ইতিহাসের কথা ইতিহাসের কাহিনি - অভীক মুখোপাধ্যায়
Posted in ইতিহাসের কথা ইতিহাসের কাহিনিঠিক কতটা পুরোনো হলে তাকে ইতিহাসের কথা বলা চলে? এই এক সেকেন্ড আগে যা ঘটে গেছে, তা-ও কি ইতিহাস নয়?
চিন - ভারত সম্পর্কে জন্ম নেওয়া টানাপোড়েন নিয়ে ভাবতে বসলেও তো ইতিহাস এসে পড়ে। সম্প্রতি কুড়ি জন জওয়ানের নিহত হওয়ার কাহিনি টেনে নিয়ে যায় অব্যর্থ অতীতের সরণীতে।
সাহিত্যের চর্চা করলে সু্যোগসন্ধানী হওয়া বেমানান৷ কিছু ঘটবে আর তা নিয়ে লিখব এটা ঠিক লাগে না। কিন্তু চর্চা এমন হলে ক্ষতি কোথায়, যেখানে আলোড়ন হবে ইতিহাসের অলিতে গলিতে।
সাইনো - ইন্ডিয়া টেনশনকে কেন্দ্র করে ইন্টারনেটে প্রতি মূহুর্তে জন্ম নিচ্ছে অখণ্ড সব ফেক নিউজ। এজেন্ডা চালাচ্ছে দলগুলো। এই সময়ে অকাট্য তথ্যই দেশের জিজ্ঞাসু চেতনার উত্তর হতে পারবে।
তথ্যনিষ্ঠতার ভিত্তিটাই আসল। কলমধারীও যেন বিচারক না হয়ে ওঠে এটাও বিষয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে একটা লাইন বলা হয় যে, এই যুদ্ধ আসলে যুদ্ধকে বন্ধ করার জন্য লড়া হয়েছিল: A war to end the war.
এই উক্তির পেছনে কিছু পাশ্চাত্য যুক্তি আছে। বলা হয়, ১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শেষই হয়নি। শুধু কাগজে কলমে একটা সমঝোতা হয়েছিল। পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটেনি। বন্দুকের ব্যারেল নত হয়েছিল, কিন্তু কোথাও ওড়েনি শান্তির পতাকা। ট্রুপগুলো নিজ নিজ দেশমুখী হলেও মন পড়েছিল দখলের জমিতেই।
প্রত্যেক সৈনিক, প্রত্যেক নাগরিক এবং প্রত্যেক যুদ্ধকারী দেশের সরকার মনে মনে যুদ্ধ লড়ছিল। গোরুর গাড়ি ভরে নোট নিয়ে গিয়ে মাত্র এক প্যাকেট পাউরুটি কিনে আনা মানবতার সামনে সত্যিই কি যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? ক্ষুধা কি অস্ত্র তুলে নেয়নি তখন? জার্মান - পোলিশ ইহুদিদের অবস্থা দেখলেই সত্যিটা মেলে।
দুই বিশ্বযুদ্ধ এবং তাদের সন্ধি সংক্রমণ নিয়ে লিখতে বসলে গোটা একটা বইও কম পড়ে যাবে। কিন্তু এই কথাগুলো না-বললে ভারত - চিন টেনশনটাকে ধরা যাবে না। আসলে ভারত আর চিনের এই রোজদিনের ঝামেলা বন্ধ হওয়ার জন্য একটা বড় যুদ্ধ দরকার। না বন্ধুরা, আমার শুভবুদ্ধির অভাব রয়েছে বলে ব্যক্তি-আক্রমণ করবেন না, আমি শুধু ইতিহাস থেকে দাওয়াই বলে দিলাম। বাকিটা সময় বলবে।
একটা সত্যি কথাকে আপনারা স্বীকৃতি দেবেন নাকি তিরস্কার করবেন, তা জানা নেই, তবুও বলি -- ১৯৬২ সালে শুরু হওয়া ভারত-চিন যুদ্ধ কিন্তু আজ পর্যন্ত চলছে। শেষ হয়নি।
মনে রাখার বিষয় হল এই দুই দেশের মধ্যে মতান্তর কিন্তু স্বাধীন ভারতে শুরু হয়নি, বরং চিনের থেকে দূরত্ব বজায় রাখার সিদ্ধান্ত ভারতের ব্রিটিশ সরকারের ছিল। ব্রিটিশরা ভাবত, রাশিয়া আরব সাগর অবধি সাম্রাজ্য বাড়াতে চাইছে। সেই কারণেই তড়িঘড়ি করে একটা হাফ হার্টেড চিন্তাভাবনা নিয়ে ভারতের উত্তরে চিনের দিকের সীমানাটা টেনে ফেলা হয়। অজস্র ভুলচুক ছিল।
আর এই কারণেই আজও কখনও চিন, কখনও নেপালের সাথে ভূমি সংক্রান্ত বিবাদে জড়িয়ে পড়ে ভারত।
স্বাধীন ভারতের অন্তরিম সরকার বাহাদুর এই সীমারেখা স্পষ্ট করে তোলার কোনো চেষ্টা না-করায় যতবার বিবাদ ওঠে, ততবার দায় গিয়ে পড়ে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের বিদেশ নীতির ওপর।
নেহরুজি হিন্দি - চিনি ভাই ভাই ডাক দিলেও ডাল গলেনি। সীমারেখা যে এসবে শোধরায় না। তার ওপরে ১৯৫৯ সালে তিব্বতি ধর্মগুরু দলাই লামাকে আশ্রয় দেওয়ার ফল হয়েছিল মারাত্মক।
কূটনীতিকেরা বলেন, দলাই লামাকে ভারতে শেল্টার দেওয়ার ব্যাপারটাই ভারত - চিন সংঘাতের আধারশিলা। তবে শুধুই কি তা-ই? নাকি কেঁচো খুঁড়তে কেউটের মতো ব্যাপার? দেখা যাক আরও কী কী কথা আসে।
অনুসন্ধান। একটা বড় শব্দ। কারো রহস্য যদি অনুসন্ধানে ভেদ হয়, তাহলে সে তো শংকিত হবেই। চিনের রহস্য উদঘাটনে ভারতের একটা বড় অবদান বহুকাল আগে থেকেই রয়েছে।
চিন আত্মরতিতে মগ্ন দেশ। নিজের দেশের অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে বুকফোলানো ভাব হোক বা নিজের রাষ্ট্রের রহস্য নিয়ে সজাগ ভাব, ভারত তার কাছে এক বড় বাধা। হিমালয়ের মতোই। আর এর প্রচণ্ড সূত্রপাত করেছিলেন পণ্ডিত নৈন সিংহ রাওয়াত।
তখন ইন্টারনেট ছিল না, কৃত্রিম স্যাটেলাইট ছিল না। ওই অন্ধদশায় ক্ষমতাবান রাষ্ট্র নিজের সীমানা মিথ্যা ভাবে এঁকে প্রতিবেশী দেশকে ভয়াক্রান্ত করত। এশিয়া মহাদেশে চিনের এই চজল, কপট এবং ভ্রমটাকে ভেঙে দিয়েছিলেন শ্রী নৈন।
যে যতই জেমস বন্ড দেখুন না কেন, আধুনিক ভারতের প্রথম গুপ্তচরের কথা পড়লে তা ছেড়ে উঠতে পারবেন না। ১৮৩০ সালে কুমায়ুনের জোহার উপত্যকায় গোরিগঙ্গা নদীর ধারের অধুনা পিথোরাগড়ে তাঁর জন্ম হয়।
নৈন, এমন এক গুপ্তচর, যিনি কোনো সেনাদলের বা সাম্রাজ্যের রহস্য চুরি করতেন না, বরং তাঁদের রহস্যে ঘেরা সীমানার প্রকৃত রূপ সবার সামনে মেলে ধরে তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রবৃত্তির কফিনে মেরে দিতেন শেষ পেরেক।
চিনের উদ্দেশে গুপ্ত যাত্রা করেছিলেন তিনি। এবং তাঁর এই যাত্রার ফলে দুটো সত্য সামনে আসে --
এক, তিব্বত আর চিনের স্পষ্ট সীমা কী। এবং
দুই, ভারতে যে নদীকে ব্রহ্মপুত্র বলে ডাকা হয়, তা তিব্বতের সাংপো মোটেই নয়, তার উদগম স্থল হল মানসসরোবর।
এই রহস্য সামনে আসামাত্র তিব্বতের মতো শান্ত এবং ধর্মপরায়ণ দেশের সুরক্ষা নিয়ে সারা বিশ্ব চিন্তায় পড়ে যায়। কারণ এতদিন চিন মিথ্যে ভৌগলিক দাবী করে নিজের মতো একটা মানচিত্র সাজিয়ে রেখেছিল এবং তার বিরুদ্ধে এবার প্রশ্ন উঠে গেল।
পণ্ডিত নৈন সিংহ রাওয়াতকে নিয়ে ডক্টর উমা ভট্ট এবং ডক্টর শেখর পাঠক লিখেছেন 'অন দ্য ব্যাঙ্ক অব এশিয়া'।
২০০৪ সালে ভারতীয় ডাকবিভাগের পক্ষ থেকে শ্রী নৈনের নামে একটি ডাকটিকিট প্রকাশিত করে তাঁকে সম্মানিত করা হয়। ২০০৩ সালের ২রা ফেব্রুরায়ি দ্য হন্দু পত্রিকায় শ্রী শ্যাম মেনন শ্রী রাওয়াতকে নিয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন: ওয়াকিং উইদ নৈন সিংহ।
১৮৭০ সালের পরে এই চমকপ্রদ তথ্য সামনে আনার জন্য শ্রী রাওয়াতকে 'এশিয়ান এক্সপ্লোরার' বলে সম্মানিত করা হয়েছিল। চিনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভারত তথা বিশ্ববাসীর চেতনার জনকের কাছে আমরা সকলেই ঋণী।
ব্রিটিশরা চিনের এই আগ্রাসন তখনই বুঝে ফেললেও কিছু কাঁচাপাকা সিদ্ধান্তে শাসন চালিয়ে গিয়েছিল। নিজেদের দেশ তো নয়, অত দরদ ছিল না।
স্বাধীন ভারতের অন্তরিম সরকার হয়তো কঠোর ধরণের কিছু ভাবলেও ভাবতে পারত। তাঁদের দূরদর্শীতার অভাব নাকি ভারত শান্তির দেশ এই মিথটা অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা খোদায় মালুম।
একটা টাইম মেশিন থাকলে নাহয় গিয়ে সিদ্ধান্ত পালটে দেওয়া যেত৷ কী বলেন?
চমৎকার লেখা। এক বিস্মৃত নায়কের কথা সামনেও এল। পরবর্তী লেখাগুলোয় চিনের দাবি আর বাস্তবের ফারাকটা আরেকটু তথ্য, সম্ভব হলে পুরোনো মানচিত্র উদ্ধার করে লিখলে ভালো হয়।
ReplyDeleteঅনেক নতুন তথ্য জানতে পারলাম... সত্যিই আমরা বিদেশের জেমস বন্ড নিয়ে মাতামাতি করি, কিন্তু আমাদের দেশেও যে এরকম একজন জেমস বন্ড আছেন, তার কথা আমরা কতজনই বা জানি... ক্লাস লেখা পুরো... এরকম লেখা ভবিষ্যতে আরো চাই, আর তার জন্য অপেক্ষায় রইলাম...
ReplyDeleteInteresting, could we get a story on broader canvas on Nain Singh ?
ReplyDelete