0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১০

কয়লাখনির ‘ভূমিঅধিগ্রহণ’ ও ‘কমপেন্সেশনে’র ঘোর কেটে গেছে। হেড অফিস থেকে ডেপুটেশনে আসা চ্যাটার্জি ফিরে গেছে নিজের ডেরায়। জমিহারানো চাষীদের থেকে ডিপোজিট কালেকশন মন্দ হয়নি। আমি ও চ্যাটার্জি দুজনেই লেটার অফ অ্যাপ্রিসিয়েশন পেয়েছি। হয়ত আগামী প্রমোশনের সময় কাজে লাগবে।আমাদের খরচা বাবদ সমস্ত বিল পাশ হয়ে গেছে। 

আমার জীবন আবার ফিরে এসেছে সেই ঢিমে তেতালা গতে। যন্ত্রের মত কাজ করে যাই। সন্ধ্যেবেলায় খালি ঘরে ফিরি। সময় কাটাই টিভিতে ‘নুক্কড়’ বা অন্য সিরিয়াল দেখে। শনিবার বিকেলে দূরদর্শন দেখায় আর্ট ফিল্ম। রবিবার কমার্শিয়াল হিন্দি সিনেমা। লেবার কলোনিতে একমাত্র টিভিসেট আমার ঘরে। ফলে রোববার চারপাশের বাড়ির মহিলারা তাদের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে অনায়াসে ঢুকে পড়ে। ঘরে বোনা আসন বিছিয়ে মাটিতে বসে যায় । আদ্দেকঘন্টা ইন্টারভ্যালের সময় ঘরে গিয়ে সবাইকে খাইয়ে হুড়মুড়িয়ে ফিরে এসে জায়গা দখল করে। পুরুষেরা বাইরে দাঁড়িয়ে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে থাকে। আমি চৌকিতে উঠে জানলায় পিঠ লাগিয়ে বসি। শিকের ফাঁক দিয়ে কিছু আঙুল আমার পিঠে সুড়সুড়ি দেয় , বলে সরে বসতে—ওদের দেখতে অসুবিধে হচ্ছে। বিরক্ত হয়ে শোয়ার ঘরে গিয়ে একটা হিন্দি জাসুসী উপন্যাস খুলে মন লাগাতে চেষ্টা করি। সরলা থাকতেই এসব হচ্ছিল। ও দু’একবার রেগে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিত। আমি খুলে দিতাম। ওর মুখে আষাঢ়ের মেঘ ঘনাত ।

সে যাকগে; লাভের মধ্যে আমার কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় হেড অফিস একজন নতুন অফিসারকে পাঠিয়েছে আমার শাখায়। 

জগন তির্কিকে দেখে হতাশ হলাম। আমার কাছেই প্রথম পোস্টিং! সব গোড়া থেকে হাতে ধরে শেখাতে হবে। হে প্রভু! আর কত? 

আদিবাসী ওঁরাও সমাজের ছেলে জগন। ভেবেছিলাম বেশ কালো পাথরে কোঁদা হাট্টাকাট্টা নওজোয়ান হবে, কোথায় কী-- রোগাপ্যাংলা লম্বাটে গড়ন, কন্ঠার হাড় উঁচু, গলার আওয়াজ ফ্যাঁসফ্যাঁসে। দাঁত থেকে বোঝা যায় গুড়াকু করার (দাঁতে মিশি দেয়ার) অভ্যাস আছে। কিন্তু আদিবাসী ছেলে এত রোগা! ভাল করে খায় না নাকি?

কাগজপত্তরে আলতো চোখ বুলিয়ে নিই --- দু’বছর আগে রায়গড়ের কলেজ থেকে রাজনীতি শাস্ত্রে এম এ, ৫৫%। বেশ, ওসব জায়গায় কেমন পড়াশুনো হয় সে আমার জানা আছে।

এই প্রথম চাকরি?

নহী স্যার। পহলে ধর্মজয়গড় কলেজ মেঁ অস্থায়ী লেকচারার থা।

আচ্ছা? ফির ছোড় দিয়ে কিঁউ?

আসলে আমার আওয়াজ পাতলা। সেকন্ড বেঞ্চের পরে কেউ শুনতে পায় না। ছেলেরা ক্লাসের মধ্যে হুটিং করতে লাগল। ঘাবড়ে গেলাম, তোতলাতে লাগলাম। সাতদিনের বেশি টিঁকতে পারলাম না। 

চাপরাশি মনবোধি থেকে শুরু করে সবার চেহারায় চাপা হাসির ঢেউ। জগন ঘামতে লাগল।

আমি সবাইকে আলতো ধমক দিয়ে বললাম—নতুন এসেছে, সবাই ওকে কাজ শিখতে সাহায্য কর। প্রথম দিন ফিল্ড অফিসার ওকে লেজার জটিং এবং ব্যালান্সিং এর পদ্ধতি শেখাবে; কাল ফিল্ড ইন্সপেক্শনে নিয়ে যাবে। আগে ওকে জল আর চা দাও।

ফিল্ড অফিসারের পাশে টেবিলে একটা চেয়ার টেনে জগন বসে পড়ল। 

কাজের শুরুতে প্রথম চা’টা না পাওয়া অব্দি আমার কাজের ইঞ্জিন নিউট্রালে থাকে, চায়ে চুমুক দিলেই ফার্স্ট গিয়ার। কিন্তু আজ একটু দেরি হচ্ছে কি?

বারান্দা থেকে লোকজনের চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে, হলটা কী? 

সাহাবজী, জলদি আইয়ে। সাঁপ !

কোথায় সাপ? ক্যাশিয়ারকে কেবিন বন্ধ রাখতে বলে বেরিয়ে আসি।

ইধর নহীঁ, পিছে কে কমরে মেঁ। মনবোধি ওহী হ্যায়।

পেছনের কামরায় ইটের দেয়ালে কাদামাটির শস্তা গাঁথনি। দেয়ালে একপাশে ভিজে বালির উপর বসানো মাটির জালা, তাতে খাবার জল ভরা। ঠান্ডা পেয়ে সাপ এসে কুণ্ডলী পাকিয়ে নাকি বিড়ের মত পড়ে ছিল। মনবোধির চিৎকারে সরে গিয়ে দুটো দেয়ালের জোড়ায় লেপটে রয়েছে, আর চেরা জিভ বের করে ভয় দেখাচ্ছে। আমি ও মনবোধি দুটো লাঠি বাগিয়ে এগিয়ে যাই। কিন্তু অমন জায়গায় লাঠির ঘা ফসকে যাবে। কী যে করি ! সবাই দূর থেকে তামাশা দেখছে, বিরক্ত লাগে। কি সাপ এটা? 

কেউ বলছে চিতি বা চন্দ্রবোড়া, কেউ ডোমহি বা কেউটে, কেউ ঢোরিয়া বা ঢোঁড়া। কোন সবজান্তা বলছে – ওসব কিছু না, এটা পিটপিটি বা হেলে সাপ। নির্বিষ , মারার দরকার নেই।

পেছন থেকে একটা পাতলা মেয়েলি আওয়াজ—জরা হট জাইয়ে স্যার! ইয়ে হ্যায় ঘোড়া -করেত, কাটনে পর মৌত নিশ্চিত। 

ভিড় ঠেলে আমাকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে এগিয়ে এসেছে জগন তির্কি কিন্তু একী চেহারা! খালি পা, ফুলপ্যান্ট প্রায় হাঁটুর কাছাকাছি গুটোনো, হাতে মনবোধির জল বয়ে আনার বাঁকের কাঠ—মুখের দিক ছুঁচলো। সেটাকে ও দু’হাতে তুলে ধরেছে বল্লমের মত। ফুলে উঠছে নাকের পাটা, একদৃষ্টিতে সাপটাকে দেখছে -যেন হিপনোটাইজ করতে চায়।

ব্যাংকের মাটির জোড় দেওয়া ইটের দেয়াল হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এখানে এখন গজিয়ে উঠেছে রায়গড়-জশপুরের বিশাল ঘন বন। বহু যুগ ধরে ঘটে আসা এক আদিম শিকারের অভিনয় আবার শুরু হয়েছে। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ দর্শক। 

জগনের হাতে কাঠের বল্লম একটু একটু দোলে , যেন দূরত্বটি মেপে নিচ্ছে। সাপটা বোধহয় বিপদের গন্ধ পেয়েছে , আরও গুটিয়ে গিয়ে শরীরটাকে ছোট্ট করে নিচ্ছে। শোনা যাচ্ছে শুধু জগনের নিঃশ্বাসের শব্দ। হঠাৎ সবাই চিৎকার করে ওঠে। হাতের বল্লম নিঁখুত আন্দাজে সাপটাকে গেঁথে দিয়েছে দুই দেয়ালের ভাঁজের মধ্যে। চোট পড়েছে শিরদাঁড়ার মাঝামাঝি। আহত সাপ নিস্ফল আক্রোশে জড়িয়ে ধরছে কাঠটাকে , ছোবল বসাচ্ছে ওর গায়ে। জগন হাত সরায় না। বলে –কোন ভয় নেই , ও এখন কিস্যু করতে পারবে না। কেউ একজন বাকি কাজটা করুন। 

মনবোধি তাড়াতাড়ি একটা ভাঙা ইঁট কুড়িয়ে এনে সাপের মাথাটা থেঁতো করে দেয় । সাপটা মারা গেছে। কিন্তু শরীর এখনও মাটিতে পড়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে। জগন আমাকে বলে—স্যারজি, ওর মুখে কয়েক ফোঁটা জল দিন। প্রাণীর শেষ সময়ে মুখে জল দেবেন না?

মনবোধি কিছু কাগজ, কেরোসিন আর দেশলাই নিয়ে আসে। সাপটাকে পাঁচিলের বাইরে নিয়ে পুড়িয়ে দেবে। ভিড়ের থেকে একজন –মাথায় জটা, গায়ে কম্বল জড়ানো—ওর সঙ্গী হয় ।

জগন হাসে। আমাকে বলে যে ওই লোকটা হল সাওরিয়া জাতির। সাপটা পুড়লে ছুরি দিয়ে ছাল ছাড়িয়ে নুন লাগিয়ে খাবে।

আমাকে ফিল্ড অফিসার ফিসফিস করে বলে – ইয়ে লৌন্ডা পহলা দিনহী সিক্কা জমা দিয়া, মাননা পড়েগা। 

ছোঁড়াটা প্রথম রাতেই বেড়াল মেরেছে, এলেম আছে।





আমার মদ খাওয়া একটু বেড়ে গেছে। নুরের দোকানের শস্তা হুইস্কির বিলও আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে।

মাঝে মধ্যে বিঁঝয়ার পাড়া থেকে ঘরে তৈরি মহুয়া আনিয়ে নিই মনবোধিকে দিয়ে। এরা আমার ব্যাংকের ঋণী। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ যোজনায় বিঁঝওয়ার -মঁঝওয়ার জনগোষ্ঠী হল ‘অতি-পিছড়া’ বা ‘খুব পিছিয়ে থাকা’ আদিবাসী। ফলে পাঁচ একর জমিতে কুয়ো খুঁড়ে ডিজেল পাম্প চালিয়ে চাষবাস করলে বা তরিতরকারি ফলালে এরা পাবে শতকরা ৮০ সাবসিডি বা ভর্তুকি। ফলে এই লোন শোধ করা এদের জন্যে বড় সমস্যা নয়। তবু দশমাসের মাথায় মঙ্গল বিঁঝওয়ার সব লোন শোধ করে দেওয়ায় একটু অবাক হলাম বইকি। 

ব্যাপারটা সরেজমিনে দেখব বলে আমি খান্ডে ও জগনকে নিয়ে একটি বাইকে সওয়ার হয়ে দু’কিলোমিটার দূরের বিঁঝওয়ার মহল্লায় হানা দিলাম। সবার পিছনে আমি ঠেলেঠুলে বসেছি। খান্ডে প্রায় পেট্রোল ট্যাংকের উপর বসে বাইকটা চালাচ্ছে। আমার পিঠে ক্যারিয়ারের লোহা ফুটছে। কিন্তু মিনিট পাঁচ সহ্য করাই যায় ।

মঙ্গল বিঁঝওয়ারের চালাঘর গাঁয়ের বাইরে ক্ষেতের গায়ে। কিন্তু ক্ষেত কোথায়? ওর জমি জুড়ে বিশাল ইঁটভাটা, কুড়িজন মেয়েপুরুষ কাটা মাটি থেকে কাদা বানিয়ে ইটের ছাঁচে ঢেলে সাজিয়ে রাখছে। একদিকে হেডমিস্ত্রি বাংলাভাট্টা বানিয়ে তাতে কাঠকয়লা ও কাঠের গুঁড়ো এবং ধানের তুষ দিয়ে আগুন ধরিয়েছে। মাঠের উপর একটা ট্র্যাক্টর দাঁড়িয়ে। তার পাশে দুটো চেয়ার লাগিয়ে জনাদুই সাফারি স্যুট পরা লোক সিগ্রেট ফুঁকছে।

আমরা গিয়ে ওদের সামনে দাঁড়াই। ওদের মধ্যে একজন উঠে হাত বাড়িয়ে বলে- অশোক অগ্রওয়াল। আমারই ইঁটভাট্টা, বলুন , আপনাদের কী সেবা করতে পারি? ক’হাজার ইঁট চাই? এখন হাজার প্রতি দুশো টাকা দর, আপনার সাইটে পৌঁছে দেবার আলাদা চার্জ।

আমি বলি যে ব্যাপারটা অন্য। এই জমি তো মঙ্গল বিঁঝয়ারের।ক্ষেতি করার লোন দিয়েছিলাম। এখানে ইঁটভাট্টা? লাইসেন্স নিয়েছেন?

অগ্রওয়ালের মুখের ভাব বদলে যায়। বলে পঞ্চায়েতের পারমিশন আছে, তাই যথেষ্ট। তারপর চেঁচিয়ে ডেকে আনে মঙ্গলকে। মঙ্গল সবাইকে প্রণাম করে আগরওয়ালকে জানায় যে ঠিকেদারের দেওয়া দাদনের টাকায় ও ব্যাংকের লোন চুকিয়ে দিয়েছে ।

--হল তো? আমি কোন বে-আইনি কাজ করি নি ম্যানেজার বাবু।আপনারা আসতে পারেন। হ্যাঁ, যদি ইঁট কেনেন তো আপনাকে একশ’ আশিতে দেব, এর কমে নয়।

আমি ওখান থেকে সরে আসি। মঙ্গল ওর ঘরে নিয়ে যায়। 

বলে –নারাজ ঝন হোবে সাহাব। রাগ করবেন না । আমার জমিটা ছিল একটুকরো টিকরা—সমতল মাঠের মত। ওতে চাষবাস হয় না। ঠিকেদার সাহেব ইঁট বানাতে মাঠ খুলে কাঁকর সাফ করে গর্ত খুঁড়ে ক্ষেত বানিয়ে দিল। আর তিনমাস পরে বৃষ্টি নামবে, ইটের কাজ শেষ,ওর সঙ্গে চুক্তি শেষ। তখন এখানে ধান লাগাব। মিছে বলছি না, এই যে মিনিমাগনা ক্ষেত তৈরি হয়ে গেল এটা আমি নিজে করলে অনেক পয়সা লাগত, উলটে আমি আগাম পেয়ে ব্যাংকের পয়সা ফেরত দিলাম। 

আর ঘর চলে মহুয়া, মৌরি থেকে চোলাই বানিয়ে। এক বোতল দশ রুপয়া। আজ আপনি এক বোতল নিয়ে যান, পয়সা লাগবে না। খেয়ে দেখুন, খাঁটি জিনিস। না জল মেশানো, না নিশাদল বা ইস্পিরিটের মিলাবট। কোন রিস্ক নেই। 

কে বলে আদিবাসী মানে খুব সহ্জ সরল বোকাসোকা লোক!



তিনদিন হল শ্বশুরবাড়ি থেকে টেলিগ্রাম এসেছে যে আমার মেয়ে হয়েছে। কিন্তু আমি যেন শিগগির ছুটি নিয়ে দেখতে আসি। অল ওয়েল। কাম শার্প, ওয়ান উইক লীভ ইত্যাদি। আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। নিমকি ভাল আছে তো? কাম শার্প কেন লিখেছে? 

কিন্তু যাব কী করে? খান্ডে ছুটিতে, জগন নতুন, প্রোবেশনে আছে। কাকে চার্জ দেব? 

কোরবা গিয়ে হেড অফিসে আর্জেন্ট কল লাগালাম। সাতদিন পরে অন্য ব্রাঞ্চ থেকে রিলিভার এল। ছেলেটা ভাল। সব শুনে বলল—আপনি তিনদিনের জন্যে যান, গিয়ে প্রসূতির স্বাস্থ্যের কথা লিখে টেলিগ্রাম করে আরও চারদিন বাড়িয়ে নেবেন। বাকি আমি দেখে নেব। 



ওকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে গেওরা লোক্যালে চড়ে বসলাম। বিলাসপুর স্টেশনে একটা কনেক্টিং ট্রেন মিস করে পরেরটা ধরে যখন শ্বশুরবাড়ি পৌঁছুলাম তখন রাত দেড়টা। একটা রিকশাকে ডাবল ভাড়ায় রাজি করিয়েছিলাম। দু’বার কলিংবেল বাজিয়ে সাড়া না পেয়ে নিমকির ছোটভাই মনীশের নাম ধরে বারকয়েক ডাকার পর উঠোনের আলো জ্বলল। কয়েক সেকন্ড নিস্তব্ধ। তারপর মনীশের চিৎকার—জীজাজি আ গয়ে, জীজু আ গয়ে!

হইচই পড়ে গেল। ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠল, এমনকি সামনের দুটো বাড়িতেও। শাশুড়ি অপ্রস্তুত; এতদিন বাদে দামাদবাবু এসেছে, তাও মাঝরাতে—কী করে ঠিকমত যত্নআত্তি করা যায়!

কিন্তু নিমকি কোথায়! আর বাচ্চাটা?

বিস্তর চেঁচামেচির মাঝে যা বুঝলাম—সিজারিয়ান হয়েছিল, চারদিন আগে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। মা ও মেয়ে সুস্থ আছে, চিন্তার কারণ নেই । ওরা ভেতরের ঘরে ঘুমোচ্ছে।



শাশুড়ি আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেছেন।

--হাত-পা ধুয়ে জামাকাপড় ছেড়ে ফেল, বরং গরম জল করে দিচ্ছি। ক’ফোঁটা ডেটল মিশিয়ে চান করে ফেল। ছোট বাচ্চার কাছে সাবধানে যেতে হয় । তারপর অল্প কিছু মুখে দিয়ে তাড়াতাড়ি শুতে যাও। বাকি কথা কাল হবে।



ঘরে নীল আলো জ্বলছে।

মশারির ভেতরে দু’জন ঘুমে কাতর। কাঁথায় মোড়া একটা ছোট্ট পুঁটলি আর ওপাশে এক নারীশরীর—ঘুমের মধ্যেও একটা হাত বাচ্চাটার গায়ে। 

আমি আস্তে করে ওই হাতটা ছুঁই, অল্প করে আমার দিকে টানি। কিন্তু এক ঝাপটায় হাত আমার কবল থেকে সরে যায়—জেগে আছে?

নাঃ ; তিন-তিন বারের ব্যর্থ চেষ্টা, হাল ছেড়ে দিই। রেগে আছে আমার ওপর? কেন এত রাগ? সিজারিয়ানের সময় হাজির হইনি বলে? ঠিকমত খবর পৌঁছয়নি যে! তবু শেষ দুটো মাসে আমার সপ্তাহের শেষে কয়েকবার আসা উচিৎ ছিল , ভুল হয়ে গেছে। কিছু ভুল জন্মের সময়ে দেয়া বিসিজি টীকার মত—যার দাগ সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়।

এবার অন্ধকারে ছায়াশরীরের মুখে আলতো করে হাত বোলাই—চোখ, নাক, ঠোঁট।

আচমকা কেউ আমার দুটো আঙুল কামড়ে ধরে।



জানলার কাঁচ, মশারির জাল পেরিয়ে বিছানায় ঢুকছে ভোর। কেউ আমাকে ধীরে ধীরে ঝাঁকাচ্ছে। আমার চোখে কাঁচা ঘুম। নিমকি আমার হাত টেনে কাঁথা জড়ানো পুতুলের গায়ে রাখে।

--আমি বাথরুমে যাচ্ছি। তুমি ওকে ধরে রাখ, যেন পড়ে না যায়।

না, পড়ে যাবেনা । ধরে রাখব, সারাজীবন। ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করি।

তখন কি জানতাম যে অনেক কথাই রাখা যায় না?



নাঃ , চারদিনেই ফিরে এসেছি। টাকা চাই, সিজারিয়ান ইত্যাদিতে ওঁদের অনেক খরচ হয়ে গেছে। ওঁরা এক পয়সা নেবেন না। কিন্তু নিমকি জিদ ধরেছে—হাসপাতালের বিল নিয়ে যাও, অফিসে ক্লেইম জমা কর। নিয়মে কেটেকুটে যাই দিক তা আমাকে পাঠাও, আমি বাবাকে ঠিক গছিয়ে দেব।

টের পাচ্ছি, আমার ভেতরে কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। পুরনো কলকব্জা বদলে যাচ্ছে। কারণ?

ওই পুতুলটা! ছোট্ট ছোট্ট হাত, এইটুকু-টুকু পা। ফোকলা মুখে যখন তখন হাসে, আবার ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ওঠে। ওকে চাই । ওর ভিজে কাঁথা বদলে দেব, মুখে দুধের বা জলের বোতল গুঁজে দেব। কোলে করে পায়চারি করে আয়-ঘুম আয়-ঘুম লোরি শুনিয়ে ঘুম পাড়াব। একদিন মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে খলবলিয়ে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াবে। তারপর একদিন আমার আঙুল ধরে হাঁটি -হাঁটি-পা-পা করে টলতে টলতে সোজা হয়ে দাঁড়াবে। 

আমার দেরি করা চলবে না । ট্রান্সফার চাই, নইলে এই সময়টা—মাত্র কয়েকমাস—কখন আঙুলের ফাঁক দিয়ে খসে পড়বে। এবার হেড অফিসে তদবির করব। লজ্জা কিসের? সবাই করে। আমি কিছু অন্যায় আবদার করছি না। এত বছর বনেবাদাড়ে জঙ্গলে নদীর পারে সোনামুখ করে রয়েছি; নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছি। এখানেও তিনবছর হয়ে গেল।



টাকাপয়সা ধারধোর করে জোগাড় হয়েছে। নিমকিকে মনিঅর্ডার করেছিলাম, প্রাপ্তিসংবাদ এসে গেছে। কিন্তু শান্তিতে দুটো হফতা কাটাব তার জো নেই। গতকাল কেটেছে এক নয়া লফড়া সামাল দিতে । 

পনের দিন আগে ঘর থেকে ফেরার সময় জগন এক সলজ্জ তরুণীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে—ওর বৌ। খান্ডে, নরেশ ও মনবোধি ওর পেছনে লেগেছে—নয়ী ভাবীকি হাত কী খানা খায়েঙ্গে। কিন্তু আজ সক্কালে দুই বুড়ো, দুই জোয়ান ও এক মহিলা ওর ঠিকানা জিজ্ঞেস করে গাঁয়ের দিকে গেছল; বেলায় খবর এল যে আজ ও ডিউটি করতে পারবে না –ঘরে জরুরি কাজ। বৌকে ডাক্তার দেখাতে হবে।

সারা স্টাফ মুচকি হাসল—মাত্র পনের দিনেই ডাক্তার!

আমি সবাইকে ধমকালাম যাতে নিজের কলিগের সম্বন্ধে ছ্যাবলামি না করে কাজে মন দেয়।

এরপর সন্ধ্যেবেলা যা ঘটল তার জন্যে আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না।

খবর এল আমাকে জগনের বাড়িতে যেতে হবে—ওখানে সালিশী সভা চলছে। এখন আমার মতামতের পর ব্যাপারটার ফয়সালা হবে।

গিয়ে দেখি দাদুসাহেব আগেই পৌঁছে গেছেন। দু’জন পঞ্চও আছে। উনি আমার জন্যে যা যা ঘটেছে তা সংক্ষেপে ফের বললেন। 

জানা গেল তরুণীটির সঙ্গে জগনের সামাজিক ভাবে বিয়ে হয়নি। শুধু তাই নয়, মেয়েটির বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তাকে ও বিয়ের দিন ভোরে মোটরবাইকে চাপিয়ে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে। এই দলটির একজন মেয়ের ভাই, অন্যজন বৌ হারানো যুবক। দুই বুড়োর একজন মেয়েটির বাবা, অন্যজন যুবকটির। মেয়ের বাবা আবার ওদের গাঁয়ের মুখিয়া।

ওরা পনেরদিন ধরে খোঁজার পর আজ এদের নাগাল পেয়েছে। এখন এর একটা বিহিত করা দরকার।

মাই গড! এ তো একেবারে পৃথ্বীরাজ-সংযুক্তা কেস! আর ওই রোগাপটকা ছিরকুটে দাঁত মিনমিনে জগন এমন হিরো! মানুষ চেনা সত্যি কঠিন।

আপনারা কী চান? মানে আপনাদের রীতিরেয়াজ কী বলে?

মেয়ের ভাই চেঁচিয়ে উঠল – আগের দিনকাল হলে জগনকে কেটে ফেলতাম! গাঁয়ের সীমানায় ধরতে পেলে তাই করতাম। এমন অপমান? সমাজের মুখে চূণকালি?

ওর হলেও-হতে -পারত- স্বামীটি বলল—দুটোকেই।

দাদুসাহেব হাত তুললেন। সিয়ানেরা বলুন—আপনারা এতদূর থেকে আমার গাঁয়ে এসেছেন, আপনারা কী চান?

ছোঁড়া দুটো আবার চেঁচিয়ে উঠল – হমেঁ ন্যায় চাহিয়ে।

মুখিয়া হাত তুলে শান্ত গলায় বললেন—এখানে যাই ফয়সালা হোক সেটা জগনকে মানতে হবে। নইলে আমরা কোরবা থানায় গিয়ে ডাইরি করব। জগনের গিরেফতারি হবে। তাহলে ম্যানেজার সাহেব ওকে লাথ মারকে সরকারি নৌকরি সে নিকাল দেঙ্গে। ইয়ে টুরা কী গর্মী নিকাল জায়েগী। আমরা চাইব ও মেয়েটিকে ওর বাপ-ভাইয়ের হাতে ছেড়ে দিক, আমরা ফিরিয়ে নিয়ে যাব। অব পঞ্চনকে জো মঞ্জুর।

সরকারি চাকরির গুমর! সব বেরিয়ে যাবে। এখন বাকি পাঁচমাথা যা বলেন।

আমি হাত তুলি। বলি—হক কথা। এই বৈঠকে যা ফয়সালা হবে সেটা সবাইকে মানতে হবে। আমরা এখানে বসেছি সমস্যার জট ছাড়াতে, জট পাকাতে নয় । মেয়েটি কি নাবালিক? মানে চৌদ্দ বছরের কম? তাহলে বাপ-ভাই ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। কী হে জগন? ক্যা বোলতে হো? নাবালিক মেয়েকে ভাগিয়ে এনেছ? তাহলে আমিই তোমাকে থানায় দেব।



জগন এতক্ষণ মাথা নীচু করে একপাশে বসেছিল, একটাও কথা বলেনি। এবার মুখ তুলে তাকিয়ে বলল—ওর মিডল পাসের সার্টিফিকেট সঙ্গে আছে। ওর বয়েস ষোল। আর ও নিজের ইচ্ছেয় আমার সঙ্গে এসেছে। ভাগিয়ে আনি নি।

ছেলেদুটো লাফিয়ে ওঠে।

ঝুঠ বোল রহে। লাবারি মার রহে। উস মিঠলবরাকে বাতোঁ মেঁ মত আইয়ে সাহাবমন। বিলকুল ভগাকে লে আয়ে হ্যাঁয় । পুরে গাঁও কো মালুম। মড়ওয়া গাড় গিস। ওকর বাদ ইয়ে কান্ড ।

মিথ্যে কথা বলছে। ওই মেনিমুখোর মিঠে মিঠে কথায় ভুলবেন না সাহেবেরা। গাঁয়ের সবাই জানে যে বিয়ের মঞ্চ সাজানো হয়ে গেছল। তারপরও ভাগিয়ে এনেছে।

--যাও, গিয়ে স্কুল পাসের সার্টিফিকেটটা আমাদের দেখাও। তারপর বৌমাকে নিয়ে এস। সবার সামনে নিজের মুখে বলুক ওর কী ইচ্ছে।

দাদুসাহেবের কথায় আমিও সায় দিই।

--ইয়ে কেইসা ন্যায়? বাপ-ভাইকে বাতোঁ কী কোই কীমত নহীঁ?

আমি হাত তুলি। দেখ, যদি ও নাবালিক হয় তাহলে আমি জগনকে নিজে গিয়ে ভেলইবাজার ফাঁড়িতে পুলিশের হাতে দেব। চাকরি তো যাবেই, কয়েক বছর জেলের চাক্কি ঘোরাতে হবে।

আর যদি ও বালিগ হয় তবে ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওকে আটকে রাখলে বাপ-ভাই সমেত আমরা সবাই জেলের ঘানি টানব। এবার ও কাগজ নিয়ে আসুক, --দুধ কে দুধ, পানি কী পানি! 

জগন কাগজ নিয়ে এসে দাদুসাহেবের হাতে দেয় । উনি মন দিয়ে সইসাবুদ সীলমোহর দেখে মাথা হেলান। মেয়েটির বয়েস ষোল বছর চারমাস। এবার ভেতরের ঘরের চৌকাঠ ধরে ঘোমটায় প্রায় মুখ ঢেকে দাঁড়িয়েছে এক নারী। আমি দাদুসাহেবের দিকে তাকাই।

--বেটি, কোই ডরেকে বাত নহীঁ। তোর সঙ্গ ন্যায় হোহী। যো যো পুছতন সচ সচ বাতাবে। সির্ফ হাঁ অউ না । এখানে তোর বাপ-ভাই এসেছেন । ওঁরা বলছেন জগন তোমাকে মড়োয়া থেকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে তুলে এনেছে। সচ? 

মেয়েটি প্রবল বেগে মাথা নাড়ে। বাপ-ভাই উত্তেজিত, নিজেদের মধ্যে নীচু গলায় কিছু বলাবলি করে। 

যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তাকে তোমার পছন্দ? তার ঘর করবে?

আবার দু’দিকে মাথার আন্দোলন। 

তুমি জগনের সঙ্গে থাকতে চাও? কোন জবরদস্তি নেই, তোমার কি তাই ইচ্ছে?

মেয়েটি ওপর নীচে মাথা হেলায়।

তুমি বাপ-ভাইয়ের সাথে ঘরে ফিরতে চাও? 

মেয়েটি ফুঁপিয়ে উঠে দু’দিকে মাথা নেড়ে প্রবল আপত্তি জানায়। 

কাঁদছ কেন ?

ওমন মোলা মার ডারহি। ওরা আমায় মেরে ফেলবে। 

মেয়ের বাবার আক্কেল গুড়ুম। 

এসব কী বলছিস নোনী? তোকে এতটুকু থেকে খাইয়ে পড়িয়ে বড় করেছি, এখন তোকে মারব? সাহেবরা বলছেন তুই নাকি বড় হয়েছিস, যেখানে ইচ্ছে বিয়ে কর, যার সঙ্গে ইচ্ছে থাক। কিন্তু একটা কথা; নিজে মুখ পুড়িয়েছিস আর ওই মুখে আমাদের গাঁয়ে পা রাখিস না । আর জেনে রাখ, বাড়ি থেকে বিপদে আপদে একটা ফুটো কড়িও পাবি না। 

জোয়ান ভাই বিড়বিড় করে—শালা জগন! নিঘঘাৎ আমার বোনকে জাদুটোনা করে বশ করেছে। নইলে—

মেয়ের বাপ শেষ চেষ্টা করে। আমার মেয়ের তো বিয়েই হয়নি। তাহলে কোন পরিচয়ে ও জগনের সঙ্গে থাকবে? 

জগন মুখ খোলে—বাজে কথা; আমরা আহিরণ নদীর পারে সর্বমঙ্গলা মন্দিরে দেবীর সামনে মালাবদল করে পূজারীর আশীর্বাদ নিয়েছি, গলায় মঙ্গলসূত্র সিঁথেয় সিঁদূর পরিয়েছি । সেটা মিথ্যে?

এবার ছেলের বাপ, ওদের মুখিয়া, বলে—সব বুঝলাম। কিন্তু আমাদের সমাজেরও কিছু রীত রয়েছে। জগন আমার হোনেওয়ালে বহুকো চোরিছুপে ভগাকে লে আয়া—ইতনা তো পক্কা! অব হমনকে আনেজানে কী খর্চ ওলা দেনা পড়হি। অউ শাদিবর হমন সভোলা বোগরা-ভাত খিলানা পড়হি। 

চোরের মত আমার হবু ছেলেবৌকে ভাগিয়ে এনেছে এটাতো প্রমাণ হয়েছে। এখন ওকে আমাদের চারজনের আসাযাওয়ার খাইখরচ দিতে হবে। আর আজ রাত্তিরে খাসির মাংস ভাত খাওয়াতে হবে। তবে কাল সকালে বিদায় নেব।

বুঝলাম, গান্ধর্ব বিবাহেও খর্চা আছে।

জগনের মুখে ছিরকুটে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। ও জানে পেটে খেলে পিঠে সয়। তক্ষুনি ও সালিশীসভার সবাইকে এবং ব্যাংকের সব স্টাফকে রাত্তিরে মাংস ভাত খাওয়ার নেমন্তন্ন করে বসল। রাঁধবে ওর বৌ—তবে না বৌভাত!

(আগামী কিস্তিতে শেষ

0 comments: