0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















২৩.২

রঙ্গনাথের প্রিন্সিপালের কথায় বাধা দিয়ে কিছু বলার সাহস হল না। তাই বলল, “হ্যাঁ, প্রিন্সিপাল

সাহেব, ঠিকই আছে’।


হঠাৎ প্রিন্সিপাল খেপে গেলেন। “ঠিক তো বটেই রঙ্গনাথ বাবু, আমায় চার চার বোনের বিয়ে দেয়া

বাকি। পকেটে একটা ফুটো কড়িও নেই। কাল বৈদ্যজী যদি আমায় কান ধরে কলেজ থেকে বের করে দেন

তো কেউ ভিক্ষাও দেবে না।

“তাহলে আমি ওই খান্না-বান্নাকে বাপ বলে ডাকব, নাকি বৈদ্যজীকে? তুমিই বলে দাও”।

গোড়ার কথাবার্তায় প্রিন্সিপালের একটা মানবিক এবং সংবেদনশীল চেহারা দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু

এখন উনি যা করছেন তাতে সেই চেনা বাংগড়ুপনা বা ক্যাওড়ামিই প্রকট হচ্ছে। এভাবে ওঁর তৈরি

সাময়িক আবেগঘন মায়ার প্রভাব গায়েব হয়ে গেল।

রঙ্গনাথ আগের মত হালকা মেজাজে। বলল, “না না; আপনি যা করছেন- সব ঠিক। আর যেখানে যা আছে,

সব ঠিকই আছে। ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হলে বেশি কি হত? এখানে আপনি কোন ভাইস চ্যান্সেলরের

চেয়ে কম নাকি”?

এতক্ষণে প্রিন্সিপাল একটু হাসলেন। বললেন। “ হ্যাঁ, সে তো বটেই। আমি তো নিজেকে ভাইস

চ্যান্সেলরের থেকেও সেরা ভাবি। আজকাল ভাইস চ্যান্সেলরের জীবনও নরক সমান। সকাল থেকেই

নিজের মোটরগাড়ি চড়ে সমস্ত আমলাদের সেলাম ঠুকতে বেরোয়। কখনও চ্যান্সেলরের সামনে হাজির

হও, কখনও কোন মন্ত্রীর, কখনও সেক্রেটারির। গভর্নর বছরে অন্ততঃ চারবার বকুনি লাগান।

দিনরাত ক্যাঁও -ক্যাঁও, চ্যাঁও -চ্যাঁও! ছাত্রের দল মুখের উপর মা-বোন তুলে গালি দিতে দিতে মিছিল

বের করে। সবসময় মার খাওয়ার ভয়! পুলিস ডাকো তো এসপি হাসে। বলে -দেখ এই ভাইস

চ্যান্সেলরকে! ছেলেদের উপর বছরে দশ- বিশবার লাঠি তলোয়ার না চালিয়ে এনার শান্তি নেই। এই তো

অবস্থা, বাবু রঙ্গনাথ”!

গলা খাঁকারি দিয়ে ফের বললন,”এখনও প্রিন্সিপালগিরিতে এসব ঝামেলা শুরু হয় নি। আর যেখানে

বৈদ্যজীর মত ম্যানেজার, সেখানে প্রিন্সিপাল, ধরে নাও, কোন বব্বর সিংহের চেয়ে কম নয়। আমি

কাউকে খোশামোদ করতে চাই না। বৈদ্যজীর খুঁটি ছুঁয়ে রেখে সবাইকে জুতোর আগায় ঠিক রাখি। তুমি কী

বল, বাবু রঙ্গনাথ”?

“যা বলছেন, একদম ঠিক”।

“আর সত্যি কথা জানতে চাও তো বলি—ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার না হওয়াতে আমার কোন দুঃখ

নেই। ওখানে আরো বড় নরক, একেবারে কুম্ভীপাক! রাতদিন খোসামুদি। কোন সরকারি বোর্ড দশ

টাকার গ্রান্ট দেয়, তো কান ধরে যেমন ইচ্ছে থিসিস লিখিয়ে নেয়। যাকেই দেখ, একটা না একটা

রিসার্চ প্রোজেক্ট বগলদাবা করে বসে আছে। জিজ্ঞেস করলে বলে—রিসার্চ করছি। কেমন রিসার্চ?

যার খাচ্ছ, তার গুণ গাইতে থাক, ব্যস। এদের কী যেন বলে? একটা বিশেষ শব্দ? হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়ল-

-বুদ্ধিজীবী। অবস্থা এমন যে এইসব বুদ্ধিজীবীরা বিলেত যাওয়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য নিজের বাপের

নাম বদলে দিতে পারে। এদের চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে দশবার জুতোপেটা কর, কিন্তু একবার তো

আমেরিকা ঘুরে আসতে দাও! এই হল তোমার বুদ্ধিজীবী”।

এবার উনি নিজের মাতৃভাষা অবধী থেকে একটি প্রবাদ আউড়ে দিলেন।

“গু খেতে হলে হাতির গু খাব। আমি তো এটাই ভেবেছি যে বৈদ্যজীর খোসামোদ করলে আর কাউকে তেল

দেবার দরকার নেই। লেকচারার হওয়া আমার পোষাবে না”।




প্রিন্সিপাল মাথা নেড়ে লেকচারার হবেন না জানিয়ে দিলেন। ওনার মুখের ভাবে মনে হল যেন সংসারের

সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শোকের ছায়া নেমেছে।

“এটা একদম ঠিক বলেছেন”, রঙ্গনাথ সায় দিল।

প্রিন্সিপাল তীক্ষ্ণ চোখে রঙ্গনাথকে দেখতে লাগলেন। তারপর ফিকে হেসে ধীমে স্বরে বললেন, “কী

ব্যাপার বাবু রঙ্গনাথ? আজ আমি যাই বলি সবতাতেই হ্যাঁ বলছ যে”?

রঙ্গনাথ বলল, ‘ভাবছি, আপনার অভিজ্ঞতা থেকে শিখব। কী দরকার কারও কথার ভুল বের করার? যে

যাই বলুক, আমি বলব –ঠিক বলেছেন”।

প্রিন্সিপাল সাহেব হা-হা করে হেসে উঠলেন, “তুমিও ঠিক বলেছিলে, রঙ্গনাথ বাবু। যখন পিকাসোর নাম

নিলাম, তোমার নিশ্চয়ই বমি পাচ্ছিল, এটা বুঝি—।

“এতে অবাক হবার কী হয়েছে? এসব কথার প্রভাব মেশিনের উপরেও পড়ে। তোমায় একটা ঘটনার কথা

বলি।

“একটা হাওয়াই জাহাজ ইন্ডিয়া থেকে ইংল্যাণ্ড যাচ্ছিল। যাত্রীদের মধ্যে একজন তামাক ব্যবসায়ী

ছিল। শালার সারা জীবন কাটল বিড়ি-সিগ্রেটের কারবার করে। হঠাৎ ওর কী যে হল, ব্যাটা লিটারেচার

আর ফিলজফির তত্ত্ব আওড়াতে লাগল। ব্যস, তক্ষুণি হাওয়াই জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল।

বিমান একহাজার ফুট নীচে নেমে এল। আতংক ছড়িয়ে পড়ল। সবাই ভাবল কোন দুর্ঘটনা হয়েছে, কিন্তু

একটু পরে আবার ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল। বিমান উড়তে লাগল।

“হাওয়াই জাহাজের ইঞ্জিনিয়ার কারণ খুঁজে কী পেল জান? ওই তামাকের ব্যবসায়ী হঠাৎ কার্ল

জেসপার্সের নাম নিয়েছিল। আর সেই ঝটকায় বিমানের ইঞ্জিনের হার্ট ত্থেমে গেল।তখন সব যাত্রী

ওই লোকটাকে মিনতি করতে লাগল—মশাই, হয় চুপ করে থাকুন, নয় শুধু তামাক নিয়ে কথা বলুন। নইলে

অ্যাকসিডেন্ট হবে”।

রঙ্গনাথ হেসে উঠল,”আজ আপনি ভারি মজার কিসসা শোনাচ্ছেন”।

প্রিন্সিপালের চেহারায় উদাস ভাব। “আপনার জন্য রোজ এমন সব কিসসা শোনাতে পারি। কিন্তু আপনি

আমাকে কোথায় পাত্তা দিচ্ছেন? আপনি তো আজকাল খান্না মাস্টারের কথায় নাচছেন”।




ওরা এখন ফেরার পথ ধরেছেন। আঁধার নেমেছে। বাতাসে শীতের আমেজ। রাস্তার ধারে কয়েকজন

যাযাবর শ্রেণীর লোক বসে আগুন পোহাচ্ছিল আর অভিজাতকুলের অবোধ্য কোন ভাষায় নিজেদের

মধ্যে গল্প করছিল। যেভাবে লোকে পথের ধারে পড়ে থাকা গরু -মোষকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যায়,

প্রিন্সিপাল তেমনই করে ওদের এড়িয়ে চলতে লাগলেন। রঙ্গনাথ একবার পেছন ফিরে ওদের দেখে

মন্তব্য করল—“বেশ ঠান্ডা পড়েছে”।

প্রিন্সিপাল সাহেব আবহাওয়া নিয়ে কোন কথা বলার মুডে ছিলেন না। উনি আগের কথার খেই ধরে

বললেন,”তোমরা এখনও লোক চিনতে শেখ নি। রূপ্পন তো শুনলাম খান্না মাস্টার চক্করে পড়েছে।

কিন্তু, বাবু রঙ্গনাথ! এই খান্না মাস্টারটি কেমন চিজ সে তো তোমার বোঝা উচিত।




“খান্না বড় চালু মাল। দেখ, সেদিন কলেজে মারপিটের পরিস্থিতি হল কিনা? ওর তো কিছু এসে যায় না।

কিন্তু কলেজের ইজ্জত গেল”।

রঙ্গনাথ, “আমি তো শুনেছি ঝগড়ায় দু’পক্ষেরই দোষ ছিল”।

প্রিন্সিপাল সাধু-সন্তের মত বললেন, “তোমার শোনা -না -শোনায় কি হয় বাবু রঙ্গনাথ? মামলা তো

এখন কাছারিতে পৌঁছে গেছে। ম্যাজিস্ট্রেট যেমন বুঝবেন, ফয়সালা করবেন”।

--“এ তো বড় খারাপ কথা”!

--‘খারাপ মানে? এক ঘটি জলে ডুবে মরার সমান, রঙ্গনাথ বাবু! কিন্তু খান্না মাস্টারের লজ্জা-শরম

বলতে কিছুই নেই। আমাকেই ওর গলায় পাথর বাঁধতে হবে, তবে না ডুববে”!

উনি এখন সরকারের প্রচার বিভাগের মত নিস্পৃহভাবে—অর্থাৎ কেউ শুনুক, না শুনুক, আমি তো

বলবই—বলতে লাগলেন।

“ পুলিস জবরদস্তি দু’পক্ষেরই নামে ধারা ১০৭ এর মামলা শুরু করেছে। এটা পুলিসের হারামিপনা। খান্না

করল বদমাইসি। ওর সঙ্গীসাথীরা মারামারির জন্যে উসকে দিল। আর পুলিস চালান কাটল দুপক্ষের

নামে! এ তো একদম ‘অন্ধের নগরী চৌপট রাজা’ 1 কেস।

“কালকেই শুনানি ছিল। আমাকে বলল মিটমাট করে নাও। আমি বললাম—তার কি দরকার? আমাকে

সোজা ফাঁসিকাঠে চড়িয়ে দিন—ঝামেলা খতম। শিবপালগঞ্জে শুধু খান্না মাস্টার থাকবে, আর থাকবে

ওর গুণ্ডার পাল। ফের কিসের ঝগড়া, কিসের বিবাদ?

“আমি তো চুপচাপ চলে এলাম। কিন্তু ওদের দেখ—সত্তরটা ছেলে নিয়ে ‘প্রিন্সিপাল মুর্দাবাদ’ মিছিল

বের করেছে। শহরের আদালত। অনেক ভালো লোকের নিবাস। ওরা জিজ্ঞেস করছিল—এইসব ছেলেপুলে

কোথাকার? খান্না মাস্টার আগ বাড়িয়ে বলে দিল –ওরা ছঙ্গামল কলেজের ছাত্র।

“বেশরম হতে হয় তো ওর মত”।

ফের উনি অবধী বুলিতে তিন নম্বর প্রবাদ আউড়ে দিলেন—'ন্যাংটোর পোঁদে জুটেছে ইজের, তো নেচে

নেচে বলছে-এই তো ছায়া পেয়েছি’।

“ বুঝেছ বাবু রঙ্গনাথ! এই হচ্ছে তোমাদের খান্না মাস্টার। রূপ্পন বাবুকে বলে দিও—ওর সঙ্গে বেশি

গা ঘষাঘষি না করতে। নইলে একদিন কাঁদতে হবে”।




এবার ওরা থানার সামনে দিয়ে যাচ্ছেন। লণ্ঠন হাতে ক’টা সেপাই এদিক করছে। ভারি শোরগোল।

কয়েকটা ছোঁড়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোরাস গাইছে। থানার পাশে দারোগাজির কোয়ার্টারের সামনে তিনটে

ট্রাক দাঁড়িয়ে, তাতে মালপত্র তোলা হচ্ছে। হো-হল্লার আসল কারণ ওটাই।

প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন, “মনে হচ্ছে দারোগাজীর হয়ে গেছে”! বলতে বলতে উনি রঙ্গনাথের কাঁধ

ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন, “এই ব্যাপার! পুরো এলাকা নোংরা ময়লায় ভরে গেছল। এবার সাফ হচ্ছে”।

1 হিন্দি কথা সাহিত্যের প্রখ্যাত ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্রের লেখা ‘অন্ধের নগরী চৌপট রাজা”।

প্রবাদের অর্থ যে দেশে নিয়ম কানুন নেই, রাজা গায়েব।




রঙ্গনাথ,”বুঝতে পারছি না, এত তাড়াতাড়ি অর্ডার এসে গেল! কী ভাবে? দুপুর বেলাতেও কোন খবর

শুনিনি তো”।

প্রিন্সিপাল সাহেবের খুশির কোন সীমা নেই। দেখে মনে হচ্ছে এবার উনি ডানা মেলে আকাশে উড়ে

সামনের গাছের ডালে গিয়ে বসবেন আর বুলবুলির মত সুরেলা শিস দেবেন। বললেন, “বাবু রঙ্গনাথ,

এতদিন মামার সঙ্গে থেকেও ওনাকে চিনতে পারোনি? আগের দারোগাকে উনি বারো ঘণ্টার মধ্যে

শিবপালগঞ্জ থেকে ভাগিয়ে দিয়েছিলেন। এই দাওগা তো তবু চব্বিশ ঘন্টা টাইম পেয়ে গেল”।

এরপর ফিসফিসিয়ে, “বৈদ্যজীর মহিমা কেউ বুঝতে পারে? যেদিন উনি জোগনাথকে জামিনে ছাড়লেন না,

সেদিনই বুঝেছিলাম যে এনার দিন ঘনিয়ে এসেছে। তার সাথে আমার ১০৭ ধারার মামলা। তুমিই বল বাবু

রঙ্গনাথ, এর কোন দরকার ছিল? কিন্তু এনাকে বোঝাবে কে? ইনি রামাধীনকে বাপ ডেকেছেন। ও যেমন

ইচ্ছে, তেমনই নাচিয়েছে—সে তো তুমি দেখেছ। এখন এটাও দেখলে যে দশটা দিন গেল না, ওর শমন

এসে গেল”।

ছোকরার দলের কোরাস জারি—“দারোগাজী, ট্রাকে চড়লেন, দারোগাজী, ট্রাকে চড়লেন”।

ওরা দলবেঁধে ট্রাকে দারোগাজীর মালপত্র তোলা দেখছে।

একটা ট্রাকে শিশু কাঠের কিছু বড় বড় পালংক উঠে গেছে আর খালি জায়গাটুকুতে একটা চমৎকার

ভাল জাতের গরু আর তার বাছুর। প্রিন্সিপাল সাহেব দেখে টেখে প্রশ্ন করলেন, “মোষ দেখছি না যে!

মুররা জাতের দুধেল মোষ”?

রঙ্গনাথ বোঝাতে লাগল, “ এই গরুটা টিকৈতগঞ্জের ঠাকুর পরিবার দিয়েছিল। বিধবা ছেলে বৌয়ের পেট

খসানোর মামলা। গোদান করে পাপমুক্ত”!

উনি বিশেষ কাউকে লক্ষ্য না করে উঁচু আওয়াজে বললেন, “মোষটা কোথায় গেল? দেখছি না যে”!

অন্ধকারে কারও স্বর ভেসে এল—“বিক্রি হয়ে গেছে”।

“কোথায়”?

“শহর থেকে এক গোয়ালা এসেছিল”।

“কততে গেল”?

“একশ’তে আর কত? তুমি কি ভেবেছিলে-- হাজার”?

“আমি তো এখনও তাই ভাবছি”, প্রিন্সিপাল মজা করে বললেন।

তারপর রঙ্গনাথের কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিলেন। ভাবটা—তুমিও কথাবার্তার মজাটা উপভোগ কর।

এখন ট্রাকের পাশে সেরেফ কিছু পালংক পড়ে আছে। রঙ্গনাথ শুনেছিল যে দারোগাবাবুর শখ নানারকম

পালংক জোগাড় করা। এখন নিজের চোখে দেখল। খুব হৈচৈ আর চেঁচামেচির মধ্যে ট্রাকে পালংক তোলা

হচ্ছে। কিছু উঠে গেছে, কিছু উঠছে, কিছু উঠবে। রাস্তায় কোরাস গাওয়া ছেলের দল এখন অন্ধকারের

মধ্যেও ট্রাকের কাছে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ভারি উৎসাহের সঙ্গে ট্রাকে পালংক তোলা দেখছে।

এক সেপাই ট্রাকে রাখা পালংকের উপর চড়ে হাতে লণ্ঠন ঝুলিয়ে নীচের লোকজনকে পালংক তুলতে

নির্দেশ দিচ্ছে। “আবে ও! কব্জাটা ভেঙে ফেললি তো! জানতাম, এ ব্যাটা না ভেঙে ছাড়বে না”।




ওর হুঙ্কার শুনলে সবাই মানবে যে পালংকের কব্জা ভেঙে ফেলাটা আজ ভারতীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে

বড় দুর্ঘটনা বটে! রঙ্গনাথও পালংক যারা ট্রাকে তুলছিল তাদের সান্ত্বনা দেবার জন্যে শীতল স্বরে

বলল, “হাঁ ভাই, কব্জা-টব্জা ভেঙো না। সামলে সুমলে ট্রাকে তোলো”।

প্রিন্সিপাল সাহেব রঙ্গনাথের কথা শুনে জোরে হেসে উঠলেন। এক সেপাই পালংক তোলার কাজ

করতে করতে নিজের জায়গা থেকে বলল, “কে বটে? প্রিন্সিপাল সাহেব নাকি? জয়হিন্দ্‌ সাহেব”।

“কী হয়েছে ভাই? জয়হিন্দ! বদলি হয়েছে কি”?

“হ্যাঁ, প্রিন্সিপাল সাহেব। দারোগাজী এসপি সাহেবকে দরখাস্ত দিয়েছিলেন। মেয়ের পড়াশুনোর জন্যে

শহরে বদলি চেয়েছিলেন”।

“আমার কলেজে ভর্তি করাতেন। শিবপালগঞ্জ কোন শহর থেকে কম নাকি”?

“আপনার কলেজ তো একটা হিন্দুস্থানী স্কুল। উনি ইংরেজিতে পড়াতে চান। ভগতিন স্কুলে। বেবির

উর্দি তৈরি হয়ে গেছে। নীল নীল উর্দি। গায়ে চড়ালে একদম ইংরেজ মেয়ের মত দেখায়”।

“তাহলে শহরে বদলি হয়েছে। বেশ, ভাল কথা। কিন্তু গরু কোথায় রাখবেন? খড় ভুষি কোথায় পাবেন?

গরুটা বেচবেন কি”?

সেপাই এবার একটা বড় পালংক হেঁইয়ো করে সর্বশক্তি দিয়ে ট্রাকে তুলছিল। কোঁকাতে কোঁকাতে

বলল, “না। গরু থাকবে সৈনিক ফার্মে। দারোগার ভাইসাহেব ওখানেই চাকরি করেন। এখানে গাই বেচারার

ঠিক মত খাওয়া জুটত না। এখন ওর খাওয়ার দিন আসছে”।

ট্রাকের উপরে সওয়ার সেপাইয়ের পুরো নজর পালংকের কবজায় আটকে ছিল। ও দাঁতে দাঁত পিষে

বলছিল, “ ঠিক সে। আবে ঠিক সে। আরে, আরে, এবার অন্য পালংকটাকেও ভাঙবি নাকি! যদি ভাঙে তো

সালা ---“।

কেউ বলল যে বৈদ্যজী এক্ষুণি দারোগাজীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। বলছিলেন—উনি থাকতে ওনার

বদলি কী করে হতে পারে? আদেশ বদলে দেবেন।

প্রিন্সিপাল রঙ্গনাথকে বললেন, “যদি চোখের চামড়া থাকে, তাহলে দারোগাজী ভোরের মোরগ ডাকার

আগে শিবপালগঞ্জ ছেড়ে চলে যাবেন”।

খানিকক্ষণ ট্রাকে চড়া মালপত্তর খুঁটিয়ে দেখা হল। রঙ্গনাথ বলল, “ দারোগাজীর শখ ছিল নানারকম

পালংক”।

“ওনার শখ যা কিছু মিনি মাগনা পাওয়া যায় তা হাতিয়ে নেয়া”। হঠাৎ উনি ট্রাকের উপড় চড়ে থাকা

সেপাইকে ডাক দিয়ে বললেন, “ আরে ভাই সেপাইজি! ওই কব্জা ভাঙা খাটিয়াটা ছেড়ে দাও না! যদি

টাকাখানেক দামে নীলামে ওঠে তো আমিই কিনে নেব”।

সেপাই বলল, “আপনি এত বড় মানুষ হয়ে কেন ছোটলোকের মত কথা বলছেন? নেবেন তো পুরো ট্রাক

নিয়ে নিন। বলুন, আপনার ঘরে পুরো ট্রাক পাঠিয়ে দিই”?

“হেঁ-হেঁ-হেঁ! একটা গোটা ট্রাক নিয়ে আমি কি করব? আমি তো মামুলি এক মাস্টার”। ফের গলার স্বর

বদলে মোটা আওয়াজে বললেন, “দারোগাজী ঘরেই আছেন তো? বৈদ্যজীও রয়েছেন? তো চলুন বাবু




রঙ্গনাথ, দারোগাজীকে সেলাম করে আসি। বেচারি বড্ড ভালমানুষ ছিলেন। কখনও কাউকে কষ্ট দেন

নি। কারও থেকে কিছু চাইতেন না। ভগবান যা দিতেন তাই চোখ বুঁজে নিয়ে নিতেন”।

হ্যাঁ, সত্যিই ভালোমানুষ ছিলেন, তাই চলে যেতে হল—রঙ্গনাথ ভাবছিল।

(চলবে)

0 comments: