প্রবন্ধ - অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধ
(দ্বিতীয় পর্ব)
ভারতে মুসলিম শাসকদের প্রভাবে বাংলা ভাষায় প্রচুর পরিমাণে আরবি-ফারসি শব্দ ঢুকে পড়ে। কারণ মুসলিম শাসকরা হয় আরব দেশ, নয় মঙ্গোলিয়া, নয়তো আফগানিস্তান থেকে এসেছিলেন। রাজভাষাই হল সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা কাজের ভাষা। সুলতানি শাসনামলে আরবি ছিল বাংলার মুসলমানদের ভাষা, ধর্মীয় ভাষা। আর ফরাসি ছিল রাজ-সরকারের ভাষা।তৎকালীন সময়ে ফারসি রাজভাষা হলেও গৌড়ের স্বাধীন সুলতানেরা দেশি বাংলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সেসময় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু প্রজাদের সহানুভূতি ও সমর্থন লাভের জন্য প্রচুর যোগ্য হিন্দুদের বড়ো বড়ো রাজপদে নিয়োগ করেন। মুসলিম শাসকদের উদারতায় মুসলিম শাসনের উপর হিন্দু প্রজাদের আস্থা বৃদ্ধি পায়। সেই আস্থা থেকে হিন্দু কর্মচারীরা রাজভাষা ফারসি শিখে নিলেন এবং মুসলিম শাসকদের রাজকার্যে সহযোগিতা করতে শুরু করেছিলেন। মুসলিম শাসকরাও হিন্দু কবিদের কাব্যচর্চায় উৎসাহ দিতে থাকলেন। তেরো শতকের শুরুতেই বহিরাগত তুর্কি সেনারা ধর্মে ইসলাম অনুসারী হলেও সংস্কৃতিতে পারসিক বা ফারসি। তাঁরা বাড়ির ভিতর নিজেদের মধ্যে তুর্কি ভাষায় কথাবার্তা বললেও রাজদরবারে সরকারিভাবে ফারসি ভাষায় কাজকর্ম করতেন। আবার ধর্মাচরণে ব্যবহার করতেন আরবি ভাষা। এভাবেই রাজার ভাষার প্রভাব প্রজাসাধারণের উপর পড়তে শুরু করে দেয়।
চোদ্দো শতকের শেষ দিকে বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ’, মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’, বিজয়গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল’, বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের ‘মনসাবিজয়’, কবীন্দ্র পরমেশ্বরের ‘মহাভারত পাঁচালী’, শ্রীকর নন্দীর ‘অশ্বমেধ পর্ব’, দ্বিজ শ্রীধরের ‘বিদ্যাসুন্দর’, শাহ মোহাম্মদ সগিরের ‘ইউসুফ জোলেখা’-র মতো কালজয়ী কাব্য রচিত হয়েছিল। শাহ মোহাম্মদ সগিরের ‘ইউসুফ জোলেখা’-ই ছিল প্রথম মুসলমান রচিত বাংলা কাব্য।
এ সময়ই মুসলমান শাসনের প্রভাবে বাংলা ভাষায় প্রচুর পরিমাণে আরবি, ফারসি, তুর্কি শব্দ ঢুকে পড়ে। বাংলা ভাষার সঙ্গে আরবি-ফারসির মিশ্রণে এক অন্য ধারার বাংলা ভাষার উদ্ভব হল। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার শেষ স্বাধীন পাঠান সুলতান দাদ খাঁ কররানির পতন পর্যন্ত গৌড়ের দরবারে বাংলা ও সাহিত্যের প্রভূত কদর ছিল। সেই সময়ে স্থানীয় প্রজাদের সঙ্গে দরবারের লোকজনদের ওঠা-বসা, লেনদেন ও ভাবের আদানপ্রদানে বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এও আরবি-ফারসির ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটে যায়। তবে মোগল শাসকরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি বিশেষ আগ্রহ না-দেখালেও সে সময়ের দেশীয় রাজ্যের রাজারা ও স্থানীয় জমিদারদের পৃষ্টপোষকতায় সাহিত্য ধারা অব্যাহত ছিল। এ সময়ই বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার আরও বেশি বৃদ্ধি পায়। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কাব্যে জনজীবনে বহুল ব্যবহৃত তদ্ভব ও দেশি শব্দের পাশাপাশি আরবি-ফারসি শব্দও স্থান পেয়েছে। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের কাব্যও আরবি-ফারসি শব্দের কুশলপ্রয়োগরীতি তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য সুললিত করেছে। আঠারো শতক নাগাদ রামমোহন রায়ের মতো হিন্দু ব্যক্তিত্বরাও আরবি-ফারসি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। কৃত্তিবাস ওঝাই প্রথম সেই বিদ্রোহী, যিনি সংস্কৃত ভাষায় রচিত ধর্মকথা বাংলা ভাষায় লেখার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বাংলা ভাষায় রামায়ণ অনুবাদ করেন। এরপর বাংলার সুলতানদের এবং দরবারের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রেরণায় সংস্কৃত ছেড়ে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চাতে মনোনিবেশ করেন বাংলার কবিগণ। তবে একথাও মনে রাখা দরকার, সংস্কৃত রাজভাষার মর্যাদা হারালেও মুসলমানদের একটা অংশ সংস্কৃত চর্চা করতেন। কিন্তু সুলতানেরা পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষায় রচিত সাহিত্যগুলি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করাতে উৎসাহ জুগিয়ে যেতেন। সুলতানদের পৃষ্টপোষকতায় বাংলা ভাষায় অনূদিত হতে থাকল রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবতের মতো গ্রন্থগুলি। উদারমনস্ক মুসলিমদের প্রচেষ্টাতেই সংস্কৃত ভাষায় রচিত ধর্মগ্রন্থগুলি আমরা বাংলা ভাষাতে পাই। তবে সবাই তো উদারমনস্ক হতে পারে না। কিছু সংকীর্ণমনা মওলানা ধর্মগ্রন্থগুলি বাংলা অনুবাদে কাঠি দিয়ে থমকে দিতে সক্ষম হয়েছিল। এমনকি ফারসি ভাষাতে কোরান অনুবাদ করতে গিয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ একদল মৌলভি দ্বারা প্রাণ হারাতে বসেছিলেন। এরপরেও পাশাপাশি মুসলিম লেখকরা সংস্কৃত গ্রন্থগুলি আরবি-ফারসি ভাষাতেও অনুবাদ করতে থাকেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদারের মতো লেখকদের বাংলাতে আরবি-ফারসির ব্যবহার বৃদ্ধিতে বাংলা ভাষার এক অন্যরকম শ্রীবৃদ্ধি হয়। তবে কাজী নজরুল ইসলামের কবি-সাহিত্যিকদের বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি মুখর হয়ে উঠল। কাজী নজরুলের বাংলা ভাষার একটা নমুনা দিই। তাহলে ব্যাপারটা একটু বোঝা যাবে – “আমি আল্লার ডাকে ছুটে যাই যবে তুমি মোনাজাত করগো নীরবে/তুমি যে খোদার দেওয়া – সওগত সম বেহেস্তের সাথী/তুমি যে ঈদের চাঁদ/তব তরে জাগিয়া কাটাই রাতি/তুমি নারী আগে আনিলে ইমান দীন ইসলাম পরে/তুমি যে বিজয়ী খোদার রহম আনিয়াছ জয় করে।” অথবা “আসিছেন হবিবে খোদা, আরশ পাকে তাই উঠেছে শোর/চাঁদ পিয়াসে ছুটে আসে আকাশ পানে যেমন চকোর/কোকিল যেমন গেয়ে ওঠে ফাগুন আসার আভাস পেয়ে/তেমনি করে হরষিত ফেরেশতা সব উঠলো গেয়ে।” এখানে লক্ষ করুন ‘আল্লা’, ‘মোনাজাত’, ‘খোদা’, ‘সওগত’, ‘বেহেস্ত’, ‘ইমান’, ‘দীন’, ‘রহম’, ‘হবিবে’, ‘আরশ’, ‘পাক’, ‘শোর’, ‘পিয়াসে’, ‘ফেরেশতা’ শব্দগুলির ব্যবহার একমাত্র মুসলিম কবি-সাহিত্যিকরাই করতেন। হিন্দু বাঙালি সাহিত্য ও মুখের ভাষায় পর্দা, দৌলত, মস্তান, বাবা ইত্যাদি আরবি-ফারসি শব্দগুলির ব্যবহার করলেও নজরুল ব্যবহৃত শব্দগুলি কখনোই ব্যবহার করেনি। যদিও বহু হিন্দু ব্যক্তিত্ব আরবি-ফারসি ভাষাশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন, তা সত্ত্বেও আরবি-ফারসি যথেচ্ছ ব্যবহার করেননি। বরং বলা ভালো পর্তুগিজ, ইংরেজি, জাপানি, তুর্কি ইত্যাদি সমস্ত বিদেশি শব্দ আত্মসাৎ করে হিন্দুদের এক বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। এমন অনেক বিদেশি শব্দ হিন্দু বাঙালিদের বাংলা ভাষার সঙ্গে মিশে আছে, সেসব শব্দ যে বাংলা নয়, একথা বিশ্বাসই হয় না। কয়েকটা উদাহরণ রাখা যাক – আরবি: আক্কেল, আসল, এলাকা, ওজন, খবর, খালি, খেয়াল, গরিব, জমা, জিনিস, তারিখ, বদল, নকল, বাকি, হিসাব ইত্যাদি। ফারসি: আন্দাজ, আয়না, আরাম, আস্তে, কাগজ, খারাপ, খুব, গরম, চশমা, চাকরি, চাদর, জায়গা, দেরি, বাগান, রাস্তা, পছন্দ, হিন্দু (ধর্ম অর্থে নয়, ভারতীয় বা ভারতবর্ষীয় অর্থে) ইত্যাদি। তুর্কি: দাদা, বাবা, চাকর, চাকু, তোপ ইত্যাদি। জাপানি: বোকা, হাসি, চা, লিচু, রিকশা ইত্যাদি। ওলন্দাজ : ইস্কাবন, রুইতন, হরতন, টেক্কা, তুরুপ ইত্যাদি। পর্তুগিজ: ইস্ত্রি, আলমারি, ইস্পাত, চাবি, জানালা, তামাক, পেরেক, বারান্দা, ফিতা, বোতাম, সাবান, কাজু, পেঁপে, পেয়ারা ইত্যাদি। ইংরেজি: আফিম, অফিস, জেল, পুলিশ, ব্যাংক, ভোট, কাপ, গ্লাস, চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি। উল্লিখিত শব্দগুলি বিদেশি শব্দ বটে, কিন্তু এগুলিও বাংলা ভাষা হয়ে গেছে। অথচ এগুলি কোনোটাই বাংলা শব্দ নয়। যদিও শব্দগুলি হিন্দু-মুসলিম বাঙালি নির্বিশেষে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করে থাকে। তবে কিছু ক্ষেত্রে ব্যাপক আরবি-ফারসির ব্যবহার উভয় সম্প্রদায়ের বাঙালিই করে। আজও বাড়ির দলিল-দস্তাবেজে আরবি-ফারসির আধিক্য বহমান। বিশুদ্ধ বাংলায় জমির দলিল লেখার প্রচলন হয়নি। তার কারণ দলিল-লেখকদের একটা বড়ো অংশই মুসলিম সম্প্রদায়ের।
এখন কথা হল হিন্দু বাঙালিদের বাংলা ভাষার চেয়ে মুসলমানদের বাংলা ভাষা আরবি-ফারসির এত আধিক্য কেন? কেন এমন সব আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হয়, যা হিন্দু বাঙালিরা ব্যবহার করে না? এরও একটা ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
বস্তুত বাঙালি মুসলমান এবং বাঙালি হিন্দুর ভাষা এক হলেও উভয় পক্ষের শিক্ষাদীক্ষা এবং ধর্মীয় আদর্শে স্বাতন্ত্র আছে। এজন্য একের আদর্শ, ভাব, চিন্তাপ্রণালী ঠিক অন্যের মতো কখনোই হতে পারে না। তার মানে বাঙালি বলা যাবে না, তা তো হয় না। ধর্ম এক হয়েও ভাষা ও মানসিকতার পৃথকতা থাকে। মেদিনীপুরের ভাষা ও মানসিকতা আর উত্তর ২৪ পরগনার ভাষা ও মানসিকতা পৃথক, তেমনি বরিশালের ভাষা ও মানসিকতা আর সিলেটের ভাষা ও মানসিকতাও পৃথক। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও উভয়ের ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গি আছে, থাকবেও। ভারত ভাগের পর এই সীমারেখা আরও স্পষ্ট হয়ে যায় আড়াআড়িভাবে। কারণ ভারত ভাগের আগে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে কলকাতার লেখক-সাহিত্যিকদেরই একাধিপত্য ছিল। যদিও বাংলা সাহিত্যের আধুনিককাল আরম্ভ হয়েছিল পশ্চিমবাংলার মানুষের হাত ধরে, তবু সে সময় পূর্ব বাংলার মানুষ ভাষা-সাহিত্যে পশ্চাৎপদ ছিল, একথা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই। কিন্তু বাংলা ভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছিলেন মুসলিম শাসকেরা। সে কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তাঁরাই বাংলা ভাষাকে সাহিত্যের ভাষা বানিয়েছিলেন। মুসলমানদের উৎসাহেই বাংলা ভাষার প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। ১৭৫৭ সালে শাসন-ক্ষমতা হারানোর শোকে মুসলমানেরা নতুন শাসক বৃটিশের সঙ্গে অসহযোগিতা করতে শুরু করল। ফলে মুসলমান কোন মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়নি। যখন তৈরি হয়েছিল, তখন বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। ফরায়েজি আন্দোলনের হোতারাই এর জন্য দায়ী। তাঁরা মুসলমানদের আধুনিক ও ইংরেজি শিক্ষা থেকে দূরে নিয়ে যান। এটা পিছিয়ে দেয় মুসলমানদের অনেক বছর। প্রায় শতাধিক বছর। আর সেসময়ে হিন্দু সমাজে বিদ্যাসাগরের মতো মানুষরা জন্ম নিয়েছিলেন, যাঁরা শিক্ষায় নিজের সমাজকে অনেক এগিয়ে নিয়ে যান। মুসলিম সমাজে তাঁর মতো কেউ এখনও জন্ম নেননি। যখন মুসলমানরা সম্বিৎ ফিরে পেয়েছিল তখন কানাকড়িও ছিল না, লেংটিই হয়েছিল সম্বল। শিক্ষায় দীক্ষায় জ্ঞানে চিন্তাধারায় হিন্দু সম্প্রদায়ের থেকে মুসলমান সম্প্রদায় বহু যোজন দূরে পিছিয়ে পড়ল। তার প্রভাব ভাষাতেও পড়ল। হিন্দুরা বেশি করে ইংরেজি আঁকড়ে ধরল। আর মুসলমান বেশি বেশি করে আরবি-ফারসি আঁকড়ে ধরল। ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে বাংলায় যে রেনেসাঁ এসেছিল, তার ভাগিদার ছিল না মুসলিমেরা। তারা ইংরেজি শিক্ষা নেয়নি বলেই। এটা তো ঠিক, ইংরেজি না জানলে সে আমলে অন্তত রাজানুকূল্য পাওয়া যেত না। যেটা ঘটেছে মুসলিমদের সঙ্গে। বৃটিশরাজের আনুকূল্য থেকে মুসলমানরা চরমভাবে বঞ্চিত হল। যখন এদেশে মুসলিম শাসন ছিল, তখন ফারসি ভাষার ছিল জয়জয়কার। লক্ষ করে দেখবেন, অনেক হিন্দুও ফারসি শিখেছিল সেসময়ে, যাতে তাঁরা রাজদরবারে মুন্সির চাকরি পায়। ইংরেজি না শেখায় মুসলমানেরা সরকারি চাকরিতেও ছিল খুব কম।
ইংরেজদের বিরোধিতা করতে গিয়ে মুসলমানদের যে ক্ষতিসাধন হয়েছিল, তা কোনোদিনই পূরণীয় নয়। ইংরেজ শাসনের প্রতি মুসলিম প্রজাদের আস্থাহীনতা চরম ক্ষতি করেছে মুসলিম সম্প্রদায়ের। আবেগের দিক থেকেও মুসলিমরা ইংরেজ শাসন মেনে নিতে পারেনি। তার উপর ইংরেজরা যখন হিন্দুদের নানা সুবিধা দিতে থাকে, সেটা তাদের মনে অসন্তোষের জন্ম দেয়। তারা সবক্ষেত্রে ইংরেজদের অসহযোগিতা করতে থাকে, আর ফলাফলে পিছিয়ে পড়ে। ১৭৯৩ সালে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চালু করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এতে বাংলার হিন্দু জমির মালিকরা রাতারাতি সব জমির একমাত্র মালিক হয়ে যায়। তাদের ক্ষমতা ও আভিজাত্য বেড়ে যায় অনেক। আর দরিদ্র মুসলিম কৃষক, কৃষিকাজ করাটা আগে যাদের ছিল ইচ্ছাধীন, হিন্দু জমিদারির আওতায় আসাতে সেই প্রভুর জমিতে কাজ করতে ও জোরপূর্বক কর দিতে তাদের বাধ্য করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই বিপরীত ব্যাপার ঘটে হিন্দুদের ক্ষেত্রে। আগে রাজস্ব আদায়ের যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল, সেখানে মুসলিমদের সরিয়ে দেয় ইংরেজরা। বদলে তারা অনুগত হিন্দুদের নিয়োগ করে উচ্চপদে। সুতরাং অভিজাত মুসলিমরা আর্থিক সংকটে পড়ে যায়। পশ্চিম বাংলায় তিতুমিরের নেতৃত্বে ১৮২৭-১৮৩১ পর্যন্ত চলে বিদ্রোহ। এই দুই আন্দোলনে সহিহ মুসলিম হওয়ার তাড়নায় বাংলার মুসলমানেরা ধর্মীয় শিক্ষাকে অনেক বেশি আপন করে নিতে থাকে। ইসলাম ধর্মে অনৈসলামিক আচার ছেড়ে ফরজ পালনে মুসলমানরা উৎসাহী হয়ে পড়েছিল। কিন্তু অমিল হল, হিন্দুরা শিক্ষাগ্রহণে সমাজে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে, কিন্তু মুসলমানেরা পারেনি। অথচ ঠিক এমন সময়েই বাংলার হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধুনিক শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে থাকে। এ সময় একে একে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, অ্যাংলো হিন্দু কলেজ, সংস্কৃত কলেজ ও বেদান্ত কলেজ। মোটকথা, কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষাক্ষেত্রে হিন্দুরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকে। কিন্তু বাংলার অধিকাংশ মুসলিম, যাঁরা গ্রামবাসী ও কৃষক, তাঁরা এ দুইটি আন্দোলনের প্রভাবে যত বেশি ইসলামসংলগ্ন হয়ে পড়েন, ততটাই দূরে সরে যান ইংরেজি ও আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ থেকে। এদিকে হিন্দুরা যত বেশি ইংরেজ হয়ে উঠছিল, মুসলমানরা তত বেশি আরবি হয়ে উঠছিল। অথচ পরিস্থিতি অন্যরকমও হতে পারত। হিন্দুরাও যদি ইংরেজদের সবরকমভাবে বর্জন করতে পারত, তাহলে ইংরেজরা ২০০ ভারতে রাজত্ব করতে পারত না। আধুনিক শিক্ষা গ্রহণে মুসলিমদের অনীহার বিষয়টা এখন যতই সমালোচনা করি না-কেন, তখন যদি হিন্দু-মুসলিম একই সঙ্গে এই ইংরেজি শিক্ষাটা না নিত, তাহলে কিন্তু ইংরেজদের পক্ষে ইংরেজির জন্য একটা পূর্ণ বিকশিত মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি গঠন করা সম্ভব হত না। এই মধ্যস্বত্বভোগী কেরানি শ্রেণিটাই কিন্তু ইংরেজদের আরও দেড়শত বছর উপমহাদেশ শাসন করতে সাহায্য করেছিল। আধুনিক শিক্ষাগ্রহণে মুসলিমদের অনীহার বিষয়টাকেই কিন্তু গান্ধীর অহিংস নীতির মতো একটা ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে পরিণত করার সুযোগ ছিল উপমহাদেশের নেতাদের। সেটা সফল হওয়ার সম্ভাবনাও থাকত, বিচ্ছিন্ন সশস্র আন্দোলনের চেয়ে জোরদার হত। কারণ সরাসরি যুদ্ধের সুযোগ সেখানে ইংরেজদের থাকত না। ইরেজ শাসনের ২০০ বছরে ২৪০-৩৫০ ট্রিলিয়ন পাউন্ড ভারত থেকে ইংল্যান্ডে পাচার হয়েছে। এই পাচারকৃত অর্থের বেশিরভাগই বন্ধ করে দেওয়া যেত, যদি ইংরেজি-বিরোধী আন্দোলনটাকে হিন্দু-মুসলিম যৌথভাবে একটা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পরিণত করতে পারত ১৮৫৭ সালের আগেই।
এবার হয়তো অনেকে বলবেন, তাহলে হিন্দুরাও তো মুসলমানদের মতন অশিক্ষিত হয়ে পড়ত, সমাজে পিছিয়ে পড়ত। এ প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য পরিষ্কার – ইংরেজি ভাষা না শিখলে জীবনে কোনো উন্নতি করা যাবে না, এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। পৃথিবীর এরকম বহু দেশ আছে যেখানে ইংরেজি ভাষাকে বর্জন করেও উন্নতির শিখরে। থাইল্যান্ডে কখনো ইংরেজ বা অন্যদের কলোনি ছিল না। থাইল্যান্ডের উন্নতি কি এগিয়ে থাকা কোনো দেশ থেকে কম? ভারতীয়রা হাজার বছর আগে থেকেই আরব বণিকদের সঙ্গে সফলভাবে বাণিজ্য করেছে ইংরেজি না জেনেই। ভাষা কখনোই অন্তরায় হয়নি। চিনেও ইংরেজরা তেমন কলকে পায়নি। চিন এখন উন্নতির শীর্ষে। জাপান ইংরেজি ভাষাকে ঘৃণা করে, জাপানি ভাষাকেই সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেয়। চিন আর জাপানে বেশিরভাগ মানুষ ইংরেজি ভাষা জানে না। জাপানে উন্নতি হয়নি? মানুষ নিজেদের উন্নয়নের পথ খুঁজে নিতে পারে, ইতিহাস সাক্ষী। আবার পশ্চিমী দুনিয়ায় বেশিরভাগ মানুষ যে চাইনিজ বা জাপানিজ ভাষা জানে না, তাতে ব্যবসা-বাণিজ্য তো থেমে থাকেনি সে সব দেশের মধ্যে। যে সময় বৃটিশ সারা বিশ্বে উপনিবেশ বানায়নি, তখনও জ্ঞান চর্চা থেমে থাকেনি।
কিন্তু ভারত তথা বাংলায় বৃটিশদের উপনিবেশের ফলে বাংলার বাঙালিরা ভাষা সংকটের মধ্যে পড়ে গেল। ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষা করাই দায় হয়ে পড়ল। ভাষা এখন বিশুদ্ধতা ছাড়িয়ে সংকর ভাষায় রূপ পরিগ্রহ করেছে। বাঙালির বাংলা ভাষা বিদেশি ভাষার মোড়কে সেজে উঠেছে। হিন্দু বাঙালির ভাষায় ইংরেজি, আর মুসলিম বাঙালির আরবি। পশ্চিমবাংলার ইংরেজি জানা বাঙালিদের কথোপকথনে কান পাতলেই টের পাবেন তাদের মুখের ভাষার বিশেষ বিশেষণ বেশিরভাগই ইংরেজি, তার ক্রিয়াপদ ও সর্বনামই শুধু বাংলা। সাধারণ মানুষের মুখে ভাষাতেও ইংরেজি কথা, যা তদ্ভব আকারে নিত্য চলছে। যেমন – পেনসিল, টেবিল, চেয়ার, হোটেল ইত্যাদি। বাঙালিরা নিত্যব্যবহার্য শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ দেখুন জাপানিরা ইংরেজির পরিবর্তে জাপানি প্রতিশব্দ ব্যবহার করে। জাপানি ভাষায় যথাক্রমে এমপিকচিল, চুকুয়ে, ইছু, হোতেরু ইত্যাদি।
বর্তমানে ইংরেজি শব্দ যেমন বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়েছে, তেমনি ইংরেজরা ভারতে শাসক হওয়ার আগেও অন্য নানা বিদেশি ভাষা আমাদের পূর্বপুরুষদের ভাষার ভিতর অবলীলায় ঢুকে পড়েছিল। বাংলা ভাষার শরীরে সেসব শব্দগুলি এমনভাবে গেঁথে গেছে যে, সেগুলি বিদেশি ভাষা কি না জানিই না। যেমন – ঠান্ডা, আলু, মাছ, জুয়ো, তে-রাস্তা ইত্যাদি। ভারতে উপনিবেশের আগেও বিদেশিদের নিত্য আনাগোনা ছিল। নবাবি আমলেই কবি ভারতচন্দ্রের লেখা থেকেই জানতে পাই, তাঁর সময়ে বিলেতি জাতি বাস করত। যেমন – ফিরিঙ্গি, ফরাসি, আলেমান, ওলন্দাজ, দিনেমার, ইংরেজ প্রমুখ। উল্লিখিত ছটি জাতের মধ্যে প্রথম দুটি ভাষাকে বলে রোমান্স (Romance) ভাষা, বাকি চারটিকে বলে জার্মানিক (Germanic) ভাষা। এই রোমান্স ভাষাই দেদার বাঙালির ভাষা, যা অজ্ঞাতসারে বাংলা ভাষায় বিলীন হয়ে গেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, নবাবি আমলেই বাংলা ভাষা দু-হাতে বিদেশি শব্দ আত্মসাৎ করে নিজের দেহকে পুষ্ট করেছে। বিদেশি শব্দকে স্বদেশি করাই হচ্ছে বাংলা ভাষার চিরকালের ধর্ম।
কিন্তু বিদেশি তথা ইংরেজি ভাষা বাংলা ভাষাকে এতটাই গ্রাস করে ফেলেছিল যে, সাহিত্যসম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও মাঠে নামতে হয়েছিল। শুরু করলেন ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার প্রকাশ। উদ্দেশ্য: ‘ইংরেজিপ্রিয় কৃতবিদ্যদের’ এবং ‘সংস্কৃত পণ্ডিত্যাভিমানীদের’ উভয় গোষ্ঠীকেই নিন্দা করা। বঙ্কিমচন্দ্র সাধারণ সাহিত্যসেবী ছিলেন না। তিনি ছিলেন কায়মনোবাক্যে স্বদেশের, স্বদেশবাসীর মঙ্গলকামী। নিজেদের আত্মসম্মানে উজ্জীবিত করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। (চলবে)
0 comments: