Next
Previous
Showing posts with label ইতিহাসের কথা ইতিহাসের কাহিনি. Show all posts
0

ইতিহাসের কথা ইতিহাসের কাহিনি - অভীক মুখোপাধ্যায়

Posted in






জিয়া কে আম



নেতারা টাকা খেতে ভালোবাসেন। কোনো কোনো নেতা আম খেতেও ভালোবাসেন। কেটে, চুষে, খোসা ছাড়িয়ে... আম আর আমজনতার যাবতীয় রস তাঁরা আস্বাদন করেন। জনতার রসাস্বাদন করা নেতার উদাহরণ ভূরি ভূরি, আমি নাহয় আম–খোর নেতা নিয়ে গল্পটা বলি। জিয়া–উল–হক, নাম তো সুনা হি হোগা।

পাকিস্তানের মাটিতে সবথেকে দীর্ঘ সময় ধরে নিষ্কণ্টক রাজত্ব করে যাওয়া মিলিটারি শাসক জিয়ার প্রত্যেকটি পদক্ষেপ পাকিস্তানের প্রথম মিলিটারি রুলার আইয়ুব খানের একেবারে বিপরীত ছিল। আইয়ুব যা যা বানিয়েছেন, জিয়া তা-ই তা-ই নষ্ট করেছেন। আইয়ুবের জন্ম খাইবার পাখতুনবাহ এলাকার একটি ফৌজি পরিবারে। ফৌজি বলতে ব্রিটিশ আর্মির অধীনে চাকরি করত। আইয়ুব নিজে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া সেরে আর্মি জয়েন করেন। অত্যন্ত ট্যালেন্টেড হওয়ার ফলে আইয়ুব সিনিয়রদের নজর কাড়েন। তাঁকে ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্ট একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। এই জায়গাটাকে পৃথিবীর মিলিটারি সার্ভিসের কেমব্রিজ বলা চলে। কোর্স কমপ্লিট করে ফিরে আসার পরে ভারতের ব্রিটিশ ফৌজের একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক রূপে অধিষ্ঠিত হন আইয়ুব খান। এরপর পাকিস্তানের জন্ম হল। আইয়ুব নিজের জন্য বেছে নিলেন পাক আর্মির অপশন। সেখানকার টপ জেনারেল হয়ে গেলেন।

জিন্নাহ সাহেবের মৃত্যুর পরে লিয়াকত আলিই হলেন হর্তাকর্তাবিধাতা। তিনি আইয়ুব খানকে নিজের সরকারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্ব দিলেন। লিয়াকত আলিকে হত্যা করা হল। তখন পাকিস্তানের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মুখ কই? আইয়ুব খান নিজের ক্ষমতায় সরকার দখল করলেন। পাকিস্তানে উন্নয়নের জোয়ার এল। পাশপাশি কোল্ড ওয়ার চলছিল। আইয়ুব খান আমেরিকার পক্ষ নিলেন। আমেরিকাও নিজের ঝুলি উপুড় করে ঢেলে দিল অঢেল টাকা, অস্ত্র, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প। রাস্তাঘাট, বন্দর, স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, বাঁধ, ক্যানাল ইত্যাদি তৈরি হল। পাকিস্তানে স্বাধীন কসমোপলিটান সোসাইটির জন্ম আইয়ুব খানের সময়েই হয়েছিল।

এরপর ১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ, ইস্ট বেঙ্গল হাতছাড়া হয়ে যাওয়া, ফাতিমা জিন্নাহর প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে ঠগবাজি করে জেতার মতো পর পর আঘাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে আইয়ুব খান নিজের চামচা জেনারেল ইয়াহা খানকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করতে বাধ্য হলেন। তিনিও হেরে গেলেন একাত্তর সালে, ক্ষমতায় এবার জুলফিকার আলি ভুট্টো।

এই ভুট্টো সাহেব একবার মুলতানে গেলেন। তা, সেবারে ওখানে যে স্যুটটা পরছিলেন, সেটার ফিটিংস খুব একটা ভালো ছিল না। মুলতানের এক সেনা অফিসার নিজে সেই স্যুটটাকে ঠিক করানোর দায়িত্ব নিলেন। ভুট্টোকে ট্যাঙ্কের ভেতরে বসিয়ে ঘোরালেন। কামান দেগে দেখালেন। এহেন খাতির পেয়ে ভুট্টো ভারী খুশি হলেন। মাত্র একবছরের মধ্যেই ওই সেনাধিকারিক অন্য সাতজন সিনিয়র জেনারেলকে টপকে পাকিস্তানের সেনাধ্যক্ষ রূপে পোস্টিং পেলেন। এই নতুন সেনাধ্যক্ষর নাম - জিয়া উল হক। সেই মুহূর্তে জুলফিকারের কাছে জিয়ার মতো বিশ্বস্ত আর কেউ ছিলেন না। যাই হোক, বিশ্বস্ত ব্যক্তির বিশ্বস্ততা এমন পর্যায়ের ছিল যে, পরের দুবছরের মধ্যে জুলফিকার আলি ভুট্টো কবরে চলে গেলেন, আর জিয়া গিয়ে বসলেন ওঁর চেয়ারে। 

একজন পঞ্জাবি মিলিটারি ক্লার্ক তথা মৌলবির ছেলে জিয়া দিল্লি ইউনিভার্সিটি থেকে বি.এ. পাস করে আর্মি জয়েন করেছিলেন। নিজের ধর্মীয় মতবাদ নিয়ে এতটাই গোঁড়া ছিলেন যে, একবার ইংরেজ অফিসারদের সঙ্গে ধার্মিক সাংস্কৃতিক অধিকার নিয়ে বেশ কথা কাটাকাটি হয়ে যায়। পাকিস্তান জন্ম নেওয়ার পরে পাক আর্মিতে চলে যান। আর বাকি সব কিছু তো লিখেইছি।

আজকের এই দক্ষিণপন্থী আবহে যে যাই বলুন না কেন, জিন্নাহ সাহেবের মধ্যে কিন্তু এতটুকু ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না। আদবানিজি এই নিয়ে মুখ খোলায় বিতর্ক হয়েছিল বটে, কিন্তু ইহাই সত্য। জিন্নাহ সাহেব হিন্দু-মুসলমান নিয়ে যা যা করেছিলেন, তা ছিল তাঁর রাজনীতি। জিন্নাহ নিজের প্রথম বক্তৃতায় একটি সেকুলার দেশের কল্পনা করেছিলেন। ‘হিন্দু মুসলিম শিখ ইসাই, পাকিস্তান মে মস্ত রহো ভাই...’। জিন্নাহ রিপাবলিক অব পাকিস্তানের আইডিয়া দিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর বছর দশেক পরে পাকিস্তানের অফিশিয়াল নাম হয় ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান। তারপর শুরু হয়ে গেল কাউকে কম মুসলমান, কম দেশভক্ত, কম বুদ্ধিমান বলার ইঁদুরদৌড়। সুন্নীরা হলেন টপ ক্লাস। শিয়ারা নীচু। আহমেদিয়াদের বলে দেওয়া হল নন-মুসলিম। ধর্ম এমন একটি বিষয় যে সবসময়েই বড় নাজুক, সব সময়েই বড় বিপদ অনুভব করে। তাই যখন জিয়া এলেন, তখন তিনি ধর্মের পালে হাওয়া তুলে ইসলামকে রক্ষা করার এজেন্ডা নিলেন। সেটাও বাকি সব এজেন্ডার ওপরে রইল।

শরিয়া কানুন লাগু হল। ব্লাসফেমিতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করল পাকিস্তান। কিছু বলেছ কী ধর্মের মাথারা ব্লাসফেমির দোহাই দিয়ে তোমার মাথাটি কেটে নিয়ে গেণ্ডুক খেলবে। হুদুদ অর্ডিন্যান্স এল। হুদুদ মানে? অ-ইসলামিক আচরণ করলে সাজা পেতে হবে। চাবুক পড়বে, পাথর ছুঁড়ে মারা হবে। তারপর এসে গেল প্রেস সেন্সরশিপ। জিয়া বললেন, আমি অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখি। ব্যাস, করো, মুজাহিদিনদের সাপোর্ট করো। মাদ্রাসা খোলা হতে থাকল। পরে সেখান থেকে কী শিক্ষার জন্ম পাকিস্তান দিতে পেরেছে, তা বিশ্ববাসীর কাছে অজানা নয়। ধর্মের নাম করে দেশের যুবকদের একটা নতুন আইডিয়োলজি দিল পাকিস্তান, আর দিল অস্ত্র — যাও, সন্ত্রাস চালাও!

আই এস আই-এর ক্ষমতা ক্রমশঃ বাড়ছিল। যে যত জো হুজুর বলবে, সে-ই সংসদে পৌঁছবে। কারা সংসদে যাওয়ার টিকিট পেল? ধর্মগুরুরা। রাষ্ট্রের সমস্ত বিষয়কে এবার ধর্মের চশমায় দেখা হতে লাগল। সবকিছুর সমাধানের জন্য ব্যবহার করা হতে লাগল শরিয়া কানুন। ভাবটা এমন যে, এইসব করলেই ধর্মরক্ষা হবে।

আর এইসব কিছুর মাঝে একদিন আম ফাটল। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন পাঠকবন্ধু — বোমা নয়, আম ফাটল। ঘটনাটাও ভারী অদ্ভুত। একবার একটি ফৌজি মহড়া দেখার জন্য জিয়া বহাবলপুর গিয়েছিলেন। যেহেতু জিয়া আম খেতে ভালোবাসতেন, সেখানে কেউ বা কারা তাঁকে আম উপহার দেয়। আমের ঝুড়ি কে দিয়েছিল কেউ জানে না। সেই ঝুড়ি তাঁর প্লেনে রাখা হয়। প্লেন যখন মাঝ আকাশে, তখন সেই আমগুলোর মধ্যে থাকা বোমায় বিস্ফোরণ ঘটে। ১৯৮৮ সালের ১৭ই আগস্ট জিয়া উল হকের মৃত্যু হয়। 

প্রচুর কন্সপিরেসি থিওরি চলে। আমের মধ্যে থাকা বোমার কথাটা আগেই লিখেছি। জিয়ার ভক্তবৃন্দ নারা তুলল — ‘জব তক সুরজ চান্দ রহেগা, জিয়া তেরা নাম রহেগা...’। কিন্তু এ ভাই পাকিস্তান, এখানে লোকে করোনা আসার আগে থেকেই হাতে ধুয়ে ফেলার অভ্যেস জারি রেখেছে। ২০১০ সালের অষ্টাদশ সংবিধান সংশোধন দ্বারা পাকিস্তানের সংবিধান থেকে তাঁর নাম মুছে দেওয়া হয়।

কিন্তু জিয়ার নাম সবার মনে রয়ে গেছে। আজও যখন পাকিস্তানের চারজন বুদ্ধিজীবী টিভি চ্যানেলে বসে পাকিস্তানের দুর্দশা নিয়ে কথা বলেন, তখন জিয়াকেই গালিগালাজ করেন। অবশ্য এই মিডিয়াই একদা জিয়াকে মাস্টার টেকনিশিয়ান কিংবা রিংমাস্টার অভিধায় ভূষিত করত।
2

ইতিহাসের কথা ইতিহাসের কাহিনি -- অভীক মুখোপাধ্যায়

Posted in











রাজেশ্বরী নামটা কি তোমার পছন্দ?



বর্ষা এসে গেছে, কিন্তু কারো আর তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।

কারণ কী?

করোনার ভয়।

বর্ষা যেমন এসেছে, একটা সময়ে চলেও যাবে। তার আসা-যাওয়ার ফাঁকে কি ভেজা পাতার ওপরে হাঁটার শব্দটুকুও শুনব না আমরা? আসুন না, এই বর্ষণমুখর দিনে ঘরে বসেই পড়ে নিই বিংশ শতকের এক আসল নায়কের প্রেমকাহিনি। আমাদের ন্যাশনাল হিরোর কথা।

আমরা শুধু ন্যাশনাল হিরোদের বীরত্ব দেখি। ওইটুকুই কি সব? তাঁদের কি জীবন বলতে কিচ্ছু নেই? মোহ নেই? মায়া নেই? প্রেম নেই? তাঁদের জীবনের যতটা শুনি, তার থেকেও অনেক বেশি কথা না-শোনা হয়েই থেকে যায়। অন্তরালে। মাতৃভূমির জন্য তাঁরা নিবেদিত প্রাণ। নিজের জীবিনের স-বকিছু তাঁরা জুয়ার দানের মতো বাজি হিসেবে লাগিয়ে দেন শুধু আমাদের রক্ষা করবেন বলেই। কিন্তু তাঁরাও তো কোনো পরিবারের ‘সর্বস্ব’? তাঁরাও তো কোনও রমণীর ডায়েরির পাতায় লাল কালিতে লেখা নাম? তাঁরা নিজেরাও যে কোনও ছানি অপারেশনের তারিখ পেছোতে বাধ্য মায়ের নয়নের মণি? 

গল্প, কাহিনি এসব লিখলেও এটা আসলে সত্যি ঘটনা। এক পি ভি সি অ্যালাইভ সোলজারের জীবনের কথা।

পি ভি সি অ্যালাইভ?

জীবিত অবস্থায় সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান ‘পরমবীর চক্র’ প্রাপক যোদ্ধা।

নাম?

শ্রী রাম রাঘোবা রাণে।


জন্ম ১৯১৮ সালে। সৈন্যজীবন শুরু হল বাইশ বছরে বয়েসে। তখন ব্রিটিশদের জমানা। ইংরেজদের হয়ে লড়তে লড়তে বার্মা দেশে গিয়ে পড়লেন রাণে। তখন সেনাবাহিনীর কোরটার নাম ছিল ‘বোম্বে স্যাপার্স্’। এটাকেই আবার ‘বোম্বে এঞ্জিনিয়ার গ্রুপ’-ও বলা হতো। স্বাধীনতার পরে অবশ্য এরই নাম হয়ে যায় ‘কর্পস্ অব এঞ্জিনিয়ার্স্’। 

যাই হোক, হাতে মিডিয়াম মেশিন গান আসার আগে এসে গেল ‘কম্যান্ড্যান্ট কেইন’। তখনকার দিনে ট্রেনিং পিরিয়ডে এটাই ছিল বেস্ট ক্যাডেটের সম্মান। মানে, প্রথম থেকেই বাহিনীর জন্য মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন।

আর যখন মেশিন গান হাতে তুললেন তখন?

একার দমে জাপানের একটা প্লেন গুলি মেরে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন এই রাম রাঘোবা রাণে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল। ভারত স্বাধীন হয়ে গেল ১৯৪৭ সালে। রাণে হয়ে গেলেন ভারতীয় স্থল বাহিনীর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট।

স্বাধীনতায় দেশের অনেক কিছু বদলে গেলেও কিছু জিনিস বদলায়নি। যেমন ইন্ডিয়ান মিলিটারি। বিশেষ করে স্থলসেনার বেশিরভাগ কায়দা – কানুন সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। ব্রিটিশ পিরিয়ডের।

তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই অত তাড়াতাড়ি যে ভারত ভূখণ্ডের আবার স্থলসেনার প্রয়োজন পড়বে তা কেউ ভাবেননি। পাকিস্তান ভারতের থেকে প্রাপ্ত অর্থসাহায্য নিয়ে হাতিয়ার কিনে ভারতকেই আক্রমণ করে বসল।

পাকিস্তানের পরিকল্পনা ছিল কাশ্মীরে দুদিক থেকে আক্রমণ করা হবে। প্রথম আক্রমণ হল শ্রীনগরে। সৈন্যবাহিনী তৎপর হয়ে ওঠার আগেই অখনূর এবং নৌশেরা সহ সম্পূর্ণ জম্মুও আক্রান্ত হল।

সেনার ইন্টেলিজেন্স সক্রিয় হয়ে উঠল। খবর পাওয়া গেল যে, পাকিস্তানি সেনা রাজৌরি থেকে অপারেট করছে। রাজৌরি একটা ছোট্ট গ্রাম। শ্রীনগর এবং জম্মু দুই জায়গা থেকেই এর দূরত্ব একশো কিলোমিটারের বেশি।

ভারতীয় সেনার পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে, সর্বপ্রথমে রাজৌরি দখল করতে হবে। গাছের শেকড় কেটে দিলে গাছ আপনা আপনি মাটিতে পড়ে যাবে।

পাকিস্তানি সেনাপ্রধানরাও তো আর ঘাসে মুখ দিয়ে চলতো না। তারা আগে থেকেই জানত যে ভারত সরকার এধরণের কোনো পরিকল্পনাই করবে। তাই রাজৌরিকে ভারত থেকেই বিচ্ছিন্ন করার আগাম প্ল্যানটাকে এক্সিকিউট করে দিলেন তারা। রাজৌরি থেকে ভারতগামী (বা উলটোটা) সমস্ত ছোট এবং বড় পথ অবরুদ্ধ করে দিল পাকিস্তানি সেনা।

এই অবরোধের ফলে সেনার গাড়ি বা ট্যাঙ্ক যাওয়ার আর কোন পথ রইল না। অবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার যে, স্বাধীন ভারতে এমন এলাকাও ছিল যেখানে ইন্ডিয়ান আর্মড অ্যান্ড আর্টিলারি কোরের কোনো দখলই ছিল না।

বড় বড় পাথরের চাঁই দিয়ে পথ বন্ধ করে দিয়েছিল পাকিস্তানি সেনা। ভারতের আর্মি পাথর সরানোর সবরকম সম্ভাব্য প্রয়াস শুরু করল। বুলডোজার আনা হল। কিন্তু এত বড় কর্মযজ্ঞ তো আর নিভৃতে করা যাচ্ছিল না। তখন আজকের দিনের মতো টেকনোলজি ছিল না। একটা বিশালাকার ট্যাঙ্কের থেকে অনেক বেশি শব্দ করত একটা বুলডোজার। আর এই আওয়াজের জন্য পথের পাশের ঝোপেঝাড়ে অপেক্ষা করে থাকছিল পাকিস্তানি সেনারা। প্রথম বারে বুলডোজার চালাতেই শব্দ লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে চারজন জওয়ানের প্রাণ নিয়ে নিল তারা। বুলডোজার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হল ভারতীয় সেনা।

তবে ইন্ডিয়ান আর্মি হাল ছাড়েনি। অলটারনেটিভ প্ল্যান আনা হল। জঙ্গলের পথ খোঁজা হল। লক্ষ্য নির্ধারিত করে এগোনোর দায়িত্ব গিয়ে পড়ল সেনার নির্দিষ্ট একটি সেকশনের ওপরে। এই কাজে পারদর্শী ‘কর্পস্ অব এঞ্জিনিয়ার্স্’রাই এগোতে শুরু করল। 

সেদিন নেতৃত্বে ছিলেন রাম রাঘোবা রাণে। সঙ্গে কয়েকটা ট্যাঙ্ক আর বত্রিশ জন সঙ্গী জওয়ান। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা চিহ্নিত করতে করতে এগোচ্ছিলেন। তাঁদের পেছনে এগোচ্ছিল বাকি বাহিনী।

পাকিস্তানি সেনারা এই পদ্ধতিটাও অনুমানের মধ্যেই রেখেছিল। পরিকল্পনা সাজানো ছিল আগে থেকেই। রাণে সাহেবদের টিম এগোতেই মাটিতে প্রবল বিস্ফোরণ ঘটল। মাইন ব্লাস্ট! গোটা পলটন কেঁপে উঠল।

এগোনো তখন প্রায় অসাধ্য একটা ব্যাপার। বোঝাই যাচ্ছিল যে, জঙ্গলের মাটিতে আনাচে কানাচে বিছিয়ে রাখা হয়েছে প্রাণঘাতী মাইন। সৈন্যরা নিজেদের প্রত্যেক পদক্ষেপকেই সন্দেহ করছিল। এই বুঝি প্রাণ যায়, এই বুঝি কিছু হয়! আর চতুর্দিক থেকে তখন পাকিস্তানি মর্টার হানার ভয়। সেই সময়ে মর্টারে লোহার টুকরো ভরা হতো। অ্যাসল্ট ইন্টেনসিটি বেড়ে যেত।

রানে সাহেবের মাথায় তখন একটাই কথা ঘুরছিল – একটি বার যা হোক করে যদি আমরা রাজৌরি অবধি পৌঁছে যেতে পারি, তাহলে আমাদের চলা পথ ধরে বাকি ট্রুপ রাজৌরি পৌঁছে যেতে পারবে। 

এরই মধ্যে একটা মর্টার ফায়ার করল পাক বাহিনী। আহত হলেন ভারতীয় সেনার বেশ কয়েকজন জওয়ান। তাঁদের হাঁটুতে লোহার টুকরো ঢুকে গেল। একদিকে বন্ধ পথ, জঙ্গলের মাটিতে পোঁতা মাইন, মর্টার হামলা, আহত জওয়ান – সব মিলিয়ে সে এক ভয়ংকর দশা! হেডকোয়ার্টার থেকে বলা হল, ‘ফিরে এসো!’

কিন্তু রাণেও কোঙ্কণী মরাঠা। জাতিতে ক্ষত্রিয়। বাড়িয়ে দেওয়া পা ফিরিয়ে নিতে জানতেন না। উনি এমন একটা পথ, এমন একটা উপায় বের করলেন, যা পাকিস্তানি সৈন্যরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি।

নিজের বাহিনীকে তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দিলেন –

 সব ট্যাঙ্ক অ্যারো ফর্মেশনে চলবে। মানে, সরলরেখায়।

 সবথেকে সামনে যে ট্যাঙ্কটি থাকবে, তার ড্রাইভিং বক্সে একটা দড়ি বেঁধে ঝোলানো থাকবে সামনের দিকে।

 ওই প্রথম ট্যাঙ্কটির নীচে, দুদিকে চাকার মাঝে রাণে নিজে বুকে হেঁটে এগোতে থাকবেন।

 যেখানেই মাটিতে মাইন পোঁতা দেখবেন, সেখানেই রাণে ওই ঝুলন্ত দড়ি ধরে ডানদিকে টান মারবেন। ট্যাঙ্ক তখন থেমে যাবে। মাটি-কাদার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মাইনের বোতাম অফ করে সেটাকে নিষ্ক্রিয় করে দেবেন রাণে।

 এই মাইন ডি-অ্যাক্টিভেশন সম্পূর্ণ হলে তিনি দড়ি ধরে বাঁদিকে টান মারলে আবার ট্যাঙ্ক চলতে শুরু করবে।

রাণে যেহেতু জীবিত অবস্থায় পরম বীর চক্র পেয়েছিলেন, তা থেকে বোঝাই যাচ্ছে তিনি সফল হন। কিন্তু রাণে নিজের স্কিলের থেকেও বেশি নিজের মনের জোরের অপর আস্থা রেখেছিলেন। তিনি নিজে লিখে গেছেন যে, যখন কাদামটির মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে উনি অন্ধের মতো মাইন ডীফিউজ করেছেন, তখন প্রতিবার তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে আসতো।

৮ই এপ্রিল সকাল ছ’টায় শুরু হওয়া অপারেশন, ১২ই এপ্রিল সন্ধ্যে ছ’টায় গিয়ে শেষ হল। বলা ভালো, সফল হল। এই গোটা অপারেশন চলাকালীন রাণে নাকি নিমকি খেয়েছিলেন। আর এভাবেই নিজের বত্রিশ সঙ্গী জওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে ইন্ডিয়ান আর্মির ট্যাঙ্ক দিয়ে একটা রেখা টেনে দিয়েছিলেন বাকি ভারত আর রাজৌরির মধ্যে।

তারপর একদিন ভারত এই যুদ্ধে জয় লাভ করল। ভারতীয় সেনার রণকৌশলের ফলে ও রসদ তথা অস্ত্রের অভাবে ভারতের সীমানা ছেড়ে পিছু হটে গেল পাক বাহিনী।

এই যুদ্ধ জয়ের নায়ক ছিলেন রাম রাঘোবা রাণে। বলা হয়, যদি রাণে না থাকতেন, তাহলে যুদ্ধটা হয়তো বছরের পর বছর চলতো। অসাধারণ রণকৌশল, পরাক্রম, শৌর্যবীর্যের জন্য তিনি পেলেন পরমবীর চক্র। রাষ্ট্রপতি বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ নিজের হাতে তাঁর কাঁধে ব্যাজ লাগিয়ে দিলেন।

তখন বয়েস কত ছিল বলুন তো?

তিরিশ বছর!

দ্য মোস্ট এলিজেবল ব্যাচেলর অব দ্য কান্ট্রি। 

তা এই কুমারের কপালে কোন কুমারীর নাম লেখা ছিল?

গুগল সার্চ করলে বন্ধুরা পেয়ে যাবেন রাম রাঘোবা রাণের স্ত্রী’র নাম – রাজেশ্বরী রাণে। কিন্তু এখানেও একটা গল্প আছে। ওই কন্যের নাম সেদিন রাজেশ্বরী ছিল না।

তাহলে কী নাম ছিল?

লীলা! আজ্ঞে হ্যাঁ, লীলা।

নাম তো নয় যেন শিল্প। বাস্তবেও শিল্পী মেয়ে। রাণে যখন লীলাকে প্রথমবার দেখেন, তখন লীলা নাকি গান করছিলেন। অভ্যর্থনা সঙ্গীত। এ ধরণের গান সাধারণত কোনও অনুষ্ঠানে অতিথিদের আগমনে গাওয়া হয়ে থাকে।

শিবাজী হাইস্কুল, সদাশিবনগর, করবার, কর্ণাটক। রাণে ছুটিতে নিজের বাড়ি গিয়েছিলেন। প্রধান অতিথি হিসেবে শিবাজী হাইস্কুলে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন রাণে।

সেখানে প্রথম চার চোখ এক হল। শাড়ি পরিহিতা লীলা রাণেকে দেখেই চলেছিলেন... দেখেই চলেছিলেন। তাঁর মুখে তখন স্বাগত-সঙ্গীত। 

আমরা রাণের কীর্তি দেখেছিলাম তাঁর তিরিশ বছর বয়েসে। এই সময়ে রাণে সাঁইত্রিশ।

আর লীলা?

তিনি ঊনিশ।

রাণে লীলাকে দেখামাত্রই তাঁর প্রেমে পড়ে গেলেন। কিন্তু ফৌজি মানুষ। ডেকোরাম মেইনটেইন করা তাঁর মজ্জাগত অভ্যেস। তিনি লীলাকে কিচ্ছুটি বললেন না। নিজের ছুটির মেয়াদ কিছুটা বাড়িয়ে নিয়ে একদিন সোজা চলে গেলেন লীলার বাড়ি।

বয়েসের এতটা ফারাক দেখে সামান্য ইতস্তত করলেও লীলার বাড়ির পক্ষে এমন ছেলেকে জামাই হিসেবে পাওয়া গর্বের বিষয় ছিল। ৩রা ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৫ চার হাত এক হয়ে গেল। মিশে গেল দুটি মন।

ফুলশয্যার রাতে নিজের প্রিয়তমাকে প্রথম কী বলেছিলেন বলুন তো –

‘রাজেশ্বরী নামটা কি তোমার পছন্দ?’

লীলা নামক মেয়েটি বলেছিল, ‘খুব সুন্দর নাম।’

‘তাহলে আজ থেকে তোমার নাম হল রাজেশ্বরী রাণে।’

‘এই নামটাই কেন বাছলে?’

রাণে বলেছিলেন – ‘একবার একটি রাজপরিবারের আমন্ত্রণে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানে রাজমাতার নাম ছিল রাজেশ্বরী দেবী। ওঁর ব্যক্তিত্ব দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। সেই দিন থেকে তোমাকে দেখার আগে অবধি আমি ঈশ্বরের কাছে একটাই প্রার্থনা করেছিলাম, আমি যেন ওই রাজমাতার মতো ব্যক্তিত্বের স্ত্রী পাই। আর আজ তুমিই আমার সহধর্মিণী, রাজেশ্বরী।’

এরপর নিবিড় মৌনতা ছাড়া আর কিছু ছিল না। আকাশে একটা ক্লান্ত চাঁদ উঁকি মারছিল। মাটির বুকে এক যোদ্ধা নিজের রণক্লান্তি ভুলে শুধু ভালোবাসতে চাইছিল। চাঁদকে মেঘ ঢেকে দিল, যোদ্ধার মুখ ঢেকে দিল রাজেশ্বরীর শাড়ির আঁচল।

তারাভরা রাত ক্রমশ যুবতী হচ্ছিল। আলোর দরকার ছিল না। রাণে নিজের হাতেই ঘরের রোশনাই নিভিয়ে দিয়েছিলেন।
5

ইতিহাসের কথা ইতিহাসের কাহিনি - অভীক মুখোপাধ্যায়

Posted in


পদ্মনাভ দিব্যদেশম

বিষ্ণুসহস্রনাম আসলে একটি ব্যঞ্জনা। তাঁর অনন্ত নামরাজির মধ্যে থেকে গুটি কয়েককে চয়ন করে নিয়ে তৈরি একটি সীমিত সূচী। সেখানে শ্রদ্ধানত হয়েছে মানুষের উদ্যোগ। 

কে করেছিলেন? 

পিতামহ ভীষ্ম। নিজের পৌত্র যুধিষ্ঠিরের জন্যে বেছে দিয়েছিলেন সহস্র নাম। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, বিষ্ণুর নাম মাত্র এক সহস্র। কখনোই নয়!

কিন্তু তবুও এই সূচীটাই বিষ্ণুভক্ত মানুষের মনের শান্তি। যাক গে বাবা, এই এক সহস্র নামটাও তো পেলাম। এই শ্রমসাধ্য নামতালিকাতে মোট পাঁচবার ‘নাভি প্রকরণ’-এর উল্লেখ রয়েছে:

উনিশতম শ্লোক,

চৌত্রিশতম শ্লোক (দু’বার),

একান্নতম শ্লোক এবং

আটান্নতম শ্লোক।

এগুলিতে মোট তিনবার পদ্মনাভ, একবার হিরণ্যনাভ (নাভি থেকে ব্রহ্মাকে প্রকটকারী) এবং একবার রত্ননাভ (যার নাভিই সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ রত্ন) বলা হয়েছে।

এই ভারতে বুদ্ধিপিশাচদের অভাব নেই। অনেক বুদ্ধিপিশাচ এই পদ্মনাভর উল্লেখকে মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত বলেন। হয়তো তাঁরা জানেন কিংবা জানেন না যে এই তিনটি ‘পদ্মনাভ’-নামের তিনটি পৃথক অর্থ রয়েছে।

উনিশতম শ্লোকে পদ্মনাভ মানে, যার নাভি থেকে কমল পুষ্প জন্মায়।

চৌত্রিশতম শ্লোকে পদ্মনাভ মানে, যার নাভি কমল পুষ্পের মতো।

আর তৃতীয়টায়? সেখানে কিন্তু পদ্মনাভ শব্দের অর্থ একটু গূঢ়। গম্ভীর। প্রভুর ভক্তবাৎসল্যের রূপ।

একান্নতম শ্লোকে পদ্মনাভ মানে, যিনি নিজের ভক্তদের পদ্মফুলের মতো হৃদয়ের কেন্দ্রে বা নাভিতে বিরাজ করেন। 

মহাত্মা ভীষ্ম নিজের যথাসাধ্য চেষ্টা দিয়ে এই নাভি প্রকরণের উল্লেখ করে গেছেন। কিন্তু তিনিও মানুষ। সাধ্যের অতীত কাজ করতে পারেন না। তাঁর প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণ বলে দক্ষিণভূমির অন্তিম তটীয় নগরীর বুকে বিরাজমান মহাবিষ্ণু প্রথমে উল্লেখিত পদ্মনাভর মূর্তরূপ, যার নাভি থেকে ফোটে পদ্মের ফুল। 

‘দিব্যদেশম’ তামিল ভাষার প্রাচ্য ধার্মিক সাহিত্যের সবথেকে বড় মান্যতাগুলির মধ্যে একটি।

এই মান্যতার জন্ম হয়েছে দিব্যপ্রবন্ধম থেকে। একে তামিল ভাষায় সংগৃহীত বৈষ্ণব-বেদ বলা হলেও তা অত্যুক্তি হবে না। এতে মোট বারো হাজার বৈষ্ণব সন্তদের দ্বারা বিরচিত চার হাজার পদ্য স্থান পেয়েছে। তা শ্লোক হতে পারে, মন্ত্র হতে পারে, দোহা চৌপাই সোরঠা ইত্যাদি ছন্দ হতে পারে।

মোট চার হাজার পদ্য থাকায় একে নালায়ির দিব্যপ্রবন্ধম বলা হয়। তামিলে নালায়ির মানে চার হাজার।

এই দিব্যপ্রবন্ধমে যত বিষ্ণুমন্দিরের উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলিকেই বলা হয় দিব্যদেশম। 

এমন মন্দিরের সংখ্যা কত?

একশো আট।

এই একশো আটটি মন্দিরের মধ্যে একশো ছয়টি পৃথিবী পৃষ্ঠে বিরাজমান। বাকি দুটির অবস্থান ব্রহ্মাণ্ডের অন্যত্র কোথাও। একশো ছ’টির মধ্যে আবার একশো পাঁচটি ভারতে এবং একটি নেপালে। নেপালে অধিষ্ঠিত মন্দিরটি হল মুক্তিনাথ শালিগ্রাম। 

উত্তর ভারতের বুকে রয়েছে আটটি দিব্যদেশম। উত্তরপ্রদেশে চারটি, উত্তরাখণ্ডে তিনটি, গুজরাতে একটি। এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা চলে যে, অযোধ্যাভূমিতে শ্রীরামজন্মভূমিকে তামিলের দিব্যপ্রবন্ধমে একটি দিব্যদেশমের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এই তথ্য পড়ে চমকে উঠতেই হয় যে কারা উত্তর আর দক্ষিণের মধ্যে ভেদাভেদের পশুটাকে জলপানি জোগায়?

সবথেকে বেশি সংখ্যক দিব্যদেশম আছে তামিলনাড়ুতে। মোট পঁচাশিটি। কেরলে এগারোটি। অন্ধ্রে দুটি। কেরলের একাদশ দিব্যদেশমের মধ্যেই একটি হল পদ্মনাভস্বামী। জনপদের নাম তিরুবনন্তপুরম।

অনন্তপদ্মনাভস্বামীর মন্দির দ্রাবিড় মন্দির স্থাপত্যশৈলীর আধারে নির্মিত হয়েছে। 

কত কিংবদন্তী! শোনা যায় যে, শেষনাগের ওপরে অধিষ্ঠিত মহাবিষ্ণুর এই পদ্মনাভ মূর্তির মূলস্থান আসলে কেরলেও কাসরগোড জনপদে স্থিত একমাত্র হ্রদ-মন্দির, যেখানে একটি নিরামিষাশী কুমীর ছিল মন্দিরটির প্রধান রক্ষক। সেখান থেকেই মার্তণ্ড বর্মা এই মূর্তিটিকে নিয়ে আসেন।

যেহেতু এই মন্দিরের নির্মাণে চের সাম্রাজ্যের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল, তাই অতি সঙ্গত ভাবেই স্থাপত্য কলায় চের প্রভাব লক্ষণীয়। যেমন উঁচু পাঁচিলের পিঠে অধিষ্ঠিত গোপূরম, নির্মাণে তিরুবত্তরের আদিকেশব মন্দিরের হুবহু প্রতিকৃতিকরণ।

ত্রাভাংকোর রাজবংশ আসলে চের রাজবংশের শাখা। চের-দের বলা হয় কেরল-পুত্র। এমনি এমনি বলা হয় না, এর পেছনে আছে দুহাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস। ত্রাভাংকোরের রাজবংশ নিয়ে লিখতে বসলে হয়তো একটা বইও কম পড়বে।

বর্তমান পরিদৃশ্যের ইতিয়াশ সতেরশো পঞ্চাশ সালের পৌষ –মাঘের সন্ধিক্ষণে চাপা পরে গেছে। যখন মহারাজ ত্রাভাংকোর মার্তণ্ড বর্মা নিজের রাজ্যকে পদ্মনাভ স্বামীর হাতে সঁপে দিয়ে নিজেকে এবং নিজের সকল উত্তরপুরুষকে ‘পদ্মনাভ দাস’ বলে ঘোষণা করেছিলেন।

আজও ত্রাভাংকোরের মহারাজ এই উপাধিই ধারণ করেন। এখনকার মহারাজের সম্পূর্ণ নাম: শ্রী পদ্মনাভ দাস শ্রীমূলং রামা বর্মা। তাঁর পুত্রও এই উপাধি নেবেন। পৌত্রও। প্রপৌত্রও।

পদ্মানাভস্বামী মন্দিরের পরিচালনার দায়িত্ব ফিরে পেয়ে ত্রাভাংকোর রাজবংশ যে সম্মান পেল, তা কেবল উচিৎ নয়, তা কেবল রাজনৈতিক নয়, তা কেবল অনায়াস নয়, তা হল মহাবিষ্ণুরপ্রতি সমর্পিতপ্রাণ কেরল-পুত্রদের মহান চের পরম্পরাকে ভারতভূমির নতশির অভিবাদন। 

3

ইতিহাসের কথা ইতিহাসের কাহিনি - অভীক মুখোপাধ্যায়

Posted in









ঠিক কতটা পুরোনো হলে তাকে ইতিহাসের কথা বলা চলে? এই এক সেকেন্ড আগে যা ঘটে গেছে, তা-ও কি ইতিহাস নয়?
চিন - ভারত সম্পর্কে জন্ম নেওয়া টানাপোড়েন নিয়ে ভাবতে বসলেও তো ইতিহাস এসে পড়ে। সম্প্রতি কুড়ি জন জওয়ানের নিহত হওয়ার কাহিনি টেনে নিয়ে যায় অব্যর্থ অতীতের সরণীতে।
সাহিত্যের চর্চা করলে সু্যোগসন্ধানী হওয়া বেমানান৷ কিছু ঘটবে আর তা নিয়ে লিখব এটা ঠিক লাগে না। কিন্তু চর্চা এমন হলে ক্ষতি কোথায়, যেখানে আলোড়ন হবে ইতিহাসের অলিতে গলিতে।
সাইনো - ইন্ডিয়া টেনশনকে কেন্দ্র করে ইন্টারনেটে প্রতি মূহুর্তে জন্ম নিচ্ছে অখণ্ড সব ফেক নিউজ। এজেন্ডা চালাচ্ছে দলগুলো। এই সময়ে অকাট্য তথ্যই দেশের জিজ্ঞাসু চেতনার উত্তর হতে পারবে।
তথ্যনিষ্ঠতার ভিত্তিটাই আসল। কলমধারীও যেন বিচারক না হয়ে ওঠে এটাও বিষয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে একটা লাইন বলা হয় যে, এই যুদ্ধ আসলে যুদ্ধকে বন্ধ করার জন্য লড়া হয়েছিল: A war to end the war.
এই উক্তির পেছনে কিছু পাশ্চাত্য যুক্তি আছে। বলা হয়, ১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শেষই হয়নি। শুধু কাগজে কলমে একটা সমঝোতা হয়েছিল। পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটেনি। বন্দুকের ব্যারেল নত হয়েছিল, কিন্তু কোথাও ওড়েনি শান্তির পতাকা। ট্রুপগুলো নিজ নিজ দেশমুখী হলেও মন পড়েছিল দখলের জমিতেই।
প্রত্যেক সৈনিক, প্রত্যেক নাগরিক এবং প্রত্যেক যুদ্ধকারী দেশের সরকার মনে মনে যুদ্ধ লড়ছিল। গোরুর গাড়ি ভরে নোট নিয়ে গিয়ে মাত্র এক প্যাকেট পাউরুটি কিনে আনা মানবতার সামনে সত্যিই কি যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? ক্ষুধা কি অস্ত্র তুলে নেয়নি তখন? জার্মান - পোলিশ ইহুদিদের অবস্থা দেখলেই সত্যিটা মেলে।
দুই বিশ্বযুদ্ধ এবং তাদের সন্ধি সংক্রমণ নিয়ে লিখতে বসলে গোটা একটা বইও কম পড়ে যাবে। কিন্তু এই কথাগুলো না-বললে ভারত - চিন টেনশনটাকে ধরা যাবে না। আসলে ভারত আর চিনের এই রোজদিনের ঝামেলা বন্ধ হওয়ার জন্য একটা বড় যুদ্ধ দরকার। না বন্ধুরা, আমার শুভবুদ্ধির অভাব রয়েছে বলে ব্যক্তি-আক্রমণ করবেন না, আমি শুধু ইতিহাস থেকে দাওয়াই বলে দিলাম। বাকিটা সময় বলবে।
একটা সত্যি কথাকে আপনারা স্বীকৃতি দেবেন নাকি তিরস্কার করবেন, তা জানা নেই, তবুও বলি -- ১৯৬২ সালে শুরু হওয়া ভারত-চিন যুদ্ধ কিন্তু আজ পর্যন্ত চলছে। শেষ হয়নি।
মনে রাখার বিষয় হল এই দুই দেশের মধ্যে মতান্তর কিন্তু স্বাধীন ভারতে শুরু হয়নি, বরং চিনের থেকে দূরত্ব বজায় রাখার সিদ্ধান্ত ভারতের ব্রিটিশ সরকারের ছিল। ব্রিটিশরা ভাবত, রাশিয়া আরব সাগর অবধি সাম্রাজ্য বাড়াতে চাইছে। সেই কারণেই তড়িঘড়ি করে একটা হাফ হার্টেড চিন্তাভাবনা নিয়ে ভারতের উত্তরে চিনের দিকের সীমানাটা টেনে ফেলা হয়। অজস্র ভুলচুক ছিল।
আর এই কারণেই আজও কখনও চিন, কখনও নেপালের সাথে ভূমি সংক্রান্ত বিবাদে জড়িয়ে পড়ে ভারত।
স্বাধীন ভারতের অন্তরিম সরকার বাহাদুর এই সীমারেখা স্পষ্ট করে তোলার কোনো চেষ্টা না-করায় যতবার বিবাদ ওঠে, ততবার দায় গিয়ে পড়ে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের বিদেশ নীতির ওপর।
নেহরুজি হিন্দি - চিনি ভাই ভাই ডাক দিলেও ডাল গলেনি। সীমারেখা যে এসবে শোধরায় না। তার ওপরে ১৯৫৯ সালে তিব্বতি ধর্মগুরু দলাই লামাকে আশ্রয় দেওয়ার ফল হয়েছিল মারাত্মক।
কূটনীতিকেরা বলেন, দলাই লামাকে ভারতে শেল্টার দেওয়ার ব্যাপারটাই ভারত - চিন সংঘাতের আধারশিলা। তবে শুধুই কি তা-ই? নাকি কেঁচো খুঁড়তে কেউটের মতো ব্যাপার? দেখা যাক আরও কী কী কথা আসে।
অনুসন্ধান। একটা বড় শব্দ। কারো রহস্য যদি অনুসন্ধানে ভেদ হয়, তাহলে সে তো শংকিত হবেই। চিনের রহস্য উদঘাটনে ভারতের একটা বড় অবদান বহুকাল আগে থেকেই রয়েছে।
চিন আত্মরতিতে মগ্ন দেশ। নিজের দেশের অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে বুকফোলানো ভাব হোক বা নিজের রাষ্ট্রের রহস্য নিয়ে সজাগ ভাব, ভারত তার কাছে এক বড় বাধা। হিমালয়ের মতোই। আর এর প্রচণ্ড সূত্রপাত করেছিলেন পণ্ডিত নৈন সিংহ রাওয়াত।
তখন ইন্টারনেট ছিল না, কৃত্রিম স্যাটেলাইট ছিল না। ওই অন্ধদশায় ক্ষমতাবান রাষ্ট্র নিজের সীমানা মিথ্যা ভাবে এঁকে প্রতিবেশী দেশকে ভয়াক্রান্ত করত। এশিয়া মহাদেশে চিনের এই চজল, কপট এবং ভ্রমটাকে ভেঙে দিয়েছিলেন শ্রী নৈন।
যে যতই জেমস বন্ড দেখুন না কেন, আধুনিক ভারতের প্রথম গুপ্তচরের কথা পড়লে তা ছেড়ে উঠতে পারবেন না। ১৮৩০ সালে কুমায়ুনের জোহার উপত্যকায় গোরিগঙ্গা নদীর ধারের অধুনা পিথোরাগড়ে তাঁর জন্ম হয়।
নৈন, এমন এক গুপ্তচর, যিনি কোনো সেনাদলের বা সাম্রাজ্যের রহস্য চুরি করতেন না, বরং তাঁদের রহস্যে ঘেরা সীমানার প্রকৃত রূপ সবার সামনে মেলে ধরে তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রবৃত্তির কফিনে মেরে দিতেন শেষ পেরেক।
চিনের উদ্দেশে গুপ্ত যাত্রা করেছিলেন তিনি। এবং তাঁর এই যাত্রার ফলে দুটো সত্য সামনে আসে --
এক, তিব্বত আর চিনের স্পষ্ট সীমা কী। এবং
দুই, ভারতে যে নদীকে ব্রহ্মপুত্র বলে ডাকা হয়, তা তিব্বতের সাংপো মোটেই নয়, তার উদগম স্থল হল মানসসরোবর।
এই রহস্য সামনে আসামাত্র তিব্বতের মতো শান্ত এবং ধর্মপরায়ণ দেশের সুরক্ষা নিয়ে সারা বিশ্ব চিন্তায় পড়ে যায়। কারণ এতদিন চিন মিথ্যে ভৌগলিক দাবী করে নিজের মতো একটা মানচিত্র সাজিয়ে রেখেছিল এবং তার বিরুদ্ধে এবার প্রশ্ন উঠে গেল।
পণ্ডিত নৈন সিংহ রাওয়াতকে নিয়ে ডক্টর উমা ভট্ট এবং ডক্টর শেখর পাঠক লিখেছেন 'অন দ্য ব্যাঙ্ক অব এশিয়া'।
২০০৪ সালে ভারতীয় ডাকবিভাগের পক্ষ থেকে শ্রী নৈনের নামে একটি ডাকটিকিট প্রকাশিত করে তাঁকে সম্মানিত করা হয়। ২০০৩ সালের ২রা ফেব্রুরায়ি দ্য হন্দু পত্রিকায় শ্রী শ্যাম মেনন শ্রী রাওয়াতকে নিয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন: ওয়াকিং উইদ নৈন সিংহ।
১৮৭০ সালের পরে এই চমকপ্রদ তথ্য সামনে আনার জন্য শ্রী রাওয়াতকে 'এশিয়ান এক্সপ্লোরার' বলে সম্মানিত করা হয়েছিল। চিনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভারত তথা বিশ্ববাসীর চেতনার জনকের কাছে আমরা সকলেই ঋণী।
ব্রিটিশরা চিনের এই আগ্রাসন তখনই বুঝে ফেললেও কিছু কাঁচাপাকা সিদ্ধান্তে শাসন চালিয়ে গিয়েছিল। নিজেদের দেশ তো নয়, অত দরদ ছিল না।
স্বাধীন ভারতের অন্তরিম সরকার হয়তো কঠোর ধরণের কিছু ভাবলেও ভাবতে পারত। তাঁদের দূরদর্শীতার অভাব নাকি ভারত শান্তির দেশ এই মিথটা অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা খোদায় মালুম।
একটা টাইম মেশিন থাকলে নাহয় গিয়ে সিদ্ধান্ত পালটে দেওয়া যেত৷ কী বলেন?

8

ইতিহাসের কথা ইতিহাসের কাহিনি - অভীক মুখোপাধ্যায়

Posted in

কালিদাস, আপনাকে খুব মনে পড়ে



মাঝেমধ্যেই কালিদাসকে মনে পড়ে যায়।

কোন কালিদাস?

কোন কালিদাস আবার? কালিদাস বললে যে একজনকেই বোঝায়!

মহাকবি কালিদাস?

হ্যাঁ। মেঘদূত-এর রচয়িতা কালিদাস। অভিজ্ঞানশকুন্তলম্-এর প্রণেতা কালিদাস। রঘুবংশ-এর কাব্যকার কালিদাস।

উনিই তো চিদগগনচন্দ্রিকা-এর অভিলেখক ছিলেন, তাই না?

একদম সঠিক। পরম শৈব এবং মহাকালের স্থিরভক্তিযোগের প্রতিপাদক কালিদাস।

কালিদাস মহাবিখ্যাত। তাঁর কাব্যরসের স্বাদ নেওয়ার সাধ আম জনতার একটা বড় অংশের মনে থাকলেও সাধ্য নেই। তবুও তিনি আলোচনার বিষয়বস্তু। শিক্ষনীয় এক চরিত্র। হাইটেক জমানায় মা-বাবারা কালিদাসের কিংবদন্তী নিয়ে নিজেদের ছেলেপুলেদের কাছে গল্প বলেন কিনা জানা নেই, আমাদের বাপ-মায়েরা তো বলতেন।

লোকশ্রুতিতে একটা নির্ধারিত স্থান আছে কালিদাসের। বোকা কালিদাসের। বোকা থেকে ঘষটে ঘষটে বুদ্ধিমান হয়ে ওঠা কালিদাসের। এ-ই তো জীবন—সারল্য হারিয়ে চাতুর্যের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া মানেই সাফল্য।

কিন্তু আমার কালিদাসের কথা এত বেশি মনে পড়ে কেন? সে কথা বলতে গেলে কুমারদাসের গল্পটাও বলতে হয়। অনেকেই হয়তো জানেন। তবুও মনে যখন পড়ছে, তখন আরেকবার ঝালিয়ে নিই।

কে কুমারদাস?

বলা হয় যে সিংহল দ্বীপের, এখনকার শ্রীলঙ্কার, তৎকালীন (কালিদাসের সময়ের) শাসক ছিলেন কুমারদাস। তিনি নিজে একজন কুশল-কবি ছিলেন। এবং ছিলেন মহাকবি কালিদাসের পরম মিত্র।

কুশল-কবি? কবি আবার কুশল হয় নাকি?

এ কেমন শব্দ-ব্যবহার হল? কুশল শব্দটার দুরভিসন্ধি দেখে মাঝে মাঝে আমি নিজেও চমকে উঠি। লিখতে-লিখতে আঙুল সরে না, সত্যিই তো—কবি কখনও কুশল হয় কি? এমন কথা কখনও শুনেছেন?

কুশল শব্দের এক অর্থ, আর কবিতা লেখা অন্য এক বিষয়। একেবারে পৃথক।

বৈদিককালে একজন ছাত্র যখন গুরুকুলে অন্ত্যেবাসী থেকে পড়াশোনা করত, তখন কুশাসনে বসার প্রচলন ছিল। এবার চলে আসা যাক সেই কুশের আসন তৈরি কথায়। তা তৈরি করতে যে কষ্ট ভোগ করতে হতো তা বলে বোঝানো মুশকিল।

আগে জোগাড় করতে হতো কুশ। আর কুশ জড়ো করার সময় আঙুলের ডগাগুলো ভয়ানক ভাবে ক্ষতবিক্ষত হতো। কাঁটামুখগুলো খুঁজে খুঁজে ঠিক বের করে নিত ত্বকের নীচে থাকা রক্তজালিকাদের ঠিকানা। 

কিন্তু যে ছাত্র কুশ তোলার সময় আহত না-হয়ে কুশাসন বানিয়ে ফেলতে পারত, তাকে দেখে গুরুরা ধন্য ধন্য করতেন। বলতেন—‘তুই, খুব কুশল ছাত্র!’

দেখুন বন্ধু, কোথা থেকে কীভাবে উৎপন্ন হয়ে আজ একটি শব্দ কোথায় এসে পৌঁছে গেছে। আজ একজন কবিও কুশল, একজন বাচিক শিল্পীও কুশল, একজন লেখকও কুশল আবার একজন যোদ্ধাও কুশল। 

যাই হোক, আমরা বলছিলাম কুশল-কবি কুমারদাসের কথা।

তিনি সিংহল দ্বীপের নিবাসী ছিলেন। লিখে ফেলেছিলেন ‘জানকীহরণ’-এর মতো যশস্বী একটি মহাকাব্য।

তাঁর এক প্রেমিকা ছিল। সে ছিল গণিকা। তার নাম কামিনী। প্রণয় পর্ব চলছিল দুজনের। কামিনী জিজ্ঞেস করল—‘কুমার, আপনি আমাকে বিয়ে কবে করছেন?’

এই প্রশ্নের উত্তর কুমার মুখে দিলেন না। খসখস করে লিখে দিলেন একটি সংস্কৃত শ্লোকের প্রথম দুটি পঙক্তি—‘নাও। এই শ্লোকটাকে যেদিন পূর্ণ লিখে আনতে পারবে, আমি সেদিনই তোমাকে বিয়ে করে নেব।’

কথা শেষ করে কুমারদাস আর সেখানে অপেক্ষা না-করে নিজের মহলে ফিরে এলেন। কামিনী তখন সেই কাগজখানা হাতে নিয়ে চিন্তায় মগ্ন। কামিনীর মা রাজাম্মা মেয়ের এমন বিভোর দশা দেখে জানতে চাইলেন—‘কী হয়েছে, কামিনী? মন এমন উচাটন কেন?’

কামিনী সব কথা মা’কে জানাল। উপায় বলতে বলল।

রাজাম্মা বললে—‘কুমারদাসের লেখা এই শ্লোকটাকে পূর্ণ করার ক্ষমতা একজনেরই রয়েছে। তিনি হলেন কালিদাস।’


কামিনীর এবার কালিদাসের শরণাগত হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না। সে সঙ্গে সঙ্গে কালিদাসকে পত্র লিখল—

হে মহাকবি,

আপনিই তো যক্ষ – যক্ষিণীর বিরহ বেদনার কথা কুবেরের সামনে রেখেছিলেন। আপনিই প্রেমের দূত রূপী মেঘকে পাঠিয়েছিলেন। আপনিই আপনার কাব্যে অজ-ইন্দুমতী, দুষ্মন্ত-শকুন্তলা, অগ্নিমিত্র-মালবিকা আর হর-পার্বতীর মিলন ঘটিয়েছেন। দয়া করে পত্রে লেখা শ্লোকটিকে পূর্ণ করে কামিনী-কুমারদাসের মিলন ঘটিয়ে দিন। এর জন্য আমি আপনাকে সিংহল দ্বীপে আমন্ত্রণ করছি।

আপনার অপেক্ষায় রইলাম। 

ইতি— কামিনী। 


কামিনীর পত্র পাঠ করা মাত্রই কালিদাসের মনে পড়ে গেল যে তাঁর বন্ধু কুমারদাসও আগেই বহুবার তাঁকে সিংহল দ্বীপে যাওয়ার জন্য সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কালিদাস এবারে রওনা দিলেন। 

কালিদাস সিংহল দ্বীপে পা-রাখলেন বটে, কিন্তু কুমারদাসকে তা জানালেন না। এখন কুমারদাসকে চমক দেওয়া নাকি কামিনীকে সাহায্য করাই তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল একথা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।

প্রথমেই গেলেন কামিনীর বাসগৃহে। কিছুক্ষণে মধ্যেই শ্লোক সম্পূর্ণ করে দিলেন। তারপর কুমারদাসের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা বললেন। 

কুমারদাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা তুলতেই রাজাম্মার মনে শঙ্কা দেখা দিল। যদি কালিদাস গিয়ে কুমারদাসকে বলেন যে এই শ্লোক তিনিই সম্পূর্ণ করেছেন, তাহলে বিয়ে তো দূরে থাক এবার হয়তো কুমারদাস তাঁদের মহাদণ্ডে দণ্ডিত করবেন।

তাহলে উপায়?

কুটিল রাজাম্মা উপায়ও বের করলেন। কালিদাসের মুখ চিরতরের জন্য বন্ধ করে দিতে হবে। তাঁর মরণ চাই।

আপ্যায়ণের সময় কালিদাসের পেয় তক্রে মিশিয়ে দেওয়া হল কালকূট বিষ। বিষের তেজে কালিদাসের মৃত্যু ঘটল।

তবে রাজাম্মা এসব চক্রান্ত করলেও কামিনী কিন্তু তা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি। তাই যখন সে সবকিছু জানল, তখন গ্লানিতে আর থাকতে না-পেরে সে-ও ওই একই পানীয়ের বাকিটুকু পান করে মৃত্যুকে বরণ করে নিল। 

খবর এসে পৌঁছল কুমারদাসের কানেও। সিংহল দ্বীপের শাসক কুমারদাস অবসাদে আত্মদাহ করে বসলেন।


এই জন্যই কালিদাসকে বড় মনে পড়ে। আমার মন নিজেকেই প্রশ্ন করে:কালিদাসের মৃত্যুর জন্য তাহলে কে দায়ী ছিল?

এক, কালিদাস নিজেই দোষী ছিলেন। তিনি নিজের বন্ধুকে না-জানিয়ে সিংহল দ্বীপে গিয়ে নিজের সঙ্গেই একটা গুরুতর অপরাধ করেছিলেন। তাঁকে প্রথম আতিথেয়তা করার অধিকার এক এবং একমাত্র কুমারদাসেরই ছিল।

দুই, রাজাম্মার মতো অপরাধীর কথা অস্বীকার করার জায়গাই নেই। সে একজন হত্যাকারী ছিল।

তিন, এবং সম্ভবত সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল কালিদাসকে নাকি তাঁর স্ত্রী বিদ্যোত্তমা অভিশাপ দিয়েছিলেন। 

কোন অভিশাপ?

