0

ধারাবাহিক - গার্গী বসু

Posted in




















 (পর্ব ৭)

স্কুল থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যেতেই বিলি দেখল রাস্তা বন্ধ। কতগুলো লোক ভিড় করে খুব হইচই করছে। বিলি কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। চে গেভারা নামে একজন মানুষ নাকি কিসব বিপ্লবধর্মী বই লিখেছেন, সেই নিয়েই জটলা। কানাঘুষো শুনে মনে হচ্ছে মানুষটি বেশ জনপ্রিয়। দু-একটা টুকরো কথা বিলির কানে এল।

আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিলির চোখের সামনে একটা দৃশ্য ফুটে উঠল। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কয়েকজন বিচিত্র মুখোশধারী মানুষ চলেছে গুঁড়ি মেরে। কখনও গাছের পেছনে লুকিয়ে থেকে, কখনও বুকে হেঁটে বা কনুইতে ভর দিয়ে সামনে এগিয়ে চলেছে তারা। তাদের চোখে কালো কাপড় বাঁধা। হলদেটে সবজেটে বস্তা কেটে জামার মত করে তাদের গায়ে চাপানো। কখনও গাছের পেছনে লুকিয়ে, কখনও মাটিতে শুয়ে পড়ে, গুঁড়ি মেরে নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে শত্রুর ওপরে। শত্রু না মিত্র বিলি জানেনা। শুধু দেখতে পাচ্ছে, সামনে থেকে আসা একদল লোক, যাদের হাতে বড় বড় বন্দুক। নির্মমভাবে গুলি চালাচ্ছে তারা। মুখোশধারী মানুষগুলো চুপিসাড়ে বন্দুকধারী মানুষগুলোকে ঘায়েল করছে, তাদের মেরে ফেলে উঠে দাঁড়াচ্ছে, তারপর আবার চলছে সামনে। এরাই “গেরিলাবাহিনী।“ একটা কালো টুপি পরা লোক এদের নেতা। ওঁরই নাম আর্নেস্তো চে গেভারা।

বিলি এর আগে এই নামটা শোনেনি কখনও। আজই শুনল আর সঙ্গে সঙ্গে দেখতেও পেল। এরকম আগে হোত না। এরকমটা হওয়া শুরু হয়েছে কিছুদিন ধরে। হঠাৎ করে বিলির চোখের সামনে ফুটে ওঠে এমন সব দৃশ্যপট যেখানে বিলি দেখতে পায় অচেনা মানুষ, অচেনা জায়গা, বাড়ি-ঘর, রাস্তা; বা অজান্তেই সাক্ষী হয়ে যায় সম্পূর্ণ অচেনা কোন ঘটনার। এই যে কিছু অচেনা লোকের কথা-বার্তায় শুধু চে গেভারার নামটা শুনেই বিলি দেখতে পেল কে এই মানুষটা।

চটকা ভাঙতেই ভিড়টা থেকে সরে এসে আবার স্কুলের রাস্তায় ফিরতে লাগল বিলি। হঠাৎ মনে পড়ল, আরও একটা রাস্তা আছে যেটা স্কুল থেকে বিলির বাড়ির দিকে যায়। কিন্তু সেই রাস্তায় যাওয়া মানা। দিদার নিষেধ আছে ঐ রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবে না। রাস্তাটা একটু বেশিই নির্জন। জনবসতি থেকে দূরে সেই রহস্যময় জঙ্গলটার পাশ দিয়ে বেঁকে গেছে বলেই হয়ত। বিলি জানে দিদা কেন এত ভয় পায়। ঐ রহস্যময় ভুতুড়ে জঙ্গলে বিলি যদি হারিয়ে যায়? দিদা মাঝে মাঝেই বলে, বিলি ছাড়া দিদা-দাদুর আর কেই বা আছে? তাইতো ওরা বিলিকে সবসময় আগলে রাখে। সেই কারণেই হয়তো পিসিকে ওরা পছন্দ করে না। 

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বিলি। তারপর দিদার হাজার বারণ করা সত্বেও পা বাড়াল জঙ্গলের রাস্তায়। বিলির বাড়ির পেছনের রাস্তা ধরেও এই জঙ্গলে ঢোকা যায় তবে, সেটা অন্যদিক। এই দিকটা একেবারেই অচেনা বিলির। রাস্তাটা শুনশান। লোকজনের চলাচল নেই বললেই চলে। বিলি একাই হাঁটছে। দুপুর গড়িয়ে সবে বিকেল হচ্ছে। একটা নরম হলুদ আলো ছেয়ে আছে সবখানে। কিছুটা এগিয়েই রাস্তাটা দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। যেদিকটা বড় রাস্তার সাথে গিয়ে মিলেছে, সেদিকটা ছেড়ে বিলি হাঁটতে লাগলো উল্টোদিকে। এই রাস্তাটাই বেঁকে গিয়ে জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেছে। সামনের দিকে এগোতে থাকলে দেখা যায় কিছু পরিত্যক্ত বাড়িঘর-দোকানপাট, একসময় এখানে মানুষজন ছিল। কোন অজানা কারণে ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে গেছে জায়গাটা। তাতে আরও বেশি গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি হয়েছে। জঙ্গলের কাছটায় দুপুর গড়িয়ে আসা মরা হলুদ আলো ফিকে সবুজে পরিণত হয়েছে। গাছে-গাছে লেগে সবজেটে হয়ে আছে চারপাশ। বিলির গায়ে জলপাই সবুজ রঙের কার্ডিগান। ঝাঁকড়া চুলগুলো চুড়ো করে বাঁধা। ওকে দেখে মনে হচ্ছে যেন এই জঙ্গলেরই একটা মানব সংস্করণ চলেছে। বিলির গায়ের রঙ রোদ ঠিকরে পড়া গমের মত। গাছের ফাঁকে ফাঁকে একটা মিশমিশে আলো-ছায়ার মধ্যে বিলিকে আর আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে না। জলপাই কার্ডিগানটা ভাল করে গায়ে টেনে নিল বিলি। ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে যাবে একটু পরেই। তখন শীত করবে। জঙ্গলের ভেতর দিকটায় কি বড় বড় আগাছা। গাছ থেকে নেমে আসা ডালপালা মাটির কাছাকাছি পৌঁছেছে। বড় বড় পা ফেলে বিলি এগোয়। বাড়ির রাস্তাটা কোনদিকে?

রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে বিলি আরও এগোতে থাকে। আশ্চর্য রকমের শান্তি বিরাজ করছে চারিদিকে। কোন শব্দ নেই কোথাও। বিলির হঠাৎ মনে হল এই বিশাল পৃথিবীতে আবার ও একা হয়ে গেছে। বাবা-মা নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর এরকমই মনে হত। ঠিক সেই অনুভূতিটা ফিরে এল আবার। বাবা-মায়ের কথা মনে হতেই বিলির মনে পড়ে গেল পরপর সব ঘটনা। প্রথমে বাবা-মা ওকে ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। তারপর অনাথ আশ্রম থেকে ওর বন্ধুদের ছেড়ে চলে আসতে হল দিদার সাথে। দিদার বাড়িতে ডার্বি ছিল একমাত্র সঙ্গী। কিন্তু হায় রে ভাগ্য! ডার্বিও ওকে ছেড়ে চলে গেল। ডার্বির কথা মনে হতেই বিলির চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। ওর মনে পড়ে গেল সেই দিনটার কথা। ডার্বির মৃত্যুর পরে একদিন ভার্জিনিয়া পিসি এসেছিল দিদার কাছে। দুজনের বাকবিতণ্ডায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিলি কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। ওদের বাড়ির পেছনের দিকে আরও একটা দরজা আছে যেটা সরাসরি বাগানে নিয়ে যায়। পারতপক্ষে ওইদিকটায় কেউ যায় না। বিলিরও অনুমতি নেই যাওয়ার। বিলি উঁকি মেরে দেখেছিল কাছাকাছি কেউ নেই। তারপর সন্তর্পনে পা বাড়িয়েছিল পেছনের দরজা দিয়ে বাগানের দিকে। এদিকটা আগাছায় প্রায় ঢেকে গেছে। বড় বড় গাছের ছায়ায় ঠান্ডা আর স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। সূর্যের তেজ বোঝা যায় না। বড় বড় ঘাস পেরিয়ে বিলি হাঁটছিল আপনমনে। বাড়ির দেওয়াল যতটা বিস্তার করে আছে ততদূর হেঁটেই যাওয়া যায়। ঘাসের মধ্যে কখনও পায়ে লাগে এবড়ো-খেবড়ো মাটি, পাথরের টুকরো। বিলি একটু অবাক হয়। দাদু-দিদাকে বরাবর দেখেছে বাগানটাকে খুব যত্ন করতে। তাহলে এই দিকটায় এমন অযত্ন করে রেখেছে কেন? হঠাৎ বিলি দেখেছিল, একটা জায়গায় ঘাস-লতাপাতাগুলো কেমন যেন উঁচু হয়ে আছে। কোন খরগোশ বা বেড়াল জাতীয় প্রাণী ঘাসের নিচে পিঠ উঁচু করে বসে থাকলে যেমন দেখাবে খানিকটা সেরকম। বিলি তাড়াতাড়ি সেদিকে এগিয়ে গিয়েছিল। প্রথমেই হাত না দিয়ে পা দিয়ে সেখানকার ঘাস-পাতা সরিয়ে দেখল। আর কি আশ্চর্য! পুরু ঘাসের চাদরের নিচে দেখা গেল পাশাপাশি দুটো জং ধরা বিশাল লোহার আংটা। এমন একটা চমকের জন্য বিলি মোটেই প্রস্তুত ছিল না। আরও খানিকটা ঘাস সরানোর পর দেখা গেল একটা গোলাকার চাকতির মত দেখতে জিনিসের ওপরে আংটা দুটো আটকানো আছে। যেমন দরজার পাল্লায় হাতল লাগানো থাকে ঠিক সেরকম। আচ্ছা, এটা একটা দরজার মত দেখতে কেন? নাকি এটা সত্যি একটা দরজা? বিলির মন বলছিল এই পাল্লাটার ওদিকে কিছু একটা রহস্য আছে। এতদিন এটা চোখে পড়েনি কেন!

সঙ্গে সঙ্গে হাতল ধরে টান মারল বিলি। দরজাটা নড়ে উঠল কিন্তু পুরোপুরি খুলল না। এবার দুটো হাতল একসঙ্গে ধরে সমস্ত শক্তি দিয়ে খোলার চেষ্টা করল। একটা মৃদু চড়চড় শব্দে পাল্লাটা মাঝখান বরাবর ফাঁক হয়ে গেল। ভেতরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। দরজাটা পুরোপুরি খুলে ফেলল বিলি। একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নীচের দিকে। সূর্যের আলোয় যতদূর দেখা যাচ্ছে, শুধু সিঁড়ি। কিসের সুড়ঙ্গ এটা? কোথায় যাচ্ছে এটা? মাটির নিচে কি একটা গুপ্ত ঘর? বিলি রোমাঞ্চিত হয়েছিল। ও কি কোন গুপ্তধনের সন্ধান পেতে চলেছে? সূর্যের আলো অত দূর পৌঁছতে পারছে না। নিচটা অন্ধকার। বিলি সামনে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করল। নাহঃ কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। চুপ করে কান পাতল বিলি। বিলির নিজস্ব নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। বিলি চোখ বন্ধ করে পা বাড়িয়েছিল সিঁড়িতে।

সিঁড়িটা নাতিদীর্ঘ। কয়েকটা ধাপ মাত্র। বিলি সাবধানে এগোল। ধাপে ধাপে পা রেখে নামতে লাগল নিচে। বেশ মজবুত সিঁড়িটা। শেষ ধাপে এসে বোঝা গেল এরপর সামনে যেতে গেলে অন্ধকারে ঠাহর করে এগোতে হবে। কিন্তু এই জায়গাটায় একটা চেনা চেনা গন্ধ আছে। বিলি একবার উপর দিকে তাকাল। ঝকঝকে নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে সুড়ঙ্গের দরজার বাইরে। বিলির হঠাৎ মনে হল এরকমটা আগেও হয়েছে, এই রাস্তায় সে আগেও এসেছে। কিন্তু বিলি তো জানতই না এই দরজাটার কথা। ও এখানে কি করে আসবে? অন্ধকারে হাঁটার অভ্যেস যেন অনেক পুরোনো। বিলি হাত মুঠো করল। দুই চোখ বন্ধ করে নিল। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠল ওর। আর ঠিক তখনই কপালের আধবোজা সাদা দাগ চিরে দপ করে জেগে উঠল একটা চোখ। একটু ঘোলাটে চোখটার মণি ঘন নীল। অক্ষিপল্লবহীন আয়ত চোখটা পুরোপুরি খুলে গেল। নরম দ্যুতিময় এই তৃতীয় চোখ। অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখছে বিলি। সিঁড়িটা এসে শেষ হয়েছে শক্ত কাঠের মেঝেতে। অনেকদিন কারুর পা পড়েনি এখানে মনে হয়। বেশ বড় ঘরটা। দেওয়ালে কত ছবি টাঙ্গানো। অনেক পুরনো সব ছবি। বিলি মন দিয়ে দেখতে লাগলো। ছবিতেও ওদের বাড়িটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাড়ির সামনে লাইন দিয়ে অনেক ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেদের পরনে গ্যালিস দেওয়া প্যান্ট আর ফুলহাতা জামা। মেয়েরা পরেছে লম্বা ফ্রক বা গাউন। তাদের হাতে বেতের ঝুড়ি। কারুর কারুর মাথায় বেড় দিয়ে আছে ফুলের মুকুট। সবার হাসিমুখ। পাশের ছবিটা বোধহয় বাগানে তোলা। একজন বয়স্ক লোক বসে আছেন চেয়ারে। তার কাছ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে নয়-দশ বছরের একটি ছোট্ট মেয়ে। পরনে ফ্রক আর চুলে রিবন বাঁধা। এই মেয়েটিকে ভীষণ চেনা লাগল বিলির। বয়স্ক লোকটির পেছনে দাঁড়িয়ে আছে একটু বড় একটি মেয়ে। আরে!! এই মেয়েটাকে অবিকল ভার্জিনিয়া পিসির মত দেখতে। একইরকম ঠোঁট টেপা চাপা হাসি। এটা কি ভার্জিনিয়া পিসির ছোটবেলার ছবি? কে জানে? হবেও বা। বিলি হাত বাড়িয়ে দেওয়াল থেকে খুলে নিল ছবিটা। ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটা যেন শেষ হয়নি। ছবির একপাশে সাদা বর্ডারটা নেই তো। বাকি সব ছবিগুলোর আছে। ছবিটা হাতে নিয়ে পেছনে ওলটাতেই দেখা গেল ফ্রেমের বাইরে কিছুটা অংশ মুড়িয়ে ছবির পেছনে গুটিয়ে রাখা হয়েছে। গুটিয়ে যাওয়া অংশটা হাত দিয়ে টেনে টেনে সোজা করতে লাগল বিলি। এতদিনের পুরনো কাগজ। অযত্নে ছিল। টেনে সোজা করার পর দেখা গেল মুড়িয়ে রাখা অংশটায় কোন মহিলার ফ্রকের কাপড় দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মুখটা বোঝা যাচ্ছে না। এই ছবিটা বেশ লম্বাটে ধরণের। ছোট ফ্রেমে ছবিটাকে গুটিয়ে রাখারই বা কি মানে হতে পারে? বিলি হাত বুলিয়ে ছবিটা মুছল। কিন্তু ঠিক তখনই কি যেন ঘটে গেল। বিলি স্পষ্ট দেখল ছবির মধ্যে সবচেয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে অবিকল তার মত দেখতে একটি মেয়ে। সেই ঝাঁকড়া চুল, জোড়া ভ্রূ আর কপালে আড়াআড়ি শুয়ে থাকা চাঁদ। বিলির মাথার মধ্যে সব ওলট-পালট হয়ে গেল। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল সে।

0 comments: