ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক৪
রূপেশের ওই চিঠিটা! যেন অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষায় থেকে মনোযোগ হারিয়ে ফেলা স্লিপ ফিল্ডারদের সামনে স্নিক থেকে ছিটকে আসা ক্যাচ! ফার্স্ট স্লিপের হাত ফসকে পড়ে যাওয়ার মুহুর্তে ডাইভ মেরে বলটা মাটি থেকে তুলে নিয়েছে সেকন্ড স্লিপ। উইকেট কিপার থেকে শুরু করে সব ফিল্ডারদের আনন্দ দেখে কে!
বড়বৌদির বাপের বাড়ির ওই তুতো বোনটি যেন ওরই অপেক্ষায় ছিল। হবু শাশুড়ি রূপেশের চিবুকে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে বললেন – কিছু ভেব না বাবা। আমার মেয়ে খুব গুণী; ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লে কি হবে, গাঁয়ে গিয়েও মানিয়ে নিতে পারবে। ওকে আমরা সেভাবেই বড় করেছি। অনেকদিন তো হাত পুড়িয়ে খেয়েছ, এবার তোমার কষ্টের দিন শেষ।
এই যে ম্যানেজার!
রূপেশ চমকে উঠেছে। বাড়ির ছাদে গিয়ে চিলেকোঠার পাশে দুটো ইঁটের উপর বসে একটা সিগ্রেট ধরিয়েছিল, আচমকা অপরিচিত মেয়েলি গলার সম্বোধনে ওর হাত থেকে সিগ্রেট পড়ে যায় ।
এই অভ্যেসটা ওর ছুরিতে থাকার সময়ই বেড়ে যায় , প্রথমদিকে রামনিবাস সঙ্গী হত, পরের দিকে রাজন। বাড়িতে বড়বৌদি জানেন, উনিই বলেছিলেন যব খুব ধুঁয়া পীনে কী তিয়াস হোগী তব ছাত পর চল দেনা দেবরজী। উহাঁ কপড়া সুখানে কে লিয়ে লছমনিয়া ইয়া হম জাতে; অউর কোই নহীঁ।
আজকে দু’পক্ষের কথাবার্তা হবার পর ভেবেছিল ল্যাঠা চুকে গেছে। আসলে ও তো মেয়েদেখার পক্ষপাতী ছিল না । বড়ীভাবীকে বলেছিল—এটা একটা লটারি, আমি টিটি সিরিজ কি এবি সিরিজ দেখে কি বুঝব? আপনার পছন্দ মানে সব ঠিকই আছে।
কিন্তু ভাবী বলেছিলেন—তুমি না দেখ তো চোখ বুজে থেক ; মেয়ে বলেছে ও ছেলে দেখবে। আজকালকার মেয়ে , তায় ইংলিশ মিডিয়াম; বুঝতেই পারছ।
এখন সেই মেয়েটা ছাদে উঠে এসে ওকে এভাবে ডাকছে!
--শোন, অমন হাঁ করে থেকো না । চটপট কাজের কথায় আসি। মেরী জীজী, মতলব তোমার বড়ীভাবী, বলেছেন—দশ মিনিট, তার বেশি নয় । তোমাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আমার কয়েকটি শর্ত আছে । এক, আমি তোমাকে ‘এ জী, ও জী’ করতে পারব না । ডাকব ম্যানেজার বলে, তুমি রাজি?
বেশ; টাকাপয়সা গয়নাগাঁটি নিয়ে আমার খুব একটা মাথাব্যথা নেই। বছরে দু’বার গয়না গড়িয়ে দাও—এসব বায়নাক্কা করব না। কিন্তু একবার কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবে, নইলে ঝগড়া করব। আমার জিভে খুব ধার, পাড়ায় কেউ লাগতে আসেনা।
তিন নম্বর, খাওয়া দাওয়া নিয়ে খুব ঝামেলা হবে না। রাত্তিরে রুটি খাই, ও আমি বানিয়ে নেব। দিনের মধ্যে যতবার চা-কফি বলবে আমি বানিয়ে দেব। কিন্তু বেড-টি তুমি বানাবে। আমার অনেকদিনের ইচ্ছে হাজব্যান্ড সক্কালে চা-বিস্কুট ট্রেতে করে নিয়ে এসে “জাগো, মোহন প্যারে জাগো’ গেয়ে আমার ঘুম ভাঙাবে—অন্ততঃ একটা বছর, ব্যস।
চার, আমি তোমাকে ‘আপ-আপ” করতে পারব না; বড়দের সামনেও না। দুজনেই দুজনকে ‘তুম” বলব, আমরা ভাল বন্ধু হব। বড়রা এ’নিয়ে আপত্তি করলে তুমি আমাকে ডিফেন্ড করবে; করবে তো? ব্যস, হাত মিলাও।
রূপেশ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। মেয়েটার বাড়ানো হাত ও অগ্রাহ্য করতে পারে না। কিন্তু নারীশরীরের অপরিচিত গন্ধে ও অবাক হয় , হাত ছাড়তে ভুলে যায় ।
মেয়েটা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।
এমনসময় নীচের থেকে বড়ী ভাবীর আওয়াজ শোনা যায় – এ নিমকি! নিমকি রে!
মেয়েটা তড়িঘড়ি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সিঁড়ির দিকে ছুট লাগায়—টা-টা।
আরে, মেয়েটির ডাকনাম তাহলে নিমকি! কি গেঁয়ো নাম। বিয়ের পর রূপেশ এসব বদলে দেবে। মানে নিজে ওর একটা প্রাইভেট নাম দেবে, যা আর কেউ জানবে না ।
ও সবাইকে বলেছে আজ একটু তাড়াতাড়ি আসতে।
কাল থেকে ও ছুটিতে যাচ্ছ-- দু’সপ্তাহের জন্যে। রিলিভার সি প্রসন্নাকে ভাল করে চার্জ বুঝিয়ে দেবে। চেয়েছিল তিনসপ্তাহ, কিন্তু এখন পিক সীজন, বছরের টার্গেট পুরো করতে মাত্র দ’'মাস বাকি আর তারপরেই অ্যানুয়াল ক্লোজিং বা বার্ষিক লেখাবন্দী। এ’সময় কাউকেই ছুটি দেওয়া হয় না, মেডিক্যাল গ্রাউন্ড ছাড়া। হেড অফিসে পার্সোন্যাল ম্যানেজার সুরভি সাক্সেনা হেসেই খুন।
--রূপেশ স্যার, হানিমুন তিনমাসের জন্যে পেন্ডিং থাক, নতুন বছরের গোড়ায় বসন্তকালে যাবেন’খন।
প্রসন্না চার্জ বুঝে নিতে ঠিক এগারটায় হাজির। রূপেশ নিজের স্যুটকেস গুছিয়ে কেবিনের একপাশে রেখে দিয়েছে। লাঞ্চের পর এখান থেকেই আলি আহমদ সার্ভিসের বাসে চড়ে চার ঘন্টায় বিলাসপুর। আশি কিলোমিটার পথ, চারঘন্টা একটু বেশি। কিন্তু রাস্তা খারাপ। এমনিতেই গাঁয়ের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া মোরাম ঢালা ফেয়ারওয়েদার রোড, পাকা পিচঢালা হতে আরও দু’বছর। তারপর গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত দৈত্যাকার বিশাল বিশাল ডোজার সমানে গর্জন করে ছুটে চলেছে। প্রায়ই রাস্তা ভেঙে গর্ত তৈরি হয়, বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই।
খোঁড়া হচ্ছে মাটি—বড় একটা লেকের মত এলাকা জুড়ে, তার মধ্যে তৈরি স্লোপ বেয়ে ট্রাক নেমে যাচ্ছে প্রায় ৬০ ফুট নিচে, কয়লা ভরে উঠে আসছে উপরে। এর নাম নাকি ওপেনকাস্ট মাইনিং। এতদিন সবাই জানত মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা এই কালো হীরে তুলে আনতে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে লিফট বেয়ে নিচে নামতে হয়। এমনটা রূপেশ ‘কালা পাত্থর’ সিনেমায় দেখেছে। এখানে যে নতুন টেকনিক, মাটির উপরেই বিরাট কর্মযজ্ঞ। তাই সারাক্ষণ হাওয়ায় একটা ধূলোর আস্তরণ ও কয়লার গুঁড়ো, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
এর মধ্যে নিমকি মানে সরলাকে এনে কোথায় তুলবে? হ্যাঁ, ওর হবু বৌয়ের নাম সরলা শ্রীবাস্তব। কার্ড ছাপা হয়ে বিলি হয়ে গেছে। তবে ওর ক্লার্ক নরেশ আর ফিল্ড অফিসার খান্ডে ভাল পরামর্শ দিয়েছে।
রেললাইনের ওপারে গড়ে উঠেছে লেবার কলোনি, ঘোরাপাট গাঁয়ে। সেখানে জমি হারিয়ে মজদুর বনে যাওয়া অনেক চাষি কোয়ার্টার পেয়েছে। কিন্তু বেশ কিছু নতুন মজুরের দল গাঁয়ের মোহ ছাড়তে পারেনি। ওরা কোয়ার্টারের দরজায় তালা ঝুলিয়ে থাকে গাঁয়ের বাড়িতে—যতদিন না ক্রমশঃ হাঁ করে এগিয়ে আসা কয়লা খাদান ওদের পাড়া অব্দি পৌঁছে গিয়ে বাপ-ঠাকুর্দার সময়ের বাস্তুভিটেটি গিলে নিচ্ছে।অনেকে দল বেঁধে খাদান এরিয়ার বাইরে ভাটা বা পড়তি ঊষর জমিতে মাটির দেয়াল আর খাপরার চাল তুলে নতুন ঘর বানিয়ে নিচ্ছে। এভাবে গড়ে উঠেছে বেদখল কলোনি যাতে নিজেদের ফেলে আসা গাঁয়ের স্মৃতিতে ওরা দুটো খুঁটির গায়ে টিনের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে বড় বড় আঁকাবাঁকা অক্ষরে লিখে দিচ্ছে জনপদের নাম—“নয়া বরপালী” বা “নয়া চারপারা”। সকাল সন্ধ্যে ওদের ঘরের সামনে লোহার পাতে তৈরি কয়লার উনুনে আঁচ পড়ে আর নীলচে ধোঁয়ার কুন্ডলি পাকিয়ে পাকিয়ে আকাশে উঠতে থাকে। এখানে কয়লা ফ্রি—তাই জঙ্গলের চুরি করে কেটে আনা কাঠে উনুন ধরানোর দিন শেষ।
সুন্দর করে গোবর লেপে নিকানো ঘরের মেঝে আর বাইরের দেয়ালে বড় বড় করে স্থানীয় শিল্পীর আঁকা ছবি। নীলকন্ঠ শিবের গোটা শরীর নীল,গলায় জড়ানো ফণাতোলা সাপ, মাটিতে পোঁতা ত্রিশুলের গায়ে বাঁধা ডমরু আর শিঙ্গা, পাশে সাদা রঙের নন্দীষাঁড় শুয়ে শুয়ে অলস চোখে জাবর কাটছে। কোথাও রামসীতা কেবট বা কৈবর্তের নৌকো চড়ে গোদাবরী নদী পার হচ্ছেন। আবার কোথাও একটি লতানো গাছে একটি চারপাপড়ির ফুল, তাকে ঠোকরাচ্ছে একটা বড়সড় টিয়েপাখি।
এখানে বিজলি ফ্রি, তাই যেখানে যেখানে বাঁশের ডগায় করে লাইনটানা সম্ভব হয়েছে সে পাড়ায় অনেকের ঘরে হলদে ষাট পাওয়ারের বাল্ব। বাকি ঘরে এখনও হ্যারিকেন, হ্যাজাকবাতি বা টেমি জ্বলে।
কিন্তু একটা ঘরেও পায়খানা বা সেপ্টিক ল্যাট্রিন নেই। সবাই যায় লোটা হাতে জল নিয়ে মাঠে ঘাটে, সকাল-সন্ধ্যে। হেসে বলে বাড়ির মধ্যে দুর্গন্ধযুক্ত পায়খানা থাকবে –এ কেমন কথা! এসব শহুরে ব্যামো! আর স্নান করে সবাই পুকুরে বা কুয়োর পাড়ে বালতি দিয়ে জল তুলে।
কিন্তু সরলা যে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মেয়ে, আবার ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনে বড় হয়েছে।
খান্ডে আর নরেশ জানায় ওই ঘোরাপাট কলোনির লেবার কোয়ার্টার যারা তালা মেরে রেখেছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাসে একশ’ টাকা নিয়ে ভাড়া খাটাচ্ছে। অনেক স্কুল টিচার বিশেষ করে মহিলারা ওভাবেই আছেন। চারপাড়া গাঁয়ের ডোজার ড্রাইভার চামারসায় থাকে নিউ চারপাড়ায়, আমাদের ডিপোজিটার। জমির ক্ষতিপূরণের টাকা বাঁচিয়ে এক লাখ টাকা এই ব্র্যাঞ্চে ফিক্সড ডিপোজিট করেছে। ও ম্যানেজার সাহাবের ফ্যামিলির জন্যে বিনে পয়সায় দিতে রাজি। কিন্তু আমরা বলেছি আমাদের স্যার ফোকটে নেবেন না। সবার মত মাসে একশ’ টাকা করে দেবেন। দুটো পাকা ঘর, ছোট রান্নাঘর পেছনের পাকা আঙিনা উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে ঘেরা। পাকা বাথরুমের ছাদ নেই, তাতে কি, কাপড় টাঙানোর গজাল পোঁতা আছে। আলাদা সেপ্ট্রিক ল্যাট্রিন। উঁচুতে একটা ঘুলঘুলি। কলের জল চব্বিশঘন্টা ফ্রি, কয়লা ও বিজলি ফ্রি। আর কি চাই?
রূপেশের কিন্তু কিন্তু ভাব দেখে নরেশ বলে ওঠে—এত ভাববেন না স্যার। ওখানে কয়লাখনির হাসপাতাল আছে, তাতে একজন এমডি আর একজন এমবিবিএস ডাক্তার। এছাড়া নার্স, ড্রেসার, ফার্মাসিস্ট। ডক্টর তিওয়ারি আমাকে বলেছেন – ব্যাঙ্কের স্টাফের জন্যে পয়সা লাগবে না। এছাড়া মার্কেট কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে। তাতে চাল-ডাল-ডেইলি নীডস এর দুটো দোকান, একটা মিষ্টির, একটা ওষূধের, একটা গম পেষার কল, একটা দোসা-ইডলি-কফিওলা আন্না রেস্টুরেন্ট –সব খুলে গেছে। আর কলিয়ারির তরফ থেকে ওখানের মাঠে স্ক্রিন টাঙিয়ে মাসে দুটো করে সোমবার সিনেমা দেখায়। ঘর থেকে ফোল্ডিং চেয়ার নিয়ে যেতে হয়। ভাবীজির দিল বহলানে কা কাম হো জায়েগা। নইলে রোববারে ওনাকে নিয়ে যাবেন কোরবা। শপিং করিয়ে আনবেন। আর দুটো পিকনিক স্পট।
সে যাকগে, বিয়ের পর ভাবীজিকে এখানে নিয়ে আসার আগে আপনি নিজে ঘরটা দেখে নেবেন। কোন অসুবিধে হলে আমরা আছি।
প্রসন্নাকে রিজার্ভ ব্যাংকের পেন্ডিং রিটার্ন্সের ফাইলটা খালি ধরিয়েছে এমন সময় চড়া গলায় কথাকাটাকাটি কানে আসায় ওর মেজাজ বিগড়ে গেল।
-- হচ্ছেটা কী?
খান্ডের উত্তেজিত গলাঃ--স্যার, ক্রিমিনাল কন্সপিরেসি! ব্যাংককে চুণা লাগানোর ষড়যন্ত্র; মনে হচ্ছে পুলিশ ডাকতে হবে।
ও প্রদন্নাকে ফাইলটা দেখতে বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে।
হলের এককোণায় মাটিতে উবু হয়ে বসে একটা হাবাগোবা লোক। হেঁটো ধুতি আর নীলরঙা পিরান। মুখে কথা নেই। তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে দুজন নারীপুরুষ। তারা তুমুল ঝগড়া করছে ফিল্ড অফিসার খান্ডের সঙ্গে। মহিলাটির মুখের সঙ্গে উত্তেজিত হাতনাড়া দেখার মত।
--ক্যা হুয়া? ইতনা চিঁ-পোঁ কাহে? ইয়ে ব্যাংক হ্যায়, কোঈ মছলীবাজার নহীঁ হ্যায়। আরামসে বাত করো। হম সুনেঙ্গে।
--সাহাব, আপকে ইয়ে আদমী হম লা ঠগ কহিস, মোর আদমী লা চোর কহিস। এ কোঈ তরীকা হ্যায়?
খান্ডেও সমান উত্তেজিত। বলে - চোরকে চোর বলব না?
সবাইকে চুপ করিয়ে রূপেশ বলে—সবার কথা শুনব, কিন্তু এক এক করে। আমি যাকে জিজ্ঞেস করব শুধু সে কথা বলবে; ঠিক আছে? আগে খান্ডে বল কী হয়েছে?
খান্ডের হাতে একটা “জমিন কী পর্চি” বা ল্যান্ড রেভিনিউ বিভাগ থেকে ইস্যু করা জমির মালিকানার ডকুমেন্ট। এতে মালিকের নাম, পরিবারের অংশীদারদের নাম, ক’জন অপ্রাপ্তবয়স্ক, জমির পরিমাণ এবং তাতে কী কী ফসল হয়েছে, খাজনা কত—সব লেখা থাকে।
–দেখুন স্যার, আপনিই দেখুন---মালিকের নাম কী লেখা আছে? আর বাবার নাম কী?
--- বিহানু পুত্র আত্মারাম, মানে আত্মারামের ছেলে বিহানু হল জমির মালিক। তাই তো?
--ঠিক স্যার। এবার ওই মাটিতে বসা লোকটাকে জিজ্ঞেস করুন ওর নাম কী? এটা নাকি ওরই জমির কাগজ।
--কেইসে গা? কা নাম তোর ?
--- আত্মারাম।
--দেখলেন তো, ব্যাটা নিজের ছেলের জমির কাগজ ব্যাংকে বন্ধক রেখে লোন নিতে এসেছে। এটা ঠগবাজি নয় ? চিটিং নয়?
কল কল করে ওঠে সঙ্গী মহিলাটি।
--না সাহেব , ইয়ে জোজোয়া হবে, বেইমান নহীঁ। ইয়ে সহী গোঠিয়াথে, ওকর ঘর কা নাম আত্মারাম, সরকারি নাম বিহানু।
( না সাহেব, এ বোকাহাঁদা, কিন্তু বেইমান নয়। ও সত্যি কথা বলছে। ওর ঘরের নাম আত্মারাম, সরকারি কাগজে বিহানু।)
--দেখলেন স্যার, ওই মেয়েটার চালাকিটা দেখলেন! ঘরের নাম আত্মারাম? তাহলে সরকারি কাগজে বাপের নাম আত্মারাম হয় কীকরে ? আত্মারামের ব্যাটা আত্মারাম? চালাকি পেয়েছে? এসব থানায় গিয়ে শোনাক।
এবার মুখ খোলে সঙ্গের আধপাকা চুলের পুরুষটি। বলে—মহিলাটি ঠিক বলছে। ওর পতিদেবের ঘরের নাম আত্মারাম, কিন্তু সরকারি কাগজে বিহানু, দুটোই ওর নাম।
--তুমি কে হে? এই বিহানু বা আত্মারাম তোমার কে হয়?
-- নাহী; কোন রিস্তা নাহী; হমন ওকর পড়োশি হন, অউ গাঁওকে সিয়ান।
( কোন আত্মীয়তা নেই, ওরা আমার পড়শী, আর আমি গাঁয়ের মুখিয়া।
খান্ডে ভাঙা ইংরেজিতে বলে – এসব কমিশন খাওয়ার ধান্ধা স্যার, এর কথায় বিশ্বাস করবেন না।
রূপেশ মাথা চুলকোয়। এই আষাঢ়ে গল্প এরা এমন জোর গলায় বলছে কী করে? কিন্তু আজকে যে ওকে বাস ধরে বিলাসপুর যেতে হবে। দু’দিন পরে বিয়ে, তারপরে দ্বিরাগমন সেরে ফিরবে সেই দুটো রোববার জুড়ে নামে ১৪ দিন , আসলে ১৬ দিন ছুটি কাটিয়ে।
হে ভগবান! আজকে কাউকে কড়া কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।ও ফিল্ড অফিসারকে বলে থানাপুলিশ ছাড়, এদের ঘরে যেতে বল। আত্মারাম সন অফ আত্মারাম লিখে লোন দিলে আমাকেই অফিস সাস্পেন্ড করবে বা পাগলা গারদে পাঠাবে।
খান্ডে নিতান্ত অনিচ্ছায় জমির ডকুমেন্ট ফিরিয়ে দিয়ে বলে – যা ভাগ! আজ সাহেবের মেজাজ ফুরফুরে, তাই এ’যাত্রা বেঁচে গেলি।
ওরা চলে যায় ,কিন্তু মহিলাটি বিড়বিড় করতে করতে যায়—মোলা ন্যায় নহীঁ মিলিস।
রূপেশ প্রসন্নাকে গোল্ড সিলভারের থলেগুলো লোনলেজার আর প্রমিসরি নোটের সঙ্গে নম্বর মিলিয়ে চেক করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রসন্না সিকিউরিটি ফর্মস ও ক্যাশ চেক করার পর বলে—যান, লাঞ্চ করুন গে’। আপনাকে বাস ধরতে হবে। বাকি আমি আপনার ফিল্ড অফিসারের থেকে বুঝে নেব।
সব ঘড়ির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছিল। এবার রূপেশ সবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলে—রোববারে বিলাসপুরে আমার পার্টিতে আপনারা সবাই আসছেন। নরেশ, প্রসন্না স্যারকে তুমি সঙ্গে করে নিয়ে আসবে, কোন কিন্তু-পরন্তু শুনছি না।ভিলাইনগরে সেক্টর সিক্সে কমিউনিটি হল, সন্ধ্যে সাতটায়। মনে থাকে যেন!
চাপরাশি মনবোধি যাদব ওর স্যুটকেসটা তুলে নেয়। বাসে তুলে দিয়ে ফিরে আসবে। ব্যাঙ্কের মকানমালিক দাদুসাহেবের কথায় আগের চাপরাশি বুধরাম চুরির অপবাদ মাথায় নিয়ে কাজ ছেড়ে নিজের গাঁ হরদিবাজারে ফিরে গেছে। এখন আরেকজনকে ছ’টাকা দৈনিক মজুরিতে রাখা হয়েছে। ম্যাট্রিক ফেল এই নতুন ছেলেটি কিন্তু বেশ চটপটে। তবু বুধরামের মারখাওয়া অপমানিত মুখ মনে পড়ে আর নিজের অজান্তে মনবোধির প্রতি রূপেশের ব্যবহার কেমন যেন রুক্ষ হয়ে যায়। কিন্তু রূপেশ যে আজ কার মুখ দেখে উঠেছিল!
বেরনোর সময় বাধা পড়ল।
ব্যাংকের বারান্দায় উঠে এসে গায়ের ধুলো ঝাড়ছে সেই আত্মারামের দল এবং সঙ্গে চশমা পড়া গিরিধারী পাটোয়ারি। গিরিধারী হাসিমুখে এগিয়ে এসে রূপেশকে নমস্কার করে—জানি আপনার তাড়া আছে, ছুটিতে যাচ্ছেন। আমি শুধু পাঁচ মিনিট নেব, ব্যস।
রূপেশ বুঝে যায় আজ আলি আহমদ বাসে চড়া ওর কপালে নেই। পরের বাস আদর্শ ট্রান্সপোর্ট আসবে দেড়ঘন্টা পরে। ওর ইশারায় মনবোধি স্যুটকেসটা নিয়ে ভল্ট রুমে রেখে দেয়। গিরিধারী রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়া পাটোয়ারি, কালেক্টরের অফিসেও ওর “পঁহুচ” আছে। ওকে চটানো ঠিক নয়।
পাটোয়ারি চটপট কাজের কথায় আসে। বলে – ওরা ঠিক বলছে। ওর নাম আত্মারাম, ওর বাপের নামও আত্মারাম, সরকারি কাগজে বিহানু নামটা আমার দেওয়া।
মানে? রূপেশের হাঁ-মুখ বন্ধ হয় না। পাটোয়ারি চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ে, বটুয়া থেকে পান বের করে গালে পোরে। মনবোধি হাওয়া বুঝে চায়ের জল চড়াতে চলে যায়।
--শুনুন সাহেব, এই গতবছরের কথা। দু'বছর আগের সার্ভেতে এদিকের মৌজা দুরপা, মৌজা ভেলইবাজার এবং মৌজা হরদিবাজার এলাকায় প্রায় কুড়িটি গাঁয়ের নীচে কয়লা আছে বলে জানা গেল। গত বছর কোল ইন্ডিয়া সেকশন নাইনের নোটিশ দিয়ে জানাল যে আপাততঃ বারোটা গ্রাম অধিগ্রহণ করা হবে আর প্রতি জমির পর্চিতে , মিনিমাম পাঁচ একর, সবাই একটা করে চাকরি পাবে। আমার কাজ হল ওই গ্রামগুলোর রেকর্ড দুরুস্ত করা, ম্যাপ বানানো। যারা ক্ষতিপূরণ পাবে তাদের নামের লিস্টি তৈরি করা। এখন হল কি যাদের বাবা বা জমির লম্বরদার মারা গেছে তারা আমার কাছে এসে মৃত ব্যক্তির নাম কাটিয়ে নতুন জীবিত লম্বরদারের নাম লেখাতে লাগল। ধরুন, স্বর্গবাসী বাবার জায়গায় বড়ছেলে। একে বলে—ফৌতি উঠানা।
আমি ভীষণ ব্যস্ত, সকাল থেকে খাটছি। এই রেকর্ড ঠিক করছি, ওই চেন নিয়ে কারও জমি মাপছি। বলতে দ্বিধা নেই, আপনাদের কৃপায় দু’পয়সা আমদানিও হচ্ছে। এমনই এক দিন সাতসকালে এরা তিনজন এসে হাজির। আমি জমি মেপে দেখেছি, ঠিক আছে। ওর বাবা মারা গেছে। ফৌতি ওঠাতে হবে। কিন্তু কাগজ দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ, যেমন আপনাদের আজ হয়েছে। ওর বাবা আত্মারাম আর ওর নামও নাকি আত্মারাম। দেখছেন তো, ব্যাটা একনম্বরের জোজোয়া। মুখে একটাই বুলি – ওর নামও আত্মারাম। শেষে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে পাড়া পড়শির থেকে চেক করে জানলাম যে ওর বাবা আত্মারাম ছিল সফল পুরুষ, করিৎকর্মা লোক। ওই সম্পত্তি বাড়িয়ে কুড়ি একর জমি করেছে, তাও তিন গাঁয়ে। ছেলেটা এমন ন্যালাক্যাবলা হওয়ায় গাঁয়ের বৈগাপুরুত গুনে বলেছিল যে ওকে ওর বাপের নামটাই করে দিলে ওর মধ্যে বদলাও আসবে। তাই ও হয়ে গেল আত্মারাম নম্বর দুই। যেমন আপনি স্কুলের ইতিহাসে পড়েছেন না—চার্লস ২, ইয়া শাহ আলম ২।
আমার এত ভ্যান্তারা পোষাল না। সরকারি কাগজে ওসব চলবে না। ওকে বললাম—শোন ব্যাটা, জরদ্গব ভ্যাবাগঙ্গারাম! আজ থেকে তোর নাম হল বিহানু। সাতসকালে, মানে বিহানবেলায় , এসে আমার মাথাখারাপ করেছিস তাই। রেকর্ডে ওর নাম হল বিহানু পুত্র আত্মারাম। দেখবেন ওই পর্চিতে ওর ফটো লাগানো আছে। আমার এবং তহসীলদার সাহেবের সই আছে। নিয়মে যা লোন পাবে দিয়ে দিন । কয়লা খাদান বরপালী গাঁয়ের ভেতর একেবারে ওর বাড়ির উপর দিয়ে যাবে। কুড়ি একর জমি ; ক্ষতিপূরণ হিসেবে কম-সে-কমঁইয়ের কয়েক লাখ টাকা পাবে, চাকরি পাবে। সবটাকা আপনার ব্যাংকে জমা হবে। আমি বলছি ঠকবেন না ।
আরও একঘন্টা কেটে গেছে। রূপেশ দাঁড়িয়ে আছে গাঁয়ের সীমানায় একটা পলাশ গাছের ছায়ায়। এখানেই বাস থামবে । আরও ক’জন যাত্রী অপেক্ষায় রয়েছে। দু’জন স্কুলের দিদিমণি, একজন গ্রামসেবিকা, আর নতুন পুলিশ আউটপোস্টের থানেদার পান্ডেজি। ওকে দেখে হেসে মাথা নেড়ে নমস্তে করলেন। রূপেশও প্রত্যুত্তর দিয়ে চুপ করে রইল ।নইলে বাসে পাশের সীটে বসে বিলাসপুর অবদি যত রাজ্যের ফালতু গসিপ আর কিসসা শুনতে হবে।
বাস আসতে আর কত দেরি? মনবোধিকে ফিরে যেতে বললেও যাচ্ছে না, জিদ ধরেছে বাসের মাথায় স্যুটকেস তুলিয়ে সাহাবকে সামনের দিকে জানলার পাশে একটা ভাল সীটে বসিয়ে তবে যাবে। ও টের পেয়েছে রূপেশের অকারণ রূঢ়তা, কিন্তু কারণ বুঝতে পারছে না—তাই প্রাণপণে সাহাবকে খুশি করতে এঁটুলির মত লেগে রয়েছে।
হঠাৎ একটা হুইসিলের চেরা আওয়াজে ও চমকে উঠল । পাশের আর একটা বড় গাছের নীচে জমা হয়েছে ভিড় আর মুখে বিচিত্র রঙ মাখা দুই ভাঁড় সবাইকে চটজলদি ডায়লগ আর মেঠো রসিকতায় হাসানোর চেষ্টা করছে।
সুনো, সুনো! সব্বোজন সুনো! কাল আহিরণকে তির দুঠিন সাগোন অউ সীসম ভারি বতিয়ানে লাগিস। কেইসে গা ভাই সুকালু?
হাঁ ভাই দুকালু। মহুঁ রহেন ওহাঁ। আপন আখোঁ মা দেখেহন, কানো মা সুনেহন”।
( শোন গো শোন; সবাই শোন। কাল আহিরণ নদীর তিরে দুটো সেগুন আর শিশুগাছ নিজেদের মধ্যে খুব গল্পগুজব করছিল । কি গো ভাই সুকালু? হ্যাঁ ভাই দুকালু। আমি ওখানে ছিলাম তো। নিজের চোখে দেখেছি, নিজের কানে শুনেছি।)
এইভাবে সুকালু দুকালুর (সুখীরাম দুখীরাম) রসালো গল্প আর ভাঁড়ামিতে দর্শকেরা মজে যায়, মাঝে মাঝে হাততালি ও হাসির হররা ওঠে। রূপেশ বুঝতে পারে এই দুই ভাঁড় এলাকায় বেশ পরিচিত। একটা বাচ্চা মেয়ে এলুমিনিয়ামের বাটি নিয়ে দর্শকদের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় । বেশ চলছিল, আচমকা তাল কাটল।
সুকালু জিজ্ঞেস করে—চল ভাই, বিলাসপুরে সত্যম টকিজে ‘শোলে’ লেগেছে , গিয়ে দেখে আসি। কী বললি? বাসের ভাড়া আর টিকিটের পয়সা কোত্থেকে জুটবে? চিন্তা করিস না। থানেদারের বিবিকে পটিয়ে রেখেছি। ওই দেবে।
পাবলিকের হাসি বাধা মানে না। ভিড়ের থেকে সুঁই সুঁই করে সিটি বেজে ওঠে।
কিন্তু জটলার মধ্যে এতক্ষণ হাসতে থাকা থানেদারের মুখ রাগে বেগুনি; বগল থেকে টুপি মাথায় চড়িয়ে হাতের রুল উঁচিয়ে পান্ডেজি তেড়ে যান ওদের দিকে, মুখে গালির ফোয়ারা।
বিপদ বুঝে সুকালু কথা পালটায়।
“আরে দুকালু ! তুই কি থানেদারের বিবি শুনলি নাকি? গলত। মেহর জমাদারকী বিবি বলে হন; অব কান পকড়, নাক রগড়। থানেদার সাহাব মাফ কর দেহি।“
(আমি তো জমাদারের বিবি বলেছি। তুই ভুল শুনেছিস। এবার কান ধর, নাকখৎ দে। থানেদার সাহাব মাফ করে দেবেন।)
এবার ওরা হাসিমুখে দৌড়ে পালায়। তেড়ে যাওয়া পান্ডেজির তেজ কমে। মোটরের গর্জন, ধুলো উড়িয়ে বাস এসে গেছে।
(চলবে)
0 comments: