0

ধারাবাহিক - শিবাংশু দে

Posted in












৩. 

সন্ধেবেলা একটা মেসেজ পেলুম, ফোনে। 
-তোমাকে আর এমব্যারাস করবো না, সরি। হায়দরাবাদে আর থাকতে ভালো লাগছে না। কোথায় যাবো ঠিক করিনি। ভালো থেকো... 
সঙ্গে সঙ্গে ফোন লাগালুম। ধরলো না। এক ঘন্টা পরে আবার। ধরলো না। এত রাতে নন্দিনীদিকে ফোন করা উচিত নয়। একটা মেসেজ করে দিলুম। 'অনু কি বাইরে গেছে?' উত্তর সঙ্গে সঙ্গে। না তো, আজই ফোন করেছিলো। এখানেই আছে। 
এবার তো সঙ্গিনীকে বলতেই হয়। 
- শোনো, বিজয়া সান ইসিদ্রো ফিরে যেতে চাইছে .. 
- হঠাৎ কেন? তুমি ম্যাজিক দেখানো শুরু করলে নাকি? 
- আরে না। ম্যাজিক জানলে কি আর তোমাকে বলি? 
- ওসব অন্যকে বোলো। আমিও ভুগি তোমার ম্যাজিকের জ্বালায়। নয়তো কবেই শিলাইদা ফিরে যেতুম ... 
- প্রিয়ে... 
- মনে রেখো, তোমার থেকে অন্তত বারো-চোদ্দো বছরের ছোটো। জীবনটা পড়ে আছে। কষ্টে থাকে। আর কষ্ট দিও না.. 
সুখ আর শুশ্রূষা, মেরুগুলো কেন যে এত আলাদা, এত দূর ... 
আমার অফিস থেকে অনুর ডিপার্টমেন্ট গাড়িতে পাঁচ-সাত মিনিট লাগে। ইউনি'র পোস্ট অফিসটার কাছে। সাড়ে বারোটায় একটা মিটিং শেষ করে বসকে বলি একটা কাজে যাচ্ছি। কাছেই। দরকার হলে পিং করবেন। গাড়ি পার্ক করার সময় ড.ভেঙ্কট রাওয়ের সঙ্গে দেখা। অনু'র এইচ-ও-ডি। লাঞ্চে বাড়ি যাচ্ছেন। 
- হ্যালো, ইউ'র হিয়ার? নাও? 
- অনন্যা? 
- ইয়াহ, পারহ্যাপ্স ইন স্টাফ রুম .. 
- থ্যাংকস .. 
স্টাফরুমের সামনে একজন মহিলা রক্ষী। অনু'র নাম বলি। 
- ওয়েটা, 
এক মিনিট পরেই অনু বেরিয়ে আসে। ওর চোখ দেখেই বুঝতে পারি একেবারে অপ্রত্যাশিত কেউ দাঁড়িয়ে আছে সামনে। 
- তুমি? 
- জি ম্যাডাম .. 
অস্ফুটে বলে, 
- এখানে আসবে ভাবিনি.. 
- গলতি মাফ কিয়া জায়। আপনে মজবুর কী.. 
তাকিয়ে থাকে। কিছু বলে না। 
- কুছ তো বোলিয়ে জনাব.. 
- এখানে? এখন? 
- খুব সত্যি কথা। তবে কোথায়? কখন? 
- জানি না... 
- আর ইউ আনকমফর্টেবল ? 
- নাহ, একেবারেই না.. 
- তোমার চোখ কিন্তু অন্য কথা বলছে .. বেশ, আমি যাই। চারদিকে ছেলেমেয়েরা ঘুরছে। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা এমব্যারাসিং হতে পারে। 
- তবে এলে কেন? 
- বলতে হবে? 
- জানি না... 
- ফোন করলে ধোরো, কথা আছে... 
- আমারও আছে ... 
- টেক ইয়োর টাইম.. 
দিন তিনেক ফোন করিনি। ফোন আসেওনি। ব্যস্তও ছিলুম অন্য কাজে। অনুষ্ঠানের দিন এগিয়ে আসছে। এবার গোছানো শুরু করতে হবে। নন্দিনীদি দুবার ফোন করেছেন। সন্ধের দিকে অফিস থেকে বেরোবার আগে ফোন করলুম অনুকে। একবার বাজতেই ধরলো। 
- কী ব্যাপার? ফোন করোনি কেন? 
- ফোন তো তোমার করার ছিলো.. 
- তাও সত্যি.. 
- তবু ভুল স্বীকার করলে। ভালো লাগলো.. 
- বালিকে, বয়স হচ্ছে, মাফ কর দিয়া জায়.. 
- আমারও বয়স হচ্ছে.. 
- ঝগড়া করবে নাকি? 
- নাহ, বলো .. 
- ফাইন্যাল রিহার্সালের শিডিয়্যুলটা বানাতে হবে। কবে বসা যায়? 
- আমি তার কী জানি? 
- মানে? আর কে জানবে? 
- তুমি জানবে। আর বাকিদের আমি জানি না.. 
- প্রথমত আমি তোমাকে চাই... 
- মানে? 
- দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই.. 
- খেপে গেলে নাকি? 
- শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই.. মানে প্রোগ্রামের জন্য.. 
- আমি চাই না.. 
- আই'ল ওয়েট ফর ইয়োর কল.. 
অনু আর ফোন করেনি। কিন্তু রিহার্সালে গিয়ে দেখি পৌঁছে গেছে। অত্যন্ত বাধ্য সহকারীর মতো যা বলছি, শুনছে। অনুষ্ঠানে নিজের অংশটা দারুণভাবে পারফর্ম করছে। হয়তো একটু ইউফোরিক ভাবসাব। কিন্তু ভালো লাগলো খুব। সবাই প্রশংসা করছে। নন্দিনীদি একবার বললেন, অনুর জন্য এমন মাস্টার লাগিয়েছি না, ওকে পারফর্ম করতেই হবে। খেয়াল করলুম, শর্মিলা অপাঙ্গে একবার আমার দিকে চাইলো। জানি, বাড়িতে ফোন গেলো বলে। 
অনুষ্ঠানের দিন দেখি বালিকা তার 'বৌদি'র সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে আছে, যেন একশো বছরের পরিচয়। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এসেছিলেন উদ্বোধন করতে। মেলা লোকজন। লালফিতের জয়জয়কার। ক্যামেরা, প্রেস, ফোকাস। ক্যামেরাওয়ালারা তো দেখি অনুকেই ফোকাস করে যায়। সেটাই স্বাভাবিক। ওকে দেখতে ভারি সুন্দর লাগছিলো সারা সন্ধে। গাঢ় নীল রঙের তসর শাড়ি একটা। চওড়া সোনালি পাড়। আর অনুর চলাফেরা তো সব সময়েই, কী যেন বলে নাজুক, নাজুক। খুশি থাকাটা সে সংক্রমিত করতে পারে। 
সেদিনের অনুষ্ঠান উতরে গেলো। আমাদের দেশের ভাষায় যাকে বলে 'ঠিকে বা'। গ্রুপ ছবি তোলার সময় ঠেলেঠুলে 'আমার মাস্টারের সঙ্গে ছবি তুলবো' বলে পাশে এসে দাঁড়ায়। ধন্দ লাগে। অচেনাও লাগে বেশ। চারদিকে এত লোকজন। আলাদা করে অনুর সঙ্গে কোনও কথা হয় না আর। ফেরার পথে সঙ্গিনী বলেন, মেয়েটার খুব ডেপথ আছে। এমন মেয়েদের নিজেদের প্রায়োরিটির সঙ্গে জীবনটা মেলে না। সারাজীবন অ্যাডজাস্টমেন্ট। কষ্ট পাওয়াটাই নিয়ম। উপলক্ষ হয়তো কেউ থাকে। কিন্তু তারা বোধ হয় দায়ী নয়। আমি চুপ করে থাকি। মনে মনে পাশে বসা ভদ্রমহিলাকে বলি, ছুটি, ইউ আর গ্রেট। 
আমি যে অপেক্ষা করছিলুম, এমন নয়। কিন্তু পাঁচ-ছ'দিন অনুর থেকে কোনও ফোন না পেয়ে একটু অবাকই হই। মনে হলো, থাক। বোধ হয় নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার পালা চলছে ওর। সেদিন বিকেলদিকে অফিস থেকে বেরোবো বলে তৈরি হচ্ছি, ফোন এলো। 
- বলো.. 
- ফোন করনি কেন? 
- যা বাবা, আমি তো ভাবলুম তুমিই.. 
- কেন? আমিই বা কেন সব সময় আগে ফোন করবো? 
- ঐ যে বলেনা 'লেডিজ ফার্স্ট ... 
- ছিঃ, এত চীপ জোক মেরোনা দয়া করে.. 
- বেশ বলো... 
- কাল বিকেল ছটার সময় একবার ব্যারিস্টায় আসবে? 
- ছটায় বেরোবো কী করে? 
- কাল শনিবার... 
- ওহ, আচ্ছা। কিছু আছে নাকি? 
- আছে, আমার ফিউনারেল... 
- সে কী? সুইসাইড করছো নাকি? 
- অনেকদিন আগেই করেছি। কাল বাকিটা চুকিয়ে দেবো... 
- ধুর, ফ্রেইলটি দাই নেম... 
বঞ্জারা হিলস মেন রোডে শনিবার বিকেলবেলা গাড়ি পার্ক করার জায়গাই থাকে না। সিটি সেন্টার মলের পাতালই ভরসা। গাড়ি রেখে আসতে আসতে মিনিট দশেক দেরি হয়ে গেলো। দেখি আগের দিন ঠিক যেখানে আমরা বসেছিলুম, সেখানেই বসে। দরজার দিকে পিছন ফিরে। কাছে গিয়ে বলি, স্যরি। 
- আজকেও দেরি করলে? 
- হয়ে গেলো। কিন্তু 'আজকেও' শব্দের অর্থ বিশদে কহিও... 
- বলেছি না, আজ আমার ফিউন্যারেল.. 
চুপ করে থাকি। হঠাৎ হেসে ওঠে। 
- মুখটা অমন হয়ে গেলো কেন? বাবুমোশায় অত ভালোবাসা ভালো নয়... 
- এই বলার জন্যই ডেকেছো নাকি? 
- নাহ, ঐ একটু ভূমিকা আর কী... 
- হয়ে গেছে? ভূমিকা? 
- হমম, আমি কাল চলে যাচ্ছি.. 
- মানে.. 
- মানে আপাতত বাড়িতে, দিল্লি... 
- তার পর? 
- আমার আগের ইনস্টিটিউটে ফিরে যাবো এমাসের শেষ দিকে.. 
- মানে, বিদেশে.. 
- হ্যাঁ, লণ্ডনে.. তবে ঠিক নেই। যদ্দূর মনে হয় জ্যুরিখ যেতে হবে... 
- বেশ। তোমার ফেলে আসা সংসার অপেক্ষা করছে সেখানে... 
- আমার সংসার? ও, তুমি আমার এক্স হাজব্যান্ডের কথা বলছো বোধ হয়? নাহ, আমাদের লিগাল সেপারেশন হয়ে গেছে... 
- ওহ, জানতুম না .. 
- তুমি কিছুই জানো না..., ভাবো গায়ে পড়া একটা 'বাচ্চা মেয়ে' ... অলওয়েজ দেয়ার টু এমব্যারাস ইউ, দ্য আদার ওম্যান ... 
- আর কিছু বলবে? 
- স্যরি, অ্যায়াম টকিং ট্যু মাচ ... না 'কাকু' যা বলছি সব মিথ্যে, কিচ্ছু বিশ্বাস কোরো না ... সব মিছে কথা.. সব... 
চুপ করে থাকি। সজল চোখের শুশ্রূষা দিতে শিখিনি কখনও। শুধু সময়ের স্বস্তিটুকুই থাক। শনিবার সন্ধেবেলা কফিশপের উচ্চকিত কোলাহলের মধ্যে নিঃশব্দ একটা চরাচর স্থির হয়ে আছে। 'যেতে পারি, যেকোনও দিকেই আমি চলে যেতে পারি'। যেন ঘড়ির কাঁটার চলনে বাঁধা একটা নিঃশব্দ সংলাপ। শরীরের এক কোণে লুকিয়ে থাকা হৃদপিণ্ডের না শোনা সপ্তম সিম্ফনিতে বাঁধা রাগ ভৈরবি। যে সংলাপ আসা উচিত এই মুহূর্তে, হয়তো গুলজার সাহেবও মজবুর তার সন্ধানে। আমার জন্য স্রেফ আত্মসমর্পণ। সে বড়ো সুখের সময় নয়... 
ঠিক বলা যাবে না মাঝখানে কতটা সময় গোধূলি লগনের মেঘ ঢেকে দিয়ে গেছে। শুধু বুঝতে পারি, মেঘে ভিজে গেছি খুব। সত্যিই খুব ভিজে গেছি। 
গাঢ় বাদামি রঙের টেবিলে সোনালি কোস্টার পাতা। তার উপর অনুর হাত। সুগঠিত আঙুল। মেয়েটা আংটি পরে না। 
- ছুঁতে পারো। বাধা নেই.. 
ঐ ওষ্ঠে যে হাসি তার অর্থ এখনও বুঝি না। হয়তো বুঝি, কিন্তু কে আর হৃদয় খুঁড়ে.. 
- সরিয়ে নেবো? হাতটা? 
- না, আমাকে দাও.. 
কতক্ষণ শব্দহীন, ভুলে গেছি। হঠাৎ হেসে ওঠে পাহাড়ি নদীর মতো, 
- এখন যদি শর্মিলাদি এখানে এসে পড়ে? কী করবে? 
- কিছুই করবো না। বাড়িতে ফোন যাবে একটা, আর কী? 
- তুমি খুব ভাগ্যবান। অমন একজন তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকে... 
- ঠিক বলেছো, আই ডোন্ট ডিজার্ভ হার.. 
- খুব সাজিয়ে কথা বলতে পারো তুমি। কখনও বেঁধে ফেলা যায় না... 
- এমনিতেই বাঁধা থাকি এপার ওপার । আর কত বাঁধবে? 
- এবার যাবো.. 
- হ্যাঁ, চলো ওঠা যাক... 
- একটা গিফট দেবো ভাবলাম তোমাকে। কিছুই পেলাম না.. 
- আমি তো এত কাণ্ড কিছুই জানতুম না। চলে এলুম খালি হাত ... 
- তুমি তো গিফট দিয়েছো আমাকে.. 
- সে কী? কবে? 
- কবিতার বই, তোমার সেই হোলি স্ক্রিপচার , বলিও তাহা ফেরত চাহো কি না? 
- কবে দেখা হচ্ছে আবার? 
- বোধ হয় আর হবে না.. 
- সে কী? নিঠুর রমণী তুমি কি এতই নিষ্ঠুর? 
- যে কথাটা বলার জন্য আজ এসেছি সেটা বলে নিই এবার.. 
- বাপরে, খুব লোডেড ভূমিকা তো.. 
- দ্যাখো, তোমার কথা জানি না। কিন্তু আমি এই গত কয়েকমাসের যা কিছু, সব সঙ্গে নিয়ে যাবো। চোখের দেখা আবার নাও হতে পারে। ম্যাটার করে না। তুমি কী ভাবছো, তাও ম্যাটার করে না... শুধু জানিয়ে রাখলাম... যদি কিছু নাও বলো, তাও কিছু আসে যায় না.. তোমার একটা টুকরো আমার সঙ্গে থেকে যাবে... 
- ভালো থেকো, সাবধানে থেকো... 
- আসি, টা টা... 
- এসো..

0 comments: