2

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়



ঝম ঝম করে কেটে গেল আরও একটা ঘটনাবহুল মাস। ভোটের প্রস্তুতি, ভোটের প্রচার, দাদা দিদি, জোট ঘোঁট, চাপান উতোর, মাঝে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস – রবীন্দ্রজয়ন্তী, আবার সেই কচাকচি – বিশ্লেষণ-বিশ্লেষণ-বিশ্লেষণ এবং অবশেষে ফলাফল ঘোষণা। উফ্‌... ‘ভোটের’ বাদ্যি থামলে মিষ্টি!! আবার ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান – অনেক হয়েছে টাইম পাস – এবার সবাই মন দিন নিজ নিজ কাজে। আসছে নজরুল জয়ন্তী, চাইলে পালন করতেই পারেন। সদ্য গেল শিলচরের ভাষা শহীদ দিবস – ১৯শে মে। আজ, ২১শে মে, সেই ভাষা শহীদদের স্মরণ করে প্রকাশিত হলো বাংলা ভাষায় এক ব্যতিক্রমী অনলাইন ম্যাগাজিন, ঋতবাক ২য় বর্ষ, ২২তম সংখ্যা। 

এ কথা তো অনস্বীকার্য যে, যে কোনও কাজের প্রতি আন্তরিক নিষ্ঠা কাজটিকে প্রতি দিন সমৃদ্ধ করে, উৎকৃষ্ট করে। এগিয়ে চলার পথে একটা রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে চলার নিয়মেই আর একটা নতুন রাস্তা তৈরী হয়ে যায়, চলা তো থামে না। আর এই চলতে চলতেই কত নতুন নতুন মানুষ চেনা, মুহূর্তে মুহূর্তে অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হওয়া। আজ এমনই কিছু অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ঋতবাক। ঋতবাক পরিচালক গোষ্ঠীকে উৎকৃষ্ট করল জীবনের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এমনই কিছু নাম। ব্লগে সংযোজিত হলো উপদেষ্টামণ্ডলী। সেখানে রয়েছেন বাংলা বিভাগীয় প্রধান(কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়), সাহিত্যিক গবেষক, ডঃ বিশ্বনাথ রায়, প্রবাদ প্রতিম প্রবীণ ব্লগার, সাহিত্য-ব্রতী, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, এযাবৎ ঋতবাক ফেসবুক গ্রুপ ও ম্যাগাজিনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, সাহিত্য প্রেমী, স্বপন দেব এবং সম্পাদকের এই ম্যাগাজিন শুরুর ভাবনাকে অঙ্কুরিত করার প্রধান রূপকার, প্রাবন্ধিক – ব্লগার, শুভ্র ভট্টাচার্য। এঁরা যে এতদিন ছিলেন না, তা নয়। ছিলেন সেই প্রথম থেকেই। এত দিনে স্বীকৃতি দেওয়া গেল। ঋতবাক ধন্য। অশেষ কৃতজ্ঞতা জানবেন সকলে। 

এদিকে ঋতবাক পাবলিশার অ্যান্ড বুক সেলার পুরোদমে প্রস্তুত। সামনে বছর বইমেলার আগে অন্তত ২৪টি বই করার প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। উৎসাহী বন্ধুরা যোগাযোগ করুন সরাসরি। বই মেলার কথা আসতেই, প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ল ঋতবাক বার্ষিক সংকলনের কথা। লেখা মনোনয়ন ও নির্বাচন পর্ব শুরুর পথে। আপনারা তো জানেনই, লেখার গুনগত মান ও বক্তব্যের যুক্তিগ্রাহ্য স্বচ্ছতাই লেখা মনোনয়ন ও নির্বাচনের একমাত্র মাপকাঠি। তাই আপনাদের কাছে অনুরোধ, অনেক অনেক ভালো ভালো লেখা পাঠান ঋতবাকে। 

সকলের আন্তরিক সহযোগিতায় ঋতবাকের যাত্রা পথ আরও মসৃণ ও সুগম হোক। 

শুভেচ্ছা নিরন্তর...

সুস্মিতা বসু সিং

2 comments:

2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - গৌতম দত্ত

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ



এক বৈশাখে...
গৌতম দত্ত



শহুরে কলকাতায় পলাশ গাছ বেশ কমে গেছে। কিন্তু অগুন্তি কৃষ্ণচূড়া ভুলিয়ে দিয়েছে পলাশের সেই নেশা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সবুজ পাতা ঘিরে আগুনরঙা কৃষ্ণচূড়া ফুলের বাহার কলকাতায় জানান দেয় যে বসন্ত চলছে। বাংলা ক্যালেন্ডার আজ আমাদের বাড়িতে অচল বললেই হয়, ইংরেজি ক্যালেন্ডারের একচেটিয়া দাপটে। তবু এই পলাশ আর কৃষ্ণচূড়ার আগুনে রঙ বাঙালীর মননে ধাক্কা মেরে জানিয়ে দেয় যে বসন্ত এসে গেছে আর এর পরেই আসতে চলেছে সেই কঠিন রুক্ষ গ্রীষ্মের দুটো মাস। একলা বৈশাখ মানে পয়লা বৈশাখ আর বেশী দেরী নেই। আমরা না চাইলেও একলাই সে আসবে আমাদের এই বাংলায়, তার প্রবল বৈভবে। আর তলে তলে শুরু হয়ে যায় বাঙালীর আর এক প্রাণের উৎসবের প্রস্তুতি পর্ব। 

বাঙালীর বারো মাসে তেরো পার্বন আজ শুধু বইয়ের পাতায় বা আধুনিক বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার পাতায় আর শুধুমাত্র পুরোনো মানুষজনের স্মৃতিচারণে। ফাগুন পূর্ণিমার সেই দোল আজ হারিয়েই গেছে “হোলি”র আতিশয্যে। নেড়াপোড়া কি, তা আজকের প্রজন্ম জানেই না। কম্প্যুটার আর কম্‌পিটিশনের জগতে তারা যে আজ ঘরবন্দী! শহর আর মফঃস্বলের খেলার মাঠ আজ “প্রোমোটার” নামক এক শ্রেণীচরিত্রে’র কারণে উধাও। বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন উচ্চবিত্ত আবাসনের ছাদ ঘিরে গড়ে উঠছে “স্কাই ওয়াক”। আধুনিক মনের আধুনিক উপাচার। তবু এখনো চড়ক ঘোরে আমাদের এই কলকাতা শহরেও। মেলাও বসে সারা বৈশাখ মাস জুড়ে বিভিন্ন পাড়ায় পাড়ায়। আর সেই মেলায় আধুনিক অনেক কিছুর সাথে এখনো দেখা যায় সেই তালপাতার হাতপাখা কিংবা বেতের ফুলের সাজি। এরই মাঝে বেঁচে আছে আমাদের সেই পুরোনো দিনের সব স্মৃতি।

এই আজকের দিনে, মেনে যেদিন আমি এই লেখাটি লিখছি সেই ১৯শে মে বাঙলা ভাষার জন্যে উত্তাল হয়ে উঠেছিল আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যের বরাক উপত্যকা। ১৯৬১ সালের উনিশে মে, শিলচরে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাঙলার জন্য পুলিশের গুলিতে প্রাণ কেড়েছিল বাংলাভাষী ১১ জনের। এটা আমাদের গর্ব।

আর আমাদের বাঙালী জীবনে সবচেয়ে যে বড় ঘটনাটি ঘটেছিল এই বৈশাখে সেটা আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। তাই ২৫শে বৈশাখ আমাদের জীবনে এক এগিয়ে চলার দিন। শ্রদ্ধায়, স্মরণে আর ভালবাসায় তাই বাঙালী এখনো তাঁকেই বরণ করে নেয় বাঙলার অন্যতম এক উৎসব হিসেবে। দূর্গাপুজো বাদ দিলে বাঙলা প্রিয় মানুষজন উন্মুখ হয়ে থাকেন এই দিনটার জন্যে। আবৃত্তি, গান, নৃত্য, নাটকের মূর্ছণায় এখনো ভেসে যায় শুধু আমাদের এই দুপারের বাংলা নয়, সারা বিশ্বের বাঙালীরা।

তবু এখানেই একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। কতটা আমরা নিতে পেরেছি আমাদের শয়নে-স্বপনে-জাগরণে’র একান্ত আপনজন এই রবীন্দ্রনাথের আদর্শ বা তাঁর লিপিবদ্ধ চিন্তাধারাকে। তাঁর একান্ত সৃষ্টি এই শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতী আজ সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে আসে কোনও এক অধ্যক্ষ মহাশয়ের পানীয়ের বিল সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশের হাত ধরে। যে ভাবনায় তিনি তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর স্বপ্নের সেই শিক্ষার জগৎ তা আজ কোথায় ? রাজনীতি, রাজনীতি আর রাজনীতির চাপ তার সর্বাঙ্গে। অহরহ নানান অজুহাতে সেখানে পড়াশোনার পরিবেশ আজ বিপন্ন। কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের বিশ্বকবির চোখে ভাষা সেই প্রাচীন ভারতের তপোবনের সমুজ্জ্বল ছবি। যা নির্মাণ করার জন্যে যখন যাঁকে প্রয়োজন তাঁকে ডেকে এনেছিলেন এই প্রাঙ্গনে শিক্ষাদানের জন্য শত আর্থিক বাধা সত্ত্বেও, সেই উজ্জ্বল গরিমা আজ কোথায় ! 

তিনি যে কতদূর খালি চোখে দেখতে পেতেন তাঁর অজস্র পরিচয় ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর লেখার ছত্রে ছত্রে। আমাদের সমাজে এখনো যেন বাস্তব যা তিনি লিখে গেছেন আজ থেকে কতো বছর আগে। তেমনই কয়েকটা পংক্তি আজ শোনাই আপনাদের। কতদিন আগে লেখা ‘রাজা ও রানী’ নাটকে –

সেখানে রানী সুমিত্রা জিজ্ঞেস করছেন দেবদত্ত’কে –


সুমিত্রা ।। আহা কে ক্ষুধিত ?

দেবদত্ত ।। অভাগ্যের দুরদৃষ্ট। দীন প্রজা যত

                      চিরদিন কেটে গেছে অর্ধাশনে যার

                    আজো তার অনশন হল না অভ্যাস,

                                    এমনি আশ্চর্য।

সুমিত্রা ।। হে ঠাকুর, একী শুনি।

                  ধান্যপূর্ণ বসুন্ধরা, তবু প্রজা কাঁদে

                                               অনাহারে ?

দেবদত্ত ।। ধান্য তার বসুন্ধরা যার।

                           দারিদ্রের নহে বসুন্ধরা। এরা শুধু

                    যজ্ঞভূমে কুক্কুরের মতো লোলজিহ্বা

                 এক পাশে পড়ে থাকে ; পায় ভাগ্যক্রমে

                      কভু ষষ্টি, উচ্ছিষ্ট কখনো। বেঁচে যায়

                         দয়া হয় যদি, নয় তো কাঁদিয়া ফেরে

                                    পথপ্রান্তে মরিবার তরে। ””



কি মনে হল ? এই সংলাপগুলো কি এখনও খুব একটা প্রাচীন বলে মনে হয় ? আমার তো হয় না সে যতই সংখ্যাবিচারে বোঝাতে চান না কেন। 

ভাবুন তো ‘রক্তকরবীর’ ভাবনাগুলো। আধুনিক যান্ত্রিক যুগের যন্ত্রণার কথা লিখে গেছেন সেই ১৯২৫ সালে।ধরিত্রীর সব সম্পদ লুন্ঠনে সেই উন্মত্ত রাজা, কৃষি থেকে টেনে এনে, নিঃস্ব লোকগুলোকে দিয়ে সেই দুর্গম খনি থেকে সোনা আহরনে ব্যস্ত। তাদের রক্তের বদলে রাজা মেটাতে চায় তার ঐশ্বর্য্য সঞ্চয়ের বিকৃত লালসা। সারাদিন ধরে রাজার দল তাদেরকে শোষণ, শাসন, ব্যভিচার আর ষড়যন্ত্রে’র কলে পিষে পিষে নিংড়ে নেয় তাদের জীবনীশক্তি। আর তারপরে ছুঁড়ে দেয় আস্তাকুঁড়েতে। সেই সব শোষিত মানুষগুলোর আর তাদের নামে পরিচয় নেই। তারা শুধু সংখ্যা ! ৪৭ এর ফ কিংবা ৬৯ এর ঙ ! রাজার আমলাতন্ত্র চব্বিশ ঘন্টা ধরে তাদের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ঘিরে রাখে। এই শোষন এই যন্ত্রণা থেকে কি আমরা এখনো এই একবিংশ শতাব্দীতেও মুক্ত হতে পেরেছি ? কি বলেন আপনারা ?

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আশাবাদী। তাই তো দেখি এর মধ্যেই বিশুপাগল আর নন্দিনী পারে ফুল ফোটাতে। ধানের ক্ষেতের সেই সবুজ দেখাতে রাজাকেও নন্দিনী বার করে আনে আর সেই অভেদ্য দূর্গ থেকে। এখন যখন শুনি কৃষি আমাদের ভিত্তি আর শিল্প আমাদের ভবিয্যৎ তখন সত্যিই ভয় করে। পারবো কি আমরা কৃষিভিত্তিক ভারতবর্ষকে অন্য দিকে জোর করে নিয়ে যেতে। নন্দিনী’রা আজ অসহায় রাজনীতির আবর্তে। 

আবার “কালের যাত্রা’য়” দেখি শূদ্ররা শাস্ত্র পড়ছে। দলে দলে ছুটে এসে তারা চাইছে রথের দড়ি ধরে টান দিতে। বলছে ‘রথ চালাবোই আমরা’। জীবনের মূল সমস্যা খাদ্য আর বস্ত্রের। বিজ্ঞান তার উন্নতি নিয়ে যতই মাতামাতি করুক না কেন, আসল সমস্যা মানুষের বেঁচে থাকা। সেখানে জোগানদার হচ্ছে সাধারণ জনগনই। তাকে মেরে কিছুই বাঁচানো যায় না। তাদের জোরেই ঘোরে সভ্যতার চাকা। তাই তারা সচেতন হয়ে উঠে বলে ওঠে, ‘জয় আমাদের হাল লাঙল চরকা তাঁতের’। একথা রবীন্দ্রনাথ বারংবার বলে গেছেন তাঁর বিভিন্ন ভাবনার অনুষঙ্গে।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের ভাবার সময় কি এখনো আসেনি?









2 comments:

1

প্রবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ



নজরুলের গান : গানের নজরুল
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



ক্যালেন্ডারের সেই তারিখটা, ২৫শে মে এলে তাঁর জন্মদিনে নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয়, কতটা মনে রেখেছি নজরুলকে? কি ভাবে মনে রেখেছি নজরুলকে কিংবা আদৌ মনে রেখেছি কিনা, তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্ন আমাদের থাকতেই পারে। কিন্তু একটা উচ্চারণে বোধকরি কোন ভুল নেই যে বাঙালির – অন্নদা শঙ্কর রায়ের অমর পংক্তি “আর সবই ভাগ হয়ে গেছে শুধু, ভাগ হয়নিকো নজরুল”। পণ্যায়নের সর্বব্যাপী থাবার নীচে নজরুল-সৃষ্টি ততটা আলোচিত নয় এই প্রজন্মের কাছে। পাড়ায় পাড়ায় নজরুল জয়ন্তী পালন বন্ধ হয়েছে অনেকদিন, নজরুলের গানেও দীক্ষিত হচ্ছেন না একালের সংগীত শিল্পীরা। এই সবই সত্যি। আবার এটাও সত্যি রবীন্দ্রনাথ নামক মহাসাগরের পর বাঙালির সাহিত্য-সংগীত-সংস্কৃতির সৃষ্টিভূমিতে নজরুল ছাড়া আর কাকেই বা পেলাম ! রবীন্দ্রনাথ চলে গেছেন একচল্লিশের ৭ই অগস্ট, আর নজরুলের অসুস্থতার প্রাথমিক লক্ষণ ধরা পড়ে ঐ দিন থেকেই। নজরুলের কবিতার কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু নজরুলের বাকরুদ্ধ হওয়ার পঁচাত্তর বছর পরেও অন্তত বাংলা গানের ক্ষেত্রে নজরুলকে সরিয়ে দেবার মত কাউকেই তো পেলামনা !

বস্তুত গানের নজরুল এক বিস্ময়কর প্রতিভা। কাব্যের নজরুলের নির্মোহ আলোচনা কম হয়নি। রবীন্দ্র-উত্তর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাস মনে করেছিলেন “তাঁর কবিতা চমৎকার, কিন্তু মানোত্তীর্ণ নয়” । অবশ্য একথাও জীবনানন্দ বলেছিলেন যে “... এরকম পরিবেশে হয়তো শ্রেষ্ঠ কবিতা জন্মায় না কিংবা জন্মায়, কিন্তু মনন প্রতিভা ও অনুশীলিত সুস্থিরতার প্রয়োজন। নজরুলের তা ছিল না”। নির্ভুল মূল্যায়ন। শৈশব থেকে দারিদ্রের মুখোমুখি হয়ে মাত্র ৯বছর বয়সে পিতৃহারা নজরুল তাঁর বহুমুখী সৃজনশীলতা পাখনা মেলার মত আকাশের সন্ধান পেলেন না। ১৯১৯ থেকে ১৯২৮ - নজরুলের কাব্যজীবনের এই ৯ বছরের সময়কালেও কবেই বা সুস্থিতি পেয়েছিলেন তিনি! করাচির সেনানিবাসের পাট চুকিয়ে ফিরে এলেন ২০বছর বয়সে, দেশ তখন উত্তাল। সদ্যগঠিত কম্যুনিষ্ট পার্টির সংঠন, কৃষক সমিতি, সাংবাদিকতা, স্থায়ী থাকার জায়গা নেই, উপার্জনের ব্যাবস্থা নেই । কাব্যসাধনার জন্য সুস্থিতি পাবেন কি করে ? এর সঙ্গে ছিল পত্রিকা সম্পাদনার ধকল, মৌলবাদী হিন্দু – মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের আক্রমণ, কারা বরণ। তথাপি বিস্ময়কর এই যে কি অমিত ঐশ্বর্য দান করে গিয়েছেন সেদিনের তরুণ প্রজন্মের কাছে। দেশ ও সমাজ প্রেম তাঁর কাব্যে মুক্তকন্ঠ সুস্পষ্টতা পেয়েছিল। সমবয়সী ভিন্ন ধারার কবি জীবনানন্দ দাস যেমন বলেছিলেন “ভাষা, ভাব, বিশ্বাসের আশ্চর্য যৌবন রয়েছে এই কবিতাগুলির ভিতর”। 

সুস্থিত হলেন তখন যখন তিনি ‘গানের নজরুল’। যখন তিনি সুরের রাজা হয়ে আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগ নির্মাণের প্রস্তুতি সারছেন। গান তাঁর ঝোড়ো জীবনেরও প্রধান সঙ্গী ছিল। গান তো নয় – দেশাত্মবোধের চারণমন্ত্র। ১৯১৯এ নেতাজি সুভাষচন্দ্র স্মৃতিচারণ করেছিলেন “আমরা যখন যুদ্ধে যাবো, তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাবো, তখন তাঁর গান গাইবো”। গান তিনি ছেলেবেলা থেকেই গাইতেন, সুর করতেন। ১৯২০তে করাচির সেনানিবাস থেকে ফিরে আসার পর গান শুনিয়েই জয় করে নিয়েছিলেন কলকাতার বিদগ্ধ মহলকে। সভা-সমিতি কিংবা ঘরোয়া সাহিত্য আড্ডায় তাঁর গানই থাকতো প্রবল আকর্ষণের কেন্দ্রে। নানান বিদগ্ধজনের স্মৃতিকথায় নজরুলের আপনভোলা গানপাগল মূর্তিটির ছবি লেখা আছে। মুজফফর আহমেদ লিখেছেন ‘কারখানার শ্রমিকরা পর্যন্ত ডেকে নিয়ে যেতেন নজরুলকে’। বুদ্ধদেব বসু তাঁর স্মৃতিচারণে জানিয়েছেন ‘নজরুল যে ঘরে ঢুকতেন সে ঘরের সবাই ঘড়ি দেখতে ভুলে যেতেন’। অথচ প্রথাগত কোন সংগীত শিক্ষা তাঁর ছিল না। বাল্যেই পিতৃহারা, লেটোর দলে গান গাওয়া, পাঊরুটির কারখানায় কাজ করা কিংবা রেলের গার্ড সাহেবের ঘরে ফরমাস খাটা নজরুলের সামনে সে সুযোগ আসেনি। যেমন ছিলনা তাঁর কোন প্রথাগত ছাত্রজীবন। লেটোর দলে ঘুরে বেড়ানো বাউণ্ডুলে নজরুল বাংলার মাটি থেকে তামাম লৌকিক সুর আত্মস্থ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সাংগীতিক প্রতিভার পটভূমি কিভাবে নির্মিত হয়েছিল তার কোন লেখাজোখা নেই। নজরুল স্মৃতির সবচেয়ে বিশ্বাস্য সূত্র মুজফফর আহমেদ তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন যে কলকাতায় আসার পর রবীন্দ্রসংগীতই তাঁর পরিবেশনের শীর্ষস্থানে থাকত। তিনি নজরুলকে ‘রবীন্দ্র সংগীতের হাফেজ’ বলতেন। চুরুলিয়ার বাউণ্ডুলে কৈশোর জীবনে কিংবা করাচির সেনা নিবাসে রবীন্দ্রনাথের গান কি করে আয়ত্ব করেছিলেন নজরুল, এ বড় বিস্ময় ! বাল্য ও কৈশোরে শুধু লেটোর দলের গানই নয়, কবিগান, ঢপ, কীর্তন, আখড়াই, ভাদু, মনসার গান, কাওয়ালি, ঝুমুর, পাঁচালি, ইত্যাদি লোক আঙ্গিকের গান তিনি আত্মস্থ করেছিলেন যা পরবর্তী সময়ে ‘গানের নজরুল’কে নির্মাণ করেছিল । 

১৯২৮এ নজরুল কাব্যজগৎ থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিয়ে চলে এলেন গানের ভুবনে। গ্রামফোন কোম্পানীর মাসমাইনের গীতিকার–সুরকার-কম্পোজার-ট্রেনার সব দায়িত্ব। গ্রামফোন কোম্পানীর বাংলা গান রেকর্ডিংএর প্রধান। ১৯৩৩এ প্রকাশিত রুবাইৎ-ই-ওমর খৈয়াম’ গ্রন্থের ভুমিকায় নজরুল জানালেন “কাব্যলোকের গুলিস্তান থেকে সংগীতলোকের রাগিনী দ্বীপে আমার নির্বাসন হয়ে গেছে”। সংগীতের সবক’টি বিভাগই নজরুলের জাদু স্পর্শের ঐশ্বর্য পেয়েছিল। নানান বাদ্যযন্ত্রের পারদর্শিতা, গান গাওয়া, গান লেখা, সুর করা, থিয়েটার ও সিনেমার সংগীত পরিচালনা এমনকি একটি সিনেমায় ভক্ত ধ্রুব চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। মাত্র এগারো বছরের সাংগীতিক জীবনে অবিশ্বাস্য তিন হাজারেরও বেশি গান লিখেছিলেন আর তাঁর গানের রেকর্ডের সংখ্যা ১৭০০। রাগাশ্রয়ী আধুনিক গান, প্রেম সংগীত, ছোটদের গান, কীর্তন, আগমণী, শামা সংগীত, গজল, কাওয়ালি, ইসলামি গান – সব ধরণের গান। 

একথা বললে অতিউক্তি হবে না যে, নজরুলের সাংগীতিক প্রতিভাকে ভর করেই গ্রামফোন কোম্পানী বাংলা গানের বিপণন ব্যবসাকে প্রথম পোক্ত করতে পেরেছিল। এদেশে প্রথম গান শোনার যন্ত্র বা কলেরগান আসে ১৯০০ সাল নাগাদ এবং ১৯০২এ প্রথম বাংলা গানের রেকর্ড হয় তখনকার থিয়েটার দলে সখীর নাচের দলের দুই বালিকাকে দিয়ে। পরিশীলিত গায়ন রুচি তৈরী হতে লেগে গেছে আরো বিশ/পঁচিশ বছর। তখন বাংলা গান বলতে কিছু রাগাশ্রয়ী গান, চটুল দেহতত্বের গান, কীর্তন, ভজন, ইত্যাদি। বাঙালির গান শোনার কান সবে তৈরী হতে শুরু করেছে। কলকাতা বেতার ব্যবস্থা সবে শুরু হয়েছে - ১৯২৭এর ১৬ই অগস্ট, বাংলা চলচ্চিত্র তখনও নির্বাক। ঠিক এই সময়েই অসামান্য সাঙ্গীতিক প্রতিভা নজরুলকে ‘শিকার’ করলো গ্রামফোন কোম্পানী। নজরুলেরও স্থায়ী উপার্জনের প্রয়োজন ছিল। কলের গানের বণিক নিংড়ে নিলো নজরুলকে। সেই সময় নজরুলের লেখা এবং তাঁর প্রশিক্ষণে গান রেকর্ড করার জন্য লাইন পড়ে যেতো, কারণ তাঁর রচনা ও সুর মানেই ছিল সেই শিল্পীর অবধারিত সাফল্য ও লোকপ্রিয়তা। তিরিশের দশকে সেকালের প্র্মুখ শিল্পীরা – আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, কমলা ঝরিয়া, কাশেম মল্লিক, আব্বাসউদ্দীন, যুথিকা রায়, মৃণালকান্তি ঘোষ, ধীরেন দাস, ফিরোজা বেগম, সুপ্রভা সরকার এবং আরো অনেকেই নজরুল গানের সার্থক শিল্পী রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। এঁরা সকলেই নজরুলের প্রশিক্ষণে গ্রামফোনে গান গেয়েছেন। বস্তুত রবীন্দ্রগানের বাইরে আধুনিক বাংলা রেকর্ডের গানে কাব্যের লাবণ্য ও পরিশীলিত গায়ন ভঙ্গি প্রথম নিয়ে এসেছিলেন নজরুলই। চল্লিশ থেকে ষাট দশক পর্যন্ত যে সময়কালকে আমরা বলি বাংলা গানের স্বর্ণযুগ। সেই স্বর্ণযুগের গানের জলসায় তিনি নেই। কিন্তু সংশয়ের যায়গা নেই এই স্বর্ণযুগের প্রস্তুতিপর্ব সারা হয়েছিল নজরুলের হাতেই।

রবীন্দ্রনাথ নিজের গানের ভবিষ্যৎ দেখেছিলেন – বলেছিলেন ‘বাঙালি সুখে দুঃখে আমার গানই গাইবে, এ গান তাদের গাইতেই হবে’। নজরুলও তেমনই আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন। ১৯৩১এ জনসাহিত্য সংসদের অধিবেশনের ভাষণে নজরুল আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিলেন “সাহিত্যে দান আমার কতটুকু তা আমার জানা নেই, তবে এটুকু মনে আছে, সংগীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি। সংগীতে যা দিয়েছি সে সম্বন্ধে আজ কোন আলোচনা না হলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে তখন আমার কথা সবাই মনে করবেন – এ বিশ্বাস আমার আছে”। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা ও সুর সংরক্ষণের বন্দোবস্ত ছিল, শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর প্রয়াসে রবীন্দ্রনাথের গান পেয়েছে এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ কিন্তু নজরুলের গানের ক্ষেত্রে তা হয়নি । নজরুলের বহু গানের কথা ও সুর হারিয়ে গেছে, অনেক নজরুল ভক্ত তাঁর গানকে নিজের গান বলেও চালিয়ে দিয়েছেন একথাও শোনা যায়। নজরুলের অনভিজাত দিলখোলা জীবন যাপনই এরকম সুযোগ করে দিয়েছিল। দু খিলি জর্দাপান খাইয়েই নাকি গান লিখিয়ে নেওয়া যেত তাঁকে দিয়ে। 

গানের জগতে নজরুল ছিলেন মাত্র বারো বছর, আর এই অল্প সময়কালেই, বিপণনযোগ্য বাংলা গানের ভুবনকে শাসন করেছেন, ধারে কাছে কেউ ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথও নয়। সত্য বটে, নজরুলের গানে রবীন্দ্রনাথের গানের মত আলোক সামান্য নান্দনিক স্পর্শ ছিল না। তাঁর গান ছিল স্বতস্ফূর্ত, সরল, আবেদনে প্রত্যক্ষ আর তাই শিক্ষিত, অশিক্ষিত সকলকেই স্পর্শ করে তাঁর গান। আধুনিক বাংলাগানের ক্ষেত্রে নজরুল জনপ্রিয়তার শিখরে উঠলেন আর এই সূত্রেই বাংলার বিদগ্ধ মহল ও তাঁর কবি বন্ধুদের কাছ থেকে পেলেন উপেক্ষা। তাঁরা অনেকেই দূরে সরে গেলেন। গ্রামফোন কোম্পানীর বেতনভোগী চাকুরে, বণিক কোম্পানীর নির্দেশমত হালকা চটুল গানের নির্মাণও তাকে করতে হয়েছিল পেটের দায়ে। বাংলা সংগীতের ভাণ্ডারকে নজরুল ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছেন, কিন্তু গ্রামফোন কোম্পানীর বানিজ্যিক স্বার্থ মেটাতে গিয়ে কম মূল্য চোকাতে হয়নি নজরুলকে। সেই মূল্য তাঁর সমাজসচেতন গণমুখী কাব্যচেতনার সঙ্গে চির বিচ্ছেদ। ইসলামী গান, বাংলা গজল গানের জন্য বিরূপ হয়েছিলেন হিন্দুরা, তাঁর কবিবন্ধুরা আর শ্যামা সংগীত রচনার জন্য বিধর্মী আখ্যা পেয়েছিলেন মৌলবাদী মুসলিমদের কাছ থেকে। গানের নজরুলের কাছ থেকে তাঁর বন্ধুদের দূরে সরে যাওয়া বা রেকর্ড কোম্পানীর দাসত্ব মেনে নেওয়া নজরুলকে গ্লানিবোধে আক্রান্ত ও বিষাদগ্রস্ত করেছিল সেকথাও আমরা জানি। রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি পত্রে নজরুল লিখেছিলেন “গুরুদেব, বহুদিন আপনার শ্রীচরণ দর্শন করিনি। আমার ওপর হয়তো প্রসন্ন কাব্যলক্ষী হিজ মাস্টার্স ভয়সের কুকুরের ভয়ে আমাকে ত্যাগ করেছেন। কাজেই সাহিত্যের আসর থেকে আমি প্রায় স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছি। ... আমার এক নির্ভিক বন্ধু আমাকে উল্লেখ করে একবার বলেছিলেন যাকে বিলিতি কুকুরে কামড়েছে তাকে আমাদের মাঝে নিতে ভয় হয়। সত্যি ভয় হবারই কথা, তবু কুকুরে কামড়ালে লোকে নাকি ক্ষিপ্ত হয়ে অন্যকে কামড়াবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আমার কিন্তু সে শক্তি নেই, আমি হয়ে গেছি বীষ জর্জরিত নির্জীব”। (সূত্র – ‘অঞ্জলী লহ মোর সংগীতে’ / অরুণ কুমার বসু , ‘পুরশ্রী’ পত্রিকা, জুলাই ১৯৯৯)। আর্থিক অসাচ্ছল্য, পুত্র বুলবুলের অকাল মৃত্যু, নিকটজন ও কবিবন্ধুদের দূরে সরে যাওয়া, স্ত্রী প্রমিলার পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী হয়ে পড়া নজরুলকে ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত, বিষাদগ্রস্ত করেছিল। কিন্তু সেই ক্লান্তি, বিষাদের বিন্দুমাত্র ছায়াপাত তাঁর সংগীত সৃষ্টিতে পড়েনি। শুধু অফুরন্ত দিয়ে গেছেন বাংলা গানের ভাণ্ডারে। ভেতরের ক্ষয় গোপন করে শুধু রাশি রাশি দিয়ে গেছেন।

গ্রামফোন রেকর্ডের গান নিশ্চিতভাবেই ‘গানের নজরুলের’ সামগ্রিক পরিচয় নয়। তাঁর জাগরণের গান, যৌবনের গান প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে প্রবাদের মত হয়ে আছে। সেখানে আজও তাঁর আসন অটল। নজরুলের সচেতন সৃষ্টির সময়কালই তো মাত্র ২১বছরের – ১৯২০ থেকে ১৯৪১। ১৯৪২এর অগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে তিনি যখন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন তখন তাঁর বয়স সবে বিয়াল্লিশ। ফুলের জলসায় নীরব কবি বেঁচেছিলেন আরো ৩৫ বছর। ১৯৭৬এর ২৯শে অগস্ট নজরুলের দেহাবসান হয়। সে তো তাঁর দেহের মৃত্যু। নজরুল ইসলাম বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন মৃত্যুঞ্জয়ী বীরের মর্যাদায়। বাংলার শেষ চারণকবি নজরুলের গান কিংবা গানের নজরুল সম্পর্কে কথা সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে উপসংহার টানি এই নিবন্ধের – “...দুঃখের পথে আর এক পাথেয় নজরুলের গান। বুকভরা, কন্ঠভরা গান। অপরাজিত প্রাণের আনন্দিত উদার জলোচ্ছ্বাস – রাত্রির সীমান্তে প্রভাতী পাখির কলধ্বনি” । (‘নজরুল স্মৃতি’)


1 comments:

0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in


প্রবন্ধ



রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রে বাংলার পল্লীপ্রকৃতির রূপমাধুর্য 
মনোজিৎকুমার দাস 



বাঙালির নবজাগরণে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অবদান স্বর্ণাক্ষরে লিখিত। বাংলার কৃষ্টি সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করার ক্ষেত্রে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রতিভাধর নারী পুরুষদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । এই সংস্কৃতিবান পরিবারের কন্যা ইন্দিরা দেবী (১৮৭৩-১৯৬০) সঙ্গীতশিল্পী, লেখক ও অনুবাদক । তাঁর পিতা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পিতৃব্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত জ্ঞানদানন্দিনী তাঁর মাতা। চিন্তাচেতনা ও আদর্শগত দিক থেকে ইন্দিরা দেবী রবীন্দ্রনাথের ভাবশিষ্যা ও মানস সঙ্গিনী । 

পত্র সাহিত্য রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের অন্যতম শাখা। তাঁর পত্রসাহিত্য তাঁর গল্প -উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, কবিতা, গানের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তাঁর পত্র সাহিত্যের অন্যতম হচ্ছে ‘ছিন্নপত্র’। ছিন্নপত্রের চিঠিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে রবীন্দ্রনাথ প্রায় ২২টি জায়গা থেকে চিঠিগুলো লিখেছিলেন। জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশের শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসর, কালিগ্রাম গোয়ালন্দ, বোয়ালিয়া, নাটোর, কুষ্টিয়া, ইছামতি, দিঘাপতিয়া, পাবনা, ইত্যাদি। সবচেয়ে বেশি চিঠি লিখেছিলেন শিলাইদহ থেকে ৫৬ খানা, সাজাদপুর থেকে ২৬ খানা, পতিসর থেকে ১৩ খানা। আর সবচেয়ে বেশি চিঠি লিখেছিলেন ভ্রাতুপুত্রী ইন্দিরাকে। ছিন্নপত্র রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশের নদীমাতৃক নিসর্গের অতি অন্তরঙ্গ এক পত্রকাব্য। রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্রের প্রতিটি ছত্রে ছত্রে পদ্মাতীরের সুখ সৌভাগ্য, আনন্দ চিত্র কাব্যিক ভাষায় তাঁর আদরের ভ্রাতুপুত্রী ইন্দিরাকে লিখেছেন। প্রথমে রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী সম্বন্ধে আলোচনা করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না ।

ইন্দিরা দেবীর জন্ম ২৯ ডিসেম্বর ১৮৭৩ সালে কলকাতা থেকে অনেক দূরে বোম্বাই প্রদেশের বিজাপুরের অন্তর্গত কালাদিঘিতে। পিতা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র এবং ভারতের প্রথম আই সি এস, কন্যার জন্মকালে বোম্বাই প্রদেশে কর্মে নিযুক্ত। মাতা জ্ঞানদানন্দিনী অসামান্যা সুন্দরী, অসাধারণ গুণবতী। বিয়ের পর তিনি আপন প্রতিভাবলে উচ্চশিক্ষিতা হন। পিতা মাতার আদর যত্নে ইন্দিরা ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে থাকেন। 

ইন্দিরার পিতা সত্যেন্দ্রনাথ আমেদাবাদ সেসন জজ, বোম্বাই প্রদেশে সে সময় পর্যন্ত প্রায় চৌদ্দ বছর ধরে চাকরি করার পর ছুটির জন্য তিনি আবেদন করেন। নিয়মানুসারে সেপ্টেম্বর মাসের আগে সে ছুটি পাওয়া যাবে না। সে সময়ে বেশ শীত পড়ে যাবে। শিশুরা শীতে কষ্ট পাবে ভেবে শীতের আগেই স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীকে পুত্র-কন্যাসহ বিলাতে পাঠিয়ে দিলেন। ইন্দিরার বয়স তখন পাঁচ। লন্ডন থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে সাসেক্স জেলার ব্রাইন নামক এক সমুদ্রতীরস্থ শহরে ইন্দিরা তার মায়ের সাথে বাস করতে থাকেন।

তারপর ১৮৭৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর ছোট ভাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লন্ডন পাড়ি দেন। আর সেটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিলাত যাত্রা। দূর বিদেশে ৫ বছর বয়সী শিশু ইন্দিরাকে কাছে পেয়ে রবীন্দ্রেনাথের মন খুশিতে ভরে ওঠে। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, “শিশুদের কাছে হৃদয়কে দান করিবার অবকাশ সেই আমার জীবনে প্রথম ঘটিয়াছিল।” 

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রীকে নিজে পড়ে শোনাতেন ছোটদের‘ হেলেন’স বেবীস, আর তাঁকে পড়তে দিয়েছিলেন লুই ক্যারলের ‘এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যড এবং ‘থ্রো দি লুকিং গ্লাস’ ইত্যাদি বই। 

শিশু বয়স থেকে রবি কাকার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ইন্দিরার মনে গেঁথে ছিল। ইন্দিরা দেবী তাঁর লেখা ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’তে লিখেছেন, “রবিকাকা ছোট ছেলেমেয়েকে স্বভাবতই ভালোবাসতেন, আমাদের ভাইবোনকে দিয়ে এ বিষয়ে তাঁর হাতেখড়ি হয়। বিলেতে গিয়ে আমাদের সঙ্গে সেই যে তাঁর ভাব হয়ে গিয়েছিল, সেটা শেষজীবন পর্যন্ত অটুট ছিল। ছেলেদের মন ভোলানোর তাঁর এক উপায় ছিল, নানারকম মজা করে গান গাওয়ান।” 

অতি শৈশবেই ইন্দিরা তাঁর সাহিত্যপ্রীতির পরিচয় দেন। তার মূলে ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। কিশোরী ইন্দিরার মন সাহিত্যরসে আপ্লুত না থাকলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রীকে যে ভাষা ও অনুষঙ্গে চিঠিগুলো লিখতেন তা হৃদয়ঙ্গম করা ইন্দিরার পক্ষে সহজ হতো না। এ কথার স্বীকৃতি মেলে ইন্দিরা দেবীর লেখা এ কথা থেকে, “আমার যখন আন্দাজ ন’বছর বয়স তখন থেকেই অক্ষয় চৌধুরীকে কবিতায় চিঠি লিখতুম।”

১৮৮০ সালে ইন্দিরা দেশে ফিরে আসেন। বয়স তখন তাঁর সাত বছর। পডাশুনোর জীবন আরম্ভ হল। তাঁকে ভর্তি করা হল সিমলার অকল্যান্ড হাউস স্কুলে। ওখান থেকে কলকাতায় এলেন পরের বছরে। ভর্তি হলেন এবার লরেটো হাউসে। ছ’বছর এখানে পডাশুনো করে ১৮৮৭ সালে ইন্দিরা এনট্রান্স পাশ করেন। এবার বাড়িতে বসেই পড়াশুনো আরম্ভ হল। পাশ করলেন এফ এ এবং বি এ। বি এ পাশ করলেন ১৮৯২ সালে অতিরিক্ত অধীত বিষয় ফরাসি ভাষা নিয়ে। সেই বছরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়ে-পুরুষ সবার নম্বর মিলিয়ে ইংরেজি বিষয়ে হলেন প্রথম; আর শুধু মেয়েদের মধ্যে প্রথম হলেন যোগফলে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে। তাঁর মেধার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘পদ্মাবতী ’ পদক লাভ করেন। 

রবীন্দ্রনাথ ভ্রাতুষ্পুত্রীকে ফরাসিভাষা শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করেন। ইন্দিরা দেবী ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’তে লিখেছেন ,“আমি লরেটো স্কুলে ফরাসি শিখতুম বলে একবার আমার জন্মদিনে স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি, টেবিলের উপর তখনকার দিনের বিখ্যাত ফরাসি কবি কপ্পে, মেরিমে, কঁৎদলীল লা ফঁতেন প্রভৃতির রচনাবলী সুন্দর করে বাঁধিয়ে সোনার জলে তাদের নাম ও আমার নাম লিখিয়ে সাজিয়ে রেখেছিলেন। দেখে যে কত আনন্দ হয়েছিল বলা যায় না। এখনো সেই বইগুলি শান্তিনিকেতনের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের শোভাবর্ধন করছে ।” 

রবীন্দ্রনাথ এর মাঝেই কবিতা, সঙ্গীত, গল্প উপন্যাস লিখে নিজের আসন পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন । ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা রবীন্দ্রনাথের লেখালেখি, গান, নাটক ইত্যাদির সঙ্গে মনে প্রাণে সম্পৃক্ত হন। ইন্দিরা ইতিমধ্যেই ট্রিনিটি কলেজ অফ মিউজিক থেকে ডিপ্লোমা অর্জন করেন এবং বাদ্রিদাস মুকুলের নিকট উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিক্ষা করেন। ইন্দিরা দেবী রবীন্দ্রসঙ্গীতে এবং পিয়ানো, বেহালা ও সেতার বাজনায় পারদর্শী হন। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতে স্বরলিপি রচনা করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের ‘মায়ার খেলা’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘কালমৃগয়া’ ইত্যাদি সহ দু’শ রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি রচনা করেন, আর সেই সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বহু স্বরলিপি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন ।

ইন্দিরার যখন ছাব্বিশ বছর বয়স তখন আইনজীবী প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে ১৮৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর বিয়ে হয়। ইন্দিরা ‘দেবী’ ‘দেবীচৌধুরানী’ হলেন। প্রমথ চৌধুরী তখন সবেমাত্র ব্যারিস্টারি পাস করে এসে প্রাকটিস শুরু করেছেন। সে সময়েই তাঁর পডাশুনোর গভীরতা ও সাহিত্যানুরাগের কথা ঠাকুরবাড়ির লোকেরা জেনেছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর অগ্রজ আশুতোষ চৌধুরীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘদিনের পরিচয়। আশুতোষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘সাহিত্যের সঙ্গী’। লেখালেখির সূত্রে প্রমথ চৌধুরীও রবীন্দ্রনাথের বন্ধু হলেন। প্রমথ চৌধুরী আইনজীবী থেকে সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীতে পরিণত হন অল্পদিনের মধ্যেই।

পড়াশোনা, গানবাজনা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যে ইন্দিরার কৃতিত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের অবদান কোন অংশেই কম নয়। এ প্রসঙ্গে ইন্দিরা দেবী নিজেই লিখেছেন, “সিমলা থেকে নেমে এসে সেই যে বছর আষ্টেক বয়সের পর কলকাতার স্কুলে ভর্তি হলুম তখন থেকে প্রায় তাঁর জীবনান্ত পর্যন্ত রবিকাকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব আমাদের সাহিত্যজীবনকে গড়ে তুলেছিল, এ কথা অবশ্যই স্বীকার্য। সে ক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত আমরা যা কিছু করেছি, হয়েছি, এমন কি ভেবেছি, পর্যন্ত তা তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাবে আচ্ছন্ন।”

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি শিক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্যে কৃতিত্বের দাবীদার। সে সময়ে ঠাকুরবাড়ি থেকে বেশ কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। বিভিন্ন সময়ে ঠাকুরবাড়ি থেকে বিভিন্ন পত্রিকা প্রকাশ পায়। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, ‘বালক’ পত্রিকার কথা। রবীন্দ্রনাথ পরিচালিত এবং ইন্দিরার মাতা জ্ঞানদানন্দিনী দেবী-সম্পাদিত ‘বালক’ পত্রিকায় ইন্দিরার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। ওটা ছিল রাস্কিনের একটি রচনার অংশ বিশেষের তরজমা। তিনি রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধসহ ‘জাপানযাত্রীর ডায়রী’র ইংরেজি অনুবাদ করেন। ইন্দিরার সাহিত্য জীবনে অনুবাদের সাহায্যে বিদেশি সাহিত্যের রস গ্রহণ এবং রবীন্দ্রসাহিত্যের রস বিদেশকে উপহার দেওয়া ইন্দিরার সাহিত্য জীবনের উজ্জ্বল অধ্যায়। কৈশোর থেকে অনুবাদকর্মে অনুরাগ তাঁকে উত্তরজীবনে দক্ষ অনুবাদক হিসাবে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। ‘বামাবোধিনী’, ‘বঙ্গলক্ষ্মী’, ‘সাধনা’, ‘সবুজপত্র’, ‘পরিচয়’, ইত্যাদিতে তাঁর অনূদিত গল্প, সঙ্গীত ও সাহিত্যবিষয়ে তাঁর অনেক মৌলিক রচনা প্রকাশিত হয় বঙ্গনারীর শুভাশুভ বিষয়ে তাঁর মতামত ‘নারীর উক্তি’ নামক প্রবন্ধে বিধৃত করেছেন। এখানে উল্লেখ করার মত একটা বিষয় হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলী ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন মনীষী আঁদ্রে জিদ। অন্যদিকে, গীতাঞ্জলীর অতিবিখ্যাত ভূমিকাটি ফরাসিতে অনুবাদ করেছিলেন ইন্দিরা দেবী। ইন্দিরা দেবী পরবর্তীকালে এ ছাড়াও বেশকিছু মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলো মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য -- ‘শ্রুতি- স্মৃতি’, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতে ত্রিবেণী সঙ্গম (১৯৫৪), ‘রবীন্দ্রস্মৃতি (৫খণ্ড, ১০৫৯) ইত্যাদি।

ইন্দিরা রবীন্দ্রনাথের কত স্নেহভাজন ছিলেন তা বোঝা যায় তাঁকে লেখা রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিগুলো থেকে। রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিগুলো থেকে ইন্দিরার মনের ও রুচির প্রসারতা ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্নেহের ভ্রাতুষ্পুত্রীকে একগুচ্ছপত্রে পদ্মা ও তার চারপাশের নিসর্গ ও মানুষের কথা এবং তাঁর চারণক্ষেত্র শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসর, ইত্যাদি স্থানে দেখা নানা অনুষঙ্গের কথা লিখেছিলেন। জমিদারী দেখাশোনার কাজে এক সময় দফায় দফায় পদ্মাতীরে এবং পদ্মাবক্ষে পদ্মাবোটে বাস করতে হয়েছিল। তাঁকে কাটাতে হয়েছিল পদ্মা ও পদ্মার শাখা নদীগুলোর তীরবর্তী মানুষদের ও প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে। সময়টা ১৮৮৫ থেকে ১৮৯৫ সাল। এই দশ বছরে সময়ের মধ্যে কবি স্নেহের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে বেশ কিছু ব্যক্তিগত চিঠি লেখেন । এই সব চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাবনা, কল্পনা, ধ্যানধারণা, মানুষজন, নদনদী ও প্রকৃতিক সৌন্দর্যকে সহজ সরল সাবলীল গদ্যে লিখেছেন। 

ইন্দিরা দেবী চিঠিগুলোর ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অংশ বাদ দিয়ে সাহিত্য সম্পর্কীত অংশ একটি খাতায় লিখে রাখেন। পত্রগুলোর ‘ছিন্নদশা’ এভাবেই শুরু হয়। পরে এই সব পত্রাংশকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আরো একবার পরিমার্জন করেন। পরিমার্জিত পত্রগুচ্ছ ১৯১২ সালে ‘ছিন্নপত্র’ নামে প্রকাশিত হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মাত্র শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লিখিত পত্র সংযুক্ত হলেও ছিন্নপত্রে অধিকাংশ পত্র ইন্দিরা দেবীকে লেখা। 

উনিশ শতকের শেষ দশকের বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, পাবনা, ও রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ, প্রকৃতি ও পরিবেশের চিত্র উঠে এসেছে ছিন্নপত্রে। চব্বিশ বছরের তরুণ রবীন্দ্রনাথ পত্রগুলো লিখতে শুরু করেন, আর লিখেছেন চৌত্রিশ বছরের তারুণ্য পর্যন্ত। বলা যায় তারুণ্যের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন তাঁর লেখা পত্রগুচ্ছে। অবশ্যই তাঁর লেখার মধ্যে রোমান্টিকতা আছে।ছিন্নপত্রের পত্রগুলোতে রবীন্দ্রনাথ নিটোল বর্ণনায় প্রকৃতির বৈচিত্রকে উপস্থাপন করেছেন অসংখ্য রূপক, উপমার সাহায্যে। সামান্য বিষয়বস্তু, গাছপালা বৃক্ষলতা, নদনদী, গায়ের কিশোর কিশোরী, চাষী, মজুর এমনকি সমাজের অপাক্তেয় বেদেরদের যাযাবর জীবনের কথা রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়ায়নি। এক কথায় বলা যায় মাঠঘাটের ছোট্ট তৃণটি থেকে বিশালাকৃতির হাতি, বর্ষার পদ্মার বিপুল জলরাশির প্রচণ্ড স্রোত। বিল আর ঝিলের নিস্তরঙ্গ জল, শিলাইদহ সহ পদ্মার চরগুলোতে নির্জন নিস্তব্ধতাকে উপলব্ধি করার কথা তিনি তুলে ধরেছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্নেহের ইন্দিরাকে লিখছেন- ‘তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনো লেখায় হয়নি। ...তোকে আমি যখন লিখি তখন আমার এ কথা কখনো মনে উদয় হয় না যে, তুই আমার কোন কথা বুঝবি নে, কিম্বা ভুল বুঝবি, কিম্বা বিশ্বাস করবি নে, কিম্বা যেগুলো আমার পক্ষে গভীরতম সত্য কথা সেগুলোকে তুই কেবলমাত্র সুরচিত কাব্যকথা বলে মনে করবি। সেই জন্যে আমি যেমনটি মনে ভাবি ঠিক সেই রকমটি অনায়াসে বলে যেতে পারি...’

ইন্দিরাকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির ওপরের অংশে তিনি তাঁর আদরের ভ্রাতুষ্পুত্রীকে নিজের মনের অনুভূতি যে ভাবে প্রকাশ করেছেন, তা থেকে উপলব্ধি করা যায় তাঁর মনের সঙ্গিনী ছিলেন।

পূর্ববঙ্গে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথের দেখা বাংলাদেশের নদীমাতৃক নিসর্গের অনুষঙ্গ ও অনুভূতি কাব্যিক ভাষায় ইন্দিরা দেবীকে জানিয়েছে এক একটা পত্রে। শিলাইদহ কুঠিবাড়ির দু’পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা ও গড়াই নদী, সাজাদপুর ও পতিসরের কাচারী বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদনদী এবং মানুষজন, নিসর্গ প্রকৃতি, জল জমিন, নৌকা - মাঝি মাল্লা, গাছপালা, ফলফুল, ইত্যাদি রবীন্দ্রনাথের মানসপটে যে ভাবে ধরা দিয়েছে, তা তাঁর বিদুষী ভ্রাতুষ্পুত্রীকে কাব্যিক গদ্যে লিখেছেন। ইন্দিরাকে লেখা রবীন্দ্রনাথের সেই সব চিঠির কয়েকটা থেকে অংশ বিশেষ এখানে তুলে ধরলে পাঠক বুঝতে পারবেন বিদুষী ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা রবীন্দ্রনাথের মনে কী আসন লাভ করেছিলেন। 

এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ভ্রাতুষ্পুত্রীকে গ্রামের খালের পাড়, বেদেদের ছাউনি ফেলার দৃশ্য তুলে ধরেছেন -- ‘আমার সামনে নানারকম গ্রাম্য দৃশ্য দেখতে পাই, সেগুলো আমার দেখতে বেশ লাগে। ঠিক আমার জানলার সুমুখে, খালের ওপারে, একদল বেদে বাখারির উপর খানকতক দর্মা এবং কাপড় টাঙিয়ে দিয়ে তারই মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। গুটিতিনেক খুব ছোট ছোট ছাউনি মাত্র- তার মধ্যে মানুষের দাঁড়াবার জো নেই। ঘরের বাইরেই তাদের সমন্ত গৃহকর্ম চলে।’

আর এ চিঠিতে তিনি ইন্দিরাকে লিখছেন গ্রামের সুখদুঃখের কাহিনী এভাবে--‘ আমাদের এই মাটির মা, আমাদের এই আপনার পৃথিবী, এর সোনার শস্যক্ষেত্রে এর স্নেহশালিনী নদীগুলোর ধারে, এর সুখদুঃখময় ভালোবাসার লোকালয়ের মধ্যে এই সমস্ত দরিদ্র মর্ত্য হৃদয়ের অশ্রুর ধনগুলিকে কোলে করে এনে দিয়েছে বালি।’ রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরাকে তাঁর প্রিয় শিলাইদহ কুঠিবাড়ির যে বিবরণ দিয়ে কতটা তাঁর মনের মাধুরী মেশানো তা পড়লেই বুঝতে পারা যায়। 

‘শিলাইদহের অপর পারে একটা চরের সামনে আমাদের বোট লাগানো আছে। প্রকাণ্ড চর- ধু ধু করছে- কোথাও শেষ দেখা যায় না- কেবল মাঝে মাঝে এক এক জায়গায় নদীর রেখা দেখা যায়- আবার অনেক সময়ে বালি’কে নদী বলে ভ্রম হয়।... গ্রাম নেই, লোক নেই, তরু নেই, তৃণ নেই- বৈচিত্রের মধ্যে জায়গায় জায়গায় ফাটল-ধরা ভিজে কালো মাটি, জায়গায় জায়গায় শুকনো সাদা বালি।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনেক গল্প উপন্যাস, কবিতা লিখেছিলেন শিলাইদহ, সাজাদপুর, পদ্মাবোটে, পতিসরে বসেই।

‘অনেক কাল বোটের মধ্যে বাস করে হঠাৎ সাজাদপুরের বাড়িতে এসে উত্তীর্ণ হলে বড়ো ভালো লাগে। বড়ো বড়ো জানলা দরজা, চারিদিক থেকে আলো বাতাস আসছে... যেদিকে চেয়ে দেখি সেই দিকেই গাছের সবুজ ডালপালা চোখে পড়ে এবং পাখির ডাক শুনতে পাই।......বিশেষত এখানকার দুপুর বেলাকার মধ্যে একটা নিবিড় মোহ আছে। রৌদ্রের উত্তাপ, নিস্তব্ধতা, নির্জনতা, পাখিদের- বিশেষত কাকের ডাক, এবং সুন্দর সুদীর্ঘ অবসর- সবসুদ্ধ আমাকে উদাস করে দেয়। ...কেন জানি নে মনে হয়, এইরকম সোনালি রৌদ্রে ভরা দুপুর বেলা দিয়ে আরব্য উপন্যাস তৈরি হয়েছে।...আমার এই, সাজাদপুরের দুপুর বেলা গল্পের দুপুর বেলা। মনে আছে, ঠিক এই সময়ে এই টেবিলে বসে আপনার মনে ভোর হয়ে পোস্টমাস্টার গল্পটা লিখেছিলুম। ... ..এখানে যেমন আমার মনে লেখবার ভাব ও ইচ্ছা আসে এমন কোথাও না। বাইরের জগতের একটা সজীব প্রভাব ঘরে অবাধে প্রবেশ করে। ...আলোতে আকাশে বাতাসে শব্দে গন্ধে সবুজ হিল্লোলে এবং আমার মনের নেশায় মিশিয়ে কত গল্পের ছাঁচ তৈরি হয়ে ওঠে!...... 

রবীন্দ্রনাথ আর একটি চিঠিতে ইন্দিরাকে লিখছেন----‘অনেকে বাংলাদেশকে সমতলভূমি বলে আপত্তি প্রকাশ করে; কিন্তু সেইজন্যেই এ দেশের মাঠের দৃশ্য, নদীতীরের দৃশ্য আমার এত বেশি ভালো লাগে। যখন সন্ধ্যার আলোক এবং সন্ধ্যার শান্তি উপর থেকে নামতে থাকে তখন সমস্ত অনবরদ্ধ আকাশটি একটি নীলকান্তমণির পেয়ালার মতো আগাগোড়া পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে, যখন স্তিমিত শান্ত নীরব মধ্যাহ্ন তার সমস্ত সোনার আঁচলটি বিছিয়ে দেয় তখন কোথাও সে বাধা পায় না। 

রবীন্দ্রনাথের মনের সঙ্গী কারা হবে সেকথাই প্রকাশ করেছেন এ চিঠিতে তাঁর মানস সঙ্গিনী ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে ---‘কাল থেকে হঠাৎ আমার মাথায় একটা হ্যাপি থট এসেছে। আমি চিন্তা করে দেখলুম, পৃথিবীর উপকার করব ইচ্ছা থাকলেও কৃতকার্য হওয়া যায় না; কিন্তু তার বদলে যেটা করতে পারি সেইটে করে ফেললে অনেক সময় আপনিই পৃথিবীর উপকার হয়, নিদেন যা হোক একটা কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। আজকাল মনে হয়, যদি আমি আর কিছুই না করে ছোট ছোট গল্প লিখতে বসি তা হলে কতকটা মনের সুখে থাকি এবং কৃতকার্য হতে পারলে হয়তো পাঁচজন পাঠকেরও মনের সুখের কারণ হওয়া যায়। ...গল্প লেখবার একটা সুখ এই, যাদের কথা লিখব তারা আমার দিনরাত্রির সমস্ত অবসর একেবারে ভরে রেখে দেবে, আমার একলা মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার সময় আমার বদ্ধ ঘরের সংকীর্ণতা দূর করবে।
------কিন্তু কী চমৎকার হয়েছিল, কী বলব! কতবার বলেছি, কিন্তু সম্পূর্ণ কিছুতেই বলা যায় না। নদীতে একটি রেখামাত্র ছিল না; ও-ই সেই চরের পরপারে যেখানে পদ্মার জলের শেষ প্রান্ত দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে আর এ পর্যন্ত একটি প্রশস্ত জ্যোৎস্নারেখা ঝিক্ ঝিক্ করছে।... মনে হয়, যেন একটি উজাড় পৃথিবীর উপরে একটি উদাসীন চাঁদের উদয় হচ্ছে, জনশূন্য জগতের মাঝখান দিয়ে একটি লক্ষ্যহীন নদী বহে চলেছে, মস্ত একটা পুরাতন গল্পেই পরিত্যক্ত পৃথিবীর উপরে শেষ হয়ে গেছে। আজ সেই-সব রাজা রাজকন্যা পাত্র মিত্র স্বর্ণপুরী কিছুই নেই, কেবল সেই গল্পের ‘তেপান্তরের মাঠ’ এবং ‘সাত সমুদ্র তেরো নদী’ ম্লান জ্যোৎস্নায় ধু ধু করছে। ... আমি সেই মুমূর্ষ পৃথিবীর একটিমাত্র নাড়ীর মতো আস্তে আস্তে চলছিলুম।

পূর্ববাংলার নদনদী, মাঠঘাট, গাছপালার নির্জনতা রবীন্দ্রনাথের মনে কতটা রেখাপাত করেছিল, তা তিনি তাঁর ইন্দিরাকে লেখা পত্রে মনোমুগ্ধকর বর্ণনায় উঠে এসেছে এ ভাবে: ঐ যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে ওটাকে এমন ভালোবাসি। ওর এই গাছপালা নদী মাঠ কোলাহল নিস্তব্ধতা প্রভাত সন্ধ্য সমস্ত সুদ্ধ দু’হাত আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছা করে----- মনে হয় পৃথিবীর কাছে থেকে আমরা যে ধরতে ইচ্ছা করে--- মনে হয় পৃথিবীর কাছ থেকে আমরা যে এ পৃথিবীর ধন পেয়েছি এমন কি স্বর্গ থেকে পেতুম?------। আমাদের মাটির মা, আমাদের এই আপনার পৃথিবী, এর সোনার শস্যক্ষেত্রে, এর স্নেহশালিনী নদীগুলোর ধারে, এর সুখদুখঃময় ভালোবাসার লোকালয়ের মধ্যে এই সমস্ত দরিদ্র মর্ত্য হৃদয়ের অশ্রুর ধনগুলিকে কোলে করে এনে দিয়েছে।’

রবীন্দ্রনাথের মানসলোকে পূর্ববাংলার ঋতুচক্রের নানা দৃশ্য অপূর্ব অনুষঙ্গে ধরা দিয়েছিল। সবুজের মাঝে শরতের কাশের বনের কাশফুল কেমন করে তাঁর মনকে আপ্লুত করেছিল সে কথা এক পত্রে ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে লিখছেন এ ভাবে

--- এই সুবিস্তীর্ণ জলরাজ্যে মধ্যে শরতের উজ্জ্বল রৌদ্রে আমি জানালার কাছে এক চৌকিতে বসে আর এক চৌকিতে উপর পা দিয়ে সমস্ত বেলা কেবল গুনগুন কওে গান করছি।---- রামকেলি, প্রভৃতি সকালবেলাকার সুরের একটু আভাস লাগামাত্র এমন একটি বিশ্বব্যাপী করুণা বিগলিত হয়ে চারিদিককে বাষ্পাকুল করছে যে এই সমস্ত রাগিনীকে সমস্ত পৃথিবীর নিজের গান বলে মনে হচ্ছে। এ একটা ইন্দ্রজাল, একটা মায়ামন্ত্র। 

এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ এদেশের হতভাগাদের সম্বন্ধে তাঁর অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন এ ভাবে। আমরা হত হতভাগারা তাদের রাখতে পারি নে, বাঁচাতে পারি নে, নানা দৃশ্য প্রবল শক্তি এসে বুকের কাছ থেকে তাদের ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিয়ে যায়। কিন্ত বেচারা পৃথিবীর যতদূর সাধ্য তা সে করেছে-----আমি পৃথিবীকে বড় ভালবাসি।

কলকাতার ছেলে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববাংলার শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসর এবং পদ্মা বোটে বসে কালবৈশাখীর তাণ্ডবে গাছপালার মাথা লুটিয়ে পড়া, জলের টেউগুলো যেন ফণা তুলে নৃত্য করার কথা চিঠিতে কেমন ভাবে প্রকাশ করেছেন দেখা যেতে পারে। ‘ --- কাল পনের মিনিট বাইরে বসতে না বসতে পশ্চিম ভয়ানক মেঘ করে এল। খুব গাঢ় আলুথালু রকমের মেঘ, তারই মাঝে মাঝে চোরা আলো পড়ে রাঙা হয়ে উঠছে।------ গাছগুলো হাউহাউ শব্দে একবার পূর্বে একবার পশ্চিমে লুটিয়ে পড়তে লাগল। ঝড় যেন সোঁ সোঁ করে সাপুড়ের মতো বাঁশি বাজাতে লাগল। আর জলের ঢেউগুলো তিন লক্ষ সাপের ফণার  তালে তালে নৃত্য আরম্ভ করে দিল। ।

ছোটগল্পের জনক রবীন্দ্রনাথ বহু ছোটগল্প, কবিতা লিখেছিলেন বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে। এখানে তাঁর অসাধারণ ’ছুটি’ গল্পের কথা বলা যায়। এ গল্পের নায়ক ফটিক, ফটিকের দুরন্তপনা ও শেষ পরিণতির কথা তিনি অসাধারণ ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। এ গল্পটি সাজাদপুর কাচরিবাড়িতে বসে লেখা। রবীন্দ্রনাথ নৌকাযোগে তাঁর কাচারি বাড়িতে জমিদারী দেখাশোনা করতে আসতেন। এমনই একদিন ওই রকম নৌকা ঘাটে ভিড়েছিল। নদীর তীরে গ্রামের ছেলেগুলো খেলা করছিল। তাদের মধ্যে সর্দার গোছের ছেলে ছিল। সেই ছেলের ডানপিটেমিকে কেন্দ্র করেই তিনি ‘ফটিক’ চরিত্র অবতারণা করে ‘ছুটি’ গল্প লেখেন । 

ছিন্নপত্র কাব্যের নায়িকা যেন পদ্মা, নায়ক কবি রবীন্দ্রনাথ! পদ্মা যেন তাঁর পরাণ প্রিয়া, সে কথার অনুরণন আমরা দেখতে পাব তাঁর এ কবিতায়- ...হে পদ্মা আমার, তোমায় আমায় দেখা শত শত বার। একদিন জনহীন তোমার পুলিণে, গোধুলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে, সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অস্তমান তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরান। অবসান সন্ধ্যালোকে আছিলে সেদিন নতমুখী বধুসম শান্ত বাক্যহীন; সন্ধ্যাতারা একাকিনী সস্নেহ কৌতুকে চেয়ে ছিল তোমাপানে হাসিভরা মুখে। সেদিনের পর হতে, হে পদ্মা আমার, তোমায় আমায় দেখা শত শত বার।

ইন্দিরা দেবী যে স্নেহাধন্য ছিলেন তাঁর খুল্লতাত রবীন্দ্রনাথের, তা তিনি তাঁর লেখা ‘রবীন্দ্রস্মৃতি ( ৫খণ্ড, ১০৫৯)’ এর পাতায় পাতায় কৃতজ্ঞচিত্তে লিপিবদ্ধ করেছেন। ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতে ত্রিবেণী সঙ্গম’ (১৯৫৪) গ্রন্থে ইন্দিরা দেবী স্মরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথকে, যার স্নেহের পরশের তিনি সঙ্গীতে ঋদ্ধ হয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইন্দিরা দেবীচৌধুরানীকে ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক, ১৯৫৭ বিশ্বভারতী ‘দেকিকোত্তম’ উপাধি এবং ১৯৫৯ সালে রবীন্দ্রভারতী সমিতি প্রথম ‘রবীন্দ্রপুরস্কার'এ ভূষিত করে। ১৯৬০ সালের ১২ আগস্ট লোকান্তরিত হন। মানস সঙ্গিনীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের পত্রগুচ্ছে বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্য বর্ণনার প্রাপ্তিতেই ইন্দিরা দেবী চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন পাঠকের স্মরণে।  

0 comments:

1

প্রবন্ধ - পলাশ কুমার পাল

Posted in


প্রবন্ধ



সংরক্ষণে ছড়া
পলাশ কুমার পাল



"ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি
                    চামে কাটে মজুমদার
                                  ধেয়ে এলো দামোদর...."

ছোটবেলায় ঠাকুমার মুখে শোনা সে ছড়া। অনেকেরই শৈশব কেটেছে ঠাকুমার কোলের কাছে শুয়ে এইরূপ নানা ছড়া এবং নানা রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ায়। ঠাকুমার পাখার হাওয়া এবং চাঁদের জোত্‍স্না ছিল সোনার কাঠি এবং রূপোর কাঠি; যা রূপকথা আজ।

আজ ঠাকুমার 'মা'-কে বাদ দিয়ে ঠাকুর বানিয়ে ভক্তি-শ্রদ্ধা ঢালা হচ্ছে, ভালোবাসার কার্পণ্যতাকে ঢাকতে। ফলত সে সব ছড়া হারিয়েছে সংস্কৃতি থেকে। তবে নতুনভাবে ভক্তি এসেছে পাঠ্যসূচীতে। সংরক্ষণের ব্যবস্থা; ঠাকুমা-দাদুদের যেমন বৃদ্ধাশ্রম সংরক্ষণ করছে। আর এই পাঠ্যসূচীর চাপে দমবন্ধ হওয়া শিশুকে সংরক্ষণ করছে এইসব ছড়া। নতুন শিক্ষাব্যবস্থার নতুন দিক।

সভ্যতার বিবর্তনে নিজেদের আরও বেশি সভ্য করার নেশায় ভুলে যাচ্ছি সভ্যতার সীমাকে। অতিরিক্তের নেশায় মাতাল হওয়ার মতোই বিবর্তনের যুগে আমরা সভ্যতায় বুঁদ হয়ে পরছি সর্বচেতনাকে কালিমা লিপ্ত করে। অর্থ-সম্মান-প্রয়োজনীয়তার মতো গুটি কয়েক ঘুঁটিকে আগলাতে আগলাতে দাবার মতোই সাজিয়ে নিচ্ছি গোটা সমাজ। ফলত জীবনের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে কানামাছি-বৌবসন্তীর মতো নানা খেলা; যে খেলায় শৈশব হাসত আপন স্ফূর্তিতে খোলা আকাশের মতো কল্পনায়, বাতাসের মতো মৃদুহাসিতে...

আর এই হারিয়ে যাওয়ার তালিকায় ছড়ার এগিয়ে যাচ্ছে বিলুপ্তির দিকে। যে ছড়া মানুষের কল্পনাপ্রসূত মজার ছন্দকথন; যা মানুষকে হাসাত, জীবনের মাঝে জীবন হয়ে উঠত এবং শিশুদের কল্পনায় সম্পৃক্ত হয়ে শিশুমনকে আনন্দে জারিত করে মনকে বিস্তৃতি প্রদান করত উদার হৃদয়ের উত্‍স-পথে। বর্তমানে আত্মকেন্দ্রিকতার বৃত্ত চেতনমনের সেই সভ্যতাকে দখল করে বসেছে। ফলত ছড়া হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীতে বৃক্ষছেদনের মতো...

এই হারানোর একমাত্র কারণ কি কেবল আত্মকেন্দ্রিক মন? আমি বলব এর প্রত্যক্ষ কারণ আত্মকেন্দ্রিক মন হলেও পরোক্ষ কারণ হারিয়ে দেওয়া দাদু-ঠাকুমার ছন্দ। আধুনিক থেকে পুনরাধুনিকের পথে কবিতা যেমন ছন্দ হারিয়ে ফেলেছে, তেমনই পরিবার থেকে অস্তিত্বহীন হয়ে পরছে দাদু-ঠাকুমারা। একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙনের জোয়ারে একাকী মানুষ নিজের স্বার্থের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের রাশিকে সাজাতে সাজাতে পরিবারের মধ্যে বৃদ্ধের মুখ্য শিকড়টাকে বিনষ্ট করতে সচেষ্ট। ফলত শিকড়হীন পরিবার পারিবারিকতাকে হারাচ্ছে; হারাচ্ছে আনন্দ... আর নবপ্রজন্মকে দিচ্ছে ভবিতব্য মরুভূমির পাঠ; যেখানে জল নেই। কেবল বালি আর বালি... এই বালি আর বালির মধ্যে উদ্যানরূপ আধুনিকতা। অন্যভাবে বললে; গৃহপ্রবেশের সময় পুরানো অ্যালবাম, তাক, তক্তা বা আলমারির মতো পণ্যগুলোকে যেমন অবাঞ্জিত মনে করি, এই 'আধুনিকতা' নামক নতুন ঘরে গৃহপ্রবেশের সময় তেমনই বৃদ্ধদের প্রতি মনোভাবও একইরকম হয়ে পরছে আজ। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষার দেখানদারি চাকচিক্য সমাজ-দোকানে থাকলেও কর্মী হিসাবে অন্তরলোকে কেবল একটা বৃত্ত বেড়ে উঠছে। শূন্য। তাই দ্রব্য-গুণের নীচতাকে ঢাকতে সামনে কাঁচ ও আলোর মোহময়ী সজ্জা; খদ্দেরের কাছে নিজেদের জাতটাকে উচ্চ করতে। আর নানা অজুহাতের গল্পকাহিনীর ট্রাজেডি হয়ে বৃদ্ধরা সংরক্ষিত হতে থাকে আশ্রমে। সেখানেও আবার নতুন ব্যবসার মুখশ্রী। ফলে সংরক্ষণের নামে বৃদ্ধত্ব পঙ্গুত্বের নামান্তর। সেখানে কোনো ছড়া নেই, নেই আনন্দ! অথচ তাঁরই সন্তান-সন্তনি সুখী হয়ে উঠছে গৃহকোণে, সন্তানকে লালন-পালন করছে পণ্যের মতো। পুরানো অ্যালবাম বিতাড়িত করে নতুন অ্যালবামে ঘর সাজাচ্ছে। পণ্যের মতো তাদের গুণমান বৃদ্ধির জন্য শিক্ষাঙ্গনে ঢুকিয়ে দিচ্ছে শিশুমনের টুঁটি টিপে। শিশুমন যেন ইঁদুর-দৌড়ে নেমে পরছে। দৌড়াচ্ছে... রুদ্ধশ্বাসে দম বন্ধ করা দৌড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে শৈশব মরছে... এখানেই দার্শনিক রুশোর পরিবেশ থেকে শিশুশিক্ষার ভাবনা ধাক্কা খাচ্ছে। ধাক্কাই বা বলব কেন! এভাবে বলা যায় যে, শিশুরা এই প্রতিযোগিতার পরিবেশে প্রতিযোগী হয়ে ওঠার শিক্ষা পাচ্ছে। একটা নিটল গদ্য। নিরস!

তাদের পদ্য হয়ে ওঠা মাঠ-খেলা-ছড়া-দাদু-ঠাকুমা সব কোথায় হারাচ্ছে! লোকসংস্কৃতি তেমন শিক্ষার অজুহাতে বিলুপ্ত প্রায়। বংশ পরাম্পরায় বা সমাজ পরম্পরায় বা সংস্কৃতি পরম্পরয় যে সব বার-ব্রত এবং তারই সহযোগী ছড়া প্রচলিত হয়ে আসছিল প্রজন্মের ক্রমে; বৃদ্ধদের একঘরে করার সাথে সাথে সেগুলো একবৃত্তের মধ্যে ক্রমশ ছোট হয়ে পরছে... ছড়া শোনাবার মতো , আদর দেওয়ার মতো শিশুদের সঙ্গীর অভাব দেখা দিচ্ছে।

অন্যদিকে ছড়ার অভাব মেটাবার জন্য শিক্ষাঙ্গন নিজেদের মতো ফাঁদি জাল পাতছে। পাঠ্যসূচীতে মজার ছবি ও ছড়ার উপস্থাপনায় এক মোহময়ী ডাক, যেখানে শিশুর ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকে পদদলিত করে পিতা-মাতা মাখো মাখো হয়ে উঠছে। তিনবছরের শিশুর খেলার মাঠে বাবা-মা'র স্বপ্নরা অট্টালিকা হাঁকাচ্ছে... শিশুঘাস মরে যাচ্ছে, মানসিক উষ্ণায়নে সমাজ সভ্যতা স্লোগান তুলছে নতুন পৃথিবী গড়ার... আদেও কি এটাই সুস্থ পৃথিবীর অভিমুখে অগ্রগতি?

প্রশ্নের উত্তরে কবিতার উত্‍সমুখে যেতে হয়। মুখে মুখে প্রচলিত গাঁথা-কাহিনী-ছড়া থেকে ক্রমবিবর্তনে কবিতা এসেছে। কিন্তু তার প্রাথমিক ধাপ ছিল ছড়া। ছন্দ-মিল যুক্ত কিছু কথন। পরবর্তীতে ক্রমে ক্রমে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন চিত্রকল্প, অলংকার, চমকপ্রদ শব্দ বা নানারূপ ছন্দ। যেগুলো সেই পদ্যগুলোকে সহজপাচ্য থেকে কঠিন করেছে এবং পাঠকে ভাবনার গভীরে টেনে নিয়ে গেছে। কিন্তু এই গভীরতার মধ্যেও ছন্দের ঝংকারে লেখক-পাঠকে একাত্মতা তৈরি হয়ে যেত। কিন্তু আজ সেই ছন্দই নেই!

বরং আপন আপন মনের জ্ঞানগর্ভ গবেষণাধর্মী যুক্তি উঠে আসছে গদ্যের মতো। ভালো, কিন্তু ভালো নয়। কারণ এটাকে আমরা গদ্য বলি না। অজুহাত দিই গদ্যছন্দের যুক্তিতে। আসলে কবিতাগুলো এখানেই হার মানে, ঐ 'গদ্য' শব্দের ঋণগ্রস্থতায়। আসলে ছন্দে গদ্য বলে কিছু হয় না। অথচ কবির নাম রমরমাচ্ছে গদ্যকথনকে কবিতার নামান্তরে... আসলে সময়ের ধারা! যে ধারাতে শিক্ষা বা পরিবার নতুনপন্থী।

নীতিপথের থেকে যুক্তিপথ বড় হয়ে উঠছে... আর যুক্তির ঘুঁটিতে ঘুঁটিতে শিক্ষা নিজের চারিপাশে বলয় তৈরি করে নিচ্ছে... শিশুদের ছবি এবং ছড়ায় ভুলিয়ে পাঠের গহ্বরে ঢুকিয়ে নিচ্ছে... ছড়াগুলো এই অর্থে একপ্রকার ঐ বৃদ্ধদের মতোই সংরক্ষিত হচ্ছে। লোকসংস্কৃতিহীন ছড়া। শিশুগুলোও তাই। একটা কৃত্রিম পরিবেশে বসবাস। সেখানে মন নয়, দেহই রয় সহ্যের খাতিরে বা সময়ের ধারায়...

"ঘুমপাড়ানি           মাসি পিসি
মোদের বাড়ি এসো,
খাট নেই            পালঙ নেই
চৌকি পেতে বসো।"

এই ছড়ার কথনের মতো অসহায় হয়ে খাট ও পালঙের অভ্যাস ত্যাগ করে চৌকিকেই যেন মানিয়ে নিচ্ছি আজকাল।

"খোকা ঘুমালো         পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে         ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কীসে?"

সময়ের উঠানে, খেয়ে নেওয়া ধানের মতো হারিয়ে যাওয়া শৈশব বা ছড়া বা বৃদ্ধদের কী উত্তর দেব? বা কোন খাজনায় মেটাব তাদের শূন্যস্থানে?

আবার লক্ষ্য করলে দেখব, ঘুমপাড়ানি এইসব ছড়া যেমন মাতৃমুখ থেকে হারিয়েছে, তেমনই ঐ ছড়াগুলোর মধ্যে 'চৌকি' বা 'খাজনা' বা 'বর্গী' -এই শব্দগুলোও বর্তমানে অপ্রচলিত প্রায়। ফলত বইয়ে ছড়া পাঠে শিশুরা কেবল মূল্যায়নের ফলাফলে মান্যতা পাচ্ছে, হৃদয়ে হয়তো নয়। সমাজে তো নয়ই!

বলতে গেলে মূল্যায়নই এখন সবকিছুর মাপকাঠি। সেখানে বৃদ্ধ শিশু বা ছড়া কেউই বাদ যায় না। বাদ যায় না ঠাকুরও। ঠাকুরকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করি, পূজা করি। বিনিময়ে কিছু পাওয়ার আশাও করি। না পেলে সেই ভক্তি-শ্রদ্ধা সব অদৃশ্য হয়ে নিজেদের ভিতরের মুখ কর্কশ হয়ে প্রকাশিত হতে থাকে।

শিশুরা মূল্যায়নে ভালো ফল না হয়ে উঠলে পিতা-মাতার বিরাগের কারণ হয়। অন্যদিকে ছড়ার মূল্যায়ন শেষ হলে বা অতিক্রান্ত হলে ছড়াগুলো মন থেকে হারায়। কারণ সেগুলো লোকসামাজিক নয়। অন্যদিকে প্রয়োজন মিটলে বা প্রতিষ্ঠাকে ছুঁলে সন্তানরা বৃদ্ধদের আশ্রমে পাঠান। অথচ সবই নেপথ্যের কৌশল। প্রকাশ্যে কেবল অজুহাত! ঠাকুরমাকে ঠাকুর বানানোর মতো; যেখানে প্রজন্মের ধারক ও বাহক 'মা'টা গৃহহারা হয়।

অথচ কানকাটা অন্ধের মতো সময় হাঁটতে থাকে... অন্ত্যমিলে নতুন ছড়া হয় ছন্দহীনতায়, যা পাঠকের কাছে ছিড়ি(শ্রী)-হীন; অথচ ছড়া। আবার শিশুরা সময়ের শিশ্(শিস্) হয়ে ওঠে 'উ'কারের উপশমকে কষ্টে রূপ দিয়ে... একটা খেলা। শিশুমাটির তালকে চাপড়ে চাপড়ে মূর্তি বানানোর খেলা! সংরক্ষণের মতোই। তবু প্রচলিত গতি এই শিশু-ছড়া-বৃদ্ধের, নতুন অন্ত্যমিলে... বলা যায় প্রয়োজনগ্রস্থ ছড়া; সংরক্ষণে ছড়া! হৃদ্যতাহীন বাত্‍সরিক এক আশ্রমিক পদ্য, যা প্রাণহীন।


1 comments:

2

প্রবন্ধ - তুষার সরদার

Posted in


প্রবন্ধ


সত্যমিথ্যার আলোছায়া
তুষার সরদার


মানুষের জীবনে খুব সাধারণ অথচ অপরিহার্য দুটি বিষয় হচ্ছে সত্য ও মিথ্যা। জীবনে এই দুটি বিষয়েরই প্রয়োজন আছে। ক্ষেত্র এবং সময় বিশেষে দুটি বিষয়েরই সংজ্ঞা এবং তাৎপর্য পরিবর্তিত হয়। পরিস্থিতিভেদে মিথ্যা সর্বদাই কুটিল ও হানিকারক হয় না অথবা সত্য সর্বদাই হিতকারক ও সরল হয় না। সত্য ও মিথ্যার এই বিচিত্র গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করতে গিয়ে আঙ্গিক হিসাবে মহাভারতে উল্লেখিত কয়েকটি প্রসঙ্গ অবলম্বন করা হয়েছে। এখানে যেসব প্রসঙ্গের বা ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে সেগুলি জনপ্রিয় এবং প্রায় সকলেরই মোটামুটি জানা আছে। সেজন্য ওই ঘটনাগুলির খুঁটিনাটি বা বিস্তৃত বিবরণ অপ্রয়োজনীয় বোধে দেওয়া হল না।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দ্রোণপর্ব। কৌরবপক্ষের সেনাপতি আচার্য দ্রোণের প্রবল বিক্রমে পাণ্ডবপক্ষ তখন গভীর বিপন্নতায় নিমজ্জিত। পাণ্ডবপক্ষীয় কোন বীরই রণাঙ্গনে আচার্যের ধ্বংসলীলা কিছুতেই রোধ করতে পারছেন না। এদিকে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সর্বশ্রেষ্ট ধনুর্ধর অর্জুন তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় অস্ত্রগুরুর বিরুদ্ধে কোন মারাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আন্তরিকভাবে অনিচ্ছুক। অন্য কোন উপায় না থাকায় মহাভারতের প্রবলতম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুনকে না জানিয়েই দ্রোণবধের গোপন এক পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সেই পরিকল্পনাটি করা হয়েছিল দ্রোণাচার্যেরই একটি বিশেষ কথার উপর ভিত্তি করে। তিনি কথাপ্রসঙ্গে পাণ্ডবদের একসময় বলেছিলেন তাঁর হাতে যতক্ষণ অস্ত্র থাকবে ততক্ষণ তাকে যুদ্ধে পরাজিত বা নিহত করা অসম্ভব। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে সম্মুখ-সমরে অস্ত্রের আঘাতে মহাবীর দ্রোণাচার্যকে অস্ত্রহীন করে ফেলা কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। অতএব অন্যতর অমোঘ এক আঘাতের কথা ভাবা হয়েছিল। অতর্কিত সেই আঘাতে যেকোন মহাবীরের বিকলন সম্ভব।

শ্রীকৃষ্ণের পরিকল্পনা অনুযায়ী পরদিন রণক্ষেত্রে ‘অশ্বথামা’ নামের একটি রণহস্তীকে নিহত করে মধ্যমপাণ্ডব ভীম ‘অশ্বথামা হত’ হয়েছে বলে চিৎকার শুরু করলেন এবং পান্ডবপক্ষীয়রা সৈন্যরা সেই দাবিতে প্রবল ভাবে গর্জন করতে লাগলেন। সেসব কথা শুনে তাঁর পুত্র অশ্বথামা নিহত হয়েছে ভেবে দ্রোণাচার্য আশঙ্কায় নিতান্ত ব্যাকুল হয়ে নিগূঢ় বিশ্বাসে পরম সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের কাছেই সেই ভয়াবহ সংবাদ সত্য কিনা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। 

সবাই জানেন যে সে প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির কী বলেছিলেন এবং তা বলার পর কী কী ঘটেছিল। যুধিষ্ঠির তখন যে উত্তরটি দিয়েছিলেন সেটি ঠিক সত্য বা মিথ্যা ছিল না। বলা যায় সেটি অর্ধসত্য বা অর্ধমিথ্যা ছিল। এই অর্ধসত্য বা অর্ধমিথ্যাটি বলার জন্য শাস্তিস্বরূপ পরমধার্মিক মহাসত্যবাদী যুধিষ্ঠিরকে একবার নরক-দর্শনের কষ্ট নিতে হয়েছিল। 

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী যুধিষ্ঠির জীবনে এই একবারই তিনি মিথ্যা বলেছিলেন এবং সেটি আবার অর্ধমিথ্যা ছিল মাত্র। কিন্তু মহাভারত রচয়িতার বর্ণনা অনুসারে যুধিষ্ঠির আরও অন্তঃত তিন তিনবার মিথ্যাভাষণ এবং মিথ্যাপোষণ করেছিলেন। সেগুলির প্রত্যেকটিই সম্পূর্ণ এবং প্রত্যক্ষ মিথ্যাকথন ছিল। এগুলির কথা বিবেচনা করলে যুধিষ্ঠিরকে একজন যথেষ্ট পোক্ত মিথ্যাবাদী বলে নিঃসন্দেহে ভেবে নেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে তো মিথ্যাকথনের অপরাধের জন্য নরক-দর্শনের পরিবর্তে নরকবাসই যুধিষ্ঠিরের যথাযথ শাস্তি ছিল।

প্রথমতঃ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মিথ্যাচারণ হোল অজ্ঞাতবাসকালে মৎসরাজ বিরাটের কাছে আদ্যন্ত মিথ্যাকথন। দ্রৌপদীসহ ভাইদের সঙ্গে নিয়ে যুধিষ্ঠির সেখানে সম্পূর্ণ মিথ্যা নাম বলেছিলেন ও মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় দীর্ঘ এক বছর ধরে সে মিথ্যাকে তিনি সযত্নে লালন করে গেছেন।

দ্বিতীয়তঃ একচক্রা নগরীতে চারভাই এবং মা কুন্তী সমেত নিজেদের ব্রাহ্মণ হিসাবে পরিচয় দিয়ে এক ব্রাহ্মণের গৃহে আশ্রয় নিয়ে দীর্ঘদিন বাস করেছিলেন। সে যুগে ভিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে দরিদ্র ব্রাহ্মণদের জীবিকার্জন প্রচলিত ছিল বলে যুধিষ্ঠিরাও তাই করতেন, যাতে অন্যের কাছে তাঁদের মিথ্যা পরিচয় নিটোল সত্য বলে চালানো যায়।

তৃতীয়তঃ দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় গিয়ে ক্ষত্রিয় হয়েও সেখানে নিজেদের ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দিয়েছিলেন এবং ব্রাহ্মণদের জন্য নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করেছিলেন।। ক্ষত্রিয় রাজারা লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হলে ধৃষ্টদ্যুম্ন যখন অন্য সম্প্রদায়কে লক্ষ্যভেদে আহবান জানালেন, ‘ব্রাহ্মণ’ যুধিষ্ঠিরের অনুমতিক্রমেই অর্জুন ব্রাহ্মণ হিসাবে লক্ষ্যভেদে অগ্রসর হয়েছিলেন। এগুলি প্রত্যক্ষভাবে অন্যের পক্ষে হানিকারক না হলেও স্পষ্টতঃই সম্পূর্ণ মিথ্যাচারণ। 

এই তিন তিনটি মিথ্যাচারের জন্য পরবর্তী কালে যুধিষ্টিরের কোনরকম শাস্তিবিধানের কোন উল্লেখ না থাকলেও শুধু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কথিত সেই অর্ধমিথ্যাটির জন্য শাস্তিবিধানের উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ একাধিকবার পূর্ণমিথ্যা কথনেও কোন অপন্যায় ঘটে নি, কিন্তু মাত্র একবার অর্ধমিথ্যা কথনেই শস্তিযোগ্য অপন্যায় ঘটে গেছে। তবে কী মহাভারত রচয়িতা তাঁর মহাগ্রন্থে স্ববিরোধী বক্তব্য প্রকাশ করেছেন?

দৈবী মহিমাকীর্তন, মানুষিক মহত্বের দেবত্বে উত্তরণের বিবরণ, অসাধারণ চরিত্রচিত্রণ, মহাকাব্যিক জটিলতা এবং সর্বোপরি কালজয়ী সাহিত্যগুণ, সবদিক দিয়েই মহাভারত শ্রেষ্ট মহাকাব্য রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর সেই কালোত্তীর্ণ মহাকাব্যে স্ববিরোধিতার মত অতি নিম্নমানের অসঙ্গতি বর্তমান থেকে গেল? ঘটনাগুলির গভীরতা যথাযথ ভাবে অনুধাবন করতে পারলে এই তথাকথিত ‘অসঙ্গতি’ কে এক তাৎপর্যপূর্ণ সুসঙ্গতি বলে প্রতিভাত হবে।

একটু তলিয়ে চিন্তা করলে বোঝা যাবে ওই অর্ধমিথ্যাটির সঙ্গে অন্য তিনটি পূর্ণমিথ্যার একটি মূলগত পার্থক্য আছে। পূর্ণমিথ্যাগুলি কথিত হয়েছিল পাণ্ডবদের আত্মপরিচয় গোপন করার জন্য। অর্ধমিথ্যাটি কথিত হয়েছিল তীব্র সংকটে পড়ে – যুদ্ধক্ষেত্রে সম্ভাব্য পরাজয়ের মুখে পড়ে। আর শুধু এজন্যই যুধিষ্ঠিকে শাস্তি পেতে হয়েছিল – করতে হয়েছিল নরক দর্শন! অথচ এমন ধারণাই সাধারণ্যে বহুল প্রচলিত রয়েছে যে আত্মরক্ষার্থে মিথ্যাকথন গুরুতর অপরাধ নয়।

এই আপাত-স্ববিরোধিতার আড়ালে এক গভীর মহান জীবনাদর্শের বাণী নিহিত আছে। যখন শুধুমাত্র আত্মপরিচয় গোপন করতে গিয়ে যখন মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হল সেক্ষেত্রে সত্য-বিচ্যুতি যতটা গভীর, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পরাজয় এড়ানোর তাগিদে মিথ্যা ভাষণের ক্ষেত্রটিতে সে বিচ্যুতি অনেক বেশি গভীর – তাই শাস্তিযোগ্য। সত্যনিষ্ঠ বলে প্রতিষ্ঠিত কারো পক্ষে সত্যের সহজ পরীক্ষায় ব্যর্থ হবার অপরাধের তুলনায় সত্যের কঠিন পরীক্ষায় ব্যর্থ হবার অপরাধ অনেক বেশী। যুধিষ্ঠিরের মত একজন সত্যনিষ্ঠ বলে খ্যাত ব্যক্তির যুদ্ধে পরাজয়ের ভয়ে সত্য-বিচ্যুতির অপরাধ মহাভারতকার কিছুতেই ক্ষমা করতে পারেননি। 

অন্য এক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েও এই মহৎ তত্ত্বটিকে প্রতিষ্ঠা করা যায়। পূর্ণ মিথ্যাভাষণগুলি আত্মগোপনের জন্য কথিত হয়েছিল, কিন্তু তা কারো কোন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্য কথিত হয়নি। সেজন্য সেগুলিকে পাপ বলে গণ্য করা হয়নি। কিন্তু কুরুক্ষেত্রের রণভূমিতে যুধিষ্ঠিরের এই অর্ধমিথ্যা ভাষণটি প্রত্যক্ষভাবে কৌরব সেনাপতি মহারথী দ্রোণাচার্যের নিশ্চিত বিনাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছিল – তাই তা পাপ বলে গণ্য হয়েছিল। ‘ধর্মরাজ’ অভিধার খোলসটির আড়ালে যুধিষ্ঠির অধার্মিকতার অনেক কাজই করেছিলেন। কিন্তু সেসব অন্য কাহিনী।





2 comments:

0

বিশেষ রচনা - শৌনক দত্ত

Posted in


বিশেষ রচনা




উনিশ মে'র রোদ্দুবেলায় 
শৌনক দত্ত 



সুস্মি তখনো আছে। গোঁ ধরেছে শিলচর যাবে। অগত্য স্ত্রীর কন্নায় কর্ম। শিলচর কেন বিখ্যাত, কেন যাবে, আমি অত্তসব জানিনা। সুস্মিকে প্রশ্ন করতেই বলে, 

-গ্লাসে ডুবে মরো! 

কি বলবো না ভেবেই বললাম, 

-যা বাবা মরতে যাবো কেন? 

আগের চেয়েও রাগান্বিত কন্ঠে সুস্মি বললো, 

-তুমি কি বাঙালী? 

চোখ ছানাবড়া হলো আমার। তখন কি জানতাম, উনিশে মে শিলচরে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে এগারোজন। আমার কাছে ভাষা আন্দোলন বলতেই বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারী। স্মুমি খুব রেগে গেছিলো। সেই রাগ ভাঙাতে ল্যাপিতে বসলাম। পড়ালেখা করলাম। আর তখন জানতে পারলাম, উনিশে মে’র আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া ভাষা দিবসের কথা। বেশ কয়েকদিন অনেক কিছু রপ্ত করলাম। তারপর আমাদের শিলচর ভ্রমণ। 


শিলচর ঐতিহাসিক ষ্টেশনচত্বর ঘুরে যখন লজে ফিরেছি তখন আমার এই কয়েকদিনের জ্ঞান ফলাবার সাধকে আটকে রাখতে পারলাম না। তাছাড়া সুস্মির সেইদিনের রাগের মোক্ষম জবাব দিতে বললাম, 
-ভাষা শহিদ দিবসের ইতিহাস আমি জানতাম না ভাবছো, আমি গোটা ইতিহাসটা জানি। 

সুস্মির উত্তরের আশা না করেই আপনমনেই বলতে শুরু করেছি।

-বাঙালীর প্রাণের ভাষা বাংলা। মাতৃভাষার অধিকারের জন্য বাঙালী প্রাণকে তুচ্ছজ্ঞান করেছে। মাতৃভাষার জন্য কোন জাতির এতখানি দরদ থাকতে পারে, তা বাঙালীরা প্রাণের বিনিময়ে প্রমাণ করেছে। বাহান্নর ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রাণ দিয়েছেন সালাম, রফিক, সফিয়ুর, বরকত ও জব্বার। বাহান্নর চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ১৯৬১ সালের মে মাসে বাংলা ভাষার ব্যবহার বন্ধ করার প্রতিবাদে ভারতের রাজ্য আসামের শিলচর শহরে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন এগারো জন ভাষাশহীদ। দুঃখের বিষয় ইতিহাস তাঁদের তেমন মনে রাখেনি। আসাম রাজ্যের প্রধান ভাষা অহমীয়া হলেও বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ,কাছাড় এবং শিলচর হলো বাঙালীদের ঘাঁটি। দেশবিভাগের একবছর পর ১৯৪৮ সালে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সুরমা ভ্যালী (বর্তমান সিলেট বিভাগ) পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয় । কিন্তু বৃহত্তর সিলেটের তিন চতুর্থাংশ নিয়ে বরাক ভ্যালী থেকে যায় আসামে । ১৯৬১ সালে আসাম প্রাদেশিক সরকার শুধু অহমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারী ভাষা ঘোষণা করলে ক্ষোভ দানা বাঁধে বাঙালীদের ভেতর । ক্রমশঃ তা রূপ নেয় আন্দোলনের। প্রথমে সত্যাগ্রহ, পরে সহিংস । ১৯৬১ সালের ১৯ মে । আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্বে এদিন শিলচরে সকাল ৬টা-সন্ধ্যা ৬টা ধর্মঘট পালন করে। বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে ভাষাবিপ্লবীরা যখন স্থানীয় রেলওয়ে ষ্টেশনে রেলপথ অবরোধ পালন করছিল, তখন নিরাপত্তারক্ষায় নিয়োজিত আসাম রাইফেলসের একটি ব্যাটালিয়ান তাদের বাধা দেয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে আসাম রাইফেলস গুলিবর্ষণ করলে ঘটনাস্থনে প্রাণ হারান ১১ জন ভাষাবিপ্লবী। আহত হন অর্ধশতাধিক। রাজ্য সরকার শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়। এরপর আসামে বাংলাকে ২য় রাজ্যভাষা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। সেদিন মাতৃভাষার জন্য যে ১১ জন বীর শহীদ আত্মবলি দেন, তাদের মধ্যে ছিলেন পৃথিবীর প্রথম নারী ভাষাশহীদ, সতের বছরের তরুণী, কমলা ভট্টাচার্য। পৃথিবীর ইতিহাসে মাত্র দুজন নারী মাতৃভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন- একজন শহীদ কমলা ভট্টাচার্য, দ্বিতীয় জন শহীদ সুদেষ্ণা সিংহ, যিনি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতির আন্দোলনে শহীদ হন।

সুস্মি হেসে ফেটে পড়ে। 

-ভাল, খুব ভাল! নেট ঘেঁটে তো ভালই বললে। এবার তবে একটি বই করে ফেলো। 
বিদ্রুপটা ঠিক গায়ে লাগলো। 

-তুমি কি বলতে চাইছো এটা ঘটনা নয়? পৃথিবীর প্রথম নারী ভাষাশহীদ কমলা ভট্টাচার্য নয়? 

-আমি তা তো বলছি না! তবে তুমি কি বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী ভাষা আন্দোলনের কথা জানো? জানো কি আদিবাসী ভাষাশহীদ সুদেষ্ণা সিংহের কথা? 

পড়ুয়া আর জানুয়াদের সাথে এই এক সমস্যা তাদের সাথে কিছুতেই কিছু করে পেরে ওঠা যায় না। মনে মনে ভাবা কথাটা বলে ফেলতেই সুস্মি হেসে উঠলো। হাসির দমক থামিয়ে বললো, 

-শুনবে সেই ইতিহাস? 

বাইরে তখন গোধূলির আলো। পর্দার ফাঁকে মিঠে রোদ্দুর গলে পড়ছে সুস্মির মুখে। আমার আগ্রহ যে বেড়েছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে সুস্মি। ঠক ঠক দরজার আওয়াজে কথা থেমে গেলো। কফি অর্ডার করা ছিলো। কেয়ারটেকার কফি মগ নিয়ে ঢুকলো। কফি মগে চুমুক দিয়ে সুস্মি বলতে শুরু করলো,

-বরাক-ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় শুরু হয়েছিল মাতৃভাষার দাবী … ভারতের উত্তর পূবাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের দুটি প্রধান উপত্যকা- একটি ব্রহ্মপুত্র, অপরটি বরাক। পার্বত্য কাছাড়, কাছাড়, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ এই চারটি জেলা নিয়েই আসামের বরাক উপত্যকা। আর এই বরাক উপত্যকার নীচেই বাংলাদেশের সুরমা উপত্যকা। উভয় উপত্যকার এক নির্ভীক প্রান্তিক জাতি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী। ভারতে আসাম রাজ্যের কাছাড়, পাথারকান্দি, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ , ত্রিপুরা রাজ্য এবং মণিপুরে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সংখ্যাধিক্য। বাংলাদেশে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের অধিক বসতি দেখা যায়, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ছাড়াও দেশের অনেক জায়গাতেই নানান প্রয়োজনে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জনগণ নিজেদের ঐতিহাসিক আবাস গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী এবং মৈতৈ মণিপুরী (মৈতৈদের ভেতর যারা ইসলাম ধর্ম পালন করেন তাদেরকে পাঙন/পাঙান বলা হচ্ছে) এই দুই ভিন্ন জাতিকে বরাবর রাষ্ট্রীয় নথিপত্র ও দলিল দস্তাবেজে ‘মণিপুরী’ হিসেবে দেখানো হয়। ভারতের মণিপুরসহ উভয় উপত্যকায় বরাবর একটি আন্তঃজাতিগত দ্বন্দ্ব আছে - কে মণিপুরী আর কে মণিপুরী নয় - তা নিয়ে। উভয় রাষ্ট্রের উভয় উপত্যকার রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম বরাবর এই আন্তঃজাতিগত দ্বন্দ্ব থেকে নানান ফায়সালা নিতে চায়। আর তা হচ্ছে কৌশলে ভাষিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভাষা ও জাতিগত অস্তিত্বকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সমমর্যাদা না দেয়া। ভারতের মণিপুর অঞ্চলেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জাতিদের ঠার বা ভাষার উদ্ভব। স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন ‘লিংগুস্টিক সার্ভে অব ইণ্ডিয়া’ পুস্তকের ৫নং খণ্ডে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের ‘বিষ্ণুপুরীয়া মণিপুরী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ভারতের সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রের সকল ভাষিক সংখ্যালঘু জাতির সদস্যরা প্রাথমিক স্তরে শিক্ষা লাভের জন্য নিজের মাতৃভাষায় পড়ালেখা করার মৌলিক অধিকার রাখে। রাষ্ট্রে প্রান্তিক জাতিদের কোনও জনমিতি, পরিসংখ্যান, তথ্য উপাত্ত জনগণের দলিল হিসেবে রাখা হয় না। যাও থাকে তার প্রায় পুরোটাই লোকদেখানো ও বানোয়াট। বাংলাদেশে যেমন ১৯৯১ কি ২০০১ সালের সকল আদমশুমারীতেই দেশের বাঙালি বাদে অপরাপর জাতিদের জনসংখ্যা বাড়ে কমেনি, সেরকম ভারতেও। ১৯৬১ সনের ভারতীয় জনপরিসংখ্যানে আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জের পাথারকান্দিতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের জনসংখ্যা মাত্র একজন নারী দেখানো হয়, অথচ সেখানে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের জনসংখ্যা ছিল ২২,০০০ এরও বেশী। অথচ ঐ একই জায়গার জনসংখ্যা ১৯৭১ সালে দেখানো হয়েছে ১০,১৬৪ জন। রাষ্ট্রের এই জনপরিসংখ্যানিক দলিল থেকে আমরা ধারণা করতে পারি প্রান্তিক জাতি বিষয়ে রাষ্ট্র কি ধরনের মনোযোগ ও উদ্যোগ বহাল রাখে। আর তা বরাক কিংবা সুরমা উপত্যকা যাই হোক না কেন। বরাক উপত্যকার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের ভাষা আন্দোলন আমাদেরকে ভাষার লড়াই, জাতিগত অস্তিত্বের সংকট এবং রাষ্ট্রের আইনগত সিদ্ধান্তগ্রহণে কার্যকরী উৎসাহ ও ইশারা দিতে পারে। বরাক উপত্যকার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের ঘটনাপঞ্জী (১৯৫৫-১৯৯৬) অনুযায়ী ১৯৫৫ সন থেকেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা মাতৃভাষার অধিকারের আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলন(১৯৫৫-১৯৯৬) শুরু হয় ‘নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মহাসভা’র ১৯৫৫ সালের দাবীর ভেতর দিয়েই, যেখানে তাদের দাবী ছিল আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং ভাষার অধিকারের দাবীতে ভাষা পরিষদের উদ্যোগে গড়ে উঠে ‘সত্যাগ্রহ আন্দোলন’। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সাতটি দাবীর ভেতর ছিল : আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতি, আসামের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে রাষ্ট্রীয় বেতার কার্যক্রমে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম প্রচার, নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান, কেন্দ্র ও রাজ্য সভাতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের আসন সংরক্ষণ, সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের কোটা সংরক্ষণ, ভাষিক সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং ১৯৬১ সালের আদমশুমারীর সংশোধন। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬১ সালের ২ জুলাই ভাষা পরিষদ ভাষা দাবী দিবস পালন করে। ১৯৬১ সনের ২৫ জুলাই আসাম রাজ্যের শিক্ষা বিভাগের সাথে যোগাযোগ করা হয়। ১৯৬৩ সনের ২২ মার্চ শ্রী ডি এন বাজপেয়ি নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদের সাথে দেখা করেন। ভাষা পরিষদ ১৯৬৪ সালের ৭ জুলাই আসামের মূখ্যমন্ত্রীর কাছে একটি মেমোরান্ডাম পেশ করেন। ১৯৬৪ সালেরই ২৮ জুলাই বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য রাজনৈতিক বিভাগের কাছে পাঠানো হয়। ১৯৬৫ সালের ২ থেকে ৮ জুলাই ভাষা দাবী সপ্তাহ পালন করা হয়। ১৯৬৬ সালের ২৩ মার্চ নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা পরিষদ স্টেট বোর্ড অব ইলিমেন্টারি এড্যুকেশন এর সেক্রেটারি শ্রী কে কে শর্মার সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁকে আসামে প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে দ্রুত বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা চালুর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। ১৯৬৭ সালের ২ জুলাই দাবী সপ্তাহ ১২ দিন দীর্ঘায়িত করা হয় এবং কাছাড় জেলার সর্বত্র পাবলিক সভা সমাবেশ করা হয়, এইসব সভায় আদমশুমারী জালিয়াতির বিরুদ্ধে জোরদার বক্তব্য রাখা হয়। ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে ভাষা পরিষদ নিজেরাই নিজস্ব উদ্যোগে জনপরিসংখ্যান উত্থাপন করেন এবং কাছাড়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের জনসংখ্যা দেখান ৬৬,৬২৩ জন। ১৯৬৮ সালের মে মাস থেকেই স্কুল, কলেজসহ রাস্তা ঘাটে পিকেটিং, ধর্মঘট, গণশ্লোগানের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসেই পাবলিক সভাগুলো আরো ব্যাপক বিস্তৃত হয় এবং ১৯৬১ সনের ঔপনিবেশিক আদমশুমারী প্রতিবেদন পোড়ানো হয়। ১৯৬৮ সনেরই ২৫ জুলাই আসামের শিক্ষামন্ত্রী জে বি হেগজার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের দাবীর প্রেক্ষিতে ভারত সরকারের ভাবনা তুলে ধরেন। একই সনের ৩০ আগস্ট কাছাড়ের জনগণ আবারও আসামের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবী দাওয়া সংবলিত মেমোরান্ডাম পেশ করেন। ১৯৬৯ সালের ১৫ অক্টোবর কাছাড়ের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী শিক্ষার্থী ও যুবসমাজ রক্ত দিয়ে রক্তস্বার কর্মসূচি পালন করে। এর পর পরই ভাষা আন্দোলন আরো চূড়ান্ত গণ রূপ নেয় এবং ব্যাপক ধর্মঘট, ধরপাকড়, বন্ধ কর্মসূচি চলতে থাকে। ১৯৬৯ সালের ২২ অক্টোবর কাতিগড়া বন্ধ কর্মসূচি থেকে ৭ জন ভাষাবিদ্রোহীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৯ সনে পূর্ব পাকিস্থানে একদিকে যেমন চলতে থাকে গণঅভ্যুত্থান একই দিকে বরাক উপত্যকায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের ভাষা আন্দোলন বন্ধ-ধর্মঘট- ঘেরাও-গ্রেফতারের ভেতর দিয়ে জনরূপ নেয়। নরসিংহপুর, রাতাবাড়ি, শালচাপড়া বন্ধ (৫-২৯ অক্টোবর, ১৯৬৯)। জাপিরবন্দ বন্ধ(৩০ অক্টোবর ১৯৬৯) থেকে ২৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়, এই প্রথম কোন নারী ভাষাবিপ্লবীও গ্রেফতার হন। মেহেরপুর বন্ধ (৩১ অক্টোবর ১৯৬৯) থেকে ৫ জন নারী আন্দোলনকারীসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পয়লা নভেম্বর, ১৯৬৯ সালের পিকেটিং থেকে ২৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়, ৩ নভেম্বর ১৯৬৯ গ্রেফতার হন ৩৮৫ জন, ১-৫ নভেম্বরের ভেতর তিন জেলার ডিসি অফিসে পিকেটিং করে চেয়ার দখল করে নেয়া হয়, ৪-৫ নভেম্বর ১৯৬৯ গ্রেফতার করা হন ১১১ জনকে। রাষ্ট্রের ধরপাকড় ও নির্যাতনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে ১১-১৩ নভেম্বর, ১৯৬৯ তারিখে শিলচর শহরে বিশাল গণসমাবেশের আয়োজন হয়। শিলচর, নরসিংহপুর, হাইলাকান্দি ও পাথারকান্দিতে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে ফেলেন ভাষাবিপ্লবীরা, এই ঘটনায় সরকার ২৩৮ জনকে গ্রেফতার করে। ১৭ নভেম্বর ১৯৬৯ শিলচর বন্ধ থেকে ৩০০ জন সত্যাগ্রহীকে গ্রেফতার করা হয়। হাইলাকান্দির ও এস এ মাঠে বিশাল সমাবেশ ডাকা হয় একই সনের ২১ নভেম্বর, হাইলাকান্দি বন্ধ থেকে সবচে’ ব্যাপক ধরপাকড়টি হয় প্রায় ১৫০০ জন ভাষাবিদ্রোহীকে সরকার অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে। ১৯৬৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর ‘ডিসি অব লিংগুস্টিক মাইনরিটিস ইন ইন্ডিয়া’ শিলচর আসেন এবং মহাসভার সাথে বৈঠক করেন।

কফি অনেকক্ষণ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সুস্মি চুপচাপ কফিমগটা নাড়ছে আমার আগ্রহ আরো চরমে - তারপর কি হলো বৈঠকের শেষে? 


চলবে...

0 comments:

0

ধারাবাহিক - অমিতাভ প্রামাণিক

Posted in


ধারাবাহিক



সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে - তিন
অমিতাভ প্রামাণিক




- একী রে, গোপাল, তোর এই হাল কী করে হল, বাবা? গালময় না কামানো দাড়ি, চুল উস্কোখুস্কো, পরণের জামা মনে হচ্ছে কতদিনের না কাচা। বলি, ব্যাপারটা কী?

- আর বলো না পিসি, আমি আর বেশি দিন নেই।

- ও আবার কী কথা বাবা! মরুক তোর শত্তুর।

- শত্তুর না গো পিসি, আমারই দিন ঘনিয়ে এসেছে। এক গণক হাত দেখে বলল।

- কোন গণক?

- সে তুমি চিনবে না। খোদ কাশী থেকে পাশ দিয়ে এসেছে। আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র নখদর্পণে। 

- বলিস কী? সত্যি সত্যি সে তোকে এই কথা বলল?

- তবে আর বলছি কী, পিসি! বলেছে আর মেরেকেটে কটা মাত্র দিন।

- আহা রে বাছা, তোর বউটার কী গতি হবে রে? ঐটুকু একরত্তি ছেলে তোর, কাজকম্মোও তো কিছু করে না। তা এর কোনো বিধান দেয় নি সেই গণক?

- মৃত্যুর কি বিধান হয় গো, পিসি? নিয়তির মার কেউ খণ্ডাতে পারে, কখনো দেখেছ?

- তাই তো। সেও তো ঠিক। ভগবানের মার, দুনিয়ার বার। তো তুই এখন অবেলায় এই পাড়ায়? কারো বাড়ি যাচ্ছিলি বুঝি?

- কার বাড়ি আর যাব পিসি? তোমার এখানেই আসছিলাম।

- আমার এখানে! হঠাৎ -

- আর কদিনই তো মাত্র আছি, পিসি। ভাবলাম তোমার এখানে চাড্ডি প্রসাদ যদি পেয়ে যাই।

- এই বেলা তিনটেয়? একটু আগে আসতে পারলি নে? আমার তো খাওয়া দাওয়া হয়ে গেছে, বাবা। ঠিক আছে, তুই এক কাজ কর, কাল আয়। গণক এই সব বলেছে, পিসির হাতে দুটো ভাত খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে, তো কালকের দুপুরের খাওয়াটা এখানেই খাস। তবে বাবা, আমি বিধবা মানুষ, আমার তো নিরামিষ খাবার, ভাত-ডাল-তরকারি। তোর রুচবে তো মুখে? 

- কেন রুচবে না, পিসি? তোমার রান্নার হাত যে এত ভাল, তা কি আমি জানিনে? আর এই যে বাড়িতে এত যত্ন করে শাকসব্জি লাগাও, এর যে কী স্বাদ –

- কাল আসিস তবে। বেশি দেরি করিস নে আবার।

- না গো, পিসি। আমি বেলায় বেলায় চলে আসব।


পিসিটি গোপালের নয়, রাজার। রাজা গোপালের সঙ্গে বাজি ফেলেছেন, হাড়কিপটে পিসির হাত গলিয়ে যদি দশটা টাকা সে কোনভাবে আনতে পারে, তবে তিনি একশো টাকা উপহার দেবেন। গোপাল তার বয়স্য, রাজা তাকে বিশেষ স্নেহ করেন। গোপালের উপস্থিত বুদ্ধি তুখোড়, তার অনেক প্রমাণ তিনি পেয়েছেন। অগাধ সম্পত্তির মালিক এই বিধবা পিসিটি অবশ্য কৃপণ-শিরোমণি, একটা ফুটো পয়সা তার হাত দিয়ে গলে না। তার কাছ থেকে দশ টাকা কেন, দশ পয়সাও আদায় করা অসম্ভব। মহারাজ নিশ্চিত গোপাল এবার ধরাশায়ী হবে। 

পরদিন গোপাল হাজির সকাল সকাল। পিসি শাক-ভাত-লাউঘন্ট বেড়ে দিতেই গোপাল হাঁ হাঁ করে উঠল, না গো পিসি, আমি তো তোমার প্রসাদ পেতে এসেছি। তুমি আগে খেয়ে নাও। পাতে যা থাকবে, আমি তাই খাব। তুমি বরং তেল-গামছা দাও, আমি ততক্ষণে পুকুরে দুটো ডুব দিয়ে আসি। 


স্নান করে এসে পিসির এঁটো থালায় খেতে বসল গোপাল। 


- কেমন হয়েছে রান্না?

- খাসা হয়েছে, পিসি।

- আর কিছু নিবি?

- এ কটা আগে খেয়ে নিই। তারপর পেটে জায়গা থাকলে নেব।

- ঠিক আছে। ভাল করে খা।



পাঁচ মিনিট পরে আবার পিসি জিজ্ঞেস করলেন, কী নিবি বল।


- লাউ-চিংড়িটা দারুণ হয়েছে, পিসি।

- চিংড়ি? চিংড়ি কোথায় পাব গোপাল? লাউয়ের নিরামিষ ঘন্ট রেঁধেছি বাবা। বিধবা মানুষ, আমি কি চিংড়ি-টিংড়ি খেতে পারি? লোকে শুনলে বলবে কী?

- না গো পিসি, লাউ চিংড়িই। দারুণ হয়েছে। কী অদ্ভুত রান্না তোমার, পিসি!


গোপালের উচ্ছ্বাস যেন থামতেই যায় না। 


- চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তুলছিস কেন? বলছি না লাউয়ের ঘন্ট। চিংড়ি টিংড়ি নেই। খেতে কি লাউ চিংড়ির মত লাগছে নাকি?

- আরে লাউ চিংড়ি কি শুধু লাউয়ের ঘন্টর মত লাগবে? দেখবে এস।


পিসি এসে দেখল গোপালের পাতে পরিষ্কার কয়েকখানা কুচো চিংড়ি!


- চিংড়ি কী করে এল রে, গোপাল? আমি তো এসব খাইনা। পুকুরের জলে রান্না, জলের সঙ্গে কি দু-একটা –

- দু-একটা কী গো পিসি, আমার পাতেই তো দশ বারোটা। তুমিও বেশ অনেকগুলোই খেয়েছ তার মানে। 

- থাম থাম, এত জোরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলিস নে। বলছি না, আমি বিধবা মানুষ, আমিষ ছোঁয়াও আমার পাপ। পাড়া প্রতিবেশী শুনলে কী বলবে?

- সে আমি কী জানি? দেখছই তো লাউয়ের মধ্যে এতগুলো কুচো চিংড়ি এই থালায়। 

- তুই বাপু আর কথা বাড়াস নে। এই নে চারটি পয়সা। মুখ বন্ধ কর, বাবা।

- মুখ কী করে বন্ধ রাখবো, পিসি? কাল তো মহারাজ আমাকে জিজ্ঞেস করবেন, পিসির বাড়ি কী খেলে? আমি কী বলব?

- তোর আগ বাড়িয়ে বলতে যাওয়ার কী দরকার?

- আমি মিথ্যে বলতে পারব না, পিসি। মিথ্যে কথা বলা মহাপাপ। মহারাজ শূলে চড়াবেন।

- এদিকে আমার নামে যে ঢি ঢি পড়ে যাবে! সে বেলা! তোকে খেতে বলে কী পাপ করলাম, গোপাল! এই নে, পুরো চারানাই নে।

- চারানা দিয়ে পাপস্খালন হয়, পিসি? ভগবান শুনলে কী বলবে? বলবে, গোপাল, তুই মাত্তর চারানার জন্যে এত বড় মিথ্যে কথা বললি? নে, এবার পুন্নাম নরকে যা। অন্তত পঁচিশটা টাকা না পেলে –


দশ টাকার কমে রফা হল না। গামছায় লুকিয়ে আনা কুচো চিংড়িগুলো কাজে লেগে গেল বেশ। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় গোপালের কাণ্ড দেখে হাসতে হাসতে একশো টাকা বের করে দিলেন।


কৃষ্ণচন্দ্রের বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ, শৌখিন মানুষ। মাত্র আঠার বছর বয়সে তিনি নদীয়ার রাজা হয়েছেন। বাবা রঘুরাম রায় ছিলেন জমিদার। আদিশূরের কনৌজ থেকে আনা পাঁচ ব্রাহ্মণের একজন ভট্টনারায়ণের পুত্র নীপ থেকে অধস্তন একাদশ পুরুষ ছিলেন কামদেব। তার পুত্র জমিদার বিশ্বনাথ চতুর্দশ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লী গিয়ে সম্রাটের কাছ থেকে রাজা উপাধি পেয়েছিলেন। তার অধস্তন ষষ্ঠ পুরুষ কাশীনাথ ১৫৯৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিক্রমপুরের কাছে এক বিরাট ভূখণ্ডের প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন। দিল্লীর মসনদে তখন সম্রাট আকবর। বাংলার নবাব দেশীয় জমিদারদের শায়েস্তা করতে দিল্লীতে দরবার করলে আকবরের সেনা বাংলা আক্রমণ করে। তাতে কাশীরাম সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে গৃহত্যাগ করে। যুদ্ধে কাশীনাথ নিহত হলে তার স্ত্রী হরেকৃষ্ণ সমাদ্দার নামে একজনের বাড়ি আশ্রয় পান, সেখানে তার পুত্র রামচন্দ্র জন্মগ্রহণ করে। নিঃসন্তান হরেকৃষ্ণ রামচন্দ্রকে তার ক্ষুদ্র জমিদারি দিয়ে যান। রামচন্দ্রের চার পুত্রের বড়টির নাম দুর্গাদাস, তিনি লেখাপড়া শিখে ও যুদ্ধে নৈপুণ্য দেখিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে মজুমদার উপাধি পান ও ভবানন্দ মজুমদার নামে পিতামহ কাশীনাথের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চোদ্দটা পরগণার অধীশ্বর হন। ভবানন্দের তিন ছেলে, তারা সবাই দিল্লীর বাদশাহের আনুকূল্য পেয়ে জমিদারির এলাকা আরো বাড়িয়ে তোলেন। মধ্যমপুত্র গোপালের কর্মদক্ষ কনিষ্ঠ পুত্র রাঘব পিতামহের প্রাসাদ ত্যাগ করে রেউই নামে এক জায়গায় রাজধানী স্থাপন করে। তার পুত্র রুদ্র ১৬৭৬ সালে বাদশা আওরঙ্গজেবের ফরমানবলে আরো পরগণা লাভ করেন। কৃষ্ণের উপাসক রুদ্র রাজধানী রেউই-এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন কৃষ্ণনগর। রুদ্রের পুত্র রামজীবন, তার পুত্র রঘুরাম হচ্ছে কৃষ্ণচন্দ্রের পিতা। ১৭১০ সালে কৃষ্ণচন্দ্রের জন্ম, পিতার অকালমৃত্যুতে তিনি রাজা হয়ে বসেছেন।


কৃষ্ণচন্দ্র সদাশয় উদার-হৃদয় পুরুষ। তার নদীয়ার রাজত্ব উত্তরে মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমে ভাগীরথী, দক্ষিণে গঙ্গাসাগর, পূর্বে ধূলিয়াপুরের বড়গঙ্গা। প্রায় সাড়ে পনের হাজার বর্গমাইল জুড়ে এই রাজ্য সুইজারল্যান্ড দেশের চেয়ে কিছুটা বড়ো। এর মধ্যে আছে ৪৯টি পরগণা ও ৩৫টি কিসমৎ। বড় বড় জায়গাগুলো পরগণা, যেমন নবদ্বীপ, উখড়া, সুলতানপুর, গয়েশপুর, মহিষপুর, শান্তিপুর, চারঘাট। অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট জায়গাগুলো কিসমৎ, যেমন হালিশহর, কলকাতা, পলাশি, বাগমারি, বালিয়া। গদিতে বসার সময় এর মোট সংখ্যা ছিল পঁচাত্তরটা, কৃষ্ণচন্দ্র নিজের যোগ্যতায় তার সাথে আরো ন’টা বাড়িয়েছেন।


কৃষ্ণচন্দ্রের যখন জন্ম হয়, বাংলার অবস্থা বেশ চিত্তাকর্ষক। বাংলার দেওয়ান তখন মুর্শিদকুলি খাঁ, তার ওপরেই দায়িত্ব এখানকার রাজস্ব আদায়ের। বাণিজ্যের কারণে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়মে জাঁকিয়ে বসেছে ইংরেজরা, চন্দননগরের ফোর্ট ডরলিয়ান্সে ফরাসীরা, চুঁচুড়ার ফোর্ট গুস্তাভাসে ওলন্দাজেরা। 


মুর্শিদকুলি আদতে ছিলেন ব্রাহ্মণসন্তান, মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে শতাব্দীর শুরুতেই, ১৭০১ সালে বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত হয়েছেন। বছর তিনেক পরেই ঢাকা থেকে তার কর্মক্ষেত্র সরিয়ে এনেছেন মুকসাদাবাদে, আর এসেই সেই জায়গার নাম বদলে নিজের নামে রেখেছেন মুর্শিদাবাদ। শুধু দেওয়ানই নয়, বছর দশেকের মধ্যে তিনি হয়েছেন বাংলার নবাবও। তার প্রতিপত্তি প্রবল, কাশিমবাজারে ইংরেজদের কুঠি বানানোর পরিবর্তে তাদের কাছ থেকে আদায় করেছেন পঁচিশ হাজার টাকা। সেই টাকা দিয়ে মুর্শিদাবাদে খোলা হয়েছে টাঁকশাল। ইংরেজরা তাকে সমীহ করে চলে, নিজেদের বাণিজ্য বজায় রাখতে তারা দিল্লী থেকে ফরমান আনিয়ে নিয়েছে, তার ফলে প্রতিপক্ষ ফরাসী আর ওলন্দাজদের থেকে তারা বেশ এগিয়ে, যদিও মুর্শিদকুলি সেই ফরমানকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে নিজের প্রতিপত্তি বজায় রেখেছেন তাদের ওপর। তার কথার নড়চড় হবার উপায় নেই। 


রাজস্ব বাড়াতে মুর্শিদকুলি বাংলায় অনেক নতুন নিয়ম জারি করেছেন, আর তার ফলে বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্থানীয় হিন্দু জমিদাররা। মুর্শিদাবাদের যাবতীয় হিন্দু মন্দির ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে তাদের ইঁট পাথর দিয়ে নিজের জন্যে কাটরায় নিজের স্মৃতিস্তম্ভ বানিয়েছেন। হিন্দুরা সঙ্গত কারণেই তার ওপর ক্ষুব্ধ।


অবশ্য সবাই নন। মানিকচাঁদ নামে এক জৈন ব্যবসায়ী বাংলার নামজাদা ধনী। মুর্শিদকুলি যখন বাংলার নবাব হলেন, মানিকচাঁদ তার ব্যবসা দেখাশুনা করতে দিলেন নিজের ভাইপো ফতেচাঁদকে। মুর্শিদকুলি এই ফতেচাঁদকে নিয়োগ করলেন দেওয়ানী মহাজন বা ব্যাঙ্কার হিসাবে, তাকে শিরোপা দেওয়া হলো জগৎশেঠ অর্থাৎ বিশ্ববণিক। সমগ্র বাংলায় যা রাজস্ব সংগৃহীত হতো, তার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ জমা পড়ত জগৎশেঠের কাছেই।


মানিকচাঁদ ১৭৩২ সালে আর ফতেচাঁদ ১৭৪৪ সালে মারা যান, ব্যবসার দায়িত্ব স্থানান্তরিত হয় ফতেচাঁদের দুই নাতি শেঠ মহাতব রাই আর মহারাজা স্বরূপচাঁদের ওপর। তাদের দুজনকেও জগৎশেঠ নামেই ডাকা হতে থাকে।


মুর্শিদকুলি অবশ্য ততদিন বেঁচে ছিলেন না, তিনি মারা গেছেন কৃষ্ণচন্দ্র রাজা হবার বছর তিনেক আগেই, ১৭২৫ সালে। পারস্যের খোরাসান অঞ্চলের উত্তরপুরুষ তার জামাই সুজা খাঁ হয়েছেন বাংলার নবাব। মির্জা মহম্মদ নামে এক তুর্কীর দুই ছেলে হাজি আহমেদ আর আলিবর্দী খাঁ সুজা খাঁর প্রিয়পাত্র। হাজি আহমেদ সুজার আলবোলা বয়ে বেড়ায় আর আলিবর্দী সেনাবাহিনীর ফাইফরমাস খাটে। কিন্তু হাজির প্রভাব নবাবের ওপরে এতটাই যে সে হয়ে গেল নবাবের পরামর্শদাতা, আর তার পরামর্শে ১৭২৯ সালে তার ভাই আলিবর্দী খাঁকে করে দেওয়া হলো বিহার প্রদেশের রাজ্যপাল। মাত্রই বছরখানেক হয়েছে তখন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কৃষ্ণনগরের রাজবাড়িতে আসীন হয়েছেন। আর সেই বছরেই জন্মেছেন আলিবর্দীর পছন্দের ছোট ভাইপো জৈনুদ্দিনের ছেলে মির্জা মহম্মদ, যাকে সবাই সিরাজুদ্দৌলা বা সিরাজ বলে ডাকে। 


চোদ্দ বছর শান্তিতে রাজ্য চালিয়ে সুজা খাঁ ১৭৩৯ সালে দেহ রাখলে তার ছেলে সরফরাজ খাঁ বিপদে পড়ে গেলেন বাপের প্রিয়পাত্রদের চালিয়াতিতে। আলিবর্দীকে বিহার প্রদেশের দেওয়ান করে দেওয়ার পেছনে জগৎশেঠের হাত ছিল। সরফরাজ প্রকৃতিতে অলস ও চরিত্রহীন, দু-হাতে পয়সা ওড়াতে ভালবাসে। টাকাকড়ি নিয়ে ঝামেলা তো হচ্ছিলই, শেঠদের বাড়ির মেয়েদের প্রতি কু-দৃষ্টি দেওয়ায় জগৎশেঠ চাইছিলেন এই বংশ যেন রাজ্য চালাতে না পারে, তাই তলে তলে ঘনিষ্ঠতা হয় হাজি আর ভাই আলিবর্দীর সাথে। হাজি তখন মুর্শিদাবাদে আর আলিবর্দী পাটনায়। হাজির যুদ্ধে পটুত্ব নেই, সেই সুযোগে আলিবর্দী ভাইদের শত্রুদের বিনাশ করার অছিলায় গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজকে হারিয়ে মুর্শিদাবাদে জাঁকিয়ে বসলেন। সেটা ১৭৪১ সাল। 


আলিবর্দী অবশ্য শান্তিপ্রিয় মানুষ, রক্তপাত একেবারে পছন্দ করতেন না। ইচ্ছে করলেই সরফরাজ আর তার অনুগামীদের মুন্ডু কেটে লালদিঘির জলে ভাসিয়ে দিতে পারতেন, সাধারণত মুসলমান শাসকেরা রাজ্যদখল করলে সেই রকম কিছুই করতো – অনেকসময় নিজের জন্মদাতা বাপকেও কেটে ফেলতে দ্বিধা করতো না – কিন্তু আলিবর্দী তার ধার দিয়েও গেলেন না। ওদেরকে নজরবন্দী রেখে রাজ্যশাসনে মন দিলেন। 


কিন্তু তিনি শান্তি চাইলেই তো শান্তি তাকে চাইবে, এমন কোন কথা নেই। রাজ্য দখলের পরের বছরেই মূর্তিমান বিভীষিকার মত হাজির হল মরাঠা দস্যুর দল। মোগলদের যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে মারাঠারা চৌথ নামে রাজস্বের এক চতুর্থাংশ যে কর তাদের প্রাপ্য বলে স্বীকার করিয়ে নিয়েছিল, তা মোগলদের অধিকৃত সমস্ত জায়গা থেকেই আদায়ের ছলে আক্রমণ করতে ধেয়ে এলো শস্যভাণ্ডার বাংলায়। 


দশ বছর ধরে চললো এই নিরন্তর অত্যাচার। মহারাষ্ট্রের পূবদিক পেরিয়ে উড়িষ্যা হয়ে তারা ঢুকে পড়তো বাংলার মধ্যে, আর একের পর এক গ্রাম জ্বালিয়ে লুঠপাট করত ঘরবাড়ি। তাদের আক্রমণে ছারখার হয়ে গেল রাঢ় বাংলা। ভাগীরথী পেরোলেই এপারে কলকাতা, মানে ইংরেজদের ঘাঁটি, আর নদীয়া, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জমিদারি। 


আলিবর্দী সহজে হার মানার পাত্র নন, তিনি বর্গীদের সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধে নিরত রইলেন। আর এই যুদ্ধের খরচাপাতি তোলার জন্যে রাজশাহী, দিনাজপুর আর নদীয়ার জমিদারদের কাছে পত্র পাঠালেন। আলিবর্দীর রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে ছিলেন নন্দকুমার, তিনি কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে পাঠালেন বারো লাখ টাকা নজরানার বিল। নদীয়া এলাকায় বিশাল হলে কী হবে, রাজস্ব উৎপাদনে তেমন সড়গড় নয়। এলাকায় প্রচুর পতিত ও নিষ্কর জমি। কোনোক্রমে বারো লক্ষ টাকা জোগাড় করে কৃষ্ণচন্দ্র পাঠালেন আলিবর্দীর রাজস্ব বিভাগের কর্মচারী সাজোয়াল সুজন সিং-এর হাতে, সে ব্যাটা টাকাটা আত্মসাৎ করে দিলো। আলিবর্দী খবর পেলেন, নদীয়ার জমিদার টাকা দেয় নি, ফলে কৃষ্ণচন্দ্রকে মুর্শিদাবাদের কারাগারে বন্দী করা হলো। 


বেশিদিন অবশ্য কারাগারে থাকতে হয় নি। গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় আলিবর্দী ধর্মপ্রাণ কৃষ্ণচন্দ্রের নানা সদ্‌গুণের পরিচয় পান। রাজা উর্দুভাষায় রামায়ণ-মহাভারতের অংশ অনুবাদ করে নবাবকে শুনাতেন, তাতে নবাব খুব খুশি হতেন। এছাড়াও কৃষ্ণচন্দ্রের বন্দী হওয়ার খবরে রাজ্যজুড়ে হিন্দুসমাজে উদ্বেগের খবর পাওয়া যায়, সে খবর পৌঁছায় আলিবর্দীর কানেও। তিনি কৃষ্ণচন্দ্রকে মুক্তি দেন বার্ষিক পঁচিশ হাজার টাকা অতিরিক্ত কিস্তি দেবার প্রতিশ্রুতিতে। 


তাতে অবশ্য বর্গী সমস্যার সমাধান হলো না। দিল্লীর শাসন শিথিল, আলিবর্দী তাদের সাথে এঁটে উঠছেন না, গঙ্গার পশ্চিমের জমিদাররা মারাঠাদের কর দেওয়া শুরু করেছে। বড় বড় জমিদাররা পালাচ্ছে দেশ ছেড়ে। কৃষ্ণনগরের অনতিদূরে অগ্রদ্বীপ, পাটুলি জ্বলছে বর্গীদের মশালের আগুনে। মাত্র পঁচিশ মাইল দূরে দাঁইহাটিতে বিরাট চম্পূ বা শিবির স্থাপন করে গেড়ে বসেছেন বর্গীদের নেতা স্বয়ং ভাস্কর পণ্ডিত। সেতু পেরোলেই এপারে পলাশি, নবদ্বীপ। মুর্শিদাবাদও বেশি দূরে না, আলিবর্দী তার পরিবারের লোকজনদের সরিয়ে দিয়েছেন গোদাবাড়ি গ্রামে। কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান রঘুনন্দনের বাস্তুভিটে যে গ্রামে, সেই চাঁড়ুল আর তার পাশের গ্রামগুলো সব শ্মশান। পলাশিতে বর্গীরা থানা বসিয়ে দিয়েছে। যে কোনোদিন তারা কৃষ্ণনগরে হানা দিলেই কৃষ্ণচন্দ্রের দফারফা। রঘুনন্দনের পরামর্শে রাজপরিবারের নিরাপত্তা রক্ষা করতে রাতারাতি রাজধানী উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো কৃষ্ণনগর থেকে ষোলো মাইল দূরে এক জলাশয়স্নিগ্ধ জঙ্গলঘন গ্রামে, তার নাম শিবনিবাস। কলকাতায় যখন মহাসমারোহে কাটা হচ্ছে মারাঠা ডিচ, কৃষ্ণচন্দ্রের নতুন রাজধানী রক্ষা করতে তার চারদিক ঘেরা হচ্ছে জলাশয় দিয়ে। যে জলা সেখানে আগেই ছিল, তার সাথে খাল কেটে পূবদিকে পদ্মার শাখানদী ইছামতী আর মাথাভাঙার সাথে মিলিয়ে দেওয়া হলো, পশ্চিমে তিনমাইল খাল কেটে মিলিয়ে দেওয়া হলো কৃষ্ণনগরের কাছে হাঁসখালি গ্রামের উত্তর দিয়ে বয়ে যাওয়া অঞ্জনার সঙ্গে। এর ফলে কঙ্কণের মত গোলাকৃতি জলবেষ্টিত এক ভূখণ্ডের সৃষ্টি হলো, এর নাম রাখা হলো কঙ্কণা। ইছামতী-মাথাভাঙা-চূর্ণীখালের মিলন হওয়ায় শিবনিবাসও হয়ে গেল এক ত্রিবেণীসঙ্গম। রাজবাড়ির পাশেই স্থাপন করা হল বিশাল বিশাল শিবের মন্দির। নগরে প্রবেশে পথ রইল শুধু পূবদিকে। উত্তর-পূবে এক গঞ্জ বানিয়ে তার নাম রাখা হলো কৃষ্ণগঞ্জ। কাছের অন্যান্য জলাশয়ের একটির স্বত্ত্ব দেওয়া হলো দেওয়ানকে, লোকমুখে তার নাম হয়ে গেল দেওয়ানের বেড়। 


আলীবর্দী উপায় না পেয়ে ভাস্কর পণ্ডিতের শর্ত মেনে কর দিতে রাজি হওয়ায় বাংলায় বর্গী হাঙ্গামা কমে গেল শেষমেষ। কৃষ্ণচন্দ্র অবশ্য শিবনিবাস থেকেই নদীয়ার জমিদারি চালাতে লাগলেন।


নদীয়ায় হিন্দু-মুসলমান দু’সম্প্রদায়েরই অনেক প্রজা, তিনি তাদের অভাব অনুযোগ শোনেন ও রীতিমত চেষ্টা করেন তাদের মন রাখতে। নিজে বৈষ্ণব, অথচ শাক্তদের বিন্দুমাত্র অপছন্দ তো করেনই না, বরং সবাইকে নিয়ে চলার পক্ষে তিনি। নৌকাযোগে কলকাতা যাবার পথে হালিশহরের ঘাটের পাশে উচ্চ সুরেলাকণ্ঠের শ্যামাসঙ্গীত শুনে রাজা তার নৌকা ঘাটে ভিড়াতে বলেন। আলাপ করেন গানের শিল্পীর সঙ্গে। পরদিন সকালে সেই শিল্পীর হাতে রাজার চিঠি আসে – তিনি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন মাসিক বৃত্তি দিয়ে তাকে সভাকবি করার। শিল্পী সবিনয়ে রাজার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও রাজা অখুশি হননি, বরং তাকে একশো বিঘা জমি আর কবিরঞ্জন উপাধি দান করেন। মাঝে মাঝেই হালিশহর কাছারিবাড়িতে তাদের মোলাকাত হতে থাকে। রাজা সন্ধ্যের দিকে তাকে অনুরোধ করেন, রামপ্রসাদ, নতুন কোন গান বাঁধলে নাকি? 


রামপ্রসাদ ভক্তিভরে তাকে শোনায় মায়ের গান –

অন্নপূর্ণার ধন্য কাশী।
শিব ধন্য কাশী ধন্য, ধন্য ধন্য আনন্দময়ী।
ভাগীরথী বিরাজিত, প্রবাহে অর্ধ শশী।
উত্তরবাহিনী গঙ্গা জল ঢালিছে দিবানিশি।
শিবেরত্রিশূলেকাশী, বেষ্টিতবরুণা-অসি

তন্মধ্যে মরিলে জীব, শিবের শরীরে মিশি।
কী মহিমা অন্নপূর্ণার, কেউ থাকে না উপবাসী।
ওমা, রামপ্রসাদ অভুক্ত তোমার, চরণধূলার অভিলাষী।


রাজা চোখ বুঁজে এই গানের রস গ্রহণ করেন, শেষ হলে সাধু সাধু করতে থাকেন। রামপ্রসাদের মত তিনিও কিছু কিছু সঙ্গীত রচনা করেছেন, এমনকি শ্যামা মায়ের বন্দনাও। 

অতি দুরারাধ্যা তারা ত্রিগুণা রজ্জুরূপিণী
না সরে নিঃশ্বাস পাশ, বন্ধনে রয়েছে প্রাণী।
চমকিত কী কুহক অর্জিত এ তিন লোক।
অহংবাদী জ্ঞানী দেখে তমোরজ্যোতি ব্যাপিনী।।


বস্তুত রাজ্যচালনার চেয়ে গান-বাজনা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যাপারে তার অদম্য উৎসাহ। তার সভায় এসব বিষয়ে যারা চর্চা করেন, তাদেরই রমরমা। নবরত্নের মত সভা আলো করে রয়েছেন পুরাণবিশারদ পণ্ডিত গদাধর তর্কালঙ্কার, সংস্কৃতজ্ঞ কালিদাস সিদ্ধান্ত ও কন্দর্প সিদ্ধান্ত, রাজজ্যোতিষী অনুকূল বাচস্পতি, রাজবৈদ্য আয়ুর্বেদাচার্য গোবিন্দরাম, বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি, হরিরাম তর্কসিদ্ধান্তর মত পণ্ডিত মানুষেরা। মহারাজের নিত্য সহচর শঙ্কর তরঙ্গ ও রামবোল, সভার ভারপ্রাপ্ত কর্তা গোপাল চক্রবর্তী, সেনাবাহিনীর কোষাধ্যক্ষ বা বক্সী নন্দগোপাল রায়, মুনশি অর্থাৎ ফার্সিভাষায় লেখক ও সচিবপ্রধান কিঙ্কর লাহিড়ী, ঘড়িয়াল বা সময়রক্ষক কার্তিক, আমিন নীলকণ্ঠ রায়, দেওয়ান ও আমিনের পেশকার বিশ্বনাথ বসু ও কৃষ্ণ সেন, হাবসী প্রহরী ইমামবক্স ও দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্র। জব চার্ণকের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই যে শোভা সিং রহিম খাঁর বিদ্রোহে হুগলি-বর্ধমান বিধ্বস্ত হয়েছিল, সেই অরাজকতার সময় রামকৃষ্ণ মিত্র নামে একজন পৈতৃক কোন্নগর গ্রাম ছেড়ে নদীয়ায় চাঁড়ুল গ্রামে বাসা বাঁধেন, তার পৌত্র এই রঘুনন্দন। কৃষ্ণচন্দ্র রাজা হওয়ার বছরেই তিনি সামান্য মুহুরীর কাজে বহাল হয়ে বারো বছরের পরিশ্রমে নদীয়ার দেওয়ানপদে উন্নীত হন ও রাজসভার মন্ত্রণাদাতাদের অন্যতমরূপে পরিগণিত হন। রঘুনন্দন খুবই করিৎকর্মা পুরুষ, তার পরামর্শেই নদীয়ারাজ্যে স্থাপিত হয়েছে বহু টোল, চতুষ্পাঠী, বহু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও বিদ্যার্থীর বৃত্তির ব্যবস্থা হয়েছে, দিগ্বিজয়ী পণ্ডিতরা প্রায়ই আসে নদীয়ারাজ্যে। তিনিই জমি জরিপ করিয়ে রাজ্যের আয় বৃদ্ধি করেন। 


বস্তুত সারা বাংলায় নদীয়াতেই তখন পণ্ডিত মানুষের ছড়াছড়ি। ছিলেন শ্রীকান্তঃ কমলাকান্তো বলরামশ্চ শংকরঃ। এই চারজন পণ্ডিত একত্রে একপক্ষে থাকলে নাকি স্বয়ং সরস্বতীও অন্যপক্ষ অবলম্বন করে জিততে পারেন না। ছিলেন স্মার্ত পণ্ডিত গোপাল ন্যায়ালঙ্কার, যিনি নির্ণয় শীর্ষক একগাদা সংস্কৃত পুস্তক লিখে খ্যাতিলাভ করেছেন। ছিলেন বুনো রামনাথ নামে খ্যাত নির্লোভ মহাপণ্ডিত রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর পাণ্ডিত্য ও আর্থিক অনটনের কথা জেনে কিছু অর্থসাহায্যের জন্যে তাঁর বাড়ি যান, গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, পণ্ডিতমশাই, আপনার কোনো অসঙ্গতি আছে?


ন্যায়শাস্ত্রে অসঙ্গতি মানে অসমন্বয়। পণ্ডিত বললেন, না, কোনো অসঙ্গতি নেই। আমি ছাত্রদের কাছে সকল পাঠেরই সঙ্গতি প্রদর্শনের সমর্থ হয়েছি।

রাজা দেখলেন, একে তো ইঙ্গিতে বোঝানো মুশকিল, তাই সরাসরি বিষয়ে এলেন, বললেন, আপনার টাকাকড়ির অনটন আছে?

পণ্ডিত বললেন, না। আমার আহারাদির জন্যে টাকাকড়ির প্রয়োজন তো নেই। ক্ষেতে শস্য আছে, তা থেকে গিন্নী চাল প্রস্তুত করেন আর ঐ যে তেঁতুল গাছ দেখছেন, ওর পাতার ঝোল দিয়ে আমি পেট পুরে ভাত খাই। 

রাজা নিরাশ হয়ে ফিরে গেলেন।


পণ্ডিতের স্ত্রীও কম তেজস্বিনী নন। একদিন গঙ্গার ঘাটে স্নানে গেছেন, সেখানে তখন গেছেন দাসদাসী-পালকি-বেহারা পরিবৃত হয়ে রাজরাণীও। রামনাথের স্ত্রী ঘাটের এক পাশে নিঃশব্দে স্নান করে কলসীতে জল ভরতে যাবেন, অমনি তাকে এক দাসী বলে উঠল, কে গা তুমি? তোমার সাহস তো কম না। দেকচো না রাণীমা স্নানে এয়েচেন? তুমি একেনে বসে জল ঘোলা কচ্চো?

পণ্ডিতের স্ত্রী শান্তভাবে বললেন, বাছা, ভদ্রভাবে কথা বলো। আমি তোমার চেয়ে বয়সে ও মানে ঢের বড়।

উদ্ধত দাসী মুখ ঝেমটে বললো, আ গেলো যা। হাতে তো ঐ একগাচি লাল সুতো, তার আবার দেমাগ কত!

ব্রাহ্মণী হেসে বললেন, তুই মূর্খ স্ত্রীলোক, তোকে কী বোঝাবো এই লালসুতোর মর্ম। এই সুতো যতদিন আমার হাতে থাকবে, এই নদীয়ার মান-যশ ততদিন থাকবে। 

সে যশ-মানের অধিকারী প্রকৃতই ছিলেন বুনো রামনাথ। তাবড় তাবড় দিগ্বিজয়ী পণ্ডিতদের তর্কে পরাজিত করেছিলেন তিনি। 


আর এক অসামান্য পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন। বাংলার তাবড় রাজারাজড়া নবাব বাহাদুর তো বটেই, শোনা যায় বর্গীদের প্রধান ভাস্কর পণ্ডিতও তাঁকে সম্মান জানিয়েছিলেন।


কৃষ্ণচন্দ্রের সভা গমগম করে এইসব বিদ্বান ও করিতকর্মা যুগপুরুষদের উপস্থিতিতে। এরা ছাড়াও গোপাল তো আছেই সভাস্থল উজ্জীবিত রাখতে। তার সঙ্গে রাজা খুঁজে পেয়েছেন আর এক রত্নকে। রাজার ধারণা সে ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি।


তার নামটিও ভারত। বর্ধমানের পান্ডুয়ায় তার জন্ম, সে রাজার প্রায় সমবয়সী। বাবা নরেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন জমিদার। কিন্তু জমি নিয়ে খোদ বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ্র রায়ের সঙ্গে তার বিবাদ লাগলে তিনি রাজার মাকে গালাগালি দেন। ফলে রাজার সেনাপতি এসে চড়াও হয়, কীর্তিচন্দ্র পালিয়ে বাঁচেন, ভারত এসে আশ্রয় নেয় নওয়াপাড়া গ্রামে মামার বাড়িতে। কাছে তাজপুর গ্রামের টোলে ব্যাকরণ আর সাহিত্য পাঠ শুরু হয় তার। চোদ্দ বছর বয়সে বিয়েও করে ফেলে। শুধু সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোন ভাষা শেখেনি, এই বলে তার দাদারা ভর্ৎসনা করলে সে গিয়ে ভর্তি হয় বাঁশবেড়িয়ার কাছে দেবানন্দপুরে, সেখানে রামচন্দ্র মুন্সীর কাছে শেখে ফার্সী ভাষা। মাত্র পনের বছর বয়সে সত্যনারায়ণ পুজো উপলক্ষ্যে পাঁচালির আকারে সত্যপীরের কথা লিখে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। 


ভারতের আত্মীয়েরা পরামর্শ দেয় তাকে বর্ধমানে ফিরে গিয়ে জমিজায়গা দেখাশুনা করার। এদিকে নিয়মিত খাজনা না দেওয়ায় সে জমি বর্ধমানের রাজা কেড়ে নিয়েছেন, ভারত মোক্তার হিসাবে তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানালে তাকে ধরে গারদে পুরে দেওয়া হয়। ভারত গুণী ছেলে, কারারক্ষীদের সঙ্গে ভাল ব্যবহারের জন্যে তার ওপর সদয় হয়ে একজন তাকে বের হতে দেয়, রাতের অন্ধকারে গোপনে পালিয়ে গিয়ে সে আশ্রয় নেয় উড়িষ্যার সুবেদার শিবভট্টর কাছে। সেখানে কিছুকাল কাটিয়ে আবার ফিরে আসে বাংলায়।


চন্দননগরে তখন ফরাসী উপনিবেশ। তার দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর বাড়িতে আশ্রয় মেলে ভারতের। কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে ইন্দ্রনারায়ণের নিয়মিত সাক্ষাৎ হয়, সেখানে ভারতচন্দ্রের সঙ্গে মোলাকাৎ হয় তার। এই রকম একজনকেই তো খুঁজছিলেন তিনি। কৃষ্ণনগরের রাজসভায় উঠিয়ে নিয়ে আসেন ভারতচন্দ্রকে। চল্লিশ টাকা বেতনে সে নিযুক্ত হয় সভাকবি হিসাবে। 


রাজার আদেশে ভারতচন্দ্র রচনা করে তিনখণ্ডে অন্নদামঙ্গলকাব্য। ভাষা, ছন্দ, কাব্য সবকিছুতেই তার অগাধ নিয়ন্ত্রণ। কাব্যের শুরুতে সেই সময়কার বাংলার অবস্থা, বর্গী আক্রমণ ও তার ফলে নদীয়ারাজ্যের অবস্থা, সব লিখেছে সে অনুপম পয়ারে।


স্বপ্ন দেখি বর্গি রাজা হইল ক্রোধিত।
পাঠাইলা রঘুরাজ ভাস্কর পণ্ডিত।।
বর্গি মহারাষ্ট্র আর সৌরাষ্ট্র প্রভৃতি।
আইল বিস্তর সৈন্য আকৃতি-বিকৃতি।।
লুটি বাঙ্গালার লোকে করিল কাঙ্গাল।
গঙ্গা পার হইল বান্ধি নৌকার জাঙ্গাল।।
কাটিল বিস্তর লোক গ্রাম গ্রাম পুড়ি।
লুটিয়া লইল ধন ঝিউড়ী বহুড়ী।।
পলাইয়া কোঠে গিয়া নবাব রহিল।
কী কহিব বাঙ্গালার যে দশা হইল।।
লুটিয়া ভুবনেশ্বর যবন পাতকী।
সেই পাপে তিন সুবা হইল নারকী।।
নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়।
বিস্তর ধার্ম্মিক লোক থেকে গেল দায়।।


এই নরক থেকে উদ্ধার পাওয়া কি সহজ কাজ! খাদ্য-অর্থ লুটে নিয়ে গেছে মারাঠী বর্গী, নদীয়ার অবস্থা শোচনীয়। কিন্তু তাই বলে নবাবের খাজনা তো মকুব হবে না। রাজ্যের যখন এই অবস্থা, প্রজাবৎসল রাজা তাদের কাছে খাজনা জোগাড়ের কী উপায় করবেন! কিন্তু মুর্শিদাবাদের নবাব এতে কর্ণগোচর করার লোক নয়। তারা রাজাকে ধরে নিয়ে গিয়ে পুরে দিলো গারদে।


মহাবদ জঙ্গ তারে ধরে লয়ে যায়।
নজরানা বলে বার লক্ষ টাকা চায়।।
লিখি দিলা সেই রাজা দিব বার লক্ষ।
সাজোয়াল হইল সুজন সর্ব্বভক্ষ।।
বর্গিতে লুটিল কত কত বাসুজন।
নানা মতে রাজার প্রজার গেল ধন।।
বদ্ধ করি রাখিলেন মুরশিদাবাদে।
কত শত্রু কত মতে লাগিল বিবাদে।।


ধীরস্থির রাজা হতাশ হলেন না, নিজের প্রতি তাঁর বিশ্বাস অগাধ। বন্দী অবস্থাতেই তিনি দেবী অন্নপূর্ণার স্তব করলেন। দেবী স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাঁকে দেবীর পূজার আয়োজন করে দেবীর মাহাত্ম্য প্রচারের উপদেশ দিলেন। সেই মতো –


দেবি পুত্র দয়াময় ধরা পতি ধীর।
বিবিধ প্রকারে পূজা করিল দেবীর।।
চৌত্রিশ অক্ষরে বর্ণাইয়া কৈলা স্তব।
অনুকম্পা শ্রবণে হইল অনুভব।।
অন্নপূর্ণা ভগবতী মুরতি ধরিয়া।
স্বপন কহিল মাতা শিয়রে বসিয়া।।
শুন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র না করিহ ভয়।
এই মূর্ত্তি পূজা কর দুঃখ হবে ক্ষয়।।
আমার মঙ্গল গীত করহ প্রকাশ।
কয়ে দিলা পদ্ধতি গীতের ইতিহাস।।
চৈত্রমাসে শুক্লপক্ষে অষ্টমী নিশায়।
করিহ আমার পূজা বিধি-ব্যবস্থায়।।
সভাসদ তোমার ভারতচন্দ্র রায়।
মহাকবি মহাভক্ত আমার দয়ায়।।
তুমি তারে রায়গুণাকর নাম দিও।
রচিতে আমার গীত সাদরে কহিও।।
আমি তারে স্বপ্ন কব তার মাতৃবেশে।
অষ্টবাহ গীতের উপদেশ সবিশেষে।।
সেই আজ্ঞামত রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়।
অন্নপূর্ণা পূজা করি তরিল সে দায়।।
সেই আজ্ঞা মত কবি রায়গুণাকর।
অন্নদামঙ্গল কহেন বরসভর।।


দেবী অন্নপূর্ণা বা সতীর মাহাত্ম্য এই অন্নদামঙ্গল কাব্যে। হরগৌরীর মিলন, বিবাদ, অন্যান্য দেবদেবীদের ভূমিকা সব কিছু নিয়ে এর বিস্তৃতি। শিব যখন শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে সতীর দেহত্যাগের পর, তার সেই অংশের বর্ণনা শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়। রাজা বারবার শুনতে চান এ অংশটা, ভারত, আবার পড়ো ঐ জায়গাটা, ঐ যে ধিয়া তাধিয়া তাধিয়া। ভারত পড়তে থাকে –


ধিয়া তাধিয়া তাধিয়া ভূত নাচে।
উলঙ্গী উলঙ্গে পিশাচী পিশাচে।
সহস্র সহস্র চলে ভূত দানা।
হুহুঙ্কারে হাঁকে উড়ে সর্প বীণা।
চলে ভৈরব ভৈরবী নন্দী ভৃঙ্গী।
মহাকাল বেতাল তাল ত্রিশৃঙ্গী।
চলে ডাকিনী যোগিনী ঘোর বেশে।
চলে শাঁকিনী প্রেতিনী মুক্ত কেশে।
গিয়া দক্ষ যজ্ঞে সবে যজ্ঞ নাশে।
কথা না সরে দক্ষরাজে তরাসে।


রাজা বলেন, হুম, বেড়ে লিখেছ। কী যেন ছন্দটা বলছিলে সেদিন? নিহতসর্প না কী যেন –

ভারতচন্দ্র বলে, ভুজঙ্গপ্রয়াত মহারাজ। এই যে পরের লাইনেই লিখেছি –


অদূরে মহা রুদ্র ডাকে গভীরে।
অরেরে অরে দক্ষ দেরেস তীরে।।
ভুজঙ্গপ্রয়াতে কহে ভারতী দে।
সতী দে সতী দে সতী দে সতী দে।।


রাজা খুশি হয়ে ভারতচন্দ্রকে রায় গুণাকর খেতাব দিয়েছেন। তার সঙ্গে মূলাজোড় গ্রামটিও দান করেছেন তাকে, ছশো টাকা বার্ষিক রাজস্ব আসে সেখান থেকে। কবি হিসাবে ভারতচন্দ্রের নাম ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলায়।


সম্প্রতি রাজার ইচ্ছায় ভারতচন্দ্র লিখতে শুরু করেছে রসমঞ্জরী। নরনারীর কামনা-বাসনা নিয়ে সংস্কৃতে এতগুলো সরস কাব্যগ্রন্থ আছে, মহর্ষি বাৎস্যায়ণ বিরচিত গ্রন্থটি তো অতি উৎকৃষ্ট। এ ছাড়াও ভানুদত্ত মিশ্রের রসমঞ্জরী, জয়দেবের রতিমঞ্জরী, রূপ গোস্বামীর উজ্জ্বল নীলমণি, কল্যাণমল্লের অনঙ্গরঙ্গ – এ বিষয়ে গ্রন্থের অভাব নেই। বাংলায় কেন এই বিষয়ে উৎকৃষ্ট কাব্য থাকবে না, ভারতচন্দ্রের মত গুণী কবি যেখানে রয়েছে! 


মাঝে মাঝেই রাজ-উদ্যানে ভারতচন্দ্রের রসমঞ্জরীর পাঠের আয়োজন হয়। রাজা নিমন্ত্রণ পাঠান যাবতীয় পাত্র-মিত্র-অমাত্যদের। এদিনও ডাক গেল সবার কাছে। সকলেই নির্দিষ্ট সময়ে হাজির, শুধু গোপালের দেখা নেই।


রাজা উদ্যানের দ্বারপালকে বলে রাখলেন, গোপাল এলে যেন তাকে সহজে ঢুকতে না দেওয়া হয়। 


নীলমণি সমাদ্দার নামে এক গায়ক ভারতচন্দ্রের রচনায় সুর দেয়। তার গাওয়া কিছু গানের পর শুরু হল রসমঞ্জরী থেকে পাঠ। বয়োবিভাগ অংশ থেকে পাঠ করছে ভারতচন্দ্র, তার বিষয় যৌবনের বিভিন্ন ভেদ, পুরুষ ও নারীর। ভারতচন্দ্র পড়ে চলেছে –

নারীর যৌবন বড় দুরন্ত। 
শরীর মাঝে পোষে বসন্ত।।
বিনোদ বিননে বিনায়ে বেণী। 
পুরুষে দংশিতে পোষে সাপিনী।।
কত কত অলি নয়নে ঘোরে। 
মধুবাক্যে কত কোকিল ঝোরে।।
মলয় বাতাস শ্বাসেতে বহে। 
সৌরভে সুরভি গৌরব নহে।।


শুনে মহারাজ ঘন ঘন মাথা নাড়াতে লাগলেন। আর একবার পড়ো, ভারত, কী লিখেছ, নারী শরীর মাঝে পোষে বসন্ত! আহা আহা। 


সভা চলাকালীন গোপালের সশব্দ প্রবেশ ঘটেছে। তাকে তো দারোয়ান কিছুতে ঢুকতে দেবেনা। রাজার হুকুম! অনেক অনুনয়-বিনয়ে কাজ না হলে গোপাল শেষে তাকে বুঝিয়েছে, দ্যাখো বাপধন, তুমি তো জানো, রাজা আমাকে কত ভালবাসেন, প্রতিদিনই কিছু না কিছু উপহার দেন। আজ যা দেবেন, তার অর্ধেক তোমার।


ঘুষ পেলে পাথরও গলে যায়, এ তো সামান্য প্রতিহারী। আর রাজা তো বারণ করেন নি, বলেছেন, সহজে যেন ঢুকতে না পারে। এতক্ষণ অনেক ধানাই পানাই করেছে। সে দরজা খুলে দিয়েছে।


সভায় তখন চলছে ভারতচন্দ্রের জাতিকথন অংশের পাঠ। স্ত্রীজাতি চারি প্রকারের। পদ্মিণী, চিত্রিণী, শঙ্খিনীর পর শেষটির নাম হস্তিনী। তার স্বরূপ কেমন?

স্থূল কলেবরস্থূল পয়োধরস্থূল পদকর ঘোরনাদিনী।
আহার বিস্তরনিদ্রা ঘোরতরবিহারে প্রখর পরগামিনী।
ধর্ম্ম নাহি ডরদন্ত ঘোরতরকর্ম্মেতে তৎপর মিথ্যাবাদিনী।
সুপ্রশস্ত কায়বহু লোম হয়মদ গন্ধ কয় সেই হস্তিনী।


সেই বর্ণনা শুনে রাজা তো হেসে গড়াগড়ি। তোমার ধর্মপত্নীটি কোন প্রকারের, ভারত?


সভায় ব্যাঘাত ঘটলো গোপালের অস্বাভাবিক আচরণে। সে গিয়ে ধড়াম করে অসভ্যের মত গিয়ে পড়ল একজনের ঘাড়ে। খাদ্য, পানীয় যা রাখা ছিল সেখানে সব ছত্রাকার হয়ে গেল। একজন গোপালকে কী বলতে গেল। গোপাল তাকে বলল, তোর বাপের কী রে শালা? 


রাজার চোখের সামনে এসব ঘটনা ঘটছে। প্রচণ্ড রেগে গিয়ে তিনি বললেন, এক্ষুণি কান ধরে একশোবার ওঠবোস করো। আর তোমার আজ বিশ টাকা জরিমানা।


গোপাল সঙ্গে সঙ্গে কান ধরে ফটাফট পঞ্চাশবার ওঠবোস করল। দশটাকা রাজার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, বাকি পঞ্চাশবার ওঠবোস করবে আর দশটাকা জরিমানা দেবে আপনার দ্বারপাল। ওর সঙ্গে চুক্তি আছে আজকে আমার যা প্রাপ্য হবে, তার অর্ধেক ওর। 


রাজা মুহূর্তে বুঝে গেলেন কী ঘটেছে। কিন্তু এ নিয়ে মস্করা অধিক অগ্রসর হবার আগেই সভায় প্রবেশ করল রাজার বিশ্বস্ত সেনা-অনুচর। কৃষ্ণচন্দ্রের হাতে তুলে দিল সে একটা চিঠি। চিঠির বিষয় খুবই সংক্ষিপ্ত। তাকে অবিলম্বে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ যেতে হবে, ধনী জগৎশেঠের প্রাসাদে, বিশেষ প্রয়োজনে। (ক্রমশ)





0 comments: