0

প্রবন্ধ - সত্যম ভট্টাচার্য

Posted in

শীতের কথকতা

শীত মানে এক আশ্চর্য কুহক। শীত মানে রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে বারান্দায় কমলার খোসা ছাড়ানো আর মায়ের উল কাটা, বাবার রেডিওতে তখন অজয় বসু ইডেন গার্ডেন থেকে। শীত মানে চলে যাওয়া সময়, যাকে ফিরে পাওয়া যায় হাতে জ্যাকেটের পকেটের ওম থেকে। রোদ্দুরে মেলে দেওয়া লেপ আর সারাদিন বৃদ্ধের বসে থাকা তার জন্য। ওদিকে তারযন্ত্রে টংটং আওয়াজ তুলছে ধুনকর। সকাল থেকে কাজে বসে গেছে তারা আর তুলো উড়ছে সমানে। কোথা থেকে যেন উঁকি দিচ্ছে টকটকে লাল শালু। আবার হয়তো কদিন ধরে রোদই উঠলো না, শুধু কমলা বলটা সারাদিন ধরে এপার থেকে ওপার করলো। আর টুপটুপ করে ঝরে পড়লো অজস্র শিশিরবিন্দু, গাছের পাতা থেকে সারারাত টিনের চালে অথবা টিনের চাল থেকেই। এদিকে কুয়াশারা এসে উড়তে উড়তে লেগে যায় মাথার টুপিতে বা গায়ের চাদরে। তাদের গুঁড়ো গুঁড়ো রেণুতে কত ভালোবাসার কথা লেখা থাকে। সে ভালোবাসার জন্যে মাইলের পর মাইল হাঁটা যায় সকালের প্রাইভেট টিউশন বাদ দিয়ে, আলতো ঘষা খেয়ে যায় আঙ্গুলে আঙ্গুল। গাঢ় কুয়াশাতে কাছাকাছি এলে স্পষ্ট হয় অবয়ব আর তার আগে যাবতীয় ঝাপসা। কনকনে ঠান্ডায় থিরথির করে কাঁপা ঠোঁট অথবা সাড়া না দেওয়া আঙ্গুল তাজা হয় তামাকের সুঘ্রাণে। কখোনো আবার কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে যায় চশমার কাঁচ। ধোঁয়া উঠতে থাকে চায়ের গেলাস অথবা কফির কাপ থেকে। যত বুদবুদ তত আহ - অজ্ঞাতসারেই আস্বাদের শব্দ নির্গত হয়। এরকমই কোনও এক রোদ্দুরের সকালে তোরঙ্গ থেকে আত্মপ্রকাশ করে গরম জামা, উলিকট, সোয়েটার, মাঙ্কি টুপিরা। গায়ে তেল মেখে ঝপ করে কুয়ো থেকে জল ঢেলে নেয় কেউ আর হি হি করে কাঁপে, টোকা খায় দাঁতে দাঁত। কেউ আবার দাড়িয়ে থাকে আদুল গায়ে গরম জলের জন্যে। ধোঁয়া ওঠে রাস্তার পাশের ভাপা পিঠের দোকান থেকে, সেখানে কনকনে শীতে প্রতি ভোরে বা সন্ধ্যায় ছোট্ট উনুনে দোকান দেন পাশেরই গ্রাম থেকে আসা মাসী। পরতে পরতে প্রতি গ্রাসে তার স্বাদ বাড়ে, কোনো গহীন অন্তরালে লুকিয়ে থাকা খেজুর গুড়েরা চালান হয়ে যায় মুখের ভেতর ধীরে ধীরে। দূরে একা পড়ে থাকে ধান কেটে নেওয়া ন্যাড়া ক্ষেত, তাতে বিকেল বা সন্ধ্যাবেলায় পড়ে থাকা ধিমি ধিমি আগুন থেকে ধোঁয়া ওঠে মাঝে মাঝে পাক খেয়ে। ওদিকে আবার সকাল সন্ধ্যেতে কয়লার উনুনের ধোঁয়া জমে কাছে দূরে প্রান্তরে প্রান্তরে। সারাদিন ধরে উঠোনে ঝাড়বার পর চাষীবউ গোলাতে নিয়ে তোলে সমস্ত ধান। পৌষপার্বণ আসে। ঢেঁকি-ছাঁটা চালের পিঠে পুলির গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে আকাশ বাতাস। দোকানের শোকেস থেকে সাজানো নলেন গুড়ের সন্দেশেরা হাতছানি দিয়ে ডাকে। তার ম ম গন্ধে মনে পড়ে, এমনই এক শীতের সকালে বন্ধুর বাড়িতে সদ্য গাঢ় করা খেজুড় রস, গরম ভাজা মুড়ি আর জামবাটি ভর্তি গরুর দুধ পৌছে দিয়েছিল কোন তুরীয় আনন্দে। এ সমস্ত খবর নিয়ে পরিযায়ীরা উড়ে গেছে কতকাল... কত কত দূরে।

তারাও জানে যে শীতকাল আসলে ফ্যানাভাত হয়, নতুন কালো নুনিয়া চালের ফ্যানাভাত, তাতে ছোট ছোট লাল গোল আলু পড়ে, সর্ষের তেল আর কাঁচালঙ্কার গন্ধে মাতোয়ারা হয় ভুবন। রাস্তার পাশের দোকান থেকে লকলকে মাথা নেড়ে ডাক দিতে থাকে ধনেপাতারা আর তারপর ছড়িয়ে যায় তাদের সুঘ্রাণ নিয়ে একা অথবা যাবতীয় সুখাদ্যে। ডাকে পালং, তার আলু-বেগুন-ছিম-বড়ির পাতলা ঝোল যেদিন ছড়িয়ে যায় গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতে, কোথা থেকে যেন এক অপার্থিব আলো এসে পড়ে ডাইনিং টেবিলের ওপর। নিজের চারিদিকে সবুজের আস্তরণ নিয়ে বাজারে চলে আসে ফুলকপিরা। কোনো কোনো রাতে তারা ভেসে ওঠে মটরশুঁটিদের নিয়ে খিচুড়ির কড়া থেকে। মোড়ে মোড়ে বসে যায় হরেক চপ ভাজার দোকান। মাথায় টিমটিমে হলদে আলো নিয়ে সন্ধ্যে থেকে তাকে ঘিরে বসে থাকে ক’জন। কোথাও আবার ছোট্ট কুপি জ্বলে আর কথা চলে ফেলে আসা সময়ের। মনে পড়ে, এসময় মা রাঁধতেন বোয়ালমাছ, আলু-বেগুন-বড়ি-ধনেপাতা সহযোগে, রাতে তাকে রেখে দেওয়া হত পরদিন খাবার জন্য। আর পরদিন গরম ভাতের ওপর যখন সে সুখাদ্য গলে গলে যেত তার সোনালী রঙ নিয়ে - আহা সেসব আর বলবার নয়। এসময়ই বাজারে চলে আসে কালো হলদে ট্যাংরারা, ফুটফুটে পেঁয়াজকলির সাথে তার গা মাখা পাতলা ঝোল কোনো কোনো ছুটির দিনে শোভা পায় পাতে। হাঁক দিয়ে চলে যায় নকল জয়নগরের মোয়া, হোক না তা নকল, কিন্তু খেতে তো ভালোই। মনে পড়ে এসময় পুরোনো পাড়ার মাঠে খেলা হত দাড়িয়াবান্ধা - আজো কেউ খেলে কিনা সেসব সেখানে কে জানে। মা-কাকিমা-দিদি-বোন-আমরা ছোটরা মিলে খেলা হত। পাশেই ব্যাডমিন্টন খেলতো কেউ কেউ। শীত আসলেই তার কোর্ট কাটাকাটি আর নেট টাঙ্গানো, তারপর বড় হলে আলো জ্বালিয়ে রাতে। ওদিকে বড় মাঠে ক্রিকেটের পিচ কাটা হয়ে যাবে পুজোর পরেই। গাঁদা-ডালিয়া-চন্দ্রমল্লিকাদের জন্য জমি বানানো হবে। আর অপেক্ষা - কোনদিন দেখা দেবে প্রথম কুঁড়িটি। তাকে আবার আঙ্গুল তুলে দেখানো যাবে না। এসবের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে পিকনিকের দিন আর জায়গা। তা নিয়ে হাজার তর্ক-বিতর্কের পর শেষে গোসা করে মুখ ফুলিয়ে যাব না বলে বাড়ি চলে যাবে কেউ কেউ। শেষমেশ সেও কিন্তু যাবেই। সাউন্ডবক্স-ব্যাটারী চলে আসবে আগের রাতে, রাতভোর নেচে কুঁদে সে ফুরিয়ে যাবে একসময়। পরদিন তার আর আওয়াজ নেই। তবু যাওয়া হবে নাচতে নাচতেই। ট্রাক চলে আসবে ভোর ভোর। বেলুন টেলুন দিয়ে সুন্দর করে সে সাজবে। হৈ হৈ করতে করতে একসময় ছেড়ে যাবে। সেদিন দাদা প্রথম দিদির হাত ধরবে। পাহাড়ী নদীর বড় পাথরের আড়ালে চলে যাবে কেউ, রক্সি বা চুমু খেতে। শেষে গোল হয়ে নাচবে সবাই। দূরে কড়াতে টগবগ করে ফুটবে লাল মাংসের ঝোল। খেতে বসা হবে যখন চাঁদ উঠে গেছে আকাশে। একটা বড় চ্যাটালো পাথরের ওপর থালা নিয়ে পৌঁছে গেছে কজন। মনে পড়ে এমনই এক চড়ুইভাতিতে, সন্ধ্যে নামছে, প্রাথমিকে তখন, ফিরবো। ট্রাকের চাকা ঢুকে গেল নদীর নরম বালি মাটিতে, উঠছে না কিছুতেই। এদিকে স্থানীয় লোকেরা এসে বলছে - চলে যান এখুনি, পাহাড় থেকে মহাকাল বাবাদের নামার সময় হল। মায়ের কোলে বসে কাঁপছি ঠকঠক করে নদীর পাথরের ওপর। এভাবেই শীত আসলেই কত কত কথা মনের বন্ধ দরজা ঠেলে বের হয়ে আসে... মিশে যায় তারা নরম সোনালী রোদ্দুরে। রিক্ত মনে বসে থাকি স্মৃতিবিজড়িত শূন্য হৃদয় নিয়ে।

0 comments: