প্রবন্ধ - সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধভূমধ্যসাগরের বুকে ক্যালিফোর্নিয়া শহরের কিছু দূরে আছে এক দ্বীপপুঞ্জ, যার পোশাকি নাম ‘চ্যানেল আইল্যান্ডস’। মাত্র আটটি দ্বীপের সমষ্টি। কেউ চাইলেও আজ এখানে যেতে পারবেন না কারণ মার্কিন নৌসেনা এই দ্বীপপুঞ্জকে ব্যবহার করে সেনা প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র পরীক্ষার কাজে। মার্কিন আদমশুমারি অনুযায়ী এ দ্বীপে কোনও স্থায়ী বাসিন্দা নেই। থাকেন শুধু শ’দুয়েক সেনা ও আধা সেনা লোকজন।
এই দ্বীপপুঞ্জের এক ধারে আছে এক দ্বীপ, যার নাম সান নিকোলাস। আজ কেউ না থাকলেও এক দিন এখানে থাকতেন আদিবাসী সম্প্রদায়, দ্বীপের নামে যাদের নাম হয়েছিল নিকোলিনো। আর অন্যান্য দ্বীপে যারা থাকতেন তাঁদের নাম ছিল চুমাস ও টংভা। এঁরা এখানে বাস করেছেন দশ হাজার বছর বা তার বেশি সময় ধরে। আজ আর কোনও নিকোলিনো বেঁচে নেই।
নিকোলিনোরা তাঁদের নাম যে নিকোলিনো সে কথা জানতেন কি না বলা কঠিন। ১৫৪০ সালে স্পেনীয় কাপ্তান কাব্রিলো এই দ্বীপ আবিষ্কার করেন। সান নিকোলাস নামটা তাঁরই দেওয়া। কয়েক হাজার বছর ধরে এই দ্বীপসমূহের অধিবাসীরা সুখে দুঃখে নিজেদের মতোই ছিল। বাকি পৃথিবীর সঙ্গে কোনও যোগাযোগই ছিল না তাঁদের। যোগ ছিল না তথাকথিত ইউরোপীয় বা অন্য কোনও সভ্যতার সঙ্গে। আঠেরোশো শতকের শেষ ভাগে শুরু হল সেই যোগাযোগ যা অচিরেই দুর্যোগে পরিণত হল ১৮১৪ সালে। এই দ্বীপে পাওয়া যেত প্রচুর ভোঁদড় ও সিল, ফার ও চামড়ার জন্য যা শিকারিদের কাছে লোভনীয়। রাশিয়ার জার প্রথম পল-এর পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হল ‘রুশ মার্কিন কোম্পানি’, তারা পাড়ি জমাতে লাগল সান নিকোলানোতে। রফা হল, নিকোলিনোরা সিল আর ভোঁদড় শিকার করে চামড়া ছাড়িয়ে দেবে তাদের। কিছু কাল চলেও ছিল সে ব্যবসা, তার পর লাগল গোলমাল। প্রথমে বচসা, তার পর এক অসম যুদ্ধ তিরধনুক ও মাস্কটের। বলা বাহুল্য, দাঁড়াতেই পারল না নিকোলিনোরা। দশ হাজার বছর ধরে যাঁদের এখানে বাস, তাঁদের বড়জোর দশ-বিশ জন বেঁচে রইল।
এর পর কুড়ি বছর কেটে গিয়েছে। মূল মার্কিন ভূখণ্ডের শাসনভার মেক্সিকানদের হাত-ফেরতা চলে এসেছে আমেরিকানদের হাতে। ১৮৩৫ সালে সিদ্ধান্ত হল, যে ক’জন নিকোলিনো তখনও বেঁচেবর্তে আছেন তাঁদের নিয়ে আসা হবে মূল ভূখণ্ডে। জাহাজ চলল। নিকোলিনোদের জড়ো করা হল সমুদ্রসৈকতে, তার পর তোলা হল জাহাজে। সেদিন প্রকৃতি একেবারেই বিরূপ, ঝড় উঠতে পারে যে কোনও মুহূর্তে, ক্যাপ্টেন চার্লস হুবার্ড ক্রমাগত তাড়া লাগাচ্ছেন। চিরকালের বাসভূমি চিরতরে ছেড়ে জাহাজে উঠলেন অধিবাসীরা। জাহাজ সবে চলতে আরম্ভ করেছে, তখন ঘটল এক সাংঘাতিক ঘটনা। এক নিকোলিনো যুবতী জাহাজ থেকে জলে দিল ঝাঁপ, আর সেই উত্তাল হয়ে ওঠা সমুদ্রে সাঁতরে চলল সদ্য ছেড়ে আসা দ্বীপের দিকে। লোকে বলে, সে জাহাজে উঠে দেখেছিল তার সন্তান সেখানে নেই, তাই এই দুঃসাহসিক কাজ। ঝড় উঠছে, কাজেই এক জনের জন্য জাহাজ থামানো ঠিক নয় বলে সিদ্ধান্ত নিলেন কাপ্তেন।
নিকোলিনোরা কিন্তু ‘সভ্য’ সভ্যতায় এসে বাঁচলেন না। যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান নিকোলিনো নারী-পুরুষেরা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেন। তখন সবার খেয়াল হল সেই মেয়েটির কথা। সে যদি বেঁচে গিয়ে থাকে আর সাঁতরে দ্বীপে উঠতে পেরে থাকে, তা হলে সে-ই তো এই গোটা জাতির একমাত্র জীবিত প্রতিনিধি। অতএব খোঁজ লাগাও। সেই বাজারে একশো ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে, বলে এক জনকে পাঠানো হল। সে ফিরে এল, মেয়েটিকে খুঁজে পায়নি। কিছু বছর পর আর-এক জন গেলেন, তাঁকে কবুল করা হয়েছে দুশো ডলার। কিন্তু তাঁর ভাগ্যেও শিকে ছিঁড়ল না। এঁদের কথায় উৎসাহিত জর্জ নিডেভার নামে এক ব্যক্তি চললেন সেই নাম না-জানা নিকোলিনো মহিলার খোঁজে।
দ্বীপে পৌঁছে নিডেভারের নজরে এল সিলের চামড়া, যত্ন করে কেটে শুকোতে দেয়া হয়েছে। দেখতে পেলেন পায়ের ছাপ। তার পর পেলেন এক অদ্ভুত আস্তানার সন্ধান। তিমির পাঁজরার হাড় দিয়ে তৈরি সে বাড়ি। তার সামনে বসে মাছের ছাল ছাড়াচ্ছেন এক মহিলা, যার বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। পাখির পালক শুকিয়ে তা গেঁথে জামা তৈরি করে পরেছেন তিনি। এই সেই জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়া সেদিনের তরুণী। ইতিমধ্যে কেটে গিয়েছে আঠেরো বছর। না, সন্তানকে তিনি বাঁচাতে পারেননি। এরই মধ্যে কোন সময়ে সে মারা গিয়েছে, হয়তো বন্য কুকুরের আক্রমণে, বা অন্য কিছুতে। নিজের হাতেই তার দেহ সমাহিত করেছেন মা, সেটাই ওঁদের প্রথা। তার পর একা বাস করছেন এতগুলো বছর। ঝড় উঠলে তা থেকে বাঁচার রাস্তা খুঁজে নিয়েছেন, আবিষ্কার করেছেন এক গুহা। আর সেই গল্পের মতো কোনও ‘ফ্রাইডে’ কিন্তু তাঁকে সঙ্গ দিতে আসেনি।
এত দিন পরে একজন মানুষ— তাও আবার অন্য সম্প্রদায়ের— দেখে মহিলা কিন্তু রেগে ওঠেননি। ভয় পাননি। সুন্দর করে হেসেছেন। এমনকি কিছুটা মাছ কেটে খাবার জন্য এগিয়েও দিয়েছেন অতিথিকে। কেউ কারও ভাষা বোঝেন না। আকারে-ইঙ্গিতে তাঁকে বোঝানো হল, জাহাজে করে তাঁকে নিয়ে আসা হবে। তাতেও তাঁর কোনও আপত্তি নেই। মহিলা চলে এলেন সান্টা বারবারা মিশন-এ। কিন্তু কে তাঁর ভাষা বুঝবে? আগে যে নিকোলিনোদের আনা হয়েছিল তাঁরা তো মারা পড়েছেন সভ্যতার সংস্পর্শে এসেই। কাছের দ্বীপ চুমাস ও টংভা দ্বীপের লোক এনে লাভ হল না। কেউ বোঝে না এই মহিলার ভাষা।
এত কাল একা থেকেছেন, সন্তানকে হারিয়েছেন, কিন্তু মহিলা অত্যন্ত প্রাণোচ্ছল। নিজের ভাষাতে গান করেন। নাচেন। তাঁকে দেখতে ভিড় করেন বহু মানুষ। নিডেভার নিজের বাড়িতেই রাখলেন তাঁকে। তার সেই গানের নাম হল ‘টোকি টোকি’ গান। মানে বোঝেন না কেউ, কিন্তু মুখে মুখে ফিরতে লাগল সেই গান। ‘টোকি টোকি ইয়াহামিমেনা/ ওয়েলেশকিমা নিশুইয়া হামিনা/ টোকি টোকি...’ মহিলা মাঝে মাঝে ঘুরে চারদিক দেখেন। কখনও ঘোড়া দেখেননি, বিস্ময় প্রকাশ করেন। ভাষা না থাকলেও হাসিতে আর আচরণে সবার তিনি প্রিয়পাত্রী হয়ে উঠলেন।
মাত্র সাত সপ্তাহ। অসুস্থ হয়ে পড়লেন মহিলা। আঠেরো বছর ঝড়ঝঞ্ঝায় একা কাটিয়ে যিনি ছিলেন স্বাস্থ্যবতী, তথাকথিত সভ্য সমাজে এসে তিনি ভয়ানক ডিসেন্ট্রির শিকার হলেন। মহিলা যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন ফাদার সাঞ্চেজ তাঁকে ব্যাপ্টাইজ করে নাম রাখলেন জুয়ানা মারিয়া। সভ্যতা তাঁকে কিছুই দেয়নি, বরঞ্চ নষ্ট করে দিয়েছে তাঁর জীবন, তাঁর প্রিয় সব মানুষকে। শেষ সময়ে তাঁকে শুধু একটা নাম দেয়া হল। তার আসল নাম কী ছিল, কেউ জানল না। বহু হাজার বছর ধরে যাঁরা পৃথিবীর বুকে চলেফিরে বেড়িয়েছিলেন তাঁদের শেষ প্রতিনিধি চলে গেলেন। সভ্যতা তাঁকে কিছুই দেয়নি অকালমৃত্যু ছাড়া, তিনি পৃথিবীকে দিয়ে গেলেন বাঁচার ইচ্ছার এক অতুলনীয় কাহিনি। সান্টা বারবারার সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত করা হল তাঁকে।
ক্যলিফোর্নিয়ার সান্টা বারবারাতে রাস্তার ধারে জুয়ানার মূর্তি আছে সন্তান কোলে।
এর অনেক পরে, ১৯৩৯ সালে এক অভিযাত্রী দল গিয়ে দেখেছে, তখনও দাঁড়িয়ে আছে সেই তিমির পাঁজরের হাড়ে তৈরি কুটির। আর মাত্র বছর আটেক আগে, ২০১২ সালে আবিষ্কার হয়েছে সেই গুহা, যা মহিলাকে বাঁচাত সামুদ্রিক ঝড়ের হাত থেকে। তবে এক দিন হয়তো মার্কিন নৌবাহিনীর মারণাস্ত্র পরীক্ষার সময়ে সে গুহা ধ্বংস হয়ে যাবে। হয়তো বা গিয়েছে এর মধ্যেই।
শহুরে মানুষের একটা অভ্যাস আছে এটা ভাবা যে প্রকৃতির কোলে যাঁরা থাকেন তাঁদের কাছে না যাওয়াই ভাল, তাঁরা রোগের আকর ইত্যাদি। প্রথম সেই বিশ জন নিকোলিনো ও পরে জুয়ানা মারিয়ার পরিণতি কিন্তু এ বিশ্বাসে প্রশ্ন তুলে দেয়। সভ্যতা কি নিরাপদ, না কি বেশি নিরাপদে আছেন তাঁরাই যাঁরা নগরসভ্যতার থেকে অনেক অনেক দূরে জীবনকে সাপ্টে বাঁচছেন, ‘তাজা মাছ যারা টেনে তোলেন ডাঙায়’? প্রশ্নটা আরও বেশি করে ওঠে আজ, যখন সারা বিশ্ব, বিশেষত তথাকথিত প্রথম বিশ্ব এক মহামারির আঘাতে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে।
0 comments: