Next
Previous
Showing posts with label প্রবন্ধ. Show all posts
0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in







অনেক কিছুই ইতিহাসকে বয়ে বেড়ায়। এমনকি নিজের মনের কথা বলতে না পারা গাছেরাও। ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে কোনো কোনো গাছও। সেই গাছ নানাভাবে ব্যক্ত করে থাকে ইতিহাসের কোনও এক করুণ অধ্যায়ের কথা। সেও পরবর্তী প্রজন্মকে জানাতে চায় বহু বছর আগে ঘটে যাওয়া কোনও এক কালো দিনের কথা। অতীতে ঘটে যাওয়া এক হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উত্তরপ্রদেশের ফতেহপুর জেলার মুঘল রোডে অবস্থিত ‘বাওয়ানী ইমলি’ নামক একটি বিখ্যাত তেঁতুল গাছ। বর্তমানে অবশ্য তা ভারতের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। ফতেহপুর জেলার বিন্ডকি মহকুমার খাজুয়া শহরের কাছে বিন্ডকি তহশিল সদর দপ্তর থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত স্মৃতিস্তম্ভরূপী এই গাছ বহন করে চলেছে ১৮৫৮ সালের ২৮ শে এপ্রিলে ঘটে যাওয়া ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়কে। এই তেঁতুল গাছেই ইংরেজরা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়েছিল ৫৩ জন বিপ্লবীকে! এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মর্মান্তিক ঘটনা আজও আমাদের আলোচনার বাইরে থেকে গেছে।

১০ই মে, ১৮৫৭ সালে বাংলার ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে সিপাহী মঙ্গল পান্ডের ফাঁসির পর যখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই হিসেবে ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ শুরু হয় তখন বিদ্রোহের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয় মঙ্গল পান্ডের জন্মভূমি উত্তরপ্রদেশেও। উত্তরপ্রদেশের ফতেহপুরে বিপ্লবীরা ঠাকুর যোধা সিং-এর নেতৃত্বে বিদ্রোহের দিকে পা বাড়ায়। এমনকি যোধা সিং-এর সহকারী ছিলেন ফতেহপুরের ডেপুটি কালেক্টর হিকমত উল্লাহ খান। যোধা সিং ও তাঁর নেতৃত্বে থাকা বিপ্লবীরা প্রথমে ফতেহপুর আদালত ও কোষাগার নিজেদের দখলে নেয়। আসলে, যোধা সিং আটাইয়ার মনে অনেকদিন ধরেই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের আগুন জ্বলছিল। তাঁর মনে সেই আগুন জ্বালাতে সহায়ক ছিলেন সিপাহী বিদ্রোহের আরেক বিপ্লবী তাঁতিয়া টোপি। মাতৃভূমি ভারতবর্ষকে বিদেশি ইংরেজদের হাত থেকে স্বাধীন করার জন্য এই দুই মহারথী পাণ্ডু নদীর তীরে ব্রিটিশদের সাথে সংঘর্ষে জড়ান। মুখোমুখি যুদ্ধের পর ইংরেজ সৈন্যরা মাঠ ছেড়ে পালায়। এই দুই বীর কানপুরে তাঁদের পতাকা উত্তোলন করে। যোধা সিং আটাইয়ার মনের সেই স্বাধীনতার জন্য আগুন এতেও নিভল না। ১৮৫৭ সালের ২৭শে অক্টোবর, মাহমুদপুর গ্রামে যখন একজন ইংরেজ ইন্সপেক্টর ও একজন সৈনিক একটি বাড়িতে ছিলেন তখন তিনি তাঁদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারেন। ভুললে চলবে না যে তখনও দেশে সিপাহী বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে। এরপর ওই একই বছরের ৭ই ডিসেম্বর তিনি গঙ্গাপার রাণীপুর পুলিশ চৌকিতে হামলা চালান ও একদল ইংরেজ সৈন্যকে হত্যা করেন। আওয়াধ এবং বুন্দেলখণ্ডের বিপ্লবীদের তিনি সংগঠিত করে ফতেহপুর দখল করেন। পরিবহনের জন্য বিপ্লবীরা খাজুহাকে তাঁদের কেন্দ্র করে তুলেছিলেন। কর্নেল পওয়েল প্রয়াগ থেকে কানপুর যাচ্ছিলেন। সেই সময় একজন বেইমান সর্দার বা প্রধানের খবরে সেই কর্নেল সাহেব সেই স্থানে জড়ো হওয়া বিপ্লবী বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন। কর্ণেল পওয়েল চেয়েছিলেন যোধা সিং-এর শক্ত ঘাঁটি ভাঙতে। কিন্তু, যোধা সিং-এর অব্যর্থ পরিকল্পনায় তা হয়ে ওঠেনি। যোধা সিং গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতির মাধ্যমে কর্ণেল পওয়েলকে হত্যা করেন।

কর্নেল পওয়েলের হত্যার পর ব্রিটিশরা কর্নেল নেইলের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি নতুন দল পাঠায় যোধা সিং ও তাঁর নেতৃত্বে থাকা সমস্ত বিপ্লবীদের শায়েস্তা করার জন্য। কর্নেল নেইলের হাতে বিপ্লবীরা ভারী ক্ষতির মুখে পড়েন, তবুও যোধা সিং-এর মনোবল একটুও কমল না। তিনি ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বড় রকমের যুদ্ধের জন্য নতুন সামরিক সংগঠন করেন আর তার জন্য অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি তহবিল সংগ্রহের পরিকল্পনাও করেন। এইসব কাজের জন্য ছদ্মবেশে যাত্রা শুরু করেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, বিপ্লবীরাও যেমন ছিলেন যাঁরা নিজেদের দেশ তথা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত ছিলেন ঠিক তেমনি কিছু বিশ্বাসঘাতকরাও ছিল যারা বিপ্লবীদের সমস্ত পরিকল্পনা বিদেশি শাসক ইংরেজদের কাছে ফাঁস করে বিপ্লবীদের ধরিয়ে দিয়ে বিপ্লব আন্দোলন তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনকে রোধ করত। হয়তো দাসত্ব বা পশুত্ব এই বিশ্বাসঘাতকদের প্রিয় ছিল। আসলে এই বিশ্বাসঘাতকরা প্রকৃত মানুষের সন্তান ছিল না। অর্গাল নরেশের সাথে আলোচনা করার পর যখন যোধা সিং আটাইয়া খাজুহাতে ফিরে আসেন তখন বিশ্বাসঘাতকেরা এই বৈঠকের খবর ব্রিটিশদের দিয়ে দেয়। ঘোড়হা গ্রামের কাছে ব্রিটিশের সেনাবাহিনী তাঁকে ঘিরে ফেলে। অল্প সংগ্রামের পর, যোধা সিং ও তাঁর ৫১ জন সহ বিপ্লবীগণ ব্রিটিশের হাতে বন্দি হন। অর্থাৎ, আমরা দেখলাম যে, ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে যোধা সিং আটাইয়ার নেতৃত্বে বিপ্লবী তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের দল ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে প্রথমদিকে সফলভাবেই বিজিত হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তাঁদের সেই বিজয়ের আনন্দ ক্ষণস্থায়ী ছিল। নিজেদের জাতির মধ্যে থাকা বিশ্বাসঘাতকদের সাহায্যে ব্রিটিশরা এই বিপ্লবীর দলকে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছিল।

২৮ এপ্রিল, ১৮৫৮। ভারতীয় সিপাহী বিদ্রোহ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক ‘কালো দিবস’। উত্তরপ্রদেশে ফতেহপুর জেলায় অবস্থিত মুঘল রোডের তেঁতুল গাছে যোধা সিং আটাইয়া ও তাঁর ৫১ জন সঙ্গী এবং গৌতম ক্ষত্রিয়— অর্থাৎ মোট ৫৩ জনকে ব্রিটিশ বাহিনী ফাঁসিতে ঝোলায়। তবে এখানেই ব্রিটিশ বাহিনীর নিষ্ঠুরতা থামেনি। তারা গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে ঘোষণা করে যে, “যদি কেউ গাছ থেকে মৃতদেহ নামায় তাহলে তাকেও এই একইভাবে এই তেঁতুল গাছে ফাঁসি দেওয়া হবে।” গ্রামবাসীরা ব্রিটিশ বাহিনীর এই হুমকিতে বেশ ভয় পেয়ে যায়। তারা আর সাহস করেনি মৃতদেহগুলোকে গাছ থেকে নামাতে। দীর্ঘ ৩৭ দিন ধরে মৃতদেহগুলো গাছে ঝুলতে থাকে। শকুনের দল সেই মৃতদেহগুলোকে ছিঁড়ে খেতে থাকে। গ্রামবাসীরা কিছুই করতে পারছিল না। অবশেষে, ওই বছরের জুন মাসে, মহারাজ ভবন সিং তাঁর সহকর্মী সহ আসেন এবং মৃতদেহগুলোকে গাছ থেকে নামিয়ে এনে সেগুলোর দাহ বা সৎকারের ব্যবস্থা করেন। পরে সাহসী বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে সে বাওয়ানী ইমলি গাছটিকে ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

বিন্ডকি ও খাজুহার মাঝে অবস্থিত সেই অভিশপ্ত তেঁতুল গাছটি আজ বাওয়ানী ইমলি বা বাওয়ানী তেঁতুল গাছ হিসেবে এক শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। এই স্মৃতিস্তম্ভটি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মত্যাগের প্রতীক। এমনকি, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী অধ্যায়গুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে আছে ১৮৫৮ সালে ২৮ এপ্রিলের দিনটি। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এই পঞ্চাশের অধিক স্বাধীনতা সংগ্রামীকে প্রকাশ্যে তেঁতুল গাছে ফাঁসি দেওয়ার মতো নৃশংস ঘটনা আজও অনেকের কাছে অজানা। এমনকি যাঁরা ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে চর্চা বা পড়াশোনা করেন বা পড়ান তাঁদের অনেকেই হয়তো এই ঐতিহাসিক নৃশংস ঘটনার কথা তেমন জানেন না। ইতিহাসের এক অন্ধকারতম দিনটির সাক্ষী সেই তেঁতুল গাছটি আজও দাঁড়িয়ে আছে সেই কালো ইতিহাসকে ধরে রেখে। স্থানীয়রা বিশ্বাস করে যে, সেইদিনের নৃশংস ঘটনায় সেই তেঁতুল গাছটিও নিদারুণ কষ্ট পেয়েছে আর তাই সেই গণহত্যার পরে গাছটির বৃদ্ধিও বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ, ইতিহাসের কালো দিনের সাক্ষী এক গাছও হয়। সেও প্রকৃত মানুষের মতো অনুভব করতে পারে নৃশংস ঘটনায় মানুষকে হারানোর হাহাকার ও ব্যথা। আর কালো ইতিহাসকে ধরে রাখতে কিংবা বোঝাতে সেও আর বাড়তে চায় না। হয়তো এই গাছের মতো ইতিহাসও থমকে থাকে মানব সমাজে ঘটা কোনও এক নৃশংস ঘটনায়!
0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in




















মহাভারতের প্রধান মহিলা চরিত্র বলতে দ্রৌপদীকে আমরা বুঝি। তাঁর বিক্রমশালী পঞ্চ স্বামী। নিঃসন্দেহে তিনি এই মহাকাব্যের প্রধান নারী চরিত্র। তাঁর চরিত্রের গভীরতা ও সাহস মনে দাগ কাটে। কিন্তু দ্রৌপদী ছাড়াও মহাভারতে এমন অনেক অনেক নারী চরিত্র আছে, যাঁরা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও কাব্যে উপেক্ষিতা থেকে গিয়েছেন। তাঁদের নাম সহসা কেউ মনেও আনে না

এমনই একজন উপেক্ষিতা নারী আহিল্যাবতী। এই নাগকন্যার জন্যই একদা প্রাণরক্ষা হয়েছিল দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমের। কিন্তু সেভাবে তাঁর কথা জানে না প্রায় কেউই। সর্পরাজ বশকের মেয়ে ছিলেন আহিল্যাবতী। তিনি অত্যন্ত সুন্দরী, বুদ্ধিমতী এবং প্রতিভাময়ী ছিলেন। নিজের ছেলেকে নিজের হাতে অস্ত্রবিদ্যা শিখিয়েছিলেন তিনি।

একদা মহাদেবের বাগান থেকে একটি ফুল চুরি করেছিলেন আহিল্যাবতী। তাঁর এই কাজে অত্যন্ত রেগে গিয়ে দেবী পার্বতী বসক-কন্যাকে মানবী জন্মের অভিশাপ দেন। তবে এই গল্পের শুরু আরও আগে। পঞ্চপাণ্ডব তখনও ছোট। দুর্যোধন ও শকুনি মিলে একবার ভীমকে বিষ খাইয়ে নদীর জলে ফেলে দেন। অচেতন অবস্থায় ভীম এসে পৌঁছন আহিল্যাবতীর নাগ-রাজ্যে। বুদ্ধিমতী আহিল্যা ভীমকে দেখেই তাঁকে দ্বিতীয় পাণ্ডব হিসেবে চিনতে পারেন। বিষক্রিয়ায় ততক্ষণে মৃত্যু হয়েছে ভীমের। আহিল্যাবতীর অনুরোধেই তাঁর বাবা নাগরাজ বশক মহাদেবে দেওয়া বর ব্যবহার করে ভীমের প্রাণ ফিরিয়ে দেন।
পরবর্তীকালে মানবীজন্ম নিয়ে ভীমের পুত্র ঘটোত্‍কচের সঙ্গে বিয়ে হয় আহিল্যাবতীর। আহিল্যাবতী ও ঘটোত্‍কচের ছেলে বারবারিক। তাঁকে যুদ্ধবিদ্যা শেখান আহিল্যাবতী নিজেই। ছেলের অন্তরে দয়ামায়ারও সঞ্চারও করেন তিনি। বারবারিকের প্রতিভায় খুশি হয়ে তাঁকে তিনটি অসাধারণ তীর উপহার দেন মহাদেব এবং অগ্নিদেব দেন একটি ধনুক। মা আহিল্যাবতীর থেকে শিখে অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী বারবারিক মহাভারতের যুদ্ধেও পাণ্ডবদের পক্ষে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন।
0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in






ভোর রাত্রের একটা দৃশ্য এরকম – একটা ঘরের জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসছে রমণ ও শীৎকারের শব্দ। হরিদাস প্রভাতী নাম সংকীর্তন করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে – তার শব্দ। দূর থেকে এগিয়ে আসছে মৃতদেহ কাঁধে শ্মশানযাত্রীর দল। হরিনাম ধ্বনি ও তাদের খোলকরতালের শব্দ। এতো কিছু শব্দ মিলে সেই ভোর রাত্রের যে অনুনাদ বা রেসোনেন্স তৈরী হলো, তাতেই এই দুনিয়ায় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেলো। পৃথিবীর সময় উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করলো। যে মৃত যুবতীটি একটু আগেই কবরে শুয়ে ছিলো, সে জীবিত হয়ে উঠে এলো। ১৯৮০ সাল ১৯৮১র দিকে না গিয়ে এই দুনিয়ার সময় এগোতে লাগলো পেছনে, ১৯০০ সাল বা প্রাচীন পৃথিবীর দিনগুলোর দিকে। আমরা দেখলাম, এখন যে যুবতীটি মৃত, সে বেঁচে উঠেছে, ঘড়ির কাঁটা আরো পেছনে ঘুরতেই সে ধর্মযাজক দ্বারা ধর্ষিতা হচ্ছে! পৃথিবীর সময় আরো আরো পেছোচ্ছে, সোনার দাম কমছে। সেসব দিনগুলোয় আগের মতো দূষণ বা পল্যুশন নেই, সুন্দর একটা প্রাকৃতিক পরিবেশ। গল্পকারের দারুণ কল্পনাশক্তি, অসাধারণ পরাবাস্তবতা! এমনটাই লেখে সুবল দত্ত - তার ‘সময়-শোধন’ গল্পে। ঘড়ির কাঁটাকে এরকম পিছিয়ে নিয়ে গেলে আজকের মানুষ বুঝতে পারবে তাদেরই সমূহ ভুলভ্রান্তি। সত্যিই তো, নিজেদের সংশোধনের জন্যে আমাদের অতীতের থেকে শিক্ষা নেয়াটা বড় জরুরী। সময়কে পেছনে নিয়ে যেতে যেতে নানা ঘটনা পরম্পরাকে দেখিয়ে দিতে দিতে, এই গল্পের পরিসমাপ্তিতে লেখক ঘোষণা করলো- মানবতার বিরুদ্ধে সমস্ত জটিল কার্যকলাপ মুছে যাচ্ছে। এরপরে শুভবুদ্ধির প্রতিশ্রুতি। পৃথিবীর সময় আবার আগের মতোই সামনের দিকে এগোচ্ছে। দারুন এ গল্প – অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ভাবনা ! এখানেই গল্পকার সুবল দত্তের স্বকীয়তা!
সুবল দত্ত এসময়ের একজন উল্লেখযোগ্য গল্পকার। মিডিয়া প্রভাবিত দুনিয়ায় বহির্বঙ্গের এই গল্পকারের পরিচিতি অপেক্ষাকৃত সীমাবদ্ধ। যে ব্যপক পরিচিতি ও প্রচার তার প্রাপ্য , তা তিনি হয়তো এখনো পান নি। সুবল দত্তর সঙ্গে আমার পরিচয় ২০১৬ নাগাদ। থাকেন জামসেদপুরে। তার জন্ম পুরুলিয়ার মানবাজারে – ১৯৫৫ সালে। পেশায় স্টেট ব্যাঙ্ক-এর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। চাকুরী সূত্রে তাকে বিহার ঝাড়খন্ডের বিভিন্ন প্রান্তে যেতে হয়েছে। ওই অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষদের জীবনযাত্রা , ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তিনি বেশ কিছুটা পরিচিত। লেখক জীবনে তার প্রাথমিক আত্মপ্রকাশ কবি হিসেবে। গল্পও লিখেছেন। প্রসঙ্গত এটাও উল্লেখ করা যায়, সুবল দত্ত একজন শিল্পী – তার করা প্রচ্ছদ রয়েছে আমার কাব্যগ্রন্থ ‘অনন্ত জলশব্দে আমি’ তে। এযাবৎ তার দুটো গল্পগ্রন্থ – ‘প্ল্যাগিয়ারিস্ট’ ও ‘প্রদাহবোধ ১১’, যা প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে ২০১৪ ও ২০১৬ সালে। তার প্রৌঢ়ত্বে, রিটায়ার-সময়ের কাছাকাছি। সুবল দত্তের বইদুটো হাতে আসার পর তার গল্পের উপর আমার ভীষণ আগ্রহ জন্মায়। তাই আমি চেষ্টা করেছি তার গল্পকে বোঝবার, তাকে নিয়ে সামান্য লেখবার।
‘শৈলী’ পত্রিকার ৪৭তম / কার্তিক-১৪২৬ সংখ্যা এখন আমার সামনেই। এতে প্রকাশিত হয়েছে সুবল দত্তের একটা গল্প – ‘ইন্দে ইয়লো সামান গে তন্নো’। আমি এই গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়ি। দেখি - একটা তামিলভাষী ভিখিরি গোছের মানুষ, তাকে বুঝিয়ে বাজিয়ে টাকার বিনিময়ে কিনে নেয়া হলো, কেনা হলো লোকটার একটা কিডনী, যেটা অপারেশন করে লাগিয়ে নেয়া হলো পয়সায়ালা মালিক মিহির সিং এর শরীরে। সুস্থ হয়ে কিছুদিন বাদে মিহির সিং এক রাত্রে সুপারভাইজেশনে গেলেন তার কারখানায়। তিনি দেখলেন, অবর্ণনীয় বিষাক্ত পরিবেশে রাত্রে লেবার মজদুরগুলো কাজ করে যাচ্ছে। মিহির সিং আরো দেখলেন, ওই মজদুরগুলোর মুখ কিডনী-বেচা তামিল মানুষটার মুখের মতোই! ওই মজদুরগুলোর ‘পেট থেকে উজ্জ্বল লাল রক্তের মত তরল গড়িয়ে পড়ছে’। এই বর্ণনায় পাঠক থমকে যায় – যে মানুষ একজায়গায় কারখানায় তার শ্রম বিক্রি করছে, সেই মানুষ অন্য জায়গায় তার কিডনীটা বিক্রি করছে! যে দেশ, যে ভাষাই হোক না কেন, তাদের চেহারা এক – তারা হলো নিঃস্ব উপায়হীন শ্রমজীবি মানুষ। তাদের সবার জাতও এক। গল্পটা পড়বার পর আমার চোখে ভাসছে সেই ট্রেনযাত্রী সেই ভিখারীগোছের তামিল মানুষটার মুখ, যে মুখ দিয়ে সে অঙ্গীকার করছে তার দাসত্বের, সে তামিল ভাষায় বলছে - ‘ইন্দে ইয়লো সামান গে তন্নো’ , যার অর্থ হলো ‘আমার যা আছে সব তোমার।’ এই গল্প লেখকের সমাজ ও দর্শণবোধকে আমি আবার সমীহ জানালাম।
এবার সুবল দত্তের প্রকাশিত গ্রন্থদুটো থেকে পড়া কিছু গল্পকে তুলে ধরা যাক। খুঁজে দেখার চেষ্টা করি তার লেখার চরিত্র বা বিশিষ্টতা।
‘বি পি এল’ – গল্পের মূল চরিত্র রজনী নামের লোকটাকে দেখি একটা সাপকে হাতে পিষে ধরেছে , ছোবল খাবার পরও সাপটার মুখ হাতের মুঠোয় চেপে ধরে ওটার সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। যেন সাপটা এই সমাজ ব্যাবস্থারই প্রতিরূপ । রজনী ভূমিহীন, ব্যাঙ্ক-ডিফল্টার, ঋণের দায়ে জেলখাটা, একটা সর্বস্বান্ত মানুষ । ওর কাছে গ্রামের মুখিয়া, বিপিএল কার্ড ইস্যু করা বাবু, ঋণদেয়া ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, অফিসের ক্লার্ক সবাই বিষাক্ত। তাই বিষাক্ত সাপটার সাথে লোকটার খালি হাতে এই লড়াইও সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা লড়াই। যাদের পাবার কথা , তারা বিপিএল কার্ড পায় না। হাজার হাজার চালচুলোহীন মানুষ, পথের ভিখিরী, আরোগ্যহীন কুষ্ঠরোগীর দল এই গল্পে উঠে আসে। গল্পের শেষে দেখি ওই সব মানুষগুলো দলে দলে এগিয়ে আসছে, বাহাতের আঙ্গুলে কালি মাখিয়ে টিপছাপ দিচ্ছে। না কোন দলিলে নয়, কোন কাগজেও না। বর্জিত প্রান্তে পড়ে থাকা একটা বোবা পাথরের দেয়ালে ওরা ওদের আঙ্গুলের নিস্ফল টিপছাপ রেখে যাচ্ছে! সর্বস্বান্ত মানুষদের নিস্ফল টিপছাপ লাগানোর চিত্রকল্পটার মধ্যে গল্পকারের বক্তব্য একটা ধারালো মাত্রা পেয়েছে। লেখার ফাঁকে ফাঁকে এই গল্পেই তার লেখনীতে উঠে এসেছে কিছু অসাধারণ বর্ণনা। বিবেচকী লাইন – যেমন ‘গরিবের সংসার হোলো বহতা নিকাশির জল। ঝির ঝির বইতে থাকে তো বেশ। থেমে গেলেই পচা নর্দমা।’ কিংবা ‘দূরে পলাশ ডাবরের পলাশ জঙ্গল যেন দিগন্তে এক বিশাল সাঁঝা চুল্‌হা। যেন এই বিশাল উনুনে সন্ধেবেলার রুটি সেঁকা হবে।’
আদিবাসী উন্নয়নের নামে প্রত্যন্ত গ্রামে নেমে আসে সান্নাটা। খনির মালিক, পুঁজিপতিদের চক্রান্ত। এসবের জীবন্ত ছবি ‘একটি শেষ বিরলতম উপজাতির অন্তিম পার্বণ’ গল্পে। লিদরি লুগুন –এর মতো কমবয়সী সমাজকর্মী, সৎ অ্যাক্টিভিষ্টরা স্বার্থন্বেষী সমাজ ব্যবস্থার গোপন চক্রান্তে খুন হয়ে যায়। আসল কথা হচ্ছে পুঁজিবাদী উন্নয়ণ! আদিবাসীদের পার্বণে সবাই চুর হয়ে থাকে, হাড়িয়া বা ডিয়েং পানীয়ের নেশায়। সেই পানীয়তে মেশানো থাকে বিষ। একটা গ্রাম, একটা উপজাতি শেষ হয়ে যায় - সেখানে আর বাঁধা দেয়ার কেউ থাকে না। এদেরই জমি লুটে নিয়ে, বন-জংগল দখল করে তৈরী হয় পুঁজিবাদী উন্নয়ণের ইমারত। লেখক খুব মুন্সীয়ানার সঙ্গে এই উপজাতি সমাজ জীবনকে তার গল্পে একেছেন, তুলে এনেছেন দলিত ও পিছিয়ে থাকা সমাজের কথা, তাদের উপর অন্য একশ্রেনীর মানুষের নির্মম শোষনের ইতিকথা।
ছোটগল্পের বিষয় সূত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, জীবনের চলমান স্রোত থেকে গল্পকার সংগ্রহ করেন খন্ড খন্ড উপলব্ধি (perception) , সেটাই হয়ে ওঠে ছোটগল্পের প্রাণবীজ। এমনি ভাবেই ছোটগল্পের মধ্যে প্রকাশিত হয়ে ওঠে চলমান জীবনের সত্য। সুবল দত্ত বিভিন্ন সূত্রে আদিবাসীদের কাছে গিয়েছেন, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের সঙ্গে মিশেছেন। তাই তারই সমূহ উপলব্ধি সামুহিকভাবে মিশে থাকে তার লেখা গল্পগুলোয়।
কুষ্ঠরোগীদের জীবনকেন্দ্রিক গল্প ‘শাম্বর বংশবীজ, অর্জুনের দ্বন্দ্ব’ – এই গল্পে মানবজীবনের সাথে সাথে সমাজজীবনের কুষ্ঠদশার বিবরণই উঠে আসে। বিদেশবাসী ডঃ অর্জুন WHO-র তরফে কুষ্ঠরোগীদের সার্ভে করতে দীর্ঘদিন বাদে নিজের দেশে ফিরে আসে। তার নিখোঁজ বাবাকে সে খুঁজে পায় কুষ্ঠরোগীদের আশ্রমে। আমরা জানতে পারি কুষ্ঠজীবনের অসহায় নির্মমতার কথা, তাদের সমাজ-বিচ্যুত আবরুদ্ধ জীবনের কথা, রোগের চিকিৎসায় ওষুধ কোম্পানীগুলোর ধান্ধাবাজীর কথা। সুবল দত্তের গল্প শুধু কাহিনীমাত্রিকই নয়, গল্পের এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে চাবুক মারা নানা উপলব্ধি। এখানে নায়ক অর্জুন উপলব্ধি করে, মানুষ যদি জরায়ু ভেদ করে তার মায়ের গর্ভে পুনর্বার ফিরে যেতে পারে – তাহলেই এ পৃথিবী পিচাশমুক্ত হবে। এই গল্পে লেখক শোনায় – ‘ অসমোসিস প্রক্রিয়াতে মিথ্যে সত্যের ভেতরে ঢুকে গেছে।’ গল্পের উপসংহারে দেখি আরো এক চরম উপলব্ধি! দেখি দাউ দাউ আগুনে পুড়ে যাচ্ছে কুষ্ঠ সমাজের মানুষজন, পুড়ে যাচ্ছে পচাগলা বিকৃত সময়ের কাহিনী। গল্পের পরিণতিতে বলা হয় – ‘চরম বিকৃতির পর ধ্বংস তারপর শুদ্ধসৃজন হতে বাধ্য।’ গল্পের পাতায় পাতায় এমনি নানা আশ্চর্য, অপ্রচলিত উপলব্ধি পাঠকে অনিবার্য এক দার্শনিকতার মুখোমুখি দাঁড়া করিয়ে দেয়।
সুবল দত্তের সামাজিক অভিজ্ঞতার ফসল - ‘পুনর্জন্ম’ গল্প। এটা আদিবাসীদের জীবন ও সমাজের গল্প। লেখক নিপাট বর্ণনা করছে এক অপ্রচলিত সমাজের জীবন যাপন, তাদের আচার সংস্কৃতি, পালা-পার্বণ, এমন কি কথাবার্তা। গল্পের পটভূমি পরিচিত গ্রাম-শহরের বাইরে , স্বতন্ত্র তার পরিবেশ। এমনই পরিবেশের একটা মেলা, লোকজনের জমায়েত। সেখানে আদিবাসী মেয়ে লিদরি-র উপর শারীরিক অত্যাচার ও তার প্রতিবাদ। এই বিষয় নিয়েই লেখা ‘পুনর্জন্ম’ গল্পটা!
গতানুগতিক কাহিনীর বাইরে বেরিয়ে এসে কি করে অভিনব কাহিনী লিখতে হয়, তার ট্যাকটিস সুবল দত্তের গল্পে হামেশাই খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন, তার গল্প ‘নিস্তার’। এই গল্পের প্রধান চরিত্র মাতাল মাহাতো একটা অন্ধকার ঘরে দিনভর বাঁধা থাকে। রোগের কারণে তার চোখে দিনের আলো সহ্য হয় না, তার শরীরে ইয়া বড় বড় চুল গজায়। মাসে মাসে মাতাল মাহাতোর বউ সেই চুল কেটে ফেরিয়ালার কাছে বিক্রি করে। সেটা তার পরিবারের আয়। মাতালের বউ মোহিণীর দুসরা আয় নিজের শরীর বেচে, এই শরীর বেচাটাকে সে স্বাভাবিক ভাবেই উপভোগ করে, তাতে কোন রাখঢাক নেই। একটাই মাত্র ঘর, সেই ঘরের এক কোনে অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত মাতাল দেখে তার ভাই থুলকু ও তার বউ মোহিণী শারীরিক যৌন সম্পর্কে দিনের পর দিন জড়িয়ে থাকে। এই দৃশ্য মাতাল মাহাতোকেও যৌনকাতর করে তোলে। মানুষের আরোগ্যের জন্যে রক্ত খাওয়া কি জরুরী ? যৌন সম্পর্কে অপারগ মাতাল মাহাতো তার বউ মোহিণীর যোনিতে জিভ দিয়ে ঋতুশ্রাবের রক্ত চেটে চেটে খায়। মোহিণীও নিজেকে উলঙ্গ করে তার অসুস্থ স্বামীর কাছে নিজের রক্তাক্ত জরায়ু মেলে ধরে! এমনই একটা অস্বাস্থ্যকর, নোংরা পরিবেশ, নরকীয় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর যৌনতা, যা কিনা পবিত্র, অথচ অদ্ভুত। এই ‘নিস্তার’ আমাদেরকে অকল্পনীয় গল্পদৃশ্যের মুখোমুখি পৌছে দেয়। মনে পরে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাগৈতিহাসিক প্রতিবন্ধী যুগল ভিখু-পাঁচির গল্পের পচাগলা অন্ধকারময় জীবনের কথা !
সুবল দত্ত নারীর হৃদয়কে গভীর ভাবে অনুসন্ধান করে তাকে উপস্থাপন করেছে ‘কনফেশন’ গল্পে । এই গল্পের মেয়েটি নার্সস্টাফ, সে পরপুরুষদের সঙ্গে কয়েকবার শুয়েছে, নিজের ঘরে অন্যের সংগে যৌনসম্পর্কের অভিজ্ঞতাও তার আছে। এই পদ্মাবতী তার ডিউটির হাসপাতালের প্রেমিক ডাক্তারটির সাথে অবাধে মেলা মেশা করে, তার সাথে একান্তে অনেক অন্তরঙ্গ সময় কাটায়। অথচ এই গল্পেরই অভিমুখ হঠাৎ পালটে যায়। একদিন পদ্মাবতীর শরীরকে ভোগ করার জন্য ডাক্তার তাড়িত-কামুকের মতো হাত বাডায়! তখনই উঠে আসে তীব্র অসম্মতি বা নারীর প্রতিরোধ। কারণ পদ্মাবতী ডাক্তারের মধ্যে এতোদিন একজন প্রকৃত প্রেমিককেই খুঁজেছে, তার ভালোবাসার মানুষটির মধ্যে সে কোন ধর্ষক কিংবা সহজলভ্য কামুক পুরুষকে দেখতে চায় নি। হৃদয়ের যে গভীর অনুসন্ধানটি পদ্মাবতীর মধ্য দিয়ে পাঠকদের কাছে পৌঁছায়, তা হলো শারীরিক যৌন সম্পর্কই সব সময়ে বড় কথা নয় , নারীর হৃদয়ও খুঁজে ফেরে কোন প্রকৃত প্রেম, নিটোল কোনো ভালোবাসা।
গল্পটার নাম ‘সেতু’। একটা নদী, একদিকে গরীব, অন্যদিকে বড়লোক। এই নদীর মাথার উপর দিয়ে বিশাল একটা সেতু। যখন গাড়ী যায়, থর থর করে কাঁপতে থাকে ব্রীজটা। নোংরা নদীপারের কাছেই একটা বস্তীতে থাকে কিসকু আর তার বউ। দারিদ্র, ডায়ারিয়া, এনকেফেলাইটিস এসব নিয়েই অপরিচ্ছন্ন জীবন। এই কাহিনী টানটান একমুখী কোন গল্প নয়। এ গল্প যেন পথ চলতে চলতে চোখ মেলে দেখা – এতে উঠে আসে অনেক ঘটনা, জীবনের অভিজ্ঞতা, ভাবনারা। বৃষ্টি, বৃষ্টি - এ গল্পের দ্রুতগামী ঘটনারা আসে এক অতি-বর্ষণের রাতে। চারদিকে জল থই থই। নদীতে জলের স্রোত। এমন অবস্থায় নদীর উপরের সেতুটা ভেঙ্গে পড়ে। এমনি দুর্যোগের সময় কিসকুর বউ জন্ম দেয় একটা বাচ্চার। বানভাসি জল, না ডাক্তার, না অ্যাম্বুলেন্স। কিসকু তার সদ্যোজাত প্রথম সন্তানটাকে জলের ছাট বাঁচাতে একটা ঝুড়িতে ঢাকাঢাকি দিয়ে রাখে। তারপর সদ্যপ্রসবা বউর হাতে হাত, সদ্যোজাত সন্তান ঝুড়িতে – মাথায় তোলা, কিসকু জলের উজান ঠেলে নির্ভয়ে হাটতে থাকে। সে চায় তার প্রজন্মকে বাঁচাতে, নিজেরা বাঁচতে।
গল্প সমাজ ও জীবনের দর্পণ। বর্তমান জটিল জীবনের বিভিন্ন দিক একই গল্পের মধ্যে মিলে মিশে থাকে। ‘ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা ছোট ছোট দুঃখকথা / নিতান্তই সহজ সরল’ – এটা ছোট গল্পের পরিচয়। অথচ উক্ত ছোট্ট পরিধিতে আজকের ছোটগল্প যে দাঁড়িয়ে থাকবে তারও কোন গ্যারান্টি নেই। সুবল দত্তের গল্প চিরাচরিত ছোটগল্পের এই সংজ্ঞাকে অতিক্রম করে গেছে।

কানু ওরাঁওর বাঘের সঙ্গে মোকাবিলার গল্প ‘দৌড়’। গল্পের পটভূমি জঙ্গলঘেরা অঞ্চল - সরায়বিন্দা, বাঘবিন্দা, মহুলটাঁড়। কানু বাঘ মারতে বেরিয়েছে, বাঘেদের ওপর ওর খুব রাগ। জঙ্গলের মধ্যে বিপদজনক অবস্থা কানু যখন বাঘেদের মুখোমুখি হয়, তখন বোঝা যায় তার সামনে বাঘের মতোই উপস্থিত কিছু হিংস্র, উগ্রপন্থী মানুষ এবং নারীও! এই গল্পের বুনোট খুব আকর্ষনীয় – গল্পে বন জঙ্গল আর আদিবাসী পরিবেশের বর্ণনা পাঠকদের নিশ্চয়ই ভালো লাগবে।
গল্পের রূপবৈচিত্র্য খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, কোন লেখা সাংকেতিক বা প্রতীকধর্মী, কোথাও রয়েছে প্রেম আখ্যান, কোথাও মনস্তাত্বিক টানাপোড়েন। আবার কোন লেখা প্রত্যন্ত আদিবাসী সমাজকে প্রধান্য দেয়। গল্প হতে পারে বস্তনিষ্ঠ, কিংবা কাল্পনিক, অথবা কাব্যিক। কোন গল্পে বিন্যাস ও আঙ্গিক প্রধান্য পায় । গল্পের বহুধাবিস্তৃত বহুমাত্রিকতার দুনিয়ায় সুবল দত্তের সফর অনেকটাই। তবে তার বেশীর ভাগ গল্পেই বিভিন্ন মাত্রা একসঙ্গে মিলেমিশে থাকে। কোন গল্পের বিশেষ মাত্রা কি , তা নির্ণয় করা একটু মুস্কিলের কাজ।
তবুও লেখালেখির বৈশিষ্ট্য ও গুনগত-প্রাধান্যের ভিত্তিতে সুবল দত্তের আরো কিছু গল্প নিয়ে আলোচনা করা যাক।


গল্পের বিন্যাস

‘প্রদাহবোধ-১১’ গল্প সংকলনের প্রথম গল্প ‘ও অকূলের কূল, ও অগতির গতি’। এ গল্পটা প্রভু মন্ডলের, যে কিনা মাস্টার অফ ফার্মেসী পাশ, তারই দশ কিলোমিটার পদযাত্রার গল্প। যাত্রাপথের দু’ কিলোমিটার বাদে বাদে গল্পটার এক একটা পরিচ্ছদের নাম দেয়া হয়েছে কাম, ক্রোধ, মোহ, লোভ, দম্ভ ও মোক্ষ। গল্পের এই বিন্যাস অভূতপূর্ব! এর পরিচ্ছদগুলোয় শুধু যাত্রাপথের বিবরণই থাকে না, আসে প্রভু মন্ডলের জীবন, যৌনতা, নকলি ওষুধ কোম্পানীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ, প্রতিবাদ। এমনকি ব্যক্তি নির্যাতন, সমাজকে মরনের দিকে ঠেলে দেয়ার মতো লোভ, মোক্ষর নামে ভন্ড অসাধু ও ধর্মীয় মানুষদের নিপাত কামনা ও বিদ্রোহ এ গল্পের পরিচ্ছদে ফিরে ফিরে আসে। নকলি ওষুধ বানিয়ে যারা লক্ষ লক্ষ টাকা কামায় তাদের বিরুদ্ধে এক ফার্মাসিস্টের লড়াই এ গল্পের মূল উপজীব্য হলেও, সুবল দত্তের লেখনী, কল্পনা , বর্ণনাতে এ লেখা একটা সামাজিক বহুমাত্রিকতা পেয়েছে। আমার বিচারে, অতুলনীয় এ গল্পের বিন্যাস।

গল্পের প্লট

গল্পের নাম – ‘সীতাহার’। ঘুপসি অন্ধকার ঘর। সেখানে থাকে অন্ধ কানামতি। এই অন্ধকার কামরায় যুবতী কাজের মেয়ে, বিলাতিকে আমরা দেখি। সে কাপড় খুলে নগ্ন হয়ে লড়াই করছে কানা মতিকামারটার সঙ্গে। সে লড়াই কোন যৌন আক্রমণ বা প্রতিরোধের না। কাজের মেয়েটা সোনার সীতাহার চুরি করেছে, এরপর আরো কিছু হাত সাফাই করার জন্যে মেয়েটা আলমারির চাবির দখল নিতে চায়। কানামতি তা বুঝতে পারে। তাই ঘরের মধ্যে ডান্ডাডান্ডি। একদিকে শক্ত সমর্থ বয়স্ক একটা কানা লোক, অন্য দিকে অল্প বয়েসী একটা মেয়ে। অনেক সময় ধরে এই লড়াইএর পর আঘাতে বিলাতি মারা যায়। গল্পের পরিণতিতে জানা যায় ওই সোনার সীতাহারটা বিলাতির বিয়ের জন্যেই সংরক্ষিত ছিলো। গল্পের শেষে থাকে ছোটগল্পের চমক। একটা আবদ্ধ ঘরে নগ্ন যুবতীর সঙ্গে বয়স্ক কানা লোকটার এই লড়াইএর প্লট ও গল্পের আঙ্গিকটা আমাদের চমকে দেয়!

গল্পের কল্পবিজ্ঞান

কখনো কখনো কল্পবিজ্ঞানের জগতে ঢুকে পরে সুবল দত্তের গল্প। যেমন গল্পে এসেছে একটা বিশাল ক্রিস্টাল পাথর, যাতে বিশেষ কিছু ধাতব পদার্থ, যার গুণে খাড়া পাহাড়ের গায়ে ঝুলন্ত ওই বিশালাকায় ক্রিস্টাল পাথরটা ব্রহ্মান্ডের অন্য গ্রহগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখার ক্ষমতা রাখে। ওই ক্রিস্টাল পাথরটা টেলিট্রান্সপোর্টেশনের মাধ্যম। কোন লোক তিহার জেলে আটকে আছে, কিন্তু এই টেলিট্রান্সপোর্টেশনের মাধ্যমে তার ত্রিমাত্রিক শরীর ওই পাথরটির উপর হাজির হয়ে আছে [ গল্প - মোতি লাকড়া]। বিজ্ঞানে এমন হয়েছে কিনা জানি না, গল্পকার এখানে অতি আশ্চর্য বৈজ্ঞানিক কাহিনী ফেঁদেছে। তাতে আমাদেরই পরিচিত মানুষজন, সামাজিক আচার সংস্কৃতি। কেন্দ্রে কল্পবিজ্ঞানের একটা ক্রিস্টাল পাথর – এমনি ভাবেই টান টান সাসপেন্স রেখে আমরা গল্পটাকে উপভোগ করি।
ভূমিকায় উল্লিখিত ‘সময়-শোধন’ গল্পে নানা শব্দ মিলে যে অনুনাদ বা রেসোনেন্স তৈরী হয়, তাতে যে সব অবিশ্বাস্য কান্ড ঘটে যায়, তাতেও কল্পবিজ্ঞানের ছায়া থাকে।
 
গল্পের প্রতীক ধর্ম –

সুবল দত্তের গল্পের প্রতীকের ব্যবহার আছে। মানব সংষ্কার, মানবিক আন্দোলন, বই লেখা সৃস্টিশীলতা – এগুলো কি ব্যর্থ সময়যাপন? একজন মানুষ কিংবা লেখকের মৃত্যু ? একটা কালভার্টের নীচে নালি, সেখানে থকথকে কালো পাঁকে পরে আছে একটা অর্ধপ্রোথিত লাশ – লোকটার হাতে ধরা একটা বই , কিংবা খাতা, ধরা যাক ওটা ডায়েরী। গল্পের মধ্যে দেখি লেখা মন্তব্যটা – ‘সংস্কৃতির দেহ নব্বই অংশ পাঁকে ডুবে আছে’ ! ওই ডায়েরীর মধ্যে ধরা আছে বর্তমানের কবিদের শ্রেষ্ঠ চিন্তা ভাবনা, ওরই মধ্যে আছে মৃতবৎ সংস্কৃতির পুনর্জীবনের দিশা। কেউ কি এগিয়ে আসবে এইসব শ্রেষ্ঠ চিন্তা ভাবনা ও সংস্কৃতিকে উদ্ধার করতে? পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে মহীন নামে এক কবি ঝাপিয়ে পড়লো নালায়, পাকের মধ্যে। গল্পের শেষে মহীন সেই ডায়েরী উদ্ধার করতে সক্ষম হলো। এমনি ভাবেই প্রতীক ব্যবহারের মাধ্যমে সংস্কৃতি সম্পর্কে হতাশ মানুষকে সজাগ ও উজ্জীবিত করার গল্প ‘একটি অপ্রকাশিত কাব্য-সংকলনের উদ্ধারের কাহিনী’ আমাদের চমকিত করে।
 
চরম বাস্তবতার গল্প

‘বিকলাঙ্গদের কথা’ প্রান্তিক জীবনের চরম বাস্তবতার কথা বলে। প্রথম সন্তান বিকলাঙ্গ, সেইই ওই পবিবারের একমাত্র পুঁজি। বিকলাঙ্গদের খাতায় অসুস্থ ছেলেটার নাম, তা দেখিয়ে ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মাসে মাসে টাকা আসে। রোগগ্রস্থ ছেলেটা যখন অসময়ে মারা যায়, তখন ওর বাপ ফর্মে মৃত ছেলের টিপছাপ নিয়ে পৌছে যায় ব্যাঙ্কে। অন্তিম কিস্তির টাকাটা যাতে মার না যায়। শোকগ্রস্থ, শ্মশানযাত্রী ভুকলের ক্ষেত্রে এটাই আসল বাস্তব। সেইদিনই বিকলাঙ্গ ছেলেটির আসন্ন প্রসবা মা, ভুকলর বউ, শ্মশানের কাছে ঝোপের আড়ালে একটি সুন্দর ছেলের জন্ম দেয়। ভুকল সবার অজান্তেই, নিজের নবজাত শিশু পুত্রটির একটা পা দুমড়ে মুচড়ে দেয় – যাতে বড় হয়ে এই সন্তানটিও বিকলাঙ্গ হয়েই বেঁচে থাকে। যাতে ভবিষ্যতেও বিকলাঙ্গ খাতায় এই ছেলেটার নাম দেখিয়ে মাসে মাসে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা পাওয়া যায়। এই গল্পের অন্য একটা ডায়মেনশনও আছে। পেটের দায়ে ভুকলর বউ অন্য পুরুষের সঙ্গে শোয়, ভুকল জানে না সদ্যজাত সন্তানটি তার বীর্যের প্রকৃত উত্তরসুরী কিনা? – নাকি তারই বউএর গর্ভে জমিদার ছোট শর্মার সন্তান! এই টানা পোড়েন, এই বাস্তব পরিস্থিতির আলোকপাতে আলোচ্য গল্পটা এসময়ের একটা অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প হয়ে ওঠে।

গল্পে কাল্পনিকতা

সুবল দত্তের ‘বিস্ফোরক’ গল্পে দেখি একটা লোক পালঙ শাকের থলে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। সেই ব্যাগের মধ্যে ভরা আছে দুটো জীবন্ত বোমা; যেগুলো যে কোন মুহূর্তেই ফেটে পড়তে পারে! সেই বোমা দুটো ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে! তাদের আলোচনার বিষয় সমাজ, ধর্ম, ইলেকশন, এমনকি মার্কসের তত্বও! ওই লোকটি নিমিত্তমাত্র, বোমাদুটোই সিদ্ধান্ত নেবে কখন তারা ফেটে পড়বে। ওই বোমাদুটোর মধ্যে রয়েছে যাবতীয় মানবিক গুনাগুন। গল্পের মধ্যে বোমাকে দিয়ে কথা বলানো, লেখকের এই কাল্পনিকতায় আমরা চমকে যাই!
আরেকটা গল্প ‘তোমায় নতুন করে পাব বলে’- এতে বাংলাভাষা প্রেমী এক লেখক হাসপাতালের নির্জন কক্ষে শুয়ে আছে। লোকটা নাম সুবল দত্ত, লেখক নিজেই। বাংলা ভাষা চর্চার ভবিষ্যত নিয়ে লোকটা চিন্তিত। অতি আধুনিক চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে সময় এগোতেই লোকটা তার কল্পনায় আবিস্কার করে তার বেডের চারপাশে আরো অনেক কবি লেখক সাহিত্যিকদের মুখ। কে নেই সেখানে। অশোক মিত্র, বারীন ঘোষাল, কাজল সেন, সমীর রায়চৌধুরী, অজিত রায় – এমন কি স্বয়ং মহাশ্বেতা দেবীও তার বিছানার চার পাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে। তাদের সবার মুখে এক একটা করে বেলুন ফুলে উঠতে থাকে – সেইসব বেলুনগুলো থেকে বেরিয়ে আসে অজস্র অক্ষর – উঠে আসে বাংলা ভাষার জয়গান। সুবল দত্ত গল্পে এমনই এক কাল্পনিক আবহ তৈরী হয়, কল্পনার কলমে সে লিখে ফেলে বাংলাভাষাকে উজ্জীবন করার আরোগ্যকথা।

গল্পের পরাবাস্তবতা ও যাদুবাস্তবতা

আধুনিক গল্পের বিশেষ বৈশিষ্ট্য পরাবাস্তবতা ও ম্যাজিক রিয়েলিজম। পরাবাস্তব ও যাদুবাস্তব উভয়ক্ষেত্রেই যাদু ও বাস্তবতার মিশেল থাকে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোস-এর লেখায় এর প্রচুর উদাহরণ আছে। এবার আসা যাক সুবল দত্তের লেখায়।
তার ‘অন্তর্জলি’ গল্পের একটা দৃশ্য – ‘মনে হলো পুরো পুকুরটাই মস্তবড়ো আগুনের গোলা। …… ততক্ষণে জলে প্রচুর লোক নেমে গেছে। …… নাভিজলে দাঁড়িয়ে থাকা ওদের সবার প্রচন্ড প্রদাহ। নানা রকমের কষ্ট ও দৈন্যতাগুলি ভিন্ন ভিন্ন রঙের অগ্নিশিখা হয়ে তাদের সারা শরীর পোড়াচ্ছে …… ।’ এই বর্ণনাটা পুকুরের মধ্যে খাটে বসানো এক মৃতমুখী মহিলা ও তার ধর্ষক লোকটার অন্তর্জলি ক্রিয়াকর্মের দৃশ্য। এখানে হিংসা, ক্রোধ, ভয়, উৎকন্ঠা নিয়ে জড়ো হয়েছে জনতারা – সারা পুকুরটাই যেন মস্তবড়ো আগুনের গোলা হয়ে গেছে। আমরা দেখি পরাবাস্তবতার সফল প্রয়োগ।
‘অমূর্ত’ গল্পের দৃশ্যে দেখি যাদুবাস্তবতার ছোঁয়া! এখানে শিল্পীর ছবি আঁকার ব্রাশ স্থির, অথচ ক্যানভাস উঠছে, নামছে, সরছে। কোন এক অমূর্ত অদৃশ্য শক্তির চালনাতেই নির্মিত হচ্ছে শিল্প, আঁকা হয়ে যাচ্ছে ছবি, চিত্রমালা। দর্শক নিখিলেশ কিংবা ছবি আঁকে যে ছোট্ট ছেলেটা তারা অনড়, স্থির। গল্পকার এখানে যে বার্তা দিতে চান, তা হলো শিল্পের ক্ষেত্রে এই অদৃশ্য সত্ত্বাটাই মুখ্য – সে কখন যে কাকে দিয়ে কি আঁকিয়ে নেবে তা কেউ জানে না!
 
গল্পের মধ্যে কাব্যকথা

বিপত্নীক বাবা চোখের জল মুছতে মুছতে স্বামীর ঘরে গোলাপিকে পাঠিয়েছে। তার জীবন দুর্বিষহ! নির্জন জলাশয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে গোলাপি। সে দেখছে, চারাপোনা ব্যাঙাচির ঝাঁক ভারি জলের ভিতর থেকে একটুকরো রুপালি আলো টেনে তুলছে। এই গল্পে একটাই চরিত্র, একজন যুবতীর জলের চোরাপাকে ডুবে আত্মহত্যা করার গল্প। চারপাতার এই গল্প ‘সলিল সমাধি’। এই আলোচ্য গল্পটির কাব্যরূপ আমাদের মনে চিরন্তন হয়ে থাকবে। গদ্যের মধ্যে এমন কাব্যিক আবহ সুবল দত্তের কলমে অনায়াসেই চলে আসে। এটাই তার লেখার গুন!

গল্পের অসাধারণ কিছু টুকরো দৃশ্য

অদ্ভুত অদ্ভুত সব দৃশ্য কল্পনা সুবল দত্তের গল্পে হামেশাই উঠে আসে। গল্পকারের ছোট ছোট এক একটা লাইন বা কয়েকটা লাইনের বর্ণনা আমাদের চমকে দেয়! কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যাক,মোতি লাকড়া লোকটা ‘ লিঙ্গতে দড়ি বেঁধে মাল বোঝাই টেম্পো টেনেছে’। [গল্প - মোতি লাকড়া]
‘মরার হাতের টিপছাপ নিয়ে ভুকল টাকা তুলতে এসেছে’। বিকলাঙ্গ মৃত ছেলের টিপছাপ নিয়ে সত্যি কেউ কখনো ব্যাঙ্কের থেকে টাকা তোলার কথা কল্পনা করেছে কি?[ গল্প – বিকলাঙ্গদের কথা]
সিঙ্কু নিজের স্ত্রীকে ধর্ষণ করার শাস্তি দিচ্ছে, অকল্পনীয় পদ্ধতিতে দেয়া হচ্ছে ধর্ষককে শাস্তি, তার বর্ণনা ‘সিঙ্কু মনোযোগ সহকারে ছুড়ি দিয়ে তার পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলেছিল। লোকটা …… জেগে রয়েছে কি অজ্ঞান বোঝা যায় না। একটু দূরে উইঢিবি ভেঙে ফেলে সেই ঢিবি তার পেটে চাপিয়ে দিয়েছিল। সেখান থেকে অজস্র উইপোকা বেরিয়ে তার উন্মুক্ত প্রস্রাবনালীর ভিতর দিয়ে ধুকতে লাগল।’ [গল্প – অন্তর্জলি ]
গুরুদেবের নির্দেশে নিজের মৃতপ্রায় স্ত্রী ও ধর্ষক লোকটার অন্তর্জলি ক্রিয়াকর্মের আয়োজন যেভাবে সিঙ্কু যে ভাবে করছে, তা আমার ভাষায় এরকম। - একটা খাট পুকুরের জলে পাতা হয়েছে। পায়াগুলো জলে কিছুটা ডুবে রয়েছে। সিঙ্কুর স্ত্রী ও ধর্ষক লোকটাকে সেই খাটে রাখা হলো। মৃতপ্রায় দুটো মানুষ , একজন অপরাধী , অন্যজন নিরপরাধ - তারা খাটে বসে আছে পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে। ওরা তখন পারলৌকিক শান্তিকামী। এমন অন্তর্জলি যাত্রার বর্ণনা বাংলা সাহিত্যে আরো আছে কিনা, আমি জানি না। [গল্প – অন্তর্জলি ]
গল্পের শুরুটা এমনি ‘ উঠোনের বাইরে পুটুসের বেড়া। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই সেখানে পেচ্ছাপ করতে গিয়ে একটা হলদে তীর পেচ্ছাপের উল্টো স্রোত বেয়ে সমীরণের তল পেটে বিঁধল’। [ গল্প – শূন্যতাবোধ]
ইত্যাদি।
সুবল দত্তের গল্পে অনায়াসেই ঢুকে থাকে জীবনের গূঢ় তত্ব, অদ্ভুত দার্শনিকতা। দিগন্ত প্রসারী তার কল্পনাশক্তি। তার লেখার বিন্যাস ও আঙ্গিক অসাধারণ। তার গল্পের প্লটগুলোও অসামান্য। আমরা দেখেছি গল্পের মধ্য দিয়ে সে পাঠকদের নিয়ে যায় অপরিচিত কোনো কল্পবিজ্ঞানের জগতে। আবার কখনো কখনো তার গল্প হয়ে ওঠে কবিতা। গল্পের মধ্য দিয়ে সে পাঠককে আটকে রাখে অসীম কল্পনার দিগন্তহীন জগতে। আদিবাসী প্রত্যন্ত সমাজ সংস্কৃতি ও সাম্প্রতিক সভ্যসমাজ – এ দুটোই তার পরিচিত বিষয়, তাই তার লেখা বৈচিত্রময়। এই লেখকই কখনো চরম বাস্তবতাবাদী, - তারই কলমে বেরিয়ে আসে ‘বিকলাঙ্গদের কথা’, প্রান্তিক জীবনের চরম বাস্তবতার ইতিহাস। আমরা দেখেছি তার গল্পে পরাবাস্তবতা ও ম্যাজিক রিয়েলিজমের সফল প্রয়োগ।
সব কিছু মিলিয়েই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সুবল দত্ত তার গল্পে বহুমাত্রিকতার সফল স্বাক্ষর বহন করেছেন এবং এসময়ের তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ গল্পকার। তার লেখার স্টাইল এ সময়ের বাংলা সাহিত্যে বিরল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, সম্প্রতি মার্চ – ২০২০তে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত মঞ্চে সুবল দত্তকে প্রদান করা হয় ‘একমাত্র সাহিত্য সম্মান-২০১৮’। আমি আশা করবো বর্তমান সময়ের বাংলা সাহিত্যে এই বিশিষ্ট গল্পকারের গল্প আরো বেশী বেশী পঠিত হোক এবং আলোচিত হোক। তিনি শারীরিক দিক থেকে সুস্থ থাকুন। আমি চাই তার গল্পের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার। ভবিষ্যতেও তিনি সক্রিয় থাকুন। আমাদের দাবী, সুবল দত্ত এমনি আরো অনেক অনেক ভালো ভালো গল্প আমাদের উপহার দিন।



[প্রবন্ধটি ধানবাদের একটা কাগজে ২০২০ সালে প্রকাশিত]
0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - সেবিকা ধর

Posted in





কে কোথায় কতবার গেছেন বা কত দিন থেকেছেন, তার ওপর পারিপার্শ্বিকতা ও সেই মানুষের জীবন যাত্রার যাপনের কথাবার্তা নির্ভর করে না।বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কোনো দিন আফ্রিকাতে যান নি, কিন্তু তিনি চাঁদের পাহাড়ের মতো অসামান্য একটি লেখা লিখেছেন যা শুধু বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্যের একটি অন্যতম সম্পদ।

থাক সেসব প্রসঙ্গ।রবীন্দ্রনাথ সাতবার ত্রিপুরায় এসেছিলেন।ত্রিপুরার মহারাজাদের হৃদ্যতা, হৃদয়ের শব্দ, আন্তরিক আহ্বান কবিকে মুগ্ধ করেছিল এবং কবি কোথায় যেন ত্রিপুরার সঙ্গে এক অদৃশ্য ডোরে বাঁধা পড়েছিলেন, না হলে সেই সময় পরাধীন ভারতবর্ষে যখন অখণ্ড ভারতের ত্রিপুরার সঙ্গে অখণ্ড বঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই

ভালো নয়, তার মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ বারেবারে ঘুরে ঘুরে এসেছেন ত্রিপুরায় এবং এখানকার রাজাদের আনুকূল্যে তিনি বসবাস করেছেন এখানে।এসব নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, বইপত্র আছে। সেসব আমরা জানি। ফলে নতুন করে এই ব্যাপারটা নিয়ে বলার কিছু নেই।বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাতবার ত্রিপুরায় আসার কথা বলেছি।

কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন এই যে তিনি সাতবার ত্রিপুরায় এসেছিলেন তাতে ত্রিপুরার কী এল,কী গেল? তাতে ত্রিপুরার মানুষ, ত্রিপুরার ভূপ্রকৃতি, ত্রিপুরার যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, যা অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বর্ধিষ্ণু তার কী এল গেল?

এখন কথা হল যে একজন কবি যিনি আন্তর্জাতিক মাপের এবং একই জাতীয়ও। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক না হলে জাতীয় হওয়া যায় না।অনেক লেখকই আন্তর্জাতিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের যে আন্তর্জাতিক বোধ ও চিন্তা তা বারবার প্রস্ফুটিত হয়েছে তাঁর লেখার মধ্যে,বিশেষ করে প্রবন্ধের মধ্যে তিনি নিজের আন্তরিক চেতনা ও চৈতন্য তুলে ধরেছেন।যেকথা বলছিলাম, রবীন্দ্রনাথের বার বার ত্রিপুরায় আসার কারণ ত্রিপুরার মানুষের অসম্ভব আতিথ্য এবং অতি যত্ন আত্তি তিনি পেয়েছেন।কিন্তু তাঁর কথা সাধারণ মানুষের কী কাজে লেগেছে? এখন আমাদের কথা হলো একজন বড় লেখক, কবি, সাহিত্যিক একেবারেই নির্দিষ্ট কারওর নন, আবার নিজেরও নন।তাঁর নিজস্ব গতি এবং চলন তাঁর জীবনের সূত্র ধরে তাঁকে অন্য পথে নিয়ে যায়।এবং তিনি সেই পথে চলতে থাকেন এবং চলতে চলতে দুপাশে কখনও পাহাড়ি গোলাপ, কখনওবা বন্য সৌন্দর্য, কখনও কেয়ারী করা মনোরম বাগান।কখনও বা অতি দীর্ঘ বাগিচা দেখে তিনি মুগ্ধ হন। তার সুগন্ধে তিনি মুগ্ধ হন এবং তাঁর স্বভাব কৌতূহলে, স্বভাব সৌন্দর্য মুগ্ধতায় তিনি ঢুকে পড়েন সেই বাগানের মধ্যে,সেখানে থাকে অনেক আনন্দ,অনেক মায়া, কায়া, জীবন যাপনের গান।রবীন্দ্রনাথ সেই গানে অবগাহন করেছেন এবং নিজে নিজে সেই সঙ্গীতের যে সুর ও মূর্ছনা তাকে আত্মীকরণ করেছেন এবং তাকে ধরেই অনেকটা পথ অতিক্রম করেছেন।আবার নতুন বাঁকে তিনি ঘুরে গেছেন এবং ঘুরে গেছেন বলেই তাঁর সাহিত্য এবং সৃষ্টি, ছবি আঁকা এবং অন্যান্য কাজ শান্তিনিকেতন তৈরি করা, শ্রীনিকেতন তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে কতখানি প্রাসঙ্গিক? এর উত্তর দিতে গেলে এক সমুদ্র জিজ্ঞাসা এবং এক হিমালয় উত্তর আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। এর উত্তর খুব সহজ নয়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিঃশ্বাসেই জড়িয়ে থাকেন। রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রশ্বাসে জড়িয়ে আছেন।যেমন একজন ভক্ত,আস্তিক মানুষ যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন তাঁর যে ইষ্ট মন্ত্র, তাঁর যে জপা এবং অজপা মন্ত্রযান,তা যেমন তাঁকে নিয়ে যেতে থাকে কোনো এক অপার্থিব সুরলোকে, তেমনি একইভাবে একজন রাজনৈতিক কর্মী তিনি মার্কসবাদী বিশ্বাসী হতে পারেন,তিনি গান্ধীবাদী বিশ্বাসী হতে পারেন কিংবা অন্য যেকোনো দর্শনে বিশ্বাস রাখতে পারেন এবং সেই দর্শনের যে মূল কথা সেই দর্শনের যে মূল বাণী, সেই দর্শনের যে সমাজ বিপ্লব অথবা অহিংসার পথে এগিয়ে যাওয়ার যে কথাবার্তা, তাকে তিনি আত্মীকরণের মাধ্যমে নিজের মধ্যে নিয়ে আসেন এবং একজন প্রকৃত রাজনৈতিক কর্মী এবং সংগঠক তাঁর কাজ করে যান সারাজীবন। কখনও বিপ্লবের স্বার্থে, কখনও অহিংসার স্বার্থে, কখনও গ্রাম পুনর্গঠনের স্বার্থে,কখনও আরও কোনো দার্শনিক স্বার্থে।রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে এমনই এক দর্শন কাব্য, তাঁর লেখা পড়লে পরে যে দার্শনিক অভিঘাত, যে দার্শনিক ব্যঞ্জনা, যে দার্শনিক জিজ্ঞাসা আমাদের সামনে ফুটে ওঠে বারবার তাঁর নাটকে,তাঁর প্রবন্ধে, তাঁর ছোট গল্পে, তাঁর উপন্যাসে,তাঁর গানে। তিনি সর্বত্রগামী। সব কিছু লিখেছেন ,এবং অসম্ভব পরিশ্রমী ছিলেন তিনি। আমরা জানি বা পড়েছি বহু নবজাতক বা নবজাতিকার নামকরণ তিনি করেছেন। তিনি পরাধীন দেশে গ্রাম উন্নয়নের জন্যে শান্তিনিকেতন এবং শ্রীনিকেতন তৈরি করেছিলেন। শান্তিনিকেতনকে করেছেন আন্তর্জাতিক বিদ্যাচর্চা এবং সারস্বত চর্চার অন্যতম জায়গা।পাশাপাশি শ্রীনিকেতন হয়ে উঠেছে আমাদের গ্রামীণ শিল্পকলা এবং শিল্পকর্মের যে প্রতিভূ তাকে স্পষ্ট করার জন্য কোনো এক সংগঠন।সম্পূর্ণ স্বদেশী চিন্তায়, স্বদেশী ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ এই পথে এগিয়েছেন, আবার পাশাপাশি পাশ্চাত্যের আলো, পাশ্চাত্যের জ্ঞান ও বোধ,চীন, জাপানের যে দার্শনিক চিন্তা, ইরাণও পারস্যের যে বিবিধ শিল্প সৌকর্য, ইউরোপের কারিগরি প্রভাব ইত্যাদি প্রভৃতি তিনি ভারতে প্রয়োগ করেছেন।পুত্র রথীন্দ্রনাথকে তিনি বাগিচা চর্চা বিদ্যা শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন বিদেশে।এমন নানা কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আমাদের মনে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, যে কীকরে মানুষ ভোর চারটের সময় উঠে রাত্রি বারোটা একটা পর্যন্ত কাজ করতেন।বিনিদ্র চোখে তিনি জেগে থাকেন সাধারণ মানুষের জন্য,গ্রাম উন্নয়নের জন্য,গ্রাম পুনর্গঠনের জন্য,তিনি জেগে আছেন মানুষের কল্যাণের জন্য জন্য,মানুষের আত্মমর্যাদার জন্য।সেখানে কোনো রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা নেই,সেখানে কোনো রাজনৈতিক কাঠামো নেই,রাজনৈতিক বন্ধন নেই। রবীন্দ্রনাথ স্বভাবত স্বতন্ত্র মানুষ। তার বন্ধন যা আছে তা দেশের বন্ধন। সে মানব বন্ধন। রবীন্দ্রনাথ একজন মুক্ত স্বাধীন মানুষ হিসাবে বারবার বারবার দাঁড়িয়েছেন মানুষের পক্ষে।

তিনি পরাধীন ভারতবর্ষের হিজলি জেলে গুলি চালনার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকরা হিজলি জেলে বিপ্লবীদের হত্যা করেছিল।জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি পথে নেমেছেন বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে। তখন তিনি প্রচুর গান লিখেছেন ১৯০৫ সালে,গান গেয়েছেন,নিজে পথে নেমে সকল মানুষকে একসঙ্গে সংগঠিত করেছেন, ঐক্যবদ্ধ করেছেন।ব্রিটিশদের অত্যাচারে, দেশবাসীর যন্ত্রণায়, দেশবাসীর যাতনায়, দেশবাসীর রক্তক্ষরণে, নিহত দেশবাসীর মৃত মুখ তাঁকে বারবার আঘাত করেছে।তিনি পরদিন নাইটহুড পরিত্যাগ করেন জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর।

আমরা জানি ছবি আঁকা একটা বিরাট পরিশ্রমের কাজ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অনায়াসে তা করে গেছেন ষাটোর্ধ বয়সে। মনে রাখতে হবে তাকে ইদানীং তথাকথিত 'অতি বিজ্ঞ' গবেষক প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে রবীন্দ্রনাথ আসলে 'রঙকানা' বা 'কালারব্লাইণ্ড।' কিন্তু একজন মানুষ যদি 'রঙ কানাই' হয় তাহলে তিনি কীভাবে এই সংস্থাপন আলো-ছায়ায়,কালো-সাদায়, রঙে নির্মাণ করলেন আমাদের সামনে। আমরা জানি তার সেই চুম্বন নামের বিখ্যাত ছবিটির কথা।যেখানে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে চুম্বনের আভাসে রয়েছেন এমন কথা ইতিহাস বলে। বিচিত্রগামী লেখক তিনি।তিনি দেবতার গ্রাসের মতো কবিতা লিখছেন।লিখছেন দুই বিঘা জমির মতো কবিতা,আবার লেখেন তোমার শঙখ ধুলায় পড়ে আছে নিয়ে তিনি লিখছেন এমন কোনো লাইন। তিনি লিখছেন 'জানি মোর কবিতা হয় নাই হয় নাই সর্বত্রগামী।'এই যে আফসোস, এই যে হাহাকার, তা একজন সৃষ্টিশীল মানুষের পক্ষেই সম্ভব। ঐকতান পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ এই কথা লিখেছিলেন।

আমরা কি মনে রেখেছি রবীন্দ্রনাথকে? প্রাত্যহিকতায় ত্রিপুরার মানুষ, পশ্চিম বাংলার মানুষ, বাংলাদেশের মানুষ, যারা বাংলা ভাষায় অন্তত কথা বলেন,লেখেন, তারা কি মনে রেখেছেন রবীন্দ্রনাথকে? না কী শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণের মলাট লিখন এক ধারাবাহিক পূজা পদ্ধতি। রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখে গেছেন 'তোমায় পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি।'কিংবা 'তোমার দ্বারে কেন আসি ভুলে যে যাই'।এই যে নিজেকে দেখতে পাওয়া, নিজেকে নিজের আয়নায় আবিষ্কার করা, তা একজন বড় মাপের দার্শনিকের পক্ষেই সম্ভব।

আমরাও তো তাঁকে সেভাবে গুরুত্ব দিয়েছি কী? আজকে যখন সমস্ত পৃথিবী দীর্ণ হিংসায় জর্জরিত। 'যখন নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস।শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস' এই লাইন কী অমোঘ হয়ে আসে না? কিংবা যখন তিনি বলেন 'আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনিই লীলার তব- এই যে তুমি এবং আমি।এটা কী?

আমাদের অনুভূতিতে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্যায়, পূজা পর্যায়,স্বদেশ পর্যায় বলে আলাদা কিছু হয় না।'আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে' বনে এটা কী প্রেমের গান না প্রত্যাখ্যানের গান? কিংবা এইটা নি বিরহের গান না কী প্রাত্যহিক যন্ত্রণার গান, মিলনার্তির গান? যে যন্ত্রণা নিয়ে আমরা সকালবেলা উঠি মেঘার্ত আকাশ থাকলে আকাশকে মনে হয় মেঘ মলিন কোনো ছাদের কার্নিশ। সেই রকম এক মনন নিয়ে যখন আমরা রবীন্দ্রনাথের গানে প্রবেশ করতে থাকি, যখন আমরা তাঁর ছবিতে প্রবেশ করতে থাকি, যখন আমরা তার নাটকে প্রবেশ করতে থাকি, তখন মনে হয় জীবন কী আসলে এরকম? কিংবা জীবন কী আসলে এরকমই? জীবন কি আসলে এরকমই হওয়ার কথা ছিল? বা হওয়ার কথা ছিল না?

রক্তকরবী নাটকে রঞ্জন, নন্দিনী, বিশু পাগল, অধ্যপক, রক্তকরবীর মালা নন্দিনীর গলায়, তা কি কোনো স্বপ্নিল উচ্চারণ না কী কোনো প্রেমার্তি? না কী তা আসলে বিদ্রোহের সামগ্রিক শোষণ, সামগ্রিক সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের একক জেগে থাকা।রাজা অথবা রক্তকরবী অথবা মুক্তধারা আমাদের বারে বারে জীবন ও বিবিধ বিষয় নিয়ে সতর্ক করে দেয়, যা আজও আধুনিক প্রাসঙ্গিক।

ফলে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে আমরা কিছুই ভাবতে পারি না।আমরা বাতাস দেখতে পাই না,কিন্তু অনুভব করতে পারি, বাতাস আছে।যখন বুকে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়, তখন আমরা বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করি।ঠিক তেমনি আমাদের জীবনে যখনই দুঃখ কষ্ট অনুভব করি, নানাভাবে পর্যুদস্ত হই,তখনই আমরা রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হই।রবীন্দ্রনাথ আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন।

আমরা যখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংকটে পড়ি তখন আমরা সাংস্কৃতিকভাবে সাংস্কৃতিক চেতনা ও চৈতন্যে রাজনৈতিক চেতনা ও ভাবনায় ভয়ানক যাতনায় পরি,তখন একেবারে অন্তিম দশা যেন উপস্থিত হয় আমাদের সামনে, তখন রবীন্দ্রনাথ প্রায় 'সর্বরোগহর' মালিশ এবং ওষুধ হিসাবে আমাদের সামনে আসেন।আমাদের বিশ্বাস সভ্যতা যতদিন থাকবে, যতদিন মানুষ কথা বলবে,যতদিন মানুষ প্রতিবাদ করবে,গান করবে,যতদিন মানুষ সজাগ থাকবে ততদিন রবীন্দ্রনাথ থাকবেন, জেগে থাকবেন,আমাদের হৃদস্পন্দন হয়ে। জীবন ও আধ্যাত্মিকতা, জীবন ও পারিপার্শ্বিকতা, জীবন ও প্রকৃতি চেতনা সব মিলিয়ে এক অন্যন্য সাধারণ ব্যাক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ। সেই রবীন্দ্রনাথকে আমাদের প্রণাম।আমাদের জীবনের ভালোবাসা, বিরহ, বেদনা, বিচ্ছেদ,সুখ,আনন্দ,দুঃখ, সব কিছুইতেই রবীন্দ্রনাথ।

আমাদের স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই,রবীন্দ্রনাথ সাতবার ত্রিপুরায় এসেছেন।তিনি এসেছেন বলে ত্রিপুরার মানুষ যেমন তাঁকে ভালোবেসে খুশি হয়েছেন তেমনি নিজেদের সমৃদ্ধও করেছেন।ত্রিপুরার মানুষ এমনিই অসম্ভব আথিত্য পরায়ণ তাঁরা। তাঁরা জানেন মানুষকে ভালোবাসতে,মানুষকে আপন করে নিতে।মানুষকে বুকের কাছে,বুকের মধ্যে টেনে নিতে। তাঁরা স্বার্থপর নন।তারা স্বার্থপরতার ঊর্ধ্বে উঠে অনেক কথা,অনেক উচ্চারণ করতে পারেন,যা অনেকেই পারেন না।সে ত্রিপুরার রাজা বা প্রজা যেই হোন না কেন।আমরা কাউকে ছোট করছি না।কিন্তু ত্রিপুরার মানুষের এই আতিথ্য বোধটুকু অসামান্য, অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথ তাতে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

চির ভালোবাসার কাঙাল রবীন্দ্রনাথ।তিনি ত্রিপুরার মানুষের এই ভালোবাসাটুকু টের পেয়েছেন।এবং পেয়েছিলেন বলেই ত্রিপুরার আকাশে,বাতাসে রবীন্দ্রনাথের কাছে ত্রিপুরার মানুষের কন্ঠস্বর রবীন্দ্রনাথের রচনায়,রবীন্দ্রনাথের লেখায়, রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ভাবনায়, রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রে বার বার উঠে এসেছে।ফলে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরায় সাতবার এসেছিলেন বলে ত্রিপুরা ধন্য।আবার প্রকারান্তরে বলতে হয় রবীন্দ্রনাথও খানিকটা ধন্য হয়েছেন এই ত্রিপুরার মাটিকে স্পর্শ করে।ত্রিপুরার মানুষের প্রেম ও ভালোবাসা প্রীতি পেয়ে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন ত্রিপুরার মানুষ তাঁকে ভালোবাসে, এবং তিনিও ত্রিপুরার মানুষ, প্রকৃতি, আকাশ বাতাসের মতো রাজাদেরও ভালোবাসতেন।রবীন্দ্রনাথ এসে ত্রিপুরাকে ধন্য করেন নি।করা সম্ভব নয় কিন্তু আমাদের কারও কারও জীর্ণ পর্ণ কুটিরের সামনে দিয়ে যদি একদিন কোনো এক প্রবহমান স্বর্ণালী স্রোত বয়ে যায়, যে স্রোতের মধ্যে লুকিয়ে থাকে জীবন চর্যার আশ্চর্য মোহময়তা। তাকে দেখে কী আমরা মুগ্ধ হব না? অথবা আমরা যারা দেখতে পাই নি তাঁকে, তাঁরাও কি বালির মধ্যে খুঁজে বেড়াই না? তাঁর মুছে যাওয়া পায়ের ধ্বনি। সেই স্বর্ণময় স্রোতের অস্তিত্ব মুখে মুখে কি গল্প-কাহিনি ছড়ায় না? তিনি এসেছিলেন।তিনি এসেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- 'এসেছিলে তবু আসো নাই জানায়ে গেলে।'এই যে জানায়ে যাওয়ার কথা সেকথাই হয়তো ফুটে থাকে আমাদের মনের ঘরে। আমাদের চিন্তায়, চৈতন্যে, সাংস্কৃতিক ফসলে।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে সারাক্ষণ জড়িয়ে থাকেন।সকাল বেলা আমরা যারা সাহিত্য,সংস্কৃতি ও মনন চর্চা করি তাদের কথা বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথের অনেক লাইন মানুষকে ভরসা দেয়। সকাল বেলা থেকেই মানুষকে মনুষ্যত্ব জাগরণের যে অভিশ্রুতি তা রবীন্দ্রনাথই দিতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের যে গান, সে গানের লাইন সকাল থেকে গড়াতে গড়াতে দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা থেকে রাত্রির দিকে চলে যায় নক্ষত্র স্নান সারতে থাকে, আমরা রবীন্দ্রনাথের প্রাত্যহিক চেতনায় উপস্থিতির জন্য দুঃখে,সুখে আনন্দে, বিরহে,বেদনায় প্রেমার্তিতে, অসফলতায়, সাফল্যে রবীন্দ্রনাথ যেন বা কোনো মহীরুহ সম।তাঁর সেই লাইন- 'আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনই লীলা তব।' এই যে আমাকে অশেষ করছ মানে কী? আমার জীবনকে, আমার উচ্চারণকে তুমি অশেষ করেছ।চিরজীবী করছ, মানে এই নশ্বর পৃথিবীতে কিছুই চিরজীবী নয়। কিন্তু তবুও তাঁর এই গানের কথা,তাঁর এই ছোট গল্পের লাইন,তাঁর এই ছবির কথা,নাটকের কথা, আমরা যখন কোনও ভাবে না কোনও ভাবে মনে করি, তখন আমাদের মধ্যে একটা অন্য ধরনের উন্মেষ তৈরি হয়।'স্ত্রীর পত্র' পড়তে পড়তে আমরা মৃণালের যে যন্ত্রণা, তা সোচ্চার নারীবাদ না হলেও মৃণাল যেভাবে একজন স্বাধীন নারী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং মাখন বড়ালের নাম চিহ্নিত গলিতে আর সে ফিরে যাবে না, এই কথা যখন সে উচ্চারণ করে, তখন আমরা বুঝতে পারি রবীন্দ্রনাথ ঠিক কোনখানে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের হৃদয় স্থবিরতায় অথবা 'ছুটি' গল্পে যখন ফটিক এক বাঁও মেলেনা, দুবাঁও মেলেনা তখন আমরা বুঝতে পারি মৃত্যুর সঙ্গে খেলা করতে করতে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে যান 'অতিথি' নামক আখ্যানে তারাপদকে তিনি যাত্রা করেন নতুন কোনও এক অভিযাত্রায়।।ফলে তাঁকে বাদ দিয়ে জীবন উচ্চারণ, নিঃশ্বাস গ্রহণ নিঃশ্বাস পতন সম্ভব নয়।
0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - অম্লান রায় চৌধুরী

Posted in






মঙ্গল গ্রহে মানুষের উপনিবেশ স্থাপনের পরিকল্পনা ইলান মাস্ক এক দশক আগেই করে ফেলেছেন । তার জন্যেই তিনি ইতিহাসের সব চাইতে বড় রকেট স্টারশিপ বানিয়েছেন । তার উৎক্ষেপন দেখিয়ে তিনি বিশ্ববাসীকে তাকও লাগিয়েছেন ।

এবার মূল ভাবনায় এসেছে সেখানকার শাসন ব্যবস্থা ও নানান পরিকল্পনার ব্যাপার। তিনি ভাবছেন গ্রীসের মতন প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক আবহাওয়ার ব্যবস্থা করতে। ওনার ভাবনাতে এটা পরিস্কার যে সেখানকার শাসন ব্যবস্থা পৃথিবী গ্রহের গণতান্ত্রিক দেশ গুলোর মতন হবেনা । কারণ ব্যবস্থাটার গতিপ্রকৃতির নির্ধারক সেইখানকার অর্থনীতি , প্রযুক্তি , নিরাপত্তার উপর ।

তৈরি হবে এক নতুন সামাজিক শ্রেণী, সেটা কেমন হবে সেটাও এক বড় নির্ধারক।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু প্রশ্ন আসে । মনে পড়ে , ইলন মাস্ক কি চাইছেন এক ময়না দ্বীপের মতন জায়গা তৈরি করতে – মানিক বাবুর ‘পদ্মা নদির মাঝির’ আদলে । যেখানে মানিক বাবু যেমন চেয়েছিলেন – তার পছন্দের দ্বীপ , যেখানে থাকবেনা কোনো ধর্ম , শাসনব্যবস্থা আসবে সমাজ তন্ত্রের ছোঁয়ায় ।

ভিতরে ঢুকলে বা উপন্যাসের অন্তরে গেলে দেখা যায় বা বোঝা যায় তার সাধের ময়নাদ্বীপ কেমন হবে । কি তার সম্ভাবনা , কতটা বাস্তব , কতটা গ্রহনযোগ্য ।

এটাও দেখতে হবে, ইলন মাস্ক কি মঙ্গলগ্রহে আদতে ময়নাদ্বীপের মতো কোনো নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছেন বা দেখাতে চাইছেন? তার আগে একবার স্মরণ করা যাক, হোসেন মিয়ার সেই ময়নাদ্বীপ কেমন রাষ্ট্র বা সমাজের ইঙ্গিত দেয়।

মানিক নতুন করে বসতি স্থাপনের মাধ্যমে এক নতুন সমাজব্যবস্থা সৃষ্টি করতে চান সেখানে—এমনই ইঙ্গিত মেলে। তিনি তখনো পুরোপুরি মার্ক্সবাদী কিনা সেটি নিয়ে হয়তো বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু নতুন একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা চেতনায় ও চিত্তে ধারণ করেছিলেন সেটি পরিষ্কার। মূলত সেই স্বপ্নেরই প্রারম্ভিক একটি পরীক্ষা–নিরীক্ষার স্থল সম্ভবত ময়নাদ্বীপ।

আপাতদৃষ্টিতে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণিনির্বিশেষে সবকিছুর ঊর্ধ্বে এক নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ার প্রয়াস দেখা যায় ময়নাদ্বীপে। দ্বীপে মসজিদ, মন্দির কোনোটাই বানানো হবে না, সব লৌকিক ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে এক অসাম্প্রদায়িক সমাজ হবে ময়নাদ্বীপ।

কিন্তু হোসেন মিয়ার কাছে প্রথম অগ্রাধিকার সেখানে মানুষের প্রজনন। দ্রুত সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে দ্বীপকে জনবহুল করে তুলতে চান তিনি। এটা অনেক দিশা দেখায় , মনে হয় দ্বীপের লোক বাড়াতে হবে – স্বাভাবিক – কারণটা মানা যায় অন্যাটা ধর্মের তাড়নায় বংশবৃদ্ধির যে প্রথা তাকে মান্যতা দেওয়া হচ্ছে কিনা সেটাকেও বুঝে দেখার জায়গাটাকে রাখতে হবে । তবে দুটোই কিন্তু হোসেন মিঞাকে সামনে রেখেই বলা হচ্ছে – কাজেই বিষয়টা খুব যে পরিস্কার বলা সে কথা বলা যায়না।

গণতন্ত্রের কথাও কি বলেছিলেন হোসেন মিয়া? না, কারণ সেখানে হোসেন মিয়া সর্বময় ক্ষমতার মালিক। তিনিই ঠিক করে দেন সেখানে কার শাসন চলবে। আপাতত শ্রেণিহীন এক সমাজের খোদা হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায় তাঁর প্রতিটি কথায়, তৎপরতায়। কাজেই সেই ই হবে ধর্মের নিয়ন্ত্রক – নিজের ধর্মকে রাখার চেষ্টা থাকতেই পারে । ধর্মহীন সমাজের কথা বোধ হয় ভাবা যাচ্ছে না ।

মাস্ক খাঁটি গণতন্ত্র ও বাক্‌স্বাধীনতার অবতার হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। তথাকথিত উদারনৈতিক গণতন্ত্রের (লিবারেল ডেমোক্রেসি) বড় সমালোচক মাস্ক। এই গণতন্ত্র সমাজের একটি বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব তো করেই না, বরং এই ব্যবস্থার উপাদান ও হাতিয়ারগুলো ওই বৃহৎ অংশকে প্রান্তিক করে রাখার আয়োজন করে রেখেছে—এমনই মত ইলন মাস্কের।

এবার মঙ্গলে মানুষের শাসনব্যবস্থা নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার ধারণা দিয়েছেন। এক কথায় সেটিকে গ্রীসের ধাঁচে ‘প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র’ বলেই অভিহিত করেছেন।

বলা বাহুল্য সেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পৃথিবী গ্রহের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো হবে না। সেই ব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করবে সেখানকার অর্থনীতি, প্রযুক্তি, নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি সামাজিক শ্রেণি।

মাস্ক যখন জনপ্রিয় মাইক্রোব্লগিং সাইট টুইটার (পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে রাখেন এক্স) ৪৪ বিলিয়ন ডলারে কিনে নেন, তখন বলেছিলেন, তাঁর অধীনে টুইটার হয়ে উঠবে বাক্‌স্বাধীনতা চর্চার প্রধান ক্ষেত্র। মালিকানা নেওয়ার পর অনেক বিতর্কিত অ্যাকাউন্ট যেগুলো ভুল তথ্য, অপতথ্য, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, বর্ণবাদ ও উসকানিমূলক তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো ফেরত আনেন মাস্ক।

এরপর যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীলদের পাশে দাঁড়িয়েছেন ইলন মাস্ক। নব্যরক্ষণশীলদের অবতার ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম আমলে সরাসরি সমর্থন না জানালেও এবার সরাসরি তিনি তাঁকে সমর্থন দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, নির্বাচনে তহবিল জোগান দিয়েছেন। এরই মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের জন্য মনোনীত হয়েছেন। তাঁর কাজ হবে আমলাতন্ত্র সংকুচিত করে সরকারের অনুন্নয়ন ব্যয় কমানো

এই নব্যরক্ষণশীলদের নিয়ে লিবারেলদের সবচেয়ে বড় শঙ্কা হলো, এরা সেই অর্থে রক্ষণশীল নয়, যারা ঐতিহ্যগতভাবে বিদ্যমান ব্যবস্থার রক্ষক হিসেবে তৎপর থাকে। এই নব্যরক্ষণশীলেরা বিদ্যমান ব্যবস্থা ভেঙে ঢেলে সাজাতে চায়। তারা দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি ও করপোরেট আঁতাত ভেঙে দেওয়ার কথা বলে। আধুনিককালের দৃষ্টিভঙ্গিকে সামাজিক সংহতি ও স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর মনে করে। বঞ্চিতদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু তাদের সামগ্রিক পরিকল্পনা কখনো স্পষ্ট হয়নি। তাদের প্রতিশ্রুত ব্যবস্থাটি শুধু তারাই ভালো জানে!

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবতার হোসেন মিয়া যেমন ময়নাদ্বীপে এমন এক ব্যবস্থার কথা বলে সেটিও অস্পষ্ট, শুধুই ইঙ্গিতময়। সেটি এক শ্রেণিহীন সমাজ, যেখানে সবকিছু চলে একক ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর শর্তে।

ইলন মাস্ক ও ডোনাল্ড ট্রাম্প নেক্সাস কোন ধরনের ব্যবস্থা চান সেটিও পরিষ্কার নয়। প্রথমবার ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প তাঁর অনেক প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়ন করতে পারেননি। এবারও পারবেন এমন সম্ভাবনা দেখছেন না বিশ্লেষকেরা।

মাস্ক বলছেন, মঙ্গলেও তিনি গণতন্ত্রই চাইবেন। তবে সেখানে প্রশাসনিক ব্যবস্থা কেমন হবে সেটি তিনি সেখানকার বাসিন্দাদের হাতেই ছেড়ে দিতে চান। কথাটি আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ ও সরল মনে হলেও তিনি যে হোসেন মিয়ার চরিত্রে আবির্ভূত হবেন না সেটি বলা যায় না।

কিন্তু ময়না দ্বীপ তো মার্ক্সবাদী ধারণার সাথে মেলে না। এটা তো এক অর্থে উপনিবেশ। হোসেন মিয়া যার সর্বময় ক্ষমতার মালিক। ময়না দ্বীপকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সমাজব্যবস্থা মনে করতে গেলে তো হোসেন মিয়াকে মার্ক্সবাদী বলতে হয়! যা আদপেই অসম্ভব ও হাস্যকর। বুঝলাম, হোসেন মিয়া হয়ত অনন্ত তালুকদারের মত (এ উপন্যাসের ভূস্বামী) পুরোপুরি শোষক শ্রেণির নন। কিন্তু তিনি তো বুর্জোয়া সমাজেরই একজন প্রতিনিধিত্বকারী, খেটে খাওয়া মানুষদের সাথে যার শ্রেণিগত দূরত্ব অনেকখানি। তার হাতে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি আসবে এটা মানিক নিজেও বিশ্বাস করতেন না।

হোসেন মিয়ার অনেক ধূর্তামি তো তিনি নিজ বয়ানে বা কুবেরের চোখ দিয়ে উন্মোচন করে দিয়েছেন।
আর ময়না দ্বীপে ধর্ম নেই এটাও তো ঠিক নয়। হোসেন মিয়া যতই বলুক তার দ্বীপে মসজিদ মন্দির কোনটাই হবে না, অর্থাৎ সব লৌকিক ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে একটা অসাম্প্রদায়িক সমাজ হবে তার দ্বীপ, কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি প্রচলিত ধর্ম না থাকলেও নতুন একটি ধর্ম তো থাকছেই, হোসেন মিয়ার তৈরি করা ধর্ম। হোসেন মিয়া যেখানে অঘোষিত খোদা। তারও আছে কিছু নিয়মকানুন।

সন্তান জন্মদানে অক্ষম নারী পুরুষের কোন মূল্য নেই তার দ্বীপে। তাই বৃদ্ধ বশিরের স্ত্রীর সাথে যুবক এনায়েতের সাথে অবৈধ প্রণয় স্বীকৃতি দিয়েছেন হোসেন মিয়া। মানলাম যুক্তি আছে , দ্বীপের জনসংখ্যা বাড়াতে হবে – বন্ধ্যা নারীর প্রয়োজন সেখানে থাকবার কথা নয়।

কেতুপুরে বরং তারা হোসেন মিয়াকে এতটা ভয় করে না, কিন্তু ময়না দ্বীপে গেলে তো তারা পুরোপুরি অসহায়। হোসেন মিয়ার মতের বাইরে যায় এমন সাহস সেখানে কোথায় তাদের! আর ময়না দ্বীপে তো তারা কেউ স্বেচ্ছায় যায় না। যায় নিতান্ত বাধ্য হয়ে।
কাজেই প্রশ্ন থেকে যায় কেন উপন্যাসের পরিণতি হয়েছে একটি কল্পিত দ্বীপে নিক্ষিপ্ত হবার মধ্যদিয়ে।

মার্ক্সবাদী চিন্তাচেতনার সাথে আদতেই মেলানো যায় না এই রহস্যপূর্ণ আধো চেনা ময়না দ্বীপকে। ময়না দ্বীপে দেড় হাজার নারী পুরুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে এরকম অদ্ভুত ইচ্ছার বাইরে হোসেন মিয়ার আর কোন ইচ্ছা নেই এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। হোসেন মিয়ার চরিত্রের সাথে তার এ আকাঙ্ক্ষা মেলে না। বরং এর ভিতরে যে তার একজন সামন্তপ্রভু হয়ে উঠার আকুতি বিদ্যমান তা বুঝতে পাঠকের খুব বেগ পেতে হয় না। কুবেরের ময়না দ্বীপে আসা মানে ধীরে ধীরে একটা সময় পুরো জেলে পাড়াই এখানে উঠে আসবে। জেলে জীবন ত্যাগ করে পুরোপুরি শ্রমিক জীবন। তাতে কি তাদের মানসিক বা অর্থনৈতিক কোনক্ষেত্রেই বিন্দুমাত্র অগ্রগতি হবে?

বুঝতে পারছি মানিক একটা পরিবর্তন চেয়েছেন। যুগ যুগ ধরে চলে আসা শোষিত জেলেপাড়ার অচলাবস্থায় চেয়েছেন একটা ধাক্কা দিতে। মানিক তখন ধীরে ধীরে মার্ক্সবাদে দীক্ষা নিচ্ছেন। নতুন সমাজব্যবস্থার চিন্তা তার চেতনায় জন্ম নিতে থাকে। ময়না দ্বীপ সেই চিন্তারই ফসল বলে সমালোচকদের ধারণা। এ ধারণা হয়ত অমূলক না,

তবে নতুন এই সমাজ ব্যবস্থা এর ভিতর দিয়েই সমাজতান্ত্রিক ধারায় বিনির্মিত নিশ্চয়ই না। বরং তা সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থারই অন্য রূপ। শোষণের রূপ বদলেছে, মাত্রা কমেনি। ধর্মীয় শিকলও আছে, ভিন্ন পরিচয়ে। মানিকের সাম্যবাদী চেতনা এখানে হোসেন মিয়ার প্রভুত্বে হোঁচট খেয়েছে। তিনি জানতেন, বিদ্যমান অচলাবস্থা না ভাঙ্গলে শোষিত শ্রেণির মুক্তি নেই। কিন্তু সেই অচলাবস্থা ভাঙ্গার পথ কিরকম হবে, তা মানুষের প্রকৃত মুক্তি আনবে নাকি নতুন কোন শিকলে বন্দী করবে মানিক কি বিষয়টি সম্পর্কে তখনও পরিষ্কার নন?
মাস্কের ভাবনার সেই নতুন মঙ্গলগ্রহতে কি আমরা আবার ঐ বাধ্য হওয়া , অজানা ভাবনার সমুদ্রে ঝাঁপ দেব , যেমনটা ময়নাদ্বিপে যাওয়ার মানুষদের মধ্যে কাজ করছিলো । মানিক বাবু নিজেও বোধ হয় খুব একটা পরিস্কার ছিলেননা – ঐ সেখান কার ( ময়নাদ্বীপের ) গঠনতন্ত্র বা পরিচালন সম্বন্ধে , তাই ওনাকে ভরসা করতে হয়েছিলো হোসেন মিঞার উপর ।

এরকমটা হয়েই থাকে । আর সেটা যে খুব একটা কাম্য নয় সেটাও পরীক্ষিত ।
0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in




















চক্র বলতেই মনে আসে ছোটবেলায় ঠাকুরঘরে দেখা ফটোফ্রেমে বিষ্ণু ভগবানের হাতে এক মারাত্মক অস্ত্রের কথা – সুদর্শন চক্র! কিংবা বিনয় মজুমদারের কবিতা – ‘ফিরে এসো চাকা’! কেউ কেউ কথায় কথায় বলে ফেলেন – লোকটার ভাগ্যচক্র খারাপ চলছে। স্কুলের খাতায় একটা শিওর-শট প্রশ্ন – মেঘবৃষ্টি কিংবা প্রকৃতির ঋতুচক্র বর্ণনা করো। মহাভারতের সেই দৃশ্য, বীর কর্ণর রথযাণের চক্র মৃত্তিকাতে নিমজ্জিত; অর্থাৎ রথের চাকা মাটিতে বসে গেছে – গাড়ী এগোচ্ছে না, মৃত্যু অবধারিত! অতএব দেখা যাচ্ছে ‘চক্র’ বিষয়টা একটা বিশাল ব্যাপার। তাই ‘চক্র’ নিয়ে লিখতে গেলে ধন্ধ লাগে, কি ভাবে লিখবো, কতটা লিখবো। তাই ভাবছি, ‘চক্র’ নিয়ে বলতে বসে এখানকার মূল আলোচনাটা যান্ত্রিক ‘চক্র’কেই নিয়ে হোক। অতএব, আলোচনা শুরু করা যাক গাড়ীর চাকাকে নিয়ে।

চাকার কথা

দৈনন্দিন জীবনে আমরা সবাই চাকার সঙ্গে পরিচিত। একটা বৃত্তাকার গোলাকৃতি বস্তু , যা তার কেন্দ্রের(Centre) চারদিকে ঘুরতে পারে। কিন্তু এই চাকা কি নিজে নিজেই ঘুরবে? না, তা হয় না। এই ঘোরানোর জন্যে চাই একটা শক্তি। গাড়ীর চাকাকে ঘোরানোর জন্যে তাই থাকে ইঞ্জিন। ইঞ্জিনের উৎপন্ন শক্তি কিছু যান্ত্রিক ব্যবস্থার (গীয়ার, লিঙ্ক ইত্যাদি) সাহায্যে চাকাটাকে ঘোরাতে পারে।

একটা গোলাকার গাছের-গুড়ি ঢালু সমতল রাস্তায় রেখে দাও, সেই গুড়িটা নিজের কেন্দ্র বা অক্ষের (Axis) চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে গড়িয়ে গড়িয়ে নীচের দিকে যাবে। এক্ষেত্রে গোলাকার জিনিষটাকে ঘূর্ণনে যে সাহায্য করলো, সেটা অভিকর্ষীয় বল (Gravitational Force)। গরুর গাড়ীর চাকা ঘুরছে, গাড়োয়ানের গাড়ী এগোচ্ছে, সেক্ষেত্রে কাজ করছে গরুর শরীরের পেশী শক্তি – যাকে আমরা বলতে পারি প্রানীর ভেতর থেকে উদ্ভুত একটা যান্ত্রিক শক্তি (Mechanical Energy)। গরুর গাড়ীর চাকার ক্ষেত্রে চাকা যে ঘুরছে , ( না-ঘুরে ঘষটাচ্ছে না) তার জন্যে জরুরী মাটি ও চাকার সংযোগস্থলে ক্রিয়াশীল একটা ঘর্ষণ-জনিত বল (Frictional Force)। মাটিতে বা রাস্তায় চাকাকে ঘোরাবার জন্যে এমন একটা ঘর্ষণ-জনিত বল সব সময়ে জরুরী। কখনো কি দেখেছো, একটা ট্রাকের চাকাগুলো নরম পিছলা কাদা মাটিতে ঘুরেই যাচ্ছে, মানে চাকা স্কীড করছে। এখানে মাটি নরম থাকার জন্যে চাকা ও রাস্তার সংযোগস্থলে ঘর্ষণ-জনিত বলটা কাজ করছে না। তাই চাকা ঘুরছে না, গাড়ী এগোচ্ছে না। সে এক হ্যাপা! চাকাগুলোর নীচে ইট রাখো, পাথরের নুড়ি ঢালো, নইলে কাঠের তক্তা রাখো। এবার হয়তো চাকা স্লীপ না করে গাড়ীটা এগিয়ে আসবে।

এই চাকার উদ্ভব বা আবিষ্কারের ইতিহাসটা কি? সে একটা জটিল প্রশ্ন! যেমন কেউ যদি জিজ্ঞেস করে মানব সভ্যতার জন্ম ও বিকাশের কালপঞ্জী বা ইতিহাসের কথা। তবে মনে করা হয় চাকার আবিষ্কার খ্রীষ্টের জন্মের দশ হাজার বছর আগেই (10000BC) হয়ে গেছিলো – যে যুগটাকে নিউলিথিক এজ বলা হয়। অন্যমত হিসেবে কেউ কেউ বলে থাকে খ্রীষ্টের জন্মের পাঁচ হাজার বছর আগেই (5000BC) মেসোপটেমিয়াতে প্রথম চাকার আবিষ্কার হয়।

কবে প্রথম চাকার আবিষ্কার হয়েছিলো, সে বিতর্কে যাবার দরকার নেই। বরং কল্পনায় দেখা যাক সেই আদিম মানুষগুলোকে, যাদের মাথায় প্রথম চাকার ধারণা এসেছিলো। একদিন সেই মানুষগুলো একটা ভারী গোল পাথরের চাই ঠেলতে চেষ্টা করছিলো , তারা সেটা করতে পারছিল না, পাথরটা এত ভারী যে সেটা এক অসম্ভব কাজ। তখন সেই মানুষগুলো নজর গেল সেরকমই আরেকটা গোলপাথরে, সেটা রাখা ছিল একটা খাড়া করে রাখা থালার মতো, বৃত্তীয় পাথরের পরিধিটা ছিলো জমি ছুঁয়ে। একটু ঠ্যালা দিতেই সেই পাথরটা অনায়াসে গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। পাথরটা নিজের কেন্দ্র বা অক্ষের চারপাশে কেমন সহজেই ঘুরে যাচ্ছে। তাকে ঠেলতে তেমন বেগ পেতে হচ্ছেনা। সেই হলো মানুষের বোধগম্য প্রথম চাকা!

কিংবা ধরা যাক, একটা বিশাল মোটা গাছের গুড়িকে লোকগুলো টেনে নিয়ে যেতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো; তখন কেউ বললো , এটাকে গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হোক। তখন দেখা গেলো টেনে নেয়ার বদলে গাছের গুড়িটাকে চাক্কার মতো ঠেলতেই সেটাকে অনেক সহজেই এগিয়ে নেয়া যাচ্ছে। ব্যাস, সেইসব প্রাচীন দিনগুলোতে এমনি ভাবেই চলে এলো চাকার ধারনা। হয়তো আদিম ইতিহাসে চাকাকে এমনি ভাবেই প্রথম আবিষ্কার করা হয়েছিলো। এরপরে নানা পরিবর্তন ও নানা পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে সেদিনের সেই আবিষ্কার আজকের বর্তমান চাকার চেহারা নিয়েছে।

সেই সব মানুষগুলো যারা পাথর ঠুকে প্রথম আগুন জ্বালিয়েছিলো, কিংবা যারা গড়িয়ে দেয়া পাথরের চাকতির মধ্যে চাকার যান্ত্রিক সুবিধা আবিষ্কার করেছিলো, তাদের কোন সঠিক ইতিহাস নেই। তবুও এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় সভ্যতার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ছিল আগুন জ্বালানো । তার অনেক অনেক পরে সভ্যতার আরেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হোল চাকার ব্যবহার, যার যান্ত্রিক সুবিধাকে নিজেদের মতো করে কাজে লাগানো গেল।

বানরের চেহারা থেকে নানা পরিবর্তনের পর মানুষের আধুনিক চেহারা এসেছে; তেমনি চাকার প্রাচীন চেহারার সঙ্গে তার বর্তমান চেহারার প্রচুর তফাৎ। একদম প্রথম যুগে ঠেলা গাড়ি বা রথের চাকায় ব্যবহৃত হতো নিরেট (Solid) কাঠের চাকতি। এখনকার গরুর গাড়ীর চাকার মতো স্পোকয়ালা হালকা ডিজাইন তখন ছিল না। একটা নিরেট কাঠের চাকা ওজনে খুব ভারী, তার তুলনায় গরুর গাড়ীর কাঠের চাকা ওজনে অনেক হাল্কা। হালকা চাকাকে টানতে বলও(Force) কম লাগে।

কালে কালে বিকাশের ধারায় কাঠের চাকার জায়গা দখল করলো লোহার চাকা। লোহা বলতে তখন ঢালাই লোহার (কাষ্ট আয়রণ)ব্যবহার ছিল। এরপর এলো স্টীলের চাকা, যা তুলনামূলক হাল্কা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটা হাল্কা স্টীল নির্মিত সাইকেলের চাকা, সরু সরু স্টীলের স্পোক লাগিয়ে যেটাকে প্রয়োজনীয় ভাবে মজবুত করা হয়েছে। কোন কোন গাড়ীতে স্টীলের চাকা দেখা যায়, তার চারপাশে রাবারের আস্তরণ বা লাইনিং লাগানো। চলতে গেলে মসৃণ রাস্তায় চাকা যাতে স্লিপ না করে, গাড়ী যাতে বরাবর এগোয়। এরপরে দেখা গেলো মোটর কার বা ট্রাকের টায়ার, এতে হালকা স্টীলের রিম, মাঝে হাওয়া ভরা টিউব আর বাইরে রাবারের মজবুত টায়ার। চাকার নামে খুলে গেল বড় বড় টায়ার কোম্পানী – ডানলপ, এম-আর-এফ ইত্যাদি। আজকাল তো চারচাক্কার যে সব মোটরগাড়ীগুলো আসছে, সেগুলোতে আছে টিউবলেস টায়ার, মাঝে হাওয়া ভরার জন্যে আলাদা করে টিউবের দরকার নেই।

প্রযুক্তি কেমন পালটে যায়। এক জামানায় ঠেলা গাড়ীর চাকার অক্ষ(Axle) ফিট করা থাকতো বিনা বিয়ারিং-এ, একটা গর্তের মধ্যে। বিজ্ঞান এখন অনেক উন্নত, যে কোন চাকার সাথে এখন লাগানো থাকে বিয়ারিং, যাতে কম শক্তি খরচ করে, কম মেহনতে চাকাটাকে ঘোরানো যায়।

চক্রের বিভিন্ন ব্যবহার

এবারে দেখা যাক, চক্রকে আমরা কি কি ভাবে কাজে লাগাতে পারি। গাড়ির চাক্কা ছাড়াও যে যে সব ক্ষেত্রে চক্রের ব্যবহার দেখা যায়, সেগুলোকে এক এক করে উল্লেখ করা যাক।

I. কুমার-এর চাকা – মাটির ভার, গ্লাস বা পাত্র তৈরী করতে একে ব্যবহার করা হয়। জমির সমান্তরালে ঘুরতে থাকা চাকাটির ঘূর্ণনের সাহায্যে কুমার মাটির পাত্র তৈরী করে।

II. চৌবাচ্চা থেকে জল তোলবার সময় আমরা দেখেছি পুলির (Pulley) ব্যবহার। যেকোন ভারী জিনিষ তোলার জন্যে পুলি নামক চাকাটির ব্যবহার খুব সুবিধাজনক। যে কোন ক্রেনেও এই ধরনের পুলির ব্যবহার সব সময় দেখা যায়।

III. যাতায় শস্য পেশাই করা। সেখানেও ব্যবহৃত হচ্ছে দুটো পাথরের চাকা।

IV. পুরাণো দিনের ছবিতে দেখেছি সেচের জন্যে তৈরী হয়েছে বিরাট চক্র, তাতে বালতির মতো পাত্র (Bucket) পর পর লাগনো। এদিয়ে নদী থেকে জল তোলা হতো। চক্রটা ধীরে ধীরে ঘুরলে একদিকের বালতিতে যখন নদীর জল ভরতো, তখন অন্যদিকের বালতির ভরা জল জমিতে খালি হতো। এরকমই ছিল পুরোনো দিনের সেচ-ব্যবস্থা।

V. বর্তমান যুগ হচ্ছে মেশিনারীর যুগ। যেকোন মেশিন খুললেই যে সব যন্ত্রাংশ পাওয়া যাবে তাতে অনেক রকম কলকব্জার মধ্যে থাকে বিশেষ ভাবে ডিজাইন করা দাঁতয়ালা চাকা, যেগুলো ঘুরতে থাকে। এই গুলোকে বলা হয় গীয়ার – যা কিনা এক ধরণের চক্র।

VI. তাপ বিদ্যুত বা জল বিদ্যুত কেন্দ্রে টারবাইন ঘুরছে। এই টারবাইনের ভেতরে যেটা থাকে , সেটাও একধরনের ব্লেডয়ালা চাকা । এই টারবাইনের নিয়ন্ত্রিত ঘূর্ণনের ফল হিসেবেই বিদ্যুত তৈরী হয়।

VII. জাহাজ চলছে , বিমান উড়ছে। এখানেও আমরা দেখি ‘প্রপেলার’ নামক চক্রের ব্যবহার।

VIII. জল সরবরাহের জন্যে যেসব বড় বড় পাম্প থাকে, যা দিয়ে প্রেসারে জল পাঠানো যায়, সেসব পাম্পেও থাকে একধরনের ব্লেডয়ালা চক্র।

IX. নাগরদোলা – বাচ্চারা বড়োরা মেলার মাঠে নাগরদোলায় বসে চেঁচাচ্ছে। নাগরদোলার এই যে মজা, চক্র আবিষ্কৃত না হলে তা কি সম্ভব ছিলো?

X. ষ্টীয়ারিং হুইল – আমরা তো হামেশাই কার চালাই, গাড়ী চালানোর জন্যে সামনেই যে ষ্টীয়ারিংটা থাকে , সেটাও তো একটা চাকা।

XI. যে পায়ে-পঙ্গু মানুষটা নিজের হাতে হুইল-চেয়ারে এক যায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, লক্ষ করো, সেখানেও একাধিক চাকার ব্যবহার রয়েছে। মানুষটা যেটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হুইল-চেয়ারটাকে সামনে পেছনে করছে, সেখানেও একটা সরু স্টীলের চাকা বা ষ্টীয়ারিং , যেটা লোকটার হাতে, তার আসহায়তার অবলম্বন।

এমনিভাবেই খুঁজে নিলে দেখা যাবে চাকা বা চক্রের অজস্র ব্যবহার!

অন্যান্য কিছু চক্রের কথা

আমার ‘চক্র’ নিয়ে এই লেখা পড়ে এক তান্ত্রিকমশাই তো খুব ক্ষেপে গেলেন! আপনি ইঞ্জিনীয়ারের চোখ দিয়েই শুধু ব্যাপারগুলো দেখেছেন, আপনার চক্র নিয়ে আলোচনাটা শুধুমাত্রই মেশিন আর গতিতে সীমাবদ্ধ রাখছেন, কেন ? আপনি কি জানেন ভৈরবচক্র, কুন্ডলিনী চক্রের কথা? জানেন, মানবদেহে এসবের ব্যবহার ঈশ্বর নির্দিষ্ট!

আসলে তন্ত্র মন্ত্রের এই সব চক্রের ব্যপারে আমার কোন ধারণা নেই। আমি ঈশ্বর-বিশ্বাসী নই। তাই তান্ত্রিকমহোদয়ের ভৈরবচক্র, কুন্ডলিনী চক্রের উত্তর দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও মনে হয় লেখা শেষ করবার আগে চাকার যান্ত্রিক ব্যবহার ছাড়াও, আরো কিছু চক্রের কথা এখানে উল্লেখ করে দেয়া উচিত; যাতে পাঠকেরা এই নিবন্ধে আমার গতিবিদ্যা ও যান্ত্রিক সুবিধাবাদী লেকচারে ক্ষেপে না যায়।

বৃষ্টি চক্রের কথা তো আমরা জানি। জল-বাষ্প-মেঘ-বৃষ্টি-জল – এমনি ভাবেই তার ঘুরে ঘুরে আসা। জন্মচক্রের কথা বললেই মনে পড়ে জন্ম, শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য – এও এক আশ্চর্যজনক চক্র , যার কোন কিছুকেই আমরা এজীবনে বাদ দিতে পারিনা। এবারে আসি মেয়েদের মাসিক চক্রের কথায় – ঘুরে ঘুরে কি এক নিয়মে মহিলারা যৌবনে ঋতুমতী হয়। আমাদের ভেতরে যে রক্ত সংবহন পদ্ধতি সেটাও তো একটা চক্রের নিয়মে চলে। প্রজাপতির জীবনচক্র যদি ধরি, তবে তো শুয়োপোকা – গুটি - ডানা মেলা পতঙ্গ – সব মিলিয়ে কি অদ্ভুত ভাবে চক্রবৎ এই প্রজাপতির জন্মকথা। আবহাওয়া আর ঋতুচক্রকে বাদ দেই কিভাবে – এই যে বছরে বছরে পালা করে ছ’টা ঋতু – গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্ত – এও এক অদ্ভুত চক্র, চাইলেই কি এর কোন কিছুকে আমাদের জীবন থেকে বাদ দেয়া যায়? আর সবচেয়ে আশ্চর্য হচ্ছে এই মহাকাশ, গ্রহমন্ডল। সেখানে চক্রবৎ গ্রহ , উপগ্রহ এসবের পরিক্রমা, জোয়ার ভাঁটা, পূর্ণিমা- অমাবস্যা। চক্রের অধীনে এমনি আরো কত যে বিস্ময়- এসব কিছু পরোপুরি জানতে আমাদের আরো অনেক সময় লেগে যাবে।
0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - অম্লান রায় চৌধুরী

Posted in







মনযোগের অর্থনীতি এক নতুন ধারণা। আমরা দেখেছি মনযোগ দিয়ে কাজ করলে কাজ ভালো হয় , ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে, এছাড়াও দেখেছি যে কাজের বাঁধা সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করা যায় , মনযোগের ফলে।

মার্কিন মনোবৈজ্ঞানিক সমিতির সংজ্ঞা অনুযায়ী "মনোযোগ হল এমন একটি মানসিক অবস্থা, যাতে সংজ্ঞানীয় সম্পদগুলি পরিবেশের অন্য সব দিক বাদ দিয়ে কিছু বিশেষ দিকের উপরে কেন্দ্রীভূত হয়।"

আরেকটি সংজ্ঞা অনুযায়ী "মনোযোগ হল কোনও বিশেষ তথ্যের উপরে কেন্দ্রীভূত মানসিক সংযোগ। তথ্য আমাদের চেতনায় আসে, আমরা বিশেষ কোনও তথ্যের প্রতি মনোযোগ দেই এবং এরপরে সিদ্ধান্ত নেই কোনও পদক্ষেপ নেব না কি নেব না।"

মনোযোগ একটি সীমিত সম্পদ। কেন দেখা যাক ।

বর্তমানে আধুনিক তথ্য যুগে এসে প্রায় সবার আন্তর্জাল তথা ইন্টারনেট সংযোগ থাকার সুবাদে বিপুল পরিমাণ ডিজিটাল বিষয়বস্তু (তথ্য, সাহিত্য, শিল্পকলা) তাৎক্ষণিকভাবে সুলভ এমনকি বিনামূল্য হয়ে পড়েছে।

কিন্তু মানুষের মনে তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষমতার কোনও পরিবর্তন হয়নি। প্রতিদিন সময়ের পরিমাণ এক মিনিটও বাড়েনি। ফলে তথ্য নয়, বরং মনোযোগ একটি সীমিতকারী নিয়ামকে পরিণত হয়েছে। প্রচুর তথ্য , মনযোগের সময় সীমিত – কাজেই টানাটানি ।

তাত্ত্বিকভাবে পরিমাপযোগ্য না হলেও কোনও একটি বিশেষ বিষয়ের উপরে মানুষ কতটুকু সময় মনোযোগ দান করে, তার উপর ভিত্তি করে মনোযোগের একটি মূল্যমান বের করা সম্ভব।

ইংরেজিতে "মনোযোগ দিয়ে পরিশোধ" (টু পে অ্যাটেনশন) নামক যে পদবন্ধটি আছে, তা থেকে বোঝা যায় মনোযোগ একটি সীমিত মানসিক সম্পদ, যার অর্থনৈতিক মূল্য আছে।

একটি বিষয়ে মনোযোগ দিলে অপর দিকে সেটি দেওয়া সম্ভব নয়।

সবার কাছে এখন এত বেশি তথ্য লভ্য হয়ে পড়েছে যে এর ফলে মনোযোগ ব্যবহার করে সবচেয়ে মূল্যবান তথ্যটি বের করে নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক খুঁটিনাটি বাদ দেওয়ার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

১৯৭১ সালেই মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ও নোবেল স্মারক পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ হার্বার্ট সাইমন ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে "একটি তথ্য-সমৃদ্ধ বিশ্বে তথ্যের প্রাচুর্যের ফলে অন্য কিছু ঘাটতির সৃষ্টি হবে, যা হল তথ্য যা কিছু ভোগ করে। তথ্য কী ভোগ করে, তা স্পষ্ট প্রতীয়মান: তথ্য তার গ্রাহকের মনোযোগ ভোগ করে।

সমসাময়িক তথ্য যুগে এসে পরিগণক যন্ত্র (কম্পিউটার), বুদ্ধিমান মুঠোফোন (স্মার্টফোন) ও আন্তর্জাল (ইন্টারনেট) সবার হাতের কাছে চলে আসায় তথ্য আর কোনও মূল্যবান সম্পদ নয়, বরং মানুষের মনোযোগ হল তার চেয়ে বেশি মূল্যবান। এ কারণে তথ্যপ্রযুক্তি দানব প্রতিষ্ঠানগুলি (যেমন গুগল, মেটা, অ্যাপল, অ্যামাজন, মাইক্রোসফট) প্রায় বিনামূল্যে তাদের তথ্য সরবরাহ সেবাটি প্রদান করে থাকে। ব্যবহারকারীরা তাদের মনোযোগ দিয়ে (অর্থাৎ মোটা দাগে কতটুকু সময় তারা ঐ সব প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল মঞ্চে ব্যয় করছে) ঐসব প্রতিষ্ঠানকে লাভবান করে। ব্যবহারকারী যত বেশি সময় কোনও ওয়েবসাইটে বা আন্তর্জাল মঞ্চে ব্যয় করবে, তাকে কোনও কিছু ক্রয় করতে প্ররোচিত করা তত বেশি সহজ হয়ে উঠবে।

এ কারণে কোনও কোনও বিশ্লেষক ২১শ শতকের প্রথম দুই দশককে "তথ্য অর্থনীতি" না বলে "মনোযোগের অর্থনীতি" হিসেবে অভিহিত করেছেন।

গোল্ডহেবারের মতে ২০শ শতকের শেষে এসে উন্নত বিশ্বের শ্রমশক্তির একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ আর ভৌত পণ্য উৎপাদন, পরিবহন ও বিতরণের সাথে জড়িত নয়, বরং তারা তথ্যের কোনও না কোনও রূপ ব্যবস্থাপনা করে জীবিকা নির্বাহ করে।

এই নতুন অর্থনীতির নাম দেওয়া হয় "তথ্য অর্থনীতি"।

কিন্তু তার মতে এই উপাধিটি সঠিক নয়। অর্থনীতি হল কোনও সমাজ তার দুষ্প্রাপ্য সম্পদগুলি কীভাবে ব্যবহার করে, সে সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড। কিন্তু আধুনিক তথ্যযুগে এসে তথ্য কোনও দুষ্প্রাপ্য সম্পদ নয়, বরং তথ্য বাতাসের মত সর্বক্ষণ ও সর্বব্যাপী বিদ্যমান। অন্যদিকে আন্তর্জালে সত্যিকার অর্থে যে জিনিসটি দুষ্প্রাপ্য, তা হল মানুষের মনোযোগ। তাই স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাল জগতের অর্থনীতির মূল বিনিময় মুদ্রা হল মনোযোগ, তথ্য নয়।

নতুন আন্তর্জাল অর্থনীতিতে সেবাগ্রাহক বা ব্যবহারকারীর মনোযোগ যে অর্থের সমতুল্য, তার একটি উদাহরণ হল আন্তর্জাল ভিত্তিক সরাসরি সঙ্গীত পরিবেশনা মঞ্চ স্পটিফাইয়ের মূল্য পরিশোধ পদ্ধতি।

প্রাথমিকভাবে গ্রাহকেরা স্পটিফাইয়ের বিনামূল্যের একটি সংস্করণ ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু এর বিনিময়ে তাদেরকে গান শোনার ফাঁকে ফাঁকে বাধ্যতামূলকভাবে কিছুক্ষণ বিজ্ঞাপন শুনতে হয়, নইলে পরবর্তী গান শোনা যায় না।

এভাবে ব্যবহারকারীরা তাদের মনোযোগকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করে স্পটিফাইয়ের সেবার মূল্য পরিশোধ করেন।

কিন্তু স্পটিফাইয়ের দ্বিতীয় একটি সংস্করণে যদি ব্যবহারকারী অর্থের দ্বারা মাসিক একটি মূল্য পরিশোধ করেন, তাহলে তাকে আর কোনও বিজ্ঞাপন শুনতে হয় না।

এভাবে মনোযোগকে বিনিময়যোগ্য সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করে স্পটিফাই গ্রাহক ধরে রাখে ও ভবিষ্যত অর্থ-পরিশোধকারী গ্রাহক সৃষ্টি করে।

আমাদের কাছে পড়ে রইল কেবল নিজের বুদ্ধিমত্তা আর মনযোগ – সেটাকেই না হয় শান দেই – ধারালো করি , তথ্য তো আসবেই বিনামূল্যে।
0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in








সতীদাহ প্রথা হলো হিন্দু ধর্মাবলম্বী কোনো সদ্য বিধবা নারীকে স্বামীর চিতায় সহমরণ বা আত্মাহুতি দিতে বাধ্য করার এক অমানুষিক ও অমানবিক প্রথা চালু ছিল হিন্দুধর্মালম্বীদের মধ্যে।

সতীদাহ প্রথা বিলোপর অন্যতম পূরোধা রাজা রামমোহন রায়। রাজা রামমোহন রায় ১৭৭২ সালের ২২ মে হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রমাকান্ত রায় ও মাতার নাম তারিণী দেবী। সতীদাহ প্রথা বিলোপের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন রাজা রামমোহন রায়। কোন সময় সতীদাহ প্রথার উদ্ভব হয়, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। তবে খ্রিস্টপূর্ব চার শতকে দিগ্বীজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডারের ভারত আগমনের বিবরণে সতীদাহ প্রথার সন্ধান মেলে।

তা ছাড়া পৌরাণিক কাহিনীগুলোয় এমন আত্মাহুতির অনেক উদাহরণ রয়েছে। ‘সতী’ শব্দটি এসেছে দেবী সতীর নাম থেকে। রাজা দক্ষের কন্যা ও দেবতা শিবের স্ত্রী সতী। রাজা দক্ষ সতীর সামনে শিবকে তিরস্কার করলে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেতে তিনি আত্মাহুতি দেন। তা ছাড়া মহাভারতে পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী স্বামীর সঙ্গে স্বেচ্ছায় সহমরণে গিয়েছিলেন। হিন্দু ধর্মের ধর্মগ্রন্থসমূহে সহমরণের এমন কিছু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া গেলেও সতীদাহের আদেশ কোনো ধর্মগ্রন্থেই নেই। বরং বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে এমন অনেক নারী চরিত্র আছেন, যারা স্বামীর মৃত্যুর পরও বেঁচে ছিলেন। ধর্মগুরুরা এসব পৌরাণিক কাহিনী ব্যবহার করেছেন সতীদাহ প্রথার নামে নারী হত্যার ক্ষেত্র তৈরিতে। সতীদাহ প্রথা ছিল মূলত সামাজিক ও ধর্মীয় হত্যাকাণ্ড। মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির দখল নিতে এবং পারিবারিক মানসম্মান নষ্ট হওয়ার ভয় থেকে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়রা সদ্য বিধবা হওয়া নারীকে জোর করে স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারতেন। খ্রিস্টপূর্বকাল থেকেই ভারতে সতীদাহের মতো ঘটনা ঘটে আসছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭-এ আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় পাঞ্জাবে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। ‘রাজতরঙ্গিনী’তে আছে সতীর ঘটনা। বরাহমিহির সতীর গুণগান গেয়েছেন। মঙ্গলকাব্যে আছে সতীর উল্লেখ। মুলতান থেকে দিল্লি যাওয়ার পথে ইবনে বতুতা আমঝারিতে তিনজন মেয়েকে সতী হতে দেখে প্রায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। আবার বার্নিয়েরের মতো কেউ কেউ সতী হওয়া থেকে কোনো কোনো মেয়েকে রক্ষা করেছেন। তার নজর এড়ায়নি যে প্রধানত ব্রাহ্মণরা হিন্দু মেয়েদের সতী হতে উৎসাহ দিত। সবাই স্বেচ্ছায় সতী হত না। কিন্তু একটা বিধবা মেয়ের আজীবন ভরণপোষণের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অথবা তার সম্পত্তি হস্তগত করার জন্য জোর করে তাকে চিতায় উঠতে বাধ্য করা হত। স্বপন বসুর ‘বাংলায় নবচেতনার ইতিহাস’ বইতে পাই যে মেয়েরা সতী হলে কোনো কোনো ধনী পরিবার থেকে তখনকার সময় দুইশ টাকা অবধি সাম্মানিক জুটত। এই অর্থের লোভে ব্রাহ্মণরা মেয়েদের সতী হতে উৎসাহ দিত। স্বপন বসুর ‘সতী’ নামক বইতেই আছে একটি অল্পবয়সি মেয়ের স্বামী মারা যেতে সে সতী হবে বলে মনস্থির করল। আত্মীয়স্বজন বেজায় খুশি। চারিদিকে সাজ সাজ রব। চিতার আগুন জ্বলে উঠতেই মেয়েটির কাকা মেয়েটিকে ধরে চিতায় তুলে দিল। আগুনে ঝলসে মেয়েটি বাঁচবার জন্য চিতা থেকে লাফ দিল। শুরু হয়ে গেল হুড়োহুড়ি। চিতা থেকে পালালে চলবে না। সংকল্প যখন করেছে তাকে সহমরণে যেতেই হবে। আধপোড়া মেয়েটা প্রাণভয়ে ছুটে পালিয়ে একটা ঝোপের পিছনে আশ্রয় নিল। তার কাকা কিন্তু লোকজন সঙ্গে এনে তাকে ঠিক খুঁজে বের করে আবার জবরদস্তি করে চিতায় তুলে দিল।

পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে পুরো পরিবারের মান সম্মান বাড়িয়ে দিয়ে গেল মেয়েটি। ব্যাপক হারে বাংলায় সতীদাহ প্রথা চলছিল। এক তথ্য অনুযায়ী বাংলা বিভাগে ১৮১৫ সালে সতী হয়েছে ৩৭৮ জন (তার মধ্যে কলকাতা বিভাগে ২৫৩ জন), ১৮১৬ সালে সতী হয়েছে ৪৪২ জন (কলকাতা বিভাগে ২৮৯ জন); ১৮১৭ সালে সতীর সংখ্যা ৭০৭ জন (কলকাতায় ৪৪২ জন); ১৮১৮ সালে বাংলা প্রেসিডেন্সিতে সতীর সংখ্যা ৮৩৯ জন (কলকাতা বিভাগে তার মধ্যে ৫৪৪ জন); ১৮১৯ সালে বাংলায় সতীর সংখ্যা ৬৫০ (কলকাতায় ৩৭০ জন); ১৮২০ সালে সর্বমোট ৫৯৭ জনের মধ্যে কলকাতায় সতীর সংখ্যা ৩৭০। তখন তো বাংলা প্রেসিডেন্সিতে কলকাতা বিভাগ ছাড়াও ঢাকা বিভাগ, মুর্শিদাবাদ বিভাগ, পাটনা বিভাগ, বেনারস বিভাগ ও বেরিলি বিভাগ ছিল। কিন্তু সতীদাহ সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ছিল কলকাতা বিভাগে। পার্লামেন্টের পেপারের তথ্য অনুযায়ী সতীদাহে হিন্দুদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র বেনারসকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে কলকাতা বিভাগ।

আবার কলকাতা বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সতীদাহ হয়েছে বর্ধমান, হুগলি, নদীয়া, কলকাতার উপকণ্ঠ ও জঙ্গলমহলে। ১৮১৯ সালের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সতীদাহের সংখ্যা- বর্ধমান: ৭৫, হুগলি: ১১৫, নদিয়া: ৪৭, কলকাতা উপকণ্ঠ: ৫২, জঙ্গলমহল: ৩১, কটক/পুরী: ৩৩, যশোর: ১৬, মেদিনীপুর: ১৩ ও ২৪ পরগণা: ৩৯। হাউস অব কমন্সের নির্দেশে এই পরিসংখ্যান ১৮২৫ সালের ১ জুলাই লিখিত আকারে প্রকাশিত হয়।

কেরীর তালিকা অনুযায়ী ১৮০৩ সালে সতী হয় ২৭৫ জন। ১৮০৪ সালে ছয় মাসে ১১৬ জন। অদ্ভুত ব্যাপার শিক্ষার হার যেখানে একটু বেশি সেখানেই সতীদাহর ঘটনা বেশি। ১৮২৩-এ ৫৭৫ জন সতী হয়। ১৮২৬-এ ৬৩৯ জনের মধ্যে কলকাতায় ৩৬৮ জন। আবার এমন ঘটনাও দেখা যায় যে স্বামীর সঙ্গে একদিনও ঘর করেনি, সে স্বেচ্ছায় স্বামীর বুকের ওপর নিশ্চিন্তে মাথা দিয়ে ‘স্বর্গারোহন’ করেছে। মাঝে বৃষ্টি হয়ে চিতার আগুন নিভে সে আধপোড়া হয়ে শুয়ে আছে। তবু তার বিকার নেই। ধিকি ধিকি জ্বলতে জ্বলতে যখন আবার চিতায় আগুন জ্বালানো হল তার ভবলীলা সাঙ্গ হল।

বাংলায় সতী হওয়ার অনুষ্ঠানটিও ছিল অদ্ভুত। যে মেয়ে সতী হবে বলে মনস্থির করত সে স্নান করে নতুন কাপড় পরে পা আলতায় রাঙিয়ে একটি আমডাল নিয়ে শবের কাছে বসত। মাথার চুল বিছিয়ে দেওয়া হত। ছেলে বা নিকট আত্মীয় অনুষ্ঠানের সব জিনিস জড়ো করে চিতা প্রস্তুত করত। সে গায়ের গয়না খুলে সিঁদুরের টিপ পরে সাতবার চিতা প্রদক্ষিণ করে আঁচলে বাঁধা খই, কড়ি বা গয়না ছুড়ে ছুড়ে দিত উন্মত্ত জনতাকে। লোকে কাড়াকাড়ি করত ওগুলো পাওয়ার আশায়। তারপর বিচিত্র, গগনভেদী বাজনার মধ্য দিয়ে সে চিতায় উঠত। মেয়েদের চিতার সঙ্গে বুকে, কোমরে, পায়ে দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা হত যাতে তারা পালিয়ে না যায়। শুধু সহমরণ নয়, সমাজে তখন অনুমরণ, সহসমাধি, কতরকম প্রথা। স্বামীর সঙ্গে একসাথে পুড়ে মারা গেলে সহমরণ। স্বামীর মৃত্যুর সময় অনুপস্থিত থাকলে, অসুস্থ হলে বা গর্ভবতী হলে পরে স্বামীর ব্যবহৃত যে কোনো জিনিস যেমন লাঠি, চটি, থালা, বাঁধানো দাঁত, স্বামীর লেখা চিঠি ইত্যাদি নিয়ে চিতায় উঠত স্ত্রী। এটি হল ‘অনুমরণ’। যেমন ভোলা চামারের বউ উদাসীয়া। ভোলা মারা যাবার সাত বছর পরে সে ১৮২২ সালের ৫ মে ভোলার ব্যবহৃত থালা নিয়ে সতী হয়। কোঙ্কন অঞ্চলের মেয়েরা স্বামীর অনুরূপ এক চালের মূর্তি গড়ে অনুমৃতা হত।

এটি ‘পলাশবুদি’। মৃত ভাই-এর চিতায় বোনের আত্মাহুতি দেওয়ার ঘটনাও আছে। সেখানে বাবা নিজে একসঙ্গে পুত্র ও কন্যার চিতা সাজিয়ে অগ্নিসংযোগ করেছিল। ১৮১৮ সালের শেষদিকে চন্দননগরের এক তরুণী ভাবী স্বামীর চিতায় আত্মাহুতি দেয়। বিয়ের আগেরদিন ছেলেটি কলেরায় মারা যায়। মেয়েটি জোর করে সতী হয়। রক্ষিতারাও সতী হত। রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত সাধ্বী স্ত্রী সতী হবে না রক্ষিতা। সম্ভবত ১৮১৭ সালে সরকার আইন করে রক্ষিতাদের সহমৃতা হওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায়, ‘দিল্লির এক শেঠজি স্বর্গে গেছেন। শেঠজি কোটিপতি। ঘরে তার চার-চারটি স্ত্রী। দলে দলে খিদমদগার, হুঁকোবরদার। যমুনার ধারে কয়েকশ মণ চন্দনকাঠ দিয়ে তৈরি করা হল আকাশছোঁয়া চিতা। চিতায় শেঠজির সঙ্গে উঠলেন তার চারটি স্ত্রী। কিন্তু অমন মানী লোকের স্বর্গে গিয়ে চারটি স্ত্রীতেই কেবল কুলোবে কেন? এতএব ঝি-চাকরকেও স্বর্গে যেতে হল তার সঙ্গে। তামাক সাজবে কে- পা টিপে দেবে কে- হাওয়া করবে কে? সেইখানেই শেষ নয়। দুটো প্রকাণ্ড আরবি ঘোড়াকেও চিতায় চড়িয়ে দেওয়া হল। আবার ঘোড়া কেন? বা-রে নইলে শেঠজির মতো অমন দিকপাল লোক কীসে চড়ে স্বর্গের দেউড়িতে ঢুকবেন? এমনই ছিল সে যুগের কুসংস্কার। সেদিন রামমোহনের চোখ ফেটে জল এসেছিল লজ্জায় ও ক্ষোভে। সেদিন রাজা রামমোহন রায় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, এই ইতিহাস বদলাতে হবে। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানকে এক মন্ত্রে মিলিয়ে দিয়ে সারা ভারতবর্ষে একটি মহাজাতিকে গড়ে তুলতে হবে। আর সেই মিলনমন্ত্র আসবে এই দেশের উপনিষদ থেকেই। সেই সংকল্প বুকে নিয়েই চার বছর পরে রামমোহন রায় দেশে ফিরলেন।’ ১৮১২ সালে তার ভাই মারা যান, আর সেইসময় তার ভাইয়ের স্ত্রীকে চিতায় পুড়িয়ে মারা হয়। এই নির্মম দৃশ্য চোখে দেখে তিনি মেনে নিতে পারেননি।

এই ঘটনা তার মনে তীব্র প্রভাব ফেলে। আর তাই তিনি এই প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে এই প্রথার বিরুদ্ধে একটি বাংলা পুস্তক রচনা করেন। তখনকার দিনে যা হত সব শাস্ত্র মেনে হত। আর তাই তিনি মনুসংহিতা সহ বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি নিয়ে প্রমাণ করেন সতীদাহ প্রথা অন্যায়। এ ছাড়া তিনি সম্বাদ কৌমুদী সহ বিভিন্ন পত্রিকায় এ বিষয়ক লেখা প্রকাশ করতেন। এরপর নতুন গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিংক-এর কাছে একটি আবেদনপত্র দেন। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর ১৭ নম্বর রেগুলেটিং আইন পাস করে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করেন। শত শত বছর ধরে চলে আসা নৃশংসতম সতীদাহ প্রথা মোগল সম্রাট শাহজাহান বিলোপ করতে গিয়েও ব্যর্থ হন। তবে কোনো সদ্য বিধবা নারীর শিশুসন্তান থাকলে তার সতীদাহ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অনেক সতীদাহের ঘটনা ঘটত, যা সম্রাট বা তার লোকজনের কানে পৌঁছাত না। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার ভয়ে ইংরেজরাও এই প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সাহস পাচ্ছিল না।

১৭৯৯ সালে খ্রিস্টান যাজক ও বাংলায় গদ্য পাঠ্যপুস্তকের প্রবর্তক উইলিয়াম কেরি এই প্রথা বন্ধের প্রয়াস নেন। গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলির কাছে তিনি সতীদাহ বন্ধের আবেদন জানান। এরপর রামমোহন রায় ১৮১২ সালে সতীদাহবিরোধী সামাজিক আন্দোলন শুরু করেন। তিনি ও তার লোকেরা বিভিন্নভাবে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে এই প্রথা শুধু অমানবিকই নয়, বরং তা শাস্ত্র ও আইনবিরুদ্ধ। ১৮২১ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘সহমরণ বিষয় প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ’ শিরোনামের ছোট একটি পুস্তিকা।

১৮২৮ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক বাংলার গভর্নর হয়ে আসেন। তিনি সতীদাহ প্রথার কথা আগে থেকেই জানতেন। লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্য আবেদন করেন। লর্ড বেন্টিঙ্ক রামমোহনের যুক্তি অনুভব করে আইনটি পাসে উদ্যোগী হন। ব্রিটিশ শাসনের ক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তিনি ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথাকে নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে আইন পাস করেন।

সতীদাহ প্রথা বিলোপর অন্যতম পূরোধা হিসাবে রাজা রামমোহন রায় নমস্য হয়ে থাকবেন চিরদিন।
0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - সেবিকা ধর

Posted in









জলকে 'জীবন' বলা নতুন কিছু নয়, এই তথ্য- সর্বজনবিদিত যেমন অ এর পর আ।পৃথিবীর তিনভাগ জল একভাগ স্থল এও আমাদের জানা।ত্রিপুরার মহিমময় জলভাণ্ডার তার নদী, খাল, হাওড়- বাওড়,দিঘি,ছোট বড় পুকুর সবই রাজ্যের মানুষের জীবন বেঁচে থাকা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতোভাবে জড়িত।ত্রিপুরার অতিবিখ্যাত গোমতী নদী রবীন্দ্রনাথের লেখায় অমর হয়ে আছে।এখন কথা হল ত্রিপুরার এই যে জলসম্পদ- জল তা নীর-বাসনা হয়ে অবিরত আমাদের কাছে এক শিল্পরূপ তুলে ধরে।ত্রিপুরার রাজারা ছিলেন বিদ্ব্যোৎসাহী।শিল্প ও সাহিত্য প্রেমী সংস্কৃতি বোধ সম্পন্ন মানুষ। রবীন্দ্রনাথকে তারা কীভাবে আপন করে নিয়েছিলেন তা ইতিহাসের সাক্ষ্য কণা হয়ে জেগে আছে।আমরা জলের কথা বললাম।এবার আমরা ত্রিপুরার কিছু জল সম্পদের কথা বলি।

ত্রিপুরায় যে যে নদী আছে মনু,হাওড়া,গোমতী, খোয়াই, দেও, জুড়ি, ধলাই ইত্যাদি প্রভৃতি সবই ত্রিপুরার মানুষের জীবনে সভ্যতার বহতা আঙ্গিক হিসাবে জড়িত।ত্রিপুরার রাজারা নদীর বুকে প্রাসাদ তৈরি করে জল ও জল শিল্পকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন।রাজস্থানের যে জলাশয় কেন্দ্রিক প্রাসাদ তার তুলনায় 'নীরমহল' একেবারেই স্বতন্ত্র। হয়তো স্থাপত্যের নিরিখে শিল্পের কলাকৌশলে সূক্ষ্মতায় রাজস্থানের প্রাসাদেরা যে শৈল্পিক চূড়া স্পর্শ করে নীরমহল হয়তো তার তুলনায় কিঞ্চিৎ ঊন হলেও তার শোভা এবং বৈশিষ্ট্য অনন্য।বিশেষ করে রাতে যখন আলো জ্বলে উঠে নীরমহল- এর মনুষ্যবিহীন ঘর ও বারান্দায় তখম মনে হয় স্বপ্ন লোকের কোনও অলৌকিক চাবি আমাদের সামনে এসে দোল খায়।তাকে ধরে নিয়ে স্বপ্ন ও কল্পনা এবং বাস্তবের দরজাটুকু খুলে ফেললে আনন্দ ও শৈল্পিক জাগরণে।আবার দিনে নীরমহলের শোভা অন্যরকম।

পৃথিবীর কোলে জলের শোভার মধ্যে জেগে থাকা সে যেন এক অলৌকিক রাজহংস।দূর থেকে ধীরে নৌকো পথে যত তার কাছে যাওয়া যায় তর তার মহিমময় রূপ যেন ফুটে ওঠে চোখের সামনে।শীত সকালের অলৌকিক কুয়াশার মধ্যে এই মহল যেন এক কুহক যাত্রার কথা বলে।নৌকো করে নেমে এসে ধীরে ধীরে ভেতরে এলে রাজার বিশ্রাম কক্ষ,নর্তকীদের নাচের জায়গা, বারান্দা, ঝরোখা, রাজাদের ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট স্বতন্ত্র নৌকো- ঘাট সবই আমাদের বোধ ও শৈল্পিক ভাবনাকে নবরসে জাড়িত করে।মুঘলরা ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য বিস্তারের পর দিল্লিকে রাজধানী করলে অনেক ধরনের বাগান তারা বানিয়েছিলেন।মুঘল শাসকদের কাছে বাগান-বিলাস এবং জল একটা বড় ব্যাপার ছিল।সব ধরনের বাগানেই ছিল পরিকল্পনার ছাপ এবং জলের ব্যবস্থা। এমনকি তারা অতি বিখ্যাত সব স্থাপত্য জলের আয়োজন রাখতেন।মধ্য এশিয়ায় জলের অভাবে কি এই জল তৃষ্ণার অন্যতম কারণ? তাই স্থাপত্য নির্মাণ করলেই জলের আয়োজন। যেমন তাজমহল।ত্রিপুরার রাজাদের ব্যাপারটি স্বতন্ত্র। তারা জলের ভেতর শিল্প গড়েছেন।শিল্পের স্বপ্নের সঙ্গে জলের স্বপ্নও মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

এবার আসি আমরা নীরমহল প্রসঙ্গে।বোটে করে নীরমহল যেতে যেতে অজস্র পাখি এবং মাছ ধরার নৌকো চোখে পড়ে আমাদের। এর প্রাকৃতিক শোভা অনবদ্য। সৌন্দর্য মুগ্ধ টুরিস্টরা এই জলশোভার ছবি নেন অকাতরে।এই প্রাসাদের গম্বুজ ও ঝরোখা ইসলামিক ও হিন্দু স্থাপত্য শৈলীর সমন্বয়বাদী এক ধারাবাহিকতার কথা বলে।

নীরমহল যার অর্থ “জল প্রাসাদ”। এটি ১৯৩০ সালে রুদ্রসাগরের হ্রদের মধ্যবর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুর কর্তৃক নির্মিত একটি রাজকীয় প্রাসাদ এবং এটি ১৯৩৮ সালে সম্পন্ন হয়। এটি ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে ৫৩ কিলোমিটার দূরে মেলাঘরে রুদ্রসাগর লেকের মাঝখানে অবস্থিত এবং হিন্দু ও মুসলিম স্থাপত্য শৈলীর সমাহার করে।এই প্রাসাদটি ভারতের সবচেয়ে বড় এবং পূর্ব ভারতে একমাত্র। ভারতে শুধু দুটি জল প্রাসাদ আছে অন্য আরেকটি রাজস্থান রাজ্যের “জল মহল“। ত্রিপুরার ‘হ্রদ প্রাসাদ‘ হিসাবে পরিচিত, নীরমহল একটি গ্রীষ্ম বসবাসের স্থান হিসাবে নির্মিত হয়েছিল। সুন্দর রুদ্রসাগর হ্রদে প্রাসাদ নির্মাণের জন্য মহারাজা বীর বিক্রম মাণিক্য বাহাদুরের ধারণা ছিল এবং ১৯২১ সালে তিনি তাঁর প্রাসাদ নির্মাণের জন্য ব্রিটিশ কোম্পানি “মার্টিন ও বার্নসকে” স্বীকৃতি দেন। কাজটি সম্পন্ন করার জন্য কোম্পানিটি নয় বছর সময় নেয়। মহারাজা বীর বিক্রম মাণিক্য বাহাদুর ‘মাণিক্য রাজবংশের‘ ছিলেন, যা আজ বিশ্বের একক শাসক লাইন থেকে দ্বিতীয় বলে মনে করা হয়।

প্রাসাদ হল মহারাজার মহান দূরদর্শিতা এবং হিন্দু এবং মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মিশ্রণের তার চিত্তাকর্ষক ধারণা।

প্রাসাদটিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রাসাদটির পশ্চিমাঞ্চল অন্দর মহল নামে পরিচিত। এটা রাজকীয় পরিবার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। পূর্ব দিকের একটি খোলা আড়ম্বরপূর্ণ থিয়েটার যেখানে নাটক, থিয়েটার, নাচ এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলি মহারাজা এবং তাদের রাজকীয় পরিবারের আনন্দ উপভোগের জন্য সংগঠিত হয়।

রুদ্রসাগর লেকে অবতরণে নীরমহল দুটি স্টারওয়েজ ঢুকিয়েছে। ‘রাজঘাট‘ থেকে হাতে চালানো নৌকা দিয়ে মহারাজ প্রাসাদে যান।

১২২ মিটার লম্বা কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে দুধ-সাদা রঙের প্রাসাদে রয়েছে সর্বমোট ২৪টি কক্ষ, যাকে ঘিরে রয়েছে সুন্দর বাগান। প্রাসাদের গম্বুজ আকৃতির মিনারগুলি, বিরাট ‘দরবার কক্ষ’, রাজা-রানির বিশ্রামকক্ষ, সুউচ্চ নজরমিনার সবই চমৎকৃত করবে। রুদ্রসাগরের পাড় থেকে জলের মধ্যে থাকা নীরমহলকে দেখে রাজস্থানের উদয়পুরের লেক-প্যালেস ‘জলনিবাস’-এর পিছোলা লেকের উপর অবস্থিত কথা মনে পড়বে। রুদ্রসাগর লেকের জলেও পড়ে নীরমহলের প্রতিবিম্ব। ৫.৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রুদ্রসাগর সরোবর বিভিন্ন ধরনের পাখির বিশেষত পরিযায়ী জলকেলির এক নিরাপদ ঠাঁই। নীরমহলের প্রশস্ত ছাদ থেকেও রুদ্রসাগরের এক দারুণ দৃশ্য চোখে পড়ে।

যেটুকু সৌন্দর্য কথা,সৌন্দর্য মালা আমাদের সামনে দিয়ে যেন বা আমাদের সামনে কোনো সিনেমার ছবি হয়ে ছুটে গেল সেই শব্দমালাদের যে শিল্পিত রূপ তার বর্ণনায়।নীরমহলের ছায়ার আলোয় ইতিহাসে ভূগোলে করার চেষ্টা হল তা হয়তো অসম্পূর্ণই।প্রকৃত প্রস্তাবে যেকোনো রস ও সৌন্দর্য তো আসলে অপূর্ণই।অপূর্ণতাই তার সুন্দর হয়ে উঠার বহুমাত্রিক গুণ।