Next
Previous
Showing posts with label someপ্রতীক. Show all posts
2

Someপ্রতীক - নাসের হোসেন

Posted in
 


একবার অরুণদা কবিতাপাক্ষিক - এর জন্য দুটো বই রেডি করেছিলেন। প্রভাতদা ও আমি গিয়েছিলাম। কবিতার বইটির নাম " ওড়াউড়িতে নয়" এবং গদ্যের বইটি " কবির কথা,কবিদের কথা"। বইদুটির নাম অন্যরকম দিয়েছিলেন অরুণদা। প্রভাতদা সেটা বদলে দিয়ে এই দুটি নাম দিলেন এবং অরুণদারও নামদুটি পছন্দ হয়েছিল।

ঠিক হল বইমেলায় (পার্কস্ট্রিটের মুখে) কোনো একদিন অরুণদা তাঁর বইদুটিতে সই করবেন স্টলে একঘণ্টা বসে। অটোগ্রাফ যারা নিতে চায়, তারা নেবে।একদিন ঘোষণাও করে দেওয়া হল,আগামীকাল অরুণদা কবিতাপাক্ষিক স্টলে বসবেন,তাঁর কাব্যগ্রন্থ ও গদ্যগ্রন্থ সই করবেন।

নির্ধারিত দিনে আমি যথাসময়ে পৌঁছে গেলাম অরুণদার অ্যাপার্টমেন্টে। ওনার মেয়ে ও জামাই বলে দিলেন,নাসের আপনি বলেই একা ছাড়ছি। তবু খুব চিন্তায় থাকবো।স্টলের বসা শেষ হলেই যথাসময়ে বাড়িতে নিয়ে আসবেন। অরুণদা তৈরি হয়ে নিয়ে স্বভাবসিদ্ধ হাসতে হাসতে বললেন, আরে নাসের আছে,ও খুব সিনসিয়ার এবং পারটিকুলার এসব ব্যাপারে। 

ট্যাক্সি থেকে নেমে বইমেলায় কিছুটা পথ হাঁটতে হবে,সামনেই কবিতাপাক্ষিক স্টল। অরুণদা বললেন, বইমেলায় হাঁটতে খুব ভালো লাগছে। বলতে না বলতে সামনে এসে গেল কয়েকজন ফুটফুটে সুন্দরী 

ফরাসি মেয়ে, ইউনিভার্সিটির ছাত্রী এরা, গবেষিকা। অরুণদা ওদের সঙ্গে হাসতে হাসতে ফরাসিভাষায় কথা জুড়ে দিলেন। আমার সঙ্গে ওদের পরিচয়ও করিয়ে দিলেন, বললেন,নাসের হোসেন বাংলার কবি,আমার তরুণ কবিবন্ধু। যাইহোক মেয়েগুলির সঙ্গে তাঁর কথা আর থামে না। হাতঘড়ি দেখছি, সই করার সময়টা প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে।বাধ্য হয়ে বললাম,অরুণদা স্টলে সকলে অপেক্ষা করছে।যাইহোক, কোনোমতে মেয়েগুলিকে বিদায় জানিয়ে শেষপর্যন্ত কবিতাপাক্ষিক স্টলে পৌঁছে গেলেন। সময়ের নড়চড় হয়নি। তবু প্রভাতদা ভেবেছিলেন,আমরা আর- একটু আগে এসে পৌঁছোবো। প্রভাতদা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, একটু দেরি হয়ে গেল যে! অরুণদা হাসতে হাসতে বললেন, স্টলের কাছেই ফরাসি সুন্দরীদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। নাসের এমনি বেরসিক, বারবার তাগাদা দিচ্ছে। ফরাসি সুন্দরীদের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না, বলো তো?

যাইহোক, বইদুটির ক্রেতারা এবং সইশিকারিরা অরুণদার সই নিতে থাকলো। অরুণদার মেজাজ সবসময় খোশমেজাজ। যেন কোনো চাপই লাগছে না তাঁর।

ঠিক একঘণ্টা পর অরুণদা উঠে পড়লেন। যথাসময়ে মেয়ে ও জামাইয়ের কাছে পৌঁছতে হবে। অরুণদা ও আমি বইমেলার বাইরে এসে ট্যাক্সির খোঁজ করছি, কিন্তু পাচ্ছি না। এমনসময় স্বস্তিক অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়ার মিনিবাস এসে সামনে দাঁড়ালো। অরুণদা 'এসো নাসের' বলেই ঝপ করে উঠে পড়লেন মিনিবাসে। লোক বেশি ছিল না,কিন্তু সিটগুলো ভর্তি ছিল। তিনি দুহাত উপরে তুলে রড ধরে দাঁড়ালেন।আমি একটু জোরেই বলে উঠলাম, বিখ্যাত কবি অরুণ মিত্র- কে বসবার একটা সিট দিন। সঙ্গেসঙ্গে ঠিক সামনের ভদ্রলোক উঠে দাঁড়লেন। অরুণদা বসলেন।পরে আমিও বসার জায়গা পেলাম।স্বস্তিকে যথাসময়েই পৌঁছে গেলাম আমরা।উপরে ফ্ল্যাটে পৌঁছতেই উমাদি ও আশিসদা প্রায় সমস্বরেই বলে উঠলেন, বাহ্ যথাসময়ের আগেই তো এসে গেছেন! অরুণদা আমাকে আর- একটু বসে যেতে বলছিলেন। কিন্তু আমার অন্য জায়গায় যাওয়ার ছিল। অরুণদা বললেন, তোমার কাল কি অন্য কোনো কাজ আছে? না থাকলে কাল অবশ্যই এসো আমার কাছে। তাঁর মুখের হাসি তখনো অমলিন।
0

Someপ্রতীক - ছন্দা দাশ

Posted in



হেডিং পড়ে কপালে ভাঁজ পড়লেও দিনের আলোর মত‌ই সত্যি যে বর্তমান প্রজন্ম উল্লেখ করার মত‌ই ব‌ই বিমুখ হয়ে পড়েছে দিন দিন।এর প্রভাব কিন্তু একদিন একটা জাতির জন্য অভিশাপ বয়ে আনবে।বাবা মা ভাবছেন এখন দিনকাল যা পড়েছে তাতে ওরা তো নিজেদের পাঠ্যবই পড়তেই সময় পাচ্ছে না তাতে আবার অন্যব‌ই ?সে কিছুতেই হয়না। রেজাল্ট ভালো করতেই হবে।তা না হলে ভালো স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না।সে সবার পিছনে পড়ে থাকবে। জীবন ব্যর্থ হবে। একথা সত্যি যে বর্তমান সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের নামে স্কুল পর্যায়েই লেখাপড়ার যে পরিমাণ চাপ, এতে করে স্কুলের পড়া শেষ করতেই তারা হিমশিম খাচ্ছে। তাই নির্দিষ্ট কিছু ব‌ইয়ের বাইরে অন্য কোন ব‌ই পড়ার সময় ও সুযোগ তেমন একটা থাকে না। এখনকার বাচ্চারা ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যায় আর না হয় গৃহশিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে। স্কুল থেকে ফিরে এসে আবার ব‌ইখাতা নিয়ে বসে।হোম‌ওয়ার্ক শেষ করে যতটুকু সময় পায় , তারা ঘুমিয়ে রেস্ট নেয় আর নয়তো খেলাধুলা করে। তবে তাদের খেলাধুলা মানে মোবাইল বা কম্পিউটারে বসে ভিডিও গেইম খেলা। সন্ধ্যার পর আবার স্কুলের পড়া শিখতে হয়।রাতের পড়া শেষ করে অল্প কিছু সময় পেলে তারা টিভিতে কার্টুন বা অন্য কোন আকর্ষণীয় প্রোগ্রাম দেখতে বসে।স্কুলের নির্দিষ্ট কিছু ব‌ইয়ের বাইরে অন্য কোনো ব‌ইয়ের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই। অভিভাবকরা ও চায়না তাদের সন্তান স্কুলের ব‌ইয়ের বাইরে অন্য কোন ব‌ই পড়ুক।এসব কারণে নতুন প্রজন্ম ব‌ই পড়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।তারা খুব ভালো রেজাল্ট করে ও মেধাবী হতে পারছেনা। আমরা এখন কী দেখছি? মাধ্যমিক পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া শিক্ষার্থী বাংলা নববর্ষ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ভাসা ভাসা। ভালো কোন ধারণা নেই। এরজন্য মূলত দায়ী আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও আমাদের অভিভাবকদের মানসিকতা। এভাবে যদি চলতে থাকে তবে অদূর ভবিষ্যতে পাঠক শূন্য আমাদের দেশ হবে। ইতিমধ্যেই তার প্রমাণ পাই আমরা যখন শপিং সেন্টার ,ব‌ইমেলার দিকে দৃষ্টিপাত করি। একসময় বড় বড় শপিং সেন্টারে একটি বা দুটি বইয়ের দোকান অবশ্যম্ভাবী ছিল। ছোটবেলায় আমরা সেসব দোকান থেকে ছোট ছোট গোয়েন্দা সিরিজের বই, রূপকথার ব‌ই, শিশু কিশোর ম্যাগাজিন ইত্যাদি কিনে নিজেকে রাজা মনে করতাম। যতক্ষণ না সে ব‌ই পড়তে না পেয়েছি মনে শান্তি আসতো না।পড়ার পর সে ব‌ই আবার বিনিময় করতাম বন্ধুদের সাথে।সে আর এখন নেই।এ প্রসঙ্গে আমাদের অন্যতম কবি আসাদ চৌধুরী বলেছেন "এখন আর ব‌ই প্রকাশ করিনা। কার জন্য করবো, কিসের জন্য করবো?এখন তো ব‌ইয়ের পাঠক নেই। যখন ছিল তখন ব‌ই প্রকাশের আগ্রহ ছিল। এখন ব‌ই প্রকাশ করলে প্রকাশকের কাছে লজ্জায় পড়তে হবে।

আরেকজন অন্যতম প্রধান কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন,"আমি ভেবে কুল পাইনা পাঠকেরা কোথায় হারিয়ে গেল? আমি তো এখনও লিখছি। কিন্তু সেই আগ্রহী পাঠক কোথায়? তবে কি আমি ভালো আর লিখতে পারছি না?এই দুই কবির আক্ষেপ থেকেই সুস্পষ্ট ফুটে উঠেছে ব‌ই পড়া থেকে আমরা কতটা বিমুখ হয়েছি। অথচ একথা ভুলে গেলে চলবে না একমাত্র ব‌ইই পারে মানুষের মানসিক উন্নয়ন ঘটাতে, জ্ঞান অর্জনের দ্বার উন্মুক্ত করতে।ব‌ই হচ্ছে সেই বন্ধু,যে একজন মানুষকে তার ভালোমন্দ বিচারের সর্বোত্তম পরামর্শ দিয়ে থাকে।যে মানুষ ব‌ই পড় তার চিন্তা চেতনা অনেক গভীর,তার দূরদর্শিতা,তার জীবনবোধ সমাজের, দেশের, পরিবারের জন্য কল্যাণকর। এইজন্যই ভিক্টর হুগো বলেছেন "ব‌ই বিশ্বাসের অঙ্গ,ব‌ই মানব সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য জ্ঞান দান করে।অত‌এব ব‌ই হচ্ছে সভ্যতার রক্ষা কবচ।"আর হেনরি ওয়ার্ড বলেছেন' ব‌ইয়ের মতো ভালো সঙ্গী আর কিছু নেই।ব‌ইয়ের সঙ্গে কথা বলা যায়,ব‌ই উপদেশ দেয়, কিন্তু কিছু করতে বাধ্য করায় না"

একটু পিছন ফিরে যখন দেখি মনে হয় কতো দ্রুত দিনগুলো পাল্টে গেল।তখন ও ঘরে ঘরে টেলিভিশন
আসেনি। থাকলেও স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ছিল না।তখন বিনোদনের একমাত্র সেরা মাধ্যমে ছিল ব‌ই। প্রায় প্রতি ঘরেই ব‌ই পড়ার প্রবণতা ছিল সদস্যদের। জন্মদিন, রেজাল্ট ভালো হলে বড়রা ছোটদের ব‌ই উপহার দিতেন।সেই ব‌ই পেয়ে ছোটরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠতো।বার বার নতুন ব‌ইয়ের গন্ধ শুঁকে যেন ওরা তৃপ্তি লাভ করতো। বড়রা ও অবসর সময়ে বসে গল্প, উপন্যাসের পাতায় নিজেদের মগ্ন থাকতো। বড়দের দেখেই তো ছোটরা শেখে। তাই ওরাও ব‌ই পড়ার প্রতি অনুরক্ত হয়। দূর্রভাগ্যবশত এখন বড়রাও আর ব‌ই পড়ে অবসর সময় কাটায় না। বরং তারা জি বাংলা,ষ্টার প্লাস,ষ্টার জলসার পঁচা,উদ্ভট,শিক্ষাহীন সিরিয়ালগুলোর মধ্যে আটকে থাকে। যখন আমাদের দেশে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলো প্রভাব বিস্তার করে , তখন থেকেই মূলত ব‌ইয়ের পাঠক ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এরপরে ভিসিডি, ডিভিডি প্লেয়ার, কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন এল।ওসবের প্রতি আকর্ষণের কারণে ব‌ইয়ের প্রতি আকর্ষণ আরও হ্রাস পেল।আর এখন তো সামাজিক মাধ্যমের মধ্যেই ছেলে, বুড়ো, যুবক, যুবতী সবাই আসক্ত।এ যেন মাদকাসক্তির চাইতেও মারাত্মক। মহামূল্যবান ব‌ই পড়ে র‌ইল অযত্নে, অবহেলায়। বাচ্চারা এখন কি দেখছে? বাবা,মা,ভাই,আপু সবাই ফেসবুক আসক্ত। ছোটরা তো বড়দের দেখেই শিখবে। তাই ওরাও আর ব‌ই পড়ে না।ওতে ওদের কোন আগ্রহ নেই। এভাবে চললে অদূর ভবিষ্যতে আমরা মেধাহীন জাতিতে পরিণত হব।এ থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে‌ই হবে। আমার, আপনার জন্য, দেশের জন্য। আমাদের নতুন প্রজন্মকে ব‌ইয়ের দিকে টানতে হলে সবার আগে ওদের হাতে ব‌ই তুলে দিতে হবে। অভিনয় করে হলেও তাদের সামনে প্রতিদিন নিয়ম করে ব‌ই পড়তে হবে।এতে করে ওরা বড়দের অনুসরণ করে ব‌ইয়ের দিকে আকৃষ্ট হবে। এটা পরিবার থেকেই দায়িত্ব নিতে হবে। তাই আসুন আপনার প্রজন্মকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য আজ‌ই,এখুনি‌ই ব‌ই পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে সচেষ্ট হোন।ব‌ই পড়ার সুদিন ফিরে আসার প্রত্যাশায় আমরা জাগি।
0

someপ্রতীক - রীতা পাল

Posted in






এবারের someপ্রতীক যেদিন লিখতে বসেছি, সেদিনের যে খবরটি মনকে নাড়া দিয়ে গেলো, সেটি হলো – ধর্ষণ। দুই নাবালিকা বোনকে বাড়ি থেকে কয়েকজন তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে, যার মধ্যে একজন নাবালকও ছিলো। দুই বোন বাড়ি ফিরে কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বড়ো বোন মারা যায়। ছোটো বোনের জবানবন্দীতে নাবালক সহ কয়েকজন ধরা পড়েছে।

ধর্ষকদের ব্যবস্থা যা করার, আইন করবে। আমার প্রশ্ন – দুই নাবালিকার আত্মহত্যার চেষ্টা নিয়ে। ধর্ষণ তো অনেক হলো, শাস্তিও বেশ কিছু। বদল ঘটলো কি কিছু?

নারী হিসেবে, মা হিসেবে মনে হচ্ছে, মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু ভুল থেকে যাচ্ছে না তো? প্রাণ ফিরে পেয়েও তারা ‘প্রাণ’কেই সবচেয়ে বড়ো পাওয়া বলে ভাবতে পারছে না কেন? আমরা কেন তাদের শেখাতে পারছি না – তোমার একমাত্র পরিচয় – তুমি নারী। ধর্ষিতা নয়। অপরদিকে যারা ধর্ষক, তারা কখনোই পুরুষ নয়। তারা ধর্ষক। 

‘ধর্ষণ’ একটা দুর্ঘটনা ছাড়া কিছুই নয়। এটা এমন একটা দুর্ঘটনা, যা কেবল মেয়েদের জীবনেই ঘটে। ঘরে থাকলেও ঘটতে পারে। কোনো কোনো মেয়ের জীবনে একাধিকবারও ঘটতে পারে। লজ্জা তার নয়, সমাজের। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবর্তন না আনতে পারলে ফোটার আগেই কিন্তু অনেক কুঁড়ি ঝরে পড়বে।

মেয়েদের আত্মরক্ষা শেখানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে – খুব ভালো কথা। কিন্তু মনোজাগতিক পরিবর্তন না হলে সে শিক্ষা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
1

someপ্রতীক - সুমিকমল

Posted in

ঋতুপর্ণ ঘোষ এমন একজন মানুষ যে  তাঁর সম্পর্কে লেখা খুব সহজ কাজ নয়, আমি জানিনা আমি ওনাকে নিয়ে লেখার জন্য যোগ্য মানুষ কিনা, যখন ঋতবাকের তরফ থেকে আমাকে লিখতে বলা হয় মনে মনে একটু দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে ছিলাম কিন্তু এই প্রিয় পরিচালক নিয়ে লিখতে হবে মনে করে বেশ খুশিও হয়েছিলাম। গত 31st আগস্ট তার জন্মদিন ছিল সুতরাং সেই কথা মাথায় রেখেই ঋতবাকের  সবিনয় শ্রদ্ধার্ঘ রইল এই মহান পরিচালকের প্রতি। 1963  31st আগস্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ ঋতুপর্ণ ঘোষ। মাত্র 49 বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। হীরের আংটি নামক চলচ্চিত্র টি তিনি প্রথম পরিচালনা করেন, ছবি করার ক্ষেত্রে তার অনুপ্রেরণা হলেন বিশ্ববরেণ্য পরিচালক স্রী সত্যজিৎ রায়।এই কথা তিনি অকপটে বলেছেন ও লিখে গেছেন অনেক পত্র পত্রিকায়। 

খ্যাতির মধ্যগগনে থাকতে থাকতেই হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন উনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।

এক অদ্ভুত শূন্যতার সৃষ্টি  হলো আজকের সিনেমা জগতে। যাত্রা শুরু হীরের আংটি দিয়ে এবং শেষ হলো তা চিত্রাঙ্গদায়।

টলিউড ও বলিউডের অনেক নামি দামি শিল্পীদের নিয়ে উনি কাজ করেছেন,খুব অনায়াস ভাবে।

ঋতুপর্ণ ঘোষ কে  ঘিরে মানুষের ছিল অনেক কৌতূহল ,কিন্তু তিনি ছিলেন অসম্ভব স্বাধীন ও দৃঢ়চেতার মানুষ, 

যে কোনো সাক্ষাৎকারে তিনি ছিলেন একেবারেঅকপট।যা বলতেন তা তার অন্তরের বিশ্বাস থেকে বলতেন। তিনি বাঙালি সাবেকি রান্না খেতে খুবই পছন্দ করতেন।

একবার সৌভাগ্যবশত আমার ওনার বাড়ি যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল,সে ই বাড়িতে যেমন ছিল অজস্র বই, আর ছিল অজস্র সিনেমার ডিভিডি, 

এম এল এ ফাটা কেষ্ট  থেকে শুরু করে স্টিফেন স্পিলবার্গ এর ছবি কিছুই বাদ নেই।

এমন কাব্যময় গৃহ আমি আগে কখনো দেখিনি।উনি তেমন মানুষের সাথেই আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন  যাদের সঙ্গে তার সুক্ষবোধ মেলে।

কাজের বিষয় ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও শ্রদ্ধাশীল।তার অধিকাংশ ছবি  নয় জাতীয় না হয় আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন।

বড় অসময় চলে গেলেন এই প্রতিভাধর মানুষ টি ,না জানি তার ঝুলিতে আরো কত পুরস্কার জড়ো হতে,আর আমরা বাঙালিরা গর্বে ভয়ে উঠতাম।

তিনি এই সময়ের মধ্যে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে গেছেন উচ্চমানের এগারটি ছবি। আর তার কোনো ছবির শুভমহরত হবেনা কিন্তু আবহমান ধরে চলবে তার হিরের আংটি থেকে চিত্রাঙ্গদা কে নিয়ে এই সফরের কাহিনী নিয়ে আলোচনা।

আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তোমাকে অকুন্ঠ শ্রদ্ধা জানাই ,আর চাই দীর্ঘায়ু নিয়ে আবার ফিরে এসো এই বাংলায় আমরা সমৃদ্ধ হই তোমার সৃষ্ঠ শিল্প কে চাক্ষুষ দেখে।

12

someপ্রতীক - রানা পাল

Posted in





সঠিক সালটা এই মুহূর্তে মনে নেই। আশির দশকের শেষ, নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিক। আনন্দবাজার গ্রুপের একটি পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় একটি উপন্যাস প্রকাশিত হলো, নাম ‘বাৎসরিক’। নতুন লেখক। নাম আগে দেখিনি। পড়বো কি পড়বো না ভেবে পড়তে শুরু করি, আর সেই পড়া ছেড়ে উঠি সোজা লেখার শেষে। প্রায় এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলেছিলাম, এবং বলা বাহুল্য, মুগ্ধ হয়েছিলাম। এত পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, যেন প্রতিটি দৃশ্য চোখের সামনো পরিস্কার দেখা যায়। একটি দৃশ্যের পর আরেকটি দৃশ্য – এরকমভাবেই ভাগ করা ছিলো লেখাটি। উপন্যাস হিসেবে প্রকাশিত হলেও আদপে ওটি ছিলো একটি চিত্রনাট্য। লেখকের নাম ঋতুপর্ণ ঘোষ। এই চিত্রনাট্যই যে পরবর্তীকালে ১৯শে এপ্রিল নামক চলচ্চিত্রের রূপ নেবে, এবং সেই চলচ্চিত্রের নির্মাণযুদ্ধে যে আমিও একজন সৈনিক হিসেবে শামিল থাকবো, সেদিন সে কথা জানা ছিলো না।

ঋতুর সঙ্গে উমার পরিচয় উনিশশো বিরানব্বইতে। আমার তখন তিনটে ছবি এবং একটি অতি জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালে কাজ করা হয়ে গেছে। আমাদের এক প্রোডাকশন সহকারী বন্ধু গৌর গাঙ্গুলী এক সন্ধ্যায় আমায় নিয়ে গেছিলো ঋতুপর্ণর সঙ্গে আলাপ করাতে। ঋতু তখন কাজ করতো একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায়। তখনও চাকরিটা ছাড়েনি। ছেড়েছিলো ১৯শে এপ্রিলের সাফল্যের পর। আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহার্য নানান জিনিসের বিজ্ঞাপনে ঋতুর লেখা কালজয়ী সব ক্যাপশন আজও জ্বলজ্বল করে। তার কিছু যেমন – বোরোলীন চিরদিন। বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। আলু চিপসের ‘ফান মাঞ্চ’ নামটি ঋতুর দেওয়া। এরকম আরও কত! সব তো আমার জানা নেই, কারণ আমি বিজ্ঞাপনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। তবে ঋতুর সঙ্গে দুটি উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞাপন ছবিতে ওর সহকারী থাকার সৌভাগ্য হয়েছিলো।

ঋতুর সঙ্গে প্রথম যখন আমার পরিচয় হয়, তখন ওর প্রথম ছবি হীরের আংটি করা হয়ে গেছে। এই অসাধারণ ছবিটি তৈরি হয়েছিলো চিল্ড্রেন্স ফিল্ম সোসাইটির প্রযোজনায়, তাই এর বাণিজ্যিক মুক্তি ঘটেনি। দূরদর্শনে এখনও দেখানো হয় প্রায়ই।

আমি চিরকালই একটু মুখচোরা, কম কথা বলা মানুষ। কিন্তু ঋতুর গুণেই প্রথম দিন থেকেই কাছের মানুষ হয়ে গেলাম ওর। শুধু আমি নয়, পরবর্তী সময়ে দেখেছি, শুটিং দলের সকলের সঙ্গেই ওর একান্ত সখ্যতা ছিলো। পরিচালক হিসেবে কোনও আলাদা রাশভারী ইমেজ ওর তৈরী করার দরকার পড়েনি কোনওদিন। সকলেই ওর মেধার কাছে, কাজের কাছে, বশ্যতা স্বীকার করতো, মানতো, সম্মান করতো, ভালোবাসতো।

ঋতু প্রায় সবাইকেই তুই বলে সম্বোধন করতো। তাই নিয়ে নানা মহলে নানা কথা হয়েছে বটে, কিন্তু আমি জানি, সেটা ছিলো ওর মানুষকে আপন করে নেওয়ার প্রথম ধাপ। এই কারণে বয়স্ক অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ওর সঙ্গে কাজ করতে এসে প্রথমটা একটু তটস্থ থাকতেন বটে, কিন্তু অচিরেই অন্তরঙ্গ হয়ে উঠতেন ওর সঙ্গে। সুপ্রিয়া দেবী, মাধবী মুখোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়... এঁদের সবাইকেই ঋতু দিদি এবং তুই বলতো। তাঁরাও ওকে তুই সম্বোধনই করতেন, এবং এর মধ্যে কোথাও কোনও অসম্মান ছিলো না। ছিলো শুধু ঋতুর মানুষকে আপন করে নেওয়ার ইচ্ছা ও ক্ষমতা।

ঋতুর প্রায় সব ছবিতেই যখন চিত্রনাট্য লেখা শুরু হতো, ডাক পড়তো আমার। আমি ওর প্রায় সব ছবির চিত্রনাট্য লেখার সাথী ছিলাম। ওর লেখার পদ্ধতিটা ছিলো অদ্ভুত। ও ঘরের মধ্যে পায়চারী করতে করতে বলে যেত, আর আমি লিখে যেতাম। লিখতে লিখতে আমার কোনও কিছু প্রস্তাব থাকলে ওকে বলতাম, কখনও কখনও পছন্দ হলে সেটা রাখতো। ওর অনেক চিত্রনাট্যতে আমার সামান্য ছোঁয়া থেকে গেছে, আমি গর্বিত।

অসুখ ছবির চিত্রনাট্য লেখার সময় বেশ মজা হয়েছিলো। ও তখন একটি সিনেমা পত্রিকার সম্পাদক। সকালবেলা ওর বাড়ি পৌঁছতাম, সম্ভব হলে তখন কিছুটা লেখা হত। তারপর ওর সাথে গাড়িতে অফিস যেতে যেতে কিছুটা লেখা হত। তারপর ওর অফিসে বসে, ও ওর সম্পাদনার কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমায় বলে যেত, আর আমি লিখে যেতাম। এইভাবে শেষ হয়েছিলো অসুখ-এর চিত্রনাট্য। গল্পটাও ওর মাথায় এসেছিলো অদ্ভুতভাবে। সেই সিনেমা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে ঋতু একসময় মুম্বই যায় কিছু প্রথম সারির অভিনেতাকে নিজেই ইন্টারভিউ করতে। সেই সময় ওকে কিছুদিন মুম্বইতে থাকতে হয়। ইতিমধ্যে মাসিমা, মানে ঋতুর মা, অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঋতুকে খবর পাঠানো হয়। প্লেনে ফিরতে ফিরতে অসুখের গল্পটা ওর মাথায় আসে এবং প্লেনে বসেই স্ক্রিপ্টটা লিখতে আরম্ভ করে। তখন ইটিভি থেকে পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের একটা লাল মোটা ডায়রি বছরের প্রথমে উপহার দেওয়া হতো। ঋতুর কাছে সেটা ছিলো। সেটাতেই ও লিখতে শুরু করেছিলো। ফিরে এসেই আমায় ডাকে এবং আমি যেতেই সেই লাল ডায়রি আমার হাতে তুলে দেয়। আমিও ওর লেখার পর থেকে লিখতে আরম্ভ করি।

তখন ক্যাসেটের যুগ। ঋতুর একটা পুঁচকে রেকর্ডার ছিলো। তার ক্যাসেটগুলোও ছোট। সেই রেকর্ডারেই ও বন্দী করে এনেছিলো মুম্বাইয়ের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জবানী। তার ট্রান্সকৃপশনের ভার পড়লো আমার উপর। সেই তালিকাটি বিশাল না হলেও ছিলো মোক্ষম। শাহরুখ খান, দেব আনন্দ, জ্যাকি শ্রফ। তাঁদের সেই সব ইন্টারভিউয়ের সব কথা ছাপা হয়নি, ছাপা যায় না। সেই সময় ওঁদের জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, সুখ-দুঃখ-অভিমানের কথা শুনতে শুনতে আমার চোখে জল এসেছে। অবাক হয়ে ভেবেছি, কি সাবলীল অন্তরঙ্গতায় ঋতু ওঁদের মনের গভীর থেকে সে সব কথা তুলে এনেছে!

আমি তো বাঙাল। আমার পূর্বপুরুষরা বরিশালের ঝালোকাঠির বাসিন্দা ছিলেন। তো পাঁচ, সিঁড়ি, এসব কথায় আমার চন্দ্রবিন্দু লাগতো না। ঋতু আমায় ক্ষেপিয়ে ক্ষেপিয়ে, সেই উচ্চারণ শুদ্ধ করিয়েছে। এই শেষ দিন পর্যন্তও ওর সামনে ওই শব্দগুলি ব্যবহার করার সময় সতর্ক থাকতাম। আর ও সেটা উপভোগ করে, আমার দিকে তাকিয়ে মুচ্‌কি মুচ্‌কি হাসত। চোখে চোখে কথা হতো, হুম্‌ম্‌, বুঝেছি।

বয়ে শূণ্য র আর ডয়ে শূণ্য ড়’এ আমার খুব বানান ভুল হতো। দিনের পর দিন আমায় ধরিয়ে দিয়েছে, আমার বানান শুদ্ধ করে দিয়েছে। কত দিন কোনও লেখা লিখতে বসে আটকে গেলে, ওকে ফোন করে বা মেসেজ করে জেনে নিয়েছি, অমুক বানানটা কি হবে। এখনও আটকে গেলে অভ্যাসবসত ফোনে হাত চলে যায়। তারপর মনে পড়ে, ওপারের মানুষটাই তো নেই।

এই ওপারের মানুষটার না থাকাটা যে আমার জীবনে কতখানি প্রভাব ফেলেছে, তা বলে বোঝাতে পারবো না। প্রথম ধাক্কাই হল, আমার প্রতিটি কবিতার প্রথম পাঠক ছিলো ঋতু। ওর প্রুফ দেখা অভ্যেস ছিলো বলে ও ওভাবেই ঠিক করে দিতো আমার বানান, শব্দ বন্ধের বাঁধুনী বা জিজ্ঞেস করতো, এই শব্দটা কেন ব্যবহার করেছিস, এটাই চাস তুই, ইত্যাদি। সে আর কেউ করবে না আমার জন্য। এখন মনে হচ্ছো এই লেখাটাও ওকে একবার দেখিয়ে নিলে ভালো হতো। নিশ্চয়ই ও ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে বলতো এইভাবে লেখ।

একসময় শুরু হলো ১৯শে এপ্রিল ছবির শুটিং। তার আগে আমার আরও তিনটি ছবিতে কাজ করা হয়ে গেছে। একইরকম প্রতিটি স্তর পেরিয়েছিলাম – শুটিং, এডিটিং, ডাবিং, সাউন্ড মিক্সিং, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ১৯শে এপ্রিল করার সময় আমার নতুন অভিজ্ঞতা হলো। বিশেষত ডাবিং-এর সময়। যতদিন ধরে ছবিটার শুটিং হয়েছিলো, প্রায় ততদিন ধরেই ডাবিং হয়েছিলো, যা সাধারণত হয় না। শুধু ডাবিং যে অভিনয়কে সমৃদ্ধ করে কোন স্তরে নিয়ে যেতে পারে, ঋতুর কাজ না দেখলে সেটা বোঝা কঠিন। ওর ছবি তৈরি ছিলো প্রতিমা বানানোর মতন – কাঠামো বাঁধা, খড় জড়ানো, মাটি লেপা, রং চড়ানো, গর্জন তেল লাগানো, গয়না পরানো... ঠিক যেভাবে সেজে ওঠে প্রতিমা।

ঋতুর এই খুঁতখুঁতুনি, ছবি তৈরীর প্রতিটি স্তরে এবং যতক্ষণ না পর্যন্ত একেকটা সীন তার মনমতো হচ্ছে, চেষ্টা করে যাওয়া – এ সকলের মধ্যে থাকে না। অনেকেই দেখি আপোষ করে, মেনে নিয়ে অবস্থাটার সাময়িক সামাল দেন। এও বুঝি যে অধিকাংশ সময়েই তাঁরা অসহায়, নিরুপায়। কিন্তু ঋতুকে কোনও অবস্থাতেই আপোষ করতে দেখিনি। যদি সময়ের নিদারুণ তাড়ণায় কখনও কিছু পরিবর্তন করতে হয়েছে, সেই পরিবর্তনের জন্য নতুন প্রেক্ষিত তৈরি করে তাকেও শৈল্পিক উৎকর্ষে পৌঁছে দিয়েছে ঋতু। 

সব চরিত্র কাল্পনিক ছবির শুটিং চলছিলো। সেদিন ফ্লোরে উপস্থিত বিপাশা বসু। হঠাৎ দেখি ঋতু স্টুডিও থেকে গটগট করে বেরিয়ে এসে ওর গাড়িতে উঠে পড়লো এবং হুশ করে চলে গেলো। কি ব্যাপার খোঁজ করতে গিয়ে দেখি, আর্টের ছেলেদের বলা ছিলো একটি বিশেষ ধরণের স্কুলব্যাগের কথা। হলুদ ক্যানভাসের পুরনো দিনের স্কুলব্যাগ। সেটা পায়নি বলে শুটিং বন্ধ করে দিয়ে বাড়ি চলে গেলো! বিপাশা মুম্বই থেকে এসে পাঁচতারা হোটেলে আছে। তার বাড়তি একদিনের ব্যায়ভারও অনেক। আমরা ভেবেছিলাম সে সব বিচার করে ঋতু হয়তো সেদিন ফিরে আসবে শুটিং-এ। অপেক্ষাও করেছিলাম। এলো না। পরদিন সেই ব্যাগ এলে তবে ও সেই শট নেয়। সেই ব্যাগটির কিন্তু শটে ব্যবহার ছিলো না। নানান জিনিসের সাথে এক কোণে পড়েছিলো। তবু ও যা দেখাবে, সঠিক দেখাবে। এটাই ছিলো ওর শিক্ষা, ধর্ম, গুণ।

ঋতুর মনের মতন হওয়ার জন্য প্রত্যেকটা স্ক্রিপ্টকে অন্তত তিন থেকে পাঁচটা ধাপ পেরোতে হতো। করমাগত কাটাকুটি আর নতুন করে লেখা। এই পরীক্ষায় সব থেকে বেশি বেগ পেতে হয়েছিলো ‘খেলা’ ছবির স্ক্রিপ্টকে। প্রায় কুড়ি বার কেটে নতুন করে লেখা হয়ছিলো। পুরনো স্ক্রিপ্টগুলোর খুব একটা খোঁজ করতো না ঋতু। কিন্তু আমি রেখে দিতাম গুছিয়ে। তার ফল পেলাম উত্তর বাংলার এক জঙ্গলের মধ্যে।

জঙ্গলের মধ্যে খেলা ছবির শুটিং চলছে। হঠাৎ আমার তলব। গেলাম। ঋতু বললো- শোন, একটা সীন লিখেছিলাম মনে আছে? শঙ্কর বুম্বাকে বকছে, যখন জানতে পারে বাচ্চাটাকে না বলে নিয়ে আসা হয়েছে? বললাম হ্যাঁ, মনে আছে। বললো, সেটা এই স্ক্রিপ্টে বাদ দিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে রাখলে ভালো হতো। তোর কাছে আছে সীনটা? দেখছি বলে সহকর্মী শুদ্ধকে নিয়ে গেলাম সেই ট্রাকটার কাছে, যেটাতে আমাদের পরিচালনা বিভাগের ট্রাঙ্কটা রাখা ছিলো। ধরাধরি করে নামিয়ে ট্রাঙ্ক হাটকে খুঁজে বার করলাম সেই সীন। সে সীন শুট হলো এবং ছবিতেও থাকলো।

এই যে এমন একজন গুণী পারফেক্টশনিস্ট-এর সাথে কাজ করার আনন্দ, তা বোধহয় আর পাবো না। তাই আর কাজ করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু আমি দিন আনি দিন খাই মানুষ তো, কাজ না করলে খাবো কি? অতএব বাধ্য হয়ে কাজ করে যেতে হচ্ছে।



সব চরিত্র কাল্পনিক ছবির শুটিং চলা কালীন একদিন আমার জন্মদিন ছিলো। আমাকে জানতে না দিয়ে ঋতু সেদিন বিশাল আয়োজন করে আমার জন্মদিন পালন করেছিলো। শুটিং থামিয়ে কেক কাটা থেকে শুরু করে হৈ চৈ, সব। সেটি আমার একটি বিশেষ জন্মদিন বলে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।

আটানব্বই সালে হঠাৎই আমার জীবনে আকস্মিক বজ্রপাত হয়। আমার স্ত্রী দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চলে যান। আমার দুটি কন্যা তখন সবে দশ আর সাড়ে চার। আমি দিশেহারা হয়ে যাই। সেই সময় মনে আছে একটি বিকেলের কথা। ঋতুর বসার ঘরে আমরা দুজন দুটো সোফায় বসে আছি, আর ও আমায় বুঝিয়ে যাচ্ছে, কি ভাবে একাকিত্বকে জয় করতে হয়, কি ভাবে ও তা করেছে। সেদিন ঘন্টার পর ঘন্টা ও আমায় অনেক কথা বলেছিলো। আমি নির্বাক হয়ে হয়তো শুনিনি, হয়তো আমিও কিছু বলেছিলাম, মনে নেই। কিন্তু মনে আছে সেই সময়টার কথা। তখন আমায় এমন করে সাহস জুগিয়ে, আবার নতুন করে বাঁচার, এগিয়ে যাবার পথ ঋতুই দেখিয়েছিলো। কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে ঘর অন্ধকার হয়ে গেছে, আমরা টের পাইনি। সে দিনটার কথা আমি আমার মনকে ভুলতে দিইনি। যখনই মন দুর্বল হয়েছে, ঋতুর সেদিনের বলা কথাগুলি মনে মনে আউড়েছি। সেদিন সত্যি আমার কাছে একলা ঋতুর প্রকাশ ঘটেছিলো। বুঝেছিলাম, ওর একাকিত্বের কাছে আমার একাকিত্ব সিকি ভাগও না। নতুন করে বাঁচার উদ্যম পেয়েছিলাম সেদিন। কিন্তু সেই উদ্যম যে মানুষটা আমায় জুগিয়েছিলো, সে নিজেই শেষ পর্যন্ত একাকিত্বের কাছে হেরে গেলো।

আমার জীবনের এই ঘটনার পর পরই বাড়িওয়ালি ছবির শুটিং হয়। কিছুটা শুটিং হয়েছিলো তারকেশ্বরের দশঘরা জমিদারদের বাড়িতে। সেই বাড়িতেই ঋতু ওর প্রথম ছবি হীরের আংটি-র অনেকখানি শুট করেছিলো। আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে সব জায়গা দেখিয়ে তখনকার গল্প বলতো অনেক। তো, সেই সময় দিন সাতেক আমাদের তারকেশ্বরে থাকতে হয়েছিলো। বাইরে শুটিং করতে গেলে যা হয়... সারাদিন শুটিং সেরে হোটেলে ফিরে সবাই ফ্রেশ হয়ে জমাটি আড্ডা হয়, গান হয়। ওই ছবিতে ঋতুর সহযোগী ছিলো মন্টুদা, মানে আমাদের বন্ধু অভিনেতা সুমন্ত মুখোপাধ্যায়। মন্টুদার দারুণ গানের গলা। সেদিন মন্টুদা গান ধরলো, ও জীবন ছাড়িয়া যাস্‌নে মোরে, তুই জীবন ছাড়িয়া গেলে, আদর করবে কে, জীবন রে...

আমি তখন শোকে পাথর, ব্যোম মেরে আছি। এই গান শোনা মাত্র ব্যস, আমি হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললাম। ঋতু দৌড়ে এসে আমায় জাপটে ধরলো। আমি ওর বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতেই থাকলাম, কাঁদতেই থাকলাম। কানে এলো, ওকে কাঁদতে দাও, বারণ কোরোনা।

আমি আজীবন ওর সহকারীই থেকেছি। সে আমার গর্বের। কিন্তু কোনওদিনই আমাদের সম্পর্কটা পরিচালক আর সহকারীর ছিলো না। আমার বন্ধু, আমার জীবনযাপনের কাণ্ডারী, আমার পথপ্রদর্শক... সব ছিলো ঋতু। ইংরিজিতে যাকে বলে ফ্রেন্ড, ফিলোজ়ফার অ্যান্ড গাইড। এমন বন্ধুকে হারানো জীবনের এক অপূরণীয় ক্ষতি। ঋতুর প্রথম ছবিতে কাজ করার সুযোগ আমার হয়নি। কিন্তু ওর শেষ ছবি অবধি সঙ্গে থাকতে পেরেছি, এটাই আমার বিরাট প্রাপ্তি।

ওর শেষ পরিচালিত ছবি, সত্যান্বেষী। সে ছবির শেষ দিনের শুটিং ছিলো কলকাতা থেকে অনেক দূরে, ধান্যকুড়িয়া রাজবাড়িতে। সেদিন ওর শরীরটা ভালো ছিলো না। মেক আপ ভ্যানে শুয়েছিলো। শট প্রস্তুত করে ওকে ডাকা হলো। ওর মুখটা দেখে আমি চমকে উঠলাম! এত অস্বাভাবিক লাগছিলো! সহকর্মী বন্ধুদের বললামও সে কথা। শট শেষ হওয়ার পর আমি প্রত্যেকবার যেটা করি, সেবারও করলাম। ওর সামনে গিয়ে বরিশালী ভাষায় বললাম – আরেকখান ছবি শ্যাষ হইয়া গ্যালো। ও মুচ্‌কি হাসলো। মনে হলো, ভিতরে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ধীর পায়ে হেঁটে গাড়ির দিকে চলে গেলো। ওই চলে যাওয়াটা আমার স্মৃতিতে পেরেকের মতন গেঁথে আছে, কারণ সেই আমার জীবিত ঋতুপর্ণকে শেষ দেখা।
1

someপ্রতীক - রীতা পাল

Posted in






আজ সকালে আমার এক পড়শী - বয়সে আমার চেয়ে বছর কুড়ি’র বড়ো - যাঁকে আমি দিদি বলে ডাকতাম, মারা গেলেন। না, করোনা মৃত্যু নয়। বয়সকালীন হৃদযন্ত্র বিপর্যয়ে মৃত্যু। সকাল দশটায় শেষ দেখা দেখতে গেলাম। তাঁর তিন ছেলে এক মেয়ে – সকলেই উপস্থিত। স্বামী আগেই গত হয়েছেন। শেষ বয়সের সব দায়িত্বই ছোট ছেলের পরিবার সামলেছে। ছোট ছেলের বৌয়ের এ নিয়ে যে একেবারে ক্ষোভ ছিলো না, তা নয়। আমার কাছে সে মন খুলে মাঝে মাঝে কথা বলতো। আমি আমার সাধ্যমতো তাকে সহ্যশক্তি জোগাতাম। মৃত্যুশয্যায় গিয়ে দাঁড়ালাম মহিলাদের ভিড়ে। আমি পুঁইডাঁটা চিবোতে ভালোবাসা নিতান্তই আটপৌরে গৃহবধু। শেষ প্রণাম সেরে বোকার মতো বলে ফেললাম –‘ওফ্‌, এই ক’টা দিন দীপা আর গৌতমের ওপর দিয়ে যা গেলো...’। অমনি পাশ থেকে শিক্ষিত মার্জিত রুচির এক মহিলা বলে উঠলেন – ‘ছোট ছেলে, ছেলে-বৌয়ের পক্ষ টেনে কিছু বলবেন না তো, সেয়ানা কম? – টাকাপয়সা গয়নাগাঁটি সব নিজেরা দখল করেছে’। 

আমি কেমন ভেবড়ে গিয়ে পাতলা হতে শুরু করলাম। গুটিগুটি পায়ে পিছু হটে বাড়ি ফিরে ভাবতে বসলাম। আচ্ছা, ছোট বৌ দীপার জায়গায় যদি আমি হতাম, তাহলে কি আমি তিন বৌমার (মেয়ের কথা না হয় বাদই দিলাম) দায়িত্ব একা নিজের কাঁধে তুলে নিতাম অর্থের লোভে? ইষ্টুম-উষ্টুম ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো, দীপা আমায় একাধিকবার বলেছে টাকাপয়সার হিসাব সে বোঝে না। ও সব তার স্বামীর ব্যাপার। সে সব কষ্ট সহ্য করছে শুধু স্বামীর মন রক্ষার জন্য। স্বামীর যে মা-অন্ত প্রাণ। তর্কের জন্য, নিরপেক্ষতার তাগিদে দীপাকে ডাকসাইটে অভিনেত্রী ভাবতে শুরু করলাম। ভাবতে ভাবতে মনে এলো – আজন্মকাল থেকে শুনে আসছি মেয়েরা যে মা হওয়ার শারীরিক কষ্ট দশ মাস দশ দিন ধরে সহ্য করে, তাও তো নাকি শিশুকন্ঠে ‘মা’ ডাক শোনার লালসায়। তাই বলে কি মায়ের কষ্টের মহিমা বিলীন হয়ে যায়? দীপা-গৌতম যদি তাদের অধিকারের সীমা লঙ্ঘণ করে সব সম্পত্তি কুক্ষিগত করে – নিঃসন্দেহে সেটা খারাপ কাজ। কিন্তু সেইজন্য মায়ের শেষ সময়ের (যেটা ছিলো তাদের কাছে অনির্দিষ্টকাল) দায়িত্ব পালনকে কেন ভালো বলা যাবে না – বুঝতে পারলাম না। 

ভাবনার জন্য কিছুদূর পিছনে তাকাতেই শুনতে পেলাম নয় সন্তানের বিধবা জননীর কাল্পনিক উক্তি – ‘নয়টাকে পেটে ধরেছি বটে তবে আমার স্থাবর-অস্থাবরসবই পাবে হেবো, একটু হাবা বটে, তবে মনটা ওর অসম্ভব ভালো’।আটজন কৃতি সন্তানের মায়ের নবম সন্তান হেবোর জন্য লজ্জাবোধ ছিলো না মোটেই। পেটের কলঙ্ক তো মনে করতেনই না। কৃতি এবং বোকা – সবই তাঁর নিজের। আঁকড়ে ধরতেন তাকেই, যে তার কাছের। সমান অধিকারের চিন্তা তার মাথায় আসতো না।জোর করে বোঝাতে গেলে বলে উঠতেন – ‘ও মা, এ আবার কেমন কথা? হাতের পাঁচ আঙুল আবার সমান হয় নাকি? জীবনের প্রথম দশমাস দশদিন যে স্থান দেয় সেই মাতৃগর্বের অধিকারী, তেমনি দ্বিতীয় শৈশবে সমস্ত প্রয়োজন মেটায় যে, সেই তো সেরা সন্তান। কর্তব্য বুঝলাম না, অধিকার বুঝে গেলাম, সমানাধিকার বুঝে গেলাম, নারীর অধিকার বুঝে গেলাম। 

আমি কোন নারী? নিজের বাবা মাকে পরের বাড়ির জিম্মায় রেখে দিয়ে স্বামীর বাবা মায়ের দায়িত্ব সম্পর্কে নিরন্তর সকল সন্তানের সমান কর্তব্যের বুলি আউড়ে যাওয়া সুবিধাভোগী নারী? পুঁইডাঁটার সঙ্গে আধুনিক শিক্ষার মেলবন্ধনে বিশেষ পারদর্শী নারী-যে বলে ছেলে মেয়ে আমার কাছে সমান - অধিকার সমান - তবে শেষ বয়সটা হয় ছেলের কাছে, নয় বৃদ্ধাশ্রমে - রক্ষে করো বাপু, জামাইয়ের বাড়ি গিয়ে থাকতে পারবো না। অধিকার সমান, কিন্তু পরের বাড়ির মেয়ে আর পরের বাড়ির ছেলের কর্তব্য যে এক – এটা শেখাতে ব্যর্থ এক নারী। ছেলে মেয়ে উভয়েই যদি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়, তবু আমার কাছে ‘ছেলের বাড়ি’আর ‘জামাইয়ের বাড়ি’। 

আমাদের সংবিধান থেকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ কথাটি বাদ দেওয়ার ফন্দি আঁটছেন বর্তমান সরকার। তা নিয়ে শিক্ষিত মানবতাবাদীরা বিশেষ চিন্তিত। আমি অবশ্য বুঝেই উঠতে পারিনি সমাজতন্ত্র কী জিনিস – মাথায় মাখে না গায়ে দেয়। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে সমাজতন্ত্র ধাঁচের সমাজব্যবস্থা গঠনের জন্য ভারত রাষ্ট্র কতদূর এগিয়েছে, ঠিক কোন্‌খানটাতেই বা বাধা পড়লো, এবং তার ফলে এদেশের ধর্ম, অর্থ, শ্রেণী বৈষম্যের শিকার যারা, তারা আর কতোটা নিম্ন মুখে পতিত হবে? হেবোর মা কি সুবিধাবাদী নাকি সমানাধিকার বুঝতে পারা এক নারী? 

বামজমানার শেষদিকে আমার ঘরের হিন্দু কাজের লোককে একদিন প্রশ্ন করেছিলাম –‘আজ যে বড় তাড়াতাড়ি কাজে এলে?’ সে বলে উঠলো – ‘এখন যে রোজা চলছে বৌদি। ভোর থেকে জল আসে কলে। তাই তাড়াতাড়ি কাজ সারা হয়ে যায়। মুখপোড়ারা দোলের দিন দুপুরবেলা একঘন্টা জল বেশি দিতে পারে না। কিন্তু রোজার সময়ে গোটা মাস ভোর ৩টে থেকে জল দেয়। বার-এও বেশি দেয় গো’। আমি কল ঘোরালেই জল পাওয়া মানুষ। দোলের দিন আমার ঘরের কাজের মহিলাকে দোল খেলে ফেরা মাতাল স্বামী ছেলেকে কিভাবে জলের যোগান দিতে হয়, খোঁজ নিইনি। যতোই আটপৌরে হই না কেন ধর্মনিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছি। শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আমার স্বধর্মীয় লোকের ক্ষোভ যথার্থ কিনা খোঁজ নেওয়ারও দরকার বোধ করিনি। 

ন্যায্যই হোক আর অন্যায্যই হোক, হিন্দুদের জমা ক্ষোভকেই মূলধন করলো বিশেষ এক শ্রেণীর রাজনীতিক। কানাঘুষায় শুনতে পাচ্ছি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটিও অচিরেই নাকি বিদায় নেবে ভারতীয় সংবিধান থেকে। মানবতাবাদীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার জোগাড়। মনে হলো বড়ো ভুল হয়ে গেছে। আমি সাধারণ মানুষ। যৎসামান্য আমার ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা সম্বল করে দরিদ্র হিন্দুর এইক্ষোভ কেন সময়মতো তুলে ধরিনি?আমার মতো হাজার হাজার সাধারণ মানুষের যান্ত্রিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ সেজে ওঠার সুযোগেই তো বিশেষ ধর্মীয় সংগঠন রাষ্ট্রের চালিকা শক্তি হয়ে ওঠার সুযোগ পেলো! 

ঘড়িতে ৩টে বাজে। তৈরি হয়ে নিলাম। মৃতা পড়শীরবাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। মৃতদেহ বাড়ির বাইরে বের করার তোড়জোড় চলছে। আরেকবার প্রণাম জানালাম। সোজা গেলাম দীপার কাছে। দূরত্ববিধি মেনেই বলে উঠলাম – ‘তুই কাঁদছিস কেন? পরের বাড়ির মেয়ে হয়েও তুই তো কোনো কর্তব্যে অবহেলা করিস নি। ওঠ্‌, চারটে বাজতে চললো, তোর শাশুড়ির চা খাওয়ার সময়। আজকের বিকেলের চা-টাও আমাদের সকলের জন্য তুইই কর্‌।’ 

হ্যাঁ, পড়শীর প্রতি আমারমতো সাধারণ মানুষেরও দায়িত্ব আছে। পরিবার দিয়েই দেশ গঠিত হয়। তাই আমার কাঁধে বিশাল দায়িত্ব। সময়মতো সাদাকে সাদা বলার দায়িত্ব। ‘সাদা’ যে আসলে সাতটি রঙের সমাহার – সে তথ্য পৃথিবীকে জানানোর দায়িত্ব বিশেষজ্ঞের – আমার নয়।
4

someপ্রতীক - সুমিতা ব্যানার্জী

Posted in




আমি সুমিতা ব্যানার্জী। মাসীমা আমার নৃত্য গুরু। আজ তাঁর স্মৃতিচারণ করতে বসে অতীতের অনেক স্মৃতি ভীড় করে আসছে।

ছোটবেলা থেকেই নাচের প্রতি আমার দুর্বলতা ছিল। যখন আমি খুব ছোট তখন পাড়ার একজন – নাম ছবি ক্ষেত্রী – তাঁর কাছেই নাচের প্রাথমিক শিক্ষা। সেভাবে দেখতে গেলে ওই ছবি মাসিই ছিলেন আমার প্রথম নৃত্য শিক্ষাগুরু। একটু বড় হওয়ার পরে বাবা নিয়ে গেলেন গুরু বন্দনা সেনের কাছে। সেখানে বেশ কয়েক বছর কত্থকের তালিম নিয়েছিলাম। এরপরে নানা জায়গায় অনেক অনুষ্ঠান করেছি, একটু পরিচিতিও ঘটেছে। এইভাবে চলতে চলতে হঠাৎ একদিন ডাক এল “সৌরভ” নামে একটি সংস্থা থেকে। ওদের ওখানে তখন “মেঘদূত” নামে একটি প্রযোজনার প্রস্তুতি চলছে। আমাকে দেওয়া হলো “যক্ষিণী” চরিত্রটা করার জন্য। রবীন্দ্রসদনের হলে এটি অনুষ্ঠিত হয়। এখানে অনেক Musician ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন রবীন পাল। তিনি সরোদ বাজিয়েছিলেন। এই রবীনদাকেই পরবর্তীকালে উদয়শংকর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টারে দেখেছি Musicianদের মধ্যে অন‍্যতম মুখ্য শিল্পী হিসেবে। আস্তে আস্তে সময়ের সাথে সাথে আমিও বড় হতে লাগলাম। যখন আমার বয়স ষোল বছর কয়েক মাস, তখন আমার বাবা আমাকে নিয়ে গেলেন উদয়শংকর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টারে। আসলে আমার বাবা একসময় রয়টারে এবং পরবর্তীকালে অমৃতবাজার পত্রিকাতে সাংবাদিকতা করতেন। সেই সুবাদে অনেক নামী দামী মানুষের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। ঠিক সেইভাবেই উদয়শংকরের সাথেও তাঁর বেশ ভাল সম্পর্ক ছিল। আমার কথা বাবা তাঁকে বলেছিলেন। ফলস্বরূপ আমার তাঁর সেন্টারে যাওয়া। সালটা ইংরাজী ১৯৭১-এর February মাস, সন্ধ্যা ৬টা। সেইসময় মাসীমাই ছিলেন সেন্টারের সর্বময়ী কর্ত্রী। সেইদিন সন্ধ্যায় সেখানে গিয়ে দেখি কোনও একটা অনুষ্ঠানের মহড়া চলছে। হাসিমুখে মাসীমা এগিয়ে এলেন। দেখলাম, সুন্দর পেটানো চেহারা এবং অদ্ভুত এক ব্যক্তিত্বসম্পন্না মহিলা, যাঁকে দেখলে সমীহ করতে ইচ্ছা করে। আর একজনকে এখানে দেখে অবাক হলাম, তিনি হলেন রবীনদা। উনিও আমাকে দেখে বলে উঠলেন, “আরে একে তো চিনি – এতো সুমিতা। খুব ভাল নাচে।” মাসীমা সেই শুনে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন আর উপস্থিত যারা ছিল তাদের দেখিয়ে বললেন, ওদের দেখে দেখে আমিও যেন অনুসরণ করে নাচ করি। বলা বাহুল্য যে “মম” অর্থাৎ মমতাশংকরও সেইখানে উপস্থিত ছিল। একদম নতুন আমি। কিছুই জানি না। কি নাচ! কিসের অনুষ্ঠান! তবুও আমার সাধ্যমত আমি করতে লাগলাম। নাচের শেষে মাসীমা খুব খুশি হয়ে বললেন, “কি? আমাদের সাথে tour-এ যাবে নাকি show করতে”? এ এক অভাবনীয় প্রস্তাব। আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। এরপর শুরু হলো প্রস্তুতি। একটি নতুন মেয়েকে কি যত্নের সাথে মাসীমা তৈরি করলেন সেটা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। পাটনা গেলাম। এর আগে এতো বড় group-এর সাথে আমি এত দূরে কোথাও যাইনি। খুব আনন্দ করেছিলাম আমরা। মাসীমার গাম্ভীর্যের নীচে একটা সরল মানুষও লুকিয়ে থাকত। একদিন সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ উনি আমাদের group-এর এক পুরুষ কর্মীকে ভয় দেখাবেন ঠিক করলেন। অন্ধকার সিঁড়ির এক কোণে দাঁড়িয়ে দুটো হাত সোজা উপরে তুলে দিলেন আর আমাদের বললেন একটা সাদা চাদর দিয়ে ওঁকে ঢেকে দিতে। আমরা তাই করলাম আর সবাই লুকিয়ে পড়লাম। শুধু একটি মেয়ে গিয়ে সেই মানুষটিকে জানাল যে মাসীমা তাকে ডাকছেন। মাসীমা করলেন কী, ঐ চাদরে ঢাকা এত উঁচুতে হাতের পাতা এমনভাবে নাড়তে লাগলেন যেন মনে হলো অসম্ভব লম্বা একজন মানুষ মাথা নাড়ছে। যার উদ্যেশ্যে এত কিছু, সে বেশ হেলতে দুলতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে ঐ অদ্ভুত দৃশ্য দেখে বাপরে মারে বলে চিৎকার জুড়ে দিল। আমাদের মধ্যেও উঠল হাসির রোল। এমনই ছিলেন মাসীমা। আমরা তাঁকে যেমন ভয় পেতাম, ততটাই সমীহ করতাম। অনেক কিছু শিখেছি ওঁর কাছে। একজন নৃত্য শিল্পীর হাঁটা চলা, বসা, দাঁড়ানো – সবই শিখেছি ওঁর কাছে। মেরুদণ্ড টানটান যেন থাকে সবসময়। তাই বোধহয় এখনও সোজা না হয়ে বসতে পারি না। আলস্য বলে কিছু ছিল না ওঁর মধ্যে। আমার আগেকার জীবন অনেকটাই বদলে গেল ওঁর সংস্পর্শে এসে। একজন নৃত্য শিল্পী হতে গেলে শুধু সুর, তাল, ছন্দ মিলিয়ে পা ফেলা বা দেহ ভঙ্গিমা নয়, একজন সত্যিকারের নৃত্য শিল্পীকে জানতে হবে মঞ্চের উপযুক্ত ব্যবহার। পোশাকের সমস্ত খুঁটিনাটি। মঞ্চে আলোর ব্যবহার আর উপযুক্ত মেকআপ। অতিরিক্ত মেকআপ উনি একদম পছন্দ করতেন না। আর মেয়েদের খোলা লম্বা চুলের ব্যবহার দেখেছি এই সেন্টারে এসে।

পোশাক তৈরি হত আমাদের সেন্টারে। আমাদের রাঘবন গুরুজিকেও দেখেছি সেলাই মেশিনে পোশাক সেলাই করতে। একটা নেশার ঘোরের মত কেটেছে ওই সব দিনগুলো। আমাদের মঞ্চে আলোর কাজ করতেন তখন স্বনামধন্য তাপস সেন। “সীতা স্বয়ম্বরা” নামে একটি প্রযোজনা হয়েছিল সেই সময়। খুব নামডাক হয়েছিল ঐ সীতা স্বয়ম্বরার। সেখানে রামের ভূমিকায় মমতাশংকর, তাড়কা রাক্ষসীর ভূমিকায় তনুশ্রীশংকর, আর মীনাক্ষী বলে একটি মিষ্টি দেখতে মেয়ে ছিল সীতার ভূমিকায়। আমি ছিলাম অহল‍্যা। এখানে রাম ও তাড়কার যুদ্ধের একটি scene ছিল। পর্দার ওপরে shadow তে দেখানো হয়েছিল সেই দৃশ্য। দর্শক দেখছে বিশাল দৈত্যাকার তাড়কার সাথে সাধারণ মানবের রূপে রামের লড়াই। আলোর কি চমকপ্রদ ব্যবহার আর তেমনই তনুশ্রী আর মমর অপূর্ব নৃত্য শৈলী। ঐ দৃশ্যের পরে hall কারতালিতে ফেটে পড়ত। মাসিমাকে দেখেছি ঐ দৃশ্যটিকে বাস্তবায়িত করতে স্টেজ রিহার্সাল-এর সময় কি পরিশ্রমটাই না করতে। অনেক কথা মনে পড়ছে। ছোট ছোট ঘটনা। আমরা ট্রেনে করে যাচ্ছি টাটা-জামশেদপুর। কোনও একটি স্টেশনে ট্রেন থেমেছে। একটি ছোট ছেলে আইস ক্রীমের একটা বাক্স নিয়ে হেঁকে চলেছে, “ঠাণ্ডা আইস ক্রীম, ঠাণ্ডা আইস ক্রীম।” হঠাৎ দেখি মাসীমা ওকে ডেকে জিজ্ঞাসা করছেন, “এই এদিকে আয় তো। কি? তোর কাছে শুধুই ঠাণ্ডা আইস ক্রীম? গরম আইস ক্রীম নেই?” ছেলেটি একটু থতমত খেয়ে “না” বলে একছুটে ওখান থেকে পালিয়ে গেল, আর আমরাও মাসীমার ঐ রসিকতায় খুব মজা করে হাসতে লাগলাম।

তিন বছর ছিলাম ওঁর কাছে। অনেক শিখেছি, অনেক পেয়েছি। আজ মাসীমা নেই, কিন্তু ওঁর দেওয়া শিক্ষাগুলো আমাকে আজও অনুপ্রাণিত করে। উদয়শংকর সৃজনশীল নৃত্যের যে জাদু শিখিয়েছিলেন, তাঁর সুযোগ্যা শিষ্যা ও সহধর্মিণী শ্রীমতী অমলাশংকর কিভাবে তা এতদিন ধরে নিষ্ঠার সাথে, কি অসম্ভব শ্রদ্ধায় বহন করে নিয়ে এসেছেন, ভাবলে শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে মাথা নত হয়ে যায়।

কিছু মানুষের কথা ভাবলে মনে হয়, কেন চিরকাল তাঁরা থাকেন না। মাসীমার চলে যাওয়া এক অপূরণীয় ক্ষতি, বিশ্বের নৃত্য সমাজে। মাসীমা যেখানেই থাকুন ভালো থাকবেন, আপনার নাচ নিয়ে। আশীর্বাদ করুন, আপনার শেখানো সবকিছু যেন সারাজীবন অন্তরের গভীরে প্রতিপালন করতে পারি।


১ - উদয় শঙ্কর, ২- অমলা শঙ্কর, ৩- আনন্দ শঙ্কর, ৪- মমতা শঙ্কর, ৫- তনুশ্রী শঙ্কর, ৬- সুমিতা ব্যানার্জী (লেখিকা)






















ছবি ঋণ - লেখিকা



0

someপ্রতীক - সুশান্ত চন্দ্র

Posted in


আত্ম অনুভূতিকে আত্ম স্বতন্ত্র রূপে প্রত্যক্ষ করাই হল ART। জীবনের প্রাঙ্গণে সুন্দরের আবির্ভাব ঘটেছে বারবারই। তবু মানুষ আজো বুঝি তার পূর্ণ অর্থ খুঁজে পায়নি। তাই চলেছে নিরন্তর অনুসন্ধিৎসার অভিযান।

প্রত্যুষে সূর্য তার আলোর আবেদনে যে বিস্ময় আনে, ফুল ফোটানো জ্যোৎস্না, আন্দোলিত বসন্ত বাতাস, বন বেতসের নৃত্য ভঙ্গিমা, মর্মর মুখরিত সায়াহ্নের নিঃসঙ্গ বনপথ, রূপ পূজারী মানুষের মনে ভিন্ন রসের সঞ্চার করে।

তাই মানুষ চায় তার ছন্দে সুরে লেখায় রেখায় বর্ণবিন্যাসে এই পলাতক সৌন্দর্যকে চিরস্থায়ী করে রাখতে। তাই কবির কল্পনা উজ্জীবিত অতীতের উজ্জিয়নী মহাকালের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে আজো বেঁচে আছে। হাজার মানুষের মনের গহনে যে মন অনুভব করে, সেই মনই করে শিল্পের রচনা। সত্যিকারের শিল্পবোধ সহজাত। অনন্তকালের অবগুণ্ঠনের ফাঁকে ফাঁকে যে সৌন্দর্য লক্ষ্মীর আবির্ভাব ঘটে বারে বারে, তাকে অকুণ্ঠ চিত্তে অভিবাদন জানায় মানুষের বিমুগ্ধ শিল্প মন। সেই বিমুগ্ধতার উপলব্ধি ঘটে গ্যেটে বা রবীন্দ্রনাথের চিত্তলোকে। আবার সাধারণ মানুষের মনেও। শিল্পানন্দের অনুভব চলে সবার অন্তর লোকে।

কিছু চিত্তের বাহির অঙ্গনে এনে সবার সামনে মেলে ধরবার শক্তিটুকুই হল শিল্পীর নিজস্ব সম্পদ। বাইরের জগতে রূপাশ্রয়ী করবার তাগিদ এলে সাধনার কথা ওঠে। শিল্পীর এই সাধনাগুলো প্রকাশের অনন্ত প্রয়াস যে পরম গীতি ধ্বনিত হল আমার মনে, তাকে মনোলোকের বাইরে এনে বিশ্ব মানসের গোচর যদি করতে না পারি, তবে তা আমার একান্ত নিজস্ব বস্তু হয়ে রইল।

যে সৌন্দর্যসুধায় সিক্তও হল আমার মন সেই সুধার ধারার বিস্তৃতি ঘটল না সবার মনের ঘাটে ঘাটে। প্রকাশের অভাবে সমাজে স্বীকৃতি পেলো না আমার শিল্প অনুভূতি। উপলব্ধির দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে আমি যে অসীম আনন্দ লাভ করলাম সুন্দরের অনুধ্যানে, তাকেই চরম বলে স্বীকার করব। নাই বা হল আমার অন্তরের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। নাই বা রূপ পেল আমার আনন্দ বিশ্বজনের চোখের সামনে। যে শিল্পী কায়া দিল না, তার অন্তর লক্ষ্মীকে তার অনুভূতিকে কি অস্বীকার করা যায়? কাগজে কলমে বা ক্যানভাসের বুকে রুপ দেওয়া তো আঙ্গিকের ব্যাপার। দার্শনিক ক্রোচে যাকে বলেছেন টেকনিক। এই টেকনিক-এর সাহায্যে আত্মানুভূতিকে বাইরের রসিক জনের দরবারে হাজির করা হয়। একথা অবশ্যই স্বীকার্য। তবে একথাও সত্য যে প্রকাশ শক্তিহীন শিল্পীর দল শিল্পানন্দের যে আস্বাদন করে তাও কোনও অংশে কম নয়। সুন্দরের জন্য যে গোপন অর্ঘ্য এরা রচনা করে চলেছে, তার মুল্য অপরিসীম।

তবে প্রকাশের সাধনা করতে পারলে ব্যাক্তিগত আনন্দকে ছড়িয়ে দেওয়া যায় সর্বজনের মাঝে।

একের আনন্দ বহুর আনন্দ হয়ে সৃষ্টি করে শাশ্বত সুন্দরের। এই প্রকাশের সাধনা যে করে তাকেই আমরা শিল্পী বলি। প্রতিভাবান বলি। খোলা চোখে আমরা কোনও বস্তু বা দৃশ্য নিজেরা দেখি। আরও দশজনকে সে দৃশ্য দেখাতে গেলে ক্যামেরার প্রয়োজন হয়। শিল্পীর মন এই ক্যামেরা আর শিল্পীর প্রতিভা এই ক্যামেরার ভিতরকার কলকব্জা। ক্যামেরার ভিতরের উল্টোপাল্টা রীতি পদ্ধতির মাধ্যমে যেমন সুন্দর ছবিখানি আমরা পাই, তেমনি প্রতিভার জারক রসে জারিত হয়ে আমাদের অতি পরিচয়ের মরচে ধরা বস্তু জীবন স্বপ্নের স্বর্ণাভায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

এবার আসা যাক universality-র কথায়। এর প্রতিশব্দ হিসেবে গ্রহণ করা যাক সর্বজন অধিগম্যতাকে। শিল্প হবে বিশ্ব মানুষের অধিগম্য। শিল্প হবে দেশ ও কাল নিরপেক্ষ। অর্থাৎ দেশ ও কালের সীমা ছাড়িয়ে শিল্পের আবেদন পৌছবে সর্বত্র। এ দেশের কবি বিরহ মিলনের যে গাহক রচনা করবে, ওদেশের মানুষ তাকে অভিনন্দিত করবে শ্রদ্ধার সঙ্গে। এই universality-র ধারণা শিল্প ধারণার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে মিশে আছে।নআমরা মনে করি শিল্প হবে ইউনিভার্সাল, অর্থাৎ যে শিল্প রসোতীর্ণ হয়েছে তার আবেদন পৌছবে সকল মানুষের মনে। কিন্তু এর তত্ত্ব যদি এতই সহজ, তবে ইউনিভার্সালিটির প্রশ্নে এত জটিলতা কেন? কেন রবীন্দ্রনাথের মত মহাকবির মনেও আক্ষেপ ছিল যে তাঁর কবিতা সর্বত্রগামী হয়নি? তাই তিনি আক্ষেপ করেন সেই কবির জন্য, “যে আছে মাটির কাছাকছি সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।”

বস্তুত, অভিধানগত ভাবে কোনও শিল্পই ইউনিভার্সাল নয়। মানুষের রুচি ভিন্নধর্মী। শিক্ষা, দীক্ষা, পরিবেশ মানুষের রুচিকে গড়ে তোলে। আর মন ধর্মকেও পূর্ণাঙ্গ রুপ দেয়। শিল্প আবার এই মনের কাছেই দরবার করে। তাই কোনও শিল্পই সর্বজন অধিগম্য হতে পারে না। যে অর্থে আহার, নিদ্রা, ভয় ইউনিভার্সাল, শিল্প সেই অর্থে ইউনিভার্সাল নয়। একজন খাঁটি বৈষ্ণব যে ভাবে তার সমস্ত সত্তা দিয়ে উপভোগ করে কৃষ্ণলীলার মাধুর্য, ঠিক তেমন করে বৈষ্ণব কাব্য কাহিনীর রস গ্রহণ করতে পারেনা সাধারণ পাঠক। শিল্প-সুরের ধ্বনি বিভিন্ন মনে বিভিন্ন ধরণের প্রতিধ্বনি তোলে। রসবেত্তার আবেগ, মনন, ধর্ম, রুচির ওপর শিল্পের সাফল্য অনেকখানি নির্ভর করে। শিল্পের আবেদন যে মানুষের অনুভূতিলোকে!

অধ্যাপক কলিংউডের কথায় বলা যায়, শিল্পের মূল্য সবসময় নির্ণীত হয় ব্যক্তি বিশেষের দ্বারা। ব্যক্তি না থাকলে শিল্প থাকে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আর্ট-এর ক্ষেত্রে ইউনিভার্সালিটি কথাটির অর্থ বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ।

যিনি সাধনা করেছন শিল্প সৃষ্টির জন্য আর যিনি রস উপলব্ধির সাধনা করেছেন, তাঁরা দুজনেই একই কোটির মান। কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেন, “The light that never was on sea or land” - জল, স্থল, অন্তরীক্ষে কোথাও এই শিল্পসৃষ্টির তুল্য মর্যাদাসম্পন্ন বস্তুর দেখা পাওয়া যায়না।

তাই তো শিল্প হল অনন্য পরতন্ত্রা।

দার্শনিক Basanque-এর ভাষায় uniquely individual। শিল্পের এই ঐকান্তিক বৈশিষ্ট্য জাত হয় শিল্পীর কল্পনা থেকে। কল্পনা বা imagination আদর্শ বা ideal-এর সঙ্গে মিশে গিয়ে কবি তথা শিল্পীকে সৃষ্টিধর্মে প্রবুদ্ধ করে। স্নায়বিক ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে কল্পনা প্রবৃত্তির একটি বাস্তববাদী ব্যাখ্যা দিয়েছেন Aristotle-

কল্পনা হল অনুভূতিরই প্রতিচ্ছবি, যা মানুষের মনের মধ্যে থাকে সবসময়। আসলে কল্পনা বিষয়টিকে প্রায় গভীর একটি দার্শনিক প্রতীকে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। সর্বপ্রথম তিনি নিছক কল্পনা “Fancy” থেকে প্রকৃত কল্পনার “Imagination”–এর পার্থক্য নিরূপণ করেছেন। বড় শিল্পীর কাছে কল্পনা বিষয়টি শুধু জৈবিক না, দার্শনিকও। ভারতীয় শাস্ত্রজ্ঞরা বলে থাকেন প্রতিভা হল “অপূর্ব বস্তু নির্মাণ ক্ষমা প্রজ্ঞা।” রবীন্দ্রনাথের সেই “আমি” তত্ত্ব, যে আমির চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে আকাশে আলো ফুটে ওঠে, গোলাপ সুন্দর হয়, সেও এই কল্পনা তত্ত্বের অনুসারী। “Me”-“My life” – “Lotus” – “Blooming”... বৌদ্ধ দর্শনের এই ধ্যান মন্ত্র রাবীন্দ্রিক মননে মিশে যায় অনায়াসে।
0

someপ্রতীক - রীতা পাল

Posted in



















‘এ পাড়ায় সূর্য ওঠে না’ – গত ২১শে জুন ২০২০ রবিবার, প্রতিদিন ছুটিতে প্রকাশিত কবীর সুমনের লেখাটি প্রসঙ্গে কিছু লেখার ইচ্ছে থেকেই এ রচনার সৃষ্টি।

মূল লেখাটি মূলত আমেরিকার কালো মানুষদের নিয়ে। এই প্রসঙ্গে লেখক বাঙালী ও কেরালার বামপন্থী এবং হিন্দুত্ববাদীদের বিরোধিতা করেছেন। আমার যৌবনের সুমনকে আবার প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় খুঁজে পেলাম। হিন্দুত্ববাদীদের বিরোধিতা করে তিনি যা লিখেছেন, তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাতে আমি গঙ্গাজলেই গঙ্গাপুজো সারবো।

হিন্দুত্ববাদীদের মোকাবিলায় আমাদের তার লেখা গানের একটি কলিকেই মূলমন্ত্র করে নিতে হবে – “হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কন্ঠ ছাড়ো জোরে”। অন্য গানের ভোরে আমাদের দেখা হবে কিনা তা নির্ধারণ করবে আমাদের কন্ঠের জোর। এ ব্যাপারে চ্যাপ্টার ক্লোজড্‌। আমি যদি হঠাৎ বেশ একজন কেউকেটা হয়ে উঠি, এবং সাংবাদিকরা আমাকে এই ব্যাপারে পর্যুদস্ত করার জন্য বন্দী করেন, আমি ঘোড়েল রাজনীতিক কিম্বা দক্ষ অভিনেতার মতোই বলে উঠবো – “নো কমেন্টস্‌”।

এবার আসি কেরালার বামপন্থী দম্পতির কথায়। এখানে বামপন্থী দম্পতি বর্ণবিভেদের সমর্থক। কেরালার দম্পতি আমেরিকায় ছেলের কাছে গিয়ে জানতে পারেন ছেলে আফ্রিকান আমেরিকান এক মেয়ের প্রেমে পড়েছে। ছেলে বাবা-মায়ের সাথে মেয়েটির আলাপ করাতে নিয়ে এলে দুজনেই আর্তনাদ সহকারে বলে ওঠেন – “আমরা কমিউনিষ্ট ও মানবতাবাদী, কিন্তু তাই বলে আমরা চাইবো না আমাদের ছেলে এ দেশে এতো সাদা মেয়ে থাকতে কোথাকার একটা নিগ্রো মেয়েকে বিয়ে করুক। বাচ্চাগুলো যা হবে!” মেয়েটি তখন তার বয়ফ্রেন্ডকে বললেন – “আমি বরং যাই, আমি নিগ্রো বলে তোমার মা-বাবার যা অবস্থা, এবারে তো এম্বুলেন্স ডাকতে হবে যা দেখছি”। কেরলকুমারও মিউ মিউ করে বললেন – “হ্যাঁ, সেই ভালো”।

আমার একান্তভাবে মনে হয়েছে এই ঘটনায় শিক্ষিত প্রীমিক প্রেমিকার প্রেমের দৌর্বল্য অনেক বেশি প্রণিধানযোগ্য ব্যাপার। প্রেম যদি শিক্ষিত মানবতাবাদী বামপন্থী বলে পরিচয়দানকারীদের সাথেও লড়তে না পারে, তাহলে বামপন্থীদের অবক্ষয় তো সুনিশ্চিত। কারণ বামপন্থী হলেও তারা তো আসলে মানুষই। দোষ ত্রুটি তো থাকবেই। এবং সেই ত্রুটি যদি সন্তান ও তার প্রেমিকা দূর করতে না পারে, বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেয়, তাহলে প্রকৃত দায়িত্ব কার? বামপন্থাকে বাঁচাতে হলে, রকৃত বামপন্থী পেতে হলেও তো লড়াই চাই। ডান, বাম, অতি-বাম কোনো পন্থাই কিন্তু লড়াই কিম্বা প্রতিবাদ ছাড়া বাঁচে না। হাওড়ার শিবপুরে সুমনের একক অনুষ্ঠানে গিটার হাতে বিশেষ একটি গান গাইতে গাইতে গান থামিয়ে বলে উঠেছিলেন – “কী সুভাষবাবু, দিনবদলের স্বপ্ন আর কতোদিন আমাদের দেখে যেতে হবে?” প্রশ্ন দরকার। প্রতিবাদ দরকার। সই কিম্বা নাম কোনোটাতেই প্রকৃত খাঁটি জিনিস মেলে না। সু-মনদের প্রশ্নেই তৈরি হতে পারে খাঁটি কিম্বা কম ত্রুটিপূর্ণ মানুষ। 

এবার আসি বাঙালি বামপন্থী প্রসঙ্গে। তাদের সম্পর্কে আপনার অভিযোগ “বাঙালি বামপন্থী মানে কবীর সুমনকে এতো বছর পরেও সুমন চট্টোপাধ্যায় বলে যাওয়া”। এই ধরণের ঘটনা থেকেই তো মানুষের প্রকৃত মনোভাব বুঝতে পারা যায়। ভাগ্যিস! যায়। তবে এ নিয়ে আক্ষেপ না রাখাই ভালো। আপনিই তো এই লেখায় উল্লেখ করেছেন – সবার উপরে মানুষ সত্য। তা যদি হয় তাহলে কবীর সুমন যতোটা সত্য, সুমন চট্টোপাধ্যায়ও ততোটাই। আর আমার মতো একজন সাধারণ মানুষেরই কি কম দোষ? আপনি যে লোকসভার সাংসদ, ভুলতে বসেছিলাম। আপনার লেখায় মনে পড়ে গেলো। আমাদের তিনজনের সংসারে আপনার নামের আগে কবীর এখন নেই এবং আগেও নামের শেষে চট্টোপাধ্যায় ছিলো না। আপনি আমাদের কাছে শুধুই সু-মন। আপনার আগে আমরা মাঠ-ঘাট-বন পেরিয়ে আসা আহ্বান শুনেছি, পথে নেমে জেতার স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু আপনিই প্রথম লড়তে নেমে হেরে যাওয়ার সম্ভাবনায় আপোস করা মানুষের বিবেক দংশনে প্রলেপ লাগিয়ে গেয়েছেন – “আমাকে না আমার আপোস কিনছো তুমি”

আপনার লেখার শেষদিকে আপনি সংশয় প্রকাশ করেছেন – আমেরিকার কালো মানুষদের পাড়ায় সূর্য কি আর উঠবে কোনোদিন? এই প্রসঙ্গে বলি, আমার ছেলের সূত্রে জানতে পারলাম শিক্ষিত বাঙালি এখন আর আমেরিকায় ‘ওদের’ কালুয়া বলে ডাকতে পারে না। শব্দটা বাঙলা হলেও এতোদিনের বহুল ব্যবহারে ‘ওরা’ বুঝতে পারছে যে এটা ‘ওদের’কেই বলা হচ্ছে। বাঙালিরা ইদানিং ‘ওদের’ তাই ‘শ্যামল’ ‘শ্যামলী’ বলে ডাকতে শুরু করেছে। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, বিদ্বেষ কমেনি এতোটুকুও। আশার কথা একটাই, কালো মানুষের আন্দোলনে অনেক সাদা মানুষও সামিল হচ্ছেন। আজকের আন্দোলনের মূলে ‘জর্জ ফ্লয়েড’ নামটি এবং ঘটনাটি প্রায় গোটা পৃথিবীটাই জানে।

এবারের someপ্রতীক যথার্থ হলো কিনা, তা নিয়ে আমার নিজের মধ্যেই যথেষ্ট সংশয় দেখা দিচ্ছে। এই মুহূর্তে নিজের রাজ্যে ১৮ বছরের ছেলেটির মায়ের কান্না হৃদয় ভারাক্রান্ত করে তুলছে। বিশ্বাস করুন পাঠক, মাতৃহৃদয়ের হাহাকার নিয়েই কলম চালাচ্ছি। নিজেকেই প্রশ্ন করছি - একজন মা হয়েও ছেলেটিকে ‘সাম্প্রতিক’ করতে পারলাম না কেন? একটু চিন্তা করতেই উত্তর পেয়ে গেলাম। কোটি কোটি সু-মন যদি হিন্দুত্ববাদী সুবিধাবাদী এবং মানবতাবাদীদের মেরুকরণ করতেই না পারেন, তাহলে আরো অনেক তাজা প্রাণ ঝরবে। যাঁরা নিজেদের ‘মানবতাবাদী’ বলে পরিচয় দেন, দোষ ত্রুটি থাকলেও তাদেরই সমালোচনা করা যায়। প্রতিবাদ করা যায়। এ হেন করোনা আবহেও দেশে এবং রাজ্যে সকল রাজনৈতিক দলই যখন গদির স্বপ্ন দেখতে অথবা গদি সামলাতে ব্যস্ত, তখন গদিতে কাকে বসাবো বা থাকতে দেবো – সাধারণ মানুষের এ চিন্তা করার এটাই সঠিক সময়। না হলে কিন্তু অনেক দেরি হয়ে যাবে।
0

someপ্রতীক - রীতা পাল

Posted in




আমাদের আবাসনের একটি মেয়ে তিন বছর বয়স থেকে আমাদের কাছে খুবই আসা যাওয়া করতো। ওর সঙ্গ আমাদের সকলেরই খুব প্রিয় ছিলো। সেই মেয়ের বয়স যখন ছয়, তখন একদিন দেখি আমাদের বাড়িতে এসে মনমরা হয়ে বসে আছে। আমার চোদ্দ বছরের ছেলে কী হয়েছে প্রশ্ন করায় বললো, ওর ক্লাশের অন্য একটি মেয়ে ওকে আজ মেরেছে। আমার ছেলে সঙ্গে সঙ্গে ওকে বললো – তুইও ওকে মারলি না কেন? সে বলে উঠলো – না রে, ওর একটা খুব বড়ো দল আছে। তখন তাকেও একটা দল তৈরির প্রস্তাব দিলে ফোঁস্‌ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো – আমার দলে কেউ আসবেই না।

এতো বছর পর গল্পটা আজ হঠাৎ মনে পড়ার কারণ – এই পরিস্থিতিতে আমারও একটা দলের অভাব অনুভূত হচ্ছে। আর নেত্রী হওয়ার সাধ বা সাধ্য কোনোটাই আমার নেই। কিন্তু দল বা আমার মতো সাধারণ সমমনস্ক কিছু মানুষের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হওয়ার তাগিদ খুবই অনুভব করছি। করোনা এবং পরিযায়ী প্রসঙ্গে কেন্দ্র-রাজ্য যা করলো, তার প্রতিবাদে চীৎকার করে উঠতে খুব ইচ্ছে হলেও গভীর মনন তা করতে দিলো না। অন্য একটি দৃশ্য চোখের পাতায় ভেসে উঠলো। ছেলের পরীক্ষার ফল বের হয়েছে। একেবারেই আশানুরূপ হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। ভাবুক গোছের ছেলেটি বর্তমান শিক্ষার বিষয়বস্তুতে কোনো আকর্ষন খূঁজে পায় না। বাবা-মা সে খবর রাখেন না, কিংবা রাখলেও প্রতিকারের পথ জানেন না। তাই ছেলেটির সামনেই একে অপরের নীতির প্রতি দোষারোপ করতে থাকেন। ছেলেটি নীরব হয়ে শুনতে থাকে। আমার আপনার নির্বাচিত কেন্দ্র-রাজ্য সরকার তাই তো করবে, যা আমরা করে থাকি – তাই না? প্রতিবাদ করতে হলে তো নিজের বিরুদ্ধেই করতে হয় – তাই তো? দিনের পর দিন যখন সরকারি স্বাস্থ্য শিক্ষা কাঠামো ভেঙে পড়ছে, নদী ভাঙন রোধ করা হচ্ছে না, তখন আমরা সাধারণ মানুষ চুপ থেকেছি। আমফান বিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণ সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবে – এটা ভাবা বাড়াবাড়ি নয়? কান্তি গাঙ্গুলি নিজের সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে অনেকবার বলেছিলেন, ত্রাণের টাকা দলের লোকের মধ্যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটাতে দৃষ্টি দেওয়া সম্ভব হয়নি। বাম দলের সেই লোকেরাই বর্তমান সরকারি দলের সদস্য। কাজেই আরো দক্ষতার সঙ্গে সে প্রথা বয়ে চলেছে। সুযোগসন্ধানী বাম বিরোধী মানুষ এবার একটু মুচকি হেসে বলে উঠবেন – তাহলে স্বীকার করছেন তো সমস্যাটা বাম আমলে তৈরি, তৃণমূলের কোনো দোষ নেই? না, আমি সহমত নই। ৫ বছরের বাচ্চাকে ভালো স্কুলে ভর্তি করার জন্য ৩ লাখ ডোনেশনরূপী ঘুষ দিই, বাড়ির বেআইনি নির্মাণের জন্য কর্পোরেশন আর কাউন্সিলারকে উৎকোচ দিই – সেই আমাদের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের কিছু লোক কাটমানি নেবে না তো কী করবে? স্বামী কণিকার ভক্ত, স্ত্রী সুচিত্রার – শুধু এই কারণেই তাদের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে আদানপ্রদান বন্ধ। আমাদের আগের প্রজন্ম হিন্দি সিনেমাকে অপসংস্কৃতি মনে করতেন। সেই আমার আপনার নির্বাচিত নেতা যদি বিরোধীদের দেশদ্রোহী আখ্যা দেন, খুব অবাক হওয়ার কিছু থাকে কি? ‘যব গোডাউনই এইসা হ্যায়, তো শোরুম ঔর ক্যায়সা হোগা’?

নিদান যে নেই তা নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে কালো মানুষের বিক্ষোভে সাদারাও সামিল হয়। অন্তঃসত্ত্বা হাতিটিকে যে পদ্ধতিতে হত্যা করা হয়েছে সারা দেশ তাতে ধিক্কার জানিয়েছে – ভালো কথা। কিন্তু ভালো কথা নয় একেবারেই যখন এরই সাথে সাড়ে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বাকে প্রায় বিনা অপরাধে তিহার জেলে আটক রাখা নিয়ে একটিও কথা বলা হয় না। আমার আপনার সংঘবদ্ধ হতে হবে এই সব বিষয়ে। সংরক্ষণ আইন নিয়ে কিছু বলতে গেলেই তাতে রাজনীতির রঙ তথা ভোটের অঙ্ক এসে যাবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ যদি এ সম্পর্কে এই মত প্রকাশ করে যে, সংরক্ষণ নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই, নিম্নবর্গের কতজন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী বা ডেপুটি কালেক্টর হলেন তা নিয়েও আমরা চিন্তিত নই – আমাদের সম্মিলিত দাবি – দলিতদের স্বাধীনভাবে দেশের সর্বত্র চলাফেরা করার অধিকার দিতে হবে, দেশের সম্পদ সমানভাবে ভোগ করতে দিতে হবে – তাহলে সরকারও ভাবতে বাধ্য হবে। আজ না হয় কাল নয়তো অবশ্যই পরশু। পরিস্থিতি দেখালো, মহামারীতেও একদিন লকডাউন তুলে দিতে হয়, মন্দিরের দরজা খোলার ফরমান জারি হলেও পুরোহিত প্রাণভয়ে বেঁকে বসেন। কাজেই নিজেদের রক্ষার দায়িত্ব এবং সভ্যতাকে পরিপুষ্ট করার ভার শিক্ষিত-অশিক্ষিত নারী-পুরুষ ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলকেই কাঁধে তুলে নিতে হবে। সহানুভূতি বা সমবেদনা ভালো। কিন্তু আত্মমর্যাদা না থাকলে সমবেদনা খুব একটা কাজে আসে না। অর্থাৎ আমাদের সমস্যা সরকার অথবা বিরোধী পক্ষ দূর করে দেবে – এ চিন্তা যেমন অমূলক, তেমনি গরীবের সমস্যা অনুভূতিশীল ধনী দূর করবে কিংবা দলিতদের সমস্যা উচ্চবর্গের লোক সমাধান করবে – এ ভাবনাও ভিত্তিহীন। ‘অধিকার কেড়ে নিতে হয়’। জনমত তৈরি করতে হবে, পথে নামতে হবে। সাথী জুটবেই। লড়াই যদি হয় অশুভের সঙ্গে, সেখানে নেতৃত্ব নিয়ে চিন্তা নেই – দলিত সমস্যায় দলিতরা নেতা, অন্যরা সমর্থক – পরিযায়ী সমস্যায় তারাই নেতা, দলিত ও দরিদ্ররা সমর্থক। এই আন্দোলনে ‘আমরা সবাই রাজা’। নিরন্ন ধর্মভীরু হিন্দুরা যদি রামমন্দির নির্মাণের বিরোধিতা করে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে সোচ্চার হয়, এবং কোটি কোটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ দল নির্বিশেষে ধর্ম নির্বিশেষে সে দাবির প্রতিধ্বনি তোলে – তবেই একমাত্র বন্ধ হবে ‘জাতের নামে বজ্জাতি’। সব ঝড়ই থেমে যায় একদিন, ঝরাপাতাদের আমরা মনেও রাখি না। প্রতিটা ঝড় থেকেই নতুন কিছু আহরণ করে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে ঝরাপাতাদের বলিদানের সার্থকতা। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে বিনা দোষে মার খেয়ে চলা – কখনোই সমাধান হতে পারে না।

0

someপ্রতীক - সৌমিত্র বসু

Posted in


বহুরূপীতে অনেক সময় দুপুর থেকে মহলা হয়ে সন্ধ্যের মধ্যে শেষ হয়ে যেতো। আমরা ছেলে ছোকরারা সেই সুযোগে উত্তর কলকাতায় পেশাদার থিয়েটারের নাটক দেখতে যেতাম। আমাদের দলের পাণ্ডা ছিলো রমাপ্রসাদ বণিক। দু-চারটে ছবি করার সূত্রে সেই সময়েই তার সঙ্গে এই সব পেশাদার অভিনেতাদের যোগাযোগ হয়ে গিয়েছিলো, ফলে পয়সা-কড়ি কিছু খরচ করতে হতো না। এই রকমই একদিন, দল থেকে বেরিয়ে দেখা গেল সন্ধ্যে গড়িয়ে গেছে। থিয়েটার পাড়ায় পৌঁছোতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তার চেয়ে যাই, কলামন্দিরে ঢুকে পড়ি। বহুরূপীর মহলাঘর লোয়ার রেঞ্জে, কলামন্দির সেখান থেকে হাঁটা পথে মিনিট পাঁচেক। মাটির ওপরের কলামন্দিরে তখন মৃচ্ছকটিক নাটকের অভিনয় হচ্ছে। কেউ একটা কানে কানে বললো, বসন্তসেনা যে করছে, মেয়েটা বাঙালী। জানিস তো, নাম ঊষা গাঙ্গুলি। অজ্ঞতার থেকেও তো মানুষ অনেক সময় সত্যি কথা বলে ফেলে। ঊষাদি যে বাঙালী নয়, সেটা তো আইনের সত্য, সরকারি সত্য। কিন্তু সেসব কাগুজে সত্যের বাইরেও তো কিছু সত্য থাকে, কী নাম দেবো তার, হৃদয়ের সত্য? সেখানে ঊষাদি বাঙালী। একশো ভাগ বাঙালীই। কিংবা, তুলনাটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো হয়তো, রবীন্দ্রনাথের গোরা যেমন একই সঙ্গে আইরিশম্যান, হিন্দু এবং ভারতীয় মানুষ। ঊষাদি তার তুলনায় অনেক ছোট পরিসরে একই সঙ্গে অবাঙালী, বাঙালী, ভারতীয় মানুষ এবং থিয়েটারের মানুষ। সেই মানুষ, যে নিজের কথা বলবার জন্যে অনবরত স্পন্দিত হয়। থিয়েটারের মধ্যে দিয়ে, থিয়েটারের বাইরের যে কোনো রন্ধ্রপথ দিয়ে সে বেরিয়ে আসে, ফুটন্ত জলের মতো ফুলে ফেঁপে।

কিন্তু বাঙালী কথাটা বললাম কেন? নিজে বাঙালী বলেই বুঝি। ঊষাদির বাংলা উচ্চারণে একটা মিষ্টি আড়ষ্টতা ছিলো, কিন্তু যতদূর জানি, এ ভাষা পড়ায় কোনো অসুবিধে ছিলো না। রবীন্দ্রনাথটা তো বেশ ভালো করে পড়েছিলো। দখলটা কতটা পর্যন্ত তা বোঝাবার জন্যে একটা কথা বলি, খুব বেশি মানুষ সে কথা হয়তো জানেন না। কর্ণেল বসু নামে এক ভদ্রলোকের একটি রেকর্ডিং স্টুডিও ছিলো, সেখানে কাজ করতেন শ্রাবন্তী মজুমদার। সেই সুবাদে এটাকে সবাই শ্রাবন্তীর স্টুডিও নামেই চিনত। সেখানে ঊষাদি আসতো, বিজ্ঞাপনের গান, যেগুলো বাংলায় লেখা হয়েছে এবং তার হিন্দি করতে হবে, গাইতে হবে সেইসব গান, তার অনুবাদের কাজ করবার জন্যে। তার বাইরেও, বালক বনে মহান বলে একটা হিন্দি নাটকের সিরিজ আসতো সেই স্টুডিওতে, মহাপুরুষদের ছোটোবেলার কোনো না কোনো কাহিনী নিয়ে নাটক, তার বাংলাও করতো ঊষাদি, যতদূর মনে পড়ছে। একটু প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলি, সেই বালক হলো মহানের নাটকগুলোতে ছোট্ট মহাপুরুষের চরিত্রের একচেটিয়া অভিনেতা, শ্যামল সেন আর চিত্রা সেনের তখনো গোঁফ-দাড়ি না ওঠা সন্তান, কৌশিক সেন। যাই হোক, অনুবাদের কাজ, কেঠো অনুবাদ নয়, বিজ্ঞাপনের জন্যে মনোমোহিনী অনুবাদের কাজ যাদের করতে হয়, তাদের দুটো ভাষাই বেশ ভালো না জানলে চলে না, এ তো যে কেউ বুঝতে পারবেন। মৃচ্ছকটিকের সেই মেয়েটির সঙ্গে ওই স্টুডিওতেই ভালো করে ঊষাদি হিন্দিতে নাটক করেন, এই পর্যন্ত জানি, তখনো পর্যন্ত সে সব নাটক দেখাবার ব্যাপারে খুব টান অনুভব করিনি। সে টান টের পেলাম আর একটু বড় হয়ে ওঠার পরে, আর সেই তাঁর নিজের ক্ষেত্রে ঊষাদি আমাকে একেবারে ফ্ল্যাট করে দিলেন। তাই নিয়ে কথা বলবার আগে একটা ছোট্ট ঘটনার কথা একটু বলে নিই। একবার বিভাস চক্রবর্তীর সঙ্গে কী একটা প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি বলছিলাম, মেয়েদের যে কোনো কাজে তাদের স্বভাবের ধরন, খারাপ অর্থে নয়, সদর্থে যাকে মেয়েলিপনা বলে, তা চলে আসতে বাধ্য। তখন যাদবপুরে সাহিত্য নিয়ে পড়ছি, উইমেন্স ডায়লেক্ট ইত্যাদি নিয়ে কথাবার্তা শুনছি, সেইসব জায়গা থেকেই কথাটা মাথায় এসেছিলো কিনা আজ আর বলতে পারবো না। বিভাসদা কিছুতেই মানবেন না। শেষে বললেন, বেশ, এই যে ঊষার কোর্ট মার্শাল, বলো, কোথায় মেয়েলিপনা আছে? আমি চুপ।

আমি এখনো বিশ্বাস করি, মেয়েদের কাজে সাধারণভাবে তাদের লিঙ্গগত যে অভিজ্ঞান, তা থেকে যাওয়ার কথা, যেমন পুরুষের। কিন্তু এইসব তর্ককে সরিয়ে রেখে যদি বলি, ঊষাদির কাজের মধ্যে এমন একটা প্রাবল্য, একটা তীব্র আগ্রাসী ধাক্কা আমি পেয়েছি, তার সঙ্গে মেয়েলি ধরন বলতে আমরা যা বুঝি, তার খুব স্পষ্ট বিরোধ আছে। অথচ সেই প্রাবল্য প্রায় এই মানুষটির নিজস্ব অভিজ্ঞান হয়ে আছে, অন্তত আমার কাছে। বহু মানুষকে নিয়ে কাজ করতে পারতেন, তাদের একসঙ্গে জুটিয়ে পাটিয়ে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনাটা খুব সহজ কাজ নয়, বিশেষত আমাদের মত হাফ পেশাদারদের দেশে। ঊষাদি সেটা কী করে করতেন বলার অভিজ্ঞতা আমার নেই, কিন্তু পারতেন যে, তা তো প্রযোজনা দেখেই বোঝা যেতো। আমার মনে হয়, এর পেছনে তাঁর তীব্র আবেগের একটা বড় ভূমিকা আছে। ঊষাদি কোথাও বক্তৃতা করতে গেলে বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠবেন এবং বোঝাই যায়, সেটা উত্তেজনার অভিনয় নয়, সত্যি সত্যি উত্তেজনা। নাটকের শেষে এসে জড়িয়ে ধরছেন, কোনো ভান নেই, ভালোবাসার তাপটা স্পষ্ট অনুভব করা যায়। আমরা দুজন পাশাপাশি বসে কোনো নাটক দেখছি, ঊষাদির নাটকটা অপছন্দ হয়েছে। অশ্লীল, ধান্দাবাজি বলে মনে হয়েছে। ঊষাদি আমার কাছে এমন করে অভিযোগ করছেন যেন আমি একবার নির্দেশককে বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে। একবার টেলিভিশনে ধারাবাহিকভাবে নাটক নিয়ে কী একটা করার কথা হলো, আমাকেও ডেকে নিলেন। তাঁর ঘরে বসে দুজনে নানারকম পরিকল্পনা হচ্ছে, সে পরিকল্পনার মধ্যে প্রভূত আবেগ, হয়তো অত আবেগের ধাক্কাতেই কাজটা আর হয়ে উঠলো না শেষ পর্যন্ত। আমাকে ওঁর দলের একটি মেয়ে বলেছিলো, উঃ! মহিলা কী ভালোবাসতে পারে, আর নিজের থিয়েটারের ব্যাপারে কী নিষ্ঠুর হতে পারে। এই নিষ্ঠুরতাটা তো ভালোবাসা থেকেই আসে।

সাধারণভবে থিয়েটারের আজকের যে চেহারা, সেটা একেবারেই পছন্দ হচ্ছিলো না। বহুবার আমাকে বলেছেন, সৌমিত্র, আমার এই বিনোদিনী কেয়া মঞ্চে আমরা থিয়েটারের লোকেরা মাঝে মাঝে একটু আড্ডা মারবো। নিজেদের মধ্যে মন খুলে কথা বলবো। খুব ঘন ঘন যে হতে পারেনি সেই আড্ডা, তার একটা দায় হয়তো আমারও। আমিও সময় দিইনি, দিতে পারিনি। ওই ছোটো পরিসরে নাটক করাতেন, আমাদের অন্তর্মুখকে দিয়েও নাটক করিয়েছেন। প্রথম অভিনয়টা দেখতে পারেননি, পাকিস্তান চলে যেতে হয়েছিলো, তাই নিয়ে কী আফশোষ। পরের নাটকটা দেখে সেই বুক জড়িয়ে ধরা।

একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। ওইরকম একটা আড্ডায় বসেছি আমরা, রবিবারের সকাল। যে বাবা-মায়েদের সন্তানেরাও থিয়েটারে এসেছে, তাদের নিয়ে আড্ডা, বাবা-মা আর ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গ। আমি সস্ত্রীক সঞ্চালক। যা হয়, শেষ হতে হতে বেলা হয়ে গেলো। তাতে কিছু না, দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমার আবার সেদিন আলিপুর জেলের ভেতরে কয়েদীদের সামনে একটা অনুষ্ঠান আছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঢুকতেই হবে, জেলের ব্যাপার, ইচ্ছেমতো যাওয়া যাবে না। আমি পালাবার তাল করছি। অসম্ভব। ঘটনাটা বললাম, আমি বাইরে খেয়ে নেবো। অসম্ভব। কাঁধ ধরে বসিয়ে দিলেন। সে হাতের যা জোর, আমার হাঁটু পর্যন্ত অবশ হয়ে গেলো। আলাদা করে ভাত দিয়ে খাওয়ালেন, কোনোমতে না পেট পুরে। হাঁক-ডাক করে পরিবেশন করিয়ে করিয়ে।

কত যে বয়েস হয়ে গেলো। অমন করে কাঁধ চেপে বসিয়ে দেবার মতো মায়াবী শক্ত হাত আর কোথাও আছে বলে তো বিশ্বাস হয় না।
0

someপ্রতীক - ওমর কায়সার ও খালেদ হামিদী

Posted in

নবজাগরণের মানুষ

‘আব্বা আমাদের চাচাতো–মামাতো ভাইদের নাম রেখেছিলেন নিজের নামের মতো দীর্ঘ করে। সবার বড়ো আমার মামাতো ভাই সৈয়দ আবুল ফজল মোহাম্মদ কামরুজ্জামান। তারপর আমার অগ্রজ আবুল কালাম মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। ততদিনে আব্বার নাম ইংরেজিতে সংক্ষিপ্ত হয়ে ডা.এ টি এম মোয়াজ্জেমে পরিণত হয়েছে। তখন থেকে আমাদের সবার নামে যেন এ টি এম থাকে, এটাই হয় তাঁর লক্ষ্য। অতএব আমার নাম রাখা হয় আবু তৈয়ব মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান। আমার ভাইয়ের আবু তালেব মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান।......আমার প্রথম গল্প বেরিয়েছিল এ টি এম আনিসুজ্জামান স্বাক্ষরে। তারপর এ টি এম বর্জন করি। পত্রিকার পাতায় তা দেখে আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘এ টি এম লেখনি কেন?” বললাম, ‘‘ওটা বাদ দিয়েছি।’’ আব্বা একটু চুপ করে থেকে বললেন,‘আমার ছেলে হিসেবে চেনা যাবে না’’

স্যারের আত্মজীবনী কাল নিরবধির প্রথম পর্ব জন্মের আগের শেষ স্তবকে এইভাবে উঠে এসেছে তিনি কীভাবে আনিসুজ্জামান হলেন। চিকিৎসক বাবা আক্ষেপ করেছিলেন— নামের বাড়তি অংশ বাদ দেওয়ায় তাঁর ছেলে হিসেবে চেনা যাবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আনিসুজ্জামানকে চেনা গেল একটা জাতির বাতিঘর হিসেবে, অভিভাবক হিসেবে, তিনি হয়ে উঠেছিলেন নবজাগরণের মানুষ। পরপার থেকে তাঁর বাবা কি সেটা টের পেয়েছেন? 

বাংলাদেশের দেশের প্রতিটি নাগরিক যেমন আনিসুজ্জামান স্যারদের মতো মানুষের কাছে অনেক ঋণ, তেমনি আমারও আছে।কিন্তু তাঁর সরাসরি ছাত্র হিসেবে আমার কিছু বাড়তি ঋণ আছে।

আজ আমার মনে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলোর কথা, খুব কাছ থেকে শোনা স্যারের বক্তৃতাগুলোর কথা।

স্যার ছিলেন তুখোড় বক্তা। পরিমিত ও যথাযথ শব্দ প্রয়োগ করে কথাগুলো এমনভাবে বলতেন যেন কোনো কথাশিল্পীর লেখা গদ্য তিনি পাঠ করে শোনাচ্ছেন। যেন অনেক আগে ভেবেচিন্তে কথাগুলো আগে থেকে লিখে রেখেছেন। কোনোদিন তাকে অযাচিত শব্দ উচ্চারণ করতে দেখিনি।

তাঁর বক্তব্যে সাহিত্য রাজনীতি, ভাষা, সমাজ তা যে কোনো বিষয় হোক না কেন তা উপস্থিত শ্রোতাদর্শকদের উপভোগ্য হয়ে উঠত সুন্দর পরিবেশনের কারণে।বিষয় যতই গুরুতর হোক স্যার তা তুলে ধরতেন রসপূর্ণ করে।

চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে একবার শিল্পী মুর্তজা বশীরের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্যার বক্তৃতা দিতে উঠে বলেছিলেন — মুর্তজা বশীরকে সামনে রেখে আমরা কি তাঁর শোকসভা করছি? সবাই কেমন গুরুগম্ভীর হয়ে তার গুনগান আর স্মৃতিতর্পন করছি।তাঁর প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় মুহূর্তেই পুরো অনুষ্ঠান উৎসবে পরিণত হলো। মুর্তজা বশীরের হাতে আংটি পরা থেকে শুরু করে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের মজার মজার সব গল্প বলতে বলতে কখন যে শিল্পী মুর্তজা বশীরের মূলশিল্পকর্ম এবং লেখালেখির জগতে তিনি প্রবেশ করিয়ে দিলেন উপস্থিত দর্শকশ্রোতাদের।একধরনের মোহাবিষ্ট হয়ে শুনতাম তাঁর কথামালা। এমন শিল্পশোভন বক্তব্য বাংলাদেশে সত্যিই বিরল।

সংবাদপত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে একটি বক্তব্যর কথা বলি। স্যারের বক্তৃতার প্রতি আকর্ষণতো ছিলই, তার উপর সাংবাদিক হিসেবে বিষয়টির প্রতি আমার আগ্রহ থাকাতে এটির কথা বেশ মনে আছে। সেদিন স্যার সংবাদপত্র এবং অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে ভাষার ভুল ব্যবহারের উদাহরণ দিয়ে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছিলেন। আপাত দৃষ্টিতে যে ভুলগুলো কারও চোখে পড়ে না তাই তিনি দেখিয়ে দিলেন আঙুল তুলে। দেখিয়ে দিলেন শব্দের ভুল প্রয়োগের কারণে কীভাবে বাক্য মূল ভাবনা হারিয়ে বসে। সেদিনের বক্তব্যে ছিল তীব্র ব্যঙ্গ আর হাস্যরস। স্যার সেদিন বলেছিলেন, ‘উইমেন ওপেন টেনিস টুর্নামেন্ট’কে বাংলা করতে গিয়ে কেউ যদি লেখেন— ‘উম্মুক্ত মহিলা টেনিস টুর্নামেন্ট’ লেখেন, তবে এই বয়সেও মনটা কেমন হয়ে যায় বটে।বাংলা ভাষার পত্রিকাগুলোর জন্য সেদিনের ভাষণ ছিল এক অনন্য দিকনির্দেশনা।

এমনিতে বাংলা ভাষার অপব্যবহার ও প্রমিত বাংলার বিকৃতি নিয়ে স্যার চিন্তিত ছিলেন। নানা বক্তৃতায় তিনি এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলতেন, পঞ্চাশের দশকে প্রমিত বাংলার চর্চা ছিল। মানুষ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতো ঠিক, কিন্তু সাহিত্যে, নাটকে, লেখায় এবং নাগরিক জীবনের আলাপে সালাপে প্রমিত বাংলার চর্চা হতো। আজকাল অনেকেই এই প্রমিত ভাষা স্বীকার করেন না।

মূলত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর আমাদের স্বাধীনতার সকল মূল্যবোধ পায়ের তলায় পিষে দিয়ে যখন হন্তারক শাসকগোষ্ঠী এই দেশটিকে আরেকটি পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল তখন ইচ্ছাকৃতভাবে প্রমিত বাংলাকে বিকৃত করা হচ্ছিল।

একটি বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, বায়ান্ন সালে যে ভাষার জন্য বাঙালি প্রাণ দিয়েছে, সেই মাতৃভাষাকে আমরা হত্যা করছি। ভাষা বিকৃতির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে স্যার উল্লেখ করেছিলেন – ৭৫ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী নিজেরা নিজেরা নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এইসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবহৃত ভাষায় আরবির প্রভাব দেখা দেয়। পাশাপাশি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলো ভাষাকে বিকৃত করেছে। সেই সময় বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে প্রয়োজনে আরও একটি বায়ান্নর প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।

একদিন স্যার ক্লাসে বঙ্কিম পড়াচ্ছিলেন। ক্লাস শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কিশোর নামে আমার এক বন্ধু স্যারকে বোকার মত অপ্রাসঙ্গিক একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল। সে জানতে চেয়েছিল শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদের মধ্যে কে বড় কবি। এই প্রশ্নে আমিও বিব্রত হয়েছিলাম। কারণ কথাটা সে এমনভাবে স্যারকে বলেছিলো যে, এই ব্যাপারে আমারও জানার আগ্রহ আছে।

স্যার একটু অবাক হয়ে কপালে ভাঁজ তুলে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, পড়ালাম বঙ্কিমচন্দ্র, বুঝালাম বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমের কী অবদান। আর তোমরা জিজ্ঞেস করছ শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদ নিয়ে।

তখন কিশোর বলেছিল, অনেকেই আমাদের এই প্রশ্ন করে।

স্যার তখন বললেন, নজরুল বড় নাকি রবীন্দ্রনাথ বড়। এই প্রশ্নও তো কেউ কেউ করে নিশ্চয়ই।

আমরা দুজন একে অপরের দিকে হাসলাম।

স্যার বললেন, কেউ কারো চেয়ে ছোট নয়, আবার কেউ বড়ও নয়। জাম ভালো নাকি জামরুল ভালো, এরকম প্রশ্ন করা বোকামির কাজ। এক একটার এক এক রকমের স্বাদ। কবিদের ব্যাপারে তুলনামূলক বিচারটা করে কেউ কেউ কাউকে সামাজিকভাবে উপরে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। তাদের মধ্যে অন্য একটা রাজনীতি খেলা করে।

স্যার প্রশ্ন করলেন- তুমি শামসুর রাহমান পড়নি, আল মাহমুদ পড়নি? ওদের পড়ো। তখন তুমি নিজেই বুঝে নেবে কে তোমার প্রিয় কবি।

আরেকবার শামসুর রহমানের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কোনো এক অনুষ্ঠানে স্যার বলেছিলেন, শামসুর রাহমান আমাদের ইতিহাসের পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছেন। কবিতায় নিজের কালকে তুলে এনেছেন বলে তিনি কালোত্তীর্ণ কবি।

স্যারের মতে শামসুর রাহমান ইতিহাসের পাশাপাশি হেঁটে গেছেন। কিন্তু তিনি নিজে বাঙালির ইতিহাসের অংশ। তার আত্মজীবনী কাল নিরবধি শুধু একটি মানুষের ব্যক্তি জীবনের স্মৃতি গাঁথা নয়। শুধু অসাধারণ গদ্যশৈলীর উদাহরণ নয়। একজন মানুষ একটি পরিবার একটি সমাজ একটি জনপদ ও রাষ্ট্রের সদস্য। মানুষ যত বড় হয় তার প্রেক্ষাপট ততো বড় হয়। আনিসুজ্জামানের আত্মজীবনী তাই হয়ে উঠেছে বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস। ১৯৪৭ এর পরে বাঙালির জীবনে কতশত ঘটনা ঘটে গেল। ‌ কত পরিবর্তন, রাষ্ট্র বদল। সময়ের পদে পদে তিনি সেসবে সংযুক্ত ছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। একাত্তরের যুদ্ধে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন রাষ্ট্রের বাংলা সংবিধান লিখতে করলেন কঠোর পরিশ্রম। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর সামরিক শাসন, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। মোটকথা সাতচল্লিশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রত্যেকটা জাতীয় আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তাঁর।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরেরা যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার বিচারের দাবিতে ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এক গণআদালতের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই গণআদালতে আনিসুজ্জামান গণহত্যায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহযোগী গোলাম আযমের কর্মকাণ্ড তুলে ধরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। সেই অভিযোগটা আমাদের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

স্যারের লেখা যে বইটি আমি প্রথম পড়েছি সেটি হলো মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য । এটি তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভ। এই বইতে বাঙালি মুসলমান সমাজে মানসিকতার বিবর্তনের কথা বর্ণিত আছে। বিপুল পরিশ্রম, সাধনা এবং মেধা না থাকলে এইরকম গ্রন্থ রচনা সম্ভব হয়ে উঠত না।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য স্যার নীরবে কাজ করে দূর–প্রসারী অবদান রেখে গেছেন। আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। একদিন আমাদের কাছে গোলাম মোস্তফা স্যার এসে বললেন, তোমরা সবাই থেকো। আনিস স্যার আজ একটা নতুন বিষয়ে বক্তব্য দেবেন। স্যারের নির্দেশে মিলনায়তনে আমরা সবাই জড়ো হয়েছিলাম। বাংলা বিভাগের অন্যান্য শিক্ষক ছিলেন সঙ্গে। বাংলা গদ্যের উদ্ভব নিয়ে স্যারের সাম্প্রতিক এক গবেষণা নিয়ে কথা বললেন সেদিন। আমরা জানতাম বাংলা কবিতার বহু বছর পর, ইংরেজ শাসনামলে, তাদেরই পরিচর্যায় বাংলা গদ্যের জন্ম হয়েছে। এই তথ্য ভুল প্রমাণ করলেন আনিসুজ্জামান। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় গ্রন্থাগার, আর্কাইভ ঘুরে, দলিল সংগ্রহ করে প্রমাণ করলেন- মূলত ইংরেজ আমলের বহু আগে বাংলা গদ্যের প্রবর্তন হয়েছে। বাংলা ভাষা সম্পর্কে তাঁর সেই ঐতিহাসিক ঘোষণার একজন সাক্ষী হিসেবে আমি গর্ববোধ করি।

মনে পড়ছে- আশির দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবদারের আন্দোলনের কথা। ‌ চোখে ভাসছে স্যারের বাসার সামনে অবস্থানরত তরুণ-তরুণীদের ছবি। তাঁদের একটাই দাবি- প্রিয় আনিস স্যারকে কোথাও যেতে দেবেন না। একজন স্যারকে ধরে রাখতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম আন্দোলন আর হয়েছিল কিনা আমার জানা নেই।

এখন স্যার এই পৃথিবীটাই ছেড়ে চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর কাছেতো সময়ের অনেক দাবি ছিল। এই দুঃসময়ে, একটি নতুন পৃথিবীর উত্থানের সময় আনিসুজ্জামানের মতো একজন অভিভাবকের খুব তো প্রয়োজন ছিল।

মনে পড়ছে- চবিতে তাঁর বিদায়ের দিন এক ছাত্রী কাঁদতে কাঁদতে গেয়েছিলেন- শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে.....। সেদিন স্যারকে দেখেছিলাম ভেজা চোখে গানটি আকুল হয়ে শুনতে।

আজ সেই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটছে আমার ভেতরে। মনে হচ্ছে কারা যেন সমস্বরে গাইছে সেই গান। আর স্যার মেঘের ওপার হতে তা শুনতে কান পেতে আছেন।

-ওমর কায়সার
******************************************************


আনিসুজ্জামানের দেহাবসান

বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ, লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান এই অকল্পিতপূর্ব করোনাকালে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগে, শেষে ওই অণুজীব-আক্রান্ত হয়ে, ১৪ মে ২০২০ তারিখে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কারো কারো ধারণা, বাড়িতে নয়, হাসপাতালেই তিনি করোনাক্রান্ত হন যা জাতির চিত্তকে অভাবনীয়রূপে ভারাক্রান্ত করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জন্ম ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭ সালে, ব্রিটিশশাসিত ভারতের পশ্চিমবংগের উত্তর চব্বিশ পরগণায়, এক উচ্চশিক্ষিত পরিবারে। কলকাতায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হলেও কৈশোরেই তিনি পিতৃপরিবারের সাথে চলে আসেন খুলনায়। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে ঢাবি থেকে তিনি পিএইচডি শুরু করেন এবং ১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি লাভ করেন।

আনিসুজ্জামান জড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সংগে। তিনি ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের বংগানুবাদক। মনে পড়ে, ভি. আর. আম্বেদকর ভারতের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা, যিনি 'হিন্দু বৌদ্ধ ও মার্ক্সবাদ' নামে একটি ছোট অথচ শক্তিশালী ব্যতিক্রমী বই লিখে অনেক কৌতূহলী পাঠককে চমকে দেন। এদিকে আনিসুজ্জামান লেখেন 'বাংলাদেশে পাকিস্তানের মানবাধিকার লঙঘন', 'আমার একাত্তর' এবং 'প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম'-এর মতো মাইল ফলকতুল্য গ্রন্থ।

তাছাড়াও তিনি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে, আরেক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ কুদরাত-ই-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবে সক্রিয় থাকেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বিষয়ে তাঁর গবেষণাও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। 

আনিসুজ্জামান অনেক পুরস্কারেও ভাস্বরতর হয়ে ওঠেন। সেগুলোর মধ্যে অবশ্যউল্লেখ্য ০১. প্রবন্ধের জন্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০); ০২. শিক্ষায় অবদানের জন্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক (১৯৮৫); ০৩. শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্যে ভারত সরকার কর্তৃক তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ; ০৪. সাহিত্যে অবদানের জন্যে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৫); ০৫. আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃক দুবার আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৩ ও ২০১৭)

০৬. রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট. ডিগ্রি (২০০৫) এবং ০৭. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক (২০১৮)। তাছাড়াও, বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালের ১৯ জুন তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত করে। তাঁকে শিক্ষকের শিক্ষকও বলা হয়।

তাঁর সাহিত্যকৃতির মধ্যে 'স্বরূপের সব্ধানে'; 'সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি' এবং 'বিপুলা পৃথিবী' গ্রন্থত্রিতয় অবশ্যউল্লেখ্য।

প্রতিক্রিয়াশীলতাবিরোধী আনিসুজ্জামান ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রসহ প্রাগ্রসর জীবনচেতনার প্রতি, একই সংগে দায়বদ্ধ ও উন্মুখ থাকেন।

তাই জাঁ পল সার্ত্রর প্রয়াণে সীমন দ্য বোভোয়ার যেমন বলেন, তেমনি আজ বলতে হয়, আনিসুজ্জামান তাঁর মতোই আছেন, শুধু শ্বাস-প্রশ্বাস নেই।

-খালেদ হামিদী
0

someপ্রতীক - রীতা পাল

Posted in

‘হাসির কথা শুনলে বলে হাসবো না না না না’ - আমি মোটেও এই প্রজাতির লোক নই। তাই বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতেও হেসে ফেলছি। 

বর্তমানের বিশ্ব করোনা বিপর্যয়ে বেশ কিছু মানুষ বলতে আরম্ভ করেছেন – সব খারাপেরই কিছু ভালো দিকও থাকে – লকডাউনের ফলে দূষণের মাত্রা অনেক কমে গেছে, আকাশ যে নীল তা নতুন করে উপলব্ধি করা যাচ্ছে, সর্বোপরি মানুষ তার পরিবারের সাথে ‘কোয়ালিটি টাইম’ কাটাতে পারছে। কথাগুলো শুনে আনন্দে আত্মহারা হওয়ারই কথা, কিন্তু আমার কেন জানি না মানুষের এ হেন বোধোদয়েও হাসি পাচ্ছে। 

‘আমার তো চব্বিশ গুণ সাত আর আমার স্ত্রীও তো দারুন ব্যস্ত – তাই বাচ্চাকে একেবারেই সময় দিতে পারি না’ – এ কথা বলতে এতোকাল যারা একটুও লজ্জা পায়নি, তারাই আজ ‘কোয়ালিটি টাইম’ কাটানোর জয়গান গাইছে। আসলে প্রকৃতি মানুষের ঘাড় ধরে বলছে – ‘না বুঝবি তো মগজে তোর গজাল মেরে গোঁজাবো’। 

আমাদের আগের প্রজন্ম কৃষিনির্ভর হওয়ায় নিশ্চিন্তে পরিবার বাড়িয়ে গেছে। তারপর শিল্প আসায় বিপুল পরিবর্তন হলো। আমাদের মতো দেশে সরকারকে পরিবার পরিকল্পনা শুরু করতে হলো। অথচ বেঁটে খাটো ঋজু মানুষটি বুঝতে পেরেছিলেন যে, অর্থের মাধ্যম হিসেবে শিল্প আসতে চলেছে – এর ফলে যৌথ পরিবার ভেঙে পড়বে এবং সংসারে বড়ি-আচার-আমসত্ত্ব বানানো বিধবাকূল অপাংক্তেয় হয়ে পড়বে। তাই কর্মবীর ঈশ্বরচন্দ্র নারীশিক্ষা ও বিধবাবিবাহের প্রচলনের মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসনে নেমে পড়লেন কোমর বেঁধে। এ হেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টার কপালে কী সম্মান জুটেছিলো, সে আমরা জানি। 

যৌথ পরিবারের ভাঙনের মতো আমাদের দেশে কম্প্যুটারের প্রবেশও ছিলো অনিবার্য। বামপন্থীরা বলেছিলেন - এর ফলে দেশে বেকারি বাড়বে। কথাটা পুরোপুরি ভুলও নয়। ক্রিয়া মাত্রেরই প্রতিক্রিয়া থাকবে। তার জন্য ক্রিয়াকে রোখার চিন্তা অযৌক্তিক। দরকার ছিলো উদ্বৃত্ত কর্মীদের কিভাবে কোন কোন কাজে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, তার পরিকল্পনার কথা বলা। পরিবর্তে বেকারি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিজ্ঞানের দান কম্প্যুটারকেই তারা ভিলেন বানিয়ে বসলেন। কম্প্যুটার এলো, কিন্তু আর্থিক ও মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকা এলাকায় আশীর্বাদ হিসেবে নয়, ভোগান্তি হিসেবে। অনেক এলাকাতেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে পাশবই আপডেট করার মেশিন সহ বেশ কিছু কম্প্যুটার বিভিন্ন তুচ্ছ কারণে দিনের পর দিন অচল পড়ে থাকে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ কর্মী না অর্থ – অভাবটা কিসের জানি না। 

এই প্রসঙ্গে অন্য একটি উদাহরণ মাথায় আসছে – বিভিন্ন জায়গায় ব্র্যান্ডেড কোম্পানির শোরুম বা আউটলেটগুলো লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, তারা শোরুম খোলার আগে এলাকার আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার ওপর রীতিমতো গবেষণা করে নেয়। তাই তাদের বিভিন্ন জায়গার শোরুম একইরকম ঝাঁ-চকচকে এবং একইরকম সম্ভারে সজ্জিত থাকে না। মুনাফাই মূল উদ্দেশ্য হওয়ায় পরিকল্পনা ও প্রয়োগে অভ্যস্ত তারা। মুনাফার মতো মানবকল্যাণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ, নতুন পণ্যের ক্ষেত্রে সরকারি না বেসরকারি, সামাজিকভাবে অগ্রসর না অনগ্রসর আর্থিকভাবে সক্ষম না অক্ষম এলাকা – এই তথ্যগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই যে কোনো জিনিসেরই সফল রূপায়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা দরকার। বলার কথা এটাই – প্রকৃতির ভাণ্ডার বিবিধ উপাদানে ভরপুর। যন্ত্রের শক্তি, মানুষের শক্তি, প্রাকৃতিক শক্তি, অর্থ সবই আছে। কোথায় কোন শক্তিকে কাজে লাগালে মানবসভ্যতার সবচেয়ে বেশি উপকার, সেটা ভেবে দেখতে হবে। অবশ্য মানুষের উন্নতি বা মঙ্গলই যদি আমাদের একমাত্র বিবেচ্য হয়, তবেই।

এবার একটা পারিবারিক ঘটনার কথা বলি। আমার দেওর আমার চেয়ে দেড় বছরের ছোটো। তার মেয়ে আমার ছেলের থেকে আবার আট বছরের ছোটো। তিন বছরের ছোট্টো এ হেন মেয়েটি একদিন আমাকে বললো – ‘জানো জেম্মা, তুমি আর বাবা সমবয়সী’। আমি তো আপ্লুত। বললাম – ‘একদম ঠিক বলেছো’। আমার উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে এবার সে বলে উঠলো – ‘আর আমার মা আর তুতানদাদা(আমার ছেলে) সমবয়সী’। বলা বাহুল্য, এবারে আর উৎসাহ দিতে পারলাম না। তিন বছরের একটা শিশু ‘সমবয়সী’ শব্দটা বিভিন্নভাবে প্রয়োগ করতে করতেই একদিন সঠিক প্রয়োগ শিখে যাবে। চিন্তা নেই। কিন্তু, আমরা যারা লকডাউনে বন্দী অবস্থায় নিজেদের সচেতন হিসেবে প্রমাণ করার জন্য দূষণ, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো নিয়ে অনেক কথা বলছি, লকডাউন কেটে গেলেও এই সচেতনতা কি বজায় রাখতে পারবো?

আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে ভোপালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কলোনীতে এক আত্মীয়ের কোয়ার্টারে বেড়াতে গিয়ে দেখেছিলাম – সেখানে প্রায় প্রত্যেক অফিসারেরই বাইক ছিলো। কিন্তু রোজ প্রত্যেকে বাইক বের করতেন না। দুজন করে জোট বেঁধে একজনের বাইকে অন্যজন এবং পরদিন অন্যজনের বাইকে আগেরজন সওয়ার হতেন। অর্থাৎ যে কলোনী থেকে ৪০টা বাইক রোজ রাস্তায় নামার কথা, সেখানে ২০টা বের হতো। একথা ঠিক যে, বসবাসের স্থান, গন্তব্যস্থল এবং কাজের সময় এক হওয়াতেই এটা সম্ভব হয়েছিলো। করোনা যুদ্ধে জয়ী মানব সমাজ দূষণ কমাতে এরকম কোনো ভাবনা কি ভাববে? এখন আমরা যেভাবে জলের মতো জল খরচ করছি, সে সম্পর্কে সচেতন হবো কি? ভারতের অনেক শহরেই কিন্তু জলকষ্ট শুরু হয়ে গেছে। 

কাজের লোক বা পরিচারিকা ছাড়া এই লকডাউনের মধ্যে আমরা সকলেই দিব্যি সংসার চালাচ্ছি। অবশ্য এর পেছনে কাজ করছে মৃত্যুভয়। কিন্তু মৃত্যুভয় কাটলে করোনা যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর আমরা এই মানুষগুলোকে এবং তাদের কাজকে সম্মান দিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সপ্তাহের নির্দিষ্ট একটা দিন কি ছুটি দিতে পারবো?

মানুষ হিসেবে আমরা মুক্ত চিন্তার ধারক এবং সাহসী না হতে পারলে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়। এ কাজ কোনো রাজনীতিক, বা ধর্মগুরু বা এনজিওর নয়। কারণ, এদের পায়ে অনেক ধরণের বেড়ি বাঁধা। উচ্চশিক্ষিত মানবিক ও সচেতন কেজরিওয়ালকে ভোট বৈতরণী পার হতে জনদরদী কাজকর্মের পরেও হনুমান চালিশা মুখস্থ বলতে হয়। বিপক্ষ দল ‘জয় শ্রীরাম’ বললে মাথা খাটিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ‘জয় হনুমান’ ধ্বনি দিতে হয়। একই কারণে কেজরিওয়ালের মহিলাদের জন্য বাস ও মেট্রোতে ভাড়া মকুবে আমার মতো সামান্য গৃহবধুর প্রতিবাদ উগরে দিতে বাধা নেই। যে দেশে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে মহিলা সমাজ কাঁধ দিয়েছে, যে নারীশক্তির মহিমা উপলব্ধি করে স্বয়ং নেতাজী মহিলা সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলেছেন – স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সেই দেশে সত্তর বছর ধরে চলা নারী পুরুষের সমানাধিকারের লড়াইয়ে এই কুঠারাঘাত মেনে নেবো না। সরকার হিসেবে জননেতা হিসেবে সমাজে নারীর সুরক্ষার নামে সংরক্ষণ বরদাস্ত করবো না। সবিনয়ে বলতে চাই, নারী কিন্তু আজ ঘরেও কম লাঞ্ছনার শিকার হয় না। তাই বাসভাড়া মকুব নয়, দরকার নারীর প্রতি পুরুষের মনোভাবের পরিবর্তন। সম্ভব হলে সেটা করুন। না হলে ছেড়ে দিন। ঘরে বাইরে দৈনন্দিন লড়াইটা নারীকে নারীর মতো করেই লড়তে দিন। বিকাশ ভট্টাচার্যের মতো নেতা যদি বলেন ‘আমি তো গরুর মাংস খাই’, তাহলে ভোটযুদ্ধে তাঁর জামানত জব্দ হতে বাকি থাকে মাত্র। আর গরুর কুঁজে সোনা ফলানো নেতা ড্যাঙডেঙিয়ে লোকসভায় নির্বাচিত হন। আসলে একথা তো ঠিক যে, নির্ভীক সাহসী মানুষ যদি নেতৃত্বই দিতে না পারেন, লাভ কি? যে সমস্যা ডিরোজিওপন্থী শিক্ষিত ছাত্র সমাজের ছিলো না। তারা অনায়াসে ব্রাহ্মণদের গায়ে বিভিন্ন জন্তুর হাড়কে গরুর হাড় দাবি করে ছুঁড়ে মারতে পেরেছিলেন। 

আজ যখন এই লকডাউনে রামনবমী উপলক্ষ্যে এবং আরো কিছু ধর্মীয় জমায়েত সম্পর্কে টিভিতে অনুষ্ঠান দেখতে বসি, সেখানে ডাক্তারবাবুদের বলতে শুনি, লকডাউনের সময়ে দয়া করে ঘরে বসে প্রার্থনা বা ধর্ম পালন করুন, মন্দিরে বা মসজিদে প্রার্থনা করলে যদি ভগবান শোনেন, তাহলে ঘরে বসে প্রার্থনা করলেও ভগবান শুনবেন। ডাক্তারবাবুদের বলি, আপনারা তো সমাজের প্রিভিলেজড্‌ ক্লাশ, এতো ভয় কিংবা বিনয়ের সাথে সত্য গোপন কেন? সর্বহারাদের না হয় হারাবার জন্য শৃঙ্খল রয়েছে, আপনাদের তো হারাবার কিছুই নেই। উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাধু-ভণ্ড, নেতা-ক্যাডার সকলেই জানে, আপনারাই আসল ভগবান। সোজা কথা সোজা করেই বলুন না – একজন কেন, একশোজন মিলে ভগবানকে ডাকলেও উনি শুনবেন না। আটদিন ধরে মন্দিরের মধ্যে গণধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত আট বছরের বাচ্চা মেয়ের ডাকও ঐ মন্দিরে অধিষ্ঠিত ভগবান শোনেননি। কাজেই মন্দিরে মসজিদে অথবা ঘরে, কোথাওই বসে ডাকলে ঈশ্বর শোনেন না। তাই নিজেদের ও অপরের প্রাণ বিপন্ন করতে বাইরে বেরোবেন না। তাও যদি ডাকতে হয়, আত্মসন্তুষ্টির জন্য ঘরে বসে ডাকুন।

হ্যাঁ, কিছু ভাবনা কিছু পরিবর্তন এই দুঃসময়ে গৃহবন্দী থাকা অবস্থাতেই ভাবতে ও করতে হবে। কারণ এ কথা তো ঠিক - ‘একদিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে’। সবাই মিলে দিন বদলের স্বপ্ন দেখার কাজটা এই দুঃসময়েই শুরু করাটা খুবই জরুরি।