প্রবন্ধ - অনিরুদ্ধ গঙ্গোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধআমাদের সময়ের কবি লিখেছেন –
বৃষ্টি এলেই আসবে কফি, কান টানলে মাথা
এক বিকেলে অফিস কেটে ঝুপ্পুস কলকাতা
আলতো ভাপে নাম লিখেছি কফি শপের কাচ
মেঘ যদি না ডাকে, তোমার আসতে বারণ আছে।
সত্যিই, মেঘলা দিনের প্রত্যাশী মন হোক, বা ল্যাপটপে চোখ আটকানো কাজের ব্যস্ত সময়, রাত জাগা পড়ার টেবিলেই হোক, কি চোখজুড়োনো পাহাড়ী দৃশ্য সামনে নিয়ে হোটেলের বারান্দা, বা বন্ধুসমাগমে নেহাতই অবসরের আড্ডা, এক ধুমায়িত কাপ কফি এখন আমাদের প্রায় অবশ্যম্ভাবী সঙ্গী হয়ে উঠেছে। মান্না দে যদিও সেই ১৯৮৩ সালে গেয়েছিলেন, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’, সে কেবল এক প্রজন্মের আক্ষেপ। পরের প্রজন্মরা আজও কফি হাউস মাতিয়ে রেখেছে। তার সাথে সাথে আনাচে কানাচে বিস্তার ঘটেছে, যাকে আজকাল বলা হয়, তৃতীয় লহরের কফি শপ বা ক্যাফে সংস্কৃতি। আসুন. এক কাপ কফি নিয়ে বসে একটু আড্ডা মারা যাক সেই কফি নিয়েই। ভারতের কফি।
উৎপাদন, রপ্তানি এবং আভ্যন্তরীন চাহিদা – এই সব দিক দিয়েই এখন আমাদের দেশে কফির রমরমা। ভারতে কফির উৎপাদন এবং ব্যবসার উন্নয়নবর্ধক স্বায়ত্বশ্বাশক সংস্থা কফি বোর্ডের প্রধান নির্বাহক বলছেন, ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরে দেশে কফির উৎপাদন ৩.৬ লক্ষ মেট্রিক টন হবার সম্ভাবনা, এবং পরের বছর তা আরও বাড়বে। ঐ বছরেই ভারত ১৫,৪০০ কোটি টাকার কফি রপ্তানি করেছে, তার মধ্যে প্রায় ৯,৫০০ কোটি টাকার কফি কেবল মাত্র কর্নাটক থেকে। কফি আবাদীরাও খুশী। এ বছর রোবাস্টা কফির ৫০ কেজির বস্তার জন্য তাঁরা ১২,০০০ থেকে ১৫,০০০ টাকা পেয়েছেন। মাত্র দু বছর আগেও তাঁরা পেতেন মেরেকেটে ৫,০০০ টাকা। তবে এই স্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হবার সম্ভাবনা কম। পৃথিবীতে উৎপাদন ও চাহিদায় ব্রাজিল অগ্রগণ্য দেশ। তারপর ভিয়েতনাম, কলম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া। গত বছর প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য ব্রাজিলের উৎপাদন বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের উৎপাদন বর্ধিত বিশ্বব্যাপী চাহিদা পূরণ করতে যথেষ্ট নয়। এই পরিস্থিতির সুবিধা পেয়েছেন ভারতের উৎপাদকরা। ব্রাজিল স্বমহিমা ফিরে পেলে চাকা ঘুরতে পারে। ভারতে উৎপন্ন কফির ৭০ শতাংশই রপ্তানি হয়ে থাকে।
ভারতে পানীয় হিসেবে কফির ব্যবহারের সব থেকে প্রাচীন বিবরণ পাওয়া যায় সপ্তদশ শতাব্দীতে। জাহাঙ্গীরের রাজসভায় ইংরেজ রাজার রাষ্ট্রদূত স্যার টমাস রো সাহেবের চ্যাপলেইন রেভারেন্ড এডোয়ার্ড টেরী আনুমানিক ১৬১৬ সালে একটি স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন:
“সেখানে অনেক মানুষই অত্যন্ত কঠোরভাবে তাঁদের ধর্মাচরণ পালন করেন এবং কোন রকম পানাসক্তি থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু একটি পানীয়, যাকে তাঁরা কফি বলেন, তাঁরা পান করেন, যা উপাদেয় তো বটেই, তারও বেশী স্বাস্থ্যকর। এক ধরণের কালো রঙের বীজ জলে সেদ্ধ করে এটি বানানো হয়, যার থেকে জলও সেই রঙ ধারণ করে, কিন্তু জলের স্বাদ সামান্যই পরিবর্তিত হয়। অথচ পাচনশক্তি বাড়ায়, শরীরে উদ্দীপনা আনে এবং রক্ত পরিশোধনেও সাহায়্য করে।“
কফি পানের প্রচলন হলেও এ দেশে কফি চাষের সূচনা তখনও হয়নি। তা শুরু হয় আরো কিছু বছর পরে, আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে। এই সম্পর্কে একটি মজার কাহিনী আছে।
কফি বিষয়ে গবেষকরা বলেন, সম্ভবত আফ্রিকাতে ইথিওপিয়ায় কফির প্রথম উৎপাদন শুরু হয়। সেখানে কলদি নামের এক ছাগপালক লক্ষ্য করেন, তাঁর ছাগলগুলি একটি বিশেষ উদ্ভিদের ফল খেয়ে অত্যন্ত তেজী আচরণ করছে। তখন তিনি এই গাছগুলি আবাদ করে তার ফল থেকে পানীয় প্রস্তুতি শুরু করেন। সেই ছিল কফির প্রথম মনুষ্যকৃত উৎপাদন ও ব্যবহার। ষোড়শ শতাব্দীতে কফি আরব দেশে ও পরে ইওরোপে প্রসার লাভ করে। সপ্তদশ শতকে আরব বা য়েমেন হয়ে উঠেছিল কফি রপ্তানির প্রধান কেন্দ্র। সে সময় আবার ভারত ছিল মধ্যপ্রচ্যে মশলাপাতি রপ্তানির শীর্ষে। ধরে নেওয়া যায়, তখন য়েমেন থেকে সমুদ্রপথে আরবসাগর হয়ে বা স্থলপথে পারস্যদেশ হয়ে কফির বীজ ভারতে আমদানী হতো। কিন্তু তা চাষের উপযুক্ত ছিল না। তার কারণ য়েমেন থেকে কফির বীজ শুধুমাত্র তাপে সেঁকা (roasted) বা সেদ্ধ অবস্থায় ছাড়া আর কোন ভাবে দেশের বাইরে পাঠানো নিষিদ্ধ ছিল। এর অন্যথা করে ধরা পড়লে কঠোর শাস্তি, এমন কি মৃত্যুদন্ডও, দেওয়া হত। এইভাবে য়েমেন কফির উৎপাদন ও ব্যবসা নিজেদের কুক্ষিগত ও একচেটিয়া করে রেখেছিল।
সেই সময় দক্ষিণ ভারতে এক সুফি সন্ত ছিলেন হজরত শাহ জামের আল্লাহ মাজরাবি। তাঁর অনুগামীদের কাছে তিনি বাবা বুদান নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে, সম্ভবত ১৬৭০ থেকে ১৬৯০ সালের মধ্যে কোন সময় তিনি হজ তীর্থভ্রমণে মক্কা গিয়েছিলেন। ফেরবার পথে তিনি আসেন য়েমেনের বন্দর শহর মোচাতে। সেখানে কফির বাড়বাড়ন্ত দেখে, এবং তার বীজ থেকে বানানো ‘কাহবা’ (পানীয়, যার অপভ্রংশ থেকে সম্ভবত কফি নামের উৎপত্তি) পান করে তিনি বিশেষ প্রভাবিত হন। কফির চাষ পদ্ধতি থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত কিভাবে পানীয় প্রস্তুত করা হয়, ইত্যাদি বিশদ বৃত্তান্ত অধ্যয়ন করে তিনি স্থির করলেন, ভারতে এই বস্তুটির কৃষিকাজ প্রয়োজন। কিন্তু তার জন্য চাই কাঁচা ফল বা বীজ যার চালান নিষিদ্ধ। অতএব আল্লাহকে স্মরণ করে তিনি করে বসলেন এক দুঃসাহসিক কাজ। ইসলাম ধর্মে সাত সংখ্যাটির মাহাত্ম্য আছে, এই সংখ্যাকে মঙ্গলকারী বা পয়মন্ত মনে করা হয়। তিনি সাতটি কফির বীজ তাঁর দাড়ির মধ্যে কোন প্রকারে লুকিয়ে রাখলেন। মতান্তরে তিনি তাঁর লাঠির ফাঁপা অংশে ঐ সাতটি বীজ লুকিয়েছিলেন। সংখ্যার মাহাত্ম্য বা তাঁর দাড়ির ঘনত্ব, যার জোরেই হোক, তিনি য়েমেনের সিকিউরিটি চেক নিরাপদে অতিক্রম করে দেশে ফিরে আসেন। অবশেষে নীলগিরি পর্বতমালার চন্দ্রগিরি পর্বতে তিনি ওই সাতটি অঙ্কুরিত কাঁচা বীজ রোপন করলেন। সময়ে গাছ বেরোল, ফুল ধরল, এবং অনেক ফলও উৎপন্ন হোল। তার বীজের অংশ পুনরায় রোপন করে আরও গাছ হল। এইভাবে ভারতে শুরু হল কফি চাষের প্রারম্ভ এবং বিস্তার। বাবা বুদানকে তাই দেশে কফি চাষের জনক বলা হয়।
এই গল্প সত্য বা নিছক লোক কাহিনী হতে পারে। কিন্তু বাবা বুদান এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। অধুনা কর্নাটকের চিকমাগালুরু জেলায় যে পর্বতে তিনি কফির চাষ করেছিলেন বলে কথিত আছে, তা এখন বাবা বুদান গিরি নামে পরিচিত। এই পাহাড়ে তাঁর মাজারও আছে, সেখানেই তাঁকে এবং তাঁর অনুগামী আরও দুজন সুফি সন্তকে হত্যা করা হয়। এই স্থানকে দত্তত্রেয় বাবা বুদান পীঠ বলা হয়। দত্তত্রেয় ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের যুগ্ম অবতার বলে মান্য একজন ঋষির নাম, তার সঙ্গে বাবা বুদানের কী যোগ ? যে গুহা দত্তত্রেয়র ধ্যানস্থল ছিল, সেখানেই বাবা বুদানও প্রার্থনা করতেন বলে কথিত আছে। দত্তত্রেয় অবধুত প্রথার অংশ। সব রকম আচার, বিধি, সংস্কার থেকে বিরত হয়ে এক নিরাকার ঈশ্বরের সাধনা, নিরাড়ম্বর, অহিংস জীবনযাপন এই প্রথার মূল দর্শন। সুফি তত্ত্বের সঙ্গে তার সাযুজ্য দেখা যায়। তাই দত্তত্রেয় বাবা বুদান গিরি দুই সম্প্রদায়েরই পীঠস্থান।
যাই হোক। ফিরে আসি কফির কথায়। ভারতে কফির চাষ অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রধানত ওলন্দাজদেরই নিয়ন্ত্রণে ছিল। তাঁরা মূলত নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী কফির আবাদ করতেন। ইংরেজদের আগমন ও ক্রমান্বয়ে প্রাধান্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে কফি চাষেও তাঁদের অংশীদারী বাড়লো। বেশী জমি-জায়গায় কফির চাষ হতে লাগলো এবং উৎপাদনও বাড়লো। কারণ ইংরেজরা ব্রিটেন এবং ইওরোপের অন্য অনেক দেশে ভারতে উৎপন্ন কফি বীজ রপ্তানিও শুরু করে।
স্বাধীনতার পর কফি ক্ষেত্রের মালিকানা পূর্ণভাবে ভারতীয়দের হাতে আসে। দেশে কফির উৎপাদন ও বিপণনে নিয়ন্ত্রণ ও সহায়তার জন্য স্বাধীনতার আগেই ১৯৪২ সালে ভারত সরকার ভারতীয় কফি বোর্ড স্থাপন করেছিল। এটি একটি স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা হলেও বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রকের অধীনস্থ। উৎপাদন ও রপ্তানির ব্যাপারে কফি উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের নানা রকম বিধিনিষেধের আওতার মধ্যে চলতে হত। যার ফলে উৎপাদন পরিসংখ্যানে অনেক বছর পর্যন্ত তেমন চমকপ্রদ কোন উন্নতি দেখা যায়নি। নব্বই দশকের মাঝামাঝি অর্থনৈতিক উদারীকরণ প্রক্রিয়ার পর, বিশেষ করে রপ্তানি এবং মূল্য ধারণের ক্ষেত্রে উৎপাদকরা অনেক স্বাধীনতা লাভ করেন। ফলত, উৎপাদন, ব্যবসা এবং লভ্যাংশও ক্রমবর্ধমানভাবে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
কফি চাষের জন্য কতকগুলি বিশেষ পরিমন্ডলের প্রয়োজন। কফির প্রকারভেদে আবশ্যিকতা ভিন্নতর হলেও, সাধারণভাবে কয়েকটি প্রয়োজনীয়তা উল্লেখযোগ্য। মোটামুটিভাবে বলা যায়, মাঝারি ঢালু জমি, যেখানে জল বাহিত হয়ে নেমে যেতে পারে, জৈব সার সমৃদ্ধ উর্বর জমি, ১৫ থেকে ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা, ১৬০-১৭০ সেমি গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত, ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ আর্দ্রতা, এবং সমুদ্রস্তর থেকে ৭০০-১৫০০ মিটার উচ্চতা কফি চাষের জন্যে উপযুক্ত।
এই সব আবশ্যিকতার পরিপূরক জায়গা হল পশ্চিম ঘাট পর্বতমালা। তাই ভারতের কফি চাষের সিংহভাগ এই অঞ্চলেই হয়। দেশে যত কফি উৎপাদন হয়, তার ৭১ শতাংশ আসে কর্নাটকের নীলগিরি পর্বতশ্রেণীর উপত্যকায় অবস্থিত কোড়াগু বা কূর্গ, চিকমাগালুরু ও হাসান জেলা থেকে। এদের মধ্যে আবার একা কোড়াগু জেলাই ৩৩ শতাংশের অংশীদার। কেরালা (২১%) ও তামিল নাড়ু (৫%) অন্য দুই প্রধান উৎপাদক রাজ্য। এ ছাড়া উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতেও কফির আবাদি হয়। এখন অন্ধ্র প্রদেশ এবং ওড়িশাতেও পূর্ব ঘাট পর্বতাঞ্চলের উপত্যকাভুমিতে কফি উৎপাদন হচ্ছে।
![]() |
বাবা বুদান গিরি |
![]() |
বড় বৃক্ষের ছত্রছায়ায় কফি গাছের চাষ |
আমাদের দেশে কফি প্ল্যান্টেশনগুলির শ্যামলিমা এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। এখানে কফি গাছ রোপন করা হয় অন্য বড় বৃক্ষের আচ্ছাদনের (canopy) নীচে। কফি বাগানগুলিতে দেখা যাবে অনেক ফল এবং নানা রকম শিম গোত্রের ছায়া প্রদানকারী গাছ, তার সঙ্গে এলাচ, দারচিনি, তেজপাতা, লবঙ্গ, জায়ফল, গোলমরিচ ইত্যাদি মশলার গাছ কফির গুল্মদের ছত্রছায়া বিস্তার করে যেন সুরক্ষা প্রহরীর মত অবস্থান করছে। এই সব গাছ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতাই শুধু নিয়ন্ত্রণ করে না, এদের শুখনো ফুল-পাতা, এবং এই সব বৃক্ষ যে পাখীদের আকর্ষণ করে আনে, তাদের বর্য্যপদার্থ, মাটিকে জোগায় প্রয়োজনীয় জৈব সার, রোধ করে মাটির অবক্ষয়। সরাসরি সূর্যালোক না পাওয়ায় ফলগুলি বেশী বাড়ে না, কিন্তু ফলন পর্যাপ্ত হয়। ভারতই প্রধান দেশ যেখানে এই অনন্য পদ্ধতিতে কফি চাষ হয়। এই কফির গুণগত মানও উচ্চ, এর অম্লতা কম, সুবাস ও স্বাদ আকর্ষণীয়।
ভারতে প্রধানত দু’ ধরণের কফির চাষ হয়ে থাকে, প্রথমটি আরবিকা, এবং অন্যটি হল রোবাস্টা। এ ছাড়াও সময়ের সাথে কিছু ভিন্ন প্রজাতির বা সঙ্কর গোত্রীয় কফির উৎপাদন সীমিতভাবে হলেও আরবিকা ও রোবাস্টা বা তাদের জ্ঞাতিবর্গের কফিরই মুখ্যভাবে আমাদের দেশে চাষ হয়।
আরবিকাই আদি কফি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইওরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ায় যে কফি ছড়িয়ে পড়েছিল, এবং বাবা বুদান যা ভারতে প্রথম উৎপন্ন করেছিলেন, তা এই আরবিকা। এর গাছগুলি ১৫ ফিট পর্যন্ত বেড়ে উঠতে পারে, কিন্তু বাণিজ্যিক সুবিধার্থে ৬ ফিটের মত উচ্চতায় ছেঁটে দেওয়া হয়। আরবিকার বীজে অম্লতা ও ক্যাফেইনের পরিমান কম। স্বাদে মসৃণ, কড়া ভাব কম, কতকটা মিঠাপন আছে। গন্ধে হালকা চকোলেট বা এক ধরণের ফলজাতীয় সুবাস পাওয়া যায়। অন্য দিকে রোবাস্টা (যার আসল বৈজ্ঞানিক নাম ক্যানেফোরা) গাছ উচ্চতায় আরবিকার দ্বিগুণ হতে পারে। এর বীজে ক্যাফেন ও অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টের পরিমান বেশী। স্বাদে তীব্রতা ও ঈষৎ তিক্ততা বিদ্যমান। গন্ধে যেন রবারের আভাস পাওয়া।
রসিকদের কাছে আরবিকাই কৌলীন্য অর্জন করলেও রোবাস্টাও পিছিয়ে নেই। বিশ্বের ৬০ শতাংশ উৎপাদন আরবিকার হয়ে থাকে। ভারতেও ফলনের হিসেবে ঐতিহ্যগতভাবে আরবিকাই প্রাধান্য পেয়ে এলেও গত দেড়-দু দশকে রোবাস্টা তাকে অতিক্রম করে এখন সিংহভাগ, প্রায় ৭০ শতাংশ, লাভ করেছে। তার কারণ আছে। আরবিকার গাছ স্বভাব-চরিত্রে একটু কমনীয়, বলা যায় পলকা ধরনের। এর ফলগুলির সংক্রমণ এবং কীটের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। গত শতাব্দীতে এক ধরণের সংক্রমণ ভারত সহ বিশ্বের অনেক দেশে একাধিকবার আরবিকার ফলন নষ্ট করে দেয়। অন্য দিকে, অ্যাসিডিটি বা অম্লতা এবং অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট অধিক পরিমানে থাকার জন্য রোবাস্টা রোগ প্রতিরোধে অনেক শক্তিশালী। একই ক্ষেত্রফলের এলাকায় রোবাস্টা আরবিকার তুলনায় বেশী ফল যোগায়। এবং আরবিকার জন্য ঢালু জমি অপরিহার্য হলেও রোবাস্টা কিন্তু কম ঢালু , বা অনেক জায়গায় সমতল জমিতেও বেশ বেড়ে ওঠে।
কফি একটি বার্ষিক ফসল, এর ফলন বছরে একবারই হয়। গাছগুলিতে প্রথমবার ফুল আসতে তিন-চার বছর লাগে, কিন্তু তার পর ষাট বছর পর্যন্তও ফসল উৎপন্ন করে যেতে পারে। আমাদের দেশে ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাস কফি গাছে প্রস্ফুটনের সময়। এই সময়ে গাছগুলিতে থোকা থোকা সাদা ফুল আসে, সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। অনেকটা জুঁই ফুলের মত দেখতে এই ফুলগুলির হালকা সুবাসও অনেকটা জুঁইয়ের মত। প্ল্যান্টেশনগুলিতে এ সময়ে যাঁরা প্রথমবার কফি ফুলের শোভা দেখবেন এবং গন্ধ আঘ্রাণ করবেন, তাঁদের অনেকের কাছেই এগুলি বুনো জুঁইয়ের উদ্দাম প্রগলভতা বলে ভ্রম হতে পারে। সময়মত এবং পর্যাপ্ত ফুল আসার জন্য জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসে বৃষ্টিপাতের প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জলবায়ুর ক্রমবিবর্তনের ধাক্কায় প্রধান কফি অঞ্চল দাক্ষিণাত্যে এই বর্ষণ আজকাল সব সময় নির্ভরযোগ্য নয়। তাই ইদানীং প্ল্যান্টেশনগুলিতে দেখা যাবে স্প্রিঙ্কলারের সাহায্যে জল ছিটিয়ে কৃত্রিম বর্ষণ উপায়ে সেচন করা হয়।
![]() |
কফি ফুলের শোভা |
কফি ফুলগুলির আয়ু মাত্র তিন-চার দিন। তারপর তাদের পাপড়ি একে একে ঝরে পড়ে। তবে তার আগেই ফুলের বাহারে-গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ছুটে আসে মৌমাছি আর পিঁপড়ে ইত্যাদি পোকামাকড়। পরাগায়ন অর্থাৎ pollination প্রক্রিয়ায় এদের ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য আরবিকার ক্ষেত্রে স্ব-পরাগায়ন সম্ভব, কারণ এদের ফুলে দু’ ধরণের ক্রোমোজোমই বর্তমান। রোবাস্টার জন্য পারস্পরিক পরাগমিলন বা cross pollination জরুরী। দেখা গেছে মৌমাছিদের বদান্যতায় দু’ ধরণের কফিতেই কিন্তু ফলন বৃদ্ধি পায়। তাই অনেক কফি উৎপাদকরা আবার মৌ-পালনও করে থাকেন। কফি ফুলের পাপড়ি থেকেও এক প্রকার চা তৈরী হয়। ফুলের পাপড়িগুলি ঝরে গেলে দেখা যায় ছোট্ট সবুজ রঙের গুটির মত ফলের আবির্ভাব। এই ক্ষুদ্র সবুজ ফলগুলি ধীরে ধীরে পরিনত হয়ে লাল, হলদেটে-লাল বা চেরি ফলের মত বেগুনি রঙ ধারণ করে, আকারেও বেড়ে ওঠে। এই অবস্থায় গুচ্ছ গুচ্ছ ফল সমারোহে গাছগুলির শোভাও এক দেখবার মত দৃশ্য। কফি ফলের পরিপক্কতার প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ। আরবিকার ক্ষেত্রে লাগে প্রায় সাত মাস, আর রোবাস্টার জন্য প্রায় ন’ মাস। কফির ফলকে cherry, berry এবং বীজগুলিকে beans বলা হয়ে থাকলেও এরা কিন্তু এদের গোত্রীয় নয়। চেরি বা বেরী ফলে মাত্র একটি করে বীজ থাকে, শতকরা ৯০ ভাগ কফির ফলেই থাকে দুটি করে বীজ। আর বীজগুলি মোটেই bean বা শুঁটি জাতের ফসল নয়।
ফল পাকবার পর সেগুলি বেছে বেছে আহরণ করে সংগ্রহ করাও শ্রমসাধ্য ব্যাপার, এবং আমাদের দেশে অধিকাংশত তা মানবিক শ্রমভিত্তিক। এই সব প্রক্রিয়া প্রতি বছর অনেক মানুষের কর্মসংস্থান করে। যাই হোক, এর পর আসে ফল থেকে বীজ নিষ্কাশনের পর্যায়। প্রধাণত দুই পদ্ধতিতে তা হয়ে থাকে। প্রথমটি প্রাচীন এবং আদি উপায়। একে বলা যায় শুষ্ক পদ্ধতি বা dry process। ফল সংগ্রহের পর পরিষ্কার করে ধুয়ে নিয়ে তা ছড়িয়ে বিছিয়ে দেওয়া হয় রোদে শুখানোর জন্য। কোড়াগু বা চিকমাগালুরের কফি এস্টেটগুলিতে গেলে ঘরে ঘরে দেখতে পাওয়া যাবে সমতল খালি জায়গা বা উঠোন যেখানে কফি ফল শুখানো হয়। পর্যাপ্ত সূর্যালোক পেলে প্রায় চার সপ্তাহ লাগে সঠিক শুষ্কতা আনতে, অর্থাৎ ফলগুলিতে জলের আর্দ্রতা ৬৫-৭০ শতাংশ থেকে ১২-১৩তে কমিয়ে আনতে। খুব বেশী শুখিয়ে ফেললে আবার বীজ ভঙ্গুর হয়ে যায়। এর পর যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফলের খোসা, শাঁস ইত্যাদি বাদ দিয়ে বীজ বার করে আনা হয়। যে সব অঞ্চলে সূর্যালোক এবং উত্তাপ সহজপ্রাপ্য নয়, সেখানে এই পদ্ধতি চলে না। সে সব জায়গায় বীজ নিষ্কাশনের প্রক্রিয়াকে বলা হয় আর্দ্র পদ্ধতি বা wet process। এই পদ্ধতি অনেকটাই যান্ত্রিক এবং বেশী ব্যয়সাপেক্ষ, তবে নাকি এতে করে বীজের গুণগত মানও বজায় থাকে বেশী। অধিকাংশ আরবিকা বীজ এই পদ্ধতিতে নিষ্কাশন করা হয়। এখানে পাকা ফল না শুখিয়ে শাঁসালো অংশ আগেই যান্ত্রিক উপায়ে অপসৃত করা হয়। তার পরও একটা পাতলা আবরণ বীজের গায়ে লেগে থাকে। সেটিকে প্রাকৃতিক এনজাইমের সাহায্যে একটি আধার বা ট্যাঙ্কের মধ্যে দু-তিন দিন রেখে ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়ায় সরিয়ে ফেলা হয়। এর পর বীজগুলি ভালো করে ধুয়ে নিয়ে রোদে বা গরম হাওয়া চালিয়ে শুখানো হয়। বীজের বাইরের শুখিয়ে যাওয়া অংশ, যাকে বলা হয় পার্চমেন্ট, তা যান্ত্রিক উপায়ে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। কাঁচা বীজকে অভিপ্রেত শুষ্কতায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়াকে বলা হয় সেঁকানো বা roasting।
এই দুই পদ্ধতি ছাড়া আর এক, একটু অদ্ভুত, উপায়েও কফি ফল থেকে বীজ বার করার চলন আছে, তবে খুবই সীমিত পরিসরে। আমাদের দেশে এবং দক্ষিণ এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশে বিড়াল প্রজাতির এক জন্তুর নাম Asian palm civet, যাদের বাংলায় বলা হয় গন্ধগোকুল বা খাট্টাস। অরণ্যবাসী এই নিশাচর প্রাণীটি অন্য ছোট জীব শিকার করে খেলেও পাকা ফলই এদের প্রিয় ও প্রধান খাদ্য। এরা বেছে বেছে কফির পাকা ফল খেয়ে তার শাঁসালো অংশ নিপূণভাবে হজম করে ফেলে। তারপর অপাচ্য বীজগুলি তাদের বিষ্ঠার সঙ্গে বর্জ্য পদার্থ হিসেবে বেরিয়ে আসে। সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে নিষ্কাশিত এই বীজ সংগ্রহ করে যথাযথ ভাবে পরিশোধন করে নেওয়া হয়। শুনতে বিদঘুটে লাগলেও কফির দুনিয়ায় সিভেট কফি একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পণ্য, এর মুল্যও বেশ ভারী।
ব্রিটিশদের সময় থেকেই কফি বীজ ভারত থেকে ইওরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো, সে যুগে সমুদ্রপথে কাঠের আধারে করে। কেপ অব গুড হোপ বা উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ইওরোপ পৌঁছতে লেগে যেত প্রায় ছ’ মাস। এই দীর্ঘ সময়ে সাগরের লবনাক্ত আর্দ্র পরিমন্ডল, বিশেষ করে বর্ষণসিক্ত জলহাওয়া, কফির বীজগুলিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটাতো। আর্দ্রতা শোষণের ফলে বীজগুলি হয়ে উঠতো আকৃতিতে স্ফীত, রঙে ফেকাসে। অম্লতা অনেকাংশে হ্রাস পেতো। এর থেকে যে পানীয় তৈরী হতো, তার স্বাদে কড়া ভাব ও তিক্ততা কম হতো এবং মসৃনতা বৃদ্ধি পেতো, আর তা ছিল সাহেবদের বেশ পছন্দ। উত্তরোত্তর পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমাগত উন্নতি ঘটার ফলে যাত্রার সময় কম হয়ে আসার কারণে বীজের মধ্যে সেই পরিবর্তন আর রইলো না। ভারতীয় কফির জনপ্রিয়তা পশ্চিমে কমতে শুরু হলো। আমাদের দেশের রপ্তানিকারকরা তখন এক অভিনব পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন। চালান করার আগে পশ্চিম উপকুলের সামুদ্রিক পরিবেশে প্রাকৃতিক হাওয়া চলাচল করতে পারে এমন সব গুদামে বাছাই করা বীজ এখন বর্ষাকালে ১২ থেকে ১৬ সপ্তাহ রেখে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে লব্ধ কফিকে বলা হয় Monsoon Malabar Coffee এবং এই কফি এখন ভারতের ভৌগলিক ইঙ্গিত (geographical indication) পণ্য আইনে সংরক্ষিত।
রোস্টিংয়ের পর বাজারজাত হবার আগে কফি প্রায়শই আরও একট পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যায় যাকে বলা হয় সংমিশ্রণ বা blending। প্রজাতি, উৎপত্তিস্থল এবং কৃষিপদ্ধতির ওপর নির্ভর করে প্রত্যেক শ্রেণীর কফির গুণগত বৈশিষ্ট্য আছে, স্বাদ-গন্ধের অনন্যতা লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন ধরণের কফিকে নির্দিষ্ট শতাংশে ভালোভাবে মিশ্রিত করাই blending । এতে মিশ্রিত কফির মধ্যে প্রত্যেক বীজের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের সুষম মিলন ঘটিয়ে, বলা যায়, নতুন রকমের গুণগত এক এক কফি নির্মিত হয়। এই মিশ্রণ আরবিকা ও রোবাস্টার হতে পারে, আবার ব্রাজিলের আরবিকার সঙ্গে কলম্বিয়ার আরবিকার হতে পারে, বা ভারতের ও ইন্দোনেশিয়ার রোবাস্টার সঙ্গে পশ্চিমের আরবিকার হতে পারে, এবং বিভিন্ন শতাংশেও হতে পারে। এমন কতই মিশ্রণ ঘটিয়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কফি বাজারে আসে।
![]() |
চিকোরি ফুল ও শিকড় |
![]() |
কফি বীজের সংমিশ্রন (blending) হচ্ছে |
কফি যখন গুঁড়ো পাউডার হয়ে বাজারে আসে, তখন প্যাকেটের ওপর আরেকটি উপাদানের উল্লেখ আপনারা দেখতে পাবেন। এর নাম চিকোরি। এই চিকোরি বস্তুটি কী ? এটি একটি উদ্ভিদের নাম। এর ফুলগুলি নীল রঙের, পাতায় ও শিকড়ে ওষধিগুণ আছে বলে সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই ব্যবহৃত হবার উল্লেখ পাওয়া যায়। কফি পাউডারে যা মিশ্রণ করা হয় তা এর শিকড়। শিকড়কে শুখিয়ে গুঁড়ো করে কফি পাউডারের মতই দেখতে খয়েরী রঙের একটি চূর্ণ পাওয়া যায়। স্বাদেও কফির মত বলে, ঐতিহাসিক সময়ে যখনই কফি মহার্ঘ্য হয়েছে, যেমন আমেরিকার গৃহযুদ্ধ, বা বিশ্বযুদ্ধ, বা পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক আকালের সময়ে, বিকল্প হিসেবে অথবা মিশ্রিত করে চিকোরি কফির পরিপূরক স্থান পেয়েছে। এখন কফি পাউডারে কিছু শতাংশ চিকোরি মিশ্রণ প্রায় অনিবার্য। এমনিতে এর স্বাদ বেশ তিক্ত এবং এক ধরণের কেঠো গন্ধ আছে। কিন্তু কফির সঙ্গে মেশালে কফির স্বাদে বলিষ্ঠতা এবং গভীরতা এবং গন্ধে নতুন মাত্রা আনে। প্রধাণত ভুমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলিতে পাওয়া গেলেও এখন বিশ্ব জুড়েই চিকোরির আবাদ হয়।
এবার একটু জানা যাক কফির পানীয় প্রস্তুত করার প্রণালী বা brewing সম্বন্ধে। কফি নির্যাস বানানোর জন্য প্রয়োজন একটি আধার যার মধ্যে থাকে একটির ওপর আরেকটি রাখা তিনটি প্রকোষ্ঠ। সব থেকে সরল এবং পুরোনো পদ্ধতি হল ভারাকর্ষণ বা gravity পদ্ধতি। একটি ছাঁকনি অথবা ফিল্টার কাগজের ওপর গুঁড়ো কফি মাঝের প্রকোষ্ঠে রেখে ওপর থেকে ধীরে ধীরে গরম জল ঢালা হয় যা কফির ভেতর দিয়ে বাহিত হয়ে নীচে রাখা পাত্রে চুঁইয়ে চুঁইয়ে বিন্দু বিন্দু জমা হয়। এই তরলকে বলা হয় decoction। দক্ষিণ ভারতে গরম দুধ ও চিনির সঙ্গে মিশিয়ে ঘরে ঘরে এই ‘ফিল্টার কাপি’ পানের চলন বহুকাল থেকেই সমানভাবে জনপ্রিয়। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে ওপরের প্রকোষ্ঠে পিস্টন দিয়ে চাপ সৃষ্টি করে গরম জলকে অপেক্ষাকৃত দ্রুত বেগে কফি পাউডারের ভেতর দিয়ে তলার প্রকোষ্ঠে পাঠানো হয়। একে বলে French press প্রণালী। এতে নাকি কফির ক্যাফেন, অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট ইত্যাদি গুণগত আবশ্যিক উপাদানগুলি নির্যাসের মধ্যে অধিক মাত্রায় মজুদ থাকে। আর একটি পদ্ধতিতে নীচের প্রকোষ্ঠে জল ফোটানো হয়। বাষ্প হয়ে কফি পাউডারের মধ্যে দিয়ে পরিচালিত হয়ে ওপরের প্রকোষ্ঠে ওঠে এবং ক্রমে ঠান্ডা হয়ে নির্যাস হয়ে জমা হয়। এমনি সব প্রক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরণের কফি প্রস্তুতকারক যন্ত্র বাজারে পাওয়া যায়। কফির নির্যাস বানানো একটু সময়সাপেক্ষ। আজকের চটজলদির যুগে যাদের সময়ের অভাব, তাদের জন্য এসেছে ইনস্ট্যান্ট কফি। কেবল গরম জলে গুলে নিলেই কফি তৈরী, কোন তলানি গুঁড়োও থাকে না। তবে খানদানী কফি রসিকরা এ কফি পছন্দ করেন না।
আমেরিকায় কফি পানের ইতিহাসে তিনটি লহর বা waveকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যে সব বিশেষত্বের নিরিখে এদের কাল বিভাজন করা হয়েছে, সেগুলি অনুসরণ করলে পৃথিবীর অন্যত্র এবং ভারতেও এই তিন লহরকে নির্ধারণ করা যেতে পারে। বহু বছর ধরে কফি এ দেশে চিরাচরিত উপায়ে প্রস্তুত করে পরিবেশিত হত অথবা ইনস্ট্যান্ট কফি পান করা হত, সেখানে কফির উৎস বা প্রস্তুতি পদ্ধতিগত বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি মুখ্য ছিল না। কফি ছিল মোটামুটি সর্বসাধারণের সামর্থ্যের মধ্যে। কফি বোর্ড পরিচালিত কফি হাউসগুলি এবং ছোট-বড় রেস্তোরাঁ এই পর্বের ধারক ও বাহক। কফি তখন বড় শহরগুলিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। বলা বাহুল্য, কফির এই প্রথম লহর কিন্তু আজও বেশ জনপ্রিয়। ১৯৯৬ সালে ক্যাফে কফি ডে’র আবির্ভাব নিয়ে এল ক্যাফের সংস্কৃতি। এঁরা কফির উৎসস্থানগত বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দিলেন। সেই সঙ্গে জোর দিলেন ক্যাফেকে এক উপভোগের জায়গা করে তুলতে, যেখানে এক কাপ কফিকে সঙ্গী করে অবসর সময়ও কাটানো যায়, আবার কাজের কাজও করা যায়। তাছাড়া দ্বিতীয় স্তরের শহরগুলিতেও কফিকে ছড়িয়ে দিতে এঁদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেই ধারাকেই এগিয়ে নিয়ে গেল ২০১১ সালে টাটা গোষ্ঠীর সহযোগে বহুজাগতিক শৃঙ্খলা স্টারবাকসের আগমন। বিভিন্ন প্রজাতির ও ধরণের কফিকে এঁরা ভারতে নিয়ে এলেন। সেই সঙ্গে কফির সাথে রকম রকম সুগন্ধি, পানীয় ইত্যাদির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে কত বিচিত্রভাবে কফিকে উপভোগ করা যায়, তার বহুবিধ বিকল্প তাঁরা গ্রাহকদের উপলব্ধ করলেন। কফির গুণমান উন্নত করতেও এঁদের প্রয়াস উল্লেখযোগ্য। গত দু’ দশকে কস্টা কফি, থার্ড ওয়েভ কফি ইত্যাদি ব্র্যান্ডেড কফি শৃঙ্খলা সহ ছোট বড় অনেক ক্যাফের প্রাদুর্ভাব শহরে শহরে ঘটেছে।
কিন্তু তৃতীয় লহর বা Third Wave চিহ্নিত হয়েছে speciality coffee বা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কফি দিয়ে। ভৌগলিক স্থানগত বিশেষত্ব, ত্রুটিহীন কাঁচা বীজ নির্বাচন থেকে শুরু করে বীজের প্রক্রিয়াকরণের প্রত্যেক স্তরে গুণগত মান বজায় রাখা, এমন কি যে জল ব্যবহৃত হবে তার মান ইত্যাদি, এবং শেষে প্রস্তুত কফির স্বাদ ও গন্ধের অনন্যতা, এত সব ব্যাপারের নিরিখে সেই কফি বিশিষ্টতার তখমা পাবে কি না, তা নির্ভর করে। স্পেশিয়ালিটি কফি অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি সংস্থা মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে বিচার করে নির্ধারণ করেন কোন কফি গুণবত্তার মাপকাঠিতে কত উন্নত মানের। ৯০এর ওপর নম্বর পেতে পারলে সেই কফিকে স্রেষ্ঠ বলে গণ্য করা হয়।
![]() |
দক্ষিণ ভারতের ‘ফিল্টার কাপি’ |
![]() |
ঐতিহ্যবাহী কফি হাউস |
![]() |
আজকের কফি শপের কফি |
আজকের ক্যাফেতে পুরোনো সেই একই ধরণের কফির জায়গায় পাবেন হরেক রকমের কফি। গরম কফি চাইলে নির্বাচন করুন কালো আমেরিকানো বা ফেনিল এসপ্রেসো, অথবা দুধ মেশানো লাটে, ক্যাপুচিনো, মোকা ইত্যদির মধ্যে থেকে। ঠান্ডাই পছন্দ ? তাহলে বেছে নিন নিছক বরফ মেশানো কালো কফি, না হলে ভ্যানিলা, ক্যারামেল, চকোলেট, ক্রীম, আইসক্রীম ইত্যাদির মিশেলে তৈরী সম্ভার। আপনার রুচি আর পছন্দমত কফি অচিরেই বানিয়ে দেবেন ব্যারিস্টারা। সেই ১৯৪৬ সালে ফ্র্যাঙ্ক সিনাট্রা গেয়েছিলেন, ‘They’ve got an awful lot of coffee in Brazil’, আজ এ দেশে থাকলে তিনি নিশ্চয়ই বলতেন, ‘ভারতেও তো এখন দেখছি কফির হরেকরকমবা’ !