Next
Previous
Showing posts with label প্রবন্ধ. Show all posts
1

প্রবন্ধ - অনিরুদ্ধ গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in









আমাদের সময়ের কবি লিখেছেন –

বৃষ্টি এলেই আসবে কফি, কান টানলে মাথা
এক বিকেলে অফিস কেটে ঝুপ্পুস কলকাতা
আলতো ভাপে নাম লিখেছি কফি শপের কাচ
মেঘ যদি না ডাকে, তোমার আসতে বারণ আছে।


সত্যিই, মেঘলা দিনের প্রত্যাশী মন হোক, বা ল্যাপটপে চোখ আটকানো কাজের ব্যস্ত সময়, রাত জাগা পড়ার টেবিলেই হোক, কি চোখজুড়োনো পাহাড়ী দৃশ্য সামনে নিয়ে হোটেলের বারান্দা, বা বন্ধুসমাগমে নেহাতই অবসরের আড্ডা, এক ধুমায়িত কাপ কফি এখন আমাদের প্রায় অবশ্যম্ভাবী সঙ্গী হয়ে উঠেছে। মান্না দে যদিও সেই ১৯৮৩ সালে গেয়েছিলেন, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’, সে কেবল এক প্রজন্মের আক্ষেপ। পরের প্রজন্মরা আজও কফি হাউস মাতিয়ে রেখেছে। তার সাথে সাথে আনাচে কানাচে বিস্তার ঘটেছে, যাকে আজকাল বলা হয়, তৃতীয় লহরের কফি শপ বা ক্যাফে সংস্কৃতি। আসুন. এক কাপ কফি নিয়ে বসে একটু আড্ডা মারা যাক সেই কফি নিয়েই। ভারতের কফি।


উৎপাদন, রপ্তানি এবং আভ্যন্তরীন চাহিদা – এই সব দিক দিয়েই এখন আমাদের দেশে কফির রমরমা। ভারতে কফির উৎপাদন এবং ব্যবসার উন্নয়নবর্ধক স্বায়ত্বশ্বাশক সংস্থা কফি বোর্ডের প্রধান নির্বাহক বলছেন, ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরে দেশে কফির উৎপাদন ৩.৬ লক্ষ মেট্রিক টন হবার সম্ভাবনা, এবং পরের বছর তা আরও বাড়বে। ঐ বছরেই ভারত ১৫,৪০০ কোটি টাকার কফি রপ্তানি করেছে, তার মধ্যে প্রায় ৯,৫০০ কোটি টাকার কফি কেবল মাত্র কর্নাটক থেকে। কফি আবাদীরাও খুশী। এ বছর রোবাস্টা কফির ৫০ কেজির বস্তার জন্য তাঁরা ১২,০০০ থেকে ১৫,০০০ টাকা পেয়েছেন। মাত্র দু বছর আগেও তাঁরা পেতেন মেরেকেটে ৫,০০০ টাকা। তবে এই স্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হবার সম্ভাবনা কম। পৃথিবীতে উৎপাদন ও চাহিদায় ব্রাজিল অগ্রগণ্য দেশ। তারপর ভিয়েতনাম, কলম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া। গত বছর প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য ব্রাজিলের উৎপাদন বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের উৎপাদন বর্ধিত বিশ্বব্যাপী চাহিদা পূরণ করতে যথেষ্ট নয়। এই পরিস্থিতির সুবিধা পেয়েছেন ভারতের উৎপাদকরা। ব্রাজিল স্বমহিমা ফিরে পেলে চাকা ঘুরতে পারে। ভারতে উৎপন্ন কফির ৭০ শতাংশই রপ্তানি হয়ে থাকে।


ভারতে পানীয় হিসেবে কফির ব্যবহারের সব থেকে প্রাচীন বিবরণ পাওয়া যায় সপ্তদশ শতাব্দীতে। জাহাঙ্গীরের রাজসভায় ইংরেজ রাজার রাষ্ট্রদূত স্যার টমাস রো সাহেবের চ্যাপলেইন রেভারেন্ড এডোয়ার্ড টেরী আনুমানিক ১৬১৬ সালে একটি স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন:

“সেখানে অনেক মানুষই অত্যন্ত কঠোরভাবে তাঁদের ধর্মাচরণ পালন করেন এবং কোন রকম পানাসক্তি থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু একটি পানীয়, যাকে তাঁরা কফি বলেন, তাঁরা পান করেন, যা উপাদেয় তো বটেই, তারও বেশী স্বাস্থ্যকর। এক ধরণের কালো রঙের বীজ জলে সেদ্ধ করে এটি বানানো হয়, যার থেকে জলও সেই রঙ ধারণ করে, কিন্তু জলের স্বাদ সামান্যই পরিবর্তিত হয়। অথচ পাচনশক্তি বাড়ায়, শরীরে উদ্দীপনা আনে এবং রক্ত পরিশোধনেও সাহায়্য করে।“


কফি পানের প্রচলন হলেও এ দেশে কফি চাষের সূচনা তখনও হয়নি। তা শুরু হয় আরো কিছু বছর পরে, আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে। এই সম্পর্কে একটি মজার কাহিনী আছে।


কফি বিষয়ে গবেষকরা বলেন, সম্ভবত আফ্রিকাতে ইথিওপিয়ায় কফির প্রথম উৎপাদন শুরু হয়। সেখানে কলদি নামের এক ছাগপালক লক্ষ্য করেন, তাঁর ছাগলগুলি একটি বিশেষ উদ্ভিদের ফল খেয়ে অত্যন্ত তেজী আচরণ করছে। তখন তিনি এই গাছগুলি আবাদ করে তার ফল থেকে পানীয় প্রস্তুতি শুরু করেন। সেই ছিল কফির প্রথম মনুষ্যকৃত উৎপাদন ও ব্যবহার। ষোড়শ শতাব্দীতে কফি আরব দেশে ও পরে ইওরোপে প্রসার লাভ করে। সপ্তদশ শতকে আরব বা য়েমেন হয়ে উঠেছিল কফি রপ্তানির প্রধান কেন্দ্র। সে সময় আবার ভারত ছিল মধ্যপ্রচ্যে মশলাপাতি রপ্তানির শীর্ষে। ধরে নেওয়া যায়, তখন য়েমেন থেকে সমুদ্রপথে আরবসাগর হয়ে বা স্থলপথে পারস্যদেশ হয়ে কফির বীজ ভারতে আমদানী হতো। কিন্তু তা চাষের উপযুক্ত ছিল না। তার কারণ য়েমেন থেকে কফির বীজ শুধুমাত্র তাপে সেঁকা (roasted) বা সেদ্ধ অবস্থায় ছাড়া আর কোন ভাবে দেশের বাইরে পাঠানো নিষিদ্ধ ছিল। এর অন্যথা করে ধরা পড়লে কঠোর শাস্তি, এমন কি মৃত্যুদন্ডও, দেওয়া হত। এইভাবে য়েমেন কফির উৎপাদন ও ব্যবসা নিজেদের কুক্ষিগত ও একচেটিয়া করে রেখেছিল।


সেই সময় দক্ষিণ ভারতে এক সুফি সন্ত ছিলেন হজরত শাহ জামের আল্লাহ মাজরাবি। তাঁর অনুগামীদের কাছে তিনি বাবা বুদান নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে, সম্ভবত ১৬৭০ থেকে ১৬৯০ সালের মধ্যে কোন সময় তিনি হজ তীর্থভ্রমণে মক্কা গিয়েছিলেন। ফেরবার পথে তিনি আসেন য়েমেনের বন্দর শহর মোচাতে। সেখানে কফির বাড়বাড়ন্ত দেখে, এবং তার বীজ থেকে বানানো ‘কাহবা’ (পানীয়, যার অপভ্রংশ থেকে সম্ভবত কফি নামের উৎপত্তি) পান করে তিনি বিশেষ প্রভাবিত হন। কফির চাষ পদ্ধতি থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত কিভাবে পানীয় প্রস্তুত করা হয়, ইত্যাদি বিশদ বৃত্তান্ত অধ্যয়ন করে তিনি স্থির করলেন, ভারতে এই বস্তুটির কৃষিকাজ প্রয়োজন। কিন্তু তার জন্য চাই কাঁচা ফল বা বীজ যার চালান নিষিদ্ধ। অতএব আল্লাহকে স্মরণ করে তিনি করে বসলেন এক দুঃসাহসিক কাজ। ইসলাম ধর্মে সাত সংখ্যাটির মাহাত্ম্য আছে, এই সংখ্যাকে মঙ্গলকারী বা পয়মন্ত মনে করা হয়। তিনি সাতটি কফির বীজ তাঁর দাড়ির মধ্যে কোন প্রকারে লুকিয়ে রাখলেন। মতান্তরে তিনি তাঁর লাঠির ফাঁপা অংশে ঐ সাতটি বীজ লুকিয়েছিলেন। সংখ্যার মাহাত্ম্য বা তাঁর দাড়ির ঘনত্ব, যার জোরেই হোক, তিনি য়েমেনের সিকিউরিটি চেক নিরাপদে অতিক্রম করে দেশে ফিরে আসেন। অবশেষে নীলগিরি পর্বতমালার চন্দ্রগিরি পর্বতে তিনি ওই সাতটি অঙ্কুরিত কাঁচা বীজ রোপন করলেন। সময়ে গাছ বেরোল, ফুল ধরল, এবং অনেক ফলও উৎপন্ন হোল। তার বীজের অংশ পুনরায় রোপন করে আরও গাছ হল। এইভাবে ভারতে শুরু হল কফি চাষের প্রারম্ভ এবং বিস্তার। বাবা বুদানকে তাই দেশে কফি চাষের জনক বলা হয়।


এই গল্প সত্য বা নিছক লোক কাহিনী হতে পারে। কিন্তু বাবা বুদান এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। অধুনা কর্নাটকের চিকমাগালুরু জেলায় যে পর্বতে তিনি কফির চাষ করেছিলেন বলে কথিত আছে, তা এখন বাবা বুদান গিরি নামে পরিচিত। এই পাহাড়ে তাঁর মাজারও আছে, সেখানেই তাঁকে এবং তাঁর অনুগামী আরও দুজন সুফি সন্তকে হত্যা করা হয়। এই স্থানকে দত্তত্রেয় বাবা বুদান পীঠ বলা হয়। দত্তত্রেয় ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের যুগ্ম অবতার বলে মান্য একজন ঋষির নাম, তার সঙ্গে বাবা বুদানের কী যোগ ? যে গুহা দত্তত্রেয়র ধ্যানস্থল ছিল, সেখানেই বাবা বুদানও প্রার্থনা করতেন বলে কথিত আছে। দত্তত্রেয় অবধুত প্রথার অংশ। সব রকম আচার, বিধি, সংস্কার থেকে বিরত হয়ে এক নিরাকার ঈশ্বরের সাধনা, নিরাড়ম্বর, অহিংস জীবনযাপন এই প্রথার মূল দর্শন। সুফি তত্ত্বের সঙ্গে তার সাযুজ্য দেখা যায়। তাই দত্তত্রেয় বাবা বুদান গিরি দুই সম্প্রদায়েরই পীঠস্থান।


যাই হোক। ফিরে আসি কফির কথায়। ভারতে কফির চাষ অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রধানত ওলন্দাজদেরই নিয়ন্ত্রণে ছিল। তাঁরা মূলত নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী কফির আবাদ করতেন। ইংরেজদের আগমন ও ক্রমান্বয়ে প্রাধান্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে কফি চাষেও তাঁদের অংশীদারী বাড়লো। বেশী জমি-জায়গায় কফির চাষ হতে লাগলো এবং উৎপাদনও বাড়লো। কারণ ইংরেজরা ব্রিটেন এবং ইওরোপের অন্য অনেক দেশে ভারতে উৎপন্ন কফি বীজ রপ্তানিও শুরু করে।


স্বাধীনতার পর কফি ক্ষেত্রের মালিকানা পূর্ণভাবে ভারতীয়দের হাতে আসে। দেশে কফির উৎপাদন ও বিপণনে নিয়ন্ত্রণ ও সহায়তার জন্য স্বাধীনতার আগেই ১৯৪২ সালে ভারত সরকার ভারতীয় কফি বোর্ড স্থাপন করেছিল। এটি একটি স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা হলেও বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রকের অধীনস্থ। উৎপাদন ও রপ্তানির ব্যাপারে কফি উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের নানা রকম বিধিনিষেধের আওতার মধ্যে চলতে হত। যার ফলে উৎপাদন পরিসংখ্যানে অনেক বছর পর্যন্ত তেমন চমকপ্রদ কোন উন্নতি দেখা যায়নি। নব্বই দশকের মাঝামাঝি অর্থনৈতিক উদারীকরণ প্রক্রিয়ার পর, বিশেষ করে রপ্তানি এবং মূল্য ধারণের ক্ষেত্রে উৎপাদকরা অনেক স্বাধীনতা লাভ করেন। ফলত, উৎপাদন, ব্যবসা এবং লভ্যাংশও ক্রমবর্ধমানভাবে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।


কফি চাষের জন্য কতকগুলি বিশেষ পরিমন্ডলের প্রয়োজন। কফির প্রকারভেদে আবশ্যিকতা ভিন্নতর হলেও, সাধারণভাবে কয়েকটি প্রয়োজনীয়তা উল্লেখযোগ্য। মোটামুটিভাবে বলা যায়, মাঝারি ঢালু জমি, যেখানে জল বাহিত হয়ে নেমে যেতে পারে, জৈব সার সমৃদ্ধ উর্বর জমি, ১৫ থেকে ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা, ১৬০-১৭০ সেমি গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত, ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ আর্দ্রতা, এবং সমুদ্রস্তর থেকে ৭০০-১৫০০ মিটার উচ্চতা কফি চাষের জন্যে উপযুক্ত।


এই সব আবশ্যিকতার পরিপূরক জায়গা হল পশ্চিম ঘাট পর্বতমালা। তাই ভারতের কফি চাষের সিংহভাগ এই অঞ্চলেই হয়। দেশে যত কফি উৎপাদন হয়, তার ৭১ শতাংশ আসে কর্নাটকের নীলগিরি পর্বতশ্রেণীর উপত্যকায় অবস্থিত কোড়াগু বা কূর্গ, চিকমাগালুরু ও হাসান জেলা থেকে। এদের মধ্যে আবার একা কোড়াগু জেলাই ৩৩ শতাংশের অংশীদার। কেরালা (২১%) ও তামিল নাড়ু (৫%) অন্য দুই প্রধান উৎপাদক রাজ্য। এ ছাড়া উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতেও কফির আবাদি হয়। এখন অন্ধ্র প্রদেশ এবং ওড়িশাতেও পূর্ব ঘাট পর্বতাঞ্চলের উপত্যকাভুমিতে কফি উৎপাদন হচ্ছে।

বাবা বুদান গিরি

বড় বৃক্ষের ছত্রছায়ায় কফি গাছের চাষ

আমাদের দেশে কফি প্ল্যান্টেশনগুলির শ্যামলিমা এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। এখানে কফি গাছ রোপন করা হয় অন্য বড় বৃক্ষের আচ্ছাদনের (canopy) নীচে। কফি বাগানগুলিতে দেখা যাবে অনেক ফল এবং নানা রকম শিম গোত্রের ছায়া প্রদানকারী গাছ, তার সঙ্গে এলাচ, দারচিনি, তেজপাতা, লবঙ্গ, জায়ফল, গোলমরিচ ইত্যাদি মশলার গাছ কফির গুল্মদের ছত্রছায়া বিস্তার করে যেন সুরক্ষা প্রহরীর মত অবস্থান করছে। এই সব গাছ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতাই শুধু নিয়ন্ত্রণ করে না, এদের শুখনো ফুল-পাতা, এবং এই সব বৃক্ষ যে পাখীদের আকর্ষণ করে আনে, তাদের বর্য্যপদার্থ, মাটিকে জোগায় প্রয়োজনীয় জৈব সার, রোধ করে মাটির অবক্ষয়। সরাসরি সূর্যালোক না পাওয়ায় ফলগুলি বেশী বাড়ে না, কিন্তু ফলন পর্যাপ্ত হয়। ভারতই প্রধান দেশ যেখানে এই অনন্য পদ্ধতিতে কফি চাষ হয়। এই কফির গুণগত মানও উচ্চ, এর অম্লতা কম, সুবাস ও স্বাদ আকর্ষণীয়।


ভারতে প্রধানত দু’ ধরণের কফির চাষ হয়ে থাকে, প্রথমটি আরবিকা, এবং অন্যটি হল রোবাস্টা। এ ছাড়াও সময়ের সাথে কিছু ভিন্ন প্রজাতির বা সঙ্কর গোত্রীয় কফির উৎপাদন সীমিতভাবে হলেও আরবিকা ও রোবাস্টা বা তাদের জ্ঞাতিবর্গের কফিরই মুখ্যভাবে আমাদের দেশে চাষ হয়।


আরবিকাই আদি কফি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইওরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ায় যে কফি ছড়িয়ে পড়েছিল, এবং বাবা বুদান যা ভারতে প্রথম উৎপন্ন করেছিলেন, তা এই আরবিকা। এর গাছগুলি ১৫ ফিট পর্যন্ত বেড়ে উঠতে পারে, কিন্তু বাণিজ্যিক সুবিধার্থে ৬ ফিটের মত উচ্চতায় ছেঁটে দেওয়া হয়। আরবিকার বীজে অম্লতা ও ক্যাফেইনের পরিমান কম। স্বাদে মসৃণ, কড়া ভাব কম, কতকটা মিঠাপন আছে। গন্ধে হালকা চকোলেট বা এক ধরণের ফলজাতীয় সুবাস পাওয়া যায়। অন্য দিকে রোবাস্টা (যার আসল বৈজ্ঞানিক নাম ক্যানেফোরা) গাছ উচ্চতায় আরবিকার দ্বিগুণ হতে পারে। এর বীজে ক্যাফেন ও অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টের পরিমান বেশী। স্বাদে তীব্রতা ও ঈষৎ তিক্ততা বিদ্যমান। গন্ধে যেন রবারের আভাস পাওয়া।


রসিকদের কাছে আরবিকাই কৌলীন্য অর্জন করলেও রোবাস্টাও পিছিয়ে নেই। বিশ্বের ৬০ শতাংশ উৎপাদন আরবিকার হয়ে থাকে। ভারতেও ফলনের হিসেবে ঐতিহ্যগতভাবে আরবিকাই প্রাধান্য পেয়ে এলেও গত দেড়-দু দশকে রোবাস্টা তাকে অতিক্রম করে এখন সিংহভাগ, প্রায় ৭০ শতাংশ, লাভ করেছে। তার কারণ আছে। আরবিকার গাছ স্বভাব-চরিত্রে একটু কমনীয়, বলা যায় পলকা ধরনের। এর ফলগুলির সংক্রমণ এবং কীটের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। গত শতাব্দীতে এক ধরণের সংক্রমণ ভারত সহ বিশ্বের অনেক দেশে একাধিকবার আরবিকার ফলন নষ্ট করে দেয়। অন্য দিকে, অ্যাসিডিটি বা অম্লতা এবং অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট অধিক পরিমানে থাকার জন্য রোবাস্টা রোগ প্রতিরোধে অনেক শক্তিশালী। একই ক্ষেত্রফলের এলাকায় রোবাস্টা আরবিকার তুলনায় বেশী ফল যোগায়। এবং আরবিকার জন্য ঢালু জমি অপরিহার্য হলেও রোবাস্টা কিন্তু কম ঢালু , বা অনেক জায়গায় সমতল জমিতেও বেশ বেড়ে ওঠে।


কফি একটি বার্ষিক ফসল, এর ফলন বছরে একবারই হয়। গাছগুলিতে প্রথমবার ফুল আসতে তিন-চার বছর লাগে, কিন্তু তার পর ষাট বছর পর্যন্তও ফসল উৎপন্ন করে যেতে পারে। আমাদের দেশে ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাস কফি গাছে প্রস্ফুটনের সময়। এই সময়ে গাছগুলিতে থোকা থোকা সাদা ফুল আসে, সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। অনেকটা জুঁই ফুলের মত দেখতে এই ফুলগুলির হালকা সুবাসও অনেকটা জুঁইয়ের মত। প্ল্যান্টেশনগুলিতে এ সময়ে যাঁরা প্রথমবার কফি ফুলের শোভা দেখবেন এবং গন্ধ আঘ্রাণ করবেন, তাঁদের অনেকের কাছেই এগুলি বুনো জুঁইয়ের উদ্দাম প্রগলভতা বলে ভ্রম হতে পারে। সময়মত এবং পর্যাপ্ত ফুল আসার জন্য জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসে বৃষ্টিপাতের প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জলবায়ুর ক্রমবিবর্তনের ধাক্কায় প্রধান কফি অঞ্চল দাক্ষিণাত্যে এই বর্ষণ আজকাল সব সময় নির্ভরযোগ্য নয়। তাই ইদানীং প্ল্যান্টেশনগুলিতে দেখা যাবে স্প্রিঙ্কলারের সাহায্যে জল ছিটিয়ে কৃত্রিম বর্ষণ উপায়ে সেচন করা হয়।

কফির ফল
  কফি বীজ

কফি ফুলের শোভা




কফি ফুলগুলির আয়ু মাত্র তিন-চার দিন। তারপর তাদের পাপড়ি একে একে ঝরে পড়ে। তবে তার আগেই ফুলের বাহারে-গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ছুটে আসে মৌমাছি আর পিঁপড়ে ইত্যাদি পোকামাকড়। পরাগায়ন অর্থাৎ pollination প্রক্রিয়ায় এদের ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য আরবিকার ক্ষেত্রে স্ব-পরাগায়ন সম্ভব, কারণ এদের ফুলে দু’ ধরণের ক্রোমোজোমই বর্তমান। রোবাস্টার জন্য পারস্পরিক পরাগমিলন বা cross pollination জরুরী। দেখা গেছে মৌমাছিদের বদান্যতায় দু’ ধরণের কফিতেই কিন্তু ফলন বৃদ্ধি পায়। তাই অনেক কফি উৎপাদকরা আবার মৌ-পালনও করে থাকেন। কফি ফুলের পাপড়ি থেকেও এক প্রকার চা তৈরী হয়। ফুলের পাপড়িগুলি ঝরে গেলে দেখা যায় ছোট্ট সবুজ রঙের গুটির মত ফলের আবির্ভাব। এই ক্ষুদ্র সবুজ ফলগুলি ধীরে ধীরে পরিনত হয়ে লাল, হলদেটে-লাল বা চেরি ফলের মত বেগুনি রঙ ধারণ করে, আকারেও বেড়ে ওঠে। এই অবস্থায় গুচ্ছ গুচ্ছ ফল সমারোহে গাছগুলির শোভাও এক দেখবার মত দৃশ্য। কফি ফলের পরিপক্কতার প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ। আরবিকার ক্ষেত্রে লাগে প্রায় সাত মাস, আর রোবাস্টার জন্য প্রায় ন’ মাস। কফির ফলকে cherry, berry এবং বীজগুলিকে beans বলা হয়ে থাকলেও এরা কিন্তু এদের গোত্রীয় নয়। চেরি বা বেরী ফলে মাত্র একটি করে বীজ থাকে, শতকরা ৯০ ভাগ কফির ফলেই থাকে দুটি করে বীজ। আর বীজগুলি মোটেই bean বা শুঁটি জাতের ফসল নয়।


ফল পাকবার পর সেগুলি বেছে বেছে আহরণ করে সংগ্রহ করাও শ্রমসাধ্য ব্যাপার, এবং আমাদের দেশে অধিকাংশত তা মানবিক শ্রমভিত্তিক। এই সব প্রক্রিয়া প্রতি বছর অনেক মানুষের কর্মসংস্থান করে। যাই হোক, এর পর আসে ফল থেকে বীজ নিষ্কাশনের পর্যায়। প্রধাণত দুই পদ্ধতিতে তা হয়ে থাকে। প্রথমটি প্রাচীন এবং আদি উপায়। একে বলা যায় শুষ্ক পদ্ধতি বা dry process। ফল সংগ্রহের পর পরিষ্কার করে ধুয়ে নিয়ে তা ছড়িয়ে বিছিয়ে দেওয়া হয় রোদে শুখানোর জন্য। কোড়াগু বা চিকমাগালুরের কফি এস্টেটগুলিতে গেলে ঘরে ঘরে দেখতে পাওয়া যাবে সমতল খালি জায়গা বা উঠোন যেখানে কফি ফল শুখানো হয়। পর্যাপ্ত সূর্যালোক পেলে প্রায় চার সপ্তাহ লাগে সঠিক শুষ্কতা আনতে, অর্থাৎ ফলগুলিতে জলের আর্দ্রতা ৬৫-৭০ শতাংশ থেকে ১২-১৩তে কমিয়ে আনতে। খুব বেশী শুখিয়ে ফেললে আবার বীজ ভঙ্গুর হয়ে যায়। এর পর যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফলের খোসা, শাঁস ইত্যাদি বাদ দিয়ে বীজ বার করে আনা হয়। যে সব অঞ্চলে সূর্যালোক এবং উত্তাপ সহজপ্রাপ্য নয়, সেখানে এই পদ্ধতি চলে না। সে সব জায়গায় বীজ নিষ্কাশনের প্রক্রিয়াকে বলা হয় আর্দ্র পদ্ধতি বা wet process। এই পদ্ধতি অনেকটাই যান্ত্রিক এবং বেশী ব্যয়সাপেক্ষ, তবে নাকি এতে করে বীজের গুণগত মানও বজায় থাকে বেশী। অধিকাংশ আরবিকা বীজ এই পদ্ধতিতে নিষ্কাশন করা হয়। এখানে পাকা ফল না শুখিয়ে শাঁসালো অংশ আগেই যান্ত্রিক উপায়ে অপসৃত করা হয়। তার পরও একটা পাতলা আবরণ বীজের গায়ে লেগে থাকে। সেটিকে প্রাকৃতিক এনজাইমের সাহায্যে একটি আধার বা ট্যাঙ্কের মধ্যে দু-তিন দিন রেখে ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়ায় সরিয়ে ফেলা হয়। এর পর বীজগুলি ভালো করে ধুয়ে নিয়ে রোদে বা গরম হাওয়া চালিয়ে শুখানো হয়। বীজের বাইরের শুখিয়ে যাওয়া অংশ, যাকে বলা হয় পার্চমেন্ট, তা যান্ত্রিক উপায়ে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। কাঁচা বীজকে অভিপ্রেত শুষ্কতায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়াকে বলা হয় সেঁকানো বা roasting।


এই দুই পদ্ধতি ছাড়া আর এক, একটু অদ্ভুত, উপায়েও কফি ফল থেকে বীজ বার করার চলন আছে, তবে খুবই সীমিত পরিসরে। আমাদের দেশে এবং দক্ষিণ এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশে বিড়াল প্রজাতির এক জন্তুর নাম Asian palm civet, যাদের বাংলায় বলা হয় গন্ধগোকুল বা খাট্টাস। অরণ্যবাসী এই নিশাচর প্রাণীটি অন্য ছোট জীব শিকার করে খেলেও পাকা ফলই এদের প্রিয় ও প্রধান খাদ্য। এরা বেছে বেছে কফির পাকা ফল খেয়ে তার শাঁসালো অংশ নিপূণভাবে হজম করে ফেলে। তারপর অপাচ্য বীজগুলি তাদের বিষ্ঠার সঙ্গে বর্জ্য পদার্থ হিসেবে বেরিয়ে আসে। সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে নিষ্কাশিত এই বীজ সংগ্রহ করে যথাযথ ভাবে পরিশোধন করে নেওয়া হয়। শুনতে বিদঘুটে লাগলেও কফির দুনিয়ায় সিভেট কফি একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পণ্য, এর মুল্যও বেশ ভারী।


ব্রিটিশদের সময় থেকেই কফি বীজ ভারত থেকে ইওরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো, সে যুগে সমুদ্রপথে কাঠের আধারে করে। কেপ অব গুড হোপ বা উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ইওরোপ পৌঁছতে লেগে যেত প্রায় ছ’ মাস। এই দীর্ঘ সময়ে সাগরের লবনাক্ত আর্দ্র পরিমন্ডল, বিশেষ করে বর্ষণসিক্ত জলহাওয়া, কফির বীজগুলিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটাতো। আর্দ্রতা শোষণের ফলে বীজগুলি হয়ে উঠতো আকৃতিতে স্ফীত, রঙে ফেকাসে। অম্লতা অনেকাংশে হ্রাস পেতো। এর থেকে যে পানীয় তৈরী হতো, তার স্বাদে কড়া ভাব ও তিক্ততা কম হতো এবং মসৃনতা বৃদ্ধি পেতো, আর তা ছিল সাহেবদের বেশ পছন্দ। উত্তরোত্তর পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমাগত উন্নতি ঘটার ফলে যাত্রার সময় কম হয়ে আসার কারণে বীজের মধ্যে সেই পরিবর্তন আর রইলো না। ভারতীয় কফির জনপ্রিয়তা পশ্চিমে কমতে শুরু হলো। আমাদের দেশের রপ্তানিকারকরা তখন এক অভিনব পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন। চালান করার আগে পশ্চিম উপকুলের সামুদ্রিক পরিবেশে প্রাকৃতিক হাওয়া চলাচল করতে পারে এমন সব গুদামে বাছাই করা বীজ এখন বর্ষাকালে ১২ থেকে ১৬ সপ্তাহ রেখে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে লব্ধ কফিকে বলা হয় Monsoon Malabar Coffee এবং এই কফি এখন ভারতের ভৌগলিক ইঙ্গিত (geographical indication) পণ্য আইনে সংরক্ষিত।


রোস্টিংয়ের পর বাজারজাত হবার আগে কফি প্রায়শই আরও একট পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যায় যাকে বলা হয় সংমিশ্রণ বা blending। প্রজাতি, উৎপত্তিস্থল এবং কৃষিপদ্ধতির ওপর নির্ভর করে প্রত্যেক শ্রেণীর কফির গুণগত বৈশিষ্ট্য আছে, স্বাদ-গন্ধের অনন্যতা লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন ধরণের কফিকে নির্দিষ্ট শতাংশে ভালোভাবে মিশ্রিত করাই blending । এতে মিশ্রিত কফির মধ্যে প্রত্যেক বীজের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের সুষম মিলন ঘটিয়ে, বলা যায়, নতুন রকমের গুণগত এক এক কফি নির্মিত হয়। এই মিশ্রণ আরবিকা ও রোবাস্টার হতে পারে, আবার ব্রাজিলের আরবিকার সঙ্গে কলম্বিয়ার আরবিকার হতে পারে, বা ভারতের ও ইন্দোনেশিয়ার রোবাস্টার সঙ্গে পশ্চিমের আরবিকার হতে পারে, এবং বিভিন্ন শতাংশেও হতে পারে। এমন কতই মিশ্রণ ঘটিয়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কফি বাজারে আসে।


চিকোরি ফুল ও শিকড়



কফি বীজের সংমিশ্রন (blending) হচ্ছে

কফি যখন গুঁড়ো পাউডার হয়ে বাজারে আসে, তখন প্যাকেটের ওপর আরেকটি উপাদানের উল্লেখ আপনারা দেখতে পাবেন। এর নাম চিকোরি। এই চিকোরি বস্তুটি কী ? এটি একটি উদ্ভিদের নাম। এর ফুলগুলি নীল রঙের, পাতায় ও শিকড়ে ওষধিগুণ আছে বলে সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই ব্যবহৃত হবার উল্লেখ পাওয়া যায়। কফি পাউডারে যা মিশ্রণ করা হয় তা এর শিকড়। শিকড়কে শুখিয়ে গুঁড়ো করে কফি পাউডারের মতই দেখতে খয়েরী রঙের একটি চূর্ণ পাওয়া যায়। স্বাদেও কফির মত বলে, ঐতিহাসিক সময়ে যখনই কফি মহার্ঘ্য হয়েছে, যেমন আমেরিকার গৃহযুদ্ধ, বা বিশ্বযুদ্ধ, বা পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক আকালের সময়ে, বিকল্প হিসেবে অথবা মিশ্রিত করে চিকোরি কফির পরিপূরক স্থান পেয়েছে। এখন কফি পাউডারে কিছু শতাংশ চিকোরি মিশ্রণ প্রায় অনিবার্য। এমনিতে এর স্বাদ বেশ তিক্ত এবং এক ধরণের কেঠো গন্ধ আছে। কিন্তু কফির সঙ্গে মেশালে কফির স্বাদে বলিষ্ঠতা এবং গভীরতা এবং গন্ধে নতুন মাত্রা আনে। প্রধাণত ভুমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলিতে পাওয়া গেলেও এখন বিশ্ব জুড়েই চিকোরির আবাদ হয়।


এবার একটু জানা যাক কফির পানীয় প্রস্তুত করার প্রণালী বা brewing সম্বন্ধে। কফি নির্যাস বানানোর জন্য প্রয়োজন একটি আধার যার মধ্যে থাকে একটির ওপর আরেকটি রাখা তিনটি প্রকোষ্ঠ। সব থেকে সরল এবং পুরোনো পদ্ধতি হল ভারাকর্ষণ বা gravity পদ্ধতি। একটি ছাঁকনি অথবা ফিল্টার কাগজের ওপর গুঁড়ো কফি মাঝের প্রকোষ্ঠে রেখে ওপর থেকে ধীরে ধীরে গরম জল ঢালা হয় যা কফির ভেতর দিয়ে বাহিত হয়ে নীচে রাখা পাত্রে চুঁইয়ে চুঁইয়ে বিন্দু বিন্দু জমা হয়। এই তরলকে বলা হয় decoction। দক্ষিণ ভারতে গরম দুধ ও চিনির সঙ্গে মিশিয়ে ঘরে ঘরে এই ‘ফিল্টার কাপি’ পানের চলন বহুকাল থেকেই সমানভাবে জনপ্রিয়। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে ওপরের প্রকোষ্ঠে পিস্টন দিয়ে চাপ সৃষ্টি করে গরম জলকে অপেক্ষাকৃত দ্রুত বেগে কফি পাউডারের ভেতর দিয়ে তলার প্রকোষ্ঠে পাঠানো হয়। একে বলে French press প্রণালী। এতে নাকি কফির ক্যাফেন, অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট ইত্যাদি গুণগত আবশ্যিক উপাদানগুলি নির্যাসের মধ্যে অধিক মাত্রায় মজুদ থাকে। আর একটি পদ্ধতিতে নীচের প্রকোষ্ঠে জল ফোটানো হয়। বাষ্প হয়ে কফি পাউডারের মধ্যে দিয়ে পরিচালিত হয়ে ওপরের প্রকোষ্ঠে ওঠে এবং ক্রমে ঠান্ডা হয়ে নির্যাস হয়ে জমা হয়। এমনি সব প্রক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরণের কফি প্রস্তুতকারক যন্ত্র বাজারে পাওয়া যায়। কফির নির্যাস বানানো একটু সময়সাপেক্ষ। আজকের চটজলদির যুগে যাদের সময়ের অভাব, তাদের জন্য এসেছে ইনস্ট্যান্ট কফি। কেবল গরম জলে গুলে নিলেই কফি তৈরী, কোন তলানি গুঁড়োও থাকে না। তবে খানদানী কফি রসিকরা এ কফি পছন্দ করেন না।


আমেরিকায় কফি পানের ইতিহাসে তিনটি লহর বা waveকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যে সব বিশেষত্বের নিরিখে এদের কাল বিভাজন করা হয়েছে, সেগুলি অনুসরণ করলে পৃথিবীর অন্যত্র এবং ভারতেও এই তিন লহরকে নির্ধারণ করা যেতে পারে। বহু বছর ধরে কফি এ দেশে চিরাচরিত উপায়ে প্রস্তুত করে পরিবেশিত হত অথবা ইনস্ট্যান্ট কফি পান করা হত, সেখানে কফির উৎস বা প্রস্তুতি পদ্ধতিগত বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি মুখ্য ছিল না। কফি ছিল মোটামুটি সর্বসাধারণের সামর্থ্যের মধ্যে। কফি বোর্ড পরিচালিত কফি হাউসগুলি এবং ছোট-বড় রেস্তোরাঁ এই পর্বের ধারক ও বাহক। কফি তখন বড় শহরগুলিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। বলা বাহুল্য, কফির এই প্রথম লহর কিন্তু আজও বেশ জনপ্রিয়। ১৯৯৬ সালে ক্যাফে কফি ডে’র আবির্ভাব নিয়ে এল ক্যাফের সংস্কৃতি। এঁরা কফির উৎসস্থানগত বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দিলেন। সেই সঙ্গে জোর দিলেন ক্যাফেকে এক উপভোগের জায়গা করে তুলতে, যেখানে এক কাপ কফিকে সঙ্গী করে অবসর সময়ও কাটানো যায়, আবার কাজের কাজও করা যায়। তাছাড়া দ্বিতীয় স্তরের শহরগুলিতেও কফিকে ছড়িয়ে দিতে এঁদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেই ধারাকেই এগিয়ে নিয়ে গেল ২০১১ সালে টাটা গোষ্ঠীর সহযোগে বহুজাগতিক শৃঙ্খলা স্টারবাকসের আগমন। বিভিন্ন প্রজাতির ও ধরণের কফিকে এঁরা ভারতে নিয়ে এলেন। সেই সঙ্গে কফির সাথে রকম রকম সুগন্ধি, পানীয় ইত্যাদির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে কত বিচিত্রভাবে কফিকে উপভোগ করা যায়, তার বহুবিধ বিকল্প তাঁরা গ্রাহকদের উপলব্ধ করলেন। কফির গুণমান উন্নত করতেও এঁদের প্রয়াস উল্লেখযোগ্য। গত দু’ দশকে কস্টা কফি, থার্ড ওয়েভ কফি ইত্যাদি ব্র্যান্ডেড কফি শৃঙ্খলা সহ ছোট বড় অনেক ক্যাফের প্রাদুর্ভাব শহরে শহরে ঘটেছে।


কিন্তু তৃতীয় লহর বা Third Wave চিহ্নিত হয়েছে speciality coffee বা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কফি দিয়ে। ভৌগলিক স্থানগত বিশেষত্ব, ত্রুটিহীন কাঁচা বীজ নির্বাচন থেকে শুরু করে বীজের প্রক্রিয়াকরণের প্রত্যেক স্তরে গুণগত মান বজায় রাখা, এমন কি যে জল ব্যবহৃত হবে তার মান ইত্যাদি, এবং শেষে প্রস্তুত কফির স্বাদ ও গন্ধের অনন্যতা, এত সব ব্যাপারের নিরিখে সেই কফি বিশিষ্টতার তখমা পাবে কি না, তা নির্ভর করে। স্পেশিয়ালিটি কফি অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি সংস্থা মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে বিচার করে নির্ধারণ করেন কোন কফি গুণবত্তার মাপকাঠিতে কত উন্নত মানের। ৯০এর ওপর নম্বর পেতে পারলে সেই কফিকে স্রেষ্ঠ বলে গণ্য করা হয়।

দক্ষিণ ভারতের ‘ফিল্টার কাপি’


ঐতিহ্যবাহী কফি হাউস


আজকের কফি শপের কফি

আজকের ক্যাফেতে পুরোনো সেই একই ধরণের কফির জায়গায় পাবেন হরেক রকমের কফি। গরম কফি চাইলে নির্বাচন করুন কালো আমেরিকানো বা ফেনিল এসপ্রেসো, অথবা দুধ মেশানো লাটে, ক্যাপুচিনো, মোকা ইত্যদির মধ্যে থেকে। ঠান্ডাই পছন্দ ? তাহলে বেছে নিন নিছক বরফ মেশানো কালো কফি, না হলে ভ্যানিলা, ক্যারামেল, চকোলেট, ক্রীম, আইসক্রীম ইত্যাদির মিশেলে তৈরী সম্ভার। আপনার রুচি আর পছন্দমত কফি অচিরেই বানিয়ে দেবেন ব্যারিস্টারা। সেই ১৯৪৬ সালে ফ্র্যাঙ্ক সিনাট্রা গেয়েছিলেন, ‘They’ve got an awful lot of coffee in Brazil’, আজ এ দেশে থাকলে তিনি নিশ্চয়ই বলতেন, ‘ভারতেও তো এখন দেখছি কফির হরেকরকমবা’ !
0

প্রবন্ধ - সব্যসাচী রায়

Posted in








আপনি কিছু বুঝতে পারছেন না। কারণ আপনি ভাবছেন, যদি কাউকে আটকানো হয়, তাহলে আদালত বসবে, বিচারক থাকবে, আইনজীবী থাকবে, কাগজপত্র থাকবে। কিন্তু এখানে নেই কিছুই। আছে শুধু একটা প্যাটার্ন। একটা অ্যালগরিদম। আর শর্তাবলী, যা আপনি কখনও পড়েননি—ক্লিক করেছেন “অ্যাকসেপ্ট” করে। এখন সেটাই যথেষ্ট। কোনও আদালতের আদেশ নেই। কোনও সাক্ষর লাগে না। শুধু নীরবে, ধীরে ধীরে আপনার অধিকারগুলো সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনভাবে, যেন আপনি ভুলেই যান যে কখনও সেই অধিকার ছিল।

২০০১ থেকে অ্যালগরিদমিক নাগরিকত্বের উত্থান। ২০০১ – “প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট”—নামটা শুনলেই বোঝা যায় কতটা দেশপ্রেমিক! এর আড়ালে শুরু হল নাগরিকদের উপর নজরদারি। ২০০৮ আর্থিক ধসের পর জন্ম নিল “ঝুঁকি-পূর্বাভাস” শিল্প। ২০১৩, স্নোডেন ফাঁস করল গোটা মেটাডেটা নজরদারির খেলা। আমরা কাঁধ ঝাঁকালাম। ২০১৬–২০২০, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ঢুকে পড়ল চাকরির ইন্টারভিউতে, টেলি-হেলথে, মেজাজ মাপার সফটওয়্যারে। ২০২০, হেলথ সার্ভেইল্যান্স হয়ে গেল “স্বাভাবিক।” ২০২১–২০২৩, সেফটি আর ওয়েলনেস নামে ভবিষ্যদ্বাণী করা এআই মেইনস্ট্রিম হয়ে গেল। ২০২৪–এখন, ট্রাস্ট স্কোর, ইমোশনাল প্রোফাইল, ঝুঁকি মডেল ঢুকে গেছে আপনার প্রতিদিনকার অ্যাপে। অপ্ট আউট করার সুযোগ নেই।

ওয়েলনেস অ্যাপস (মমতার আড়ালে নজরদারি?): ঘুম মাপা? মুড ট্র্যাক করা? কেমন নিরীহ, তাই না? কিন্তু আপনার ঘুম ভেঙে তিনটের সময় অনলাইন শপিং করলে সেই অ্যাপ বলে দেয় আপনি “আবেগিকভাবে অস্থির এবং আর্থিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।” এবং সেই ডেটা চলে যায় বীমা কোম্পানির ঝুঁকি মডেলে। আপনি ভাবছেন, অ্যাপটা কেবল মজার কোটস দিচ্ছে? হ্যাঁ, সেই কোটসের পেছনে নীরবে বীমার প্রিমিয়াম পাল্টে যাচ্ছে।

এআই ঝুঁকি স্কোরিং, হাসি মাপা হয়, গলা মাপা হয়। আপনার এইচআর ইন্টারভিউ এখন আর শুধু কথার উপর নির্ভর করে না। আপনার মুখের ভঙ্গি, চোখের পলক, ইমেইলের টোন—সব বিশ্লেষণ করছে অ্যালগরিদম। আপনি স্ল্যাক-এ কম উত্তর দিচ্ছেন? কল মিস করছেন? আপনার নামের পাশে লেগে যাচ্ছে “ইমোশনালি কম রেজিলিয়েন্ট” ট্যাগ। অফিস শেষে গাড়িতে বসে কাঁদলে? সেটা-ও ঝুঁকি সংকেত।

মেন্টাল হেলথ প্রোফাইলিং। BNPL (বাই নাউ পে লেটার) অ্যাপ আপনার ফোন মডেল, ইমোজি ব্যবহার, রাতের শপিং—সব যোগ করে ঠিক করছে আপনি “বিশ্বাসযোগ্য” কিনা। একইসাথে, আপনার সার্চ হিস্টরি দেখে বলছে আপনি ডিপ্রেশন প্রবণ কিনা।

টেলিহেলথ আর চ্যাটবট থেরাপি। এআই থেরাপিস্ট নোট করেছে, “দীর্ঘস্থায়ী দুঃখ।” আপনি ফলো-আপ করেননি। ডেটা চলে গেছে “নন-কমপ্লায়েন্ট” ট্যাগে। পরের ডাক্তার বলে দিল, “দুঃখিত, আমরা এখন নতুন পেশেন্ট নিচ্ছি না।”

সেফটি ফিল্টার আর প্রেডিক্টিভ পুলিশিং। আপনি ইনস্টাগ্রামে ভুল মেম শেয়ার করেছেন। একটা রাজনৈতিক হ্যাশট্যাগ বেশি ফলো করেছেন। অ্যালগরিদম ভুল বুঝেছে। আপনাকে ব্লক করেনি। শুধু কম রিচ দিয়েছে, পোস্টে কেউ সাড়া দেয় না। আপনি হয়ত টেরই পাবেন না, শুধু ভাববেন “অ্যালগরিদম খারাপ চলছে।”

এখনকার টুলস। হায়ারভিউ – মুখের ভঙ্গি দেখে চাকরির ইন্টারভিউয়ের স্কোর দেয়। পিমেট্রিক্স – নিউরোসায়েন্স গেম দিয়ে আপনার “ইমোশনাল এজিলিটি” মাপে। প্যালান্টির – সরকার আর পুলিশের প্রেডিক্টিভ মডেল চালায়। সিফট – আপনার অনলাইন ব্রাউজিং, কেনাকাটা থেকে ট্রাস্ট স্কোর বানায়। অনফিডো – মুখ চিনে আচরণ প্রোফাইল তৈরি করে। বেটারহেল্প এবং টকস্পেস – “অ্যানোনিমাইজড” ডেটা বেচে মানসিক স্বাস্থ্যের ট্রেন্ড বানায়। বেনেভোলেন্টএআই – আপনার মানসিক স্বাস্থ্য ডেটা “অপ্টিমাইজ” করে। (মানে: ট্র্যাক করে, টার্গেট করে।)

ডিজিটাল জাতপাত। এখন এই জাতপাত কাগজে লেখা নয়। এটা আপনার ইমোশনাল টেম্পারেচার দিয়ে মাপা হয়। নতুন নাম: “ডিজিটাল ওয়েলনেস প্রোটোকল”, “ইউজার ট্রাস্ট অ্যালগরিদম”, “হার্ম রিডাকশন ফ্রেমওয়ার্ক”, “বিহেভিয়রাল অ্যাস্যুরেন্স স্কোর”। আসলে বলছে: “আমরা আপনার আত্মার স্কোরিং অটোমেট করেছি।” আপনি এখন থার্মোস্ট্যাটের মত, শুধু আপনার এঙ্গজাইটি বেশি।

এগুলো কাল্পনিক নয়। হিথ্রোতে এক মহিলাকে বোর্ডিংয়ে আটকানো হল, কারণ তার ট্র্যাভেল হিস্ট্রিতে “মেন্টাল হেলথ ফ্ল্যাগ।” এক ডেলিভারি পার্টনার উবার ইটস থেকে বাদ পড়ল, কারণ তার প্যাটার্ন “অস্বাভাবিক।”আপনাকে সরাসরি ব্যান করা হয়নি, শুধু আপনার পাশে লেখা হয়েছে: “লো ভ্যালু।” নতুন ব্ল্যাকলিস্ট। আপনি একা নন। আপনার বন্ধুর ডেটা, ভাইবোনের দেউলিয়াত্ব, রুমমেটের লেট পেমেন্ট—সব মিলিয়ে যাচ্ছে। কে আসলে করেছে তা জরুরি নয়, আপনি কার সঙ্গে মিশছেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। অ্যালগরিদমিক দোষ ভাগাভাগি। এটাই ডিজিটাল টেম্পারামেন্ট ট্রেনিং। আপনাকে ‘সফটনিং আপ’করা হচ্ছে। ছোট করা হচ্ছে। “কমপ্লায়েন্স” এর জন্য নতুন করে গড়া হচ্ছে।

গভীরতর সমস্যা। এই সিস্টেমটা আপনাকে কেবল আটকাচ্ছে না, বদলে দিচ্ছে, জানিয়ে দিচ্ছে আপনি কেমন মানুষ হবেন। আপনি রাত জাগতে ভয় পাচ্ছেন কারণ ফোন মাপছে। আপনি মুড লিখতে ভয় পাচ্ছেন কারণ সেই মুড কোথাও গিয়ে ডেটা হয়ে যাচ্ছে। আপনি আস্তে আস্তে এক অ্যালগরিদমিক শিষ্টাচার তৈরি করছেন—যেন মেশিনকে খুশি রাখতে হবে। আপনার হাসি, রাগ, প্রেম—সব কিছু ফিল্টার হয়ে যাচ্ছে যেন আপনি “ঝুঁকিপূর্ণ” না হন।

এটাই আসল বিপদ। আপনি নিজের নয়, কারও ডেটা মডেলের সংস্করণ হয়ে যাচ্ছেন। আপনি একটা ‘ঝুঁকি প্রোফাইল’। এক ‘ট্রাস্ট স্কোর’। এবং এর মধ্যে কোনও মানবিক বিতর্ক নেই। কোনও ভোট নেই। কোনও প্রতিবাদ নেই—কারণ আপনি জানেন না ঠিক কিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। একদিন দেখবেন, আপনি শুধু নিজের অধিকার হারাননি, নিজের স্বভাবটাই হারিয়ে ফেলেছেন।

এখানে আসল প্রশ্ন শুধু প্রযুক্তি নয়, নৈতিকতা। যে অ্যালগরিদম আমাদের ঝুঁকি মাপে, সেটা কে বানায়? তার মানদণ্ড কী? আপনি কি জানেন, এই মডেলগুলোর অনেকটাই ট্রেন হয় পুরনো পক্ষপাতের বর্ণ, লিঙ্গ, আর্থিক অবস্থা? ফলাফল: পুরনো বৈষম্য নতুন নামে ফিরছে। ডিজিটাল জাতপাত।

একটা সময় ছিল, মানবাধিকার মানে ছিল: “আপনি মানুষ বলেই কিছু অধিকার আপনার।” এখন অধিকার মাপা হচ্ছে আপনি কতটা “লো রিস্ক।” যদি আপনার বন্ধুর দেউলিয়াত্ব, মুড সুইং, বা পুরনো কোনও রাজনৈতিক পোস্ট আপনার নামের পাশে ঝুঁকি যোগ করে, আপনি অজান্তে এক অদৃশ্য নিম্নস্তরের নাগরিক হয়ে যাচ্ছেন। এটা শুধু ব্যক্তি নয়, সমাজকেও পাল্টে দিচ্ছে। মানুষ খোলামেলা কথা বলার বদলে অ্যালগরিদম-বান্ধব আচরণ শিখছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কাগজে আছে, কিন্তু বাস্তবে কমে যাচ্ছে—কারণ অ্যালগরিদমিক ভয়। এর ফলে তৈরি হচ্ছে এমন একটা সংস্কৃতি যেখানে সবাই একটু বেশি নীরব, একটু বেশি সাবধানী, একটু বেশি নিরপেক্ষ দেখাতে চায়।

প্রশ্ন হলো: আমরা কি এমন সমাজ চাই যেখানে মেশিন আমাদের চরিত্র নির্ধারণ করবে? যেখানে নৈতিকতা আর মানবিক ভুলের জায়গা নেই, শুধু ডেটা প্যাটার্নের জেল? এই প্রশ্ন এখনই করতে হবে—কারণ একবার প্যাটার্ন লিখে গেলে, তা মুছতে পারবে না কেউ।

শেষে, আপনার আচরণ এখন “কনটেন্ট।” আপনার মুড এখন “মেট্রিক।” আপনার সুনাম এখন একটা অদৃশ্য শেয়ারবাজারে কেনাবেচা হচ্ছে। কোনও অনুমতির দরকার নেই, শুধু প্যাটার্ন চাই। আপনি আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন না। আপনাকে শর্তাবলীর মাধ্যমে বন্দি করা হচ্ছে। আপনার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়নি, আপনাকে শুধু “ঝুঁকি মিটিগেশনের জন্য রিক্যালিব্রেট” করা হয়েছে। কোনও বিচার নেই। কোনও আপিল নেই। কোনও নোটিফিকেশন নেই।

শুধু একদিন দেখবেন: আপনি একটু কম দেখতে পাচ্ছেন, একটু কম বুঝতে পারছেন। আর এক কোণে পড়ে আছে সেই মানসিক ওয়েলনেস সার্ভে, যা আপনি কখনও শেষ করেননি।এই সবই, এখনো পর্যন্ত পাশ্চাত্য, বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রগতি। কিন্তু আমরাও একই পথে যাচ্ছি।
0

প্রবন্ধ - সব্যসাচী রায়

Posted in




















২০ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে ২১শ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত ভারত ও বহুজাতিক কর্পোরেশন (এমএনসি)–এর সম্পর্ক মর্মান্তিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। প্রাথমিকত উপনিবেশিক প্রয়োজন দ্বারা পরিচালিত এবং পরবর্তীতে সার্বভৌম অর্থনৈতিক নীতির দ্বারা পরিচালিত, ভারতের বৈশ্বিক পুঁজির সঙ্গে সম্পৃক্ততা কখনো স্বাগত, কখনো সংরক্ষণবাদ, তারপর মুক্তিবাদ এবং সাম্প্রতিককালে সূক্ষ্ম সন্দেহের মধ্যে দোলাচ্ছল করেছে। এই প্রবন্ধে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে তুলনা এবং বৈপরীত্যের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করব—কীভাবে ভারতের এমএনসির প্রতি নীতি গঠিত হয়েছে, সহযোগিতা বা দ্বন্দ্বের কারণগুলি কী ছিল, এবং এর জাতীয় উন্নয়ন ও কর্পোরেট কৌশলের উপর প্রভাব কী কী।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: সাম্রাজ্যবাদী শুরু ও স্বাধীনতার পর সতর্কতা

ব্রিটিশ রাজের সময়ে ভারতের অর্থনীতি বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদের অংশ ছিল। প্রধানত ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় এমএনসিগুলো চাষ, রেল ও খনন শিল্প পরিচালনা করত। কর্পোরেট বিনিয়োগ ছিল বেশিরভাগই শোষণমূলক: লাভ বিদেশে স্থানান্তরিত হত, স্থানীয় অবকাঠামো বা দক্ষতা বিকাশে পুনরায় বিনিয়োগের তুলনায় অনেক বেশি লাভ উত্তোলন হত, যা এক অসম উন্নয়নের চিত্র রেখে গিয়েছিল।

১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর ভারত মিশ্র-অর্থনীতির মডেল গ্রহণ করে। দেশটি আমদানিপূরণ শিল্পায়নের মাধ্যমে স্বনির্ভরতার পথে হাঁটায়। ১৯৫৬ সালের শিল্পনীতি প্রস্তাবে “কোর”, “জরুরি” ও “বেসরকারি” খাত নির্ধারণ করা হয়। কোর ও ভারী শিল্প রাষ্ট্রের দায়িত্বে রাখা হয়, বেসরকারি (বহুজাতিকসহ) বিনিয়োগ কঠোর নিয়ন্ত্রণের আওতায় আসে। লাইসেন্স, কোটা ও বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এমএনসির প্রবেশ কঠিন করেছিল। ১৯৬০ এর দশকে ভারতের বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) মোট জিডিপির মাত্র ০.০৪% ছিল, যা বৈদেশিক পুঁজির উপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশের আর্থিক সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার নীতি প্রতিফলিত করেছিল।

সংরক্ষণবাদ বনাম বাস্তববাদ

২০ শতাব্দীর সংরক্ষণবাদ:

লাইসেন্স রাজ: এমএনসিগুলোকে বহু দপ্তর থেকে অনুমতি নিতে হত; দীর্ঘবিচারের কারণ সময়সীমা লংঘিত হতো এবং প্রতি খাতে সর্বোচ্চ ২০% বৈদেশিক মালিকানা সীমা বড় বিনিয়োগকে বিঘ্নিত করেছিল।

ঘরোয়া উদ্যোগের প্রাধান্য: সরকারি ক্রয়নীতি ও প্রকল্পে ঘরোয়া প্রতিষ্ঠানের অগ্রাধিকার প্রযুক্তি স্থানান্তর ও বিশ্ব বাজারে সংযুক্তি বন্ধ করে দেয়।

ফলাফল: স্বনির্ভরতা হালকা ভারী শিল্প গড়ে তুললেও অদক্ষতা, কম উৎপাদনশীলতা ও প্রযুক্তিগত স্থবিরতা বাড়ায়।

উদারীকরণ (১৯৯১ থেকে) ও প্রারম্ভিক ২১শ শতাব্দীর বাস্তববাদ:

অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে ভারত লাইসেন্স রাজ ভেঙে ফেলে, এফডিআই সীমা শিথিল করে এবং টেলিকম, ব্যাংকিং, অটোমোবাইল খাত উন্মুক্ত করে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) ও কর-ছাড় প্রণোদনা দিয়ে রপ্তানিমুখী এমএনসিদের আকৃষ্ট করা হয়—স্যামসাং, হোন্ডা, কোকা-কোলা–এর মতো প্রতিষ্ঠান বড় কারখানা স্থাপন করে। ফলাফলস্বরূপ প্রযুক্তি বিস্তৃতি, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ও পরিষেবা ও উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থান দ্রুত বৃদ্ধি পায়; এফডিআই প্রবাহ ১৯৯০ সালে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০০৮ সালে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও ওপর গিয়ে পৌঁছায়।

তুলনামূলক বিশ্লেষণ: সহযোগিতা ও দ্বন্দ্বের চালক

সম্পৃক্ততার অনুপ্রেরণা:

২০ শতাব্দীতে ভারত রক্ষণশীল ছিল, ক্ষয়িষ্ণু দেশীয় শিল্পকে রক্ষায় এমএনসিদের প্রতিযোগিতা থেকে সংরক্ষণ করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল।

২১ শতাব্দীতে গুরুত্ব পড়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে; ভারতে বিনিয়োগের মাধ্যমে খেলার গ্যাপ পূরণ ও উদ্ভাবন ত্বরান্বিত করা হয়েছে।

নিয়ন্ত্রক কাঠামো:

১৯৯১ পূর্ববর্তী কঠোর নিয়ন্ত্রণ: জটিল লাইসেন্স ও বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা এমএনসিদের উচ্চ প্রবেশব্যয় চাপিয়ে দেয়।

ক্রমাগত উদারীকরণ: উদারীকরণে বৈদেশিক মালিকানা সীমা (অনেক ক্ষেত্রে ১০০% স্বয়ংক্রিয় অনুমোদন) বাড়ানো, ই-ফার্ম পদ্ধতিতে প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও পক্ষপাতহীন বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব:

২০ শতাব্দীতে: সীমিত এমএনসি উপস্থিতিতে প্রযুক্তি গ্রহণ ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে ধীরগতি ছিল; তথাপি ঘরোয়া স্টিল, ঔষধ ও অটোমোবাইল শিল্প গড়ে ওঠে।

২১ শতাব্দীতে: এমএনসি–গুলি পুঁজি, ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও বৈশ্বিক সরবরাহশৃঙ্খল যোগান নিয়ে আসে; তবে জমি অধিগ্রহণ, শ্রমনীতি ও ক্ষুদ্র উদ্যোগের স্থানচ্যুতি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।

রাজনৈতিক ও জনমত:

রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদ: স্বাধীনতার পর ভারত এমএনসিদেরকে সন্দেহের চোখে দেখে, তাঁদের উপনিবেশিক শোষণের সাথে যুক্ত করে।

আধুনিক দ্বৈতমনা: একদিকে যারা এমএনসিদের প্রসারকে সাধুবাদ জানায়, অন্যদিকে কিছুজন লভ্যাংশ প্রত্যাগত, পরিবেশগত ক্ষতি ও সামাজিক অসমতা নিয়ে সমালোচনা করে।

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উভয় পক্ষের কথাবার্তা উসকে দেওয়া হচ্ছে। এনজিও ও কর্মী সংগঠনগুলি এমএনসি প্রকল্পের বৃহৎ জমি অধিগ্রহণে স্থানীয় সম্প্রদায়ের উৎখাত এবং পরিবেশের অবনতি তুলে ধরে ভাইরাল প্রচার করে। বিপণন মণ্ডলী এবং গবেষণা সংস্থাগুলি বলছেন—এই সমালোচনা লক্ষ লক্ষ সরাসরি ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান এবং অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা ও ডিজিটাল সংযোগে এমএনসিদের অবদানের কথা ভুলে যায়। এছাড়া নির্বাচনেও নানা রাজ্যের নীতি এই কর্পোরেট বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা হয়ে উঠেছে—বৃদ্ধি ও ন্যায়ের মধ্যে সূক্ষ্ম সমন্বয়কারী নীতি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট।

একবিংশ শতকে সম্পর্কের পতন না পুনর্বিন্যাস?

সাম্প্রতিক মন্দা ও নীতিগত প্রতিক্রিয়া

নীতিগত অনিশ্চয়তা: ই-কমার্স, তথ্য সংরক্ষণ, ও ডিজিটাল ট্যাক্স সংক্রান্ত হঠাৎ পরিবর্তিত নীতিমালা বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির (এমএনসি) আস্থা টলিয়ে দিয়েছে (যেমন: ফ্ল্যাশ সেল নিষেধাজ্ঞা বা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ভোটাধিকার সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা)।

ভূ-রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস: আমেরিকা-চীন প্রযুক্তি দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে, ভারত এখন বৈশ্বিক বিনিয়োগ আকর্ষণ ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার মাঝে ভারসাম্য রাখতে বাধ্য, যার প্রেক্ষিতে ২০২০ সালে চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধকরণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

এই অনিশ্চিত পরিবেশে বহু বহুজাতিক সংস্থা আপাতত "ঘটনার-মোড়-ঘোরার-অপেক্ষায়-থাকা" মনোভাব নিয়েছে, নীতিগত অবস্থা স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত বড় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখেছে। একাধিক আন্তর্জাতিক সিইও মন্তব্য করেছেন, তথ্য সার্বভৌমত্ব ও ডিজিটাল কর সংক্রান্ত অনির্দিষ্টতা দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের রিটার্ন হিসাবকে কঠিন করে তুলছে, ফলে কর্পোরেট স্তরে ঝুঁকিবিমুখতা বেড়েছে। পাশাপাশি, ভারতের কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতার অভিমুখ বিদেশি সরবরাহ শৃঙ্খল ও নিরাপত্তা নিরীক্ষা আরও কঠোর করেছে, অনুমোদন প্রক্রিয়া মন্থর হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কিছু সংস্থা তাদের অভ্যন্তরীণ পরিচালন কাঠামো পুনর্বিন্যাস করছে, ভারত-কেন্দ্রিক নীতিমালা বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করছে, এবং স্থানীয় অংশীদারিত্ব বাড়িয়ে ভারতের প্রতি প্রতিশ্রুতি দেখাতে চাইছে। এসব অভিযোজনের লক্ষ্য—কর্পোরেট স্বার্থ সংরক্ষণ এবং ভারতের পরিবর্তিত নীতিগত অগ্রাধিকারের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো।

কর্পোরেট প্রতিক্রিয়া

কিছু সংস্থা “চায়না-প্লাস-ওয়ান” কৌশল গ্রহণ করে ভারতে উৎপাদন ও ডেটা সেন্টারে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। অনেকেই নতুন প্রকল্প স্থগিত রেখেছে অথবা আরও স্বচ্ছ নীতিগত পরিবেশের দাবি জানিয়েছে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অনিশ্চয়তা তুলে ধরে। অনেক সংস্থাই এখন তাদের ভারতে উপস্থিতি পুনর্মূল্যায়ন করছে—স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে, ঝুঁকি ও লাভ ভাগ করে নেওয়ার যৌথ উদ্যোগে যাচ্ছে। তারা সম্মতি টিম গঠন করছে, নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে, এবং ভারতে কেন্দ্রিক পরামর্শদাতা বোর্ড তৈরি করছে যাতে নীতিগত পরিবর্তন আগাম আঁচ করা যায়। কেউ কেউ তাদের লক্ষ্য স্থানান্তর করছে টিয়ার-২ ও টিয়ার-৩ শহরের দিকে, যেখানে জমি, শ্রম ও লজিস্টিক তুলনায় স্থিতিশীল হলেও বাজার ছোট। শিল্প সংগঠনগুলিও এক্ষেত্রে সক্রিয়, তারা এক-জানালার অনুমোদন ব্যবস্থা চালুর দাবিতে রাউন্ডটেবিল আলোচনা ও শ্বেতপত্র তৈরি করছে। আশা—হঠাৎ আদেশ নয়, বরং ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে টেকসই ও মসৃণ বৃদ্ধির পথ সুগম হবে।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

ডিজিটাল অর্থনীতি: সফটওয়্যার ও ফিনটেক ক্ষেত্রে ভারতীয় ইউনিকর্নগুলির উত্থান পশ্চিমা কর্পোরেশনদের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পারস্পরিক উদ্ভাবনী সহযোগিতার পথ তৈরি করছে।

নির্বাচিত অংশগ্রহণ: "আত্মনির্ভর ভারত" উদ্যোগ এক ধরনের স্বনির্ভরতার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে, তবে তা সেমিকন্ডাক্টর, পরিকাঠামো এবং নবায়নযোগ্য শক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে MNC-দের স্বাগত জানায়—শর্ত, তারা যেন ঘরোয়া সক্ষমতা গঠনে অবদান রাখে।

এই প্রেক্ষিতে বহু এমএনসি স্থানীয় গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে, ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে দক্ষতা উন্নয়ন চুক্তি করছে, এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে দেশীয় সরবরাহকারীদের শক্তিশালী করছে। তারা “মেক ইন ইন্ডিয়া” গাইডলাইনের আওতায় কারখানা তৈরি করছে, যাতে ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও সরবরাহ শৃঙ্খল স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। রাজ্য সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পও শুরু হচ্ছে, যেখানে প্রকৌশলী ও কারিগরি কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে। চুক্তিতে দেশীয় কনটেন্ট শর্ত জুড়ে দিয়ে এবং ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারে বিনিয়োগ করে, এই সংস্থাগুলি দেখাচ্ছে—ভারতের কৌশলগত খাতে অংশগ্রহণ শুধু লাভজনকই নয়, বরং রূপান্তরমূলক, কারণ তারা দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় লক্ষ্যে সহায়ক টেকসই ইকোসিস্টেম তৈরি করে।

উপসংহার

ভারত ও বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির সম্পর্কের গতি এক শতকের মধ্যে সন্দেহপ্রসূত সংরক্ষণবাদ থেকে উদার মুক্তবাজার এবং বর্তমানে শর্তসাপেক্ষ জটিল সহযোগিতায় পৌঁছেছে। বিশ শতকের প্রথমার্ধে বিদেশি বিনিয়োগের প্রতি অবিশ্বাস ও কঠোর নিয়ন্ত্রণ দেশীয় সংস্থাগুলিকে সুরক্ষা দিলেও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে রুদ্ধ করে রেখেছিল। ১৯৯১ পরবর্তী যুগে উন্মুক্ত নীতিমালা বিদেশি পুঁজির সদ্ব্যবহার ঘটিয়েছে, প্রবৃদ্ধি ঘটিয়েছে, এবং ভারতকে বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত করেছে। তবে সাম্প্রতিক নীতিগত দোলাচল এবং দেশীয় শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে একটি পুনর্বিন্যাস জরুরি হয়ে উঠেছে—একটি ভারসাম্য যেখানে উন্মুক্ততা ও কৌশলগত স্বনির্ভরতা যুগপৎ চলবে। শেষপর্যন্ত, ভারতের অভিজ্ঞতা দেখায়—বহুজাতিকদের সঙ্গে সফল সহযোগিতা শুধু নীতিগত উদারতার উপর নির্ভর করে না, বরং সুসংহত ও পূর্বানুমেয় নীতিমালারও প্রয়োজন, যা বিদেশি বিনিয়োগকে জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যগুলির সঙ্গে সংযুক্ত করতে সক্ষম।


তথ্যসূত্র

Brandl, K., Moore, E., Meyer, C., & Doh, J. (2021). The impact of multinational enterprises on community informal institutions and rural poverty. Journal of International Business Studies. https://doi.org/10.1057/s41267-020-00400-3

Goswami, S. (2019). Land acquisition and involuntary displacement: A study of changing state-society relations. European Researcher. Series A, 10(3), 148–155. https://www.researchgate.net/publication/336382820_Land_Acquisition_and_Involuntary_Displacement_A_Study_of_Changing_State_Society_Relations

JLL India. (2025, February 13). India's warehousing boom: Tier II-III cities drive 100M sq. ft. Retrieved from https://www.jll.co.in/en/newsroom/indias-warehousing-boom-tier-ii-iii-cities-drive-100m-sq-ft

Lane, P. R., & Milesi-Ferretti, G. M. (2011). India's financial globalisation. IMF Working Paper No. 11/7, International Monetary Fund. Retrieved from https://www.elibrary.imf.org/view/journals/001/2011/007/article-A001-en.xml

Palit, A. (2008). India's foreign investment policy: Achievements and inadequacies. Institut Français des Relations Internationales (Ifri). https://www.ifri.org/sites/default/files/migrated_files/documents/atoms/files/av18palitfinal.pdf

Sahoo, P., Nataraj, G., & Dash, R. K. (2014). Foreign Direct Investment in South Asia: Policy, Impact, Determinants and Challenges (26th ed., p. 41). Springer.
0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in



















ঋত্বিক ঘটক একজন প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র পরিচালক। চলচ্চিত্র জগতে পরিচালক, সহকারী পরিচালক ছাড়াও চিত্রনাট্যকার ও অভিনেতা রূপেও কাজ করেছেন তিনি। দেশবিভাজন ট্রিলজি নামে পরিচিত ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’ এবং ‘সুবর্ণরেখা’ এই তিনটি ছবি চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তাঁর সেরা কাজ রূপে বিবেচনা করা হয়। সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেনের সমসাময়িক এবং সমান্তরাল চলচ্চিত্র নির্দেশক হয়েও তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র। ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন, ৫০টির কাছাকাছি প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লিখেছেন। অপরদিকে নাট্য জগতেও নির্দেশক, নাট্যকার এবং অভিনেতা সব রূপে সমান স্বাচ্ছন্দ্যে বিরাজ করেছেন তিনি। শিল্পের নানা মাধ্যমে বারবার ফিরে এসেছে সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশা, চাওয়া পাওয়া, তৎকালীন সমাজে নারীদের অবস্থা, দেশভাগের নির্মমতার খণ্ডচিত্র, প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বামপন্থী প্রতিবাদী ভাবাবেগ। শিল্পের নানা ক্ষেত্রে সাবলীলভাবে বিচরণকারী এই মানুষটিকে তাই ১৯৭০ সালে ভারত সরকার শিল্পকলা বিভাগে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করে।

৪ নভেম্বর ১৯২৫ সালে অবিভক্ত বাংলার ঢাকাতে জন্ম হয় ঋত্বিক ঘটকের। তিনি ও তাঁর যমজ বোন প্রতীতিদেবী ছিলেন বাবা সুরেশচন্দ্র ঘটক ও মা ইন্দুবালা দেবীর নয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। সংস্কৃতের কৃতী ছাত্র সুরেশচন্দ্র পেশাগত জীবনে উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মচারী (ম্যাজিস্ট্রেট) ছিলেন। ঋত্বিকের বড় দাদা মণীশ ঘটক ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক, কল্লোলযুগের সুপরিচিত ঔপন্যাসিক ও কবি ও তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম মুখ, যাঁর কন্যা মহাশ্বেতা দেবী বাংলা সাহিত্যের রত্ন। আবার তাঁর আরেক দাদা আশিষচন্দ্র ঘটকের নাতি পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় এখনকার সময়ের স্বনামধন্য অভিনেতা, চিত্রপরিচালক ও চিত্রনাট্যকার। সক্রিয় বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী সাধনা রায়চৌধুরীর ভাগ্নী সুরমা দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ঋত্বিক ঘটক। তাঁদের তিন সন্তান ঋতবান, সংহিতা ও শুচিস্মিতা ঘটক। চিত্রপরিচালক ঋতবান ‘ঋত্বিক মেমোরিয়াল ট্রাস্টে’র সঙ্গে যুক্ত এবং ঋত্বিকের অসমাপ্ত তথ্যচিত্র ‘রামকিংকর’ সম্পূর্ণ করেছেন ও ‘অসমাপ্ত ঋত্বিক’ নামক একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। পাশাপাশি বাবার প্রথম দিকের কাজ ‘বগলার বঙ্গদর্শন’, ‘রঙের গোলাম’-এর মত ছবি পুনরূদ্ধার করেছেন। তাঁর বড় মেয়ে সংহিতাও তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন।

ঋত্বিকের প্রাথমিক পড়াশোনার সূচনা হয় ময়মনসিংহের মিশন স্কুলে। এরপর দাদা মণীশ ঘটক তাঁকে কলকাতার বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করে দেন। এই সময়েই ঋত্বিকের নাটকে হাতেখড়ি। ঋত্বিকের প্রথম দিকের নাট্য অভিনয় ‘চন্দ্রগুপ্ত।’ (১৯৩৬)। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের এই নাটকে ঋত্বিক চাণক্যের ভূমিকায় অভিনয় করতেন রিচি-রোড, ম্যাডক্স স্কোয়ারে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হলে, রাজশাহী ফিরেও নাটক থেকে সরে যাননি। এরপর ১৯৪২ সালে ঋত্বিক ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাশ করেন। বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে বি.এ. পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি হন। তবে লেখালেখি ও নাট্য চর্চার নেশায় এম.এ.-র পাঠ অসমাপ্তই থেকে যায় তাঁর।

কলকাতায় এসে স্কুলে পড়াশোনার সময় থেকেই প্রেমের কবিতার মধ্যে দিয়ে লেখালেখির সূচনা হয় তাঁর। ১৯৪৭-এ ‘গল্পভারতী’তে তাঁর লেখা প্রথম গল্প ছাপা হয়। এরপর ‘দেশ’ ‘অগ্রণী’ ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর গল্প। ১৯৪৭ সালেই নিজস্ব কাগজ ‘অভিধারা’ প্রকাশ করা শুরু করেন ঋত্বিক। চোখ, কমরেড, গাছ, আকাশগঙ্গা ইত্যাদি তাঁর লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গল্প। বাংলা বিভাজন দুই বাংলার বিক্ষুব্ধ সময়ের চিত্র, প্রেম, সামাজিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল তাঁর লেখার মূল বিষয়। তাঁর কম বয়সের কাঁচা হাতের লেখা পড়ে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় তাঁকে একজন ‘শক্তিমান নবীন লেখক ‘বলে আখ্যা দিয়েছেন।

গল্প লিখতে লিখতে একসময় তাঁর মনে হয় ‘‘গল্পটা inadequate’’। ফলত নাটকের জগতে তাঁর প্রবেশ। প্রথমে রবীন্দ্রনাথের নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে শুরু করেন নাট্যজীবন। এরপর ধীরে ধীরে গণনাট্যের সঙ্গে পরিচয় হয়। ১৯৪৮ সালে ‘বহুরূপী’ ‘নবান্ন’ নাটকের শো করে। শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় তাতেও অভিনয় করলেন ঋত্বিক। এইসময়ে লিখলেন প্রথম নাটক ‘কালো সায়র’। ‘নবান্ন’ নাটকে সাফল্যের পরে ১৯৪৯-এ গণনাট্যের নতুন নাটক ‘ঢেউ’তে বৃদ্ধ কৃষকের ভূমিকায় নিজেই অভিনয় করলেন। ১৯৫১ সালে যুক্ত হন ভারতীয় গণনাট্য মঞ্চের (Indian People’s Theatre Academy-IPTA) সঙ্গে। ১৯৫২ সালে নিজের লেখা ‘দলিল’ নাটকটি নিয়ে তিনি ১৯৫৩ সালে পাড়ি দেন বোম্বেতে–গণনাট্যের কনফারেন্সে। নাটকটির পরিচালক ও প্রধান অভিনেতা ছিলেন ঋত্বিক নিজেই। এই নাটকটি ঐ প্রর্দশনীতে প্রথম হয়। এছাড়া ১৯৫৫-তে তাঁর লেখা ও নির্দেশনাতে ‘সাঁকো’ খুবই প্রশংসা পায়। অভিনেতা ঋত্বিকের পরের নাটক বিজন ভট্টাচার্যের নির্দেশনায় দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ। ‘জাগরণ’-এর জিন্না থেকে ‘বিসর্জন’-এর রঘুপতি, ‘ঢেউ’-এর বৃদ্ধ কৃষক, ‘নীলদর্পণ’-এ তাঁর অভিনয়, তাঁর নির্দেশনা মাতিয়ে তুলেছিল আপামর নাটকপ্রেমী বাঙালিকে।

নাটক করতে করতেই তাঁর মনে হয়, কয়েক হাজার নয়, লক্ষ মানুষের কাছে যেতে হবে। তখন সহ-পরিচালকরূপে নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’ (১৯৫০) এর মাধ্যমে তাঁর চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ। এরপর ‘বেদেনী’ (১৯৫১) চিত্রনাট্যকার রূপে ‘মধুমতী’ ইত্যাদি নানা ছবি করেছেন।

নির্দেশক ঋত্বিকের আটটি পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছবি ছিল — নাগরিক (১৯৫২), অযান্ত্রিক (১৯৫৮), বাড়ী থেকে পালিয়ে (১৯৫৮), মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২) তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩) এবং যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪)। এর মধ্যে সুবর্ণরেখা ১৯৬৫ সালে আর নাগরিক ১৯৭৭ সালে মুক্তি পায়। সাধারণ মানুষ, তাঁদের জীবনের দৈনিক সংগ্রাম, দেশভাগের যন্ত্রণা বারবার ফিরে আসে তাঁর ছবিতে। ছবিকে তিনি শিল্প নয় বরং সমাজের, নিজের ভাবনা, প্রতিবাদ, আবেগ, দাবী প্রকাশ করার মাধ্যম রূপে বিবেচনা করতেন। এছাড়া ইন্দিরা গান্ধী, পুরুলিয়ার ছৌ, ভয়, বিহার, আমার লেনিন ইত্যাদি বিবিধ বিষয় নিয়ে তিনি স্বল্পদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেন।

১৯৬৬ সালে পুণের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গে অধ্যাপক রূপে যুক্ত হন। সেখানে তাঁর সমসাময়িক উল্লেখযোগ্য ছাত্র ছিলেন মণি কৌল (Mani Kaul), সুভাষ ঘাই (Subhas Ghai ), কুমার সাহানি (Kumar Sahani), বিধুবিনোদ চোপড়া (VidhuVinod Chopra), আদূর গোপালকৃষ্ণন (Adoor Gopalakrishnan) প্রমুখরা। কিন্তু সেখানকার শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনেও বেশী দিন টিকে থাকতে পারেনি তাঁর শিল্পী মন। কিন্তু চলচ্চিত্র বিষয়ক তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলি আজও নানা চলচ্চিত্র বিষয়ক ছাত্র ও গবেষকের কাছে মূল্যবান নথি বলে গণ্য।

১৯৬৯ সালে, জীবনের শেষবেলায়, গোবরা মানসিক হাসপাতালেই লিখে ফেলেন ‘সেই মেয়ে’। নিজের নির্দেশনায় সে নাটক অভিনয় করালেন হাসপাতালের রোগী ও কর্মী-চিকিৎসকদের দিয়ে। জীবনে যখনই গল্প লিখতে লিখতে, ছবি করতে করতে অস্থির হয়েছেন নাটকই সেই খরার দিনে তাঁর বক্তব্য প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে। বার বার ভাঙা দেশ, জীবন আর কলোনির গল্প ফিরে এসেছে মঞ্চের সংলাপে। তাঁর বন্ধুরাই বলছেন, ‘হি ওয়াজ নেভার সিনসিয়ার টু দ্য থিয়েটার’, কিন্তু, শেষ পর্যন্ত গণনাট্য আন্দোলনের ইতিহাসে ঋত্বিক এক স্থায়ী আসনের দাবিদার হয়ে রয়ে গেছেন। তাই শোভা সেন তাঁকে যথার্থই বলছেন, ‘নাট্য-আন্দোলনের হোতা বা পুরোহিত!’

চলচ্চিত্রের জন্য সত্যজিৎ রায়ের মতো জীবদ্দশায় বাণিজ্যিক বা আন্তর্জাতিক সাফল্যের মুখ সেভাবে দেখেননি ঋত্বিক ঘটক। ১৯৫৭ সালে ‘মুসাফির’ ছবি তৃতীয় সেরা কাহিনী চিত্র (feature film) হিসেবে জাতীয় পুরস্কার মঞ্চে সার্টিফিকেট অব মেরিট অ্যাওয়ার্ডে (Certificate of Merit Award) ভূষিত হয়। ১৯৫৮-তে হিন্দি ছবি ‘মধুমতী’ ফিল্ম ফেয়ারের জন্য সেরা গল্পরূপে মনোনয়ন পায়। ১৯৭০ সালে ‘হীরের প্রজাপতি’ সেরা শিশু চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় পুরস্কারে প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক লাভ করে। ১৯৭৪-এ ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ছবির গল্প জাতীয় পুরস্কার মঞ্চে রজত কমল পুরস্কার পায়। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর জন্য বাংলাদেশ সিনে জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে সেরা নির্দেশক পুরস্কারে ভূষিত করে। ২০০৭ সালে এই ছবি ‘ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে’র একটি সমালোচক দলের দ্বারা নির্মিত বাংলাদেশের সেরা দশটি চলচ্চিত্রের তালিকায় শীর্ষস্থান লাভ করে। ১৯৯৮ সালে এশীয় পত্রিকা সিনেমায়ারের তৈরী সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রের তালিকাতে ‘সুবর্ণরেখা’ ১১তম স্থান পায়। আন্তর্জাতিক স্তরে এই সাফল্য দেখে তাই তাঁর স্ত্রী সুরমা ঘটক স্মৃতিচারণে আক্ষেপ হয়ে বারবার ফিরে এসেছিল শেষ জীবনে তাঁর বলে যাওয়া কটা কথা — “লক্ষ্মী , টাকাটা তো থাকবে না, কাজটাই থাকবে। তুমি দেখো আমার মৃত্যুর পর সবাই আমাকে বুঝতে পারবে।”

দীর্ঘদিন ব্যাপী হতাশা ও অত্যাধিক মদ্যপানের ফলে ১৯৭৬ সালে ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় ঋত্বিক ঘটকের মৃত্যু হয়। তাঁর কথা তাঁর মৃত্যুর পরে সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। সত্যি ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক।
0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in








দেবযানী অসুরদের গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা। দেবযানীর জীবনের প্রেম পূর্ণতা লাভ করে না। কচ ও দেবযানীর জীবনের ব্যর্থ প্রেমের এক বেদনা বিধূর উপাখ্যান শোনাতে চাই। দেবলোকের আচার্য বৃহস্পতি ছিলেন দেবতাদের পরম পূজনীয়। অন্যদিকে অসুর সম্রাজ্যে পূজনীয় ছিলেন আচার্য শুক্রাচার্য। বৃহস্পতি পুত্র কচ ও শুক্রাচার্যের বিদূষী পরমা সুন্দরী কন্যা দেবযানী। দেবতা ও অসুরের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই থাকতো। দেবতাদের সাথে যুদ্ধে যে সকল দৈত্য নিহত হতেন শুক্রাচার্য তাঁর সঞ্জীবনীমন্ত্রের সাহায্যে তাঁদের জীবনদান করতেন। বৃহস্পতির এই বিদ্যা জানা না থাকার কারণে তিনি নিহত দেবসৈন্যকে জীবিত করতে পারতেন না। এই মন্ত্র জানার জন্য দেবতাদের অনুরোধে বৃহস্পতি তাঁর পুত্র কচকে শুক্রাচার্যের কাছে পাঠান। কচ শুক্রাচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে এক হাজার বৎসর তাঁর গৃহে অতিবাহিত করেন। এই সময় কচ ব্রহ্মচর্যব্রত পালন করে গুরু শুক্রাচার্য এর সেবা করেন।তিনি গুরুকন্যা রূপসী তরুণী দেবযানীর সান্নিধ্যও আসেন। এক সময় দেবযানী কচের প্রতি আকৃষ্ট হন। ঘটনাক্রমে তা ভালোবাসায় পরিণত হয়। দেবযানী কচকে ভালোবেসেই বারবার দৈতদের কবল থেকে তাঁকে বাঁচিয়ে তোলেন তিনি তাঁর বাবা শুক্রাচার্যকে বলে। একসময় দৈত্যরা কচের অভিসন্ধি জানতে পারেন। সেই কারণে, দৈত্যরা কচকে হত্যা করে তাঁর দেহকে খণ্ড খণ্ড করে কুকুরের খাবার হিসাবে ব্যবহার করেন। কিন্তু দেবযানীর অনুরোধে শুক্রাচার্য তাঁকে জীবিত করেন। এরপর দৈত্যরা কচকে দ্বিতীয়বার হত্যা করলেও দেবযানীর অনুরোধে শুক্রাচার্য আবার কচকে জীবিত করেন। তৃতীয়বার দৈত্যরা কচকে হত্যা করে তাঁর দেহ ভস্ম করেন। এরপর উক্ত ভস্ম মদের সাথে মিশিয়ে শুক্রাচার্যকে পান করান। দেবাযানীর পুনঃপুনঃ অনুরোধে তিনি আবার কচকে জীবিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এইবারে শুক্রাচার্য দেখলেন কচ জীবিত হলে তাঁর পেট চিরে বের হবে। তাই তিনি উদরস্থ কচকে প্রথমে সঞ্জীবনী মন্ত্র শেখালেন। এরপর মন্ত্রবলে কচকে জীবিত করলে, কচ শুক্রাচার্যের পেট থেকে বের হন, কিন্তু শুক্রাচার্য মারা যান। এরপর কচ, শুক্রাচার্যকে জীবিত করেন। এরপর আরো পাঁচশত বৎসর শুক্রাচার্যের আশ্রম থেকে কচ স্বর্গে যাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এই সময় শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী তাঁর কাছে প্রেম নিবেদন করেন। কিন্তু কচ গুরু-কন্যা বিবেচনায় দেবযানীকে প্রত্যাখ্যান করেন। সেই সাথে তিনি জানালেন যে তাঁরা দুজনই শুক্রাচার্যের শরীরের অভ্যন্তর হতে জাত, সেই কারণে দেবযানীর সাথে তাঁর সম্পর্ক দাঁড়ায় ভাই-বোন। ক্ষুব্ধ দেবযানী কচকে অভিশাপ দিলেন যে, তিনি যে সঞ্জীবনী বিদ্যা অর্জন করেছেন, তা কার্যকরী হবে না। কচ পাল্টা দেবযানীকে অভিশাপ দিলেন যে, দেবযানীর অন্তরের ইচ্ছা পূরণ হবে না। কোন ব্রাহ্মণ বা ঋষিপুত্র তাঁকে বিবাহ করবেন না। এরপর কচ স্বর্গে চলে যান। ইনি অভিশাপের কারণে নিজে কখনও এই বিদ্যার সুফল পান নি। তবে তিনি যাঁদেরকে এই বিদ্যা শিক্ষা দিয়েছিলেন, তাঁরা ফললাভ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর " বিদায় অভিশাপ" কাব্য নাটকেকচের মুখ দিয়ে অভিশাপের পরিবর্তে আশীর্বাদ জানিয়েছেন। এই বলে
কচ: আমি বর দিনু, দেবী, তুমি সুখী হবে । । ভুলে যাবে সৰ্ব্বগ্লানি বিপুল গৌরবে । রবীন্দ্রনাথে "বিদায় অভিশাপ " তার এই বর বাস্তবে দেবযানীর কপালে জোটেনি।আগের কথায় ফিরে যাওয়া যাক। কচ শেষে দেবযানীর কাছে এসে প্রার্থনা করলেন নিজের দেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে। দেবযানী বিষণ্ণ হলেন। কচকে ডেকে তাকে বিবাহ করতে অনুরোধ করলেন। কচ একথায় বিস্মিত হলেন। কারণ গুরুকন্যা তার কাছে ভগিনীর সমান। দেবযানী বললেন – তোমাকে আমার ভাল লেগেছে। তাছাড়া আমার জন্যই তুমি বার বার মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছো। এখন আমায় এভাবে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত নয়। কচ চিন্তিত হলেন। তিনি দেবযানীকে বোঝাতে চাইলেন। দেবযানী কচকে বললেন
--হায় সখা, এ তো স্বগর্পুরী নয়। পুষ্পে কীটসম হেথা তৃষ্ণা জেগে রয়
মর্মমাঝে, বাঞ্ছা ঘুরে বাঞ্ছিতেরে ঘিরে,
লাঞ্ছিত ভ্রমর যথা বারম্বার ফিরে
মুদ্রিত পদ্মের কাছে। হেথা সুখ গেলে
স্মৃতি একাকিনী বসি দীর্ঘশ্বাস ফেলে
শূন্যগৃহ--হেথায় সুলভ নহে হাসি।
যাও বন্ধু, কী হইবে মিথ্যা কাল নাশি--
উৎকণ্ঠিত দেবগণ।
যেতেছ চলিয়া ?
সকলি সমাপ্ত হল দু কথা বলিয়া?
দশশত বর্ষ পরে এই কি বিদায়? কচ বললেন,আর যাহা আছে তাহা প্রকাশের নয় সখী। বহে যাহা মর্মমাঝে রক্তময় বাহিরে তা কেমনে দেখাব।
দেবযানী--জানি সখে,
তোমার হৃদয় মোর হৃদয়-আলোকে
চকিতে দেখেছি কতবার, শুধু যেন
চক্ষের পলকপাতে; তাই আজি হেন
স্পর্ধা রমণীর। থাকো তবে, থাকো তবে,যেয়ো নাকো । সুখ নাই যশের গৌরবে।
দেবযানীর আঁকুতি ব্যক্ত করলেন--
হেথা বেণুমতীতীরে মোরা দুই জন
অভিনব স্বর্গলোক করিব সৃজন।'
কচ--নহে, নহে দেবযানী।
'দেবযানী প্রশ্ন --নহে? মিথ্যা প্রবঞ্চনা! দেখি নাই আমি মন তব? জান না কি প্রেম অন্তর্যামী?
বিকশিত পুষ্প থাকে পল্লবে বিলীন--
গন্ধ তার লুকাবে কোথায়? কতদিন
যেমনি তুলেছ মুখ, চেয়েছ যেমনি,
যেমনি শুনেছ তুমি মোর কণ্ঠধ্বনি,
অমনি সর্বাঙ্গে তব কম্পিয়াছে হিয়া--
নড়িলে হীরক যথা পড়ে ঠিকরিয়া
আলোক তাহার। সে কি আমি দেখি নাই?
ধরা পড়িয়াছ বন্ধু, বন্দী তুমি তাই
মোর কাছে। এ বন্ধন নারিবে কাটিতে।
ইন্দ্র আর তব ইন্দ্র নহে । কচ-
শুচিস্মিতে,
সহস্র বৎসর ধরি এ দৈত্যপুরীতে
এরি লাগি করেছি সাধনা ?
দেবযানী কচের কথার প্রতিবাদ করে প্রশ্ন করলেন--
বিদ্যারই লাগিয়া শুধু লোকে দুঃখ সহে
এ জগতে? করে নি কি রমণীর লাগি
কোনো নর মহাতপ? পত্নীবর মাগি
করেন নি সম্বরণ তপতীর আশে
প্রখর সূর্যের পানে তাকায়ে আকাশে
অনাহারে কঠোর সাধনা কত? হায়,
বিদ্যাই দুর্লভ শুধু, প্রেম কি হেথায়
এতই সুলভ? সহস্র বৎসর ধরে
সাধনা করেছ তুমি কী ধনের তরে
আপনি জান না তাহা। বিদ্যা এক ধারে,আমি এক ধারে-- কভু মোরে কভু তারে চেয়েছ সোৎসুকে; তব অনিশ্চিত মন
দোঁহারেই করিয়াছে যত্নে আরাধন
সংগোপনে। আজ মোরা দোঁহে এক দিনে আসিয়াছি ধরা দিতে। লহো, সখা, চিনে যারে চাও। বল যদি সরল সাহসে "বিদ্যায় নাহিকো সুখ, নাহি সুখ যশ! দেবযানী কচকে বোঝালেন অতীত বছরগুলোতে উভয়ের নষ্টালজিক প্রেমময় অনুষঙ্গের কথা। বললেন তাঁকে দেবলোকে ফিরে না গিয়ে তাঁকে বিয়ে করে থেকে যেতে।
কচ দেবযানীর অনুরোধ উপেক্ষা করে বললেন –দেবযানী, প্রসন্ন হও, তুমি আমার কাছে গুরুরও অধিক। তোমার যেখানে উৎপত্তি, শুক্রাচার্যের সেই দেহের মধ্যে আমিও বাস করেছি। ধর্মত তুমি আমার ভগিনী। অতএব আর ওরূপ কথা বলো না। তোমাদের গৃহে আমি সুখে বাস করেছি, এখন যাবার অনুমতি দাও, আশীর্বাদ করো, সাবধানে আমার গুরুদেবের সেবা করো।
একথা শুনে দেবযানী ক্রোধিত হলেন। তিনি অভিশাপ দিলেন, নারী হয়ে তিনি বারবার অনুরোধ করলেন কচ তাও কথা রাখলেন না। তাই তার পিতার কাছ থেকে কচ যত বিদ্যা শিখেছেন সব নিষ্ফল হবে। ও বাক্যে কচ ব্যাথিত হলেন। বললেন, বিনা অপরাধে তাকে দেবযানী এত বড় অভিশাপ দিলেন। কামে উত্তেজিত হয়ে তিনি কচকে অভিশাপ দিলেন। কচ ঠিক করলেন তাকেও শাপ নিতে হবে।কচ দেবযানীকে অভিশাপ দিলেন ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ শুক্রের কন্যা হয়ে তাকে ক্ষত্রিয়ের স্ত্রী হতে হবে। দেবয়ানী ও কচের প্রেম পূর্ণতা পেল না।

সূত্র: মহাভারত। উদ্ধৃতি রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপ।
0

প্রবন্ধ - শৌনক ঠাকুর

Posted in



















বর্তমান দেশে বিদেশে যখন কাদামাটির তৈরি স্থাপত্য ভাস্কর্যের উপর বিভিন্ন ধরনের রিসার্চ চলছে তখন আজ থেকে একশো সাত বছর আগে কবিগুরু দেখিয়ে গেছেন কিভাবে মাটিকে কাজে লাগিয়ে শিল্পবোধ ও সৌন্দর্যচেতনার প্রকাশ ঘটানো যায় শান্তিনিকেতনের বাড়িগুলিতে মাটির র স্থাপত্য ভাস্কর্যের সঙ্গে ছিল আভিজাত্যের ছোঁয়া।

ভারতবর্ষের ঐতিহ্য, পল্লী-ভাবনা, পল্লী-সংস্কৃতি, দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তবতা, মৌলিকতা -- এসবের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল শান্তিনিকেতনের এক একটি গৃহ। প্রত্যেকটি গৃহ কিন্ত তার স্বীয় স্বীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।

কোণার্ক

আশ্রমের উত্তর দিক দিয়ে শুরু করি। উত্তর দিকে যে বাড়িটি রয়েছে তার নাম কোণার্ক। ‘কোণার্ক’ শব্দটিকে ভাঙলে পাওয়া যায় ‘কোণ’ ও ‘অর্ক’। ‘কোণ’ শব্দের অর্থ কোণ বা কোণা বা প্রান্ত। আর ‘অর্ক’ হল সূর্য। অতএব, ‘কোণার্ক’ শব্দটির অর্থ হল ‘সূর্যকোণ’। ১৯১৮ সালে শান্তিনিকেতন আশ্রমের উত্তর প্রান্তে এই বাড়ি তৈরীর কাজ শুরু হয়। প্রথমে দু’টি মাটির ঘর তৈরি করা হয়। এর বছর দু’য়েক পরে শুরু হয় এই মাটির বাড়ি পরিমার্জন ও পরিবর্ধন। সালটি ১৯২১-২২। বাড়িটির স্থাপত্য শিল্পের দিক থেকে বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বহন করে ; —-

বাড়ি যে সাধারণ বাড়ি নয় এ কথা বলা বাহুল্য মাত্র। শুধু বাইরে নয় ভিতরেও একটা অভিনবত্ব রয়েছে।

বাড়িটির তল উঁচু প্লিন্থের। এই পিন্থ (Plinth) হল স্থাপত্যের একটি মৌলিক উপাদান। এটি দেখতে প্ল্যাটফর্মের মত । এটি স্তম্ভ ,মূর্তি বা অন্য কোনো কাঠামোর নিচে থাকে।

ঘরগুলোর সামনে বারান্দা রয়েছে। বারান্দাগুলো ঘরের সঙ্গেই অ্যাটাচ।

ঘরের উচ্চতার সঙ্গে তারতম্যের রেখে তৈরি করা হয়েছিল বাড়ির মেঝে।

ঘরের মাঝে রয়েছে ভেন্টিলেশন। এই ভেন্টিলেশনের মাধ্যমে দিনের আলোর প্রবেশের পথটি সহজ ও সুগম হয়েছে।

মূল ঘরের ভিতের উচ্চতা প্রায় দু’ফুটের বেশি।

ইস্পাতের থামের উপর পেটাই টালির ছাদ। বীম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল ইস্পাত।

বারান্দার মেঝের উচ্চতা প্রায় নয় সাড়ে নয় ইঞ্চি।

এই ঘরের সামনেটা কাঁকর মাটি দিয়ে সুবিন্যস্ত ।

বাড়িটির সামনের দিকে শিমূল গাছের আধিক্য ছিল। অবশ্য অন্যান্য গাছও ছিল। তবে তার পরিমাণ কম।

কোনার্ক গৃহস্থাপত্যের দিক থেকে সহজ-সরল এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তায় গঠিত। সার্থক বাসপোযোগী পরিকল্পনার সঙ্গে ছিল সহজ-সরল গৃহবিন্যাস, আলো-বাতাসের উন্মুক্ততা।


উদয়ন

এবার পূর্ব দিকে হাঁটা দিই। উদয়ন কেবলমাত্র একটি ঘর নয় এগুলিকে ঘরের সমষ্টি বলা যেতে পারে। ‘উদয়ন’ একটি সংস্কৃত শব্দ। এর অর্থ হল ভোর বা সূর্যোদয়। এই গৃহের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯১৯-২০ সালে। তবে সমাপ্ত হতে সময় লেগেছিল প্রায় ১৮ বছর অর্থাৎ ১৯৩৮ সাল। বাড়িটি বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বহন করে ; —-

এটি মূলত অনেকগুলো ঘরের সমষ্টি।

বাড়িটি বেশ মজার। এর বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রকম উচ্চতা রয়েছে। যেমন বসার ঘরের এবং শোয়ার ঘরের যে উচ্চতা মাঝের ঘরগুলো উচ্চতা কিন্ত আলাদা। আবার কোন কোন অংশের উচ্চতা প্রায় তিন তলার কাছাকাছি। উচ্চতার তারতম্য হলেও কিন্তু ঘরগুলো কখনই বিশদৃশ্য বা বেমানান নয়।

দোতলায় রয়েছে লম্বা বারান্দা। বারান্দাগুলিতে জয়পুর ঘরানার কংক্রিটের জালির কাজ শোভা বর্ধন করেছে।

বারান্দাগুলোর বৈঠকে মেজাজকে মাথায় রেখে তৈরি।

বারান্দার কাজের সঙ্গে ঘরের কাজের বিস্তর ফারাক। ঘরের দেওয়াল শীতলপাটি ও কাঠের পাল্লা দিয়ে তৈরি।

দেয়াল ও মেঘের সংযোগস্থলটি মুড়ে দেওয়া ছিল।

সিলিংগুলিতে অবশ্য পাতলা কাঠের কারুকার্য ছিল।

কাঠের সিলিং এর ভাবনা গৃহপ্রবেশ নাটকে যতীনের ছিল।

ঘরের সামনে মোরামে ঢাকা উদ্যান।

অবশ্য ঘরের পিছন দিকেও ছিল উদ্যান , গুহাগৃহ , চিত্রভানু এবং জাপানি বাগিচার বিন্যাস ইত্যাদি। বিশিষ্ট লেখক অরুণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় --- ‘শান্তিনিকেতন আশ্রম স্থাপত্য ও রবীন্দ্রনাথ’ নামক প্রবন্ধে বলেছেন,“ সামনের elevation এবং গৃহের পিছনের উদ্যান, গুহাঘর, চিত্রভানু, জাপানি বাগিচার বিন্যাস —- সব মিলেমিশে প্রাচ্য আভিজাত্যের নিদর্শনই বহন করে।”

উদয়ন যেন এক ‘ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্যের’ দৃষ্টান্ত। নানান বৈচিত্র্যে ঋদ্ধ, রূপ-রস-গন্ধের বিন্যাসে শোভিত এই উদয়ন রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য ও আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ ছিল।


শ্যামলী

কবিগুরু তার ৭৫-তম জন্মদিনে (১৯৩৫ সালে) যে বাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন সেই বাড়িটির নাম শ্যামলী। কবি অবশ্য নিজেই লিখেছেন ; —-

“শ্যামলী মাটির বাড়ি, এ আমার শ্যামলী, আমার শেষ আশ্রয়।”

এটি উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত। এ বাড়ির নকশা তৈরি করেছিলেন সুরেন কর। সুরেন কর ছিলেন কবির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং শান্তিনিকেতনের একজন বিখ্যাত স্থপতি। তিনি ১৯২৭ সালে জাভা সফরে গিয়ে বাটিক শিল্প বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেন। এই বাড়িটির স্থাপত্যের দিক থেকে বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বহন করে। এটা মাটির বাড়ি , মাটির ছাদ , মাটির মেঝে।অভিনব পরিকল্পনা করলেন।

এই ঘরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই ঘরে চৌকাঠ বলে কিছু নেই। এমনকি সিড়িও নেই। ঘর এবং পথের তফাৎ বোঝা যাবে না। মানে কবি বলতে চেয়েছেন পথ যেন অবাধে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করবে। ঘরেই পথ আবার পথেই ঘর।

ঘরের চারিদিকে চুন বালির আস্তানা দিয়ে মাটির হাড়ি সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। যাতে বাইরের উত্তাপ ঘরে প্রবেশ করতে না পারে। সকালে ঘর যাতে ঠান্ডা থাকে। দেয়াল তৈরি হয়েছিল উলু-খড় ও মাটি দিয়ে মাটির সঙ্গে গোবর আলকাতরা আর বেনাগাছে টুকরা মিশিয়ে মসলা তৈরি করে দেওয়ালে আলকাতরা দেয়া হয়েছিল। এর ফলে উইপোকার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

পুরু লাল মাটির দেওয়াল। লালমাটির দেশের তীব্র গরম থেকে বাঁচতে এ বাড়ির ছাদটাও মাটির। কবির আমন্ত্রণে এ বাড়িতেই সস্ত্রীক এসেছিলেন গান্ধীজি। কাটিয়েছিলেন গুরুদেবের সঙ্গে বেশকিছুটা সময়। বাড়িটির সামনের অংশ বৌদ্ধ চৈতের আদলে তৈরি হয়েছিল।

ঘরের এক পাশে ছিল জাম , বেল , মাদার , কুরচি। আর অন্যপাশে তেঁতুল , আতা , শিরীষ , ইউক্যালিপটাস। সামনের আঙিনা ছিল গোলঞ্চের বাহার। পিছনের দিকে ছিল কাঁঠাল, আমসহ বিভিন্ন গাছ।

কবি বেলফুল সহ বিভিন্ন ফুলের টব দিয়ে সাজিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল বাতাবি পাতিলেবুর গাছ। লেবু ফুলের গন্ধ কবিগুরুর খুব প্রিয় ছিল।

এই বাড়ির দেওয়ালে হাই রিলিফ কাজ। হাই রিলিফ (High Relief) হল এমন একটি ভাস্কর্য যেখানে খোদাই করা মূর্তি বা নকশার অংশগুলি পটভূমি থেকে প্রায় অর্ধেক বা তার বেশি পরিমাণ খোদাই করা হয়। এর ফলে মূর্তিগুলো প্রায় স্বতন্ত্রভাবে দাঁড়িয়ে থাকার মতো দেখায়।

দরজা দু’পাশে সাঁওতাল ও সাঁওতালি দম্পতির ছবি। (ছবিটি রামকিঙ্কর বেজের আঁকা)

মাটির সার্থক ব্যবহার যে কিভাবে করতে হয় তার প্রমাণ এই শ্যামলী গৃহটি।

শ্যামলী বাড়িটি রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয় ছিল। তিনি কখনও আম গাছে নিচে, কখনও গোলঞ্চ গাছের পাশে, হাজার মৌমাছির গুঞ্জনে রচনা করে গেছেন সাহিত্যের অমর সৃষ্টি। রাণী চন্দ তাই সস্নেহ সুরে বলেন , শ্যামলীর চারদিক ঘিরে সে যেন এক ছোট ছেলের খেলা। ‘শেষ সপ্তক’-এ ‘চুয়াল্লিশ নম্বর’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ---

“আমার শেষবেলাকার ঘরখানি

বানিয়ে রেখে যাব মাটিতে,

তার নাম দেব শ্যামলী।


পুনশ্চ

কবির স্বপ্নের শ্যামলী টানা বর্ষণ আর ঝড়ের দাপটে ভগ্ন প্রায় হয়ে পড়ে। দেওয়ালের কিছু অংশ এবং ছাদের কিছু অংশ ভেঙে যায়। আবার নতুন উদ্যমে শুরু হয় মেরামতির কাজ। নতুন গৃহ নাম রাখা হল পুনশ্চ। শ্যামলীর একটা সংস্করণ পুনশ্চ। শিল্প সংস্কৃতির দিক থেকে এই বাড়িটি বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বহন করে ; —-

এই ভিত ছিল বেশ খানিকটা উঁচু ।

ঘরের সামনে ছিল একটা স্টেপ বাগান।

পূর্ব দিকের বারান্দায় প্রথম সূর্যের কিরণ এসে পড়ত। কবি সেখানে লেখালেখির পাশাপাশি চিত্রকলাতেও মনোনিবেশ করেছিলেন।

আবার রৌদ্র যখন প্রখর হয়েছে তখন তাকে আড়াল করার জন্যেও এর বিপরীত কোণে দুটি জানলার লাগানো হয়েছিল।

ঘরের মধ্যেকার বায়ু চলাচলের সুগম ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

বাড়িতে প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সৌন্দর্য ।

প্রয়োজনের সাথে সৌন্দর্য চেতনার হর-গৌরির মিলন ঘটেছিল।

আসবাবপত্রের দিকে খেয়াল রাখা হয়েছিল।

কাঠের বড় বড় বাক্সগুলিকে একদিকে যেমন স্টোর তেমনি বসার জায়গা সে ব্যবহার করা হয়েছিল

বাড়িটির গঠন শৈলীতে অভিনবত্ব আছে।


উদীচী

কবি রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ বাড়ি ছিল উদীচী । ‘উদীচী’ শব্দের অর্থ হল বৃদ্ধি, সমৃদ্ধি এই বাড়িটির অবস্থান ছিল পূর্ব দিকে। দোতলা বাড়ি। ছোট ছোট ঘর। এটি তৈরি করা হয় ১৯৩৮ সালে।বাড়িটি বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বহন করে ; —-

পূর্ব দিকে অবস্থান হওয়ায় এর নাম ছিল উদীচী।

ছোট ছোট অনেকগুলো ঘর ।

প্রথমে একতলার দিকটা ফাঁকা ছিল শুধুমাত্র কয়েকটি থাম তার ওপরে দোতলার অংশ নিচটা খোলা।

এগুলো ডুপ্লেক্স (Duplex house) বাড়ি বাড়ি গুলি এমন ধরনের আবাসিক ভবন যেখানে একই কাঠামোর মধ্যে দুটি পৃথক বাসস্থানের ব্যবস্থা থাকে প্রতিটি ঘরে নিজস্ব প্রবেশপথ রাখার জায়গা এবং শয়নকক্ষ।

সুন্দর উদ্যান বিন্যাস এবং বাগানের পরিকল্পনা।

ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেকচারের সার্থক প্রয়োগ এটি।

তবে অন্যান্য বাড়িগুলো তুলনায় এ বাড়ির ব্যয় কম।

অজন্তা গুহার অনুকরণে করা হয়েছিল থামগুলি।

দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গাছের অবস্থান ছিল প্রাঙ্গণে।

এই বাড়ির চাতাল বারান্দা সিঁড়ি সবমিলিয়ে ভারতীয় স্থাপত্য শিল্পের উজ্জ্বলতম নিদর্শন।


সাধারণভাবে শিল্পী তার শিল্পসত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটান কখনও শব্দে, কখনও সুরে, কখনও বা রঙে। কিন্ত রবীন্দ্রনাথ শুধু এসবের মধ্যে নিজেকে ধরে রাখলেন না। তিনি প্রমাণ করলেন বাস্তুশিল্প বা স্থাপত্যকলাতেও সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ ঘটানো সম্ভব। শান্তিনিকেতনের এক একটি বাড়ি স্থাপত্যকার রবীন্দ্রনাথের সফলতম ফসল।পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্থাপত্য নির্মাণে তিনি অভিনবত্ব দেখিয়েছেন।আশ্রমের রূপ পরিবেশ সামগ্রিক বাস্তুশিল্পের সাথে পরিবেশবান্ধব এক আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। খেয়ালি-কবি বাড়ি বদল করতে ভালবাসতেন। বলেছিলেন মাটির বাড়ি ‘শ্যামলী’ তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। কিন্ত এগুলিকে বাস্তবায়নের জন্য কবিগুরুকে নানান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে পড়তে হয়েছিল। কিন্ত ভালো কাজেই বাধা আসে। কিন্ত সে বাধা ভালো কাজকে রুদ্ধ করতে পারে না। তাই বাধা এসেছে, সাময়িক সমস্যা সৃষ্টি করেছে আবার সমাধানের পথ বেরিয়ে এসেছে। এভাবেই মানবনির্মিত পরিবেশ এবং প্রকৃতিনির্মিত পরিবেশের সার্থক সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল এই গৃহগুলি। সৌন্দর্যবোধের সাথে সামগ্রিক জীবন বোধের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিল যা এই আশ্রমটিকে এনে দিয়েছিল সজীবতা ও তপোবন-সুলভ মাধুর্যতা।





--------------------------

গ্রন্থঋণ

‘গুরুদেব’ - রানী চন্দ

‘রবীন্দ্রনাথ ও লোক সাহিত্য’ - ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য

‘শান্তিনিকেতন আশ্রম স্থাপত্য ও রবীন্দ্রনাথ’ - অরুনেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।

‘শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রনাথ’ - ডঃ অতসী সরকার

পশ্চিমবঙ্গ রবীন্দ্র সংখ্যা ১৪০৩
0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in

সমরেশ মজুমদার লৌকিক প্রয়াণে তাঁর গল্প-উপন্যাসের বোদ্ধা পাঠকরা দুঃখে ম্রিয়মাণ হবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শাখা গল্প-উপন্যাসে ও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা যেমন — ভ্রমণকাহিনি, গোয়েন্দাকাহিনি, কিশোর উপন্যাসের মতো শাখাগুলোতেও রয়েছে তাঁর উজ্জ্বল স্বাক্ষর। বাংলা সাহিত্যে তিনি যে ঋদ্ধতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন তা কিন্তু বাঙালি সাহিত্য প্রেমিক বোদ্ধা পাঠকের মন থেকে মুছে যাবে না কোন দিনই।

বহুমাত্রিক বর্ণিল প্রতিভার অধিকারী লেখক হিসেবে সমরেশ মজুমদার তাঁর প্রত্যেকটি লেখার বিষয় ভিন্ন, রচনার গতি এবং গল্প বলার ভঙ্গি ও প্রেক্ষাপটের নান্দনিকতা পাঠকদের আন্দলিত করে।

বাংলা কথাসাহিত্যের পাঠকদের সমরেশ মজুমদার তাঁর লেখনির বর্ণিল প্রতিভা দ্বারা প্রবলভাবে টানে।

সমরেশ মজুমদারের দীর্ঘ সাহিত্য কর্মকান্ডের শুরু যে উপন্যাসটি দিয়ে সেটির নামটি দৌড়। উপন্যাসের উৎসর্গে লিখেছিলেন — ‘দৌড় আমার প্রথম উপন্যাস, প্রথম প্রেমে পড়ার মতো’। এ উপন্যাসের শেষটাও মনে রাখার মতো: ‘মেয়েদের চোখের দৃষ্টি মাঝে মাঝে এক হয়ে যায় কি করে! মায়ের, নীরার অথবা এখন এই জিনার? যে চোখ শুধুই বলে — ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো-ঈশ্বর, তবে কেন বুক জ্বলে যায়!’

তিনি তাঁর উপন্যাস ‘দৌড়’ লেখার পর থেকে আর থামেননি। একের পর এক লিখেই চললেন, যা সে সময়ের জনমানসের বিশেষ করে তরুণ সমাজের অস্থিরতার বাস্তব চিত্র।

বাংলা সাহিত্যে তাঁর অমর ট্রিলজি ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ তাঁর অমর সৃষ্টি। অবশ্য এর সঙ্গে ‘মৌষলপর্ব’ যুক্ত করে চতুর্ভুজ হিসেবে আখ্যা দেন অনেকেই।

সাতকাহন, গর্ভধারিণী, অগ্নিরথ, সিংহবাহিনী, এত রক্ত কেন, কলিকাতায় নবকুমার, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান, গঙ্গা, বুনোহাঁস, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা ইত্যাদি তাঁর লেখা সমসাময়িক কালের ঘটনা প্রবাহের উজ্জ্বল সৃষ্টি।

নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাস “কালবেলা”। এর স্রষ্টা হিসেবেই তিনি পাঠকের কাছে অধিক প্রিয়। কালবেলার অমর দুই চরিত্র অনিমেষ ও মাধবীলতা। সমরেশ এই উপন্যাসে দুটি চরিত্র সৃজন করেছেন অভিজ্ঞতার আলোকে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, তার লেখা কালবেলা উপন্যাস তার মাস্টারপিস।

কালবেলা গত শতাব্দীর আটের দশকের শুরুতে প্রথমে কলকাতার একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় ধারাবাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। এই প্রকাশনাকালে তার জনপ্রিয়তার আঁচ টের পাওয়া যায়। সেটা প্রবল তাপ ও চাপ নিয়ে আবির্ভূত হয় যখন বই আকারে প্রকাশিত হয়। কালবেলার যে ত্রিভুজ কিংবা চতুর্ভুজ সেখানে মার্কসবাদী চেতনা মুখ্য হয়ে উঠেছে। পুরো ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির চালচিত্র হাজির রয়েছে। তখন পশ্চিমবঙ্গের ভোটের রাজনীতিতে সবেমাত্র কংগ্রেসকে হটিয়ে সিপিআই (এম) ক্ষমতাসীন হয়েছে। মার্কসবাদ, সমাজতন্ত্র সবই তখন তরুণদের মধ্যে ভীষণভাবে জাগরুক। সমরেশ এই সময়ের কথা বলছেন না ঠিকই। বলছেন আরও একদশক কিংবা তারও আগের কথা। কিন্তু সেসবকে তরুণরা এবং ওই সময়ের অন্যান্য বয়সীরাও দারুণভাবে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।

সমরেশ মজুমদার এর কালবেলা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অনিমেষ ও মাধবীলতা। অনিমেষ ও মাধবীলতা কে ঘিরে এই উপন্যাসটি আবর্তিত।

কালবেলা’র এইসব সুযোগ তাকে আপনার ক্ষেত্রটাকে বিকশিত হয়ে ওঠার সুবিধা দেয়। এ বাংলা, ও বাংলা দুই জায়গাতেই অনিমেষ ও মাধবীলতার ভেতর দিয়ে তরুণরা তো বটেই অন্যবয়সীরাও যেন আদর্শিক একটা জায়গা খুঁজে পায়। প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির ঘেরাটোপের বাইরে গিয়ে এই আদর্শ তাদের কাছে গুরুত্বও পায়। যে কারণে কালবেলা’র চরিত্রদ্বয় ফিকশন বা কল্প জগতের মানুষ হয়েও বাস্তবের মানুষের উপর প্রভাবিত করে।

পাঠকপ্রিয়তার তুঙ্গস্পর্শী এক উপন্যাস। রাজনীতিতে অনিমেষের কঠিনভাবে জড়িয়ে পড়া, আদর্শের সঙ্গে বাস্তবতার বিপুল ফারাক উপলব্ধিজনিত হতাশা এবং তারপর তার জীবনের এক উজ্জ্বল উদ্ধার, যার নাম মাধবীলতা। মাধবীলতা যেন তার জীবনের ধ্রুবতারা; ঝড়, ঝঞ্ঝা, সমস্ত প্রতিকুলতার মধ্যে যে অনিমেষকে স্থিতধী করে রাখে। কালবেলা আমাদের জানায়, বিপ্লব ও প্রেম পরস্পরবিরোধী হতেই হবে এমন কথা নেই, পরম বিশ্বাসে একে অন্যের হাতে হাত ধরেও তারা চলতে পারে। কালবেলার পাঠকরা কি কখনও ভুলতে পারবেন সেই উক্তি: বিপ্লবের আরেক নাম মাধবীলতা!

তাঁর লেখা পড়ে মনে হয়, মার্কস, লেনিন, মাওয়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত নকশালিস্টদের সে সময়ের কর্মকান্ডকে কাছ থেকে দেখে অভিজ্ঞতার আলোকেই রচনা করেন কালবেলা। শুধু এতটুকু জানা আছে যারা অনিমেষ এবং মাধবীলতা হয়ে উঠতে চেয়েছিল, হয়েওছিলেন তারা শেষাবধি কিন্তু সেটাকে কনটিনিউ করলেন না, ব্যতিক্রম আছে কি না জানা নেই। অনিমেষ-মাধবীলতারা শেষাবধি কেন অনিমেষ, মাধবীলতা থাকেননি, তার কারণ জীবনের দৌড় সেটাকে সমর্থন করে না। সমরেশ মজুমদাররা জীবনের রেখায় কালবেলার পরিভ্রমণকে সমাপ্তি দেন না। বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার-উপন্যাসের ফারাক যেন জীবনের গদ্যকেই প্রস্ফুটিত করে।

সমরেশ মজুমদার যে শুধু বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী ছিলেন তা নয়, সাহিত্যিক জীবনের শুরু থেকেই মঞ্চ নাটক ও গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি সমরেশ মজুমদারের ঝোঁক ছিল প্রবল। তাঁর প্রথম গল্প ‘অন্যমাত্রা’ লেখা হয়েছিল মঞ্চনাটক হিসেবে এবং এই গল্পটি ১৯৬৭ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় গল্প হিসেবে ছাপা হয় আর সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর লেখকজীবনের জয়যাত্রা। পাঠকের সামনে উপন্যাসিক হিসেবে এই অসামান্য প্রতিভার আবির্ভাব ১৯৭৫ সালে, সে বছরেই সমরেশ মজুমদারের প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ ছাপা হয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকাতেই।

সমরেশ মজুমদারের লেখায় সাবলীলতা, স্পষ্ট ঘটনার বিস্তার ও নিপুণ পরিমিতিবোধ তাঁকে আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যে খ্যাতি এনে দিয়েছে। জন্মসূত্রে তিনি উত্তরবঙ্গের লোক। কিন্তু তাঁর লেখার সঙ্গে একটা আত্মীয়তা অনুভব করে পূর্ববাংলা তথা অধুনা বাংলাদেশের মানুষ। তাঁর রচিত এমন বহু সাহিত্য রয়েছে যার মাধ্যমে সরাসরি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের প্রক্ষাপট এসেছে একান্নবর্তী পরিবারের মতো। তাই একজন সমরেশ মজুমদার পশ্চিমবঙ্গ নাকি বাংলাদেশে বেশি জনপ্রিয়? —এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যে কারও পক্ষে কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াবে। তবে জীবনের শেষ পর্বে এসে তিনি যত সৃষ্টি রচনা করেছেন তার মধ্যে কী উপন্যাস কী ছোটগল্প, তিনি ফিরে গেছেন তাঁর নিজের জন্মভূমিতে, উত্তরবঙ্গে। সমরেশ মজুমদার তাঁর জীবনের শেষ সময়ের রচনাগুলোতে উত্তরবঙ্গের প্রক্ষাপট ফুটে উঠেছে প্রাণবন্ত হয়ে।

উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ — এই ত্রয়ী উপন্যাসের ওপরই বোধ করি দাঁড়িয়ে আছে সমরেশ মজুমদারের পাঠকপ্রিয়তার সৌধ। অনিমেষ আর মাধবীলতা, সমরেশের পাঠকের কাছেই প্রিয় দুটো নাম। অনিমেষ নামে এক মফস্বলী তরুণের উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় পা রাখা, রাজনীতির অগ্নিগর্ভ পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত — সেই সঙ্গে আত্ম-অনুসন্ধানের গল্প উত্তরাধিকার। বাস্তবতা সম্বন্ধে ধারণাহীন সহজসরল এক তরুণের উপলব্ধির উন্মেষকালের গল্প উত্তরাধিকার। তারপর কালবেলা।

সমরেশ মজুমদার তার কালবেলা উপন্যাসের অনিমেষ ও মাধবীলতা এই দুটি চরিত্র যুব মানসের উপর ভর করে।

বাংলা সাহিত্যে আর কোন উপন্যাসের চরিত্র এভাবে পাঠককে উপর ভর করতে পারিনি। আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতেও পারেননি। এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন সমরেশ মজুমদার। তখন যারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, তাদের একটা বড়ো অংশ অনিমেষ ও মাধবীলতার মায়ায় নিজেকে বেঁধে আনন্দিত হয়েছেন। প্রত্যেকের ছদ্মনাম হয়ে উঠেছে ওই দুই নাম। যারা ডয়েরি লিখছেন সেখানে নিজেদেরকে ওই নামে প্রকাশ করছেন। প্রেমিক প্রেমিকা আড়ালে আবডালে নিজেদেরকে সম্বোধিত করছেন অনিমেষ ও মাধবীলতারূপে।

সমরেশ মজুমদারের শৈশব কেটেছে ডুয়ার্সের গয়েরকাটা চা বাগানে, সেখানেই শিক্ষাজীবনের শুরু, এরপর কলকাতায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি টেনে সেখানেই জীবিকার তাগিদে স্থায়ী হয়েছিলেন। তাই চা বাগানের মদেসিয়া সমাজ থেকে কলকাতার নিম্নবিত্ত মানুষেরা বারবার তাঁর কলমে উঠে এসেছেন বাস্তবতার রক্তমাংস নিয়ে।

সমরেশ মজুমদার উত্তরবঙ্গের সন্তান হাওয়ায় নকশালবাড়ি আন্দোলনে অবলোকন করেছিলেন। সেই আলোকেই তিনি সে সময়ের নকশাল বাড়ি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, বিস্তৃতি ও পরিণতিকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল বলে মনে হয়। আর সেই আলোকেই তিনি আমার সৃষ্টি কালবেলা উপন্যাস রচনা করেন এবং এই উপন্যাসের অনিমেষ ও মাধবীলতাকে তুলে ধরেছেন অভিজ্ঞতা আর কল্পনার মিশেলে। সেই অস্থির সময়ের বাস্তব চিত্র তার কালবেলা উপন্যাসে বাস্তবতার নিরিখে উপস্থাপিত হয়েছে।

বহুমাত্রিক বর্ণিল প্রতিভার অধিকারী লেখক হিসেবে সমরেশ মজুমদার তাঁর লেখনি শুধুমাত্র গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি; এ কথার আভাস আগেই দেওয়া হয়েছে।

সাহিত্যে আলোচনা, খ্যাতি, সমালোচনা এসব থাকবেই। কিন্তু একজন দৃঢ় মনস্ক সাহিত্য হওয়ার জন্য যে স্পৃহা দরকার জীবনজুড়ে, তার পুরোটাই দেখিয়ে গেছেন সমরেশ মজুমদার। তাই তিনি একজন সমরেশ মজুমদার হয়েই বেঁচে থাকবেন পাঠকের হৃদয়ে। যারা নিয়মিত বর্তমান সময়ের বাংলা সাহিত্য পড়েন, গবেষণা করেন বা অন্ততপক্ষে খোঁজখবর রাখেন তাদের কাছে এ কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে, সমরেশ মজুমদার বাংলা কথাসাহিত্যের এক উজ্জ্বল প্রতীক, এক দীপ্তিমান নক্ষত্র। পাঠকপ্রিয়তার তুঙ্গস্পর্শী তাঁর লেখা গল্প উপন্যাস ও অন্যান্য লেখায়। বাংলা সাহিত্যঙ্গনে চিরকালের জন্য অমর হয়ে থাকবেন।