গল্প - সুস্মিতা বসু
Posted in গল্পডিসেম্বর মাস। ২৪ তারিখ। জাঁকিয়ে শীত পড়েছে দিল্লি শহরে। শহরতলিতে, অলিতে গলিতে তবে অবশ্য শীততাপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে বসে তা টের পাওয়া যায়না একদমই।
ভিকাজি কামা প্লেস অফিস চত্বরে তখন বেলা ১:০০ টা। ।unch শেষ করেই মোটা জ্যাকেট টা চেয়ারের মাথা থেকে টেনে নিল আনন্দ। গায়ে চড়িয়ে চট করে হাত গলালো পকেটে। দুটো চারকোনা ছোটবড় প্যাকেট আঙুল ছুঁতেই দ্রুত পা চালালো ও। দুপুরে lunch এর পর অফিসের ছ’তলার এই ব্যালকনিতে ও প্রায় রোজই আসে। সিগারেট খেতে। আজও ব্যতিক্রম হল না। দু একজন চেনা মুখ রোজই জুটে যায় সঙ্গী হিসাবে।
আজ ও ছিল - তবে হঠাৎ দেখল এক কোনায় অবিনাশদা দাঁড়িয়ে, ডান হাতে সিগারেটের প্যাকেট।
আনন্দ ওনাকে দেখে একমুখ হেসে বললো “কবে এলেন?”
আবিনাশ আনন্দকে বুকে জড়িয়ে বললেন “আজ ই এলাম ভায়া, সকালের ফ্লাইটে। রিপোর্ট জমা দিতে। চলবে নাকি?“ বলেই বাড়িয়ে দিলেন প্যাকেটটা।
-ক’দিন ছুটি? একটা সিগারেট ধরিয়েই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল আনন্দ। “এক মাস তো?”
- বলছি বলছি – তার আগে বল আজ সন্ধ্যাবেলা কি করছ? চলে এস। তোমাদের বউদি আজ জমিয়ে ডিম কষা আর ফ্রায়েড রাইস বানাবে । না এলে ভায়া মিস করবে।
- আরে না না – আজই এলেন, আগে জেট ল্যাগ কাটুক তারপর নয়…..
- শোনো বিকেল বিকেল চলে এস ওদের নিয়ে। কাল ছুটি আছে, রাত অব্দি জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। আমি মিঠুকে বলে দিচ্ছি। বুঝলে….
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে জলন্ত সিগারেটের বাট্ টা রেলিংয়ের গায়ে ঘষে দিয়ে করিডরের দিকে এগিয়ে গেলেন – বাঁক নেবার আগে মুখ ঘুরিয়ে হাত নেড়ে বাই করলেন। আনন্দও হাত নাড়ল । তারপর রোজের মতো রেলিংয়ে ভর দিয়ে নিজের দু-হাতের তালুতে চিবুক রেখে চোখ রাখল সামনের রিং রোডে – আনমনা হয়ে। অবিরাম গাড়ির আনাগোনা ডিঙিয়ে দৃষ্টি হারাল বহুদূরে – আর মন পাড়ি দিল সেই সুদূর আফ্রিকায় যেখান থেকে সদ্য ফিরেছেন অবিনাশদা । জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা ফিরিয়ে আনলো ভিকাজি কামাতে। মুখটা কেমন তেতো লাগল - ফিরে চলল ফের নিজের ডেস্কের দিকে।
ঘড়ির কাঁটায় চোখ পড়তেই হাতের বই নামিয়ে রাখল নীতা। ফোন বাজল। ও জানে বিকেল ৫.০০ টার কল্ টা আনন্দর । প্রায় দৌড়ে গিয়ে ধরল । মেয়ে ঘুমোচ্ছে তাই ।
হ্যালো বেরিয়েছ? বাসে? সিট্ পেলে?
পেয়েছি
আজ খুব হাওয়া দিচ্ছে - এদিকে বৃষ্টিও হয়ে গেছে এক পশলা- ছাতা কি সঙ্গে….
না নেই। ছাড়ো – শোনো আজ তুমি রেডি থেকো – আমরা একটু বেরোব
কোথায়? এই ঠান্ডায়? জানো আজ হিটার চালাতে হল
নীতার গলায় আতঙ্কের আভাস পেয়ে আনন্দ তাড়াতাড়ি আশ্বাস দিয়ে বলল
বেরবো মানে অবিনাশ দার বাড়িতে – ডিনারে
ও তাই!! অবিনাশ দার এই সময় ফেরার কথা শুনেছিলাম – এসে গেছেন তাহলে।
আনন্দ বুঝল নীতাও খুশী – অবিনাশদার স্ত্রী, মিঠু বৌদি ও অবিনাশদা দুজনেই নীতাকে খুব স্নেহ করেন । তেমনি ভালোবাসেন ওদের মেয়ে তিতলি কে ।
সন্ধ্যা ৮.০০ নাগাদ সাজুগুজু করে তিতলি রেডি সবার আগে। বাবা মার সঙ্গে বসে পড়ল তাদের মিনি পদ্মিনী তে। মিনিট কুড়ি লাগে । কিন্তু আজ লাগল পাক্কা এক ঘন্টা। গাড়ি এই বিকট ঠান্ডায় চলতে নারাজ। স্টার্ট নিতে বেগড়বাঁই করল বেশ কিছুক্ষণ। অবশেষে অবিনাশদের বাড়ির নীচে গাড়ি পার্ক করে ওরা সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করল । কলিং বেল্ বাজাতেই দরজা খুলে বৌদির সাদর আপ্যায়ন । তিত্লিকে নিয়ে সোজা বসিয়ে দিলেন ডিনার টেবিলে, বললেন
ন’টা বাজে, ও খেয়ে নিক – তারপর আমরা ধীরেসুস্থে খাব। আমি খাইয়ে দিচ্ছি, তোমরা ততক্ষণ গরম গরম পাকোড়া খাও চায়ের সঙ্গে
চা-পাকোড়া খেতে খেতে সবাই আফ্রিকার গল্পে মেতে উঠল – নীতার দেশ দেখার ইচ্ছা অসীম – ও আরো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তথ্য সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ল । এতদিন পর অবিনাশদা কে পেয়ে আড্ডা জমে উঠেছিল । কথায় কথায় রাত বাড়ল । খাওয়া দাওয়া সেরে বেরতে বাজল প্রায় রাত ১.০০ টা । তিতলি ঘুমিয়ে গেছিল অনেক আগেই। তাই ওঁরা চাইছিলেন আমরাও ষাতে রাত কাটিয়ে ভোরে বাড়ি ফিরি। নীতার ইচ্ছা ছিল। বাদ সাধল আনন্দ । ও বাড়ি ফিরতে চায় । তিতলির স্যান্টা ক্লজের গিফ্ট সাজাতে হবে তাই। অগত্যা বাড়ি ফেরা নিশ্চিত হল ।
অবিনাশদা ফ্ল্যাটের দরজা খুলতেই দমকা হিমেল হাওয়া এসে ঢুকে পড়ল ঘরে। তিতলির লাল জ্যাকেটের হুডটা টেনে দিল নীতা প্রায় চোখ অব্দি – ওকে কোলে নিয়ে তরতর করে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে নিচের পার্কিং লটে । পিছু পিছু আনন্দ নামল। ওর পিছনে নেমে এলেন অবিনাশদা ও, বললেন
-যাবে কি করে? কিছু তো দেখাই যাচ্ছে না ভায়া – এত কুয়াশা তে বাড়ি গিয়ে কাজ নেই, চল ওপরে চল। শুধু শুধু মেয়েটাকে নিয়ে টানাটানি করলে।
- না দাদা আজ আসি । ঠিক পৌঁছে যাব, চিন্তা করবেন না।
এবার আনন্দ বেশ জোর দিয়েই বলল – গলাটা যেন কিরকম একটু রুক্ষ শোনাল। মেয়েকে পিছনের সিটে ভালো করে শুইয়ে দিচ্ছিল নীতা। কথাটা কানে আসতেই ওর মনে হল আনন্দ টেনশন করছে। প্যাসেঞ্জার সিটে বসে সামনের দিকে তাকাতেই মালুম হল, আগামী কুড়ি মিনিট স্রেফ আন্দাজে গাড়ি চালানো সোজা কথা হবে না। বুকটা নীতার ও ঢিপ্ ঢিপ্ করতে লাগল। কিন্তু আনন্দকে সাহস করে আরেকবার রাত কাটানোর জন্য অনুরোধ করতে পারল না।
অবিনাশদাকে “গুডনাইট” বলে আনন্দ গাড়ি স্টার্ট দিল। নীতা আনন্দর পাশে বসে মনে মনে দুগ্গা নাম করল। যাত্রা শুরুতে নীতা বরাবর এমনটাই করে। এতে মনে বেশ জোর পায় ও। গাড়ি এগোল হাউসিংয়ের গেটের দিকে গুটি গুটি। দারোয়ান সেলাম দিল। গাড়ির আলো দেখে গেট সে আগেই খুলে রেখেছিল। অতি ধীর গতিতে গাড়ি এগিয়ে চলল। ভরসা শুধু ডিভাইডার আর ফগ্ লাইট। সেই ডিভাইডারকে চোখে রেখেই আনন্দ শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে অতি সন্তর্পণে চারচাকা এগিয়ে নিয়ে চলল কোনো রকম ঝুঁকি না নিয়ে।
দেখতে দেখতে বাড়ির কাছাকাছি পিছনের বড় রাস্তায় এসে পড়েছে। এখান থেকে সামনের গলিতে ঢুকে পড়লে আর মিনিট পাঁচেক। গলিতে ঢুকবার মুখেই হনুমানজীর মন্দির। নজর পড়ল সেদিকে। এত রাতে বন্ধ। শুধু একটা আলো জ্বলছিল। সেইদিকে দেখছিল নীতা। এই মন্দিরে প্রতি মঙ্গলবার আসে ও। পূজো দেয়। কখনও লাড্ডু কখনও জিলিপি কিনে দেয়। যেদিন যা মন চায়। ওর সঙ্গে মেয়েও আসে। নিয়ম করে। কিন্তু ঠিক কবে যে মন্দিরে আসা শুরু হয়েছিল সেটা মনে করার চেষ্টা করেও পারল না। গলিতে বাঁক নিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল, ধীরে ধীরে মন্দিরের আলোটা মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশায়। এমনি সময় হঠাৎ একটা ঝট্কা। আচমকা সব চিন্তার সূতো ছিঁড়ে গেল। চারিধারে ঘন কুয়াশা। এত ঘন যে একহাত দূরে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। প্রমাদ গুনল - বুঝল গলির মাঝখানে গাড়ি থেমে গেছে।
আনন্দর দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ উদ্বিগ্ন স্বরে বলল
কি হল? বলেই ঘাড় ঘুরিয়ে দ্রুত দেখে নিল মেয়েকে – অকাতরে ঘুমাচ্ছে।
স্টার্ট নিচ্ছে না । ঠেলতে হবে মনে হচ্ছে। থমথমে মুখে আনন্দ কথাটা বলেই দরজা খুলে নেমে গেল ওই হাড়হিম করা শীতে।
সে কি? বলেই আঁতকে উঠল নীতা, দেখল আনন্দ সমানে গাড়ির পিছন থেকে ধাক্কা দিচ্ছে প্রাণপণে। তবু গাড়ি অনড়।
আমি আসি? একা পারবে না। প্যাসেঞ্জার সিটের কাঁচ নামিয়ে আনন্দর উদ্দেশ্যে কথা কটা ছঁড়ে দিল নীতা নীচুস্বরে।
নীতা নেমে এল আলোয়ানটায় মাথা ঢেকে আনন্দর কাছে। চারিধারে চোখ বুলিয়ে নিল। সারা পাড়া নিঝুম। শীতের রাতে মোটা লেপের নিচে উষ্ণতাকে আঁকড়ে তখন সবাই গভীর গরম ঘুমে মগ্ন। একলা সাইকেল রিক্সা দাঁড়িয়ে। কেউ কোথাও নেই। শুধু নিকষ কালো রাতের অন্ধকারে সাদা কুয়াশার চাদর লেপ্টে আছে বিপন্ন এই দম্পতিকে। হাড় কাঁপানো শীতে নীতা আনন্দর গা ঘেঁষে দাঁড়ালে আনন্দ নীতার কানের কাছে মুখ নামিয়ে এনে ফিস্ ফিস্ করে বলল
তুমি সামনে বাঁদিক থেকে একটু ঠেলতে পারবে? সামনের চড়াইটা পার করতে হবে। একা পারব না।
আনন্দর গলাটা কি রকম অসহায় শোনাল। বিনা বাক্যব্যয়ে নীতা চলে এল সামনে। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠেলতে লাগল। খানিক বাদে মনে হল এই শীতের রাতেও ও দরদর করে ঘামছে। কিন্তু গাড়িটা যেন একটু নড়ে উঠল। দ্বিগুন উৎসাহে ঠেলতে যাবে এমন সময় দেখে ছোট্টখাট্ট চেহারার এক বুড়ো সর্দারজী কুয়াশা ফুঁড়ে এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে – বললেন
বেটা, তুম অন্দর বৈঠো – হাম ধাক্কা দেতে হ্যয়
নীতা স্তম্ভিত। যারপরনাই আশ্চর্য হল। কিন্তু ওনার কথা অমান্য করতে পারল না। চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসল। গাড়িতে বসে সর্দারজীর মুখটা ঠিক ঠাহর করতে পারল না – একে বাইরে কুয়াশা তার উপর ওনার একমুখ সাদা গোঁফদাড়ি, মাথায় বিরাট পাগড়ী। চোখে পড়ল ওনার ডান হাতের স্টীলের বালা। চকচক করছে কব্জির কাছে। পাঞ্জাবীর হাতা গোটানো কনুই অব্দি - গায়ে কোনো গরম কাপড় নেই। কিন্তু এই বয়সেও ওনার গায়ে যে কি অপরিসীম শক্তি – তা বুঝতে বাকি রইল না নীতার। বলিষ্ঠ হাতে সামনের ওই চড়াইটা অবলীলায় উতরিয়ে দিলেন একনিমেষে। আর গাড়িও হুড়মুড় করে ঢালে গড়িয়ে গেল। বললেন
-অব যাও
আনন্দ দৌড়ে এসে গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন স্টার্ট দিতেই গাড়ি চলতে শুরু করল। জিজ্ঞাসা করল
তোমার সর্দারজী কই?
এই তো… বলে বাঁ দিকে তাকিয়ে সর্দারজীকে আর দেখতে পেল না নীতা। যেমনি কুয়াশা ফুঁড়ে আচমকা এসেছিলেন তেমনি হঠাৎ করেই হারিয়ে গেলেন কুয়াশাতে। কি আশ্চর্য!
উনি কে ছিলেন?
0 comments: