1

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in



৫ম পর্ব 
শান্তির সারল্যমাখা দৃষ্টিতে কোনো দীনতা নেই বরং একপশলা বৃষ্টির মত নির্ভরতা আছে। তার জীবন যে আর একটু হলেই কলুষ কদর্যতায় মোড় নিতে পারতো সেটা তার থেকে আর কেই বা ভালো বুঝতে পারে! তার স্বামী মানুষটির ব্যবহারে সে কোনওরকম করুণার প্রচ্ছন্ন গর্ব বা ঔদ্ধত্য সে দেখেনি। শরৎ অবশ্য নিজেও চেষ্টা করেন সম্পর্কের রসায়নটি সহজসরল রাখার। নিজে যদিও খুব একটা স্বচ্ছল নন এখনো তবুও তারই মধ্যে পরিপাটি করে দেড়কামরার ঘরটি শান্তি বেশ দৃষ্টিনন্দন ভাবে সাজিয়ে রাখে সর্বদা। তার সেলাই এর হাত মন্দ নয়। কুরুশকাঁটায় যে কটি আসন এর মধ্যে শান্তি বুনেছে তার সবগুলোই বেশ সুন্দর। 
এখানে এক ধরণের ছোট ইলিশ পাওয়া যায়, শরৎ নিজে খুব একটা খাদ্যরসিক না হলেও এক দু টুকরো মাছ থাকলে দু গ্রাস ভাত অন্যদিনের চেয়ে বেশী খান। তাই সপ্তাহে একদিন অন্ততঃ ইরাবতীর ওই ইলিশসহযোগে তাদের দ্বিপ্রাহিক আহারটির সমাপন হয়। শরৎ বোধহয় একমাত্র পটলভাজা খেতে খুব ভালবাসেন। রেঙ্গুনে ও বস্তুটি দূর্লভ বলে প্রায়ই নিজের মুখে কয়েকবার আক্ষেপ করেছেন। শান্তি সে সব শুনে মুখটিপে হাসে। বড়ই শান্ত আর শ্রীময়ী তার ভাবভঙ্গী। কেবল একলা ঘরে কখনো কখনো সে উদাস হয়ে অন্যমনা হয়ে যায়। লোকমুখে সে শুনেছে শরৎবাবু একজন মস্ত লেখক। সাধারণ মেয়েদের কথা এর আগে তাঁর মত করে কেউ সেভাবে লেখেনি! আজ সেই বিরাট খ্যাতিমান মানুষটাই তার স্বামী। তাও যেন শান্তির মুখ ফোটেনা। কোথায় একটা সংকোচ এসে সময়ে সময়ে তাকে বোবা করে দেয়। খুব সাধারণতম মেয়ে হলেও তার নিজের জীবনের অনেক ওঠাপড়ার কথাই তো বলা বাকী রয়ে গেছে তার একান্ত পুরুষটিকে। খুব ঘনিষ্ঠতার মুহূর্ত ছাড়া তাঁকে দুহাতের বেড়ীতে জড়িয়ে ধরতে আজও সংকোচ হয়। 
শরৎের জীবনে এখন নতুন পর্বের জোয়ার এসেছে। প্রকাশক চিঠিতে জানিয়েছেন 'শ্রীকান্তে' র প্রথম পর্ব আর 'পল্লীসমাজ' এই দুটি বইয়ের প্রথম সংস্করণ এর মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। ভারতবর্ষ আর যমুনা এই দুটি পত্রিকাই পর্যায়ক্রমে শরৎকে লেখক হিসেবে পায়ের তলার জমি শক্ত করতে সাহায্য করছে। তাদের সূত্র ধরেই গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স তাঁর বইগুলির প্রকাশক। এই প্রকাশকের কাছ থেকে ঠিকানা জুটিয়ে দুটি তরুণ সাহিত্যসেবী শরৎকে আজকাল নিয়মিত চিঠি লেখেন। এরা হল হেমেন্দ্রকুমার রায় ও নরেন্দ্র দেব এই দুজনেই বেশ সম্ভাবনাময়। হেমেন্দ্র এখন অতিলৌকিক জীবন নিয়ে আগ্রহী। শরৎ অবশ্য নিজেও থিয়োসফি নিয়ে চর্চা করেছেন একসময়। এই দুজনের মধ্যে নরেন্দ্র মানুষটি আসলে কবি স্বভাবের। মজার ব্যাপার এই যে দুই যুবকেরই ইচ্ছা রবীন্দ্রনাথের প্রভাবমুক্ত হয়ে একটা নতুন ধারার সাহিত্য সৃজন করার। বর্তমানে তা শুনতে আজব লাগলেও শরৎ নিজেও বোঝেন রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার প্রাবল্য এমনই প্রভাবশালী যে তা থেকে দূরে থাকা সত্যিই কঠিন। একমাত্র উপায় হচ্ছে রবীন্দ্রধারায় স্নাত হয়েই সমান্তরালভাবে সাহিত্যরচনা করে যাওয়া। নিজেও ঠিক সেভাবেই এগোচ্ছেন। 
দ্বিতীয় খবরটি হল শরৎ শীঘ্রই পিতৃত্বের পদে উন্নীত হতে চলেছেন। শান্তি আর শরৎের যৌথজীবনের প্রথম অভিজ্ঞানটি আসতে বেশী দেরী নেই আর। শান্তি একটি কামিনী ফুলের গাছ পুঁতেছে। নির্জন রাত্রিতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে সেই ফুলের গন্ধটি তিনি শান্তির সঘন নিঃশ্বাসে যেন অনুভব করেন। শরৎ তার এই ছোট্ট নীড়টিতে বাস করে এখন খুব সুখ অনুভব করেন। এতদিনের উদভ্রান্ততা আর অস্থির জীবনের কিয়দংশটি পার করে এসে অবশেষে পাওয়া একান্ত নিজের এই মানবীটিকে ঘুম থেকে জাগিয়েই পরম উষ্ণতা ভরে বুকে টেনে আনেন একটি দীর্ঘচুম্বনের আমন্ত্রণ সহ। 
ভারতবর্ষের আকাশে এখন এক নতুন দূর্যোগ। বড়লাট লর্ড কার্জন প্রশাসনিক সুবিধার নাম করে বাংলার মানচিত্রে কিছুটা পরিমার্জন করতে বদ্ধপরিকর। বাংলা, বিহার, ওড়িশা ও আসামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে কেবল হিন্দু ও মুসলমান জনসংখ্যার আধিক্যের ওপর ভিত্তি করে এই বিভাজনের পরিকল্পনা করেছেন ইংরেজ সরকার। ঢাকার নবাব সলিমুল্লা দেড়লক্ষ পাউন্ডের বিনিময়ে এই অনৈতিক প্রস্তাবটিতে সায় দিয়েছেন। স্বভাবতই এই প্রস্তাবটিতে বাংলার প্রতিষ্ঠিত বিদ্বজ্জনেরা সরাসরি এর বিরোধিতা জানিয়েছেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় নিজে একজন প্রভাবশালী নেতা ও সুবক্তা। কলকাতার বিভিন্ন পথেঘাটে তাঁরই নেতৃত্বে একটা জোর এই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন দানা পাকছে। ঠিক এই সময় গজদন্ত মিনার থেকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও পথে নামলেন। ভ্রাতুষ্পুত্র অবন, গগন,দীনেন্দ্র এঁদের সকলকে নিয়ে আরও কিছু লোক জোগাড় করে জোড়াসাঁকো থেকে চিৎপুরের রাস্তায় হিন্দু মুসলমান, শিখ, সবাইকে আলিঙ্গন করে রাখী পড়াতে লাগলেন আর আহবান করলেন বাংলার অখন্ডতা বজায় রাখার জন্য। কাছেই নাখোদা মসজিদের ইমামকেও রাখী পড়িয়ে আলিঙ্গন করলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। একটি চমৎকার রাখী সংগীতও এই উপলক্ষে রচনা করেছেন তিনি। রাখীবন্ধনের এই উন্মাদনায় সারা দেশ যেন নতুন এক সৌভ্রাতৃত্বের বোধে নড়েচড়ে বসল। 
সুদূর বর্মায় বসে শরৎ এই খবরগুলো বন্ধুদের চিঠি থেকেই যেটুকু যা জানতে পারেন। মনে মনে ছটফট করেন আর ভাবেন এ সময়টায় বাংলাদেশে থাকলে বেশ হত। এদিকে শান্তির প্রসবের সময় এগিয়ে আসছে। একটু রক্তাল্পতায় ভোগে সে। আর তার সাথে রয়েছে লিভারের দূর্বলতা। প্রসবপর্ব ভালোয় ভালোয় যাতে সব মিটে যায় তার জন্য শরৎ সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্হাই করে রেখেছেন। চেম্বার সেরে বাড়ি ফেরার পথে সুরেশ দিনে একবার করে তার বৌঠানকে এসে দেখে যায়। শরৎ নিজেই দুধ চিনি ছাড়া চা বানিয়ে আনেন আর কিছুক্ষণ ধরে বিভিন্ন বিষয়ে চলে গল্পগুজব। তার অভিন্নহৃদয় সুহৃদ মহিম এখন গুপ্তসমিতির কাজে কখনো পেগু বা ইয়াগন কিংবা সুরাভায়ার গোপন ডেরায় আত্মগোপন করে আছে। তার সাথে কারোরই অনেকদিন দেখা হয়নি। তলোয়ারকর বলে একটা মারাঠী ছেলে সে ওদের দলেরই, এইখানের একটা বাসায় ভাড়া থাকে ও তেলের কোম্পানির মজুরদের সংগঠিত করার কাজে দিবারাত্র পরিশ্রম করে। তার কাছেই মহিমের যেটুকু খবর যা মাঝেমধ্যে পাওয়া যায়। সম্প্রতি নাকি সাংহাইয়ের একটি ক্লাবে একটা বড়োসড়ো পুলিশি হানায় ওদের প্রথম সারির কিছু নেতাকে পুলিশ ধরেছে। তারপর বাধ্য হয়েই মহিম আর মহতাপ সিং এই দুই কমরেড আপাতত অন্যকোথাও গা ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে আছে। এখন আর নতুন করে ধরপাকড় হতে দেওয়া যাবেনা। বর্মায় জাহাজঘাটা আর রেলস্টেশনে পুলিশের পিকেটিং আগের তুলনায় বেড়েছে।ইংরেজ গোয়েন্দাদের বিশ্বাস এই স্বদেশী বিপ্লবীদের অনেকেই ভারতবর্ষ ছেড়ে বর্মা, ইন্দোচীন, মালয়, জাভা এসব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে ইংরেজ বিরোধী সশস্ত্র আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মহিম যে এদেরই একজন তা তিনি অনেকদিনই জানেন। সে আসলে ছদ্মবেশ ধারণে পটু আর অনেক কটি ভাষায় কথা বলতে পারার সুবাদে তার ওপর গুপ্তসমিতির দায়িত্বও বেশী। শরৎ এইসব খবরে বড় বিচলিত হন। যারা জীবনবিপন্ন করে স্বাধীনতার জন্য লড়ছে, তাদের অনেকের নামই ইতিহাসের স্রোতে হয়তো হারিয়ে যাবে একদিন। দেশ কখনো সত্যিই স্বাধীন হলে এদের কথা কেই বা মনে রাখবে? পরাজিত জাতির প্রতিনিধি হয়ে সংবেদী শরৎ সর্বদাই এই রাজদ্রোহীদের উদ্দেশ্যে কোটিকোটি নমস্কার জানান। 
বিকেলে স্ত্রীকে নিয়ে পোজনডংএর জেটির কাছ থেকে বেড়িয়ে আসেন অফিসের পর। জায়গাটা সাগরের মোহনার কাছে বলে একটা জোলো নোনতা হাওয়া লাগে দুজনার গায়ে। শান্তি মাথায় ঘোমটা টেনে সলজ্জ ভঙ্গীতে পাশে পাশে হাঁটে আর তার পাতলা আঙুলগুলো শরৎ সযত্নে ধরে থাকেন মুঠিতে। সাতমাসেও তার উদরটি এখনো সেরকম স্ফীত হয়নি বলে অল্প হাঁটা চলা করতে অসুবিধা হচ্ছেনা। খাঁড়ির কাছেই একটা ধাঙড়পল্লী আছে। সেখানকার দরিদ্র প্রায়োলঙ্গ শিশুগুলি ওদের দেখে হাসতে হাসতে দৌড়ে আসে। পকেটে চারপয়সার লবেঞ্চুষ নিয়েই বেরিয়েছিলেন শরৎ। হরির লুটের বাতাসার মত সেগুলো তাদের মধ্যে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যার আকাশে হঠাৎ করে কর্কশ ডাক ছেড়ে একটা দুটো সাগরবিহঙ্গ উড়ে যায়। চতুর্দিকে একটা অবসন্ন দারিদ্র ছড়ানো থাকলেও শরৎ এদিকটায় বেড়াতে ভালোবাসেন। ফেরার পথে টুংরিদের ঘরের সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে দেখলেন টুংরি আর তার বৃদ্ধা মা তাসি একমনে বসে বসে বেতের ঢাউস আকারের ঝুড়ি বুনছে। এগুলো সব মাছের আড়তে চলে যাবে চালানি মাছ রাখার জন্য। সস্ত্রীক শরৎকে সামনে দেখতে পেয়ে ফোকলা দন্তহীন মুখে বুড়ি একগাল হাসে। শরৎ এ পল্লীতে সেবারের প্লেগের সময় অনেককে সুস্থ করে তোলায় এখানে সবাই তাঁকে ভালবাসে; ভক্তিও করে। তাসির নুয়ে যাওয়া ভাঁজকরা চেহারাটা দেখলেই বাংলাদেশে নিজের মা এর মুখটা তখনি মনে পড়ে আর বুকটা কেমন যেন মুচড়ে ওঠে। ভালোয় ভালোয় সন্তানটি প্রসব হয়ে গেলে একবার সপরিবারে তাঁকে দেশে যেতেই হবে।

1 comment: