2

গল্প - সুস্মিতা হালদার

Posted in


দুপুরবেলা লাঞ্চের পর নিজের ঘরখানায় এসে বসলেন অম্বিকাবাবু— অম্বিকা চৌধুরী। কতদিন যে দেখা হয়নি এই ঘরটার সাথে। সারা বাড়ির মধ্যে এটাই ওনার নিজের জায়গা, একান্তই আপনার স্থল। টানটান করে পাতা বিছানাটার ওপর এলিয়ে দিলেন শরীরটা। এখনও তেমন জুত নেই শরীরে। হাসপাতাল থেকে আজই ছাড়া পেয়েছেন— সকালে। দশ-পনেরো মিনিটের বেশী বসে থাকতে পারছেন না। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। মাস দুয়েক আগে বুকে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন শহরেরই এক হাসপাতালে। কিছুদিন পর ভালোও হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু দিন পনেরো-কুড়ি আগে আবার জোরালো হয় ব্যথাটা। সাথে সাথেই ভর্তি করা হয়। তারপর চলল যমে মানুষে টানাটানি। সবাই ধরেই নিয়েছিলেন, উনি আর বাঁচবেন না এ যাত্রায়। কিন্তু সবাইকে অবাক করেই ‘অলৌকিক’ ভাবেই উতরে গেলেন, চিকিৎসায় সাড়া দিয়ে। 
হাসপাতাল থেকে ফেরার পর গা-হাত-পা ধুইয়ে দিলেন স্ত্রী অঞ্জুদেবী। দুপুরে একটু স্যুপ খেয়ে এসে বসেছেন এই ঘরটায়। উনি বাড়িতে না থাকলেও অযত্ন হয়নি এই ঘরখানার। অঞ্জুদেবী পরিপাটি করে গুছিয়ে রেখেছেন তাকে। 
-“ইয়ে বলি, একটু ফোনটা দেবে?” স্ত্রীকে নরম স্বরে প্রশ্ন করেন অম্বিকাবাবু, “অনেকদিন তো ওটা খোলাই হয়নি।” 
-“মরণদশা! ঘরে ফিরতেই ফোন! বুড়ো বয়েসে ভীমরতি ধরলো? … একদম পাবে না এখন। ডাক্তারে বারণ করেছে না, ওসব স্মার্টফোন ধরতে। আরো ক্ষতি হবে।” প্রায় ঝেঁঝিয়ে ওঠেন অঞ্জুদেবী। অবশ্য এ ঝাঁঝও বড় মোলায়েম লাগে অম্বিকাবাবুর। 
-“একটু দাও না। বেশীক্ষণ করব না। দু’দশ মিনিট দেখে তোমায় দিয়ে দেব।” স্বরটা যেন একটু কাতরই লাগে।কী আর করা যায়? বুড়ো বয়েসের সঙ্গী এই স্মার্টফোনটার ওপর যে বেজায় মায়া পড়ে গেছে। কতদিন প্রায় ছুঁতে পারেন নি ওটাকে। আজ একটু না ছুঁলে হয়? 
অল্প কাকুতি-মিনতিতেই কাজ হল। ফোনটা হাতে পেয়েই হোয়াটস্অ্যাপটা খোলেন অম্বিকাবাবু। এটাই তো আসল আকর্ষণ-স্থল। কত লোকে কত মেসেজ পাঠায়! নিজেকে বেশ চাঙ্গা লাগে, এত এত মেসেজ দেখলে। যদিও তেমন খোঁজখবর বা সুখ-দুখের কথা বলার মতো লোক মেলে না হোয়াটস্অ্যাপে, তবু লোকে মনে করে মেসেজ তো পাঠায় — কত ভিডিও, কত জোকস্ − ‘Good Morning’, ‘Good Night’ লেখা ডিজাইনদার ছবি! হোয়াটস্অ্যাপ খুলতেই চোখ পড়ে যায় ‘প্রাক্তনী’ গ্রুপটায়। অম্বিকাবাবু একটা হাইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। বছর দশেক হয়ে গেল অবসর নিয়েছেন। এই হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপটা হল ওনার প্রাক্তন স্কুলের প্রাক্তন কলিগদের গ্রুপ যাঁরা অবসরপ্রাপ্ত, কিংবা যাঁরা আগে ঐ স্কুলে ছিলেন পরে অন্য কোথাও ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেছেন, এখনও সার্ভিসে বহাল। অনেকগুলো মেসেজ এসেছে গ্রুপে, পঞ্চাশখানা! কৌতূহল ধরে রাখতে পারলেন না। ঝটপট খুলে ফেললেন গ্রুপের চ্যাট উইন্ডোটা। 
একি! কী বলছে সব? শোকবার্তা কীসের? কে মারা গেছেন? শোকের উৎসস্থল খুঁজতে খুঁজতে একটা মেসেজে এসে থমকে গেলেন-
“Ambikababu is no more. Aj sokale amader chere chole gechen uni… Ambikababu – amader ex-Head Sir, Ambika Chowdhury.”
বিস্ফারিত চোখ মেলে বারবার দেখেন মেসেজটা। মানে? উনি নিজে মারা গেছেন? নিজেরই যেন বিশ্বাস হয় না — নিজে মৃত না জীবিত! এ কি মরণোত্তর স্বপ্ন দেখছেন, নিজেকে জীবিত হিসেবে? … ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগল। নড়বড়ে আঙুলে টাইপ করতে লাগলেন একটি মেসেজ − 
“আমি মরি নি ভায়া! বেঁচেই আছি। আজ সকালে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরেছি। … তা এই সুসংবাদটির উৎসদাতাটি কে?” 
ওনার মেসেজটা ‘সেন্ট’ হওয়ার কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই হাজার হাজার মেসেজ ঢুকতে থাকে, হঠাৎ বাঁধের জল ছাড়লে যেমন হয় ঠিক তেমনভাবেই। মেসেজের তোড় দেখেই বোঝা যায়, গ্রুপ মেম্বাররা কতটা অ্যাকটিভ হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ খুবই লজ্জিত; কেউ কেউ ভীষণ দুঃখিত এরকম ভুল সংবাদ রটে যাওয়ায়। কেউ একজন ‘পলিটিশিয়ান’ গোছের ভাব নিয়ে বক্তৃতা শুরু করলেন— কেন কোনো ভেরিফিকেশন ছাড়াই খবর পোস্ট করা হয়! এরজন্য গ্রুপ অ্যাডমিনকেই দায়ী করলেন। দুর্ভাগ্য ও সৌভাগ্যবশত উনি ভুলে গিয়েছিলেন গ্রুপটি সীমিত জনসংখ্যার ও সকল মেম্বারই এখানে ‘অ্যাডমিন’— ব্যক্তিটি নিজেও ‘অ্যাডমিন’। কেউ কেউ আবার ঠাওরাতে পারলেন না এটা কি ‘মস্করা’, না কি অম্বিকাবাবুর ‘প্রেতাত্মা’ মেসেজ পাঠাল! সরাসরি এমনটা না লিখলেও মেসেজের ধরণে তা স্পষ্টতই বোঝা যায়। অনেক তর্ক-বিতর্কের মাঝেই একজন ‘টিকটিকি’র কাজ করলেন। প্রায় গোয়েন্দাগিরি করে খোঁজ বের করলেন সেই উৎসদাতাটির ‘পরিচয়’। 
জানা গেল খবরটি সত্যই ভুয়ো— তবে আগায়, গোড়ায় না। 
মানে? সেটা কেমন জিনিস? খবর আগায় ভুয়ো, গোড়ায় ঠিক? 
হ্যাঁ। উৎসদাতার শোনার ভুলে এই বিভ্রান্তি।
সকলেই প্রায় রে রে করে তেড়ে উঠলেন। কোন গ্রুপ মেম্বার এ কাজ করে থাকেন! তাঁকে বহিষ্কার করার প্রক্রিয়া শুরু হোক। 
আরে? এতো সহজেই খেপে উঠলে চলে না। একটু সবুর করতে হয় তো! হলেই বা সেন্টিমেন্টাল ইস্যু, ‘মরাল’ এথিক্সেরও প্রশ্ন আসছে।… উৎসদাতা এই গ্রুপের কেউ নন। উনি বহিরাগত। 
সকলেই যেন একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। যাক্, গ্রুপটা তাহলে ‘ঝোল টানা’র হাত থেকে বাঁচল। 
তা কী করে এই বিভ্রান্তির উৎপত্তি? 
প্রযুক্তিবিদ্যার ‘কোষ্ঠকাঠিন্যের’ ফলে। প্রযুক্তি যেমন মরা মানুষকে বাঁচায়, তেমন বেঁচে থাকা মানুষকে মরিয়েও দিতে পারে — মৃত্যুসংবাদ ছড়ানোয় সাহায্য করে। 
সে আবার কী? একটু খোলসা করে বলা যায় না?
অবশ্যই। … জনৈক ব্যক্তি উৎসদাতাকে ফোনে বলেছিলেন, “অম্বিকাবাবু আজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি চলে গেলেন।” সেই জনৈক ব্যক্তি সম্ভবত বাস-ট্রান্সপোর্টে ছিলেন। তাই বাইরের আওয়াজেই হোক আর ফোনের ‘নেটওয়ার্ক’ বিগড়োনোর জন্যই হোক উৎসদাতা শোনেন, “উনি আজ চলে গেলেন।” ‘ভেরিফাই’ করার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু দু’বারেই একই শোনেন। তারপর সেই জনৈক ব্যক্তিকে ফোনে পাওয়ার চেষ্টা করে গেলেও তা বিফলে যায়। বিভ্রান্তিকর শোকবার্তাটি দিয়ে ফোনটি আপন খেয়ালে ‘পরিষেবা সীমার বাইরে’ চলে যায়। ফোনটির খেয়াল ফিরতে হলে কত সময় যে অপেক্ষা করতে হতো তা গণনা করা বড়ই শক্ত। 
আর অপেক্ষা করা তো চাট্টিখানি কথা নয়। খবর যে থেমে থাকে না। থাকলে চলে না। সে-ও যে প্রবহমান, আপন খেয়ালেই। উৎস থেকে খরস্রোতা হয়ে বয়ে এসে একবার সমতলে পড়লেই সে প্রশস্ত-বিবর্ধিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষণকালের মধ্যেই। তখন ‘নিরুপায়’ উৎসদাতার আর কীই বা করার থাকে!

2 comments:

  1. SAGNIK CHOWDHURY1 July 2020 at 12:40

    ভালো লাগলো...।
    ডিজিটাল যুগে এই ভুলগুলো খুবই হচ্ছে...!!

    ReplyDelete
  2. Khub sundar. Jantrikata amader kibhabe cheye feleche ei golpe tar i proticchobi.

    ReplyDelete