কালিদাস নিজের মহাকাব্য ‘কুমারসম্ভব’-এ শিব আর পার্বতীর সাংসারিক ভোগ বিলাসের কথা লেখায় বিদ্যোত্তমা বলেছিলেন—‘আপনি যখনই কোনো নারী-পুরুষের প্রেমের জন্য নিজের লেখনী এবং মেধার ব্যবহার করবেন, তখন তা আপনার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’

এই অভিশাপের নিদান বের করার জন্যই নাকি তিনি ‘রঘুবংশ’ রচনা করেন, কিন্তু পতিব্রতা নারীর অভিশাপকে নষ্ট করতে পারেননি। যদি সেদিন শাপ নষ্ট হয়ে যেত, তাহলে কামিনীর পত্র পেয়ে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠতেন না। 

মন আর মস্তিষ্কের মধ্যে কালিদাস সর্বদাই মনকে প্রাধান্য দিয়েছেন। অভিজ্ঞানশকুন্তলম্-এ তিনি লিখেছেন—‘সন্তা হি সন্দেহপদেষুবস্তুষু, প্রমাণমন্তঃকরণপ্রবৃত্তয়ঃ’। মানেটা দাঁড়ায়— জীবনে যখনই সন্দেহাস্পদ অবস্থা সৃষ্টি হবে, তখন মনের কথা শোনাই ভালো। 

আর এভাবেই, হ্যাঁ এভাবেই হৃদয়ের কথা শুনে তিনি কামিনী-কুমারদাসের মিলনের জন্য চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর প্রবেশদ্বারও পেয়ে গেলেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। 

রাজাম্মাকে হত্যাকারী হিসেবে কারাগারে বন্দি করা হয়েছিল। সে হয়তো বলেছিল—‘আমরা কালিদাসের কথা বলি, বলবও। কোথাও কুমারদাসের কথা এলে কিংবা কালিদাসের মৃত্যুপ্রসঙ্গ উঠলে কুমারদাসের কথাও হয়তো বলব। কিন্তু কালিদাসের মৃত্যু নিয়ে কি বিদ্যোত্তমা বা কামিনীর কথা উঠবে?’

সত্যিই তো, কিছু প্রশ্ন অনুত্তরিত থাকলেই ভালো হয়, যেমন সাপের ফণাকে যতক্ষণ অবধি স্পর্শ না-করছেন, ততক্ষণ অবধি তাকে দেখতে সুন্দর লাগে। তাই না?
4

ইতিহাসের কথা ইতিহাসের কাহিনি - অভীক মুখোপাধ্যায়

Posted in

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং রাসায়নিক বিভীষিকা


তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। আজ্ঞে হ্যাঁ, কেউ মানুন বা না-মানুন এই করোনা আবহ আসলে তৃতীয় মহাযুদ্ধ। যুদ্ধ বাঁধলে এমনিতে নিহত হন সৈন্যরা। কেবলই ক্ষয় হয় সামরিক শক্তি। এবং পাশাপাশি তা দেশ তথা বিশ্বের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে থাকে। কিন্তু এই হারে অসামরিক মানুষের মৃত্যু যুদ্ধের ফলাফলেও থাকে না। তাই বিগত দুটো বিশ্বযুদ্ধে যে ক্ষয়ক্ষতি পৃথিবীবাসী দেখেছিলেন, তার বহু বহু গুণ বেশি ক্ষতি দেখতে চলেছি আমরা। 

চিনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসকে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাহেব ‘চাইনিজ ভাইরাস’ বললেন, তখন প্রাথমিকভাবে প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত সাংবাদিক এবং পরে চিনের পক্ষ থেকে ফোঁস করে উঠল আধিকারিকেরা। কেন বলা হবে এটাকে চিনা ভাইরাস? এরই মাঝে শোনা গেল আরেকটা খবর –পেন্টাগন নাকি এই ভাইরাসের উৎস এবং প্রসার নিয়ে নিজেদের ইনভেস্টিগেশন চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু একটা সূত্র পাওয়ার অপেক্ষা। যদি কোনোভাবে প্রমাণিত হয় যে, বি এস লেভেল ফোর প্রাপ্ত উহান ইনস্টিটিউট অব ভিরোলজি থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়েছে, তাহলে আমরা, বিশ্ববাসীরা, চতুর্থ মহাযুদ্ধ দেখতে পাব?

চিন ভাইরাস ছড়িয়েছে কি ছড়ায়নি সেই কথা সময়ই বলবে, তবে এমন ঘটনা কি আগে হয়েছে? উন্নত প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান আজকের মানুষের হাতে বায়ো ওয়ারফেয়ারের সমস্ত পরিকাঠামো সহজলভ্য করে দিয়েছে, কিন্তু অতীতের কোনো বিশ্বযুদ্ধে কি এমন কিছুর সাক্ষী থেকেছে পৃথিবীবাসী? 

এক কথায় উত্তরটা হল –হ্যাঁ, সাক্ষী থেকেছে। একটু অন্যভাবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রাসায়নিক বিভীষিকার সাক্ষী থেকেছে এই পৃথিবী।

উনিশ শতকের শেষ ভাগ। শিল্প-উদ্যোগ ক্রমশঃ বাড়ছিল। মানুষের হাতে অস্ত্রের নতুন একটা শৃঙ্খলা এসে পড়ল। মানুষ বুঝে গেল যে, একটা বুলেট ফায়ার করে বা গোলা দেগে যত না মানুষ মারা সম্ভব, তার থেকে বিষাক্ত গ্যাসের ব্যবহারে অনেক বেশি মানুষ মারা সম্ভব। বিষাক্ত গ্যাসের প্রয়োগ করতে পারলে বিশাল সৈন্যবাহিনীকেও কয়েক মিনিটেই পদানত করে দেওয়া সম্ভব। 

তবে অশুভ বুদ্ধির মানুষ যেমন ছিলেন, শুভবুদ্ধিসম্পন্নদের অভাবও কিন্তু ছিল না। এই বিষাক্ত গ্যাসের ভয়াবহ ব্যবহারের কথা মাথায় রেখেই প্রথম হেগ সন্ধি হল। ১৮৯৯ সাল। ইউরোপের সমস্ত দেশ মিলে সিদ্ধান্ত নিল যে, ওইদিন থেকে যে কোনো প্রকারের বিষাক্ত শ্বাসরোধকারী গ্যাসের সামরিক প্রয়োগ করা হবে না।

কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী আছে, যে কোনও নিয়ম তৈরিই করা হয় শুধুমাত্র তা ভাঙার জন্য। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না।

রাসায়নিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্য গ্যাসের মধ্যে ছিল ক্লোরিন, ফসজিন, ডাইফসজিন, মাস্টার্ড এবং জাইলাইল ব্রোমাইড। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্যবহারের জন্য মোট কী পরিমাণ রাসায়নিক দ্রব্যের উৎপাদন করা হল, দেখুন?

এক লক্ষ নব্বই হাজার টন! 

এবং এই উৎপাদনের মধ্যে এক লক্ষ টনের জনক ছিল জার্মানি। 

আর উল্লেখিত এই সমস্ত গ্যাসের মধ্যে সবথেকে বেশি উল্লেখযোগ্য ছিল ফসজিন। ফসজিনের উৎপাদন মাত্রার দিকে তাকানো যাক –সাঁইত্রিশ হাজার টন।

রাসায়নিক হামলায় মৃত সৈনিকদের মধ্যে অষ্টআশি হাজার পাঁচশো জনের মৃত্যু এই ফসজিনের জন্য হয়েছিল। গ্যাস হামলায় মৃত সিভিলিয়ানদের আশি শতাংশ ছিলেন ফসজিনের রাসায়নিক বিষক্রিয়ার শিকার। কেমিক্যাল উইপনের ব্যবহারের ফলে সবথেকে বেশি সৈন্য মরেছিল রাশিয়ার। সংখ্যাটা প্রায় ছাপ্পান্ন হাজার। এখানেও সিংহভাগ দায় ফসজিনেরই।

ভেরা ব্রিট্টেইন নামে একজন মহিলা-লেখক নিজের বই ‘আ টেস্টামেন্ট অব ইয়ুথ’ বইতে মাস্টার্ড গ্যাস নিয়ে লিখে গেছেন। সেখানে লেখা হয়েছেঃ ‘মাস্টার্ড গ্যাসে আক্রান্ত মানুষদের দেখলে গা শিউরে উঠবে। কী বীভৎস! দেখলে মনে হবে গোটা গা পুড়ে গেছে, সারা দেহে ফোসকা। অন্ধ!’

এই ভেরা ব্রিট্টেইন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ফ্রান্সের কৈঞ্চ্ নদীর তীরে এটপ্লেস নামক স্থানে নার্সের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। 

যুদ্ধের সময়ে মোট চুরানব্বই হাজার টন ক্লোরিন উৎপাদিত হয়েছিল। ক্লোরিন ব্যবহার করে শত্রুনিধনে কিছু সমস্যা ছিল। 

কারণ, ক্লোরিন গ্যাসকে কন্টেইনারে ভরে সেই কন্টেইনার থেকে শত্রু-সেনাদের ওপরে ঢেলে দেওয়া হতো। এমতাবস্থায় যদি হাওয়া বিপরীতে বইতে আরম্ভ করে দিত, তখন নিজের বাহিনীকে রক্ষা করাই অসম্ভব হয়ে পড়ত। বস্তুত, ‘হাওয়া বিপরীতে বইছে’ এই বাক্যটিও এই জরুরি অবস্থার ভিত্তিতেই সৃষ্টি হয়েছিল। 

যেমন জার্মানি যখনই এর ব্যবহার করেছে, তখনই হাওয়া বিপরীতে থাকায় খুব অল্পমাত্রাতেই করতে বাধ্য হয়েছে। এবং এর পাশাপাশি ক্লোরিনকে আটকানোর জন্য মাস্ক এসে পড়ায় জার্মানি বিশেষ সুবিধেও করতে পারেনি। 

গ্যাসীয় হামলার জন্য জার্মানি শেল ব্যবহার করা শুরু করল। ধাতুর আধারে গ্যাস ভরে শত্রুদের লক্ষ্য করে শেল দাগা হতো। আছড়ে পড়ার পরে তা ফেটে ভেতরে থাকা রাসায়নিক বায়ুর সঙ্গে মিশে বিক্রিয়া করে নিজের খেলা দেখাতে শুরু করে দিত। 

নানা ধরণের রাসায়নিক আক্রমণের জন্য নানা রঙের শেল ব্যবহার করা হতো। ক্লোরিনের জন্য সবুজ, মাস্টার্ড গ্যাসের জন্য হলুদ, নীল রঙ ছিল ডাইফিনাইলক্লোরাসোইন –এর জন্য। অবশ্য এই ডাইফিনাইলক্লোরাসোইন পড়ায় প্রতিটা শেলের মধ্যে থাকত। এর প্রভাবে শত্রু সৈন্য এবং তাদের ঘোড়া বমি করতে শুরু করে দিত। 



যা আগেই লেখা হয়েছে – নিয়ম তৈরিই করা হয় ভাঙার জন্য। প্রকৃতির এই শাশ্বত নিয়ম প্রথম হেগ সন্ধির ক্ষেত্রেও অকাট্য প্রমাণিত হল। 

১৯১৪ সালে ফ্রান্সে দাঙ্গার সময় পুলিশ টিয়ার গ্যাসের ব্যবহার করে একটা বার্তা দিয়ে ফেলল যে, হেগ সন্ধি দ্বারা টিয়ার গ্যাসকে কোনো ভাবেই আটকানো হয়নি। এবং বিশ্বযুদ্ধের গোড়ার দিকে ফ্রান্স টিয়ার গ্যাসের ব্যবহার করতে লাগল। আর পরে জার্মানি এই সুযোগটাই নিল চরম ভাবে।

১৯১৪ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবর মাস অবধি চলা জার্মানি – ফ্রান্স সংঘর্ষে দুপক্ষই মারাত্মক ভাবে টিয়ার গ্যাসের ব্যবহার করল। হেগ সন্ধিতে ফাটল ধরছিল।

অক্টোবর, ১৯১৪ সাল। জার্মান সৈন্যরা তখন মার্ন নদীর তীরে ফ্রান্স আর ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ লড়ছে। জার্মানরা তখন ওয়াররুমে রাসায়নিক আক্রমণের ছক কষা শুরু করে দিয়েছিল। এবং জার্মানি একটা রাসায়নিক আক্রমণ শুধু এটা বোঝার জন্যেই করল যে, এ ধরণের আক্রমণে কতখানি কাজ হবে।

এই যোজনার মাথা ফ্রিটস হার্বারকে ওই বছরের ডিসেম্বর মাসেই সেনাদলের রাসায়নিক বিভাগের দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হল। হার্বারের একটাই কথা ছিল—জারমানির ওয়ার্ল্ড ক্লাস ইন্ডাস্ট্রির মুখোমুখি হওয়ার মতো কেউ নেই। কোনো নীতির ধার ধারার দরকার নেই। জয়ই শেষ কথা। 

জানুয়ারি, ১৯১৫ সাল। রাশিয়া আর জার্মানির মধ্যে তখন বলিমভের (পোল্যান্ড) যুদ্ধ চলছে। জার্মানি নিজের আগের করা পরীক্ষার কথা মাথায় রেখে একসঙ্গে আঠেরো হাজার গ্যাস –শেল দেগে বসল। হাজার হাজার রুশ সৈন্য নিহত হল। যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে ভয়েই পালাল রাশিয়ান বাহিনী।

তবে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলা হল। কারণ প্রতিপক্ষ রাশিয়া একটা ব্যাপার ধরে ফেলেছিল –অত্যধিক ঠাণ্ডায় জাইলাইল ব্রোমাইড জমে যাচ্ছিল। শেল ফাটছিল ঠিকই, কিন্তু ভেতরে থাকা রাসায়নিক জমাট বেঁধে থাকায় তা বায়ুতে মিশে বিক্রিয়া করতে পারছিল না। 

১৯১৫ সালের এপ্রিল মাস। য়েপ্রেসের দ্বিতীয় যুদ্ধে জার্মানি আবার রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার করল। এবারে প্রতিপক্ষ ছিল ফ্রান্স এবং ব্রিটেন। মে মাসে জার্মানি রাশিয়ার ওপরে রাসায়নিক আক্রমণ করল। একটা দেশ একতরফা ভাবে রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার করেই চলেছিল। কী অদ্ভুত! রক্তপাত না-ঘটিয়ে পড়ায় ছাপ্পান্ন হাজার রাশিয়ান সৈন্যর প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল জার্মানির এই ঘাতক হাতিয়ার। 

জার্মানির ভয়াবহ হামলার মুখে পড়েছিলেন ব্রিটেনের ডরসেট রেজিমেন্টের সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আর্নেস্ট শেফার্ড। তিনি নিজের ডায়রিতে লিখে গেছেন, ‘চারিদিকে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। সবাই কাশছিল। কাশির দমকে বমি করছিল সবাই। চোখের সামনে সকলকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছিলাম।’ 

ব্রিটেন এভাবেই দুবার বিষাক্ত গ্যাসের আক্রমণের মুখে পড়ে প্রথম হেগ সন্ধির প্রতি সমস্ত আস্থা হারিয়ে ফেলল। ১৯১৫ সালে লুন্সের যুদ্ধে ব্রিতেন প্রথমবারের জন্য রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগ করল। ক্লোরিন গ্যাসের ব্যবহার করেছিল ব্রিটেনের বাহিনী। 

জার্মানি বারবার রাসায়নিক আক্রমণ করলেও কখনওই এধরণের হামলার কথা স্বীকার করেনি। জার্মানরা মাত্র একটি বার রাসায়নিক আক্রমণের কথা স্বীকার করে। তাদের মতে ১৯১৫ সালের অক্টোবর মাসে শ্যাম্পেন নামক শহরে ফরাসি সেনার সঙ্গে যুদ্ধে তারা রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগ করেছিল। ফসজিনের সঙ্গে ক্লোরিন মিশিয়ে ব্যবহার করা হয়েছিল। ওই একবারই নাকি! 

১৯১৫ সাল শেষ হওয়ার আগেই প্রথম হেগ সন্ধির মেয়াদ শেষ করে দিল ভয়াবহ রাসায়নিক আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণ। ১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের বরদন যুদ্ধে গুলির থেকে বেশি শেল দাগা হল। 

ব্রিটেন বুঝল বিপদ ক্রমশ বাড়ছে। ১৯১৬ সালের এপ্রিল মাসে তারা একটা যন্ত্র বানাল – রেসপিরেটর। একটা খুব ছোট বাক্সে সেটাকে রাখা হতো এবং বিষাক্ত গ্যাসের আক্রমণ হলে সৈন্যরা সেটা ব্যবহার করে নিজেদের প্রাণ রক্ষা করত। 

সব বিষেরই যেমন অধিবিষ থাকে, ঠিক সেভাবেই প্রতিটা গ্যাসের আক্রমণ ঠেকলে বাঁচার জন্য উপায় বের করা হতে লাগল। রাসায়নিক হামলা আস্তে আস্তে নির্বিষ হয়ে পড়ছিল। এরই মধ্যে ১৯১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে য়েপ্রেসের তৃতীয় যুদ্ধে জার্মানি মাস্টার্ড গ্যাসের ভয়াবহ ব্যবহার করে আবার বিপক্ষকে চমকে দিল।

এবার প্রতিপক্ষ একটাই উপায় দেখল। জার্মানির গ্যাস গোডাউনটাকেই কবজা করতে হবে। মিত্রশক্তি ফ্রান্সের কেম্বরাইতে জার্মানির সংগ্রহ করে রাখা মাস্টার্ড গ্যাসের গোডাউনের দখল নিল। ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে জার্মানির ওপরেই এই গ্যাসের প্রয়োগ করল তারা। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিও কিন্তু রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগেই হয়েছিল। মিত্রশক্তি উত্তর ফ্রান্সে নিযুক্ত জার্মান সেনার হিন্ডেনবার্গ লাইনের বিরুদ্ধে মাস্টার্ড গ্যাসের ব্যবহার করে বসল। 

এটাই শেষ বারের জন্য ব্যাপক হারে রাসায়নিক আক্রমণ ছিল।

১৯১৮ সালের এপ্রিল মাসে আমেরিকা একটি নতুন রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি করা আরম্ভ করল। নামঃ লেভিসাইট। কিন্তু যতদিনে এই রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠল, ততদিনে শেষ হয়ে গেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।



যুদ্ধে কোন অস্ত্র কখন, কীভাবে কাজে লাগে তা বলা কঠিন। যেখানে তলোয়ার চলে না, সেখানে ছুঁচ দিয়ে কাজ হয়। ট্যাংক ব্যবহার করে মারা না-গেলে হয়তো নাইন এম এম ব্যারেটা দিয়ে কাজ সারা যায়। তাই আজকের দিনে দাঁড়িয়ে গোলাগুলি দূরে সরিয়ে রেখে কেউ যদি ন্যানোমিটারের মাপের জীবাণুর ব্যবহার করে তাতেও আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু নেই। শুধু একটাই কথা, যার ব্যবহারই করা হবে, তা হবে মানবতার বিরুদ্ধে।