ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক১৫
গের্ট হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ ইনেসের দিকে।
-‘উকিল হয়ে পাশ করলে… কিন্তু সেটা তো আলাদা ব্যাপার। সেটা তো পেশা!’
-‘পেশা হোক বা ব্যক্তিগত জীবন… আসল ব্যাপারটা তো তোমাকে নিয়েই। যাই হোক, আমার মতে তোমার মনের জোর যে কম শুধু তাই নয়, তুমি অদ্ভুত কাপুরুষের মত আচরণ করছ।’
-‘কাপুরুষের মত?’
-‘হ্যাঁ। কারণ বের্শেন চলে গেছে বলে তুমি কষ্ট পাচ্ছ এবং কষ্ট পেয়ে নিষ্কর্মার মত বসে আছ। কোনও কাজ না করার ফলে তোমার কষ্ট আরও বেড়ে যাচ্ছে। তুমি নিজেও জান যে তোমার মনের জোর নেই এবং সেই কারণেই তুমি পড়াশুনায় ফিরতে চাইছ।’
-‘সেই কথাটা তোমার আমাকে না বললেও চলবে। ও হ্যাঁ, ভাল কথা… ঠিক কী কারণে বের্শেনকে আমার ভালবাসা উচিত নয়?’
-‘এটা তো আমারও প্রশ্ন! শোনো গের্ট, তুমি তো আর কচি খোকা নও। নিজের প্রতি সৎ থাকো। আসল কথাটা কী?’
-‘আমার ভীষণ একা লাগছে ইনেস। সহ্য করতে পারছি না আমি।’
-‘পড়াশুনা শুরু করলে অবশ্য একদিকে ভালই হবে। তুমি তো আগে কখনও সেভাবে খাটবার চেষ্টা করনি।’
-‘এইরকম একাকিত্ব আমি সহ্য করতে পারছি না!’
-‘অনেকেই তো একা। তাছাড়া তোমার সঙ্গে তো আমি আছি, ফ্লক আছে। তুমি যদি চাও, বের্শেনের সঙ্গে দেখা করে আসতে পারো। সে হতভাগা নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে।’
-‘ভুল করছ… আমি তো বের্শেনের কাছে কিছু চাইনি। বরঞ্চ সে চলে যাবার পরে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। ওর সুন্দর মাথার গড়ন, মিষ্টি শিশুসুলভ মুখ… এসব দেখেই আমার অসহ্য লাগতো। ও সব সময় আমাদের সঙ্গে চিপকে থাকতো… সব সময়! পুরো ব্যাপারটাই বিরক্তিকর!
- ‘থামো! তুমি নিজেও জানো যে যা বলছ সেটা তুমি বিশ্বাস কর না।’
কিন্তু গের্ট থামে না। থামতে চায় না সে। ইনেসের দুটো হাত শক্ত করে ধরে আছে সে। মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে প্রচণ্ড আবেগমথিত স্বরে সে বলে যায়…
‘ইনেস, ও আমাদের বিরক্ত করত। আমি একদম নিশ্চিতভাবে, ঠিকভাবে ভেবেই বলছি তোমায় যে ও আমাদের জ্বালিয়ে খেত। তুমি ওকে কত প্রীতি ভালবাসা দিয়েছ, আমিও দিয়েছি। তুমি সব সময় ওকে আগলে দেখে রাখতে, যখন আমরা সন্ধ্যায় একসঙ্গে বেরতাম লং ড্রাইভে। আমরা ওকে ভালবাসায় ভরিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম।’
‘এবং সে শান্ত হয়ে ফ্লককে কোলে নিয়ে তার কলারটা চেপে আমাদের মাঝে বসে থাকত; সেও সব সময় আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ উষ্ণ প্রীতি দেখিয়েছে।’
‘কিন্তু তুমি তাকে আমার চেয়েও বেশি ভালবাসা দিয়েছ। আমার ব্যাপারে তুমি সেভাবে পরোয়া কর না।’
‘ছেলেমানুষি কোর না গের্ট!’
‘ওহ… ইনেস, আমি চাই যে তুমি আমায় ভালোবাসো!’ গের্ট আরও শক্ত করে চেপে ধরে ইনেসের দুই হাত। এতটাই শক্ত করে ধরে যে তার কব্জি ফ্যাকাসে হয়ে যায়; ইনেসের হাতের পাতায় সে নিজের মুখ চেপে ধরে। এক অদ্ভুত সমর্পণে কম্পিত হয়ে আনত হয় তার শরীর। মুখমণ্ডল উত্তেজনায় সাদা হয়ে যায়। ইনেস গের্টের গলা জড়িয়ে ধরে তার দুই হাতে। কিছুক্ষণ পিছনদিকে হেলিয়ে রাখে তার মাথা। তারপর হঠাৎ চুম্বনে আবদ্ধ হয়ে কেঁদে ওঠে তীব্রভাবে।
-------------------
প্রথমে বের্নহার্ড চার্লসকে জেরাল্ডের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেনি। তবে যাবার কথা উঠতো মাঝে মাঝেই। বিকেলের দিকে সময়টা ফাঁকা থাকত। ইচ্ছে হলে পরদিনই যেতে পারত তারা। এরকম একটা অদ্ভুত ব্যাপার বেশিদিন ফেলে রাখা ঠিক নয়। কিন্তু চার্লসের এক গোঁ; সে যেতে একেবারেই রাজি নয়। সে বলল যে তার ভয় করছে। এখন এই ভয়ের ব্যাপারে বের্নহার্ড আর কী বা করতে পারে? চার্লস উল্লেখ না করলে জেরাল্ডের বাড়ি যাবার ব্যপারে বের্নহার্ড আর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কিছুই বলবে না ঠিক করল।
অবশ্য বের্নহার্ড নানা ব্যাপারে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। অচেনা জায়গা, সবকিছুই অজানা অচেনা তার কাছে। ফলে অনেক সময় তাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। তাছাড়া আসল কথা হল যে তার আরও অর্থ প্রয়োজন। মাসের প্রথমে বাবা যে টাকাটা পাঠিয়ে দেন, তাতে ঘর ভাড়া আর দুই বেলার খাওয়া হিসেব করে চললে কুলিয়ে যায়। কিন্তু লন্ড্রির খরচ, স্বরলিপি কিনবার খরচ, পিয়ানোর ভাড়ার খরচ ছাড়াও শীতের জন্য বেশ কিছু পোশাক কেনা প্রয়োজন, যেগুলো সে এখনও কিনে উঠতে পারেনি। এছাড়া বাসভাড়া থেকে শুরু করে চার্লসকে সিগারেট কিনতে ধার দেওয়া পয়সা… খরচের কি শেষ আছে? মোট কথা হল যে তার টাকা দরকার।
আশ্চর্য হয়ে সে লক্ষ্য করল যে চার্লস এবং অন্যান্য বন্ধুদের কাছে সে যেরকম পরিস্থিতির কথা অতীতে শুনেছে, সে নিজেই এখন সেরকম পরিস্থিতিতে পড়েছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি সামলে নেবার জন্য সে একেবারেই প্রস্তুত নয়। তার টাকার দরকার এবং সে জানে না যে কী ভাবে সেই টাকা যোগাড় হবে। চার্লস সে কথা শুনে শুধুই কান এঁটো করা হাসি দিল। বের্নহার্ডের একেবারেই ভাল লাগল না তার এই অদ্ভুত ব্যবহার। কারণ বের্নহার্ড তাকে গত বেশ কয়েকটা সপ্তাহে বারেবারে সাহায্য করেছে। তাছাড়া পরের কিস্তির টাকা মাদাম দুবোয়ার কাছ থেকে পেতে আরও আটদিন বাকি আছে এবং সে কথা শুনে কী ভাবে কারো হাসি পায়, সেটাও বের্নহার্ড ভেবে পেল না।
বের্নহার্ড তার সঙ্গীতশিক্ষকের কাছে জানালো তার সমস্যার কথা। সঙ্গীতশিক্ষকের কাছে একটা নয়, একাধিক উপায় জানা আছে এই সমস্যার সমাধান বের করবার। এখন বের্নহার্ডকে বেছে নিতে হবে সে ঠিক কোন কাজটা করতে চায়।
‘আপনি তো নিজেও সঙ্গীত শিক্ষা দিতে পারেন, আপনার অগ্রগতি প্রশংসনীয়!’
প্রশংসা শুনে বের্নহার্ড লজ্জায় লাল হয়ে যায়।
‘কিন্তু আপনাকে দেখতে খুবই তরুণ… আসলে দেখে মনে হয় স্কুলের শিক্ষার্থী!’
বের্নহার্ড এই কথাটা হাসিমুখে একেবারে অগ্রাহ্য করে। কারণ, যে উপায়গুলি তার সামনে এসেছে, সেগুলো বেশ আকর্ষণীয়। যেমন, একজন ভদ্রমহিলা এসেছেন আমেরিকা থেকে, মাতৃভাষা জার্মান, পোষা একটা বাঁদর আছে বাসায় এবং তিনি কণ্ঠসঙ্গীত শিখতে চান। বের্নহার্ডের শিক্ষকের নামডাক শুনে তাঁর শরণাপন্ন হয়েছেন। এই ভদ্রমহিলা খুব ধনী এবং গায়িকা হতে চান; অথচ তিনি কিছুতেই বুঝতে চান না যে কেন শিক্ষক প্রতিদিন তাঁকে সঙ্গীতশিক্ষা দিতে রাজি হন না।
এছাড়া আছে একটা রাশিয়ান কয়ার, যারা একজন বাজিয়ে খুঁজছে, যে স্বরলিপি দেখে চট করে বাজিয়ে দিতে পারবে এবং অন্যান্য যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পী এবং কণ্ঠসঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে রিহার্সাল দেবার সময় বের করতে পারবে।
আর আছে একটা জ্যাজ ব্যান্ড, যারা একজন প্রতিভাবান পিয়ানোবাদকের সন্ধানে আছে। এরা সিন নদীর উত্তরে শহরের কেন্দ্রস্থলে একটা ছোট বারে নিয়মিত কনসার্ট করে। দিনে চার ঘণ্টা এদের সঙ্গে বাজাতে হবে। অনুষ্ঠানের সময় শিল্পীরা লাল স্যুট আর সাদা লাল চেক টাই পরে এবং বের্নহার্ড এদের সঙ্গে বাজালে দিনে ১৫০ ফ্রাঁ রোজগার করতে পারবে, কারণ এই ব্যান্ডটার বেশ নামডাক আছে।
কিন্তু এই তরুণ পিয়ানোবাদককে সব বিষয়গত খুঁটিনাটি ভালভাবে জানতে হবে এবং সেই ব্যান্ডে অন্তর্ভুক্ত হবার আগে একটা অডিশন পরীক্ষায় উপস্থিত হতে হবে। কিন্তু বের্নহার্ডের মনে একটু সন্দেহ ছিল যে এই কাজটা সে ঠিকভাবে সামলাতে পারবে কি না। ফলে সে ওই আমেরিকান ভদ্রমহিলা, যার পোষা বাঁদর আছে, তাঁকে সঙ্গীতশিক্ষা দেবার কাজটা বেছে নিল। তার শিক্ষক তার যোগ্যতা বিষয়ে সুপারিশ করে খুব সুন্দর একটা চিঠি লিখে দিলেন। চিঠিটা নিয়ে দিনের শেষে বের্নহার্ড খুব ক্লান্ত হয়ে নিজের বাসায় ফিরল।
(চলবে)



0 comments: