Next
Previous
Showing posts with label প্রবন্ধ. Show all posts
0

প্রবন্ধ - সব্যসাচী রায়

Posted in




















২০ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে ২১শ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত ভারত ও বহুজাতিক কর্পোরেশন (এমএনসি)–এর সম্পর্ক মর্মান্তিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। প্রাথমিকত উপনিবেশিক প্রয়োজন দ্বারা পরিচালিত এবং পরবর্তীতে সার্বভৌম অর্থনৈতিক নীতির দ্বারা পরিচালিত, ভারতের বৈশ্বিক পুঁজির সঙ্গে সম্পৃক্ততা কখনো স্বাগত, কখনো সংরক্ষণবাদ, তারপর মুক্তিবাদ এবং সাম্প্রতিককালে সূক্ষ্ম সন্দেহের মধ্যে দোলাচ্ছল করেছে। এই প্রবন্ধে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে তুলনা এবং বৈপরীত্যের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করব—কীভাবে ভারতের এমএনসির প্রতি নীতি গঠিত হয়েছে, সহযোগিতা বা দ্বন্দ্বের কারণগুলি কী ছিল, এবং এর জাতীয় উন্নয়ন ও কর্পোরেট কৌশলের উপর প্রভাব কী কী।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: সাম্রাজ্যবাদী শুরু ও স্বাধীনতার পর সতর্কতা

ব্রিটিশ রাজের সময়ে ভারতের অর্থনীতি বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদের অংশ ছিল। প্রধানত ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় এমএনসিগুলো চাষ, রেল ও খনন শিল্প পরিচালনা করত। কর্পোরেট বিনিয়োগ ছিল বেশিরভাগই শোষণমূলক: লাভ বিদেশে স্থানান্তরিত হত, স্থানীয় অবকাঠামো বা দক্ষতা বিকাশে পুনরায় বিনিয়োগের তুলনায় অনেক বেশি লাভ উত্তোলন হত, যা এক অসম উন্নয়নের চিত্র রেখে গিয়েছিল।

১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর ভারত মিশ্র-অর্থনীতির মডেল গ্রহণ করে। দেশটি আমদানিপূরণ শিল্পায়নের মাধ্যমে স্বনির্ভরতার পথে হাঁটায়। ১৯৫৬ সালের শিল্পনীতি প্রস্তাবে “কোর”, “জরুরি” ও “বেসরকারি” খাত নির্ধারণ করা হয়। কোর ও ভারী শিল্প রাষ্ট্রের দায়িত্বে রাখা হয়, বেসরকারি (বহুজাতিকসহ) বিনিয়োগ কঠোর নিয়ন্ত্রণের আওতায় আসে। লাইসেন্স, কোটা ও বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এমএনসির প্রবেশ কঠিন করেছিল। ১৯৬০ এর দশকে ভারতের বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) মোট জিডিপির মাত্র ০.০৪% ছিল, যা বৈদেশিক পুঁজির উপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশের আর্থিক সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার নীতি প্রতিফলিত করেছিল।

সংরক্ষণবাদ বনাম বাস্তববাদ

২০ শতাব্দীর সংরক্ষণবাদ:

লাইসেন্স রাজ: এমএনসিগুলোকে বহু দপ্তর থেকে অনুমতি নিতে হত; দীর্ঘবিচারের কারণ সময়সীমা লংঘিত হতো এবং প্রতি খাতে সর্বোচ্চ ২০% বৈদেশিক মালিকানা সীমা বড় বিনিয়োগকে বিঘ্নিত করেছিল।

ঘরোয়া উদ্যোগের প্রাধান্য: সরকারি ক্রয়নীতি ও প্রকল্পে ঘরোয়া প্রতিষ্ঠানের অগ্রাধিকার প্রযুক্তি স্থানান্তর ও বিশ্ব বাজারে সংযুক্তি বন্ধ করে দেয়।

ফলাফল: স্বনির্ভরতা হালকা ভারী শিল্প গড়ে তুললেও অদক্ষতা, কম উৎপাদনশীলতা ও প্রযুক্তিগত স্থবিরতা বাড়ায়।

উদারীকরণ (১৯৯১ থেকে) ও প্রারম্ভিক ২১শ শতাব্দীর বাস্তববাদ:

অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে ভারত লাইসেন্স রাজ ভেঙে ফেলে, এফডিআই সীমা শিথিল করে এবং টেলিকম, ব্যাংকিং, অটোমোবাইল খাত উন্মুক্ত করে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) ও কর-ছাড় প্রণোদনা দিয়ে রপ্তানিমুখী এমএনসিদের আকৃষ্ট করা হয়—স্যামসাং, হোন্ডা, কোকা-কোলা–এর মতো প্রতিষ্ঠান বড় কারখানা স্থাপন করে। ফলাফলস্বরূপ প্রযুক্তি বিস্তৃতি, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ও পরিষেবা ও উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থান দ্রুত বৃদ্ধি পায়; এফডিআই প্রবাহ ১৯৯০ সালে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০০৮ সালে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও ওপর গিয়ে পৌঁছায়।

তুলনামূলক বিশ্লেষণ: সহযোগিতা ও দ্বন্দ্বের চালক

সম্পৃক্ততার অনুপ্রেরণা:

২০ শতাব্দীতে ভারত রক্ষণশীল ছিল, ক্ষয়িষ্ণু দেশীয় শিল্পকে রক্ষায় এমএনসিদের প্রতিযোগিতা থেকে সংরক্ষণ করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল।

২১ শতাব্দীতে গুরুত্ব পড়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে; ভারতে বিনিয়োগের মাধ্যমে খেলার গ্যাপ পূরণ ও উদ্ভাবন ত্বরান্বিত করা হয়েছে।

নিয়ন্ত্রক কাঠামো:

১৯৯১ পূর্ববর্তী কঠোর নিয়ন্ত্রণ: জটিল লাইসেন্স ও বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা এমএনসিদের উচ্চ প্রবেশব্যয় চাপিয়ে দেয়।

ক্রমাগত উদারীকরণ: উদারীকরণে বৈদেশিক মালিকানা সীমা (অনেক ক্ষেত্রে ১০০% স্বয়ংক্রিয় অনুমোদন) বাড়ানো, ই-ফার্ম পদ্ধতিতে প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও পক্ষপাতহীন বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব:

২০ শতাব্দীতে: সীমিত এমএনসি উপস্থিতিতে প্রযুক্তি গ্রহণ ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে ধীরগতি ছিল; তথাপি ঘরোয়া স্টিল, ঔষধ ও অটোমোবাইল শিল্প গড়ে ওঠে।

২১ শতাব্দীতে: এমএনসি–গুলি পুঁজি, ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও বৈশ্বিক সরবরাহশৃঙ্খল যোগান নিয়ে আসে; তবে জমি অধিগ্রহণ, শ্রমনীতি ও ক্ষুদ্র উদ্যোগের স্থানচ্যুতি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।

রাজনৈতিক ও জনমত:

রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদ: স্বাধীনতার পর ভারত এমএনসিদেরকে সন্দেহের চোখে দেখে, তাঁদের উপনিবেশিক শোষণের সাথে যুক্ত করে।

আধুনিক দ্বৈতমনা: একদিকে যারা এমএনসিদের প্রসারকে সাধুবাদ জানায়, অন্যদিকে কিছুজন লভ্যাংশ প্রত্যাগত, পরিবেশগত ক্ষতি ও সামাজিক অসমতা নিয়ে সমালোচনা করে।

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উভয় পক্ষের কথাবার্তা উসকে দেওয়া হচ্ছে। এনজিও ও কর্মী সংগঠনগুলি এমএনসি প্রকল্পের বৃহৎ জমি অধিগ্রহণে স্থানীয় সম্প্রদায়ের উৎখাত এবং পরিবেশের অবনতি তুলে ধরে ভাইরাল প্রচার করে। বিপণন মণ্ডলী এবং গবেষণা সংস্থাগুলি বলছেন—এই সমালোচনা লক্ষ লক্ষ সরাসরি ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান এবং অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা ও ডিজিটাল সংযোগে এমএনসিদের অবদানের কথা ভুলে যায়। এছাড়া নির্বাচনেও নানা রাজ্যের নীতি এই কর্পোরেট বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা হয়ে উঠেছে—বৃদ্ধি ও ন্যায়ের মধ্যে সূক্ষ্ম সমন্বয়কারী নীতি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট।

একবিংশ শতকে সম্পর্কের পতন না পুনর্বিন্যাস?

সাম্প্রতিক মন্দা ও নীতিগত প্রতিক্রিয়া

নীতিগত অনিশ্চয়তা: ই-কমার্স, তথ্য সংরক্ষণ, ও ডিজিটাল ট্যাক্স সংক্রান্ত হঠাৎ পরিবর্তিত নীতিমালা বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির (এমএনসি) আস্থা টলিয়ে দিয়েছে (যেমন: ফ্ল্যাশ সেল নিষেধাজ্ঞা বা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ভোটাধিকার সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা)।

ভূ-রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস: আমেরিকা-চীন প্রযুক্তি দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে, ভারত এখন বৈশ্বিক বিনিয়োগ আকর্ষণ ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার মাঝে ভারসাম্য রাখতে বাধ্য, যার প্রেক্ষিতে ২০২০ সালে চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধকরণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

এই অনিশ্চিত পরিবেশে বহু বহুজাতিক সংস্থা আপাতত "ঘটনার-মোড়-ঘোরার-অপেক্ষায়-থাকা" মনোভাব নিয়েছে, নীতিগত অবস্থা স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত বড় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখেছে। একাধিক আন্তর্জাতিক সিইও মন্তব্য করেছেন, তথ্য সার্বভৌমত্ব ও ডিজিটাল কর সংক্রান্ত অনির্দিষ্টতা দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের রিটার্ন হিসাবকে কঠিন করে তুলছে, ফলে কর্পোরেট স্তরে ঝুঁকিবিমুখতা বেড়েছে। পাশাপাশি, ভারতের কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতার অভিমুখ বিদেশি সরবরাহ শৃঙ্খল ও নিরাপত্তা নিরীক্ষা আরও কঠোর করেছে, অনুমোদন প্রক্রিয়া মন্থর হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কিছু সংস্থা তাদের অভ্যন্তরীণ পরিচালন কাঠামো পুনর্বিন্যাস করছে, ভারত-কেন্দ্রিক নীতিমালা বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করছে, এবং স্থানীয় অংশীদারিত্ব বাড়িয়ে ভারতের প্রতি প্রতিশ্রুতি দেখাতে চাইছে। এসব অভিযোজনের লক্ষ্য—কর্পোরেট স্বার্থ সংরক্ষণ এবং ভারতের পরিবর্তিত নীতিগত অগ্রাধিকারের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো।

কর্পোরেট প্রতিক্রিয়া

কিছু সংস্থা “চায়না-প্লাস-ওয়ান” কৌশল গ্রহণ করে ভারতে উৎপাদন ও ডেটা সেন্টারে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। অনেকেই নতুন প্রকল্প স্থগিত রেখেছে অথবা আরও স্বচ্ছ নীতিগত পরিবেশের দাবি জানিয়েছে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অনিশ্চয়তা তুলে ধরে। অনেক সংস্থাই এখন তাদের ভারতে উপস্থিতি পুনর্মূল্যায়ন করছে—স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে, ঝুঁকি ও লাভ ভাগ করে নেওয়ার যৌথ উদ্যোগে যাচ্ছে। তারা সম্মতি টিম গঠন করছে, নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে, এবং ভারতে কেন্দ্রিক পরামর্শদাতা বোর্ড তৈরি করছে যাতে নীতিগত পরিবর্তন আগাম আঁচ করা যায়। কেউ কেউ তাদের লক্ষ্য স্থানান্তর করছে টিয়ার-২ ও টিয়ার-৩ শহরের দিকে, যেখানে জমি, শ্রম ও লজিস্টিক তুলনায় স্থিতিশীল হলেও বাজার ছোট। শিল্প সংগঠনগুলিও এক্ষেত্রে সক্রিয়, তারা এক-জানালার অনুমোদন ব্যবস্থা চালুর দাবিতে রাউন্ডটেবিল আলোচনা ও শ্বেতপত্র তৈরি করছে। আশা—হঠাৎ আদেশ নয়, বরং ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে টেকসই ও মসৃণ বৃদ্ধির পথ সুগম হবে।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

ডিজিটাল অর্থনীতি: সফটওয়্যার ও ফিনটেক ক্ষেত্রে ভারতীয় ইউনিকর্নগুলির উত্থান পশ্চিমা কর্পোরেশনদের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পারস্পরিক উদ্ভাবনী সহযোগিতার পথ তৈরি করছে।

নির্বাচিত অংশগ্রহণ: "আত্মনির্ভর ভারত" উদ্যোগ এক ধরনের স্বনির্ভরতার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে, তবে তা সেমিকন্ডাক্টর, পরিকাঠামো এবং নবায়নযোগ্য শক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে MNC-দের স্বাগত জানায়—শর্ত, তারা যেন ঘরোয়া সক্ষমতা গঠনে অবদান রাখে।

এই প্রেক্ষিতে বহু এমএনসি স্থানীয় গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে, ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে দক্ষতা উন্নয়ন চুক্তি করছে, এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে দেশীয় সরবরাহকারীদের শক্তিশালী করছে। তারা “মেক ইন ইন্ডিয়া” গাইডলাইনের আওতায় কারখানা তৈরি করছে, যাতে ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও সরবরাহ শৃঙ্খল স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। রাজ্য সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পও শুরু হচ্ছে, যেখানে প্রকৌশলী ও কারিগরি কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে। চুক্তিতে দেশীয় কনটেন্ট শর্ত জুড়ে দিয়ে এবং ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারে বিনিয়োগ করে, এই সংস্থাগুলি দেখাচ্ছে—ভারতের কৌশলগত খাতে অংশগ্রহণ শুধু লাভজনকই নয়, বরং রূপান্তরমূলক, কারণ তারা দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় লক্ষ্যে সহায়ক টেকসই ইকোসিস্টেম তৈরি করে।

উপসংহার

ভারত ও বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির সম্পর্কের গতি এক শতকের মধ্যে সন্দেহপ্রসূত সংরক্ষণবাদ থেকে উদার মুক্তবাজার এবং বর্তমানে শর্তসাপেক্ষ জটিল সহযোগিতায় পৌঁছেছে। বিশ শতকের প্রথমার্ধে বিদেশি বিনিয়োগের প্রতি অবিশ্বাস ও কঠোর নিয়ন্ত্রণ দেশীয় সংস্থাগুলিকে সুরক্ষা দিলেও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে রুদ্ধ করে রেখেছিল। ১৯৯১ পরবর্তী যুগে উন্মুক্ত নীতিমালা বিদেশি পুঁজির সদ্ব্যবহার ঘটিয়েছে, প্রবৃদ্ধি ঘটিয়েছে, এবং ভারতকে বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত করেছে। তবে সাম্প্রতিক নীতিগত দোলাচল এবং দেশীয় শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে একটি পুনর্বিন্যাস জরুরি হয়ে উঠেছে—একটি ভারসাম্য যেখানে উন্মুক্ততা ও কৌশলগত স্বনির্ভরতা যুগপৎ চলবে। শেষপর্যন্ত, ভারতের অভিজ্ঞতা দেখায়—বহুজাতিকদের সঙ্গে সফল সহযোগিতা শুধু নীতিগত উদারতার উপর নির্ভর করে না, বরং সুসংহত ও পূর্বানুমেয় নীতিমালারও প্রয়োজন, যা বিদেশি বিনিয়োগকে জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যগুলির সঙ্গে সংযুক্ত করতে সক্ষম।


তথ্যসূত্র

Brandl, K., Moore, E., Meyer, C., & Doh, J. (2021). The impact of multinational enterprises on community informal institutions and rural poverty. Journal of International Business Studies. https://doi.org/10.1057/s41267-020-00400-3

Goswami, S. (2019). Land acquisition and involuntary displacement: A study of changing state-society relations. European Researcher. Series A, 10(3), 148–155. https://www.researchgate.net/publication/336382820_Land_Acquisition_and_Involuntary_Displacement_A_Study_of_Changing_State_Society_Relations

JLL India. (2025, February 13). India's warehousing boom: Tier II-III cities drive 100M sq. ft. Retrieved from https://www.jll.co.in/en/newsroom/indias-warehousing-boom-tier-ii-iii-cities-drive-100m-sq-ft

Lane, P. R., & Milesi-Ferretti, G. M. (2011). India's financial globalisation. IMF Working Paper No. 11/7, International Monetary Fund. Retrieved from https://www.elibrary.imf.org/view/journals/001/2011/007/article-A001-en.xml

Palit, A. (2008). India's foreign investment policy: Achievements and inadequacies. Institut Français des Relations Internationales (Ifri). https://www.ifri.org/sites/default/files/migrated_files/documents/atoms/files/av18palitfinal.pdf

Sahoo, P., Nataraj, G., & Dash, R. K. (2014). Foreign Direct Investment in South Asia: Policy, Impact, Determinants and Challenges (26th ed., p. 41). Springer.
0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in



















ঋত্বিক ঘটক একজন প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র পরিচালক। চলচ্চিত্র জগতে পরিচালক, সহকারী পরিচালক ছাড়াও চিত্রনাট্যকার ও অভিনেতা রূপেও কাজ করেছেন তিনি। দেশবিভাজন ট্রিলজি নামে পরিচিত ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’ এবং ‘সুবর্ণরেখা’ এই তিনটি ছবি চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তাঁর সেরা কাজ রূপে বিবেচনা করা হয়। সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেনের সমসাময়িক এবং সমান্তরাল চলচ্চিত্র নির্দেশক হয়েও তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র। ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন, ৫০টির কাছাকাছি প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লিখেছেন। অপরদিকে নাট্য জগতেও নির্দেশক, নাট্যকার এবং অভিনেতা সব রূপে সমান স্বাচ্ছন্দ্যে বিরাজ করেছেন তিনি। শিল্পের নানা মাধ্যমে বারবার ফিরে এসেছে সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশা, চাওয়া পাওয়া, তৎকালীন সমাজে নারীদের অবস্থা, দেশভাগের নির্মমতার খণ্ডচিত্র, প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বামপন্থী প্রতিবাদী ভাবাবেগ। শিল্পের নানা ক্ষেত্রে সাবলীলভাবে বিচরণকারী এই মানুষটিকে তাই ১৯৭০ সালে ভারত সরকার শিল্পকলা বিভাগে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করে।

৪ নভেম্বর ১৯২৫ সালে অবিভক্ত বাংলার ঢাকাতে জন্ম হয় ঋত্বিক ঘটকের। তিনি ও তাঁর যমজ বোন প্রতীতিদেবী ছিলেন বাবা সুরেশচন্দ্র ঘটক ও মা ইন্দুবালা দেবীর নয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। সংস্কৃতের কৃতী ছাত্র সুরেশচন্দ্র পেশাগত জীবনে উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মচারী (ম্যাজিস্ট্রেট) ছিলেন। ঋত্বিকের বড় দাদা মণীশ ঘটক ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক, কল্লোলযুগের সুপরিচিত ঔপন্যাসিক ও কবি ও তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম মুখ, যাঁর কন্যা মহাশ্বেতা দেবী বাংলা সাহিত্যের রত্ন। আবার তাঁর আরেক দাদা আশিষচন্দ্র ঘটকের নাতি পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় এখনকার সময়ের স্বনামধন্য অভিনেতা, চিত্রপরিচালক ও চিত্রনাট্যকার। সক্রিয় বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী সাধনা রায়চৌধুরীর ভাগ্নী সুরমা দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ঋত্বিক ঘটক। তাঁদের তিন সন্তান ঋতবান, সংহিতা ও শুচিস্মিতা ঘটক। চিত্রপরিচালক ঋতবান ‘ঋত্বিক মেমোরিয়াল ট্রাস্টে’র সঙ্গে যুক্ত এবং ঋত্বিকের অসমাপ্ত তথ্যচিত্র ‘রামকিংকর’ সম্পূর্ণ করেছেন ও ‘অসমাপ্ত ঋত্বিক’ নামক একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। পাশাপাশি বাবার প্রথম দিকের কাজ ‘বগলার বঙ্গদর্শন’, ‘রঙের গোলাম’-এর মত ছবি পুনরূদ্ধার করেছেন। তাঁর বড় মেয়ে সংহিতাও তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন।

ঋত্বিকের প্রাথমিক পড়াশোনার সূচনা হয় ময়মনসিংহের মিশন স্কুলে। এরপর দাদা মণীশ ঘটক তাঁকে কলকাতার বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করে দেন। এই সময়েই ঋত্বিকের নাটকে হাতেখড়ি। ঋত্বিকের প্রথম দিকের নাট্য অভিনয় ‘চন্দ্রগুপ্ত।’ (১৯৩৬)। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের এই নাটকে ঋত্বিক চাণক্যের ভূমিকায় অভিনয় করতেন রিচি-রোড, ম্যাডক্স স্কোয়ারে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হলে, রাজশাহী ফিরেও নাটক থেকে সরে যাননি। এরপর ১৯৪২ সালে ঋত্বিক ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাশ করেন। বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে বি.এ. পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি হন। তবে লেখালেখি ও নাট্য চর্চার নেশায় এম.এ.-র পাঠ অসমাপ্তই থেকে যায় তাঁর।

কলকাতায় এসে স্কুলে পড়াশোনার সময় থেকেই প্রেমের কবিতার মধ্যে দিয়ে লেখালেখির সূচনা হয় তাঁর। ১৯৪৭-এ ‘গল্পভারতী’তে তাঁর লেখা প্রথম গল্প ছাপা হয়। এরপর ‘দেশ’ ‘অগ্রণী’ ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর গল্প। ১৯৪৭ সালেই নিজস্ব কাগজ ‘অভিধারা’ প্রকাশ করা শুরু করেন ঋত্বিক। চোখ, কমরেড, গাছ, আকাশগঙ্গা ইত্যাদি তাঁর লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গল্প। বাংলা বিভাজন দুই বাংলার বিক্ষুব্ধ সময়ের চিত্র, প্রেম, সামাজিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল তাঁর লেখার মূল বিষয়। তাঁর কম বয়সের কাঁচা হাতের লেখা পড়ে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় তাঁকে একজন ‘শক্তিমান নবীন লেখক ‘বলে আখ্যা দিয়েছেন।

গল্প লিখতে লিখতে একসময় তাঁর মনে হয় ‘‘গল্পটা inadequate’’। ফলত নাটকের জগতে তাঁর প্রবেশ। প্রথমে রবীন্দ্রনাথের নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে শুরু করেন নাট্যজীবন। এরপর ধীরে ধীরে গণনাট্যের সঙ্গে পরিচয় হয়। ১৯৪৮ সালে ‘বহুরূপী’ ‘নবান্ন’ নাটকের শো করে। শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় তাতেও অভিনয় করলেন ঋত্বিক। এইসময়ে লিখলেন প্রথম নাটক ‘কালো সায়র’। ‘নবান্ন’ নাটকে সাফল্যের পরে ১৯৪৯-এ গণনাট্যের নতুন নাটক ‘ঢেউ’তে বৃদ্ধ কৃষকের ভূমিকায় নিজেই অভিনয় করলেন। ১৯৫১ সালে যুক্ত হন ভারতীয় গণনাট্য মঞ্চের (Indian People’s Theatre Academy-IPTA) সঙ্গে। ১৯৫২ সালে নিজের লেখা ‘দলিল’ নাটকটি নিয়ে তিনি ১৯৫৩ সালে পাড়ি দেন বোম্বেতে–গণনাট্যের কনফারেন্সে। নাটকটির পরিচালক ও প্রধান অভিনেতা ছিলেন ঋত্বিক নিজেই। এই নাটকটি ঐ প্রর্দশনীতে প্রথম হয়। এছাড়া ১৯৫৫-তে তাঁর লেখা ও নির্দেশনাতে ‘সাঁকো’ খুবই প্রশংসা পায়। অভিনেতা ঋত্বিকের পরের নাটক বিজন ভট্টাচার্যের নির্দেশনায় দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ। ‘জাগরণ’-এর জিন্না থেকে ‘বিসর্জন’-এর রঘুপতি, ‘ঢেউ’-এর বৃদ্ধ কৃষক, ‘নীলদর্পণ’-এ তাঁর অভিনয়, তাঁর নির্দেশনা মাতিয়ে তুলেছিল আপামর নাটকপ্রেমী বাঙালিকে।

নাটক করতে করতেই তাঁর মনে হয়, কয়েক হাজার নয়, লক্ষ মানুষের কাছে যেতে হবে। তখন সহ-পরিচালকরূপে নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’ (১৯৫০) এর মাধ্যমে তাঁর চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ। এরপর ‘বেদেনী’ (১৯৫১) চিত্রনাট্যকার রূপে ‘মধুমতী’ ইত্যাদি নানা ছবি করেছেন।

নির্দেশক ঋত্বিকের আটটি পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছবি ছিল — নাগরিক (১৯৫২), অযান্ত্রিক (১৯৫৮), বাড়ী থেকে পালিয়ে (১৯৫৮), মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২) তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩) এবং যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪)। এর মধ্যে সুবর্ণরেখা ১৯৬৫ সালে আর নাগরিক ১৯৭৭ সালে মুক্তি পায়। সাধারণ মানুষ, তাঁদের জীবনের দৈনিক সংগ্রাম, দেশভাগের যন্ত্রণা বারবার ফিরে আসে তাঁর ছবিতে। ছবিকে তিনি শিল্প নয় বরং সমাজের, নিজের ভাবনা, প্রতিবাদ, আবেগ, দাবী প্রকাশ করার মাধ্যম রূপে বিবেচনা করতেন। এছাড়া ইন্দিরা গান্ধী, পুরুলিয়ার ছৌ, ভয়, বিহার, আমার লেনিন ইত্যাদি বিবিধ বিষয় নিয়ে তিনি স্বল্পদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেন।

১৯৬৬ সালে পুণের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গে অধ্যাপক রূপে যুক্ত হন। সেখানে তাঁর সমসাময়িক উল্লেখযোগ্য ছাত্র ছিলেন মণি কৌল (Mani Kaul), সুভাষ ঘাই (Subhas Ghai ), কুমার সাহানি (Kumar Sahani), বিধুবিনোদ চোপড়া (VidhuVinod Chopra), আদূর গোপালকৃষ্ণন (Adoor Gopalakrishnan) প্রমুখরা। কিন্তু সেখানকার শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনেও বেশী দিন টিকে থাকতে পারেনি তাঁর শিল্পী মন। কিন্তু চলচ্চিত্র বিষয়ক তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলি আজও নানা চলচ্চিত্র বিষয়ক ছাত্র ও গবেষকের কাছে মূল্যবান নথি বলে গণ্য।

১৯৬৯ সালে, জীবনের শেষবেলায়, গোবরা মানসিক হাসপাতালেই লিখে ফেলেন ‘সেই মেয়ে’। নিজের নির্দেশনায় সে নাটক অভিনয় করালেন হাসপাতালের রোগী ও কর্মী-চিকিৎসকদের দিয়ে। জীবনে যখনই গল্প লিখতে লিখতে, ছবি করতে করতে অস্থির হয়েছেন নাটকই সেই খরার দিনে তাঁর বক্তব্য প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে। বার বার ভাঙা দেশ, জীবন আর কলোনির গল্প ফিরে এসেছে মঞ্চের সংলাপে। তাঁর বন্ধুরাই বলছেন, ‘হি ওয়াজ নেভার সিনসিয়ার টু দ্য থিয়েটার’, কিন্তু, শেষ পর্যন্ত গণনাট্য আন্দোলনের ইতিহাসে ঋত্বিক এক স্থায়ী আসনের দাবিদার হয়ে রয়ে গেছেন। তাই শোভা সেন তাঁকে যথার্থই বলছেন, ‘নাট্য-আন্দোলনের হোতা বা পুরোহিত!’

চলচ্চিত্রের জন্য সত্যজিৎ রায়ের মতো জীবদ্দশায় বাণিজ্যিক বা আন্তর্জাতিক সাফল্যের মুখ সেভাবে দেখেননি ঋত্বিক ঘটক। ১৯৫৭ সালে ‘মুসাফির’ ছবি তৃতীয় সেরা কাহিনী চিত্র (feature film) হিসেবে জাতীয় পুরস্কার মঞ্চে সার্টিফিকেট অব মেরিট অ্যাওয়ার্ডে (Certificate of Merit Award) ভূষিত হয়। ১৯৫৮-তে হিন্দি ছবি ‘মধুমতী’ ফিল্ম ফেয়ারের জন্য সেরা গল্পরূপে মনোনয়ন পায়। ১৯৭০ সালে ‘হীরের প্রজাপতি’ সেরা শিশু চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় পুরস্কারে প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক লাভ করে। ১৯৭৪-এ ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ছবির গল্প জাতীয় পুরস্কার মঞ্চে রজত কমল পুরস্কার পায়। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর জন্য বাংলাদেশ সিনে জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে সেরা নির্দেশক পুরস্কারে ভূষিত করে। ২০০৭ সালে এই ছবি ‘ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে’র একটি সমালোচক দলের দ্বারা নির্মিত বাংলাদেশের সেরা দশটি চলচ্চিত্রের তালিকায় শীর্ষস্থান লাভ করে। ১৯৯৮ সালে এশীয় পত্রিকা সিনেমায়ারের তৈরী সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রের তালিকাতে ‘সুবর্ণরেখা’ ১১তম স্থান পায়। আন্তর্জাতিক স্তরে এই সাফল্য দেখে তাই তাঁর স্ত্রী সুরমা ঘটক স্মৃতিচারণে আক্ষেপ হয়ে বারবার ফিরে এসেছিল শেষ জীবনে তাঁর বলে যাওয়া কটা কথা — “লক্ষ্মী , টাকাটা তো থাকবে না, কাজটাই থাকবে। তুমি দেখো আমার মৃত্যুর পর সবাই আমাকে বুঝতে পারবে।”

দীর্ঘদিন ব্যাপী হতাশা ও অত্যাধিক মদ্যপানের ফলে ১৯৭৬ সালে ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় ঋত্বিক ঘটকের মৃত্যু হয়। তাঁর কথা তাঁর মৃত্যুর পরে সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। সত্যি ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক।
0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in








দেবযানী অসুরদের গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা। দেবযানীর জীবনের প্রেম পূর্ণতা লাভ করে না। কচ ও দেবযানীর জীবনের ব্যর্থ প্রেমের এক বেদনা বিধূর উপাখ্যান শোনাতে চাই। দেবলোকের আচার্য বৃহস্পতি ছিলেন দেবতাদের পরম পূজনীয়। অন্যদিকে অসুর সম্রাজ্যে পূজনীয় ছিলেন আচার্য শুক্রাচার্য। বৃহস্পতি পুত্র কচ ও শুক্রাচার্যের বিদূষী পরমা সুন্দরী কন্যা দেবযানী। দেবতা ও অসুরের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই থাকতো। দেবতাদের সাথে যুদ্ধে যে সকল দৈত্য নিহত হতেন শুক্রাচার্য তাঁর সঞ্জীবনীমন্ত্রের সাহায্যে তাঁদের জীবনদান করতেন। বৃহস্পতির এই বিদ্যা জানা না থাকার কারণে তিনি নিহত দেবসৈন্যকে জীবিত করতে পারতেন না। এই মন্ত্র জানার জন্য দেবতাদের অনুরোধে বৃহস্পতি তাঁর পুত্র কচকে শুক্রাচার্যের কাছে পাঠান। কচ শুক্রাচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে এক হাজার বৎসর তাঁর গৃহে অতিবাহিত করেন। এই সময় কচ ব্রহ্মচর্যব্রত পালন করে গুরু শুক্রাচার্য এর সেবা করেন।তিনি গুরুকন্যা রূপসী তরুণী দেবযানীর সান্নিধ্যও আসেন। এক সময় দেবযানী কচের প্রতি আকৃষ্ট হন। ঘটনাক্রমে তা ভালোবাসায় পরিণত হয়। দেবযানী কচকে ভালোবেসেই বারবার দৈতদের কবল থেকে তাঁকে বাঁচিয়ে তোলেন তিনি তাঁর বাবা শুক্রাচার্যকে বলে। একসময় দৈত্যরা কচের অভিসন্ধি জানতে পারেন। সেই কারণে, দৈত্যরা কচকে হত্যা করে তাঁর দেহকে খণ্ড খণ্ড করে কুকুরের খাবার হিসাবে ব্যবহার করেন। কিন্তু দেবযানীর অনুরোধে শুক্রাচার্য তাঁকে জীবিত করেন। এরপর দৈত্যরা কচকে দ্বিতীয়বার হত্যা করলেও দেবযানীর অনুরোধে শুক্রাচার্য আবার কচকে জীবিত করেন। তৃতীয়বার দৈত্যরা কচকে হত্যা করে তাঁর দেহ ভস্ম করেন। এরপর উক্ত ভস্ম মদের সাথে মিশিয়ে শুক্রাচার্যকে পান করান। দেবাযানীর পুনঃপুনঃ অনুরোধে তিনি আবার কচকে জীবিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এইবারে শুক্রাচার্য দেখলেন কচ জীবিত হলে তাঁর পেট চিরে বের হবে। তাই তিনি উদরস্থ কচকে প্রথমে সঞ্জীবনী মন্ত্র শেখালেন। এরপর মন্ত্রবলে কচকে জীবিত করলে, কচ শুক্রাচার্যের পেট থেকে বের হন, কিন্তু শুক্রাচার্য মারা যান। এরপর কচ, শুক্রাচার্যকে জীবিত করেন। এরপর আরো পাঁচশত বৎসর শুক্রাচার্যের আশ্রম থেকে কচ স্বর্গে যাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এই সময় শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী তাঁর কাছে প্রেম নিবেদন করেন। কিন্তু কচ গুরু-কন্যা বিবেচনায় দেবযানীকে প্রত্যাখ্যান করেন। সেই সাথে তিনি জানালেন যে তাঁরা দুজনই শুক্রাচার্যের শরীরের অভ্যন্তর হতে জাত, সেই কারণে দেবযানীর সাথে তাঁর সম্পর্ক দাঁড়ায় ভাই-বোন। ক্ষুব্ধ দেবযানী কচকে অভিশাপ দিলেন যে, তিনি যে সঞ্জীবনী বিদ্যা অর্জন করেছেন, তা কার্যকরী হবে না। কচ পাল্টা দেবযানীকে অভিশাপ দিলেন যে, দেবযানীর অন্তরের ইচ্ছা পূরণ হবে না। কোন ব্রাহ্মণ বা ঋষিপুত্র তাঁকে বিবাহ করবেন না। এরপর কচ স্বর্গে চলে যান। ইনি অভিশাপের কারণে নিজে কখনও এই বিদ্যার সুফল পান নি। তবে তিনি যাঁদেরকে এই বিদ্যা শিক্ষা দিয়েছিলেন, তাঁরা ফললাভ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর " বিদায় অভিশাপ" কাব্য নাটকেকচের মুখ দিয়ে অভিশাপের পরিবর্তে আশীর্বাদ জানিয়েছেন। এই বলে
কচ: আমি বর দিনু, দেবী, তুমি সুখী হবে । । ভুলে যাবে সৰ্ব্বগ্লানি বিপুল গৌরবে । রবীন্দ্রনাথে "বিদায় অভিশাপ " তার এই বর বাস্তবে দেবযানীর কপালে জোটেনি।আগের কথায় ফিরে যাওয়া যাক। কচ শেষে দেবযানীর কাছে এসে প্রার্থনা করলেন নিজের দেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে। দেবযানী বিষণ্ণ হলেন। কচকে ডেকে তাকে বিবাহ করতে অনুরোধ করলেন। কচ একথায় বিস্মিত হলেন। কারণ গুরুকন্যা তার কাছে ভগিনীর সমান। দেবযানী বললেন – তোমাকে আমার ভাল লেগেছে। তাছাড়া আমার জন্যই তুমি বার বার মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছো। এখন আমায় এভাবে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত নয়। কচ চিন্তিত হলেন। তিনি দেবযানীকে বোঝাতে চাইলেন। দেবযানী কচকে বললেন
--হায় সখা, এ তো স্বগর্পুরী নয়। পুষ্পে কীটসম হেথা তৃষ্ণা জেগে রয়
মর্মমাঝে, বাঞ্ছা ঘুরে বাঞ্ছিতেরে ঘিরে,
লাঞ্ছিত ভ্রমর যথা বারম্বার ফিরে
মুদ্রিত পদ্মের কাছে। হেথা সুখ গেলে
স্মৃতি একাকিনী বসি দীর্ঘশ্বাস ফেলে
শূন্যগৃহ--হেথায় সুলভ নহে হাসি।
যাও বন্ধু, কী হইবে মিথ্যা কাল নাশি--
উৎকণ্ঠিত দেবগণ।
যেতেছ চলিয়া ?
সকলি সমাপ্ত হল দু কথা বলিয়া?
দশশত বর্ষ পরে এই কি বিদায়? কচ বললেন,আর যাহা আছে তাহা প্রকাশের নয় সখী। বহে যাহা মর্মমাঝে রক্তময় বাহিরে তা কেমনে দেখাব।
দেবযানী--জানি সখে,
তোমার হৃদয় মোর হৃদয়-আলোকে
চকিতে দেখেছি কতবার, শুধু যেন
চক্ষের পলকপাতে; তাই আজি হেন
স্পর্ধা রমণীর। থাকো তবে, থাকো তবে,যেয়ো নাকো । সুখ নাই যশের গৌরবে।
দেবযানীর আঁকুতি ব্যক্ত করলেন--
হেথা বেণুমতীতীরে মোরা দুই জন
অভিনব স্বর্গলোক করিব সৃজন।'
কচ--নহে, নহে দেবযানী।
'দেবযানী প্রশ্ন --নহে? মিথ্যা প্রবঞ্চনা! দেখি নাই আমি মন তব? জান না কি প্রেম অন্তর্যামী?
বিকশিত পুষ্প থাকে পল্লবে বিলীন--
গন্ধ তার লুকাবে কোথায়? কতদিন
যেমনি তুলেছ মুখ, চেয়েছ যেমনি,
যেমনি শুনেছ তুমি মোর কণ্ঠধ্বনি,
অমনি সর্বাঙ্গে তব কম্পিয়াছে হিয়া--
নড়িলে হীরক যথা পড়ে ঠিকরিয়া
আলোক তাহার। সে কি আমি দেখি নাই?
ধরা পড়িয়াছ বন্ধু, বন্দী তুমি তাই
মোর কাছে। এ বন্ধন নারিবে কাটিতে।
ইন্দ্র আর তব ইন্দ্র নহে । কচ-
শুচিস্মিতে,
সহস্র বৎসর ধরি এ দৈত্যপুরীতে
এরি লাগি করেছি সাধনা ?
দেবযানী কচের কথার প্রতিবাদ করে প্রশ্ন করলেন--
বিদ্যারই লাগিয়া শুধু লোকে দুঃখ সহে
এ জগতে? করে নি কি রমণীর লাগি
কোনো নর মহাতপ? পত্নীবর মাগি
করেন নি সম্বরণ তপতীর আশে
প্রখর সূর্যের পানে তাকায়ে আকাশে
অনাহারে কঠোর সাধনা কত? হায়,
বিদ্যাই দুর্লভ শুধু, প্রেম কি হেথায়
এতই সুলভ? সহস্র বৎসর ধরে
সাধনা করেছ তুমি কী ধনের তরে
আপনি জান না তাহা। বিদ্যা এক ধারে,আমি এক ধারে-- কভু মোরে কভু তারে চেয়েছ সোৎসুকে; তব অনিশ্চিত মন
দোঁহারেই করিয়াছে যত্নে আরাধন
সংগোপনে। আজ মোরা দোঁহে এক দিনে আসিয়াছি ধরা দিতে। লহো, সখা, চিনে যারে চাও। বল যদি সরল সাহসে "বিদ্যায় নাহিকো সুখ, নাহি সুখ যশ! দেবযানী কচকে বোঝালেন অতীত বছরগুলোতে উভয়ের নষ্টালজিক প্রেমময় অনুষঙ্গের কথা। বললেন তাঁকে দেবলোকে ফিরে না গিয়ে তাঁকে বিয়ে করে থেকে যেতে।
কচ দেবযানীর অনুরোধ উপেক্ষা করে বললেন –দেবযানী, প্রসন্ন হও, তুমি আমার কাছে গুরুরও অধিক। তোমার যেখানে উৎপত্তি, শুক্রাচার্যের সেই দেহের মধ্যে আমিও বাস করেছি। ধর্মত তুমি আমার ভগিনী। অতএব আর ওরূপ কথা বলো না। তোমাদের গৃহে আমি সুখে বাস করেছি, এখন যাবার অনুমতি দাও, আশীর্বাদ করো, সাবধানে আমার গুরুদেবের সেবা করো।
একথা শুনে দেবযানী ক্রোধিত হলেন। তিনি অভিশাপ দিলেন, নারী হয়ে তিনি বারবার অনুরোধ করলেন কচ তাও কথা রাখলেন না। তাই তার পিতার কাছ থেকে কচ যত বিদ্যা শিখেছেন সব নিষ্ফল হবে। ও বাক্যে কচ ব্যাথিত হলেন। বললেন, বিনা অপরাধে তাকে দেবযানী এত বড় অভিশাপ দিলেন। কামে উত্তেজিত হয়ে তিনি কচকে অভিশাপ দিলেন। কচ ঠিক করলেন তাকেও শাপ নিতে হবে।কচ দেবযানীকে অভিশাপ দিলেন ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ শুক্রের কন্যা হয়ে তাকে ক্ষত্রিয়ের স্ত্রী হতে হবে। দেবয়ানী ও কচের প্রেম পূর্ণতা পেল না।

সূত্র: মহাভারত। উদ্ধৃতি রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপ।
0

প্রবন্ধ - শৌনক ঠাকুর

Posted in



















বর্তমান দেশে বিদেশে যখন কাদামাটির তৈরি স্থাপত্য ভাস্কর্যের উপর বিভিন্ন ধরনের রিসার্চ চলছে তখন আজ থেকে একশো সাত বছর আগে কবিগুরু দেখিয়ে গেছেন কিভাবে মাটিকে কাজে লাগিয়ে শিল্পবোধ ও সৌন্দর্যচেতনার প্রকাশ ঘটানো যায় শান্তিনিকেতনের বাড়িগুলিতে মাটির র স্থাপত্য ভাস্কর্যের সঙ্গে ছিল আভিজাত্যের ছোঁয়া।

ভারতবর্ষের ঐতিহ্য, পল্লী-ভাবনা, পল্লী-সংস্কৃতি, দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তবতা, মৌলিকতা -- এসবের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল শান্তিনিকেতনের এক একটি গৃহ। প্রত্যেকটি গৃহ কিন্ত তার স্বীয় স্বীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।

কোণার্ক

আশ্রমের উত্তর দিক দিয়ে শুরু করি। উত্তর দিকে যে বাড়িটি রয়েছে তার নাম কোণার্ক। ‘কোণার্ক’ শব্দটিকে ভাঙলে পাওয়া যায় ‘কোণ’ ও ‘অর্ক’। ‘কোণ’ শব্দের অর্থ কোণ বা কোণা বা প্রান্ত। আর ‘অর্ক’ হল সূর্য। অতএব, ‘কোণার্ক’ শব্দটির অর্থ হল ‘সূর্যকোণ’। ১৯১৮ সালে শান্তিনিকেতন আশ্রমের উত্তর প্রান্তে এই বাড়ি তৈরীর কাজ শুরু হয়। প্রথমে দু’টি মাটির ঘর তৈরি করা হয়। এর বছর দু’য়েক পরে শুরু হয় এই মাটির বাড়ি পরিমার্জন ও পরিবর্ধন। সালটি ১৯২১-২২। বাড়িটির স্থাপত্য শিল্পের দিক থেকে বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বহন করে ; —-

বাড়ি যে সাধারণ বাড়ি নয় এ কথা বলা বাহুল্য মাত্র। শুধু বাইরে নয় ভিতরেও একটা অভিনবত্ব রয়েছে।

বাড়িটির তল উঁচু প্লিন্থের। এই পিন্থ (Plinth) হল স্থাপত্যের একটি মৌলিক উপাদান। এটি দেখতে প্ল্যাটফর্মের মত । এটি স্তম্ভ ,মূর্তি বা অন্য কোনো কাঠামোর নিচে থাকে।

ঘরগুলোর সামনে বারান্দা রয়েছে। বারান্দাগুলো ঘরের সঙ্গেই অ্যাটাচ।

ঘরের উচ্চতার সঙ্গে তারতম্যের রেখে তৈরি করা হয়েছিল বাড়ির মেঝে।

ঘরের মাঝে রয়েছে ভেন্টিলেশন। এই ভেন্টিলেশনের মাধ্যমে দিনের আলোর প্রবেশের পথটি সহজ ও সুগম হয়েছে।

মূল ঘরের ভিতের উচ্চতা প্রায় দু’ফুটের বেশি।

ইস্পাতের থামের উপর পেটাই টালির ছাদ। বীম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল ইস্পাত।

বারান্দার মেঝের উচ্চতা প্রায় নয় সাড়ে নয় ইঞ্চি।

এই ঘরের সামনেটা কাঁকর মাটি দিয়ে সুবিন্যস্ত ।

বাড়িটির সামনের দিকে শিমূল গাছের আধিক্য ছিল। অবশ্য অন্যান্য গাছও ছিল। তবে তার পরিমাণ কম।

কোনার্ক গৃহস্থাপত্যের দিক থেকে সহজ-সরল এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তায় গঠিত। সার্থক বাসপোযোগী পরিকল্পনার সঙ্গে ছিল সহজ-সরল গৃহবিন্যাস, আলো-বাতাসের উন্মুক্ততা।


উদয়ন

এবার পূর্ব দিকে হাঁটা দিই। উদয়ন কেবলমাত্র একটি ঘর নয় এগুলিকে ঘরের সমষ্টি বলা যেতে পারে। ‘উদয়ন’ একটি সংস্কৃত শব্দ। এর অর্থ হল ভোর বা সূর্যোদয়। এই গৃহের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯১৯-২০ সালে। তবে সমাপ্ত হতে সময় লেগেছিল প্রায় ১৮ বছর অর্থাৎ ১৯৩৮ সাল। বাড়িটি বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বহন করে ; —-

এটি মূলত অনেকগুলো ঘরের সমষ্টি।

বাড়িটি বেশ মজার। এর বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রকম উচ্চতা রয়েছে। যেমন বসার ঘরের এবং শোয়ার ঘরের যে উচ্চতা মাঝের ঘরগুলো উচ্চতা কিন্ত আলাদা। আবার কোন কোন অংশের উচ্চতা প্রায় তিন তলার কাছাকাছি। উচ্চতার তারতম্য হলেও কিন্তু ঘরগুলো কখনই বিশদৃশ্য বা বেমানান নয়।

দোতলায় রয়েছে লম্বা বারান্দা। বারান্দাগুলিতে জয়পুর ঘরানার কংক্রিটের জালির কাজ শোভা বর্ধন করেছে।

বারান্দাগুলোর বৈঠকে মেজাজকে মাথায় রেখে তৈরি।

বারান্দার কাজের সঙ্গে ঘরের কাজের বিস্তর ফারাক। ঘরের দেওয়াল শীতলপাটি ও কাঠের পাল্লা দিয়ে তৈরি।

দেয়াল ও মেঘের সংযোগস্থলটি মুড়ে দেওয়া ছিল।

সিলিংগুলিতে অবশ্য পাতলা কাঠের কারুকার্য ছিল।

কাঠের সিলিং এর ভাবনা গৃহপ্রবেশ নাটকে যতীনের ছিল।

ঘরের সামনে মোরামে ঢাকা উদ্যান।

অবশ্য ঘরের পিছন দিকেও ছিল উদ্যান , গুহাগৃহ , চিত্রভানু এবং জাপানি বাগিচার বিন্যাস ইত্যাদি। বিশিষ্ট লেখক অরুণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় --- ‘শান্তিনিকেতন আশ্রম স্থাপত্য ও রবীন্দ্রনাথ’ নামক প্রবন্ধে বলেছেন,“ সামনের elevation এবং গৃহের পিছনের উদ্যান, গুহাঘর, চিত্রভানু, জাপানি বাগিচার বিন্যাস —- সব মিলেমিশে প্রাচ্য আভিজাত্যের নিদর্শনই বহন করে।”

উদয়ন যেন এক ‘ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্যের’ দৃষ্টান্ত। নানান বৈচিত্র্যে ঋদ্ধ, রূপ-রস-গন্ধের বিন্যাসে শোভিত এই উদয়ন রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য ও আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ ছিল।


শ্যামলী

কবিগুরু তার ৭৫-তম জন্মদিনে (১৯৩৫ সালে) যে বাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন সেই বাড়িটির নাম শ্যামলী। কবি অবশ্য নিজেই লিখেছেন ; —-

“শ্যামলী মাটির বাড়ি, এ আমার শ্যামলী, আমার শেষ আশ্রয়।”

এটি উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত। এ বাড়ির নকশা তৈরি করেছিলেন সুরেন কর। সুরেন কর ছিলেন কবির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং শান্তিনিকেতনের একজন বিখ্যাত স্থপতি। তিনি ১৯২৭ সালে জাভা সফরে গিয়ে বাটিক শিল্প বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেন। এই বাড়িটির স্থাপত্যের দিক থেকে বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বহন করে। এটা মাটির বাড়ি , মাটির ছাদ , মাটির মেঝে।অভিনব পরিকল্পনা করলেন।

এই ঘরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই ঘরে চৌকাঠ বলে কিছু নেই। এমনকি সিড়িও নেই। ঘর এবং পথের তফাৎ বোঝা যাবে না। মানে কবি বলতে চেয়েছেন পথ যেন অবাধে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করবে। ঘরেই পথ আবার পথেই ঘর।

ঘরের চারিদিকে চুন বালির আস্তানা দিয়ে মাটির হাড়ি সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। যাতে বাইরের উত্তাপ ঘরে প্রবেশ করতে না পারে। সকালে ঘর যাতে ঠান্ডা থাকে। দেয়াল তৈরি হয়েছিল উলু-খড় ও মাটি দিয়ে মাটির সঙ্গে গোবর আলকাতরা আর বেনাগাছে টুকরা মিশিয়ে মসলা তৈরি করে দেওয়ালে আলকাতরা দেয়া হয়েছিল। এর ফলে উইপোকার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

পুরু লাল মাটির দেওয়াল। লালমাটির দেশের তীব্র গরম থেকে বাঁচতে এ বাড়ির ছাদটাও মাটির। কবির আমন্ত্রণে এ বাড়িতেই সস্ত্রীক এসেছিলেন গান্ধীজি। কাটিয়েছিলেন গুরুদেবের সঙ্গে বেশকিছুটা সময়। বাড়িটির সামনের অংশ বৌদ্ধ চৈতের আদলে তৈরি হয়েছিল।

ঘরের এক পাশে ছিল জাম , বেল , মাদার , কুরচি। আর অন্যপাশে তেঁতুল , আতা , শিরীষ , ইউক্যালিপটাস। সামনের আঙিনা ছিল গোলঞ্চের বাহার। পিছনের দিকে ছিল কাঁঠাল, আমসহ বিভিন্ন গাছ।

কবি বেলফুল সহ বিভিন্ন ফুলের টব দিয়ে সাজিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল বাতাবি পাতিলেবুর গাছ। লেবু ফুলের গন্ধ কবিগুরুর খুব প্রিয় ছিল।

এই বাড়ির দেওয়ালে হাই রিলিফ কাজ। হাই রিলিফ (High Relief) হল এমন একটি ভাস্কর্য যেখানে খোদাই করা মূর্তি বা নকশার অংশগুলি পটভূমি থেকে প্রায় অর্ধেক বা তার বেশি পরিমাণ খোদাই করা হয়। এর ফলে মূর্তিগুলো প্রায় স্বতন্ত্রভাবে দাঁড়িয়ে থাকার মতো দেখায়।

দরজা দু’পাশে সাঁওতাল ও সাঁওতালি দম্পতির ছবি। (ছবিটি রামকিঙ্কর বেজের আঁকা)

মাটির সার্থক ব্যবহার যে কিভাবে করতে হয় তার প্রমাণ এই শ্যামলী গৃহটি।

শ্যামলী বাড়িটি রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয় ছিল। তিনি কখনও আম গাছে নিচে, কখনও গোলঞ্চ গাছের পাশে, হাজার মৌমাছির গুঞ্জনে রচনা করে গেছেন সাহিত্যের অমর সৃষ্টি। রাণী চন্দ তাই সস্নেহ সুরে বলেন , শ্যামলীর চারদিক ঘিরে সে যেন এক ছোট ছেলের খেলা। ‘শেষ সপ্তক’-এ ‘চুয়াল্লিশ নম্বর’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ---

“আমার শেষবেলাকার ঘরখানি

বানিয়ে রেখে যাব মাটিতে,

তার নাম দেব শ্যামলী।


পুনশ্চ

কবির স্বপ্নের শ্যামলী টানা বর্ষণ আর ঝড়ের দাপটে ভগ্ন প্রায় হয়ে পড়ে। দেওয়ালের কিছু অংশ এবং ছাদের কিছু অংশ ভেঙে যায়। আবার নতুন উদ্যমে শুরু হয় মেরামতির কাজ। নতুন গৃহ নাম রাখা হল পুনশ্চ। শ্যামলীর একটা সংস্করণ পুনশ্চ। শিল্প সংস্কৃতির দিক থেকে এই বাড়িটি বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বহন করে ; —-

এই ভিত ছিল বেশ খানিকটা উঁচু ।

ঘরের সামনে ছিল একটা স্টেপ বাগান।

পূর্ব দিকের বারান্দায় প্রথম সূর্যের কিরণ এসে পড়ত। কবি সেখানে লেখালেখির পাশাপাশি চিত্রকলাতেও মনোনিবেশ করেছিলেন।

আবার রৌদ্র যখন প্রখর হয়েছে তখন তাকে আড়াল করার জন্যেও এর বিপরীত কোণে দুটি জানলার লাগানো হয়েছিল।

ঘরের মধ্যেকার বায়ু চলাচলের সুগম ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

বাড়িতে প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সৌন্দর্য ।

প্রয়োজনের সাথে সৌন্দর্য চেতনার হর-গৌরির মিলন ঘটেছিল।

আসবাবপত্রের দিকে খেয়াল রাখা হয়েছিল।

কাঠের বড় বড় বাক্সগুলিকে একদিকে যেমন স্টোর তেমনি বসার জায়গা সে ব্যবহার করা হয়েছিল

বাড়িটির গঠন শৈলীতে অভিনবত্ব আছে।


উদীচী

কবি রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ বাড়ি ছিল উদীচী । ‘উদীচী’ শব্দের অর্থ হল বৃদ্ধি, সমৃদ্ধি এই বাড়িটির অবস্থান ছিল পূর্ব দিকে। দোতলা বাড়ি। ছোট ছোট ঘর। এটি তৈরি করা হয় ১৯৩৮ সালে।বাড়িটি বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বহন করে ; —-

পূর্ব দিকে অবস্থান হওয়ায় এর নাম ছিল উদীচী।

ছোট ছোট অনেকগুলো ঘর ।

প্রথমে একতলার দিকটা ফাঁকা ছিল শুধুমাত্র কয়েকটি থাম তার ওপরে দোতলার অংশ নিচটা খোলা।

এগুলো ডুপ্লেক্স (Duplex house) বাড়ি বাড়ি গুলি এমন ধরনের আবাসিক ভবন যেখানে একই কাঠামোর মধ্যে দুটি পৃথক বাসস্থানের ব্যবস্থা থাকে প্রতিটি ঘরে নিজস্ব প্রবেশপথ রাখার জায়গা এবং শয়নকক্ষ।

সুন্দর উদ্যান বিন্যাস এবং বাগানের পরিকল্পনা।

ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেকচারের সার্থক প্রয়োগ এটি।

তবে অন্যান্য বাড়িগুলো তুলনায় এ বাড়ির ব্যয় কম।

অজন্তা গুহার অনুকরণে করা হয়েছিল থামগুলি।

দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গাছের অবস্থান ছিল প্রাঙ্গণে।

এই বাড়ির চাতাল বারান্দা সিঁড়ি সবমিলিয়ে ভারতীয় স্থাপত্য শিল্পের উজ্জ্বলতম নিদর্শন।


সাধারণভাবে শিল্পী তার শিল্পসত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটান কখনও শব্দে, কখনও সুরে, কখনও বা রঙে। কিন্ত রবীন্দ্রনাথ শুধু এসবের মধ্যে নিজেকে ধরে রাখলেন না। তিনি প্রমাণ করলেন বাস্তুশিল্প বা স্থাপত্যকলাতেও সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ ঘটানো সম্ভব। শান্তিনিকেতনের এক একটি বাড়ি স্থাপত্যকার রবীন্দ্রনাথের সফলতম ফসল।পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্থাপত্য নির্মাণে তিনি অভিনবত্ব দেখিয়েছেন।আশ্রমের রূপ পরিবেশ সামগ্রিক বাস্তুশিল্পের সাথে পরিবেশবান্ধব এক আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। খেয়ালি-কবি বাড়ি বদল করতে ভালবাসতেন। বলেছিলেন মাটির বাড়ি ‘শ্যামলী’ তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। কিন্ত এগুলিকে বাস্তবায়নের জন্য কবিগুরুকে নানান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে পড়তে হয়েছিল। কিন্ত ভালো কাজেই বাধা আসে। কিন্ত সে বাধা ভালো কাজকে রুদ্ধ করতে পারে না। তাই বাধা এসেছে, সাময়িক সমস্যা সৃষ্টি করেছে আবার সমাধানের পথ বেরিয়ে এসেছে। এভাবেই মানবনির্মিত পরিবেশ এবং প্রকৃতিনির্মিত পরিবেশের সার্থক সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল এই গৃহগুলি। সৌন্দর্যবোধের সাথে সামগ্রিক জীবন বোধের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিল যা এই আশ্রমটিকে এনে দিয়েছিল সজীবতা ও তপোবন-সুলভ মাধুর্যতা।





--------------------------

গ্রন্থঋণ

‘গুরুদেব’ - রানী চন্দ

‘রবীন্দ্রনাথ ও লোক সাহিত্য’ - ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য

‘শান্তিনিকেতন আশ্রম স্থাপত্য ও রবীন্দ্রনাথ’ - অরুনেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।

‘শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রনাথ’ - ডঃ অতসী সরকার

পশ্চিমবঙ্গ রবীন্দ্র সংখ্যা ১৪০৩
0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in

সমরেশ মজুমদার লৌকিক প্রয়াণে তাঁর গল্প-উপন্যাসের বোদ্ধা পাঠকরা দুঃখে ম্রিয়মাণ হবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শাখা গল্প-উপন্যাসে ও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা যেমন — ভ্রমণকাহিনি, গোয়েন্দাকাহিনি, কিশোর উপন্যাসের মতো শাখাগুলোতেও রয়েছে তাঁর উজ্জ্বল স্বাক্ষর। বাংলা সাহিত্যে তিনি যে ঋদ্ধতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন তা কিন্তু বাঙালি সাহিত্য প্রেমিক বোদ্ধা পাঠকের মন থেকে মুছে যাবে না কোন দিনই।

বহুমাত্রিক বর্ণিল প্রতিভার অধিকারী লেখক হিসেবে সমরেশ মজুমদার তাঁর প্রত্যেকটি লেখার বিষয় ভিন্ন, রচনার গতি এবং গল্প বলার ভঙ্গি ও প্রেক্ষাপটের নান্দনিকতা পাঠকদের আন্দলিত করে।

বাংলা কথাসাহিত্যের পাঠকদের সমরেশ মজুমদার তাঁর লেখনির বর্ণিল প্রতিভা দ্বারা প্রবলভাবে টানে।

সমরেশ মজুমদারের দীর্ঘ সাহিত্য কর্মকান্ডের শুরু যে উপন্যাসটি দিয়ে সেটির নামটি দৌড়। উপন্যাসের উৎসর্গে লিখেছিলেন — ‘দৌড় আমার প্রথম উপন্যাস, প্রথম প্রেমে পড়ার মতো’। এ উপন্যাসের শেষটাও মনে রাখার মতো: ‘মেয়েদের চোখের দৃষ্টি মাঝে মাঝে এক হয়ে যায় কি করে! মায়ের, নীরার অথবা এখন এই জিনার? যে চোখ শুধুই বলে — ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো-ঈশ্বর, তবে কেন বুক জ্বলে যায়!’

তিনি তাঁর উপন্যাস ‘দৌড়’ লেখার পর থেকে আর থামেননি। একের পর এক লিখেই চললেন, যা সে সময়ের জনমানসের বিশেষ করে তরুণ সমাজের অস্থিরতার বাস্তব চিত্র।

বাংলা সাহিত্যে তাঁর অমর ট্রিলজি ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ তাঁর অমর সৃষ্টি। অবশ্য এর সঙ্গে ‘মৌষলপর্ব’ যুক্ত করে চতুর্ভুজ হিসেবে আখ্যা দেন অনেকেই।

সাতকাহন, গর্ভধারিণী, অগ্নিরথ, সিংহবাহিনী, এত রক্ত কেন, কলিকাতায় নবকুমার, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান, গঙ্গা, বুনোহাঁস, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা ইত্যাদি তাঁর লেখা সমসাময়িক কালের ঘটনা প্রবাহের উজ্জ্বল সৃষ্টি।

নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাস “কালবেলা”। এর স্রষ্টা হিসেবেই তিনি পাঠকের কাছে অধিক প্রিয়। কালবেলার অমর দুই চরিত্র অনিমেষ ও মাধবীলতা। সমরেশ এই উপন্যাসে দুটি চরিত্র সৃজন করেছেন অভিজ্ঞতার আলোকে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, তার লেখা কালবেলা উপন্যাস তার মাস্টারপিস।

কালবেলা গত শতাব্দীর আটের দশকের শুরুতে প্রথমে কলকাতার একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় ধারাবাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। এই প্রকাশনাকালে তার জনপ্রিয়তার আঁচ টের পাওয়া যায়। সেটা প্রবল তাপ ও চাপ নিয়ে আবির্ভূত হয় যখন বই আকারে প্রকাশিত হয়। কালবেলার যে ত্রিভুজ কিংবা চতুর্ভুজ সেখানে মার্কসবাদী চেতনা মুখ্য হয়ে উঠেছে। পুরো ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির চালচিত্র হাজির রয়েছে। তখন পশ্চিমবঙ্গের ভোটের রাজনীতিতে সবেমাত্র কংগ্রেসকে হটিয়ে সিপিআই (এম) ক্ষমতাসীন হয়েছে। মার্কসবাদ, সমাজতন্ত্র সবই তখন তরুণদের মধ্যে ভীষণভাবে জাগরুক। সমরেশ এই সময়ের কথা বলছেন না ঠিকই। বলছেন আরও একদশক কিংবা তারও আগের কথা। কিন্তু সেসবকে তরুণরা এবং ওই সময়ের অন্যান্য বয়সীরাও দারুণভাবে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।

সমরেশ মজুমদার এর কালবেলা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অনিমেষ ও মাধবীলতা। অনিমেষ ও মাধবীলতা কে ঘিরে এই উপন্যাসটি আবর্তিত।

কালবেলা’র এইসব সুযোগ তাকে আপনার ক্ষেত্রটাকে বিকশিত হয়ে ওঠার সুবিধা দেয়। এ বাংলা, ও বাংলা দুই জায়গাতেই অনিমেষ ও মাধবীলতার ভেতর দিয়ে তরুণরা তো বটেই অন্যবয়সীরাও যেন আদর্শিক একটা জায়গা খুঁজে পায়। প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির ঘেরাটোপের বাইরে গিয়ে এই আদর্শ তাদের কাছে গুরুত্বও পায়। যে কারণে কালবেলা’র চরিত্রদ্বয় ফিকশন বা কল্প জগতের মানুষ হয়েও বাস্তবের মানুষের উপর প্রভাবিত করে।

পাঠকপ্রিয়তার তুঙ্গস্পর্শী এক উপন্যাস। রাজনীতিতে অনিমেষের কঠিনভাবে জড়িয়ে পড়া, আদর্শের সঙ্গে বাস্তবতার বিপুল ফারাক উপলব্ধিজনিত হতাশা এবং তারপর তার জীবনের এক উজ্জ্বল উদ্ধার, যার নাম মাধবীলতা। মাধবীলতা যেন তার জীবনের ধ্রুবতারা; ঝড়, ঝঞ্ঝা, সমস্ত প্রতিকুলতার মধ্যে যে অনিমেষকে স্থিতধী করে রাখে। কালবেলা আমাদের জানায়, বিপ্লব ও প্রেম পরস্পরবিরোধী হতেই হবে এমন কথা নেই, পরম বিশ্বাসে একে অন্যের হাতে হাত ধরেও তারা চলতে পারে। কালবেলার পাঠকরা কি কখনও ভুলতে পারবেন সেই উক্তি: বিপ্লবের আরেক নাম মাধবীলতা!

তাঁর লেখা পড়ে মনে হয়, মার্কস, লেনিন, মাওয়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত নকশালিস্টদের সে সময়ের কর্মকান্ডকে কাছ থেকে দেখে অভিজ্ঞতার আলোকেই রচনা করেন কালবেলা। শুধু এতটুকু জানা আছে যারা অনিমেষ এবং মাধবীলতা হয়ে উঠতে চেয়েছিল, হয়েওছিলেন তারা শেষাবধি কিন্তু সেটাকে কনটিনিউ করলেন না, ব্যতিক্রম আছে কি না জানা নেই। অনিমেষ-মাধবীলতারা শেষাবধি কেন অনিমেষ, মাধবীলতা থাকেননি, তার কারণ জীবনের দৌড় সেটাকে সমর্থন করে না। সমরেশ মজুমদাররা জীবনের রেখায় কালবেলার পরিভ্রমণকে সমাপ্তি দেন না। বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার-উপন্যাসের ফারাক যেন জীবনের গদ্যকেই প্রস্ফুটিত করে।

সমরেশ মজুমদার যে শুধু বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী ছিলেন তা নয়, সাহিত্যিক জীবনের শুরু থেকেই মঞ্চ নাটক ও গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি সমরেশ মজুমদারের ঝোঁক ছিল প্রবল। তাঁর প্রথম গল্প ‘অন্যমাত্রা’ লেখা হয়েছিল মঞ্চনাটক হিসেবে এবং এই গল্পটি ১৯৬৭ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় গল্প হিসেবে ছাপা হয় আর সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর লেখকজীবনের জয়যাত্রা। পাঠকের সামনে উপন্যাসিক হিসেবে এই অসামান্য প্রতিভার আবির্ভাব ১৯৭৫ সালে, সে বছরেই সমরেশ মজুমদারের প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ ছাপা হয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকাতেই।

সমরেশ মজুমদারের লেখায় সাবলীলতা, স্পষ্ট ঘটনার বিস্তার ও নিপুণ পরিমিতিবোধ তাঁকে আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যে খ্যাতি এনে দিয়েছে। জন্মসূত্রে তিনি উত্তরবঙ্গের লোক। কিন্তু তাঁর লেখার সঙ্গে একটা আত্মীয়তা অনুভব করে পূর্ববাংলা তথা অধুনা বাংলাদেশের মানুষ। তাঁর রচিত এমন বহু সাহিত্য রয়েছে যার মাধ্যমে সরাসরি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের প্রক্ষাপট এসেছে একান্নবর্তী পরিবারের মতো। তাই একজন সমরেশ মজুমদার পশ্চিমবঙ্গ নাকি বাংলাদেশে বেশি জনপ্রিয়? —এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যে কারও পক্ষে কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াবে। তবে জীবনের শেষ পর্বে এসে তিনি যত সৃষ্টি রচনা করেছেন তার মধ্যে কী উপন্যাস কী ছোটগল্প, তিনি ফিরে গেছেন তাঁর নিজের জন্মভূমিতে, উত্তরবঙ্গে। সমরেশ মজুমদার তাঁর জীবনের শেষ সময়ের রচনাগুলোতে উত্তরবঙ্গের প্রক্ষাপট ফুটে উঠেছে প্রাণবন্ত হয়ে।

উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ — এই ত্রয়ী উপন্যাসের ওপরই বোধ করি দাঁড়িয়ে আছে সমরেশ মজুমদারের পাঠকপ্রিয়তার সৌধ। অনিমেষ আর মাধবীলতা, সমরেশের পাঠকের কাছেই প্রিয় দুটো নাম। অনিমেষ নামে এক মফস্বলী তরুণের উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় পা রাখা, রাজনীতির অগ্নিগর্ভ পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত — সেই সঙ্গে আত্ম-অনুসন্ধানের গল্প উত্তরাধিকার। বাস্তবতা সম্বন্ধে ধারণাহীন সহজসরল এক তরুণের উপলব্ধির উন্মেষকালের গল্প উত্তরাধিকার। তারপর কালবেলা।

সমরেশ মজুমদার তার কালবেলা উপন্যাসের অনিমেষ ও মাধবীলতা এই দুটি চরিত্র যুব মানসের উপর ভর করে।

বাংলা সাহিত্যে আর কোন উপন্যাসের চরিত্র এভাবে পাঠককে উপর ভর করতে পারিনি। আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতেও পারেননি। এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন সমরেশ মজুমদার। তখন যারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, তাদের একটা বড়ো অংশ অনিমেষ ও মাধবীলতার মায়ায় নিজেকে বেঁধে আনন্দিত হয়েছেন। প্রত্যেকের ছদ্মনাম হয়ে উঠেছে ওই দুই নাম। যারা ডয়েরি লিখছেন সেখানে নিজেদেরকে ওই নামে প্রকাশ করছেন। প্রেমিক প্রেমিকা আড়ালে আবডালে নিজেদেরকে সম্বোধিত করছেন অনিমেষ ও মাধবীলতারূপে।

সমরেশ মজুমদারের শৈশব কেটেছে ডুয়ার্সের গয়েরকাটা চা বাগানে, সেখানেই শিক্ষাজীবনের শুরু, এরপর কলকাতায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি টেনে সেখানেই জীবিকার তাগিদে স্থায়ী হয়েছিলেন। তাই চা বাগানের মদেসিয়া সমাজ থেকে কলকাতার নিম্নবিত্ত মানুষেরা বারবার তাঁর কলমে উঠে এসেছেন বাস্তবতার রক্তমাংস নিয়ে।

সমরেশ মজুমদার উত্তরবঙ্গের সন্তান হাওয়ায় নকশালবাড়ি আন্দোলনে অবলোকন করেছিলেন। সেই আলোকেই তিনি সে সময়ের নকশাল বাড়ি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, বিস্তৃতি ও পরিণতিকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল বলে মনে হয়। আর সেই আলোকেই তিনি আমার সৃষ্টি কালবেলা উপন্যাস রচনা করেন এবং এই উপন্যাসের অনিমেষ ও মাধবীলতাকে তুলে ধরেছেন অভিজ্ঞতা আর কল্পনার মিশেলে। সেই অস্থির সময়ের বাস্তব চিত্র তার কালবেলা উপন্যাসে বাস্তবতার নিরিখে উপস্থাপিত হয়েছে।

বহুমাত্রিক বর্ণিল প্রতিভার অধিকারী লেখক হিসেবে সমরেশ মজুমদার তাঁর লেখনি শুধুমাত্র গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি; এ কথার আভাস আগেই দেওয়া হয়েছে।

সাহিত্যে আলোচনা, খ্যাতি, সমালোচনা এসব থাকবেই। কিন্তু একজন দৃঢ় মনস্ক সাহিত্য হওয়ার জন্য যে স্পৃহা দরকার জীবনজুড়ে, তার পুরোটাই দেখিয়ে গেছেন সমরেশ মজুমদার। তাই তিনি একজন সমরেশ মজুমদার হয়েই বেঁচে থাকবেন পাঠকের হৃদয়ে। যারা নিয়মিত বর্তমান সময়ের বাংলা সাহিত্য পড়েন, গবেষণা করেন বা অন্ততপক্ষে খোঁজখবর রাখেন তাদের কাছে এ কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে, সমরেশ মজুমদার বাংলা কথাসাহিত্যের এক উজ্জ্বল প্রতীক, এক দীপ্তিমান নক্ষত্র। পাঠকপ্রিয়তার তুঙ্গস্পর্শী তাঁর লেখা গল্প উপন্যাস ও অন্যান্য লেখায়। বাংলা সাহিত্যঙ্গনে চিরকালের জন্য অমর হয়ে থাকবেন।
0

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in



















প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদী তাঁর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে সমগ্র দেশবাসীকে সতর্ক ও সজাগ থাকতে বলেছেন সাইবার জালিয়াতির বিরুদ্ধে। কোভিড পরবর্তী যুগে সাইবার ক্রাইম মহামারীর ন্যায় অত্যধিক হারে বেড়ে যাওয়ায় জনগণ ভীত, সন্ত্রস্ত। একেকটা দিন যায় আর যারা তখনও ‘টার্গেট’ হয়নি শ্বাস ফেলে। যারা আক্রান্ত তারা প্রায় সর্বস্বান্ত।

সব সময়েই সমাজে ভাল ও মন্দ দু ধরনের মানুষ থাকে, একদল যখন কিছু ভাল কাজ করে অন্যদল তার বিপরীতে তাকে হেনস্থা করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হাত ধরাধরি করে যখনই কোন নতুন আবিষ্কার বা পুরনোকে উন্নত করেছে তখনই অন্য এক গোষ্ঠী তাকেই সম্বল করে মানুষের ক্ষতি সাধনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তা পারমাণবিক ‘ফিউশন’ বা একীকরণ হোক অথবা ডিজিটাল দুনিয়ায় প্রবেশের মত অত্যাধুনিক ব্যবস্থা। পারমাণবিক একীকরণ মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করার আগেই তৈরি হয়ে গেল মানব বিধ্বংসী পারমাণবিক বোম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার পরীক্ষাও করা হোল, বিনা দোষে মারা গেল দেড় থেকে আড়াই লক্ষ লোক, চিরকালের মত পঙ্গু হয়ে গেল আরও বেশি এবং পরবর্তী প্রজন্ম তাদের শরীরে সেই বিষ বহন করতে লাগল।

বৈদ্যুতিক থেকে বৈদ্যুতিন দুনিয়ায় প্রবেশ করে এসে গেল কমপিউটার। কায়িক শ্রম লাঘব করে শুরু হোল নতুন এক শ্রমজীবন, কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং পেশার অধিকারী ব্যক্তি, আদতে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। এই শ্রমে ঘাম ঝরে না কিন্তু ঘুম কাড়ে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা পরিবার ও সমাজ জীবন ধাক্কা খাচ্ছে। অতিরিক্ত শ্রমে ক্লান্ত যুব সমাজকে ক্লান্তি দূর করতে নানা ভোগ্যপণ্য ও উৎকট বিনোদনে মজিয়ে দিচ্ছে। হাতের মুঠোফোনে বিরামহীন হরেক বিনোদন, শ্লীল অশ্লীলে ভেদাভেদ ঘুচে যাচ্ছে বয়সের ভেদাভেদ না মেনেই। আর্থিক বৈষম্যের শিকার সমাজ, একদলের হাতে অর্থ অফুরন্ত অন্যদের বাড়ন্ত। বাড়ছে দ্বেষ হিংসা ঘৃণা পরিবার থেকে সমাজে, বৃহত্তর সমাজে। স্বার্থান্বেষী রাজনীতিক এই সুযোগে জাগিয়ে তুলছে মানুষের মধ্যে সন্দেহ আর অবিশ্বাসের বীজ একাধিক প্রক্রিয়ায়, এমনকি পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কেও। শহরের এই ব্যধি অচিরেই ছড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত গ্রাম্য জীবনে। সারা পৃথিবী এক অস্থির অবস্থায় রয়েছে। এরই মধ্যে প্রযুক্তি নিয়ে এল ডিজিটাল পদ্ধতিতে মানুষের পরিচয় নথিভুক্ত করার ব্যবস্থা। ডিজিটাল পরিচয় পত্র অনেক সুবিধেজনক ও সুরক্ষিত, ব্যক্তিগত পরিচয় এবং আর্থিক লেনদেন।

আধার কার্ডে প্রত্যেকের পরিচয় সরকারের ঘরে সুরক্ষিত বলা হলেও সব জায়গায় সেই সুরক্ষাকবচ খুলে দিতে হচ্ছে। ব্যাঙ্ক থেকে ফোনের সিম, হাসপাতাল থেকে শ্মশান সর্বত্র। ওঁৎ পেতে ছিল দুষ্টু লোকেরা। ঝাঁপিয়ে পড়ল টাকার ঝাঁপি নিয়ে। দুর্নীতির বাজারে বিক্রি হয়ে গেল আমাদের পরিচয়, যেন আমরাই বিক্রি হয়ে গেলাম। আর কিছু গোপন রইল না। “গোপন কথাটি রবে না গোপনে”, রবি ঠাকুরের গান যে এইভাবে সত্যি হয়ে উঠবে এত বছর পরে তা কি উনি জানতেন? আমতা আমতা করে সরকার একসময় স্বীকার করতে বাধ্য হোল কিছু ছাঁকনি দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আরে ছাঁকনিটাই তো ফুটো। সুরক্ষিত রাখার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়াই হয়নি। চোর আটকাতে সদর বন্ধ, খিড়কী দরজা হাট খোলা। আমাদের সব ডেটা এখন ক্রিমিনালদের হাতে। তারা রীতিমতো অফিস চালাচ্ছে। নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ তাদের হাতে, নিত্যনতুন ক্রাইমের ফর্মূলা লিখছে। তাদের মাথায় এমবিএ ডক্টরেট মহাজ্ঞানীজন। শলাপরামর্শ দেওয়ার শিক্ষক আছে। আছে মনস্তাত্বিকও। তাদের পরিচালনা করছে কিছু মাফিয়া যাদের সঙ্গে রাজনীতিকদের যোগাযোগ রয়েছে। বিশাল ব্যবসা। একাধিক জায়গায়। ফাঁদ পাতা রয়েছে এ ভুবনে সর্বত্র।

এক দশকেরও আগে আমার জি-মেল সে হ্যাক করেছে বলে এক কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র আত্মীয় জানালো। পড়াকালীন অবস্থায় শিখে নিচ্ছে জালিয়াতির পাঠ। চেকপয়েন্ট গবেষণা অনুসারে সারা বিশ্বে প্রতি বছর আগের বছরের চেয়ে তিরিশ শতাংশ করে সাইবার ক্রাইম লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। গত বছর সাড়ে বারো বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে এবং অনুমান আর চার বছরে চোদ্দ ট্রিলিয়ন ডলার ছোঁবে। এটা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানে আক্রমণের হিসেব। এবছর দ্বিতীয় কোয়ার্টারে গড়ে প্রতি সংস্থায় প্রতি সপ্তাহে ১৬৩৬ বার আক্রমণ হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতি বছর তেরো শতাংশ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতে এবছর প্রথম চার মাসে ৭৪০,০০০ সাইবার ক্রাইম কেস নথিভুক্ত হয়েছে যার মধ্যে ৮৫% অনলাইন আর্থিক জালিয়াতি। এর মধ্যে ১,১৭,২০০ টির হদিস মিলেছে। বিশ্বে এবং এশিয়াতে যথাক্রমে দশম ও ষষ্ঠ স্থানে আছে ভারত। এ বছর সংস্থা এবং ব্যক্তি উভয়েই অনেক বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে। প্রতি এক লাখে ৪৪৬ জন আক্রান্ত। তথ্যপ্রযুক্তি রাজধানী শহর বেঙ্গালুরুতে সব থেকে বেশি ক্রাইম নথিভুক্ত হয়।

খুব প্রচলিত কয়েকটি সাইবার ক্রাইম হোল – অন্যের কমপিউটার বা নেটওয়ার্কে বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়া বা হ্যাকিং, সন্দেহজনক সফটওয়্যার বা ম্যালওয়্যার কমপিউটারে ঢুকিয়ে দেওয়া, পরিচিতি তথ্য চুরি, ইলেকট্রিসিটি ফোন বা জলের বিল নিয়ে মিথ্যে তথ্য দিয়ে টাকা মেরে দেওয়া, ব্যক্তিকে প্রলোভিত করে তথ্য বা টাকা পাঠাতে বলা, চাকরি পাওয়ার নাম করে টাকা হাতানো। কোনরকম ভয় দেখিয়ে যেমন পর্নোগ্রাফি, বেআইনি লটারি, মধুচক্র বা মাদক সংক্রান্ত কোনো চক্রের নাম করে তার সাথে যুক্ত থাকার খবর পুলিশ বা সিবিআই নাম নিয়ে কোনো ব্যক্তিকে ফাঁসানো।

প্রতি ৩৭ সেকেন্ডে একজন আক্রান্ত হচ্ছে ভারতে বলে সমীক্ষায় প্রকাশ। সব থেকে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ষোল থেকে চব্বিশ বছরের ছেলে বা মেয়ে। মধ্যবয়সী থেকে প্রৌঢ় এবং বৃদ্ধদের বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়। তবে পঁচাত্তর বা তার বেশি বয়সের ব্যক্তিরা কম আক্রান্ত হলেও সহজে তাদের কব্জা করে টাকা আদায় করা যায়। প্রবীণদের প্রধান সমস্যা বয়সের জন্য অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে না পারা, সহজেই পাসওয়ার্ড ভুলে যাওয়া বা রক্ষা করা। তারা কোনো কাগজে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের পাসওয়ার্ড তার সাথেই লিখে রাখেন যা সবসময় বিপদের। এছাড়া ফোনে বা হোয়াটস অ্যাপে বা মেইলে এমন কোনো মেসেজ বা ছবি পাঠানো হয় এবং তা সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি বা ডিজিটাল অ্যারেস্টের হুমকি দেওয়া হয় যার ফলে সেই ব্যক্তি সামাজিক অবমাননার সম্মুখীন হতে পারে এমন সংবাদে সহজেই আনমনা বৃদ্ধকে মানসিকভাবে দুর্বল করে তাকে তার থেকে উদ্ধারের নামে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এই ধরনের ঘটনা আজকাল খুব বেশি শোনা যাচ্ছে। গত বছর প্রায় লক্ষাধিক পেনশনপ্রাপক এই ধরনের জালিয়াতির শিকার।

ব্যক্তিগত স্তরে জটিল পাসওয়ার্ড বানানো (এটা প্রবীণদের পক্ষে মনে রাখা মুশকিল) এবং মাঝেমাঝে বদলে ফেলা, সামাজিক শিক্ষা ও সচেতনতা, সফটওয়্যার আপডেট, ফায়ারওয়াল ব্যবহার, ভাইরাস প্রতিরোধ ব্যবস্থা, সমাজমাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি কিছু নিয়ম মেনে চলার কথা বলা হয়। সাইবার অপরাধ মোকাবিলা করার জন্য সরকারিভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে কাজ শুরু হয়েছে এবং পুলিশের প্রতি থানা ও হেড কোয়ার্টারে অপরাধ নথিভুক্ত করার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সব থেকে সুবিধেজনক ব্যক্তিগত স্তরে অচেনা নম্বরে সাড়া না দেওয়া বা ভুল করে ধরলেও যখন বোঝা যাচ্ছে সন্দেহজনক তখন তিরিশ সেকেন্ডের আগেই ফোন কেটে দেওয়া। ফোনের দখল যেন কোনভাবেই অপরাধীর হাতে না চলে যায়।

যতই প্রধানমন্ত্রী বলুন সদা সতর্ক থাকার কথা, মানুষের মন বিশেষত প্রবীণ মন অন্যমনস্ক, বিষাদগ্রস্ত, চিন্তাশীল, ক্লান্ত থাকেই আর সেই দুর্বল মুহূর্তে নিজেকে সচেতন রাখা মুশকিল। সেই সুযোগটাই নেয় সাইবার অপরাধীরা, হাতিয়ে নেয় কষ্টোর্পাজিত লাখ লাখ টাকা। সরকার উপযুক্ত সতর্কতা ও যথাযথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা না নিয়ে সব নাগরিককে তাদের পরিচয় ও গোপন তথ্য সর্বত্রগামী করে দিয়ে বিপদের সামনে ফেলেছে।
4

প্রবন্ধ - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in






পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের জন্ম ৩১ জানুয়ারী ১৯৪৩। সত্তর দশকের একজন প্রধান কবি হিসেবে তিনি পরিচিত। তার লেখা পাঁচটা কাব্যগ্রন্থ, একটা নির্বাচিত কবিতা সংকলন, এছাড়াও রয়ে গেছিল বেশ কিছু অগ্রন্থিত কবিতা, একটা পরিকল্পিত কাব্যগ্রন্থের পান্ডুলিপি। তার মৃত্যুর কয়েক বছর পরে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়, কবির প্রকাশিত, অগ্রন্থিত বা অপ্রকাশিত কবিতাগুলোকে এক মলাটের মধ্যে ধরে রাখার। ২০২২ এর জানুয়ারীতে কাজরী রায়চৌধুরী ও বিতান ভৌমিকের সবিশেষ উৎসাহে, তাদের যৌথ সম্পাদনাতে প্রকাশিত হয় ‘কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়’।
তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ত্ব, যিনি রকে আড্ডা দিচ্ছেন, বন্ধ কারখানার গেটে শ্লোগান দিচ্ছেন, বাচ্চাদের সাথে দোলনায় ঝুলছেন, রাজনীতির জটিল বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছেন, বোহেমিয়ান হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন, কবিতা লিখছেন, নাটকের স্ক্রিপ্ট তৈরী করছেন, গনসংগীতের মহড়ায় নীরব শ্রোতা বা গানে ঠোঁট মেলাচ্ছেন, নিজের বাড়ির ছোট্ট কামরায় বন্ধুদের নিয়ে সাহিত্যের আড্ডা বসাচ্ছেন, সম্পাদনা করছেন উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রিকা। এই হলেন আমাদের পার্থ দা, পার্থ বন্দোপাধ্যায় (বন্দ্যোপাধ্যায়-এর বদলে তিনি নিজে বন্দোপাধ্যায় বানানই লিখতেন)।
প্রসঙ্গত জানাই পার্থ বন্দোপাধ্যায় জীবন কেটেছে কোলকাতার একটা সম্পন্ন অঞ্চলে, হাজরা রোডে। কিছু বামপন্থী গন আন্দোলনের সাথে প্রথম জীবনে যুক্ত ছিলেন। সেই হিসেবেই তিনি একজন বামপন্থী ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিগত জীবনে বেশ কিছুকাল একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। তার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন তারই এক অনুজ বন্ধু, শ্যামল ভট্টাচার্য – ‘পার্থদার রাজনীতি যত না মস্তিষ্কের ততোধিক হৃদয়ের। যত না তাত্ত্বিক গোঁড়ামির, তার চেয়ে বেশী মানবিক উদারতার’ [ সুত্র – ‘রবিশস্য’ পত্রিকা, শরৎ ২০১৫]।
তিনি মূলতঃ কবি হলেও নানা বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন, নাটক লিখেছেন। তার নির্মিত চিত্রনাট্য নিয়ে সিনেমাও তৈরী হয়েছে। জীবনের প্রথম দিকে ‘ফুল ফুটুক’ ও তার পরবর্তী সময়ে যথাক্রমে ‘ম্যানিফেস্টো’ ও ‘পর্বান্তর’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। দেশ জুড়ে রাজনৈতিক বিতর্কের দিনগুলোতে ‘ম্যানিফেস্টো’ একসময়ে খুব উল্লেখযোগ্য একটা পত্রিকা ছিল এবং একে ঘিরেই পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ীতে বসতো বৈঠক, সাহিত্যসভা। সেখানে চলতো সাহিত্যিক আলোচনা ও নানান রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বিতর্ক। পার্থ বন্দোপাধ্যায় সক্রিয়ভাবে একসময়ে যুক্ত ছিলেন শ্রমিকদের বিভিন্ন আন্দোলনে। তিনি গান ও সাংস্কৃতিক গ্রুপ ‘গণবিষাণ’-এরও একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী, নাট্যকার, নির্দেশক, গীতিকার। তার লেখার উপর গনবিষাণ-সংস্থা অন্ততপক্ষে ন’খানা গণসংগীত স্রোতাদের উপহার দিয়েছেন। আর্থিক উপার্জন তার তেমন একটা ছিল না, একান্নবর্তী পরিবারে তিনি ছিলেন বে-রোজগারে বা কম রোজগেরে মানুষ। পরবর্তী সময়ে বিয়ে করেন রত্না বন্দোপাধ্যায়কে। তাদের একমাত্র পুত্র সন্তান প্রাঙ্গণ। জীবনের শেষ দিকে এসে পার্থ বন্দোপাধ্যায় নিজেকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলেন। বড় একা হয়ে গিয়েছিলেন। তছাড়া পায়ে বাতের জন্যে একা একা চলা ফেরা করতেও অসুবিধে হতো। অবশেষে তিনি প্রয়াত হন ১৭ মার্চ ২০১৫তে।
# # #

পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের জীবন যেমন অধ্যয়ণের বিষয়, তার কবিতার বৈচিত্র্যময়তাও তেমনি আকর্ষনীয়! ‘কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়’ বইটির পরিপ্রেক্ষিতে তার কবিতা নিয়ে সামান্য আলোকপাত করা যাক। কবির ‘তোমার জন্য তোমাদের জন্য’ কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতাটি ‘মহাশ্বেতা’ পাঠকদের জন্যে তুলে ধরছি।
পাতার আগুন জ্বালি
জ্বলে ওঠে বসন্তের দিন
#
হলুদ শিখার নৃত্য মধুবাতাসের বুকে
কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে নিভে যায়
পড়ে থাকে অবশিষ্ট একরাশ শাদাকালো ছাই
#
তোমাকে দেবার মতো কিছু নেই বলে আজ
মহাশ্বেতা, ভষ্ম থেকে প্রতিমা বানাই (মহাশ্বেতা)

এতো কোনো কবিতা নয়, একটা ইতিহাস। বসন্তের বজ্র নির্ঘোষের দিনে কেউ কেউ আগুন জ্বালতে চেয়েছিল। কিন্তু সফল হয় নি সেই চেষ্টা – সত্তর দশকে আগুন জ্বলেছিল বটে, কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে তা নিভে গেছে, পড়ে আছে ছাই এর অবশেষ। অন্য দিকে একসময়ে রাশিয়া, চীন, পূর্ব-ইউরোপ সাম্যবাদের ধ্বজা নিয়ে মানুষের আশা স্বপ্নের প্রতীক ছিল, তাও ততোদিনে ভেঙে পড়েছে। তবুও হাল ছাড়েন না কবি। যে স্বপ্নের প্রতিমাকে গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল, আগুন নিভে গেলেও মহাশ্বেতা সময়ের জন্যে কবি অবশেষে নির্মান করেন তার ভষ্মের প্রতিমা। ‘মহাশ্বেতা’ সেইসব আশা-ভঙ্গুর সময়ের জন্যে নির্মিত একটা কবিতার ভাষ্কর্য! অবশ্যই এটা কবিতা হিসেবেও অনন্য!
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতা লেখা শুরু সত্তরের দশকে। সত্তর দশকের সন্ত্রাস, ৭২ সালের নির্বাচনের পর পশ্চিমবঙ্গের পটপরিবর্তন, ৭৩ সালের খাদ্য-অমিল, ৭৪এর সরকার বিরোধী আন্দোলন, রেল ধর্মঘট, ইন্দিরা গান্ধীর আমলে দেশ জুড়ে এমার্জেন্সী, বন্দীমুক্তি আন্দোলন – এই সব বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তার কবিতায় ফুটে উঠেছে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পোস্টার অথবা কবিতা’ – যার রচনা কাল ১৯৬৮ -১৯৭৯, এখানকার লেখা কবিতাগুলো অনেকটাই সোজা সাপ্টা, বেশীর ভাগ বিবৃতিধর্মী, কোথাও আবেগময় এবং কোথাও কোথাও ছুঁয়ে আছে কাব্যিকতা!
সোজাসাপ্টা উচ্চারণে তিনি লেখেন –
‘পোষ্টার অথবা কবিতা
যে যা খুশি ভেবে নিতে পারো
আমি চাই কথাগুলো আটটা পাঁচটার গেটে অনায়াসে মিশে যাক
তেতে উঠুক অবস্থানের তাবু’। [পোস্টার অথবা কবিতা –১৯৬৮]
এরকমই ভাবেই পার্থ বন্দোপাধ্যায় তার কবিতার মধ্য দিয়ে প্রান্তিক শোষিত সংগ্রামী মানুষদের প্রতি অনুগত থাকতে চান। এই দিনগুলোতে তার বক্তব্যের মধ্যে নেই কোনো কাব্যিক লুকোচুরি, সোজা সাপ্টা কথাতেই তিনি লেখেন –
‘শৃঙ্খলিত মানুষের চলার ছন্দের মধ্যে
জেগে উঠছে যে ঘুম-ভাঙার গান
হে সময়, আমাকে তুমি তার প্রতি অনুগত থাকতে সাহায্য করো
হাতুড়ির ঘা মেরে
প্রতিদিন রক্তের ভেতরে তোমার অবিরাম নির্দেশ পাঠাও।’
(আমাকে নির্দেশ দাও / রচনাকাল – ১৯৭০)।
উপরের লাইনগুলো কতোটা কবিতা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। তবে এই কবিতার মধ্যে সময়ের যথার্থ আবেগ রয়েছে, রয়েছে সমাজ সচেতনতা। এরপরে ১৯৭৩ সাল, দেশ জুড়ে দুর্ভিক্ষ, খাদ্যাভাব। এ সময়ে লেখা কবিতার কথাগুলো পাঠকের হৃদয়কে বিদ্ধ করে, যখন পার্থ বন্দোপাধ্যায় তার দীর্ঘ কবিতাটিতে লেখেন –
‘ভারতবর্ষ, তোমার চোখের মণিতে দুর্ভিক্ষের কালো থাবা
তোমার মাথার উপরে মৃত্যু .........
ভারতবর্ষ, তোমার অহিংসার মন্ত্র আমাকে দীক্ষিত করেনি – আমি ব্রাত্য
আমি কোনো ফতোয়া মানিনি
মৃত্যু আমার বাঁপাশে ডানপাশে
আমার দিকেও নেমে আসছে পুষ্টিহীনতার করাল প্রতিহিংসা
#
হাজার হাজার জেল গারদ তুলে কেউ আমার মুখ বন্ধ করতে পারবে না
...... আমি কাউকে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে তুলে নেবার জন্য প্ররোচিত করিনি
-আমি সেই চন্ডাল
প্রত্যেকটা চিতার পাশে জেগে থাকছি
প্রত্যেকটা চিতার পাশে, আগুন আগলে রাখছি ঘৃণায়।’ [ মার্চ ’৭৩]

১৯৭৪ সালে দেশ জোড়া রেল ধর্মঘট, কবি রেল ধর্মঘটের সমর্থনে দাঁড়িয়েছেন, লিখছেন কবিতা, যদিও তার লেখার লাইন অনেক জায়গাতেই শ্লোগানধর্মী! যেমন, উদ্ধৃত অংশের শেষের লাইনগুলো –
‘প্রত্যেকটি ধর্মঘটি রেল-কর্মীর মাথার উপরে ঝুলছে গ্রেপ্তারি-পরোয়ানা
.........
তবু এই প্রতিজ্ঞামুখর সময়
বার বার জ্বলে উঠছে আগুনের অপ্রতিহত ইস্তাহার
যার কিছুই নেই তার কিছু হারাবার ভয় নেই
(রেল ধর্মঘটের আজ চার দিন / রচনাকাল - ১১ই মে ১৯৭৪)

‘বৃষ্টির দিনে কলকাতার এক উপাখ্যান’ দীর্ঘ কবিতাটাতে কবি জলে ভেজা শহরের চিত্র তুলে ধরে ব্যক্ত করেন নিজস্ব ক্ষোভ। আরেকটি দীর্ঘ কবিতা ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক’এ কবি একজন ভিয়েতনামি মানুষের ধারাভাষ্যে সাম্রাজ্যবাদী চীন ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার বিরুদ্ধে উগরে দিয়েছেন তার ক্ষোভ ও ঘৃণা। প্রথম কাব্যগ্রন্থভুক্ত এইসব কবিতাগুলো মূলতঃ শ্লোগান বা বিবৃতিধর্মী; তবুও কবিতার ভেতর দু’চারটে দৃশ্য বা চমকপ্রদ বর্ণনা পাঠককে আকুল করে।
যদিও ‘পোস্টার অথবা কবিতা’ কাব্যগ্রন্থটির কিছু কবিতার উচ্চারণ কাব্যিক কারণে মনকে ছুয়ে যায়, কবিতা সেখানে শ্লোগান নয়। তিনি কবিতাকে লেখেন জীবনকে ছুঁয়ে, কবিতার ভাষা ছুঁয়ে থাকে প্রাচীন লোককথা, কবিতার লাইনগুলো গভীরতায় একটা ভিন্ন মাত্রা পায়। যেমন –
শীতের প্রস্তুতি ছিল গাছে গাছে পাতায় পাতায় ......
যা ছিল না আজও নেই
সে কেবল গরিবের গরম পোশাক ......
দিন যায় রাত্রি আসে
পৌষের আকাশ নিয়ে অভাগী ফুল্লরা গায়
আজো সেই বুক-ভাঙা যন্ত্রণার গান
দঃখীর সম্বল বলতে
জানু ভানু কৃশানু শীতের পরিত্রাণ ...(জানু ভানু কৃশানু / রচনা-১৯৭৪)
এই কবিতায় আসে অভাগী ফুল্লরার কথা। দুঃখী মানুষের সম্বল জানু, অর্থাৎ হাঁটু, যেটা জড়িয়ে সে শীত কাটায়। ভানু অর্থাৎ সূর্য, সেটাই কৃশানু বা রুগ্ন-দেহ বস্ত্রহীন মানুষের শীতের সম্বল। লোককথা এবং শব্দের গূঢ় ব্যবহার এই কবিতাটাকে নান্দনিক করে তোলে।
পার্থ বন্দোপাধ্যায় তার অনেক কবিতাতে নিপুন ছন্দের স্বাক্ষর রেখেছেন। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে বক্তব্যের দিক থেকে মনোগ্রাহী একটা কবিতা, ‘হেলে’র কিছু লাইন।
ভয় পাস নে ভয় পাস নে ছেলে
কেউটে কিংবা গোক্ষুর নয় ও সাপ নেহাত হেলে
কামড়ে দিলে পা
খুব জোরতো দুচার দিনের ঘা
#
আর সাহস করে ছেলে
যদি তুলতে পারিস লাঠি
দেখবি ও সাপ পায়ের কাছে
ঠান্ডা মেরে গুটিয়ে আছে দিব্যি পরিপাটি ... (হেলে)।
এই কবিতাটা, যতদূর মনে পড়ছে, প্রতুল মুখোপাধ্যায় সুর করে নিজেই গেয়েছেন।
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতার বিষয় সাধারণ মানুষ, নিরন্ন মানুষ, ফুটপাথের মানুষ। রাস্তার শিশুদের নিয়ে লেখা কবিতা ‘রাস্তায় যে বড়ো হবে’। এই কবিতার কয়েকটা লাইন –
‘একটি শিশু সোনার থালা’
মিথ্যে কথা – অলীক প্রতিশ্রুতি
তোর চাই নতুন বর্ণমালা
অ-য়ে অন্ন
আ-য়ে আশ্রয় ......
... এ পৃথিবী তোকে যতই বঞ্চিত করুক
তোর হাতেই নতুন পৃথিবী গড়বে
যদি তুই শিখে নিতে পারিস
শ-য়ে শ্রেনি
স-য়ে সংগ্রাম।
এই লাইনগুলোর মধ্যে দেখি কবি তার বিবৃতিধর্মীতা ভেঙে পাঠকদের দিকে ছুড়ে দেন কিছু নতুনতর শ্লোগান, যার আবেদনও অনবদ্য।
কবিতাসমগ্র-র পাতা পালটে আমরা পৌঁছে যাই পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে – ‘কাকেরা আশ্চর্য পাখি’, যার প্রকাশকাল মার্চ ১৯৮৬।
কবির প্রতিবাদী কন্ঠস্বর এখানেও অব্যাহত। একজন সংগ্রামী সচেতন মানুষের দৃষ্টিতে তিনি লেখেন –
‘পায়ের নিচে ফুঁসছে মাটি
মাথার ওপর রক্তমাখা আকাশ
তাকাস, তোরা যাত্রাপথে মাথার ওপর তাকাস।’ (দিন আসছে)
এই পর্বের কবিতাগুলো পড়লে বোঝা যায় পার্থ বন্দোপাধ্যায় তার বাস্তব জীবনে জড়িয়ে আছেন বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে, ভাগ নিয়েছেন মজুরদের নুন্যতম দাবী দাওয়ার প্রশ্নে। তিনি পথ হেঁটেছেন শ্রমিকদের মিছিলে। তিনি ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের সাথে বন্ধ কারখানার গেটে ধর্ণায় বসেছেন।
‘রুগ্ন শিল্পের মজুরদের ধারাবাহিক রুগ্নতার প্যানপ্যানানি ভালো লাগছে না আপনার
জীবন যখন গলানো পিচের মতো ফুটতে থাকে অভাবের কড়াইয়ে
খিদে যখন মৃত্যুর ছায়ার মতো পাক খেতে থাকে তলপেটে
চেনা গন্ধমাখা বৌয়ের শাড়ি চাপা অন্ধকারে হয়ে যায় ফাঁসের দড়ি-
তাতে আপনার কী যায় আসে – আপনি আটতলার বাসিন্দা .....’ (খোলা চিঠি / মাননীয় অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র সমীপেষু)। এই কবিতাটা সে সময়ে বন্ধ-থাকা এ-স্টক কারখানার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা, যে শ্রমিক আন্দোলনের সাথে কবি সরাসরি জড়িয়ে ছিলেন।
কিংবা,
‘কারখানাতে / তালা মানেই / জীবন ফালাফালা / কেউ দিয়েছে গলায় দড়ি / কেউ দিয়েছে / রেল লাইনে গলা / কারখানাতে / তালা মানেই / শাদা থানের শাদা আকাশ / শূন্য ভাতের থালা ...... বন্ধ গেটের / অস্ত্রবিহীন তাঁবুর থেকে / উঠছে নতুন নারা / লোহার জাল / যতই কঠিন হোক / এসমা- ন্যাসা / হোকনা যতই জারি / লোহা গলানো হাতই পারে / ভাঙতে জারিজুরি’। ‘লোহার জাল’ শীর্ষক এই কবিতাতে দেখি কবি বিশ্বাস রাখেন শ্রমিকশ্রেণীর সংঘবদ্ধ সামূহিক শক্তিতে।
‘কারখানা লকআউট
দুমাস ছমাস নয়, পুরো চোদ্দমাস
ছেঁড়াফাটা রঙচটা তাঁবুর ভেতর বাড়ে দীর্ঘ হাহুতাশ ......
তাঁবু আগলে বসে থাকে মহিম-মাসুদ-পরিমল’। (সপ্তমী)
দুর্গা পূজা, সপ্তমীর দিন হিন্দু মুসলমান শ্রমিকেরা বন্ধ কারখানার গেটে ধর্ণা দিয়ে বসে আছে। এই কবিতা তার পক্ষেই লেখা সম্ভব, যেহেতু কবি নিজে শ্রমিক আন্দোলনের সাথে সরাসরি জড়িয়ে আছেন, তাদের মিছিল মিটিং ধর্ণায় ভাগ নিয়েছেন।
এই পর্বের কবিতাগুলো যে শুধু শ্রমিক মজদুর ভাবনা নিয়ে লেখা তা নয়। সাধারণ বিষয় নিয়ে অনেক কবিতা আছে এই গ্রন্থে। যেমন ‘কাকেরা আশ্চর্য পাখি’ বিষয় হিসেবে একটা ব্যতিক্রমী কবিতা, উপেক্ষিত পাখি কাকেদের নিয়ে লেখা কবিতা। ‘আমি-র মুখে’ কবিতাটা ব্যক্তিগত ঘেরাটোপ ভাঙ্গার কবিতা, আত্ম-আহমিকা বিসর্জন দেয়ার আহ্বানের কবিতা। লেকের রাস্তায় রঙচটা শাড়ি, ফাটা কামিজ পরা যুবতীরা তার কবিতার বিষয় হয়ে যায়( তিনটি যুবতী চলে যায়)। ‘প্রচ্ছদপট’ কবিতায় তিনি লেখেন ক্ষয়িষ্ণু বঞ্চনাময় এই সমাজ ও পৃথিবীর কথা –
‘নিরবধি কাল নয়, বিপুলা পৃথিবী নয়
এ মাটির কাছে তুমি চেয়েছিলে পিপাসার জল
এ মাটি দিয়েছে জল – তার চেয়ে ঢের বেশি ঢেলেছে গরল’

তবুও কবি বিশ্বাস করেন সাথীদের সাথে মিলে সংঘবদ্ধ সংগ্রামে। লেখেন এই সুপরিচিত কবিতাটা, যাকে একটা জনপ্রিয় গানেও রূপ দেয়া হয়েছে।
‘শ্লোগান দিতে গিয়েই আমি চিনতে শিখি
নতুন মানুষজন
শ্লোগান দিতে গিয়েই আমি বুঝতে শিখি
কে ভাই – কে দুশমন’ ( শ্লোগান থেকে )।

এরপর ১৯৯১ সালে প্রকাশ পেলো পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের চটি কবিতার বই ‘তোমার জন্য, তোমাদের জন্য’। এখান থেকেই তার লেখার পটপরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। শ্লোগান, আন্দোলন, সমাজ ইত্যাদি বিষয় থাকলেও তার কবিতায় প্রেম বিষয়টা তেমনভাবে উচ্চারিত ছিল না। এই বইএর প্রথম কবিতা ‘তোমাকে’ – তাতে তিনি লিখলেন – ‘ঊর্মিমালা, আমাকেও ডাকো তুমি, ডাকো আজ অন্য কোন নামে’!
কবির নিজের ভেতরে জমিয়ে রাখা প্রেম ভলোবাসার স্মৃতি এতোদিন কবিতায় উহ্য ছিল, জানি না কেন, তার কবিতার বইতে তিনি তেমন ভাবে প্রকাশ করেন নি! এই তৃতীয় বইটাতে দেখলাম, কবি তুলে ধরেছে তার জীবনে প্রেমের স্মৃতি – ‘উনিশ বছর আগে’ কবিতায় –
‘মনে আছে, আমরা ছিলাম মুগ্দ্ধ আমাদের শরীরের ঘ্রাণে ও আস্বাদে
ঊনিশ বছর আগে, এরকমই ঝমঝম সন্ধ্যার ভেতর #
তুমি, আমি, ভালোবাসা ... মেঘ বৃষ্টি ঝড়’।
কিংবা, যে প্রেমের কথা কবি এতোদিন বলেন নি, এবারে তা লিখলেন কবিতায়,
‘তুমি বলেছিলে
এক আকাশ ভালোবাসার নীচে
দুজন মানুষ অকুলান হবে না’ (রাত্রি যায়)।
অথবা, ‘এপ্রিলের মৃত্যু’ কবিতায় নারীকে নিয়ে লিখলেন অসামান্য এই লাইনগুলো –
‘খোলা মাঠে গাছের মতো সাবলীল যে মেয়েটি
একদিন বৃষ্টির দিকে খুলে রেখেছিল শরীর
তাকেও দেখতে পাবে
বিবাহের যৌতুকে সেও পেয়েছে মৃত্যুর সাদা পাতা’ – তাহলে কি কবির পর্যবেক্ষণে বিবাহ-পরবর্তী সময়ে মেয়েটি সুখী নয়? বিবাহ তাকে উপহার দিয়েছে মৃত্যুর সাদা পাতা?
প্রেম ভালোবাসা বিরহ এসব কবিতার পাশাপাশি এই বইতে আছে কয়েকটি অসামান্য কবিতা, যেমন ‘মহাশ্বেতা’ বা ‘আলেয়া’! ‘মহাশ্বেতা’ – কবিতাটার উদ্ধৃতি এই নিবন্ধর প্রথমেই দিয়েছি, ‘আলেয়া’ থেকে তুলে দিচ্ছি তার কবিতার প্রথম তিনটে লাইন –
‘বাতাসের হাতে বেজায় লম্বা দড়ি
ফাঁসজাল হয়ে সমানে টানছে, সামনে টানছে শুধু
কিছুই জানিনা কদ্দুর যাওয়া – নিবিড় তিমির ধূ ধূ’।

কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে বিতান ভৌমিক লিখেছেন, কবির “রাজনৈতিক কর্মীসত্তার সাথে ‘তোমার জন্য তোমাদের জন্য’ কাব্যগ্রন্থে আমরা দেখা পাই এক প্রেমিকের। দরদী মন তার কবিতায় রয়ে গেল। প্রেমিক স্বভাবও তার কবিতায় রয়ে গেল। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মীর উপস্থিতি তুলনায় কমে এল।” [সূত্র – ভূমিকা, কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায় (এখানে আলোচিত বইটি)।]
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘শাদাপাতার দেশ’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৪এ। এই পর্বের কবিতার অভিমুখ কিছুটা আলাদা। প্রেম, জীবন, সমাজ, পরিবেশ অনেক কিছুই রয়েছে – শ্লোগান ও বিবৃতি কমে এসেছে।
এই পর্বের একটা অসামান্য কবিতা, নগরায়নের বিরুদ্ধে, পরিবেশ-ধ্বংসের বিরুদ্ধে –
‘ভীষণ ধারালো জিভে গোঁফ চেটে নিয়ে
বাঘিনিকে স্থির ভাবে বলেছিল বাঘ
-জঙ্গল ফুরিয়ে গেলে লোকালয়ে যাবো
শুয়োর হরিণ যদি না পাই তো ক্ষতি নেই
মানুষের হাড়মাংস খাব।’ (জঙ্গল ফুরিয়ে আসছে)
প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসের বিষয়টা যে কতো মারাত্মক হতে পারে, তা চার লাইনে বাঘের ভয়াবহ ডায়ালগে এখানে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।
‘ভিন্ন জীবন’ কবিতার প্রথম লাইন কাব্যিকতার মাধুর্যে পরিপূর্ণ, - ‘মানব গিয়েছে ডুবে মল্লিকার দুই হাঁটু জলে’ – এই লাইন আমাদের ভাবনাকে আরো বিস্তৃতি দেয়। ‘বাংলার বিবেক / ১৯৯০’ কবি লেখক কবি বুদ্ধিজীবিদের দিকে ছুঁড়ে দেন তীব্র কঠাক্ষ! ‘চাঁদিপুর’ কবিতায় প্রেমের এক তীব্র আর্তি –
‘জোয়ারের অপেক্ষায় ঝাউয়ের ছায়ার নীচে বসে আছি আমরা দুজন
কখন সমুদ্রে যাব শরীরের অসম্ভব আকাঙ্খা জুড়াতে যাব কখন – কখন
মরে যেতে ইচ্ছে করে কোনো দিন জীবনের অতিরিক্ত ভালোবাসা পেলে’।
প্রসঙ্গত বলি, উপরের কবিতাটা কবি লেখেন, বিয়ের পর বউকে নিয়ে যখন তারা চাঁদিপুর ঘুরতে গিয়েছিলেন। [ কবিপত্নী রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ, – ‘রবিশস্য’ পত্রিকা, শরৎ ২০১৫]
এমনি ভাবেই সময় এগিয়ে চলে। চলতে চলতে একসময়ে কি জীবনের রেস্ত সত্যিই ফুরিয়ে আসে, কেন তবে হাতের তালুতে কপাল সুদ্ধু মাথাটা ঢলে পড়বার ভয়, সে কি কোনো মৃত্যুর বিষণ্ণ চিন্তা? ‘শীতগ্রীষ্মের মাঝখানে’ কবিতায় কবি কেন উচ্চারণ করেন – ‘রেস্ত ফুরিয়ে আসছে ইয়ার’।
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘দ্বাদশ আশ্চর্য’ প্রকাশিত হয় ২০০২এ, এর কবিতাগুলোর রচনাকাল ১৯৯৯-২০০২। এটাই কবির শেষ কাব্যগ্রন্থ। যদিও নান্দীমুখ সংসদ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের ‘নির্বাচিত কবিতা’।
যথাক্রমে কবির চতুর্থ ও পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘শাদাপাতার দেশ’ ও ‘দ্বাদশ আশ্চর্য’ সম্পর্কে বিতান ভৌমিকের নিরীক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ – “মৃত্যুচেতনা ও দার্শনিকতার যে উন্মেষ দেখেছিলাম ‘সাদা পাতার দেশ’ কাব্যগ্রন্থে সেই মৃত্যুচেতনা ও দার্শনিকতা ‘দ্বাদশ আশ্চর্য’ কাব্যগ্রন্থে আরও পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে। নিচুতলার মানুষের প্রতি যে দরদ কবির সাথে ছায়ার মতো এতদিন জেগেছিল সেই দরদের ভেতরেও এবার দেখা দিল একধরণের দার্শনিক বোধ।” [ সূত্র – ভূমিকা, কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়]
কবিতাসমগ্র-র পরবর্তী অংশে আছে কবির ‘পরিকল্পিত কাব্যগ্রন্থ’, যার তিনি কোনো নামকরণ করে যান নি।
কবির ‘পরিকল্পিত কাব্যগ্রন্থ’ থেকে একটা পুরো কবিতা তুলে দিচ্ছি, যে লেখায় কবি পার্থ বন্দোপাধ্যায় হয়তো নিজেকেই নিজে মেলে ধরেছেন – ‘কবির স্বভাবে নেই / দুদন্ড সুস্থির হয়ে / চুপচাপ বসা / স্বজনে বাচাল বলে / দুর্জনেরা বলে বোলচাল / কবি ভাবেঃ কেল্লা ফতে / এতদিনে করেছি কামাল / # / গ্রীষ্ম ও বর্ষায় নেই / কবির নিজস্ব কোনো / নিরাপদ ছাতা # / তুচ্ছাতি বিষয় নিয়ে এ সংসারে / কবে আর কার মাথা ব্যথা / # / রোদেই পুড়ুক / আর জলেই ভিজুক / ঋতুর তরঙ্গভঙ্গে / কবির আকাশ তবু / সত্যবদ্ধ খোলা সাদা পাতা’।
এ ছাড়াও রয়েছে পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের বিভিন্ন সময়ে লেখা পুস্তকাকারে অগ্রন্থিত কবিতা। এই অংশগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মণিমাণিক্যের মতো অনেক কবিতা, যা কিনা কবির কাব্যিকতা ও তার ব্যক্তিজীবনকে বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করবে।
জীবনের শেষর দিকের লেখা কবিতাতে দেখি, তার রাজনৈতিক ভাবনার বাঁক – এক্ষুনিই আমাদের এই পৃথিবীটাকে আমূল বদলে ফেলতে হবে - এই জাতীয় রাজনৈতিক তীব্র কর্মিসত্ত্বা তার মধ্যে যা কিছুটা ছিল, তা কালের প্রবাহে অবসিত হয়েছে। যে কাজ কবি পারেন নি, তা সম্পন্ন করার জন্যে তো তার উত্তরসূরীরা রয়েছে। ‘দিন কাটছে’ কবিতাটা পড়লে এই ভাবনার পরিবর্তনটা স্পষ্ট হবে –
‘সামনে উঁচু পাহাড়
ঠিক পেরিয়ে যাব আমি না পারলে আমার ছেলে
তেমন কোনো প্রতিজ্ঞা নেই আর’। (অগ্রন্থিত কবিতা)
‘জেগে থাকি’ কবিতায় খুঁজে পাই একজন জীবনানন্দীয় রোমান্টিক কবিকে – ‘ যতক্ষণ জেগে থাকি / এক পৃথিবীর গন্ধ লেগে থাকে বুকের ভেতর’ (অগ্রন্থিত কবিতা)।
সমস্ত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে একটা অসাধারণ লেখা হিসেবে পাঠকদের নজর কাড়বে ‘সে কাঁদেনি’, পুরো কবিতাটাই তার ‘অগ্রন্থিত কবিতা’ থেকে তুলে দিলাম -
‘অঝোর বৃষ্টির রাত
একাই ভিজেছে আজ পাষাণপ্রতিমা
আমি জানি- আর কেউ সে কথা জানে না।
#
অবিশ্রান্ত ধারাপাত
সারা রাত সে কাঁদেনি – কেঁদেছে আকাশ।’


পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতাতে যে সব বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁজে পাওয়া যায়, সেগুলোকে পরপর লিখলে এরকমটা দাঁড়ায় –
১- কবিতাতে দীর্ঘ বাক্যবন্ধের ব্যবহার।
২- কোথাও কবিতাতে নাটকীয় সংলাপ ধর্মিতা।
৩- কলাবৃত্ত, মিশ্র-কলাবৃত্ত, দলবৃত্ত ইত্যাদি সব ছন্দর ব্যবহারে পারদর্শিতা।
৪- কবিতার মধ্যে চমৎকার নিয়ে আসেন চলতি বা তৎসম শব্দ, দেশজ শব্দ কিংবা প্রাচীন কবিতার উদ্ধৃতি বা লাইন। যেমন – ‘আয়মনকুলির শোকে উথালিপাথালি নদী আজো পাড় ভাঙে’ লাইনে দেশজ শব্দ ‘উথালিপাথালি’র নিপুন ব্যবহার।
৫- কবিতার বিষয় নির্বাচনের বৈচিত্র্য। যেমন –‘কাকেরা আশ্চর্য পাখি’ কবিতাটা, যা কিনা কবির মৌলিক কল্পনা প্রতিভারও একটা দৃষ্টান্ত ।
৬- কবিতার জগতটা বর্ণ, দৃশ্য, গন্ধ-স্পর্শের এক মিশ্রিত জগত। চিত্রধর্মিতা তার কবিতার একটা বৈশিষ্ট্য। তার কবিতা জনহীন বায়বীয় পরিবেশে ভেসে বেড়ায় না।
৭- কবির কবিতার বিষয় মূলত নাগরিক জীবন। তার সাথে মিলে যায় দৈনন্দিন জীবনের খুটিনাটি, মানুষের বেঁচে থাকার কষ্টকর চেষ্টা, মজদুর শ্রমিকের লড়াই, প্রতিবাদ-বিদ্রোহ, মানুষের প্রেম-ভালোবাসা, এমনকি নৈসর্গিক নানা চিত্রমালা।
৮- কবিতার বিভিন্ন জায়গাতে অসামান্য সব চিত্রকল্পের ব্যবহার। যেমন- ‘বাতাসের হাতে বেজায় লম্বা দড়ি’ কিংবা ‘মানব গিয়েছে ডুবে মল্লিকার দুই হাঁটু জলে’ ইত্যাদি সব লাইন।
পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতাচর্চা সম্পর্কে বিশিষ্ট কবি রঞ্জিত গুপ্তর একটা মূল্যায়ন খুব প্রাসঙ্গিক – ‘সত্তরের কাব্য আন্দোলনের প্রথম দিনগুলিতে যে শিল্পহীন প্রচারধর্মীতার একমুখী চর্চা চলেছিল পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের সেদিনের স্বরটি তার দ্বারা ছিল অনেকাংশে আক্রান্ত। তবু কবি তার অন্তর্লীন স্বভাবে ছিলেন এর সম্পূর্ণ বিপরীত। কাব্যিক সুষমারিক্ত তার সেদিনের বিবৃতিধর্মীতার পেছনে আসলে কোন অকবিসুলভ অক্ষমতা ছিল না। বরং তিনি যেন সচেতনভাবেই চেয়েছিলেন প্রচলিত রূপবদ্ধ ভেঙ্গে কবিতার ভিন্নতর ভাষা খুঁজে নিতে।’ [ গ্রন্থসূত্র – কালের মন্দিরা – রঞ্জিত গুপ্ত]।
# # #
কাজরী রায়চৌধুরী ও বিতান ভৌমিক সম্পাদিত ‘কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়’ পড়তে পড়তে এই নিবন্ধটি লিখতে প্ররোচিত হয়েছি। এতোক্ষণ যা লিখলাম, তা বেশীর ভাগই কবির কবিতা নিয়ে আমার প্রতিক্রিয়া, কবির জীবনের দু চারটে কথা। প্রসঙ্গক্রমে জানাই পেশাগত কারণে আমি বহির্বঙ্গে থাকতাম, তবুও পার্থদার সাথে আমার সামান্য কিছু ব্যক্তিগত যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। মনে পড়ে, আমি মধ্যপ্রদেশ থেকে কোলকাতায়, যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সত্যেনদা’র ক্যান্টিনে অপেক্ষা করছি, আমার ক্লাসমেট কবি তমাল ভৌমিকের সাথে দেখা করবো বলে। দেখলাম, কিছুক্ষণ পরে তমাল এলো, তার সাথে পার্থ বন্দোপাধ্যায়! তিনি সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতি মহলে বেশ পরিচিত। আমি তো বিনা নোটিশে পার্থদা’কে দেখে অবাক! জানলাম, পার্থদা আমার সাথে নাকি দেখা করতেই এতোটা পথ পেরিয়ে এসেছেন। এম্নিভাবেই পার্থদা ছিলেন সবারই বন্ধু – তিনি যেমন আমার বন্ধু, তেমনি অনায়াসে সম্ভবতঃ আমার ছেলেরও বন্ধু!
এবার ‘কবিতাসমগ্র’ বইটি সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।
এই বইটি নির্মাণে সম্পাদক-দম্পতি (কাজরী রায়চৌধুরী ও বিতান ভৌমিক) অত্যন্ত সক্রিয়তা দেখিয়েছেন। পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের মৃত্যুর অল্প কয়েকটা বছরের মধ্যেই তার সবগুলো লেখাকে জড়ো করেছেন, তাকে ২৭২ পৃষ্ঠার একটা সুন্দর বইএর আকার দিয়েছেন। হয়তো তাদের সাথে আরো কিছু বন্ধুসাথীরা ছিলেন, যারা পেছনে থেকে এই বিশাল কর্মকান্ডটিকে সম্পন্ন করতে সাহায্য করেছেন, যার সবটা আমি জানি না। তবে এক্ষেত্রে মূল উদ্যোগটি সংকলন সম্পাদক কাজরী ও বিতানেরই। মৃত্যুর পরে প্রায়শঃই কবি লেখকেরা হারিয়ে যায়, পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের মতো কবি ও একজন বিশেষ ব্যক্তির লেখাগুলোকে সংরক্ষিত রাখাটা অবশ্যই সময়ের বিচারে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ – যা সম্পাদকদ্বয় করে দেখিয়েছেন।
‘কবিতাসমগ্র / পার্থ বন্দোপাধ্যায়’ বইটা হাতে নিলেই বোঝা যায়, এটা কোনো দায়সারা গোছের কাজ নয়। অত্যন্ত সুচারুভাবে সম্পাদিত এই কবিতাসমগ্রে রয়েছে গ্রন্থ বা বিষয়ভিত্তিক এক একটা পর্ব, পর্বের প্রথমে প্রত্যেকটি প্রকাশিত গ্রন্থের প্রচ্ছদের ছবি আছে, আর গ্রন্থভিত্তিক সূচি। পরিশিষ্টে আছে গ্রন্থতালিকা, প্রকাশকাল, প্রকাশকের নাম ঠিকানা। পরিশিষ্টে আরো আছে, পরিশ্রম করে তৈরী করা, সমস্ত কবিতাগুলোর বর্ণানুক্রমিক সূচি – যা ভীষণ উপযোগী।
কবিতাসমগ্রটা পরিপূর্ণতা পেয়েছে যে দুটো বিশেষ পর্বের সংযুক্তিকরণে – (১) পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের ‘পরিকল্পিত কাব্যগ্রন্থ’, যা কবি তার জীবিত অবস্থায় প্রকাশের আলোয় আনতে পারেন নি। (২)অন্য পর্বটা পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের ‘অগ্রন্থিত কবিতা’ – যেগুলো পান্ডুলিপি, ডায়েরী বা অন্য কোনো সূত্রে জোগাড় করে গ্রন্থিত করা অবশ্যই কষ্টসাধ্য কাজ। যদিও কবির পরিবারের ও কবিপত্নী রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতা এখানে উল্লেখযোগ্য। তবুও এই মূল্যবান সংকলনটার সম্পাদক হিসেবে কাজরী ও বিতানের নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের প্রতি আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।
যথেষ্ট মোটা সাইজের বই, কাগজের কোয়ালিটি, বাঁধাই, প্রচ্ছদ ইত্যাদি খুবই ভালো। সুন্দর প্রচ্ছদটি এঁকেছে তন্ময় মৃধা। বইটার মূল্য মাত্র চারশো টাকা, বইটার প্রকাশক – অন্যতর পাঠ চর্চা কেন্দ্র, কোলকাতা – ৭০০০৪৭। গ্রন্থটি উৎসর্গীকৃত হয়েছে, কোনো বিশেষ ব্যক্তি নয়, ‘কবিতার অনুরাগী পাঠকদের হাতে’। বইটাতে কবি পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের নিজস্ব হাতে লেখা পান্ডুলিপি, ব্লার্বে তার ছবিসহ সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া আছে।
এই গ্রন্থটি প্রকাশ করার আগে বন্ধুপ্রতিম বিতান ভৌমিক জানিয়েছিল তাদের এই পরিকল্পনার কথা। তার সাথে কথাবার্তার মাধ্যমে কিছুটা অনুমান করতে পারি, সম্পাদকদ্বয় ও তাদের কাছাকাছি থাকা বন্ধুদের কতই না পরিশ্রম ও উদ্যোগ নিতে হয়েছিল পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতাসমগ্রটি প্রকাশ করবার জন্যে। বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, এই গ্রন্থটি কোন বড় প্রকাশনা বা বিগ হাউজ পাবলিশার্সের আর্থিক বা ব্যবসায়িক আনুকুল্যে ছাপা হয় নি।
পরিশেষে আরো যে কথাটা বলতে চাই, কবির কবিতা পড়বার সাথে সাথে পার্থ বন্দোপাধ্যায়কে জানাটাও খুব জরুরী - গ্রন্থটির ‘ভূমিকা’র মধ্যে এই কাজটি খুব সুন্দর ভাবে পাঠকদের জন্যে করে রেখেছেন বিতান ভৌমিক। প্রায় ১৫ পৃষ্ঠা দীর্ঘ ভূমিকা জুড়ে রয়েছে পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতার আলোচনা, বিশ্লেষণ, কবির ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘটনা, সাল-তামামি। এই সুন্দর ভূমিকাটির জন্যে বিতান ভৌমিককে বিশেষভাবে অভিনন্দন জানাই।
সত্তর দশকের কবি পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতাসমগ্রটি বাংলা সাহিত্যে ঐতিহাহিক ভাবে একটা উল্লেখযোগ্য সংযোজন। উপরের আলোচনায় তার কবিতাসমগ্রর একটা পরিচয় দেবার চেষ্টা করেছি। আমার বারবার মনে হয়েছে এই কবির জীবনটাও স্বতন্ত্রভাবে আলোচনার একটা বিষয়। যার মধ্য দিয়ে সত্তরদশক ও তার পরবর্তী সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি ও শ্রমিক আন্দোলনের একটা ছবি আমরা খুঁজে পেতে পারি। আশা করি, ভবিষ্যতে পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের ‘গ্রন্থসমগ্র’ও প্রকাশিত হবে। তাতে তার সমগ্র সাহিত্য ও জীবন নিয়ে আরো বেশী আলোচনা ও চর্চার সুযোগ আমাদের সামনে হাজির হবে, এবং তা হবে সময়েরই প্রয়োজনে।