0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




সোয়ানার রহস্যময় মানুষ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 
১৯ 
ফ্রান্সেস্কো লক্ষ্য করলো সোয়ানা কিম্বা আশেপাশের জায়গায় যারা থাকে, তাদের কারো সঙ্গে লোকটির চেহারায় কোনো মিল নেই। তার সুগঠিত শরীর এবং পেশির গড়ন অনেকটা খেলোয়াড় বা দৌড়বিদদের মতো। নীল হ্রদের মত রঙের চোখের দৃষ্টিটা ভীষণ গভীর, অন্তর্ভেদী। চোখের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সেস্কোর হঠাৎ সেন্ট আগাথার শিখরের উপরে উড়ে বেড়ানো অসপ্রে বাজপাখির জোড়ার কথা মনে পড়ে গেলো। কপালের গড়ন চাপা, ঠোঁট পুষ্ট এবং ভেজা ধরণের। হাসি এবং দৃষ্টি দক্ষিণদেশের বাসিন্দাদের মত মাপা ও চাপা ধরণের নয়, বেশ প্রকট। এই সব কিছু খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে, মন্‌টে জেনারাসো পর্বতে এই স্বর্ণকেশ যুবকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফ্রান্সেস্কো মনে মনে এই পাহাড়ি গ্রাম্য মানুষটির সহজ সৌন্দর্যের তারিফ না করে পারলোনা। 
এখানে আসার প্রকৃত কারণ ফ্রান্সেস্কো ঠিক ভেঙে বললো না লোকটিকে। বললো যে অনেক দূরে এক গ্রামে এক মুমূর্ষু মানুষকে ধর্মকথা শোনাতে এসেছিল। তারপরে তার সহকারীকে ছাড়াই রওনা দিয়েছিল। এখন পাহাড়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে সে। একটু বিশ্রাম না করে সঠিক পথে যেতেও পারবে না সে। মেষপালক সরল মানুষটি বিশ্বাস করলো এই মিথ্যা। ঝকঝকে দাঁতের সারি দেখিয়ে হাসলে সে। জ্যাকেট খুলে সেটা আগুনের পাশে ভালোভাবে বিছিয়ে যাজকের বসবার আসন বানিয়ে দিলে। জ্যাকেট খুলে ফেলার পরে তার সুগঠিত কাঁধ এবং কোমর অবধি উন্মুক্ত রোদ্দুরে পোড়া তামাটে বাদামী শরীর দৃশ্যমান হল, কারণ জ্যাকেটের নিচে লোকটির কোনো শার্ট ছিলনা। 
এই সরল প্রকৃতির মানুষটির সঙ্গে বাক্যালাপ শুরু করা খুবই সমস্যার বলে মনে হল ফ্রান্সেস্কোর কাছে। লোকটি নিজেও তরুণ যাজকের সামনে অপ্রস্তুত বোধ করছিল। হাঁটু গেড়ে আগুনের সামনে বসে কাঠকুটো দিয়ে উস্কে দিচ্ছিল আগুনটা একটু পর পর, রান্নার পাত্রের ঢাকা খুলে দেখছিল এবং দুর্বোধ্য পাহাড়ি ভাষায় এক দুটো কথা বলবার চেষ্টা করছিল। এইসব করতে করতে হঠাৎ উচ্ছল একটা সুরেলা আওয়াজ লোকটা পাহাড়ের উপত্যকায় ভাসিয়ে দিলো। আওয়াজটা জেনারাসো পর্বতের ঢালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এলো। 
প্রতিধ্বনিটা মিলিয়ে যাবার আগেই জোর হাসাহাসি, চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা গেলো। মনে হল যেন কারা এদিকেই আসছে। অনেকগুলো কণ্ঠস্বর, শিশুদের গলা, তার মধ্যে একজন নারীর কণ্ঠ, সে হেসে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে, আবার ক্ষণে ক্ষণে সাহায্য চাইছে। সেই নারীর কণ্ঠস্বর শুনে ফ্রান্সেস্কোর হঠাৎ মনে হল যে তার অবশ হয়ে যাওয়া হাতে পায়ে সাড় ফিরে আসছে। প্রাণের অদ্ভুত রহস্য যেন তার আপন সত্তার মাঝে ইন্দ্রজালের খেলা দেখাচ্ছে। অন্তরে সে দগ্ধ হতে লাগলো, যদিও বাইরে সেই ভাব প্রকাশ পেলোনা। সে যেন একইসঙ্গে মুক্তির আনন্দে এবং এক অদৃশ্য বন্ধনে জড়িয়ে যেতে লাগলো। 
ইতিমধ্যে, সেই নারীকণ্ঠের হাস্যরোলের সঙ্গে উদ্ধার করবার জন্য ডাকাডাকির আওয়াজ কাছাকাছি এগিয়ে আসতে লাগলো। সামনের খাড়াই নিচের ঢাল বেয়ে উঠে এলো সেই দুরন্ত ঝাঁকড়া লোমশ রামছাগলটি। সেই যে, সেই প্রাণীটি যে পাহাড়ি পথে একদিন ফ্রান্সেস্কোকে নাকাল করে ছেড়েছিল। তার পেছন পেছন এলো ছাগল- ভেড়ার বড় একটা দল। সেই কন্যা এলো সেই প্রাণীর পিঠে বসে, তার বাঁকানো শিং ধরে। হয়তো নিছক মজা করতে গিয়েই তার পিঠে চড়ে বসেছে সে। এখন আর নামতে পারছেনা। প্রাণীটির গলা জড়িয়ে ধরে পেছনদিকে বেঁকে যাচ্ছে সে, কিন্তু কিছুতেই বাগে এনে থামাতে পারছেনা দুরন্ত প্রাণীটিকে। সে যে ঠিকভাবে তার পিঠে বসতে পারছে, এমনও নয়; তার জুতোবিহীন খালি পা ভূমি স্পর্শ করে আছে। প্রাণীটিকে সামলাতে বিশেষ চেষ্টা করে যাচ্ছে সে; তা করতে গিয়ে তার পোশাকের ঢিলে ব্লাউজের গলার সীমানা নেমে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে তার পুষ্ট স্কন্ধ, আভাস পাওয়া যাচ্ছে বক্ষের বিভাজিকার। তার কেশরাশি হাওয়ায় উড়ছে বন্ধনবিহীন। তার স্কার্টের ঝুল সরে গিয়ে পায়ের গোছ, হাঁটু অবধি দৃশ্যমান হচ্ছে। 
সেই কন্যা সামনাসামনি আসবার বেশ কিছু আগে থেকেই ফ্রান্সেস্কো বুঝতে পেরেছিলো যে ছাগল–ভেড়ার দলের সঙ্গে কে আসছে! দূর থেকেই শোনা গিয়েছিল তার কণ্ঠস্বর। কন্যার হাসি, চিৎকারের শব্দ, হাত-পায়ের অনিচ্ছাকৃত আন্দোলন, উড়ন্ত উন্মুক্ত কেশরাশি, হাঁ হয়ে যাওয়া খোলা ঠোঁট, বুকের ওঠাপড়া- সব মিলিয়ে তাকে একদম আলাদা এক মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। গোলাপি আভায় ঢেকে গিয়েছিল তার মুখ, প্রগাঢ় উচ্ছ্বাসে উজ্জ্বল ছিল তার চোখ। সব মিলিয়ে তাকে অপরূপ দেখাচ্ছিল। তড়িৎগতিতে সে সরে যাওয়া পোশাকের প্রান্ত স্বস্থানে ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করছিল। 
ফ্রান্সেস্কো কোনো কথা বলতে পারছিলনা। সম্পূর্ণ দৃশ্যপট তাকে যেন একদম বিবশ, অসাড় করে দিচ্ছিল। তার কাছে সেই কন্যার উপস্থিতি এত সুন্দর বলে মনে হয়েছিল যে - প্রাণীকে বশীভূত করে তার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর সঙ্গে যে ডাকিনীতন্ত্রের বিন্দুমাত্র কোনো সংযোগ থাকতে পারে, সে কথা ঘুণাক্ষরেও তার মনে হয়নি। পরিবর্তে, নানারকম ছবি জেগে উঠেছিল তার মনে। মর্মরের মূর্তি খোদাই করা সারকোফাগাস, যা পাহাড়ি ঝর্ণার জলে টইটম্বুর থাকে, সোয়ানার গ্রামের চৌকোনা মোড়ের মাঠ, তার কাকা, বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা ছবির মূর্তি– এসব নানা ছবি ভেসে আসছিল তার মনে। সারকোফাগাসের পাথরের খোদাই করা মূর্তিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠতে লাগলো তার সামনে। নেকড়ে টেনে নিয়ে যাওয়া রথ, নেচে নেচে যাওয়া স্যাটিয়ারের মূর্তি, বাঁশিওয়ালা, ঈশ্বরভক্ত নর্তকীর দল- সব ছবি মনে পড়তে লাগলো তার। মনে হল যেন সেই দলের মধ্য থেকেই এই কন্যে এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। 
ফ্রান্সেস্কোকে আগাথা প্রথমে লক্ষ্য করেনি, কিন্তু রামছাগলটি তরুণ যাজককে সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পেরেছিলো। কাজেই সেখানে এসে সে সবার আগে ফ্রান্সেস্কোর কোলের উপরে সামনের দুই পায়ের ক্ষুর অবলীলায় তুলে দিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালো। সে স্থির হয়ে দাঁড়ানোর ফলেই অবশেষে আগাথা তার পিঠ থেকে ধীরেসুস্থে নামতে সক্ষম হল। আগাথা যখন টের পেলো যে সেখানে একজন আগন্তুক রয়েছে, এবং যখন দেখল যে সেই আগন্তুক তরুণ যাজক ছাড়া আর কেউ নয়, তার মুখের হাসি এবং উচ্ছলতা মুহূর্তে নিভে গেলো; পরিবর্তে মুখে দেখা দিলো এক অদ্ভুত কাঠিন্য এবং উদ্ধতভাব। 
-‘তুমি আজ গির্জায় এলেনা কেন?’- ফ্রান্সেস্কোর ফ্যাকাসে মুখ এবং কণ্ঠস্বরে এমন একটা অভিব্যক্তি ছিল যে আপাতদৃষ্টিতে তাকে ক্রোধ ছাড়া আর কিছু বলা যাবেনা; যদিও তরুণ যাজকের মনের প্রকৃত অবস্থা ছিল অত্যন্ত জটিল। তার অন্তরের উত্তেজনা লুকোতে চাইছিল সে। অপ্রস্তুত মনে হচ্ছিল নিজেকে। তার পুরোহিত সত্তা ক্রুদ্ধ হয়েছিল নিঃসন্দেহে। তার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ দেখে মেষপালক ফিরে তাকালো; গোলাপি আভার ঔজ্জ্বল্য মিলিয়ে গিয়ে এক হতাশা এবং লজ্জার বিবর্ণতায় সেই কন্যার মুখমণ্ডল ঢেকে গেলো। 
আগাথাকে শব্দবাণে বিদ্ধ করে ফ্রান্সেস্কোর অদ্ভুত তৃপ্তি হচ্ছিল। যদিও সে জানে যে এই শব্দগুলি তার আত্মার অন্তঃস্থলের বাণী নয়; তার মর্মরশুভ্র কপালের শিরা ফুলে উঠছিল কথার অভিঘাতে এবং সেই কথার মধ্য দিয়েই সে যেন মুক্তির আনন্দ অনুভব করছিল। জীবনের গভীরতম প্রয়োজন যেন সেই মুহূর্তে তার কথার মধ্যে প্রাণ পেয়েছিল, তার অনুরাগ রূপান্তরিত হয়েছিল পুঞ্জীভূত রাগে, তার অন্তরাত্মা যে কী সাঙ্ঘাতিক নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছিল, সেই সব কষ্ট যেন স্বর্গীয় আলোতে সিক্ত হয়ে উঠেছিল। তার ধিকিধিকি ছাইচাপা ক্রোধের আগুন অবশেষে প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে দাউদাউ জ্বলে উঠল। সে নিজেও বুঝতে পারছিল যে সে অদ্ভুত মরিয়া আচরণ করছে, কিন্তু এই দুর্বলতাকে ঐমুহূর্তে তার ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে মনে হচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল যে এই ক্রোধের সেতু অতিক্রম না করলে সে কোনোদিন আনন্দের ভূমিতে পৌঁছাতে পারবেনা। সে প্রেমের ঐন্দ্রজালিক যাদুবৃত্তের কেন্দ্রের এতখানি কাছাকাছি চলে এসেছিল যে প্রিয় মানুষের উপস্থিতি তাকে বিহ্বল করে তুলেছিল, পরিণামের ভয়াবহতা নিয়ে সে বিন্দুমাত্র ভাবিত ছিলনা। 
তরুণ যাজক ইতিমধ্যে সচেতনভাবেই অনুভব করেছিল নিজের আমূল পরিবর্তন। আপন সত্তার প্রতিফলন নগ্নভাবে দেখতে পেলো ফ্রান্সেস্কো। সে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল পার্বত্য পথে, কতকটা আগাথার চিন্তায় মগ্ন হয়েই সে এলোমেলোভাবে ঘুরছিল এবং অবশেষে আগাথাকে খুঁজে বের করে তার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ- এই কর্মসূচী সম্পূর্ণভাবে গির্জার অনুশাসন- বহির্ভূত। গির্জায় ধর্মীয় কাজের সঙ্গে এর কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই। সে শুধুই পাহাড়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে, ব্যাপারটা এত সহজ নয়। তার নিজের কাজের দিশাও যেন সে হারিয়ে ফেলেছে। নিজেকে পথভ্রষ্ট মানুষ বলেও মনে হচ্ছিলো না তার, মনে হচ্ছিল সে যেন উচ্চতা থেকে পড়তে থাকা একটা পাথরের নুড়ি কিম্বা জলের ফোঁটা, অথবা যেন ঝড়ের আগে উড়ে যাওয়া খড়কুটো। 
-------------------------------- 
(চলবে) 
গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা 


0 comments: