0

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in









প্রকৃতিগতভাবে মানুষ অবাধ্য। হাজারো বিশৃঙ্খলার মধ্যে থেকেও প্রকৃতি যেভাবে শৃঙ্খলা বজায় রেখে চলে, আবির্ভাবের পর থেকেই আর সব প্রাণী এবং মানুষ-পূর্ব মানব প্রজাতিদের যেটুকু শৃঙ্খলা তা-ই মানুষ জিনে বয়ে নিয়ে এসেছে এবং এতদিন কাটিয়েছে। এছাড়া অন্য কোনোরকম নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। সামাজিক, ধর্মীয় বা আইনি সব নিয়মই আধুনিক মানুষের সৃষ্টি। তাই শৃঙ্খলা ভাঙার চেষ্টা একেবারে শিশুকাল থেকে। শিশু শৃঙ্খল পড়তে জানে না, তাই তার গতিবিধি কাজকর্ম সবই বড়দের মনে হয় বে-নিয়ম। একে তো হাজারটা নিয়মের চোটে নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা, তার ওপর যদি হঠাৎ কোনো কিছুর জন্যে আবার কিছু নিয়ম বাধ্যতামূলক করা হয় তো সব বয়সের মানুষই বিরক্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু কিছু নিয়ম যদি সমাজের সকলের ভালোর জন্যে চালু হয় তাহলে নাচার হলেও মেনে নিতে হয়। এই চাপিয়ে দেওয়া নিয়ম এবং বাধ্য হয়ে ভালো ছেলেমেয়ের মত মেনে নেওয়া এটাতে মনের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। যা হয়েছে বর্তমান কোভিড-১৯ জীবাণুর ব্যাপক সংক্রমণের ছোঁয়াচ এড়াতে। একনাগাড়ে অন্তরীণ থাকতে থাকতে সব মানুষেরই অল্পবিস্তর অবসাদ সংক্রমিত হচ্ছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। 
স্কুলে পড়া সু-স্বাস্থ্য এবং গার্হস্থ্য বিজ্ঞানে শরীর-স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্যে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা সম্বন্ধে যা কিছু শিখেছিলাম তার সবটাই উপদেশ মনে করে পরবর্তী জীবনে বিসর্জন দিয়ে সমাজের নিয়ম-না-মেনে-চলার মূল স্রোতে মিশে গিয়েছি। এমনকি খাবার আগে হাত ধোয়ার মত অবশ্য কর্তব্যটাকেও অমান্য করেছি। কোভিড-১৯-এর কল্যাণে কিছু শৃঙ্খলা আমাদের অভ্যেস করতে বাধ্য করেছে। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার জন্যে কয়েকটা নিয়ম এখন মেনে চলতে হচ্ছে যেমন বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, খাবার আগে হাত ধোয়া, মুখে হাত বা রুমাল চাপা দিয়ে কাশি হাঁচি, যেখানে সেখানে থুতু নোংরা না-ফেলা ইত্যাদি অর্থাৎ যেসমস্ত কাজ না করার জন্যে সাধারণ জীবাণু ছড়িয়ে সর্দি কাশি জ্বর গলাব্যাথা ইত্যাদি রোগ হয়ে থাকে। সত্যি বলতে কি এগুলো মেনে চলার জন্যে শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। সর্বদাই এসব দিকে নজর দেওয়া অবশ্যই উচিৎ, এসময় তো বটেই এবং আমরা দিচ্ছিও কিন্তু আমরা নজর দিচ্ছি না আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি। প্রতিদিন একটু একটু করে মনের অবক্ষয় হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না, শুধু মনে হচ্ছে, ধুর্‌, ভালো লাগছে না। একটা আরোপিত চাপের মধ্যে থাকতে থাকতে এই ভাবটা যখনই আসছে তখনই বুঝতে হবে মনের অবস্থান আর স্বাভাবিক নেই, পরিবর্তন আসছে, অস্থির হয়ে উঠছে। এই অস্থিরতার মাত্রা প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে আলাদা এবং তা নির্ভর করছে ব্যক্তির পারিবারিক, সামাজিক, কর্মক্ষেত্র, আর্থিক ইত্যাদি নানা অবস্থানের ওপর। এরসাথে আছে বয়স এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য। 
মানুষ অভ্যেসের দাস। বয়স অনুসারে যে বয়সের যা কাজ আমরা তাতে অভ্যস্ত হয়ে যাই। যেমন শিশু যতক্ষণ বাড়িতে থাকে সে তার নিজের মনে খেলা করতে থাকে যা অনেকসময় বড়দের মনে হয় দুষ্টুমি আর তখন শাসন প্রক্রিয়া চলে; পড়ুয়ারা স্কুল-কলেজে যাওয়া, পড়া-টিউশন, বন্ধুদের সাথে আড্ডা ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকে; চাকুরি বা শ্রমজীবীরা নিজের কর্মক্ষেত্রে সারাদিন বা রাত কর্মব্যস্ত ছাড়াও বন্ধুদের সাথে নিয়মিত দেখা, আড্ডা, ক্লাব, পার্টি ইত্যাদিতে পরিশ্রান্ত হয়; অবসর জীবন যাদের তারাও নিজের নিজের মত সময় কাটানোর একটা পন্থা বের করে নেয়। অর্থাৎ প্রত্যেকে তার জীবন যাপনের একটা উপায়ে দিন কাটায়। এখন এই লকডাউন আমাদের এই যাপনের অভ্যেসকে ঘেঁটে দিয়েছে একেবারে। হঠাৎ করে গৃহবন্দি অবস্থাটাকে জীবনের, নাকি মৃত্যুর(?), ভয়ে মেনে নিতে বাধ্য হলেও যখন এটা দীর্ঘদিন চলে তখনই কালবৈশাখীর মেঘের মত হামাগুড়ি মেরে আসতে থাকে অবসাদ। ভালো লাগছে না। কবে উঠবে এই লকডাউন। কবে যাব স্কুল, কলেজ। কবে আবার অফিসে কারখানায় গিয়ে কাজ করতে পারব। কবে আবার পার্কে, সরোবরে প্রাতর্ভ্রমণ বা সান্ধ্য আড্ডায় মিলিত হব। কবে আবার সিনেমা, নাটক ইত্যাদি মনোরঞ্জনের জায়গায় যাব। কবে সাজুগুজু করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেব। তার মানে কবে আবার আমরা যে যার অভ্যেসের জগতে ফিরে যাব। 
এক ব্যক্তির সাথে আর এক ব্যক্তির সাক্ষাতে কথার সাথে চোখের মিলনও হয়। চোখে চোখ রেখে কথা বলতে না পারলে স্বস্তি মেলে না। চার চোখের মিলনে মনের সেতুও গড়ে ওঠে। অথচ সামাজিক দূরত্ব সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আজকাল অডিও ফোনে স্বস্তি মেলে সিকি ভাগ। তাই ভিডিও কলিং করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর একটা চেষ্টা চলছে। মন ভালো রাখার জন্যে নানা জনে বা গোষ্ঠী মিলে হরেক উপায় বের করছে। ডিজিটাল মাধ্যমে অডিও ও ভিডিও অনুষ্ঠান চলছে, অনেকে যোগদান করছে আর বেশিরভাগ লোক শুনছে বা দেখছে। মনোবিদেরা ফোনে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে পরামর্শ দিচ্ছেন, মন উৎফুল্ল রাখার উপায় বলছেন। কিছুদিন আগে এক উৎকণ্ঠিত মায়ের প্রশ্ন ছিল, “আর পারছি না। একদম কথা শুনছে না ছেলে। ভীষণ দুষ্টুমি করছে” ইত্যাদি যা অনেক মায়েরেই অভিযোগ। খুব সুন্দর করে বর্তমান পরিস্থিতি বুঝিয়ে উত্তর দিলেন মনঃচিকিৎসক, অনেক কিছু বলার পর বললেন, “ওকে ঘরের কাজে লাগান, ছাত থেকে কাপড় তুলে আনতে বলুন” ইত্যাদি। প্রশ্নকর্ত্রী বুঝলেন কী না জানি না, চুপ করে গেলেন কিন্তু আমার মনে কৌতুহল যদি ঘরের কাজ করতে বা ছাত থেকে কাপড় তুলতে ছেলে অস্বীকার করে কারণ সে তো আগে কখনও এ কাজ করেনি আর সে এই অবস্থা বুঝে বা না-বুঝে যে দুষ্টুমি করছে বাড়িতে তা তো তার স্বাভাবিক ক্রিয়াকর্মের বাইরে থাকার জন্যে। মনোবিদেরাও এই অবস্থায় কীভাবে সামাল দেবে নানা বয়সের লোকেদের বিভিন্ন মানসিক সমস্যার তা তাদেরও গবেষণার বিষয়। কারণ প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজস্ব মানসিকতার ওপর বাঁচে আর এই মানসিকতা তৈরি হয় মস্তিষ্কের বৃহত্তর সম্মুখভাগ সেরিব্রাম বা গুরুমস্তিষ্কের ওপরের স্তরের ধুসর বাহ্যাংশে যা দশ হাজার কোটি নিউরন মস্তিষ্ক কোষ দিয়ে তৈরি। এটাই মানুষের একান্ত নিজস্ব এবং মনের রান্নাঘর। আপাতভাবে মানুষে মানুষে প্রচুর মিল থাকলেও প্রতিটা মানুষ তার নিজস্ব শারীরগত এবং মানসিক গঠন নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখানেই মনের গোষ্ঠী চিকিৎসা অচল হয়ে যায়। অন্তরীণ শিশুদের ওপর মনের যে চাপ বাড়ছে তা কীভাবে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রতিক্রিয়া করবে তা ভবিষ্যতই বলবে। গার্হস্থ কলহের অভিযোগ যে ক্রমশ বাড়ছে তা তথ্যই প্রমাণ। প্রবীণদের মনে হতাশা, অশক্ত প্রবীণদের অবস্থা আরও করুণ। বৃদ্ধ বয়সে একলা যারা আছেন তাদের একাকীত্ব এমনিতেই জীবনসঙ্গী হয়ে আছে তার ওপর গৃহবন্দি অবস্থায় পথ্য ও ওষুধের চিন্তায় মনের অবস্থা ভেঙে পড়ার মত। সকালে বা বিকেলে ঘর থেকে দু-পা দূরে কয়েকজন মিলে কথাবার্তা বলে মন হাল্কা করার একটা উপায় ছিল, সেটাও বন্ধ। বদ্ধ ঘরের বাইরে বেরিয়ে বাড়ির মহিলারাও নানা কাজ করতেন, সেটাও ছিল কিছুক্ষণের জন্যে হলেও একঘেয়েমি থেকে একটা মুক্তির স্বাদ। ঘরের কাজে সাহায্য করার লোকেরা না আসায় অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ আপাত স্বস্তি দিলেও অভ্যস্ত কর্মক্ষেত্র পরিবেশ প্রবল কাজের চাপেও মনকে কিছুটা হলেও শান্তি দেয়, পাঁচটা লোকের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলা একটা দারুণ টোটকা মন ভাল রাখার। এসবের বাইরেও জনসংখ্যার দশ শতাংশ শিশু থেকে প্রৌঢ় আছেন আমাদেরই সাথে যাদের কথা আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি। কেমন আছেন এইসব লোকেরা যারা বিশেষ কোনো সহায়তা ছাড়া কিছু করতে পারেন না? আমরা সবাই কিছু না কিছু ভাবে অন্যের ওপর নির্ভর করি কিন্তু এই সংখ্যালঘু অথচ সংখ্যার নিরিখে উপেক্ষিত মোটেই নয় তারা কিভাবে যাপন করছেন জীবন এই দুর্বিষহ লকডাউনে? এদের মধ্যে অনেকেই আছেন সাহায্য ছাড়া এক পা-ও চলতে পারেন না, বসতে পারেন না, খেতে পর্যন্ত পারেন না। কিছুদিন আগে এক বৃদ্ধ পিতা তার অসমর্থ স্ত্রীর চোখের সামনে হুইল চেয়ারে আবদ্ধ তারই মানসিক অপরিণত প্রৌঢ় সন্তানকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে কারণ সন্তান মাস্ক পড়ে রাস্তায় বেরোতে রাজি হচ্ছিল না। সমাজ এবং আইনের চোখে পিতা খুনী বলেই সাব্যস্ত হয়েছে। কিন্তু কেন তাকে এই কাজ করতে হল, কোন মানসিক হতাশার তলানিতে আগে থেকেই নিমজ্জিত হওয়া এবং এই লকডাউন তাকে আরও গভীরে নিয়ে গিয়ে তার এতদিনের ভাল গুণকে একমুহূর্তে নষ্ট করে তাকে দিয়ে খুন করাতে বাধ্য করল তা কোন মনোবিদ ব্যাখ্যা করবে? স্কুল জীবনে অভ্যস্ত অপরিণত মনের সন্তানদের কিভাবে সামাল দেবেন অভিভাবকেরা যখন বাধ্যতামূলক বন্ধ স্কুল এবং সন্তানেরা সেখানে যাওয়ার জন্যে কান্নাকাটি করছে। কারণ সেখানে স্কুল পাঠ্যক্রম ছাড়াও গান খেলাধুলা আর শিক্ষক ও বন্ধুদের মাঝে সে খুঁজে পায় আনন্দ, তার জীবনের সার্থকতা। 
একশো বছর আগে প্লেগের সময় এমন অবস্থা হলেও মানসিক চিকিৎসার উন্নতি তখনও হয়নি যার জন্যে সে নিয়ে গবেষণাও কম। তবু আমাদের সবাইকেই এই ভয়ংকর কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেই বাঁচতে হবে, অন্যদের বাঁচাতে হবে। এখনই কোনো নির্দিষ্ট দিশা জানা নেই। জীবনই এখন বিশাল পরীক্ষাগার বিশেষ করে মনের স্বাস্থ্য গবেষণার জন্যে যেখানে যত মানুষ তত মনের রোগ জন্ম নিচ্ছে। আশা করি কালো মেঘ একদিন সরবে, শরতের উজ্জ্বল আলো সব মলিনতা ঘুচিয়ে দেবে।

0 comments: