0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in


(২) 

বাড়ির বিছানা ছাড়া চট করে ঘুম আসেনা সাগরিকার। মা কিন্তু এতক্ষণে ঘুমিয়ে কাদা। মনে হয় রাত দেড়টা মত হবে। হাল্কা চাঁদেরর আলো আকাশে ভেসে আছে। আর দু'দিন পরে কার্তিক পূর্ণিমা। মিসেস লোবোর এই গেস্ট হাউসটা কিন্তু সেই বৃটিশযুগের। কলোনিয়ান স্থাপত‍্য অযত্ন আর কালের প্রকোপে জৌলুস হারালেও তার আভিজাত‍্য হারায়নি। মিসেস লোবো আর একটি আদিবাসী মেয়ে, সম্ভবত ওঁর সহকারিণী একতলার পুবের দিকের দুটো ঘর নিয়ে থাকেন। ওপর তলায় তিনটে ঘর অতিথিদের ভাড়া দেওয়া হয়। আপাতত অন‍্য দুটো ঘর বন্ধ। অফ্ সিজন বলেই হয়তো। এমনিতেও মা-মেয়েতে একটা ঘরেই দিব‍্যি কুলিয়ে যায়। এ ঘরে একটা ভিক্টোরিয়ান ড্রেসিংটেবিল আছে। সেটার ওভাল শেপের আয়নাটা খুব সুন্দর। গেস্ট হাউসের সিঁড়িগুলো ধাপে ধাপে সমুদ্রের দিকে চলে গেছে। তারপর মোটামুটি আধ কিলোমিটার হাঁটলেই সমুদ্র। আজকাল সমুদ্রের সৈকতের ওপর স্থায়ী কনস্ট্রাকশন নিয়ে সরকার কড়াকড়ি শুরু করে দিয়েছে। খুব বেশীদিন হয়তো এটাকেও রাখতে দেবেনা। রাতের নিস্তব্ধতা সাথে সমুদ্রের চাপা গর্জন কানে আসছে। অনর্গল ঢেউয়ের একটা অদ্ভূত আকর্ষণ আছে। বালির পাড় গুলো ভিজছে ফেনায়। ফসফরাসের আলো নেচে নেচে সমুদ্রের ঢেউকে জ‍্যোৎস্নার সাথে মাখিয়ে এক অলীক ক‍্যানভাসে পরিণত করে তুলছে। দু একটা কুকুর দূরে ডেকে উঠল। 

সাগরিকা জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে অনেকক্ষণ ধরে। বাইরের অন্ধকারটাও এতক্ষণে চোখ সওয়া হয়ে গেছে। খুব মনখারাপ করছে ওর। কিন্তু কারণটা বুঝতে পারছে না। 

কদিন আগেই একটা কবিতা কোথায় যেন পড়ছিল ও। এই মায়াবী অন্ধকারে সেই লাইনগুলোই যেন মাথার মধ‍্যে ঘুরছে কেবল। 


" মায়াটুকুই তো লেগেছিল 
চোখের কাজলে... 
সেটুকু ফেরৎ নেবে! বলো! 
নুপুরটুকুও দিয়ে দিলাম 
দাঁড়িয়ে আছি এপার যমুনায় 
অথৈ কান্নাটুকু আমার 
খেয়া দেখে 
চোখের জলে ভুবন ভেসে যায় ..." 

এসব মনখারাপের কোন অর্থ হয় না। 

যদিও সাগরিকার মনের ভিতরটা এতক্ষণ তোলপাড় করে উঠছে থেকে থেকেই। 

কি যেন একটা অজানা সংযোগ থেকে একটা প্রবল বিচ্ছিন্নবোধ ওকে আজকাল খুব কষ্ট দিচ্ছে। মাথার রগ দুটো এবার টিপটিপ করে ব‍্যথা করছে। কয়েকমাস হল প্রায়ই এরকম হচ্ছে। এগুলো কি পাগল হয়ে যাবার লক্ষণ? 

********* 

দাদা আজকাল বাড়িতে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া চিঠি লেখেনা। ওরা কয়েকজন মিলে একটা সমবায় কেন্দ্র করেছে পুরুলিয়ায়। সেখানেই দাদারা একটা প্রাইমারী ইস্কুল খুলে শবর আর অন‍্য কয়েকটি প্রান্তিক জনজাতির স্বনির্ভর কর্মপ্রকল্পের মাধ‍্যমে উন্নয়নের কাজে জীবনটাকে সঁপে দিয়েছে। এই ক'বছরে দু একবার মা আর সাগরিকাও ওখানে গেছে। জায়গাটা ভালই। কালো পাথুরে সিল‍্যুটে পলাশ ফুলগুলো আগুনের মত জ্বলে। হুইলচেয়ারে বসা দাদাকে দেখলে বুকের মধ‍্যে একটা চিনচিনে কষ্ট হয়। এটা জেলে থাকতে পুলিশের থার্ড ডিগ্রীর ফল! তবে দাদা সেটাকে আমল না দিয়েই নিজের লক্ষ‍্যে অবিচল আছে এটাই খুব বড় ব‍্যাপার। একজন কম‍্যুনিষ্ট চাইলে সব পরিস্থিতিতেই সারাটা জীবন নিজের আদর্শের জন‍্য খরচ করতে পারে এটাই দাদার বিশ্বাস। নিজের নামের সাথে ব‍্যাপ্তিকে ক'জন আর এক করে দিতে পারে? দাদা কিন্তু পেরেছে। সাগরিকা তাই খুব গর্ববোধ করে। ওরা মা-মেয়ে দুজনে বইখাতা, লেখাপড়ার সরঞ্জাম এসব টুকিটাকি জিনিষ মাঝেমধ‍্যে ওখানে পাঠিয়ে সাহায‍্য করে। দাদা কিন্তু এসবের মাধ‍্যমে তার বাড়ির সাথে যোগাযোগের একমাত্র অবলম্বনটাকে হাসিমুখে মেনে নিয়েছে। দাদাদের ইস্কুলের গেটটা দরমার। লম্বা একটা উঠোন পেরিয়ে তারপর ক্লাসঘর। আর এই পথটা সবসময় হলুদ রাধাচূড়ার স্তুপে ঢেকে থাকে। সুখমণি কিস্কু বলে একটি মেয়ে এই ইস্কুলের কাজে দাদাকে সাহায‍্য করে। সাগরিকা 'সুখী দিদি' বলে ডাকে মেয়েটিকে। মিষ্টি হাসিমুখের মেয়েটা যে ওর দাদাকে অন্তর থেকে ভালবাসে সেটা তার কালো হরিণচোখের সরলতায় বোঝা যায়। মেয়েটিও নাকি একসময় পলিটিক‍্যাল প্রিজনার ছিল। বহরমপুর জেলেই আলাপ দাদার সাথে। সাগরিকা ভাবে ওদের যদি ধরে বিয়ে দিয়ে দেওয়া যেত! আবার পরক্ষণেই ভাবে থাক না! সব সম্পর্কের ডাকনাম নাই বা হল! মনের বাঁধনটাই বা কম কিসের? 

********** 

একটা হলুদ রঙের আলো মাটিতে এসে পড়ছে। তার সঙ্গে বাসী ফল পাকুড় আর ধূপধুনোর গুমোট গন্ধটা এই দমচাপা পাতালঘরটায় ঘুরছে বলেই নাকে আসতে গা টা গুলোচ্ছে। চারিদিকে শুকনো খড়ের গাদা আর চামচিকের বিষ্ঠায় জায়গাটা অপরিচ্ছন্ন হয়ে আছে। ও টের পেল সারা শরীরটা শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাঁধা। তাই গায়েও খুব ব‍্যথা করছে। সঙ্গে মাথায়ও ব‍্যথা! কপালের কাছে থেকে একটা চ‍্যাটচ‍্যাটে তরল জমাট বেঁধে আছে , রক্ত বোধহয়! ও বুঝতে পারল যে মাথায় লাগবার পর আসলে এতক্ষণ ওর জ্ঞান ছিল না। এবার যেন একটু একটু করে টের পাচ্ছে সব কিছু। তবে ওই হলুদ আলোটার উৎস কোথায় ও জানে না। 

মাথাটা আর একবার তুলতে চেষ্টা করতে গিয়েও পারল না। এখন যদি একটু খাবার জল দিত কেউ...কিন্তু কাউকে ডাকলেও কি কেউ এখানে শুনতে পাবে? এখানে কেন যে ও বন্দী সেটাই বা কে ওকে বলবে? অনেকগুলো প্রশ্ন ঝাঁকে ঝাঁকে মাথায় ভীড় করতেই আবার ও জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো। 

***********

0 comments: