Next
Previous
Showing posts with label প্রবন্ধ. Show all posts
0

প্রবন্ধ - সেবিকা ধর

Posted in









জলকে 'জীবন' বলা নতুন কিছু নয়, এই তথ্য- সর্বজনবিদিত যেমন অ এর পর আ।পৃথিবীর তিনভাগ জল একভাগ স্থল এও আমাদের জানা।ত্রিপুরার মহিমময় জলভাণ্ডার তার নদী, খাল, হাওড়- বাওড়,দিঘি,ছোট বড় পুকুর সবই রাজ্যের মানুষের জীবন বেঁচে থাকা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতোভাবে জড়িত।ত্রিপুরার অতিবিখ্যাত গোমতী নদী রবীন্দ্রনাথের লেখায় অমর হয়ে আছে।এখন কথা হল ত্রিপুরার এই যে জলসম্পদ- জল তা নীর-বাসনা হয়ে অবিরত আমাদের কাছে এক শিল্পরূপ তুলে ধরে।ত্রিপুরার রাজারা ছিলেন বিদ্ব্যোৎসাহী।শিল্প ও সাহিত্য প্রেমী সংস্কৃতি বোধ সম্পন্ন মানুষ। রবীন্দ্রনাথকে তারা কীভাবে আপন করে নিয়েছিলেন তা ইতিহাসের সাক্ষ্য কণা হয়ে জেগে আছে।আমরা জলের কথা বললাম।এবার আমরা ত্রিপুরার কিছু জল সম্পদের কথা বলি।

ত্রিপুরায় যে যে নদী আছে মনু,হাওড়া,গোমতী, খোয়াই, দেও, জুড়ি, ধলাই ইত্যাদি প্রভৃতি সবই ত্রিপুরার মানুষের জীবনে সভ্যতার বহতা আঙ্গিক হিসাবে জড়িত।ত্রিপুরার রাজারা নদীর বুকে প্রাসাদ তৈরি করে জল ও জল শিল্পকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন।রাজস্থানের যে জলাশয় কেন্দ্রিক প্রাসাদ তার তুলনায় 'নীরমহল' একেবারেই স্বতন্ত্র। হয়তো স্থাপত্যের নিরিখে শিল্পের কলাকৌশলে সূক্ষ্মতায় রাজস্থানের প্রাসাদেরা যে শৈল্পিক চূড়া স্পর্শ করে নীরমহল হয়তো তার তুলনায় কিঞ্চিৎ ঊন হলেও তার শোভা এবং বৈশিষ্ট্য অনন্য।বিশেষ করে রাতে যখন আলো জ্বলে উঠে নীরমহল- এর মনুষ্যবিহীন ঘর ও বারান্দায় তখম মনে হয় স্বপ্ন লোকের কোনও অলৌকিক চাবি আমাদের সামনে এসে দোল খায়।তাকে ধরে নিয়ে স্বপ্ন ও কল্পনা এবং বাস্তবের দরজাটুকু খুলে ফেললে আনন্দ ও শৈল্পিক জাগরণে।আবার দিনে নীরমহলের শোভা অন্যরকম।

পৃথিবীর কোলে জলের শোভার মধ্যে জেগে থাকা সে যেন এক অলৌকিক রাজহংস।দূর থেকে ধীরে নৌকো পথে যত তার কাছে যাওয়া যায় তর তার মহিমময় রূপ যেন ফুটে ওঠে চোখের সামনে।শীত সকালের অলৌকিক কুয়াশার মধ্যে এই মহল যেন এক কুহক যাত্রার কথা বলে।নৌকো করে নেমে এসে ধীরে ধীরে ভেতরে এলে রাজার বিশ্রাম কক্ষ,নর্তকীদের নাচের জায়গা, বারান্দা, ঝরোখা, রাজাদের ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট স্বতন্ত্র নৌকো- ঘাট সবই আমাদের বোধ ও শৈল্পিক ভাবনাকে নবরসে জাড়িত করে।মুঘলরা ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য বিস্তারের পর দিল্লিকে রাজধানী করলে অনেক ধরনের বাগান তারা বানিয়েছিলেন।মুঘল শাসকদের কাছে বাগান-বিলাস এবং জল একটা বড় ব্যাপার ছিল।সব ধরনের বাগানেই ছিল পরিকল্পনার ছাপ এবং জলের ব্যবস্থা। এমনকি তারা অতি বিখ্যাত সব স্থাপত্য জলের আয়োজন রাখতেন।মধ্য এশিয়ায় জলের অভাবে কি এই জল তৃষ্ণার অন্যতম কারণ? তাই স্থাপত্য নির্মাণ করলেই জলের আয়োজন। যেমন তাজমহল।ত্রিপুরার রাজাদের ব্যাপারটি স্বতন্ত্র। তারা জলের ভেতর শিল্প গড়েছেন।শিল্পের স্বপ্নের সঙ্গে জলের স্বপ্নও মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

এবার আসি আমরা নীরমহল প্রসঙ্গে।বোটে করে নীরমহল যেতে যেতে অজস্র পাখি এবং মাছ ধরার নৌকো চোখে পড়ে আমাদের। এর প্রাকৃতিক শোভা অনবদ্য। সৌন্দর্য মুগ্ধ টুরিস্টরা এই জলশোভার ছবি নেন অকাতরে।এই প্রাসাদের গম্বুজ ও ঝরোখা ইসলামিক ও হিন্দু স্থাপত্য শৈলীর সমন্বয়বাদী এক ধারাবাহিকতার কথা বলে।

নীরমহল যার অর্থ “জল প্রাসাদ”। এটি ১৯৩০ সালে রুদ্রসাগরের হ্রদের মধ্যবর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুর কর্তৃক নির্মিত একটি রাজকীয় প্রাসাদ এবং এটি ১৯৩৮ সালে সম্পন্ন হয়। এটি ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে ৫৩ কিলোমিটার দূরে মেলাঘরে রুদ্রসাগর লেকের মাঝখানে অবস্থিত এবং হিন্দু ও মুসলিম স্থাপত্য শৈলীর সমাহার করে।এই প্রাসাদটি ভারতের সবচেয়ে বড় এবং পূর্ব ভারতে একমাত্র। ভারতে শুধু দুটি জল প্রাসাদ আছে অন্য আরেকটি রাজস্থান রাজ্যের “জল মহল“। ত্রিপুরার ‘হ্রদ প্রাসাদ‘ হিসাবে পরিচিত, নীরমহল একটি গ্রীষ্ম বসবাসের স্থান হিসাবে নির্মিত হয়েছিল। সুন্দর রুদ্রসাগর হ্রদে প্রাসাদ নির্মাণের জন্য মহারাজা বীর বিক্রম মাণিক্য বাহাদুরের ধারণা ছিল এবং ১৯২১ সালে তিনি তাঁর প্রাসাদ নির্মাণের জন্য ব্রিটিশ কোম্পানি “মার্টিন ও বার্নসকে” স্বীকৃতি দেন। কাজটি সম্পন্ন করার জন্য কোম্পানিটি নয় বছর সময় নেয়। মহারাজা বীর বিক্রম মাণিক্য বাহাদুর ‘মাণিক্য রাজবংশের‘ ছিলেন, যা আজ বিশ্বের একক শাসক লাইন থেকে দ্বিতীয় বলে মনে করা হয়।

প্রাসাদ হল মহারাজার মহান দূরদর্শিতা এবং হিন্দু এবং মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মিশ্রণের তার চিত্তাকর্ষক ধারণা।

প্রাসাদটিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রাসাদটির পশ্চিমাঞ্চল অন্দর মহল নামে পরিচিত। এটা রাজকীয় পরিবার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। পূর্ব দিকের একটি খোলা আড়ম্বরপূর্ণ থিয়েটার যেখানে নাটক, থিয়েটার, নাচ এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলি মহারাজা এবং তাদের রাজকীয় পরিবারের আনন্দ উপভোগের জন্য সংগঠিত হয়।

রুদ্রসাগর লেকে অবতরণে নীরমহল দুটি স্টারওয়েজ ঢুকিয়েছে। ‘রাজঘাট‘ থেকে হাতে চালানো নৌকা দিয়ে মহারাজ প্রাসাদে যান।

১২২ মিটার লম্বা কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে দুধ-সাদা রঙের প্রাসাদে রয়েছে সর্বমোট ২৪টি কক্ষ, যাকে ঘিরে রয়েছে সুন্দর বাগান। প্রাসাদের গম্বুজ আকৃতির মিনারগুলি, বিরাট ‘দরবার কক্ষ’, রাজা-রানির বিশ্রামকক্ষ, সুউচ্চ নজরমিনার সবই চমৎকৃত করবে। রুদ্রসাগরের পাড় থেকে জলের মধ্যে থাকা নীরমহলকে দেখে রাজস্থানের উদয়পুরের লেক-প্যালেস ‘জলনিবাস’-এর পিছোলা লেকের উপর অবস্থিত কথা মনে পড়বে। রুদ্রসাগর লেকের জলেও পড়ে নীরমহলের প্রতিবিম্ব। ৫.৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রুদ্রসাগর সরোবর বিভিন্ন ধরনের পাখির বিশেষত পরিযায়ী জলকেলির এক নিরাপদ ঠাঁই। নীরমহলের প্রশস্ত ছাদ থেকেও রুদ্রসাগরের এক দারুণ দৃশ্য চোখে পড়ে।

যেটুকু সৌন্দর্য কথা,সৌন্দর্য মালা আমাদের সামনে দিয়ে যেন বা আমাদের সামনে কোনো সিনেমার ছবি হয়ে ছুটে গেল সেই শব্দমালাদের যে শিল্পিত রূপ তার বর্ণনায়।নীরমহলের ছায়ার আলোয় ইতিহাসে ভূগোলে করার চেষ্টা হল তা হয়তো অসম্পূর্ণই।প্রকৃত প্রস্তাবে যেকোনো রস ও সৌন্দর্য তো আসলে অপূর্ণই।অপূর্ণতাই তার সুন্দর হয়ে উঠার বহুমাত্রিক গুণ।
0

প্রবন্ধ - অম্লান রায় চৌধুরী

Posted in






এখন ফোন ইন্টারনেট সহ অন্যান্য ডিভাইস আমাদের জীবনের এতখানি
দখল করে নিচ্ছে যে বাস্তবের সঙ্গে আমরা তাল মিলিয়ে চলতে পারছিনা।
প্রতিক্ষণ আমাদের মনে হচ্ছে দুনিয়ায় হরেক রকমের ইভেন্ট ঘটে
চলেছে । সে সবের সঙ্গে সংযুক্ত ও সম্পৃক্ত না থাকতে পারলে বেঁচে থাকা
অর্থহীন । তাই আমি আইসক্রীম কিনতে গিয়ে ভারচুয়াল দুনিয়ায় একটানা
সফর করতে থাকি , আর এমনটা বুঁদ হয়ে যাই , শেষ মেশ আইসক্রীম আর
কেনা হয়না । হয়তা অন্য কিছু করে বাড়ি এলাম , আসল কাজটা এভাবেই
হয়না। এই প্রবণতা কে বলা হয় ‘ফোমো’ – যার অর্থ -- ফিয়ার অফ
মিসিং আউট । যার সঙ্গে মিশে থাকে বেশ মিঠে কড়ায় দানা বাঁধা আশঙ্কা
, উদ্বেগ ।

‘ফোমো’ র আগের ধাপ ‘ইয়েলো’ (ইউ অনলি লিভ ওয়ান্স)।
‘ফেমো’ র স্রষ্টা প্যাট্রিক ম্যাকগিনিস এর বিবরণ দিয়েছেন নিজের
জীবনের আখ্যান দিয়ে । নতুন শতকের একেবারে শুরুর পর্ব সেটা।
এই ফোমোর বিষয়টা এখন বেশ চালু। দেখা যায় সব সময় । একসময় আমি
ভাবতাম ‘ফোমো’র সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশাল কোনো অঘটন বা আঘাত বা
এমন কিছু ঘটনা যা অনুমেয় যোগ্যও নয় – যেমন ৯/১১ দিনটির
ভাঙ্গচুরময় অভিজ্ঞতা। কিন্তু দেখলাম সেটা ঠিক নয় । ভুল ভেবেছিলাম ।
ফোমো মানুষের চেতনে অনেক আগে থেকেই বিরাজ করছে । বহু মানুষ আছে
যাদের দেখা যায় দিনের শুরু থেকেই শুধু খুঁজে ফেরে সুযোগ , সে কম পয়সায়
খাবার পাওয়া থেকে আরম্ভ করে , বেশী ডিসকাউন্টে ইলেকট্রনিকস
গুডস পাওয়া – সব কিছুর খোঁজ তার নখ দর্পনে। তাদের পাওয়ার জন্য
মরিয়া , এদের কাছে হারিয়ে যাওয়ার অপশন অনেক , কোনোটাকেই তাই
ছাড়তে চায়না , হয়ত মোবাইলের মতন এক জায়গায় দেখতে পায়না কিন্তু
খোঁজ পায় , কথা বলে , নিজের জীবনের ঝুঁকিকে সামনে রেখেও চলে এই
বাক্যালাপ , এটা তার আনন্দ , না হারিয়ে ফেলার আনন্দ , একেবারেই
‘ফোমো’য় আকৃষ্ট নিবিষ্ট – এক প্রকৃষ্ট বা ক্লাসিকাল উদাহরণ ।
তবে ঐ ‘ফোমো’ ও তার কনসেপ্টকে -- সোস্যাল মিডিয়া – এখনকার
ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রাম – সম্ভবত আগুনের শিখার মতন একেবারে উসকে
দিয়েছে । করে তুলেছে ফোমোকে একটা ভয়াল ‘মডার্ন এপিডেমিক’ ।
প্যাট্রিক জে ম্যাকগিনিস, এই ফোমো কনসেপ্টের স্রষ্টা , দেখতেন তার
বন্ধুদের মধ্যে , যখন তিনি হার্ভার্ডে পড়তেন , কি ভীষণ রকমের
উত্তেজনা – ঐ ফেসবুক , ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদি নিয়ে । কি অপরিমিত সময়
তারা ব্যবহার করত সেই সময় । এটাকেই উনি দেখতেন একটা ‘ক্রনিক
সিন্ড্রোম’ হিসাবে , এবং পরবর্তী কালে তাদেরকেই দেখতেন , যে তারা
আর পারছেনা তাল মিলিয়ে চলতে জগতের সঙ্গে ।এটা ক্ষতি , চরম
ক্ষতি। এই প্রসঙ্গে একটা ব্যাঙ্গাত্মক লেখা ম্যাকগিনিসের খুব মনে
পড়ে , সেখানে তিনি Two Fo’s নামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন , একটা
ফো হলো ‘ফোমো’ যা আগেই বলেছি আর একটি হলো ‘ফোবো’ – ফিয়ার
অফ আ বেটার অপশন।

আরও আশ্চর্য লাগে যখন ম্যাকগিনিস সম্বন্ধে পড়ি এবং জানতে পারি
যে উনি বেশী চিন্তিত ছিলেন ‘ফোবো’ নিয়ে অথচ সারা দেশ চিন্তিত ছিলো
‘ফোমো’ নিয়ে। ওনার যুক্তি ছিল, যে, ফোমো কখনও আপনাকে নষ্ট করে
দেবেনা, আপনাকে আত্মা অবধি ব্যার্থ ও ক্ষয়িষ্ণু করে তুলবেনা ।
কিন্তু ফোবো তা করতে পারে । তার মতে, ফোবো আসলে মানুষকে কমিটেড
হতেই দেয়না। তাকে একটা সংশয়ের মধ্যে রাখে, সম্ভবত, হয়তো, এই
দোলায় সারাক্ষণ দোলায় । আসলে ফোবো একটি সিদ্ধান্তহীনতার
অভিশাপ ।

কোনো পরিকল্পনাকেই স্বতস্ফুর্ত ভাবে গ্রহণ করবার মতন মানসিকতা
তৈরি করতে দেয়না । এই ভয়টা আছে । অনেকেই বা বহু ক্ষেত্রেই মনের
মধ্যে একটা ‘আরো ভালো’ অথবা বোধ হয় ‘আরও একটু দেখা’ যেতে পারে
– এই সমস্ত ভাবনাগুলোকে প্রশ্রয় দেয়। তারা সব সময় ‘আরো ভালো’র
সন্ধানে মত্ত থাকে , আসল কাজের জিনিষটা শেষে পাওয়া হয়না । এই
ভীতিটা ম্যাকগিনিসের আছে এবং তার ব্যাক্ষায় বেশ দেখা যায় ।
দেখা যায়, দুটো চাকরীর অফার, ঠিক করতেই পারলোনা, দ্বীধায়,
সিদ্ধান্ত নিতে পারলোনা -- কোনোটাতেই শেষে জয়েন করা হলোনা । কিংবা
বেড়াতে যাওয়ার জন্য নানান জায়গার অপশন, বাছাবাছি করতে করতে
ভ্যাকেশন শেষ, যাওয়া হলোনা – এমনটা হয় , হচ্ছে , আর এটাই ‘ফোবোর’
ফল।

আসলে দ্বীধার মাত্রাটাকে বড় বেশী জোড় দেওয়া হয়, তাই সিদ্ধান্তের
ক্ষেত্রেও ততটাই শিথিলতা ।

‘ফোমো’ তে ব্যাক্তি মানুষ নিজে কষ্ট পায় । কিন্তু ফোবোর যাতনা সইতে
হয় আরও অনেক মানুষকে । ‘ফোবো’ ছেড়ে চলে যায়না, ফলটা চলতে থাকে
জীবনের অনেক দুর পর্যন্ত, কাজেই কাছ ছাড়েনা। অবচেতনকে কখনো
ছাড়েনা । বেশী বয়সে গিয়ে মনে পড়ে, ভুল সিদ্ধান্ত, জ্বালায়, করার কিছুই
থাকেনা । মানুষকে আরও আত্মসর্বস্ব বানায় ।

এখন দেখা যাক উপায় কী ? দেখা যাক না যে জীবন , শান্ত , বাগানে
দোয়েলের টানে --ফড়িংয়ের হুটোপুটিতেও শান্তভাবে পাখী শিস দিয়ে গান
গায় – এমন অবস্থাটাকে বরণ করা যায় কিনা । আরো ভাল কিছু না পাওয়া
অবধি পক্ষ অবলম্বন করবনা, এমন নির্বোধ আচরণ না হয় নাই–ই বা
করলাম । কারন আরো ভালোর কোনো নিশ্চয়তা নেই – এটাকে মাথায়
রাখতে হবে – ভবিষ্যতের উপর নিজের ইচ্ছাকে চাপিয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়
, ফল ভালো হয়না , তার প্রমাণ আছে ঝুড়ি ঝুড়ি – সমাজ থেকে কিংবা
পুরান থেকে - অনেক আছে জীবনে – তাই ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ বলতে পারা অনেক
ভালো , ‘হয়তো’ বলার চেয়ে।

এতেই জীবন সহজ ও আনন্দময় হয় । গ্যারান্টি দিচ্ছেন কিন্তু সেই
মানুষটিই যিনি ‘ফোমো’ আর ‘ফোবো’, এই দুইয়েরই স্রষ্টা।
0

প্রবন্ধ - পিয়ালী বসু

Posted in





















“The end is in the beginning and yet you go on.” ― Samuel Beckett, Endgame .

১৯০৬ সালের ১৩ এপ্রিল। আয়ারল্যান্ডের রাজধানী 'ডাবলিন ' শহরে জন্মগ্রহণ করেন অনন্য এক নাট্যকার ... স্যামুয়েল বার্কলে বেকেট ( Samuel Barclay Beckett ) ... বিংশ শতকের সাহিত্যিকদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিসেবে তাঁর নাম আজও অমর।
.
বেকেটের বাবা উইলিয়াম ফ্রাঙ্ক বেকেট ছিলেন একজন স্বখ্যাত মানুষ । বাবা'র প্রভাব বেকেটের জীবন এবং সৃষ্টিতে বেশ স্পষ্টমান ।
.
১৯২৩ -১৯২৭ সাল ...এই পাঁচ বছরে বেকেট তাঁর শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ট্রিনিটি কলেজ থেকে । স্বাভাবিক ভাবেই বেকেটের প্রতিটি সৃষ্টিতে শিক্ষার এই আলোক গভীরতা বিশেষভাবে দৃশ্যমান |
.
১৯২৯ সালে প্রকাশের আলো দেখে তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা ... ' দান্তে...ব্রুনো...ভয়েজ জেমস জয়েস'... , অগ্রজ লেখক জেমস জয়েসের লেখার দুর্বধ্যতা নিয়ে সে সময়ে সমালোচনায় তোলপাড় সাহিত্য মহল , বেকেটের উদ্দেশ্য ছিল , জয়েসকে সহজবোধ্য করে আপামর সমালোচকদের সামনে হাজির করা ... এবং সে প্রয়াসে সার্থক ছিলেন তিনি ।
.
১৯৩৮ সাল । প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস 'মুরফি ' । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ন্যাৎসিদের চূড়ান্ত বর্বরতা এবং অমানুষীকতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে বেকেট যোগ দেন ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীতে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মমতা, অনৈতিকতা, এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সুস্পষ্ট চিত্র ফুটিয়ে তোলেন বেকেট তাঁর উপন্যাসে ।
.
বেকেটের শ্রেষ্ঠ নাট্যকর্ম 'ওয়েটিং ফর গডো' প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে ... ১৯৫৩ সালে প্যারিসের থিয়েটার ডে ব্যাবিলনে মঞ্চস্থ হয় 'ওয়েটিং ফর গডো । প্যারিসের নাট্যপ্রেমীদের জন্য নাটকটির ফরাসি নাম রাখা হয় 'এন অ্যাটেনডেন্ট গডো'... অর্থাৎ গডো 'র জন্য প্রতীক্ষা । বেকেটের অন্যতম প্রিয় বন্ধু জেমস নেলসনের কথায় ... নাটকটির শো ছিল হাউসফুল ! প্রিয় বন্ধুর রচিত নাটকটির বিখ্যাত হবার অন্যতম কারণ হিসেবে নেলসন জানান , ... নাটকটি'র ভিন্ন ভিন্ন অর্থ করেছেন ভিন্ন ভিন্ন নাট্যপ্রেমী মানুষ , আর এই কারণেই বিশেষ কোন কালের গণ্ডীতে আবদ্ধ না থেকে দর্শকদের কাছে এ নাটক হয়ে উঠেছে কালোত্তীর্ণ ,সর্বজনীন ।
.
১৯৫৪ সালে নিউইয়র্কে প্রকাশিত হয়'ওয়েটিং ফর গডো'র ইংরেজি অনুবাদ, ... তারপর থেকে সম্ভবত ২৩টিরও বেশী দেশে মঞ্চস্থ হয়েছে এ নাটক এবং ৩২-৩৩ টি ভাষায় অনূদিতও হয়েছে । এই কাল্ক্রমিক ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে 'ওয়েটিং ফর গডো'র অনন্যতা ।
.
১৯৫৫ সালে লন্ডনের আর্ট থিয়েটারে চব্বিশ বছরের তরুণ পরিচালক পিটার হল'এর পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয় ওয়েটিং ফর গডো' । নাট্য সমালোচক কিনিথ টাইনান এক প্রেসমিটে জানান --- " Waiting for Godot frankly jettisons everything by which we recognise theatre. It arrives at the custom house, as it were, with no luggage, no passport and nothing to declare: yet it gets through as might a pilgrim from Mars. It does this, I believe, by appealing to a definition of drama much more fundamental than any in the books. A play, it asserts and proves, is basically a means of spending two hours in the dark without being bored. " (August 7, 1955)
.
রূপকাশ্রয়ী এবং প্রতীকী এই নাটকটিতে bleak themes এর সার্থক প্রয়োগ করেন বেকেট|

দুটি অ্যাক্টে পরিবেশিত এ নাটকটিকে 'ট্র্যাজিক কমেডি' হিসেবেও চিহ্নিত করা হয় । ESTRAGON এবং VLADIMIR এর চরিত্র দুটি আসলে সমকালীন বিধ্বস্ত মানুষের দুঃখের প্রতীক হিসেবেই খ্যাত । নাটকের শুরুতে দেখা যায়, ভবঘুরে ছন্নছাড়া দুই লোক ভলাডিমির ও এস্ট্রাগন তেমনি এক ছন্নছাড়া ধূসর এক প্রান্তরে কোন এক মি. গডোর জন্য অপেক্ষা করছে। নাটকের শেষেও তারা প্রতীক্ষাই করে; কিন্তু মনে হয় যেন তারা অনন্তকাল ধরে প্রতীক্ষা করছে... অর্থহীন এই প্রতীক্ষা, কারণ গডো আসেন না , কোনদিন আসবেন সে নিশ্চয়তাও নেই , তবু মুক্তি নেই তাদের... প্রকারান্তরে আমাদের । যাবতীয় ধর্মবিশ্বাসের বিসর্জনে, মানুষের বিপর্যস্ত অবস্থায় একটি সামগ্রিক শূন্যতার মধ্যে এই নাটক আসলে মানব সত্তাকে তার চূড়ান্ত বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে চায়... দেখিয়ে দিতে চায় ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত সবকিছুই অবলুপ্ত ... আঁকড়ে ধরার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই ।
.
১৯১৩ সালে 'ওয়েটিং ফর গডো'র ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান আবারও মনে করিয়ে দেয় , কাল্পনিক চরিত্র নয় , এ নাটক আসলে কালজয়ী চরিত্র সৃষ্টিতে চূড়ান্ত ভাবে সার্থক ।
.
আয়ারল্যান্ডের গলওয়ে'র Druid থিয়েটারে Garry Hynes এর পরিচালনায় সম্প্রতি মঞ্চস্থ হয় 'ওয়েটিং ফর গডো'। Druid থিয়েটারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ব্রশিওরে জানানো হয় -- " On a bare road in the middle of nowhere, two world-weary friends await the arrival of the mysterious Godot. While waiting, they speculate, bicker, joke and ponder life’s greater questions. As dusk begins to fall, two figures appear on the horizon "
.
অ্যাবসার্ড নাটক হিসেবে আজও উজ্জ্বল ভাবে উল্লেখ্য ওয়েটিং ফর গডো'র নাম । গোটা নাটক জুড়ে শুধুমাত্র কিছু ঘটেনা... নেই কোন সংঘাত অথবা দ্বন্দ্ব ...প্রধান দুই Protagonist চরিত্র শুধু একটি কাজই করে আর তা হলো অপেক্ষা। তারা অপেক্ষা করে গডো’র জন্য , তারা বিশ্বাস করে গডো এলে তাদের সব সমস্যার সমাধান হবে, তারা মুক্তি পাবে এই প্রাত্যহিক অভিশপ্ত জীবন থেকে। আমরা যে কী ভীষণভাবে নিঃসঙ্গ এবং অসহায় তারই এক একটি জ্বলন্ত উদাহরণ থিয়েটার অব দ্য অ্যাবসার্ডের নাটকগুলি ,

সার্থক অ্যাবসার্ড নাটক হিসেবে আজীবন আমাদের মনের মণিকোঠায় স্বযত্নে বাস করবে 'ওয়েটিং ফর গডো' ।
.
" We are all born mad. Some remain so"' ― Samuel Beckett

মানুষ হিসেবে বেকেট ছিলেন স্পর্শকাতর, অনুভূতিপ্রবণ এবং প্রচারবিমুখ ... নিজের মধ্যেই ডুবে থাকতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন তিনি , ... অনেকে বেকেট কে দুঃখবাদী ' বলে অভিহিত করেন , দুঃখবিলাসিতা অবশ্যই তাঁর জীবন যাপনে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে রয়েছে তবুও বেকেট আশাবাদী মানুষ হিসেবেই চিহ্নিত ... " Ever tried. Ever failed. No matter. Try Again. Fail again. Fail better. " তাঁর এ প্রখ্যাত উক্তি প্রমাণ করে শৈল্পিকতা বিরাজ করতো তাঁর মনের অলিন্দে ।
.
" Nothing matters , but the writing . There has been nothing else worthwhile .. a stain upon the silence " ― Samuel Beckett ১৯৮৯ সালের ২২ শে ডিসেম্বর । ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নাটকে উত্তর আধুনিকতার ধারক স্যামুয়েল বার্কলে বেকেট ।

--------------------------
ছবি - (১) -- আয়ারল্যান্ডের গলওয়ে'র Druid থিয়েটারে Garry Hynes এর পরিচালনায় সম্প্রতি মঞ্চস্থ হয় 'ওয়েটিং ফর গডো'... এটি তারই পোস্টার ছবি -(২)-- স্যামুয়েল বেকেট ছবি -(৩) -- মঞ্চে 'ওয়েটিং ফর গডো


তথ্যসূত্র :
--------
Samuel Beckett : The Complete Dramatic Works . ______Faber & Faber

Wating For Godot : Analysis .

____ Mateuez Brodowicz








0

প্রবন্ধ - রূপশ্রী ঘোষ

Posted in






প্রেম কি শুধুমাত্রই অপর একজনের প্রতি মনের আর্তি? অপর একজনের সঙ্গে গভীর সংযোগের আবিষ্কার? না কি প্রেম এমন একধরনের মহাজাগতিক সংযোগ, যা আবিষ্কার করলে এই মহাজগতের এক ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো অস্তিত্ব হিসেবে অনুভব করা যায় নিজস্ব অবস্থানের মাহাত্ম্য। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, এই যে মাহাত্ম্য শব্দটি উচ্চারণ করলাম, তা কি নিজের অহংকে এক বিন্দু হলেও বাড়িয়ে দিল? না কি এই অনুভূতিমালা নিজেকে আরও ক্ষুদ্র এক অস্তিত্বেই পরিণত করল? এমন এক ক্ষুদ্র অস্তিত্ব, যা আসলে এক অখণ্ড অস্তিত্বের অংশ। নিজের খণ্ড অস্তিত্বকে অখণ্ড অস্তিত্বের মধ্যে প্রকাশিত হতে দেখাই মনে হয় এই জীবনের এক মহার্ঘ্য অনুভূতি। প্রেম, এই অনুভূতি দেয় আমাদের। যেমন দেয় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা, যেমন দেয় একাকী এই প্রকৃতির মধ্যে অবগাহন। কিন্তু কীভাবে? আমাদের চারপাশে শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা বা প্রেমের কবিতার সংকলন প্রচুর দেখতে পাই আমরা। অনেকের অনেক প্রেমের কবিতার সংকলন রয়েছে আবার রয়েছে কবিতার সংকলনের মধ্যে বহু প্রেমের কবিতা। সেই সব প্রেমের কবিতা কালজয়ী। কিন্তু এখানে একটা ছোট্ট অভিযাত্রা হতে আমাদের। তিনজন কবির মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ এবং বিনয় মজুমদার। তবে, আলোচনার প্রসঙ্গে যে অন্য কবিদের আমরা ছুঁয়ে যাব না, তাও নয়।

রবীন্দ্রনাথের কথাই যদি ধরি, তিনি প্রেম এবং পূজাকে একত্র করে দিয়েছিলেন। এই একই অনুভূতি আমরা বৈষ্ণব পদাবলীতে বা মীরার ভজনেও পাই, পাই সূরদাসের ভজনে বা কবীরের দোঁহায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রেম শুধুই ভগবৎ দর্শনের মধ্যে একাত্ম হওয়া নয়। রবীন্দ্রনাথের প্রেমের মধ্যে যে ‘তুমি’, সেই ‘তুমি’ আমারই তো এক অখণ্ড অংশ। রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর কবিতায় বা গানে এই তুমির মধ্যে সমগ্রের এক বিস্তার ঘটান, তখন সেই ‘তোমার’ মধ্যে নিজেকেও প্রসারিত হয়ে যেতে দেখি। এ প্রসঙ্গে ‘তুমি আমার সাধের সাধনা’ যখন রবীন্দ্রনাথ বলছেন ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ শীর্ষক গানে, তখনই বুঝতে অসুবিধা হয় না, কীভাবে, রবীন্দ্রনাথ প্রেমিকার সঙ্গে এক অদ্বৈত সম্পর্ক তৈরি করে নিচ্ছেন। কিন্তু এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, আমি তো তার জন্যই সাধনা করছি, যে ‘আমি’ নই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রেমে নিজেকে তার মধ্যে খুঁজে পাওয়ার বেদনা এবং চেতনাই মনে হয় সেই কবিতা, যা আমাদের প্রেমের এক বিস্তারিত আকাশের দিকে নিয়ে চলে গেল। এখানে এসে প্রশ্ন আসতেই পারে, তবে প্রেমের কবিতা মানেই আধ্যাত্মিক কবিতা? এখানে বলতে বাধ্যই হচ্ছি, আধ্যাত্মিকতা এবং ধার্মিক ভাবনার মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রেম অবশ্যই এক আধ্যাত্মিক সম্পর্ক, যে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক আমাদের শরীরকে সাধনার এক অংশ হিসেবেই ব্যবহার করে। ঠিক যেমন, এই শরীরটা আছে বলেই আমরা বেঁচে আছি, তেমনই, শরীর আছে বলেই প্রেমের প্রকাশ সম্ভব হচ্ছে। একটি অব্যক্ত অনুভূতি, ব্যক্ত হচ্ছে। এই অব্যক্ত অনুভূতির তো ব্যক্ত হয়ে ওঠার প্রয়োজন আছে বলেই জগতের সৃষ্টি এবং তার প্রকাশ। এই দেখুন, এই কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মনে পড়ে যেতে পারে জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত পংক্তি- ‘ আমরা যাইনি মরে আজো, তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়’। কিংবা মনে হতে পারে, জীবনানন্দ যে হাজার বছর ধরে পথে হেঁটে যাওয়ার কথা বলছেন, বলছেন, সব পাখি ঘরে ফেরে, সব নদী, আর তারপর থাকে পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। ভাবুন আকাশলীনা কবিতাটির কথাও, যেখানে জীবনানন্দ প্রায় তার্কোভস্কির দ্য স্যাক্রিফাইসের লং শটের মতো ‘আকাশের ওপারে আকাশ/ বাতাসের ওপারে বাতাস’-এর রচনা করেছেন। জীবনানন্দের প্রেম কি আধ্যাত্মিক নয়? অনেক গভীর ভাবে আধ্যাত্মিক, তা না হলে তিনি প্রায় উত্তরাধুনিক এক প্রশান্তিতে এমন এক দৃশ্যের ব্যঞ্জনা তৈরি করেছেন –“ এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে—জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা”। এই যে ‘-‘- এর ব্যবহারের মধ্য দিয়ে জীবনানন্দ এক অব্যক্তকে ব্যক্ত করলেন, তা আধ্যাত্মিকতার সংযোগ ছাড়া সম্ভব ছিল না।

তবে, আমরা মনে হয় এই জায়গা থেকে প্রেমের কবিতার দিকে তাকাতে পারি। সার্থক প্রেমের কবিতা কিংবা গান, আধ্যাত্মিক হতে বাধ্য। তা আধ্যাত্মিক, কারণ তা সময় স্থান কালের যে সীমাবদ্ধতা তা পেরিয়ে মানুষকে এবং মানুষের অনুভূতিমালাকে সংযুক্ত করে। প্রেম এক সংযোগ বলেই কি তাই বিনয় মজুমদার বারবার বলেছেন অঘ্রাণের অনুভূতিমালার কথা,যে অঘ্রাণ নিয়ে জীবনানন্দ লিখেছিলেন, “ লীন হয়ে গেলে তারা তখন তো মৃত/ মৃতেরা এ পৃথিবীতে ফেরে না কখনো/ মৃতেরা কোথাও নেই, আছে?/ কোনো কোনো অঘ্রাণের অন্ধকারে হেঁটে যাওয়া শান্ত মানুষের/ হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতেরা কোথাও নেই বলে মনে হয়”। এই অঘ্রাণ আমাদের কাছে বিষাদের বার্তা নিয়ে আসে। আর এই বিষাদকে রবীন্দ্রনাথ বলেন বড়ো দুঃখের আধার”। বড়ো দুঃখ এবং করুণ রাগিনী ছাড়া প্রেমের গভীরতম প্রদেশে আলো ফেলা যায় না। বিনয় মজুমদার তাঁর ‘ফিরে এসো চাকা’ কাব্যগ্রন্থে এই বিষাদ এবং করুণ রাগিনীকেই এবং এই সংযোগকেই আবিষ্কার করে গেছেন নিয়ত। “ আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমেষেই/ গলাধঃকরণ তাকে না করে ক্রমশ রস নিয়ে/ তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ফুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে”। আমরা এই কবিতা পড়তে পড়তে আশ্চর্য হই, কারণ বিনয় মজুমদারের কবিতা, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মতোই একে অপরের সঙ্গে সুরের হারমনি তৈরি করতে করতে উঠে যায় অর্থের চূড়ায়। বিনয় মজুমদার আসলে কাব্যের এই সংযোগের ভাষাটি তৈরি করে গেছেন নিপুণভাবে তাঁর প্রতিটি কবিতার মধ্য দিয়েই। গভীর এক আধ্যাত্মিকতার রচনা তিনি করেছেন। কিন্তু তাকে আধ্যাত্মিকতার কোনও চেনা ছকের মধ্যে ফেলা যাবে না। কারণ বিনয় এক প্রকৃত ভাস্করের মতো সেই বুনন রচনা করেছেন, যা এক অখণ্ড সমগ্র। প্রত্যেক মহৎ কবিই আসলে এই সংযোগের সাধনাই করে থাকেন। “ নিষ্পেশণে ক্রমে ক্রমে অঙ্গারের মতন সংযমে/ হীরকের জন্ম হয়, দ্যুতিময়, আত্মসমাহিত”। প্রেম আমাদের এই আত্মসমাহিত এক জায়গাতেই নিয়ে চলে যায়। যেখানে আমি আর আমি হয়ে থাকি না। নিজেকে তোমার মধ্যেই আবিষ্কার করি শুধু তাই নয়, তোমার মধ্য দিয়েই আমি নিজেকে দেখি। আর তুমি তো প্রকৃতিরই এক রূপ। আমিও প্রকৃতির এক রূপ। যখন তোমার মধ্য দিয়ে আমি এই প্রকৃতির দিকে তাকাই, তখন আমি নিজেকেও দেখতে পাই। আর ধীরে ধীরে আমি আলাদা ভাবে কাউকেই দেখতে পাই না। যেমন,প্রকৃতি কি পারে নিজের সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে? কিন্তু প্রকৃতিরও তো নিজেকে প্রকাশ করার ব্যাকুলতা আছে। আর তাই তো সে একটি ফুলের মধ্য দিয়ে, একটি সম্পর্কের মধ্য দিয়ে, একটি কবিতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে। তার নিজেকে প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজন হয় আধারের। আমাদের সমস্ত শিল্প সাধনা হল প্রকৃতি এবং প্রকৃতির নিজেকে প্রকাশের আধারের মধ্যে সংযোগসাধনটুকু তৈরি করা। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিনয় মজুমদার তাঁদের কাব্যে এই প্রেমের অরূপটুকুকেই নির্মাণ করে গেছেন।
0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in






বাংলা কবিতায় জীবনানন্দই প্রথম কবি, যিনি নারীর দিকে তাকিয়েছিলেন আধুনিক দৃষ্টিতে।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় নারী ঘোর রহস্যঘন, তার দেহরূপ, আর অলঙ্কারের বর্ণনার তলে চাপা পড়ে যায় তার মানস, আর রবিঠাকুরের গানগুলিকে যদি প্রেমের গান ধরি, তাহলে, রবীন্দ্র কবিতায় নারী তেমন নয়, যেমন তার জীবনে; রবীন্দ্র কবিতায় নারী এক কল্পলোকের জগতের আলোছায়া।
নজরুলের কবিতায়ও তাই, নজরুল একধাপ এগিয়ে। তার কবিতায় নারীকে করে তুলেছে দেবীতুল্য হিসাবে। মোটকথা, রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কবিতার নারী ইহজগতের কেউ নন। তারা ‘প্রিয়া’, ‘স্বপ্ন-সহচরী’, ‘প্রিয়তমা’; তাদের কোন নাম নাই, নামহীন এক দূরতম রূপের জগত তারা। নারী তাদের কবিতায়, অতিশয় পবিত্রও বটে! তারা ব্যথা দিলেও, হৃদয় ভাঙলেও, তাদের পদতলে পড়ে থাকাই যেন প্রাপ্তি, যেন তারা ঈশ্বরী, যেকোন মূল্যে তাদের খুশি করাই প্রেমিক তথা পুরুষের অভীষ্ট! রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের এহেন ‘নারীবাদ’ বঙ্গে যে নারীদর্শনের জন্ম দিয়েছে, সেখানে, নারীর প্রসঙ্গ এলে সকলেই অপার্থিব জগত থেকে নামিয়ে আনেন শব্দমালা, আর মালা গাঁথেন মহান কল্পলোকের রূপকথায়। তারপর, সেই দেবীটিকে পুজা করতে থাকেন।
জীবনানন্দ আমাদের কবিতায় তো বটেই, মননে-মস্তিষ্কেও, এ ভূখণ্ডের প্রথম পরিপূর্ণ আধুনিকতম পুরুষ। খেয়াল করুন, জীবনানন্দের দাম্পত্যের কথা, যা আমাদের আধুনিক দাম্পত্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়। জীবনানন্দ সেই যুগে বিয়ের কন্যাকে যেন বলি দেয়া হত।
সেই যুগে তিনি, কাদামাখা একটা শাড়িসমেত কলেজফেরত লাবণ্যকে একঝলক দেখে পছন্দ করেছিলেন, যাতে আশ্চর্য হয়েছিলেন স্বয়ং লাবণ্যও! যৌতুকও নেননি, সেইসময়, যৌতুক যখন গায়ে হলুদের মতই, বিয়ের কার্যবিধিরই অংশ। নারীর ব্যাপারে জীবনানন্দের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় তার দাম্পত্যজীবনের আরো খুঁটিনাটি ঘটনায় ।

জীবনানন্দ কবিতায় প্রথম, নারীকে তার দৈহিক রূপের জন্য যে পুজো দেয়া হয়েছে বিগত শতাব্দীতে, তাকে মনুষ্যসমাজ থেকে আলাদা করে যে কল্পলোকের দেবীর আসনে বসানো হয়েছে, সেই কল্পলোকটিকে ভেঙে দিয়ে, নারীকে নিয়ে আসেন মাটির পৃথিবীতে, মানুষের ভীড়ে। অধিকাংশ বাঙালি কবির দিস্তা দিস্তা কাগজ নষ্ট হয়েছে, কেবল, নারীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আর গয়নাগাটির জৌলুশের বর্ণনায়, তাদের নারীরা অনুভবনীয় না, হয়ে উঠেছেন দর্শনীয়, তাদের যা কিছু প্রশংসা করা হয়েছে, তা ওই সবেধন নীলমনি দেহটির কারণেই, তাদের মননের, মেধার, স্বভাবের কোন বিশ্লেষণ বা উপস্থাপন, সেসবের প্রতি আগ্রহ কারো হয় নাই। কিংবা তাদের ক্লেদ, পাপ; তাদের দেবীতুল্য দেহের ভেতরে যে মানুষ তার সহজাত স্খলনের কথা, কেউ বলে নাই। জীবনানন্দের নারীদর্শন আশ্চর্যরকম নির্মোহ। সেখানে নারীকে দেবী করার প্র‍য়াস নাই, তার কাছে নিজেকে জলাঞ্জলি দেয়ার প্রতীতি নাই, বিংশ শতকের নারীবাদে সায় নাই, নারীর প্রতি কুটিল বিদ্বেষেও মতি নাই-এক আশ্চর্য নিরপেক্ষতায় দাঁড়িয়ে পৃথিবীর নারীদের তিনি দেখেছেন বাস্তবজগতের একজন, ‘পুরুষ’ না, ‘মানুষ’ হিসেবে। আর তাই, ‘প্রিয়া’, ‘স্বপ্ন-সহচরী’, ‘প্রিয়তমা’ বা ‘দেবী’দের নয়, জীবনানন্দ ভালোবেসেছেন ‘মেয়েমানুষেরে’! ভালোবাসা জীবনের অতলান্তিক সমুদ্রে একবিন্দু জলের মত ঘটনা, প্রেয়সী আরো দশটা মেয়ের মতই মেয়েমানুষ। প্রেমিক তার পুজারী না। জীবনানন্দ অকপটে বলছেন, তিনি ঘৃনাও করেছেন ‘মেয়েমানুষেরে’! কারণ, তারা দেবী নন, তারা মর্ত্যের মানুষ, তারা বিংশ শতকের সমূহ বিনষ্টের চিৎকারকে ধারণ করে। জীবনানন্দ নারীকে আর কী কী বলে ডেকেছেন? ‘মানুষী’, নারীর জন্য মানুষের বিপরীতে এই আশ্চর্য শব্দ প্রথম তিনিই ব্যবহার করেছিলেন। জীবনানন্দের নারী ‘মানসী’ নয়, যার বাস মানসজগতের কল্পরাজ্যে, তার নারী এই মর্ত্যলোকের ‘মানুষী’।
জীবনানন্দের নারী ‘পুজা’ নেয় না। নারী রূপকথার দেশে না, মানুষের ভীড়েই হারিয়ে যায়! ‘তোমার শরীর,/তাই নিয়ে এসেছিলে একবার, তারপর মানুষের ভীড়/তোমারে নিয়াছে কবে টানি!’
জীবনানন্দ জানেন, ধ্রুব অমর প্রেম বলে বিংশ শতকের পৃথিবীতে কিছু নাই, বা, আসলে প্রেম কখনো ধ্রুব নয়, হয় না। প্রেমের ইতিহাসে বেদনাই বিজয়ী। ফলে জীবনানন্দ জানেন, ‘প্রেম শুধু একদিন এক রজনীর’! আর তাই, প্রেমিকার বিট্রেয়াল, তার চলে যাওয়াকে এক দার্শনিক মহিমায় বিশ্লেষণ করে, খুব সহজে গ্রহণ করেন তিনি, মাটির নারীর জন্য কাতর হন না, রবীন্দ্র -নজরুলের মত, এগুলোকে গ্রহণ করেন জীবনের সাবালক স্বাভাবিকতায়, বলেন-‘যেতে হবে বলে/তুমি গেছ চলে/সবাই চলিয়া যায়/সকলের যেতে হয় বলে!’ কেউই আসলে যায় না, যেতে হয়-এই সত্য আজ আমাদের সামনে কত পষ্ট !

রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের নারীপুজা আর কামনার অর্ঘ্যদানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, নারীর দেহরূপের পুজা। নারীর দেহখানা তাদের কবিতায় যত এসেছে, মন তত নয়, যেটুকুওবা এসেছে, তা খণ্ডিত। বিপরীতে দাঁড়িয়ে, জীবনানন্দই খুব শাদামাটাভাবে নারীকে বলেছিলেন, ‘সুদর্শনা, তুমি আজ মৃত।’ যে রূপের জন্য নারীর এত বন্দনা, সেই রূপকে তিনি ‘মৃত’ ঘোষণা করছেন। সুদর্শনাকে বলছেন ‘তোমার মতন এক মহিলা!’ রূপের বর্ণনা যে দেন নাই জীবনানন্দ, তা নয়। তা কেমন তার নারীর রূপ?

‘বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা’ দেহ, ‘কড়ির মতন শাদা মুখ’, হিম হাত, চোখে হিজল কাঠের রক্তিম চিতা, পাশাপাশি সেই আগুনের তলেই ‘শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার’, ‘করুণ শঙখের মত’ স্তন-এরকম প্রেমিকা এ পৃথিবী একবার পায় না শুধু, এ পৃথিবীর একজনই এরকম প্রেমিকার কথা ভাবতে পারেন, তিনি জীবনানন্দ। খেয়াল করার ব্যাপার, রবীন্দ্র-নজরুলের প্রেমিকাদের প্রতি লোকের মুগ্ধ হওয়ার মতন যদি কিছু থাকে, তা হলো তাদের দৈহিক রুপ, তাদের দেবীর মত মহিমা। অথচ জীবনানন্দের ‘নারী’-র প্রেমিকা নয়। তার রূপ রহস্যময়, এই বর্ণনা থেকে খুব সুদর্শন কোন নারীর ধারণা আমরা পাই না, কেবল অস্পষ্ট, রহস্যময় একটি নারী অস্তিত্বের ধারণা পাই।

বাঙলা কবিতার পাঠককে নারীর দেহপুজা থেকে কীভাবে তার মনের রহস্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন জীবনানন্দ, বাঙালি নারীদের কীভাবে গয়নাগাটি আর ফর্শা ফর্শা মুখশ্রী ছাড়াই অপরূপ করে তুলছেন জীবনানন্দ। তিনি মননশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন, টের পাওয়া যাচ্ছে কী? আশ্চর্য হলো, স্তনের মত সেন্সুয়াল অঙ্গটির উল্লেখ করেও জীবনানন্দ পাঠককে নারীর শরীরের প্রতি কামোন্মত্ত হতে দেন না, ‘করুণ শঙখের মত’ উপমার পরে, স্তন দুধে আর্দ্র হোক বা না হোক, বোধের অতলান্ত থেকে নারীদেহের প্রতি সস্তা ক্ষুধা জাগে না অন্তত। জীবনানন্দ স্তনের উপমায় ব্যবহার করেছেন আরো বিপন্ন বিস্ময়কর উপমা, ‘সেই জলমেয়েদের স্তন/ঠাণ্ডা, শাদা বরফের কুচির মতন!’ অশ্লীলতা-শ্লীলতার প্রশ্ন না, সেসব ভেবে কবিতা লেখা জীবনানন্দের ধাতে ছিলও না। কিন্তু নারীকে দেহের উর্ধ্বে এক মননশীল জায়গায় তুলে ধরতে তার এই প্রয়াস, বিমুগ্ধচিত্তে প্রশংসার্হ!

নারীকে জীবনানন্দ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। কাউকে মানুষ বানাতে গেলে, তাকে শয়তান বা জন্তুর বা ভোগ্যপণ্যের পর্যায় থেকে উঠিয়ে আনা যেমন জরুরি, তেমনি এঞ্জেল, হুর, দেবী বা ঈশ্বরীর জায়গা থেকে নামিয়ে আনাও জরুরি। সে কাজটিও করেছেন জীবনানন্দ। উপন্যাসে ও গল্পে তো করেছেনই, সেদিকে যাব না। পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়ানো সুন্দরীদের কানে জ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, মানুশের অর্জন, কবিতা-এসব অমূল্য জিনিষের কথা বলে যে লাভ নাই, ওনারা যে সেগুলো বোঝেন না, সেকথা তিনিই প্রথম বলেছেন। সুন্দরীদের তিনি বলেছেন ‘মূর্খ’, ‘সোনার পিত্তলমূর্তি’! অনেকে ভাবতে পারেন, প্রেমের ব্যর্থতা থেকে এই কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, জীবনানন্দ প্রেমিক হিসেবে এ যুগের অনেক রোমিওর চেয়ে সফল ছিলেন। কাজিনকে বিয়ে করা হিন্দুধর্মে নিষেধ, সেই বোনকে বদ্ধ ঘরে চুমু দিয়েছেন, তার সাথে ওরাল সেক্স করেছেন। তার সাহস ছিল বলতে হবে! এবং, একদিন নয়, অনেকদিন! ফলে, প্রেমে ব্যর্থতা তার থাকলেও, ‘প্রাপ্তি’ যে কিছু ছিল না, তা নয়! যাহোক, নারীকে তিনি ঘৃনাও করেছেন, সেকথাও আমরা তার ‘বোধ’ কবিতায় দেখি। ‘পরী নয়, মানুষও সে হয়নি এখনো’-নারী তার যোগ্য মর্যাদা পায়নি, ঠিক, তবে সে পরী নয়, আর পরী করা রাখলে যোগ্য মর্যাদা সে পাবেও না, একথা জীবনানন্দ ছাড়া কে বলতে পারতেন! নারীর ভেতরের পাপ, পতন, ক্লেদ, স্খলন, তার সৌন্দর্যের অনিত্যতা বারবার উঠে এসেছে তার লেখায়। নারীকে মানুষ হিশেবে পেতে হলে, আগে ‘পরী’র ধারণা ভাঙা জরুরি, এই বোধ জীবনানন্দের স্বোপার্জিত।
জীবনানন্দের কবিতায় নারীচরিত্রের মহত্তম প্রতিনিধি যিনি, বনলতা সেন, তিনিও রবিঠাকুরের পূর্বজন্মের প্রিয়ার মত ‘মুখে তার লোধ্ররেণু, লীলাপদ্ম হাতে/কর্ণমূলে কুন্দকলি কুরুবক মাথে’টাইপ সাজসজ্জায় অতিশয় নিমজ্জিত কোন নারী, কিংবা নজরুলের ‘তোমারে বন্দনা করি, স্বপ্ন-সহচরী/ লো আমার অনাগত প্রিয়া’-র মত দেবীটাইপ কেউ নন। জীবনানন্দ নাম ধরে ডেকেছেন, বনলতা সেন, ‘প্রিয়া’, ‘দেবী’, ‘প্রিয়তমা’, ‘আফ্রোদিতি’টাইপ কিছু বলেন নাই। এই যে নাম ধরে ডাকা, এর মধ্যে আছে নারীকে বাস্তবপৃথিবীর এক পুরুষ বা মানুশের চোখে দেখার ইঙ্গিত। ‘প্রিয়া’ বললে কেবল প্রেমের, অধিকারের সম্পর্ক তৈরি হয়, স্বাভাবিক মনুষ্যপরিচয় তৈরি হয় না। বনলতা সেনকে জীবনানন্দ সেই পরিচয় দিয়েছেন, যেকারণে, রবীন্দ্র-নজরুলের কবিতার প্রিয়াদের কেউ চেনে না, অথচ বনলতা আজ জীবনানন্দের চেয়েও বিখ্যাত! জীবনানন্দ তার কবিতায় প্রায় সব নারীকেই নাম ধরে ডেকেছেন-বনলতা, শ্যামলী, মৃণালিনী ঘোষাল, অরুনিমা স্যানাল- এই নামগুলো নারীকে যে বাস্তবতায় তুলে ধরেছেন ।

রবিঠাকুরের প্রেমিকার মত ভারী ভারী গয়নায় সাজিয়ে, তার নিজের চে ওই গয়নার বর্ণনায় দশলাইন বেশি খরচ করেন নাই, নজরুলের মত না-পাওয়ার বেদনায় ভক্তের মত পুজার ভেট হাতে পড়েও থাকেন নাই জীবনানন্দ। তিন প্যারার কবিতার একটিমাত্র প্যারায় রূপের বর্ণনা এসেছে, তাও মাত্র তিনটি অঙ্গের। গয়নাগাটির বালাই নাই। তাও সে কেমন রূপ? বনলতার চুল ইতিহাসের পাতায় ছড়িয়ে থাকা এক প্রাচীন নগরীর রাতের অন্ধকারের মত, মুখও ইতিহাসের পাতায় জেগে থাকা বিখ্যাত এক শহরের স্থাপত্যশৈলীর কথা মনে করিয়ে দেয়। বনলতার আর একটি মাত্র অঙ্গের বর্ণনা জীবনানন্দ দেন, চোখ। পাখির নীড়ের মত। এসব উপমায় খুব সুশ্রী কোন নারীর চেহারা ভাসে না। নারীকে সুশ্রী দেখানোই যেখানে কবিদের যাবতীয় উপমার আরাধ্য ছিল, জীবনানন্দ সেখানে, নারীর সৌন্দর্যকে উপস্থাপন করলেন ইতিহাসচেতনা আর বোধের সমান্তরালে! এর মাধ্যমে নারীও কি কোন মেসেজ পেতে পারে না? যারা তাদের দেহবন্দনায় মেতে তাদের চোখকে অন্ধ করে রেখেছে ইতিহাস, দর্শন, শিল্প, রাজনীতি-পৃথিবীর যাবতীয় মহৎ বিষয় থেকে, তাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নারীদের ইতিহাসের সমান্তরালে উপস্থাপন, এ যে তাদেরকে প্রচ্ছন্নভাবে ইতিহাসের উত্তরাধিকার গ্রহনের আহ্বান, ভাবতে খুব কি দোষ!

জীবনানন্দের কবিতা পড়ে অনেক মূর্খ নারীবাদী কিংবা টিপিকাল বাঙালি মূর্খতাপ্রিয় নারী কষ্ট পেতে পারেন। কিন্তু, ‘পরী নয়, মানুষও সে হয়নি এখনো’- বলে শিল্পসাহিত্যে নারীকে যে পূর্ণ মানবিক প্রতীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জীবনানন্দ, তাতে নারীর প্রতি পুরুষের গত শতাব্দীর মেকি দরদের স্বরুপ ধরা পড়ে গেছে, ধরা পড়ে গেছে পুঁজির যুগে নারীকে পণ্য বানানোর পেছনে এইসব শিল্পী-সাহিত্যিকদের বুদ্ধিবৃত্তিক মদদও! আর অন্যদিকে, সাহিত্যের নারী বাস্তবের নারীর কাছাকাছি যেতে পেরেছে। ফলে বলা যায়, আমাদের সাহিত্যে, রবীন্দ্র-নজরুলের প্রেমকাতরতামূলক পদ্যের বিপরীতে, জীবনানন্দের কবিতাই প্রেম ও নারী বিষয়ক সবচেয়ে বাস্তব ও মানবিক কবিতা।
0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in






কবিতায় জাদুবাস্তবতা এবং কবিতায় তার অবস্থান প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই কবিতা কি এবং কবিতা কাকে বলে তার ওপর আলোচনা করতে হয় ।
কবিতার ইংরেজি শব্দ poetry যা প্রাচীন গ্রীক শব্দ ποιεω ,Poetry শব্দটি Greek শব্দ poiesis থেকে এসেছে যার অর্থ হলো নির্মাণ বা তৈরি, যা শিল্পের একটি শাখা, এই শাখায় ভাষায় নান্দিক কবিতা মানুষের ভাষার বিশেষ কলা, যা সাধারণ গদ্যরীতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
প্রকৃতপক্ষে, কবিতার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া বড়ই কঠিন ! বিশ্বসাহিত্যে খ্যাতিমান কবিরা বিভিন্নভাবে একে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন ‘ প্রগাঢ় আবেগগুলোর স্বত:ফুর্ত উচ্ছ্বাস’ তাঁর মতে, কবিতা সব জ্ঞানের মূল্যবোধ, সৌন্দর্যের প্রকাশ। নিভৃতচারী নারী কবি এমিলি ডিকিনসন বলেন,'যদি আমি একটি বই পড়ি তবে তা আমার ঠান্ডা শরীর উষ্ণতায় ভরে উঠে, আমি জানি ওইটাই কবিতা ' ডিলান টমাস কবিতার সংজ্ঞা দেন এভাবে;'কবিতা, যা আমাকে হাসায় কিংবা কাঁদায় অথবা হাই তোলায়, যা পায়ের আঙুলের নখ শিহরিত হয়, যা আমার দিয়ে এটা কিংবা ওটা কিংবা কিছু করাতে চায়।' খ্যাতিমান ইংরেজ কবি কোলেরিজের মতে , শ্রেষ্ঠতম বিন্যাসের শব্দগুলোর বিন্যাসই কবিতা। কবিতায় মূল্যবোধ,সৌন্দর্য প্রকাশ করতে গেলে কবিতায় তন্ময়তা, সঙ্গীতের মন্ময়তা এবং একটা বাণী। তাছাড়া ছন্দময়তা তো অবশ্য থাকতে হবে।
ইংলিশ রেঁনেসার প্রাক্কালে জন মিলটন, ক্রিস্ট্রোফার মার্লো, শেক্সপিয়ার প্রমুখ কবিরা যে সমস্ত কাব্যিক নাটক রচনা করেন, যা চিরকালীন । ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক কালপর্বে গেটের “ফস্ট”,কোলেরিজের “ কুবলাই খান” এবং জন কিটসের
"Ode on a Grecian Urn." কাব্য অন্তরঙ্গ অনুষঙ্গে কাব্যানুরাগী মানুষকে বিমোহিত করে। জন কিটস বলেছেন ,"Beauty is truth. Truth, beauty.
That is all ye know on Earth and all ye need to know."
'সৌন্দর্য হচ্ছে সত্য, সত্য হচ্ছে সৌন্দর্য পৃথিবীতে তোমরা এ সব জান আর তোমাদের এ সব জানার প্রয়োজন।"
সত্য আর সৌন্দর্যের বহি:প্রকাশই কবিতা এটাই প্রকাশ পেয়েছে জন কিটসেই এই কবিতায় । কবিতা সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল। এবার আমাদের আলোচ্য বিষয় কবিতায় জাদুবাস্তবতা। আমরা দেখার চেষ্টা করবো জাদুবাস্তবতা আসলে কী?
জাদুবাস্তবতা হলো সাহিত্যের একটি ফর্মেট, নমুনা বা গঠন। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ম্যাজিক রিয়ালিজম। বর্তমান বিশ্বসাহিত্যের গল্প এবং উপন্যাসে যার প্রভাব লক্ষণীয় হলেও মূলত ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যিকরা একে বেড়ে উঠতে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তারা এটি করেছে ইংরেজি সাহিত্য হতে নিজেদের আলাদা করতে। যা মূলত তাদের সাহিত্যের একটি আন্দোলন।
বিশ্বসাহিত্যে জাদুবাস্তবতার ব্যবহারে মার্কেজকে বলা যায় ’দ্যা ফাদার অফ ম্যাজিক রিয়ালিজম’। কেননা তিনি
তার গল্প এবং উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার যে ব্যবহার করেছেন তার ফলেই বিশ্বসাহিত্য তাকে সাদরে গ্রহণ করেছে।এছাড়া ইসাবেল এবং কার্পেন্তিয়ারও ছিলেন এ বিষয়ে সিদ্ধহস্ত। তবে জাদুবাস্তবতার ধারণাটির জন্মদাতা কোনো ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যিক নয়। জার্মান চিত্রকলা বিষয়ক সমালোচক ফ্রাঞ্জ রোহ তার নবীন ইউরোপীয় চিত্রকলা বিষয়ক বইটিতে প্রথম জাদুবাস্তবতা শব্দের বিষয়বস্তু তুলে ধরেন। চিত্রকলায় যা ব্যবহার হত। পাঠকগণদের নিকট উদাহরণস্বরূপে বলা যায়, পাঠকগণ মোনালিসার হাসির সঠিক ব্যাখ্যা এ পর্যন্ত বিভিন্ন বিশারদগণ বিভিন্ন অর্থে বলেছে। যাকে জাদুবাস্তবতা বলা চলে।
জাদুবাস্তবতা সাহিত্যে প্রথম ব্যবহার করা হয় ১৯৫৫ সালে এঞ্জেল ফোর্স নামে স্পেনীশ উপন্যাসে। পরবর্তী সময়ে মার্কেজ, ইসাবেল, কার্পেন্তিয়ারা একে বিশ্বসভার আসরে স্থান করে নিতে সাহায্য করেন তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে। যদি আমরা ১৭ শতক বা আঠার শতকের বিশ্বসাহিত্য নিয়ে কথা বলি, তাহলে দেখা যায়- ১৭২৬ সালে প্রকাশ হওয়া জনাথন সুইফটের উপন্যাস ‘গালিভার ট্রাভেলস’ এবং ১৮৪২ সালে প্রকাশিত হওয়া নিকোলাস গোগল এর উপন্যাস ‘নোজ’ এ জাদুবাস্তবতার ব্যবহার ছিল। কিন্তু তখন এর কোনো ধারণা ছিল না। এর ধারা প্রমাণ হয় যে, জাদুবাস্তবতা কোনো মৌলিক বিষয় নয়। লেখকের কল্পনা শক্তিই মূলত তার প্রকৃতরূপ। এছাড়া ওই সময়ের পরে ডিকেন্স, বালজাক আর কালভিনোর উপন্যাসেও জাদুবাস্তবতার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
এরই ধারাবাহিকতায় কবিতায় জাদুবাস্তবতা ব্যবহারের চেষ্টা করছেন সাহিত্যিকরা। কিন্তু যা করা হচ্ছে তা কী জাদুবাস্তবতা হচ্ছে নাকি তা বিচার সাপেক্ষ? কেননা কোনো অবাস্তব ঘটনার অবতারণা, পৌরাণিক কাহিনি বা মিথ ইত্যাদি বিষয়কে জাদুবাস্তবতা বলা যায় না। জাদুবাস্তবতা সেটা যা বাস্তবতাকে বিশেষ কিছু শক্তিমত্তায় বা অলৌকিক রূপে প্রকাশ করা হবে। যাতে বাস্তবতার সাথে অদ্ভুত বা বিস্ময়কর কোনো বিষয়ের সংমিশ্রণ ঘটানো হয়। এই জাদুবাস্তবতা মূলত গড়ে ওঠে কাহিনিকে কেন্দ্র করে। যার জন্য গল্প বা উপন্যাসে এর প্রয়োগ হয়ে থাকে কবিতায়ও এটি ব্যবহার করা যায়। তবে তা সবার দ্বারা সম্ভব নয়। কেননা অদ্ভুত কোনো বিষয়ের অবতারণা করলেই সেটা জাদু বাস্তবতা হয় না। আর কবিতা তো কাহিনি নির্ভর না।বাংলা সাহিত্যে কেউ কেউ এটা ব্যবহার করতে গিয়ে এমন কিছু লিখে যে তাতে কবিতার কোনো মৌলক বিষয় বা মূলভাব থাকছে না। কবিতার যদি মূলভাবনাই না থাকে তাহলে ওই লেখার কি কোন মূল্য আছে? আমাদের মনে রাখা উচিত যে কবিতায় তার বিষয়বস্তু গুরুত্বপূর্ণ।
পাঠক কবিতার মাঝে একটি রহস্য খুঁজে পায় বা ঘোরের মাঝে আবর্তিত হয়, কীভাবে এটি সম্ভব? ঠিক এই বিষয়টিরই নাম দেয়া হয়েছে জাদুবাস্তবতা বা ম্যাজিক রিয়ালিজম। অর্থাৎ কবিতার রহস্যতাকেই কবিতায় জাদুবাস্তবতা বলা চলে।
জাদুবাস্তবতার আগে সাহিত্যে পরাবাস্তবতার অবতারণা করেছেন সাহিত্যিকরা। পরাবাস্তবতা হচ্ছে এমন এক ধরনের বাস্তবতা যার সঙ্গে চাক্ষুষ বাস্তবতার কোন মিল নেই। ইংরেজীতে সুররিয়েলিজম (surrealism) বলা হয়। বস্তুত চেতনার মূল ভিত্তি হলো অযুক্তি ও অবচেতন। ফ্রয়েডীয় মনস্তাত্ত্বিক ধারণা মিলানো যায় এখানে। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের ভাবনা- মানুষ অবচেতন মনে অনেক কিছুই করে বা ভাবে। তিনি বলেন- এ ভাবনা চেতন মনের চেয়ে অবচেতন মনেরই বেশি। পরাবাস্তবতা হচ্ছে মানুষের চেতনটা যখন শিথিল হয় তখন মানব মনে অবচেতন প্রভাব ফেলে। এটি হচ্ছে- কবির প্রতীক ও চিত্রকল্পসমূহের মধ্যে যোগসূত্র। মূলত সুইজারল্যান্ড থেকে উঠে আসা ‘ডাডাইজম’ এর পরবর্তী আন্দোলন হচ্ছে ‘সুররিয়েলিজম’ বা ‘পরাবাস্ততা’। এখন আবার তাকে জাদুবাস্তবতা বলছেন অনেকে। জাদুবাস্তবতাবাদ এবং পরাবাস্তবতাবাদ উভয়ই ১৯২০ সালের দিকে তাত্ত্বিক রূপ পায়। এবং প্রায় সমসাময়িক সময়েই এদের ইশতেহার রচিত হয়। সে সময়টা ১৯২৫ সালের দিকে ফ্রাঞ্জ রোহ জাদুবাস্তবতাবাদ এবং এর কিছুদিন আগেই আন্দ্রে ব্রেতঁ প্রকাশ করেন পরাবাস্তববাদের ইশতেহার। এখন যাকে জাদুবাস্তবতা বলছেন অনেকে।
মার্ক আর্নেস্টের সংজ্ঞা আমরা তুলে ধরতে পারি। সুররিয়েলিজমকে তিনি বলেছেন সুররিয়ালিস্টের লক্ষ্য হচ্ছে অবচেতনার বাস্তব চিত্র আঁকা নয় কিংবা অবচেতনার বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে কল্পনার আলাদা এলাকা সৃষ্টি করাও নয়। এর লক্ষ্য হলো চেতন ও অবচেতন মনের সাথে বাইরের জগতের সব দৈহিক ও মনের বেড়া তুলে দেয়া। এই পরিপ্রেক্ষিত, আসলে পরাবাস্তবতাই জাদুবাস্তবতা। একারণে আমরা পরাবাস্তবতার কবিতাগুলোর। আলোকপাত করতে পারি।
ইতালিতে জন্মগ্রহণ করা ফ্রেঞ্চ আপোলিনিয়ার (১৮৮০-১৯১৮) সুররিয়েলিজম’ শব্দটি উল্লেখ করেন। তাঁর লেখা কবিতায় আদি-সুররিয়েলিজম কাব্যের নিদর্শন রয়েছে। ‘টাইরেসিয়াম-এর 'স্তন’ নাটকে প্রথম সুররিয়েলিজম প্রয়োগ করেন তিনি। পরে তা ইংরেজী ও জার্মান সাহিত্যেও এ ধারা সম্প্রসারণ হয়। ‘চাঁদের আলো’ কবিতায় তিনি পরাবাস্তবতাকে শিল্পরূপ দিয়েছেন এভাবে-
‘ক্রোধীর ঠোঁটে শ্রবণসুখকর চাঁদ
আর রাতের লোভার্ত নগর ও উদ্যান
মৌমাছির মতো নক্ষত্রদের ভ্রম হয়
এই আলোকময় মধুতে আঙুরবাগান আহত
আকাশ থেকে ঝরছে মধুর মধু
চাঁদের রশ্মি যেন মধুর ঝিকিমিকি
.হাওয়ায় গোলাপে মিশছে মধুর চন্দ্রিমা।’
বাঙলা সাহিত্যে অনেকে পরাবাস্তবতা, যা জাদুবাস্তবতার বেশ কিছু প্রয়োগ করেছেন। বর্তমানকালের প্রায় সব কবিই পরাবাস্তবতার প্রয়োগ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বা কাজী নজরুল কবিতা ও গানে সামান্য পরাবাস্তবতার উপাদান ব্যবহার করেছেন। যেমন ‘আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই, সেই পাহাড়ের ঝরনা আমি...।’ বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, শক্তি চট্টপাধ্যায়, সুনীল, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, মান্নান সৈয়দ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ কবিতায় পরাবাস্তবতা এনেছেন মাঝে মধ্যে।
আধুনিক বাংলা কবিতায় কবি বিষ্ণু দে তাঁর ‘ঊর্বশী ও আর্টেমিস’ কাব্যগ্রন্থে প্রথম সার্থক সুররিয়েলিজম বা পরাবাস্তবতার প্রয়োগ করেন। তবে পরাবাস্তবতার উপাদান সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। তাঁর ‘ঝরাপালক’, ‘বনলতা সেন’, ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ কাব্যগ্রন্থে পরাবাস্তবতার ব্যবহার অনেক বেশি। তাঁকে ‘পরাবাস্তবতার কবি’ বলা হয়ে থাকে। পরাবাস্তবতার সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়ে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে তিনি জনপ্রিয় হয়েছেন পরাবাস্তবতার কয়েকটি উদাহরণ দিতে পারি নিচের কবিতায়।
‘জানতাম তোমার চোখে একদা জারুলের বন
ফেলেছে সম্পন্ন ছায়া, রাত্রির নদীর মতো শাড়ি
শরীরের চরে অন্ধকারে জাগিয়েছে অপরূপ’- (কোন এক পরিচিতাকে, শামসুর রাহমান)
‘অনেক আকাশ’ কবিতায় সৈয়দ আলী আহসান ধরা দিয়েছেন এভাবে-
‘... সোনার ঘাসের পাতা ঘুমের মতো
অজস্র পাতার ফাঁকে হৃদয়ের নদী হয় চাঁদ নেমে ঘাসে’- -------
আল মাহমুদ বেশ কয়েক জায়গায় পরাবাস্তবতার উপাদান ব্যবহার করেছেন। ‘নদীর ভেতরে নদী’ কবিতায় পরাবাস্তবতার একটু প্রয়োগ দেখি-
‘নদীর ভেতরে যেন উচ্চ এক নদী --------।
তিতাসের স্বচ্ছ জলে প্রক্ষালনে নেমেছে তিতাসই।
নিজের শাপলা লয়ে নেমে নদী নদীর ভেতরে
ঠাট্টা বা বিদ্রুপ নেই, শ্যেনচক্ষু, নেই চারণের বালি।’
মান্নান সৈয়দ বলতেন- সুররিয়েলিজমই হলো প্রকৃত বাস্তবতা। তিনিও কবিতায় সার্থক পরাবাস্তবতার প্রয়োগ করেছেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ ’(১৯৬৭)। এখানে সুররিয়েলিজমের সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। তিনি জীবনান্দ দাশ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা লিখেছেন এবং গবেষণা করেছেন। আর এ কারণে জীবনান্দের প্রভাব কবির মনে। আরো কয়েকটি কবিতায়।যেমনঃ
১) ‘দেখেছি ঘাসের মেঝে ছিন্ন
লাল মুন্ডু নিয়ে খেলে বিনা অপব্যয়ে
সূর্য টেনে নিয়ে যাচ্ছে কালো রেলগাড়ি।’ (কবিতা, রাত্রপাত)
২) ‘জ্যোৎসনা হয় জল্লাদের ডিমের মতো জলহীন মুন্ডু
জোড়া-জোড়া চোখ
সাতটি আঙুলের ও একমুষ্টি হাত
রক্তকবরীর অন্ধকার
এবং একগুচ্ছ ভুল শিয়ালের সদ্যোমৃত যুবতীকে ঘিরে জ্বলজ্বলে চিৎকার’- ( জ্যোৎসনা কবিতায়)
৩) ‘একেকটি দিন একেকটি সবুজভুক সিংহ’ কবিতায়-
‘পরিবর্তনের ছাদ বিড়ালের মতো
অন্যমনস্ক হওয়ার সুযোগে পা টিপে-টিপে এগোল
বরফের মানুষ নাজেহাল ছোটো-ছোটো নুড়ির আওয়াজ ---- কবি জীবনানন্দ দাশের কয়েকটি কবিতার কিছু চরণ তুলে ধরলে তাঁর কবিতায় আমরা দেখতে পাই তিনি জাদুবাস্তবতার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত। লক্ষ করুন------ তিনি পাঞ্জাবির পকেটে চাঁদের উঁকি দেয়া দেখতে পান-
‘দেখি তাঁর চুলে রাত্রি থেমে আছে
চোখে সবুজ প্রিজমের ভেতর থেকে লাফিয়ে পড়ে ফড়িং
... বেরিয়ে আসছে সান্ধ্যবেলার সবগুলো তারা
দেখি তার পাঞ্জাবির ঢোল পকেটে উঁকি দিচ্ছে চাঁদ।’
‘বনলতা সেন’ কবিতাগ্রন্থের ‘তুমি’ কবিতায় রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ কবিতা সম্বন্ধে যা বলেন তার মধ্যে কবিতার সংজ্ঞা অবশ্যই নিহিত আছে। ’
জীবনান্দ দাশ তাঁর বিপুল কবিতাসম্ভারে প্রেম ,প্রকৃতি রোমান্টসিজিমরে নিবিড় সমারোহ ! জাদুবাস্তবতাবাদ নামটি সাহিত্যতত্ত্বে বিংশ শতকীয় সংযোজন হলেও সাহিত্যে এর ব্যবহার বহুপ্রাচীন। ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’ প্রভৃতি প্রাচীন মহাকাব্যগুলোকেও জাদুবাস্তবতার আলোকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। অনেক সাহিত্য সমালোচক বলেন---- জাদুবাস্তবতাবাদের সাথে অনেকের পরাবাস্তবতাবাদকে (Surrealism) মিলিয়ে ফেলেন, যদিও দু’টি ধারণায় খুবই কাছাকাছি, কিন্তু এক নয়। বলা যেতে পারে একটি গাছের দু’টি শাখা, জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় দু’টি ব্যাপারকেই খুব দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেছেন । জীবনানন্দ অন্যান্য কবিতায় পরাবাস্তবতা ও জাদুবাস্তবতার অনেক অনেক উদাহরণ যথাস্থানে দেবো। আগেই বলা হয়েছে,কবিতায় জাদুবাস্তবতা সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে জাদুবাস্তবতা কাকে বলে। সত্যি কথা বলতে জাদুবাস্তবতার সংজ্ঞা দেওয়া বড়ই কঠিন। আমরা তুলে ধরবো বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য সমালোচকের উক্তি। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য সমালোচকরা জাদুবাস্তবতা বা Magical realism নানা সংজ্ঞা প্রদান করেছেন নানা ভাবে।
বিশ্বসাহিত্যের গল্প,উপন্যাস ও কবিতায় খ্যাতনামা লেখকদের রচনায়রিয়ালিজম, ক্রিটিক্যাল রিয়ালিজম, সোস্যালিস্ট রিয়ালিজম, সুররিয়ালিজম, স্ট্রাকচারালিজম, পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম, মডার্নিজম, পোস্টমডার্নিজম, পোস্ট কলোনিয়ালিজম, ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তবতা অনুষঙ্গ আমরা লক্ষ্য করি। আমাদের আলোচ্য বিষয় কবিতায় জাদুবাস্তবতা। জাদুবাস্তবতাকে তুলে ধরার শৈল্পিক রীতি হল জাদুবাস্তবতাবাদ। কবিতায় জাদুবাস্তবতা সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে আমাদেরকে জাদুবাস্তবতাবাদের বৈশিষ্টগুলোর উপর নজর দিতে হয়। স্বপ্ন ও কল্পনার মিশেলে অতিপ্রাকৃত, অলৌকিকত্ব, কল্প কাহিনী, রহস্যময়তা ইত্যাদি জাদুবাস্তবতাবাদে দেখা যায়।
সমকালীন বিশিষ্ট ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও সমালোচক-গবেষক ডেভিড লজের মতে, ‘নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্যে বাস্তবতা লক্ষণীয় হলেও অনেক সময় ঘটনার বাস্তব অনুষঙ্গের ভেতরে চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর ঘটনাও ঘটে তখন তাকে জাদুবাস্তবতাবাদ আখ্যায়িত করা হয়,যার বিশেষ সংশিষ্টতা আছে লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের লেখায়, এসম্বন্ধে আগেই আভাস দেওয়া হয়েছে। যদিও এর দেখা পাওয়া যায় অন্যান্য মহাদেশের লেখকদের গল্প-উপন্যাসে, যাঁদের মধ্যে আছেন গুন্টার গ্রাস, সালমান রুশদি এবং মিলান কুন্দেরা। এই লেখকদের প্রত্যেকেই নানান ঐতিহাসিক ঘটনার সহিংস আলোড়ন এবং ব্যক্তিগত জীবনেও নানান উত্থান-পতনের তীব্র সংক্ষোভের ভেতর দিয়ে গিয়েছেন, তাঁদের সেই অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে প্রকাশের জন্য বাস্তববাদ যথেষ্ট ধারণক্ষম নয় বলেই তাঁরা মনে করেছেন। Lodge,1992:114)
লজ আরো মনে করেন, ‘অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিমাণ ব্রিটিশ লেখকের মধ্যে এর প্রভাব রয়েছে এবং বাইরে থেকে এর আগমন ঘটলেও কয়েকজন একে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেছেন; তাঁদের মধ্যে আছেন ফে ওয়েল্ডন, অ্যাঞ্জেলা কার্টার এবং জেনেটি উইন্টারসন। Lodge,1992:114) জাদুবাস্তবতাবাদ দৃষ্টান্ত হিসেবে মিলান কুন্দেরার ‘দ্যা বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’র একটা অংশ উপস্থাপন করেন। আমরা সেই অংশটিতে দেখি একদল নৃত্যরত মানুষ নাচতে নাচতে মাটি থেকে হাওয়ায় ভাসতে থাকে এবং ভাসতে ভাসতে আকাশে উড়ে যায়। জাদুবাস্তবতাবাদ একদিক থেকে মূলত এমন একটি রচনারীতি ও প্রকাশভঙ্গি যাতে অনেক বিষয়কে নতুন করে বর্ণনা করা হচ্ছে। এই রীতিটিকে প্রায়শই মিশিয়ে ফেলা হয় অতিপ্রাকৃত, উদ্ভট, আজগুবি ঘটনার সঙ্গে।
জাদুবাস্তবতার কথা আলোচনা করতে ডেভিড লজ যে প্রধান চারজন লেখক নাম উল্লেখ করেছেন তারা হচ্ছে: গাবরিয়াল গার্সিয়া মার্কেস গ্যুন্টার গ্রাস , , মিলান কুন্দেরা এবং সালমান রুশদি । জাপানের হারুকি মুরাকামিএর ’দ্য উইন্ড- আপ বার্ড ক্রেনিকেল ’ , রাশিয়ান লেখক মিখাইল বুলগাকভের ‘ দ্য মাস্টার এন্ড মারগারিটা’,চিলির ইসাবেলা আলেন্দের ‘ দ্য হাউস অফ দি স্পিরিট, আমেরিকান- আফ্রিকান লেখিকা টনি মরিশনের ‘ বিলাভেড’ এ magical realism বা.জাদুবাস্তবতা পুরোমাত্রায় বর্তমান।
উপন্যাসে জাদুবাস্তবতাবাদের পুরোধা গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সম্বন্ধে না বললে সাহিত্যে জাদুবাস্তবতা সম্বন্ধে সম্যক জানা সম্ভব নয়। মূর্তিমান কলোম্বিয়ান লেখক গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ৮৭ বছর বয়সে মারা যান, কিন্তু তিনি তাঁর উপন্যাসগুলোতে উজ্জ্বল ভাবে আবিষ্কার করে গেছেন জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গে। তাঁর মাস্টারপিস‘ ওয়ান হান্ডের্ড ইয়ারস অফ সোলিচিউড ’ ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়, যার জন্য ১৯৮২ সালে নোবেল প্রাইজ লাভ করেন। তিনি নোবেল ভাষণে বলেন যে তিনি চেষ্টা করেছিলেন কেন জাদুবাস্তবতা লাতিন আমেরিকায় এতটা চমৎকার। তিনি বলেন,“ কবি ও ভিক্ষুক, সঙ্গীত শিল্পী ও ভবিষ্যত দ্রষ্ট্রা , যোদ্ধা ও বদমায়েস এবং সব প্রাণীর মাঝে উদ্দাম বাস্তবতা আছে,আমরা তার মাঝে সামান্য কল্পনার মেলবন্ধন ঘটিয়েছি-----’
জাদুবাস্তবতা প্রসঙ্গে আরো বলা যায়, জাদুবাস্তবতা একটা অনুষঙ্গ যাতে অপ্রাকৃত উপাদানের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। প্রথম কালপর্বে কবি সাহিত্য ও চিত্রকরা সাহিত্য ও চিত্রকলায় শুধুমাত্র বাস্তববাদিকতাকে তুলে ধরতেন। সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশ শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশ শতকে ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকজন লেখকের লেখায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গের উপস্থিতি বিশেষ ভাবে উঠে আসে। Magical realism শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় ফ্রাৎস রো(১৮৯০- ১৯৫৫) নামে একজন কলা সমালেচকের বইয়ে ১৯২৫ সালে। এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রের লক্ষ্য ছিল দৈনন্দিন জীবনের রহস্যজনক উপাদানগুলোকে মেলে ধরা। রো যদিও সাহিত্যের রচনা শৈলিতে Magical realism হিসাবে বলে মনে করেননি। তাঁর মতে এই শব্দটির ব্যবহারিক ভিত্তি ছিল রোজকার জীবনের চমকের সামনে মানুষের বিস্ময়েরই অভিব্যক্তি।
আমেরিকার প্রখ্যাত মহিলা কবি এমিলি ডিকিনসন( ১৮৩০- ১৮৮৬) কাব্য প্রতিভার কথা উপেক্ষিত থেকে গেছে। উনিশ শতকের এমিলির কবি জীবনের কালপর্বে বিশ্ব সাহিত্যের গদ্য ও পদ্যে জাদুবাস্তবতার কথা না উঠলেও কবি এমিলি ডিকিনসন তাঁর লেখা কবিতায় পরবর্তীকাল পর্বে সাহিত্য সমালোচকরা জাদুবাস্তবতা এর অনুষঙ্গ লক্ষ করেন। উনিশ শতকের উত্তর আমেরিকার প্রখ্যাত কবিদের মধ্যে অন্যতম মহিলা কবি এমিলি ডিকিনসন এর কাব্য প্রতিভার ওপর আলোকপাত করা যেতে পারে। এমিলি ডিকিনসন উত্তর আমেরিকার বিখ্যাত কবি, তাঁর জীবিতকালে ২০০০ এর অধিক কবিতা রচনা করলেও বেঁচে থাকাকালে তাঁর কবিতা তেমন প্রকাশিত হয় না।
এমিলি ডিকিনসনের কবিতাগুলো বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। তাঁর লেখা কবিতার অর্থ তাৎপর্যপূর্ণ এবং জাদুবাস্তবতায় বর্ণনামূলক কাব্যিক অনুষঙ্গে ভরপূর । তাঁর লেখা কবিতায় ধ্যানমগ্নতা, বিশ্বজনীনতা, প্রেম ভালবাসা ও প্রকৃতি বন্দনায় ঋদ্ধ। এমিলি ডিকিনসনের কাব্যপ্রতিভার স্বাক্ষর ছড়িয়ে আছে তাঁর অসংখ্য কবিতায় জাদুবাস্তবতা বা magical realism অনুষঙ্গে , যদিও গল্প উপন্যাসে জাদুবস্তবতা বা উপস্থিতি বিশ শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশ শতকে ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকজন গদ্য লেখকের লেখায় জাদুবাস্তবতার শব্দটির কথা শোনা যায়। পদ্য গদ্য না হলেও কোন কবির কবিতায় কাব্যিক অনুষঙ্গ সাথে সাথে তা বর্ণনামূলক যে হতে পারে, তা এমিলি ডিকিনসনের কবিতায় উঠে এসেছে। তাঁর অনেক কবিতায় magical realism বা জাদুবাস্তবতার উপস্থাপিত হয়েছে গদ্যের আঙ্গিকে। প্রসঙ্গক্রমে তাঁর সে ধরনের কবিতার দুটো স্তবক উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা যেতে পারে ।
THE CHARIOT.|
Because I could not stop for Death,
He kindly stopped for me;
The carriage held but just ourselves
And Immortality.
We slowly drove, he knew no haste,
And I had put away
My labor, and my leisure too,
For his civility.
My labor, and my leisure too,
For his civility
রথ
কারণ আমি মৃত্যুর জন্য থামতে পারলাম না,
সে আমার জন্য অনুগ্রহ করে থামল;
রথটি ছিল ঠিক আমাদের আর অমরত্বের কাছাকাছি।
আমরা ধীরে ধীরে চালিত হলাম, সে জানতো কোন তাড়াহুড়ো নেই,
আর আমি দূরে ছিলাম
আমার পরিশ্রম, আর আমার অবসরও,
তার সৌজনের জন্য। (প্রাবন্ধিকের অনুবাদ)
মূলত এক নজরে একে সহজ বলে মনে হতে পারে। মানুষ প্রায়ই ভুলে যায় বর্ণনার কথা যার মাঝে কবিতার অর্ন্তনিহিত ভাব উপস্থিত থাকে। সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখলে অনুধাবন করা যাবে এমিলি ডিকিনসন সময় নিয়েছিলেন একটা গল্প সৃষ্টিতে তাঁর THE CHARIOT কবিতায় । সম্ভবত এমনটা লেখায় এমিলি ডিকিনসনের ছিল একটা সুনির্দিষ্ট সাঙ্কেতিক উদ্দেশ । এই কবিতাটিতে তিনি সধমরপ ৎবধষরংস বা জাদুবাস্তবতার উপস্থাপন করেছেন সজ্ঞানে। আর একটি কবিতায় এমিলি ডিকিনশন কিভাবে magic realism বা জাদুবাস্তবতাকে উপস্থাপন করেছেন তা তাঁর magic realism কবিতায় দেখা যেতে পারে। আমরা এই কবিতার প্রথমাংশ এখানে উদ্ধৃত করে magic realism এর উপস্থিতি লক্ষ করার চেষ্টা করব।
PLAYMATES
God permits industrious angels
Afternoons to industrious.
I met one, -- forgot my school-mates,
All, for him, straightway.
God calls home the angels promptly
At the setting sun;
I missed mine. How dreary marbles,
After playing Crown!
ঈশ্বর অনুমতি দেন পরিশ্রমী দেবদূতদেরকে
বিকালগুলোতে পরিশ্রমী খেলা খেলতে।
আমি একজনের সঙ্গে মিলিত হলাম-ভুলে গেলাম আমার স্কুলের সহপাঠীদের,
সবাই, তার জন্য সোজাসুজি এল।
ঈশ্বর দেবদূতদেরকে দ্রুত
সূর্য অস্তমিত হবার সময় ফিরে আসার জন্য ডাকলেন;
আমি নিজেকে হারালাম। বিষণœ মার্বেলগুলো,
খেলায় বিজয়মুকুট লাভের পর। ( প্রাবন্ধিকের অনুবাদ)
আপনি দেখতে পাবেন এই কবিতাটিতে একটি শিশু, (যে হতে পারে একটা ছোট্ট মেয়ে) যার মুখ দিয়ে ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে। কবিতাটির প্রথম স্তবকের তৃতীয় লাইনে মেয়েটি ঘোষণা করে একজন দেবদূতের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা।
God calls home the angels promptly
At the setting sun;
I missed mine. How dreary marbles,
After playing Crown
আমরা এই পৃথিবীতে বসবাস করি আমাদের মত । এই পৃথিবীতে আমরা স্কুলে শিশু, তাদের মার্বেল এবং সূর্যের উদয় এবং অস্ত অবলোকন করি। একটি ছোট্ট মেয়ে দেবদূতদের সঙ্গে খেলা করে। এখানেই এমিলি ডিকিনসন জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ উপস্থাপন করেছেন বিশেষ নৈপুন্যে, একথা স্বীকার করতেই হবে।
এমিলি ডিকিনসনের কবিতায় বর্ণনামূলক অনুষঙ্গ বিশেষ ভাবে উঠে এসেছে তা দেখা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। My Life had stood – a Loaded Gun –এই কবিতায় এমিলি ডিকিনসন আগের দুটো কবিতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন । আমরা এখানে এই কবিতাটির অংশ তুলে ধরছি।
My Life had stood – a Loaded Gun –
In Corners – till a Day
The Owner passed – identified –
And carried Me away –
And now We roam in Sovereign Woods –
And now We hunt the Doe –
And every time I speak for Him –
The Mountains straight reply –
আমার জীবনটা দাঁড়িয়েছিল - গুলিভরা একটা বন্দুকের সামনে-
কোণগুলোতে- পুরো একটা দিন
আমাকে শনাক্ত করে মালিক আমাকে এখানে নিয়ে আসে -
এখন আমরা সার্বভৌম বনে বনে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরছি-
আর এখন আমরা হরিণ শিকার করছি-
প্রত্যেবার আমি ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলি- পর্বত সোজাসুজি জবাব দেয়- ( প্রাবন্ধিকের অনুবাদ)
এমিলি ডিকিনসনের এই কবিতার কিছুটা ক্ষোভ আছে। বর্ণনায় উঠে এসেছে বন্দুকের কথা। এখানে তিনি অনুশোচনাহীনভাবে হরিণ হত্যা করে গর্ববোধের আভাস দিয়েছেন। বন্দুকের গুলির শব্দ পর্বতে পর্বতে প্রতিধ্বনিত হয়। দেবদূতদের সঙ্গে একটা শিশুর মিলিত হওয়া এবং একজন মহিলার মৃত্যুর তারিখের দিকে যাওয়ার মধ্যে এই কবিতার পার্থক্য আছে My Life had stood – a Loaded Gun কবিতাটিতে। এই কবিতাটির বর্ণনায় একজন অনুশোচনাহীন যৌনতা ও রিরংসা জারিত শয়তানের বিপথগামীতার কথা কবিতায় উঠে এসেছে। এটা এমিলির লেখা একটি অসাধারণ কবিতা। ঘেরাটোপে আবদ্ধ আগ্রাসনের শিকার মুক্তিকামী মহিলার মুখ দিয়ে এমিলি ডিকিনশন উৎপীড়নের কথা উপস্থাপন করেছেন। তিনি এই কবিতায় বন্দুক ও পুরুষ শিকারীর মধ্যে আক্ষরিক নয় এমন সম্পর্ক স্থাপন করেছেন কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা আধিপত্যবাদী এক মহিলাকে তুলে ধরেছেন।
এমিলি ডিকিনসনের অন্যান্য কবিতার মত এক কবিতাটিতে অনেক না বলা কথা , অব্যাখ্যাত বর্ণনার সমারোহ দেখতে পাওয়া যায়। কোথা থেকে বন্দুক আসে? কেন এটার মধ্যে বোধশক্তি আছে? সত্যি কথা বলতে এ কবিতায় অপ্রকৃত অনুষঙ্গে গল্প উঠে এসেছে। এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় এমিলি ডিকিনসনের কবিতায় ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজম, ফ্যান্টাস্টিক অনুষঙ্গ সহ নানা ধরনের বিষয় উঠে এসেছে।
গত শতকের পৃথিবীর নানা ভাষার কবিরা তাদের কবিতায় ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজম বা জাদুবস্তবতার অনুষঙ্গ উপস্থাপন করেছেন সচেতন ভাবে অরিজোনার কবি আলবার্তো আলভারো রিওস । আলবার্তো আলভারো রিওস এর জন্ম অরিজোনার নোগালসে ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫২ সালে। তিনি আগস্ট ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অরিজোনার স্টেট পোয়েট হিসাবে বিবেচিত হন। দশটি কাব্য, তিনটি ছোটগল্প সংকলন ও একটি স্মৃতিকথা প্রকাশ পেয়েছে।তিনি তাঁর কবিতায় magic realism বা জাদুবাস্তবতাকে উপস্থাপন করেছেন সচেতন ভাবে। আলবার্তোর লেখা কবিতা Domingo Limon ,Nani,Teodoro Luna’s Two kisses ইত্যাদি কবিতায় জাদুবস্তবতা বিশেষ ভাবে দৃশ্যমান। জাদুবাস্তবতাবাদের পুরোধা গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এর জাদুবস্তবতার অনুষঙ্গকে আলবার্তো তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন।আমরা একটি কবিতার উদ্ধৃত দিতে পারি।
Teodoro Luna’s Two Kisses
Alberto Alvaro Rios
Mr. Teodoro Luna in his later years had taken to kissing
His wife
Not so much with his lips as with his brows.
This is not to say he put his forehead
Against her mouth--
Rather, he would lift his eyebrows, once, quickly:
Not so vigorously he might be confused with the villain
Famous in the theaters, but not so little as to be thought
A slight movement, one of accident. This way
He kissed her
Often and quietly, across tables and through doorways,
Sometimes in photographs, and so through the years themselves.
This was his passion, that only she might see.
He might feel some movement on her lips
Toward laughter.
থিওডোরো লুনার দুটো চুম্বন
আলবার্তো আলভারো রিওস
মি. থিওডোরো লুনা তার পরবতী বছরগুলোতে চুম্বন দিয়েছিলেন
তার পতœীকে
তেমনটা তার ওষ্ঠ আর ভ্রæদ্বয় দিয়ে নয়।
এটা বলি না তিনি তার কপাল রাখেন
তার মুখে-
বরং, তিনি তার ভ্রæদ্বয় উপরে তুলতেন,একবার,দ্রæততার সঙ্গে;
তেমনটা তেজদ্বীপ্ত ভাবে তিনি বিভ্রান্ত ছিলেন না
বিখ্যাত খিয়েটারের ভিলেনের দ্বারা,কিন্তু খুব সামান্য নয় তেমন ভাবনার
একটা অল্পস্বল্প গতি,একটা দুর্ঘটনা। এই ভাবে
তিনি তাকে চুমু দিয়েছিলেন
বারবার শান্তভাবে, টেবিল পেরিয়ে আর দ্বার দেশে,
মাঝমধ্যে ফটোগ্রাফে, এই ভাবে বছর রছর তারা নিজেরা
এটাই ছিল থিওডোরো লুনার উত্তেজনা, যা একমাত্র তার পত্নীই উপলব্ধি করেন।
তিনি অবশ্যই উপলব্ধি তার পত্নীর ওষ্ঠদ্বয়ে কিছুটা স্পন্দন
আর হাসি। (প্রাবন্ধিকের অনুবাদ)
বিশ শতকে আরো অনেক কবির কবিতায় ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজম বা জাদুবস্তবতার উঠে এসেছে। এই সমস্ত কবিদের মাঝে
হাঙ্গেরিয়ান কবি জর্জ এসর্টিস (George Szirtes) অন্যতম। তিনি তাঁর কবিতায় ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজম বা জাদুবস্তবতাকে উপস্থাপন করেন। কবি জর্জ এসর্টিস এর জন্ম হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ১৯৪৮ সালে ২৯ নভেম্বর। তিনি মাত্র ৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালে রিফুজি হিসাবে ইংল্যান্ডের লন্ডনে চলে আসেন পরিবারের সঙ্গে। তিনি ফাইন আর্টস নিয়ে লন্ডন ও লীডসে পড়াশোনা করেন। লীডসে পড়াশোনা কালে তিনি কবি মার্টিন বেলের সংস্পর্শে এসে কবিতা লেখায় সম্পৃক্ত হন। তিনি তাঁর কবিতায় ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজমকে তুলে ধরেছেন বিশেষ অনুষঙ্গে । মানুষের কল্পনাকে
জাদুবাস্তবতায় উপস্থাপন করেছেন তিনি তাঁঁর নিচের ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজম কবিতায়।
Magic Realism
When she opened her hands the butterflies emerged
from her palms. This was the first chapter.
In the second she was speaking butterflies.
In the third her eyelids opened on butterflies.
Soon enough she would become a butterfly
since this was the story, the story behind the self
made of butterflies.
ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজম
যখন মেয়েটি তার হাতদ’খানা খুলল তখনই প্রজাপতিগুলো নির্গত হল
তার হাতের তালু দুটোর মাঝ থেকে। এইটাই ছিল প্রথম অধ্যায়।
দ্বিতীয়ে মেয়েটি কথা বলছিল প্রজাপতিগুলো।
তৃতীয়ে তার চোখের পাতাদুটো প্রজাপতিগুলোর ওপর নিবদ্ধ হল।
সামান্য সময়ের মধ্যে মেয়েটি একটা প্রজাপতি হয়ে গেল
এ থেকে গল্পটিতে। ( প্রাবন্ধিকের অনুবাদ)হ
আমরা এখন বাংলা কবিতায় জাদুবস্তবতা সম্বন্ধে আলোচনা করার চেষ্টা করব। তার আগে হাজার বছরের ঐতিহ্যে বাংলা ভাষায় কবিতা ক্রমবিকাশের ধারায় নানা পরিক্রমা সম্বন্ধে কথা বলতে হয়। কবিতার রূপ-নির্মাণে কবিরা কবিতাকে সব সময়ই নিজের মতো করে গ্রহণ করেছেন। চর্যাপদ থেকে শুরু করে কবিতার যাত্রা পথ দীর্ঘতর। মাইকেল মধুসূদন দত্তের অমিতাক্ষর ছন্দ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ও কাব্যের মধ্যে কবিতাকে অনেক চড়াইউৎরাই পার করতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এই পঞ্চ কবি বাংলা কবিতাকে ঋদ্ধ করেছেন। পঞ্চকবি বাংলা কবিতা ও গানে ভগবতপ্রেম, মানবিক প্রেম, দেশপ্রেম ও বিদ্রোহের বহি:প্রকাশ ঘাটান। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম পরাধীন ভারতবর্ষেও ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন তাঁর কবিতা ও গানে। পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য তাঁর অগ্নিবীণার কবিতা ও গানে অবিভক্ত ভারতের আপামর জনগণ মুক্তির মন্ত্রে। তাদের কবিতায় তেমন ভাবে জাদুবাস্তবতা বিশেষ ভাবে লক্ষ করা যায় না। আমরা প্রথমে জীবনানন্দের কবিতা উপর আলোচনা করবো। তাঁর ‘সূর্যতামসী’তে আমরা দেখতে পাই মরণের - জীবনের কথা:‘কোথাও পাখির শব্দ শুনি;/কোনো দিকে সমুদ্রের সুর;/কোথাও ভোরের বেলা রয়ে গেছে - তবে।/অগণন মানুষের মৃত্যু হ'লে - অন্ধকারে জীবিত ও মৃতের হৃদয়/বিস্মিতের মতো চেয়ে আছে;এ কোন সিন্ধুর সুর:/মরণের - জীবনের?/এ কি ভোর? (সাতটি তারার তিমির)------ সত্যি কথা বলতে জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় নিজস্ব ঘরণায় উপস্থাপন করেছেন। এর মাঝে আমরা জাদুবাস্তবতা খুঁজে পাই।
তাঁর ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যের ‘সপ্তক’কে আমরা জাদুবাস্তবতা খুঁজে পাই। ‘সপ্তক’কের কয়েক পঙ্তি আমরা এখানে তুলে ধরতে পারি:‘এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে; -/ জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা।/অনেক হয়েছে শোয়া;/- তারপর একদিন চ'লে গেছে/কোন দূর মেঘে।/অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে ----------- ’কবি যেন এখানে জাদুকরী মননের ফসল বপন করেছেন। পরের পঙ্তিগুলোতে জীবনানন্দ আরো জাদুকরী!
সরোজিনীর চলে গেলো অতদূর? ----/পাখিদেরমত পাখা বিনা?/হয়তো বা মৃত্তিকার জ্যামিতিক ঢেউ আজ? জ্যামিতির/ভূত বলে: আমি তো জানি না।/জাফরান - আলোকের বিশুষ্কতা সন্ধ্যার আকাশে আছে লেগে:/লুপ্ত বেড়ালের মত; শূন্য চাতুরির মূঢ হাসি নিয়ে জেগে।-----
বাংলা কবিতায় জীবনানন্দের হাতেই তৈরি হলো এ ধরনের কবিতা। এর বৈশিষ্ট্য হলো, তা একাধারে বহির্বাস্তবতা অন্যদিকে মনোবাস্ততাকে ধারণ করে পাঠককে জাদুবাস্ততার মধ্যে নিয়ে যায়।আঙ্গিকের এই যে নিরীক্ষা, এটাই হলো জীবনানন্দের সেই নান্দনিকতা, যার মাধ্যমে বাংলা কবিতায় ঘটল বাঁকবদল।
জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় যে রূপকল্পের অবতারণা করেছেন তাকেই রবীন্দ্রনাথ তাকে বলেছেন ‘চিত্ররূপময়তা’। দার্শনিক মনন ও মনোবাস্তবতার জন্যও জীবনানন্দের কবিতা নান্দনিকতায় যেমন ঋদ্ধ। আমাদের জানা যে বাংলা কবিতায় পরাবাস্তবতার সূচনা ঘটে জীবনানন্দের হাতে, সেই সঙ্গে ম্যাজিক রিয়্যালিজম বা জাদুবাস্তবতা । জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন‎, আকাশলীনা, আট বছর আগে একদিন, আবার আসিব ফিরে, কার্তিক মাঠের চাঁদ, আমি যদি হতাম, আমি যদি হতাম, ক্যাম্পে, গোধূলিসন্ধির নৃত্য, নির্জন স্বাক্ষর, রূপসী বাংলা, লোকেন বোসের জার্নাল,আকাশলীনা,শঙ্খমালা,সুদর্শনা ইত্যাদি কবিতায় অবশ্যই জাদুবাস্তবতা আছে।
জীবনানন্দের ‘ ক্যাম্পে ’ কবিতায় ম্যাজিক রিয়্যালিজম বা জাদুবাস্তবতা আছে কিনা বোদ্ধা কবিতা পাঠক ও সমালোচকরাভেবে দেখবার চেষ্টা করবেন। এই কবিতাটি নিয়ে অশ্লীলতার অভিযোগে বিতর্কের ঝড় ওঠে। আমরা এখানে এই কবিতা থেকে উদ্ধৃত করতে পারি । ‘ ক্যাম্পে ’ ‘একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে/সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে/দাঁতের-নখের কথা ভুলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে অই/সুন্দরী গাছের নীচে জ্যোৎস্নায়!
মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে/হরিণেরা আসিতেছে।’/তাদের পেতেছি আমি টের/অনেক পায়ের শব্দ শোনা যায়,/ঘাইমৃগী ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়।/ঘুমাতে পারি না আর;/শুয়ে শুয়ে থেকে বন্দুকের শব্দ শুনি;-------------------------------কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;/বনের ভিতরে আজ শিকারীবা আসিয়াছে,/আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেন,/এইখানে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে/ঘুম আর আসেনাকো/বসন্তের রাতে।’
জীবনানন্দ দাশের এই কবিতায় জাদুবাস্তবতার আভাস ফুটে উঠেছে। ‘চারিপাশে বনের বিস্ময়,/চৈত্রের বাতাস,/জ্যোৎস্নার শরীরের স্বাদ যেন;/ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে;/কোথাও অনেক বনে যেইখানে জ্যোৎস্না আর নাই/পুরুষহরিণ সব শুনিতেছে শব্দ তার;/তাহারা পেতেছে টের,/আসিতেছে তার দিকে/।আজ এই বিস্ময়ের রাতে/তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে;/তাহাদের হৃদয়ের বোন/বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়/পিপাসার সান্তনায় আঘ্রাণে আস্বাদে;/
কবি নিজেই এই কবিতা সম্বন্ধে কী বলেছেন তা দেখার আগে এই কবিতার আরো কিছুটা দেখে নিতে পারি।
“আমার ক্যাম্পে কবিতাটি সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলা দরকার মনে করি। কবিতাটি যখন শেষ হয় তখন মনে হয়েছিল সহজ শব্দে শাদা ভাষায় লিখেছি বটে, কিন্তু তবুও কবিতাটি হয়তো অনেকে বুঝবে না। বাস্তবিকই ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটির মানে অনেকের কাছে এতই দুর্বোধ্য রয়ে গেছে যে এ কবিতাটিকে তাঁরা নির্বিবাদে অশ্লীল বলে মনে করেছেন।
কিন্তু তবুও ক্যাম্পে কবি নিজেই এই কবিতা সম্বন্ধে কী বলেছেন তা দেখার আগে এই কবিতার আরো কিছুটা দেখে নিতে পারি। নয়। যদি কোনো একমাত্র স্থির নিষ্কম্প সুর এ কবিতাটিতে থেকে থাকে তবে তা জীবনের মানুষের কীট-ফড়িঙের সবার জীবনেরই নিঃসহায়তার সুর। সৃষ্টির হাতে আমরা ঢের নিঃসহায় ক্যাম্পে কবিতাটির ইঙ্গিত এই; এইমাত্র। কবিতাটির এই সুর শিকারী, শিকার, হিংসা এবং প্রলোভনে ভুলিয়ে যে হিংসা সফল-পৃথিবীর এই সব ব্যবহারে বিরক্ত তত নয়, বিষণœ যতখানি বিষণœ নিরাশ্রয়। ক্যাম্পে কবিতায় কবির মনে হয়েছে তবু যে স্থূল হরিণ শিকারীই শুধু প্রলোভনে ভুলিয়ে হিংসার আড়ম্বর জাঁকাচ্ছে না, সৃষ্টিই যেন তেমন এক শিকারী, আমাদের সকলের জীবন নিয়েই যেন তার সকল শিকার চলেছে; প্রেম-প্রাণ-স্বপ্নের একটা ওলটপালট ধ্বংসের নিরবচ্ছিন্ন আয়োজন যেন সবদিকে---”
জীবনানন্দ পুরুষ হরিণ ও মেয়ে হরিণের সঙ্গে মানব মানবীর অনুষঙ্গকে যে ভাবে উপস্থাপন করেছেন তাতে অবশ্য জাদুবাস্তবতার পরশ আছে। তিনি এই কবিতার শেষ স্তবকে নিজের হৃদয়ের কথা বলছেন এই ভাবে:
‘কেন এই মৃগদের কথা ভেবে ব্যথা পেতে হবে/তাদের মতন নই আমিও কি?/কোনো এক বসন্তের রাতে/জীবনের কোনো এক বিস্ময়ের রাতে/আমারেও ডাকেনি কি কেউ এসে জ্যোৎস্নায় দখিনা বাতাসে./অই ঘাইহরিণীর মতো?/
আমার হৃদয় এক পুরুষহরিণ/পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে/চিতার চোখের ভয় চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে/
তোমারে কি চায় নাই ধরা দিতে?’
জীবনানন্দের ‘ লোকেন বোসের জর্নাল ’এক নস্টালজিক অনুষঙ্গের কবিতা।
সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি -/এখনো কি ভালোবাসি?/সেটা অবসরে ভাববার কথা,/অবসর তবু নেই;/তবু একদিন হেমন্ত কাল এলে অবকাশ পাওয়া যাবে/এখন শেলফে চার্বাক ফ্রয়েড প্লেটো পাভলভ ভাবে/সুজাতাকে আমি ভালোবাসি কি না।/পুরোনো চিঠির ফাইল কিছু আছে:/সুজাতা লিখেছে আমার কাছে,/বারো তেরো কুড়ি বছর আগের সে-সব কথা;/ফাইল নাড়া কি যে মিহি কেরানীর কাজ;/নাড়বো না আমি/নেড়ে কার কি লাভ;/মনে হয় অমিতা সেনের সাথে সুবলের ভাব,
সুবলেরই শুধু? অবশ্য আমি তাকে/মানে এই অমিতা বলছি যাকে -/কিন্তু কথাটা থাক;/কিন্তু তবুও -/আজকে হৃদয় পথিক নয়তো আর,/নারী যদি মৃগতৃষ্ণার মতো - তবে/এখন কি করে মন কারভান হবে।/প্রৌঢ় হৃদয়, তুমি/সেই সব -------------প্রেম নয় তবু প্রমেরই মতন শুধু।/অমিতা সেনকে সুবল কি ভালোবাসে?/অমিতা নিজে কি তাকে?/অবসর মতো কথা ----------------সুজাতা এখন ভুবনেশ্বরে;/অমিতা কি মিহিজামে?/বহুদিন থেকে ঠিকানা না জেনে ভালোই হয়েছে সবই।
একাধারে বহির্বাস্তবতা অন্যদিকে মনোবাস্ততাকে ধারণ করে পাঠককে জাদুবাস্ততার মধ্যে নিয়ে যায় ।
জীবনানন্দ দাশ, মাত্রাচেতনা, কবিতার কথা। জনপ্রিয় জননন্দিত কবি তিনি। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাঙালির হৃদয়াসনে স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত। নারীকে ঘিরে ভাবনায় তো জাগে, ‘প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়, / হয় নাকি?’ প্রেম মুছে যায়, কিন্তু সত্যিই কি মুছে যায়, এই যে টানাপড়েন, এই যে অনিশ্চয়তার বোধ, এটাই তো এখনকার পাঠককে আকর্ষণ করে। বনলতা সেন, কিংবা সুরঞ্জনা এভাবেই পাঠকের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে। সুরঞ্জনার সংস্পর্শেই নারীর প্রতি সমর্পণের সৌন্দর্যটা বিচ্ছুরিত হয় এভাবে, ‘আরো আলো : মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়’। কিন্তু এই নারীকে ঘিরেই ঘনিয়ে ওঠে বেদনা : ‘আহা, ইহাদেরই কানে / অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেল যুবকের দল; / একবার নক্ষত্রের পানে চেয়েÑ একবার বেদনার পানে।’ তবে এতকিছুর পরেও কী মধুর জীবনানন্দের নারীভাবমূর্তি, ‘এই জীবনের সত্য তবু পেয়েছি এক তিল : / পদ্মপাতায় তোমার আমার মিল। / আকাশ নীল, পৃথিবী এই মিঠে, / রোদ ভেসেছে, ঢেঁকিতে পাড় পড়ে; / পদ্মপাতা জল নিয়ে তারÑ জল নিয়ে তার নড়ে; / পদ্মপত্রে জল ফুরিয়ে যায়।’ সময়চেতনাও তার কবিতায় স্পষ্ট।জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় বনলতা সেন, সরোজিনী, সুরঞ্জনা, সুচেতনা, সবিতা, সুদর্শনা প্রভৃতি নারীর নাম ব্যবহার করেছেন। তারা একই নারীর ভিন্ন ভিন্ন নাম, নাকি প্রকৃত অর্থেই তারা স্বতন্ত্র নারী ছিলেন- এ রহস্য আজো অনির্ণীত। বনলতা সেনকে নিয়ে রহস্য আরো গাঢ় অন্ধকার।
জীবনানন্দের কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সব মহৎ কবিতারই আছে বহুমাত্রিকতা। ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য’ কবিতাটিকে ঘিরে যে বিতর্ক ঘনিয়ে উঠেছিল, সেই বিতর্ক থেকেই বোঝা যায় একটি মাত্র অর্থ নয়, বহুমাত্রিক অর্থারোপের দিকেও পাঠককে টেনে নেয় জীবনানন্দের কবিতা। কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখলেন, ‘জীবনানন্দ আমাদের কালের ইতিহাসের অতীত ও ভবিষ্যতের সন্ধিক্ষণকে যে প্রতীক-নৃত্যে ধরেছেন তারই নাম ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য।’ ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য-
দরদালানের ভি— পৃথিবীর শেষে/যেইখানে পড়ে আছে-শব্দহীনভাঙ্গা/সেইখানে উঁচু উঁচু হরীতকী গাছের পিছনে
হেমন্তের বিকেলের সূর্য গোলরাঙা-/-------------সেইখানে যুথচারী কয়েকটি নারী/ঘনিষ্ঠ চাঁদের নিচে চোখ আর চুলের সংকেতে./মেধাবিনী; দেশ আর বিদেশের পুরুষেরা/যুদ্ধ আর বাণিজ্যের রক্তে আর উঠিবে না মেতে-----------------
জীবনানন্দ তাঁর এ কবিতে জাদুবাস্তবতাকে তুলে ধরেছন আপন চিন্তাচেতনায়। জীবনানন্দ দাশ কবিতায় এক নতুন ধারা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। সেক্ষেত্রে তাঁরা ‘হয়ে উঠেছিলেন নগরমনস্ক’। এই নগরমনস্কতায় তাঁরা শুধু নিজেদের নগরেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নগরযন্ত্রণাকে কবিতায় এনে নতুন এক ধারা নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। এ ধারাতেই পরবর্তী কয়েক দশক প্রবাহিত হয়েছে।
পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কবিতায় গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতি সম্পূর্ণভাবে ধরা পড়েছে। বাংলার গ্রামীণ অনুষঙ্গ যিনি সম্পূর্ণভাবে কবিতায় ধারণ করেছেন, তিনি কবি ওমর আলী। এ ক্ষেত্রে ওমর আলী নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। ওমর আলী অন্যতম কবি যিনি গভীর মমতায় কবিতায় জাদুবাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। তাঁর সব কাব্যের কবি জাদুবাস্তবতাকে নিখাদ অনুষঙ্গে তুলে ধরেছেন । একই সাথে গ্রামের মানুষের আনন্দ-বেদনা, দুঃসহ জীবন যন্ত্রণাকে সূ²ভাবে দেখেছেন, দেশ-কাল, সমাজ-রাষ্ট্র-স্বাধীনতা, জৈবিকতা-প্রবৃত্তি নানা বিষয় উপজীব্য করেছেন কবিতায়। বেদনার্ত মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা নিজের করে পাশে থেকেছেন। তাঁর প্রত্যেকটি কাব্যগ্রন্থই এর সত্যতা বহন করে। তাঁর কবিতার নামের প্রতি দৃষ্টি দিলে বোদ্ধা পাঠক সহজেই বুঝতে পারবে তাঁর কবিতার জাদুবাস্তবতাবাদকে। তাঁর কবিতার নামগুলো হল: ‘হৃদয় ছুঁয়ে আছে ঝড়’ ,‘এ দেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’, ‘হৃদয় ছুঁয়ে আছে ঝড়’, ‘তোমাকে দেখলেই’, ‘ডাকছে সংসার’ ‘আমার ভেতর খুব ভাঙচুর হচ্ছে’, ‘ফেরার সময়’, ‘তেমাথার শেষে নদী’, ‘অরণ্যে একটি লোক’, ‘ছবি’, ‘স্বদেশে ফিরছি’,‘ যে তুমি আড়ালে’, ‘আমার ভেতর খুব ভাঙচুর হচ্ছে’, ‘গ্রামে ফিরে যাই’, ’অরণ্যে একটি লোক’,‘ তেমাথার শেষে নদী’, ‘আত্মার দিকে’, ‘নদী, নরকে বা স্বর্গে’, ‘এখনো তাকিয়ে আছি’, ‘নিঃশব্দ বাড়ী’, ‘ভালোবাসার প্রদীপ’‘লুবনা বেগম’, ’একটি গোলাপ’ ইত্যাদি ।
‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি/আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসি মাখা;/সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকোয় রোদ্দুরে,/রূপ তার এ দেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা-------’ কবি ওমর আলী গ্রামের সহজ-সরলা নারীদের চিত্র একেছেন। ওমর আলী পাঠককে তার কবিতায় জাদুবাস্ততার মধ্যে নিয়ে যান গেছেন তার প্রমাণ মেলে এই ভাবে:
‘তার ললিত যৌবনের/ক্ষয় কিংবা নতি দেখতে শুরু করে/কিংবা অনেকেই যুবতী হতে হতে আর যুবতী হয় না।/কিংবা,/নগরকান্দার শাহানারা শুয়ে চিন্তার ওপরে মাথা রেখে/তেলমাখা বালিশেই আলুথালু জন্মের প্রথম ভ্রƒণগর্ভে ধরেছে,/অপরিষ্কৃত দেহে মৃত্তিকাগন্ধি তার শাড়িতে শস্যের ধুলো মেখে/কুণ্ঠিত জন্ম দিতে গিয়ে বুঝি কাঁঠালিয়ার দেলোয়ারা অকালে মরেছে------’ ওমর আলী তাঁর কবিতায় প্রেমও রোমান্টিকতার স্পর্শ গন্ধ বর্ণের উপস্থিত। তাঁর ওমর কবিতায় অনেক নারীর নাম ব্যবহৃত হয়েছে। তাদের রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে গ্রাম-বাংলার প্রকৃতিকেই ব্যবহার করেছেন। গ্রাম-বাংলার নানা উপকরণের সঙ্গে তাদের রূপের তুলনা করেছেন। হাসিনা, জিনিয়া হোসেন, সালেহা, শাহানারা প্রভৃতি নামের উলে¬খ রয়েছে। পুরাণাশ্রিত নায়িকার নামও আছে তাঁর কবিতায়। ওমর আলী যেসব নারীর নাম ব্যবহার করেছেন, তা গ্রামীণ মেয়েদেরই নাম।কিন্তু তাঁর কবিতায় যে একাধিক নারীর নাম উলে¬খ আছে, এগুলো একই নারীকে তিনি বিভিন্ন নামে উপস্থাপন করেছেন, নাকি কবির জীবনে এসব নারী স্বতন্ত্রভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁর প্রেমিক-মানসস্বরূপটি নির্ণীত হওয়া জরুরী। যে রহস্যটি রয়ে গেছে জীবনানন্দ দাশের ক্ষেত্রেও । ওমর আলীর কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ বর্তমান আছে। বাংলা কবিতায় কবি আল মামুদ ঋদ্ধতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি নিজেই এক স্বাক্ষাৎকারে বলেছিলেন , আমার কবিতা রহস্য সৃষ্টি না করে আসঙ্গলিপ্সার কথা বলে। কবি আল মামুদ বাংলা কবিতাকে নতুনমাত্রা দান করেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ‘ লোক লোকান্তর ’ ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হল: ‘ সোনালী কাবিন’,‘ মায়াবী পর্দা’ দুলে ওঠো,’‘ দোয়েল ও দয়িতা’, দ্বিতীয় ভাঙ্গন’ ,‘ তুমি তৃষ্ণা তুমিই পিপাসার জল’,‘ তোমার রক্তে তোমার গন্ধ’, ইত্যাদি। তিনি তাঁর অনেক কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ বর্তমান আছে। এটা বোঝানোর জন্য তাঁর কবিতা অবশ্যই উদ্ধৃত করতে হবে।
‘সোনালী কাবিন ’ থেকে:‘ সোনার দিনার নেই কাবিন চেয়ো না হরিণী/যদি চাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি----- কবি আল মামুদ কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গের কথা না বললেও তাঁর উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার কথা বলেছেন এভাবে: ‘আমার উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ আছে। স্বপ্ন , অলৌকিক, অশরীরি অনেক বিষয়কে গল্প বা উপন্যাস করে তুলেছি। আমি যেটা দিয়ে বলাতে চেয়েছি, সেটাই হয়ে উঠেছে এটা আমার বিশ্বাস।’তিনি তাঁর কবিতা প্রসঙ্গে জাদুবাস্তবতার কথা না বললেও জাদুবাস্তবতাকে তিনি এড়িয়ে যেতে পারেননি। তিনি এক সাক্ষাৎকারে কী বলেছেন আমরা দেখতে পারি। কবি আল মামুদ বলেন,‘ আমার কবিতায় রয়েছে দেহজ প্রেমের আধুনিক রূপান্তর।------ আধুনিক সাহিত্য ্ এটাকেই আমি মনে করি, যেখানে হয়তো মিলও আছে, ছন্দও আছে, গন্ধও আছে, সব কিছু মিলিয়ে একটা স্থাবর বা অস্থাবর কিছু তৈরি হবে। একটা ম্যাজিক তৈরি হবে। ’ তাঁর কবিতায় নারী বিশেষ অনুষঙ্গে উঠেছে। তিনি নিজেই বলেছেন,‘ নারী তো একটা কাঠামো। কবি বিভিন্ন্ জায়গা থেকে নারীকে এনে সেই কাঠামোতে বসিয়ে দেয়। কারো হাত, কারো চোখ, কারো কেশ , করো বক্ষস্থল, কারো মুখ, পা, কারো কোমর ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় থেকে এনে কাঠামোতে জোড়া লাগিয়ে দেয়। আমি সেটাই করেছি।--------’ তাঁর কবিতায় আমরা দেখতে পাই: ‘নদীর সিকস্তি কোনো গ্রামাঞ্চলে মধ্যরাতে কেউ/যেমন শুনতে পেলে অকস্মাৎ জলের জোয়ার,/হাতড়ে তালাশ করে সঙ্গিনীকে, আছে কিনা সেও/যে নারী উন্মুক্ত করে তার ধন-ধান্যের দুয়ার----- ’দুই বাংলার অন্যান্য কবিদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ,অমিতাভ দাশগুপ্ত ,উৎপল কুমার বসু ,জয় গোস্বামী,নবারুন ভট্টাচার্য , নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী,পূর্ণেন্দু পত্রী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়. মল্লিকা সেনগুপ্ত, শঙ্খ ঘোষ, সুবোধ সরকার, সুভাষ মুখোপাধ্যায়,শামসুর রহমান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, মাকিদ হায়দার, রফিক আজাদ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল, শহীদ কাদরী, হুমায়ূন আজাদ,হেলাল হাফিজ প্রমুখের কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ আছে কিনা বোদ্ধা কবিতা পাঠক অনুসন্ধান করার চেষ্টা করবেন বলে আশা করি।
শামসুর রাহমান এর ‘পূর্বরাগ’ কবিতায় কী বলতে চেয়েছেন তা আমরা দেখতে পারি। এ কবিতায় জাদুবাস্তবাদতার অনুষঙ্গ
আছে কিনা বোদ্ধা কবিতা পাঠক যাচাই কওে দেখবেন।
জেনেছি কাকে চাই, কে এলে চোখে ফোটে
নিমেষে শরতের খুশির জ্যোতিকণা;
কাঁপি না ভয় আর দ্বিধার নেই দোলা
এবার তবে রাতে হাজার দীপ জ্বেলে
সাজাবো তার পথ যদি সে হেঁটে আসে।
যদি সে হেঁটে আসে, প্রাণের ছায়াপথ
ফুলের মতো ফুটে তারার মতো ফুটে
জ্বলবে সারারাত, ঝরবে সারারাত।
জেনেছি কাকে চাই, বলি না তার নাম
ভিড়ের ত্রিসীমায়া স্বপ্ন-ধ্বনি শুধু
হৃদয়ে বলে নাম, একটি মৃদু নাম।
সৈয়দ শামসুল হকের অন্যান্য কবিতায় জাদুবাস্তবাদতার অনুষঙ্গ বর্তমান আছে। আমরা তাঁর পরানের গহীর ভিতর-১১ কবিতায় জাদুবাস্তবাদতার অনুষঙ্গ এখানে তুলে ধরতে পারি।
জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,/চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,/মানুষ বেকুব চুপ,হাটবারে সকলে দেখুক/কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর ৷/চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়েও,/বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পূর্ণিমার চান,/নিজেই তাজ্জব তুমি একদিকে যাইবার চাও/অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান৷/সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না----------------------- ’
সৈয়দ আব্দুল মান্নান বাংলা কবিতায় ঋদ্ধতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর কবিতায়ও জাদুবাস্তবাদতার অনুষঙ্গ বর্তমান আছে তার প্রমাণ পাই তাঁর লেখা‘পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ ’কবিতায়:‘পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ ঝর্না থেকে নেমে এসেছিলো। /এখন, রহস্যময় জলে, খেলা করে অবিরল। /পদ্মায় গিয়েছে একটি-- মেঘনায়-যমুনায়-সুরমায়-- /আর-একটি গোপন ইচ্ছায়। পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ /ঝর্না থেকে নেমে এসে সাঁতরে চলে বিভিন্ন নদীতে। /পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ জলের রহস্য ভেদ করে /এখন একাকী এক শব্দহীন সমুদ্রে চলেছে। ’
হেলাল হাফিজ এর কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ আমরা দেখতে পাই।
কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট !
লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
'মালটি-কালার' কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,জয় গোস্বামী ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তিনটি কবিতার কিছুটা তুলে ধরব। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ’কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার এই অংশকে দেখতে পারি জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ আছে কিনা।
বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!
ভালওবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি
দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীলপদ্ম
তবু কথা রাখে নি বরুণা , এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে-কোনো নারী!
কেউ কথা রাখে নি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখে না!
জয় গোস্বামীর কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ আছে কিনা তা আমরা দেখতে পারি তাঁর ‘মেঘবালিকার জন্য রূপকথা ’ কবিতা থেকে। ‘আমি যখন ছোট ছিলাম/খেলতে যেতাম মেঘের দলে/একদিন এক মেঘবালিকা প্রশ্ন করলো কৌতুহলে/
‘এই ছেলেটা, /. নাম কি রে তোর?”/আমি বললাম,/. “ফুসমন্তর !”/মেঘবালিকা রেগেই আগুন,/“মিথ্যে কথা । নাম কি অমন হয় কখনো ?”/.আমি বললাম,/“নিশ্চয়ই হয় । আগে আমার গল্প শোনো ।”/সে বলল, “শুনবো না যা-./সেই তো রাণী, সেই তো রাজা/সেই তো একই ঢাল তলোয়ার/সেই তো একই রাজার কুমার পক্ষিরাজে শুনবো না আর ।/. ওসব বাজে ।”/আমি বললাম, “তোমার জন্য নতুন ক’রে লিখব তবে ।”/সে বলল, “সত্যি লিখবি ?/বেশ তাহলে
মস্ত করে লিখতে হবে।/মনে থাকবে ?----------“তুমি কি সেই ? মেঘবালিকা /তুমি কি সেই ?’/
জয় গোস্বামীর কবিতায় জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া আছে। এই কবিতার শেষ স্তবকে অবশ্যই জাদুবাস্তবতা আমরা লক্ষ করতে পাই। ‘কেউ যায় না কোনদিনই/আজ সে কবি দেখতে পাচ্ছে/সেই দেশে সেই ঝরনাতলায়/এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়/সোনায় মোড়া মেঘহরিণী/কিশোর বেলার সেই হরিণী ।’
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বাংলা কবিতায় স্বমহিমার প্রতিষ্ঠিত। তাঁর কবিতায় জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া আমরা দেখতে পাাই। এখানে তাঁর ‘মাঠের সন্ধ্যা ’ কবিতায় দেখবো জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ।
‘অন্যমনে যেতে যেতে হঠাৎ যদি/মাঠের মধ্যে দাঁড়াই,/হঠাৎ যদি তাকাই পিছন দিকে,/হয়তো দেখতে পাওয়া যাবে /বিকেলবেলার নদীটিকে।/ও নদী, ও রহস্যময় নদী,/অন্ধকারে হারিয়ে যাসনে, একটু দাঁড়া;/এই যে একটু-একটু আলো, /এই যে ছায়া ফিকে-ফিকে,/এরই মধ্যে দেখে নেব সন্ধ্যাবেলার প্রথম তারাটিকে।/ও তারা, ও রহস্যময় তারা,/একটু আলো জ্বালিয়ে ধর, দেখে রাখি/আকাশী কোন্ বিণœতা ছড়িয়ে যায় দিকে-দিকে,/দেখে রাখি অন্ধকারে উড়ন্তওই ক্লান্ত পাখিটিকে।/ও পাখি, ও রহস্যময় পাখি।/হারিয়ে গেল আকাশ-মাটি, কান্না-পাওয়া/এ কী করুণ সন্ধ্যা! এ কোন্ হাওয়া লেগে/অন্ধকারে অদৃশ্য ওই নদীর দুঃখ হঠাৎ উঠল জেগে।/ও হাওয়া, ও রহস্যময় হাওয়া! ’
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর আরো অনেক কবিতায় জাদুবাস্তবতা উপস্থাপিত হয়েছে। পশ্চিম বাংলার ও বাংলাদেশের অনেক কবিতায়ই জাদুবাস্তবতা অনুষঙ্গ বর্তমান আছে। সীমাবদ্ধতার কারণে বক্ষ্যমান নিবন্ধ নির্দিষ্ট আয়তনের মধ্যে রাখতে হচ্ছে।
তবুও পরিশেষে বাংলাদেশের খ্যাতিমান কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘ স্বয়ম্ভূ ঈশ্বর’ নামের কবিতায় জাদুবাস্তবতা খোঁজার চেষ্টা করবে।‘যতক্ষণ জেগে থাকি, দরোজাটা বন্ধ করি না।/কেবলই মনে হয় কেউ একজন আসবে।/আমার প্রত্যাশায় এমন একজন নারী আছে,/কোনো শিল্পী যাকে আঁকতে পারেনি।/লিওনার্দো দা ভিঞ্চি,আঁরি মাতিস,/পাবলো পিকাসো অথবা যামিনী রায়,/কেউ-ই আঁকতে পারে নি তাকে।/মারকন্যার উদাস দৃষ্টির মধ্যে মুহূর্তর জন্য/আমি তাকে মূর্ত হতে দেখেছিলাম খাজুরাহে।/ব্যর্থ শিল্পী, আমার বাবার আঁকা একটি জলরঙ/ছবির ভিতরে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম তার/পেছন ফিরে তাকানোর উদ্দীপক সলজ্জ ভঙ্গিটি।/যদিও আমি জানি যে, সে-ছবির মডেল ছিলেন/আমার সিক্তবসনা মাতা, আমার জননী।/এভাবেই কুড়িয়ে পাওয়া খন্ড দৃশ্যগুলোকে/মালার মতো গেঁথে যদি তাকে আঁকা যায়,/আমার মনে হয় না তাতেও খুব একটা লাভ হবে।/কেননা, শিল্পমাত্রই তো অনুকৃতি, বাস্তবের/অথচ আমি যার কথা ভাবি, যার জন্য/অন্ধকারের দুয়ার খুলে দিয়ে বসে থাকি অপেক্ষায়-/তাকে আমি কোনদিন বাইরে দেখিনি।/তাই কেমন করে বলি, তাকে কেমনতরো দেখায়?/সে তো গাছের ফুলের মতো নয়,/সে তো আকাশের বৃষ্টি ভেজা/সহজলভ্য চাঁদের মতো নয়।,/সে অন্যরকম। ভীষণ অন্যরকম।/তার যুগলস্তনের দুর্গে মাথা কোটে অরন্য-পর্বত।/তার উড়ন্ত ঊরুযুগে পদানত মেঘের উর্বশী।
প্রজননের সঙ্গে অসম্পৃক্ত তার গর্ভদেশ।/তার যুগলব্যাকুলবাহু পুরুকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে/রাখা ছাড়া আর কোনো জাগতিক কর্তব্য শিখেনি।/আমি চাই সে আমার জাগরণের মধ্যে আসুক।
কারো কন্যারূপে নয়, কারো ভগ্নিরূপে নয়,/কারো বধূররূপে নয়, কারো মাতৃ রূপে নয়,/জগৎ-সংসারের সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে/সে আসুক, স্বয়ম্ভূ সুন্দর।
কবি নির্মলেন্দু গুণ এই কবিতায় নিচের অংশে তিনি তাঁর মন মননের সাহার্যে কল্পনার যা তুলে ধরেছেন তার মাঝে জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া আছে।‘সে যখন সম্পূর্ণ নিরাভরণ, তখন যেমন/উলঙ্গতার আচ্ছাদনে সে চিরআবৃতা, তেমনি,/যখন সে কল্পনার অন্ধকারে ছায়াবৃতা;/তখনও আমার দৃষ্টির মধ্যে সে চির-নগ্ন।/আমি যাচ্ঞা করি সেই চির-নগ্নিকাকে।’কবিতায় পোস্ট মর্ডানিজম বা উত্তরাধুনিকতার সূত্রপাত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন আশির কবিতা। এ দশকের বেশ কিছু কবিতায় নির্মিত হয়েছে নিজস্ব স্বপ্নের, কাঙ্খার। কবি খালেদ হোসাইনের ‘জলজ পাথর’ কবিতাটি আমরা এখানে তুলে ধরতে পারি। অজস্র স্বাক্ষর শেষে মৃত্যুকে যথার্থ মনে হয় গøাস বোতলের পাশে ছাইদানি, /একা মোমবাতি /উৎসব শেষ হলে সবকিছু ক্লান্তিকর লাগে /জলেরও আকাশ আছে পাতালের অযুক্তি আবেগ।
সত্তরের রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আবিদ আজাদ, ত্রিদিব দস্তিদার, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, নাসির আহমেদ, আবু হাসান শাহরিয়ার প্রমুখ এ আন্দোলনের অগ্রপথিক ছিলেন। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ সত্তরের দশকের শেষদিক থেকে শুরু করে আশির পুরোটা সময়ে জুডয়েই বাংলাদেশের স্বৈরশাসন, অত্যাচার নিপীড়েনের বিষয়গুলোকে নথিভুক্ত করতে শুরু করেন আশির কবিরা কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে তাদের কবিতায় ঢুকে যায় পোস্টমর্ডানিজম বা উত্তরাধুনিকতার যার অন্যতম প্রধান কারণ লিটল ম্যাগাজিন চর্চা। অস্বীকার করার পথ নেই বাংলাদেশের কবিতার প্রথম আধুনিকতার সূচনালগ্নে লিটল ম্যাগাজিনের চর্চা বলবৎ ছিল এবং যার কারণে বাংলা কবিতা ক্রমাগত উৎকর্ষে পথে হেঁটেছে কিন্তু উত্তরাধুনিকতার নামে পশ্চিমা সংস্কৃতি আর সেই ঘরানার কবিতা চর্চা আশির দশকে পুরোপুরি শুরু হয়। আশির দশকে কবিদের মধ্যে সাজ্জাদ শরিফ, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, রেজাউদ্দিন স্টালিন, ফকির ইলিয়াস,আবদুল হাই সিকদার, সুহিতা সুলতানা, মাসুদ খান, কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
তাদের অনেকের কবিতায়ই জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া আছে।খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতায় জাদুবাস্তবতার পরশ পাই : তোমাকে দেখেছি অলিম্পাসের তুষারধবল /চূড়ার মহিমায়/ তুমি ধরে আছ দুই হাতে বজ্র আর অশনির চাবুক /তুমি সেমিলির ঘরে যখন স্বর্ণবৃষ্টি/হয়ে নেমেছিলে, অপার তৃষ্ণায় /তোমার প্রেমের দান ভেবে ঘরে নিয়ে- /ছিলাম আগুন। রোদ্দুরে নেয়েছি আর বৃষ্টিতে বেড়েছি
সহস্র শতাব্দী দিয়ে নিজেকে গড়েছি
আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি।'
জাতিসত্তার কবি ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহাম্মদ নূরুল হূদার কবিতায় অবশ্য জাদুবাস্তবতা ছোঁয়া আছে। তিনি লিখেছেন-----
রোদ্দুরে নেয়েছি আর বৃষ্টিতে বেড়েছি
সহস্র শতাব্দী দিয়ে নিজেকে গড়েছি
আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি।'(


অনেক কবিই তাদের কবিতায় যা যা লিখেছেন তার মাঝে তাদের অজান্তেই জাদুর ছোঁয়া ফুটে উঠেছে। আমরা প্রসঙ্গক্রমে প্রবাসী সাহিত্যিক সালেহা চৌফুরীর বলতে পারি।তিনি মূলত অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক হলেও সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে‘ দলছুট শব্দরা’।তার একটি কবিতার এক অংশ----- ’বিন্দুর মাঝেসিন্দু আবিষ্কারের অভীপ্সায়’----- ‘ বালতিতে এক হাঁটুজল/ সেই দিকে চেয়ে/ সকালেরআলোতে ভাবছি সাগরের তল।’


ফকির ইলিয়াসের ‘ভরচৈত্রের ছায়াগ্রহণ’ কবিতায় জাদুবাস্তবতা লক্ষ করা যায়।
পথ্য হাতে চাঁদসুন্দরীরা-/হাত বুলায় মেঘের মাথায়। দীর্ঘজীবী হও/
রাতের শূন্যতা,/বলতে বলতে তারাগুলো হারিয়ে যায় জোনাক সংসারে/আগামী বসন্তে ভরচৈত্রের ছায়াগ্রহণ শেষ হলে/
যে পাখি দেশান্তরি হবে-/তার জন্য কয়েকটি পাপড়ি জমিয়ে রাখে সতীর্থরা/জমিয়ে রাখে কয়েকটি পাথর।
এখন আমরা নব্বইয়ের দশক কবিদের কবিতায় জাদুবাস্তবতা দেখার চেষ্টা করব। নব্বইয়ের দশকে মধ্যে উল্লেখযোগ্য দাউদ আল হাফিজ, আলফ্রেড খোকন, ওবায়েদ আকাশ, কুমার চক্রবর্তী, চঞ্চল আশরাফ, টোকন ঠাকুর, পাবলো শাহি, মজনু শাহ, মুজিব ইরম, শাহনাজ মুন্নী, সরকার আমিন, হেনরী স্বপন, কচি রেজা, কবির হুমায়ুন, কামরুজ্জামান কামু, তপন বাগচী, ব্রাত্য রাইসু, মতিন রায়হান, মাতিয়ার রাফায়েল, মারজুক রাসেল, মুজিব মেহদী, রণক মুহম্মদ রফিক, রহমান হেনরী, রিষিণ পরিমল, সাখাওয়াত টিপু, সৌমিত্র দেব প্রমুখ, তুষার গায়েন, সুনীল আচার্য প্রমুখ।
দাউদ আল হাফিজ নব্বইয়ের দশক কবিদের অন্যতম।দাউদ আল হাফিজের বাংলা কবিতার সবুজ মাঠে নব্বইয়ের দশক এ বিচরণ। তাঁর ‘পাতাঝরার গান এবং ঝরাপাতার সঙ্গীত’, ‘আলো, আরো আলো’ ও ‘জেরুজালেমে একদিন তিনহাজার বছর আগে’ কবিতাত্রয় ঋদ্ধতার স্বাক্ষর বহন করে। পরবর্তীতে তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘আনাবাস অথবা দ্বিধার গন্ধম’ । ‘ হঠাৎ বৃষ্টিতে’,‘নারী(রহস্য)’,‘ হাওয়াসম্বাদ’, ‘ অনঙ্গরঙ্গ’, ‘ অনাবাস’ ইত্যাদি কবিতায় জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া আছে ।
তাঁর ‘হঠাৎ বৃষ্টিতে’ কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করতে পারি। রমণীর নগ্নহাত/বুকে মাখে বৃষ্টির তুমুল/ আদর। কটিতে যুবতীপ্রহর/ নীলিমায় বোনে অন্ধকার/মেঘনীল চুলের বাহার!’ তাঁর লেখা‘ হাওয়াসম্বাদ’ কবিতায় জাদুবাস্তবতা আছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব বোদ্ধা পাঠক হাতে ছেড়ে দিলাম। ‘ হাওয়াসম্বাদ’-‘একটি কুমারী পাতা ছটফট কেবল কাঁপে/ আশরীর স্বপ্নশিহরণ/একটি
অনূঢ়া পাতা টলমল উচাটন হাওয়ায়/ অনঙ্গ-অঞ্জন চোখে/ একপাতা ছিন্নযোনি শান্ততপোধীর স্বপ্নে দেখে/ অনাঘাতা যোনি/একটি হলুদ পাতা শুধুই হু হু করে হুহু কাঁপে/ হিমেল হাওয়ায়--------’
কবি টোকন ঠাকুরও নব্বইয়ের দশকের কবি। তাঁর একটি কবিতা আমরা এখানে তুলে ধরলাম জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া আছে কিনা দেখার চেষ্টা করব।
দেখি রাক্ষসের মুখ, পাই ডাইনির নিঃশ্বাস
আয়নার মধ্যে তাকিয়ে নিজেকে রাক্ষস মনে হলো!/
সঙ্গে সঙ্গে রাক্ষসের মানে, সংক্ষিপ্ত বাঙলা অভিধানে পাওয়া গেল- নরখাদক জাতি, নিশাচর,. কর্বূর, প্রাচীন অনার্যজাতি ইত্যাদিৃ যদিও, রাক্ষসের একটা অপ্রত্যাশিত ভয়ঙ্কর মুখচ্ছবি /আঁকা আছে মনুষ্যকুলের মনে।/ এটা জানি, কারণ এদ্দিন আমিও মানুষের রোল /প্লে করে এসেছি। এদ্দিন আমিও মানুষ ছিলাম।/
কিন্তু আজ! আজই, নাকি কয়েকদিন ধরেই, যখনই আয়নার/সামনে গিয়ে নিজেকে দাঁড়াই, বিলিভ ইট, আমার চোখেই ধর./পড়ে আমি একটা রাক্ষস! আমার সারামুখে ডাইনিদের/ মিহি-নিঃশ্বাসের আঁচে পৃথিবীগ্রহের মায়াময় ম্যাপ আঁকা হয়ে /চলেছে, মুখ বিভাজিত হয়ে পড়েছে---
কবি ও সাহিত্য সম্পাদক ওবায়েদ আকাশের কবিতায় আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে জাদুবাস্ততাকে আমরা খুঁজে পাই। তাঁর ওবা
আঙুল কবিতার একটা অংশ এখানে তুলে ধরতে চাই।যেমন এক্ষুণি পালাল বৃষ্টিদৃশ্য, ফাঁকি দিয়ে/
তার পিঠভর্তি মেঘ, অনন্য আঙুলের ক্রাচ/দেখো, উড়ন্ত নীল, অসীমে--/বলেছি আগুনের ঘোড়া/আজ নমস্য বৃষ্টির দিনে পালাতে চেয়েছে--/আজ, উৎসব তাই--/আমরা বিস্তৃত অরণ্যের ঘুমে/আগুনের ঘোড়াগুলো উড়ে যেতে দেখি/
একুশ শতকের প্রথম দশকের কবিরা বাংলা কবিতায় নতুন মাত্রা দান করেন। প্রথম দশকের কবিদেও মধ্যে নাম থেকে অতনু তিয়াস, অবনি অনার্য, এহসান হাবীব, কাজী নাসির মামুন, তারেক আহসান, পিয়াস মজিদ,, মনির ইউসুফ, মাসুদ হাসান, রনি অধিকারী প্রমুখ। তাদের কারো কারো কবিতায় জাদুবাস্ততা উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। রনি অধিকারী একজন উদীয়মান কবি। তাঁর অনেক কবিতায়ই জাদুবাস্ততা ছোঁয়া আছে। উদাহরণ হিসাবে তাঁর লেখা রনি অধিকারী এই কবিতার কথা বলা যেতে পারে।
পথের মাঝেই পথ খুঁজে ফেরা
পথভোলা এক নির্মম রহস্য
যা ছুঁয়ে যায় হাজার রহস্যের কল্পতরু বীজ
এক-দুই-তিন এভাবে কেটেছে...
দিন-মাস-বছর- শতাব্দী।
আগুনের নদী হয়ে এভাবে জীবন
চলে বোধহয়!
অনিষ্ট সাধনে যেন বদ্ধ পরিকর
গুপ্ত হত্যাকারী মৃত্যুর উপহার সাজায়,
অতঃপর সমাধি।
কী এক অদ্ভুত মৃত্যু কুড়াতে কুড়াতে,
মৃত্যু কুড়ানি ছেলে... রহস্যময় হয়ে ওঠে,
সে এক সুন্দর সর্বনাশ!
মৃত্যু -সমাধি-শান্তি। শান্তি শান্তি
হত্যাকারী অনুশোচনায় থমকে দাঁড়ায়
দ্রাবিড় সভ্যতায়।আর আমি!
ভীরু ভালবাসায় ভৈরবীতে ভেসে
এসেছিলাম যেন নিদারুণ বেশে,
তখন অনুতাপের আগুনে পুড়ে
স্বর্গ হলো নিষিদ্ধ নগরী।
এভাবে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মগডাল উঠে
আচানক ভাবি -
মৃত্যুর মাঝেই যেন ফিরে আসে,
অনন্ত জীবন।
বাংলা কবিতায় জাদুবাস্তবতার অবস্থানের কথা বলতে হয় জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, কবি অচিন্ত্য সেনগুপ্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ওমর আলী, আল মামুদ, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখ কবিরা তাদের কবিতায় সচেতন কিংবা স্বভাবিক ভাবেই জাদুবাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। তরুণ প্রজন্মে অনেক কবিদের কবিতায় জাদুবাস্তবতা উপস্থাপন করে বাংলা কবিতায় নতুন মাত্রা দান করেছেন এবং করছেন। বারান্তরে তাদের কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ উপস্থাপনে সচেষ্ট হবো বলে আশা করি।