0

গল্প - মনোজ কর

Posted in







 দ্বাদশ পর্ব

-কী ব্যাপার। সকাল সকাল শিকারের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিলেন? কিছু পেলেন?

-আমরা এটাকে সকাল বলিনা।

-জানি। আমি ভেবেছিলাম সুন্দরী অফিসে ছিলেন।

সুন্দরী বলল,’ হ্যাঁ, ছিলাম।‘কেলো দারোগা বলল,’ আপনারা কখন যে কী প্যাঁচ মারবেন বলা মুস্কিল। কোথাও বসে একটু কথা বলতে পারি?’ পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’ কি ব্যাপারে?’

-একটা খুনের বিষয়ে। ভালো বিষয় নয়? আপনাদের এবং আমার দু’জনেরই বিষয়টা বেশ প্রিয়। তাই নয় কি?

-চলুন, অফিসে বসা যাক।

ওরা সকলে মিলে পানু রায়ের অফিসে গিয়ে বসল। পানু রায় বললেন,’ আমি সিগারেট খাই না। আপনি স্বচ্ছন্দে খেতে পারেন।‘ কেলো দারোগা পানু রায়কে ধন্যবাদ জানিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। পানু রায় বললেন,’ বলুন।‘

-শিবুলাল রেগমি খুন হয়েছে।

-কী করে?

-একটা ০.৩৮ রিভলভার থেকে ক্লোস রেঞ্জে।

-কখন?

-কাল রাত্রে।

-কোথায়?

-একটা ফ্ল্যাটে। যেখানে আপনি কাল রাত্রি আটটা নাগাদ ওর সঙ্গে দেখা করেছিলেন।

-একদম ঠিক। কিন্তু আপনি জানলেন কোথা থেকে?

-সেটা আমাদের পেশাগত গোপনীয়তা।আমি চেষ্টা করি যতটা সম্ভব সব খবর নিজের কাছেই রাখতে। যাতে আপনি না বুঝতে পারেন আমি কতটা বেশি বা কতটা কম জানি। এতে আমার প্রশ্ন করতে সুবিধে হয়।

-কেন? আপনি মনে করেন আমি আমার উত্তরে সত্য গোপন করা চেষ্টা করতে পারি?

-হ্যাঁ, তাই।আমি জানি আপনি মিথ্যা বলবেন না। কিন্তু আপনি এমন উত্তর দেবেন যাতে আমি যেটা জানতে চাইছি সেটা জানতে পারবো না। আপনি শিবুলালের সঙ্গে কাল রাত্রে দেখা করেছিলেন। কেন দেখা করেছিলেন?

-একটা ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে।

-কী রকম ব্যবসা?

-আমার এক মক্কেলের সঙ্গে জড়িত একটি ব্যবসার ব্যাপারে।

-আপনি আবার কথা ঘোরাচ্ছেন। আমি জানতে চাই আপনি কী কথা বলেছিলেন?

-আমার মক্কেলের ব্যাপার গোপন রাখার জন্য আমি চুক্তিবদ্ধ। সেটাই এই পরামর্শদান ব্যবসার নিয়ম।

-সেটা আপনার পক্ষে এই খুনের ব্যাপারটায় সুবিধেজনক হবে।

-হয়ত হতে পারে।

-শিবুলালের কাল রাত্রে অন্য কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল।

-তাই?

-আপনি জানেন কাদের সঙ্গে?

-আমি জানি কেউ শিবুলালের সঙ্গে দেখা করতে আসছিল। অন্তত শিবুলাল সেরকম আশা করছিল।

-তারা কারা?

- সেটা আমি জানিনা। দুঃখিত, আপনাকে সাহায্য করতে পারছি না।

-আমাকে সাহায্য করতে পারছেন না মানে কী বলতে চাইছেন আপনি?

-আমি যা বলেছি তাই বলতে চাইছি।

-না, আপনার কথার অনেক রকম মানে হতে পারে। হতে পারে আপনি সত্যিই জানেন না। আবার এও হতে পারে আপনি জানেন কিন্তু বলছেন না।

-আরও একটা মানে হতে পারে। অন্য কারুর থেকে কিছু শুনে, তার নিজের মত ব্যাখ্যা করে বা অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কিছু বললে সেটার দ্বারা কিছু প্রমাণ করা যায় না।

- বুঝলাম। আচ্ছা সুন্দরী, আপনি বলুন এটা কী ধরণের উত্তর। দেখুন আমি কিন্তু আজ সকালে আপনি কারও সঙ্গে দেখা করার আগেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা তো হলনা। আমার মনে হয় আমার এই দেখা না হওয়ার পিছনে সুন্দরীর বুদ্ধিমত্তার একটা ভূমিকা আছে। দেখুন ,পানু রায় ,আমরা পুলিশরা কিন্তু খুব বোকা নয়। যখন আপনি অফিসে সময়ে এলেন না এবং সুন্দরী তাড়াতাড়ি করে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন আমি তখনই বুঝতে পেরেছি আপনি কিছু একটা প্ল্যান করেছেন। আমি অপেক্ষা করছিলাম। যখন আপনারা ট্যাক্সি থেকে নামলেন তখন আপনারা একটু অসাবধান হয়ে পড়েছিলেন। আপনাদের উচিৎ ছিল একটু আগে নেমে বাকিটা রাস্তা হেঁটে আসা। এই ভুলটার জন্য যেটা হল সেটা হচ্ছে এই যে আমি ট্যাক্সি নাম্বারটা পেয়ে গেলাম। আমি অফিসে জানিয়ে দিলাম যে ঐ ড্রাইভার যেন এক্ষুণি আমাদের অফিসে দেখা করে। ওরা জানতে পারবে আপনারা কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন। আর ড্রাইভারকে একটু চাপ দিলেই আরও অনেক খবর জানা যাবে। আশা করি তারমধ্যে বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং খবরও থাকবে।

- অবশ্যই। আমার পক্ষে খুব ভাল হল যে একটা প্রকরণগত ভুল আপনি ধরিয়ে দিলেন

-ওকথা বলবেন না। আমি খুব ভালোভাবে জানি যে আপনি আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে নিজেই বুঝতে পেরেছেন যে কী ভুল আপনি করেছেন। আমার মনে হয় গাড়ির মধ্যে ঐ সুন্দরীর জন্যই আপনি গাড়িটা আগে থামাননি। তাতে ঐ সুন্দরী মহিলার মনে সন্দেহ হত। যাই হোক আমার পরের প্রশ্ন হচ্ছে যে ঐ মহিলা কে? এবং কেন উনি ট্যাক্সি থেকে নামলেন না?

- ঐ মহিলার নাম এলিনা রাই । উনি রোজমেরি অ্যাপার্টমেন্টের ৩১৭ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকেন। ওনার ফোন নম্বর ৭২৪৮১। উনি আগে আমার মক্কেল কৃষ্ণকালী চৌধুরীর সেক্রেটারি ছিলেন। এখন উনি সিনেমাপাড়ায় যাচ্ছেন। উনি মঞ্চে অভিনয়ের ব্যাপারে আগ্রহী।

-অনেক ধন্যবাদ। আমি পরে মিলিয়ে দেখে নেব।

-তার মানে কী?

-আমার মনে হয় এই খুনের সঙ্গে ঐ মহিলার কোনও যোগাযোগ নেই। অবশ্য যদি আপনি কিছু লুকিয়ে থাকেন আমার কাছে তাহলে বলতে পারবনা। আর কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন?

-আমার মনে হয় এই বিষয়ে এখন আলোচনা করতে আমি বাধ্য নই।

-ঠিক আছে। এলিনা রাই কি কৃষ্ণকালীবাবুর সেক্রেটারি ছিলেন?

-হ্যাঁ।

- আপনার সঙ্গে কৃষ্ণকালীবাবুর শেষ কবে কথা হয়েছিল?

-দেখুন, আমি ওনার আইনি পরামর্শদাতা। কখনও কাজ থাকলে দিনের মধ্যে অনেকবার কথা হয় আবার কখনও মাসের পর মাস কথা হয়না।

কেলো দারোগা সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে বলল,’ আপনি এনার উত্তর শুনলেন তো। অনেক প্রশ্নকারই এইরকম উত্তর শুনে খেই হারিয়ে ফেলবে এবং আসলে প্রশ্নটা কী ছিল ভুলে যাবে। আমার প্রশ্নটা ছিল ওনার সঙ্গে কৃষ্ণকালীবাবুর শেষ কবে কথা হয়েছিল? আপনি কি ওনার শব্দজাল থেকে আমার প্রশ্নের উত্তরটা উদ্ধার করে দেবেন?

পানু রায় বললেন,’ শুনুন, আমি বলছি। আমিই গত সোমবার বিকাল থেকে ওনার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি এবং এখনও পর্যন্ত ওনাকে পাইনি।‘

-তাহলে আপনি সোমবার বিকাল থেকে ওনাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করছেন এবং এখনও করছেন? বেশ। এবার বলুন সোমবার বিকাল থেকে এখন অবধি আপনার সঙ্গে কি কৃষ্ণকালীবাবুর দেখা হয়েছে?

পানু রায় হাসি সংবরণ করতে পারলেন না। কেলো দারোগা মাথা নেড়ে বলল,’ আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় আপনার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গীর ওপর লক্ষ্য রাখতে হয়। আপনি কী বলছেন নয় আপনি কী বলছেন না সেটাই জানা খুব দরকার। আপনার অবগতির জন্য জানাই কৃষ্ণকালীবাবু গতকাল রাত্রে শিবুলালা রেগমির সঙ্গে দেখা করেছিলেন।

-তাই নাকি!! গতকাল রাত্রে কৃষ্ণকালীর সঙ্গে শিবুলালের দেখা হয়েছিল?

-এবার আমার একটা ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দিন। আপনি কি গতকাল শিবুলালের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলেন এবং পিছনের সিঁড়ির কাছে অপেক্ষা করছিলেন? তারপর এক কমবয়সী মহিলাকে গাড়িতে তুলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন? একজন প্রত্যক্ষদর্শী এটা দেখেছে। যদিও আলো কম ছিল তবুও ঐ প্রত্যক্ষদর্শী আপনাকে চিনতে পেরেছেন। সত্যি কথা বলতে কী আপনার জনপ্রিয়তা যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে এখন আপনাকে সবাই চিনে গেছে।

-হ্যাঁ। আপনি যা বলছেন তা সঠিক।

-তাহলে কি এরকম হতে পারে যে ঐ মহিলা কোনও কারণে শিবুলালকে গুলি করে এবং আপনাকে ফোন করে জানায় যে একটা সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে এবং আপনার সাহায্য ওনার দরকার। বা এমনও হত পারে যে আপনি ওনাকে জিজ্ঞাসা করলেন কী হয়েছে। উনি আপনাকে বললেন ওনার সঙ্গে শিবুলালের কথা কাটাকাটি হচ্ছিল এবং ভয় দেখাবার জন্য উনি শিবুলালের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে ধরেন। শিবুলাল ভয় পেয়ে ওনার হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নেবার চেষ্টা করে। সেইসময় ধস্তাধস্তি চলাকালীন উনি একটি গুলি চলার শব্দ শুনতে পান এবং দেখেন শিবুলাল গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। এই পরিস্থিতে আপনি ওনাকে বলেন যে সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে কিন্তু আপনি পিছনের দরজায় অপেক্ষা করবেন এবং ওনাকে নিয়ে গাড়িতে তুলে নেবেন। একথাও কি বলেছিলেন যে এই ব্যাপারে সে যেন মুখ না খোলে?

-আপনি বলতে চাইছেন যে ঐ মহিলাকে আমি বলেছি পুলিশকে কিছু না বলতে।

-আমার সেটা মনে হয়। অন্তত এটার একটা সম্ভাবনা আছে।

-মৃতদেহ সম্পর্কে পুলিশকে কিছু না বলতে?

-হ্যাঁ। আমার সেটা মনে হচ্ছে।

-আপনার কি মনে হয়না এটা আমার পক্ষে অনাগরিকসুলভ এবং অপেশাদারি কাজ হবে?

-সেটা নির্ভর করছে আপনি ঘটনাটাকে কী ভাবে দেখছেন বা দেখাবেন তার ওপর। আইনকে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। সবাই জানে আপনি আপনার মক্কেলের স্বার্থে ব্যাপারটা এমনভাবে ব্যাখ্যা করবেন যাতে আপনার মক্কেলের কোনও ক্ষতি হয়। আসল আইনটা কী সেক্ষেত্রে সেটা গৌণ হয়ে দাঁড়ায়।

-তার মানে আপনি বলছেন মক্কেলকে বাঁচাবার জন্য আমি যে কোনও আইনের অপব্যাখ্যা করতে পারি?

-অনেকটা সেরকমই।

-বেশ কৌতূহলউদ্রেককারী সম্ভাবনা।

-আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর এখনও দেননি।

-তাহলে শুনুন উত্তর হচ্ছে –না।

-আপনি মজা করছেন না তো?

-না, একেবারেই নয়।

-আপনি প্রথম কখন শিবুলালের মৃত্যুসংবাদ পান?

-সুন্দরী টিভিতে আজ সকালে খবরটা দেখে আমাকে জানায়।

-কত সকালে?

-বলতে পারবো না।

-বেশ, তারপর আপনি ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লেন?

-আমি আমার মক্কেলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।

-কোন মক্কেল? কৃষ্ণকালী চৌধুরী? কেন?

-আমি ওকে জানাতে চেয়েছিলাম যে শিবুলাল মৃত। ভেবেছিলাম এই খবরটা ওকে ওর বর্তমান পরিকল্পনা পরিবর্তন করার জন্য দরকার।

-কৃষ্ণকালীর সঙ্গে দেখা হলো?

-না

- ফোনে কথা হলো?

-না

-অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য ওপরতলার নির্দেশ ছিল।

-আপনাদের সঙ্গে আমি সবসময় সহযোগিতা করতে চাই।

-যদি আপনার মত সবাই আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করত তাহলে ওপরওলাদের মাথায় এত চিন্তা থাকত না। যাই হোক আপনাকে কিন্তু আমি খোলাখুলিভাবে সব কিছু বলার সুযোগ দিয়েছি। সেই সুযোগের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার আপনি নিশ্চয়ই করেছেন। তবে আপনি আমরা কী চাইছি জেনেও যদি কিছু লুকিয়ে থাকেন সেটা কিন্তু ভালো হবে না। আমরা এখন কৃষ্ণকালীকে খুঁজছি। আপনার সঙ্গে যদি যোগাযোগ হয় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবেন। বলবেন খুব জরুরি দরকার।‘

কেলো দারোগা উঠে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা হাই তুলে বললো,’ সহযোগিতার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ বা বলা যেতে পারে আপনার অনিচ্ছাকৃত সহযোগিতার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। সে যাই হোক এতে যে আমার অনেক উপকার হল সে কথা বলা বাহুল্য। ও হ্যাঁ, আর একটা কথা। আপনি নিশ্চয়ই জানেন কৃষ্ণকালীবাবু নিজে ডেপুটি শেরিফ হবার সুবাদে আত্মরক্ষার জন্য সঙ্গে বন্দুক রাখতে পারেন। সেটা অবশ্য সত্যি দরকার। গভীর রাত্রিতে অনেক টাকা সঙ্গে করে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে তো কাছে বন্দুক রাখতেই হবে। তাই না মিঃ রায়? কিন্তু আপনি কি জানেন ওনার বন্দুকটা এখন কোথায়?’

পানু রায় অবাক হয়ে বললেন,’ কোন বন্দুক?’

-যেটা কৃষ্ণকালীবাবু নিজের সঙ্গে রাখেন।

-সেটাতো কৃষ্ণকালীবাবুর কাছে থাকা উচিৎ। তাই নয় কি?

-কে জানে? আমি সত্যিই কিছু জানি না। তবে জানার চেষ্টা করছি। কী হবে সে ব্যাপারে আপনি অবশ্য বাজি ধরতেই পারেন। আজ আসি। অনেক সময় নিলাম। আপনি ব্যস্ত মানুষ তার ওপর এখন নিশ্চয়ই আপনাকে বেশ কিছু ফোন করতে হবে। আমি হঠাৎ এসে পড়ায় ব্যাপারটা একটু ঘেঁটে গেল মনে হয়।

-আপনি আমার টেলিফোনে আড়িপাতার ব্যবস্থা করেননি আশা করি।

-আরে না,না, এখনও অতদূর পর্যন্ত যাইনি। দেখা হবে। আসি।

কেলো দারোগা বেরিয়ে যাবার পর পানু রায় বললেন,’ সুন্দরী মনীষা প্রসাদকে পাও কি না দেখ তো।‘ সুন্দরী বলল,’ মানে মনীষা ঝা। আমি ওর নতুন পদবিটা মনে রাখতে পারি না।‘

সুন্দরী ফোনটা পানু রায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,’ মনীষা ঝা মানে মনীষা প্রসাদ।‘

পানু রায় ফোনটা কানে লাগিয়ে বললেন,’ মনীষা, একটা জরুরি ব্যাপারে তোমাকে ফোন করছি। তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হওয়ার পর অনেক কিছু ঘটে গেছে। কৃষ্ণকালী তোমায় ফোন করতে পারে। করলে বোলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আর বোলো খুব সাবধানে যেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে, কারণ পুলিশ কৃষ্ণকালীকে খুঁজছে।‘

-কী সাংঘাতিক!! পুলিশ? কেন?

-হ্যাঁ, পুলিশ।

-আপনার কেন মনে হল উনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন?

- কারণ, আমি কাল রাত্রে ওনাকে বলেছি যে তুমি দু দু-বার ওনার সঙ্গে দেখা করতে চেষ্টা করেছিলে। শুনে তো উনি আকাশ থেকে পড়লেন। এলিনা ওনাকে বলেনি পর্যন্ত যে তুমি ওনার খোঁজ করেছিলে।

-জানিনা কেন ঐ অসভ্য মেয়েটা দু’বারই আমার সঙ্গে এমন করল? রাগে আমার সারা শরীর কাঁপছে।

-সাবধান। অত চাপ নিওনা। শান্ত হও। কৃষ্ণকালী গতরাত্রে এলিনাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছেন।

-যাক। ওনার জন্য ভালোই হয়েছে। এখন কে আফিস চালাচ্ছে?

-কেউ না।

-দেখুন মিঃ রায়। আমি আবার কাজে যোগ দিতে পারি।

-কী বলছ তুমি?

-ঠিকই বলছি। যতদিন না উনি অন্য কাউকে পাচ্ছেন ততদিন আমি কাজ চালিয়ে দিতে পারি।

-মনীষা, সেটা হয় না।

-কেন হয় না? আমার কাছে এখনও অফিসের একটা চাবি আছে।অফিসের কোথায় কী আছে আমার নখদর্পণে। আমি সমস্ত ক্লায়েন্টদের চিনি। যদিও পরিস্থিতি এখন পাল্টে গেছে তবুও ওনার বিনিয়োগ এবং কাজের ধরণ আমার জানা। আমার মনে হয় আমি খব খারাপ একটা কিছু করব না। তবে হ্যাঁ, আমার চেহারার যা অবস্থা তাতে এলিনার মত অফিসের সৌন্দর্যবৃদ্ধি হয়ত আমি করতে পারবো না কিন্তু আমার যা কাজ তা আমি অনেক বেশি দক্ষতার সঙ্গে পালন করতে পারব।

-আমার মনে হয় না এটা ঠিক কাজ হবে।

- আপনি একথা কেন বলছেন?

-কিছু অচেনা লোক অফিসে আসতে পারে।

-সে ক্ষেত্রে আমি নিজের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে ঠিক করব কাকে ভেতরে ঢুকতে দেব আর কাকে দেব না।

-কিন্তু তুমি যে সব লোকের কথা ভাবছ এর সেরকম নয়।এরা সাদা পোশাকে আসবে কিন্তু মনে রাখতে হবে এরা অত্যন্ত ক্ষমতাশালী।

-বুঝতে পেরেছি। আমার স্বামী গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে বেরোচ্ছি। আপনার সঙ্গে যদি কথা হয় ওনাকে বলবেন আমি কাজ শুরু করে দিয়েছি এবং যাতায়তের ট্যাক্সিভাড়া আমার পাওনা।

-ঠিক আছে।

ফোন রেখে পানু রায় সুন্দরীকে বললেন,’ আমি বেরোচ্ছি। আমি গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। ট্যাক্সি নয়।‘ সুন্দরী বলল,’ একজন প্রত্যক্ষদর্শীর প্রয়োজন হতে পারে।‘ পানু রায় হেসে বললেন,’ অফিসে তোমার অনেক জরুরি কাজ আছে।‘ কথা শেষ হওয়ার আগেই পানু রায়ের ফোন বেজে উঠল।

-কৃষ্ণকালী? তুমি কোথায়?

-ভালো করে শুনুন। বেশি কথা বলার সময় নেই। হতে পারে আত্মরক্ষার জন্য রেবা কৈরালার চালানো গুলিতে শিবুলাল মারা গেছে। আপনি রেবাকে বাঁচাবার ব্যবস্থা করুন।

-ঠিক আছে। নিশ্চয়ই করবো। কিন্তু আগে বলো তুমি কোথায়?

-আমি পুলিশকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছি।

-কিন্তু কেন?

-আমি যদি পুলিশের সন্দেহ আমার দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারি তাহলে সেটা কাটিয়ে রেবাকে সন্দেহ করতে পুলিশের অনেক সময় লাগবে।

-কিন্তু সেটা বিপজ্জনক হবে। তুমি কিন্তু জড়িয়ে পড়বে এবং বেরোতে পারবে না।

-আমি জড়িয়ে পরতেই চাই,মিঃ রায়।

-আমি তোমায় বারণ করছি, কালীকৃষ্ণ। তুমি যদি নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ তৈরি কর তাহলে কিন্তু সেগুলো পুলিশ ওদের সুবিধেমত ব্যবহার করে তোমাকে হেনস্তা করতে পারে।

-ঠিক আছে। আপনি রেবার দিকটা দেখুন। ওটাই সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ। আমাকে নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। আমার ব্যাপার আমি সামলে নেব। রেবাকে বাঁচাবার জন্য যা দরকার হয় করুন।

-এমনকি তুমি নিজে জড়িয়ে গেলেও?

-হ্যাঁ, আমি জড়িয়ে গেলেও।

-কিন্তু কেন এসব করছ তুমি? শুধুমাত্র রেবা তোমার ছেলের প্রাক্তন প্রেমিকা বলে?

-না, মিঃ রায়। আমি নিজে রেবাকে ভালোবাসি। সবসময় আমি ওকে ভালোবাসতাম। আমি নিজেও নিজেকে একথা বোঝাতে ভয় পেতাম কিন্তু এটা সত্যি। আমি আপনাকে বিশ্বাস করে একথা বললাম। ঈশ্বরের দোহাই আপনি একথা কাউকে বলবেন না এমনকি সুন্দরীকেও নয়। আপনি জানতে চাইলেন তাই বললাম।

অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন পানু রায়। ওপার থেকে কৃষ্ণকালীর গলা ভেসে এল,’ আপনি কি লাইনে আছেন?’ পানু রায় বললেন,’হ্যাঁ। আছি। শোনো, তোমাকে আর একটা খবর দিই। আমার সঙ্গে এলিনার কথা হয়েছে।সে আর কোনওদিন তোমার অফিসের ধারেকাছে যাবেনা বলে জানাল। তোমার অফিস এখন তালাবন্ধ।‘

-না না, তসে কী করে হতে পারে। আমার প্রচুর কাজ বাকি পড়ে আছে। দু-একদিনের মধ্যে একগাদা অর্ডার ফাইনাল হবার কথা। অনেক টাকার ব্যাপার। তার চেয়েও বড় কথা আমার এতদিনের সুনাম মাটিতে মিশে যাবে। অফিস কিছুতেই বন্ধ রাখা যাবে না। আপনি একটা কিছু ব্যবস্থা করুন।

- আমি ইতিমধ্যেই ব্যাপারটা এগিয়ে রেকেছি।আমার সঙ্গে মনীষার কথা হয়েছে। ওকে বলেছি এলিনা ছেড়ে দিয়েছে এবং অফিস তালাবন্ধ। একটা ট্যাক্সি নিয়ে ও ইতিমধ্যেই তোমার অফিসের দিকে রওনা দিয়েছে। ওর কাছে একটা চাবিও আছে বলল।

-আপনি আমাকে সত্যিই বাঁচালেন। ঈশ্বর মনীষাকে আশীর্বাদ করুন। আপনি যে বললেন মনীষা মা হতে চলেছে।

-হ্যাঁ। আর মাস দুয়েক বাকি আছে।

-ওকে বলুন যতদিন সম্ভব চালিয়ে যেতে। আপনার সঙ্গে হয়ত কয়েকদিন কথা হবেনা। সামনের কয়েকদিন আমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

-কৃষ্ণকালী, তুমি যে কী করতে চাইছ কে জানে! এসব কোরো না।

ওদিক থেকে ফোনটা কেটে গেল। সুন্দরী জিজ্ঞাসু চোখে পানু রায়ের দিকে তাকালো। পানু রায় বললেন,’ বড়কালী কী করতে চায় জানিনা কিন্তু আমাকে জড়িয়ে ফেলেছে। নিজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার এক ভয়ঙ্কর খেলায় মেতেছে আর আমাকে বললো যে আমার দায়িত্ব এটা নিশ্চিত করা যে কোনওভাবেই রেবা যেন জড়িয়ে না যায়।

-আমি তোমার কথা শুনেছি। কিন্তু বড়কালী কী বললো যখন তুমি জিজ্ঞাসা করলে যে কেবলমাত্র ওনার ছেলে রেবাকে ঠকিয়েছে বলেই উনি এত বড় ঝুঁকিটা নিতে চাইছেন?

পানু রায় হেসে বললেন,’ একথা না বলার জন্য আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যদি কাউকে বলি এমনকি তোমাকেও তাহলে বড়কালী আমাকে গুলি করে দেবে বলেছে। আমি একটু বেরোচ্ছি। যদি কেউ আমার খোঁজ করে বলবে তুমি জান না। আমি একঘন্টার মধ্যে ফিরব।‘

-আমি আন্দাজ করতে পারি?

-একশোবার!

-তুমি বড়কালীর অফিসে যাচ্ছ। দেখতে যাচ্ছ যে এমন কোনও প্রমাণ যেন ওখানে না থাকে যাতে কেলো দারোগার সুবিধে হয়।

-খুব ভালো আইডিয়া। শুধুমাত্র দু’টো ভুল ছাড়া।

-কী কী?

-প্রথমত, আমি বড়কালীর আইনি পরামর্শদাতা এবং যে কোনও রকম প্রমাণ লোপ করা বা লোপ করার চেষ্টা করা আইনের চোখে অপরাধ। দ্বিতীয়ত, আমি যে জন্য যাচ্ছি সেটা এর থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরী, তোমাকে দু’টো কথা বলি । এক- যারা আমাকে তাদের পরামর্শদাতা হিসাবে আমাকে নিয়োগ করে তারা গঙ্গাজলে ধোওয়া তুলসীপাতা নয়। দুই- প্রমাণ লুকোনো এবং প্রমাণ লোপ করা দু’টোই অপরাধ।

-বুঝেছি। ভুল বলেছি।

-বেশ, তাহলে তোমায় আরও দু’টো কথা বলে রাখি। এক- আমরা আগে থেকেই জানি আমরা ট্যাক্সিভাড়া করে কোথায় কোথায় গিয়েছিলাম সেটা কেলো দারোগা বের করবে। দুই-বড়কালী অর্থাৎ কৃষ্ণকালীর স্ত্রী চেয়েছিল তাদের প্রথম সন্তানের নামের মধ্যেও যেন কৃষ্ণ এবং কালী থাকে।

সুন্দরী কপাল কুঁচকে বলল,’ দাদু, মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না।‘

‘আমি একঘন্টার মধ্যে আসছি’-বলে পানু রায় বেরিয়ে গেলেন।

0 comments: