Next
Previous
Showing posts with label প্রবন্ধ. Show all posts
0

প্রবন্ধ - অনিরুদ্ধ গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in




















বন্দে মাতরম্ – মাতৃবন্দনার এই সুবিখ্যাত স্তবগীতি, যা গত প্রায় দেড়শো বছর ধরে ভারতীয়দের উদ্বুদ্ধ এবং ভাববেগে আন্দোলিত করেছে, তার রচয়িতা যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সে তথ্য সর্বজনবিদিত। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, বন্দে মাতরম-এর সুরস্রষ্টা কে, তবে একটু ভাবতে এবং জানতে হবে।


এক কথায়, বন্দে মাতরম্ শতাধিক বার সুরারোপিত হয়েছে। এবং অনেক সুরকারেরই পরিচয় অজ্ঞাত।


তাহলে প্রশ্ন ওঠে প্রথম কে সেই সুরকার যিনি এই স্তবগাথাকে গানে পর্যবসিত করেন ?


এ কথা সকলেই জানেন যে বন্দে মাতরম্ বঙ্কিমের আনন্দমঠ উপন্যাসে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। আনন্দমঠ বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ১২৮৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যা (মার্চ, ১৮৮০) থেকে শুরু করে ১২৮৯ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা (জুন, ১৮৮২) পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হয়। প্রথম মাসেই বন্দে মাতরম্ প্রকাশ পায়। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় শেষ কিস্তি প্রকাশিত হবার অব্যবহিত পরই ১৮৮২ সালে পুস্তকাকারে আনন্দমঠ প্রকাশিত হয়।


বন্দে মাতরম্ কিন্তু আনন্দমঠে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বেশ কিছু বছর, অন্তত চার-পাঁচ বছর, আগেই রচিত হয়েছিল। কবে এবং কোথায়, তা নিয়ে কিছু মতভেদ ছিল। বহরমপুর, লালগোলা, চুঁচুড়া, বারাসত ইত্যাদি স্থান দাবীদার হলেও, এখন মোটামুটি স্বীকৃত যে ১৮৭৫-৭৬ সালে প্রায় আট মাস তাঁর কাঁটালপাড়ার বাড়ীতে অবস্থান কালে কোন এক সময়ে বঙ্কিম বন্দে মাতরম্ রচনা করেন। চুঁচুড়াবাসী নবজীবন পত্রিকা সম্পাদক অক্ষয়চন্দ্র সরকার তাঁর ‘বঙ্কিম প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে কাঁটালপাড়ায় অবকাশযাপন করার সময়ে বঙ্কিম বন্দে মাতরম্ লিখেছিলেন বলে তিনি শুনেছিলেন, এবং পরে চুঁচুড়ায় অবস্থানের সময়ে বঙ্কিমকে তিনি বন্দে মাতরম্-এর কিছু অদল-বদল করতেও দেখেছেন। ১৮৭৪ সালে কোন একটি শীতের সকালে বন্ধুদের সকাশে আলাপরত বঙ্কিম সহসা, ‘আমি এখন জাতীয় গান রচনা করতে যাচ্ছি’, এই বলে ঘরে ঢুকে বন্দে মাতরম্ লিখে ফেললেন, এমন সব কাহিনি প্রচলিত থাকলেও তাদের পক্ষে জুতসই সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। প্রধাণত গল্প, উপন্যাস, প্রহসনের লেখক বঙ্কিমচন্দ্র কেন বাংলা হরফে অধিকাংশ সংস্কৃত আর মাত্র কিছু বাংলা বাক্য মিশিয়ে এমন একটি গাথা রচনা করলেন, এবং এত বছর তাকে অপ্রকাশিত রাখলেন, সেও বহু আলোচিত বিষয়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশিত (আষাঢ়, ১৩৪৫) আনন্দমঠ-এর যুগ্ম সম্পাদক শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রীসজনীকান্ত দাস তাঁদের ভুমিকায় লিখেছেন, ‘“বন্দে মাতরম্” গান রচনা সম্পর্কে ইতিমধ্যেই বহু কিম্বদন্তী প্রচলিত হইয়াছে। অনেকের ধারণা ইহা ‘আনন্দমঠ’ লেখার পূর্ব্বে রচিত; কেহ কেহ মনে করেন বঙ্কিমচন্দ্র বহরমপুরে ডফিন্ সাহেব কর্তৃক অপমানিত হইয়া প্রতিহিংসাপরবশচিত্তে ইহা রচনা করিয়াছিলেন।‘ অবশ্য গোপালচন্দ্র রায় আবার তাঁর ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ গ্রন্থে মতপ্রকাশ করেছেন, ‘১২৮১ সালের আশ্বিনে বা ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বঙ্কিমচন্দ্র মালদহের ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। পূজার ছুটিতে মালদহ থেকে কাঁটালপাড়ার বাড়িতে এসে বাড়ির দুর্গাপূজা দেখে প্রথমে “আমার দুর্গোৎসব” এবং পরে “বন্দে মাতরম্” রচনা করেছিলেন ... ।‘ এই উক্তিতে সময় নিয়ে ভিন্ন মত থাকলেও, স্থান নিয়ে বিরোধ নেই, এবং রচনার প্রেক্ষাপট ডফিন্ সাহেব নন, দুর্গাপূজা। সে যা হোক, রচনাটি বঙ্কিমচন্দ্র যে সেই সময়ে প্রকাশনায় অসম্মত ছিলেন, তা তাঁরই ভাই পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণায় ব্যক্ত হয়েছে। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত বঙ্কিমপ্রসঙ্গ গ্রন্থে তিনি বিবৃত করেছেন এই ঘটনা: “বন্দেমাতরম্” গীতটি উহার [অর্থাৎ ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের] বহু দিন পূর্ব্বে রচিত হইয়াছিল।—বঙ্গদর্শনে মাঝেমধ্যে দুই এক পাতা matter কম পড়িলে পণ্ডিত মহাশয় [অর্থাৎ ‘বঙ্গদর্শন’-এর কার্যাধ্যক্ষ রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়] আসিয়া সম্পাদককে জানাইতেন, তিনি তাহা ঐদিনেই লিখিয়া দিতেন। —‘বন্দেমাতরম্’ গীতটি রচিত হইবার কিছু দিবস পরে পণ্ডিত মহাশয় আসিয়া জানাইলেন, প্রায় এক পাতা matter কম পড়িয়াছে। সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র বলিলেন, ‘আচ্ছা, আজই পাবে’। এক খানা কাগজ টেবিলে পড়িয়াছিল, পণ্ডিত মহাশয়ের উহার প্রতি নজর পড়িয়াছিল, বোধ হয় উহা পাঠও করিয়াছিলেন, কাগজ খানিতে ‘বন্দেমাতরম্’ গীতটি লেখা ছিল। পণ্ডিত মহাশয় বলিলেন, ‘বিলম্বে কাজ বন্ধ থাকিবে, এই গীতটি লেখা আছে, উহা মন্দ নয় ত—ঐটা দিন না কেন?’ সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র বিরক্ত হইয়া কাগজ খানি টেবিলের দেরাজের মধ্যে রাখিয়া বলিলেন, ‘উহা ভাল কি মন্দ, এখন তুমি বুঝিতে পারিবে না, কিছুকাল পরে উহা বুঝিবে — আমি তখন জীবিত না থাকিবারই সম্ভব, তুমি থাকিতে পার।’” [‘বন্দে মাতরম্ এবং একটি উদ্ধৃতিচিহ্ণ’ – মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় / banglalive.com]


এই মাতৃবন্দনার গাথাকে বঙ্কিম একটি গীত হিসেবেই কল্পনা করেছিলেন, নেহাৎ একটি স্তোত্র হিসেবে নয়। যখন আনন্দমঠে তিনি অন্তর্ভুক্ত করলেন, তখন ভবানন্দ মহেন্দ্রকে এই গান গেয়ে মাতৃপরিচয় বোঝাচ্ছেন। তিনি নিজে সঙ্গীতপ্রেমী ছিলেন, এবং সঙ্গীত শিক্ষাও পেয়েছিলেন, এমন কথিত আছে। কিন্তু মৌলিক সুরস্রষ্টা তিনি ছিলেন না। ছাপার অক্ষরে প্রকাশে আগ্রহী না হলেও বঙ্কিম পরিচিত মহলে বন্দে মাতরম্ পাঠ করতেন, এবং তৎকালীন এক প্রসিদ্ধ সঙ্গীত বিশারদকে দিয়ে তাকে সুরবদ্ধ করতে প্রয়াসী হ’ন। ‘“বন্দে মাতরম্”-এর সুর : উৎস ও বৈচিত্র্য’ গ্রন্থে এর বিবরণে বলা হয়েছে: “... ‘বন্দে মাতরম্’ গানে প্রথম সুরারোপ করেন কে? এ-সম্পর্কে একই তথ্য এবং একই উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন জগদীশ ভট্টাচার্য ও গোপালচন্দ্র রায়। সকলেই জানেন, ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি উৎসর্গ করা হয় বঙ্কিমচন্দ্রের অভিন্নহৃদয় সুহৃদ দীনবন্ধু মিত্রের নামে। দীনবন্ধু মিত্রের পুত্র ললিতচন্দ্র মিত্র তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘বন্দে মাতরম’ রচিত হইবার পরে বঙ্কিমচন্দ্রের গৃহে তদানীন্তন সুকণ্ঠ গায়ক ভাটপাড়ার স্বর্গীয় যদুনাথ ভট্টাচার্য মহাশয় ইহাতে সুরতাল সংযুক্ত করিয়া প্রথম গাহিয়াছিলেন।....”


এই যদুনাথ ভট্টাচার্য আর কেউ নন, বাংলায় যদুভট্ট নামে যিনি স্বনামখ্যাত। বঙ্কিম তাঁর কাছে গানও শিখতেন, এমনও শোনা যায়। সুতরাং ললিতচন্দ্র মিত্রের বয়ান অনুযায়ী যদুভট্টই বন্দে মাতরম্-এর প্রথম সঙ্গীতকার।


দুর্ভাগ্যবশত যদুভট্টের সৃষ্ট সেই বন্দে মাতরম্ কেমন ছিল তা আর আজ জানার উপায় নেই, কারণ এই সৃষ্টিকে তিনি বা অন্য কেউ যদি স্বরলিপিতে রূপান্তরিত করেও থাকেন, তা এখন আর উপলব্দ্ধ নয়। তবে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে যদুভট্টের এই সুরারোপ আনন্দমঠ প্রকাশের অনেক আগেই ঘটে থাকবে। তার কারণ, আনন্দমঠ-এর প্রথম সংস্করণে যে বন্দে মাতরম্ ছাপা হয়েছিল, তার নীচে লেখা হয়েছিল, ‘মল্লার রাগ, কাওয়ালি তাল’। এখন কথা হচ্ছে যে, যদুভট্ট ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার সঙ্গীতজ্ঞ, যে ঘরানায় কাওয়ালি তাল কখনো ব্যবহৃত হয় না। অতএব ধরে নিতে হয়, যে বন্দে মাতরম্ আনন্দমঠে প্রকাশিত হয়, তার সুর যদুভট্ট রচিত সুর থেকে পৃথক।


এই প্রসঙ্গে অক্ষয়চন্দ্র সরকারের একটি লেখার কিছু উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক। সম্ভবত তখনো আনন্দমঠ-এর একটি কল্পরূপই বঙ্কিমচন্দ্রের ধারণায় ছিল, লিখিত আকার নেয়নি। অক্ষয়চন্দ্র লিখেছেন, “যখন আনন্দমঠ সূতিকাগারে, তখন ক্ষেত্রনাথ মুখোপাধ্যায় এখানকার আর একজন ডেপুটি ছিলেন, বঙ্কিমবাবু ত একজন ছিলেন; উভয়ের পাশাপাশি বাসা। সন্ধ্যার পর তিনি আসেন, আমিও যাই। তিনি সুরজ্ঞ,বড় টেবল হারমোনিয়ম্ লইয়া তিনি ‘বন্দে মাতরম্’ গানে মল্লারের সুর বসান । বঙ্কিমবাবুকে সুরের খাতিরে যৎসামান্য অদল বদল করিতে হয়।“


এই সময়কাল ১৮৭৬ সাল নাগাদ হবে, কারণ সেই সময়েই বঙ্কিম হুগলীর ডেপুটি কালেক্টর হয়ে এসে চুঁচুড়ায় বসবাস করতেন। অক্ষয়চন্দ্র এখানে যাঁকে ক্ষেত্রনাথ নামে পরিচয় দিয়েছেন, সেই ‘আর একজন ডেপুটি’র আসল নাম ছিল ক্ষেত্রমোহন। লক্ষ্যনীয়, এখানে মল্লার রাগের উল্লেখ রয়েছে, পরবর্তীতে যা আনন্দমঠ-এ নিবদ্ধ হয়েছে। অবশ্য যদুভট্টও মল্লার রাগ ব্যবহার করে থাকতে পারেন, কিন্তু কাওয়ালি তাল তাঁর ঘরানাসিদ্ধ নয়। এই কারণে একটি মত এই যে ক্ষেত্রমোহন মুখোপাধ্যায়ই বন্দে মাতরম্-এর আদি সুরকার। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সৃষ্ট বন্দে মাতরমকে সঙ্গীতরূপ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সুরকারদের দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাচ্ছেন, আনন্দমঠ রচনার পূর্বেই। এই সব সুরের কিছুই আর পাওয়া যায় না, এটাই আক্ষেপ।


১৮৮২ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশ পাওয়ার পরের বছর ১৮৮৩তে আনন্দমঠ অভিনীত হয় দ্য গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে। কেদার চৌধুরী পরিচালিত নাটকে তৎকালীন বিশিষ্ট সঙ্গীত পরিচালক ও শিল্পী দেবকান্ত বাগচী রাগ তিলক-কামোদে বন্দে মাতরম গেয়েছিলেন, এমন বিবরণ পাওয়া যায়। কথিত আছে স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র এই নাট্যরূপ দেখেছিলেন, কিন্তু আশাহত হয়ে সাহিত্যিক শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের কাছে অত্যন্ত বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন।


আনন্দমঠ বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হবার সময় থেকেই সুধীসমাজে আগ্রহ এবং প্রসংসার তরঙ্গ তুলেছিল। কলকাতার সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রথম পরিবার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ী তার ব্যতিক্রম ছিল না। উপন্যাসের ঐ অপূর্ব বন্দনাগীত যুবক রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করল। তিনি এর আগের যদুভট্ট- বা ক্ষেত্রমোহন-কৃত সুরগুলি শুনেছিলেন কিনা জানা নেই, কিন্তু নিজে মৌলিকভাবে সুরারোপের প্রচেষ্টা করেন, এবং প্রথম দেশ রাগে বন্দে মাতরম সঙ্গীতবদ্ধ করেন, এমনটাই অধিকাংশ ভাষ্যকারের বিবরণে প্রকাশ পেয়েছে।


প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘রবীন্দ্রজীবনী’তে লিখেছেন যে, শোনা যায়, বঙ্কিমচন্দ্রের জীবিতাবস্থায়ই রবীন্দ্রনাথ বন্দে মাতরম্ গানে সুর বসিয়ে তাঁকে শুনিয়েছিলেন। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ নেপাল মজুমদারও তা সমর্থন করেছেন [ভারতে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ, প্রথম খন্ড]। “বন্দে মাতরম – প্রেরণা ও বিতর্ক” প্রবন্ধ সংকলন বইতে ‘বন্দে মাতরম ও রবীন্দ্রনাথ’ নিবন্ধে সন্তোষকুমার দে বঙ্কিম জন্ম শতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের ভাষণের এই রকম উদ্ধৃতি দিয়েছেন: “তাঁর (বঙ্কিমচন্দ্রের) বন্দে মাতরম্ গানে আমিই প্রথম সুর দিয়ে তাঁকে শোনাই। সবটা আমি গান করিনি, যতটা আমি সুর দিয়েছিলাম ততটা তাঁকে শুনিয়েছি। তিনি তাতে খুব প্রসন্ন হয়েছিলেন।“


রবীন্দ্রনাথের এই উদ্ধৃতিকে সত্য মেনে চললে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়।


প্রথমত, তিনি কেন বললেন যে তিনিই প্রথম সুর দিয়েছিলেন ? কারণ স্পষ্ট নয়, তবে খুব সম্ভবত তাঁর পূর্ববর্তী সুরকারদের সুর সম্বন্ধে তিনি অবহিত ছিলেন না। যেহেতু কোন পূর্বতন স্বরলিপি ছিল না, এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয়।


দ্বিতীয়ত, তিনি ‘যতটা সুর’ দিয়েছিলেন, তা কতটা ? এ সম্বন্ধে সকলেই সহমত যে মোট ছয় স্তবকের প্রথম দুটি স্তবকই (বন্দে মাতরম্ ........ সুখদাং বরদাং মাতরম্) রবীন্দ্রনাথ দেশ রাগে সুরবদ্ধ করেন। নেপাল মজুমদারের ভাষ্য অনুযায়ী “রবীন্দ্রনাথ ‘বন্দে মাতরম্’ গানটির প্রথম অংশটি সুরসংযোগ করিয়া বঙ্কিমচন্দ্রকে শুনাইয়াছিলেন। এর বহুকাল পর ১৯৩৭-৩৮ সালে ..... কবি স্বয়ং তাহা স্বীকার করেন।“ সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথের পত্নী জ্ঞনদানন্দিনী, ঠাকুর পরিবারের থেকে প্রকাশিত ছোটদের জন্য ‘বালক’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সেই পত্রিকায় বিভিন্ন বিভাগের একটি ছিল সঙ্গীত-চর্চা সম্বন্ধীয়। রবীন্দ্রনাথের এক ভাগ্নী প্রতিভাসুন্দরী, যিনি ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য উভয় ধারার ধ্রুপদী সঙ্গীতে সুদক্ষ ছিলেন, ১২৯২ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ (অর্থাৎ ১৮৮৬ সালের মে) সংখ্যায় বন্দে মাতরম্-এর ওই প্রথম দুই স্তবকেরই ‘দেশ-কাওয়ালি সুরতালে নিবদ্ধ স্বরলিপি প্রকাশ করেন’ (রবিজীবনী, তৃতীয় খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল)। কিন্তু সেখানে স্বরলিপিকার হিসেবে প্রতিভাসুন্দরীর নাম দেওয়া হলেও সুরকারের নাম প্রকাশ হয়নি। এই জন্য একটি ভ্রান্ত ধারণা এও আছে যে দেশ রাগে নিবদ্ধ এই অংশটির প্রথম সুরকার প্রতিভাসুন্দরী। তবে এই প্রথম বন্দে মাতরম্-এর কোন স্বরলিপি সর্বসমক্ষে এলো। তবে এর ১৪ বছর পর ১৯০০ সালে রবীন্দ্রনাথের অন্য এক ভাগ্নী সরলা দেবী প্রকাশিত ‘শতগান’ বইতে এই অংশটুকুরই দেশ রাগে নিবদ্ধ স্বরলিপি পুন: প্রকাশিত হয়, এবং সেখানে সুরকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ মুদ্রিত স্বীকৃতি পান।


এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে এর চার বছর আগে ১৮৯৬ সালে কলকাতার বিডন স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে গুরুদেব বন্দে মাতরম্ গেয়েছিলেন। প্রশান্তকুমার পাল রবিজীবনী চতুর্থ খণ্ডে লিখেছেন, “.... কংগ্রেস অধিবেশনের সূচনায় রবীন্দ্রনাথ গাইলেন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ গানের প্রথম দুটি কলি, .... সুরটি তাঁর নিজেরই দেওয়া।“ রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ প্রবোধচন্দ্র সেনও এই ঘটনা সম্পর্কে কবির দ্বারা বন্দে মাতরম্-এর প্রথমাংশ গাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। ১৯০৫ বা ১৯০৬ সালে হেমেন্দ্র মোহন বোস-এর টকিং মেশিন সিলিন্ডার রেকর্ডে ধরা রবীন্দ্রনাথের একটি বন্দে মাতরম্-এর রেকর্ডিং পাওয়া যায়, সেও ঐ দুই স্তবকই। অনেক পরে যখন স্বরবিতান সংকলিত হতে লাগল, তখন স্বরবিতান-৪৬এ প্রথম দুই স্তবকেরই স্বরলিপি সংযোজিত হয়।


অর্থাৎ যা কিছু তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়, সবই নির্দেশ করে যে রবীন্দ্রনাথ ঐ প্রথম দুই স্তবকের আগে আর অগ্রসর হননি – সুরকার অথবা গায়ক হিসেবে। এর বহু পরে, ১৯৩৭ সালে যখন জাতীয় কংগ্রেস দেশের জন্য একটি জাতীয় সংগীত নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তাদের একটি প্রতিনিধি দল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন, এবং গবেষকদের মতে, তিনি এই অভিমত দিয়েছিলেন যে, যদি বন্দে মাতরম্ দেশের জাতীয় সংগীত নির্বাচিত হয়, তবে তার প্রথম দুই স্তবকই নেওয়া উচিৎ। এর কারণ ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ আলোচনার অবকাশ এই স্তরে নেই, পরে কিছু তথ্য নিয়ে আলোচনা করা যাবে। স্বাধীনতার পর ১৯৫০ সালে দেশের গণপরিষদ রবীন্দ্রনাথের দেশ রাগে সুরারোপিত বন্দে মাতরম্-এর প্রথম দুই স্তবককেই জাতীয় গানের মর্যাদা দেয়।


তৃতীয় প্রশ্ন হ’ল, রবীন্দ্রনাথ ঠিক কবে এই সুরারোপ করেছিলেন। সঠিক সিদ্ধান্তে আসা মুস্কিল। বঙ্কিমের দেহাবসান হয় ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে। যদি রবীন্দ্রনাথ তাঁকে এই সুর শুনিয়ে থাকেন, তবে তার রচনা এর আগেই হয়েছিল। ১৮৯৬এর কংগ্রেস অধিবেশনে গুরুদেবের বন্দে মাতরম্ গাওয়ার কথা, যা আগেই বলেছি, তা সব ইতিহাসেই নথিবদ্ধ। কিন্তু তারও আগে, ১৮৯০এর কংগ্রেস অধিবেশন, যেটি কলকাতাতেই হয়েছিল, সেখানেও রবীন্দ্রনাথের বন্দে মাতরম্ গাওয়ার একটি বিবরণ আছে, যার উল্লেখ অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। Calcutta Municipal Gazette, Special Issue, 1941-এ এই রিপোর্টে দেখা যায়: “{Tagore) … attends the sixth session of the Indian National Congress in Calcutta (Dec., 1890) under the presidentship of Pherozshah Mehta, when he sings the Bande Mataram on the opening day.” মনে রাখতে হবে, ১৮৮৬ সালেই প্রতিভাসুন্দরী-কৃত স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ১৮৮৬ বা সমসময়ে রবীন্দ্রনাথ দেশ রাগের সুরসংযোগ করে থাকবেন, কারণ তার পরেই স্বরলিপি বা গায়নের উল্লেখ পাওয়া যায়।


এবার আসা যাক বন্দে মাতরম-এর অন্য কিছু সুরসংযোগের কয়েকটির উল্লেখনীয় দৃষ্টান্তে। কংগ্রেসের অধিবেশন ছাড়া সাধারণ জনসমাজে এই গান বহু বছর প্রায় সুপ্তই ছিল। এর পুনরুজ্জীবন ঘটল ১৯০৫এর বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন ঘিরে। সে এক অভাবনীয় জাতিয়তাবাদের ভাবপ্রবনতা উদ্বেল করল বাংলা এবং দেশকে। শুধু গান নয়, বন্দে মাতরম্ এক রাজনৈতিক ধ্বনি হয়ে ছড়িয়ে পড়ল জনসমাজে। সে সময় ‘বন্দে মাতরম্ সম্প্রদায়’ নামে একটি গোষ্ঠি জায়গায় জায়গায় এই গান গেয়ে বেড়াত। তাঁরা সমবেত কণ্ঠে মিশ্র সুরে এই গান গাইতেন। ‘নারায়ণ’, ১৩২২ বৈশাখ সংখ্যায় হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ লিখেছেন: “আজ আমার সেই দিনের কথাই মনে পড়িতেছে — তখন সমগ্র বঙ্গদেশ 'বন্দে মাতরম্' গানে মুখরিত। বন্দে মাতরম্ সম্প্রদায়ের উদাত্ত সুর হইতে আরম্ভ করিয়া বৈষ্ণবের কীর্তনের সুর পর্যন্ত কত সুরে কতজন এই গান গাহিতেছে।“ দক্ষিণাচরণ সেন বন্দে মাতরম্ সম্প্রদায়ের জন্য রাগ খাম্বাজে একটি সুর রচনা করেছিলেন। আবার অন্য আর এক দল, ‘ভবানীপুর সেবক সম্প্রদায়ের’ জন্য রাইচরণ মুখোপাধ্যায় রাগ মল্লারে অন্য একটি সুর বেঁধেছিলেন। মল্লারেই নারায়ণচন্দ্র মুখার্জির গাওয়া একটি সংস্করণও পাওয়া যায়। হিমাংশু দত্ত, অমলা দাস, সরলা দেবী, সতী দেবী, সাহানা দেবী, কনক দাস ইত্যাদি অনেক শিল্পীরা বঙ্গ প্রদেশে এই গান অনেক সুরে পরিবেশন করেছেন।


স্বাধীনতার পূর্বে এবং পরে দেশের অন্য রাজ্যেও বহু সুরকার এবং শিল্পীরা বন্দে মাতরম্-এর সুর নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর এই গানকে বেঁধেছিলেন যে রাগে তার নাম তিনি দিয়েছিলেন বঙ্গীয় কাফি । বিষ্ণু দিগম্বর পালুসকার (কাফি), কেশবরাও ভোলে (দেশকর), বিষ্ণুকান্ত পাগনিশ (সারঙ) ইত্যাদি প্রমুখ শিল্পীরা সুরবৈচিত্র্যে গানটিকে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯২৬ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে মিশ্র খাম্বাবতী রাগে সুরবদ্ধ করে ভি ডি অম্বাইকার নাগপুরে গান্ধীজিকে মুগ্ধ করেছিলেন, পরে বাবাসাহেব আম্বেদকারও এই সুরটিকে জাতীয় সঙ্গীতের জন্য সুপারিশ করেন। সুভাষচন্দ্র বসুর অনুরোধে তিমিরবরণ রাগ দুর্গার ভিত্তিতে কুচকাওয়াজের ঢঙে সঙ্গীতবদ্ধ করেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও পরবর্তী কালে আনন্দমঠ ছায়াছবির জন্য দ্রুত লয়ে এই ধাঁচের একটি সুরারোপ করেছিলেন। দিলীপকুমার রায় একক কণ্ঠে ধ্রুপদ-ধামার ভাবে, এবং এম এস শুভলক্ষীর সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে মিশ্র রাগে গেয়েছেন। শুভলক্ষী পরে ভজনের ঢঙেও এই গান গেয়েছেন। মাষ্টার কিষণরাও ফুলামব্রিকার সুর বসিয়েছিলেন ঝিঞ্ঝোটি রাগে। পঙ্কজ মল্লিক, ভবানীচরণ দাস প্রভৃতি কত যে গুণী সঙ্গীত রচয়িতারা বন্দে মাতরম-এ সুর সংযোজনা করেছেন, তা বলে শেষ করা যায় না। এই নিবন্ধের শেষে তেমনই কিছু অল্পশ্রুত সুরের লিংক দেওয়া হ’ল।


বন্দে মাতরম্-এর সুর প্রসঙ্গ এই পর্যন্তই। এই বিষয়ের সঙ্গে সরাসরি ভাবে সম্পর্কিত না হলেও, গানটিকে নিয়ে অনবরত যা কিছু বিতর্ক চলে আসছে, অনুসন্ধানকালে সে সম্পর্কে কিছু তথ্য সামনে পাই, যার অনেকটাই হয়ত পাঠকরা অবগত থাকবেন। যাঁরা নন, তাঁদের সুবিধার্থে খুব সংক্ষেপে তা নিয়ে কিছু ব্যক্ত করলাম। এই বিবরণ নেহাতই তথ্য জ্ঞাপন, লেখকের ভুমিকা নৈর্ব্যক্তিক।


বন্দে মাতরম্-এর রচনাকালেই সংস্কৃতের শব্দ নির্বাচন নিয়ে কিছু বিরূপ সমালোচনা হয়েছিল। কথিত আছে, বঙ্কিমের কন্যাও এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন, একটি শ্রুতিপাঠের আসরে প্রথম শোনার পর উপস্থিত অনেকেই মন্তব্য করেন যে, কিছু অংশ “অত্যন্ত শ্রুতিকটু হইয়াছে। শস্য শ্যামলাং শ্রুতিকটু নয় তো কি ? দ্বিসপ্তকোটী ভুজৈর্ধৃত খরকরবালে ইহাকে কেহই শ্রুতিমধুর বলিবেন না। বঙ্কিমচন্দ্র প্রায় এক ঘণ্টা ধরিয়া ধীর ভাবে শুনিলেন, তাহার পর বলিলেন, ‘আমার ভাল লেগেছে, তাই লিখেছি। তোমাদের ইচ্ছা হয় পড়, না হয় ফেলে দাও, না হয় প’ড় না।“


সব থেকে বেশি বিতর্ক জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বন্দে মাতরম্-এর নির্বাচন না হওয়া, এবং জাতীয় গান হিসেবে মাত্র দু স্তবকের ব্যবহার নিয়ে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে রবীন্দ্রনাথের মতামতের একটা ভুমিকা নিশ্চিতভাবে ছিল। আগেই বলেছি, ১৯৩৭ সালে জাতীয় কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি একটি চার সদস্যের সাব কমিটি গঠন করে, বন্দে মাতরম্-কে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেওয়ার যুক্তিযুক্ততা এবং তার পরিণাম পর্যালোচনা করে অভিমত পেশ করার জন্য। এই কমিটির সদস্যরা ছিলেন জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু, আবুল কালাম আজাদ ও আচার্য্য নরেন্দ্র দেব। এঁরা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করেন। রবীন্দ্রনাথের মত ছিল, এর প্রথম দুটি স্তবক দেশমাতৃকার বর্ণনা এবং বন্দনা হিসেবে অতীব সৌন্দর্যময়, কিন্তু পরেরগুলি উপযুক্ত নয়। ১৯৩৭এর ২৬শে অক্টোবর একটি চিঠিতে তিনি লেখেন, “To me the spirit of tenderness and devotion expressed in its first portion, the emphasis it gave to the beautiful and beneficent aspects of our motherland made a special appeal, so much so that I found no difficulty in dissociating it from the rest of the poem and from those portions of the book of which it is a part, with all the sentiments of which, brought up as I was in the monotheistic ideals of my father, I could have no sympathy.”, কেন তিনি প্রথম দুই স্তবকের বেশি সুর সংযোজনায় বিরত থাকলেন, এই উক্তির মধ্যে তার কি একটা সম্ভাব্য কারণ পাওয়া যেতে পারে ?


এই প্রসঙ্গে একটি তথ্য জানাতে হয়। আনন্দমঠ বঙ্গদর্শনে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ হওয়ারও আগে, এবং ১৮৮২তে গ্রন্থাকারে বেরোবার বহু পূর্বে, ১৮৭৯ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ একটি গান রচনা করেন, যাতে তিনি ‘বন্দে মাতরম্’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেছিলেন (একসুত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন, এক কাজে সঁপিয়াছি সহস্র জীবন - বন্দে মাতরম্)। এর থেকে একটি উপপাদ্য এও এসেছে যে বঙ্কিম শুরুতে গানের প্রথমাংশই শুধু লিখেছিলেন, যা কোন ভাবে তরুণ রবীন্দ্রনাথের গোচরে আসে এবং তাঁকে প্রভাবিত করে। উপন্যাসে সংযোজনের প্রয়োজনে বঙ্কিম পরে আরও স্তবক জুড়ে দেন। অবশ্য এই সবই জল্পনা, এবং প্রমাণ করার মত কোন উপাদান এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।


বন্দে মাতরম্-এর শেষ চার স্তবক সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ সহ অন্য বিরোধীদের মত ছিল যে ওগুলিতে যে মাতৃমূর্তির বন্দনা করা হয়েছে, আসলে তা হিন্দু দেবী দুর্গা বা কালীরই প্রতিরূপ। সুভাষচন্দ্র বসুকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ খোলাখুলি ভাবেই এই মত ব্যক্ত করেন। তাঁদের যুক্তিতে এর জন্যই এই গান সব সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হোত না। ১৯০৫ সালে যখন বন্দে মাতরম্ ধ্বনি সরকার নিষিদ্ধ করা নিয়ে চিন্তা করছে, তখন নাকি এই গানের যথার্থ অর্থ উদ্ধারের জন্য কোন তথাকথিত বিশেষজ্ঞ আমলার পরামর্শ নেওয়া হয়, যিনিও এই সিদ্ধান্তে আসেন যে এই গানে উপাসিত মাতা আদতে কালীরই মূর্তি। সে যাই হোক, এ কথা স্বীকার্য যে সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা চিন্তা করেই বন্দে মাতরম্ সম্বন্ধে কংগ্রেস ও স্বাধীনতার পর গণপরিষদ নির্ণয় করে থাকবে।


অনেকের মতে, অন্য একটি বিষয়ও বিবেচনায় ছিল। একটি বহুস্বীকৃত দৃষ্টিকোণ ছিল এবং আছে যে বঙ্কিমচন্দ্র যে দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করেছিলেন, সে দেশ ভারত নয়, সে আসলে অবিভক্ত বঙ্গদেশ। গর্গ চট্টোপাধ্যায় (History revisited: ‘Bande Mataram was written as a song about Bengal, not India / scroll.in, May 31, 2017) বলছেন, ১৮৭১এর আদমশুমারি অনুযায়ী অবিভক্ত বাংলার জনসংখ্যা ছিল ৬.২৬ কোটি, যার ভিত্তিতে বন্দে মাতরম রচনাকালে বঙ্কিম লিখলেন ‘সপ্তকোটি কণ্ঠ’। ভারতবর্ষকে মাতা রূপে কল্পনা করলে তাঁর লেখা উচিত ছিল ‘ত্রয়োবিংশকোটি’, কারণ ঐ শুমারি মতে ভারতের জনসংখ্যা তখন ছিল ২৩.৮৮ কোটি। প্রসঙ্গত, ১৯০৫-এর বারাণসী কংগ্রেসে রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী সরলা দেবী বন্দে মাতরম-এর প্রথম দুই স্তবকের পরবর্তী স্তবকও গেয়েছিলেন, এবং তখন স্বেচ্ছাকৃত ভাবে ‘সপ্তকোটি’কে পরিবর্তন করে ‘ত্রিংশকোটি’ বলে গেয়েছিলেন, যা তখন ভারতের জনসংখ্যা ছিল। (ঋষি) অরবিন্দ ঘোষ বন্দে মাতম-এর ইংরাজী অনুবাদ করে লিখেছিলেন: “It is difficult to translate the National Anthem of Bengal into verse in another language owing to its unique union of sweetness, simple directness and high poetic force.”


২০০৬ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি নিবন্ধে অমৃতসূদন ভট্টাচার্য আরও একটি বিতর্কিত প্রশ্নের অবতারনা করেন। তিনি বলেন, আনন্দমঠ-এ বন্দে মাতরম্ যখন প্রকাশ পায়, তখন তার ২৮ চরণের মধ্যে প্রথম ১২ চরণ (‘বন্দে মাতরম্’ থেকে ‘রিপুদলবারিণীং মাতরম্’ পর্যন্ত) ছাপা হয়েছিল উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে। তাঁর প্রশ্ন ছিল, তার অর্থ কি ঐ প্রথম ১২ পংক্তি সাহিত্য সম্রাটের নিজের রচনা ছিল না ? বঙ্কিম সাহিত্যে উদ্ধৃতিচিহ্নের ব্যবহার চর্চা করে অন্য বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলেছেন যে শুধুমাত্র এই কারণের ওপর ভিত্তি করে এমন সন্দেহ অমূলক।


শেষ পর্যন্ত তবে এইটাই সার কথা যে বন্দে মাতরম্ গানের রচয়িতা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, এবং দেশের জাতীয় গান হিসেবে যে অংশ গাওয়া হয়, তার সুর সংযোজনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। অন্য গায়ক-সুরকারের কিছু অল্পশ্রুত সৃষ্টির নিদর্শন নীচের লিংকগুলিতে রইল।


ওঙ্কারনাথ ঠাকুর (বঙ্গীয় কাফি)



বিষ্ণুপন্থ পাগনিস (সারঙ্গ)



বিষ্ণু দিগম্বর পালুসকার কৃত সুর সুভদ্রা দেসাই-এর কণ্ঠে (কাফি)



বিনায়করাও দেশরাও অম্বাইকার (মিশ্র খাম্বাবতী)



কেশবরাও ভোলে (দেশকর)



নারায়ণচন্দ্র মুখার্জী (মল্লার, টপ্পা)



মাষ্টার কৃষ্ণরাও ফুলাম্ব্রিকার (ঝিঞ্ঝোটি)



সবলারাম্বোয়া সেজবল



দিলীপকুমার রায় (ধ্রুপদ/ধামার)



দিলীপকুমার রায় ও এম এস শুভলক্ষী (রাগমালিকা)


দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, জগন্ময় মিত্র, কনক দাস, দ্বিজেন চৌধুরী ও অন্যান্য (সুরকার সরলা দেবী)


0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in




















তুলসী চক্রবর্তী পাশ্ববর্তী চরিত্রে অভিনয় করেও সেকালের সিনেমায় বড়মাপের অভিনেতা। তার প্রমাণ আমরা পাই জনপ্রিয় সিনেমা 'সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ও ‘একটি রাত ' ইত্যাদিতে। তুলসী চক্রবর্তী অভিনয় অনন্যসাধারণ। সেসব ছবিতে তিনি কখনো মেসমালিক, কোথাও হোটেলমালিক, কোথাও সরাইখানার মালিক। নায়ক কিংবা খলনায়ক নন, তথাকথিত ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেও সব সিনেমায় স্বকীয়তা বজায় রেখেছেন তিনি।সাদাকালো যুগের প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর কথা বলছি। মূলত কৌতুক চরিত্রের শিল্পী হয়েও, কিন্তু আজও তিনি যেকোনো উঠতি অভিনেতা-অভিনেত্রীর অনুপ্রেরণা!
দেখতে কখনো তথাকথিত নায়কের মতো নন। সুদর্শনও বলা যাবে না। বড় বড় চোখ, এক মাথা টাক, অবিন্যস্ত দাঁত আর মোটা ভুঁড়ির ছোট চরিত্রের বড় অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয়–প্রতিভাকে একমাত্র সত্যজিৎ রায়ই বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁকে না পেলে সত্যজিৎ রায় যে ‘পরশপাথর’ বানাতে পারতেন না, এটা তিনি তাঁর শেষ জীবনে বলে গেছেন। এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় তুলসী চক্রবর্তীর নাম বলতে গিয়ে বলেছেন ‘তুলসী চক্রবর্তীর মতো অভিনেতার কদর এই পোড়া দেশে কেউ করবে না, কিন্তু তিনি যদি আমেরিকাতে জন্মাতেন, নির্ঘাত অস্কার পেতেন।’
গত শতাব্দীর ষাট–সত্তর দশকের বাংলা চলচ্চিত্র যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের কাছে তুলসী চক্রবর্তী অপরিচিত নন। এই নাম শুনলে অনেকেরই চোখে ভেসে ওঠে দুটি সিনেমা। একটি সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’, অন্যটি নির্মল দে পরিচালিত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’।
১৯৫৩ সালের কথা, মুক্তি পেল নির্মল দে পরিচালিত ‘সাড়ে ৭৪’। চারদিকে সাড়া পড়ে গেল, ছবিটির মাধ্যমে এক নতুন জুটি এসেছে পর্দায়। সে সময় একটু বয়েসি দর্শক মজেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী আর মলিনা দেবীতে। তাঁদের দাবি, নায়ক-নায়িকা তো তুলসী-মলিনা, উত্তম-সুচিত্রা তো আসলে পার্শ্বচরিত্র! শোনা যায়, সে সময় টানা আট সপ্তাহ বক্স অফিসে চলেছিল ছবিটি। এখনো দেখা যায়, কোনো চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দেখা শেষে বের হতে হতে কোনো তরুণ বলে উঠছে, ‘কই, কোথায় গেলে গো?’ যুগে যুগে এ সংলাপ ফিরেছে সিনেমারসিকদের মুখে মুখে।
ইন্দ্রাণী ছবির সেটে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তুলসী চক্রবর্তী।
অভিনয়জীবনে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’ ছবিতে অভিনয় করে। শোনা যায়, সে ছবির শুটিংয়ের আগে নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য পোশাক ডিজাইনার তাঁর পাঞ্জাবির মাপ নিতে আসছে শুনে আপ্লুত হয়ে বলছেন, ‘উফ! এ আমি কখনো ভাবতেও পারিনি!’ শুধুমাত্র অভিনয়ের জন্য নয়, ‘পরশপাথর’ তাঁর জীবনের অন্যতম মাইলফলক এ ছবি নিয়ে নানা গল্পের কারণে। এ ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তুলসী দাস নিয়েছিলেন মাত্র ১৫০০ টাকা। সত্যজিৎ রায় সম্মানী বাড়ানোর কথা বললে তুলসী দাস বলেন, এর থেকে বেশি নিলে বাকি শিল্পীরা কী দোষ করল! তারপর আর হয়ত কোনো ছবিতেই সুযোগ পাব না।
জন্ম ১৮৯৯ সালের ৩ মার্চ হাওড়ায়। বাবার অকালমৃত্যুতে মা নিস্তারিণী দেবী কলকাতায় চলে এসে সদ্য তরুণ তুলসীকে নিয়ে মা জোড়াসাঁকোয় থাকতেন তুলসীর জ্যাঠা প্রসাদ চক্রবর্তীর বাড়িতে। জাঠ্যা কাজ করতেন স্টার থিয়েটারের ব্যাকগ্রাউন্ড সংগীতের দলে। প্রসাদবাবুর সঙ্গে থিয়েটারে প্রথম যাতায়াত। এরপর আস্তে আস্তে থিয়েটারের সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসা। ১৯১৬ সালের কোনো একদিন স্টার থিয়েটারের অপরেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নজরে এলেন তুলসী। স্টারে কাজ করা শুরু করলেন ট্রেইনি আর্টিস্ট হিসেবে। অভিনয়ের পাশাপাশি সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন গানে, তবলায়, পাখোয়াজে। ১৯২০ সালে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ নাটকের মাধ্যমে স্টেজ জীবন শুরু করেন। এরপর ১৯২৭ সালে মনমোহন থিয়েটারে যুক্ত হন, তারপর মিনার্ভা, রংমহল থিয়েটারে কাজ করে প্রায় ৪২টি প্রযোজনায় অভিনয় করেছিলেন।
অবশ্য কলকাতায় শুরুতে টানাপোড়েনে কেটে গেছে তুলসী চক্রবর্তীর জীবন। প্রথমে উত্তর কলকাতার একটি দোকানে বাসনপত্র ধোয়ার কাজ করেন, তারপর সার্কাসে জোকার হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেছিলেন। থিয়েটারে কাজ করতে করতে বাংলা সিনেমা জগতে প্রবেশ করলেন ১৯৩২ সালে ‘পুনর্জন্ম’ ছবির মাধ্যমে। এরপর একে একে ‘শচীদুলাল’, ‘মনোময়ী গার্লস স্কুল’, ‘শঙ্খ সিন্দুর’, ‘কবি’, ‘পথের পাঁচালী’, ‘পরশ পাথর’, ‘মৃতের মর্ত্যে আগমন’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ইত্যাদি ছবিতে।
ছবি বিশ্বাসকে অনেকেই চেনেন হয়তো। সেই ছবি বিশ্বাস যিনি কিনা কোনোদিনও শুটিং করার সময় সংলাপ মুখস্থ করতেন না। শুধু একবার চোখ বুলিয়ে নিতেন এবং তারপরই রীতিমতো অভিনয়ের দাপট! কিন্তু সহ-অভিনেতা যেদিন তুলসী চক্রবর্তী থাকতেন, সেদিন তাঁকে কোমর বেঁধে নামতে হতো। ছবি বিশ্বাস বলতেন, কী জানি কী প্যাঁচ তুলসী কষবে! ছবি বিশ্বাস খুব ভালো করে জানতেন যে সহ-অভিনেতা যখন তুলসী চক্রবর্তী, তখন অভিনয়টাও করতে হবে চ্যালেঞ্জ রেখে, টক্কর দেওয়ার মতো
তাঁর বিষয়ে বলতে গিয়ে মহানায়ক উত্তম কুমার বলতেন, ‘তুলসীদার মতো অভিনয় তো কোনোদিনই করতে পারব না, ওনার মতো জীবন্ত হয়ে ওঠা আমার দ্বারা হবে না। ওনাকে প্রণাম জানানোর মতো একটাই পথ আছে; পরিচালক প্রযোজকদের বলে যখনই কাজ পাই, তুলসীদাকে ডেকে নিই। উনি থাকলে সিনটা দারুণভাবে উঠে যায়। ওনার ঋণ তো কোনোদিন শোধ করতে পারব না, যেভাবে যেটুকু পারি সাহায্য করি।’ আর নিজের সম্পর্কে তুলসী চক্রবর্তী বলতেন, তিনি হলেন রান্নাঘরের হলুদ, যেখানে–সেখানে কাজে লেগে যাই। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘চোখ–কান খোলা রাখি, আর সব ধরনের মানুষ দেখে বেড়াই। চরিত্রমতো যখন যাকে দরকার, তাকে তুলে ধরি। এসব চরিত্র ফুটিয়ে তোলার দরকার হয় নাকি? এসব তোমার–আমার চারপাশে ঘুরছে। যেকোনো একটাকে তুলে এনে নিজের কাঁধে ভর করাও।’
তিনি কমেডিয়ান না পূর্ণ অভিনেতা, সে প্রশ্ন দূরে থাক। তিনি একজন দক্ষ অভিনেতা, সে কথা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। বাংলা ভাষা ছাড়াও হিন্দি এবং উর্দুতেও কাজ করে গেছেন। এর মধ্যে বহু ছবির জন্য পারিশ্রমিকও নেননি শুধু ভালোবাসার জন্য। চরিত্র ছোট না বড়, গুরুত্ব আছে না নেই, এসব ভাবতেন না তুলসী চক্রবর্তী। মনপ্রাণ ঢেলে অভিনয় করতেন।
সারা জীবনে ৩১৬টি বাংলা ও ২৩টির মতো হিন্দি সিনেমা করলেও দারিদ্র্য ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। তবু নিজের বাড়িও দান করেছিলেন এলাকার দরিদ্র পুরোহিতদের জন্য। ছোট্ট দুই কামরার বাড়িতে থাকতেন স্ত্রীকে নিয়ে। উত্তম কুমার, তরুণ কুমারদের ছেলে বলে ডাকতেন নিঃসন্তান তুলসী। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য অর্থ জোগাড় করতে হিমশিম খেয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর পর পশ্চিম বাংলার সরকারের পক্ষ থেকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোরও কোনো বন্দোবস্ত ছিল না তখন। তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী উষারাণী দেবী দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন একমুঠো খাবারের জন্য। দারিদ্র্যের কারণে স্বামীর সবকটি মেডেলও নাকি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
অভিনয়জীবন ভালো কাটলেও যাপিত জীবন কষ্টে কেটেছে তুলসী চক্রবর্তীর। দুই বাংলার দর্শকের অন্তরে চিরকালের জন্য অমর হয়ে থাকবেন তিনি, এটাই মরণোত্তর জীবনের বড় পাওয়া হিসেবে থাকবে যুগের পর যুগ।
0

প্রবন্ধ - শৌনক ঠাকুর

Posted in










খ্রিস্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বৈষ্ণব পদাবলীর পাশাপাশি সমানভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল শাক্তপদাবলী। রামপ্রসাদ সেন , কমলাকান্ত ভট্টাচার্য , দাশরথি রায়সহ প্রমুখের লেখা গান লোকের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে। তবে এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ শ্যামাসংগীত রচনাকার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। যার বড় অংশই ছিল শ্যামাসংগীত। তবে রামপ্রসাদ , কমলাকান্ত বা প্রচলিত রীতি থেকে তাঁর শ্যামাগানের শব্দ-সুর-রীতি অনেকটাই আলাদা।


নজরুলের শ্যামাগান ব্যতিক্রমী হওয়ার অন্যতম কারণ হল শ্যামাসংগীতে প্রত্যক্ষ স্বদেশীয়ানার প্রচলন। দেবীকালী তার চোখে দেশমাতৃকা। ‘হিন্দুমেলা’ প্রতিষ্ঠার আগে এই প্রয়াস তেমন দেখা যায় নি। ‘আজই না হয় কালই তোরে কালী কালী বলবে লোকে।’ এই গানটিতে ‘কালী’ যে দেশমাতার রূপক। তারই কৃপাতে পরাধীন ভারতবর্ষের আপামর জনগণের শৃঙ্খলমোচন সম্ভব তা বলার অপেক্ষা রাখে না।


দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বলা যায় সুরের অভিনবত্ব। প্রচলিত শ্যামাসংগীতে একটা সুরগত টাইপ বা রীতি থাকে। কিন্তু নজরুলের শ্যামাসংগীতের মধ্যে রাগসঙ্গীত বা মার্গসংগীতের প্রভাব লক্ষণীয়। তাই তার বেশিরভাগ গানে খোলের পরিবর্তে পাখোরাজ বাজানো হত। (অবশ্য খোলের ব্যবহার যে একেবারেই নেই তা বলা যায় না)


ইংরেজ-বিরোধী আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পুঁজিবাদীদের রমরমা, মুদ্রাস্ফীতি, ঔপনিবেশিক আগ্রাসন ইত্যাদি জনমানসে ভয় ও হতাশার জন্ম দিয়েছিল। শ্যামাসঙ্গীতকেই প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছেন কাজী নজরুল। ‘কালকে তুমি কাকে মারো?’ ইত্যাদি।


প্রাত্যহিক জীবনের অতিসাধারণ উপাদান তার লেখনি গুণে হয়ে উঠেছে অমূল্য সম্পদ। ভক্তি প্রসঙ্গে একটি গানে তিনি বলেছেন — ‘ভক্তি আমার ধূপের মত / ঊর্ধ্বে ওঠে অবিরত। অথবা
‘তোর রাঙা পায়ে মে মা শ্যামা / আমার প্রথম পূজার ফুল।’ কত সুন্দর দার্শনিকচেতনা ও রূপকের দ্যোতনা।


কাজী কবির চোখে এই নারী কখনও ‘ছিন্নমস্তা’ কখনও বা ‘রক্তখেপী’। এই নারীরাই পারে জগতের যা কিছু অমঙ্গলকে বিনাশ করে শুভ শক্তির জাগরণ ঘটাতে। ‘শিখালি কাঁকন চুড়ি পরিয়াও নারী, / ধরিতে পারে যে উদ্ধত তরবারি।’ তাই কবির চোখে এই নারী মহাকালী করালবদনা। জাগরণের প্রতীক। মুক্তির দূত। ‘আমার মা আছে রে সকল নামে’ ,‘আমি কি তোকে ডাকিতে পারি’ ইত্যাদি নানান গানে কবি নারীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেছেন। আবার ‘আমার কালো মেয়ের পালিয়ে বেড়ায়’ এই ধরনের গানে কবি নারী-মুক্তি ও সম-অধিকারের বার্তা দিয়েছেন।


উর্ধ্বমুখী কুণ্ডলিনী বা সর্পশক্তিকে জাগরিত করাই হল প্রকৃত সাধনা। গীতিকার নজরুল বিভিন্ন শ্যামাগানে লৌকিক উপমা ব্যবহার করে এই দূরহ বিষয়টিকে সহজভাবে ব্যক্ত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ ‘শ্যামা নামের লাগল আগুন আমার দেহ ধূপ-কাঠিতে’, ‘ধূলোয় ভরল ধরণী’ ইত্যাদি গানের কথা বলা যেতে পারে।


রহস্যময় জটিল সৃষ্টিতত্ত্বে পুরুষ সূক্ষ্ম, অব্যক্ত, নিত্য ও চৈতন্যরূপ সত্ত্বা। আর প্রকৃতি তার দোসর। ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তের ১০ মন্ডলের ১২৯ সূক্তে এই ভাবনারই প্রকাশ রয়েছে। বিদ্রোহী কবির একটি গানে দেখা যায় মহাকাল শিব বুক পেতে গ্রহণ করেছেন মহাকালীর শ্রীচরণ — ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় / দেখে যা আলোর নাচন।’


শুধু মাতৃরূপে নয় কন্যারূপেও মা কালীকে দেখেছেন তিনি। এ কন্যা আমাদের সাধারণ ঘরে। এ কন্যা হেসে খেলে নেচে বেড়ায়। আমাদের আদরের দুলালী। কবিও বলেছেন — ‘আদরিনী মোর শ্যামা মেয়েরে / কেমনে কোথায় রাখি’।


মায়ার আবরণে মানুষ অন্ধ হয়ে থাকে। তাই সংসারের জালে আবদ্ধ হয়ে কলুর বলদের মতই কেবল ঘুরে মরে। এই জীবনবোধ ও চিরন্তন সত্যকে কত খুবই সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন গীতিকার নজরুল —‘জগৎ জুড়ে জাল ফেলেছিস মা শ্যামা কি তুই জেলের মেয়ে / (তোর) মায়ার জালে মহামায়া বিশ্বভূবন আছে ছেয়ে।’ এখানে ‘জাল’ শব্দটি মায়া ও ‘চতুর মীন’ সাধক অর্থে অর্থে প্রযুক্ত।


লৌকিক জগতকে আশ্রয় করে লোকোত্তর আর জগতের দ্যোতনা সৃষ্টি করায় তার সংগীতের মূল নান্দনিক রূপ। যেখানে থাকে অদ্বৈতবাদের পরমসত্তা এবং অতীন্দ্রিয় স্বপ্ন-সুখ।


শাক্ত ও বৈষ্ণবদের মধ্যে চিরকালীন একটা দ্বন্দ্ব বা মতপার্থক্য দেখা যায়। কিন্তু বিদ্রোহী কবির কলমে শ্যাম ও শ্যামা একাত্মতা হয়ে গেছে। শ্যামকে শ্যামামায়ের কোলে বসিয়ে তিনি দেখিয়েছেন একই অঙ্গে দুটি রূপ। ‘আমার শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে / জপি আমি শ্যামের নাম।’ কিংবা ‘আমার মনের দো-তারাতে শ্যাম ও শ্যামা দুটি তার।’ পরমাত্মা কখনই ভিন্ন নয় এক ও অদ্বিতীয়। জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এখানেই আধুনিকতা।


মানবতাবাদী কবি কাজী বলিদান প্রথার বিরোধী ছিলেন। তিনি বলেছিলেন বলিদান প্রথায় মনের পশুকে বদলে কেন বনের পশুকে ব্যবহার করা হচ্ছে। মন্দিরের বদ্ধ আবরণীতে দেবীর প্রতিষ্ঠান নয় তিনি সর্বত্র বিরাজিত ভূতের স্থিত।


নজরুলের শ্যামাসংগীত জনপ্রিয়তার আরেকটি প্রধান কারণ হল আবেগধর্মিতা। বাঙালির শান্ত-স্নিগ্ধ-নরম হৃদয় এই গানগুলি তাই চিরকালীন সম্পদ হয়ে উঠেছে। যেমন ‘আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে’, ‘আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’, ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা’, ‘জ্বলিয়া মরিবি কে সংসার জ্বালায়’। ‘মোর লেখাপড়া হ'ল না মা, আমি 'ম' দেখিতেই দেখি শ্যামা, আমি 'ক' দেখতেই কালী ব'লে নাচি দিয়ে করতালি’ ইত্যাদি।


আসলে নজরুলের ছিলেন একজন উদারপন্থী মুক্তমনা স্বাধীনচেতা মানুষ। তার কাছে ধর্ম-বর্ণ-বিভেদের উর্দ্ধে ছিল মানবিকতা। তার এই সমন্বয়পন্থী মনোভাবের জন্য বারে বারে মৌলবাদীরা তাকে আঘাত করেছে। অপমান করেছে কট্টর হিন্দুরা। একসময় পূর্ববঙ্গে রেডিওতে নজরুলের শ্যামাসংগীত বাজানো নিষিদ্ধ ছিল। এত কিছুর পরেও নজরুলের ভাবাদর্শকে কেউ বিন্দুমাত্র টলাতে পারে নি।
বাঙালির শ্বাস প্রশ্বাসের আজ ও বাহিত হয় নজরুলের শ্যামা সংগীত। শুধুমাত্র চিত্তবিনোদন বা আনন্দ প্রদান নয়, এর পিছনে রয়েছে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সমকালীন সমাজভাবনা রাজনৈতিক চেতনা। তাই সংগীতগুলো হয়ে উঠেছে তৎকালীন কালের বিশ্বস্ত দলিল। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এ গানগুলির জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমে নি। বরং বেড়েছে‌। এর সুর মূর্ছনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহমান।
আর শ্যামাসংগীতকার নজরুল আপন শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে হয়ে উঠেছেন এক পৃথক পথের যাত্রী।


_____________

ঋণ স্বীকার


১। গানের ভুবন : কাজী নজরুল : ড.মাধুরী সরকার
২। ‘কাব্যগীতির ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের স্থান’: করুণাময় গোস্বামীর
৩। ‘পঞ্চোপাসনা’ : শ্রীজিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়,
৪। ‘বাংলা সাহিত্য নজরুল’ : আজহারউদ্দীন খান
৫। শক্তি সাধনা ও শাক্ত গান: আঠারো শতকের সমাজ ইতিহাসের দায়বদ্ধতা : অরিন্দম অধিকারী
৬। ‘নজরুল ও বাংলা শাক্ত-সংগীত’ : পল্লব চট্টোপাধ্যায়
0

প্রবন্ধ - সনাতন সিংহ

Posted in






শ্রাবণের সহচর বৃষ্টি। একেবারে নাছোড় বান্দা। লেগেই থাকে। যেন সময় আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকে শুধু। যেই না গ্রীষ্ম শেষ, ওমনি মৌসুমীর হাতছানিতে তা ঝরে পরে 'মুখের পরে, বুকের পরে'। সেই মুখ ও বুক যেমন আমাদের প্রকৃতি, তেমনি আমাদের সাহিত্য ও মানব-জীবন। তবে মনে বা সাহিত্যে তার প্রভাব কম নয়। বিস্তর। রবিঠাকুরের ঝর্ণা কলমও মুখর হয়ে ওঠে তার লাবণ্যে। যেন কলম নয়, তুলি, কবিতার ক্যানভাসে বর্ণনাময় হয়ে ওঠে তা... 'টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ে নদে এল বান'।

সে বৃষ্টিতে নদীর বুক ছলাৎ ছলাৎ করে উঠুক বা বান ডাকুক বাচ্চাদের কাছে ভিন্ন। তারা দল বেঁধে সুর করে তাকে ডাকে, 'আয় বৃষ্টি ঝেঁপে/ ধান দেব মেপে।' ধান মেপে দিতে গেলে মাঠে তার জোগান থাকা দরকার। যে মাটি ফুটিফাটা, তার বুকে সোনার ফসল ফোলানোর কারিগর, চাষীরাও প্রার্থনা করে আরাধ‍্যের কাছে, 'আল্লা মেঘ দে পানি দে। পানি দে রে।'

তবে কখন সে নেমে আসবে সেই সময় অবধি সবুর করার প্রশ্নই ওঠে না। তর সয় না তাদের বউ-ঝিদের। শুরু করে দেয়, 'মেঘারানির ব্রত'। ব্রত পালন করতে করতে গলা মেলায়... 'হ্যাদে লো বুন মেঘারানি/হাত পাও ধুইয়া ফেলাও পানি/ ছোটো ভুঁইতে চিনচিনানি/ বড়ো ভুঁইতে হাঁটু পানি।'

ব্যস, 'বিন্দু বিন্দু জল' দল বেঁধে নামে বৃষ্টি হয়ে। বর্ষাও হয় মুখর। মন নাচে কবিরও। অক্ষরে অক্ষরে তারা জন্মলাভ করে ভাষার ঔরসে, 'বর্ষা যখন খুলল খাতা, প্রেমের লেখাও পারুক সে/ মেঘ যদি হয় দীপ্তি নভাল, শহর তবে ফারুক শেখ।'

প্রেমিক সত্তা তখনই যেন অভিসারের পটভূমি রচনা করে। প্রেমিকাকেও চাক্ষুষ ও স্পর্শ করতে চায় বৃষ্টি শরীরে। 'ঝিন্টি তুই বৃষ্টি হতে পারতিস/ ঝরে পড়তিস টিপ টুপ টাপ গায়ে মাখতাম।' মন-মদিরা পাল তুলে ভেসে যায় পানসি মেঘের সঙ্গে। 'নীল নবঘন'-এ আকাশ তখন এলোকেশী। থেকে থেকে বিজলীর ঝলকানি। আকাশ চেরা গর্জন। দিগন্ত ওঠে কেঁপে। আর কোন সুদূরে অপেক্ষারত প্রেমিকার উদ্দেশ্যে সন্দিগ্ধ প্রেমিক উৎকণ্ঠা জানায়, 'মেঘ করেছে মেঘের মতোই সাজাচ্ছে সে বৃষ্টিসেনা/ ধরেই নিলাম, এই চিঠিটাও তোমার কাছে পৌঁছাবে না।'

সেসব তো আর আবহাওয়া দপ্তর দেখবে না। আবার উপেক্ষাও করেও না। মেঘেদের ভেলা দেখে বিজ্ঞপ্তির অঞ্জলি-বাক্যে ভরিয়ে দেয়... হালকা থেকে মাঝারি বা ভারি, আবার কোথাও বা অতিভারি বৃষ্টিপাত হবে। সেই রকমারি বৃষ্টি সশরীরে নেম আসে মাটিতে। দেখলে মনে হবে জল-ভারি মেঘের দল যেন অর্ঘদান করছে বসুমাতাকে। আর তার ধারায় সশরীরে সপরিবারে ভিজছে আকাশ-গঙ্গার নিচে। তবে বর্ণনার বহর অনুযায়ী সে যেখানেই ঝরুক না কেন, তা কবির চোখে ভিন্ন রকম। 'ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি/ ইলিশ মাছের ডিম/ ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি/ রোদ্দুরে রিমঝিম।'

সেই ইলশে গুঁড়িতে জেলের মন উড়ু উড়ু করলেও বিরহী-মন আবার জানলায় বসে বেদনাকুল। অক্ষরে অক্ষরে তারা শরীর পায়। প্রিয়রও কাছে নিজের ব্যথাতুর করুণ ছবি দেখাতে চায় দ্বিধাহীন ভাবে। সে বেদনা কম কিসে? 'ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতায় ঝর না/ আমার এত সুখের কান্নার দাগ ধুয়ো না/ সে যেন এসে দেখে তার বিরহে কত আমি কেঁদেছি।'

সবার ইচ্ছে পূরণ করা কি সহজ-সাধ্য? কার কথা রাখবে শুনি? নিজস্ব বলে কি কিছু নেই তার? নাকি খালি লোকের শখ বা ইচ্ছে অনুযায়ী ঝরবে? কোনো কোনো দিন সেসব উপেক্ষা করে সে দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ে, দেশ-দেশান্তরে। মনাকাশ থেকে সাদাখাতার বেলাভূমি ভিজিয়ে দেয় ব্যক্তিরসে। তখন সে বিগলিত হয়ে ঘোষণা করে, 'আর হ্যাঁ, শোন-এখন আমি মেঘ নই আর/ সবাই এখন বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়।'

প্রকৃতি ডুব দেয় স্নিগ্ধতায়। মন কেমন করে ওঠে অনেকের। ভাইয়ের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে দিদি। 'ওপারেতে কালো রং/ বৃষ্টি পড়ে ঝমঝম/এ পারেতে লঙ্কাগাছটি রাঙা টুকটুক করে/ গুণবতী ভাই আমার মন কেমন করে।'

তবুও সে 'আষাঢ় গগনের' বুক চিরে নিজের দায়িত্ব নিজেই কাঁধে তুলে নেয়। সবার মঙ্গলে, সবার আবদারে ভেসে বেড়ায় প্রত্যাবর্তনের বিশুদ্ধ অঙ্গীকারে। মেঠো পথ থেকে শহুরে নালা বা শুকনো ঘাসের থেকে নবীন প্রেমাস্পদ, শুনতে পায় সে আকাশবাণী, 'এখন পুরো বর্ষা চলছে/ তাই আমরা সবাই এখন/ নানান দেশে ভীষণ ব্যস্ত/ তুমিও যাও, মন দাও গে তোমার কাজে/ বর্ষা থেকে ফিরে আমরা/ নিজেই যাব তোমার কাছে ।”

নিজের দেশে ফিরে আসা তখন তার নিজের উপর নির্ভরশীল নয়। পথ আটকে দাঁড়ায় অনেকে। স্কুল-কলেজ-অফিস -আদালতে রুটিন মাফিক জীবন কাটানো, অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক কর্তব্যকে উপেক্ষা করে কায়মনবাক্যে আহবান করে বৃষ্টিকে, 'সকল থেকে বলছি, আকাশ ঢালো একটু ঢালো/ ঠিক দশটায় ঝম ঝমাঝম বৃষ্টি হলে ভালো/বৃষ্টি হলে ঘরের ভেতর শুকতে দিস কাপড়/ বৃষ্টি হলে দুপুর বেলায় খিচুড়ি আর পাঁপড়'।

তবে কারোর 'বুকে যখন বৃষ্টি নামে নৌকা টলমল', তখন অন্তর সিক্ত হয় অনুরাগে। 'বৃষ্টি নামল যখন আমি উঠোন পানে একা/দৌড়ে গিয়ে ভেবে ছিলাম তোমায় পাব দেখা/হয়তো মেঘে-বৃষ্টিতে বা শিউলিগাছের তলে/আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছ আকাশ-ছেঁচা জলে।'

বৃষ্টির নিজের নিয়ন্ত্রণ আর নিজের উপর থাকে না। নিম্মচাপ উস্কানি দেয় সুযোগ বুঝে। দলে দলে তারা নেমে আসে। দুকূল ছাপায়। আপন বেগে পাগল পারা হয় নদ-নদী। ভেসে যায় ঘরবাড়ি, গাছপালা, পশু, মানুষজন। কলম তখন দার্শনিক হয়ে কানে বসে থাকে না, নেমে আসে সাদাখাতার সমুদ্রে। 'নিরবধি সাত দিন বৃষ্টি নিরন্তর/আছুক শস্যের কার্য হেজ্যা গেল ঘর'।

বন্দি হয় জনজীবন। থমকে যায় দিনলিপি। কর্মনাশা দিন কানের কাছে এসে বলে যায়... 'বৃষ্টিতে দেখা যায় না পৃথিবী/বৃষ্টি গড়ে তোলে নিজস্ব দেয়াল।'

সংসার অচল হয়ে অনাসৃষ্টির বৃষ্টিতে। ভাতের হাঁড়ি ভেলা হয় হা-ভাতে। পেট হাহাকার করে। নুন আনতে পান্তা ফুরানো হিসেবি জীবন সংসার-দলিলে নিজের অভাবী কলম ধরে, বেদনার-কালি জ্যান্ত হয়ে ওঠে নিদারুণভাবে, 'শ্রাবণব্যাপারী আমি, মেঘে মেঘে আমার উপায়/যত উপার্জন করি, বৃষ্টিতে খরচ হয়ে যায়।'

তবুও তা উপেক্ষা করে কোথাও আবার কেউ চাতকের মতো অপেক্ষা করে। দিন বদলের আশায় দিন যাপন করে প্রতিদিন। উপাচারে উপাচারে আরাধনা করে মেঘমল্লারের কাছে। সেই অন্তরাকুতিময়-বাষ্প বয়ে বেড়ায় বাতাস। 'বিহিত হবেই। মেঘ বদলের কাব্যি লিখছে একটা লোক/ তোমার জন্যে অন্য কোথাও অন্যরকম বৃষ্টি হোক।'
0

প্রবন্ধ - সেবিকা ধর

Posted in









যেকোনো সমাজের যে প্রতিচ্ছবি তা সাধারণভাবে ফুটে উঠে তার সাহিত্য নির্মাণে।ছবিতে, চলচ্চিত্রে, নাটকে, গানে। তবে সাহিত্যে যদি সেই সময়ের অভিঘাত ফুটে না উঠে তবে তাহলে সেই সাহিত্য কিন্তু সাহিত্য নয়। হাসনের গানে কি সেই সময়কার কথা ফুটে উঠেছে? হাসনের গানে যে প্রেমার্তি আছে, সে প্রেমার্তির সঙ্গে সঙ্গে সেই সময়ের যে সামাজিক বৈষম্য যে যন্ত্রণা তা প্রচ্ছন্ন ভাবে রয়েছে লালনের গানেও তাই।লালনের গানেও তাই।ফলে আজকের দিনে যদি যদি আমরা দেখি যে একজন লেখক যিনি সমাজ বিচ্ছিন্নভাবে বা সমাজচ্যুত ভাবে তিনি লিখে যাচ্ছেন শুধুমাত্র একটা পঞ্চাশ তলা বাড়ির মাথায় বসে, সেই কথা কিন্তু মানুষের কানে পৌঁছাবে না।মানুষের সার্বিক যে আয়োজন, সার্বিক বাঁচার যে প্রয়াস,সার্বিকভাবে এগোনর যে চেষ্টা, সেই চেষ্টাই কিন্তু প্রকৃত লেখক যিনি তিনি তুলে ধরেন তাঁর গল্প এবং উপন্যাসে।

রবীন্দ্রনাথ সবচাইতে বড় উদাহরণ। যদি দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ কোনো একটু আখ্যান বুনছেন।সেই আখ্যান বুনতে বুনতে তিনি চার অধ্যায়ের এলা এবং মনসুর যে প্রেমার্তি এবং প্রেমাভিষেক তার মধ্যে কিন্তু যে স্বস্বস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন যাকে রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন না সেই মনহীন আন্দোলন রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস অনুযায়ী যদি সস্বস্ত্র বিপ্লবীদের অনেক আত্মত্যাগ আছে, থাকবেই।তারা রবীন্দ্রনাথকে খুব শ্রদ্ধা করতেন।সেটা অন্য প্রসঙ্গ।কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেটাকে নিয়ে আসেন।ফলে শুধুমাত্র যদি তিনি একটি প্রেমার্তির উপাখ্যান লিখতেন তাহলে আজকের প্রেক্ষিতে কিন্তু সেই লেখাটি আর পড়া হতো না।স্বাভাবিকভাবে ত্রিপুরার যাঁরা লেখক যাঁরা ত্রিপুরায় লিখতে এসেছেন বা ভাষা চর্চা করতে এসেছেন যাঁরা ছোটো গল্প নির্মাণ করেছেন ত্রিপুরায় তাঁরাও কিন্তু একই পথের পথিক। একই পথের পথিক মানে তারা রবীন্দ্রনাথকে যে অনুসরণ করছেন বা রবীন্দ্রনাথের পথেই অন্ধের মতো চলছেন তা নয়। তারা তাদের নিজেদের পথ খুঁজছেন সাহিত্যের কোদাল কেটে।সাহিত্যের কোদাল কেটে নতুন নতুন রাস্তা বের করছেন তাঁরা। সেই রাস্তার মধ্য দিয়ে তারা হাঁটতে চাইছেন স্বাভাবিকতায় নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনের যে অভিঘাত এবং অন্যান্য সংঘর্ষ তাকে সঙ্গে নিয়ে।সেই সংঘর্ষ, সেই অভিঘাত মধ্যবিত্ত বাড়ির হতে পারে, হতে পারে কোনো উপজাতি পরিবারের আলোচ্য বিষয় , অথবা অন্যান্য আরও অনেক বিষয় যা ত্রিপুরারই সাংগঠনিকভাবে এবং বাস্তবিকভাবে ত্রিপুরারই। সেই ব্যাপারগুলো কিন্তু উঠে আসতে থাকে তাদের লেখার মধ্যে।তথাকথিত আর্বান জালিয়াতি অর্থাৎ নগুরে মনোভাব না থাকলে লেখা সার্বিকভাবে সফল হয় না।কিন্তু আর্বান লেখার মধ্যে একটা চালাকিও আছে। সেই আর্বান চালাকি যদি তারা করতেন তাহলে লেখাগুলি কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন হয়ে ক্রমশই একটা ধুসর স্তুপ হয়ে দাঁড়াত।তারা কিন্তু ধূসর স্তুপের কথা বলেন নি।বরঞ্চ তারা প্রাণবান,সজল,সচল প্রবহমান নদীর যেমন ধারা অথবা অরণ্যের গভীরে যেভাবে সবুজ পত্র মর্মরের কথা আমরা শুনতে পাই সেই কথাই তারা শুনিয়েছেন।এটা আশার কথা তাদের এই উচ্চারণ এবং ধারাবাহিক উচ্চারণের ফলে ত্রিপুরার সাহিত্য তা সমৃদ্ধ হয়েছে।ছোটো গল্পের ভুবন বিস্তৃত হয়েছে এবং নতুন করে নতুন ধরনের সাহিত্য গড়ে উঠেছে নতুন করে বলার ইচ্ছে গড়ে উঠেছে ত্রিপুরার জনমানসে এবং যারা লিখতে এসেছেন তাদের লেখায়।
0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in



















পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীনের অবিস্মরণীয় সৃষ্টি ' কবর 'কবিতা। ' বাংলা সাহিত্যে কাহিনী নির্ভর কবর' কবিতার রচনাকাল চলতি ২০২৫ সালে শতবর্ষে পদার্পণ করেছে।

১৯২৫ সালে 'কবর' কবিতাটি প্রথম কল্লোল পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। 'কবর' কবিতাটি প্রকাশিত হলে যাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে, তাদের মধ্যে ছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কবি সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বিএ ক্লাসের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তাঁর এ কবিতাটি প্রবেশিকা বাংলা সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়। কবি হিসেবে এটি তাঁর এক অসামান্য সাফল্য। ছাত্রাবস্থায় কবিতাটি পাঠ্যপুস্তকে স্থান পাওয়ায় ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত হয়।

'কবর' কবিতা কল্লোল পত্রিকায় ছাপা হলে সেটা পড়ে দীনেশচন্দ্র সেন 'অ্যান ইয়াং মোহামেডান পোয়েট' শিরোনামে একটি আলোচনা লিখেছিলেন ফরওয়ার্ড পত্রিকায়।

জসীম উদ্দীন তাঁর আত্মস্মৃতিতে বর্ণনা করেছেন, দীনেশচন্দ্র সেন একদিন এমএ ক্লাসের সাহিত্যের বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'জসীম উদ্দীনের মতো কবির শিক্ষক হতে পারা তাঁর জন্যে বড় গৌরবের বিষয়। শেলি, কিট্স, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ- বিশ্বসাহিত্যের এই মহারথীদের কবিতার চেয়েও জসীম উদ্দীনের কবিতা তাঁকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল'.।

কবিতাটি কবির ’ রাখালী 'কাব্যে স্থান পেয়েছিল। এ ধরনের কবিতাকে ড্রামাটিক মনোলগ বা একাকী কথন বলা হয়। যদিও গ্রামের এক বৃদ্ধের একে একে সকল প্রিয়জন হারানোর বেদনা কবি জসীম উদ্দীন ' কবর' কবিতায় সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। দীর্ঘ এ কবিতার চরণ সংখ্যা ১১৮। কবিতাটি শোক গাথা হলেও বৃদ্ধের জীবেনর ক্ষণিকের হাসি- আনন্দের অনুভূতি উঠে এসেছে বেদনার মাঝে এ ভাবে ---এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,

পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এক সময় এই বৃদ্ধের যৌবন ছিল আর তার ঘরে এসেছিল ছোট্র নববধূ, তার ছিল সোনার মত মুখ।

বাংলা সাহিত্যে যেসব মর্মস্পর্শী কবিতা আছে, তার মধ্যে 'কবর' একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বেদনা বিধুর অনুষঙ্গ ছাড়াও কবিতাটিতে প্রিয়জনদেরকে ভালবাসার স্মৃতি কাতরতা উঠে এসেছে দুঃখ বেদনায় । গ্রামীণ জীবনের দুঃখ- বেদনা এবং স্নেহ- মমতা আর প্রেম ভালবাসার চিত্র অঙ্কন করেছেন কবি এই কবিতায় গভীর মমতায়। পল্লীজীবনের অসাধারণ ছবি তুলে ধরেছেন স্মৃতিময়তায়।

মানব জীবনের হাসি- আনন্দ, দুঃখ-বেদনার ক্ষণিক বিচ্ছুরণন আলো আঁধারিতে উঠে এসেছে। অপূর্ণ ভালোবাসার হাহাকার কবিতার শব্দগুলোতে ব্যক্ত হয়েছে। মৃত্যু আর শূণ্যতাকে মনে হয় আত্মার আর্তনাদ বলে।
কবিতাটির প্রথম স্তবকেই আড্মার আর্তনাদ যেন আমরা শুনতে পাই।

''এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,

তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।

এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,

পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।

ভালবাসা প্রগাঢ় ভাবে মৃত্যু আর শূন্যতার মিশ্রনে হারিয়ে গেছে। ' এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,''
বেদনার নস্টালজিক অনুষঙ্গ কবি জসিম উদদীন অসাধারণ ভাষায় গভীর মন্ময়তায় চিত্রয়িত করেছেন।

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন কবর ' কবিতাটিতে কাহিনী বর্ণনাকারী এক গ্রামের বৃদ্ধ দাদু। আর শ্রোতা হলো তাঁর নাতি। নাতিকে উদ্দেশ্য করে বৃদ্ধ দাদু তাঁর জীবনের সকল প্রিয়জনকে হারানোর আকুতি ক্রমে ক্রমে ব্যক্ত করেছেন। যে পাঁচজন স্বজন হারানোর ব্যথা বৃদ্ধ দাদু এক এক করে বর্ণনা করেছেন তারা হলেন : বৃদ্ধের স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, নাতনী ও মেয়ে। এরা নাতির দাদী, পিতা, মাতা, বোন ও ছোট ফুপু।

পল্লীকবি জসিম উদদীন বাংলা ভাষায় একক বর্ণনায় য়ে কাহিনী উপস্থাপন করেছেন তা অতুলনীয়।
বৃদ্ধ কৃষকের বয়ানে এদের হাসি- আনন্দ, দুঃখ--বেদনার আর জীবনের সুক্ষ্মাতি সুুক্ষ্ম অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে এ কবিতায়। এগুলো কবিতার পঙ্ তিমালা থেকে তুলে ধরলে বেদনার অনুভূতিগুলো সর্বকালের পাঠকের কাছে ধরা দেবে।
'বাপের বাড়িতে যাইবার কালে কহিত ধরিয়া পা
আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।'

সে সময় দাদুর যৌবন কাল ---, যৌবনবতী দিদিমার বাপের বাড়ি যাবার সময়ের চিরায়ত অনুরোধ ব্যক্ত হয়েছে।' আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান- তলীর গাঁ।’ কবি কতটা সচেতন এটা অনুধাবন করা যায়।
আমাদের বৃদ্ধ দাদু তার যৌবনবতী বৌয়ের দেখতে যাওয়ার আগে শাপনার হাটে তরমুজ বেচি দু’পয়সার করি দেড়ী।পুঁতির মালার একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি।
দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,
সন্ধাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে!' বাঙালির স্বামী - স্ত্রীর চিরন্তন প্রেমপ্রীতি - ভালবাসার শাশ্বত ছবি ফুটে উঠেছে উপরের লাইনগুলোতে।

এই কবিতার প্রথম অংশে কবির মুখ থেকে স্বামী স্ত্রীর ভালবাসার অনুরনন উপলব্ধি করি এই কয়টি লাইন থেকে,যা বৃদ্ধ দাদু নাতির হাসি থামানোর জন্য বলছে, 'হেস না- হেস না- শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে,
দাদি যে তোমার কত খুশি হত দেখিতিস যদি চেয়ে!
কবি জসিম উদদীন বৃদ্ধ কৃষকের যৌবনবতী বউয়ের সে সময়ের অভিব্যক্তি উঠে এসেছে এ কথায়--নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, এতদিন পরে এলে,
পথ পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখিজলে।’

প্রেম ভালবাসার অসাধারণ অনুরনন আমরা লক্ষ করি উপরের লাইন থেকে। এর মাঝেই ' কবর 'কবিতার বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে । বেদনার মাঝেও ভরা যৌবনের নস্টালজিক অনুষঙ্গ যা, আনন্দের উদ্ভাসে সমুজ্জল।
আত্মজনের একটার পর একটা মৃত্যু ¡ বৃদ্ধ দাদুর হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে তুলেছে। নাতির মায়ের মৃত্যু দাদুর হৃদয়কে দুমড়ে মুচড়ে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। নাতির মা বা বৃদ্ধের মেয়ে মারা যাবার আগে তার ছেলেকে ডেকে বলল,'
'বাছারে যাই,
বড় ব্যথা র’ল, দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই;
দুলাল আমার, যাদুরে আমার, লক্ষী আমার ওরে,
কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে।
আমরা বৃদ্ধ দাদুর আত্মজনের বিয়োগ ব্যথার অশ্রু বির্সজনে বর্ণনা বাড়াতে না চেয়ে কবিতার শেষ স্তবকে তিনি নাতিকে কি বলেছেন আমরা দেখবো।
'ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে,
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।'

মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত 'কবর' কবিতাটিতে বিষাদকরুণ ছন্দোময়তার অনুরণন পাঠককে বিষদগ্রস্ত করে।

তিরিশের দশকে যখন ইউরোপীয় আধুনিক কাব্যের আদলে বাংলা কাব্যে আধুনিক কবিতার সূত্রপাত হয় সে সময়ই জসীম উদ্দীন রচনা করেছিলেন 'কবর'। '

জসীম উদ্দীনের জন্ম ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে। এটি ছিল তাঁর নানার বাড়ি। নিজের বাড়ি ছিল গোবিন্দপুর গ্রামে। বাবা আনসার উদ্দীন মোল্লা এবং মা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট। পাঁচ সন্তানের মধ্যে জসীম উদ্দীন ছিলেন চতুর্থ। তাঁদের পরিবারকে কৃষিজীবীই বলা যেতে পারে। যদিও তাঁর পিতা ছিলেন ফরিদপুর হিতৈষী এমই স্কুলের শিক্ষক। কবি যে ঘরে থাকতেন সে বাড়ির সামনে সিঁড়ি, সিঁড়ির দু'দিকে লেবু গাছ, মাঝখানে ডালিম গাছ। এই জায়গাটিই তাঁর 'কবর' কবিতার সৃষ্টির উৎসভূমি। জসীম উদ্দীনের কবি প্রতিভা বিকশিত হয় শৈশবেই।

কবি ছিলেন লোকসংস্কৃতির একান্ত অনুরাগী। তাঁর কবিতা ও গানে এই অনুরাগের ছোঁয়া আছে স্পষ্টই। একসময়ে তাঁর গুরু ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেনের কল্যাণে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে গীতিকা-সংগ্রাহকের দায়িত্ব পান।
জসীম উদ্দীন ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী।

এক শত বছর আগে লেখা পল্লীকবি জসিম উদদীনের 'কবর' কবিতা আজকের দিনেও সমান মর্যাদায় আসীন। তাঁর এ কবিতা কোনদিনই পুরনো হবে না। যুগ যুগ ধরে বাংলা সাহিত্যে পল্লীকবি জসিম উদদীন ' কবর ' কবিতা চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
1

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in



















১৮৩৯ সাল। বছর ছয়েক হল সমাজ সংস্কারক দেশের 'প্রথম আধুনিক পুরুষ' হিসেবে সম্মানিত রাজা রামমোহন রায় প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর আদর্শ থেকে গেছে আর সেই আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত হয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্থাপন করেন 'তত্ত্ববোধিনী সভা'। এই সভার মূল উদ্দেশ্য ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচার হলেও আধুনিক শিক্ষাপ্রণালী, সংস্কৃতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনার দ্বার খোলা থাকত সভায়। এই সভা থেকেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও ব্যবস্থাপনায় বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রথম 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা' প্রকাশিত হয় ১৮৪৩ সালে ১৬ই আগস্ট। এই পত্রিকার সম্পাদক হলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। এই পত্রিকা হল ব্রাহ্মসমাজের তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপত্র। এই পত্রিকার উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মধর্মের প্রচার এবং তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্যদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা। এই পত্রিকায় সে যুগের দিকপালেরা নিয়মিত লিখতেন যাঁদের মধ্যে ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার লেখকগণ ও পৃষ্ঠপোষক সকলেই ছিলেন সংস্কারপন্থী আর লেখকদের লেখার মাধ্যমেই সে যুগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এক নবযুগ। যদিও পত্রিকার মুখ্য উদ্দেশ্য বেদান্ত-প্রতিপাদ্য ব্রহ্মবিদ্যার প্রচার করা হলেও, এই পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা বা সমাজতত্ত্ব সহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর মূল্যবান ও আকর্ষণীয় লেখা। এই পত্রিকায় বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে বাঙালি পাঠককে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হতো। একই সঙ্গে রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য জাতিকে প্রস্তুত করে তুলতে নিজেদের উন্নয়ন ও আত্মগঠনের প্রেরণা জাগানো লেখাও এই পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। এইভাবে তৎকালীন নবজাগরণের সময় বাংলার সংস্কৃতি ও সভ্যতার উন্নতিতে এই পত্রিকা বিশেষ অবদান রেখেছিল। ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলনের প্রচারে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পূর্ববঙ্গে এ পত্রিকার মাধ্যমেই ব্রাহ্মধর্মের প্রসার ঘটে। পত্রিকাটি পড়ে ব্রজসুন্দর মিত্র অনুপ্রাণিত হয়ে ঢাকায় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। সীমিত যোগাযোগ ও কর্মীর অভাব সত্ত্বেও ব্রাহ্মসমাজের কাজে পত্রিকাটি অন্যতম সহায়ক হয়ে ওঠে।

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলোর মান নিরূপণ করার জন্য এশিয়াটিক সোসাইটির আদর্শ অনুসরণ করে গ্রন্থাধ্যক্ষ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির সভ্য ছিলেন পাঁচ স্বনামধন্য ব্যক্তি— ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, আনন্দমোহন বসু, রাজনারায়ণ বসু এবং বিদ্যাসাগরের বন্ধু প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী। বাংলাপিডিয়া থেকে জানতে পারি যে, তত্ত্ববোধিনীতে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো নির্বাচিত হতো পেপার কমিটির মনোনয়নের মাধ্যমে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু, আনন্দকৃষ্ণ বসু, শ্রীধর ন্যায়রত্ন, আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ, প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী, রাধাপ্রসাদ রায়, শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ ছিলেন সেই পেপার কমিটির সদস্যগণ। এখানে উল্লেখ্য যে, কমিটির অন্যতম সদস্য রাধাপ্রসাদ রায় ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের পুত্র আর এই রাধাপ্রসাদ পত্রিকাকে একটি মুদ্রণযন্ত্র দান করেছিলেন।

উনবিংশ শতাব্দীতে সাংগঠনিকভাবে বিজ্ঞান প্রচার ও প্রসারের কাজে অগ্রণী ভূমিকা নেন অক্ষয়কুমার দত্ত। তাঁর হাত ধরেই যেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রাণ প্রতিষ্ঠালাভ করে।

১৮৪০ সালে তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার ভূগোল ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন।তত্ত্ববোধিনী পাঠশালায় পড়াশোনার জন্য তত্ত্ববোধিনী সভার উদ্যোগে তাঁর প্রথম বই 'ভূগোল' প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪১ সালে। এই বইটিকে বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম বিজ্ঞানের বই হিসেবে ধরা হয়। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মাধ্যমে তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান প্রবন্ধ রচনার এক নতুন দিগন্ত ও আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য শাখা যেমন পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ের প্রচুর প্রবন্ধ তিনি রচনা করেন। তাঁর প্রবন্ধগুলো সাধারণ মানুষের কাছে মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলো জানা ও শেখার এক সহায়ক হয়ে উঠেছিল। দেবেন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা শুধু ধর্মচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক। কিন্তু অক্ষয়কুমার চাইতেন এতে বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুক্তিনির্ভর আলোচনা অন্তর্ভুক্ত হোক। শেষ পর্যন্ত অক্ষয়কুমার দত্তের ভাবনাই প্রাধান্য পায়। তাঁর সম্পাদনায় বিজ্ঞান ও যুক্তিসমৃদ্ধ লেখাগুলো প্রকাশিত হওয়ায় বাংলা সংবাদপত্রের মর্যাদা বাড়ে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক বুদ্ধিজীবী আগে বাংলা পত্রিকাকে তুচ্ছ করলেও, তত্ত্ববোধিনীর বিষয়বস্তুর গভীরতা ও মান তাঁদেরও আকৃষ্ট করে।

অক্ষয়কুমার দত্তের মতো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বিজ্ঞান প্রচার ও প্রসারের কাজে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্ত ও পত্রিকার তথা সভার গ্রন্থাধ্যক্ষ কমিটির অন্যতম সদস্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর— দুজনেই ধর্মচিন্তা প্রসারের বিরোধিতার মাধ্যমে নিজেদের বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় দিয়েছিলেন। অক্ষয়কুমারের মতোই বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর ছিলেন এই বাংলায় অন্যতম পথপ্রদর্শক। তাঁর লেখা 'বোধোদয়' ও 'জীবনচরিত' নামে বিজ্ঞানের দুই আকর গ্রন্থ পড়লে ও তাঁর 'ভূগোল খগোল বর্ণনম' সহ বিভিন্ন লেখা পড়লেই তাঁর বিজ্ঞানচর্চার গভীরতা টের পাওয়া যায়। তৎকালীন সময়ে বাল্যবিবাহ রদ ও বিধবার পুনর্বিবাহ প্রচলনের মাধ্যমে তিনি তাঁর বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক সংস্কারকের মানসিকতা প্রকাশ করেছিলেন। বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখির অনুবাদ করেছিলেন বিদ্যাসাগর। অক্ষয়কুমার দত্তের কিছু রচনার সংস্কার ও সংশোধন করে গিয়েছিলেন নিয়মিতভাবে। তত্ত্ববোধিনী সভার বেশ কিছু প্রকাশনা সম্পাদনা করেছিলেন বিদ্যাসাগর। এই যেমন, পশ্বাবলী পত্রিকার দ্বিতীয় সংস্করণের প্রথম অংশে প্রকাশিত অক্ষয়কুমার দত্তের প্রবন্ধগুলো। তাঁর তত্ত্বাবধানে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে অক্ষয়কুমার দত্তের দর্শন ও বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা 'বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার'। এই লেখাটির প্রথম ভাগ বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয় ১৮৫২ সালে ও দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয় ১৮৫৩ সালে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার লেখকদের বিজ্ঞানের লেখা লিখতে শুধু উৎসাহ দিতেন না এমনকি লেখালেখির ব্যাপারে মূল্যবান পরামর্শও দিতেন। তিনি বাংলা ভাষায় পাটিগণিত ও বীজগণিতের বই লিখতে লেখকদের উৎসাহ ও পরামর্শ দিতেন যেমনটা দিয়েছিলেন বাংলা ভাষায় গণিতের বই রচনার পথিকৃৎ প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারীকে বাংলায় বীজগণিতের বই লেখার ব্যাপারে। প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী প্রথম পাটিগণিত ও বীজগণিতের বই লিখেছিলেন। পাটিগণিত বইয়ে শব্দ সংকলনের ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের করা অনেক সাহায্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন আর এই বীজগণিত বইয়েও তিনি বিদ্যাসাগরের কথা লিখেছেন ও তাঁর প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। বিদ্যাসাগর মশাই উৎসাহ ও প্রেরণা জুগিয়েছেন অনেক গণিত তথা বিজ্ঞান লেখককে বাংলায় গণিতের বই লেখার জন্য যাঁদের মধ্যে রয়েছেন গণিত বিজ্ঞান গ্রন্থের লেখক জয়গোপাল গোস্বামী, পাটিগণিতাংকুর বইয়ের লেখক ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, গণিতাংকুর বইয়ের লেখক চন্দ্রকান্ত শর্মা, পাটিগণিত বইয়ের লেখক কালীপ্রসন্ন গঙ্গোপাধ্যায় সহ অনেকেই। দুঃখের বিষয় এই যে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'পরমকারুণিক'

ঈশ্বর-ধারণার সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় তত্ত্ববোধিনী সভার গ্রন্থাধ্যক্ষ কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন বিদ্যাসাগর। আবার, অক্ষয়কুমারের উৎসাহদাতা ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, যাঁর কাছ থেকে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলনে শরিক হন। তাঁর যুক্তিবাদী মন ধর্মের নানা মতবাদকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিল। তিনিও ধর্ম ও দর্শনের পরস্পরবিরোধী তত্ত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলেন আর যার ফলে ১৮৫৫ সালে ব্রাহ্ম ধর্ম ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ত্যাগ করেন। তত্ত্ববোধিনী সভা ত্যাগ করার পর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা ও বাংলায় বিজ্ঞানের লেখার জন্য উৎসাহ যেমন থেমে যায়নি ঠিক তেমনি অক্ষয়কুমার দত্ত ও রচনা করে গেছেন বাংলায় বিজ্ঞানের নানা লেখা ও বই। ১৮৫৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর লেখা বিজ্ঞানের বই 'পদার্থবিদ্যা'। এক সময় সভার প্রতিষ্ঠাতা দেবেন্দ্রনাথের ধর্মমতের পরিবর্তন ঘটে এবং তাঁর সঙ্গে সভার পরিচালকদের অনেক বিষয়ে মতানৈক্য হয় আর এই মতানৈক্যর ফলে ১৮৫৯ সালের মে মাসে তত্ত্ববোধিনী সভা উঠে যায়। এর সঙ্গে পেপার কমিটিও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা পরিচালনা ও বই প্রকাশনার দায়িত্ব পড়ে কলকাতা ব্রাহ্মসমাজের ওপর। অক্ষয়কুমার দত্তের পরে বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অযোধ্যানাথ পাকড়াশী, হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ এই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ১৯৩২ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে৷

অক্ষয়কুমার দত্ত ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর—দুজনেই ছিলেন আদ্যন্ত বিজ্ঞানপ্রেমী ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। এ'বছর বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথপ্রদর্শক এই দুই নমস্য ব্যক্তির ২০৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে দুজনের প্রতি রইলো সশ্রদ্ধ প্রণাম আর সেই সাথে স্মরণ করি ১৮২ বছর আগের এই বাংলায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোর দিশারী 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'-কে।


তথ্যসূত্রঃ–
বাংলাপিডিয়া,
উইকিপিডিয়া (বাংলা ও ইংরেজি),
বিদ্যাসাগরের বিজ্ঞান ভাবনা– ড. রবীন্দ্রনাথ পাত্র, অক্ষর পাবশিকেশনস্, ত্রিপুরা।
1

প্রবন্ধ - অনিরুদ্ধ গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in









আমাদের সময়ের কবি লিখেছেন –

বৃষ্টি এলেই আসবে কফি, কান টানলে মাথা
এক বিকেলে অফিস কেটে ঝুপ্পুস কলকাতা
আলতো ভাপে নাম লিখেছি কফি শপের কাচ
মেঘ যদি না ডাকে, তোমার আসতে বারণ আছে।


সত্যিই, মেঘলা দিনের প্রত্যাশী মন হোক, বা ল্যাপটপে চোখ আটকানো কাজের ব্যস্ত সময়, রাত জাগা পড়ার টেবিলেই হোক, কি চোখজুড়োনো পাহাড়ী দৃশ্য সামনে নিয়ে হোটেলের বারান্দা, বা বন্ধুসমাগমে নেহাতই অবসরের আড্ডা, এক ধুমায়িত কাপ কফি এখন আমাদের প্রায় অবশ্যম্ভাবী সঙ্গী হয়ে উঠেছে। মান্না দে যদিও সেই ১৯৮৩ সালে গেয়েছিলেন, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’, সে কেবল এক প্রজন্মের আক্ষেপ। পরের প্রজন্মরা আজও কফি হাউস মাতিয়ে রেখেছে। তার সাথে সাথে আনাচে কানাচে বিস্তার ঘটেছে, যাকে আজকাল বলা হয়, তৃতীয় লহরের কফি শপ বা ক্যাফে সংস্কৃতি। আসুন. এক কাপ কফি নিয়ে বসে একটু আড্ডা মারা যাক সেই কফি নিয়েই। ভারতের কফি।


উৎপাদন, রপ্তানি এবং আভ্যন্তরীন চাহিদা – এই সব দিক দিয়েই এখন আমাদের দেশে কফির রমরমা। ভারতে কফির উৎপাদন এবং ব্যবসার উন্নয়নবর্ধক স্বায়ত্বশ্বাশক সংস্থা কফি বোর্ডের প্রধান নির্বাহক বলছেন, ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরে দেশে কফির উৎপাদন ৩.৬ লক্ষ মেট্রিক টন হবার সম্ভাবনা, এবং পরের বছর তা আরও বাড়বে। ঐ বছরেই ভারত ১৫,৪০০ কোটি টাকার কফি রপ্তানি করেছে, তার মধ্যে প্রায় ৯,৫০০ কোটি টাকার কফি কেবল মাত্র কর্নাটক থেকে। কফি আবাদীরাও খুশী। এ বছর রোবাস্টা কফির ৫০ কেজির বস্তার জন্য তাঁরা ১২,০০০ থেকে ১৫,০০০ টাকা পেয়েছেন। মাত্র দু বছর আগেও তাঁরা পেতেন মেরেকেটে ৫,০০০ টাকা। তবে এই স্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হবার সম্ভাবনা কম। পৃথিবীতে উৎপাদন ও চাহিদায় ব্রাজিল অগ্রগণ্য দেশ। তারপর ভিয়েতনাম, কলম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া। গত বছর প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য ব্রাজিলের উৎপাদন বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের উৎপাদন বর্ধিত বিশ্বব্যাপী চাহিদা পূরণ করতে যথেষ্ট নয়। এই পরিস্থিতির সুবিধা পেয়েছেন ভারতের উৎপাদকরা। ব্রাজিল স্বমহিমা ফিরে পেলে চাকা ঘুরতে পারে। ভারতে উৎপন্ন কফির ৭০ শতাংশই রপ্তানি হয়ে থাকে।


ভারতে পানীয় হিসেবে কফির ব্যবহারের সব থেকে প্রাচীন বিবরণ পাওয়া যায় সপ্তদশ শতাব্দীতে। জাহাঙ্গীরের রাজসভায় ইংরেজ রাজার রাষ্ট্রদূত স্যার টমাস রো সাহেবের চ্যাপলেইন রেভারেন্ড এডোয়ার্ড টেরী আনুমানিক ১৬১৬ সালে একটি স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন:

“সেখানে অনেক মানুষই অত্যন্ত কঠোরভাবে তাঁদের ধর্মাচরণ পালন করেন এবং কোন রকম পানাসক্তি থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু একটি পানীয়, যাকে তাঁরা কফি বলেন, তাঁরা পান করেন, যা উপাদেয় তো বটেই, তারও বেশী স্বাস্থ্যকর। এক ধরণের কালো রঙের বীজ জলে সেদ্ধ করে এটি বানানো হয়, যার থেকে জলও সেই রঙ ধারণ করে, কিন্তু জলের স্বাদ সামান্যই পরিবর্তিত হয়। অথচ পাচনশক্তি বাড়ায়, শরীরে উদ্দীপনা আনে এবং রক্ত পরিশোধনেও সাহায়্য করে।“


কফি পানের প্রচলন হলেও এ দেশে কফি চাষের সূচনা তখনও হয়নি। তা শুরু হয় আরো কিছু বছর পরে, আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে। এই সম্পর্কে একটি মজার কাহিনী আছে।


কফি বিষয়ে গবেষকরা বলেন, সম্ভবত আফ্রিকাতে ইথিওপিয়ায় কফির প্রথম উৎপাদন শুরু হয়। সেখানে কলদি নামের এক ছাগপালক লক্ষ্য করেন, তাঁর ছাগলগুলি একটি বিশেষ উদ্ভিদের ফল খেয়ে অত্যন্ত তেজী আচরণ করছে। তখন তিনি এই গাছগুলি আবাদ করে তার ফল থেকে পানীয় প্রস্তুতি শুরু করেন। সেই ছিল কফির প্রথম মনুষ্যকৃত উৎপাদন ও ব্যবহার। ষোড়শ শতাব্দীতে কফি আরব দেশে ও পরে ইওরোপে প্রসার লাভ করে। সপ্তদশ শতকে আরব বা য়েমেন হয়ে উঠেছিল কফি রপ্তানির প্রধান কেন্দ্র। সে সময় আবার ভারত ছিল মধ্যপ্রচ্যে মশলাপাতি রপ্তানির শীর্ষে। ধরে নেওয়া যায়, তখন য়েমেন থেকে সমুদ্রপথে আরবসাগর হয়ে বা স্থলপথে পারস্যদেশ হয়ে কফির বীজ ভারতে আমদানী হতো। কিন্তু তা চাষের উপযুক্ত ছিল না। তার কারণ য়েমেন থেকে কফির বীজ শুধুমাত্র তাপে সেঁকা (roasted) বা সেদ্ধ অবস্থায় ছাড়া আর কোন ভাবে দেশের বাইরে পাঠানো নিষিদ্ধ ছিল। এর অন্যথা করে ধরা পড়লে কঠোর শাস্তি, এমন কি মৃত্যুদন্ডও, দেওয়া হত। এইভাবে য়েমেন কফির উৎপাদন ও ব্যবসা নিজেদের কুক্ষিগত ও একচেটিয়া করে রেখেছিল।


সেই সময় দক্ষিণ ভারতে এক সুফি সন্ত ছিলেন হজরত শাহ জামের আল্লাহ মাজরাবি। তাঁর অনুগামীদের কাছে তিনি বাবা বুদান নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে, সম্ভবত ১৬৭০ থেকে ১৬৯০ সালের মধ্যে কোন সময় তিনি হজ তীর্থভ্রমণে মক্কা গিয়েছিলেন। ফেরবার পথে তিনি আসেন য়েমেনের বন্দর শহর মোচাতে। সেখানে কফির বাড়বাড়ন্ত দেখে, এবং তার বীজ থেকে বানানো ‘কাহবা’ (পানীয়, যার অপভ্রংশ থেকে সম্ভবত কফি নামের উৎপত্তি) পান করে তিনি বিশেষ প্রভাবিত হন। কফির চাষ পদ্ধতি থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত কিভাবে পানীয় প্রস্তুত করা হয়, ইত্যাদি বিশদ বৃত্তান্ত অধ্যয়ন করে তিনি স্থির করলেন, ভারতে এই বস্তুটির কৃষিকাজ প্রয়োজন। কিন্তু তার জন্য চাই কাঁচা ফল বা বীজ যার চালান নিষিদ্ধ। অতএব আল্লাহকে স্মরণ করে তিনি করে বসলেন এক দুঃসাহসিক কাজ। ইসলাম ধর্মে সাত সংখ্যাটির মাহাত্ম্য আছে, এই সংখ্যাকে মঙ্গলকারী বা পয়মন্ত মনে করা হয়। তিনি সাতটি কফির বীজ তাঁর দাড়ির মধ্যে কোন প্রকারে লুকিয়ে রাখলেন। মতান্তরে তিনি তাঁর লাঠির ফাঁপা অংশে ঐ সাতটি বীজ লুকিয়েছিলেন। সংখ্যার মাহাত্ম্য বা তাঁর দাড়ির ঘনত্ব, যার জোরেই হোক, তিনি য়েমেনের সিকিউরিটি চেক নিরাপদে অতিক্রম করে দেশে ফিরে আসেন। অবশেষে নীলগিরি পর্বতমালার চন্দ্রগিরি পর্বতে তিনি ওই সাতটি অঙ্কুরিত কাঁচা বীজ রোপন করলেন। সময়ে গাছ বেরোল, ফুল ধরল, এবং অনেক ফলও উৎপন্ন হোল। তার বীজের অংশ পুনরায় রোপন করে আরও গাছ হল। এইভাবে ভারতে শুরু হল কফি চাষের প্রারম্ভ এবং বিস্তার। বাবা বুদানকে তাই দেশে কফি চাষের জনক বলা হয়।


এই গল্প সত্য বা নিছক লোক কাহিনী হতে পারে। কিন্তু বাবা বুদান এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। অধুনা কর্নাটকের চিকমাগালুরু জেলায় যে পর্বতে তিনি কফির চাষ করেছিলেন বলে কথিত আছে, তা এখন বাবা বুদান গিরি নামে পরিচিত। এই পাহাড়ে তাঁর মাজারও আছে, সেখানেই তাঁকে এবং তাঁর অনুগামী আরও দুজন সুফি সন্তকে হত্যা করা হয়। এই স্থানকে দত্তত্রেয় বাবা বুদান পীঠ বলা হয়। দত্তত্রেয় ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের যুগ্ম অবতার বলে মান্য একজন ঋষির নাম, তার সঙ্গে বাবা বুদানের কী যোগ ? যে গুহা দত্তত্রেয়র ধ্যানস্থল ছিল, সেখানেই বাবা বুদানও প্রার্থনা করতেন বলে কথিত আছে। দত্তত্রেয় অবধুত প্রথার অংশ। সব রকম আচার, বিধি, সংস্কার থেকে বিরত হয়ে এক নিরাকার ঈশ্বরের সাধনা, নিরাড়ম্বর, অহিংস জীবনযাপন এই প্রথার মূল দর্শন। সুফি তত্ত্বের সঙ্গে তার সাযুজ্য দেখা যায়। তাই দত্তত্রেয় বাবা বুদান গিরি দুই সম্প্রদায়েরই পীঠস্থান।


যাই হোক। ফিরে আসি কফির কথায়। ভারতে কফির চাষ অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রধানত ওলন্দাজদেরই নিয়ন্ত্রণে ছিল। তাঁরা মূলত নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী কফির আবাদ করতেন। ইংরেজদের আগমন ও ক্রমান্বয়ে প্রাধান্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে কফি চাষেও তাঁদের অংশীদারী বাড়লো। বেশী জমি-জায়গায় কফির চাষ হতে লাগলো এবং উৎপাদনও বাড়লো। কারণ ইংরেজরা ব্রিটেন এবং ইওরোপের অন্য অনেক দেশে ভারতে উৎপন্ন কফি বীজ রপ্তানিও শুরু করে।


স্বাধীনতার পর কফি ক্ষেত্রের মালিকানা পূর্ণভাবে ভারতীয়দের হাতে আসে। দেশে কফির উৎপাদন ও বিপণনে নিয়ন্ত্রণ ও সহায়তার জন্য স্বাধীনতার আগেই ১৯৪২ সালে ভারত সরকার ভারতীয় কফি বোর্ড স্থাপন করেছিল। এটি একটি স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা হলেও বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রকের অধীনস্থ। উৎপাদন ও রপ্তানির ব্যাপারে কফি উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের নানা রকম বিধিনিষেধের আওতার মধ্যে চলতে হত। যার ফলে উৎপাদন পরিসংখ্যানে অনেক বছর পর্যন্ত তেমন চমকপ্রদ কোন উন্নতি দেখা যায়নি। নব্বই দশকের মাঝামাঝি অর্থনৈতিক উদারীকরণ প্রক্রিয়ার পর, বিশেষ করে রপ্তানি এবং মূল্য ধারণের ক্ষেত্রে উৎপাদকরা অনেক স্বাধীনতা লাভ করেন। ফলত, উৎপাদন, ব্যবসা এবং লভ্যাংশও ক্রমবর্ধমানভাবে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।


কফি চাষের জন্য কতকগুলি বিশেষ পরিমন্ডলের প্রয়োজন। কফির প্রকারভেদে আবশ্যিকতা ভিন্নতর হলেও, সাধারণভাবে কয়েকটি প্রয়োজনীয়তা উল্লেখযোগ্য। মোটামুটিভাবে বলা যায়, মাঝারি ঢালু জমি, যেখানে জল বাহিত হয়ে নেমে যেতে পারে, জৈব সার সমৃদ্ধ উর্বর জমি, ১৫ থেকে ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা, ১৬০-১৭০ সেমি গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত, ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ আর্দ্রতা, এবং সমুদ্রস্তর থেকে ৭০০-১৫০০ মিটার উচ্চতা কফি চাষের জন্যে উপযুক্ত।


এই সব আবশ্যিকতার পরিপূরক জায়গা হল পশ্চিম ঘাট পর্বতমালা। তাই ভারতের কফি চাষের সিংহভাগ এই অঞ্চলেই হয়। দেশে যত কফি উৎপাদন হয়, তার ৭১ শতাংশ আসে কর্নাটকের নীলগিরি পর্বতশ্রেণীর উপত্যকায় অবস্থিত কোড়াগু বা কূর্গ, চিকমাগালুরু ও হাসান জেলা থেকে। এদের মধ্যে আবার একা কোড়াগু জেলাই ৩৩ শতাংশের অংশীদার। কেরালা (২১%) ও তামিল নাড়ু (৫%) অন্য দুই প্রধান উৎপাদক রাজ্য। এ ছাড়া উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতেও কফির আবাদি হয়। এখন অন্ধ্র প্রদেশ এবং ওড়িশাতেও পূর্ব ঘাট পর্বতাঞ্চলের উপত্যকাভুমিতে কফি উৎপাদন হচ্ছে।

বাবা বুদান গিরি

বড় বৃক্ষের ছত্রছায়ায় কফি গাছের চাষ

আমাদের দেশে কফি প্ল্যান্টেশনগুলির শ্যামলিমা এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। এখানে কফি গাছ রোপন করা হয় অন্য বড় বৃক্ষের আচ্ছাদনের (canopy) নীচে। কফি বাগানগুলিতে দেখা যাবে অনেক ফল এবং নানা রকম শিম গোত্রের ছায়া প্রদানকারী গাছ, তার সঙ্গে এলাচ, দারচিনি, তেজপাতা, লবঙ্গ, জায়ফল, গোলমরিচ ইত্যাদি মশলার গাছ কফির গুল্মদের ছত্রছায়া বিস্তার করে যেন সুরক্ষা প্রহরীর মত অবস্থান করছে। এই সব গাছ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতাই শুধু নিয়ন্ত্রণ করে না, এদের শুখনো ফুল-পাতা, এবং এই সব বৃক্ষ যে পাখীদের আকর্ষণ করে আনে, তাদের বর্য্যপদার্থ, মাটিকে জোগায় প্রয়োজনীয় জৈব সার, রোধ করে মাটির অবক্ষয়। সরাসরি সূর্যালোক না পাওয়ায় ফলগুলি বেশী বাড়ে না, কিন্তু ফলন পর্যাপ্ত হয়। ভারতই প্রধান দেশ যেখানে এই অনন্য পদ্ধতিতে কফি চাষ হয়। এই কফির গুণগত মানও উচ্চ, এর অম্লতা কম, সুবাস ও স্বাদ আকর্ষণীয়।


ভারতে প্রধানত দু’ ধরণের কফির চাষ হয়ে থাকে, প্রথমটি আরবিকা, এবং অন্যটি হল রোবাস্টা। এ ছাড়াও সময়ের সাথে কিছু ভিন্ন প্রজাতির বা সঙ্কর গোত্রীয় কফির উৎপাদন সীমিতভাবে হলেও আরবিকা ও রোবাস্টা বা তাদের জ্ঞাতিবর্গের কফিরই মুখ্যভাবে আমাদের দেশে চাষ হয়।


আরবিকাই আদি কফি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইওরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ায় যে কফি ছড়িয়ে পড়েছিল, এবং বাবা বুদান যা ভারতে প্রথম উৎপন্ন করেছিলেন, তা এই আরবিকা। এর গাছগুলি ১৫ ফিট পর্যন্ত বেড়ে উঠতে পারে, কিন্তু বাণিজ্যিক সুবিধার্থে ৬ ফিটের মত উচ্চতায় ছেঁটে দেওয়া হয়। আরবিকার বীজে অম্লতা ও ক্যাফেইনের পরিমান কম। স্বাদে মসৃণ, কড়া ভাব কম, কতকটা মিঠাপন আছে। গন্ধে হালকা চকোলেট বা এক ধরণের ফলজাতীয় সুবাস পাওয়া যায়। অন্য দিকে রোবাস্টা (যার আসল বৈজ্ঞানিক নাম ক্যানেফোরা) গাছ উচ্চতায় আরবিকার দ্বিগুণ হতে পারে। এর বীজে ক্যাফেন ও অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টের পরিমান বেশী। স্বাদে তীব্রতা ও ঈষৎ তিক্ততা বিদ্যমান। গন্ধে যেন রবারের আভাস পাওয়া।


রসিকদের কাছে আরবিকাই কৌলীন্য অর্জন করলেও রোবাস্টাও পিছিয়ে নেই। বিশ্বের ৬০ শতাংশ উৎপাদন আরবিকার হয়ে থাকে। ভারতেও ফলনের হিসেবে ঐতিহ্যগতভাবে আরবিকাই প্রাধান্য পেয়ে এলেও গত দেড়-দু দশকে রোবাস্টা তাকে অতিক্রম করে এখন সিংহভাগ, প্রায় ৭০ শতাংশ, লাভ করেছে। তার কারণ আছে। আরবিকার গাছ স্বভাব-চরিত্রে একটু কমনীয়, বলা যায় পলকা ধরনের। এর ফলগুলির সংক্রমণ এবং কীটের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। গত শতাব্দীতে এক ধরণের সংক্রমণ ভারত সহ বিশ্বের অনেক দেশে একাধিকবার আরবিকার ফলন নষ্ট করে দেয়। অন্য দিকে, অ্যাসিডিটি বা অম্লতা এবং অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট অধিক পরিমানে থাকার জন্য রোবাস্টা রোগ প্রতিরোধে অনেক শক্তিশালী। একই ক্ষেত্রফলের এলাকায় রোবাস্টা আরবিকার তুলনায় বেশী ফল যোগায়। এবং আরবিকার জন্য ঢালু জমি অপরিহার্য হলেও রোবাস্টা কিন্তু কম ঢালু , বা অনেক জায়গায় সমতল জমিতেও বেশ বেড়ে ওঠে।


কফি একটি বার্ষিক ফসল, এর ফলন বছরে একবারই হয়। গাছগুলিতে প্রথমবার ফুল আসতে তিন-চার বছর লাগে, কিন্তু তার পর ষাট বছর পর্যন্তও ফসল উৎপন্ন করে যেতে পারে। আমাদের দেশে ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাস কফি গাছে প্রস্ফুটনের সময়। এই সময়ে গাছগুলিতে থোকা থোকা সাদা ফুল আসে, সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। অনেকটা জুঁই ফুলের মত দেখতে এই ফুলগুলির হালকা সুবাসও অনেকটা জুঁইয়ের মত। প্ল্যান্টেশনগুলিতে এ সময়ে যাঁরা প্রথমবার কফি ফুলের শোভা দেখবেন এবং গন্ধ আঘ্রাণ করবেন, তাঁদের অনেকের কাছেই এগুলি বুনো জুঁইয়ের উদ্দাম প্রগলভতা বলে ভ্রম হতে পারে। সময়মত এবং পর্যাপ্ত ফুল আসার জন্য জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসে বৃষ্টিপাতের প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জলবায়ুর ক্রমবিবর্তনের ধাক্কায় প্রধান কফি অঞ্চল দাক্ষিণাত্যে এই বর্ষণ আজকাল সব সময় নির্ভরযোগ্য নয়। তাই ইদানীং প্ল্যান্টেশনগুলিতে দেখা যাবে স্প্রিঙ্কলারের সাহায্যে জল ছিটিয়ে কৃত্রিম বর্ষণ উপায়ে সেচন করা হয়।

কফির ফল
  কফি বীজ

কফি ফুলের শোভা




কফি ফুলগুলির আয়ু মাত্র তিন-চার দিন। তারপর তাদের পাপড়ি একে একে ঝরে পড়ে। তবে তার আগেই ফুলের বাহারে-গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ছুটে আসে মৌমাছি আর পিঁপড়ে ইত্যাদি পোকামাকড়। পরাগায়ন অর্থাৎ pollination প্রক্রিয়ায় এদের ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য আরবিকার ক্ষেত্রে স্ব-পরাগায়ন সম্ভব, কারণ এদের ফুলে দু’ ধরণের ক্রোমোজোমই বর্তমান। রোবাস্টার জন্য পারস্পরিক পরাগমিলন বা cross pollination জরুরী। দেখা গেছে মৌমাছিদের বদান্যতায় দু’ ধরণের কফিতেই কিন্তু ফলন বৃদ্ধি পায়। তাই অনেক কফি উৎপাদকরা আবার মৌ-পালনও করে থাকেন। কফি ফুলের পাপড়ি থেকেও এক প্রকার চা তৈরী হয়। ফুলের পাপড়িগুলি ঝরে গেলে দেখা যায় ছোট্ট সবুজ রঙের গুটির মত ফলের আবির্ভাব। এই ক্ষুদ্র সবুজ ফলগুলি ধীরে ধীরে পরিনত হয়ে লাল, হলদেটে-লাল বা চেরি ফলের মত বেগুনি রঙ ধারণ করে, আকারেও বেড়ে ওঠে। এই অবস্থায় গুচ্ছ গুচ্ছ ফল সমারোহে গাছগুলির শোভাও এক দেখবার মত দৃশ্য। কফি ফলের পরিপক্কতার প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ। আরবিকার ক্ষেত্রে লাগে প্রায় সাত মাস, আর রোবাস্টার জন্য প্রায় ন’ মাস। কফির ফলকে cherry, berry এবং বীজগুলিকে beans বলা হয়ে থাকলেও এরা কিন্তু এদের গোত্রীয় নয়। চেরি বা বেরী ফলে মাত্র একটি করে বীজ থাকে, শতকরা ৯০ ভাগ কফির ফলেই থাকে দুটি করে বীজ। আর বীজগুলি মোটেই bean বা শুঁটি জাতের ফসল নয়।


ফল পাকবার পর সেগুলি বেছে বেছে আহরণ করে সংগ্রহ করাও শ্রমসাধ্য ব্যাপার, এবং আমাদের দেশে অধিকাংশত তা মানবিক শ্রমভিত্তিক। এই সব প্রক্রিয়া প্রতি বছর অনেক মানুষের কর্মসংস্থান করে। যাই হোক, এর পর আসে ফল থেকে বীজ নিষ্কাশনের পর্যায়। প্রধাণত দুই পদ্ধতিতে তা হয়ে থাকে। প্রথমটি প্রাচীন এবং আদি উপায়। একে বলা যায় শুষ্ক পদ্ধতি বা dry process। ফল সংগ্রহের পর পরিষ্কার করে ধুয়ে নিয়ে তা ছড়িয়ে বিছিয়ে দেওয়া হয় রোদে শুখানোর জন্য। কোড়াগু বা চিকমাগালুরের কফি এস্টেটগুলিতে গেলে ঘরে ঘরে দেখতে পাওয়া যাবে সমতল খালি জায়গা বা উঠোন যেখানে কফি ফল শুখানো হয়। পর্যাপ্ত সূর্যালোক পেলে প্রায় চার সপ্তাহ লাগে সঠিক শুষ্কতা আনতে, অর্থাৎ ফলগুলিতে জলের আর্দ্রতা ৬৫-৭০ শতাংশ থেকে ১২-১৩তে কমিয়ে আনতে। খুব বেশী শুখিয়ে ফেললে আবার বীজ ভঙ্গুর হয়ে যায়। এর পর যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফলের খোসা, শাঁস ইত্যাদি বাদ দিয়ে বীজ বার করে আনা হয়। যে সব অঞ্চলে সূর্যালোক এবং উত্তাপ সহজপ্রাপ্য নয়, সেখানে এই পদ্ধতি চলে না। সে সব জায়গায় বীজ নিষ্কাশনের প্রক্রিয়াকে বলা হয় আর্দ্র পদ্ধতি বা wet process। এই পদ্ধতি অনেকটাই যান্ত্রিক এবং বেশী ব্যয়সাপেক্ষ, তবে নাকি এতে করে বীজের গুণগত মানও বজায় থাকে বেশী। অধিকাংশ আরবিকা বীজ এই পদ্ধতিতে নিষ্কাশন করা হয়। এখানে পাকা ফল না শুখিয়ে শাঁসালো অংশ আগেই যান্ত্রিক উপায়ে অপসৃত করা হয়। তার পরও একটা পাতলা আবরণ বীজের গায়ে লেগে থাকে। সেটিকে প্রাকৃতিক এনজাইমের সাহায্যে একটি আধার বা ট্যাঙ্কের মধ্যে দু-তিন দিন রেখে ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়ায় সরিয়ে ফেলা হয়। এর পর বীজগুলি ভালো করে ধুয়ে নিয়ে রোদে বা গরম হাওয়া চালিয়ে শুখানো হয়। বীজের বাইরের শুখিয়ে যাওয়া অংশ, যাকে বলা হয় পার্চমেন্ট, তা যান্ত্রিক উপায়ে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। কাঁচা বীজকে অভিপ্রেত শুষ্কতায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়াকে বলা হয় সেঁকানো বা roasting।


এই দুই পদ্ধতি ছাড়া আর এক, একটু অদ্ভুত, উপায়েও কফি ফল থেকে বীজ বার করার চলন আছে, তবে খুবই সীমিত পরিসরে। আমাদের দেশে এবং দক্ষিণ এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশে বিড়াল প্রজাতির এক জন্তুর নাম Asian palm civet, যাদের বাংলায় বলা হয় গন্ধগোকুল বা খাট্টাস। অরণ্যবাসী এই নিশাচর প্রাণীটি অন্য ছোট জীব শিকার করে খেলেও পাকা ফলই এদের প্রিয় ও প্রধান খাদ্য। এরা বেছে বেছে কফির পাকা ফল খেয়ে তার শাঁসালো অংশ নিপূণভাবে হজম করে ফেলে। তারপর অপাচ্য বীজগুলি তাদের বিষ্ঠার সঙ্গে বর্জ্য পদার্থ হিসেবে বেরিয়ে আসে। সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে নিষ্কাশিত এই বীজ সংগ্রহ করে যথাযথ ভাবে পরিশোধন করে নেওয়া হয়। শুনতে বিদঘুটে লাগলেও কফির দুনিয়ায় সিভেট কফি একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পণ্য, এর মুল্যও বেশ ভারী।


ব্রিটিশদের সময় থেকেই কফি বীজ ভারত থেকে ইওরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো, সে যুগে সমুদ্রপথে কাঠের আধারে করে। কেপ অব গুড হোপ বা উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ইওরোপ পৌঁছতে লেগে যেত প্রায় ছ’ মাস। এই দীর্ঘ সময়ে সাগরের লবনাক্ত আর্দ্র পরিমন্ডল, বিশেষ করে বর্ষণসিক্ত জলহাওয়া, কফির বীজগুলিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটাতো। আর্দ্রতা শোষণের ফলে বীজগুলি হয়ে উঠতো আকৃতিতে স্ফীত, রঙে ফেকাসে। অম্লতা অনেকাংশে হ্রাস পেতো। এর থেকে যে পানীয় তৈরী হতো, তার স্বাদে কড়া ভাব ও তিক্ততা কম হতো এবং মসৃনতা বৃদ্ধি পেতো, আর তা ছিল সাহেবদের বেশ পছন্দ। উত্তরোত্তর পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমাগত উন্নতি ঘটার ফলে যাত্রার সময় কম হয়ে আসার কারণে বীজের মধ্যে সেই পরিবর্তন আর রইলো না। ভারতীয় কফির জনপ্রিয়তা পশ্চিমে কমতে শুরু হলো। আমাদের দেশের রপ্তানিকারকরা তখন এক অভিনব পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন। চালান করার আগে পশ্চিম উপকুলের সামুদ্রিক পরিবেশে প্রাকৃতিক হাওয়া চলাচল করতে পারে এমন সব গুদামে বাছাই করা বীজ এখন বর্ষাকালে ১২ থেকে ১৬ সপ্তাহ রেখে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে লব্ধ কফিকে বলা হয় Monsoon Malabar Coffee এবং এই কফি এখন ভারতের ভৌগলিক ইঙ্গিত (geographical indication) পণ্য আইনে সংরক্ষিত।


রোস্টিংয়ের পর বাজারজাত হবার আগে কফি প্রায়শই আরও একট পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যায় যাকে বলা হয় সংমিশ্রণ বা blending। প্রজাতি, উৎপত্তিস্থল এবং কৃষিপদ্ধতির ওপর নির্ভর করে প্রত্যেক শ্রেণীর কফির গুণগত বৈশিষ্ট্য আছে, স্বাদ-গন্ধের অনন্যতা লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন ধরণের কফিকে নির্দিষ্ট শতাংশে ভালোভাবে মিশ্রিত করাই blending । এতে মিশ্রিত কফির মধ্যে প্রত্যেক বীজের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের সুষম মিলন ঘটিয়ে, বলা যায়, নতুন রকমের গুণগত এক এক কফি নির্মিত হয়। এই মিশ্রণ আরবিকা ও রোবাস্টার হতে পারে, আবার ব্রাজিলের আরবিকার সঙ্গে কলম্বিয়ার আরবিকার হতে পারে, বা ভারতের ও ইন্দোনেশিয়ার রোবাস্টার সঙ্গে পশ্চিমের আরবিকার হতে পারে, এবং বিভিন্ন শতাংশেও হতে পারে। এমন কতই মিশ্রণ ঘটিয়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কফি বাজারে আসে।


চিকোরি ফুল ও শিকড়



কফি বীজের সংমিশ্রন (blending) হচ্ছে

কফি যখন গুঁড়ো পাউডার হয়ে বাজারে আসে, তখন প্যাকেটের ওপর আরেকটি উপাদানের উল্লেখ আপনারা দেখতে পাবেন। এর নাম চিকোরি। এই চিকোরি বস্তুটি কী ? এটি একটি উদ্ভিদের নাম। এর ফুলগুলি নীল রঙের, পাতায় ও শিকড়ে ওষধিগুণ আছে বলে সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই ব্যবহৃত হবার উল্লেখ পাওয়া যায়। কফি পাউডারে যা মিশ্রণ করা হয় তা এর শিকড়। শিকড়কে শুখিয়ে গুঁড়ো করে কফি পাউডারের মতই দেখতে খয়েরী রঙের একটি চূর্ণ পাওয়া যায়। স্বাদেও কফির মত বলে, ঐতিহাসিক সময়ে যখনই কফি মহার্ঘ্য হয়েছে, যেমন আমেরিকার গৃহযুদ্ধ, বা বিশ্বযুদ্ধ, বা পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক আকালের সময়ে, বিকল্প হিসেবে অথবা মিশ্রিত করে চিকোরি কফির পরিপূরক স্থান পেয়েছে। এখন কফি পাউডারে কিছু শতাংশ চিকোরি মিশ্রণ প্রায় অনিবার্য। এমনিতে এর স্বাদ বেশ তিক্ত এবং এক ধরণের কেঠো গন্ধ আছে। কিন্তু কফির সঙ্গে মেশালে কফির স্বাদে বলিষ্ঠতা এবং গভীরতা এবং গন্ধে নতুন মাত্রা আনে। প্রধাণত ভুমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলিতে পাওয়া গেলেও এখন বিশ্ব জুড়েই চিকোরির আবাদ হয়।


এবার একটু জানা যাক কফির পানীয় প্রস্তুত করার প্রণালী বা brewing সম্বন্ধে। কফি নির্যাস বানানোর জন্য প্রয়োজন একটি আধার যার মধ্যে থাকে একটির ওপর আরেকটি রাখা তিনটি প্রকোষ্ঠ। সব থেকে সরল এবং পুরোনো পদ্ধতি হল ভারাকর্ষণ বা gravity পদ্ধতি। একটি ছাঁকনি অথবা ফিল্টার কাগজের ওপর গুঁড়ো কফি মাঝের প্রকোষ্ঠে রেখে ওপর থেকে ধীরে ধীরে গরম জল ঢালা হয় যা কফির ভেতর দিয়ে বাহিত হয়ে নীচে রাখা পাত্রে চুঁইয়ে চুঁইয়ে বিন্দু বিন্দু জমা হয়। এই তরলকে বলা হয় decoction। দক্ষিণ ভারতে গরম দুধ ও চিনির সঙ্গে মিশিয়ে ঘরে ঘরে এই ‘ফিল্টার কাপি’ পানের চলন বহুকাল থেকেই সমানভাবে জনপ্রিয়। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে ওপরের প্রকোষ্ঠে পিস্টন দিয়ে চাপ সৃষ্টি করে গরম জলকে অপেক্ষাকৃত দ্রুত বেগে কফি পাউডারের ভেতর দিয়ে তলার প্রকোষ্ঠে পাঠানো হয়। একে বলে French press প্রণালী। এতে নাকি কফির ক্যাফেন, অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট ইত্যাদি গুণগত আবশ্যিক উপাদানগুলি নির্যাসের মধ্যে অধিক মাত্রায় মজুদ থাকে। আর একটি পদ্ধতিতে নীচের প্রকোষ্ঠে জল ফোটানো হয়। বাষ্প হয়ে কফি পাউডারের মধ্যে দিয়ে পরিচালিত হয়ে ওপরের প্রকোষ্ঠে ওঠে এবং ক্রমে ঠান্ডা হয়ে নির্যাস হয়ে জমা হয়। এমনি সব প্রক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরণের কফি প্রস্তুতকারক যন্ত্র বাজারে পাওয়া যায়। কফির নির্যাস বানানো একটু সময়সাপেক্ষ। আজকের চটজলদির যুগে যাদের সময়ের অভাব, তাদের জন্য এসেছে ইনস্ট্যান্ট কফি। কেবল গরম জলে গুলে নিলেই কফি তৈরী, কোন তলানি গুঁড়োও থাকে না। তবে খানদানী কফি রসিকরা এ কফি পছন্দ করেন না।


আমেরিকায় কফি পানের ইতিহাসে তিনটি লহর বা waveকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যে সব বিশেষত্বের নিরিখে এদের কাল বিভাজন করা হয়েছে, সেগুলি অনুসরণ করলে পৃথিবীর অন্যত্র এবং ভারতেও এই তিন লহরকে নির্ধারণ করা যেতে পারে। বহু বছর ধরে কফি এ দেশে চিরাচরিত উপায়ে প্রস্তুত করে পরিবেশিত হত অথবা ইনস্ট্যান্ট কফি পান করা হত, সেখানে কফির উৎস বা প্রস্তুতি পদ্ধতিগত বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি মুখ্য ছিল না। কফি ছিল মোটামুটি সর্বসাধারণের সামর্থ্যের মধ্যে। কফি বোর্ড পরিচালিত কফি হাউসগুলি এবং ছোট-বড় রেস্তোরাঁ এই পর্বের ধারক ও বাহক। কফি তখন বড় শহরগুলিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। বলা বাহুল্য, কফির এই প্রথম লহর কিন্তু আজও বেশ জনপ্রিয়। ১৯৯৬ সালে ক্যাফে কফি ডে’র আবির্ভাব নিয়ে এল ক্যাফের সংস্কৃতি। এঁরা কফির উৎসস্থানগত বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দিলেন। সেই সঙ্গে জোর দিলেন ক্যাফেকে এক উপভোগের জায়গা করে তুলতে, যেখানে এক কাপ কফিকে সঙ্গী করে অবসর সময়ও কাটানো যায়, আবার কাজের কাজও করা যায়। তাছাড়া দ্বিতীয় স্তরের শহরগুলিতেও কফিকে ছড়িয়ে দিতে এঁদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেই ধারাকেই এগিয়ে নিয়ে গেল ২০১১ সালে টাটা গোষ্ঠীর সহযোগে বহুজাগতিক শৃঙ্খলা স্টারবাকসের আগমন। বিভিন্ন প্রজাতির ও ধরণের কফিকে এঁরা ভারতে নিয়ে এলেন। সেই সঙ্গে কফির সাথে রকম রকম সুগন্ধি, পানীয় ইত্যাদির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে কত বিচিত্রভাবে কফিকে উপভোগ করা যায়, তার বহুবিধ বিকল্প তাঁরা গ্রাহকদের উপলব্ধ করলেন। কফির গুণমান উন্নত করতেও এঁদের প্রয়াস উল্লেখযোগ্য। গত দু’ দশকে কস্টা কফি, থার্ড ওয়েভ কফি ইত্যাদি ব্র্যান্ডেড কফি শৃঙ্খলা সহ ছোট বড় অনেক ক্যাফের প্রাদুর্ভাব শহরে শহরে ঘটেছে।


কিন্তু তৃতীয় লহর বা Third Wave চিহ্নিত হয়েছে speciality coffee বা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কফি দিয়ে। ভৌগলিক স্থানগত বিশেষত্ব, ত্রুটিহীন কাঁচা বীজ নির্বাচন থেকে শুরু করে বীজের প্রক্রিয়াকরণের প্রত্যেক স্তরে গুণগত মান বজায় রাখা, এমন কি যে জল ব্যবহৃত হবে তার মান ইত্যাদি, এবং শেষে প্রস্তুত কফির স্বাদ ও গন্ধের অনন্যতা, এত সব ব্যাপারের নিরিখে সেই কফি বিশিষ্টতার তখমা পাবে কি না, তা নির্ভর করে। স্পেশিয়ালিটি কফি অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি সংস্থা মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে বিচার করে নির্ধারণ করেন কোন কফি গুণবত্তার মাপকাঠিতে কত উন্নত মানের। ৯০এর ওপর নম্বর পেতে পারলে সেই কফিকে স্রেষ্ঠ বলে গণ্য করা হয়।

দক্ষিণ ভারতের ‘ফিল্টার কাপি’


ঐতিহ্যবাহী কফি হাউস


আজকের কফি শপের কফি

আজকের ক্যাফেতে পুরোনো সেই একই ধরণের কফির জায়গায় পাবেন হরেক রকমের কফি। গরম কফি চাইলে নির্বাচন করুন কালো আমেরিকানো বা ফেনিল এসপ্রেসো, অথবা দুধ মেশানো লাটে, ক্যাপুচিনো, মোকা ইত্যদির মধ্যে থেকে। ঠান্ডাই পছন্দ ? তাহলে বেছে নিন নিছক বরফ মেশানো কালো কফি, না হলে ভ্যানিলা, ক্যারামেল, চকোলেট, ক্রীম, আইসক্রীম ইত্যাদির মিশেলে তৈরী সম্ভার। আপনার রুচি আর পছন্দমত কফি অচিরেই বানিয়ে দেবেন ব্যারিস্টারা। সেই ১৯৪৬ সালে ফ্র্যাঙ্ক সিনাট্রা গেয়েছিলেন, ‘They’ve got an awful lot of coffee in Brazil’, আজ এ দেশে থাকলে তিনি নিশ্চয়ই বলতেন, ‘ভারতেও তো এখন দেখছি কফির হরেকরকমবা’ !