0

ধারাবাহিক - সায়ন্তন ঠাকুর

Posted in













(৬)

খর রোদ্দুরের মাঝখানে বয়ে গেছে রাস্তা। দুপাশে ফুটে আছে উত্তাপ। বয়ে গেছে মানুষজন কোলে নিয়ে ঠাণ্ডা সেডান। রাম নবমীর জৌলুস এবং মুখে স্কার্ফ জড়ানো যুবতির দল। তারা চলে গেছে সেই কোন সকালে। তখন দীঘির জলে টলটলে পদ্ম বেঁচে ছিল। এখন শুধু হাহাকারময় বাতাস, রাস্তার ওপর শুয়ে আছে গরম আলো। ঠাকুরাণি পাহাড়ের চুড়োয় মহুয়া ফুল ফুটেছে খুব। শাদা কুসুমে কুসুমে ছেয়ে আছে বনান্ত। ওই রাস্তার সঙ্গে তাদের পিরিত হয়েছিল গত মার্চে। একটা লোক হেঁটে পার হয়ে যাচ্ছে সেই রাস্তা। নীল পাঞ্জাবি মুছে যাচ্ছে লাল ধুলোয়। সব সম্পর্ক ফেলে রেখে মিশে যাচ্ছে পাথরে তার পায়ের ছাপ। আজ রাতে সিমলিপাল থেকে বৃষ্টি আর দুমুঠো বিদ্যুৎ নিয়ে আসার জন্য সে হেঁটে চলেছে দ্রুত। খর রোদ্দুর ছাতা হয়ে ফুটে আছে লোকটির মাথায়।

সবুজ দরজা পার হয়ে ভেতরে ঢুকলেই ভেসে আসে পুরোনো জনপদের ছায়া। ধূ ধূ বাতাসে দাঁড়িয়ে থাকা শাল গাছের হলুদ পাতার শব্দের নীচে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি আর গ্লাস নিয়ে বসে আছে এক বুড়ি। খড়ি ওঠা কালো চামড়ায় জেগে উঠেছে ধমনীর নদীখাত।সে নদীর নাম ডুলুং। সবুজ দরজা পার হয়ে তার কাছেই আসতে হয় বারবার।নদীর পাশে চেয়ার পাতা, ভারী কাঠের টেবিলে ঠাণ্ডা একগ্লাস জল, লেখার খাতা, ভারী ঝর্ণা কলম পরিপাটি করে সাজানো। পুরোনো ভালোবাসার মতো তার পাশে একমুঠো ধুতরো ফুল ছড়িয়ে রেখেছে কে যেন! নদীর ওপারে ঝলমল করছে নীল এটিএম। গত শীতে যে ডেবিট অথবা ক্রেডিট কার্ড হারিয়ে ফেলেছি স্বেচ্ছায়, এটিএম মেশিনের গায়ে আটকে আছে তারা। কিন্তু সন্ধে হয়ে এসেছে আজ। এপারে তুলসী তলায় জ্বলে উঠেছে প্রদীপ। গুমগুম শব্দে মেঘ জমছে ওই টেবিলে। মাধবীলতা আর চন্দনের গন্ধে বন্ধ হয়ে গ্যাছে সবুজ দরজা। কোথাও যাওয়ার নেই আমার। কত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, কত জ্বলন্ত বুদ্ধ বিহার, আগুন লেগে যাওয়া গেরস্ত উঠোন, কত একাকী সজল জানলার মুখে লেগে থাকা আফ্রোদিতির মুখ, অশ্বারোহী সেনা সব পার হয়েই তো আজ এই সন্ধের মুখে এসে দাঁড়িয়েছি। 

কোথায় যাব আর ?
রিজার্ভ স্লিপ ছাড়া অনধিকার প্রবেশের যা শাস্তি হয়, তুমি দাও, রেস্টহাউসের চৌকিদার, তুমি শাস্তি দাও আমায়। নির্বাসিত কর আমার সব কারুবাসনা। 


ঘুম ভাঙে হঠাৎ অমিতাভর ।সবুজ সমুদ্রে একটু একটু ফুটে উঠল আলো।পুরনো বাতিঘরের মতো জেগে আছে কবেকার এক ওয়াচ টাওয়ার। সিঁড়ির পাটাতনে ফার্ণের ঝোঁপ। শ্যাওলা রঙ ভালবাসায় ঘিরে রেখেছে তাদের।পাশেই করোগেটের চালওয়ালা একখানি ছোট বাংলো। রোগা বারান্দার ধারে দুটো ঘর। খোলা জানলা বেয়ে সকালের আলো ছুটে এসে ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে তুলছে গতরাতের সব অন্ধকারের টুকরো। নদীর জল যেন লেগে আছে সে আলোর শরীরে। কান পাতলে শোনা যায় কিশোরী মেয়ের হাসির শব্দ। বয়ে যাচ্ছে বাতাস। একটা গামহার গাছের পাতায় পাতায় লেগে আছে পরজীবি লতার ফুল। শেষরাতের শিশির মেখে সে ফুল এখন আরও বেগুনি। আপনমনে টুপটাপ খসে পড়ছে গাছতলায়। খয়েরি ছোপ লেগেছে ঘাসের গায়ে। বন বাংলোর চৌহদ্দি পার হলেই প্রায় মানুষ সমান উঁচু এলিফ্যান্ট ঘাসের বন। কোথাও মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে সরু সুঁড়িপথ, কোথাও আবার পথ নিজেই হারিয়ে গেছে ঘাসের শরীরে। গামহার খয়ের শাল গাছের পুরনো মহল্লায় তারপর একসময় পাতলা এসেছে ঘাসবন নিজেই। তখন শুধু দম বন্ধ করা গাছের সারি। অনেক উঁচু হয়ে আকাশে ছড়িয়ে দিয়েছে নিজেদের। সবুজ পাতার নিজেদের মধ্যে মিলেমিশে তৈরি করেছে চন্দ্রাতপ। ওই উঁচু ওয়াচ টাওয়ারের মাথা থেকে মনে হয় অনন্ত কোনও সবুজ সমুদ্র। বাতাসের ইশারায় ঢেউ ওঠে তার শরীরে। সবুজ রঙের গন্ধ লোনা জলের মতোই আছড়ে এসে পড়ে। এখন পাতাদের যদিও হলুদ হয়ে ওঠার সময়। আকাশকে কিছু নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে তারা খসে যাবে। হারিয়ে যাবে তাদের একচক্রা জীবন। আবার নতুন পাতা কুঁড়ির মতো ফুটে উঠবে। খাবার তৈরি করবে। তারপর আবার হলুদ শীতার্ত দিন গ্রাস করবে। বারবার আসা আর যাওয়া। যাওয়া আর আসা। তবু কী হাসি ওদের মুখে। ঘন নীল আজ আকাশ। অনেকদিন পর তার গায়ে পিছলে যাচ্ছে রোদ্দুরের আলো।

সে আলোর ছটায় ঘুম ভাঙল অমিতাভর। একফালি ছোট কাঠের চৌকির ওপর দামাল শিশুর মতো গলা জড়িয়ে আদর করে গেল বাতাস। কোন জন্মের পার থেকে একটা হিল ময়লা শিস দিয়ে উঠল কয়েকবার। ব্বাক ব্বাক শব্দ তুলে মিলিয়ে গেল চকিতে কোনও কোটরা হরিণের ডাক। আবার একটা নতুন দিন। রাতচরা পাখিদের বিশ্রামের দিন। কোনও একাকী বাঘের ক্লান্তিময় সকাল। সারাদিন হয়তো ঝোরার পাশে বিশ্রাম করবে সে। গাছ ছায়া দেব ওই সুপুরুষ প্রাণীকে। আনমনা পাতা, দু এক টুকরো বুনো ফুল নেমে আসবে পেলব মসৃণ চকচকে দেহ ত্বকে। তারপর রোদ্দুর যখন সম্বরণ করবে তার উষ্ণতা, হলুদ হয়ে আসবে চরাচর, অপার্থিব সন্ধের মুখে স্নান শেষে উঠে আসবেন মায়া দেবী, তাঁর শরীরের সুবাসে অস্পষ্ট অবশ হয়ে আসবে এই দৃশ্যমান জগত তখন হয়তো সে উঠে দাঁড়াবে। মুখ তুলে জানান দেবে নিজ অস্তিত্ব। সজল মেঘের মতো তার গম্ভীর বিষাদময় ডাকে চমকে উঠবে বনস্থলী। 

ভারী অবাক হয়ে চেয়ে থাকে অমিতাভ এই অপূর্ব দিন ও রাতের দিকে। কতদিন হয়ে গেল, কত বিভিন্ন বনবাংলোর গেরস্থালির মায়ায় কেটে গেল তার কত সন্ধে কত নতুন আলোর সকাল। বৃষ্টি এল, গাছদের সবুজ রঙ ছিটকে এসে লাগল চোখে মুখে। রাতের অঝোর ধারায় লণ্ঠনের আলোর দিকে ছুটে এল কত পোকার দল। দাওয়ায় উঠে এল লাজুক কেন্নো।ওরাও তো এই মায়া ভূখণ্ডের অংশীদার। আজকাল কোথা থেকে এক মন অবশ করা স্নেহ এসে গ্রাস করেছে অমিতাভকে। এখানে অবুঝমারের মতো মারিয়াদের ঢোল শোনা যায় না। রাতের অন্ধকারে জ্বলে ওঠে না কোনও নাচের সুর। এ যেন বৃক্ষদের সাম্রাজ্য। যুথপতির মতো তারাই রক্ষা করে এই জগত। অমিতাভ চুপ করে বসে সারাদিন তাদেরকেই দ্যাখে। তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে ঝরে পড়া বৃদ্ধ পাতার চলন দ্যাখে। আবার ওই যে কচি সবুজ পাতা, কী সপ্রাণ আনন্দময় তার উপস্থিতি। ওই যে খয়েরি বাকলের বিরাট শাল গাছ, গম্ভীর, যেন কোন যুগ থেকে অখণ্ড স্বরূপের সন্ধানে ডুব দিয়েছে নিজের অতলে। আবার চনমনে ওই লতা, উচ্ছল যুবতী, সদ্য বিয়ের সিঁদুরের দাগ যেন স্পষ্ট শরীরে।

কাল মরে আসা বিকালে, আলো পড়ে এসেছে তখন, কী এক মন খারাপ করা বাতাস ভেসে আসছে কোথা থেকে, আসন্ন শীতের নিঃস্পৃহতার ধূসর রঙ সে বাতাসে, একটা বুড়ো অর্জুন গাছের দিকে চেয়েছিল অমিতাভ। হঠাত তার কেদার রাজা উপন্যাসের কেদার রাজার কথা মনে এল! আর সঙ্গে সঙ্গেই সেই মানুষটার কথাও! মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি, সরু পাড়ের ধুতি, ঘাটশিলায় সুবর্ণরেখার তীরে এক শিলাসনে বসে আছেন! তিনিই যেন ওই অর্জুন গাছ! তেমনই মগ্ন আত্মহারা। এই সন্ধের গায়ে হেলান দিয়ে দূর আকাশের দিকে কী যেন খুঁজছেন! দু একটি মৃদু তারার আলো সম্বল করে পার হয়ে যাচ্ছেন কোন অচেনা নক্ষত্রলোক। আকাশগঙ্গা বেয়ে বয়ে যাচ্ছে তাঁর অলৌকিক জীবন। আর ওই যে সবুজ লতানে এক গাছ, অর্জুন গাছের গা বেয়ে উঠে এসেছে। সে যেন ওই নির্লিপ্ত অর্জুন গাছের একমাত্র জাগতিক বন্ধন। ভালবাসা। আকণ্ঠ প্রেম। তারই টানে যেন ওই বুড়ো গাছ এখনও বেঁচে আছে এই মর পৃথিবীর বুকে। যেন গৌরীদেবী! 

আহা! ওঁরা থাকুন। সন্ধে হয়ে আসছে। তাঁদের নিভৃত প্রেমের দৃশ্য থেকে আস্তে আস্তে সরে এল অমিতাভ। কী এক অদৃশ্য ভালবাসার স্রোত তখন ঘিরে ধরেছে তাকে। সে কী গাছদের ভালবাসা ? বিগত বা আগামী জন্মের কোনও মায়া কল্পনা ? নিজেও ভালো জানে না অমিতাভ!

0 comments: