মিলিয়ে দেখে অবাক হয় — সত্যিই তো বিশ্ব সেই ফর্মুলায় চলছে! ঠিক যেমন মাধ্যাকর্ষণের সূত্র। মানুষ প্রকৃতির মনের কথা পড়তে শিখেছে তার বুদ্ধির জোরে, তার মস্তিষ্কের কারণে। তার মস্তিষ্ক সে পেয়েছে বহুযুগের বিবর্তনের ফলে, বিশেষ বিশেষ প্রাকৃতিক এবং সামাজিক অবস্থার প্রভাবে ধীরে ধীরে তার একটা বোধ তৈরি হয়েছে। আজকের বিজ্ঞান অবধি পৌঁছতে মানুষকে অনেকখানি পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ইতিহাসের বিশেষ কিছু ঘটনা না ঘটলে বিজ্ঞান আজকের এই অবস্থায় পৌঁছত না। মেসোপটেমিয়ার লোকেরা ষষ্ঠীক সংখ্যাপদ্ধতি আবিষ্কার না করলে আমরা ঘড়ি পেতাম না। ঠিক সময়ে নিউটনের মাথায় আপেলগাছ থেকে আপেলটা না পড়লে আমরা মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্ব পেতাম না। এরকম আরো অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়। বিজ্ঞানের সূত্রগুলো মহাবিশ্বের সব জায়গাতেই একই। অন্য কোন গ্রহে যদি বুদ্ধিমান প্রাণী থাকতে হয় এবং তাদের যদি চিন্তাশক্তির সাহায্যে প্রকৃতির সেই প্যাটার্নকে বুঝতে হয় তাহলে তাদেরও আমাদেরই মত একটা মস্তিষ্ক থাকতে হবে যা তাদের মাধ্যাকর্ষণ বা রিলেভিটির মত তত্ত্বগুলো আবিষ্কার করতে সাহায্য করবে। সেই মস্তিষ্ককে আমাদের মত করেই অঙ্ক বুঝতে হবে। তাদেরও একটা ভাষাপদ্ধতি থাকতে হবে যা মাধ্যাকর্ষণের মত থিওরিগুলোকে ব্যাখ্যা করবে। আমরা জানি পৃথিবীতে মানুষেরই একমাত্র উন্নত ভাষা আছে এবং সেই কারণে মানুষের মস্তিষ্কের গঠন অন্যান্য বানরপ্রজাতির জন্তুর তুলনায় একটু হলেও আলাদা। বিবর্তনের আশ্চর্য ম্যাজিকে মানুষ লক্ষ লক্ষ বছর আগে ভাষার শক্তি আয়ত্ত করেছিল। ভাষা বলতে এবং বুঝতে যদি হয় তাহলে ভিনগ্রহী ইটিদেরও মস্তিষ্কের গঠনশৈলী আমাদের মতই হতে হবে — একই রকমের স্নায়ুতন্ত্র, বিশ্বকে অনুভব করার মতো ইন্দ্রিয় ইত্যাদি। আমাদের মস্তিষ্ক যে পরিবেশ এবং বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গিয়ে এই অবস্থায় পৌঁছেছে ঠিক একই রকমের পরিবেশ এবং বিবর্তন ওই গ্রহেও হতে হবে। শুধু তাই নয়, যদি এই তত্ত্বগুলো আবিষ্কার করতে হয় তাহলে ভিনগ্রহীদের একটা পূর্বপ্রস্তুতি লাগবে অর্থাৎ তাদের বিজ্ঞানচেতনা থাকতে হবে। বিজ্ঞানচেতনার জন্য একটা সমাজব্যবস্থা থাকতে হবে যার ইতিহাস আমাদের পৃথিবীর ইতিহাসের সাথে তুলনীয় হতে হবে। ঠিক ঠিক লোককে ঠিক ঠিক সময়ে জন্ম নিতে হবে। যে অবস্থার কারণে পৃথিবীর মেধাবী মনীষীদের মধ্যে জিজ্ঞাসা জন্মেছিল এবং যেসব অবস্থার কারণে তাঁরা সেই জিজ্ঞাসার সমাধান করতে পেরেছিলেন, জীবন এবং মহাবিশ্ব সম্পর্কে সেই ভিনগ্রহীদেরও একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি এবং বোধ থাকতে হবে। মোট কথা পৃথিবীর পরিবেশ এবং ইতিহাসের প্রায় পুনরাবৃত্তি না হলে ভিনগ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণী থাকা অসম্ভব। একটা দু'টো ক্ষেত্রে কাকতালীয়ভাবে পুনরাবৃত্তি সম্ভব হলেও, সব ব্যাপারটা খাপে খাপে মিলে যাওয়াটা অলৌকিক বলেই মনে হয়। ইটি তাই একটি কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

আসলে সহজ সত্যিটা আমরা সহজেই ভুলে যাই। ভুলে যাই যে আমাদের পৃথিবীটা অনন্য, অদ্বিতীয়। বিরাট অতলান্ত মহাশূন্যে ভেসে থাকা কোটি কোটি নীহারিকায় কোটি কোটি গ্রহ তারার মধ্যে এই ছোট্ট নীল বিন্দুতেই প্রকৃতির আশ্চর্য ম্যাজিক ঘটেছিল — প্রাণস্পন্দহীন মাটি-পাথরের একাংশ কালের পৌরহিত্যে হঠাৎ একদিন জেগে উঠেছিল! তাদেরই উত্তরসূরীরা একদিন প্রশ্ন করেছিল নিজের উৎস নিয়ে। তারাই আবার আজকে তাদের আদিম বাসভূমিকে অতিক্রম করে মহাবিশ্বের অপার দূরত্বকে জয় করার স্বপ্ন দেখছে! এই সুন্দর গ্রহের ভবিষৎ একমাত্র তাদেরই অনাগত প্রজন্মের হাতে।

3 comments:

3

বইঘর - যশোধরা রায়চৌধুরী

Posted in







এই ভূগোল বস্তুত অনেক বেশি বিস্তৃত

যশোধরা রায়চৌধুরী






একটি নদী অনেক মানুষ - সতেরো গল্প
মৃদুল কান্তি দে
ঋতবাক প্রকাশনা
মূল্য ৪০০


২০০৯ -১১ , তিনটি বছর আমি গৌহাটিতে বসবাস করতাম। সরকারি চাকরির সূত্রে। সেখানে গিয়ে জানলাম গুয়াহাটি বলতে হয়। জানলাম সেখানে দুটি গ্রীষ্মকাল। বর্ষার অব্যবহিত পরে আগস্ট সেপ্টেম্বর তীক্ষ্ণ ও ঘর্মাক্ত এক গ্রীষ্ম পড়ে। জানলাম ভিজে ভিজে শীত সেখানে, জানলাম বাত দাঁত এই দুই সমস্যায় সে অঞ্চলে সবাই জর্জরিত। গুয়াহাটি আর ব্রহ্মপুত্র একাঙ্গী। অঙ্গাঙ্গী জড়িত । আমার আশৈশবের শোনা "ও গঙ্গা তুমি বইছ কেন" গানটির মূলে পল রোবসনের "ওল ম্যান রিভার" আছে তা যেমন জানতাম, অহমিয়া গান "বড়া লুইত তুমি বড়া লুইত বোবা কিয়োঁ"র কথাও জানতাম। ব্রহ্মপুত্রকে নিয়ে রচিত, ভূপেন হাজরিকার কন্ঠে সে গানটি বহুবার শোনার পর, একদিন সত্যিই অসমে গিয়ে দাঁড়ালাম ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে। সত্যি সত্যিই ব্রহ্মপুত্রের সুবিশাল সুগভীর ঘোলা জলের কূল তল হীন গাম্ভীর্যের সামনে মনে হয়েছিল গানটির এই বড়া লুইত ভার্শনটিই যেন বেশি সুপ্রযুক্ত। দু কূল প্লাবী, বন্যাদায়ী, ব্রহ্মপুত্র শুধু নদ নয়, ভৈরব মূর্তি আছে তার।

এই সময়েই আমার আলাপ হয় শ্রী মৃদুল দে-র সঙ্গে। তিনি রেল অডিটের কর্মী ছিলেন। মৃদুলের গল্প পড়ার অভিজ্ঞতা সে সময় থেকেই, এবং রীতিমতো চমক দেওয়া নানা লেখা তাঁর।

এইবার হাতে এল তাঁর এক পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। "একটি নদী অনেক মানুষ", সতেরো গল্প। এই বইয়ের প্রচ্ছদে ব্রহ্মপুত্রের শতজল ঝর্ণার ধ্বনি শোনা যায়। এবং লেখা থাকে, "ব্রহ্মপুত্র জেগে থাকে আঁতুড় ঘরে মা। নানা জাতি নানা ভাষার তুমি বন্দনা"।

শুরুতেই মালুম, এই বই একটি ব্রহ্মপুত্র নদকে ঘিরে ঘিরে বুনে তোলা গল্পের ভান্ডার। এ গ্রন্থের কনটেন্ট ঠিক কী তা বলতে গেলে দুভাবে বলা যায়। এক, গল্পসংগ্রহ । দুই, ফিক্স আপ নভেল। আসলে বিদেশের রে ব্রাডবেরি আদি বহু লেখক, লিখেছেন ফিক্স আপ নভেল। উপন্যাসোপম গল্পসংগ্রহ। যেখানে একেকটি গল্প নিটোল হয়েও, একে অপরের গায়ে হেলান দিয়ে আছে।

লেখক সূচনা কথায় লিখেছেন ঃ

"গল্প লেখার পটভূমি স্বভাবত সজীবতার আত্মপ্রকাশে নিজের নৈপুণ্যে বিচিত্রগামী। এই অনুভূতি মনের ভাবনায় উত্তর- পূর্বের অনন্য সাধারণ মানুষের ভালোবাসার স্পর্শে সচল অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে, যা চোখে দেখা সীমানার মধ্যে কেবল আটকে থাকে না, হৃদয়বৃত্ত ছুঁয়ে রাখে শাশ্বত সুর-ধ্বনির মতো। এটাই আত্মসন্ধানের পরম্পরা। উপলব্ধির এই প্রবাহে বহুমান ব্ৰহ্মপুত্র নদ আমাকে নব নব ঐশ্বর্য দিয়েছে সৃষ্টির উপাদান পেতে। সেখানে কোনো প্রাচীর নেই, দেখতে শেখায় প্রকৃতির গাছপালার ডাল একইরকমভাবে আলোছায়ার একই দিকে শুধু ছড়ায় না। নানা দিকেই তার শাখা প্রশাখা।

এই সংকলনে সতেরোটি গল্প। লেখার সময়কাল ১৯৯৫ থেকে ২০২১। এই বিস্তৃত সময় পর্বে লেখালেখির সংসার থেকে নির্বাচন করে নিলাম সেই সব গল্প যার ভরকেন্দ্র ব্রহ্মপুত্র নদের জনপদ। এবং শাখা প্রশাখায় উপস্থিত এপার- ওপার বাংলা। তবে সামাজিক-রাজনৈতিক দেশপ্রসিদ্ধ পরিসর এমনই, এই ভরকেন্দ্র সঞ্চরণশীল হয়েই যায় এবং ক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে যে-কোনো নদ-নদীর অববাহিকা মনোনীত স্থান ও লোকালয়ের ঘরে বাইরে।"

একের পর এক গল্প। সবকটির প্রেক্ষিত ব্রহ্মপুত্রপাড়, গুয়াহাটি বা তার আশেপাশের অঞ্চল। সময় যানে চেপে কখনো আশির দশক কখনো নব্বইয়ের দশকে যাতায়াত। এই গোটা চলাচল অত্যন্ত স্বচ্ছলভাবে করেন ঝরঝরে এক গদ্য ভঙ্গিতে মৃদুল দে। বোঝা যায় বাংলা কথাকারদের মধ্যে অন্যতম তিনি, যাঁর কলমে সময় সমাজ ফুটে ওঠে অতি সহজে, ছোট ছোট বাক্যে, অতীত বর্তমানের চলাচল হয় অবলীলায়।

মৃদুলের কলমে আছে মানবিকতা, জীবন বোধ, রাজনীতি সচেতনতা, সময় সচেতনতা। বলা হচ্ছে গুয়াহাটিকে ভূগোল করে। অন্তঃসারে আছে রাজনীতি সাম্প্রদায়িকতা হানাহানি অনিশ্চিতি, আর অনেক খেটে খাওয়া মানুষ। অঞ্চলের সারাৎসার না জানলে লেখা যায়না এভাবে ধুলোর গন্ধ আর হাই ওয়ের কথা।

চরিত্রগুলি বাস্তব, অতিবাস্তব, কখনো বা পরাবাস্তবের ধার ঘেঁষে যায়। যেমন তুহিন, যে আশির দশকে বুট পালিশ করেছে। ছাত্র আন্দোলন করেছে। বুটপালিসের টাকা ছাত্র সংগ্রাম তহবিলে জমা দিয়েছে। তাকে নিয়ে গল্প বুটপালিশ একদিন প্রতিদিন। বার বার কাব্যিক মোচড়ে ঘুরে এসেছে একটি কথা। নানা আকারে উৎকন্ঠা ফণা তুলে আছে।

প্রতি গল্পে মৃদুল এঁকে রেখে যাচ্ছেন নিরাপত্তাহীনতা। সমকালীন চোরা ঠান্ডা ভয়ের স্রোত। পূর্বের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের চেয়ে আলাদা। কিন্তু তবু উৎকন্ঠাগুলো সত্য। ঝাঁ চকচকে অফিস বা এরোপ্লেন আছে। তথাপি ভয়ের চোরা স্রোত। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে লিখেছেন মৃদুল এই গল্পগুলি । স্পষ্ট বোঝা যায়।

"অমরেন্দ্র একবার বলেছিলো, গণতান্ত্রিক দেশে কারিয়াপ্পার প্রভুত্ব বা শাসন কাম্য নয়। নরেন্দ্রনাথ তখনই চেপে ধরেছিলো ভাগ্নেকে, তুই গণতান্ত্রিক মহকুমাধিপতিকে ধরে কয়েনের বস্তা ফিরিয়ে দিস আমাকে! ক’বস্তা চুরি হয়েছে জানিস! চোর ডাকাতদের বাড়বাড়ন্ত, আর তুই নাকে তেল দিয়ে সুশ্রাব্য কথা বলে যাচ্ছিস।

পাঁচ মিনিট হাঁটলে হাইওয়ে। এই দিকে যাও, গুয়াহাটি। ওই দিকে, তেজপুর। আর কী চাই! ধান ভাঙার কল যন্ত্রনির্ভর শব্দের উৎস। এই শব্দ রামায়ণের মতো মিশে আছে মাংস-মজ্জায়। হৃৎপিণ্ডের শব্দ এখন ধানকলের শব্দপুঞ্জের একটি শাখা বটে।

ভালো লাগে রান্নাঘরের দীর্ঘ করিডোরে রাখা বেঞ্চে বসে, সুবিস্তৃত উঠোনের মুখোমুখি, গরম ভাত আর নানা সবজি বিভূষিত গরম ডাল খেতে। রুদ্র ধানকলের পাশ দিয়ে রাস্তা ধরে চলে এল মফস্বলের একমাত্র সিনেমা হলের কাছে। পাশে একটি ছোটো মাঠ। সেখানে মাইক, চোঙা, কয়েকটি চেয়ার আর কয়েক জন যুবক। বেলা তখন এগারোটা। খানিকটা গেলে হাইওয়ে, দোকানপাট।"

চলনে শৈল্পিক কাব্যিক। কথাসাহিত্যের এই ঢং বড় পছন্দের।

ক্ষেত্রহরির ক্ষেত্রভূমি। গল্পটি বিদেশি ভগনিয়া মানে শরণার্থীর । মা বাবার কাগজ না থাকা নিয়ে গল্প। এন আর সি -র কথা সোচ্চারে বলা নেই শুরুতে। গল্পের ভেতরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। হালকা ঢঙে। নিরাপত্তাহীনতার গল্প শুরু হয় মুরগি নিয়ে বাসে ওঠার খন্ডচিত্র দিয়ে, মুরগির বাসভাড়া হাফটিকেট না ফুল টিকেট তাই দিয়ে। তারপর গল্পটা এসে পড়ে দুরন্ত এক সন্ত্রাসের ভেতর। আপাদমস্তক শোষিত মানুষের বিষয়ে।

বরং বলা যায়, বাধ্য হত। বাঁশের মাচান পায়ের আঙুলে চেপে উপরে উঠতে হত। এক তলা, দুই তলা, তিন তলা। খুব কষ্ট হত নারা শরীরে। ক্ষিধে জর্জর মনে।

একপাশে মহাবাহু ব্রহ্মপুত্র, অপার তার বিস্তার। একপাশে স্তব্ধ সারবদ্ধ গাড়ির জট। বাঁচার তাগিদে ক্ষেত্রহরির হঠাৎ মনে হলো, নির্বাক সহস্র ইঞ্জিন গর্জন করে উঠুক এক্ষুনি। এই শ্রমজীবী মানুষ স্বেচ্ছাচারিতার দাস নয়। ভয়শূন্য স্বাধীন চিত্তে ও শ্বাস নিক। অথবা বহমান ব্ৰহ্মপুত্র তেজস্বী ঢেউয়ের কলরবে বলে উঠুক, এই শ্রমিক এই ভূখণ্ডে এসেছে সত্তরের কুড়ি ফেব্রুয়ারি। তারপর গা-গতরে খেটে কত নির্মাণ শিল্পে বা উৎপাদন বলয়ে অহর্নিশ কাজ করেছে। খাঁচায় আটকে রেখো না ওকে। মুক্ত স্কুল বালকের মতো ও গাছতলার ছায়ায় বিশ্রাম চায়।

ঠা ঠা রোদ্দুরে ক্ষেত্রহরি হাঁটছে। কোথায় যাবে, সে জানে না। তাকে নজরবন্দি অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে দুই অচেনা যুবক। ধরণীর নির্দেশ, সস্তায় শ্রম দিতে হবে। মাথায় ষোলো বা কুড়িখানা ইট তুলে বহুতল দালানে কাজ। তবু কি রেহাই আছে! রাজনৈতিক পরিস্থিতির গঠন কৌশল এমন যে ক্ষেত্রহরিকে অস্তিত্বহীন করা কিছুই না।

এরপর চলচ্চিত্রের মত একটা ঘটনাপ্রবাহ, হাতে প্রাণ রেখে মানুষের পলায়নের বর্ণনা। দ্রুতগামী শটে শটে ।

যানজট আকার নিয়েছে এমন। আগুন আগুন। লেলিহান শিখা ট্রাক বাস মোটর গাড়ির ছাদ টপকে এগিয়ে আসছে। নিশ্চল গাড়িগুলো থেকে প্রাণ বাঁচাতে ঝটপট দরজা খুলে নেমে পড়লে লোকজন। চরম বিশৃঙ্খলার অন্তর্গত ধোঁয়াধূসর সে ওই যুবকদের থেকে বিচ্ছিন্ন।

একাকী ক্ষেত্রহরি পলাতক, এসে পৌঁছায় একটি বাড়িতে। আশ্রয় পায়।

পুত্রবধূ জানতে চাইলেন, ‘দেউতা, আপনি কি ওকে চেনেন? ‘ভালো করে চিনি। ক্ষেত্রহরি। বিল্ডিং-এর লেবার। বঙালি মানুহ ।

এইবার সমস্যা খোলসা করে বলা হল। তারপরও কোন পরিত্রাণ পেল না ক্ষেত্র হরি । তাকে এই সমৃদ্ধ মানুষটি নিজের খামারের কাজে পাঠিয়ে দিলেন, বন্দীসম! ঘেটো থেকে আরেক ঘেটোতে চলে যায় ক্ষেত্রহরি।

মৃদুল দের কলমে সুর আছে গান আছে ছবি আছে। আছে দীর্ঘকাল অসমে থাকার , অসমের সংস্কৃতি জগতকে কাছের থেকে দেখার প্রমাণ। অজস্র সুন্দর মানুষ, শিল্পী তাঁর গল্পে আনাগোণা করে। তবু একেবারে সাধারণ মানুষের অনিরাপত্তা পাশাপাশি তিনি লিপিবদ্ধ করেই চলেন।

যেমন ঠোক্কর গল্পের নকুল মন্ডল। যাকে পরিত্রাণ করে এক রহস্যময় পুরুষ। নকুলের সঙ্গে তার অহি নকুল সম্পর্ক হবার কথা। কিন্তু মানবিকতার কারণে সে পুরনো কৃতজ্ঞতা ভোলেনি।

অথবা দেওয়াল গল্পে বাস স্ট্যান্ড যার জমি গ্রাস করে নেবে সেই ভীত ধনেশ্বর থেকে ফুলেফেঁপে ওঠা ব্যবসায়ীতে পরিণত ধনেশ্বর। উল্টোদিকে নিতুল। যার কিছু না থাকলেও আত্মমর্যাদা আছে। শোষককে ভয় পায় না যে।

গল্পে গল্পে বাস্তবকে পরাবাস্তবের দিকে হাত ধরে এগিয়ে দিয়েছেন মৃদুল। একটি গল্পে ( পোশাক) ধাবমান নগ্ন মেয়েকে পাঞ্জাবি খুলে দেওয়া যোগব্রতর ছবি ভাইরাল হয়ে যাওয়া। সংবাদ পত্রে পত্রে ছড়িয়ে যাওয়া একটি নগ্ন মেয়ের ছুটে যাওয়ার কাহিনি , তাকে বাঁচাতে চেয়ে পাঞ্জাবি খুলে দেওয়া ... এই কাহিনির মূলে আছে সত্যি ঘটনা... আমার নিজ চোখে দেখা সেই ফুটেজ। সেই জায়গা থেকে মৃদুল বুনলেন গল্প। এনে দিলেন ভিয়েতনামে মার্কিন বোমার তান্ডবে পোশাক পুড়ে যাওয়া উলঙ্গ মেয়ের ছুটের কথা। সেই ছবিও লাইফ ম্যাগাজিনের পাতায় ষাটের দশকের শেষে আমরা দেখেছিলাম... জুড়ে গেল আন্তর্জাতিক বৃত্ত। ধ্বংস আর সন্ত্রাসের।

এই বইয়ের গল্প পড়ার পাঠক সেই সমাজ ও রাজনীতি সচেতন, ভাষামুখী পাঠক। এ বই একটা তীক্ষ্ণ শলাকার মত। ফিলগুডের পরত ছিঁড়ে ছিঁড়ে, লাতিন আমেরিকার ছায়াছবির মত আমাদের ছন্নছাড়া, নষ্ট সময়কে দেখায়। ভূগোল হতে পারে ব্রহ্মপুত্র। কিন্তু এ কাহিনি কি গঙ্গা যমুনা অথবা নর্মদার অববাহিকা থেকে আদৌ আলাদা? একেবারেই নয়।

কাব্যিক ভাষার এই বইটির ছাপাই বাঁধাই কাগজের মান, মুদ্রণের মান সবই অতি উৎকৃষ্ট। তবে প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ফন্ট একটু পুরনো বলে মনে হয়েছে।

3 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in







৩৩


পরের দিন একবারও ফাইনহালস মেয়েটির দিকে দূরবীন তাক করে দেখেনি। যদিও সে শুনতে পেয়েছিল যে মেয়েটি গান গাইছে এবং ঘুরে ফিরে অস্ফুটে একটা সুর গুনগুন করে যাচ্ছে। সে পাহাড়ের দিকেই দেখতে লাগল সারাক্ষণ। তাঁর মন খুশিতে ভরে উঠল যখন সে পাহাড়ের মাথায় একপাল ছাগল চরতে দেখতে পেল। গির্জার চুড়ার পেছনে ডান দিকে অনেকগুলো সাদা সাদা বিন্দু ঘুরে বেড়াচ্ছে আগে পিছে পাহাড়ের ধূসর সবুজ জমির উপরে। হঠাৎ সে দূরবীন নামিয়ে রাখল। পাহাড়ের দিক থেকে গুলিগোলার শব্দ ভেসে এল একবার।

তারপর আবার একটা শব্দ। একদম পরিষ্কার শোনা গেল। খুব জোরে নয়; অনেকটা দূরে হয়তো। ব্রিজের উপরে যেসব শ্রমিকেরা কাজ করছিল, তারা কাজ বন্ধ করে থমকে দাঁড়াল। স্লোভাক মেয়েটির গুনগুন গান থেমে গেল। লেফটেন্যান্ট মুক দৌড়ে চলে এল। দূরবীনটা ফাইনহালসের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নিজে তাক করল পাহাড়ের দিকে; অনেকটা সময় ধরে দেখতে লাগল সে। নাহ, আর কোনো শব্দ শোনা গেল না। মুক ফিরিয়ে দিল তাকে দূরবীনটা… ‘সাবধানে কিন্তু এখন… দেখতে থাকুন সমানে, দেখতে থাকুন’ মৃদুস্বরে বলে সে দৌড়ে গেল উঠোনে। সেখানে অন্যান্য সৈনিকরা বন্দুকগুলো পরিষ্কার করছিল। সেসব তদারক করতে লাগল মুক।

অন্যান্য দিনের তুলনায় সেদিনের বিকেলটা বেশ চুপচাপ, থমথমে হয়ে উঠল। যদিও শ্রমিকদের কাজ করার শব্দ, ধাতু কাটা, জোড়া, স্ক্রু লাগানো ইত্যাদি সবই শোনা যেতে লাগল। একতলায় বয়স্ক নারীর কণ্ঠস্বর রান্নাঘর থেকে শোনা যাচ্ছিল। সেই নারী সমানে তার কন্যার সংগে কথা বলে যাচ্ছিল, যদিও একতরফা কথা, কারণ কন্যা কোনো কথার জবাব দিচ্ছিল না। টেমানদের বাড়ির রান্নাঘরের জানালা থেকে স্লোভাক মেয়েটির গুনগুন গান গাওয়ার শব্দ ভেসে আসছিল। মেয়েটি শ্রমিকদের জন্য রাতের খাবার বানাতে বানাতে গান গাইছিল। বিশাল কড়াইতে বড় বড় আলু সাঁতলানো হচ্ছিল, মাটির পাত্রে টমেটো সাজিয়ে রাখা হচ্ছিল; বিকেলের আলোয় খাবারগুলো খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল।

ফাইনহালস পাহাড়ের দিকে দেখতে লাগল; দূরবীন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল জঙ্গলের দিকে, নদীর পাড়ের দিকে। চারদিক নিস্তব্ধ, নিঝুম। কোনো কিছু নড়ছে না কোথাও। দু’জন সান্ত্রী, যারা রাতে টহল দেয়, তারা জঙ্গলের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। ফাইনহালস শ্রমিকদের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। ওদের কাজ প্রায় শেষের মুখে। বিম দিয়ে তৈরি কালো জমাট রাস্তাটা দুদিক থেকে শুরু হয়ে মাঝে এক জায়গায় এসে জুড়ে যাওয়া একটু বাকি। দূরবীনের কাচ একটু নামিয়ে সে দেখতে পেল যে রাস্তার উপরে সব জিনিসপত্র জড়ো করে রাখা হচ্ছে। শ্রমিকদের কাজের যন্ত্রপাতি, ঠেলাগাড়ি, বিছানাপত্র, চেয়ার, রান্নার চুলা ইত্যাদি। কিছুক্ষণের মধ্যে টেসার্জি থেকে একটা গাড়ি এলো। সব জিনিসপত্র নিয়ে আট জন শ্রমিক চলে গেল সেটায় চড়ে। স্লোভাক মেয়েটা জানালায় বসে তাদের দিকে হাত নাড়ল। জায়গাটা আরেকটু চুপচাপ হয়ে গেল। সন্ধের দিকে নদীতে মোটরবোট নিয়ে সৈনিকরা টহল দিতে বেরল। ব্রিজের মাঝের প্রায় মিটার দুয়েক পথ জুড়ে যাওয়া বাকি। খুব বেশি হলে তিন চারটে বিম বসবে ওইখানে। শ্রমিকেরা সেদিনের মত কাজ বন্ধ করল। ফাইনহালস লক্ষ্য করল যে ওদের সব যন্ত্রপাতি ব্রিজের উপরেই রাখা আছে। টেসার্জি থেকে গাড়িটা ফেরত এল। রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছোট ঝুড়িতে ফল এবং কিছু বোতল নামাতে লাগল তারা গাড়ি থেকে। কিছু সময়ের মধ্যেই ফাইনহালসের ডিউটি শেষ হবে। ডিউটি শেষ হবার আগেই আবার একটা বিরাট বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে এল। নাটকে যেমন বাজ পড়ার শব্দ হয়, ঠিক সেরকম তিন চার বার পাহাড়ের দিক থেকে ভেসে এসে প্রতিধ্বনিত হয়ে ভেঙে ভেঙে গুমগুম করে ছড়িয়ে পড়তে লাগল শব্দটা। তারপর সব চুপচাপ। তারপর আবার ছুটে এল লেফটেন্যান্ট মুক। মুকের মুখটা কুঁচকে আছে। চোখ রাখছে সে দূরবীনে; বাম থেকে ডাইনে, পাহাড়ে, পাথরে, জংগলে চারদিকে দেখে যাচ্ছে লেফটেন্যান্ট। মাথা নাড়ছে বারবার। নামিয়ে রাখল সে দূরবীনটা। একটা কাগজের টুকরোতে কী যেন লিখল সে; অল্পক্ষণ পরেই ডয়সেনের সাইকেলে চেপে গ্রেস গেল টেসার্জির দিকে।

গ্রেস বেরিয়ে যাবার পরে পাহাড়ের দিক থেকে মেশিনগানের লড়াইয়ের শব্দ পরিষ্কার শুনতে পেল ফাইনহালস। রাশিয়ান মেশিনগানের করাতের মত খ্যাসখেসে কর্কশ চাপা শব্দের বিপরীতে জার্মান মেশিনগানের স্নায়ু অবশ করা তীব্র শব্দ। মনে হচ্ছে বন্দুকের ব্রেকগুলো কেউ পাগলের মত পিষে যাচ্ছে… পিছলে অবিরাম বেরিয়ে আসছে গুলি। তবে এই যুদ্ধ বেশিক্ষণ চলল না। অল্প কয়েক বার চাপান উতোরের পরে তিন চারটে হ্যান্ড গ্রেনেডের বিস্ফোরণের শব্দ; সেই শব্দের প্রতিধ্বনিগুলো সংখ্যায় বাড়তে বাড়তে এবং তীব্রতায় ফিকে হতে হতে পাহাড়ের মাথা থেকে জঙ্গলে, সমতলে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। পুরো বিষয়টা ফাইনহালসের কাছে কিছুটা হাস্যকর বলে মনে হচ্ছিল। সে লক্ষ্য করেছে, যখনই যুদ্ধ বাঁধে, তখনই লড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক বেশি সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় শব্দ শোনা যায়। এবার আর শব্দ শুনে মুক দৌড়ে এলো না। সে ব্রিজের উপরে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আরেকটা গুলির শব্দ শোনা গেল। হয়তো এটা রাইফেলের গুলি; প্রতিধ্বনিত শব্দটা একটা ছোট নুড়িপাথর গড়িয়ে পড়ার মত হালকা আওয়াজ। তারপর সন্ধে নেমে আসা অবধি সব চুপচাপ। ফাইনহালস দূরবীনের জানালাটা একটা ধাতব পাত দিয়ে ঢেকে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এল।

গ্রেস এখনও ফিরে আসেনি। নিচে খাবার ঘরে মুক বেশ উত্তেজিত একটা ভাষণ দিল, যার মর্মার্থ হচ্ছে যে রাতে সবাইকে সজাগ এবং সতর্ক থাকতে হবে। সে সম্পূর্ণ যুদ্ধসাজে সেজে ভয়ানক গম্ভীর মুখ করে নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করল। তার বুকে পদকগুলো সাঁটা আছে, কাঁধে মেশিনগান, বেল্ট থেকে ঝুলছে ইস্পাতের হেলমেট। গ্রেস ফিরে আসবার আগেই টেসার্জি থেকে একটা ধূসর রঙের গাড়ি এলো; গাড়ি থেকে নামল এক লালমুখো মোটাসোটা ক্যাপ্টেন এবং রোগাপাতলা কাঠ কাঠ কঠোর চেহারার এক ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট। মুকের সঙ্গে তারা ধীরে সুস্থে গিয়ে ব্রিজের উপরে উঠল।

টেমানদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ফাইনহালস লক্ষ্য করল যে তারা যাচ্ছে। দূর থেকে তিনজনকে দেখে মনে হচ্ছিল যে তারা বিষয়টা বুঝে নেবার জন্য আরেকটু এগোবে। কিন্তু দেখা গেল যে তারা ফিরে আসছে। ডয়সেন তার ঘরের জানালা দিয়ে দেখছিল। টেমানদের বাড়ির একতলায় শ্রমিকেরা তাদের রান্নাঘরে একটা খড়খড়ে পুরনো টেবিল ঘিরে আধো অন্ধকারে বসে খাচ্ছিল। তাদের প্লেটে আলু, টমেটো। রান্নাঘরের এক কোণে স্লোভাক মেয়েটা এক হাত কোমরে রেখে, আরেক হাতে একটা সিগারেট নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মুখটা সিগারেটের কাছে নিয়ে এসে, মেয়েটা একটু বেশিই যেন শরীরটা ঝাঁকিয়ে দেখানেপনা করছে; এমনটাই মনে হল ফাইনহালসের। তারপর যখন অফিসারেরা চলে যাচ্ছেন, ধূসর গাড়িটা স্টার্ট নেবে, ঠিক তখনই রান্নাঘরের জানালায় সিগারেটটা রেখে দিয়ে মেয়েটা ফাইনহালসের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে হাসল। ওই মেয়েটার দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে অফিসারদের অভিবাদন করতে ভুলে গেল ফাইনহালস। মেয়েটা জানালা থেকে একটু নিচু হয়ে তাকিয়েছিল; তার গাঢ় রঙের অন্তর্বাসের ভিতর দিয়ে দৃশ্যমান বিভাজিকা; স্লোভাক মেয়েটার বাদামি মুখের নিচে সাদাটে স্তনের আভাস হৃদয়চিহ্নের আকারে জেগে আছে।

মুক ফাইনহালসের সামনে দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে উল্টোদিকে মিসেস সুজানের বাড়িতে ঢুকে গেল; সে বলতে বলতে গেল, ‘মেশিনগানটা নিয়ে আসবেন ভেতরে…’।

ফাইনহালস দেখতে পেল যে গাড়িটা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে রাস্তায় রাখা আছে একটা অস্ত্রের বাক্স এবং পাশেই একটা সরু কালো মেশিনগান শোয়ানো আছে। ফাইনহালস ধীরে ধীরে রাস্তা পেরিয়ে মেশিনগানটা নিয়ে বাড়িতে ঢুকে গেল; আবার ফিরে এসে বাক্সটা নিয়ে গেল ভিতরে। স্লোভাক মেয়েটা তখনও জানালায় এলিয়ে বসে আছে। সিগারেট থেকে জ্বলন্ত ছাইটা ফেলে দিয়ে সেটা ঘষে নিবিয়ে বাকিটুকু সে রেখে দিল তার অ্যাপ্রনের পকেটে। সে এখনও তাকিয়ে আছে ফাইনহালসের দিকে; তবে আর হাসছে না। মেয়েটাকে হঠাৎ খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে; অল্প হাঁ হয়ে থাকা মুখের ঠোঁটদুটো যন্ত্রণাকাতর উজ্জ্বল লাল হয়ে উঠেছে। তারপর হঠাৎ করেই মেয়েটা নিজের ঠোঁট কুঁচকে মুখটা বন্ধ করে পেছন ফিরে কাজ করতে শুরু করল। খাবার টেবিলটা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শ্রমিকেরা খাওয়া সেরে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ব্রিজের দিকে হাঁটতে শুরু করল। ফাইনহালস যখন ব্রিজের উপরে মেশিনগান হাতে নিয়ে গেল আধঘণ্টা পরে, তখনও শ্রমিকেরা সেখানে কাজ করছিল। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। তার মধ্যেও ওরা কাজ করে যাচ্ছে সেতুর উপরে শেষ বিমটা জুড়ে দেবার জন্য। ডয়সেন নিজের হাতে শেষ জোড়ের স্ক্রু লাগাচ্ছে। কার্বাইড ল্যাম্প জ্বালিয়েছে সে কাজটা শেষ করবার জন্য। ডয়সেন যেভাবে রেঞ্চ ঘোরাচ্ছিল, ফাইনহালসের মনে হল সে যেন ব্যারেল অরগানের* হাতল ঘোরাচ্ছে। একটা বিশাল কালো বাক্সের মত দেখতে যন্ত্রাংশে সে ড্রিল করছিল, অথচ কোনো শব্দ হচ্ছিল না। ফাইনহালস মেশিনগানটা নামিয়ে রেখে গ্রেসকে বলল… ‘এক মিনিট… এখনই আসছি…’




(চলবে)

*ব্যারেল অরগান- প্রাচীন ইউরোপীয় বাদ্যযন্ত্র, পাইপ অরগানও বলা হয়। যন্ত্রটির পাইপের মধ্যে যে সুর বাজানো হবে, সেই সুরের স্বরলিপি পিনের সাহায্যে আগে থেকেই গেঁথে অর্থাৎ প্রোগ্রাম করে রাখা থাকে। যন্ত্রের হাতল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুর বাজানো হয়। সাত থেকে দশটির বেশি সুরের অংশ একটা মাঝারি আকারের ব্যারেল অরগানে এক বৈঠকে বাজানো সম্ভব নয়।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in




















ছয়

এই বাড়ির নিচু তলায় কিছু অসামাজিক লোকের কাজকর্ম বিশু এক সপ্তাহের মধ্যেই টের পেয়ে গেলো। তারাই এই ভূতের ভয় দেখায়। একদিন জীবন বাথরুম গেছে এমন সময় নাকি সুরে একজন বলে উঠলো, এঁখান থেকে পাঁলা। ঘাড় মটকে দেবো। আবার একদিন রমেন ভয় পেলো। ঠিক সেই বাথরুমে। বিশু তদন্ত করে দেখলো বাথরুমের ভেন্টিলেটার ভেঙ্গে একটা সরু দড়ি ঢোকানো হয়েছে। বাইরে গিয়ে দেখলো দড়িটা নিচের ঘরের বারান্দায় শেষ হয়েছে। বাথরুমে ভাঙ্গা কাঁচে টান পরলে বিকট আওয়াজ হয়। আর মুখ বাড়িয়ে মুখোশ পড়ে নাকি সুরের কথায় সকলেই ভয় পাবে। বিশু বললো সবাই তৈরি থাকিস। আজ রাতেই ভূত ধরবো।আজ আর কেউ স্কুল গেলাম না। একটা উত্তেজনা রাতে জাগিয়ে রেখেছে। এবার সেই বিকট শব্দ। বিশু বাঘের মতো লাফিয়ে লাঠি হাতে নিচের তলায় গিয়ে জলজ্যান্ত ভূতের পাছায় লাঠির আঘাতে ভূতকে কাবু করে ফেললো। ভূত বাবাজি জোড় হাতে বলছে, ছেড়ে দাও বাবা আমি আর ওসব করবো না। ভূতের সঙ্গিরা সব পালিয়েছে, আমাদের হাতে লাঠি দেখে। বিশু বললো, যাও, যেখানে বিশু আছে সেখানে চালাকি করার চেষ্টা কোরো না। বিপদে পড়বে।তারপর থেকে আর কোনোদিন ভূতের উপদ্রব হয়নি সেই বাড়িতে।বিশুর বাহাদুরি দেখেই আমরা সাহসী হয়ে উঠেছিলাম। বিশুর সঙ্গে আমরা বেরোলে সকলের চোখেমুখে একটা সাহসের,শান্তির ছাপ ফুটে উঠতো। পাড়ার কোনো মানুষ বিপদে পরলে বিপদের বন্ধু এই টাইগার বিশুকেই স্মরণ করতো। তার সঙ্গে আমরা তো থাকতাম অবশ্যই। রমেন, জীবন,বিশু,আমি একবার বন্যার সময় নৌকা করে মানুষের খাবার জোগাড় করতে চড়খী গ্রামে গিয়েছিলাম। হেলিকপ্টার থেকে চিড়ের বস্তা,গুড়ের বস্তা ফেলছে চড়খীর ব্রীজে যার আসল নাম কাশীরাম দাস সেতু। সেখান থেকে আমরা চিড়ে, গুড়ের পাটালি নৌকায় তুললাম। রমেন পেটুক। বললো, একটু টেষ্ট করলে হয় না। বিশু বললো, এখন এটা সকলের সম্পত্তি। যা হবে সকলের সামনে হবে। কেউ হাত দিবি না। এখন তাড়াতাড়ি চল। বান বাড়ছে। বিশু দাঁড় টানেআর আমরা সবাই সাহায্য করে নৌ্কা ও খাবার নিয়ে চলে এলাম নতুন পুকুরের পাড়ে। সেখানে বাড়ি বাড়ি সকলকে সমানভাবে খাবার ভাগ করে দিলো বিশু। তারপর আমরা বাড়ি এসে জীবনের মায়ের হাতের রান্না, গরম খিচুড়ি আর পেঁপের তরকারি খেলাম। অমৃতের স্বাদ। বিশু বললো, কাকীমা অনেক পেঁপে গাছ পড়ে গেছে বন্যার স্রোতে। আমরা আপনাকে অনেক পেঁপে এনে দেবো। সেবার বন্যায় পেঁপে, গ্রামের লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছিলো। আমাদের গ্রাম অজয় নদীর ধারে। গ্রামগুলিও খুব নীচুস্থানে অবস্থিত। নদীর নাব্যতা বা গভীরতা অল্প। ফলে বন্যা প্রায় প্রতি বছর দেখা দিয়ে যেতো। জল যখন কমে যেতো তখন তোতনের মা ও পাড়ার মা বোনেরা মাঠে মাছ ধরার জন্য যেতো। নানারকমের শাক, ঢোল কলমি, শুশুনি তুলতো। খুব ভালো লাগতো নানারকমের মাছ ভাজা খেতে। আমি দেখলাম, তোতনের মা মাঠ থেকে দুই তিন রকমের শাক তুলেছে। ওরা ভিটামিন বোঝে না, শরীরচর্চ্চাও বোঝে না। ওরা জানে খাটবো, রোজগার করবো আর খাবো পেট ভরে। মাঠেই পাওয়া যেতো বেশির ভাগ শাক, সব্জী। , খলসে, ওআরও নানারকমের মাছ মাঠের জলে সাঁতার কেটে বেড়াতো। বেলে, তে চোখো,চ্যাঙ,ছিঙুরি,গচিমাছ ছাড়াও ছোটো কাঁকড়া তাল কাঁকড়া পাওয়া যেতো। গর্তে হাত ঢুকিয়ে বিশু অনরকবার তআল কাঁকড়া বের করে আমাদের দেখিয়েছে। পাঁকাল,গুঁতে,কৈ,মাগুর,ল্যাটা প্রভৃতি অসংখ্য মাছ। বিত্তি পেতে দিতো স্রোতের মুখে।বিশু বলছে, খাল কেটে মাঝখানে বিত্তি পেতে জল যাওয়ার নালা কেটে দিতো। মাছ লাফিয়ে ওই গর্তে পড়তো। টানা জাল,পাতা জাল দিয়ে মাছ ধরতো। এখন তোতনের মায়ের জায়গায বৌমা মাঠে যায়। কিন্তু কৃষিকাজে সার, ওষুধ প্রয়োগ করার ফলে সেইসব মাছ ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে। শাকপাতাও পায় না মা বোনেরা। এখন সব বাজারমুখী।। তখন শাক আঁচলে করে নিয়ে গিয়ে বাউরীবউ মুড়ি নিয় আসতো চাষি বাড়ি থেকে। মাঠের টাটকা শাক সবাই নিতো জলের দরে। আজ আর টাটকা কিছু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশুর কথা একশো শতাংশ সত্য। এখন আমরা বড় হয়ে গেছি। কিন্তু, স্বর্ণ যুগের সেইসব স্মৃতি মনের মণিকোঠায়চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমার মা বলতেন,ছোটো থাকাই ভালো রে,সংসার অসার। মা বলতেন,এখন সংসাররূপ চিতায় জ্বলে মরছি মরণের পরে প্রকৃত চিতায় পুড়ে যাবে আদরের দেহ...স্বজন বন্ধুরা বলবে. আর কত সময় লাগবে শেষ হতে...একটু দ্রুত করো ভাই...তবে কিসের এত অহংকার...কেন এত লোভ ... ভালোবাসায় কৃপণতা। কে ধনী... টাকায় চিতা সাজালেও পরিণতি একই..।কৃষ্ণধনে ধনী যেজন

নিজ ধামে ফেরে সেজন..।লক্ষ্মীপুজো এলেই মা বলতেন কোজাগরির অর্থ।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(৯)

মাঝরাতে একটা নারীকন্ঠের কান্না সহ আর্তনাদে গোলকপতির ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। পরক্ষণেই সে বুঝল যে এই আওয়াজটি আসলে অন্দরমহলের আঁতুড়ঘর থেকে ভেসে আসা প্রসববেদনা সহ কোন মহিলার তার সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময় ধ্বনিত হচ্ছে। তার মানে রাজবাড়ির ভিতরে তাহলে আবার একটি নতুন প্রজন্মের শুভাগমন ঘটল।

বিস্ময়ের ঘোর কাটলে ওর মনটা সাথে সাথে এক গভীর বিষাদবেদনায় যেন কেঁদে উঠল।

আজ তার স্ত্রী লক্ষ্মীমণি বেঁচে থাকলে তার মত এই অভাগার জীবনেও হয়ত এরকম প্রসববেদনা সহ একটি সদ‍্যোজাত শিশু কন্ঠের কান্নার ঢেউ উঠতে পারত, যা আর আপাতত শুনতে পাওয়াটি আদৌ সম্ভব নয়।

....

এখানে এসে মাস তিনেক স্থিতু হওয়ার পর ওর অন্নদাতা তথা বর্ধমান রাজবংশটির ইতিহাস সহ বেশ কিছু গোপন কথা এর মধ‍্যেই ওর বেশ কর্ণগোচর হয়েছে।

সুদূর লাহোরের এই পরিবারটির সাথে বঙ্গালের সম্পর্ক মাত্র আট পুরুষের। একদা শ্রীক্ষেত্র দর্শনের পথে যে পঞ্জাবী বণিক সঙ্গম রাই নামক ভাগ‍্যাণ্বেষী যুবা ও তার পরিবারটি অদূরের বৈকুন্ঠপুরে এসে বসতি গঠন করে ও ভাগ‍্যবলে, নানা ঘাতপ্রতিঘাতের পর মাত্র তৃতীয় প্রজন্মেই এদের বংশটির ভাগ‍্যের চাকা ঘুরে স্বয়ং মোগল সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে মোটা বখশিস্ পেয়ে আস্তে আস্তে বাংলায় সুবাহদারের পদে বহাল হয়ে জাঁকিয়ে বসে। ফলতঃ জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর বর্ধমানের নামানুসারে জনপদটিতে ক্রমে শুরু হয় এই "মহতবচাঁদ" বংশের ধারাবাহিক শাসন।

এর মধ‍্যে বিভিন্ন উত্থান পতনের পর ১৭৪৪ সালে এই বংশের কৃতী জমিদার তিলকচাঁদ বাহাদুরের আবির্ভাব যেন এই রাজবংশটিকে সুবে বাংলার এক অন‍্যতম পরিবারে পরিণত করতে থাকে। তার পরিণামেই রাণীমা বিষণকুমারী একই ভাবে স্বামীর অবর্তমানে জড়িয়ে পড়লেন ঘোর জটিল ও কুটিল রাজনীতির পঙ্কিল সলিলে। সেই রাণীমাই যে হয়ে উঠবেন গোলকপতির ভাগ‍্যের সহায় সেটা যেন এক অলীক গল্পকথা।

........

রামমোহনের ইদানীং নিদ্রাবেশ কমে গিয়ে অতি প্রত‍্যূষ থেকেই শাস্ত্রসাগর মন্থনে নিজেকে নিয়োজিত করেছে। খানাকুল উদ্ভূত এই যুবকটি আপাতত সতীদাহের বিপক্ষে বেশ কিছু সপ্রমাণ -উদ্ধৃতি যোগাড় করতে সচেষ্ট। তার দৃঢ় বিশ্বাস যে এই সব প্রমাণগুলোই ধর্মব‍্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে তার হাতিয়ার হয়ে উঠতে আর বেশী দেরী নেই।

শহর কলকেতা আর তার পাশ্ববর্তী জেলাগুলোতে তার এই কর্মপ্রচেষ্টা ও সতীদাহ বিরোধী উৎসাহটিকে মোটেও সুখকর চোখে দেখছেন না তাবড় সমাজপতিরা।

এর সাথে আবার যুক্ত হয়েছে কিছু প্রভাবশালী ও ধনী জমিদারবর্গের সক্রিয় বিরোধাভাসটিও। তাদের বৃহদাংশ এখন ব্রাহ্মণদের ক্ষেপিয়ে দিয়ে ওদের অনুগত জনতাকে ক্রমাগত উস্কানি দিয়ে রামমোহনকে পর্যদুস্ত করার চেষ্টায় রত।

যদিও রামমোহন এতে দমবার পাত্র নয়।

এতকিছুর মধ‍্যেও সে পরিবার প্রতিপালনে বেশ সফল। পারিবারিকভাবে তা পিতার সাথে সামান‍্য বিরোধাভাস থাকলেও সে সপরিবারে বেশ সুখকর জীবনে অধিষ্ঠিত। এর মধ‍্যে সম্প্রতি সে একটি পুত্র সন্তানের পিতৃত্ব লাভে বিশেষ গৌরবাণ্বিত। সদ‍্যজাতটির স্মিত মুখশ্রীটি দেখলেই বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে তার এই প্রিয় সন্তান "রাধাপ্রসাদ' এর বড় হয়ে ওঠার পৃথিবীর আকাশটিকে নির্মল ও কুসংস্কারমুক্ত করতে তাকে চেষ্টা করতে হবে ও সফল হতেই হবে।

অবশ‍্য হিন্দুদের চিরাচরিত ছোঁয়াছুঁয়ি, উচ্চ-নীচ বিভেদ ও পৌত্তলিকতার বিপ্রতীপে গিয়ে তাদের মত কিছু মানুষের বদান‍্যতায় আদি ব্রহ্ম উপাসনার ক্ষেত্রটিও সবেমাত্র যেমন শুরু হয়েছে, ঠিক তেমনই একে একে অন‍্য আধুনিক ভাবধারাগুলির প্রবর্তনটিও ঠিক সমানভাবে জরুরী।

পরশু একবার বর্ধমানের উদ্দেশ‍্যে যাত্রা করা প্রয়োজন। যদিও মহারাজ তেজচন্দ্র তার সম্পূর্ণ অনুকূলে নন তাও এইসব সামন্তপ্রভুদের কিছুটা হলেও পাশে পেলে কাজটা ত্বরান্বিত হবে। এই বছর খোদ ইংল‍্যন্ডের আইনসভায় সতীদাহ বিলোপের বিলটি পাশ করানো যায়নি। তাই পরবর্তী অধিবেশনের আগে এটিকে পাশ করানোর উপযোগী জনমতটিকে দ্রুতগতিতে পেশ করানোর ব‍্যবস্থা করতে হবে।

মধ‍্যযুগের পর্যটক আল-বেরুণীর ভ্রমণবৃত্তান্তটি মূল ফারসী ভাষায় পাঠ করতে গিয়ে তাকে বহুবার শিহরিত হতে হয়েছে। বিগত তিন-চারশ বছরেও হিন্দুস্তানের সামাজিক আবহাওয়া এক জায়গায় বদ্ধ হয়ে আটকে আছে সেটা যেন আদপেই মেনে নেওয়া যায়না। অশিক্ষার থেকেও কুশিক্ষা যেন দেশবাসীকে ঘাড় ধরে পদানত করে রেখেছে। এটাই তাকে আরো বেশী ভাবিয়ে তুলেছে।

টেবিলের উপর জলখাবারে আসা তক্র পান করার সাথে আখরোট ও কাঠবাদামের স্তুপটি থেকে সামান‍্য কয়েকটি মুখে তুলতেই সহাস‍্যে মিত্রবর দ্বারকানাথকে তার বৈঠকখানায় প্রবেশ করতে দেখে সে খুশী হল। দ্বারকানাথ আজ বেশ খুশী খুশী দৃষ্টিতে রামমোহনকে দেখে -

" অহঃ বেরাদর! একা একা এসব আহার মোটেও স্বাস্থ‍্যকর নয় হে! " বলে হাসিমুখে তার দিকে এগিয়ে আসতেই সে আখরোটের ভৃঙ্গারটিকে সপ্রশ্রয়ে তার দিকে এগিয়ে দিল।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in







অধ্যায়-৫

জন্মান্তরের ধারণাটি সম্ভবতঃ দেওয়ানি আদালতের অবদান; এতে বাদী-প্রতিবাদী দু’পক্ষেরই মরার সময় কোন আফসোস থাকে না যে ওদের মামলাটি শেষ হয় নি । ওরা নিশ্চিন্ত হয়ে মরে যে রায় শোনার জন্যে আগামী জন্ম তো হাতে আছেই ।

বৈদ্যজীর বৈঠকখানার বাইরের চাতালে এখন যে লোকটি বসে আছে ও বোধহয় সাত বছর আগে একটি দেওয়ানি মোকদ্দমা শুরু করেছিল; তাই ওর মুখে বারবার গতজন্মের পাপ, ভাগ্য, ভগবান, আগামী জন্মের প্রোগ্রাম এইসবের দোহাই শোনা যায় ।

লোকে ডাকে ‘ল্যাংড়া ‘বলে। কপালে কবীরপন্থী তিলক, গলায় তুলসীমালা, ঝড়জলে পোড়খাওয়া দড়িপাকানো চেহারা, রোগাটে শরীর ,পরনে মেরজাই । ওর একটা পা হাঁটুর নিচের থেকে বাদ দেওয়া, একটা লাঠির ভরসায় চলে। চেহারায় পুরনো দিনের সেইসব খ্রীস্টান সাধুসন্তের ভাব যারা নিজের হাতে নিজের পিঠে রোজ একশ’ ঘা চাবুক কষাতো।

শনিচর ওর দিকে ভাঙের গেলাস এগিয়ে দেয় । ‘ নাও ভাই ল্যাংড়া , খেয়ে ফেল। এতে ভারি ভারি জিনিস পড়েছে’।

ল্যাংড়া চোখ বুজে না বলল আর একটু পরেই ওদের মধ্যে তর্ক বেঁধে গেল যার বিষয় গড়িয়ে চলল ভাঙের গরিমা থেকে বাদাম-মুনাক্কা খাওয়ার লাভ, ক্ষণভঙ্গুর জীবন হয়ে ভোগ এবং ত্যাগ গোছের দার্শনিক প্রশ্ন পর্য্যন্ত। শেষে শনিচর অন্য হাতটি আন্ডারওয়ারে মুছে সব তর্ক উড়িয়ে দিয়ে সাংসারিক বিষয়ের প্রতি উদাসীনতা দেখিয়ে গজগজ করতে করতে বলল-- খাবে তো চোঁ চোঁ করে মেরে দাও, নইলে এই কাঁচকলা!

ল্যাংড়া একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বুজল যার মানে আত্ম-করুণা থেকে খাই খাই সবই হতে পারে । শনিচর ওকে রেহাই দিয়ে এক বাঁদর- লাফে সোজা বৈঠকখানার ভেতরে গিয়ে পড়ল। এটা দেখলে ডারউইন সাহেবের বিবর্তনবাদ নিয়ে কারও কোন সন্দেহ থাকার কথা নয় ।

বেলা দশটা। বৈঠকখানায় প্রিন্সিপাল সাহেব, ক্লার্ক, বৈদ্যজী, রংগনাথ সবাই উপস্থিত। শনিচর এবার ভাঙের ওই গেলাসটাই প্রিন্সিপালের দিকে এগিয়ে দিয়ে একই কথা বলল—‘খেয়ে নিন মাস্টারসাহেব, এতে ভারি ভারি জিনিস পড়েছে’।

প্রিন্সিপাল বৈদ্যজীর দিকে তাকালেন, ‘ কলেজের কাজ ফেলে এসেছি। এটা সন্ধ্যে পর্য্যন্ত মুলতুবি রাখলে হয় না’?

বৈদ্যজী স্নেহমাখা গলায় বললেন—সন্ধ্যেবেলা আবার খাবেন ‘খন।

‘কলেজ ছেড়ে এসেছি যে ‘!

রূপ্পনবাবু কলেজ যাবার জন্যে তৈরি হয়ে বেরোচ্ছেন। রোজ যেমন হয় – ধুতির খুঁট গলায় উঠেছে, পরনের বুশশার্ট ময়লা, কিন্তু দামি্‌ তাই চলতে পারে । পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল , মুখে পান, হাতে একটা মোটা বই, সিভিক্স ক্লাসে পড়ার জন্যে । বইটার নাম ‘জেবী জাসুস’ বা ‘পকেট ডিটেকটিভ’। পকেটে নীল-লাল দুটো ঝর্ণাকলম— দুটোতেই কালি নেই । হাতে রিস্টওয়াচ যা দেখলে পেত্যয় হয় যে জুয়ো খেললে ঘড়িও বন্ধক রাখা যায় আর বন্ধকী দামি ঘড়ি জুয়োয় হারলে দশটাকায় বাজেয়াপ্ত করা যায় ।

রূপ্পনবাবু বেরিয়ে যেতে যেতে প্রিন্সিপাল সাহেবের কথাগুলো শুনে ফেলেছিলেন। বাইরে থেকেই বললেন—কলেজ তো আপনি কবেই ছেড়ে দিয়েছেন, খালি কলেজই আপনাকে ছাড়ছে না !

প্রিন্সিপাল বিষম খেলেন। তাই হেসে উঠলেন, বললেন—বলেছেন বটে খাঁটি কথা !

শনিচর লাফিয়ে উঠে ওনার হাত চেপে ধরে বলল—তাহলে এই কথার খাতিরে হয়ে যাক এক গেলাস!

বৈদ্যজী প্রসন্নমুখে প্রিন্সিপাল সাহেবের ভাঙ খাওয়া দেখছিলেন। খাওয়া শেষ করে প্রিন্সিপাল বললেন—সত্যিই এতে ভারি সব জিনিস মেশানো হয়েছে।

বৈদ্যজী বললেন—ভাঙ তো নামমাত্র রয়েছে; আছেও আবার নেইও । আসল হল দ্রব্যগুণ—বাদাম, মনাক্কা আর পেস্তা। বাদাম বুদ্ধি এবং বীর্য বৃদ্ধি করে । মনাক্কা হজম করায়। এতে এলাচিও পড়েছে । এর প্রভাব শীতল । ফলে বীর্য ফাটে না , গাঢ় এবং জমাট হয় । আমি এই পানীয়ের একটি ছোট প্রয়োগ রঙ্গনাথের উপরও করছি।

প্রিন্সিপাল ঘাড় উঁচু করে কিছু বলব বলব করছিলেন, কিন্তু বৈদ্যজী থামেন নি , ‘কিছুদিন ধরে ওর জ্বর হচ্ছিল, শক্তি ক্ষীণ, তাই এখানে আনিয়ে নিয়েছি। রোজ একটি নিয়ম করে দিয়েছি । পুষ্টিকর খাবারে বাদাম খাওয়া, দু’পাতা ভাঙ। দেখবে--ছ’মাস পরে ফিরে যাওয়ার সময় কেমন চেহারা নিয়ে যায়।

কলেজের ক্লার্ক বোলে উঠল—ছুঁচো হয়ে এসেছিল, গণ্ডার হয়ে ফিরে যাবে নিঘঘাৎ, —দেখে নিও চাচা’!

ক্লার্ক যখনই বৈদ্যজীকে চাচা বলে ডাকে, প্রিন্সিপাল সাহেবের আফসোস হয় উনি কেন এতদিনেও বৈদ্যজীকে বাপ বলতে পারেন নি ! উদাস মুখে উনি সামনে পড়ে থাকা ফাইল গুলো উলটে পালটে দেখতে লাগলেন।

ততক্ষণে ল্যাংড়া দরজা পর্য্যন্ত এসে গেছে। শাস্ত্রে শূদ্রের আচরণের যেমন বিধান, ল্যাংড়া সেটা মেনে

চৌকাঠে প্রায় মুর্গী হয়ে বৈদ্যজীকে প্রণাম করল। দেখা গেল যে আজও আমাদের এখানে শাস্ত্রের বিধান সবার উপরে এবং জাতিভেদ তুলে দেওয়ার সব চেষ্টা হয় ভন্ডামি নয় রোমান্টিক বাতুলতা মাত্র । ল্যাংড়া ভিক্ষে চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল—তো যাই বাপু?

বৈদ্যজী বললেন—যাও ভাই, তুমি ন্যায়ের জন্যে লড়াই করছ, করে যাও । এতে আমি আর কী সাহায্য করব বল’?

ল্যাংড়া সহজভাবে বলল, ‘ ঠিকই বলেছ বাপু; ন্যায়ের লড়াই—তুমি কি করবে? যখন কোন সুপারিশ-টুপারিশের দরকার হবে, তখন নাহয় তোমার চৌকাঠে নাক রগড়াবো’।

আর একবার প্রায় মাটি পর্য্যন্ত ঝুঁকে প্রণাম করে লাঠির সাহায্যে ঝুলতে থাকা একটা পা’ সামলে ও চলে গেল। বৈদ্যজী জোরে হেসে উঠলেন। বললেন—এর হল বালকবুদ্ধি।

বৈদ্যজী কখনও সখনও হাসেন। রংগনাথ অবাক হয়ে দেখছিল হাসলে বৈদ্যজীর চেহারা কেমন নরমসরম হয়ে যায় , নেতার চেহারা বদলে গিয়ে ভালমানুষের মত দেখায়। এক নিষ্ঠাবান মহাপুরুষের বদলে ওনাকে এখন ধূর্ত বদমাসের মত লাগছে।

রঙ্গনাথ শুধোয়—ওর কিসের লড়াই?

প্রিন্সিপাল সাহেব সামনে ছড়িয়ে থাকা চেকবুক, ফাইল—যার অজুহাতে উনি মাঝে মাঝে সকালবেলায় এখানে ভাঙ খেতে আসেন—গোছাতে ব্যস্ত ছিলেন। থেমে গিয়ে বললেন—এর তহসীল অফিস থেকে একটা দলিলের নকল নেয়ার ছিল। কিন্তু এ গোঁ ধরেছে যে একপয়সা ঘুষ দেবে না আর নিয়ম মেনেই নকল আদায় করবে। এদিকে নকল দেয়ার ক্লার্কও গোঁ ধরেছে যে একপয়সা ঘুষ নেবে না এবং কায়দাকানুন মেনে নকল দেবে। এই ওর ধর্মযুদ্ধ ।

রঙ্গনাথ ইতিহাসে এম এ। অনেক যুদ্ধের কারণ ওর পড়া আছে । আলেকজেন্ডার ভারত দখল করবে বলে হামলা করল। পুরু দখল করতে দেবে না –তাই প্রতিরোধ করল। ব্যস, যুদ্ধ শুরু। আলাউদ্দিন বলল—পদ্মিনী চাই; রাণা বলল—দেব না । ব্যস, যুদ্ধ লেগে গেল। সমস্ত লড়াইয়ের গোড়ায় একটাই কারণ। একপক্ষ বলে অমুকটা নেব , অন্যপক্ষ বলে দেব না । ব্যস, লড়াই শুরু।

এখানে তো ল্যাংড়া বলছে --নকল নেব, কিন্তু নিয়ম মেনে । নকল-ক্লার্ক বলছে—নকল দেব, কিন্তু নিয়ম মেনে । তবু লড়াই!

রঙ্গনাথ প্রিন্সিপাল সাহেবকে এই ঐতিহাসিক ধাঁধার মানে জানতে চাইল। বদলে শুনতে হল অবধী ভাষার একটি প্রবাদ, যার সরল মানে হল—‘হাতি আসে, ঘোড়া যায় , উট বেচারা হুমড়ি খায়’। এই প্রবাদটি সম্ভবতঃ কোন চালু চিড়িয়াখানা নিয়ে বলা । কিন্তু রঙ্গনাথ এটুকু টের পেল যে ইশারা কোন সরকারী দপ্তরের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং কত গভীর—তা’ নিয়ে । তবু ও ল্যাংড়া এবং নকলবাবুর মধ্যে চলতে থাকা ধর্মযুদ্ধের কোন থই পেল না । শেষে প্রিন্সিপালসাহেবের কাছে নিজের অবুঝ সমস্যাটি পেশ করে ওনাকে একটু খোলসা করতে অনুরোধ করল ।

উত্তরটা দিল ক্লার্ক।

‘ এসব হল ‘গঞ্জহা’দের (গঞ্জওয়ালাদের) চোঁচলে, মানে প্যাঁচ-পয়জার; সহজে বোঝা দায়,--‘

ল্যাঙড়া থাকে পাঁচ কোশ দূরের এক গাঁয়ে। বিবি মরেছে; ছেলেটার ওপর এমন রাগ যে ওর জন্যে মরা বললেই হয় । ভক্ত মানুষ; কবীর ও দাদুর ভজন গাইত। হল কি , গাইতে গাইতে ক্লান্ত হয়ে একদিন এক দেওয়ানি মামলা দায়ের করে বসল।–

‘ মামলাটার জন্যে একটা পুরনো রায়ের নকল দরকার ছিল, তাই শুরুতে তহসীল অফিসে একটা দরখাস্ত দিল। সেটায় কিছু ত্রুটি ছিল; খারিজ হয়ে গেল। এবার দ্বিতীয় দরখাস্ত। কিছুদিন পরে তহসীল অফিসে আবার গেল—নকল চাইতে। নকলনবিস ব্যাটা মহাচালু; পাঁচটাকা চাইল। ল্যাঙড়া বলল—ঘুষের রেট তো দু’টাকা। লেগে গেল তর্ক। দু-চারজন উকিল কাছেই ছিল। ওরা প্রথমে নকলনবীসকে বোঝাল—ভাই , দু’টাকায় মেনে নাও; বেচারা ল্যাংড়া যে ! নকল পেয়ে তোমার গুণ গাইবে। কিন্তু ব্যাটা একচুল নড়বে না । বুক চিতিয়ে বলল—মরদের এক কথা । মুখ থেকে যা বেরিয়েছে তাই নেব।

‘এবার উকিলের দল ল্যাংড়াকে বোঝাতে গেল। নকলবাবুরও ঘর-গেরস্তি আছে । মেয়েদের বিয়ে বাকি, তাই বাধ্য হয়ে রেট বাড়িয়েছে। তুমিই মেনে নাও , পাঁচটাকা দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে দাও। কিন্তু সেও ঘাড় বাঁকা করল। বলল—আজকাল এই হচ্ছে। মাইনের টাকা যায় মদ-মেয়েছেলের পেছনে তারপর মেয়ের বিয়ে দিতে ঘুষ! নকলবাবু চটে গেল। বলল,’এই কথা! যাও, ঘুষ নেব না; নকল দেব কায়দাকানুন মেনে’। উকিলের দল বোঝালো,‘এমন কোর না , ল্যাংড়া ভক্ত মানুষ, ওর কথা ধরতে নেই’। কিন্তু ওর রাগ সেই যে চড়ল, আর নামল না ।

‘সত্যি বলতে কি লঙ্গড় খুব একটা ভুল বলেনি।এদেশে মেয়ের বিয়ে দেয়াও চুরি করার ওজুহাত হয়ে যায়। এক ব্যাটা ঘুষ নেয় তো আরেকজন বলতে শুরু করে—বেচারা!কী আর করে? বড় পরিবার, মেয়েদের পার করতে হবে তো!

সমস্ত বদমায়েশির শেষ যুক্তি হল মেয়ের বিয়ে, বুঝলেন?

‘যাই হোক, লঙ্গড় আর নকলবাবুর মধ্যে ভারি হাঙ্গামা বেঁধে গেল। তা’ ঘুষটুষের মামলায় হুজ্জত-হাঙ্গামা হয়েই থাকে। আগেকার দিনে পাকা কাজ হত। লোকজন ছিল এককথার মানুষ। একটা টাকা ধরিয়ে দাও, পরের দিন নকল তৈরি।আজকাল চাকরিতে সব স্কুল পাশ করা নতুন নতুন ছেলেপুলে ঢুকে লেনদেনের রেট খারাপ করে দিয়েছে। এদের দেখাদেখি পুরনো লোকেরাও বেগড়বাঁই শুরু করেছে। ফলে ঘুষ দেয়া আর ঘুষ নেয়া—দুটোই বড্ড ঝঞ্ঝাট।

‘এবার লঙ্গড়েরও মেজাজ চড়ে গেল।ও গলার কন্ঠি ছুঁয়ে বলল-ঠিক আছে বাবু, তুমি যখন নিয়মকানুন মেনে চলবে তো আমিও তাই। এবার তোমায় একটা কাণাকড়িও দেব না। আমি দরখাস্ত দিয়েছি, আজ নয় কাল আমার পালা আসবেই।

'এবার লঙ্গর গিয়ে তহসীলদার সায়েবকে সব খুলে বলল। তহসীলদার প্রথমে একচোট প্রাণখুলে হেসে নিল। তারপর বলল,সাবাশ লঙ্গড়। তোমার আর ও’সব লেনদেনের ঝামেলায় পড়তে হবেনা। নম্বর আসুক, নকল ঠিক পেয়ে যাবে। পেশকারকে ডেকে বলে দিল-দেখ, লঙ্গড় বেচারা চারমাস ধরে ভুগছে। এবার যেন সবকিছু নিয়মমত হয়, ওকে যেন কেউ কষ্ট না দেয়।পেশকার বলল, সরকার! এই লঙ্গড় ব্যাটা মহাখ্যাপা। আপনি আর এর ব্যাপারে নাই এলেন।

‘তখন লঙ্গড় পেশকারের উপর খেপে উঠল। দু’জনের মধ্যে তর্জা বেঁধে গেল। তহশীলদার কোনরকমে এদের সামলালেন।

‘লঙ্গড় জানে যে নকলবাবু কোন-না-কোন অজুহাতে ওর দরখাস্ত খারিজ করে দেবে। দরখাস্ত হল পিঁপড়ের মত, যখন ইচ্ছে যে কেউ খারিজ করে দিতে পারে। এর জন্যে কোন বিশেষ কসরত করতে হয়না। যেমন ফীসের টিকিট কম লাগানো হয়েছে, প্রাপ্তকর্তার ঠিকানায় ভুল আছে অথবা অমুক কলম খালি রয়ে গেয়েছে—এসব লিখে নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে দাও। তারপর নির্ধারিত তারিখের মধ্যে ত্রুটি শুধরে না নিলে দাও দরখাস্ত খারিজ করে।

‘তাই লঙ্গড়ও কোমর বেঁধে লেগে পড়ল। ও ঘরের দরজায় তালা ঝুলিয়ে নিজের গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আস্তানা গাড়ল। খেতখামার,ফসল, হাল-বলদ সব ভগবানের ভরসায় ছেড়ে এসেছে। ওর রোজকার কাজ হল সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত তহশীল অফিসে নোটিশ বোর্ডের আশেপাশে চক্কর লাগানো। ওর ভয় যে হতে পারে ওর দরখাস্তের কোন ত্রুটির ব্যাপারে কোন খবর নোটিশ বোর্ডে টাঙানো হল, কিন্তু ওর চোখ এড়িয়ে যাওয়ায় শোধরানোর তারিখ পেরিয়ে গেল আর দরখাস্ত খারিজ হয়ে গেল! একবার এমনই হয়েছিল বটে।

‘ও নকল পাওয়ার সমস্ত নিয়ম কানুন শিখে নিল।ফীসের পুরো চার্ট ওর মুখস্থ। দেখুন, মানুষের যখন কপাল খারাপ হয়, তখনই তার থানা-আদালতের চক্কর লাগানোর দিন আসে। এখন লঙ্গড়েরও ভাগ্য বিমুখ। কিন্তু ব্যাটা এদানীং এমন করে তহসীল অফিসের পেছনে লেগেছে যেন নকল আদায় করেই ছাড়বে’।

রঙ্গনাথ নিজের জীবনে খুব একটা বোকামি করেনি। কাজেই ওকে এ লাইনে অভিজ্ঞ বলা উচিত হবেনা।লঙ্গড়ের কাহিনীটি ওর মনে গভীর প্রভাব ফেলল, তাই ওর মনে হল ‘কিছু একটা করতে হবে’। কিন্তু কী করা উচিত তা নিয়ে ওর মনে কোন স্পষ্ট ধারণা নেই।যাহোক, ভেতরে ভেতরে ছটফটানি অসহ্য হয়ে ওঠায় ও বলে উঠল—‘ এসব ভারি অন্যায়। কিছু একটা করা উচিত’।

ক্লার্ক শিকারী কুকুরের মতন ঝাঁপিয়ে কথাটা লুফে নিল। ‘কী করবে তুমি রঙ্গনাথ বাবু? কে কী করবে?যার ছেঁড়ে, শুধু তারই জ্বলে।সবাই যদি নিজের নিজের ভার বয়ে নেয়, সেটাই অনেক। অন্যের ভার কে বইতে পারে? ভাইয়া, হরেদরে দাঁড়াল এই যে তুমি তোমার দাদ ওপাশ দিয়ে চুলকে নাও তো’ আমি আমারটা এ’পাশ দিয়ে, ব্যস্‌’।

ক্লার্ক উঠে দাঁড়াল। প্রিন্সিপাল সায়েব ঘরের এপাশ ওপাশ একনজর দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,’বদ্রীভাইয়াকে দেখছি না যে?’

বৈদ্যজী মুখ খুললেন,’ একজন কুটুম ডাকাতির ঘটনায় ফেঁসে গেছে। পুলিশের লীলা বোঝা দায়, জানই তো। বদ্রী গেছল ওখানেই, বোধহয় আজ ফিরবে’।

শনিচর চৌকাঠের কাছে বসেছিল। ঠোঁট গোল করে সিটি বাজানোর মত শব্দ করে বলল,’ যতক্ষণ না আসে ততক্ষণই মঙ্গল’।

প্রিন্সিপল সায়েব ভাঙের নেশায় ভুলে গেছেন-আরাম হারাম হ্যায়।

উনি এবার একটা বড়সড় তাকিয়া টেনে নিয়ে গুছিয়ে বসে বললেন,’কী ব্যাপার হে’?

শনিচর গলা নামিয়ে ধীরে ধীরে বলল,’ কো-অপারেটিভে গবন মানে, পয়সার হিসেবে গন্ডগোল হয়েছে।বদ্রীভাইয়ার কানে পৌঁছলে সুপারভাইজারকে জ্যান্ত চিবিয়ে খাবেন’।

প্রিন্সিপাল ভয় পেলেন। উনিও গলা নামিয়ে বললেন,’ তাই নাকি’?

শনিচর মাথা নীচু করে ফুসফুসিয়ে কিছু বলা শুরু করল।এদের দু’জনের কথাবার্তা চলছিল পার্শী থিয়েটারের সেই অখিল ভারতীয় স্টাইলে যাতে স্টেজে একজন পাত্র আরেকজনকে কিছু বলে যা ওর পাশে দাঁড়ানো তৃতীয় ব্যক্তি শুনতে পায়না, অথচ একশ’ গজ দূরের দর্শক ও শ্রোতারা সব শুনতে পায়; এবং হলের সমস্ত জনতা বুঝতে পারে এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে, ব্যতিক্রম শুধু ওই দ্বিতীয় পাত্র যাকে কথাটা বলা হল।

সংক্ষেপে, ব্যাটা শনিচর আমাদের গোপন কথাটি বলার যে চিরন্তন শৈলী তার অনুকরণ করে প্রিন্সিপাল সায়েবকে কিছু বলতে শুরু করল।

কিন্তু বৈদ্যজী কঠিন স্বর। -কী মেয়েদের মত গুজগুজ করছ? কো-অপারেটিভে তছরূপ হয়েছে তো কার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে? কোন ইউনিয়নে এসব হয় না?

একটু দম নিয়ে তারপর উনি কাউকে বোঝানোর ভঙ্গীতে বললেন—দেখ, এতদিন আমাদের ইউনিয়নে কোন গবন বা তবিল তছরূপ ঘটেনি, তাই লোকে আমাদের সন্দেহের চোখে দেখত। ভাল হল গবন হয়েছে, এখন তো বলা যাবে যে আমরা সৎলোক, যা ঘটেছে তা জানিয়ে দিয়েছি।কিচ্ছু লুকোই নি।

লম্বা শ্বাস নিয়ে উনি কথাটা শেষ করলেন।– যা হবার তা ভালই হল। একটা কাঁটা বেরিয়ে গেল, চিন্তা দূর হল।

প্রিন্সিপাল সায়েব তাকিয়ায় পিঠ দিয়ে পাথরের মত বসেছিলেন। এবার একটা এমন মন্তব্য করলেন যা সবাই জানে।– মানুষ আজকাল বড্ড বেইমান হয়ে গেছে।

এই কথাটি বড় উপকারী, সবার দরকারে লাগে। সব ভালোমানুষেরা দিনে তিনচার বার খাওয়ার পরে মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট গেলার মত এটার ব্যবহার করে থাকেন।কিন্তু ক্লার্কের কথাটা গায়ে লাগল। ও পালটা দিল, ‘সবাই সমান নয়। আমাদের কলেজে তো আজ পর্য্যন্ত এ’রকম হয় নি’।

বৈদ্যজী ওর দিকে পরম সুহৃদের মত তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন—কলেজে গবন আমি

আসলে কো-অপারেটিভে গবন হয়েছে গমের গুদামের স্টকে। ওঁর ইশারা সেদিকে।

এটা উনি ঠাট্টা করে বললেন। ব্যস্‌, প্রিন্সিপাল হেসে উঠলেন। একবার হাসির হররা ছুটলে তাতে তাল দেয় ভাঙের নেশা।উনি হাসতেই থাকলেন।কিন্তু ক্লার্কের ব্যক্তিগত খোঁচা নিয়ে সন্দেহ যায়নি।ও বলে উঠল,’ কিন্তু চাচা, কলেজে তো গন্ডা গন্ডা গোবরের ভান্ডার। সবক’টার মাথায় গোবর পোরা’।

এতে সবার হাসি। শনিচর ও রঙ্গনাথও তাতে যোগ দিল। হাসির ঢেউ বাইরের চাতাল অব্দি ছড়িয়ে গেল। দরবারে বসে থাকা কিছু ফালতু লোকও না বুঝে হেসে উঠল। ক্লার্ক চোখের ইশারায় প্রিন্সিপালকে বলল—এবার উঠলে হয়।

আমাদের সভ্যতার গৌরবময়ী ট্র্যাডিশন হল আসল কথা দু’চার ঘন্টা আলাপ ও তর্কের পর শেষ সময়ে বলা হয়।তাই বৈদ্যজী এবার প্রিন্সিপালকে শুধোলেন—আর কিছু?

‘কিছু না, ওই খান্না মাস্টারের ব্যাপারটা। পরশুদিন ক্লাসে কালো চশমা লাগিয়ে পড়াচ্ছিল। আমি ওখানেই ওকে ‘ফিক’ করে দিয়েছি। বাচ্চাগুলোর মাথা খাচ্ছিল। আমি বললাম, শোন হে,তোমাকে আমি এখানেই রগড়ে ‘ফিতা’ বানিয়ে দিতে পারি’।

প্রিন্সিপাল নিজেকে অনেক সামলাচ্ছেন, কিন্তু রাগের মাথায় ওঁর কথাবার্তায় যেখানে সেখানে ‘ফ’ ঢুকে পড়ে।

বৈদ্যজী গম্ভীর।

‘এমন করা উচিত হয়নি। বিরোধীদেরও সম্মান করতে হয়। দেখ, প্রত্যেক বড় নেতার এক-একজন করে বিরোধী থাকে। সবাই নিজের নিজের পছন্দসই বিরোধী বেছে নেয়। এই হল গণতন্ত্রের নিয়ম। আমাদের নেতারা কত ভদ্রভাবে নিজের বিরোধীদের মোকাবিলা করেন।বিরোধীরা ওদের বকবকানি চালিয়ে যায় আর নেতারা ওদের কথায় কান না দিয়ে চুপচাপ নিজের চাল চেলে দেন।কেউ কারও কথায় চলেনা।এই হল আদর্শ বিরোধ; আমাদেরও ওই কায়দায় চলতে হবে’।

রাজনীতির এসব মৌলিক নীতির ক্লার্কের উপর কোন প্রভাব পড়েনি। বলল,’ এসবে কোন কাজ হয় না। খান্না মাস্টারকে ভাল করে চিনি। ইতিহাসের এম এ, কিন্তু নিজের বাপের নাম বলতে পারবে না। কোন কম্মের নয়, শুধু দলাদলিতে উৎসাহ। ছাত্রদের নিজের ঘরে ডেকে জুয়ো খেলায়।ওর একটাই ওষুধ—ধরুন ঠেসে, লাগান দমাদ্দম!

এই কথায় বৈদ্যজী আরও গম্ভীর, কিন্তু লোকের উৎসাহ বেড়ে গেল।কথা ঘুরে গেল জুতো মারার পদ্ধতি আর প্রথার দিকে। শনিচরের উৎসাহ দেখে কে! ‘ যখন খান্নাকে দনাদ্দন-দনাদ্দন দেয়া হবে তখন আমাকে ডাকতে ভুলো না।অনেকদিন কাউকে জুতো পেটা করি নি। আমিও দু’চার ঘা দেব’।

একজন ফাটা জুতো তিনদিন জলে ভিজিয়ে রাখলে পেটানোর সময় চমৎকার শব্দ বেরোয় আর দূর-দূরান্তরে লোকেরা টের পায় যে আজ জুতোপেটা চলছে।আর একজন বলল, যদি লেখাপড়া জানা লোককে পেটাতে হয়, তাহলে ‘গোরক্ষক’ জুতোই ভাল। মারও পড়বে, কিন্তু বেশি অপমান হবে না। চাতালে বসা আর এক পন্ডিতের পরামর্শ হলঃ জুতো মারার সবচেয়ে ভাল উপায় হল এক দুই করে গুনে গুনে জুতো লাগাও কিন্তু নিরানব্বইয়ে পৌঁছে আগের গুণতি ভুলে আবার এক থেকে পেটাতে শুরু কর। চতুর্থজন মাথা নেড়ে সায় দিল—এটাই সঠিক পদ্ধতি। তাই আমি আজকাল এক থেকে একশ’ অব্দি গোনা শিখছি। (চলবে)

0 comments:

0

গল্প - মনোজ কর

Posted in








সপ্তম পর্ব

সিরাজের প্রতি-আক্রমণ ও আলিনগর চুক্তি

কলকাতা কাউন্সিল কয়েকদিনের মধ্যেই ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে দিল।২৬শে জানুয়ারি ঠিক হল যে মেজর ক্লিপট্রিকের নেতৃত্বে এক সেনাবাহিনী গঠন করা হবে আভ্যন্তরীন সুরক্ষার জন্য। এছাড়াও দ্রুত কিছু অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেবার কথা ভাবা হল। ঠিক হল যে দেশি তাঁতিদের সুরক্ষা এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে যাতে তারা আবার কাজ শুরু করতে পারে। জমিদারদের বলা হল তারা যেন প্রচার করে যে তাঁতিদের সুরক্ষা এবং কাপড় উৎপাদন ও বিক্রির ব্যাপারে কোম্পানি পূর্ণ সহযোগিতা করবে। স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং কর্মচারিরা যারা যুদ্ধের সময় নবাবের বাহিনীকে সাহায্য না করে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছিল তাদের সকলকে কোম্পানি এলাকায় ফিরিয়ে আনা হবে, তাদের বাড়ি সারানোর , সংসার চালানোর এবং আবার করে ব্যবসা শুরু করার জন্য সাময়িক সাহায্য করা হবে। যারা যুদ্ধের সময় নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবে নবাবের বাহিনীকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছিল তাদের কোনও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না। কোম্পানি কর্মচারিরা যারা এতদিন বাড়ি ছেড়ে ছিল তাদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করা হবে। মাসিক বেতন ছাড়াও এই ভাতার কারণ যুদ্ধের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ বাসস্থানের সংস্কার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি। চাকুরির শ্রেণী অনুসারে বিশেষ মাসিক ভাতার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হল।

প্রেসিডেন্ট- ৩০০ টাকা

কাউন্সিল মেম্বার-১০০ টাকা

ছোট এবং বড় ব্যবসায়ী- ৭০ টাকা

অন্যান্যরা- ৪০টাকা

এই বিশেষ ভাতা কার্যকরী হল ১লা জানুয়ারি, ১৭৫৭ থেকে। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে কলকাতা কাউন্সিল লন্ডনে কোম্পানির বোর্ডে জানালো যে বাঙলা থেকে অফিসারদের ইরাক পাঠানো হোক পারসি শেখার জন্য। পারসি শেখা অত্যন্ত জরুরি কারণ নবাবের সমস্ত নথিপত্র পারসিতে লেখা।স্থানীয় পারসি জানা লোকেরা যথেষ্ট শিক্ষিত নয় এই কাজের জন্য। কিন্তু আগে নবাবাকে সামলানো দরকার । কেবল ভাষা বুঝে কোনও লাভ নেই।

ব্রিটিশদের ১০ এবং ১১ই জানুয়ারির হুগলি আক্রমণ সিরাজকে অস্থির করে তুলল। তীব্র প্রতিশোধস্পৃহা তার রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছিল। আর দেরি না করে সিরাজ রওনা দিল কলকাতার উদ্দেশ্যে। সঙ্গে বেছে নিল মিরজাফর আর রায়দুর্লভকে। এদিকে জগতশেঠ এবং উমাচাঁদ সিরাজের আধিপত্য এবং দুর্ব্যবহার সহ্য করতে না পারলেও তার বিরুদ্ধে যাবার বিশেষ করে ব্রিটিশদের পক্ষে যোগ দেবার সাহস তখনও সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি। সুতরাং দু’জনেই তখনও দু’নৌকায় পা দিয়েই চলতে থাকল। জগতশেঠ এবং উমাচাঁদ সিরাজের অতিবিশ্বস্ত জমিদার রণজিৎ রাইকে মধ্যস্থতার কাজে লাগিয়ে গত জুনের যুদ্ধের সময় সম্পত্তির যা ক্ষতি হয়েছিল তা উশুল করার জন্য একদিকে যেমন ব্রিটিশদের শরণাপন্ন হল আবার অন্যদিকে মুর্শিদাবাদে গিয়ে সিরাজের অতি ঘনিষ্ঠ মোহনলালের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে কিছু সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে সক্ষম হল।

অন্যদিকে ক্লাইভ এবং ওয়াটসনকে পেয়ে ব্রিটিশরা নতুন উদ্যমে সিরাজের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিল। কলকাতা থেকে উত্তরে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে হুগলির প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার ভিতরে সুরক্ষিত ক্যাম্প বানিয়ে সিরাজের বাহিনীর আসার প্রতীক্ষায় রইল ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী। মাদ্রাজ থেকে মেরামত হয়ে ফিরে এসেছে গোলা-বারুদবাহী জাহাজ মার্লবোরো। সুতরাং কামান বন্দুকের কোনও অভাব নেই। সিরাজের বাহিনী হুগলির উত্তরে নদী অতিক্রম করে এগিয়ে আসতে লাগল। আর একটা বাহিনী পুর্বদিকের তীর ধরে দক্ষিণে এগোতে থাকল। ক্লাইভের ভয় ছিল যে যখন নবাবের আর একটা বাহিনী পশ্চিমের তীর ধরে আসার সময় চন্দননগর অতিক্রম করবে তখন ফরাসি সৈন্যরা নবাবের সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটল না। যদিও ইউরোপের যুদ্ধের খবর এসে পৌঁছেছে তবুও গঙ্গাবক্ষে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করল না ফরাসিরা। তা সত্ত্বেও অতিসাবধানি ক্লাইভ নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না। পরিস্থিতি ব্রিটিশদের পক্ষে সুবিধাজনক থাকলেও সংখ্যার হিসাবে সিরাজের সৈন্য বেশি ছিল। ৩০শে জানুয়ারি রণজিৎ রাইএর উদ্যোগে ক্লাইভ সিরাজের কাছে শান্তির আবেদন জানাল। সিরাজ কিন্তু তার নিজস্ব ভঙ্গীমায় শান্তি আবেদনের প্রতি সমর্থন জানালেও অভিযান বন্ধ করার কোনও প্রতিশ্রুতি দিল না। সিরাজের বাহিনী এগিয়ে চলল অব্যাহত গতিতে। খাওয়াজা পেট্রাসের দৌত্যে দুই শিবিরে পত্র বিনিময় চলতে থাকল। ২রা ফেব্রুয়ারি কিছুক্ষণের জন্য অভিযান বন্ধ থাকায় মনে হল হয়ত সিরাজ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সাময়িকভাবে অভিযান বন্ধ রেখে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটল না। পরের দিন সিরাজের বাহিনী পূর্ণ গতিতে কলকাতার দিকে এগিয়ে চলল। রাস্তার দু’ধারের গ্রামগুলো দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল। চতুর ক্লাইভ সিরাজের বাহিনীকে বিনা বাধায় এগিয়ে আসতে দিল। দুপুরের দিকে সিরাজের বাহিনী উত্তরের স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়িগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়ে এগিয়ে এসে এমন জায়গায় পৌঁছলো যার একদিকে জলাভূমি আর অন্যদিকে ব্রিটিশ নৌসেনা। ক্লাইভের ফাঁদে পা দিয়ে বেশ কয়েকজন সৈন্য প্রাণ হারাল আর বন্দি হল প্রায় পঞ্চাশজন। সিরাজ যুদ্ধবিরতির নির্দেশ দিল। কিন্তু সিরাজের সৈন্যরা এগিয়ে চলল। এরকমই ঘটে প্রতিবার। শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করার এ এক কৌশল। শহরের উত্তরে ব্রিটিশ ক্যাম্পের পূর্বে এবং দক্ষিণ-পূর্বে শ’য়ে শ’য়ে নবাবের সেনা জড়ো হল। ক্যাম্পের প্রায় অন্তর্গত একটা বাগানে সিরাজের সৈন্যরা নিষেধসত্ত্বেও অনুপ্রবেশ করায় ক্লাইভের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। বেশ কিছু সৈন্য নিয়ে ক্লাইভ আক্রমণ চালাতেই সিরাজের সৈন্যরা গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করল। প্রায় একঘন্টা ধরে যুদ্ধ এবং বেশ কিছু রক্তপাতের পর সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইভ সৈন্যদের নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে গেল।

পরেরদিন অর্থাৎ ৪ঠা ফেব্রুয়ারি সিরাজের মূলবাহিনী এগিয়ে গেলেও সিরাজ নিজে কয়েক কিলোমিটার পিছনে নবাবগঞ্জ নামে একটা গ্রামে কঠোর নিরাপত্তা সহযোগে বিশ্রাম করছিল। ক্লাইভকে চিঠি পাঠিয়ে নবাবগঞ্জে প্রতিনিধি পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানাল সিরাজ। এই চিঠির জন্য গত দু’দিন ধরে অপেক্ষা করে ছিল ক্লাইভ। চিঠি পাবার সঙ্গে সঙ্গেই ওয়ালশ এবং স্ক্রাফটনকে সিরাজের কাছে পাঠানো হল। নবাবগঞ্জে পৌঁছে জানা গেল সিরাজ অন্যত্র অবস্থান করছে। ব্রিটিশরা যদি গোপনে তাকে বন্দি করার জন্য নবাবগঞ্জে সৈন্য পাঠায় তাই শেষ মুহূর্তে স্থান বদল করে ফেলেছিল সিরাজ। নবাবগঞ্জ থেকে নবাবের সেনা পরিবৃত হয়ে ব্রিটিশ প্রতিনিধিরা সিরাজের কাছে পৌঁছে বুঝল যে প্রচুর সৈন্যসামন্ত নিয়ে সিরাজ রয়েছে ব্রিটিশ ক্যাম্পের খুব কাছেই উমাচাঁদের বাগানবাড়িতে।

রণজিৎ রাই ওয়ালশ এবং স্ক্রাফটনকে রায়দুর্লভের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। রায়দুর্লভ প্রতিনিধিদের জানাল যে তাদের সন্দেহ হচ্ছে যে নবাবকে হত্যা করার কোনও পরিকল্পনা থাকতে পারে ব্রিটিশদের তাই তাদের সার্চ করে দেখা হবে যে লুকিয়ে তারা সঙ্গে করে পিস্তল নিয়ে যাচ্ছে কি না। এছাড়াও তারা সঙ্গে করে তরোয়াল নিয়ে যেতে পারবে না। ব্রিটিশ প্রতিনিধিরা রায়দুর্লভের এই প্রস্তাবে সম্মত হল না। নবাবের অনুমতি নিয়ে রায়দুর্লভ এদের নবাবের কাছে হাজির করল। নবাবের পাশে বসে থাকা দীর্ঘ পোশাক এবং পাগড়ি পরিহিত বিশালাকৃতি রক্ষীদের চোখ দেখে মনে হচ্ছিল তারা ব্রিটিশ প্রতিনিধিদের হত্যার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছে। দুই প্রতিনিধি সিরাজকে জানিয়ে দিল যে শান্তি আলোচনা চলার সময় বিনা প্ররোচনায় ব্রিটিশ এলাকায় অনুপ্রবেশ করে নবাব ঠিক কাজ করেনি। নবাব প্রেরিত শান্তিপ্রস্তাব সে ক্ষেত্রে হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। এরপর প্রতিনিধিরা তাদের লিখিত প্রস্তাব সিরাজের হাতে তুলে দিল। ক্রুদ্ধ সিরাজ সেই প্রস্তাব ভাল করে না পড়েই পাশে বসে থাকা এক আধিকারিককে ডেকে বলল এদের দু’জনকে দেওয়ানের কাছে নিয়ে যেতে। প্রতিনিধিরা সভাকক্ষ থেকে বেরতেই উমাচাঁদ তাদের ডেকে সাবধান করে দিল এবং জানাল যে নবাবেরর কামান যে কোনও মুহূর্তে তাদের পথ আটকে দাঁড়াতে পারে। প্রতিনিধিদের সন্দেহ হল দেওয়ানের কাছে গেলে তাদের বন্দি করে কারাগারে পাঠানো হতে পারে। সঙ্গে যারা এসেছিল তাদের সমস্ত আলো নিভিয়ে দিতে বলে বড় রাস্তা দিয়ে না গিয়ে দু’জনে ঘুরপথে শিবিরে পৌঁছে গেল। ক্লাইভের কাছে তারা সবকথা বিস্তারিত ভাবে জানালো। সেই মুহূর্তে ক্লাইভ সিদ্ধান্ত নিল আর দেরি নয় কাল সকালেই হানতে হবে অতর্কিত আক্রমণ । ৫ই ফেব্রুয়ারি মাঝরাতে আগ্নেয়াস্ত্রসমেত ছ’শ সৈন্য জাহাজ থেকে নামল । তাদের সঙ্গে যোগ দিল সাড়ে ছ’শ ইউরোপিয়ান সেনা, এক’শ পদাতিক সৈন্য আর আট’শ সেপাই।ভোর হবার আগেই অভিযান শুরু করে দিল ক্লাইভ। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্লাইভের বাহিনী ঘন কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে উমাচাঁদের বাগানে পৌঁছে গেল। এদিকে মিরজাফরের নেতৃত্বে একদল সৈন্য উমাচাঁদের বাগানে রয়ে গেল সিরাজের নিরাপত্তার জন্য। বাকি সৈন্যরা কিছুটা অপরিকল্পিতভাবে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রইল। উমাচাঁদের বাগানে যেতে যেতেই ক্লাইভের কানে এল বিশাল দ্রুতগামী অশ্বারোহী বাহিনীর পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার আওয়াজ। কুয়াশায় কিছু দেখতে না পেয়ে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করল ক্লাইভের বাহিনী। কিন্তু সিরাজের সৈন্যরা ক্রমাগত উল্টোদিক থেকে গোলাবর্ষণ করতে থাকল। বাগানের দক্ষিণ থেকে মাইলখানেক আগে রাস্তাটা সরু হয়ে গেছে এবং রাস্তার পাশে ধানজমি। ধানজমির মাঝখানে আল দিয়ে জমি ভাগ করা আছে।সরু রাস্তা দিয়ে একটু এগোতেই নবাবের সৈন্যদের মুখোমুখি পড়ে গেল ব্রিটিশ সৈন্যরা। নবাবের সৈন্যদের আক্রমণ আর গোলার হাত থেকে বাঁচার জন্য পাশের ধানক্ষেতে নেমে পড়ল ব্রিটিশ সৈন্যরা। কিন্তু অসমতল ধানজমি আর আলে বাধা পেয়ে কামানগুলো টানাই সম্ভব হচ্ছিল না তাদের। এই সুযোগে গোলাবর্ষণ বাড়িয়ে দিল সিরাজের সৈন্যরা। পিছু হটতে হটতে ব্রিটিশ সৈন্যরা যখন নিজেদের দূর্গে পৌঁছলো তখন সকাল দশটা। সাতাশ জন সৈন্য এবং আঠারোজন সেপাই নিহত ও সত্তরজন সৈন্য এবং পয়ঁত্রিশজন সেপাই আহত হয়েছিল এই যুদ্ধে। নিহতদের মধ্যে ছিল দু’জন ক্যাপটেন। ক্লাইভের ব্যক্তিগত সচিব বেলসেরের একটি পা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল গোলার আঘাতে।

এই পরাজয়ে মনোবল ভেঙ্গে পড়ল ক্লাইভের সেনাপতিদের। ক্লাইভের মতো একজন অভিজ্ঞ এবং কুশলী সেনাধিপতি কী করে নিজের সেনাবাহিনীকে বিনা প্রয়োজনে এত বড় ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিল সে কথা তারা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না। নানা সন্দেহ তাদের মনে বাসা বাঁধতে শুরু করল। এমনকি মাদ্রাজ কাউন্সিলে ক্লাইভের সহকর্মিরা ক্লাইভের যুদ্ধ পরিচালনার দক্ষতা সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন তুলতে শুরু করল। কিন্তু ক্লাইভ যুক্তি দিল যে তারা যে ভয় পেয়ে চুপ করে বসে থাকবে না সেটা সিরাজকে বোঝানোর জন্য অন্য কোনও রাস্তা ছিল না। এই অতর্কিত আক্রমণ তাদের দিক থেকে কিছুটা বেশি ঝুঁকির হলেও তারা যে প্রয়োজনে বড় ঝুঁকি নিতে পারে সে কথাটা সিরাজের মাথার মধ্যে ঢোকানোর দরকার ছিল। আসলে ঘটেছিলও তাই। ক্লাইভকে আপাতত প্রতিহত করা গেলেও সিরাজের মধ্যে ব্রিটিশদের শক্তি সম্বন্ধে যে ভুল ধারণা ছিল সেটা কেটে গেল। এই যুদ্ধে সিরাজেরও কম ক্ষতি হয়নি।বাইশজন ভালো অফিসার, ছ’শ সাধারণ মানুষ, চারটে হাতি, পাঁচ’শ ঘোড়া এবং বেশ কয়েকটা বলদ ও উট নিহত হয়েছে এই যুদ্ধে। সিরাজ একেবারে সামনে থেকে দেখেছে এই যুদ্ধের ভয়াবহতা। যে কোনও মুহূর্তে তার জীবন বিপন্ন হতে পারত সে কথা সে ভালোভাবেই বুঝে গেছে। সে বুঝেছে মুখে আস্ফালন করলেও তার সেনাপতিদের মুরোদ আসলে অনেক কম। নিজের অফিসারেরা ক্ষমা না চাইলে এবং ভবিষ্যতে আর ভুল করবে না এই প্রতিশ্রুতি না দিলে তাদের বহিষ্কারের আদেশনামায় সই করেই ফেলেছিল সিরাজ। এদের না তাড়ালেও এই সমস্ত দুর্বলচিত্ত ভীরু অফিসারদের দিয়ে যে ক্লাইভের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে না সিরাজ এই যুদ্ধে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। ক্লাইভ হেরেছে তার নিজের ভুলের জন্য। এর জন্য তার সেনাপতিদের যে কোনও কৃতিত্ব নেই সে কথা সেনাপতিদের বলতে কসুর করেনি সিরাজ।

এমতাবস্থায় যা হওয়ার কথা তাই হলো। রণজিৎ রাইকে দিয়ে ক্লাইভের কাছে শান্তি আলোচনার প্রস্তাব পাঠাল সন্ত্রস্ত সিরাজ। ক্লাইভ সাগ্রহে সম্মত হলেও এ কথা জানাতে ছাড়ল না যে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে হত্যা করেনি। একমাত্র যারা তাদের সামনে এসে গিয়েছিল বা সামনাসামনি আক্রমণ করেছিল নিজেদের বাঁচার জন্য তাদের হত্যা করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিলনা তার কাছে। চিঠি দেওয়া নেওয়া চলাকালীন ক্লাইভের প্রতি মানসিক চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সিরাজের দিক থেকে নিজের শক্তি ও ঔদ্ধত্য প্রদর্শনের পরিকল্পিত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ক্লাইভ শান্তির পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে সচেতন রইল। অবশেষে ৯ই ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষরিত হল ঐতিহাসিক আলিনগর চুক্তি। এই চুক্তিতে সিরাজ তার সৈন্যবাহিনীর আক্রমণের জন্য কোম্পানির যা ক্ষতি হয়েছে তার সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হওয়া ছাড়াও কোম্পানির দূর্গ নির্মাণের ব্যাপারে সম্মতি দিল। এছাড়াও ব্রিটিশদের স্বর্ণ এবং রৌপ্যমুদ্রা বানানোতে তার যে কোনও আপত্তি নেই সে কথাও লেখা রইল এই চুক্তিতে। বাঙলায় করমুক্ত ব্যবসার অনুমতি ছাড়াও আটত্রিশটি গ্রামের মালিকানা লিখে দিল সিরাজ ব্রিটিশদের নামে। সিরাজের দিক থেকে মিরজাফর এবং রায়দুর্লভ এই চুক্তির সাক্ষী রইল। সিরাজের এই আকস্মিক এবং অপমানজনক পশ্চাদপসরণের আসল কারণ সকলের পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না। ১১ই ফেব্রুয়ারি মিরজাফর এবং রায়দুর্লভকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা থেকে বেশ কিছু মাইল উত্তরে পিছিয়ে গেল সিরাজ এবং তার বাহিনী। ব্রিটিশদের সঙ্গে সমঝোতা করে চলার বার্তা সিরাজের আচার আচরণে বেশ ভালোভাবেই প্রকাশ পেতে লাগল। ব্রিটিশদের সঙ্গে আরও কয়েকটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হল পরের দিন অর্থাৎ ১২ই ফেব্রুয়ারি।

শান্তিস্থাপনের প্রক্রিয়া চলাকালীন উমাচাঁদের মাধ্যমে ক্লাইভ সিরাজের কাছে জানতে চাইল যে চন্দননগরে ফরাসি উপনিবেশ আক্রমণের ব্যাপারে তার সম্মতি পাওয়া যাবে কি না। সিরাজ যদিও এই প্রস্তাবের পক্ষে ছিলনা কিন্তু সরাসরি এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান না করে জানাল যে যদি ফরাসিরা তাদের এলাকায় অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে তবে তাদের বাধাদানের ক্ষেত্রে তার কোনও আপত্তি নেই। সিরাজ এ কথাও জানালো যে কুড়িজন ব্রিটিশ সৈন্যকে সে তার নিজের বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় এবং কোম্পানির প্রতিনিধি হিসাবে কাশিমবাজার ফ্যাক্টরির প্রধান ওয়াটসকে সে নিজের দরবারে স্থান দিতে পারে। সিরাজের কাছ থেকে চন্দননগর আক্রমণের ব্যাপারে কোনও সরাসরি আপত্তি না পেয়ে ক্লাইভ চন্দননগর আক্রমণের সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলল। ১৮ই ফেব্রুয়ারি ক্লাইভের বাহিনী শুরু করল চন্দননগর অভিযান।

0 comments:

0

গল্প - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in






ভূমধ্যসাগরের হাওয়াতেও অনবরত জীবন-মৃত্যুর ফানুস! হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা স্ট্রিপ থেকে ইসরায়েলের দিকে ছুটে এলো পর পর কতগুলো এরোপ্লেন। এই আক্রমণের কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসরায়েলের পাল্টা আক্রমণ! ইসরায়েলের মিলিটারি কমান্ডারের ওয়ারলেস-বার্তা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়লো – ‘স্ট্রাইক! ডোণ্ট লুক বিহাইন্ড!’

প্রচন্ড শব্দ! গাজা শহরের ‘শোরেউক টাওয়ার’টা বালির পাহাড়ের মতো নিমেষেই ধ্বসে পড়লো। নাসিমা ভেঙে পড়া বিল্ডিং আর দাউদাউ আগুনের থেকে কিছুটা দূরে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে! পাশেই আলায়েনের রক্তমাখা শরীরটা। একটা অচেনা আঙ্কেল দৌড়ে এসে তার কাঁধে ঠেলা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো – ‘হেই লেড়কী, ভাগ্‌ ভাগ্‌ হিয়াসে! সবাই যেদিকে পালাচ্ছে সেদিকে ভাগ্‌!’

চার দিকে ধূলোর ঝড়। আগুনের হলকায় গায়ের চামড়া জ্বলে যাচ্ছে! বেশী কিছু বুঝে উঠবার আগে নাসিমা পালাতে শুরু করলো। ওদিকে ওর জিগরী দোস্ত আলায়েন যে রক্ত মেখে বারান্দায় শুয়ে আছে!



#

চারদিকে ভয়াবহ অবস্থা! ওরা থাকে শেরেউক টাওয়ারের একটা ফ্লাটে। গতকাল রাতে ঘুম আসার আগে নাসিমার নজরে এসেছিল - তার আম্মু আর আব্বুর মানসিক উত্তেজনা ভরা কথাবার্তা। যে কোন মুহূর্তেই এই গাজা শহরে আবার হামলা হতে পারে। এসব শুনতে শুনতে নাসিমা বিন্দাস ঘুমিয়ে পড়েছিলো।

দিন-রাতের উত্তেজনা এ গাজা শহরে খুবই স্বাভাবিক! এর কারণ লুকিয়ে আছে ইহুদি-প্রধান ইজরায়েল, হামাস উপদ্রুত গাজা-স্ট্রিপ, প্যালেস্টাইন, আরব এসব দেশগুলোর দীর্ঘকালীন ইতিহাসে। শহরে আরো অনেকেরই মতোই নাসিমার আম্মা আব্বুরা আতঙ্কের মধ্যে সময় কাটায়। অনেক রাত্রে তাদের চোখে ঘুম আসে না!

নাসিমার এখন ন’বছর। সামরিক অস্থিরতার জন্যে নাসিমাদের ইসকুল-টিসকুল সব বন্ধ! সেদিন ভোরের দিকে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে ওর মা-বাবা টিভির নিউজ দেখছিল। তারই ফাঁকে মেয়েটা কখন যেন নিজে নিজেই নীচে নেমে এসেছে। তাদের ‘শোরেউক টাওয়ার’ পাশেই আরেকটা বিরাট টাওয়ার। নাসিমা জানতো, ওখানে তার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবে আলায়েন। দশ বছর বয়েসী ছেলেটা, ওর দোস্ত। এটা ওদের রোজকার খেলবার জায়গা!

নাসিমা মুসলমান। কিন্তু ওর দোস্ত আলায়েন ইহুদী। তার পূর্বপুরুষেরা ইজরায়েল, মক্কা, জেরুজালেম এসব জায়গা ঘুরে ওরা গাজা শহরেই পাকাপাকি বাসা বেঁধেছে। আলায়েন আর নাসিমা কাছেই একটা প্রাইমারী স্কুলে পড়ে। ওরা থাকেও পাশাপাশি দুটো টাওয়ারে।

গাজা শহরটাতে ভূমধ্যসাগরীয় হাওয়ার তেতো গন্ধ! শুধু যুদ্ধ আর হানাহানি! হামাস কিংবা ইসরায়েলি হানাদারবাহিনীর সীমান্ত অনুপ্রবেশ লেগেই আছে!

এরই মধ্যে রোজকার মতো আলায়েন আর নাসিমা টাওয়ারের নীচের তালার ফাঁকা পেভমেন্টটাতে বসে খেলছিল। সামনের স্তুপ থেকে কিছু ইট পাথর জোগাড় করে ওরা দুজনে মিলে একটা দুর্গ তৈরী করেছিল। দুর্গের পাঁচিলে দুটো ছোট্ট ছোট্ট বন্দুকধারী সৈনিক আর একটা প্লাস্টিকের কামান।

খেলাঘরে বন্দুকধারী প্লাস্টিকের সৈন্যদুটোকে সাজাতে সাজাতে আলায়েন নাসিমাকে বলছিল – ‘বড় হয়ে তুই আমাকে বিয়ে করবি?’

খবরদারির ঢঙে নাসিমা বলে উঠলো – ‘তুই জানিস না? বাচ্চাদের বিয়ের কথা বলতে নেই!’

আলায়েন নাসিমার চোখে চোখ রেখে বললো, ‘আজ তোকে বাবা-মা’দের একটা সিক্রেট গল্প বলবো। প্রমিস, কাউকে বলবি না!’

তখনই এরোপ্লেনের তীক্ষ্ণ গর্জন! এগিয়ে আসছে কয়েকটা বোমারু বিমান!

তীক্ষ্ণ গর্জন মাথার উপরে! ওরা দুজন চেঁচিয়ে বললো – ‘মেঝেতে শুয়ে পড়, জলদি‌ - জলদি!’ নাসিমা আর আলায়েন প্লেনের শব্দ শুনতে পেয়েই আত্মরক্ষার কায়দায় শুয়ে পড়েছিল গ্রাউন্ডফ্লোরের পেভমেন্টে। এরকমটাই স্কুলে ওদের ট্রেনিং দেয়া আছে।

গাজা শহরটা ততক্ষণে সতর্ক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ! ভয়ঙ্কর আওয়াজ! কাঁপুনি দিয়ে পায়ের নীচে মাটি যেন দুফাঁক হয়ে গেলো!

বালির খেলাঘরের মতো ঝুরঝুর করে খসে পড়লো নাসিমাদের ষোলো তলার বিশাল ইমারত – ‘শোরেউক টাওয়ার’!

তখনই একটা আর্ত চিৎকার – আলায়েনের! বিস্ফোরণের সাথে সাথে ভাঙা রাবিশের টুকরো, বড়ো বড়ো পাথরের ঢেলা অনুভূমিক ছুটে এসেছিলো গ্রাউন্ড ফ্লোরে। ওরা যেখানে খেলছিল।

একটা ট্রমাতে হতভম্ভ হয়ে পড়েছিল মেয়েটা! কিছুক্ষণ পরে দুহাতের কনুইতে ভর দিয়ে নাসিমা মাথা তুললো। দেখলো, ওর দোস্ত আলায়েনের শরীরটা জমিতে উপুর হয়ে পড়ে আছে। মাথা দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। নাসিমা উঠে দাঁড়িয়ে ওর খেলার সাথীর হাত ধরে টানলো। একটু কেঁপে উঠে ফ্লোরে শুয়ে থাকা আলায়েনের শরীরটা স্থির হয়ে গেল।

প্রচন্ড উত্তাপে নাসিমার শরীরটা ঝলসে যাচ্ছে। রাস্তা দিয়ে লোকগুলো পালাচ্ছে। ওদেরই একজন দেখলো গ্রাউন্ডফ্লোরের মেঝেতে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আর পাশেই একটা ঘুমন্ত বালকের রক্তাক্ত শরীর! লোকটা ভীতার্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠলো। অচেনা আঙ্কেলটার হাতের স্পর্শ নাসিমার কাঁধে – ‘হেই লেড়কী, ভাগ্‌ ভাগ্‌ হিয়াসে! আবার বোমা পড়বে- মারা পড়বি।’

আলায়েনের দেহটাকে জমিনে একেলা ফেলে রেখে নাসিমা দিকশূন্যের মতো বেরিয়ে এলো বিল্ডিংটার পেভমেন্ট থেকে। কয়েক কদম এগোনোর পর নাসিমা বুঝতে পারলো তাদের নিজস্ব ফ্লাট সহ পুরো ‘শোরেউক টাওয়ার’টাই বসে গেছে। কোথায় তার আম্মু আর আব্বু? সে কিভাবে নিজের ঘরের দিকে ফিরে যাবে? সেখানে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে! তাদের অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার রাস্তা জুড়ে ভাঙ্গা বিল্ডিংটার ডাউস আবর্জনা, ডেবরিস। মাথা উচু করে তাকালেও ফ্লাটের কোনো ব্যালকনি, জানালা কিছুই দেখা যাচ্ছে না! শুধু ধোঁয়া আর ধূলোতে ঢাকা একটা নোংরা আকাশ! যেন নাসিমা অন্য কোন একটা অচেনা শহরে হারিয়ে গেছে। ছুটন্ত মানুষদের ভীড়ে আবার মেয়েটা দাঁড়িয়ে গেলো। নিজেদের ধ্বসে যাওয়া বিল্ডিংটার অদূরে দাঁড়িয়ে সে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগলো!

সমস্ত লোক সামনের দিকে ছুটছে। নাসিফা আবার দৌড় শুরু করলো।

অল্প কিছুক্ষণ ছুটবার পর ক্লান্ত হয়ে ও একটা ল্যাম্পপোষ্টের কাছে দাঁড়িয়ে পড়লো। একজন দোকানদার সাটার বন্ধ করছিলো। সে তার বোতল থেকে ঢক্‌ ঢক্‌ করে জল গিলছিল। নাসিমার তেষ্টা পেয়েছে। তাকিয়ে তাকিয়ে সে দেখছিল ঐ লোকটার জল খাওয়া।

দোকানদারটা জল খাওয়া থামিয়ে নজর করলো। একলা দাঁড়িয়ে থাকা ফর্সা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটাকে! পরনে হাফ স্কার্ট। গায়ের গেঞ্জিটা ঘামে ভিজে গেছে। মেয়েটা ড্যাব ড্যাব চোখে গিলছে দোকানদারের হাতে ধরা জলের বোতলটাকে।

‘কি দেখছিস? আকাশ থেকে বোম পড়েছে! আরো পড়বে! আমাদের গাজার শহরগুলোয় ইজরায়েলী মিলিটারিরা ঢুকে পড়েছে। তোর সাথে আর কে কে আছে?’

মেয়েটার মুখে কোন কথা নেই।

‘জল খাবি?’

নাসিমা মাথা নাড়লো! অচেনা মানুষটার হাত থেকে বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে জল গিললো।

‘বাড়ি কোথায়?’

‘শোরেউক টাওয়ারে! আম্মু আর আব্বুকে খুঁজে পাচ্ছি না! আমাদের বাড়িঘর আগুনে জ্বলছে!’

‘তোর বাবা-মা নিশ্চয়ই আগে আগে গেছে। একতালা স্কুল বাড়িতে শেলটার নিতে পারে। সামনে এগিয়ে যা, খুঁজে দ্যাখ। এই নে!’ দোকানদার আঙ্কেল হাতের থলে থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিলো- ‘খিদে পেলে খাস! দেখছিস না? সবাই পালাচ্ছে। এখান থেকে জলদি ভাগ। সামনে স্কুল বাড়িটাতে বা অন্য কোথাও শেলটার পেলে ঢুকে পড়িস! যে কোনো মুহূর্তেই আবার বোমা পড়তে পারে!’

নাসিমা রাস্তায় নেমে সামনের দিকে আবার ছুটতে শুরু করলো। সে জানে না কোথায় তার নিরাপদ শেলটার। একটু আগে দেখা বীভৎস দৃশ্যগুলো সে তার মাথা থেকে মুছে ফেলতে পারছিল না! নাসিমার দুচোখ জলে ভরে এলো। মুহূর্তেই ও দাঁড়িয়ে পড়লো রাস্তায়।

তার পেছনে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছিল একজন বয়স্কা আন্টি। এই ফর্সা ফুটফুটে মেয়েটাকে পেছন ফিরে তাকাতে দেখে জোরালো গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠলো - ‘এই মেয়েটা, কাঁদিস না মা! আমাদের মেডিটারিয়ান সী-তে আগুন লেগেছে! প্রাণে বেঁচে থাকলে সব কিছুই ফিরে পাবি। এখান থেকে সামনের দিকে পালা!’

নাসিমার মনটা তখনো পেছনে। যেদিকে ওদের শোরেউক টাওয়ার।

এতক্ষণে সে প্রায় দু কিলোমিটার এগিয়ে এসেছে। সামনেই দেখা যাচ্ছে ওদের প্রাইমারী স্কুলটা। সামরিক সতর্কতা হিসেবে প্রায় এক সপ্তাহ আগেই বাচ্চাদের স্কুলটাকে নোটিশ দিয়ে তালাবন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সামনের গেটে তালা ঝুলছে। তখনও কিছু লোক স্কুলের গেট আর উচুঁ পাঁচিল টপকে একতালার ছোটো ছোটো ঘরগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে।

রাস্তায় মানুষগুলো সামনের দিকে নিরাপত্তার জন্যে ছুটছে। এদেশে কোন আশ্রয়টাই বা নিরাপদ?

রাস্তার ছুটন্ত সেই সব লোকগুলোর হঠাৎ কানে এলো - ঝক্কর ঝক্কর শব্দ। অনেক দূর থেকে একটা ট্যাঙ্কার শুঁড় উঁচিয়ে এগিয়ে আসছে। মুহূর্তেই রাস্তাটা আবার ফাঁকা। মানুষগুলো দোকান, পিলার, ঘরের দেয়াল, চৌবাচ্চার পেছনে। যে যার মতো জায়গা খুঁজে নিয়ে এদিকে ওদিকে লুকিয়ে পড়ছে।

সামনেই বিপদ, এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা খোলা নেই। ভয়ংকর একটা অবস্থা! আরো কয়েকজনের সাথে নাসিমা ডান দিকের একটা সরু রাস্তা ধরে টার্ণ নিলো। ধ্বসে যাওয়া দুটো বাড়ির ভগ্নস্তূপের মধ্য দিয়ে রাস্তাটা এগিয়ে গেছে। রাস্তাটার উপর পড়ে রয়েছে ইট, পাথর, ঘরের আধা-পোড়া সরঞ্জাম। এই সব উত্তপ্ত ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে নাসিমা ছুটছে। পাথর রাবিশ আবর্জনার উঁচুনীচু ঢাই তার চপ্পল ভেদ করে দু’পায়ের পাতাদুটো পুড়িয়ে দিচ্ছে। মাটিতে নিভে যাওয়া আগুনের উত্তাপ। তার স্কার্টের নীচের দিককার অনাবৃত চামড়া আর মিহি পশমগুলো যেন এক্ষুনিই ঝড়ে পড়বে! এই উত্তাপ আর ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে সামান্য একটু এগোলেই, ওই তো দেখা যাচ্ছে পরিস্কার একটা মাঠ।

মাঠটা পেরিয়ে নাসিমা উঠে এলো আরেকটা মাঝারি সাইজের কংক্রীটের রাস্তায়। তার বাড়ি থেকে সে দৌড়ে দৌড়ে কতদূর এসে গেছে কে জানে? ও বসে একটু জিরিয়ে নিলো। এই রাস্তাটা পরিস্কার। দেখা যাচ্ছে দূরে একদল লোক। ওরা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ওদের পেছন পেছনে আবার হাঁটা শুরু করলো নাসিমা। মাঝে অনেকটাই দূরত্ব। ভূমধ্যসাগরের লোনা হাওয়ায় ঘেমে যাচ্ছে মেয়েটার শরীর। এই রাস্তার দুপাশে, এদিক ওদিকে ভাঙা ঘর বাড়ি।

হাঁটতে হাঁটতে নাসিমার মনে পড়ে গেল একে একে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো! একটা গুঁড়িয়ে যাওয়া ইমারত, তাদের ফ্লাটবাড়ী, টাওয়ারটা! তার নিত্যদিনের খেলার সঙ্গী আলায়েনের নেতিয়ে পড়া শরীরটা!

নাঃ, নাসিমা আর ভাবতেই পারছে না। ওর বেশ ক্ষিধে পেয়েছে। তার হাতে ধরা দোকানদার আঙ্কেলের দেয়া কেকের ছোট্ট প্যাকেটটা।

কত বেলা হলো? শহরের সমস্ত ঘড়িগুলো হয়তো এখন বন্ধ হয়ে গেছে। বেশ কিছুদিন এইসব এলাকায় লাইট আর জল আসবে না। কয়েকমাস আগেও তো ইজরাইলের এরোপ্লেন তাদের পাম্প হাউজ আর পাওয়ার হাউজে বোমা ফেলে গেছে।

সামনে লোকগুলোকে অনুসরণ করে নাসিমা ছুটে চলেছে। আর কতক্ষণ তাকে চলতে হবে?

তক্ষুনিই পেছন থেকে ওর কানে ভেসে এলো একটা গাড়ির শব্দ! ছুটতে ছুটতেই কৌতূহলবশত নাসিমা ঘাড়টা পেছনে ঘুরিয়ে নিল। চলন্ত ট্যাঙ্কারটা মাঝ রাস্তার উপর থেমে গেছে। ওটার ভেতর থেকে রাস্তায় নেমে পড়েছে উর্দি হেলমেট আর রাইফেলধারী একটা মিলিটারি।

উর্দিটা চেঁচিয়ে উঠলো – ‘ইয়েস গার্ল! গো ফরোয়ার্ড! ডোন্ট লুক বিহাইন্ড! ডোন্ট লুক বিহাইন্ড!’

নাসিমা কিভাবে পেছনে না তাকিয়ে থাকতে পারে? তার মনে হচ্ছে - পেছনে ফেলে আসা শোরেউক টাওয়ারটা তাকে হাত ছানি দিয়ে ডাকছে! আলায়েন তাকে পেছন থেকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করছে। দূর থেকে সে শুনতে পাচ্ছে তার মায়ের গলার স্বর। মা তাকে ডাকছে, ‘নাসিমা, নাসিমা, কোথায় গেলি তুই?’

নিজের অজান্তেই মেয়েটার মাথা আর শরীরটা পেছনে ঘুরে গেলো।

আবার সেই উন্মত্ত মিলিটারীটার গর্জন – ‘ডোন্ট লুক বিহাইন্ড! ......ফায়ার!’

একটা মাত্র গুলির শব্দ!

আর্তনাদ করে নাসিমার শরীরটা রাস্তায় লুটিয়ে পড়লো। ছিটকে পড়লো এতক্ষণ হাতে ধরে থাকা তার হাতের কেকের প্যাকেটটা।

এই ভূমন্ডলের আরো অজস্র গোলাগুলির শব্দের মধ্যে এই মুহূর্তের শব্দটা উপরের ঘন বায়ুমন্ডলে মিলিয়ে গেলো।



#

সামনের রাস্তাটা একদম ফাঁকা। মিলিটারির ট্যাঙ্কারটা নাসিমার রক্তাক্ত দেহটাকে অবহেলায় পাশ কাটিয়ে অনেকটা দূরে মিলিয়ে গেছে।

পাশেই একটা মৃত মহাবৃক্ষ - সেখান থেকে উড়ে এলো দুটো পালক খসা জীর্ণ কাক। ওরা মেয়েটার রক্তাক্ত দেহটার কাছেই রাস্তায় পড়ে থাকা কেকটার পাশে বসলো।

কাকদুটো দেখলো – এইমাত্র নাসিমার গোলাপী প্রাণবায়ুটুকু আকাশে উড়াল দিচ্ছে!

আকাশে উড়াল দিতে দিতে ছোট্ট ন’বছরের নাসিমা কালো বোরখাতে মুখ ঢাকা একজন মুসলিম তরুণী হয়ে যাচ্ছে। মর্তলোক থেকে নাসিমাকে আকাশে উঠে আসতে দেখে আলায়েনের আত্মাটা এইমাত্র জীবিত হয়ে উঠলো। মুহূর্তেই সে ইহুদী পোষাক আর টুপিতে নিজেকে সুসজ্জিত করে নিলো। আলায়েন এখন আর সেই দশ বছরের বালক নয়। ভূমধ্যসাগরের লোনা হাওয়ায় সে একজন শান্তি প্রত্যাশী প্যালেস্টাইনী পুরুষ!

ধোঁয়াভরা আকাশটা। আলায়েন তার হাতের প্রিয় গোলাপ ফুলটাকে নাসিমার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। নাসিমাকে বলছে – ‘শুনবি না? বাবা-মা’দের সেই সিক্রেট গল্পটা?’

যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চলে চলছে বোমারু বিমান আর হানাদারদের গোলাগুলি শব্দ! তারই মধ্যে ভূমধ্যসাগরীয় হাওয়ায় হাওয়ায় জাতিহীন বর্ণহীন ভেসে ভেসে চলছে একজন বালক আর একটা বালিকার সদ্য-নিষ্ক্রান্ত আত্মার কিছু আন্তরিক সংলাপ। তাদের সেইসব প্রেমময় সংলাপ, বিস্তীর্ণ পৃথিবীর মানুষ, তোমরা কি কিছুই শুনতে পাচ্ছো না?

0 comments: