0

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়


ওরা চল্লিশজন কিংবা আরও বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে—রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়
ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য—বাংলার জন্য।

-মাহবুব উল আলম চৌধুরী

ওঁদের স্মরণ করেই আজ প্রকাশিত হলো ঋতবাক ষষ্ঠ বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা। 

মাতৃভাষাকে লালন করার যে আন্দোলন সেই সেদিন শুরু হয়েছিলো, মনে হয় আজও চলছে তা সমান তালে...। মানে বলতে চাই, মাঝে মাঝেই শুনি 'গেল গেল' 'বাঁচাও বাঁচাও' রব। চিন্তিত বা প্রভাবিত হই নিশ্চয়ই; মানে চিন্তিত বা প্রভাবিত হওয়া উচিত অবশ্যই। তবুও পেঁচালো মন চেষ্টা করে একটু অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে বিচার করতে। বিস্তারিতই বলি... 

আসলে, কথা হলো, মাতৃভাষা যদি রাষ্ট্রভাষা না হয়, তাহলে একটু অসুবিধা হয় বৈকি। অভিমান হওয়াটাও বিচিত্র নয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে একটা বিশেষ সুবিধা হলো, আরও একখান ভাষা বেশ ফাউতে শেখার সুযোগও পাওয়া যায় – এবং একাধিক ভাষা জানা থাকাটা যে কোনও পরিস্থিতিতেই মন্দ কথা নয়, সেটা সম্ভবত অনস্বীকার্য।

ভারতবর্ষের ভাষাগত অবস্থানের চাইতে বোধহয় এ বিষয়ের প্রকৃষ্টতর উদাহরণ আর কিছু নেই। যেমন ধরুন আমরা, মানে গড়পড়তা বাঙালিরা, ছোটোবেলা থেকে মাতৃভাষা বাংলা ও পিতৃভাষা ইংরিজি (এর মধ্যে আবার অশ্লীলতা বা লিঙ্গবৈষম্য খুঁজতে যাবেন না দয়া করে) শিখতে শিখতে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দুস্তর পারাবারগুলি পেরোতে পেরোতে এক সময়ে এসে টের পাই যে দু’টো ভাষার কোনওটাই সেভাবে শেখা হলো না। যদিও এই সমস্যা আমাদের মতন নিতান্তই সাধারণ মানুষের। প্রতিভাবানরা তার মধ্যেই এই দু’টো তো বটেই, সেই সঙ্গে আমাদের ভ্রাতৃভাষা, অর্থাৎ হিন্দিটিও দিব্যি রপ্ত করে ফেলেন। আর তেমন তেমন ক্ষুরধার মস্তিষ্ক হলে তো কথাই নেই। সাত-আটটি ভাষায় গড়গড় করে কথা বলতে, পড়তে এবং লিখতেও পারেন, এমন মানুষ চিরকালই ছিলেন এবং আজকের বিশ্বায়নের যুগে তাঁদের নিয়মিত সংখ্যাবৃদ্ধিও হচ্ছে; এ নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই বিশেষ।

আসল কথা সেটাই। আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞান বলছে, একজন সাধারণ  মেধার মানুষ মোটামুটি স্বচ্ছন্দেই চার-পাঁচটা ভাষা শিখতে এবং প্রয়োজন মতন ব্যবহার করতে পারেন। তাহলে আর একটা বাড়তি ভাষা শিখতে অসুবিধা কোথায়? কোন পরিস্থিতিতে এই প্রসঙ্গের অবতারণা, সে কথা বলে দিতে হবে না নিশ্চয়ই। যে ভ্রাতৃভাষাটি আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া নিয়ে এত শোরগোল উঠছে মাতৃভাষাপ্রেমীদের মধ্যে, সেই হিন্দিকে তো আজ আর ফেলে দেওয়া যায় না। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে লেখাপড়া বা কর্মসূত্রে থাকতে হলে তো ওই হিন্দিই ভরসা। ইংরিজিটা যে এদেশের রাস্তাঘাটের নিত্য ব্যবহারিক বিনিময়ের ভাষা এখনও হয়ে উঠতে পারেনি বা অদূর ভবিষ্যতেও পারবে বলে মনে হচ্ছে না এবং সম্ভবত তেমনটা হওয়া বাঞ্ছনীয়ও নয়, সে কথা স্বীকার করতে তো কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। এবং এহ বাহ্য যে কাজের প্রয়োজনে আজকাল প্রায় অধিকাংশ মানুষকেই অন্য প্রদেশে যেতে হয়, বসবাসও করতে হয়। তাহলে সরকারি উদ্যোগে যদি হিন্দির মতো বহুল প্রচলিত একটি স্বদেশী ভাষা এই বেলা শিখে ফেলা যায়, তাতে তো অন্তত স্বদেশপ্রেমীদের বিশেষ আপত্তি থাকার কথা নয়!  বাংলার বাইরে কাঁচুমাচু মুখে ‘‘হাম মদ নেহি খাতা হ্যায়’’ বলে হাসির খোরাক হওয়ার চাইতে গম্ভীর মুখে ‘‘হম শরাব নহী পীতে হ্যঁয়’’ বলে সসম্মানে সরে আসাটা বেশি বুদ্ধির কাজ নয় কি?

তবে এত সব যুক্তির পরেও কিন্তু যে কথাটা স্বতঃসিদ্ধ থেকেই যায়, তা হলো মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা শেখা বা না শেখা প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছাধীন বিষয়। কোনও ভাষাই কোনওদিন কোনও জাতির উপর জবরদস্তি চাপিয়ে দেওয়াটা সুস্থ প্রশাসনের লক্ষণ নয়... এবং আজকের দিনটা সেই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে অস্ত্র ধরার প্রতীক। যদিও সেই সংগ্রামে আমাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলো না, তবু আমরা বুক ফুলিয়ে বলতেই পারি – আমাদের ভাষা বাংলা ভাষা এবং সেই ভাষার অধিকারের সংগ্রামকেই আজ সারা পৃথিবী সসম্মানে উদযাপন করে।

তাই বাংলা ভাষার প্রত্যেক পাঠককে আজ বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসের  অভিনন্দন!

সৃজনে থাকুন, আনন্দে থাকুন...

শুভেচ্ছা নিরন্তর।

0 comments:

1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - পল্লববরন পাল

Posted in



আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি - আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস – গোটা পৃথিবী জানে - বাঙলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানের ঢাকা শহরে ১৯৫২ সালের এই দিনে ছাত্র-যুব সমাবেশ বিক্ষোভের ওপর পাকিস্তানী প্রশাসকের পুলিশের অকথ্য নির্মম গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের কথা। একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু শহীদস্মৃতিতে বাঙালীদের সমবেত অশ্রুমোচন বা দীর্ঘশ্বাসের নাম নয়, একটা গোটা দেশের মানুষের মধ্যে আপোসহীন প্রতিবাদী চেতনার জন্মের ছাড়পত্রও, যে চেতনাকে নির্ভর করে একাত্তরে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী জনতার জয়ের মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি এমনই এক রাষ্ট্রনির্মাণের প্রথম বারুদ হিসেবে সাহিত্যিক ঐতিহ্যের মহামুহূর্ত। একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে পরবর্তী সময়ে বহু কবিতা গান নাটক ছবি ও ছায়াছবি নির্মাণ হয়েছে, এখনও হচ্ছে, আরো বহুদিন হবে।



মাহবুব উল আলম চৌধুরী। জন্ম ১৯২৭ সালের ৭ই নভেম্বর। চট্টগ্রাম জেলার রাউজান এলাকায় এক প্রাচীন ঐতিহ্যপূর্ণ পরিবারে। অল্প বয়স থেকেই রাজনীতি ও সাহিত্যচর্চা তাঁর কাছে জীবনাচরণের মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। কিশোর বয়স থেকেই তাঁর সব সাহিত্য রচনাতেই বামপন্থী প্রগতিশীলতার স্পষ্ট ছাপ। তাঁর লেখার ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন প্রায় সমবয়সী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায়। চল্লিশের দশকে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘সীমান্ত’ নামে একটি প্রগতিশীল সাহিত্য মাসিক পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি পরিচিত ও বিখ্যাত। চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকে পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন প্রথম সারির নেতা ও সংগঠক। সে সময়ে মাহবুব উল আলম চৌধুরী চট্টগ্রাম জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন।’ আহ্বায়ক হিসেবে চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন কর্মসূচিকে কার্যকর করার জন্যে দিনরাত বিরামহীন শ্রমে নিজেকে জড়িয়ে ছিলেন, তারই ফলে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আর সেই অসুস্থ অবস্থায় প্রচণ্ড জ্বরের মধ্যে তিনি খবর পেয়েছিলেন একুশের দিনে ঢাকায় গুলি বর্ষণ ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা। এই খবরের আবেগে উত্তেজনায় মাহবুব উল আলম চৌধুরী জ্বরের ঘোরে কবিতা লেখার জন্যে কাগজ কলম নিয়েছিলেন— জ্বরের তাপে তাঁর হাত কাঁপছিল— তিনি অনর্গল বলে যাচ্ছিলেন কবিতার এক একটি চরণ আর তা লিখে যাচ্ছিলেন—ননী ধর, মার্কসবাদী রাজনীতির একজন নিবেদিত কর্মী।



কবিতাটি লেখা শেষ হওয়ার পর অনতিবিলম্বে মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে দেখার জন্যে আসেন খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস— এসেছিলেন ঢাকা থেকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং তাদের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে সহযোগিতা করার জন্যে। এই কবিতার প্রথম শ্রোতা তিনিই। তাঁর কিছুক্ষণ পর মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে দেখতে আসেন তৎকালীন চলচ্চিত্র মাসিক উদয়ন পত্রিকার সম্পাদক রুহুল আমিন নিজামী। তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় – আন্দরকিল্লায় অবস্থিত কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের তত্ত্বাবধানে সারা রাত কাজ করে পুস্তিকার আকারে পর দিন সকাল বেলার মধ্যে গোপনে প্রকাশ করতে হবে অমর একুশের প্রথম সাহিত্য।



এই সূত্রে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের তৎকালীন ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরী ও প্রেস কর্মচারীদের সম্মিলিত সাহস, উপস্থিত বুদ্ধি ও আন্দোলনের প্রতি দায়বদ্ধতা রীতিমতো স্মরণযোগ্য। খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের বর্ণনায় আমরা সেই সময়ের কথা জানতে পারি, “…রাতের শেষ প্রহরে কম্পোজ ও প্রুফের কাজ যখন সমাপ্তপ্রায়, হঠাৎ একদল সশস্ত্র পুলিশ হামলা করে উক্ত ছাপাখানায়। প্রেসের সংগ্রামী কর্মচারীদের উপস্থিত বুদ্ধিতে অতি দ্রুত লুকিয়ে ফেলা হয় আমাকে সহ সম্পূর্ণ কম্পোজ ম্যাটার। তন্নতন্ন করে খোঁজাখুঁজির পর পুলিশ যখন খালি হাতে ফিরে চলে যায়, শ্রমিক কর্মচারীরা পুনরায় শুরু করেন তাঁদের অসমাপ্ত কাজ। শ্রমিক শ্রেণী যে ভাষায় যে দেশে যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, তার সংগ্রামী চেতনা যে অসাধারণ, তার প্রমাণ সেদিন হাতে হাতে পেয়েছিলাম চট্টগ্রামে। দুপুরের মধ্যে মুদ্রিত ও বাঁধাই হয়ে প্রকাশিত হয় একুশের ওপর রচিত প্রথম কবিতা - ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’।”



১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি লালদিঘির ময়দানে বিশাল জনসভায় কবিতাটি পাঠের পর এর লেখক মাহবুব উল আলম চৌধুরী, পাঠক চৌধুরী হারুনর রশীদ, কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে কবিতাটির মুদ্রণের জন্যে কাগজ সরবরাহকারী কামালউদ্দিন আহমদ বি.এ-র নামে হুলিয়া জারি হয়। জনসভায় কবিতাটির প্রথম পাঠক চৌধুরী হারুনর রশীদকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। কবিতাটির পাণ্ডুলিপি দেখাতে অসমর্থ হওয়ায় মুদ্রাকর দবির আহমদ চৌধুরীকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এ জন্যে তাঁকে ছয়মাস জেলও খাটতে হয়।

কিন্তু ঐ ২২শে ফেব্রুয়ারি লালদিঘির ময়দানে হারুনর রশীদের পাঠের পরে জনসমুদ্র উত্তেজিত বারুদ হয়ে বিস্ফোরণে ফেটে পড়লো এবং সমস্বরে আওয়াজ উঠলো – “চলো চলো ঢাকা চলো”। দ্রুত কবিতাসহ গোটা বইটি বেআইনী ঘোষিত ও বাজেয়াপ্ত হলেও ততদিনে হাতে হাতে এবং মুখে মুখে কবিতাটি পূর্ব বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে দাবানলের মতো ছড়িয়ে গিয়েছিলো।



‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি” এই কবিতা ও মাহবুব উল আলম চৌধুরীর নাম ইতিহাসে ঠাঁই পেলো “একুশের প্রথম কবিতা” ও তার কবি হিসেবে।





কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি

মাহবুব উল আলম চৌধুরী



ওরা চল্লিশজন কিংবা আরো বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে—রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়
ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য—বাংলার জন্য।
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
একটি দেশের মহান সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য
আলাওলের ঐতিহ্য
কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের
সাহিত্য ও কবিতার জন্য
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
পলাশপুরের মকবুল আহমদের
পুঁথির জন্য-
রমেশ শীলের গাথার জন্য,
জসীমউদ্দীনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাটের’ জন্য।
যারা প্রাণ দিয়েছে
ভাটিয়ালি, বাউল, কীর্তন, গজল
নজরুলের “খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি
আমার দেশের মাটি।”
এ দুটি লাইনের জন্য
দেশের মাটির জন্য,
রমনার মাঠের সেই মাটিতে
কৃষ্ণচূড়ার অসংখ্য ঝরা পাপড়ির মতো
চল্লিশটি তাজা প্রাণ আর
অঙ্কুরিত বীজের খোসার মধ্যে
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত।
রামেশ্বর, আবদুস সালামের কচি বুকের রক্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সেরা কোনো ছেলের বুকের রক্ত।


আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের প্রতিটি রক্তকণা
রমনার সবুজ ঘাসের উপর
আগুনের মতো জ্বলছে, জ্বলছে আর জ্বলছে।
এক একটি হীরের টুকরোর মতো
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছেলে চল্লিশটি রত্ন
বেঁচে থাকলে যারা হতো
পাকিস্তানের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ
যাদের মধ্যে লিংকন, রকফেলার,
আরাগঁ, আইনস্টাইন আশ্রয় পেয়েছিল
যাদের মধ্যে আশ্রয় পেয়েছিল
শতাব্দীর সভ্যতার
সবচেয়ে প্রগতিশীল কয়েকটি মতবাদ,
সেই চল্লিশটি রত্ন যেখানে প্রাণ দিয়েছে
আমরা সেখানে কাঁদতে আসিনি।
যারা গুলি ভরতি রাইফেল নিয়ে এসেছিল ওখানে
যারা এসেছিল নির্দয়ভাবে হত্যা করার আদেশ নিয়ে
আমরা তাদের কাছে
ভাষার জন্য আবেদন জানাতেও আসিনি আজ।
আমরা এসেছি খুনি জালিমের ফাঁসির দাবি নিয়ে।



আমরা জানি ওদের হত্যা করা হয়েছে
নির্দয়ভাবে ওদের গুলি করা হয়েছে
ওদের কারো নাম তোমারই মতো ওসমান
কারো বাবা তোমারই বাবার মতো
হয়তো কেরানি, কিংবা পূর্ব বাংলার
নিভৃত কোনো গাঁয়ে কারো বাবা
মাটির বুক থেকে সোনা ফলায়
হয়তো কারো বাবা কোনো
সরকারি চাকুরে।
তোমারই আমারই মতো
যারা হয়তো আজকেও বেঁচে থাকতে পারতো,
আমারই মতো তাদের কোনো একজনের
হয়তো বিয়ের দিনটি পর্যন্ত ধার্য হয়ে গিয়েছিল,
তোমারই মতো তাদের কোনো একজন হয়তো
মায়ের সদ্যপ্রাপ্ত চিঠিখানা এসে পড়বার আশায়
টেবিলে রেখে মিছিলে যোগ দিতে গিয়েছিল।
এমন এক একটি মূর্তিমান স্বপ্নকে বুকে চেপে
জালিমের গুলিতে যারা প্রাণ দিল
সেই সব মৃতদের নামে
আমি ফাঁসি দাবি করছি।



যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে চেয়েছে তাদের জন্যে
আমি ফাঁসি দাবি করছি
যাদের আদেশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের জন্যে
ফাঁসি দাবি করছি
যারা এই মৃতদেহের উপর দিয়ে
ক্ষমতার আসনে আরোহণ করেছে
সেই বিশ্বাসঘাতকদের জন্যে।
আমি তাদের বিচার দেখতে চাই।
খোলা ময়দানে সেই নির্দিষ্ট জায়গাতে
শাস্তিপ্রাপ্তদের গুলিবিদ্ধ অবস্থায়
আমার দেশের মানুষ দেখতে চায়।



পাকিস্তানের প্রথম শহীদ
এই চল্লিশটি রত্ন,
দেশের চল্লিশ জন সেরা ছেলে
মা, বাবা, নতুন বৌ, আর ছেলে মেয়ে নিয়ে
এই পৃথিবীর কোলে এক একটি
সংসার গড়ে তোলা যাদের
স্বপ্ন ছিল
যাদের স্বপ্ন ছিল আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে
আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার,
যাদের স্বপ্ন ছিল আণবিক শক্তিকে
কী ভাবে মানুষের কাজে লাগানো যায়
তার সাধনা করার,



যাদের স্বপ্ন ছিল রবীন্দ্রনাথের
‘বাঁশিওয়ালার’ চেয়েও সুন্দর
একটি কবিতা রচনা করার,
সেই সব শহীদ ভাইয়েরা আমার
যেখানে তোমরা প্রাণ দিয়েছ
সেখানে হাজার বছর পরেও
সেই মাটি থেকে তোমাদের রক্তাক্ত চিহ্ন
মুছে দিতে পারবে না সভ্যতার কোনো পদক্ষেপ।



যদিও অগণন অস্পষ্ট স্বর নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করবে
তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঘণ্টা ধ্বনি
প্রতিদিন তোমাদের ঐতিহাসিক মৃত্যুক্ষণ
ঘোষণা করবে।
যদিও ঝঞ্ঝা-বৃষ্টিপাতে—বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভিত্তি পর্যন্ত নাড়িয়ে দিতে পারে
তবু তোমাদের শহীদ নামের ঔজ্জ্বল্য
কিছুতেই মুছে যাবে না।



খুনি জালিমের নিপীড়নকারী কঠিন হাত
কোনো দিনও চেপে দিতে পারবে না
তোমাদের সেই লক্ষদিনের আশাকে,
যেদিন আমরা লড়াই করে জিতে নেব
ন্যায়-নীতির দিন
হে আমার মৃত ভাইরা,
সেই দিন নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে
তোমাদের কণ্ঠস্বর
স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকারে
ভেসে আসবে
সেই দিন আমার দেশের জনতা
খুনি জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে
ঝুলাবেই ঝুলাবে
তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলবে
প্রতিশোধ এবং বিজয়ের আনন্দে।

চট্টগ্রাম, ১৯৫২

[পাদটিকা হিসেবে একটি কথা বলা দরকার। এই কবিতায় চল্লিশজন শহীদের কথা বলা হয়েছে। হাসান হাফিজুর রহমানের বিখ্যাত ‘অমর একুশে’ কবিতায় এই সংখ্যাটা বলা হয়েছে পঞ্চাশ। আজ তথ্য হিসেবে হয়তো অতিরঞ্জিত মনে হচ্ছে, কিন্তু তখন ঐ সময়ে এইরকম বিভিন্ন সংখ্যক শহীদের কথাই প্রচারিত হয়েছিলো। এটাই স্বাভাবিক। যদিও সংখ্যাটা নয়, হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ও নৃশংসতাই মূল বিষয় – হিটলারের হলোকস্ট বা বৃটিশ শাসকের জালিয়ানওয়ালাবাগের মতো – শহীদ সংখ্যা আমরা সঠিক অনেকেই জানিনা, জানতে চাইও কি? বরং এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী প্রভাব কী অপরিসীম – সেই ভাবনার মধ্যেই আমাদের বসবাস।]

1 comments:

0

প্রবন্ধ - অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in

(দ্বিতীয় পর্ব)

ভারতে মুসলিম শাসকদের প্রভাবে বাংলা ভাষায় প্রচুর পরিমাণে আরবি-ফারসি শব্দ ঢুকে পড়ে। কারণ মুসলিম শাসকরা হয় আরব দেশ, নয় মঙ্গোলিয়া, নয়তো আফগানিস্তান থেকে এসেছিলেন। রাজভাষাই হল সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা কাজের ভাষা। সুলতানি শাসনামলে আরবি ছিল বাংলার মুসলমানদের ভাষা, ধর্মীয় ভাষা। আর ফরাসি ছিল রাজ-সরকারের ভাষা।তৎকালীন সময়ে ফারসি রাজভাষা হলেও গৌড়ের স্বাধীন সুলতানেরা দেশি বাংলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সেসময় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু প্রজাদের সহানুভূতি ও সমর্থন লাভের জন্য প্রচুর যোগ্য হিন্দুদের বড়ো বড়ো রাজপদে নিয়োগ করেন। মুসলিম শাসকদের উদারতায় মুসলিম শাসনের উপর হিন্দু প্রজাদের আস্থা বৃদ্ধি পায়। সেই আস্থা থেকে হিন্দু কর্মচারীরা রাজভাষা ফারসি শিখে নিলেন এবং মুসলিম শাসকদের রাজকার্যে সহযোগিতা করতে শুরু করেছিলেন। মুসলিম শাসকরাও হিন্দু কবিদের কাব্যচর্চায় উৎসাহ দিতে থাকলেন। তেরো শতকের শুরুতেই বহিরাগত তুর্কি সেনারা ধর্মে ইসলাম অনুসারী হলেও সংস্কৃতিতে পারসিক বা ফারসি। তাঁরা বাড়ির ভিতর নিজেদের মধ্যে তুর্কি ভাষায় কথাবার্তা বললেও রাজদরবারে সরকারিভাবে ফারসি ভাষায় কাজকর্ম করতেন। আবার ধর্মাচরণে ব্যবহার করতেন আরবি ভাষা। এভাবেই রাজার ভাষার প্রভাব প্রজাসাধারণের উপর পড়তে শুরু করে দেয়।

চোদ্দো শতকের শেষ দিকে বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ’, মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’, বিজয়গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল’, বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের ‘মনসাবিজয়’, কবীন্দ্র পরমেশ্বরের ‘মহাভারত পাঁচালী’, শ্রীকর নন্দীর ‘অশ্বমেধ পর্ব’, দ্বিজ শ্রীধরের ‘বিদ্যাসুন্দর’, শাহ মোহাম্মদ সগিরের ‘ইউসুফ জোলেখা’-র মতো কালজয়ী কাব্য রচিত হয়েছিল। শাহ মোহাম্মদ সগিরের ‘ইউসুফ জোলেখা’-ই ছিল প্রথম মুসলমান রচিত বাংলা কাব্য।

এ সময়ই মুসলমান শাসনের প্রভাবে বাংলা ভাষায় প্রচুর পরিমাণে আরবি, ফারসি, তুর্কি শব্দ ঢুকে পড়ে। বাংলা ভাষার সঙ্গে আরবি-ফারসির মিশ্রণে এক অন্য ধারার বাংলা ভাষার উদ্ভব হল। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার শেষ স্বাধীন পাঠান সুলতান দাদ খাঁ কররানির পতন পর্যন্ত গৌড়ের দরবারে বাংলা ও সাহিত্যের প্রভূত কদর ছিল। সেই সময়ে স্থানীয় প্রজাদের সঙ্গে দরবারের লোকজনদের ওঠা-বসা, লেনদেন ও ভাবের আদানপ্রদানে বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এও আরবি-ফারসির ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটে যায়। তবে মোগল শাসকরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি বিশেষ আগ্রহ না-দেখালেও সে সময়ের দেশীয় রাজ্যের রাজারা ও স্থানীয় জমিদারদের পৃষ্টপোষকতায় সাহিত্য ধারা অব্যাহত ছিল। এ সময়ই বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার আরও বেশি বৃদ্ধি পায়। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কাব্যে জনজীবনে বহুল ব্যবহৃত তদ্ভব ও দেশি শব্দের পাশাপাশি আরবি-ফারসি শব্দও স্থান পেয়েছে। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের কাব্যও আরবি-ফারসি শব্দের কুশলপ্রয়োগরীতি তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য সুললিত করেছে। আঠারো শতক নাগাদ রামমোহন রায়ের মতো হিন্দু ব্যক্তিত্বরাও আরবি-ফারসি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। কৃত্তিবাস ওঝাই প্রথম সেই বিদ্রোহী, যিনি সংস্কৃত ভাষায় রচিত ধর্মকথা বাংলা ভাষায় লেখার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বাংলা ভাষায় রামায়ণ অনুবাদ করেন। এরপর বাংলার সুলতানদের এবং দরবারের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রেরণায় সংস্কৃত ছেড়ে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চাতে মনোনিবেশ করেন বাংলার কবিগণ। তবে একথাও মনে রাখা দরকার, সংস্কৃত রাজভাষার মর্যাদা হারালেও মুসলমানদের একটা অংশ সংস্কৃত চর্চা করতেন। কিন্তু সুলতানেরা পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষায় রচিত সাহিত্যগুলি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করাতে উৎসাহ জুগিয়ে যেতেন। সুলতানদের পৃষ্টপোষকতায় বাংলা ভাষায় অনূদিত হতে থাকল রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবতের মতো গ্রন্থগুলি। উদারমনস্ক মুসলিমদের প্রচেষ্টাতেই সংস্কৃত ভাষায় রচিত ধর্মগ্রন্থগুলি আমরা বাংলা ভাষাতে পাই। তবে সবাই তো উদারমনস্ক হতে পারে না। কিছু সংকীর্ণমনা মওলানা ধর্মগ্রন্থগুলি বাংলা অনুবাদে কাঠি দিয়ে থমকে দিতে সক্ষম হয়েছিল। এমনকি ফারসি ভাষাতে কোরান অনুবাদ করতে গিয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ একদল মৌলভি দ্বারা প্রাণ হারাতে বসেছিলেন। এরপরেও পাশাপাশি মুসলিম লেখকরা সংস্কৃত গ্রন্থগুলি আরবি-ফারসি ভাষাতেও অনুবাদ করতে থাকেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদারের মতো লেখকদের বাংলাতে আরবি-ফারসির ব্যবহার বৃদ্ধিতে বাংলা ভাষার এক অন্যরকম শ্রীবৃদ্ধি হয়। তবে কাজী নজরুল ইসলামের কবি-সাহিত্যিকদের বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি মুখর হয়ে উঠল। কাজী নজরুলের বাংলা ভাষার একটা নমুনা দিই। তাহলে ব্যাপারটা একটু বোঝা যাবে – “আমি আল্লার ডাকে ছুটে যাই যবে তুমি মোনাজাত করগো নীরবে/তুমি যে খোদার দেওয়া – সওগত সম বেহেস্তের সাথী/তুমি যে ঈদের চাঁদ/তব তরে জাগিয়া কাটাই রাতি/তুমি নারী আগে আনিলে ইমান দীন ইসলাম পরে/তুমি যে বিজয়ী খোদার রহম আনিয়াছ জয় করে।” অথবা “আসিছেন হবিবে খোদা, আরশ পাকে তাই উঠেছে শোর/চাঁদ পিয়াসে ছুটে আসে আকাশ পানে যেমন চকোর/কোকিল যেমন গেয়ে ওঠে ফাগুন আসার আভাস পেয়ে/তেমনি করে হরষিত ফেরেশতা সব উঠলো গেয়ে।” এখানে লক্ষ করুন ‘আল্লা’, ‘মোনাজাত’, ‘খোদা’, ‘সওগত’, ‘বেহেস্ত’, ‘ইমান’, ‘দীন’, ‘রহম’, ‘হবিবে’, ‘আরশ’, ‘পাক’, ‘শোর’, ‘পিয়াসে’, ‘ফেরেশতা’ শব্দগুলির ব্যবহার একমাত্র মুসলিম কবি-সাহিত্যিকরাই করতেন। হিন্দু বাঙালি সাহিত্য ও মুখের ভাষায় পর্দা, দৌলত, মস্তান, বাবা ইত্যাদি আরবি-ফারসি শব্দগুলির ব্যবহার করলেও নজরুল ব্যবহৃত শব্দগুলি কখনোই ব্যবহার করেনি। যদিও বহু হিন্দু ব্যক্তিত্ব আরবি-ফারসি ভাষাশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন, তা সত্ত্বেও আরবি-ফারসি যথেচ্ছ ব্যবহার করেননি। বরং বলা ভালো পর্তুগিজ, ইংরেজি, জাপানি, তুর্কি ইত্যাদি সমস্ত বিদেশি শব্দ আত্মসাৎ করে হিন্দুদের এক বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। এমন অনেক বিদেশি শব্দ হিন্দু বাঙালিদের বাংলা ভাষার সঙ্গে মিশে আছে, সেসব শব্দ যে বাংলা নয়, একথা বিশ্বাসই হয় না। কয়েকটা উদাহরণ রাখা যাক – আরবি: আক্কেল, আসল, এলাকা, ওজন, খবর, খালি, খেয়াল, গরিব, জমা, জিনিস, তারিখ, বদল, নকল, বাকি, হিসাব ইত্যাদি। ফারসি: আন্দাজ, আয়না, আরাম, আস্তে, কাগজ, খারাপ, খুব, গরম, চশমা, চাকরি, চাদর, জায়গা, দেরি, বাগান, রাস্তা, পছন্দ, হিন্দু (ধর্ম অর্থে নয়, ভারতীয় বা ভারতবর্ষীয় অর্থে) ইত্যাদি। তুর্কি: দাদা, বাবা, চাকর, চাকু, তোপ ইত্যাদি। জাপানি: বোকা, হাসি, চা, লিচু, রিকশা ইত্যাদি। ওলন্দাজ : ইস্কাবন, রুইতন, হরতন, টেক্কা, তুরুপ ইত্যাদি। পর্তুগিজ: ইস্ত্রি, আলমারি, ইস্পাত, চাবি, জানালা, তামাক, পেরেক, বারান্দা, ফিতা, বোতাম, সাবান, কাজু, পেঁপে, পেয়ারা ইত্যাদি। ইংরেজি: আফিম, অফিস, জেল, পুলিশ, ব্যাংক, ভোট, কাপ, গ্লাস, চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি। উল্লিখিত শব্দগুলি বিদেশি শব্দ বটে, কিন্তু এগুলিও বাংলা ভাষা হয়ে গেছে। অথচ এগুলি কোনোটাই বাংলা শব্দ নয়। যদিও শব্দগুলি হিন্দু-মুসলিম বাঙালি নির্বিশেষে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করে থাকে। তবে কিছু ক্ষেত্রে ব্যাপক আরবি-ফারসির ব্যবহার উভয় সম্প্রদায়ের বাঙালিই করে। আজও বাড়ির দলিল-দস্তাবেজে আরবি-ফারসির আধিক্য বহমান। বিশুদ্ধ বাংলায় জমির দলিল লেখার প্রচলন হয়নি। তার কারণ দলিল-লেখকদের একটা বড়ো অংশই মুসলিম সম্প্রদায়ের।

এখন কথা হল হিন্দু বাঙালিদের বাংলা ভাষার চেয়ে মুসলমানদের বাংলা ভাষা আরবি-ফারসির এত আধিক্য কেন? কেন এমন সব আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হয়, যা হিন্দু বাঙালিরা ব্যবহার করে না? এরও একটা ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

বস্তুত বাঙালি মুসলমান এবং বাঙালি হিন্দুর ভাষা এক হলেও উভয় পক্ষের শিক্ষাদীক্ষা এবং ধর্মীয় আদর্শে স্বাতন্ত্র আছে। এজন্য একের আদর্শ, ভাব, চিন্তাপ্রণালী ঠিক অন্যের মতো কখনোই হতে পারে না। তার মানে বাঙালি বলা যাবে না, তা তো হয় না। ধর্ম এক হয়েও ভাষা ও মানসিকতার পৃথকতা থাকে। মেদিনীপুরের ভাষা ও মানসিকতা আর উত্তর ২৪ পরগনার ভাষা ও মানসিকতা পৃথক, তেমনি বরিশালের ভাষা ও মানসিকতা আর সিলেটের ভাষা ও মানসিকতাও পৃথক। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও উভয়ের ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গি আছে, থাকবেও। ভারত ভাগের পর এই সীমারেখা আরও স্পষ্ট হয়ে যায় আড়াআড়িভাবে। কারণ ভারত ভাগের আগে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে কলকাতার লেখক-সাহিত্যিকদেরই একাধিপত্য ছিল। যদিও বাংলা সাহিত্যের আধুনিককাল আরম্ভ হয়েছিল পশ্চিমবাংলার মানুষের হাত ধরে, তবু সে সময় পূর্ব বাংলার মানুষ ভাষা-সাহিত্যে পশ্চাৎপদ ছিল, একথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই। কিন্তু বাংলা ভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছিলেন মুসলিম শাসকেরা। সে কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তাঁরাই বাংলা ভাষাকে সাহিত্যের ভাষা বানিয়েছিলেন। মুসলমানদের উৎসাহেই বাংলা ভাষার প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। ১৭৫৭ সালে শাসন-ক্ষমতা হারানোর শোকে মুসলমানেরা নতুন শাসক বৃটিশের সঙ্গে অসহযোগিতা করতে শুরু করল। ফলে মুসলমান কোন মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়নি। যখন তৈরি হয়েছিল, তখন বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। ফরায়েজি আন্দোলনের হোতারাই এর জন্য দায়ী। তাঁরা মুসলমানদের আধুনিক ও ইংরেজি শিক্ষা থেকে দূরে নিয়ে যান। এটা পিছিয়ে দেয় মুসলমানদের অনেক বছর। প্রায় শতাধিক বছর। আর সেসময়ে হিন্দু সমাজে বিদ্যাসাগরের মতো মানুষরা জন্ম নিয়েছিলেন, যাঁরা শিক্ষায় নিজের সমাজকে অনেক এগিয়ে নিয়ে যান। মুসলিম সমাজে তাঁর মতো কেউ এখনও জন্ম নেননি। যখন মুসলমানরা সম্বিৎ ফিরে পেয়েছিল তখন কানাকড়িও ছিল না, লেংটিই হয়েছিল সম্বল। শিক্ষায় দীক্ষায় জ্ঞানে চিন্তাধারায় হিন্দু সম্প্রদায়ের থেকে মুসলমান সম্প্রদায় বহু যোজন দূরে পিছিয়ে পড়ল। তার প্রভাব ভাষাতেও পড়ল। হিন্দুরা বেশি করে ইংরেজি আঁকড়ে ধরল। আর মুসলমান বেশি বেশি করে আরবি-ফারসি আঁকড়ে ধরল। ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে বাংলায় যে রেনেসাঁ এসেছিল, তার ভাগিদার ছিল না মুসলিমেরা। তারা ইংরেজি শিক্ষা নেয়নি বলেই। এটা তো ঠিক, ইংরেজি না জানলে সে আমলে অন্তত রাজানুকূল্য পাওয়া যেত না। যেটা ঘটেছে মুসলিমদের সঙ্গে। বৃটিশরাজের আনুকূল্য থেকে মুসলমানরা চরমভাবে বঞ্চিত হল। যখন এদেশে মুসলিম শাসন ছিল, তখন ফারসি ভাষার ছিল জয়জয়কার। লক্ষ করে দেখবেন, অনেক হিন্দুও ফারসি শিখেছিল সেসময়ে, যাতে তাঁরা রাজদরবারে মুন্সির চাকরি পায়। ইংরেজি না শেখায় মুসলমানেরা সরকারি চাকরিতেও ছিল খুব কম।

ইংরেজদের বিরোধিতা করতে গিয়ে মুসলমানদের যে ক্ষতিসাধন হয়েছিল, তা কোনোদিনই পূরণীয় নয়। ইংরেজ শাসনের প্রতি মুসলিম প্রজাদের আস্থাহীনতা চরম ক্ষতি করেছে মুসলিম সম্প্রদায়ের। আবেগের দিক থেকেও মুসলিমরা ইংরেজ শাসন মেনে নিতে পারেনি। তার উপর ইংরেজরা যখন হিন্দুদের নানা সুবিধা দিতে থাকে, সেটা তাদের মনে অসন্তোষের জন্ম দেয়। তারা সবক্ষেত্রে ইংরেজদের অসহযোগিতা করতে থাকে, আর ফলাফলে পিছিয়ে পড়ে। ১৭৯৩ সালে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চালু করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এতে বাংলার হিন্দু জমির মালিকরা রাতারাতি সব জমির একমাত্র মালিক হয়ে যায়। তাদের ক্ষমতা ও আভিজাত্য বেড়ে যায় অনেক। আর দরিদ্র মুসলিম কৃষক, কৃষিকাজ করাটা আগে যাদের ছিল ইচ্ছাধীন, হিন্দু জমিদারির আওতায় আসাতে সেই প্রভুর জমিতে কাজ করতে ও জোরপূর্বক কর দিতে তাদের বাধ্য করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই বিপরীত ব্যাপার ঘটে হিন্দুদের ক্ষেত্রে। আগে রাজস্ব আদায়ের যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল, সেখানে মুসলিমদের সরিয়ে দেয় ইংরেজরা। বদলে তারা অনুগত হিন্দুদের নিয়োগ করে উচ্চপদে। সুতরাং অভিজাত মুসলিমরা আর্থিক সংকটে পড়ে যায়। পশ্চিম বাংলায় তিতুমিরের নেতৃত্বে ১৮২৭-১৮৩১ পর্যন্ত চলে বিদ্রোহ। এই দুই আন্দোলনে সহিহ মুসলিম হওয়ার তাড়নায় বাংলার মুসলমানেরা ধর্মীয় শিক্ষাকে অনেক বেশি আপন করে নিতে থাকে। ইসলাম ধর্মে অনৈসলামিক আচার ছেড়ে ফরজ পালনে মুসলমানরা উৎসাহী হয়ে পড়েছিল। কিন্তু অমিল হল, হিন্দুরা শিক্ষাগ্রহণে সমাজে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে, কিন্তু মুসলমানেরা পারেনি। অথচ ঠিক এমন সময়েই বাংলার হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধুনিক শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে থাকে। এ সময় একে একে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, অ্যাংলো হিন্দু কলেজ, সংস্কৃত কলেজ ও বেদান্ত কলেজ। মোটকথা, কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষাক্ষেত্রে হিন্দুরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকে। কিন্তু বাংলার অধিকাংশ মুসলিম, যাঁরা গ্রামবাসী ও কৃষক, তাঁরা এ দুইটি আন্দোলনের প্রভাবে যত বেশি ইসলামসংলগ্ন হয়ে পড়েন, ততটাই দূরে সরে যান ইংরেজি ও আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ থেকে। এদিকে হিন্দুরা যত বেশি ইংরেজ হয়ে উঠছিল, মুসলমানরা তত বেশি আরবি হয়ে উঠছিল। অথচ পরিস্থিতি অন্যরকমও হতে পারত। হিন্দুরাও যদি ইংরেজদের সবরকমভাবে বর্জন করতে পারত, তাহলে ইংরেজরা ২০০ ভারতে রাজত্ব করতে পারত না। আধুনিক শিক্ষা গ্রহণে মুসলিমদের অনীহার বিষয়টা এখন যতই সমালোচনা করি না-কেন, তখন যদি হিন্দু-মুসলিম একই সঙ্গে এই ইংরেজি শিক্ষাটা না নিত, তাহলে কিন্তু ইংরেজদের পক্ষে ইংরেজির জন্য একটা পূর্ণ বিকশিত মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি গঠন করা সম্ভব হত না। এই মধ্যস্বত্বভোগী কেরানি শ্রেণিটাই কিন্তু ইংরেজদের আরও দেড়শত বছর উপমহাদেশ শাসন করতে সাহায্য করেছিল। আধুনিক শিক্ষাগ্রহণে মুসলিমদের অনীহার বিষয়টাকেই কিন্তু গান্ধীর অহিংস নীতির মতো একটা ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে পরিণত করার সুযোগ ছিল উপমহাদেশের নেতাদের। সেটা সফল হওয়ার সম্ভাবনাও থাকত, বিচ্ছিন্ন সশস্র আন্দোলনের চেয়ে জোরদার হত। কারণ সরাসরি যুদ্ধের সুযোগ সেখানে ইংরেজদের থাকত না। ইরেজ শাসনের ২০০ বছরে ২৪০-৩৫০ ট্রিলিয়ন পাউন্ড ভারত থেকে ইংল্যান্ডে পাচার হয়েছে। এই পাচারকৃত অর্থের বেশিরভাগই বন্ধ করে দেওয়া যেত, যদি ইংরেজি-বিরোধী আন্দোলনটাকে হিন্দু-মুসলিম যৌথভাবে একটা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পরিণত করতে পারত ১৮৫৭ সালের আগেই।

এবার হয়তো অনেকে বলবেন, তাহলে হিন্দুরাও তো মুসলমানদের মতন অশিক্ষিত হয়ে পড়ত, সমাজে পিছিয়ে পড়ত। এ প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য পরিষ্কার – ইংরেজি ভাষা না শিখলে জীবনে কোনো উন্নতি করা যাবে না, এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। পৃথিবীর এরকম বহু দেশ আছে যেখানে ইংরেজি ভাষাকে বর্জন করেও উন্নতির শিখরে। থাইল্যান্ডে কখনো ইংরেজ বা অন্যদের কলোনি ছিল না। থাইল্যান্ডের উন্নতি কি এগিয়ে থাকা কোনো দেশ থেকে কম? ভারতীয়রা হাজার বছর আগে থেকেই আরব বণিকদের সঙ্গে সফলভাবে বাণিজ্য করেছে ইংরেজি না জেনেই। ভাষা কখনোই অন্তরায় হয়নি। চিনেও ইংরেজরা তেমন কলকে পায়নি। চিন এখন উন্নতির শীর্ষে। জাপান ইংরেজি ভাষাকে ঘৃণা করে, জাপানি ভাষাকেই সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেয়। চিন আর জাপানে বেশিরভাগ মানুষ ইংরেজি ভাষা জানে না। জাপানে উন্নতি হয়নি? মানুষ নিজেদের উন্নয়নের পথ খুঁজে নিতে পারে, ইতিহাস সাক্ষী। আবার পশ্চিমী দুনিয়ায় বেশিরভাগ মানুষ যে চাইনিজ বা জাপানিজ ভাষা জানে না, তাতে ব্যবসা-বাণিজ্য তো থেমে থাকেনি সে সব দেশের মধ্যে। যে সময় বৃটিশ সারা বিশ্বে উপনিবেশ বানায়নি, তখনও জ্ঞান চর্চা থেমে থাকেনি।

কিন্তু ভারত তথা বাংলায় বৃটিশদের উপনিবেশের ফলে বাংলার বাঙালিরা ভাষা সংকটের মধ্যে পড়ে গেল। ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষা করাই দায় হয়ে পড়ল। ভাষা এখন বিশুদ্ধতা ছাড়িয়ে সংকর ভাষায় রূপ পরিগ্রহ করেছে। বাঙালির বাংলা ভাষা বিদেশি ভাষার মোড়কে সেজে উঠেছে। হিন্দু বাঙালির ভাষায় ইংরেজি, আর মুসলিম বাঙালির আরবি। পশ্চিমবাংলার ইংরেজি জানা বাঙালিদের কথোপকথনে কান পাতলেই টের পাবেন তাদের মুখের ভাষার বিশেষ বিশেষণ বেশিরভাগই ইংরেজি, তার ক্রিয়াপদ ও সর্বনামই শুধু বাংলা। সাধারণ মানুষের মুখে ভাষাতেও ইংরেজি কথা, যা তদ্ভব আকারে নিত্য চলছে। যেমন – পেনসিল, টেবিল, চেয়ার, হোটেল ইত্যাদি। বাঙালিরা নিত্যব্যবহার্য শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ দেখুন জাপানিরা ইংরেজির পরিবর্তে জাপানি প্রতিশব্দ ব্যবহার করে। জাপানি ভাষায় যথাক্রমে এমপিকচিল, চুকুয়ে, ইছু, হোতেরু ইত্যাদি।

বর্তমানে ইংরেজি শব্দ যেমন বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়েছে, তেমনি ইংরেজরা ভারতে শাসক হওয়ার আগেও অন্য নানা বিদেশি ভাষা আমাদের পূর্বপুরুষদের ভাষার ভিতর অবলীলায় ঢুকে পড়েছিল। বাংলা ভাষার শরীরে সেসব শব্দগুলি এমনভাবে গেঁথে গেছে যে, সেগুলি বিদেশি ভাষা কি না জানিই না। যেমন – ঠান্ডা, আলু, মাছ, জুয়ো, তে-রাস্তা ইত্যাদি। ভারতে উপনিবেশের আগেও বিদেশিদের নিত্য আনাগোনা ছিল। নবাবি আমলেই কবি ভারতচন্দ্রের লেখা থেকেই জানতে পাই, তাঁর সময়ে বিলেতি জাতি বাস করত। যেমন – ফিরিঙ্গি, ফরাসি, আলেমান, ওলন্দাজ, দিনেমার, ইংরেজ প্রমুখ। উল্লিখিত ছটি জাতের মধ্যে প্রথম দুটি ভাষাকে বলে রোমান্স (Romance) ভাষা, বাকি চারটিকে বলে জার্মানিক (Germanic) ভাষা। এই রোমান্স ভাষাই দেদার বাঙালির ভাষা, যা অজ্ঞাতসারে বাংলা ভাষায় বিলীন হয়ে গেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, নবাবি আমলেই বাংলা ভাষা দু-হাতে বিদেশি শব্দ আত্মসাৎ করে নিজের দেহকে পুষ্ট করেছে। বিদেশি শব্দকে স্বদেশি করাই হচ্ছে বাংলা ভাষার চিরকালের ধর্ম।

কিন্তু বিদেশি তথা ইংরেজি ভাষা বাংলা ভাষাকে এতটাই গ্রাস করে ফেলেছিল যে, সাহিত্যসম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও মাঠে নামতে হয়েছিল। শুরু করলেন ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার প্রকাশ। উদ্দেশ্য: ‘ইংরেজিপ্রিয় কৃতবিদ্যদের’ এবং ‘সংস্কৃত পণ্ডিত্যাভিমানীদের’ উভয় গোষ্ঠীকেই নিন্দা করা। বঙ্কিমচন্দ্র সাধারণ সাহিত্যসেবী ছিলেন না। তিনি ছিলেন কায়মনোবাক্যে স্বদেশের, স্বদেশবাসীর মঙ্গলকামী। নিজেদের আত্মসম্মানে উজ্জীবিত করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। (চলবে)

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সৌম্য ব্যানার্জী

Posted in

ভারতবর্ষের মতন এত ভাষার সম্ভার ও সমারোহ যে পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে নেই, সে তথ্য যতখানি নির্ভুল, ভারতবাসী বা ভারতপ্রেমীর জন্য ঠিক ততখানিই আনন্দজনক। দশ লক্ষের উপর মানুষ কথা বলেন, এমন ভাষা এ দেশে ব্যবহৃত হয় ঊনত্রিশটি। এক লক্ষের উপর মানুষ ব্যবহার করেন, এমন ভাষা আছে আরও আঠেরোটি। এ ছাড়াও আছে একশো কুড়িটির উপর বিপন্ন আদিবাসী ভাষা, যেগুলির ব্যবহার দ্রূতগতিতে কমে আসছে। প্রায় পৌনে দু’শোর উপর অল্পাধিক ব্যবহৃত ভাষা নিয়ে সাক্ষাৎ ভাষাতাত্বিক গবেষণার বিষয়ের মতন পৃথিবীর পূর্ব প্রান্তের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে ভারতবর্ষ, বাদবাকি বিশ্বের কাছে যে দেশ ইণ্ডিয়া নামে পরিচিত।

এই নাম দুটির ভাষাতাত্বিক ইতিহাসও যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক। ভারত কথাটির অর্থ ভরতের উত্তরাধিকার বা বংশধারা। আমাদের পুরাণখ্যাত রাজা দুষ্যন্ত ও শকুন্তলার পুত্র মহারাজ ভরত পরাক্রম, ঔদার্য ও শাসনগুণে এতখানিই প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন যে এই বিস্তৃত ভূখণ্ডটি কালক্রমে তাঁর নামে চিহ্নিত হয়ে যায়। বর্ষ শব্দের অর্থ দেশ। অর্থাৎ, যে দেশের উপর রাজা ভরত রাজত্ব করেছিলেন, সেই দেশ হলো ভারতবর্ষ। এত প্রাচীন, প্রাগৈতিহাসিক কোনও শাসকের নামে পৃথিবীর আর কোনও দেশ সম্ভবত নামাঙ্কিত নয়।

ইণ্ডিয়া নামটি হিন্দু শব্দের উচ্চারণগত বিকার। হিন্দুও কিন্তু আদতে সিন্ধু শব্দের অপভ্রংশ। সম্ভবত আক্রমণকারী পারসিকদের মুখে মুখে প্রচলিত। কোনও প্রাচীণ ভারতীয় গ্রন্থে হিন্দু শব্দের উল্লেখ নেই। যে ধর্মকে নিয়ে আজ ভারতবাসীর এত গর্ব, তাকে যদি সত্যিই অন্যান্য religion গুলির পংক্তিভুক্ত করতে হয়, তাহলে তার সঠিক পরিচয় হওয়া উচিত বৈদিক ধর্ম হিসেবে।

ভারতবর্ষের অধুনা জনপ্রিয় আরেক নাম হিন্দুস্তান অনেক পরে মুসলমান আক্রমণকারীদের মুখে প্রচলিত। যাঁরা ভারতবর্ষকে হিন্দুদের দেশ ভাবতে ভালোবাসেন, তাঁরা এই বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখতে পারেন।

সে যাই হোক, আমরা আপাতত ফিরে আসবো ভারতবর্ষের প্রাচীণ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত যে ভাষাটি, তার প্রসঙ্গে। সংস্কৃত। কবে, কি ভাবে যে এই অনন্যসাধারণ ভাষাটির জন্ম, তা আজ আর নির্ণয় করা সম্ভব নয়। শুধু নাম থেকে বোঝা যায় যে, প্রাকৃত জনের ভাষার সংস্কার হয়েছিলো এ ভাষার জন্ম দেওয়ার জন্য।

গবেষণা বলে, যে ভাষায় ঋগ্বেদ লেখা হয়েছিলো, জেন্দাভেস্তার ভাষার সঙ্গে তার প্রচুর মিল। যে ইন্দো-ইওরোপীয় ভাষাসমষ্টির মধ্যে এখনকার আমেরিকা, ইওরোপ, পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশের বেশির ভাগ ভাষা পড়ে, তারই দু’টি প্রধান শাখা ইন্দো-ইরাণীয় এবং ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠীর দুই মূল ভাষা যথাক্রমে আভেস্তীয় ও সংস্কৃত। দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়জাতীয় ভাষাগোষ্ঠীর বিবর্তণের ইতিহাস কিছু জটিল, যার সম্পূর্ণ নির্ণয়ন এখনও সম্ভব হয়নি। ভাষাগুলির শব্দভাণ্ডার মূলত দ্রাবিড় হলেও তাদের ব্যাকরণের বিন্যাস অধিকাংশই সংস্কৃত নিয়মানুসারে। ঠিক কোন সময়ে, কবে থেকে এই মিশ্রণের আরম্ভ, তা আজ নির্ণয় করা দুরূহ। এর বাইরে আদিবাসীদের অস্ট্রিক জাতীয় ভাষাগুলি এবং পূর্বপ্রান্তের মোঙ্গোলীয় উৎসের কিছু ভাষা ছাড়া ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডের উত্তর-পশ্চিম-পূর্বাঞ্চলের প্রায় সব ভাষাই আদিতে সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন। এর একমাত্র ব্যতিক্রম ঊর্দূ। আরবি ও হিন্দির সংমিশ্রণে তৈরি এই মধুর ভাষাটি ভারতবর্ষকে মূঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার।

বেদান্ত-পুরাণ-মহাকাব্যের ভাষাতাত্বিক বিশ্লেষণ বলে, সে যুগের আর্যরা কথ্য ভাষা ব্যবহার করতেন মূলত দু’টি – শৌরসেনী প্রাকৃত ও মাগধী প্রাকৃত। প্রথমটি প্রচলিত ছিলো শৌরসেন, অর্থাৎ মথুরা অঞ্চল থেকে আরম্ভ করে গান্ধার প্রদেশ, অর্থাৎ এখনকার আফগানিস্তান অবধি। আর দ্বিতীয়টি বলা হতো যমুনার এদিকে, অর্থাৎ এখনকার উত্তরপ্রদেশের অনেকখানি অংশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, বঙ্গ, কামরূপ (অহম), ইত্যাদি অঞ্চলে। এই দু’টি মৌখিক ভাষার মধ্যে খুব বেশি প্রভেদ ছিলো না। দুই অঞ্চলের মানুষদের পরস্পর বাক্যালাপে বিশেষ অসুবিধা হতো না। অন্তত প্রাচীন সংকলনগুলি পড়ে তাই-ই মনে হয়।

এই দুটি প্রাকৃত ভাষা থেকে কালক্রমে ভারতের আঞ্চলিক ভাষাগুলির জন্ম হয়। শৌরসেনী প্রাকৃত থেকে জন্ম হয় উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয়, অর্থাৎ হিন্দি, পঞ্জাবি, গাঢ়ওয়ালি, রাজস্থানি, মরাঠি, গুজরাতি, প্রভৃতি ভাষাগুলির। আর মাগধী অবহট্ঠ থেকে শাখা মেলে বাংলা, ওড়িয়া, অহমিয়া, মৈথিলি, ভোজপুরি ইত্যাদি ভাষা। উদ্ভবকাল থেকে আজকের পরিপূর্ণতায় পৌঁছতে সবগুলি ভাষারই বহু সময় লেগেছে। এবং এই ভাষাগুলির বিকাশের ক্ষেত্রে প্রভূত সাহায্য করেছে ধর্ম।

পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র কথ্য ভাষাগুলির ইতিহাস এই একই সাক্ষ দেয়। যখনই নতুন ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে, তখনই ঘটেছে আঞ্চলিক প্রাকৃত ভাষার বিকাশ। কেন? কারণ, প্রচারকরা সর্বাগ্রে চেষ্টা করেন সাধারণ দরিদ্র মানুষকে নিজেদের ধর্মে দীক্ষা দিতে। কাজটি সুপ্রতিষ্ঠিত নাগরিকদের প্রভাবিত করার চাইতে অপেক্ষাকৃত সহজতর। দরিদ্র মানুষ, যাঁরা বহু সময় অবধি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজবৈষম্যের শিকার হয়েছেন, জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের আশায়, আশ্রয় ও স্বীকৃতির ভরসায় তাঁরা দলে দলে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। ভারতবর্ষে এ ঘটনা ঘটা শুরু হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে। এই সব সাধারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অশিক্ষিত মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য বৌদ্ধ পণ্ডিতরা পালি, অবহট্ঠের মতন ভাষাগুলি প্রণয়ন করেন, কারণ প্রধাণত আর্ষ ভাষা সংস্কৃত ছিলো এই প্রাকৃতজনের আয়ত্ত ও বোধ বহির্ভূত। বাংলা ভাষায় যা একেবারে প্রাথমিক রচনা বলে প্রমাণিত হয়েছে, খ্রীষ্টিয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে লেখা সেই চর্যাপদগুলি ছিলো মূলত বৌদ্ধ গান ও দোহা।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসের একেবারে প্রথম যুগে বৌদ্ধধর্ম যে কি অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো, তা সর্বাংশে আলোচনা করার পরিসর এখানে নেই। শুধু এইটুকু বললেই বোধহয় বোঝার কিছুটা সুবিধা হবে যে, বহুযুগ ধরে ভারতীয় রাজনৈতিক শক্তির কেন্দ্র, শিশুনাগ-মৌর্য-গুপ্ত-পাল রাজবংশের প্রতাপদিগ্ধ যে মগধ, সেই মগধের রাজধানী পাটলিপুত্রে প্রথম যে বাঙালি রাজবংশটি রাজত্ব করে, সেই পালরাজারা ছিলেন ধর্মে বৌদ্ধ। এই রাজবংশের হাত ধরেই বাঙালির সর্বভারতীয় ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রবেশ ও প্রতিষ্ঠা, এবং এঁদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই বঙ্গসংস্কৃতির প্রসারলাভ। প্রসঙ্গত, পাল রাজারা খ্রীষ্টিয় সপ্তম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত চারশো বছরেরও বেশি সময় ধরে পাটলিপুত্রে রাজত্ব করেছিলেন। মগধের ইতিহাসে অন্য কোনও রাজবংশ এত দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

বৌদ্ধধর্মের পর যে ধর্ম ভারতবর্ষে ব্যাপক হারে প্রচারিত হয়, সে ধর্ম ইসলাম। কুরান শরীফ, হজরৎ মুহম্মদ ও ইসলামীয় দর্শনের উপর পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, প্রাথমিক যুগে ইসলাম এ দেশে প্রচারিত হয়েছিলো মূলত অস্ত্রাগ্রে। তারপর এক সময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন ততদিনে অত্যধিক ঋজু হয়ে ওঠা ব্রাহ্মণ্যধর্মের অত্যাচারের কবল থেকে মুক্তি পাবার তাড়নায়। তীব্র জাতিভেদজনিত নিম্নবর্ণের অসহ অপমান ছাড়াও কন্যাপণ, বিধবাদের উপর অকথ্য পীড়ণ ও সতীদাহের মতন ভয়াবহ প্রথাগুলি তখন তথাকথিত হিন্দুধর্মের গলায় ফাঁসের মতন চেপে বসেছে। কেন এই অবস্থা হয়েছিলো, তার ধার্ম-সামাজিক বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ। আমাদের বক্তব্যটুকু হলো, এই অবস্থার কারণে ইসলামকে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থানাধিকার করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। তাই বৌদ্ধধর্মের মতন আঞ্চলিক ভাষাগুলিকে জনসংযোগের কাজে ব্যবহার করার প্রয়োজন, বা সেই কারণে সেগুলিকে পুষ্ট করার দায়, কোনওটাই ইসলামের ছিলো না।

যে ধর্মের ছিলো, সে হলো অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ভারতবর্ষে প্রচারিত হতে শুরু হওয়া খ্রীষ্টধর্ম। ইওরোপীয় পাদ্রীরা প্রচণ্ড উৎসাহের সঙ্গে ‘অনগ্রসর’ ভারতবাসীদের ‘সদ্ধর্মের’ আলোয় অলোকিত করে তোলার প্রয়াসী হলেন, এবং সেই প্রয়াসের কার্যসিদ্ধির জন্য তাঁদের দ্বারস্থ হতে হলো গ্রামে-গঞ্জে-হাটে-মাঠে ফেরা মানুষের মৌখিক ভাষাগুলির। এঁদের নিরন্তর প্রয়াসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কতজন মানুষ সদ্ধর্মের ছত্রছায়ায় এলেন বলা কঠিন। কিন্তু বিস্তর লাভ হলো ভারতবর্ষের আঞ্চলিক ভাষাসমূহের। উইলিয়ম কেরি, উইলিয়ম জোন্সের মতন পণ্ডিতরা পুনরুজ্জিবীত করে তুললেন বাংলার মতন মৃতপ্রায় ভাষাগুলিকে। কেরি সাহেবের শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হলো বাংলা ভাষায় প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ, বাইবেলের বঙ্গানুবাদ।

তারপর থেকে তো বাংলা ভাষার ইতিহাস ইতিহাস-ই! এত কম সময়ের মধ্যে এতখানি বৈদগ্ধ, বৈচিত্র পৃথিবীর অন্য কোনও ভাষায় সমাবিষ্ট হয়েছে বলে মনে হয় না। সর্বজনপাঠ্য বাংলা গদ্যের জন্ম ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, এবং তখন থেকে আজ অবধি, এই দেড়শো বছরের ন্যূনাধিক কিছু সময়ের মধ্যে শুধু বাংলা গদ্যসাহিত্য পৃথিবীর সেরা সাহিত্যসম্ভারের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। কবিতার কথা আলোচনা না করলেও চলে, কারণ পরিসংখ্যান বলছে, শুধুমাত্র প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা বাকি সব ভারতীয় ভাষায় মিলিয়ে যত, বাংলায় একা তার থেকে বেশি।

কিন্তু এত বিশ্লেষণ ও গৌরবান্বিত পরিসংখ্যানের পরেও এ কথা বোধ হয় অনস্বীকার্য যে বাংলা সাহিত্যের মান পড়তির দিকে। তার নানা রকম কারণ গত কয়েক দশক যাবৎ শোনা যাচ্ছে। বাঙালির সার্বিক নৈতিক অধঃপতন থেকে আরম্ভ করে কয়েকটি সাহিত্যব্যবসায়ী সংস্থার মৌরসীপাট্টা অবধি সব কিছু আছে তার মধ্যে। কিন্তু সে সব কিছুর বাইরে যে কারণটি সম্ভবত সব আঞ্চলিক ভাষারই সাহিত্যমানের পতন ঘটাচ্ছে, তা হলো বিশ্বায়ানের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারের লোভনীয় হাতছানি।

গত দু’দশকে যত বাঙালি তথা ভারতীয় লেখক ইংরেজি ভাষায় লিখেছেন, তত তার আগের দু’শো বছরের ইতিহাসেও লেখা হয়নি। বলা বাহুল্য, শিক্ষামাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষার ব্যাপক বিস্তারের ফলেই এ ঘটনা সম্ভব হয়েছে। এই সব রচনাই যে অতি উচ্চ মানের, তা নয়। কিন্তু উচ্চ মানের আঞ্চলিক সাহিত্যের থেকেও তাদের প্রায় সবারই বিক্রয়যোগ্যতা বেশি। একটি প্রকৃত অর্থে বিশ্বায়িত ভাষায় রচিত সাহিত্যের এই সুবিধা তো থাকবেই। তাই অনিবার্য কারণেই আজ ভারতবর্ষের মতন দেশের আঞ্চলিক ভাষাগুলির ভবিষ্যৎ বিপন্ন।

কিন্তু তার মধ্যেও আশার আলো দেখাচ্ছে ঋতবাকের মতন web পত্রিকারা। বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে, সমৃদ্ধতর করে তুলতে হলে এই পত্রিকাগুলিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। নিয়মিত সংগ্রহ ও প্রকাশ করতে হবে উচ্চমানের সাহিত্য। সেই কাজে সাহায্য করা সম্ভবত আমাদের মতন প্রত্যেকজন মাতৃভাষাপ্রমী সাহিত্যপ্রিয় মানুষের কর্তব্য।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in

গোঁপের আমি গোঁপের তুমি

আনন্দবাজারের প্রাক্তন সাংবাদিক বন্ধুবর মিলন দত্ত মশায় এবং তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক তপস্যা ঘোষ ‘বিতর্কিকা’ বলে একটি অতীব স্বাদু প্রবন্ধের পত্রিকা প্রকাশ করে থাকেন। কয়েক দশক আগে তার একটি সংখ্যায় থীম ছিল বাঙালী, অর্থাৎ বাঙালী বলতে আজকে কী বোঝায়। তাতে অশোক মিত্র, শঙ্খ ঘোষ, একরাম আলি এবং আরও অনেক প্রবুদ্ধজনের মতামতের সংকলন ছিল। আলোচনায় তর্কবিতর্কে উঠে এসেছিল কয়েকটি লক্ষণ, যথা খাওয়াদাওয়া, পোষাক এবং অবশ্যই ভাষা।

আমার মত গোলা পাঠকের মনে হয়েছিল যে এদের গুরুত্ব কম না করেও যদি কোনও একটি লক্ষণকে গুরুত্ব দিতেই হয়, তবে তা হবে বাংলা ভাষা যা আমাদের মাতৃভাষা। অন্তত হিন্দিবলয়ে দীর্ঘকাল বসবাসের ফলে এটাই মনে হয়েছে। ছোটবেলা থেকে আমাদের জিভ যে ভাবে বিভিন্ন স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণকে উচ্চারণ করে অভ্যস্ত, তা অন্য ভাষায় বিপর্যয় ঘটায়; ব্যস, আমরা ধরা পড়ে যাই। ক’টা বাজারচলতি উদাহরণ দিই।

ছত্তিশগড় থেকে জনৈক নারায়ণ দেবাঙ্গন ফৌজে নাম লিখিয়ে নেফা সীমান্তে লড়তে গেছল। গুরুতর আহত অবস্থায় ফিল্ড হাসপাতালে তাকে রক্ত দেয় একজন বাঙালী সহযোদ্ধা। জ্ঞান ফিরতেই তার প্রথম কথা – বাড়ি যাবো! বাড়ি যাবো!

গোপাল ভাঁড়ের গল্প মনে করুন। নানান ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত এক ব্যক্তিকে নিয়ে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র পড়লেন বিপদে, লোকটি কোন প্রদেশের? দায়িত্ব দিলেন গোপাল ভাঁড়কে। ভাঁড় মশায় এক সন্ধ্যের অন্ধকারে লোকটিকে ল্যাং মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। আচমকা এমন আক্রমণে বিপর্যস্ত লোকটির মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে – সড়া অন্ধা! (শালা, চোখের মাথা খেয়েছিস!) পরের দিন রাজসভায় গোপাল ঘোষণা করল – লোকটি ওড়িয়া।

আমাদের অবচেতনে কাজ করে মাতৃভাষা, বিপদে পড়লে আচমকা আঘাত পেলে আমরা মায়ের কাছে আশ্রয় খুঁজি, জ্বরের ঘোরে কোঁকাতে থাকি – ও মা, মাগো!

বাঙালীর আছে নিজস্ব উচ্চারণ। আমরা শকার-বকারে অভ্যস্ত, তাই কবি গাহিয়াছেন ‘বেড়ালের তালব্য শ’। আসলে আমরা এই ত্রয়ীকে – স, শ এবং ষ – একই রকম উচ্চারণ করি। হিন্দিভাষী কানে বাঙালীর শালা আর সসালা একই শোনায়। ওরা বোঝায় – বাপু হে, মায়ানগরী মুম্বাইতে খোদ অমিতাভ বচ্চন আমাদের বিলাসপুরের সত্যদেব দুবের কাছে তিনটে স’কারের স্পষ্ট উচ্চারণ শিখতে আলাদা করে পাঠ নিতেন। আর তুমি বাঙালী কিনা...!

ওরা আমাকে শেখায় – সন্দেশের ‘স’, শালগমের ‘শ’, আর ষটকোণের ‘ষ’।

আমি শিখি না, আমার বয়ে গেছে।



কিছু উক্তি, কিছু খেদোক্তি

আমাদের বর্ণমালায় রয়েছে দুটো ব – বর্গীয় ব এবং অন্তস্থঃ ব; ছোটবেলায় দাদু শিখিয়েছিলেন। আমি বুঝভম্বুল। দুটোকে আলাদা করে চিনব কী করে? দাদু অপ্রস্তুত। এই প্রশ্ন কি তাঁকেও ছোটবেলায় বিব্রত করেছিল? আমি বলি – দাদু, দুটোর দরকার কি? একটা ‘ব’ দিয়াই কাজ চালাইয়া দাও।

--দুরহ প্যাটব্যাক্কল! যা আরেক থালা ভাত খা গিয়া।

এই ডায়লগ শুনলাম আরও দু’বছর পর। শনি-রবিবারের অনুরোধের আসরে লতা মঙ্গেশকরের গলায় শুনি – প্রেম একবার এসেছিল নীরবে।

তন্ময় হয়ে শুনি। ক’দিন পরে দাদুকে জিজ্ঞেস করি – দাদু, প্রেম আইল, আবার চইল্যাও গেল। কিন্তু আমরা টের পাইলাম না ক্যারে? হেইয়া কি খালি পায়ে আইছিল?

দাদু হা-হা করে হেসে উঠলেন – দুরহ প্যাটব্যাক্কল! যা আরেক থালা ভাত খা গিয়া।

আমি ওই একটা ‘ব’ নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলাম। কিন্তু ওরা আমার পেছন ছাড়ল না। হিন্দি বলয়ে আসার পর দুই সতীনের কোঁদলের মতন আমায় পদে পদে অপদস্থ করে চলল। অংকের ক্লাসে দেখি যাকে আমি কোলকাতায় বলতাম ‘ভেক্টর অ্যালজেব্রা’, তাকে ওরা বলে ‘ওয়েক্টর অ্যালজেব্রা’। ভাইরালকে উচ্চারণ করে ‘ওয়াইরাল’। ‘ভ্যালুজ’ কে বলে ‘ওয়েলুজ’; কি যন্ত্রণা!

আমি ওদের অজ্ঞতায় হাসি। বলি ইংরেজি ‘ভি’ এর উচ্চারণ তো ‘ভ’ হবে, তাই না?

ওরাও হাসে, তা কেন? ওটার উচ্চারণ অন্তস্থঃ ব, কখনই ‘ভ’ নয়।

এবার চটে যাই, আমার অহংকারে ঘা লেগেছে। তোমরা বেশি জান? আমরা বাঙালীরা ইংরেজি উচ্চারণ বেশি বুঝি।

কোন সুবাদে?

সবচেয়ে আগে সাহেবদের গোলাম হওয়ার সুবাদে; পলাশীর যুদ্ধ শুনেছ? ‘কাণ্ডারী তব সম্মুখে ওই পলাশীর প্রান্তর, বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর’।

বেমক্কা গান গেয়ে ওঠায় ওরা কেমন ভেবলে যায়, গোল গোল চোখে আমায় দেখে। আমি ভাবি নক আউট পাঞ্চ ঝেড়েছি বটে!

তারপর দেখি ওরা হাসছে; খ্যা-খ্যা করে হাসছে, ঠা-ঠা করে হাসছে, পেট চেপে ধরে হাসছে।

--আবে বাঙালী! গর্ব সে কহো হম গুলাম হ্যায়! আরে গোলাম হলেই উত্তম শিক্ষালাভ?

আমার ভুলটা কোথায়?

শোন, ‘ভ’ হল ‘ব’য়ের মহাপ্রাণ রূপ। ব+হ= ভ। কোন ব? বর্গীয় ব, অন্তস্থঃ ব নয়। তাই ইংরেজিতে ‘ভ’ উচ্চারণের জন্য লেখা হয় বি + এইচ; ‘ভি’ কদাপি নয়।

এত সহজে হার মানার বান্দাই নই।

তাই বুঝি? তাই তোমরা বল ‘বিজয়’, বিনয়, বিনোদ, বিরাট; কিন্তু ইংরেজিতে বানান লেখ ভিজয়, ভিনয়, ভিনোদ, ভিরাট।

ঠিক তাই; কারণ ওগুলো অন্তস্থঃ ব, বর্গীয় ব নয়। বর্গীয় ব হলে ইংরেজিতে বি দিয়ে লিখব। হিন্দিতে পেটকাটি ব। আর পেটকাটা না হলে বুঝতে হবে ওটা অন্তস্থঃ ব।

যেমন? অন্তত একটা উদাহরণ দাও।

দিচ্ছি, একেবারে হাতে গরম উদাহরণ হল ‘বাহুবলী’। সিনেমাটার বিজ্ঞাপনে বানান খেয়াল কর। দুটোই বর্গীয় ‘ব’, তাই পেটকাটা ব, মানে ইংরেজি বি।

শেষ চেষ্টা করি।

সে তোমরা তোমাদের হিন্দি শব্দকে বিদেশি ভাষায় যেমন ইচ্ছে বানান কর গে’, আমার কি যায় আসে! আমরাও আমাদের মত বানান করব। তাতে কার বাপের কি!

উঁহু, কথাটা ইংরেজি বানান নিয়ে নয়, বরং নিজেদের ভাষায় শব্দের বানানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ উচ্চারণ নিয়ে। আমরা বানানে এবং উচ্চারণে কনসিস্টেন্ট, তোমরা নও।

এতবড় কথা! নেভার সে অপমান! যা তা বললেই হল? একটা লাগসই উদাহরণ দাও দিকি?

--বিবেকানন্দ। তোমরা যেভাবে উচ্চারণ কর, তাতে তো ইংরেজিতে ‘ভি’ দিয়ে না লিখে ‘বি’ দিয়ে লেখা উচিত। অথবা, তোমাদের নিজেদের যুক্তি মেনে উচ্চারণ করা উচিত ‘ভিভেকানন্দ’; যেমন ভিনোদ, ভিরাট।

এক্কেবারে ধোবি পছাড়!

আমার মনে পড়ে বিশুখুড়োর মূলোচোরের গল্প। হাতেনাতে ধরা পড়ে চোর গৃহস্বামীকে সাফাই দেয় যে ও বেড়া টপকে ঢোকেনি, ঝড়ে উড়িয়ে এনে এখানে আছড়ে ফেলেছে।

তা’ এতগুলো মূলো টেনে তুলেছ?

না, ঝড়ে আবার উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, বাঁচার তাগিদে আঁকড়ে ধরেছিলাম, তাই।

তা বেশ, কিন্তু সেই মূলোগুলো দিয়ে আঁটি বেঁধেছ যে !

এবার আপনি আমায় বলতে পারেন কত্তা!

বলি – আনন্দবাজারে ‘সম্পাদক সমীপেষু’তে চিঠি লিখব যেন বিনোদ খান্না, বিজয় হাজারে, বিন্নু মাঁকড়, বিরাট কোহলি লেখা হয় এবং প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী তব্বুকে টাব্বু না লেখা হয়।

আমার মুখের চেহারা দেখে একজনের করুণা হয়। সে বোঝায়, দোষ বাঙালীদের নয়, আসলে ওদের বর্ণমালায় দুটো ব’য়ের আলাদা লিপিচিহ্ন নেই যে। এটি সংস্কার করে নিলেই ছোটবেলা থেকেই বাচ্চারা ঠিকমত উচ্চারণ করতে শিখবে।

ছোটবেলায় দাদুর দ্বিধা আমাকে আর অবাক করে না।

আমি মাটিতে পড়ে গেছি, তবু রেহাই নেই। ওরা বলে বাঙালীদের তিনটে শ’ই বেড়ালের তালব্য শ। উদাহরণ সন্দেশ। বাঙালী বলে শন্দেশ। ছোটবেলায় দাদু বা গুরুমশায়ের কাছে শেখে বটে তালব্য শ, মূর্ধন্য ষ, দন্ত্য স। কিন্তু উচ্চারণের সময় জিভটাকে ঠিক করে তালু, মূর্ধা বা দাঁতে ঠেকায় না। আলসে জিভ মূর্ধা অবধি কখনই পৌঁছয় না। দাঁতে জিভ একবারই ঠেকায়, ইয়ার্কি করে ‘সামবাজারের সসীবাবু সসা খেতে’ বলার সময়।

আরও আঘাত সইবে আমার!

বাঙালীরা তিনটে ‘র’কে প্রায় একইরকম উচ্চারণ করে।

শুয়ে শুয়েই মনে মনে প্রতিবাদ করি। ‘র’ আর ‘ড়’ তো আলাদা। কিন্তু ‘ঢ়’? ওটার উচ্চারণ? কেউ শেখায়নি।

এক মক্কেল শান্তিনিকেতনের কলাভবনের স্নাতক। সে আমার কাটাঘায়ে নুন ছিটিয়ে বলে যে আমাদের নাকি মাত্রাজ্ঞান নেই। আমরা সমস্ত দীর্ঘমাত্রাকেও নাকি একমাত্রার মত উচ্চারণ করি। অথচ সংস্কৃত এবং হিন্দিতে দীর্ঘমাত্রার উচ্চারণে দুইমাত্রা লাগানো হয়। (লাগা না যেখানে ইচ্ছে, আমি কি করব?)

রবীন্দ্রনাথের মতন এমন বহুমুখী প্রতিভা আর কোনও ভাষায় নেই।

(তাতে তোর কি রে শালা!)

দুটো দেশের জাতীয় সংগীত রচয়িতা, ভাবা যায়!

(নে নে; হিংসেয় পেট ফেটে মর!)

কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছ যে, দু’মাত্রা করে উচ্চারণ করলে ওঁর কবিতা তোমার বায়সনিন্দিত কন্ঠেও কেমন প্রাণ পায়? এই দেখ -

সন্ধ্যা-আ রা-আ গে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখা-আ নি বাঁ-আ কা-আ।

বা, জীবনানন্দের বা-আ-ং লার মুখ আ-আমি দেখিয়া-আ ছি।

কালীদা গো কালীদা!



সাতকোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী

আমার মাথায় টিউবলাইট জ্বলে। ভাষা কি আজ কোনও জাতির সবচেয়ে বড় চিহ্ন? এয়োতির শাঁখা-পলা-মঙ্গলসূত্র? তাই রোমে ভ্যাটিক্যান দেখতে আসা মা-মাসিকে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে দিশেহারা হওয়া দুই বাঙালী তরুণীকে দেখে একজন এগিয়ে এসে বলে –আসেন বইনেরা, আসেন কাকিমা; আমার সঙ্গে আসেন। আমিও রেজিস্টার্ড গাইড। আপনাগো অন্য লাইনে নিয়া তাড়াতাড়ি দেখাইয়া দিমু নে।

ভাষা কি ধর্মের চেয়েও বড় বন্ধন? দড়ির নয়, নাড়ির টান? না হলে কেন দ্রাবিড় কাজাগম মুন্নেত্রা বা ডিএমকে দলের নেতা আন্নাদু্রাই ষাটের দশকে রাজ্যসভায় ভারতের থেকে স্বাধীন এক তামিলনাড়ু রাজ্যের দাবি করবেন? তাহলে... তাহলে কি দুইবাংলা মিলে এক স্বাধীন বাংলা গড়া যায়? ভেবে দেখুন, তাহলে কত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিসের এন আর সি, কিসের ক্যা ক্যা? কে শরণার্থী আর কেইবা অনুপ্রবেশকারী? সবই অবান্তর হয়ে যাবে।

এই রে ! কেস খেয়ে যাব? শাহীনবাগের ধর্না যে এখনও চলছে!

না না, ওসব চলবে না। ওপারের বাংলা ঠিক আমাদের মত না। ওরা জল খায় না, ‘পানি’ খায়, স্নান করে না, ‘গোসল’ করে। আরও আছে, স্তনকে বলে ‘বুনি’! নাঃ, এবার এপারেই কেস খেয়ে যাব।

মনকে বোঝাই, তাতে কি? এপারেও তো কত ফ্যাকড়া। রাঢ় বাংলায় লোকে মুড়ি না খেয়ে ‘ভুজা’ খায়, কুমড়োর বদলে খায় ‘ডিংলা’। বীরভূমের পুলিশ বোলপুরে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে চেঁচায় – গুলিয়ে দেব! গুলিয়ে দেব!

তাবলে কি ওদের ভাষা বাংলা নয়? আলবাৎ বাংলা!

আঞ্চলিক বৈচিত্র্য ভাষাকে আরও ধনী করে। তাহলে স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কি? একটু সাহস করতে ক্ষতি কি?

মনীশ ঘটক লিখেছিলেন না “নেহেরু-প্যাটেল-জিন্নার দল বলে বুলেট না বাংলা”?

১৯৫২ সালের সেই ২১শে ফেব্রুয়ারি! যদি বার্লিন ওয়াল ধ্বসে যায়, যদি দুই আয়ারল্যান্ড ফের জোড় বাঁধতে চায়? তাহলে আজ আমরা কেন স্বপ্ন দেখব না?

“আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?”

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সত্যম ভট্টাচার্য

Posted in

শীতের কথকতা

শীত মানে এক আশ্চর্য কুহক। শীত মানে রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে বারান্দায় কমলার খোসা ছাড়ানো আর মায়ের উল কাটা, বাবার রেডিওতে তখন অজয় বসু ইডেন গার্ডেন থেকে। শীত মানে চলে যাওয়া সময়, যাকে ফিরে পাওয়া যায় হাতে জ্যাকেটের পকেটের ওম থেকে। রোদ্দুরে মেলে দেওয়া লেপ আর সারাদিন বৃদ্ধের বসে থাকা তার জন্য। ওদিকে তারযন্ত্রে টংটং আওয়াজ তুলছে ধুনকর। সকাল থেকে কাজে বসে গেছে তারা আর তুলো উড়ছে সমানে। কোথা থেকে যেন উঁকি দিচ্ছে টকটকে লাল শালু। আবার হয়তো কদিন ধরে রোদই উঠলো না, শুধু কমলা বলটা সারাদিন ধরে এপার থেকে ওপার করলো। আর টুপটুপ করে ঝরে পড়লো অজস্র শিশিরবিন্দু, গাছের পাতা থেকে সারারাত টিনের চালে অথবা টিনের চাল থেকেই। এদিকে কুয়াশারা এসে উড়তে উড়তে লেগে যায় মাথার টুপিতে বা গায়ের চাদরে। তাদের গুঁড়ো গুঁড়ো রেণুতে কত ভালোবাসার কথা লেখা থাকে। সে ভালোবাসার জন্যে মাইলের পর মাইল হাঁটা যায় সকালের প্রাইভেট টিউশন বাদ দিয়ে, আলতো ঘষা খেয়ে যায় আঙ্গুলে আঙ্গুল। গাঢ় কুয়াশাতে কাছাকাছি এলে স্পষ্ট হয় অবয়ব আর তার আগে যাবতীয় ঝাপসা। কনকনে ঠান্ডায় থিরথির করে কাঁপা ঠোঁট অথবা সাড়া না দেওয়া আঙ্গুল তাজা হয় তামাকের সুঘ্রাণে। কখোনো আবার কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে যায় চশমার কাঁচ। ধোঁয়া উঠতে থাকে চায়ের গেলাস অথবা কফির কাপ থেকে। যত বুদবুদ তত আহ - অজ্ঞাতসারেই আস্বাদের শব্দ নির্গত হয়। এরকমই কোনও এক রোদ্দুরের সকালে তোরঙ্গ থেকে আত্মপ্রকাশ করে গরম জামা, উলিকট, সোয়েটার, মাঙ্কি টুপিরা। গায়ে তেল মেখে ঝপ করে কুয়ো থেকে জল ঢেলে নেয় কেউ আর হি হি করে কাঁপে, টোকা খায় দাঁতে দাঁত। কেউ আবার দাড়িয়ে থাকে আদুল গায়ে গরম জলের জন্যে। ধোঁয়া ওঠে রাস্তার পাশের ভাপা পিঠের দোকান থেকে, সেখানে কনকনে শীতে প্রতি ভোরে বা সন্ধ্যায় ছোট্ট উনুনে দোকান দেন পাশেরই গ্রাম থেকে আসা মাসী। পরতে পরতে প্রতি গ্রাসে তার স্বাদ বাড়ে, কোনো গহীন অন্তরালে লুকিয়ে থাকা খেজুর গুড়েরা চালান হয়ে যায় মুখের ভেতর ধীরে ধীরে। দূরে একা পড়ে থাকে ধান কেটে নেওয়া ন্যাড়া ক্ষেত, তাতে বিকেল বা সন্ধ্যাবেলায় পড়ে থাকা ধিমি ধিমি আগুন থেকে ধোঁয়া ওঠে মাঝে মাঝে পাক খেয়ে। ওদিকে আবার সকাল সন্ধ্যেতে কয়লার উনুনের ধোঁয়া জমে কাছে দূরে প্রান্তরে প্রান্তরে। সারাদিন ধরে উঠোনে ঝাড়বার পর চাষীবউ গোলাতে নিয়ে তোলে সমস্ত ধান। পৌষপার্বণ আসে। ঢেঁকি-ছাঁটা চালের পিঠে পুলির গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে আকাশ বাতাস। দোকানের শোকেস থেকে সাজানো নলেন গুড়ের সন্দেশেরা হাতছানি দিয়ে ডাকে। তার ম ম গন্ধে মনে পড়ে, এমনই এক শীতের সকালে বন্ধুর বাড়িতে সদ্য গাঢ় করা খেজুড় রস, গরম ভাজা মুড়ি আর জামবাটি ভর্তি গরুর দুধ পৌছে দিয়েছিল কোন তুরীয় আনন্দে। এ সমস্ত খবর নিয়ে পরিযায়ীরা উড়ে গেছে কতকাল... কত কত দূরে।

তারাও জানে যে শীতকাল আসলে ফ্যানাভাত হয়, নতুন কালো নুনিয়া চালের ফ্যানাভাত, তাতে ছোট ছোট লাল গোল আলু পড়ে, সর্ষের তেল আর কাঁচালঙ্কার গন্ধে মাতোয়ারা হয় ভুবন। রাস্তার পাশের দোকান থেকে লকলকে মাথা নেড়ে ডাক দিতে থাকে ধনেপাতারা আর তারপর ছড়িয়ে যায় তাদের সুঘ্রাণ নিয়ে একা অথবা যাবতীয় সুখাদ্যে। ডাকে পালং, তার আলু-বেগুন-ছিম-বড়ির পাতলা ঝোল যেদিন ছড়িয়ে যায় গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতে, কোথা থেকে যেন এক অপার্থিব আলো এসে পড়ে ডাইনিং টেবিলের ওপর। নিজের চারিদিকে সবুজের আস্তরণ নিয়ে বাজারে চলে আসে ফুলকপিরা। কোনো কোনো রাতে তারা ভেসে ওঠে মটরশুঁটিদের নিয়ে খিচুড়ির কড়া থেকে। মোড়ে মোড়ে বসে যায় হরেক চপ ভাজার দোকান। মাথায় টিমটিমে হলদে আলো নিয়ে সন্ধ্যে থেকে তাকে ঘিরে বসে থাকে ক’জন। কোথাও আবার ছোট্ট কুপি জ্বলে আর কথা চলে ফেলে আসা সময়ের। মনে পড়ে, এসময় মা রাঁধতেন বোয়ালমাছ, আলু-বেগুন-বড়ি-ধনেপাতা সহযোগে, রাতে তাকে রেখে দেওয়া হত পরদিন খাবার জন্য। আর পরদিন গরম ভাতের ওপর যখন সে সুখাদ্য গলে গলে যেত তার সোনালী রঙ নিয়ে - আহা সেসব আর বলবার নয়। এসময়ই বাজারে চলে আসে কালো হলদে ট্যাংরারা, ফুটফুটে পেঁয়াজকলির সাথে তার গা মাখা পাতলা ঝোল কোনো কোনো ছুটির দিনে শোভা পায় পাতে। হাঁক দিয়ে চলে যায় নকল জয়নগরের মোয়া, হোক না তা নকল, কিন্তু খেতে তো ভালোই। মনে পড়ে এসময় পুরোনো পাড়ার মাঠে খেলা হত দাড়িয়াবান্ধা - আজো কেউ খেলে কিনা সেসব সেখানে কে জানে। মা-কাকিমা-দিদি-বোন-আমরা ছোটরা মিলে খেলা হত। পাশেই ব্যাডমিন্টন খেলতো কেউ কেউ। শীত আসলেই তার কোর্ট কাটাকাটি আর নেট টাঙ্গানো, তারপর বড় হলে আলো জ্বালিয়ে রাতে। ওদিকে বড় মাঠে ক্রিকেটের পিচ কাটা হয়ে যাবে পুজোর পরেই। গাঁদা-ডালিয়া-চন্দ্রমল্লিকাদের জন্য জমি বানানো হবে। আর অপেক্ষা - কোনদিন দেখা দেবে প্রথম কুঁড়িটি। তাকে আবার আঙ্গুল তুলে দেখানো যাবে না। এসবের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে পিকনিকের দিন আর জায়গা। তা নিয়ে হাজার তর্ক-বিতর্কের পর শেষে গোসা করে মুখ ফুলিয়ে যাব না বলে বাড়ি চলে যাবে কেউ কেউ। শেষমেশ সেও কিন্তু যাবেই। সাউন্ডবক্স-ব্যাটারী চলে আসবে আগের রাতে, রাতভোর নেচে কুঁদে সে ফুরিয়ে যাবে একসময়। পরদিন তার আর আওয়াজ নেই। তবু যাওয়া হবে নাচতে নাচতেই। ট্রাক চলে আসবে ভোর ভোর। বেলুন টেলুন দিয়ে সুন্দর করে সে সাজবে। হৈ হৈ করতে করতে একসময় ছেড়ে যাবে। সেদিন দাদা প্রথম দিদির হাত ধরবে। পাহাড়ী নদীর বড় পাথরের আড়ালে চলে যাবে কেউ, রক্সি বা চুমু খেতে। শেষে গোল হয়ে নাচবে সবাই। দূরে কড়াতে টগবগ করে ফুটবে লাল মাংসের ঝোল। খেতে বসা হবে যখন চাঁদ উঠে গেছে আকাশে। একটা বড় চ্যাটালো পাথরের ওপর থালা নিয়ে পৌঁছে গেছে কজন। মনে পড়ে এমনই এক চড়ুইভাতিতে, সন্ধ্যে নামছে, প্রাথমিকে তখন, ফিরবো। ট্রাকের চাকা ঢুকে গেল নদীর নরম বালি মাটিতে, উঠছে না কিছুতেই। এদিকে স্থানীয় লোকেরা এসে বলছে - চলে যান এখুনি, পাহাড় থেকে মহাকাল বাবাদের নামার সময় হল। মায়ের কোলে বসে কাঁপছি ঠকঠক করে নদীর পাথরের ওপর। এভাবেই শীত আসলেই কত কত কথা মনের বন্ধ দরজা ঠেলে বের হয়ে আসে... মিশে যায় তারা নরম সোনালী রোদ্দুরে। রিক্ত মনে বসে থাকি স্মৃতিবিজড়িত শূন্য হৃদয় নিয়ে।

0 comments:

0

বইঘর - পল্লববরন পাল

Posted in

আবর্ত - সম্মতি দাও অবাধ্যতার
পল্লববরন পাল


বইয়ের নাম “আবর্ত”। কবি - শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী।  প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর ২০১৯। প্রকাশক ‘ধানসিড়ি’। ‘দু’জন মানুষ। শহর একটা। জীবনও, একটাই।’ এই শিরোনামে প্রথম ভূমিকার অংশ –

... তবে কাহিনিরা মানুষের চেয়ে বেশি ধুরন্ধর। কাউকে কিচ্ছুটি না জানিয়ে তারা নিজেদের মতো একটা শেষের পথে এগোতে থাকে, যে পথের নাম আমরা দিই অভ্যাস। নিজেদের গল্পের রথ নিজেরা ছোটাতে ছোটাতে কখন যে লাগাম হাতবদল হয়ে যায়, বুঝি না। আচম্বিতে আমরা দেখি, আমাদের ছোটাচ্ছে আমাদের কাহিনির ভার... নিজেদেরই তৈরি করা গল্পের জাল ভেঙে বেরোনোর পথে সৃষ্ট হয় আবর্ত।

এই আবর্ত-স্রষ্টার নাম শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী। অভিনবত্ব ত্রিমাত্রিক পদবিতেও। আমার অভিজ্ঞতায় ইতিমধ্যে ঘোষরায় বা রায়চৌধুরী একাধিক পেয়েছি – লক্ষ্য করুন পাঠক – ইনি ঘোষ রায় চৌধুরী – তিনটিই মৌলিক পদবি এবং স্বাধীন – মাঝখানে সুনির্দিষ্ট নোম্যান্স্‌ল্যান্ড সহ সীমান্ত মজুত। ত্রিমাত্রা শুভংকরের সৃষ্টিমাধ্যমেও – নাট্যকার, গদ্যকার এবং কবি। রবীন্দ্র জাদেজার মতো – ব্যাট বল ফিল্ডিং – এ এবং ও দুজনে নয়, এ ও এবং সে তিনজনেই বলে আমায় দ্যাখ্‌। বিরল প্রজাতি। নইলে দ্বিতীয় ভূমিকার পাতায় শেষ সংলাপে লেখেন – 

এই পার থেকে আমি কলকাতা পাঠাব আজীবন –
সন্ধ্যায়, সেতারে ইমন।

এর পরেও কোনো সচ্চরিত্র কবিতা পাঠক আবর্তের মধ্যে মাথা না ঢুকিয়ে পারেন?


বইয়ে দু’জন মানুষ – সূচিপত্রে নির্দিষ্ট – ‘একলব্য – হৃদয়ের ক্ষয়’ (কুড়িটি কবিতা) এবং ‘ফেরা’ (আঠাশটি কবিতা) – প্রথমজন শুরুই করছেন দ্বৈত উচ্চারণে –

সম্মতি দাও, সম্মতি দাও, আবার তোমায় আগলে রাখি
ঝড়ের গতি, উপড়ে আসা ঘর, প্রভৃতি ঠেকায় যদি
শক্ত করে আবার ধরো এই কথাদের, আর ছাড়া নয়।
হাতের মুঠো বন্ধ। এবার সম্মতি দাও, সম্মতি দাও। 

[যেমন করে গাইছে আকাশ]

কবি-নাট্যকারের মুন্সিয়ানাটা লক্ষ্য করুন পাঠক - আগলে রাখার অনুরোধ করে সম্মতির তোয়াক্কা না করেই ঝড়ের গতিতে ঘর উপড়ে পাঠককে নাছোড় হাতের মুঠোয় বন্ধ করতে শুভংকরের লাগলো মাত্রাবৃত্তের সহজ সাবলীলতায় মাত্র চারটি পংক্তি। এবং চতুর্থ পংক্তির মাঝখানে কী সাঙ্ঘাতিক ধারালো, কী নাটকীয় ঐ পূর্ণচ্ছেদ! মুঠো বন্ধ – ব্যাস! শেষ। স্তব্ধতা। শেষ মানেই তো ফের শুরু – ফের ‘সম্মতি দাও, সম্মতি দাও’

পরের স্তবকেই যে কলকাতাকে উনি আজীবন সেতারের ইমনে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন একটু আগে উৎসর্গের পাতায়, তার সম্পর্কেই বলছেন –

তছনছিয়ে চূর্ণ করি মগজজোড়া কলকাতাদের
অহং যত, ঘূর্ণিপাকে লোপাট করি গঙ্গাকিনার
সম্মতি দাও, বক্ষে তোমার রুদ্রপ্রয়াগ, মন্দাকিনী
লিখতে থাকি, এবং অমন চোখেই ধরি আষাঢ়বাড়ি

কবির নিজের আবর্তে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন কলকাতা থেকে রুদ্রপ্রয়াগ এবং মন্দাকিনী লিখতে লিখতে আমাদের সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে পৌঁছে দিচ্ছেন তাঁর ‘আষাঢ়বাড়ি’তে। এখানে আষাঢ় আর বাড়ির মধ্যে কিন্তু কাঁটাতার সীমানা ব্যবধান নেই – সম্পৃক্ত - পাঠকও কবির সঙ্গে – কী সুন্দর যুগলবন্দী – মেঘমল্লারের মতো – দুটি শব্দ পরস্পর জাপটে লীন হয়ে একটা পৃথক নতুন শব্দে যেন উত্তীর্ণ হলো এইমাত্র!

শব্দ নিয়ে যেন যা খুশি তাই আবর্তে ‘তছনছিয়া’ ঘুরপাক খেয়েছেন শুভংকর। দ্বিতীয় কবিতা ‘কালবৈশাখী’র শেষ পংক্তিতে খেলতে খেলতেই একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে বিপরীত মেরুতে গিয়ে নিজেও দাঁড়ালেন, পাঠককেও সেই মজায় মজিয়ে ছাড়লেন –

- কিন্তু এক ঝড় এসে রোজ ডেকে যায়,
সময়ের খবর পাঠায়
- সেইসবই শুনে, ভুলে থাকি।
- গতকাল শীত ছিল।
বসন্তের কবিতারা জেগে ওঠে আজ।


--কাল? বৈশাখী?

আগের কবিতার আষাঢ়বাড়িতে জুড়েছিলেন। এবার ভাঙলেন। কাল আর বৈশাখী – অনায়াস অবলীলায়। ‘দাড়িমের দানা ফাটিয়ে দশ আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে যেমন তার রস বের করে’ ঠিক তেমনি রক্তকরবীর রাজার মতো যেন বলে উঠলেন ‘সৃষ্টিকর্তার চাতুরী আমি ভাঙি’।

শুভংকরের কবিতার একটা নিজস্ব স্টাইল আছে – শব্দ গাঁথতে গাঁথতে সহসা একটি শব্দের প্রতিধ্বনি বেজে ওঠে – আচমকা দ্বিমাত্রিক কবিতা ঐ একটা শব্দে ত্রিমাত্রিক হয়ে ওঠে –

আসছে ফিরে একটানা সুর – হারমোনিয়াম...
প্রেম কি তোমার এমনি জানা?
(সবার কি সব শুনতে মানা?)

আদর বলতে, মধ্যগগন! কলোসিয়াম! [দেবব্রতর হারমোনিয়াম] 

এই আলটপকা হঠাৎ বৃষ্টির মতো ‘কলোসিয়াম’ শব্দটা কবিতার শেষে উচ্চারণের সাথে সাথেই পাঠককে চমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে, শুরু থেকে একাধিকবার ফের পড়তে হবে, হবেই – অনুষঙ্গের ঠিকানা খুঁজে বের করতে – একইভাবে ‘ঋণ’ কবিতার শেষে ‘শহরের যতেক কেবিন’ পড়েও ঝটকা লাগবে এবং এই শব্দের অনুরণনের মজা অনুধাবনের নেশা পেয়ে বসবে পাঠককে। কবি শুভংকরের স্বভাবের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা কথারা এমনিভাবেই শুধু কথার মত থাকে না – আচমকাই তারা কেউ কলকাতা, কেউ আবার পাহাড়, নয়তো হেমন্তকাল হয়ে পাঠকের সঙ্গে হেমন্ত মুখার্জীর গানের মতো এক সহজ বৌদ্ধিক সম্পর্কস্থাপন করে, যা মাথার মধ্যে অনেকক্ষণ রিনরিন ছন্দে বেজে চলে।

ছন্দে ছন্দে দুলতে দুলতে অভ্যস্ত পাঠক হঠাৎ এই কাব্যগ্রন্থে পেয়ে যাবেন পরপর দুটি গদ্যছন্দের জানলা। খুললেই শ্রাবণের নক্ষত্র নিঃসঙ্গ দহনে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। ঠোঁটের এক কোণে আলতো আলস্যের মতো, ঘুমের মতো, মায়ার মতো ঝুলবে নীলকন্ঠী হাসি। নদী বা সমুদ্রের অতীত এক মাধুর্য হয়ে ‘আশ্বিনের গাঢ় সন্ধ্যা বুকে ভর করে সবার’, ‘নৈঋতে মেঘের সাম্রাজ্য সুঠাম হয়’ – কবির আড়ালে বসে আমরাও দেখি ‘কীভাবে একটা সমগ্র দেশ প্রতিপলে ভেসে যাচ্ছে শস্যের স্বপ্নে’, উত্তাল অভিমানী নদী উঠে আসছে নারীর চোখে, যার শরীরে ছায়া দেখলে লাবণ্যের অনধিকারের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেন কবি।

‘আমায় যদি পোড়াও, তবে আগুন আনো এই মুহূর্তে
সহ্য হয় না এখন দেরি, নইলে কী আর তোমার রক্তে
ডুব দিতে চাই জ্বলার আগে? জন্ম এখন প্রেমের মতোই
মিথ্যে লাগে।...’ [দ্বিধা]

পাঠককে মনে করিয়ে দেবে সত্তর দশকের সেই আগুন-কবির পংক্তি – ‘একটি হৃদয় পোড়ে শুধুই পোড়ে/ তার যেন আর কাজ ছিলো না কোনো’ – মাত্রাবৃত্ত শক্তিরও বড়ো প্রিয় ছন্দ ছিলো। এ ছন্দের ঝোঁকে শক্তির মতোই অনায়াসে উদাস বিষণ্ণতা বুনতে বুনতে শুভংকর হঠাৎ সুনীলের মতো উচ্চারণ করেন – ‘সমস্ত সাড়ে-সাততলা বাড়ির ছাদ থেকে/ নিশ্চিত জানি,/ দেখা যাবে কলকাতার স্কাইলাইন -/ দিগন্তে হাইরাইজ, তার উপর/ সিগারেটের ধোঁয়ার মতো মেঘ/ খুব বৃষ্টির আগে আকাশটাকে/ নেভানো উনুনও মনে হতে পারে। ...’ এই কবিতার মধ্যেই কবি শুভংকর আশ্চর্য নির্মাণ করেছেন –

...মাটি আর চলাচল, চলাচল আর
নীচু বাড়ির দরজা, দরজা আর
পরিচয়ের মধ্যেকার যেটুকু অপেক্ষা
এবং আমাদের এই ফিরে আসা –
সব মুছে যায়।

শুধু শোনা যায়,
এক পরাজিত গায়ক
মল্লারের রেকাব ধরছেন বারবার। 
[হাইরাইজ]

পাঠক, লক্ষ্য করুন, কবিতার পংক্তি ভাগ ও বাঁদিকের মার্জিনের বিভিন্নতা – যা এই কবিতাটির শরীরে দিয়েছে গোপন এক গতির দোলা। আমার কাছে এটা এই গ্রন্থের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা।

পাতায় পাতায় কালিকুন্তল ভার
লুটায় সমীপে, ভাঙাবসতের ছায়ে,
তোমার সান্ধ্য, বিনীত অন্ধকারে
ভালোবাসা আজও এরকমই নিরুপায়। ... 
[মধুমাস]

দ্বিতীয় মানুষ – ফেরা – এক অনন্ত খোঁজ আর তার পরতে পরতে কিছু উথাল-পাতাল দীর্ঘশ্বাস ও অহংকারী অভিমানের বিলাস। কিসের খোঁজ? কার খোঁজ? এই কল্পনাতীত প্রশ্নপত্রের উত্তর সম্ভবত কবি নিজেও খুঁজেই চলেছেন তাঁর আঠাশটি কবিতার প্রতিটি সযত্ন শব্দ, শব্দের মাঝখানের চিলতে রোদ্দুর, দুই স্তবকের ফাঁকে আটকে থাকা বিচিত্র ঋতুসম্ভার জুড়ে। এই দ্বিতীয় মানুষটি কিন্তু আদ্যোপান্ত আচ্ছন্ন দোলাচলে। ঐ যে, আগেই বলেছি – কিসের খোঁজ, কার খোঁজ? ‘আপনারে খুঁজি আর খুঁজি তারে সঞ্চারে আমার’ – এ শ্লোগান কবিরই উচ্চারিত অধ্যায় সূচনায়। এই আচ্ছন্নতার মধ্য থেকেই আলোকিত হচ্ছে কবির খোঁজযাত্রা পথ – তাঁর যাপনভাবনা।

এ’ যেন কলকাতার এক আশ্চর্য ম্যাজিক –
গাঢ় হয়ে আসা বিকেলে
তুমি যখন বলো, এ-দেশে থাকবে না
বিরহ আমাতে ভর করার আগেই
তুমি আমার হয়ে দুঃখ পাও, আবার পরক্ষণেই
চোখ ফিরিয়ে বলে ওঠো, ফিরে আসব আবার।

এই ক্ষমতা, দুঃসাহস ও অহংকার
তোমাকে এই শুর দিয়েছে, জানি। [অহংকার] 

এ কবির বোধের নিভৃত সিন্দুকে বিরাজ করছে কলকাতা, কবির নিজস্ব সেতারের ইমনে বেহাগে। এ শহর কখনও তাঁর একান্ত মগ্ন আদর, কখনও এক পশলা কবিতাবিলাস, আবার কখনও কবি নিরুত্তর হাহাকারে চিৎকার করে ওঠেন - ‘কলকাতা আমাদের অনন্ত এক পরাজয়’।

ঝড়ে-জলে উড়ে যাওয়া
চিঠিদের কথা, ভাঙা মন
আজকাল এ শহরে কে আর শোনায়?
শব্দও বন্ধক তার কাছে। ...
...
এ সব কাল্পনিক।
আমাদের সঙ্গী বলতে শুধু এক মুঠোফোন।
কেঁপে ওঠে মাঝেমাঝে –
‘ফাঁকা নাকি? দেখা করা যায়?’ 

[মুঠোফোন] 

‘আদ্যক্ষর’ কবিতাটির কথা আলাদা করে বলতেই হয়। কারণ, এটি কবি-নাট্যকার শুভংকর রচিত। দু’জনের সংলাপ – চুম্বন দূরত্ব থেকে নয়, বরং রেস্টুরেন্ট কেবিন-টেবিলের দু’পাশে মুখোমুখি – সটান দৃষ্টির কঙ্ক্রিট সেতু নয়, এক চামচ চিনি ঢেলে চামচের চা-ডুব সাঁতারে কাপের দেয়ালে খুব সংযত ঠুং শব্দে গাঢ়তর নিস্তব্ধতায় শ্বাস নিতে সহসা এ ওর চোখ ছুঁয়ে যাওয়া – সংলাপের ভঙ্গি দেখে আমার অন্তত সেরকমই একটা দৃশ্যকল্প মাথায় এসেছে –
- অনেক তো হল এই প্রেম-অপ্রেম-নিবেদন-গ্রহণ-অভিমান।
একমুঠো শান্তি পাওয়া যায়?
- লক্ষণ ভালো নয়! সখ্যেও পাক ধরল তবে?
- সে তো ইনেভিটেবল্‌!
সারাক্ষণ চরকিপাক, অপেক্ষায় ম্লান হয়ে যাওয়া
অভ্যাসের সংলাপ – ভালো লাগে নাকি?
- তার চেয়ে দূরে থাকা, কথায় না-থাকা,
জেনে নেওয়া, আজও ভালোবাসো,
মাঝে মাঝে সাক্ষাৎ, একসিডেন্টালি ...

হে পাঠক, এ সংলাপের কোনো চরিত্রের মধ্যে কবিকে খুঁজবেন না, কারণ, কবি নিজেও সন্তর্পণে নিজেকে এড়িয়ে গেছেন এই কবিতায় – বরং তাঁর প্রিয় চরিত্র, আজকের কলকাতাকে ধরেছেন যে সংলাপে ইনেভিটেব্লি ‘অনিবার্য’ শব্দটাকে অনাত্মীয় মনে করেন, অথবা বলার মুহূর্তে এক্‌সিডেন্টালি বাঙলাটা মনে পড়ে না, ‘দৈবাৎ’ বা ‘হঠাৎহঠাৎ’ মাতৃভাষা বিস্মৃতির মধ্যে কখনো কখনো ডান বা বাম হাতে মাফলারের মতো ঘাড় টপকিয়ে নিজের পিঠ চাপড়ানিও উপভোগ করেন। এই কবিতায় একটা ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত ‘ভালো-না-লাগা’ সম্পর্কে বলতে চাই – এই ‘হাইফেন’এর অত্যধিক ব্যবহার – প্রথম পংক্তিতে ‘প্রেম-অপ্রেম-নিবেদন-গ্রহণ-অভিমান’ যদি ‘প্রেম অপ্রেম নিবেদন গ্রহণ অভিমান’ হতো, ইলিশ মাছের কাঁটার মতো প্রতি শব্দের মাঝে খোঁচা ও রক্তক্ষরণটুকু না থাকলে কি ঐ পাঁচটি শব্দের পাশাপাশি অবস্থানগত পারস্পরিক সম্পর্কের রাশ আলগা হয়ে যেতো? পাঠক বোধহয় খোঁচাটা না খেতেই বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করবেন, মানে কবিতার পাঠে হোঁচট খাবেন না। এই হাইফেন-প্রেম শুভংকরের এ বই জুড়ে অসংখ্য স্বাক্ষর রেখেছে – সচেতনভাবে নাকি অভ্যাসে, তা জানি না। শুধু হাইফেনই বা বলি কেন, ‘কমা’ও কম যায় না। দুটি উদাহরণ দিই –

এক।। মুখ ফুটে আর কেউ বলে না,
‘ভ্রান্ত হব, ভ্রান্ত হব,
নদীর কাছে চলো।’ 

দুই।। - দু-হাতেই ছেড়ে রাখো যাকে
তাকে কি কখনও বলো, ‘সাড়া দাও’?

প্রথম ক্ষেত্রে সংলাপ ভিন্ন পংক্তিতে – বেশ, তাহলে প্রথম পংক্তির শেষে ‘কমা’টির দরকার কি? আবার দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সংলাপের আগে ‘কমা’র বিরতি একই পংক্তিতে, অথচ ‘সাড়া দাও’-এ পংক্তি ভাঙলে সংলাপের গুরুত্ব কি কিছুটা বাড়তো না?

‘দু-হাতেই’ লিখছেন অথচ অন্যত্র দু’জন মানুষ (প্রথম ভূমিকায়), সে’ শহরে (দ্বিতীয় ভূমিকায়), দু’ হাতে ভুলের স্মৃতি (বাস্তুভিটে) ...

আস্ত বইটা জুড়ে শব্দ চয়নে, বোধে ও যাপনে, চিত্রকল্প নির্মাণে এতো যত্নবান নিজস্বতায় আপ্লুত কবি যতিচিহ্ন ব্যবহারেও সচেতন হয়ে উঠুন শিগগির, কারণ –

জোনাকির দেহে তুমি হয়ে ওঠো রক্তের ডানা
কাজল দিয়েই রোজ এঁকে দাও নদীর সীমানা। 

[জরাকাল]

চিরায়ত বাঙলা কবিতার নিবিষ্ট পাঠকেরা আপনার থেকে আরো অনেক অনেক এরকম মৌলিকত্বের আশায় আকুল অপেক্ষা করছে, শুভংকর। আপনার কথার সূত্র ধরেই বলি -

সম্মতি দাও, সম্মতি দাও, আমরা তোমায় আগলে রাখি

0 comments: