0

someপ্রতীক - রীতা পাল

Posted in




আমাদের আবাসনের একটি মেয়ে তিন বছর বয়স থেকে আমাদের কাছে খুবই আসা যাওয়া করতো। ওর সঙ্গ আমাদের সকলেরই খুব প্রিয় ছিলো। সেই মেয়ের বয়স যখন ছয়, তখন একদিন দেখি আমাদের বাড়িতে এসে মনমরা হয়ে বসে আছে। আমার চোদ্দ বছরের ছেলে কী হয়েছে প্রশ্ন করায় বললো, ওর ক্লাশের অন্য একটি মেয়ে ওকে আজ মেরেছে। আমার ছেলে সঙ্গে সঙ্গে ওকে বললো – তুইও ওকে মারলি না কেন? সে বলে উঠলো – না রে, ওর একটা খুব বড়ো দল আছে। তখন তাকেও একটা দল তৈরির প্রস্তাব দিলে ফোঁস্‌ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো – আমার দলে কেউ আসবেই না।

এতো বছর পর গল্পটা আজ হঠাৎ মনে পড়ার কারণ – এই পরিস্থিতিতে আমারও একটা দলের অভাব অনুভূত হচ্ছে। আর নেত্রী হওয়ার সাধ বা সাধ্য কোনোটাই আমার নেই। কিন্তু দল বা আমার মতো সাধারণ সমমনস্ক কিছু মানুষের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হওয়ার তাগিদ খুবই অনুভব করছি। করোনা এবং পরিযায়ী প্রসঙ্গে কেন্দ্র-রাজ্য যা করলো, তার প্রতিবাদে চীৎকার করে উঠতে খুব ইচ্ছে হলেও গভীর মনন তা করতে দিলো না। অন্য একটি দৃশ্য চোখের পাতায় ভেসে উঠলো। ছেলের পরীক্ষার ফল বের হয়েছে। একেবারেই আশানুরূপ হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। ভাবুক গোছের ছেলেটি বর্তমান শিক্ষার বিষয়বস্তুতে কোনো আকর্ষন খূঁজে পায় না। বাবা-মা সে খবর রাখেন না, কিংবা রাখলেও প্রতিকারের পথ জানেন না। তাই ছেলেটির সামনেই একে অপরের নীতির প্রতি দোষারোপ করতে থাকেন। ছেলেটি নীরব হয়ে শুনতে থাকে। আমার আপনার নির্বাচিত কেন্দ্র-রাজ্য সরকার তাই তো করবে, যা আমরা করে থাকি – তাই না? প্রতিবাদ করতে হলে তো নিজের বিরুদ্ধেই করতে হয় – তাই তো? দিনের পর দিন যখন সরকারি স্বাস্থ্য শিক্ষা কাঠামো ভেঙে পড়ছে, নদী ভাঙন রোধ করা হচ্ছে না, তখন আমরা সাধারণ মানুষ চুপ থেকেছি। আমফান বিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণ সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবে – এটা ভাবা বাড়াবাড়ি নয়? কান্তি গাঙ্গুলি নিজের সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে অনেকবার বলেছিলেন, ত্রাণের টাকা দলের লোকের মধ্যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটাতে দৃষ্টি দেওয়া সম্ভব হয়নি। বাম দলের সেই লোকেরাই বর্তমান সরকারি দলের সদস্য। কাজেই আরো দক্ষতার সঙ্গে সে প্রথা বয়ে চলেছে। সুযোগসন্ধানী বাম বিরোধী মানুষ এবার একটু মুচকি হেসে বলে উঠবেন – তাহলে স্বীকার করছেন তো সমস্যাটা বাম আমলে তৈরি, তৃণমূলের কোনো দোষ নেই? না, আমি সহমত নই। ৫ বছরের বাচ্চাকে ভালো স্কুলে ভর্তি করার জন্য ৩ লাখ ডোনেশনরূপী ঘুষ দিই, বাড়ির বেআইনি নির্মাণের জন্য কর্পোরেশন আর কাউন্সিলারকে উৎকোচ দিই – সেই আমাদের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের কিছু লোক কাটমানি নেবে না তো কী করবে? স্বামী কণিকার ভক্ত, স্ত্রী সুচিত্রার – শুধু এই কারণেই তাদের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে আদানপ্রদান বন্ধ। আমাদের আগের প্রজন্ম হিন্দি সিনেমাকে অপসংস্কৃতি মনে করতেন। সেই আমার আপনার নির্বাচিত নেতা যদি বিরোধীদের দেশদ্রোহী আখ্যা দেন, খুব অবাক হওয়ার কিছু থাকে কি? ‘যব গোডাউনই এইসা হ্যায়, তো শোরুম ঔর ক্যায়সা হোগা’?

নিদান যে নেই তা নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে কালো মানুষের বিক্ষোভে সাদারাও সামিল হয়। অন্তঃসত্ত্বা হাতিটিকে যে পদ্ধতিতে হত্যা করা হয়েছে সারা দেশ তাতে ধিক্কার জানিয়েছে – ভালো কথা। কিন্তু ভালো কথা নয় একেবারেই যখন এরই সাথে সাড়ে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বাকে প্রায় বিনা অপরাধে তিহার জেলে আটক রাখা নিয়ে একটিও কথা বলা হয় না। আমার আপনার সংঘবদ্ধ হতে হবে এই সব বিষয়ে। সংরক্ষণ আইন নিয়ে কিছু বলতে গেলেই তাতে রাজনীতির রঙ তথা ভোটের অঙ্ক এসে যাবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ যদি এ সম্পর্কে এই মত প্রকাশ করে যে, সংরক্ষণ নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই, নিম্নবর্গের কতজন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী বা ডেপুটি কালেক্টর হলেন তা নিয়েও আমরা চিন্তিত নই – আমাদের সম্মিলিত দাবি – দলিতদের স্বাধীনভাবে দেশের সর্বত্র চলাফেরা করার অধিকার দিতে হবে, দেশের সম্পদ সমানভাবে ভোগ করতে দিতে হবে – তাহলে সরকারও ভাবতে বাধ্য হবে। আজ না হয় কাল নয়তো অবশ্যই পরশু। পরিস্থিতি দেখালো, মহামারীতেও একদিন লকডাউন তুলে দিতে হয়, মন্দিরের দরজা খোলার ফরমান জারি হলেও পুরোহিত প্রাণভয়ে বেঁকে বসেন। কাজেই নিজেদের রক্ষার দায়িত্ব এবং সভ্যতাকে পরিপুষ্ট করার ভার শিক্ষিত-অশিক্ষিত নারী-পুরুষ ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলকেই কাঁধে তুলে নিতে হবে। সহানুভূতি বা সমবেদনা ভালো। কিন্তু আত্মমর্যাদা না থাকলে সমবেদনা খুব একটা কাজে আসে না। অর্থাৎ আমাদের সমস্যা সরকার অথবা বিরোধী পক্ষ দূর করে দেবে – এ চিন্তা যেমন অমূলক, তেমনি গরীবের সমস্যা অনুভূতিশীল ধনী দূর করবে কিংবা দলিতদের সমস্যা উচ্চবর্গের লোক সমাধান করবে – এ ভাবনাও ভিত্তিহীন। ‘অধিকার কেড়ে নিতে হয়’। জনমত তৈরি করতে হবে, পথে নামতে হবে। সাথী জুটবেই। লড়াই যদি হয় অশুভের সঙ্গে, সেখানে নেতৃত্ব নিয়ে চিন্তা নেই – দলিত সমস্যায় দলিতরা নেতা, অন্যরা সমর্থক – পরিযায়ী সমস্যায় তারাই নেতা, দলিত ও দরিদ্ররা সমর্থক। এই আন্দোলনে ‘আমরা সবাই রাজা’। নিরন্ন ধর্মভীরু হিন্দুরা যদি রামমন্দির নির্মাণের বিরোধিতা করে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে সোচ্চার হয়, এবং কোটি কোটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ দল নির্বিশেষে ধর্ম নির্বিশেষে সে দাবির প্রতিধ্বনি তোলে – তবেই একমাত্র বন্ধ হবে ‘জাতের নামে বজ্জাতি’। সব ঝড়ই থেমে যায় একদিন, ঝরাপাতাদের আমরা মনেও রাখি না। প্রতিটা ঝড় থেকেই নতুন কিছু আহরণ করে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে ঝরাপাতাদের বলিদানের সার্থকতা। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে বিনা দোষে মার খেয়ে চলা – কখনোই সমাধান হতে পারে না।

0 comments: