গল্প - শতাব্দী দাশ
Posted in গল্পকবে থেকে মৃত্যু চেয়েছি? যবে থেকে দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুতাম? দেওয়ালে ছিল নোনা ধরার দাগ। খসে পড়া রঙ, চুন। আঁকাবাকা ব-দ্বীপের রেখা। হাত বোলাতাম তাদের গায়ে। বাঁ কবজিতে প্রথম কাটা দাগটা ক্লাস টেনে আঁকা। ওটা এখন হারিয়ে গেছে, যেভাবে কোনো কোনো দ্বীপ জোয়ারজলে হারায়। তারপর, বাঁ-ডান, কবজিতে প্রায়শই ব্লেড ঘষতাম। ব্লেডের একটা ধার ছোঁয়াতাম। সামান্য চাপ দিতাম। রক্তরেখা ফুটে উঠত। তুলে নিতাম। আবার একবার। এইভাবে এবড়ো খেবড়ো অনেকগুলো দাগ। তারা আজও আছে। একেবারে ঘ্যাঁচ করে কেটে ফেলতে পারতাম না কেন ধমনী? তখনও মায়া ছিল। দেওয়াল নোনা ধরা, তবু সমুদ্রের ঘ্রাণ।
হাসপাতালে শুয়ে আছি। ঢলঢলে পোশাক আর মাস্ক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেবিকারা। এক স্ট্রিপ ওষুধ গিলেছি এই খেপে। বিগত সময়ে যে সকল পরিজনেরা খসে গেল অতিমারীতে, এমন নয় যে তাদের ছাড়া জীবন অচল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মৃত্যু আমাকে ঘোরের মতো পেয়ে বসল, জানেন? অধরাকে যেন ধরাছোঁয়ার ভিতর অনুভব করলাম। এই যেমন ধরুন মুঠোর মধ্যে ফোন, এর মধ্যেও মৃত্যু আছে। ফেসবুক খুলে আপনি হয়ত দারুন মজার একটা কথা লিখলেন। সেই সময় হঠাৎ মৃত্যুসংবাদ আছড়ে পড়তে পারে টাইমলাইনে। মনে হতেই মুঠোফোন ফেলে দিই ছুঁড়ে, যেভাবে টিকটিকি গায়ে পড়লে ঝেড়ে ফ্যালে মানুষ। ওটা বিছানায় মুখ থুবড়ে পড়ে। সেবিকা ঘুরে তাকায়। অথচ দেখুন, আমি মৃত্যুর দিকেই ধাবিত হয়েছিলাম। মৃত্যু এক টক্সিক সঙ্গীর মতো যুগপৎ আকর্ষণ আর বিকর্ষণ করে আমায়। পুল অ্যান্ড পুশ। আমি আবার মোবাইল মুঠোয় ভরি। গ্যালারিতে যাই। ছবি দেখি। পাহাড়ি, শ্যাওলা-শ্যাওলা পথ। আমাদের মুখ দেখা যাচ্ছে না। সার বেঁধে হাঁটছি। পিছন থেকে ছবিটা তুলেছিল কেউ। আমার সামনে স্যাক কাঁধে মেয়েটা, সে মারা গেছে মাসখানেক আগে৷ মুঠোফোন খবর এনেছিল। আমি মনে মনে তাকে বলি, 'আসছি'। এরকম সময়ে ঘরবাড়ি-সংসার নিবে আসে। কিংবা আসলে ঘরে ফিরতেই মন চায়, যে ঘর আমার।
নিউ জলপাইগুড়ির আগের স্টেশনের নাম 'নিজবাড়ি' বলে সেখানে আমার নেমে পড়তে ইচ্ছে করেছে কতবার! যেখানে জন্মেছিলাম, তা কি আমার নিজ-বাড়ি? কেউ বা কিছু ছিল কি ওখানে, যাকে নিজের বলে দাবি করতে পারি? হারমোনিয়ামখানা অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে খুঁজে পাইনি। মাসতুতো বোন নিয়ে গেছে। মা বলল, পড়ে পড়ে নষ্ট হবে বেলো না টানলে নিয়মিত। কোনো অনুভূতি হয়নি শুনে,অভিমান বা খারাপ লাগা। অনুভূতিশূন্যতা যে অভ্যাস করেছি, তাও তো স্বহত্যাসমান। আপন ঘর পেলে জীবনের মানে খুঁজে পাওয়া সহজ হয় হয়ত বা। মানুষ থিতু হতে পারে। হয়ত দার্শনিক ভাবেও। স্বপ্নে নিজেকে ট্রলি টানতে দেখি চড়াই বরাবর। আর কিছু এগোলেই ঘর। অথচ কোনো স্বপ্নেই কোথাও পৌঁছই না।
যেখানে থাকি, সেখানেও ঘর নেই, জানেন? ওই কোণটি গৃহকর্তার কাজকর্মের। সেই কোণটি ছেলের পড়াশোনার। ঠাকুরঘরটি শাশুড়ির। চিলেকোঠার ঘরটি শ্বশুরের। ডাইনিং টেবিলে বসে 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' করি,রান্নার নির্দেশ দিতে দিতে। আহা কর্তৃত্ব! ঘর কই? নিজ-ঘর? গুনগুন করি,
'দেখ্ ওই সুধা-সিন্ধু উছলিছে
পূর্ণ ইন্দু পরকাশে
ভুতের বোঝা ফেলে ঘরের ছেলে
আয় চলে আয় আমার পাশে।'
হেসে ফেলি। 'ঘরের ছেলে'-কেই কেবল ঘরে ফিরতে ডেকেছেন, হে কবি! আমি যাই কোথা? কবিকে মনে মনে ক্ষমা করে দিই। ডিপ্রেশনের ওষুধ একটি একটি করে রোজ টুপ শব্দে ফেলে দিই পুকুরের জলে। ঘরে ফেরার ছক কষি। নিশ্চিত জানি, সেসময় আমার ঠোঁটের কোণে ক্রূর হাসি ফোটে।
*****
আত্মহত্যাই একমাত্র গুরুতর দার্শনিক সমস্যা। টু কমিট সুইসাইড অর নট টু কমিট সুইসাইড। কেন করব না আত্মহনন? জীবন যদি অর্থহীন ভার হয়, দুঃস্বপ্ন শেষে ভারহীন জেগে উঠব না কেন? এই দেখুন, 'মৃত্যু'-কে 'জেগে ওঠা' বললুম আমি। যেমন কোভিড-এ নেগেটিভ ইজ পজিটিভ। মাঝে মাঝে মনে হয় না কি, অর্থহীন জীবনে অযথাই অর্থ আরোপ করি? কেন করব?
'কেন করব' ভাবতে ভাবতে তবু করে চলি। ধরা যাক জীবনের অর্থ এক্স। এক্সের জায়গায় আপনি মনোমতো কিছু একটা বসাবেন আর ভাববেন বেঁচে থাকার কতই না ব্যঞ্জনা! এক্স-এর মান আমি ধরলাম সম্পর্ক। স্বামী, পুত্র...এই কি জীবনের নিহিতার্থ নয়? ছেলের বাবা অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছিল। ছেলেটা কাঁদছিল বড়। সত্যি বলতে, কষ্টই হয়েছিল। কিন্তু ডিনার,লাঞ্চ, জামা ইস্তিরি আমার উপর নির্ভর না করলে কাঁদত কি তারা? ভালবাসা আমার বায়বীয় ঠ্যাকে। অতএব বায়ুপ্রবাহের নিয়ম মেনে আমার ছেড়ে যাওয়া জায়গা পূরণ হবে, এমনই দস্তুর।
পরিপাটি গার্হস্থ্যের আয়োজন ছাড়া নিজের মূল্য আছে কিনা, তা বুঝতে আলগা প্রেমও করেছিলাম দু-একটি। প্রেমিকদের ধর্ম, তাদের কথাবার্তা হতে হয় আলংকারিক। 'প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি' গোছের। যেন প্রাণ বিষয়টা বড় দামি। প্রাণের ক্ষুধাতৃষ্ণামৈথুন অতিরিক্ত অর্থ আমিও খুঁজেছি। পেলে বেঁচে যেতাম। সাম্প্রতিক প্রেমিকটি সমাজবদলের কথাও বলত অবশ্য, মার্লবরোর ধোঁয়া উড়িয়ে। অতএব ধরুন, এক্স ইজিকুয়াল্টু আদর্শবাদ, সাম্য। প্রথম প্রথম আমার ভাল লাগত তার স্বপ্ন-দেখা চোখ। বিপ্লবের ওপারে কি নিজ-বাড়ি আছে? দিন,মাস,বছর ঘুরল। সাম্য এল না। ভেবে দেখুন, বিশ্বচরাচরের একটি ছোট গ্রহ। তার একটি ছোট কোণ। সেখানে পিঁপড়েসম লোভ, ঈর্ষা, স্বার্থপরতা। তা থেকে উদ্ভুত অসাম্য। তা থেকে উত্তরণের আন্দোলন। তার মধ্যেও আবার মার্লবরো, বিচ্যুতি, বিভাজন, গোপন ঈর্ষা…কি প্রচন্ড ছোট! যত ভাবি, নিজেই সংকুচিত,বিন্দুবৎ হয়ে যাই। সাম্য যদিও এল না, তবু মিছিল-টিছিলের পর শরীর দেওয়া-নেওয়া হল অনেকবার। প্রেমিকের ভাবখানা ছিল,যেন সেই কাজটিও বিপ্লবের অংশ। যেন পরিবারতন্ত্রকে ভেঙেচুরে দিচ্ছি আমরা অপারিবারিক যৌনতা দিয়ে। যে গোপনীয়তা ও পরাক্রম নিয়ে সে আমার শরীর দখল করত, তাতে আমার সোভিয়েতের উত্থান ও পতনের সময়কার দুটি সামরিক ক্যু-এর কথা মনে পড়ত৷ নিঃশব্দ ও নির্মম। তাকে বলিনি কখনও, দুটো ক্যু-ই আমার একরকম লাগে। সে আহত হত। সোভিয়েত তার ঈশ্বর। সকলেরই নিজ নিজ ঈশ্বর থাকে। ঈশ্বর না থাকলে জীবন যন্ত্রণার, আমার মতো।
ঈশ্বর বা জীবনের অর্থ, কিছু একটা খুঁজে না পেলে মাথা ফাঁকা লাগে, জমি সরে যায়।
যদি মরে যাই, কাঁদবে ওরা। তারপর একদিন মুণ্ডিতমস্তকে ছেলে শ্রাদ্ধে ভোজ্য উৎসর্গ করবে। ওর বাবা দাঁড়িয়ে থাকবে পাশে। প্রেমিকটি মন খারাপ করে বেশি মদ খাবে কয়েকদিন। তারপর পূর্ববৎ। সকাল দশটায় স্বামীর ব্যস্ততা। সাড়ে বারোটায় ছেলেটার স্কুলগাড়ি। বিকেলে শহরে মিছিল। অনিত্যতাই নিত্য। বিস্মৃতিই সত্য৷ ওই শোক,মুণ্ডন, শ্রাদ্ধ...সবই অর্থহীন।
*****
এখন চার বিছানার ওয়ার্ডে একটি বিছানা ফাঁকা। দুই বৃদ্ধা সঙ্গী আমার। পাশের বিছানার ডিলিরিয়াম শুরু হয়েছে। আপাতত মনে করার চেষ্টা করছে , কার সঙ্গে হাসপাতালে এসেছিল? কী প'রে? সেই শাড়ি খুলে কে পরালো কয়েদির পাৎলুন জামা? 'আগরতলা? আগ্রা? আহিরিটোলা?' স্মৃতি হাতড়ে আ দিয়ে নানা নাম বলছে সে। কোথা থেকে এসেছে সে? কিংবা আমি? কেনই বা এলাম?
পরের বেডে আরেক বৃদ্ধা। তার পাশে এসে বসেছে দুই তরুণ ডাক্তার।
-কোন সাল এটা?
বৃদ্ধা নিশ্চুপ।
-কোন মাস?
নিস্তব্ধ।
-কোন ঋতু, জানেন?
বৃদ্ধার মুখে হঠাৎ আলো। বলেন,
- শরৎকাল।
-কোন দেশে থাকেন?
-বাংলা। বাংলাদেশ।
মস্তিষ্ক কি দেশভাগের আগে থমকে গেছে? কোনো এক প্রিয় মুহূর্তে আমিও কি চাইলে থমকে যেতে পারি? মুখের শরতের রোদ জ্বেলে?
'হেথা বাতাস প্রীতি-গন্ধ ভরা
চির স্নিগ্ধ মধু-মাসে
হেথা চির-শ্যামল বসুন্ধরা
চির-জ্যোৎস্না নীল আকাশে ।'
হাসপাতালে সব বেলাকেই অনন্ত দুপুর মনে হয়। খাবার-ট্রলির আসা-যাওয়া দিয়ে সময় মাপি। স্যালাইন চলে টিপ টিপ। ড্রেসিং বেঞ্চে অনিচ্ছুক খেলোয়াড়, বসে আছি। খাওয়ার জন্য এবার স্যালাইন খুলল। ভাতে ডাল, আলু, কাঁকরোল মিশিয়ে কিছু খুচরো পুষ্টি যোগ করব জীবনে। প্রথম বৃদ্ধাকে মালয়লী নার্সটি খাইয়ে দিচ্ছে যত্নে। বৃদ্ধা এখনও মনে করতে পারছে না সাকিন। কিছু করুণা, কিছু স্নেহ তারা যোগ করে গেল। শরতের আলো মাখা বৃদ্ধাটির পাশে এখনও ঝুঁকে আছে দুই তরুণ ডাক্তার।
-ঘরের যেকোনো তিনটি জিনিসের নাম বলুন।
বৃদ্ধা যেন প্রশ্ন-কমন-পড়া বালিকা।
-বিছানা। চেয়ার। খাতা।
হাততালি। জীবনে কিছু প্রত্যয় যোগ হল। কিছু অকারণ আনন্দ।
-আচ্ছা, এবার একটা গোল আঁকতে পারবেন, মাসিমা?
সম্পর্ক যোগ হল? বৃদ্ধা কাঁপা হাতে গোল আঁকছে। কি আশ্চর্য! মোটামুটি নিখুঁত সে বৃত্ত। আমার চামচ থমকে যায়। বৃত্তটা ঘুরতে শুরু করে লাট্টুর মতো খাতার উপরে। তার চারপাশে কক্ষপথ নির্মিত হয়। সে কক্ষপথের সমান্তরালে আরও অনেক কক্ষপথ। প্রতিটি-তে বৃত্তরা ঘোরে। কক্ষপথগুলি যে অগ্নিবৃত্তটি ঘিরে আছে, তাকে ছুঁয়ে আমার চোখ প্যান করে তেমন অজস্র অগ্নিগোলকে, এবং তাদের ঘিরে থাকা কক্ষপথগুলিতে, এবং সেইসব কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান বৃত্তে। আমারও ক্ষুদ্র থেকে ছিটকে বৃহতে বিলীন হওয়ার কথা ছিল.. যদি না ওই অ্যবুলেন্স,এই স্যালাইন...'কী সংগীত ভেসে আসে, মহাসিন্ধুর ওপার হতে'… নোনা দেওয়ালে যে সমুদ্রের ডাক শুনেছিলাম তা কি মহাসিন্ধু ?
ভিজিটিং আওয়ার্সের ঘণ্টা বাজল। নিচের তলায় প্রিয়জনেরা উদ্বিগ্ন ও অপেক্ষমান। প্রিয়জন কে? সে কি নিজঘরের চেয়ে প্রিয়? তখন প্রথম বৃদ্ধার মুখ মুছিয়ে দিচ্ছিল নার্স। দ্বিতীয় বৃদ্ধার আঁকা বৃত্তের প্রশংসায় যুবকদ্বয় 'টেন অন টেন' বলছিল। ছেলে আসবে আজ। আর তার বাবা। এইসব কেন্দ্রাভিমুখী টান! ব-দ্বীপ আঁকা দেওয়াল আমার বড় গভীরে নোনা ধরিয়ে গেছে। সম্পর্কের আঙুল তা স্পর্শ করতে পারবে কি কোনোদিন? ওরা এসে পড়ল বলে। আমি ছিটকে বেরিয়ে যেতে চাই কেন্দ্রাতিগ বলে দেয়াল ভেঙে। ফুটপাথে আমার ছেতরে পড়া রক্তাক্ত দেহটি কল্পনা করি। ওরা এগিয়ে আসে। আমার হাতের চ্যানেলের দিকে চেয়ে ছেলে ডুকরে ওঠে। কেন হে বালক? কেন এ মায়া? 'মা গিয়েছে, যেতে যেতে গানটি গেছে ফেলে...' যে মায়ের গানের খাতা হারিয়ে গেছে, সে মা কী ফেলে যায় ছেলের তরে? কিছু রেখে যাওয়া কি আদৌ আমার দায়? রেখে যাওয়ার দায় কি এক অর্থপূর্ণ দায়? ওরা আমাকে ফিরতে বলছে। ওরা কথা বলতে চায়। ওদের কখনও বলা হয়নি 'নিজবাড়ি' নামের স্টেশনটির কথা। নোনা ধরা দেওয়ালের কথাও বলিনি কাউকে। সংলাপ মরে গেলে মানুষ শূন্যের দিকে এগিয়ে যায় দ্রুত। কথা ভালোবাসা নির্মাণ করে। আদর্শবাদও। কথা ঈশ্বর ও অর্থ নির্মাণ করে। টু কমিউনিকেট অর নট টু কমিউনিকেট, দ্যাট ইজ দ্য কোয়েশ্চন।
0 comments: