Next
Previous
Showing posts with label প্রবন্ধ. Show all posts
1

প্রবন্ধ - প্রমিত বসু

Posted in






এই বছর দুশো পূর্ণ করলেন মধুকবি। প্রথম বাঙালি রংবাজ কবি। এক সৃষ্টিশীল রংবাজ, যিনি আজীবন কোনো আপোষ করেননি নিজের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যর সঙ্গে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যর সঙ্গে যখনই কোনো আপোষের প্রশ্ন এসেছে, তখন তার মূল্য রাখতে নিজের পরিবার, বন্ধু বা নিশ্চিত সুখের জীবন ত্যাগ করতে তাঁকে এক মুহূর্ত ভাবতে হয় নি।

তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ হোক অথবা কাব্য সৃষ্টি হোক, সর্বক্ষেত্রেই আপোষহীন ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতা বজায় রেখেছেন জীবনভর। তার জন্য নিজের স্থিতিশীল জীবন এক ঝটকায় ভয়ঙ্কর অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, কিন্তু তা বলে নিজের অবস্থান থেকে একটুও সরার কথা মনে হয়নি কখনও।

সেই সাহসেরই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় তাঁর ভাষায়, কাব্যে এবং সৃজনশীলতায়। যা কিছু প্রচলিত, তাকে ভেঙে ফেলে নতুন ছাঁদে, নতুন আঙ্গিকে পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করেন যা চমকে দেয় আপামর সাহিত্য জগৎকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি যখন বাংলা সাহিত্য আটকে আছে সেই মঙ্গলকাব্যের বাঁধা ছকে আর পাঁচালির ছন্দে, ঠিক সেই সময় নিয়ে এলেন ইউরোপীয় ধাঁচে অমিত্রাক্ষরের ঝড়। সেই ছাঁদে মেলালেন খাঁটি ভারতীয় দেব-দেবী, রামায়ণ, মহাভারত কিংবা পুরাণকে।

১৮৫৭ থেকে ১৮৬১ এই চার বছরের মধ্যে পর পর তৈরী করলেন শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী নাটক, তিলোত্তমা কাব্য, মেঘনাদবধ কাব্য, কৃষ্ণকুমারী, ব্রজাঙ্গনা কাব্য এবং বীরাঙ্গনা কাব্যের মতো একের পর এক সৃষ্টি। 'শর্মিষ্ঠা' লেখার পর পরই বলেন 'আমাদের নাটক গদ্যে না লিখে অমিত্রাক্ষরে লেখা উচিত।.. যত দিন না বাংলায় অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রচলিত হচ্ছে, ততদিন বাংলা নাটকের উন্নতি আশা করা যায় না'। পয়ার আর ত্রিপদীর কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে শুরু করলেন অমিত্রাক্ষর। বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষরের অনুপ্রবেশ ঘটানোর সাথে সাথে আধুনিক করলেন বাংলা নাটককে। নাটকে এবং কাব্যে কমেডি, ট্র্যাজেডি, বীররস, করুণরসের নতুন মাত্রা যোগ করলেন।

কোনোদিন তোয়াক্কা করেন নি গতানুগতিক কাঠামোকে, সেটা সাহিত্যেই হোক বা সমাজে। পৌরাণিক কাহিনীগুলোকে বেছে নিলেন নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে পুরাণকে পরিবেশন করতে, নিজের রচনার মধ্যে দিয়ে তার আধুনিক মানবিক মূল্যবােধকে প্রকাশ করার জন্য। কাব্যে বা নাটকে যতই পৌরাণিক গল্প ব্যবহার করুন না কেন, চরিত্রগুলোর অতিমানবিক রূপগুলোকে কেটেছেঁটে তৈরী করেন রক্তমাংসের সাধারণ মানুষ। সেখানে পরতে পরতে দেখালেন যে সভ্যতার আদিকাল থেকেই মানুষ সাদা বা কালোর বিভাজনে বিভক্ত নয়, বরং প্রত্যেকেরই চরিত্রে রয়েছে ভিন্ন মাত্রায় ধূসর উপাদান (shades of grey)।

আজ থেকে প্রায় ১৬৩ বছর আগে ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্য লিখলেন রামকে সরিয়ে রাবণকে লাইমলাইটে নিয়ে এসে, নতুন ভাব-ভাষা-রূপকল্পে। এখানে রাম অথবা রাবণ কেউই আসল মহাকাব্যের মতো নিজেদের দেবত্বে বা দানবত্বের ঘেরাটোপে বাঁধা থাকে না। রাক্ষসরা বিকটরূপী কোনো ক্যানিবেল নয়, বরং তারা আর্যদের মতোই যজ্ঞ করে, পুজো করে, বর প্রার্থনা করে। আনন্দ বা দুঃখে তাদের মানুষের মতোই প্রতিক্রিয়া থাকে। আবার বানররাও কোনো রোমশ বিশালদেহী পশু নয়, সাধারণ মানুষদের সঙ্গে তাদের কোনো ফারাক নেই। তেমনই রাম বা সীতা কোনো অবতার নয়, বরং আর পাঁচজন মানুষের মতোই তাদের জীবন চলে।

রবীন্দ্রনাথের এক উদ্ধৃতিতে এই তাৎপর্য সার্থকভাবে প্রকাশ পেয়েছে: “মেঘনাদবধ কাব্যের কেবল ছন্দোবন্ধে ও রচনাপ্রণালীতে নহে, তাহার ভিতরকার ভাব ও রসের মধ্যে একটা অপূর্ব পরিবর্তন দেখিতে পাই। এ পরিবর্তন আত্মবিস্মৃত নহে। ইহার মধ্যে একটা বিদ্রোহ আছে। কবি পয়ারের বেড়ি ভাঙ্গিয়াছেন এবং রামরাবণের সম্বন্ধে অনেকদিন হইতে আমাদের মনে একটা যে বাঁধাবাঁধি ভাব চলিয়া আসিয়াছে স্পর্ধাপূর্বক তাহার শাসন ভাঙ্গিয়াছেন। এই কাব্যে রামলক্ষ্মণের চেয়ে রাবণ-ইন্দ্রজিৎ বড় হইয়া উঠিয়াছে। যে ধর্মভীরুতা সর্বদাই কোনটা কতটুকু ভাল ও কতটুকু মন্দ তাহা কেবলই অতি সূক্ষ্মভাবে ওজন করিয়া চলে, তাহার ত্যাগ দৈন্য আত্মনিগ্রহ আধুনিক হৃদয়কে আকর্ষণ করিতে পারে নাই।”

একদম ছোট বয়স থেকেই নারীদের প্রতি তিনি ছিলেন চরম শ্রদ্ধাশীল। ১৮৪২ সালে স্ত্রী-শিক্ষা বিষয়ে একটি রচনা লিখে তিনি স্বর্ণপদক পান। সেখানে তিনি বিশেষভাবে লেখেন যে দেশের সভ্যতার আর উন্নতির প্রতীক হলো এই নারীশিক্ষা এবং সেইটা হলেই সমাজের পূর্ণতাপ্রাপ্তি ঘটতে পারে।

“Extensive dissemination of knowledge amongst women is the surest way that leads a nation to civilization and refinement… the happiness of a man who has an enlighten partner is quite complete..”

সেই যুগে সমাজের অনেক বড়ো বড়ো সংস্কারকরাও নারীদের উন্নতির কথা বললেও নিজেদের স্ব-স্ব বিবাহের ক্ষেত্রে কিন্তু সেই চিরাচরিত প্রথাকেই মেনে নিয়েছিলেন। এমনকি ঠাকুর পরিবারও তার ব্যতিক্রম নয়। সেই সময়ে তাঁর সোজা কথা - বিলিতি কায়দায় কোর্টশিপ না করলে সে কি আর প্রেম, আর প্রেম করে বিয়ে না করলে সে কি আর বিয়ে!

পদাবলীর ছাঁদে লেখা ব্রজাঙ্গনা কাব্যে আধ্যাত্মিক প্রেমলীলা থেকে বেরিয়ে এসে রাধা হয়ে ওঠে এক সাধারণ নারী, বিরহ, আক্ষেপ বা হতাশায় আকুল এক বিরহিণী, যার প্রেমের আন্তরিকতায় কোনো ভেজাল নেই। গীতরসসমৃদ্ধ এক ভক্তিরসের এই পদাবলিতে নিয়ে এলেন এক নতুন আস্বাদ, যেখানে নারীর অনুভূতিগুলোকে ঘিরে।

সেই নারীবাদী চিন্তাধারা থেকেই বোধহয় সৃষ্টি হলো 'বীরাঙ্গনা কাব্য', যা বাংলা সাহিত্যে নারীবাদের একটা জলজ্যান্ত বেঞ্চমার্ক। বীরাঙ্গনা কাব্য যে সময় লেখা হয় তখন বাংলায় মেয়েদের স্কুল হাতে গোনা কয়েকটি আর বিধবা বিবাহ শুরু হয়েছে সবে তিন চার বছর আগে। কত বড়ো অদম্য সাহসী মানুষ না হলে সেই সময় দাঁড়িয়ে পৌরাণিক নারীদের নিয়ে লেখেন পত্রকাব্য। প্রণয়ীদের লেখা পত্রে তাদের বৈচিত্র্যময় অনুভূতি বেরিয়ে আসে। কুদর্শনা সুর্পণখা রামায়ণের থেকে বেরিয়ে এসে কবির হাতযশে রূপান্তরিত হয় এক সাধারণ নারীতে, যে কিনা লক্ষণের মহান-রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে প্রেম নিবেদন করে বসে। অকুতোভয় তারা চন্দ্রের সঙ্গে প্রেমের স্বীকৃতি চায় জোর গলায়, আবার শকুন্তলা বা কৈকেয়ী প্রণয়ীদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য তাদের সরাসরি দোষারোপ করে ওঠে। সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থেকে মহিলাদের এই দৃষ্টিকোণ থেকে সৃষ্টি করেছিলেন দত্তকবি।

আজীবন সাহিত্যে ভেঙেছেন গড়েছেন, চেষ্টা করেছেন ইম্প্রোভাইজেশনের। তিনি বুঝেছিলেন যে যতি এবং অন্ত্যমিলের কঠোর নিয়মের যাঁতাকলে বাংলা ভাষা তার সহজ মাধুর্য এবং স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়ে ফেলতে বাধ্য। একটি চিঠিতে এই সম্পর্কে বলেন যে চীনা মেয়েদের যেমন লোহার জুতো পরিয়ে তাদের পায়ের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে আটকে রাখা হয়, বাংলা ছন্দের নিয়মও তেমনি ভাষার স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে বিনষ্ট করে। বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে হাজির করেন সনেট। সেখানেও দেখান নিজের কেরামতি। প্রথাগত ইউরোপিয়ান ধাঁচের পেত্রার্কীয় বা শেক্সপীয়রীয় সনেটকে যেমন গ্রহণ করলেন, তেমনি সেটা আবার নতুন করে ভেঙে তৈরী করলেন নতুন গড়ন (যেমন 'হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব')।

ধর্মের ঊর্ধ্বে গিয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে নৈর্ব্যক্তিকতা বজায় রেখেছেন চিরকাল। মাদ্রাজে থাকাকালীন যখন মিশনারিদের অধীনে চাকরিরত, সেই সময়ও মুসলিম শাসনের কিছু ভালো দিক তুলে ধরে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসনের সমালোচনা করলেন (“India under the Moslem rule was more prosperous than the Leadenhall rule. Sir Charles may disguise the fact, but history is against him.” - Leadenhall হল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির লণ্ডনের সদরদপ্তরের ঠিকানা)। আবার একই সাথে মুঘল রাজত্বের শেষের নবাবদের বিলাসবহুল জীবনের কড়া সমালোচনা করলেন।

যে খৃস্ট ধর্মের জন্য একদিন সব ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেখানে দেখেছেন পদে পদে বৈষম্য। তিনি এটা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন যে ধর্মশিক্ষা কখনও প্রকৃত শিক্ষার আলো হতে পারে না। তাই ‘নেটিভ এডুকেশন’ প্রবন্ধে এর বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয়েছিলেন মধুসূদন। স্কুলগুলিতে বাইবেল পড়ানোর মতো জবরদস্তিকে তিনি ঘৃণ্য কাজ বলেছেন— “শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাইবেল পড়লেই খ্রিষ্টধর্মের প্রসার ঘটবে এমনটা ভাবা নিতান্ত বোকামি।” তার ফলস্বরূপ যা হওয়ার তাই হয়েছে। কোনো ধর্মের মাথারাই তাঁকে ধর্মীয় স্বীকৃতি দেন নি। খ্রিস্টান সমাজে ব্রাত্য হয়েছেন, হিন্দু সমাজে চিরকাল বিধর্মীর তকমা জুটেছে।

সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকার ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বিদ্রুপ হয়েছে। মেঘনাদকাব্যের ব্যঙ্গ করে লেখা হয় 'ছুচুন্দর বধ কাব্য'। ঈশ্বর গুপ্তের মতো মানুষও তাঁর কড়া সমালোচক ছিলেন। কিন্তু তাতে কীই বা এসে যায় এই রকম মানুষের। উল্টে তাঁকেই শ্রদ্ধা জানিয়ে কবিতা লেখেন:

'আছিলে রাখালরাজ কাব্য ব্রজধামে
জীবে তুমি; নানা খেলা খেলিলে হরষে'

সাচ্চা রংবাজের মতোই প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে স্বীকার করেছেন তাঁর ঋণ। কাব্যের গুরু ভেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন বাল্মীকি, ব্যাস এবং কালিদাসকে। বীরাঙ্গনা কাব্য উৎসর্গ করেছেন স্বয়ং বিদ্যাসাগরকে। কতটা বুকের পাটা থাকলে কেউ তাঁর নিজের এপিটাফ নিজেই লিখতে পারেন, সেটা উপলব্ধি করার ক্ষমতাই আমাদের থাকে না। শহরের খ্রিস্টান সমাজের কাছে তিনি এমনই চক্ষুশূল ছিলেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর কলকাতার কোনও সমাধিক্ষেত্রে তাঁর ঠাঁই হবে কি না সেই অনিশ্চয়তায় কেটে যায় অনেকটা সময়। শেষমেশ লোয়ার সার্কুলার রোডে সমাধিস্থ হলেন, হেনরিয়েটার পাশেই। গৌরচন্দ্র বসাক-সহ কয়েক জন বন্ধু বহু বছর পরে স্মৃতিফলক বসিয়েছিলেন, তাতে মাইকেলেরই লেখা নিজের প্রয়াণলেখ: ‘দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব/ বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল!...।’

প্রতি বছরই এই সময়ের অন্য ছুটির উচ্ছ্বাসে তিনি চলে যান সব রকম জমকের আড়ালেতে। এই বছর এমনই আয়রনি যে তাঁর দ্বিশতক পূর্ণের ঠিক আগেই রাজকীয় আড়ম্বরে স্থাপিত হল সেই পৌরাণিক চরিত্রের যাকে তিনি বরাবর বিচার করেছেন মানবতার মাপকাঠিতে। অবতারের বাইরে বেরিয়ে এসে মানুষের ন্যায়-অন্যায়ের ধর্মনীতির মধ্যে রেখে মূল্যায়ন করেছেন। হয়ত আজকের সময়ে জন্মালে শাসকের নিরাপত্তাহীনতার দরুণ তাঁকে মিথ্যে দেশদ্রোহিতার মামলায় জেল খাটতে হত।

নিজের শর্তে ক'জনই বা বাঁচতে পারে? মধুসূদনও পারেননি, তা বলে ইচ্ছেটা মরে যায়নি। শিল্পের দুনিয়ায় বহু প্রবল প্রতিভাও পরিস্থিতির চাপে চুপ করে গিয়েছেন, আপস করে নিয়েছেন সময়ের সঙ্গে। মধুসূদন করেননি। মধুসূদনকেও যে একেবারে করতে হয় নি তা নয়। কাব্যচর্চায় সাময়িক বিরতি দিয়ে গ্রাসাচ্ছাদনের তাগিদে সংবাদপত্রে বা পুলিশেও চাকরি করেছেন, ওকালতি করেছেন। কিন্তু পরিস্থিতির অল্প পরিবর্তনেই ফিরে এসেছেন নিজের কাব্যরচনায়। তাই জীবনের অনেক আশা অপূর্ণ থেকে গেলেও কালজয়ী কবি হওয়ার বাসনা পূর্ণ হয়েছে।

মধুসূদন তার সমসাময়িক কালেই অনেক বিরোধিতার মধ্যেও শিক্ষিত সমাজের বড়ো অংশের কাছে শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিলেন। তার মর্যাদা যে কত বড় তা বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছে একালে। এক ধাক্কায় বাংলা ভাষার বিশ্বায়নের দরজা প্রথম খুললেন। সুগভীর স্বাজাত্যবােধ, সর্বমানবযোগ একসাথে মিলিয়ে দেবত্ব আর ভাগ্যের উর্ধ্বে তিনি তুলে ধরেছেন মানুষের পৌরুষের মহিমা। একজন আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক মানুষ হয়ে আজীবন প্রেমের ধর্ম চর্চা করে মানবতার পাঠ পড়ালেন ভবিষ্যতের শতাব্দীকে।
0

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in







গণিত— বিষয়টি অনেকের কাছে বেশ জটিল ও কঠিন। আবার অনেকের কাছে বেশ সোজা ও মজার। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গণিত বেশ জড়িয়েই আছে সে যেকোনো জিনিস কেনার জন্যে হোক বা কটা বাজে অর্থাৎ সময় দেখার জন্যে হোক বা পুজোর নৈবেদ্য হিসেবে কটা ফুল বা বেল-তুলসী পাতা লাগবে বা কত উপকরণ লাগবে, আবার রান্নায় কত চামচ নুন লাগবে বা চায়ে কত চামচ চিনি লাগবে ইত্যাদি সবই বেশ হিসেবনিকেশের ব্যাপার। আমরা তো হিসেবনিকেশেই আছি— প্রতিনিয়ত, প্রতিমূহুর্তে। তবুও, কেন গণিত আমাদের কাছে এত জটিল ও এত অধরা? এর কারণ অবশ্য এর শিক্ষণপদ্ধতি ও একে ভালোভআবে জানার জন্যে আমাদের কারুর তীব্র অনীহা। আসলে, স্কুলে ও কলেজ স্তরে বেশ কিছু অর্ধশিক্ষিত শিক্ষক-শিক্ষিকা তাঁদের পড়ানোর ত্রুটি এবং পরিমার্জিত জ্ঞান ও সৃজনশীলতার অভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে গণিত বিষয়টি বেশ জটিল করে তুলে বড়সড় গোল করে বসেন। আদৌ কিন্তু বিষয়টি জটিল বা কঠিন নয়। খেলাচ্ছলে বা আগ্রহবশত বিষয়টিতে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠা যায়। আর হয়ে ওঠা যায় একজন গণিতজ্ঞ বা গণিএ পারদর্শী ব্যক্তি। আর গণিতবিদ হতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশভারী ডিগ্রি যে প্রয়োজন তা কিন্তু নয় বরং রোজ অধ্যবসায় দরকার। অর্থাৎ নিয়মিত অঙ্কচর্চার মাধ্যমে যে কেউ যে কোনও অবস্থায় হয়ে উঠতে পারে গণিতবিদ। আর নিয়মিত চর্চা বা অধ্যবসায় আসবে কোথা থেকে? গণিতের প্রতি এক নিখাদ ভালোবাসার মাধ্যমে। আর এই প্রবন্ধে আমরা এমনই একজনকে নিয়ে আলোচনা করব যিনি গণিতকে ভালোবেসে, গণিতের কথাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করে বিশ্বশ্রুত গণিতজ্ঞ হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। তিনি একজন অনন্যা মহীয়সী নারী, নাম তাঁর হাইপেশিয়া। গোঁড়া পিতৃতন্ত্রের ধারক ও বাহকেরা বেশ নিন্দার সাথে নারীজাতিকে হেয় করার জন্য কুৎসা করে বেড়ায় যে, নারীরা গণিতজ্ঞ হতে পারে না, নারীরা গণিত-বিমুখ। অথচ এদিকে রান্নার নুন-চিনির হোক কিংবা সংসারের সমস্ত জটিল হিসেবনিকেশ নারীরাই খুব সুন্দরভাবেই সামলান। আর তাই এইসব অশিক্ষিত গোঁড়াদের প্রতি এক প্রতিবাদের নাম হলেন হাইপেশিয়া বা তাদের গোঁড়ামি, কুৎসা ও উগ্র পিতৃতন্ত্রের প্রতি এক থাপ্পড় স্বরূপ হলেন হাইপেশিয়া ও তাঁর কাজকর্ম। যিনি স্বমহিমায় দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে— হ্যাঁ, মেয়েরা বা নারীরাও পারেন গণিতের অতল জ্ঞানের সমুদ্রে তলিয়ে গণিতের মুক্তগুলো সামনে নিয়ে আসতে। পুরুষের মতো গণিতের জগতে তাঁদেরও অবাধ যাতায়াত। আর তাঁর প্রতি রাগ ও প্রতিশোধের জন্য বা নারীজাতিকে পিছিয় দিয়ে সমাজকে অন্ধকার করে রাখার জন্যেই ধর্মীয় গোঁড়া কিছু অমানুষ হত্যা করে হাইপেশিয়াকে। তবুও হাইপেশিয়াই জিতেছেন, জিতেছে শুভবুদ্ধি, নারীরা পুরুষদের সাথেই এগিয়ে চলেছেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে আর আবিষ্কার করে চলেছে অজানা সত্যকে — এটাই হয়তো প্রকৃতির গাণিতিক নিয়ম।


প্রাচীন মিশরের রাস্তায় ভিড়ের মাঝেই গণিতের কথা শোনাতেন হাইপেশিয়া। তাঁকে ঘিরে সাধ্রণ মানুষের ভিড়। তারা শুনছে মহীয়সী এই গণিতজ্ঞ ভদ্রমহিলার কাছ থেকে গণিতের নানা কথা। অনেকেই হয়তো অবাক হচ্ছেন এটা ভেবে যে, যে যুগে অর্থাৎ প্রাচীন মিশরে যেখানে মহিলাদের চিন্তাভাবনা ও কাজকর্মের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল না, বেশিরভাগ মহিলারাই গণিত ও বিজ্ঞান পড়তেন না বা বলা ভালো আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তাঁদের পড়তে দেওয়া হত না এমনকি রাজনৈতিক প্রাঙ্গণেও তাঁদের প্রবেশ নিষেধ ছিল, সে যুগের রাস্তায় দাঁড়িয়ে একজন নারী তাঁর গাণিতিক সুন্দর ও সবলীল বক্তৃতার মাধ্যমে প্রচুর মানুষকে অনায়াসে আকৃষ্ট করে চলেছেন। এ যে রীতিমতো বিস্ময়ের ব্যাপার! কিন্তু, এই বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল কিভাবে? কিভাবে সম্ভব হল একা একজন নারীর পক্ষে সমাজের গোঁড়ামি ও অসম্ভবকে বুড়ো আঙুল দেখানো?


এইসব সম্ভব হয়েছিল একজনের জন্য। তিনি হলেন হাইপেশিয়ার বাবা থেওন। যেমন একজন সফল পুরুষের পেছনে একজন নারী থাকেন ঠিক তেমনি একজন সফল নারীর পেছনেও একজন পুরুষ থাকেন। হাইপেশিয়ার পেছনে যেমনটি ছিলেন তাঁর বাবা থেওন। থেওন নিজেও একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ ছিলেন এবং ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার মিউজিয়ামের প্রধান। হাইপেশিয়াও তাঁর বাবার মৃত্যুর পরে মিউজিয়ামের প্রধান হন। যাইহোক, হাইপেশিয়া যাতে এক মুক্তমনা নারী হয়ে উঠতে পারেন সেইজন্য গতানুতিক সমাজের বিপরীত শ্রোতে গিয়ে থেওন তাঁর মেয়ে হাইপেশিয়াকে প্রচুর স্বাধীনতা দিয়েছিলেন যা সেই যুগের অন্যান্য মেয়েদের কাছে ছিল বিরল। হাইপেশিয়া তাই হয়ে উঠেছিলেন নারীদের মধ্যে অন্যতম প্রথম গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিদ এবং দার্শনিক। মিশর (অপর নাম ইজিপ্ট)-এর আলেকজান্দ্রিয়া নগরীতে ৩৫০ খ্রীষ্টাব্দে এই মহান বিদূষী নারী জন্মগ্রহণ করেছিলেন।


হাইপেশিয়ার জীবনে তাঁর পিতা থেওনের বিরাট প্রভাব ছিল। থেওন তাঁর মেয়েকে চেয়েছিলেন একজন ‘আদর্শ মানুষ’ হিসেবে গড়ে তুলতে। তিনি সর্বদা চাইতেন তাঁর মেয়ে সর্বদা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ও সবল থাকুক কেননা তা থাকলে তবেই তো একজন আদর্শ মানুষ হতে পারা যাবে। মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য গণিতচর্চা অন্যতম অপরিহার্য। তাই, তিনি গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে তাঁর জানা যাবতীয় জ্ঞান মেয়েকে শেখালেন। আর এর পাশাপাশি তৈরি করলেন সুবক্তা বা প্রভাবশালী বক্তা হিসেবে। আর সেই শিক্ষার রেশ থেকেই হাইপেশিয়া হয়ে উঠেছিলেন একজন প্রভাবশালী গাণিতিক সুবক্তা ও সুলেখক। তার পাশাপাশি হয়ে উঠেছিলেন বাবার সুযোগ্যা সহকারিণী। হাইপেশিয়া তাঁর বাবার সাথে পুরনো গণিতের পাঠ্যপুস্তকগুলো জ্যামিতি, বীজগণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার নতুন নতুন তথ্য দিয়ে আধুনিক বা আপডেট করে তুলেছিলেন। খুব জটিল ও দুরূহ গাণিতিক বিষয়কে খুব সহজ-সরলভাবে বোঝানোর ক্ষমতা ছিল হাইপেশিয়ার। খুব কঠিন ও বৃহৎ বিষয়কে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে ভেঙে নিতেন যাতে খুব সহজে বিষয়টি বোঝা যায়। এইসব গুণাবলীর জন্যে, হাইপেশিয়া ও তাঁর পিতার কৃত গাণিতিক কাজগুলি বহু যুগ ধরেই বহু গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদকে প্রভাবিত ও উৎসাহিত করেছিল। গোটা শহর থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী আসত হাইপেশিয়ার কাছে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা শিখতে। হাইপেশিয়া দিগন্ত ও কোনও নক্ষত্র বা গ্রহের মধ্যে কোণ মাপার জন্যে বহনীয় যন্ত্র ‘অ্যাস্ট্রোলেবেল’ ব্যবহারের শিক্ষা দিতেন। জানা যায় যে, এই অসাধারণ যন্ত্রটি নাবিকরা দুশো বছর ধরে মহাসমুদ্রে থাকাকালীন ব্যবহার করতেন সময় ও অবস্থান জানার জন্যে। হাইপেশিয়ার বক্তৃতায় প্রচুর জনসমাগম হত। আর এভাবেই তিনি তথাকতিত নীরস গণিতকে জনসাধারণের মাঝে জনপ্রিয় ও রসালো করে তুলতেন। তৎকালীন সমাজে হাইপেশিয়া একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। যিনি একজন শিক্ষিতা মুক্তমনা নারী হিসেবে নারীদের শিক্ষা এবং অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন।


দর্শনে গণিতকে প্রয়োগ করেছিলেন হাইপেশিয়া। তিনি নব্য-প্লেটোবাদ চিন্তাধারার ওপর ভিত্তি করে এমন একটি চিন্তাভাবনা সৃষ্টি করেন যা খুবই কার্যকারী। সেই চিন্তাভাবনা এটাই বিশ্বাসটা করে যে, মানুষ তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা তৈরি করে। এই যেমন, আমরা ১ + ১ = ২ যে হয় তা শিখতে পারি, এক জোড়া পেন, মোজা বা যেকোনও একজোড়া বস্তু একসাথে রেখে।


কিন্তু এত কিছু অবদানের শেষে হাইপেশিয়া শিকার হলেন ধর্মান্ধতার এক চরম নির্মম পরিস্থিতির। তাঁর দেওয়া শিক্ষাগুলো ছিল তৎকালীন আলেকজান্দ্রিয়ার প্রধান ধর্ম খ্রিস্টধর্মের থেকে আলাদা। ৪১২ খ্রিস্টাব্দে সিরিল নামক একজন নতুন খ্রিস্টান বিশপ হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। আর এর সাথে আলেকজান্দ্রিয়ার মানুষ দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায়। সিরিলের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার গভর্নর অরেস্টেস। এই অরেস্টেস ছিলেন হাইপেশিয়ার বন্ধু। সিরিল ও তাঁর কট্টর খ্রিস্টান অনুগামীদের বিশ্বাস ছিল যে, আলেকজান্দ্রিয়া শহরটাকে অরেস্টেস চালাচ্ছেন হাইপেশিয়ার দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। তাই, সেই অনুগামীরা হাইপেশিয়াকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেইমতো, ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসের এক সকালে এক জনসভায় যখন হাইপেশিয়া বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন সিরিলের একদল অনুগামী তাঁকে হত্যা করে। এইভাবে দ্বন্দ্বের মাঝে চিরকালের মতো নিভে যায় এক মহান দার্শনিক, গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদের জীবনের প্রদীপ। আলেকজান্দ্রিয়ার খ্রিস্টান বিশপ সিরিলের অনুসারীরা তথা সন্ত্রাসীরা তাঁকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় চার্চ সিজারিয়ামে। হাইপেশিয়া হয়তো ভাবতেও পারেননি মানুষ তাঁকে এত নির্মমভাবে হত্যা করবে। সেই সন্ত্রাসীরা সেখানে তাঁকে নগ্ন করিয়ে ঝিনুকের খোল দিয়ে তাঁর দেহের চামড়া চেঁছে ফেলে। হাইপেশিয়ার দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে বিভক্ত করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, সেই সন্ত্রাসীরা এরপর তাঁর টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া মৃতদেহটি পুড়িয়ে ছাই করে উড়িয়ে ছিল। এই বর্বর অমানুষগুলো হাইপেশিয়াকে এতটাই ভয় পেয়েছিল যে এভাবে অমানুষের মতো নির্মমভাবে হত্যা করে ক্ষান্ত থাকেনি। হাইপেশিয়াকে হত্যা করার কয়েক দিন পরেই ওরা আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে ফেলেছিল আর তার সাথে হাইপেশিয়ার সব কাজও নষ্ট করে দিয়েছিল। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম হাইপেশিয়া ও তাঁর কাজকে আর জানতে না পারে। কিন্তু ধ্রুব সত্যকে কি আর আটকানো যায়? হাইপেশিয়ার মৃত্যুর পরে তাঁর ছাত্ররা তাঁর কাজটি চালিয়ে বা এগিয়ে নিয়ে যায়। বলাবাহুল্য, হাইপেশিয়ার গবেষণা ও লেখাগুলো আজও গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং দর্শনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।


নিঃসন্দেহে, হাইপেশিয়ার মৃত্যু ইতিহাসের পাতায় একটি বড়সড় ট্র্যাজেডি। তাঁকে কেন হত্যা করা হয়েছিল সেই ব্যাপারে দুটো প্রধান তত্ত্ব রয়েছে। প্রথম তত্ত্বটির মতে, বিশপ সিরিলের সাথে আলেকজান্দ্রিয়ার গভর্নর অরেস্টেসের রাজনৈতিকভাবে প্রবল মতবিরোধে ছিলেন। এর কারণ অবশ্য হাইপেশিয়া। কেননা, সিরিল বিশ্বাস করতেন যে, হাইপেশিয়া ও তাঁর দর্শন হল গোঁড়া খ্রিস্ট ধর্মবিরোধী প্যাগান(প্রাচীন ধর্ম প্যাগানিজম-এর ধারক)তথা চার্চদ্রোহী আর অরেস্টেস ও তাঁর শাসন প্রভাবিত হচ্ছে হাইপেশিয়া ও তাঁর দর্শন দ্বারা। তাই নরকের কীট সিরিল ও তাঁর অনুগামীরা হাইপেশিয়াকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আর এর সাথে আছে দ্বিতীয় আরেক তত্ত্ব তা হল, হাইপেশিয়া একজন শিক্ষিতা এবং স্বাধীনচতা নারী ছিলেন যিনি পুরুষদের সাথে সমান স্তরে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও দর্শন ইত্যাদি গুরুগম্ভীর বিষয়ে আলোচনা করতেন। এমনকি তিনি খ্রিস্টান ধর্মের অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরে তার বিরোধিতাও করেছিলেন, যা তখনকার সময়ে সমাজে বেশ প্রভাব বিস্তার করছিল। হাইপেশিয়ার এই মহান নারীত্ব ও মুক্তচেতনা গোঁড়া পিতৃতান্ত্রিক ও ধার্মিক সিরিল এবং তাঁর অনুসারীরা মেনে নিতে পারেননি। তাই, তাঁকে বর্বরভাবে হত্যা করে নারীদের অধিকার এবং শিক্ষার জন্য একটি ধাক্কা দিতে চেয়েছিলেন। আসলে, নারীজাতির শিক্ষা বন্ধ করে দিয়ে, সমাজের মুক্তচিন্তার পথ বন্ধ করে দিয়ে এভাবেই সমাজকে অনেক পেছনে এক অন্ধকারময় যুগে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে চায় কিছু পাশবিক আসুরিক অমানুষের দল। তবুও, সত্যের জয় হয়। আসুরিক শক্তির পরাজয় ঘটে দেবত্ব শক্তির কাছে। অনুসন্ধিৎসু অসংখ্য নারী-পুরুষের দ্বারাই জ্ঞানের আলো প্রজ্জ্বলিত হতে থাকে গাণিতিক নিয়মেই ধর্মীয় সহ সমস্ত গোঁড়ামিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই।


হাইপেশিয়ার জীবন ও কর্ম এটাই দেখিয়ে গেছে যে, পুরুষের মতো নারীরাও জনসমক্ষে কথা বলতে পারেন। এমনকি জটিল ও দুরূহ বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক বিষয় নিয়েও তাঁরা অনায়াসে চিন্তাভাবনা ও আলোচনা করতে পারেন। গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত হাইপেশিয়ার চিন্তাভাবনা ও কথাগুলো পরবর্তী সময়ের গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদদের কাজে লেগেছে এবং অনুপ্রাণিত করে সাহায্য করেছে নতুন নতুন উন্নত তত্ত্ব তৈরি করার ক্ষেত্রে। বলাই যায় যে, হাইপেশিয়ার কাজ আজও আমাদের কাজে লাগে ও ভাবিয়েও তোলে। শুধু গণিত বা বিজ্ঞানের ইতিহসেই নয় গোটা মানব জাতির ইতিহাসের পাতায় হাইপেশিয়া অতি সম্মানীয় ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছেন। তিনি সমগ্র নারীজাতির আদর্শ তো বটেই এমনকি মানবমুক্তির দিশারীও বটে।
0

প্রবন্ধ - দিলীপ মজুমদার

Posted in







‘হিন্দু পেট্রিয়টে’র বিখ্যাত সম্পাদক , রাজনৈতিক সাংবাদিকতার অগ্রদূত হরিশ মুখার্জীর মৃত্যুর ২ বছর পরে ১৮৬৩ সালে মুম্বাইএর এলফিনস্টোন কলেজের এক পার্শি অধ্যাপক ফ্রামজি বোমানজির যে বইটি প্রকাশিত হয় , তার নাম ‘Lights and Shades of the Life of Baboo Hurish Chunder Mookerjee and passing thoughts on India and its people , their present and future.’ এই বইটিকে আমরা প্রথম হরিশ-জীবনী বলতে পারি । তবে স্বাভাবিক কারণে এতে পর্যাপ্ত তথ্য ছিল না । এর পরে ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত হয় রামগোপাল সান্যালের হরিশ-জীবনী । মাত্র ৫৬ পাতার এই পুস্তিকাকে সঠিকভাবে জীবনী-গ্রন্থ বলা যায় না । এই পুস্তিকায় বিক্ষিপ্তভাবে হরিশের জীবনের কিছু বিবরণ সংকলিত হয়েছে। রামগোপাল ১৮৮৯ সালে রচনা করেন ‘A General Biography of Bengal Celebrities –both living and dead .’ এই বইতে দেশের মোট আটজন খ্যাতনামা ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত জীবনকথা বর্ণিত হয়েছে ।

এর পরে ১৯১০ সালে কলকাতার ধর্মতলার চেরি প্রেস থেকে আইনজীবী ও লেখক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় : ‘SELECTION FROM THE WRITINGS OF HURRISH CHUNDER MOOKERJI.’ কোন অনুপ্রেরণায় নরেশচন্দ্র এই সংকলনে ব্রতী হয়েছিলেন , আমরা তার কোন হদিশ পাই না । তবে ভূমিকায় নরেশচন্দ্র উত্তরপাড়ার রাজা প্যারীমোহন মুখার্জীর নামোল্লেখ করেছেন , তাঁর সাহায্যের কথা বলেছেন ( ‘ I have great pleasure in acknowledging the great assistance I have derived from the never failing kindness of Raja Pyri Mohan Mookerji C.S.I , under whose directions mainly the compilation has been made . ’ ) এই প্যারীমোহন ছিলেন হরিশ মুখার্জীর বন্ধু জয়কৃষ্ণ মুখার্জীর পুত্র । ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকার দুটি খণ্ড থেকে প্যারীমোহন হরিশের কয়েকটি রচনা সংকলন করেছিলেন , যা নরেশচন্দ্র ব্যবহার করেছেন তাঁর সংকলন গ্রন্থে ।

‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকায় রচনাকারের নাম থাকত না । এই পত্রিকায় হরিশ মুখার্জী ছাড়াও রামগোপাল ঘোষ , কিশোরীচাঁদ মিত্র , রাজেন্দ্রলাল মিত্র , দ্বারকানাথ মিত্র , জয়কৃষ্ণ মুখার্জী , গিরীশচন্দ্র ঘোষ প্রভৃতির রচনা প্রকাশিত হত । এত রচনার মধ্য থেকে হরিশ মুখার্জীর রচনা সনাক্ত করা সহজ ছিল না । রচনারীতির আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য বিচার করেই সংকলন করা হয়েছে , নরেশচন্দ্র বলেছেন –‘ In making this selection , internal evidence has been our sole guide and pre-eminently we have relied upon style .’ এই সংকলনের সব রচনাই যে নিশ্চিতভাবে হরিশচন্দ্রের, সে দাবি সম্পাদক করেন নি , তবে –‘ But there is no doubt that most of them are , if one may judge from style.’

রচনাগুলি বিষয়ানুযায়ী ১০টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত , শেযে আছে পরিশিষ্ট । প্রথম অধ্যায় ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ ( The Mutiny) । এই অধ্যায়ে How Annexation Worked , The Mutiny , The Causes of the Mutiny , The Panic in Calcutta , The Lucknow Refugees , The Crises and the Native Princes , The Oude Proclamation , The Atrocity Mongers and the Sepoys , English Opinion , Retribution , English Opinion and Indian Facts , The Atrocitirs , Indiscriminate Retribution and the ‘ Antagonism of Race’ ইত্যাদি মোট ৩৫টি রচনা সংকলিত হয়েছে ।

দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম ‘ক্ষমতার হস্তান্তর’ ( The Transfer to the Crown) । এই অধ্যায়ে The Future of the Indian Government , The East India Company , The New India Bill , The Proclamation , The Transfer , India and House of Commons , The Reconciliation , The Amnesty , The Pacification of the Country ইত্যাদি মোট ১৬টি রচনা সংকলিত হয়েছে ।

তৃতীয় অধ্যায়ের নাম ‘সৈন্য বাহিনী’ ( The Army) । এই অধ্যায়ে আছে তিনটি রচনা – Native Gentlemen Officers, The Europeans Troops , The Old Sepoy Army .

চতুর্থ অধ্যায় ‘ভূমি আইন’ ( Land Law) । এই অধ্যায়ে আছে ৭টি রচনা – The New Sale Law Bill , The Sale Law and the Zaminders , The Rent Bill , The Parmanent Settlement প্রভৃতি ।

পঞ্চম অধ্যায়ের নাম ‘নীল চাষ ‘( Indigo ) । নীল আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই হরিশ মুখার্জীর খ্যাতি , অথচ এই সংকলনে নীল বিষয়ক মাত্র ৭টি রচনা আছে । এটা বিস্ময়ের ব্যাপার । এই অধ্যায়ে আছে : Indigo Planting in Nudia , Indigo Planting in Rajshaye , Indigo Planting , The Zaminder and the Planter , Planter’s Portraits , Indigo Planting and Mofussil Justice , The Planters and Official .

ষষ্ঠ অধ্যায়ে বাণিজ্যিক বিষয় ( Industrial and Commercial) আলোচিত হয়েছে , যেমন Blowing the Trumpet , Capital and Enterprise , Merchant and Banian , Workmen and Servants .

সপ্তম অধ্যায়ে ইংরেজের ‘ভারত শাসন’ ( Administration of India ) আলোচিত হয়েছে । এতে মোট ১৮টি রচনা স্থান পেয়েছে । যেমন : An Indian Parliament , Federalization , The Indian Debate , The Patriarchal System, Constitutionalism in India , The Civil Service , The Mandarins , Employment of Natives, A Native Judge for the High Court , The Civil Service and the Natives ইত্যাদি ।

অষ্টম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘ ভারতীয় ও ইউরোপীয়’ ( Indians and Europeans) । এই অধ্যায়ে The Penal Code , The Black Acts , The Native Meeting in the Town Hall , Our legislator Judges , Popular Fallacies , Who is to Blame , Treatment of Natives , The Position of the Europeans প্রভৃতি মোট ১৭টি রচনা স্থান পেয়েছে ।

দেশের সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয় ( Social and Religious ) নিয়ে মোট ৭টি রচনা আছে নবম অধ্যায়ে ; যেমন : Divisions in Hindu Society , A plea for Caste , The Social Progress of India , Christianity in India, English and Hindoo Civilization—A contrast প্রভৃতি ।

দশম অধ্যায়ে দেশের শিক্ষা ( Educational) নিয়ে ৮টি রচনা সংকলিত হয়েছে ; যেমন : The Sanskrit and Vernacular Language , Matters Educational , Our Educational Policy , The Indian Universites প্রভৃতি।

পরিশিষ্টাংশে আছে ১৫টি রচনা , যেমন : The Army , The First Indian Debate , The New Danger, The English in India , The Indian Bill , Vernacular Newspaper প্রভৃতি ।

সংকলিত রচনাগুলি প্রমাণ করে যে কোম্পানির শাসনাধীন দেশের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে হরিশ নিজের মতামত লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন তাঁর রচনায় । এ দেশের সাংবাদিকতার , বিশেষ করে রাজনীতিবিষয়ক সাংবাদিকতার অগ্রদূত হরিশ মুখার্জী । ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকা তাঁর সম্পাদনায় দেশে সৃষ্টি করেছিল অ।লোড়ন । নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত সঠিকভাবে বলেছেন , ‘ But never before he took charge of Hindu Patriot was Indo-English journalism conceived as capable of rising to the height that the Patriot achieved under him and never did this class of journalism exercise a wholesome influence upon the small educated community of the day or on the Government . ’

যে সময়কালের মধ্যে হরিশচন্দ্র ‘হিন্দু পেটিয়ট’ সম্পাদনা করেছেন , সেই ১৮৫৬ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে দেশের ইতিহাসে অনেকগুলি বড় বড় ঘটনা ঘটেছিল । যেমন : সনদের পুনর্নবীকরণ , রেভিনিউ সেল আইন , সিপাহি বিদ্রোহ , ক্ষমতার হস্তান্তর , ব্ল্যাক অ্যাক্ট আন্দোলন , নীল বিদ্রোহ , বিধবা বিবাহ আইন , বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা , স্বত্ববিলোপ নীতি ইত্যাদি । হরিশচন্দ্র এই সব ঘটনায় তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ।

নরেশচন্দ্র বলেছেন যে সিপাহি বিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে হরিশ মুখার্জীকে চমৎকার ‘publicist’-এর ভূমিকায় দেখা গেছে। কখনও তিনি বিদ্রোহের কারণ সন্ধান করার চেষ্টা করছেন , কখনও সিপাহিদের অত্যাচারের অতিরঞ্জিত ঘটনা পরিবেশন করার জন্য সাংবাদিক ও প্রচারকদের নিন্দা করছেন , কখনও অবিমৃশ্যকারিতার জন্য সিপাহিদের সমালোচনা করছেন , কখনও ডালহাউসির কার্যকলাপের –বিশেষ করে অযোধ্যা অভিযানের নিন্দা করছেন , কখনও আবার ক্যানিংএর দূরদৃষ্টির প্রশংসা করছেন , কখনও ইংরেজের জাতিগর্ব ও ভারতীয়দের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ করছেন । নরেশচন্দ্র তাই বলেছেন , ‘ The courage and statesmanship that he displayed on this occasion , the comprehensive knowledge and fearless enthusiasm for the right that characterize his writings of this period at once mark him out as a man far above the ordinary run--- a man who in other circumstances might have made his mark in far higher spheres .’

হরিশচন্দ্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে সমর্থন করেছেন । বেশ জোর গলায় তিনি বলেছেন যত ত্রুটি থাকুক না কেন , এই ব্যবস্থাই ভারতবর্ষের পক্ষে উপযুক্ত ও কর্যকরী ব্যবস্থা ; এই ব্যবস্থা ব্রিটেন ও ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করবে ( ‘Whatever the faults of the Permanent Settlement . it is the only system of landed tenure , it is clear, which is suited to India .’ ) । তিনি আসলে এই ব্যবস্থার রাজনৈতিক তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য অনুধাবন করতে পারেন নি বলেই মনে হয় । তাঁর মনে হয়েছিল যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে দেশের রায়তদের উপকার হবে । বাস্তবে তার বিপরীত হয়েছিল । নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত বলেছেন যে বহুক্ষেত্রে হরিশ জমিদারদের পক্ষ সমর্থন করেছেন বটে , কিন্তু সমানভাবে রায়তদের উপর জমিদারদের অত্যাচারেরও প্রতিবাদ করেছেন ( ‘ Hurrish Chunder was no less a friend of the ryot than that of the Zaminder , His anxious solicitude to protect the interests of Khudkhast and Kudimee ryots whose title was most insecure in those days , finds expression in many of his articles .’ ) । কৃষকদের প্রতি তাঁর আন্তরিক দরদ ও সহানুভূতির প্রমাণ পাওয়া যায় নীল বিদ্রোহের সময়ে । রিক্ত , বঞ্চিত , অত্যাচারিত রায়তদের তিনি আশ্রয় দিয়েছেন , আহার দিয়েছেন , দরখাস্ত লিখে দিয়েছেন , নীলকরদের বিরুদ্ধে মামলায় সাহায্য করেছেন । সিপাহি বিদ্রোহের মধ্যে তিনি বঞ্চিত কৃষকদের জমি হারাবার ক্ষোভকে প্রতিফলিত হতে দেখেছেন । তাদের মৌলিক অধিকার রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তাদের শিক্ষার দাবিতেও সোচ্চার হয়েছেন ।

হরিশচন্দ্রের মতো রাজনীতিমনস্ক , বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন , আপোসহীন , শ্রেণিস্বার্থহীন , মানবদরদী , দেশপ্রেমিক মানুষ দেশে তাঁর যোগ্য সম্মান লাভ করেন নি বলে সংকলনের সম্পাদক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন । নরেশচন্দ্র বলেছেন যে হরিশ জনস্বার্থের জন্য যে কাজ করেছেন , অন্য দেশের মানুষ হলে সেখানকার জনসাধারণ তাঁকে মাথায় তুলে রাখত ( ‘ In any other country , a career such as his would be a cherished treasure to the historian and a bye-word to every patriotic citizen .’ ) । কিন্তু নিজের দেশে হরিশচন্দ্র অবহেলিত হয়ে থেকেছেন । তাঁরা লেখা ও চিঠিপত্র সংকলিত হয় নি , তাঁর কোন ছবি রাখা হয় নি , তাঁর বসতবাড়ির কোন হদিশ করা হয় নি । নরেশচন্দ্র বলেছেন , ‘Whose intellectual eminence no less than his great public services demanded more adequate recognition than we have been able to give him ; for he was the first exponent and , in a very true sense , the father of the new life whose throbbings are felt today all through the length and breadth of the land.’
0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in






অনেক ধৈর্য, অধ্যাবসায় আর নিজের যোগ্যতা ও সুযোগ লাভের ফলে সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়েছেন গুলজার। অনেক ঘাতপ্রতিঘাতকে মোকাবিলা করে তাকে গুলজার নামে বিখ্যাত হতে হয়েছে।
গুলজার হিন্দি ও উর্দু ভাষার ভারতীয় কবি, গীতিকার, সুরকার, ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবে আজ বিশেষভাবে খ্যাতিমান। তিনি মূলত হিন্দী ভাষায় গল্প, কবিতা ও শায়েরী রচনা করেন। তবে উর্দু ভাষায় কবিতা ও শায়েরী রচনাতেও তিনি বিশেষ কৃতিত্ব রয়েছে।
এজন্য তাকে এই যুগের শ্রেষ্ঠ উর্দু কবি হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি সঙ্গীত পরিচালক এস.ডি. বর্মন ১৯৬৩ সালের চলচ্চিত্র বন্দিনীতে গীতিকার হিসেবে এবং আর.ডি. বর্মন, সলিল চৌধুরী, বিশাল ভরদ্বাজ এবং এ.আর. রহমান সহ অনেক সঙ্গীত পরিচালকের সাথে কাজ করেছিলেন। গুলজার কবিতা, সংলাপ এবং স্ক্রিপ্টও লেখেন। তিনি ১৯৭০-এর দশকে আন্ধি এবং মৌসম এবং ১৯৮০-এর দশকে টিভি সিরিজ মির্জা গালিবের মতো চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন। এছাড়াও তিনি ১৯৯৩ সালে কির্দার পরিচালনা করেন।
গুলজারের বহুমাত্রিক প্রতিভার কথা বিষদ ভাবে আলোচনার আগে তার ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে বলা প্রয়োজন।
সম্পূরণ সিং কালরা গুলজারের আসল নাম। তিনি ১৯৩৪ সালের ১৮ আগস্ট অবিভক্ত ভারতের (বর্তমান পাকিস্তান)ঝিলম জেলার দিনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাখন সিং। তার মায়ের নাম সুজান কৌর, তার মা ছিলেন তার বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। তিনি ছিলেন মায়ের একমাত্র পুত্র ।
মায়ের মৃত্যুর পর তিনি বেশিরভাগ সময় বাবার সাথে থাকতেন। মায়ের মৃত্যুতে তার শৈশব জীবন সুখের ছিল না। বৈমাত্রেয় ভাইবোনদের সাথে তাকে বসবাস করতে হয়েছিল নিঃসঙ্গতার মাঝে। বাবার টুপি ও ব্যাগের দোকানে রাতে থাকতে হত। সে পাড়ার লাইব্রেরির বইগুলো তাকে কবি প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে। সে-সময়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার সংকলন দ্য গার্ডেনারের উর্দু সংস্করণ পড়ে পালটে যায় তাঁর জীবনবোধ। স্কুলে থাকতেই সাহিত্য এবং কবিতার প্রতি গুলজারের অনুরাগ জেগে ওঠে। গুলজার এক সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন, ‘খামোশ সওয়াল’ এই দুটো শব্দ যে পাশাপাশি যেতে পারে কোনও দিন ভেবে দেখেননি । ‘নিঃশব্দ প্রশ্ন’। আর সেটিই তাঁর গান লেখার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। তবে এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও এক গল্প। কেন বাংলা শিখেছিলেন গুলজার? সেই কাহিনি।
গুলজার সেই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যখন তার বয়স অনেক কম- এইট নাইনে পড়েন সেই সময়ে রাতে সময় কাটানোর জন্য পাড়ার এক লাইব্রেরি থেকে বই ধার করে আনতেন রোজ রাতে ৪ আনার বিনিময়ে একটি করে বই নিয়ে আসতেন গুলজার। প্রথমদিকে তিনি গোয়েন্দা কাহিনী ও রোমাঞ্চকর কাহিনীর বই পড়তেন। একদিন লাইব্রেরিতে কোনও বই পছন্দ হচ্ছিল না। তখন লাইব্রেরির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিটি বললেন, 'একটি বই দিচ্ছি, পড়ে দেখতে। তারপর তিনি খুব উপর দিকের এক তাক থেকে একটা বই বার করে সেটি দিলেন গুলজারের হাতে। সেই বইটি ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার ইংরেজি সংকলন ‘দ্য গার্ডেনার’-এর উর্দু অনুবাদ।
বাড়ি ফিরে সেই বইয়ে ডুবে গেলেন গুলজার। এতই ভালো লেগে গেল। সেই বইটি থেকেই রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর আকর্ষণ! গুলজারের জীবন বদলে দেওয়া সেই বইটিই ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার ইংরেজি সংকলন ‘দ্য গার্ডেনার’-এর উর্দু অনুবাদ। ওই লাইব্রেরী থেকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মুন্সী প্রেমচাঁদ প্রমুখের অনেক বই পড়েছিলেন।
তারপরেই তিনি ঠিক করে নেন জীবন সমপর্ণ করবেন রবিঠাকুরকে। কয়েক বছর আগে টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গুলজার জানিয়েছেন, এক সময়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা হিন্দিতে অনুবাদ করেছেন ইংরেজি অনুবাদ থেকে। কিন্তু তাঁর মন বলত, রবিঠাকুরের মূল বাংলা শব্দগুলির মধ্যে যে গভীর সৌন্দর্য আছে, তা ইংরেজি অনুবাদে টের পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তিনি বাংলা শিখতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মন দখল করে নেন এর পরে। রাত-দিন শুধু বাংলা শিখতে শুরু করেন তিনি। লক্ষ্য একটাই রবিঠাকুরের লেখা হিন্দিতে অনুবাদ করা।
সেই থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রতি অনুরাগ বর্তমান সময়ে ভারতের অন্যতম সেরা কবির। রবীন্দ্রনাথ চর্চায় এক সময়ে বহু সময় কাটিয়েছেন তিনি। এখনও রবীন্দ্রনাথ তাঁর পথচলার সঙ্গী, সেটাও জানান গুলজার সাহেব।

সে সময়টায় ভারত বিভাগের ফলে দাঙ্গা হাঙ্গামায় তাদের পরিবারটাও খারাপ অবস্থায় পড়ে।
দেশভাগের পর চলে আসেন দিল্লীর রওশন আরা বাগে। সেখানেই ইউনাইটেড খৃস্টান স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন। ইন্টারমিডিয়েট পড়তে পড়তেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে বিদায় জানান তিনি। সঙ্গীহীন মাতৃহারা বিষণ্ণ এক কিশোর বইয়েয় মধ্যেই খুঁজে পান বন্ধুত্বের দুনিয়া। সাহিত্যের প্রতি তীব্র পিপাসা তাকে আরও গভীর পড়াশোনায় ডুবিয়ে দেয়। সাহিত্যের পাশাপাশি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও চিত্রকলার প্রতি গভীর মনোযোগী হয়ে পড়েন তিনি।ভারতীয় সুর,শব্দ ও চিত্রের জগতকে তিনি এক সুতোয় বেঁধেছেন। একাধারে সুকবি, গায়ক অন্যদিকে চিত্র পরিচালক। হিন্দি ও উর্দু ভাষায় লেখা ছোটগল্পে তিনি তৈরি করেছেন এক অনির্ণীত জগত।
দিল্লিতে পড়াশোনার পর তিনি মুম্বাইতে চলে যান রোজগারের জন্য। সেখানে তিনি বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন। পোড়খাওয়া জীবন থেকে তিনি দিনে দিনে স্বমহিমায় উজ্জ্বল শিখরে আরোহন করেন।
গাড়ির পেইন্টার হিসেবে কাজ করেন গুলজার।কাজ ছিল দুর্ঘটনায় কবলিত গাড়িগুলোকে নতুন করে পেইন্টিং করা।
তার মতে, এই কাজের পাশাপাশি তিনি অনেক সময় পেতেন। আর সেই সময়টা তিনি পড়া ও লেখার কাজে লাগাতেন।
দারিদ্র্যের জোয়ারে ভাসতে থাকা গুলজার তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতেন লেখক হওয়ার। সেজন্য গুলজার দীনভী এবং পরবর্তীতে গুলজার নাম ধারণ করেন তিনি।
এক সময় তিনি ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন , প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং পাঞ্জাবি সাহিত্য সভার সঙ্গে যুক্ত হন। এসব অ্যাসোসিয়েশনে সরদার জাফরী, কৃষণ চন্দর, কাঈফী আজমী, সাহির লুধিয়ানভি, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, গুরওয়েল সিং পান্নু, সুখবীর, রাজিন্দর সিং বেদি এবং বলরাজ সাহানির মতো কবি, লেখক, অভিনেতা ও শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব হয় তাঁর। আর এ থেকেই তার জীবনের মোড় পালটে যায়।
ষাটের দশকের প্রথম দিকের কোনো এক রোববার প্রোগ্রেসিভ রাইটারস অ্যাসোসিয়েশনের মিটিংয়ে গীতিকার শৈলেন্দ্র ও নির্মাতা বিমল রায় তাকে বলেন, চলচ্চিত্রে কাজ করার জন্য। তাদের উৎসাহে গুলজার রাজি হন। বিমল রায়ের ‘বন্দিনী’ সিনেমায় গান লিখলেন গুলজার। সে গানে সঙ্গীত পরিচালনা করলেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি সঙ্গীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মন । বিমল রয় ছাড়াও আরো অনেক গুণী মানুষদের সংস্পর্শে এসে তিনি কাজ করেছেন। সুরকার শচীন দেব বর্মণ, নির্দেশক হৃষিকেশ মুখার্জী তার মাঝে অন্যতম।
বিমল রয়ের সাথে প্রথম দেখা করতে যাওয়ার ঘটনাটি ছিল দারুণ। দেবু সেন নামে একজন কবি গুলজারকে একটি চলচ্চিত্রে কাজের জন্য বিমল রয়ের অফিসে নিয়ে যায়। অফিসের রুমে যাওয়ার পর গুলজারের সম্পর্কে সব জেনে বাংলায় দেবু সেনকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, বৈষ্ণব কবিতা কী, এর মর্ম কী, এসবের কিছু কি এই লোক বুঝবে? দেবু তখন বিমল রয়কে বলে, দাদা, উনি বাংলা বুঝেন, বাংলার অনেক গল্প-উপন্যাস তিনি পড়ে এসেছেন। এ কথা শুনে বিমল রায় বেশ অপ্রস্তুত হয়ে যান। এক সাক্ষাৎকারে গুলজার বলেন, এখনো বিমল রয়ের মুখের সেই অপ্রস্তুত ভাব তিনি ভুলতে পারেন না। এরপর থেকেই গুলজার তার সাথে কাজ করা শুরু করেন। বিমল রয়ের কাছে গুলজার অত্যন্ত ঋণী, কারণ তিনিই প্রথম গুলজারের প্রতিভা বুঝতে পেরেছিলেন এবং তাকে কাজ করতে ভরসা দিয়েছিলেন। এগুলো তাকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।
চলচ্চিত্রে এসেও গুলজার ঝুঁকে যাননি কথিত কমার্শিয়াল ভুবনে। তিনি বেছে বেছে সাহিত্য নির্ভর এবং মানসম্মত কাজেই নিজেকে যুক্ত করলেন। গান লেখার পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও লেখা শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে ‘আশীর্বাদ’ সিনেমায় তিনি প্রথম সংলাপ লিখেছিলেন। এরপর থেকে গুলজার যেসব চরিত্রের সৃষ্টি করেছেন, সেগুলোতে অভিনয় করে বহু অভিনেতা পেয়েছেন ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
১৯৬৯ সালের আগ পর্যন্ত গুলজারের গান সেভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি। তার রচিত প্রথম জনপ্রিয় গান ‘হামনে দেখি হ্যায় উন আখো কি মেহেকতি খুশবু’। ১৯৭১ সালের ‘গুড্ডি’ সিনেমায় গুলজার দুটি গান লেখেন। তার মধ্যে ‘হামকো মান কি শক্তি দেনা’ শিরোনামের প্রার্থনা সঙ্গীতটি এতোটাই গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে যে, এটি এখনো ভারতের বিভিন্ন স্কুলে বাচ্চাদের গাওয়ানো হয়।
গীতিকার হিসেবে গুলজার কাজ করেছেন উপমহাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালকদের সাথে। আগেও সেকথা কিছুটা বলা হয়েছে। আর ডি বর্মন, এস ডি বর্মন, শংকর জয়কিশান, হেমন্ত কুমার, লক্ষ্মীলাল-পেয়ারেলাল, মদন মোহন, রাজেশ রোশান ও অনু মালিকের মতো সঙ্গীত ব্যক্তিত্বের সাথে তিনি কাজ করেছেন।
লেখক-পরিচিতি এলো পরে। । কবি গুলজারের প্রথম প্রকাশিত বইটি ছোটগল্পের বই, যেটির নাম চৌরাস রাত (১৯৬২)। ১৯৬৩-তে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতার বই জানম। একই সঙ্গে উর্দু ও হিন্দি ভাষায় তিনি রচনা করে চলেন কবিতা ও ছোটগল্প। রাত প্যশমীনে কী কবিতার বইটি তেমনি একটি বই, যেটি একই সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে দুই ভাষাতেই।
এবার গুলজারের লেখা কালজয়ী গানগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘ছাইয়া ছাইয়া’। বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহমানের সুরে এই গান ছিল শাহরুখ-মনিশা কৈরালা অভিনীত সিনেমা ‘দিল সে’-এর সবচেয়ে জনপ্রিয় গান। এ আর রহমানের সুরে ২০০৭ সালে গুলজার গান লিখলেন ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’ সিনেমায়। ‘জয় হো’ শিরোনামের সেই গানের জন্য উপমহাদেশের একমাত্র গীতিকার হিসেবে অস্কার জয় করেন গুলজার। একই গানের জন্য তিনি অর্জন করেন বিশ্ব সঙ্গীতের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার গ্র্যামি-ও।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গুলজার অসংখ্য সিনেমায় গান লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ‘দ্য স্কাই ইজ পিঙ্ক’, ‘রাজি’, ‘রাঙ্গুন’, ‘ওকে জানু’, ‘মিরজা’, ‘তালভার’, ‘দৃশ্যাম’, ‘হায়দার’, ‘যাব তাক হ্যায় জান’, ‘ সাত খুন মাফ’, ‘স্ট্রাইকার’, ‘ইশকিয়া’, ‘ভীর’, ‘রাজনীতি’, ‘বিল্লু’, ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’, ‘ঝুম বারাবার ঝুম’, ‘জান-এ-মান’, ‘ওমকারা’, ‘রেইনকোট’, ‘বান্টি অউর বাবলি’, ‘মাকবুল’, ‘দিল সে’, ‘মাসুম’, ‘সদমা’, ‘খাট্টা মিঠা’, ‘মৌসাম’, ‘নামাক হারাম’ ইত্যাদি।
গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজের পাশাপাশি গুলজার আসেন চলচ্চিত্র নির্মাণেও। ১৯৭১ সালে তিনি প্রথমবারের মতো নির্মাণ করলেন ‘মেরে আপনে’ সিনেমাটি। এরপর তিনি ‘পরিচয়’, ‘কোশিশ’, ‘আচনক’, ‘আন্ধি’, ‘খুশবু’, ‘লিবাস’, ‘মাচিস’, ‘হু তু তু’ ইত্যাদি সিনামগুলো নির্মাণ করেন তিনি। গুলজার তার সিনেমাগুলোতে মানুষের সম্পর্ককে সামাজিক বিভিন্ন ইস্যুর সঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবে তুলে ধরতেন।
কবি গুলজারের সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হলো তিনি সাহিত্য বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। ভিন্ন ধারার সিনেমাগুলো তৈরি হতো ভালো কোনো সাহিত্যিকের গল্প-উপন্যাস থেকে। গুলজারের ক্ষেত্রে দেখা যায় তিনি আগে থেকেই সেসব গল্প-উপন্যাস পড়ে রেখেছেন। গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের সাথে পরিচয় থাকার কারণে চরিত্রগুলোর আবেগ, অনুভূতি সম্পর্কে তার ভালো ধারণা থাকতো। সে কারণে চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোকে মূল গল্পের চরিত্রের সাথে মিলিয়ে অভিনয় করতে কোনো অভিনেতা বা অভিনেত্রীর সমস্যা হতো না।
কোশিশ চলচ্চিত্রে সঞ্জীব কুমার এবং জয়া ভাদুড়ীর বাকশক্তিহীন দুই দম্পতির অভিনয় কিংবা আঁধি চলচ্চিত্রে সঞ্জীব কুমার এবং সুচিত্রা সেনের অভিনয় দেখে কে মুগ্ধ হয়নি? সত্তর দশকে হিন্দি সিনেমার জগতে যখন শুধুই মারপিট আর এংরি ইয়াং ম্যানের যুগ চলছিল তখন ভিন্ন ধাঁচের গল্প, ভিন্ন ধাঁচের প্রেক্ষাপট ও ভিন্ন আখ্যানভাগের এ দুটি সিনেমা দর্শকদের মনে আলাদা দাগ কেটেছিল
কোশিশ চলচ্চিত্রের একটি আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এতে বোবা এবং বধিরদের কথা বলার যে সংকেতগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তা পুরোপুরি সঠিক। এ সম্পর্কে রীতিমতো প্রশিক্ষণ নিয়ে তা অভিনয়ে আনা হয়। তখনকার সময়ে এরকম সিনেমা একদমই হতো না। কিন্তু গুলজার গতানুগতিক চলচ্চিত্র না বানিয়ে ভিন্ন ধাঁচের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র বানাতেন, যা দর্শকদের ভালো লাগতো। এগুলো সমালোচকদেরও পছন্দ হতো। বেশ কিছু চলচ্চিত্র অবশ্য অর্থনৈতিকভাবে সফলতার মুখ দেখেনি। তবে অর্থনৈতিকভাবে সফল না হলেও পরবর্তীতে সেগুলো ক্লাসিকের মর্যাদা অর্জন করেছে।
আন্ধি (অনুবাদ. 'ঝড়') হল একটি ১৯৭৫ সালের ভারতীয় রাজনৈতিক ড্রামা চলচ্চিত্র যেখানে সঞ্জীব কুমার এবং সুচিত্রা সেন অভিনীত এবং গুলজার পরিচালিত। সেই সময়ে অভিযোগ করা হয়েছিল যে ছবিটি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জীবন এবং তার বিচ্ছিন্ন স্বামীর সাথে তার সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে, শুধুমাত্র চেহারাটি রাজনীতিবিদ তারকেশ্বরী সিনহা এবং ইন্দিরা গান্ধী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। গল্পটি বেশ কয়েক বছর পর একটি বিচ্ছিন্ন দম্পতির সুযোগে সাক্ষাতের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, যখন স্ত্রী আরতি দেবী, এখন একজন নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ একটি নির্বাচনী প্রচারণার সময় তার স্বামীর দ্বারা পরিচালিত হোটেলে থাকতেন। মুভিটি রাহুল দেব বর্মনের রচিত গানের জন্য বিখ্যাত, গুলজার লিখেছেন এবং কিশোর কুমার এবং লতা মঙ্গেশকর গেয়েছেন।
পড়াশোনা করা লোকজনদের খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখেন গুলজার। তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘মেরে আপ্নে’তে কোনো পরিচিত মুখ নেননি। ভারতের National School of Drama থেকে অভিনয় শিখে আসা অভিনেতাদের নিয়ে তিনি চলচ্চিত্রটি তৈরি করেন। এ চলচ্চিত্রটি পরবর্তীতে প্রভাবশালী ও শক্তিশালী চলচ্চিত্রের মর্যাদা অর্জন করে।
১৯৯৬ সালে বৈপ্লবিক চলচ্চিত্র ‘মাচিস’ নির্মাণ করেন গুলজার। চলচ্চিত্রের বিখ্যাত গান চাপ্পা চাপ্পা চারখার
তার কবিতা এবং লেখনী নিয়ে কেউ কখনো নেতিবাচক মন্তব্য করেনি। যারা তার কবিতা ও গান পড়েছে কিংবা শুনেছে তারা একটি বিষয় স্বীকার করেছে- তার প্রতিটি লেখার কোনো না কোনো অংশের সাথে তাদের জীবনের কোনো একটি ঘটনার মিল রয়েছে। সাধারণ মানুষকে যেন পড়তে পারেন গুলজার। তিনি এমন এক কবি যাকে জনসাধারণের কবি বললে ভুল হবে না। চলচ্চিত্র জগতে তিনিই একমাত্র মানুষ যিনি সাহিত্যকে জনসাধারণের জন্য নির্মাণ করতে পেরেছেন। আর তিনি এ কাজটি করেছেন তার সংলাপ, গান এবং চলচ্চিত্র দিয়ে।
একবার কবিতা লেখা নিয়ে তাকে একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল- কবি হতে গেলে এবং কবিতা লিখতে হলে কি কাউকে উদাস হতেই হবে? উদাসী না হলে কি কবিতা লেখা যাবে না? তখন কবি গুলজার চমৎকার একটি উত্তর দিয়েছিলেন- মানুষের জীবনে উদাসীনতা একটু বেশী সময় ধরে থাকে, আর সুখ কিংবা আনন্দ হয় অনেকটা ফুলঝুরি বা আতসবাজির মতো যেটা বেশী সময় থাকে না। নিমিষেই আলো দিয়ে ফুঁড়িয়ে যায়। কিন্তু উদাসী অনেকটা আগরবাতির মতো। চারদিকে নিজের বাসনা বা গন্ধ ছড়িয়ে দেয়।
একথা অনস্বীকার্য যে তিনি যা-ই লিখেন না কেন, সেটা গান হোক, সংলাপ হোক, গল্প কিংবা উপন্যাস-চিত্রনাট্য হোক, তার লেখা প্রতিটি শব্দই জীবন্ত হয়ে ওঠে।
গুলজার যেমন অসাধারণ সব সৃষ্টিকর্ম উপহার দিয়েছেন, তেমনি তার অর্জনের পাল্লা হয়েছে ভারি। এক জীবনে যেন সব কিছুই অর্জন করে নিয়েছেন তিনি। ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন পাঁচবার, রেকর্ড সংখ্যক ২১ বার পেয়েছেন ফিল্মফেয়ার পুরস্কার; একবার অস্কার ও একবার গ্র্যামি আছে তার ঝুলিতে। এছাড়া ভারত সরকারের কাছ থেকে পদ্মভূষণ, এবং ভারতের চলচ্চিত্রে সর্বোচ্চ সম্মাননা দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন গুলজার।উর্দু ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ২০২৩ সালের জন্য ৫৮তম জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে সম্মানিত হলেন কবি,গীতিকার, পরিচালক গুলজার।
ব্যক্তি জীবনে গুলজার বিয়ে করেছেন অভিনেত্রী রাখিকে। তাদের একমাত্র সন্তান মেঘনা গুলজার। তিনিও এই সময়ের একজন আলোচিত নির্মাতা। যিনি ‘ফিলহাল’, ‘তালভার’ ও ‘রাজি’-এর মতো সিনেমা নির্মাণ করেছেন। সর্বশেষ মেঘনা গুলজার ‘ছপাক’ সিনেমাটি নির্মাণ করে প্রশংসিত হয়েছেন।

হিন্দি থেকে গুলজারের কয়েকটি কবিতা ও শায়েরী অনুবাদ করে দেখা যেতে পারে।

১)এসো তোমাকে কাঁধে তুলে নেই, তোমার ঠোঁট দিয়ে আমাকে চুমু দাও
চাঁদের কপালে চুমু দিতে
আজ রাতে দেখনি?
কনুই বাঁকালে কিভাবে
চাঁদ এত কাছে এসে গেছে।

২) দেখ, আস্তে আস্তে চল
দেখ, একবার দেখ।
পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে না কেন!
নির্জনে কাচের স্বপ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে
স্বপ্ন ভেঙে যায় কেউ দেখে না জেগে,
জেগে উঠলে কিছু স্বপ্ন মরে যাবে।

৩)দেখ, ধীরে ধীরে আরও ধীরে ধীরে হাঁট
দেখ, চিন্তা কর আর সাবধানে পা ফেলো
পায়ের শব্দ জোরে হওয়া উচিত নয়
একাকীত্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাঁচের স্বপ্নে
স্বপ্ন ভেঙ্গে দেওয়া উচিত নয়, কেউ জেগে উঠবে না।
জেগে উঠলে যে কোনো স্বপ্ন মরে যাবে।
সুরেলা কথা বলো সুরেলা কথা বলো,
টক-মিষ্টি চোখের রসালো কথা।
রাতে চাঁদে মিছরি মেশান,
দিনের দুঃখগুলো নোনতা মনে হয়।
নোনতা চোখের মাতাল শব্দ,
ডুবন্ত ছায়াগুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
সন্ধ্যার ঘ্রাণ যেন তোমার কাছে না পৌঁছায়,
অনুরণিত চোখের মাতাল শব্দ।
দেখো, ধীরে চল!
দেখো, ধীরে ধীরে চল, আরও ধীরে ধীরে,
দেখো, ভেবে চিন্তে সাবধানে পা ফেলো,
পায়ের শব্দ জোরে হওয়া উচিত নয়।
একাকীত্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাঁচের স্বপ্ন,
কারো স্বপ্ন যেন ভেঙ্গে না যায়, কেউ জেগে না যায়,
জেগে উঠলে যে কোনো স্বপ্ন মরে যাবে।
অনেকবার দেখেছি মানুষের কাছে বিক্রি
বিক্রিতে প্রতিবারই প্রত্যাশা ভেঙ্গে যায়
জীবনের এই বাজারে ভাল, সবাই
গুনতে হলেই দেয় এবং নেয়।
কিন্তু প্রতিবারই কিছু স্মৃতি রেখে যায়
জীবনের এই বাজারে ভাল, সবাই
গুনতে হলেই দেয় ও নেয়।
কিন্তু প্রতিবারই কিছু স্মৃতি রেখে যায়
জীবনের এই বাজারে কয়েক বছর পর জানা যায়
আজও বাজার একইভাবে চলছে
আর আমরাও সবার মতো দৌড়াতে থাকলাম
জীবনের এই বাজারে..!!

( অনুবাদ: প্রাবন্ধিক)


গুলজারের লেখা কয়েকটা হিন্দি শায়েরীর অনুবাদ।
১.কেউ বুঝলে
একটা কথা বলি সাহেব..
একাকীত্ব একশো গুণ ভালো
নিকৃষ্ট মানুষের কাছ থেকে..
২.
গতকাল যা হয়েছে সবই তোমার
আজকের গল্প আমাদের
৩..
সেই ভালোবাসাও তোমার ছিল সেই ঘৃণাও তোমার।
কার কাছে আমরা আমাদের আনুগত্যের বিচার চাইব?
সে শহরও তোমার, সে আদালতও তোমার।
মেধা,মনন, চিন্তা চেতনা, ধৈর্য , অধ্যাবসায়ের বলে
গুলজার আজ আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল।
( অনুবাদঃ প্রাবন্ধিক)
গুলজারের বহুমাত্রিক প্রতিভার আলোকচ্ছটা স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবে চিরকালের জন্য মনে করি।
0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in







বাংলা গল্প উপন্যাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্র (১৯১৬--১৯৭৫) বাংলা সাহিত্য জগতে প্রায় বিস্মৃত প্রায়। অথচ তিনি তাঁর গল্প উপন্যাসে পরিচিতদেরে সুপরিচিত করে তুলেছেন আঁর মানসলোকের স্মৃতি থেকে নিজস্ব ঘরাণায়।

নরেন্দ্র মিত্র ‘চাঁদমিঞা’, ‘কাঠগোলাপ’, ‘চোর’, ‘রস’, ‘হেডমাস্টার’, ‘পালঙ্ক’, ‘ভুবন ডাক্তার’, ‘সোহাগিনী’, ‘আবরণ’, ‘সুহাসিনী তরল আলতা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য গল্পের স্রষ্টা । তাঁর প্রায় পাঁচ শত গল্পে অর্থনৈতিক,সামাজিক,মানসিক টানাপড়েন থাকলেও এক পর্যায়ে গল্পগুলো হয়ে উঠেছে মানব মানবীর জীবনের গল্প।

নরেন্দ্রনাথ মিত্র তার গল্পে দেশবিভাগ-দাঙ্গা-মন্বন্তর-যুদ্ধোত্তর বিপর্যস্ত অর্থনীতির টানাপেড়েনে মানুষের দু:খ কষ্টের মাঝেও কখন কখন সুখের আভাসও উঠে এসেছে। তাঁর গল্পের জমিনে ফুটে উঠেছে কষ্টের সাতকাহন। দুঃখের বিদীর্ণ প্রান্তরই যেন তাঁর গল্পের জমিন।
সত্যি কথা বলতে বাংলা ছোটপল্পের সার্থক রূপকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র অনেকটাই আজ অনালোচিত-অনালোকিত। অথচ তাঁর গল্পের বিষয় ও কাঠামোগত বিন্যাস বাংলা ছোটগল্পসহ বিশ্বছোটগল্পের সার্থক একজন প্রতিনিধি। পাঠককে নিমগ্নচিত্তে গল্পপাঠে মুগ্ধতার সাথে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে তাঁর লেখনী। জীবনের অতিসাধারণ তুচ্ছ বিষয়ও যে অসাধারণ গল্পের বিষয় হওয়া সম্ভব, তা তাঁর রচনা পাঠেই বোঝা সম্ভব।

নরেন্দ্রনাথ মিত্র ১৯১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি, বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ভাঙ্গা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আই.এ.এবং কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ-বিভাগের সময় তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় চলে গেলেও কিন্ত তাঁর মনে গেঁথে ছিল তার পূর্ববঙ্গের স্মৃতি ও ভালবাসা।
শৈশব-কৈশোর এবং যৌবনের প্রারম্ভে দেখা পূর্ববঙ্গের খাল-বিল-নদী এবং গ্রামের প্রান্তিক মানুষের যাপিত জীবনের সুখ-দু:খ, প্রেম-ভালবাসা, বিরহ-বেদনার চিত্র বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে গভীর মমতায় তুলে ধরেছেন তার গল্প - উপন্যাসে। তার লেখালেখির সূত্রপাত বাল্যকাল থেকেই। অনেকে সাহিত্যিকের মতো নরেন্দ্র মিত্র কবিতা দিয়ে লেখালেখির সূত্রপাত করেন। কিন্তু‘ শেষ পর্যন্ত তিনি গল্প ও উপন্যাস সাহিত্যের সার্থক একজন গল্পকার হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তুলতে সক্ষম হন।।

তাঁর প্রথম মুদ্রিত কবিতা 'মূক', প্রথম মুদ্রিত গল্প 'মৃত্যু ও জীবন' দুটোই 'দেশ' পত্রিকায় ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয়। বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য ও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে একত্রে প্রথম কাব্যগ্রন্থ’ 'জোনাকি' (১৩৪৫ বঙ্গাব্দ)। প্রথম গল্প-সংগ্রহ 'অসমতল' (১৩৫২ বঙ্গাব্দ)। প্রথম উপন্যাস 'হরিবংশ'। চার দশক ধরে তিনি প্রায় পাঁচশো গল্প লিখেছেন। সেই সব গল্পগুলো প্রায় পঞ্চাশটি গল্পগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। তাঁর লেখা গল্প সংকলনগুলো হল ‘অসমতল’,‘হলদে বাঢ়ি’,‘চডাই- উৎরাই’,‘বিদ্যুতলতা’,‘সেতার’,‘ উল্টোরথ’,‘পতাকা’ ইত্যাদি, যা চার দশক ধরে লিখেছেন।

অন্যদিকে তাঁর লেখা উপন্যাসগুলো হচ্ছে ‘রূপমঞ্জরী’,‘অক্ষরে অক্ষরে’ ‘দেহমন’, ‘দূরভাষিণী’, ‘সঙ্গিনী’, ‘অনুরাগিণী’, ‘সহৃদয়া’ ‘গোধুলি’, ‘শুল্কপক্ষ’, ‘চোরাবালি’, ‘পরস্পর ‘,জলপ্রপাত’, ‘কণ্যাকুমারী’, ‘সুখ দুঃখের ঢেউ’, ‘প্রথম তোরণ’,‘তার এক পৃথিবী’,‘সেই পথটুকু’,‘নীড়ের কথা’,‘নতুন ভূবন’,‘জলমাটিরগন্ধ’,‘শিখা’,‘অনাত্মীয়া’‘নতুন তোরণ’, ‘সূর্যমুখী,‘সিঁদূরে মেঘ নির্বাস ‘ ইত্যাদি। উপন্যাসের মধ্যে 'দীপপুঞ্জ', 'চেনামহল', 'তিন দিন তিন রাত্রি' ও 'সূর্যসাক্ষী', দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশকাল থেকেই কিশেষ ভাবে সমাদৃত। তিনি ছোটগল্পকার হিসাবে বাংলা গল্প সাহিত্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন সেটাই বক্ষ্যমান নিবন্ধে তাঁর লেখা মাত্র একটি গল্পের উপর আলোচনা করে বুঝবার চেষ্টা করবে। এক্ষেত্রে মিত্রের ছোটগল্পগুলোর মাঝ থেকে সর্বাপেক্ষা পাঠকপ্রিয় ছোটগল্প ‘ রস’ এর উপর স্বল্প পরিসরে আলোকপাত করতে পারি।

‘রস’ তাঁর এক অনবদ্য সৃষ্টি। গল্পটি নিয়ে বহু নাটক, টিভি সিরিয়াল ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। হিন্দি চলচ্চিত্র ‘সওদাগর’-এ দুনিয়াখ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন অভিনয় করেছেন।
নরেন্দ্র মিত্রে নিজের কথা থেকেই উপলব্ধি করা যায় তিনি তাঁর নিজের দেখা ঘটনাপ্রবাহকে গল্পের আকারে তুলে এনেছেন। তিনি তাঁর পরিচিতদেরেকে সুপরিচিত করে তুলেছেন সে কথা তাঁর বিখ্যাত গল্প ‘ রস’ এর ভুমিকা থেকে আমরা জানতে পারি।।
নরেন্দ্র মিত্র বলেছেন রস গল্পের ভূমিকায় বলেছেন , ‘ এ গল্পের যে পটভূমি তা আমার খুবই পরিচিত। পূর্ববঙ্গে আমাদের গ্রামের বাড়িতে পূর্বদিকে ছিল একটি পুকুর। সেই পুকুরের চারধারে ছিল অজস্র খেজুর গাছ। ছেলেবেলা থেকে দেখতাম আমাদের প্রতিবেশী কিষাণকে সে সব খেজুর গাছের মাথা চেঁছে মাটির হাঁড়ি বেঁধে রাখত। বাঁশের নল বেয়ে সেই হাঁড়িতে সারারাত ধরে ঝির ঝির করে রস পড়ত। সেই রস কড়াইতে করে, বড় বড় মাটির হাঁড়িতে করে জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করতেন আমাদের মা-জেঠীমারা। শীতের দিনে রস থেকে গুড় তৈরির এই প্রক্রিয়া মায়ের পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে রোজ দেখতাম। আমাদের চিরচেনা এই পরিবেশ থেকে ‘রস’ গল্পটি বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু রসের যে কাহিনীর অংশ; মোতালেফ, মাজু খাতুন আর ফুলবানুকে নিয়ে যে হৃদয়দ্বন্দ্ব, খেজুর রসকে ঘিরে রূপাসক্তির সঙ্গে যে জীবিকার সংঘাত তা কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আসেনি। সেই কাহিনী আমি দেখিওনি, শুনিওনি। তা মনের মধ্যে যেন আপনা থেকেই বানিয়ে বানিয়ে উঠেছে।’

গল্পকার তার গ্রামে দেখা একটা সাধারণ ঘটনাকে অবলম্বন করে উঁচুদরের শিল্পোত্তীর্ণ, রস সমৃদ্ধ ‘রস’ গল্পটি রচনা করেছেন। এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আছে মোতালেফ গাছি। সে নারী বিলাসী প্রেমিক পুরুষ হলেও জীবন ও যৌবনের চাহিদা মেটানোর জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করতে সে কসুর করেনি।

আমরা তার রস গল্পের সারাংশ তুলে ধরে মূল গল্প থেকে আংশিক উদ্ধৃতি দিতে পারি নরেন্দ্র মিত্রে সৃজনশীলতা ও পরিচিত গল্পকে সুপরিচিত আঙ্গিকে রূপদানের ক্ষমতাকে বুঝানোর জন্যে। তাঁর ‘রস’ গল্পের শুরুটা এমন:

‘ কার্তিকের মাঝামাঝি চৌধুরীদের খেজুরগাছ ঝুড়তে শুরু করল মোতালেফ। তারপর দিন পনেরো যেতে না যেতেই নিকা করে নিয়ে এল পাশের বাড়ির রাজেক মৃধার বিধবা স্ত্রী মাজু খাতুনকে। পাড়াপড়শি সবাই অবাক। এই অবশ্য প্রথম সংসার নয় মোতালেফের। এর আগের বউ বছরখানেক আগে মারা গেছে। তবু পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের জোয়ান পুরুষ মোতালেফ। আর মাজু খাতুন ত্রিশে না পৌঁছলেও তার কাছাকাছি গোছে। ছেলেপুলের ঝামেলা অবশ্য মাজু খাতুনের নেই। মেয়ে ছিল একটি, কাটিখালির সেখেদের ঘরে বিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ঝামেলা যেমন নেই, তেমনি মাজু খাতুনের আছেই-বা কী? বাক্স সিন্দুক ভরে যেন কত সোনাদানা রেখে গেছে রাজেক মৃধা, মাঠ ভরে যেন কত ক্ষেতখামার রেখে গেছে যে তার ওয়ারিশি পাবে মাজু খাতুন। ভাগের ভাগ ভিটার পেয়েছে কাঠাখানেক, আর আছে একখানি পড়ো পড়ো শণের কুঁড়ে। এই তো বিষয়-সম্পত্তি, তারপর দেখতেই-বা এমন কী একখানা ডানা-কাটা হুরির মতো চেহারা। দজ্জাল মেয়েমানুষের আঁটসাঁট শক্ত গড়নটুকু ছাড়া কী আছে মাজু খাতুনের যা দেখে ভোলে পুরুষেরা, মন তাদের মুগ্ধ হয়।’

মাজু খাতুনকে বিয়ে করার পাড়া প্রতিবেশী মহিলারা মোটেই খুশি নয় । তারা মনে করে দজ্জাল স্বভাবের মাজু তুকতাক করে মোতালেফ গাছিকে বশ করেছে। মোতোলেফের ইচ্ছে ছিল কম বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করার, সে চেষ্টাও কিন্তু কম করেনি। কিন্তু অল্প বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করতে অনেক পয়সা করি দরকার। চরকান্দার এলেম শেখের আঠার-উনিশ বছরের মেয়ে ফুলবানুকে মোতালেফ এর বেশি মনে ধরেছিল।কিন্তু ফুলবানুকে পাওয়ার জন্য তার বাবাকে অনেক টাকা দেওয়া লাগবে, তার সে কোথায় পাবে! তবুও ফুলবানুকে পাওয়ার জন্য সে কম চেষ্টা করেনি।আমরা আবার নরেন্দ্র গল্প থেকে উদ্ধৃত দিতে পারি।

‘ ইতোমধ্যে অবশ্য এক হাত ঘুরে এসেছে ফুলবানু। খেতে-পরতে কষ্ট দেয়, মারধর করে এসব অজুহাতে তালাক নিয়ে এসেছে কইডুবির গফুর সিকদারের কাছ থেকে। আসলে বয়স বেশি আর চেহারা সুন্দর নয় বলে গফুরকে পছন্দ হয়নি ফুলবানুর। তালাক নেয়া হলেও চেকনাই ও জেল্লাই দেহ আর রসের ঢেউ খেলা মন মোতালেফকে টেনেছে বিশেষভাবে; ‘ফরসা ছিপছিপে চেহারা’ আর ‘ঢেউ খেলানো টেরিকাটা বাবরিওয়ালা’ খেজুর রসের কারবারি মোতালেফকেও চোখে ধরেছে ফুলবানুর ।’

ফুলবানুকে বউ হিসাবে পাওয়ার জন্য টাকা দিতে না পেরে মন:ক্ষুন্ন হয়ে মোতালেফ ফুলবানুর বাবার কাছ থেকে বাড়ি ফেরার সময় পথে জঙ্গলের ধারে মুখোমুখি হয় ফুলবানুর । ফুলবানু মোতালেফকে বলে- ‘কী মেঞা, গোসা কইরা ফিরা চললা নাকি?... পছন্দসই জিনিস নেবা, বাজানের গুনা, তার দাম দেবা না?... শোনো, বাজানের মাইয়া টাকা চায় না, সোনাদানাও চায় না, কেবল মান রাখতে চায় মনের মাইনষের। মাইনষের ত্যাজ দেখতে চায়, বুঝছ ?’ ’ মোতালেফ ফুলবানুকে ঘরে তোলার জন্য ব্যাকুল। জানায় : ‘শীতের কয়ডা মাস যাউক, ত্যাজও দেখাব, মানও দেখাব। কিন্তু‘ বিবিজানের সবুর থাকবেনি দেখবার ?’

ফুলবানুর কথা শোনার পর থেকে মোতালেফ মরিয়া হয়ে ওঠে ধারকর্জ করে টাকা জোগাড় করতে। কিন্তু ধারকর্জ সে পায় না। কিন্তু সে ফুলবানুকে পাওয়ার জন্য হাল ছাড়ে না। মোতালেফ গাছির প্রত্যাশা পূরণের জন্যই যেন খেজুর গাছগুলো উন্মুখ হয়ে উঠে। যুবতী নারী লোভী রস আহোরণকারী মোতালেফের ভাগ্যে যেন সুদিন আসার আভাস দেখা দেওয়ার কথা নরেন্দ্র মিত্রের কলমে কীভাবে উঠে এসে আমরা দেখতে পারি।

‘কিন্তু নগদ টাকা ধার না-পেলেও শীতের সূচনাতেই পাড়ার চার-পাঁচ কুড়ি খেজুরগাছের বন্দোবস্ত পেল মোতালেফ। গত বছর থেকেই গাছের সংখ্যা বাড়ছিল, এবার চৌধুরীদের বাগানের, অর্ধেক তার। মেহনত কম নয়, এক একটি করে এতগুলো গাছের শুকনো মরা ডালগুলো বেছে-বেছে আগে কেটে ফেলতে হবে। বালিকাচার ধার তুলেতুলে জুতসই করে নিতে হবে ছ্যান। তারপর সেই ধারালো ছ্যানে গাছের আগা চেঁছে চেঁছে তার মধ্যে নল পুঁততে হবে সরু কঞ্চি ফেড়ে। সেই নলের মুখে লাগসই করে বাঁধতে হবে মেটে হাঁড়ি। তবে তো দেড়কুড়ি গাছ বেশি হল। গাছ কেটে হাঁড়ি পেতে রস নামিয়ে দিতে হবে। অর্ধেক রস মালিকের রাতভরে টুপটুপ করে রস পড়বে সেই হাঁড়িতে। অনেক খাটুনি, অনেক খেজমৎ। শুকনো শক্ত খেজুরগাছ থেকে রস বের করতে হলে আগে ঘাম বের করতে হয় গায়ের। এ তো আর মা’র দুধ নয়, গাইয়ের দুধ নয় যে বোঁটায় বানে মুখ দিলেই হল।’

কথাসাহিত্যিক নরেন্দ্র মিত্র তার চিরচেনা দৃশ্যপট থেকে আহরিত অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে তার রস গল্পে নারীর মন ও শরীর থেকে পুরুষের রস সংগ্রহের কলাকৌসল তুলে ধরেছেন। একজন গাছিকে খেজুর গাছের শক্ত মাথা থেকে রস সংগ্রহ করতে পরিশ্রান্ত হতে হয়। নিয়মকানুন মেনে খেজুর গাছের মাথায় বাঁধা হাড়িতে সারারাত টুপটাপ শব্দ করে রস পড়ে হাড়ি রসে পূর্ণ হয়।

খেজুর রসের কারবারি মোতালেফের ওস্তাদ রাজেক মৃধা। মোতালেফ রাজেক মৃধার কাছ থেকে খেজুর গাছের শুকনো মাথা ‘ ছ্যানদা ‘ দিয়ে কেটে রস বের করার দক্ষতা অর্জন লাভ করে। রাজেকের কয়েকজন শাগরেদের মধ্যে মোতালেফই পাকা সফল গাছি হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে। রাজেক মরার পর তার স্ত্রীকে ঘরের বউ করে আনার পেছনে একটা বড়সড় কারণ ছিল। খেজুর গাছ কেটে রস জোগাড় করলেই তো গুড়, পাটালি তৈরি হয় না। মোতালেফে মা মরেছে তার দু’বছর বয়সের সময়। বউটাও অকালে, এখন কে রস জ্বাল দিয়ে গুড় পাটালি বানাবে?

মোতালেফের রস জ্বাল দেওয়ার জন্য মাঝ বয়সী বিধবা মাজু খাতুনকে পেয়ে পয়সার বিনিময়ে রস জ্বাল দেওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু রস বা গুড় সামান্য হলেও চুরি করার সন্দেহে তাকে দিয়ে পুরোটা শীতকাল কাজ করায় না। তারপরও সে মজুরি হাঁকে প্রায় দ্বিগুণ। এবার মোতালেফের ভিন্ন ফঁন্দি আটে। ভণিতা না করেই মোতালেফ সরাসরি মাজুকে বলে সে মজুরি প্রদান নয়, ষোলআনা লাভের মালিক বানাতে চায়; বিয়ে করে ঘরের বউ করে নিয়ে যেতে চায়। সামনে রসের সময় আসছে। মাজুর মতো আঁটসাঁট মেয়েমানুষ তার প্রয়োজন। তা না হলে এত গাছের এত এত রস সামাল দেবে কে? তবে, মাজুর সামান্য আপত্তি এ জন্য যে, জগতে যুবতী মেয়ে থাকতে মধ্যবয়সী মাজুকে তার কী দরকার? এমন প্রশ্নের জবাবে মোতালেফ বলে :
‘কমবয়সী মাইয়া-পোলা অনেক পাওয়া যায়। কিন্তু শত হইলেও তারা কাঁচা রসের হাঁড়ি।... তুমি হইলা নেশার কালে তাড়ি আর নাস্তার কালে গুড়, তোমার সাথে তাগো তুলনা?’ নারী-ভুলানো কৌশল আর নারীর মাদকতা ও মিষ্টত্ব বিষয়ে সতর্ক মানুষ মোতালেফ। এমন ‘খাপসুরৎ’ আর ‘মানানসই কথা’র লোক — রসিক-সমর্থ পুর“ষ মানুষ, তাকে অগ্রাহ্য করে কী করে মাঝবয়সী মাজু? কাজেই শুর“ হলো নতুন এক ‘ভাঙাচোরা-জোড়াতালি-দেওয়া’ সংসার! — যেখানে ঝানু খেলোয়াড় মোতালেফ ‘সঙ’ আর পুর“ষের আশ্রয়প্রত্যাশী চিরায়ত বাঙালি নারী মাজু হলো ‘সার’। এখন রস-আসবার কাল। শীতের প্রহর। রাতে শরীরের গন্ধ ও উষ্ণতা নেয়ার সময়! খেজুর গাছ আর রস; রস আর মেয়েমানুষ — সব মিলিয়ে শীতের প্রহরই বটে! ব্যস্ত মোতালেফ। দিনে-রাতে মাজু বিবির কোনো অবসর নেই। ‘এর-ওর বাগান থেকে, জঙ্গল থেকে, শুকনো পাতা ঝাঁট দিয়ে আনে ঝাঁকা ভরে ভরে, পলো ভরে ভরে, বিকেলে বসে বসে দা দিয়ে টুকরো টুকরো করে শুকনো ডাল কাটে জ্বালানির জন্যে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই, খাটুনি গায়ে লাগে না, অনেকদিন পরে মনের মতো কাজ পেয়েছে মাজুবানু, মনের মতো মানুষ পেয়েছে ঘরে।’‘

মোতালেফ তার কারবারের জন্য মাঝ বয়সী মাজুকে বিয়ে করলেও তার মনের মতো বউ না পেয়ে মোতালেফ কিন্তু খুশি নয়। কারণ, তার মন জুড়ে ছিল যুবতী নারী ফুলবানু।তাকে বিয়ে করার জন্য দরকার টাকা, আর সেই টাকা জোগাড় করার জন্যই খেজুর রস থেকে গুড় বানানোর জন্যই সে আপাতত মাঝবয়সী মাজুকে বিয়ে করেছে।
তার প্রয়োজন ‘রসের মানুষ’ যুবতী নারী! মাঝবয়সী শাশুড়ি হয়ে-যাওয়া মাজুকে দিয়ে তার বেশিদিন চলে কি? এক সময় গুড় বিক্রি টাকা থেকে ফুলবানুকে বিয়ে করার জন্য তার বাবা এলেমের হাতে অগ্রিম পঞ্চাশ টাকা গুঁজে দেয় মোতালেফ। তবে, মাজুকে বিয়ে করে ফেলায় এলেমের আপত্তি। কিন্তু মোতালেফ জানায় : ‘তার জন্যে ভাবেন ক্যান্ মেঞাসাব। গাছে রস যদ্দিন আছে, গায়ে শীত যদ্দিন আছে মাজু খাতুনও তদ্দিন আছে আমার ঘরে। দক্ষিণা বাতাস খেললেই সব সাফ হইয়া যাবে উইড়া।’ ফুলবানুর বাবা খুশি হয়; ফুলবানুও। তবে, ‘রসে ভরপুর’ নারী ফুলবানু খানিক গোসা করার ভান করে বলে : ‘বেসবুর কেডা হইল মেঞা? এদিকে আমি রইলাম পথ চাইয়া আর তুমি ঘরে নিয়া ঢুকাইলা আর-একজনারে।’

মাসদুয়েকের মধ্যেই ফুলবানু মোতালেফ নতুন বউ মাজুবানুর গন্ধ এবং তার পুরনো স্বামীর গায়ের গন্ধ ভুলে গিয়ে নতুন রসের সন্ধানে মিলিত হলো। মাজুবিবির স্বভাব-চরিত্র ভার না এই অভিযোগে তাকে তালাক দিয়ে মোতালেফ ফুলবানুকে ঘরে তুলল। মিথ্যা অপবাদ নিয়ে মোতালেফের ঘর ছেড়ে যাওয়ার আগে মাজু বলল: ‘তোমার গতরই কেবল সোন্দর মোতি মেঞা, ভিতর সোন্দর না। এত শয়তানি, এত ছলচাতুরী তোমার মনে! গুড়ের সময় পিঁপড়ার মতো লাইগা ছিলা, আর যেই গুড় ফুরাইল অমনি দূর দূর।’

রসের কারবারী মোতালেফ যৌবনবতী ফুলবানুকে বিয়ে করে ঘরে তুলে দু’দিক থেকেই লাভবান। ফুলবানুর পূণর্ যৌবনের রস ও খেজুর গাছের রস উপভোগ করে মোতালেফের অবস্থা রমরমা। জৈবিক চাহিদা পুরণের জন্য মোতালেফ মাজু বিবির সঙ্গে প্রতারণা করে ফুলবানুকে লাভ করলেও তার নতুন বউ ফুলবানুর কাছ থেকে কাম রস আহরণ করতে পারলেও দিনের আলোয় রস জ্বাল দিয়ে গুড় বানানোর বিষয়ে ফুলবানুর অভিজ্ঞ না থাকায় এদিক থেকে তেমন সুবিধা পায় না ফুলবানু থেকে। নারী ও রসের বিষয়ে মোতালেফের চোখ প্রখর হলেও ভালো সংসারী যে সে নয়, তার খানিকটা পরিচয় আমরা পাই গল্পকারের কহিনিতে। শুধুমাত্র শরীর দিয়ে সংসার চলে না তাতে সোহাগের দরকার পড়ে সত্যি, কিন্তু তাই বলে ঘর সংসারকে সাজিয়ে তোলার জন্য উভয়কেই একজোট হয়ে কাজ করতে হয়।

এদিকে মোতালেফের কাছ থেকে তালাক পেয়ে মাজু কিন্তু নিরাশ্রয় ভাবে থাকতে পারে না, তারও একটা আশ্রয়ের প্রয়োজন হয়। মাজু পুনরায় বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চায়, তবে এবার সোয়মী নির্বাচনে সে সতর্ক। রসের সঙ্গে কিছুমাত্র যার সম্পর্ক নেই, শীতকালের খেজুরগাছের ধারেকাছেও যে যায় না, নিকা যদি বসে মাজু খাতুন তার সঙ্গেই বসবে। রসের ব্যাপারে মাজু খাতুনের ঘেন্না ধরে গেছে। সে কম বয়সী পুরুষকে আর বিশ্বাস করতে পারে না, বিশ্বাস নেই যৌবনকে। শেষমেশ সে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক মাঝবুড়োকে বিয়ে করে ।

মাজুর মতো অনাথা মেয়েমানুষ বিপদের সময় মোতালেফের পাশে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু সুসময়ে তাকে তাড়িয়ে দেওয়ায় বিধাতা যেন মোতালেফের প্রতারণাকে মেনে নিতে পারেননি। যৌবনের তাড়নায় মোতালেফ রসে ভরা যুবতী ফুলবানুকে বিয়ে করার পর মোতালেফ গাছির ঘরে কিন্তু শাস্তি যেন আসেনি। এক সময় তার খেজুর গুড়ের কারবার লাটে ওঠে। সৌখিন শাড়ি পরা যুবতী ফূলবানু রসের সৌয়ামীর অপেক্ষায় প্রহর গোণে সেই ফুলবানুকে দিয়ে রস থেকে বাজাওে চলা গুড় বানানো হয়ে ওঠে কী করে! এ কারণেই গুড়ের ব্যবসা, বছর ঘুরতেই লাটে ওঠে মোতালেফের। সংসারে শুরু হয় অশান্তির যা শেষমেশ মারামারি-গালাগালিতে পৌঁছে।

এক সময় মোতালেফের মন খারাপ হয়। সে নিজের ভুল বুঝতে পারে।মাজুর জন্য যেন তার মন কাঁদে।,তার মন চায় মাজুর কাছে ছুটে যেতে। তাই সে একদিন মাজুর নতুন স্বামী নাদির মিঞার বাড়িতে ছুটে যায়। সঙ্গে নিয়ে রসের হাঁড়ি তাকে খাওয়ানোর জন্য নয়।মাজু রস জ্বাল দিয়ে খানিকটা গুড় তৈরি করে দিক, সে গুড় অজানা হাটে অচেনা খদ্দেরের কাছে বিক্রি করে মোতালেফ তার হারানো গুড়ের সুনাম ফেরাতে চায় ।অতিথি হিসেবে নাদিরের কাছে মোতালেফ সমাদর পায় , কিন্তু ক্ষোভে লজ্জায় অপমান করতে উদ্যত হয় মাজু। তারপরও কথা থাকে। প্রকৃতির নিয়ম বড় বিচিত্র! ভেতরে ভেতরে বোধ করি মোতালেফের জন্য মাজুরও মন কাঁদে। ভালবাসা মরে না তাই নরেন্দ্রনাথ মিত্র তার ‘রস’ গল্পটির কাহিনী শেষ করছেন এভাবে :

‘গলাটা যেন ধরে এল মোতালেফের। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আরো কী বলতে যাচ্ছিল, বাখারির বেড়ার ফাঁকে চোখে পড়ল কালো বড় বড় আর দুটি চোখ ছলছল করে উঠেছে। চুপ করে তাকিয়ে রইল মোতালেফ আর কিছু বলা হল না। হঠাৎ যেন হুঁশ হল নাদির শেখের ডাকে, ‘ও কী মেঞা, হুঁকাই যে কেবল ধইরা রইলেন হাতে, তামাক খাইলেন না, আগুন যে নিবা গেল কইলকার।’ হুঁকোতে মুখ দিতে দিতে মোতালেফ বলল, ‘না মেঞাভাই, নেবে নাই’।’
কথাশিল্পী নরেন্দ্র মিত্র ‘রস’ গল্প ছাড়াও আরো গল্পে বাংলার পরিচিত কাহিনিকে সুপরিচিত করে তুলেছেন।

গল্পের সার্থক রূপকারের মাঝেই 'দীপপুঞ্জ', 'চেনামহল', 'তিন দিন তিন রাত্রি' ও '‘সূর্যসাক্ষী'’ ইত্যাদির মতো উপন্যাসের ঔপন্যাসিক হওয়ার যোগ্যতা আছে। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর লোকান্তরিত হলেও আজ এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় নরেন্দ্রনাথ মিত্র মানব মানবীর অন্তর্লোকের অনুসন্ধানী গল্পকার।
0

প্রবন্ধ - তুহিন দাস

Posted in






লন্ডন থেকে প্রকাশিত হতো কবিতা ও সমালোচনার লিটলম্যাগ ‘নাইন’ (‘Nine’) । এ পত্রিকার সম্পাদকরা ছিলেন পিটার রাসেল, জি.এস. ফ্রাসার, ইয়ান ফ্লেচার প্রমুখ। মে ১৯৫০ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায় ৯৬-১০০ পৃষ্ঠায় কবি বুদ্ধদেব বসুর লেখা ‘দ্য সিচুয়েশন অফ দ্য রাইটার ইন বেঙ্গল টু-ডে’ শিরোনামে এ প্রবন্ধটি ছাপা হয়।

“আমি দেখেছি যে উপন্যাস, যা চিন্তা ও আবেগ প্রকাশের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী ও নমনীয় মাধ্যম ছিল, তা হলিউডের ব্যবসায়ীদের হাতে যান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক শিল্পের অধীনস্থ হয়ে উঠছিল, অথচ যা ক্ষুদ্র চিন্তা-সবচে’ নির্দিষ্ট আবেগকেও প্রতিফলিত করতে সক্ষম ছিল। অল্প গতিসম্পন্ন অনিবার্য মিথস্ক্রিয়ার কারণে একটি শিল্প যেখানে শব্দগুলো চিত্রের অধীনস্থ, সেখানে ব্যক্তিত্ব জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সেখানে একটি প্রবহমান অসম্মান ছিল, লিখিত শব্দের শক্তিকে অন্য একটি আরো চকচকে ও স্থুল শক্তির অধীন হতে দেখে আমার একটি ঘোর তৈরি হয়েছিল…।”

এ কথাগুলো কুড়ির দশকের আমেরিকান মেধাবী উপন্যাসিক এফ. স্কট ফিটজেরাল্ডের, তিনি জানতেন যে তিনি কি সম্বন্ধে কথা বলছেন, হলিউডে যার নিজেরও একরকম সফলতা ছিল, এবং এ কথাগুলো তার সময়ের চেয়ে আরো সাধারণভাবে ও তিক্তভাবে আমাদের সময়ে সত্য। স্থুলশক্তি আমেরিকা ছাড়িয়ে ইউরোপ থেকে প্রাচ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। সমগ্র বিশ্বসভ্যতা আজ তার কবলে পড়েছে। লিখিত শব্দ ‘সংস্কৃতি' হিসাবে বিজ্ঞাপিত একটি গণপণ্য প্রচারের জন্য কিছু যান্ত্রিক মাধ্যমের অধীনতা করে; স্বতঃস্ফূর্ত, ব্যক্তিগত, সৃজনশীল শিল্পীকে নির্মূল করার জন্য সমাজের তীব্র সংকল্প বিদ্যমান, তাদের শিল্প ও সাহিত্যের নান্দনিক স্থানচ্যুতি ঘটে এবং আধ্যাত্মিক প্রয়োজনের অবস্থানের থেকে তুচ্ছ বিনোদন বা ব্যবহারিক উপযোগের দিকে ঝোঁকে। আজকের দিনে এগুলো আজ প্রতিটি দেশে, এমনকি বাংলার লেখকদের পরিস্থিতি। আমি এমনও বলি, কারণ ভারতের অবস্থা পশ্চিমের অবস্থা থেকে আলাদা বলে মনে করা হয়, এবং অন্তত নেতিবাচক অর্থে হলেও ভারতে লেখকদের অবস্থা ভালো এমনটি আশা করা হয়। ভারত একটি প্রাচীন দেশ, একটি প্রাচীন ও ভারসাম্যমূলক সভ্যতা, যার অভ্যন্তরীণ শান্তির একটি ঐতিহ্য আছে, বিশ্ব-বাণিজ্যের কেন্দ্র থেকে দূরে—এমন একটি দেশ, যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে তুলনামূলকভাবে নিজেকে অক্ষত রেখে জেগে উঠেছিল, এবং দরকষাকষি করে রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করে: বরং সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে এটি হৃদয়স্পর্শী, রয়েছে দিল্লির একঘেয়ে বাগ্মীতা, গান্ধীর নামের বিশাল প্রচার মূল্য, এমনকি ভারতকে প্রতিশ্রুতির দেশ হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে, এবং আমাদের লেখকদের সামনের দিকে এগোনোর মতো যথেষ্ট আশাবাদী হবার মতো সবকিছু রয়েছে।

তবে আসুন আমরা ঘটনাগুলিকে একটু ঘনিষ্ঠভাবে দেখি। এটা সত্য যে, আমরা অন্তঃত যুদ্ধের ভৌতিক ভয়াবহতা থেকে রেহাই পেয়েছিলাম, কারণ জাপানি বিমান হামলা ছিল মৃদু ও কেন্দ্রীভূত নয় এবং বাংলার দুর্ভিক্ষ ব্যতীত আমাদের বস্তুগত ও মানবিক ক্ষতিও কম; এতো কম যে তা ধরার মতো নয়, ব্রিটেন, জাপান, কিংবা জার্মানীর সঙ্গে তুলনা করলে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু একটি ঔপনিবেশিক দেশ অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও এমন একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যার কারণগুলোতে একটি ছোট একাডেমিক শ্রেণী ছাড়া অন্য কারো জন্য সামান্যতম আগ্রহের ছিল না, এমন একটি যুদ্ধ যাকে জনগণের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শুধুমাত্র একটি অপ্রয়োজনীয় বিপর্যয় বা শোষণ করার জন্য প্রভুদের একটি বিরল সুযোগ হিসাবে দেখেছে যাদের পরাজয় অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত ছিল—এই ধরনের একটি দেশ একটি বিশাল নৈতিক ধ্বংসের নিন্দা করেছিল, যার প্রভাব সম্ভবত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অনুভূত হবে। আর ঠিক সেটাই ঘটেছে ভারতে। যুদ্ধ কারখানা ও ঘরবাড়ির পরিবর্তে আমাদের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে; যেমন ভাল ও মন্দের মৌলিক ধারণাগুলি, মন্দ কাজের বিরুদ্ধে উচ্চারণ, অপরাধকে মহিমান্বিত, এবং শেষদিকে ভণ্ডামিকে মাত্রাতিরিক্ত করে তুলেছে। সুতরাং, আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে স্বাধীনতার পর প্রথম পদক্ষেপ যা ভারত শুধুমাত্র নৈতিক দেউলিয়াত্বের মূল্যে পেয়েছিল তা ছিল গান্ধীর হত্যাকাণ্ড: যুদ্ধ দ্বারা চাপিয়ে দেয়া বর্বরতার দীর্ঘ উৎসাহ দ্বারা এর পথ প্রস্তুত করা হয়েছিল, এবং আমাদের যুদ্ধ, সেখানে কখনও অস্ত্র ব্যবহার না করা লোকেরা অবশেষে গণ-দুর্দশায় লিপ্ত হওয়ার একটি সুযোগ পেয়েছিল, এবং এটি তার ধারাবাহিকতায় শেষ হয়েছিল। যখন ভারতীয় জীবনে ব্রিটিশদের সম্পর্কে সবচেয়ে খারাপ কথা বলা হয়েছে, তখন সত্যটুকুও থেকে যায় যে ব্রিটিশরা বাইরের দিক ছাড়া ভারতীয় জীবনের বুননকে নষ্ট করতে পারেনি, বা সম্ভবত এটি একেবারে অন্যরকম বিষয় ছিল; দুর্নীতি শিকড়কে হুমকির মুখে ফেলছে এবং দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক দুর্দশার অনুকূল পথে অগ্রসর হচ্ছে যার বর্তমান কারণগুলি সাধারণ মানুষের কাছে খুবই অস্পষ্ট। এ খুবই ভঙ্গুর এমন অবস্থা যেখানে সাহিত্য সামগ্রিকভাবে কম উন্নতি করতে পারে।

ভারতের সবচেয়ে সাহিত্যমনস্ক অংশ বাংলায় প্রতিবন্ধকতা বেশি। লর্ড কার্জনের প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ১৯০৫ সালে শুরু হওয়া ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম ইতিহাসের অদ্ভূত বিদ্রুপের দ্বারা ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল এবং কার্জনের ধারণার চেয়েও বেশি নিষ্ঠুরতা বাংলা পেয়েছিল। আমি পাকিস্তান সৃষ্টির বিরুদ্ধে তর্ক করার প্রস্তাব করছি না, কারণ এটা এখন একটি বাস্তবতা, এবং সমস্ত যুক্তি অকেজো হবে; আমি এও সচেতন যে পাকিস্তান ভারতীয় মুসলমানদের জন্য বস্তুগত প্রয়োজনের না হলেও একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজনের ছিল; তারপরও মানচিত্র থেকে বাংলার নাম মুছে ফেলা অবশ্যই বিপুল সংখ্যক নির্দলীয় মানুষের কাছে অসহনীয় হবে, যারা কখনই আশা করা থামাবে না যে দুই বাংলা আবার এক হবে। এদিকে, একজন বাঙালি লেখক হিন্দু হোক বা মুসলমান হোক, অনুভব করতে পারে না যে এই দেশভাগ তার কাছে কি অর্থ বহন করে, একজন লেখক হিসাবে তার ইতোমধ্যে বোঝা হয়ে থাকা সমস্যাগুলির সঙ্গে নতুন এক সমস্যা যুক্ত হয়েছে। তার বইয়ের খুব ছোট বাজার এখনও কাস্টমস হাউস দ্বারা সীমাবদ্ধ; একদিকে হিন্দি আর অন্যদিকে উর্দুর প্রভাবে বাংলা ভাষা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, ইতোমধ্যেই তা বোঝা যাচ্ছে; কেননা সামগ্রিকভাবে বাঙালি সংস্কৃতির মারাত্মক বিকৃতির আশঙ্কাও রয়েছে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার পথপ্রদর্শক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাঙালি সংস্কৃতির মতো একটি জিনিস বিদ্যমান, যা ভারতের সাধারণ সংস্কৃতি থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। সবকিছুর উপরে যুদ্ধ ও রাজনীতির ষড়যন্ত্রে নতুন বিপদের সৃষ্টি হয়েছে। এফ. স্কট ফিটজেরাল্ড এ প্রসঙ্গে বলেছেন,”স্থুল শক্তির কম দীপ্তি থাকলেও সমান নৃশংসতার সঙ্গে তা চকচকে”। ব্রিটেন ও আমেরিকার লেখাপত্রের অসুখী ভাগ্য নিয়ে আজ অনেক কিছু লেখা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে, উপরোক্ত কারণে এবং আরও কিছু কারণের জন্য আমি বর্তমানে হিসেব করব যে এটি অপেক্ষাকৃত খারাপ।

এক্ষেত্রে নিকট অতীতের দিকে এক পলক দৃষ্টি দেয়া শিক্ষামূলক হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অষ্টদশ শতাব্দীর ষাটের দশকের দিকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের পক্ষে সম্ভব ছিল একজন জুতো প্রস্তুতকারকের কাছে তার মহাকাব্য পড়তে যাওয়া। বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সাহিত্য সম্মেলনে অকৃত্রিম উদ্দীপনা নিয়ে বক্তব্য দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। ঊনিশশো ত্রিশের দশক পর্যন্ত বাংলা ক্রমাগত সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন তৈরি করেছে যা সাহসী লিটল ম্যাগাজিনগুলো পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল, অনেক অ-লেখক দ্বারা সমর্থিত এবং বিরোধিতাও ছিল, এর মধ্যে এমনকি সাধারণ শিক্ষিত জনগণের কথাও শোনা গেছে। যা আজ চিন্তা করা যায় না। এটা গুজব ছিল যে সাক্ষরতা বাড়ছে; প্রতি বছর ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার্থীর সংখ্যা আগের বছরের থেকে বেশি হয়, যুদ্ধের আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি সংবাদপত্র এবং ম্যাগাজিন রয়েছে (কাগজের ঘাটতি সত্ত্বেও), এবং অবশ্যই সিনেমা এবং রেডিও রয়েছে। একই সময়ে, গণসংস্কৃতির অগ্রগতির সরাসরি বিপরীত অনুপাত দেখা যাচ্ছে, যার ইঙ্গিতগুলি হল, সাহিত্য ও সাহিত্যের শিল্পের প্রতি আগ্রহ হ্রাস পাচ্ছে এবং এমন এক বিন্দুতে সে হ্রাস পেয়েছে যেখানে অনেকেরই আর একটি বইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখার ক্ষমতা নেই যদি না বইটি একটি চলচ্চিত্রের অনুষঙ্গ অথবা রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের পক্ষের মাধ্যম হয়। যারা এখনও জীবন্ত শব্দের শক্তি সম্পর্কে সচেতন তারা বেশিরভাগই সেই অতি-নিপীড়িত কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সবচেয়ে মূল্যবান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত, যা আজ বাংলায় ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে। যুদ্ধের অন্যতম পরিণতি হল সামাজিক শ্রেণীগুলির স্থানচ্যুতি; কলকাতায়, উচ্চ শ্রেণীকে এখন কমবেশি স্থুল এবং সদ্য ধনী বৃত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে মনে হচ্ছে, এবং নিম্নবিত্ত বা শ্রমিক শ্রেণী, আপাতদৃষ্টিতে আগের চেয়ে ভালো, সিগারেট টেনে, বুশ-শার্ট পরে কিংবা সিনেমা হলের সামনে লাইন দিয়ে পেটি-বুর্জোয়া স্তরে ওঠার আকাঙ্ক্ষা করছে। বর্তমান বিবেচনায় এ উভয় শ্রেণীকে বাদ দেয়া নিরাপদ, সেক্ষেত্রে আমরা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সঙ্গে রয়ে গেছি, যার মধ্যে আছে অফিস কর্মী, অধ্যাপক, শিক্ষক প্রমুখ; চীনের ক্ষেত্রেও এমনটি ছিল, অর্থনৈতিক সংকটে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তাদের মধ্যে সৌভাগ্যবান যারা উভয়ই করতে পারে, এবং বাকি যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাদের সক্রিয় পড়ার জন্য সময় খুব কম, বা তাদের যদি সময় থাকে তবে তাদের সংবেদনশীলতা ঘুমিয়ে পড়ে। এই মধ্যবিত্ত জনগণের একটি ছোট্ট অংশ যাদের বলা যেতে পারে বাঙালি লেখক, যারা চারপাশের পরিস্থিতির দ্বারা চালিত হয়ে একটি মানসিক যন্ত্রণায় ডুবে যাচ্ছে যা প্রতি বছর অপেক্ষাকৃত ভারী হচ্ছে।

এটি লেখকের জীবনযাপনের বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে, যা আধুনিক বিশ্বে একটি সর্বজনীন সমস্যা, এবং যার কিছু সমাধান অবশ্যই হওয়া উচিত এবং কারণ স্পষ্টতই বাস্তবতা হল যদি সাহিত্যকে বাঁচতে হয় তবে সাহিত্যকর্মীকে আগে বাঁচতে হবে, এবং একটি বই লেখা হত না যদি না এর লেখক কোনোভাবে জীবনধারণ করতে পারতেন। এমনকি পশ্চিমা দেশগুলিতেও, এমন অনেক লোক নেই যারা শুধুমাত্র লেখক হিসাবে তাদের উপার্জনের উপর বেঁচে থাকতে পারে, বিশেষ করে যদি তারা কবি বা নন-ফিকশন গদ্যের লেখক হন, যেমন ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ঊনবিংশ শতাব্দীর বেশিরভাগ কবিদের অ-উপার্জিত বা পরোক্ষ আয় ছিল, যা একজন শিল্পীর জন্য সেরা জিনিস; তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইয়েটস, জয়েস, ডিএইচ লরেন্স এবং রিল্কে ব্যক্তিগত দাতাদের পৃষ্ঠপোষকতা উপভোগ করেছেন, যা দ্বিতীয় সেরা উপায়; এবং বর্তমানে জীবিত অনেক লেখকদের মধ্যে অনেকে হালকা চাকরিতে কাজ করেছেন বা করছেন, তাদের মধ্যে এলিয়ট অন্যতম, অথবা সাংবাদিক, সম্প্রচারক, প্রভাষক ইত্যাদি হিসাবে তারা তাদের মধ্যম প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে একটি অবশ্যই বেছে নিতে হবে, এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। আমেরিকায় অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে, তরুণ লেখকদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি শুষে নিচ্ছে, ফলে তাদের গবেষণার জন্য সাহিত্যকে ছেড়ে দেওয়ার ঝুঁকি রয়েছে; হেনরি মিলার আরেকটি উপায় তৈরি করেছেন, যিনি শহর থেকে দূরে একজন সন্ন্যাসী হিসেবে বসবাস করতে পছন্দ করেন, যদি সন্ন্যাসী এবং লেখকের মধ্যে দ্বন্দ্ব দূর করা যায় তাহলে ঠিক আছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, আমি এটিকে একটি সম্ভাব্য বিকল্প হিসাবে বিবেচনা করি না, কারণ, রাশিয়ার মহান সাহিত্যের বড় ধরনের পতন প্রত্যক্ষ করার পরে, আমি একজন সক্রিয় লেখক হিসাবে বলতে বাধ্য যে এর চেয়ে অন্য যে কোনও কিছুই পছন্দনীয়।

এখন অবধি, বাঙালি লেখকের জীবনযাত্রা কমবেশি একই উপায়ে ধারণ হয়েছে, কেউ কেউ, তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের পরোক্ষ আয় ছিল; উনিশ শতকের বেসরকারী উদার পৃষ্ঠপোষকতা আজ আর অজানা নয়, এবং লেখকদের একটি আশ্চর্যজনক সংখ্যা প্রতিটি অর্থে আরামদায়ক সরকারী কর্মসংস্থানে রয়েছে। হয় রাষ্ট্রের কর্তব্যগুলোর প্রকৃতি খুব বেশি বদলে গেছে, বা আমাদের লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে, কারণ সরকারী চাকরীতে তাদের কয়েকজনকে এখন সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে; বেশি প্রচলিত অর্থে, একজন লেখক হলেন কোনও ধরনের শিক্ষক, যার অর্থ দারিদ্র্য, বা কোনও ধরনের সাংবাদিক, যার অর্থ (আবার নাও হতে পারে) বস্তুগত ভরণপোষণের স্থায়িত্ব, তবে এ ক্ষেত্রে সৃজনশীল লেখার ক্ষেত্রে বাধা বা বিকৃত হওয়া প্রায় নিশ্চিত, বা এমনকি লেখক একজন চলচ্চিত্র পরিচালকও হতে পারেন, যার মানে বড় অঙ্কের টাকা এবং লেখক হিসেবে বিলুপ্তি। তিনি একজন সম্প্রচারক, প্রকাশক, বিজ্ঞাপনের জন্য কপিরাইটার, বা এই সমস্তগুলি একসঙ্গেও হতে পারেন। ধনী বণিক শ্রেণী ও বেসরকারী পৃষ্ঠপোষ্ঠকদের ক্রমবর্ধমান অতিরিক্ত লোভের কারণে অস্তিত্বহীন অভিজাতত্বের সঙ্গে ফরমায়েশের অশ্লীলতাও আসে, যদি না কোনও লেখক খুব বেশি ভাগ্যবান হন—তবে তা এখন প্রশ্নাতীত হয়ে গেছে।

তবুও মূল সমস্যাটি এই নয় যে লেখক এই পেশার মাধ্যমে যথেষ্ট উপার্জন করতে পারেন না—কারণ এটি সবসময় এমন হয়েছে—তবে পেশাটি নিজেই পথ হারিয়েছে। তিনি কোনোভাবে প্রচলিত উপায়ে জীবনযাপন করতে পারেন, অথবা তিনি দরিদ্র থাকতেই সন্তুষ্ট হতে পারেন, দারিদ্র সম্পর্কে, রিল্কে ঠিকই বলেছেন, এটা তাকে প্রয়োজনীয় কিছু থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। মৌলিক বস্তুগত চাহিদাগুলি ছাড়াও তার জন্য যা অপরিহার্য, তা হল তার রচিত সাহিত্যের গুরুত্ব থাকা উচিত—শুধুমাত্র অন্যান্য লেখকদের কাছে নয়, অন্তত অল্পকিছু সংখ্যক সতর্ক ও বুদ্ধিমান পাঠকদের কাছে, যারা তাকে অনুভব করাবে যে তিনি যা করছেন তা করা মূল্যবান, অর্থাৎ সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয়। এবং ঠিক সেটাই আজ বাঙালি লেখক অনুভব করতে পারেন না, যদি না চরিত্রের এক বিরাট প্রচেষ্টার মাধ্যমে তার চারপাশে জীবন্ত জগতের জন্য জীবন্ত সাহিত্যের ব্যাপারটা থেমে গেছে। তিনি আর জানেন না—যুদ্ধের আগে পর্যন্ত তিনি যা জানতেন—কার জন্য তিনি লিখছেন; লেখক ও পাঠকের মধ্যে সেই সূক্ষ্ম, নীরব যোগাযোগ আর নেই যা একজন শিল্পী হিসাবে তার ধারাবাহিকতার জন্য প্রয়োজনীয়; এবং গুরুতর মৌখিক সমালোচনা খুব কমই হয়, এবং যদিও অন্য কোনো কারণে নাও হয় এই কারণে যে আমাদের নিকট অতীত সাহিত্য সমালোচনার একটি ভাল পরিসংখ্যান দেখায়, বর্তমান পরিস্থিতি খুব কমই একটি কারণেরও অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়। এই ধরনের প্রকাশনাগুলির কঠোরভাবে সীমিত বিক্রয়ের জন্য খরচ অসহনীয়ভাবে বেশি, এবং আমেরিকা এবং ব্রিটেনের মতো রকফেলার ফাউন্ডেশন বা মরগান ট্রাস্ট লেখকদের ভর্তুকি দেয় না। গণরুচির সূচক হিসাবে, কেউ কেউ সমাজের একজন ধনী নারীর মন্তব্য উল্লেখ করতে পারেন, যিনি বইয়ের থেকে চলচ্চিত্রগুলোকে মূল্যায়ন করেছিলেন কারণ একটি চলচ্চিত্র নব্বই মিনিটে একই গল্প উপস্থাপন করে (যেমনটি তিনি মনে করেন) যা পড়তে পুরো দুই দিন সময় লাগে। আমেরিকান বুদ্ধিজীবীদের অভিযোগ কারণ শুধুমাত্র হলিউডের সীলমোহর একটি উপন্যাস বিক্রি করতে পারে, তবে যাই হোক না কেন, আমেরিকায় উপন্যাস অবলম্বনে যে চলচ্চিত্রগুলো তৈরি করা হয় তা এখনও তেমন পারছে না; বই থেকে চলচ্চিত্র যা অদ্ভুত এবং খুব অপ্রচলিত চর্চা যা আজকাল বাংলায় মোটামুটি নিয়মিত। এক্ষেত্রে আমাদের জনতা আমেরিকার জনতাকে পেছনে ফেলেছে যে শুধুমাত্র তারা উপন্যাসটি পড়তে চায় তখন নয় যখন শুধু এটি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, বরঞ্চ সব সেলুলয়েড হিটকে মুদ্রণ আকারে পড়ার জন্য জোর দেয়, আমাদের সর্বাধিক বিক্রিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে চলচ্চিত্রের দৃশ্য, যা বর্ণনার মতো দেখতে প্যাচআপ করা হয়েছে এবং উপন্যাস হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে।

বিষয়বস্তুগত দিক থেকে, আমাদের প্রবীণ লেখকদের বৃহত্তর সংখ্যক লেখক লেখক হিসেবে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছেন। কেউ কেউ, যারা একসময় খুব ভালো কথাসাহিত্যিক ছিলেন, তারা এখন একজন গড় স্কুলছাত্রের মানসিক স্তর নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন; কেউ কেউ রাজনীতিতে জনপ্রিয় সাহিত্য আন্দোলন ও তত্ত্বকে কাজে লাগাচ্ছেন, অথবা তাদের নিজেদের হতাশাকে যুক্তিযুক্ত করতে ব্যবহার করছেন; আমাদের দু-একজন শ্রেষ্ঠ কবি নির্জনে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। তরুণ লেখকদের ক্ষেত্রে, তাদের প্রতিভাগুলো প্রায়শই Demos-কে খুশি করার প্রকট আকাঙ্ক্ষা এবং সাফল্যের জ্বলন্ত পথের দ্বারা ধ্বংস করা হয় যা অবশেষে একজন চলচ্চিত্র পরিচালকের অবস্থানে নিয়ে যায়। যখন এ দু’টো মিলিত হয়, তখন তারা কাজের চেয়ে প্রচারণা করতে বেশি পছন্দ করে, এটাই হল বই ও আইডিয়ার থেকে বর্তমানে সবচেয়ে প্রচলিত হার। কোনও চরম দুরাবস্থার পরিবর্তে সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষয়িষ্ণুতাকে এই বাস্তবতার জন্য দায়ী হতে পারে যে লেখক নিজেরাই হয় নিয়মিতভাবে আগ্রহী নন হয় সাহিত্যে কিংবা জীবনে সাহিত্যের গভীর মানে-তে, এবং তখন তারা মাঝে মাঝে নিজেদেরকে ছদ্মবেশী করেন যাতে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসাবে উত্তীর্ণ হন। এবং যে কোনও জায়গায় যে কোনো পরিস্থিতিতে এমন অবশ্যই কিছু লেখক রয়েছেন, যেসব লেখকরা স্বতন্ত্র শব্দ উচ্চারণ করার অনিবার্য তাগিদে বিচলিত—যারা নিজেদের বহিরাগত, অনুপ্রবেশকারী, প্রায় নির্বাসিত মনে করেন, তাদের অস্তিত্ব চারদিক থেকে হুমকির মুখে পড়ে, সভ্যতা ধ্বংস হতে পারে না এ তিক্ত ধৈর্য যে বিশ্বাস থেকে আসে, নিজেদেরকে শক্তিশালী করার জন্য আর কিছু না থাকা সত্ত্বেও তা দিয়ে প্রগতিশীল অবনতির সময়ে কোনো ধরনের অপেক্ষা ব্যতীত তারা এক ধরনের গোপন, অপরাজেয় পরিশ্রম চালিয়ে যান। বাংলায় সাহিত্যের শিল্প যদি পুনরুজ্জীবিত হয় তবে তা হবে তাদের পরিশ্রমের মাধ্যমে।
0

প্রবন্ধ - ভায়লেট হালদার

Posted in






কোন কোন দেশে নারীদের যৌনতা বিষয়ে দীক্ষা দেওয়াকে মানবিক মনে করে এবং এটাকে সামাজিক ভাবেই স্বীকৃতি দেয়া হয়। এরকম একটি দীক্ষা রীতির নাম ‘যৌন শুদ্ধি।’ বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেন এটি একটি প্রচলিত প্রথা। এই যৌন আচার প্রথা অনুযায়ী প্রথম ঋতুমতী কোন কিশোরী এবং সদ্য বিধবা নারীকে কোন পুরুষের সঙ্গে যৌন সঙ্গম করে পরিশুদ্ধ হওয়া উচিত বলে মনে করা হয়। কিশোরী মেয়েদের ক্ষেত্রে যৌন নির্মূলকরণ আচার এবং কিশোরী থেকে নারীত্বে উত্তীর্ণ হওয়ার একটি ধাপ বা রূপ হিসেবে দেখা হয়।

দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার একটি দেশের নাম মালাউয়ি। এই দেশের দক্ষিণাঞ্চলের গ্রামগুলোতে আছে অদ্ভুত দুইটি প্রথা, তার মধ্যে একটি প্রথার নাম কুসাসা ফুম্বি ( Sexual cleansing) অন্যটি ‘কুলোয়া কুফা।‘ মহামারী, রোগ বালাই থেকে মুক্তি বা কোন বিপদ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে কুসাসা ফুম্বি প্রথার উৎপত্তি হয়েছিল। কুমারী মেয়েদের কুমারীত্ব জীবনের অবসান ঘটাতে অর্থের বিনিময়ে পুরুষ ভাড়া করা হয়। স্থানীয় ভাষায় ‘হায়েনা’ (hyena) একটি পেশার নাম। যে সব পুরুষেরা এই অমানবিক পেশার সঙ্গে যুক্ত তারা ‘হায়েনা’ নামেই পরিচিত। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার নামে অনিচ্ছা স্বত্বেও অগণিত কিশোরী কন্যা শত লাঞ্চনা গঞ্জনা সহ্য করে মুখ বুজে এই প্রথার শিকার হচ্ছে। কেননা হাজার হাজার বছর ধরে এই প্রথা চলে আসছে। অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে এই প্রথার উদ্ভব হয়েছিল।

‘কুসাসা কুম্বি’ প্রথা অনুযায়ী, কোন কিশোরী প্রথমবার ঋতুমতী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরিবারের অভিভাবক বাধ্যতামূলক ভাবেই একজন হায়েনাকে অর্থের বিনিময়ে ভাড়া করে থাকেন, ঐ কন্যার সঙ্গে যৌনমিলন করার জন্য। তবে এই কাজের জন্য যে কোন পুরুষকে ভাড়া করা যাবে না। শুধুমাত্র হায়েনাদের দিয়ে এই কাজ করাতে হবে। এই প্রথা অনুযায়ী যৌনমিলনের আগে কিছু রীতিনীতি আছে, সেগুলো পালন করতে হয়। যেমন, সদ্য ঋতুমতী হওয়া কিশোরীকে গ্রামের কয়েকজন নারী গ্রামের ভেতরের একটি জঙ্গলে নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকে একটি ঘর বানানো হয়ে থাকে, যা দীক্ষা শিবির নামে পরিচিত। এই দীক্ষা শিবিরে কয়কজন নারী মিলে কয়েকদিন ধরে কিশোরী মেয়েটিকে বড়দের শ্রদ্ধা করা, রান্না ও গৃহকর্ম, সদাচরণ, শালীনতা, পরিস্কার পরিচ্ছনতা, যৌন আচরন তথা কীভাবে পুরুষকে যৌন আনন্দ দিতে হয়- এই বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে থাকে। এই পর্বকে বলা হয় যৌন দীক্ষা অনুষ্ঠান (Sexual initiation rites of girls)। শিক্ষা ও দীক্ষা পর্ব শেষে কিশোরীকে অর্থের বিনিময়ে একজন পুরুষ যৌনকর্মীর সঙ্গে যৌন মিলন করতে দেয়া হয়, যিনি হায়েনা ‘নামে’ পরিচিত। হায়েনা একটি পেশা এবং তিনি অর্থের বিনিময়ে একজন কিশোরীকে যৌনতার মাধ্যমে যৌবনে প্রবর্তন করেন। যতদিন না সদ্য ঋতুমতী কিশোরী একজন হায়েনার সঙ্গে যৌন সংসর্গ করবে, ততদিন কিশোরী পরিশুদ্ধ হবে না। পরপর তিনদিন ওই কিশোরীকে হায়েনার সঙ্গে থেকে যৌন সংসর্গ করতে হবে অর্থাৎ এটাই কিশোরী থেকে নারীতে উত্তরণের প্রমাণ, এর মধ্য দিয়েই একজন কিশোরী শুচি হয়, তাই এই অনুষ্ঠানের নাম ‘নারী শুচিকরণ।‘ কিন্তু কিশোরী কোনদিন জানতে পারে না যে সে কার সঙ্গে যৌনমিলন করেছে, কেননা যৌনমিলনের সময় কিশোরীর চোখ বাঁধা থাকে। আর এ সব কিছুরই আয়োজন ও ব্যয়ভার বহন করে কিশোরীর পরিবার। কোন কিশোরী কিংবা কোন পরিবার এই প্রথা মানতে অস্বীকার করলে ধরে নেওয়া হয়, ঐ কিশোরীর পরিবার কোন জটিল রোগে আক্রান্ত। অথবা ঐ কিশোরীর পরিবার, গ্রামের দিকে ধেয়ে আসছে কোন দুরারোগ্য ব্যধি, মহামারী, অমঙ্গল ও ভয়ঙ্কর কোন বিপদ। ফলে গ্রামবাসীরা ঐ কিশোরী ও পরিবারের উপর আক্রমণ করে, অত্যাচার করে, সামাজিক ভাবে হেয় করে।

কোন নারীর স্বামীর মৃত্যু হলে শোকপ্রাপ্ত ঐ নারী অশুচি বলে বিবেচিত হন। ফলে স্বামীকে সমাধিস্ত করার আগে সদ্য বিধবাকে শুদ্ধ করতে একজন হায়েনার সঙ্গে যৌনমিলন করতে হবে, এটাই ‘কুলোয়া কুফা’ প্রথা নামে পরিচিত। যদি সদ্য বিধবা নারী গর্ভবতী হয়ে থাকে তবুও তাকে পুরুষ যৌনকর্মী হায়েনার সঙ্গে যৌন সঙ্গম করার মাধ্যমে বিধবাকে শুচি হতে হবে, এটাই তাদের বিশ্বাস।

এই পুরুষ যৌনকর্মী হায়েনাদের অনেকেই এইডস আক্রান্ত। এদের মধ্যে মালাউয়ির একজন হায়েনার নাম এরিক আনিভা। তিনি দুই স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানের জনক। এরিক আনিভা এইডসে আক্রান্ত হয়ে ভুগছেন বহুদিন ধরে। কয়েক বছর আগে বিবিসি’র প্রায় ২৭ মিনিটের একটি রেডিও রিপোর্ট ‘Stealing innocence in Malawi’এ প্রচারিত হয়েছিল। এই সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে তার স্বীকারোক্তিতে তিনি দম্ভ করে বলেছিলেন, ‘ আমি মোট ১০৪জন কিশোরী ও বিধবা নারীর সঙ্গে যৌন সংগম করেছি। তবে এর মধ্যে বেশীরভাগই ছিল ১২/১৩ বছর বয়সী স্কুল পড়ূয়া কিশোরী। তাদের প্রত্যেকে আমাকে দৈনিক কর্মমূল্য হিসেবে চার থেকে সাত ডলার দিত। তাদের সঙ্গে শারীরিক মিলন করে আমার ভাল লেগেছে, আমি জানি মেয়েগুলোরও। সব মেয়েই তাদের হায়েনা হিসেবে আমাকে পেয়ে গর্ববোধ করে। তৃপ্ত মেয়েরা অন্য মেয়েদের বলে, আনিভা হচ্ছে প্রকৃত পুরুষ। অনিভা জানে, কিভাবে একজন নারীকে আনন্দ দিতে হয়।‘

আনিভা এই কুপ্রথা টিকিয়ে রাখা ও নিজের উপার্জনের স্বার্থে গর্ব করে এইসব কথা রেডিও সাক্ষাৎকারে প্রচার করলেও অনেক মেয়েই জানিয়েছে, তারা নিতান্তই অনিচ্ছায় আনিভার সঙ্গে শারীরিক সংগম করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ তারা যৌন সংগমের মাধ্যমে যৌন শুচি না হলে তাদের বাবা-মা ও পুরো পরিবারের উপর আক্রমণ করতো গ্রামবাসী। সামাজিক ভাবে প্রচলিত এই প্রথা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই বলে মন্তব্য করেন মারিয়া নামের একজন কিশোরী। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে যৌনমিলন না করার ফলে, অনেক নারী যৌন বাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কেউ কেউ বা গর্ভবতী হন। ফলে অনেক নারীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে অমানবিক ও বিভীষিকাময় জীবন যাপন করেন।

বিবিসির রিপোর্টের এক সপ্তাহ পরেই মালাউয়ের রাষ্ট্রপতি পিটার মুথারিকার নির্দেশে এরিক আনিভা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এইচআইভি পজেটিভ হওয়া স্বত্বেও তিনি তা গোপন রেখে অর্থের বিনিময়ে যৌন সংগম করার জন্য তাকে মাত্র দুই বছরের কারদণ্ড দেয়া হয়েছিল।

মালাউয়িতে এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে ‘প্রজেক্ট ডিগনিটি’ নামের মানবাধিকার একটি সংগঠন। ১৩/১৪বছর বয়সে এই কুপ্রথার শিকার হয়েছিলেন মানবাধিকার কর্মী নাতাশা অ্যানি টনথলা। এই প্রথার বিলুপ্তি জন্য প্রাণপণে লড়াই করে চলেছেন বহুদিন ধরে।

এছাড়াও আফ্রিকা মহাদেশের জাম্বিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া, কেনিয়া, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, আইভরি কোস্ট, কঙ্গোর বিভিন্ন অঞ্চলে এই প্রথা এখনো টিকে আছে। মোটকথা, নারী অনিচ্ছায় নারীর সঙ্গে যৌনক্রিয়া করা ধর্ষণের সামিল। ‘কুসাসা ফুম্বি’ ও ‘কুলোয়া কুফা’ প্রথা মুলত আনুষ্ঠানিক ভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে নারীকে ধর্ষণ করার স্বাধীনতা ও অধিকার পুরুষেরা পেয়ে থাকে। এই প্রথা নারীর মানবিক অধিকার লঙ্ঘন করে, নারীকে লাঞ্চিত ও মর্যাদাহানি করে নারীকে পুরুষতন্ত্রের দাসী বানিয়ে রাখতে বাধ্য করে। নারীর প্রতি বৈষম্য এবং সকল প্রকার অমানবিক প্রথার বিলুপ্তি হতে আর কত দেরী?
0

প্রবন্ধ - দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্য

Posted in






রোরো নদীর জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই বালক। জল থাকলে পাথরও থাকে, তাই সে চেয়ে দেখছে এদিক ওদিক। আরে, ওই তো পাথর! এদিকে বুক পকেট থেকে তার উঁকি দেয় পালক। পালক মানেই তো পাখি! পাখির ভিতর নারী। আর পাথরে ঘুমোয় এক জখম পুরুষ। সেই মেয়েকে একা ছলছলে জলে ঠেলে দিতে সাহস হয় না তার। যায় যদি, হাতে হাত ধরে যাক। তাহলে তো তার এক সঙ্গীর প্রয়োজন। চলো পুরুষ, জল-আগুনের সঙ্গী হও, এই বলে সে পাথরে পালকটুকু জড়িয়ে ছুঁড়ে দেবে ভাবে। আরও ভাবে, সে নিজেই তবে কি সেই পাথর? তার বুকেও কি লুকিয়ে আছে কোনো সাতরাঙা পালকের পাখি? ... এইখানে এসে আমাদের একবার দু'চোখ বুজে ফেলতে হয়। খুলে নিয়ে দেখি, সেই বালক কোত্থাও নেই। আছে কি সেই রোরো নদীও? আর সেই পালকের মতো নরম এক নারী :

'রোরো নদীর ধার থেকে ঐ একটি বালক/ কুড়িয়ে পেয়েছিল রঙিন বুকের পালক/এবং একটি পাথর পেয়ে, সেই পালকে/ জড়িয়ে,ছুঁড়ে দিয়েছিল এপার থেকে/ পালক কি আর একাকিনী ওপার যাবে?'

বোর্খেসের 'সারকুলার রুইনস' গল্পটা মনে পড়ে তোমার? সেই যে... একটা লোক ভাবত দিনরাত শুধু স্বপ্ন দেখবে, সেই স্বপ্নই হবে তার ইচ্ছেপুরণের চাবিকাঠি। সেই স্বপ্নগুলোই তার আসল জীবন আড়াল করা প্রকৃত জীবন। নানান ব্যর্থ চেষ্টার পরে একদিন হঠাৎ স্বপ্নের সঙ্গে তার একরকম সমঝোতা হয়ে যায়। স্বপ্নের কামারশালার আগুনে আর আঘাতে সত্যি সত্যিই তারপর সে এক ইচ্ছামানুষ হয়ে উঠল! হৃৎপিন্ড থেকে চোখের পাতা অবধি সমস্ত কিছুতে :

'এবার বসন্তকালে বৃষ্টি হল স্বপ্নের ভিতর/ স্বপ্নের ভিতর হল বজ্রপাত'

'গভীরতা পড়ে থাকে, উপরে লাফায় তারই জল/ রমণীর সাজ আর স্বরূপের বিরোধের মতো/ এবং স্বপ্নের মতো মুহূর্তকে আক্রমণ করে, ফসফরাস, শাদা সিঁড়ি...'

স্বপ্নের ভিতর নিজেকে গড়ে নিতে নিতে সারাজীবন যিনি একটিমাত্র কবিতাই লিখে গেছেন, তাঁর নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কবিতার লাইনগুলোর আড়ালে মনের এক সাতমহলা বাড়ি মুখ ডুবিয়ে থাকে। যেন একটা পুকুরের মধ্যে ডুব দিয়ে আর ভেসে না ওঠার খেলা, যতক্ষণ ডুবে থাকা যায় ততক্ষণ যা দেখা-জানা হল, তাই দিয়েই কবিতা লেখা! তাই বোধহয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থেই আমরা 'পাতাল থেকে ডাকছি' শিরোনামের একটি কবিতা পেয়ে যাই! পাতাল থেকে ডাকছি --- প্রকাশ্যের প্রকাশ নয়, গহন আজানার রহস্যময় উন্মোচন! আমাদের কল্পনা আর চেতনার দুয়ারেই তাঁর কবিতা কড়া নাড়ুক, এ-যেন তাঁরই চাওয়া।

দু'টুকরো হয়ে বাহির-ভিতরে ছড়িয়ে প'ড়ে, নিজেই নিজের ছায়া হয়ে, দর্শক এবং শ্রোতা হয়ে, নারী এবং পুরুষ হয়ে, স্বপ্নাবিষ্ট বালক এবং আশ্চর্য জাদুকর হয়ে, তারই মতো ইজের গুটিয়ে এক সম্মোহিত মিছিলের পায়ে পা মেলায় তাঁর কবিতা। সঙ্গে থাকেন তাঁর পথভোলা ঈশ্বর।তাঁকে ডাকলে তিনি বালক কবির হাত ধরে চৌরঙ্গীর ছটফটে ব্যস্ত মোড় পার করে দেবেন। কখনো ঘুম থেকে জেগে ওঠার আকুতি -- সে-জেগে ওঠাও বোধহয় আরও এক স্বপ্নচুড়োর দিকে ঢলে পড়া --- কখনো ঘুমেই চিরসমর্পণ :

'সেগুনমঞ্জরী হাতে ধাক্কা দাও, জাগাও আমাকে/আমি আছি বিষঘুমে, জাগাও আমাকে/...জাগাও আমাকে তুমি গাছের মতন/ দীর্ঘদেহী গাছ, ঐ গাছের মতন/ পাতায় পাতায় জাগবে অরণ্যকুহেলি/...আমাকে জাগাও তুমি হলুদের মাঠে/ চঞ্চল হরিণ এসে সম্মুখে তাকাবে/...আমাকে জাগাও তুমি সেই পদ্মবনে/যেখানে ছোবল দেবে সাপে সর্বক্ষণ ... শুধু জাগরণ চাই, বারেক জীবন!' (অংশ)

'কেউ কি কখনো জাগে? নিভন্ত ঘুমন্ত রোরো নদী,/ স্বপ্নের ভিতরে চলে জলোচ্ছল, জলোচ্ছল; বেগে/ ঘুমের নিজস্ব এক প্রাপণীয় অন্ধকার আছে।'

তাঁর সম্বন্ধে শুধু এইটুকু বলা যায়, যে তাঁর আছে এক তীব্র হাতছানির মালিকানা -- স্বপ্নমঞ্জরির ঘ্রাণ তাঁর সারা পথে। বাইরের থেকে কথা তুলে নিয়ে, বাইরের কথা বলতে গিয়ে, হয়তো নকশাল আন্দোলনের ভয়াবহ দিনগুলোর কথাই সেইসব --- টানে-টোনে মনে ভর দেওয়াই শক্তির স্বভাবজাত। যা দেখছি তাই যেন শেষ কথা নয়, তার একটা 'ভিতর' আছে, একটা মনের-দেখার দিক আছে! সেইজন্যেই হয়তো তাঁর কবিতায় 'ভিতর' কথাটির এতবার যাতায়াত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পুতুল নাচের ইতিকথায়' শশী ডাক্তার কুসুমকে কী বলেছিলেন, মনে পড়ে তোমার? -- ' শরীর! শরীর! তোমার কি মন নাই কুসুম?'

' "হ্যান্ডস আপ্" ---হাত তুলে ধরো --- যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ তোমাকে তুলে নিয়ে যায়/ কালো গাড়ির ভিতরে আবার কালো গাড়ি, তার ভিতরে আবার কালো গাড়ি/ সারবন্দি জানলা, দরজা, গোরস্থান --- ওলোটপালোট কঙ্কাল / কঙ্কালের ভিতরে শাদা ঘুণ, ঘুণের ভিতরে জীবন, জীবনের ভিতরে মৃত্যু --- সুতরাং / মৃত্যুর ভিতরে মৃত্যু/ আর কিছু নয়!'

রহস্যময়তার জন্যেই তো কবিতার কাছে যায় মানুষ! যা কিছু জানার বাইরে --- প্রেম, মৃত্যু, শরীরের অগুন্তি আগুনশিখা -- সে-সব ছুঁয়ে দেখতেই কবিতার কাছে যাওয়া। সেখানে নারীও 'কালবেলা'-র 'মাধবীলতা'র মতো মনোময়, প্রতিদিনের নারী সে নয়! সে তবে কে? মধুলোভী কোনো সোনার অলীক ভ্রমর! তাকে নিয়ে একা একাই খেলার ভিতরে ঢুকে যান কবি, যেখানে আর কেউ কোত্থাও নেই। তাকে দূর থেকে গোপন দৃষ্টিজ্বরে পুড়িয়ে দিতে চেয়ে থাকেন শুধু। তাকে পাবার-হারাবার অভিঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে শেষ অবধি ভেঙে পড়েন:

'আমি সোনার একটা মাছি খুন করেছি রাতদুপুরে/...খুন করে নীল ভালোবাসায় চমকপ্রদ জড়িয়ে গেলাম।।' (অংশ)

'এই খেলাটি একলা আমার, খেলব -- যেন তার কপালের/ কাঁচপোকাটি তেমনি থাকে, চারদিকে জল, খন্দ-খানা/ কেশ করেছি আবোল-তাবোল, চুম্বনে ঐ দগ্ধ গালের/ আধখানা খাই, আধ্লা রাখি --- বুক ভরে বাস হাস্নুহানার/ এই খেলাটি একলা আমার, তোর সেখানে খেলতে মানা।' (অংশ)

'কী তুমুল বৃষ্টি হল শান্তিনিকেতনে... / ডুবে গেল কাশ ফুল, ভেসে গেল ঝরা শিউলি তলা। /... কাঁকর লেগেছে স্তনে, মাথা ভর্তি কাঁকরের ফুল,/ দুহাতে সরাই সব, তোমার স্বপ্নের মতো দেহ ---/ বাহু গন্ধে নুন জল, যতক্ষণ মেঘ থাকে ভালো।'

'আমার রমণী শুয়ে, দুই পাশে দুটি মাছরাঙা / আমার সর্বস্ব আজ ভাঙা/ আমার সর্বস্ব আজ ভাঙা।/ হাত পা ও বুকের পাঁজর / চারিদিকে অক্ষর অক্ষর/ চারিদিকে অক্ষর/...আর কিছু নেই!'

মিলনশেষের এক ক্লান্ত আলুথালু নারীর চারিদিকে এত অক্ষর