0

প্রবন্ধ - অভীক কুমার চৌধুরী

Posted in












["সময় কখন যে থমকে দাঁড়ালো কালবোশেখীর মাসে"/ সজারুর কাঁটা, ১৯৭২/ আর তাই খুব নিঃশব্দে আড়ম্বরহীন চলে গেলো ১৬ জুন ২০২০I একশো বছর পেরিয়ে আজও "সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা "হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বিশ্বব্যাপী আপামর সংগীতপ্রেমীর কাছে গানের ঈশ্বর -- "তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী"... তাঁর ই গানে উদ্বেলিত হয়েছে কত শত মানুষের জীবন, এমনই একজনকে (নাম পরিবর্তিত) নিয়ে কল্পনা ও বাস্তবের রংতুলিতে আমার এ লেখা এক একনিষ্ঠ হেমন্ত অনুরাগী স্মরণে ও একই সঙ্গে গানের ঈশ্বরকে শ্রদ্ধাঞ্জলি |]
"আমার আর হবে না দেরি", পাড়ার ফাংশানে শুনেছিলাম, আমার বন্ধু তপনের সঙ্গে তখন আমরা নেহাতই কিশোর| অবাক বিস্ময়ে দেখছিলাম সাদা ধুতি, শার্ট পরিহিত দীর্ঘদেহী, সৌমকান্তি এক মধ্যবয়সি ভদ্রলোক, মনে হোল অবিকল সেই গলায় গাইছেন| হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এসেছেন আমাদের পাড়ায়? তখনো ওনার গান সামনাসামনি শুনিনি, বাড়িতে রেডিওতে যা শুনতাম| আমি বিস্ময়ে হতবাক| একের পর এক গান শোনাচ্ছেন," শোন্ কোন একদিন" "আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা", "পথ হারাবো বলেই এবার", "আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা", "ঠিকানা আমার চেয়েছো বন্ধু", "একগোছা রজনীগন্ধা হাতে নিয়ে বললাম", "তোমার চোখের জলে যদি "... বাড়ি ফিরে আসছি , মাইকে ভেসে আসছে ,' ... "যদি পৃথিবীটা সপ্নের দেশ হয় তবে কেমন হতো"...
সেই সেদিন থেকে, এক গানের জাদুকরের মোহময় অলৌকিক, অপার্থিব সব গানের জগতের সন্ধান দিলেন আমায় সেই অনামী গায়ক, যার নাম সুনীল মুখোপাধ্যায় (পদবিতেও আশ্চর্য মিল) তারপরেই এলো সেই উথাল পাতাল সত্তর - একাত্তর সালের দিন| আমাদের স্কুল শেষ করে কলেজে ঢোকার পালা| "পথে এবার নাম সাথী পথেই হবে পথ চেনা'র আবহে শ্রেণী সংগ্রাম চলছে , "প্রত্যহ যারা ঘৃণিত আর পদানত / দেখো আজ তারা সবেগে সমুদ্যত".. উদাত্ত আহ্বান| এরই মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ , উত্তাল হয়ে উঠেছে এপার ওপার, আমাদের শপথ . "মা গো ভাবনা কেন ..", "ও আমার দেশের মাটি .."
একদিন সুযোগ এলো,তপনের সঙ্গে সুনীলদার বাড়ি গেলাম| মন্দিরতলার কাছেই বিশাল বাড়ির দোতলায় ছোট্ট দুটো ঘর, এক চিলতে বারান্দা, আমরা যে ঘরে বসলাম, তাঁর ছোট্ট চৌকিতে হারমোনিয়াম, তবলা, প্রচুর গানের বই| দেয়ালের কোণে তানপুরা, ঠিক ওপরে ফ্রেমে বাঁধানো আমাদের গানের ঈশ্বর আরো ওপরে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ| লেখা-''আমার হৃদয় তোমার আপন হাতে দোলে"|
আর কাঠের তাকে, চৌকির তলায় অজস্র রেকর্ড| শরিকি বাড়িতে এইটুকুই তাঁর বরাদ্দ| সুনীলদা আমাদের গান শোনালেন , "জীবন বলে এ ঘর তুমি ভোল, হৃদয় বলে এ ঘর গড়ে তোল "তারপর শুরু করলেন, "এমন আমি ঘর বেঁধেছি ...", পরের গান "নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশতো বড়....."., "লাজবতী নুপুরের রিনিঝিনিঝিনি " একদম শেষে " তারে বলে দিও, সে যেন আসেনা আমার দ্বারে..."
আমার গানের ঈশ্বরের কাছে কোনদিন যেতে পারিনি কিন্তু তাঁর একনিষ্ঠ সেবকের কাছেই তাঁর গান শুনতে যেতাম তাঁর বাড়ি| নভেম্বরের সন্ধ্যে, একটু ঠাণ্ডা ভাব| হারমোনিয়ামে হাত দিয়ে বসে ছিলে| কেন জানিনা সেদিন সুনীলদার মুডটা কোন কারণে অফ ছিল| কিছু বললেননা তারপর একটাই গান ধরলেন," নীল আকাশের নিচে এই পৃথিবী /আর পৃথিবীর পরে ঐ নীলাকাশ." সেদিন সত্যি ওনার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল, যখন গাইছিলেন, "এই বেদনার ইতিহাস শুনেছ কি ,/ দেখেছো কি মানুষের অশ্রু/ শিশিরে শিশিরে ঝরে"| এই সময়ে এ গান যখনই শুনি নিজের অজান্তে চোখে জল চলে আসে|

কলেজ সোশ্যাল, ইউনিভার্সিটি, রবীন্দ্রসদন আরো কিছু জায়গায় আমি ঈশ্বরের দর্শন পেয়েছি, মোটামুটি সামনে থেকে অনেকবার বেশ কিছু গান শুনেছি| জোয়ান ছয় বেহারার সঙ্গে হুন হুনা করেছি "পালকির গানে"| মনেমনে গলা মিলিয়েছি," আজ সবার মিলন বিনা/ এমন জীবন বৃথা যায়"| ভোর রাতে ঘুমের ঘোরেস্পষ্ট শুনেছি," রানার রানার ভোর তো হয়েছে /আকাশ হয়েছে লাল..." দেখেছি, "শান্ত নদীটির পটে আঁকা ছবিটি" বাড়ি ফিরে আবার কোনদিন ছুটে গেছি সুনীলদার কাছে| আবদার করেছি সুনীলদা আজ বর্ষার দিনে কিছু শোনান| শুরু করেছেন, "মন মোর মেঘের সঙ্গী", "গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিলো তারা .." ," বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল"|| তারপর শোনালেন, "সেদিন নিশীথে বরিষণ শেষে /চাঁদ উঠেছিল বনে" (১৯৪৩) আর শেষে "মেঘ মেদুর বরখারে" (১৯৫০)| শেষ গানটা ঠিক মনেও ছিলোনা, গুগল সার্চ করে পেলাম| সত্যি বলতে কি আমরা খুব হতাশ হয়েছিলাম, আমরা চেয়েছিলাম "এই মেঘলা দিনে একলা" কিংবা রবীন্দ্র সংগীত "এমন দিনে তারে বলা যায়.."| তবে একবার বর্ষণসিক্ত সন্ধ্যায় স্বয়ং ঈশ্বরের কন্ঠে শুনেছিলাম, "ওগো মেঘ তুমি উড়ে যাও কোন ঠিকানায়"| আহা কি আকুতি , কি বেদনা কথায়, সুরে, গায়কীতে | 
তারপর দিন কেটে যায়| সময় পেলেই গান শুনেছি, গানের ঈশ্বরের কন্ঠে কত সুন্দর, কত বেদনার, কত আনন্দের চিত্রিত দৃশ্যপটে বিভোর হয়েছি, আজও যেমন করে অভিভূত হয়ে যাই বারবার প্রতিবার---"কত রাগিণীর ভুল ভাঙাতে" "অনেক অরণ্য পার হয়ে", "সূর্য ডোবার পালা আসে যদি" "পথের ক্লান্তি ভুলে" "অলির কথা শুনে" "কোনোদিন বলাকারা অত দূরে যেত কি /ঐ আকাশ না থাকলে?",
দেখতে দেখতে দিন যায় দিন আসে|
একদিন সুযোগ আসে, চাকরি পেয়ে হাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে সুনীলদার কাছে যাই, প্রণাম করি| সুনীলদার খুশি আর ধরে না, আজ অভীকের অনারে বিশেষ কিছু গান| শোন্ অনুভব করো, -- সুনীলদা শ্রদ্ধায় কপালে হাত ছোঁয়ালেন| হারমোনিয়ামে হাত রাখা কিন্তু চোখ কোন সুদূরে| ধরো ওই লাইনটা, "তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো"-- একলাইন গাইলেন| আবার ধরলেন এক দু লাইন করে অনেক গান, "আরো ভালো হোত যদি তুমি আর আমি", "..ছিল ভাবে ভরা দুটি আঁখি চঞ্চল" , "মনের জানালা ধরে উঁকি দিয়ে গেছে ..", "ও দুটি আঁখি যেন", "রাগ যে তোমার মিষ্টি আরো" "কেন দূরে থাকো /শুধু আড়াল রাখো..", "বসে আছি পথ চেয়ে...", "ভোরের আলোয় পড়লো তোমায় মনে", "সেদিন তোমায় দেখেছিলাম ভোরবেলায়" ,"আর কত রহিব শুধু পথ চেয়ে", "তোমার মাঝে পেলাম খুঁজে আমার পরিচয়" "তোমায় আমায় মিলে বাঁধবো যেথা ঘর"... আর শেষে "কথা কোয়নাকো শুধু শোনো"
...সব মনে নেই... 

আবার নানারকম কাজে মেতে উঠি, সুনীলদার কাছে যাওয়া হয়না |
তপন একদিন বললো, চল, সুনীলদা ডেকেছে তোকে| কেন রে? তা জানিনা তুই চলতো|
---তুমি গল্প লেখো অভীক? বানিয়ে বানিয়ে বেশ প্রেমের গল্প লিখেছো| আমায় লিয়ে লিখবে নাকি?
"পুরানো সেই দিনের কথা" বুঝলে, অফিসে এক জলসায় শুনিয়েছিলাম," কোন পাখি ধরা দিতে চায় / অসীম আকাশ ফেলে সোনার খাঁচায়", "তোমার আমার কারো মুখে কথা নেই", "বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা", "ও দুটি আঁখি যেন", "অমন ডাগর ডাগর চোখে কেন" আর "মেঘ কালো আধার কালো" এই ছ'টি গান| একজনের অনুরোধে "কোন পাখি ধরা দিতে চায়" গানটি শেষে আবার| কিছুদিন পরে অফিস থেকে বেরোচ্ছি, সোজাসুজি সেই একজন আমার সামনে এসে বললো, আমিই সেই পাখি| আমি ঘাবড়ে গেলাম, মানে? 
সেই তন্বী তরুণী বললো, আমার নাম পাখি, আমি ধরা দিতে চাই অসীম আকাশ ছেড়ে সোনার খাঁচায়...
সর্বনাশ, বলে কি| মুখে বললাম, "তুমি কি যে বলো বুঝিনা"| বলা হয়নি, "জানিনা কখন তুমি আমার চোখে" ...
"চোখে যদি জল করে টলমল" , আমি দেখলাম, "তুমি চলে গেলে" , "যাবার আগে কিছু বলে গেলে না"
তারপর?
সুনীলদা হারমোনিয়াম টেনে নিলেন," তার আর পর নেই, নেই কোন ঠিকানা"
সম্ভব ছিলোনা ভায়া, সরকারি অফিসের পিওন | 
দেনা করে নিজের গানের রেকর্ড করেছিলাম, কেউ কেনেনি| হেমন্ত বাবু আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন| আমি অন্য কারো গান কোনদিন গাইতে পারবো না, ওনার গান করি বলে তবু দুটো খেতে পাই|
আর কিছুনা সেদিন বলে ফিরে এসেছিলাম, তারপরেও কিছুদিন ওনার বাড়ি গেছি| ওনার মুখে শোনা বেশ কিছু গান একটু সাজিয়ে নিলাম, "সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক বেশ তো" "এ জীবন বেশ চলছে", ভাবি "যায় দিন এমনি যদি যায় যাক না", তবু "কে জানে ক'ঘন্টা পাবিরে জীবনটা", দেখো, "সবাই চলে গেছে" একদিন  "আমিও পথের মত হারিয়ে যাবো" "ফেরানো যাবে না আর"| "যদি জানতে চাও" "ঘুম নেই কেন চোখে", জানি "এই যে পথের দেখা পথেই শেষ হবে" তবু "বসে আছি পথ চেয়ে" যদিও "আজ দুজনার দুটি পথ গেছে বেঁকে" কিন্তু "আজও হৃদয় আমার পথ চেয়ে দিন গোনে"| আসলে "এ ব্যাথা কি যে ব্যাথা বোঝে তা আনজনে"| 
শেষবার সুনীলদার সঙ্গে দেখা ১৯৮৯ সালের শেষ দিকে, দেখলাম প্রচণ্ড ঝড়ে বিদ্ধস্ত চেহারা , কোন গান নয়, যেন বলছেন, "যে বাঁশি ভেঙে গেছে", "সাক্ষী থাকুক ঝরাপাতা" "স্মরণের এই বালুকাবেলায়" "হিসাব মিলাতে গিয়ে দেখি", "মুছে যাওয়া দিনগুলি", "আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে"| "নিঝুম সন্ধ্যায়" "শূন্যে ডানা মেলে পাখিরা উড়ে গেলে" "পৃথিবীর গান আকাশ কি মনে রাখে"? 
"ঝাপসা হয়ে আসছে ক্রমে" 'ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলি', না, সুনীলদার গল্প কোনদিন শেষ হবে না| প্রতিদিন দেখি "নতুন নতুন রং ধরেছে সোনার পৃথিবীতে", দিগন্তে ভাসে সুর, "মালতী ভ্রমরে করে ওই কানাকানি" "আমি গান শোনাবো একটি আশা নিয়ে" "আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে "| "জীবনপুরের পথিক " মনে করায় "বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও "|
প্রতিদিন প্রতিক্ষণ অসংখ্য শব্দের মাঝে শুনি সেই স্বর্ণকণ্ঠ" এমন কিছু শব্দ দিতে পারো, যাতে কোন শব্দ নেই, স্তব্ধ আমি, শব্দে শব্দে ক্লান্ত, শিশির ঝরার শব্দ...,কুঁড়ি থেকে ফুলের ফোটার শব্দ... স্মৃতিতে অতীতকে ফিরে পাবার শব্দ"...

0 comments: