প্রবন্ধ - রঞ্জন রায়
Posted in প্রবন্ধ
গোঁপের আমি গোঁপের তুমি
আনন্দবাজারের প্রাক্তন সাংবাদিক বন্ধুবর মিলন দত্ত মশায় এবং তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক তপস্যা ঘোষ ‘বিতর্কিকা’ বলে একটি অতীব স্বাদু প্রবন্ধের পত্রিকা প্রকাশ করে থাকেন। কয়েক দশক আগে তার একটি সংখ্যায় থীম ছিল বাঙালী, অর্থাৎ বাঙালী বলতে আজকে কী বোঝায়। তাতে অশোক মিত্র, শঙ্খ ঘোষ, একরাম আলি এবং আরও অনেক প্রবুদ্ধজনের মতামতের সংকলন ছিল। আলোচনায় তর্কবিতর্কে উঠে এসেছিল কয়েকটি লক্ষণ, যথা খাওয়াদাওয়া, পোষাক এবং অবশ্যই ভাষা।
আমার মত গোলা পাঠকের মনে হয়েছিল যে এদের গুরুত্ব কম না করেও যদি কোনও একটি লক্ষণকে গুরুত্ব দিতেই হয়, তবে তা হবে বাংলা ভাষা যা আমাদের মাতৃভাষা। অন্তত হিন্দিবলয়ে দীর্ঘকাল বসবাসের ফলে এটাই মনে হয়েছে। ছোটবেলা থেকে আমাদের জিভ যে ভাবে বিভিন্ন স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণকে উচ্চারণ করে অভ্যস্ত, তা অন্য ভাষায় বিপর্যয় ঘটায়; ব্যস, আমরা ধরা পড়ে যাই। ক’টা বাজারচলতি উদাহরণ দিই।
ছত্তিশগড় থেকে জনৈক নারায়ণ দেবাঙ্গন ফৌজে নাম লিখিয়ে নেফা সীমান্তে লড়তে গেছল। গুরুতর আহত অবস্থায় ফিল্ড হাসপাতালে তাকে রক্ত দেয় একজন বাঙালী সহযোদ্ধা। জ্ঞান ফিরতেই তার প্রথম কথা – বাড়ি যাবো! বাড়ি যাবো!
গোপাল ভাঁড়ের গল্প মনে করুন। নানান ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত এক ব্যক্তিকে নিয়ে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র পড়লেন বিপদে, লোকটি কোন প্রদেশের? দায়িত্ব দিলেন গোপাল ভাঁড়কে। ভাঁড় মশায় এক সন্ধ্যের অন্ধকারে লোকটিকে ল্যাং মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। আচমকা এমন আক্রমণে বিপর্যস্ত লোকটির মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে – সড়া অন্ধা! (শালা, চোখের মাথা খেয়েছিস!) পরের দিন রাজসভায় গোপাল ঘোষণা করল – লোকটি ওড়িয়া।
আমাদের অবচেতনে কাজ করে মাতৃভাষা, বিপদে পড়লে আচমকা আঘাত পেলে আমরা মায়ের কাছে আশ্রয় খুঁজি, জ্বরের ঘোরে কোঁকাতে থাকি – ও মা, মাগো!
বাঙালীর আছে নিজস্ব উচ্চারণ। আমরা শকার-বকারে অভ্যস্ত, তাই কবি গাহিয়াছেন ‘বেড়ালের তালব্য শ’। আসলে আমরা এই ত্রয়ীকে – স, শ এবং ষ – একই রকম উচ্চারণ করি। হিন্দিভাষী কানে বাঙালীর শালা আর সসালা একই শোনায়। ওরা বোঝায় – বাপু হে, মায়ানগরী মুম্বাইতে খোদ অমিতাভ বচ্চন আমাদের বিলাসপুরের সত্যদেব দুবের কাছে তিনটে স’কারের স্পষ্ট উচ্চারণ শিখতে আলাদা করে পাঠ নিতেন। আর তুমি বাঙালী কিনা...!
ওরা আমাকে শেখায় – সন্দেশের ‘স’, শালগমের ‘শ’, আর ষটকোণের ‘ষ’।
আমি শিখি না, আমার বয়ে গেছে।
কিছু উক্তি, কিছু খেদোক্তি
আমাদের বর্ণমালায় রয়েছে দুটো ব – বর্গীয় ব এবং অন্তস্থঃ ব; ছোটবেলায় দাদু শিখিয়েছিলেন। আমি বুঝভম্বুল। দুটোকে আলাদা করে চিনব কী করে? দাদু অপ্রস্তুত। এই প্রশ্ন কি তাঁকেও ছোটবেলায় বিব্রত করেছিল? আমি বলি – দাদু, দুটোর দরকার কি? একটা ‘ব’ দিয়াই কাজ চালাইয়া দাও।
--দুরহ প্যাটব্যাক্কল! যা আরেক থালা ভাত খা গিয়া।
এই ডায়লগ শুনলাম আরও দু’বছর পর। শনি-রবিবারের অনুরোধের আসরে লতা মঙ্গেশকরের গলায় শুনি – প্রেম একবার এসেছিল নীরবে।
তন্ময় হয়ে শুনি। ক’দিন পরে দাদুকে জিজ্ঞেস করি – দাদু, প্রেম আইল, আবার চইল্যাও গেল। কিন্তু আমরা টের পাইলাম না ক্যারে? হেইয়া কি খালি পায়ে আইছিল?
দাদু হা-হা করে হেসে উঠলেন – দুরহ প্যাটব্যাক্কল! যা আরেক থালা ভাত খা গিয়া।
আমি ওই একটা ‘ব’ নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলাম। কিন্তু ওরা আমার পেছন ছাড়ল না। হিন্দি বলয়ে আসার পর দুই সতীনের কোঁদলের মতন আমায় পদে পদে অপদস্থ করে চলল। অংকের ক্লাসে দেখি যাকে আমি কোলকাতায় বলতাম ‘ভেক্টর অ্যালজেব্রা’, তাকে ওরা বলে ‘ওয়েক্টর অ্যালজেব্রা’। ভাইরালকে উচ্চারণ করে ‘ওয়াইরাল’। ‘ভ্যালুজ’ কে বলে ‘ওয়েলুজ’; কি যন্ত্রণা!
আমি ওদের অজ্ঞতায় হাসি। বলি ইংরেজি ‘ভি’ এর উচ্চারণ তো ‘ভ’ হবে, তাই না?
ওরাও হাসে, তা কেন? ওটার উচ্চারণ অন্তস্থঃ ব, কখনই ‘ভ’ নয়।
এবার চটে যাই, আমার অহংকারে ঘা লেগেছে। তোমরা বেশি জান? আমরা বাঙালীরা ইংরেজি উচ্চারণ বেশি বুঝি।
কোন সুবাদে?
সবচেয়ে আগে সাহেবদের গোলাম হওয়ার সুবাদে; পলাশীর যুদ্ধ শুনেছ? ‘কাণ্ডারী তব সম্মুখে ওই পলাশীর প্রান্তর, বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর’।
বেমক্কা গান গেয়ে ওঠায় ওরা কেমন ভেবলে যায়, গোল গোল চোখে আমায় দেখে। আমি ভাবি নক আউট পাঞ্চ ঝেড়েছি বটে!
তারপর দেখি ওরা হাসছে; খ্যা-খ্যা করে হাসছে, ঠা-ঠা করে হাসছে, পেট চেপে ধরে হাসছে।
--আবে বাঙালী! গর্ব সে কহো হম গুলাম হ্যায়! আরে গোলাম হলেই উত্তম শিক্ষালাভ?
আমার ভুলটা কোথায়?
শোন, ‘ভ’ হল ‘ব’য়ের মহাপ্রাণ রূপ। ব+হ= ভ। কোন ব? বর্গীয় ব, অন্তস্থঃ ব নয়। তাই ইংরেজিতে ‘ভ’ উচ্চারণের জন্য লেখা হয় বি + এইচ; ‘ভি’ কদাপি নয়।
এত সহজে হার মানার বান্দাই নই।
তাই বুঝি? তাই তোমরা বল ‘বিজয়’, বিনয়, বিনোদ, বিরাট; কিন্তু ইংরেজিতে বানান লেখ ভিজয়, ভিনয়, ভিনোদ, ভিরাট।
ঠিক তাই; কারণ ওগুলো অন্তস্থঃ ব, বর্গীয় ব নয়। বর্গীয় ব হলে ইংরেজিতে বি দিয়ে লিখব। হিন্দিতে পেটকাটি ব। আর পেটকাটা না হলে বুঝতে হবে ওটা অন্তস্থঃ ব।
যেমন? অন্তত একটা উদাহরণ দাও।
দিচ্ছি, একেবারে হাতে গরম উদাহরণ হল ‘বাহুবলী’। সিনেমাটার বিজ্ঞাপনে বানান খেয়াল কর। দুটোই বর্গীয় ‘ব’, তাই পেটকাটা ব, মানে ইংরেজি বি।
শেষ চেষ্টা করি।
সে তোমরা তোমাদের হিন্দি শব্দকে বিদেশি ভাষায় যেমন ইচ্ছে বানান কর গে’, আমার কি যায় আসে! আমরাও আমাদের মত বানান করব। তাতে কার বাপের কি!
উঁহু, কথাটা ইংরেজি বানান নিয়ে নয়, বরং নিজেদের ভাষায় শব্দের বানানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ উচ্চারণ নিয়ে। আমরা বানানে এবং উচ্চারণে কনসিস্টেন্ট, তোমরা নও।
এতবড় কথা! নেভার সে অপমান! যা তা বললেই হল? একটা লাগসই উদাহরণ দাও দিকি?
--বিবেকানন্দ। তোমরা যেভাবে উচ্চারণ কর, তাতে তো ইংরেজিতে ‘ভি’ দিয়ে না লিখে ‘বি’ দিয়ে লেখা উচিত। অথবা, তোমাদের নিজেদের যুক্তি মেনে উচ্চারণ করা উচিত ‘ভিভেকানন্দ’; যেমন ভিনোদ, ভিরাট।
এক্কেবারে ধোবি পছাড়!
আমার মনে পড়ে বিশুখুড়োর মূলোচোরের গল্প। হাতেনাতে ধরা পড়ে চোর গৃহস্বামীকে সাফাই দেয় যে ও বেড়া টপকে ঢোকেনি, ঝড়ে উড়িয়ে এনে এখানে আছড়ে ফেলেছে।
তা’ এতগুলো মূলো টেনে তুলেছ?
না, ঝড়ে আবার উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, বাঁচার তাগিদে আঁকড়ে ধরেছিলাম, তাই।
তা বেশ, কিন্তু সেই মূলোগুলো দিয়ে আঁটি বেঁধেছ যে !
এবার আপনি আমায় বলতে পারেন কত্তা!
বলি – আনন্দবাজারে ‘সম্পাদক সমীপেষু’তে চিঠি লিখব যেন বিনোদ খান্না, বিজয় হাজারে, বিন্নু মাঁকড়, বিরাট কোহলি লেখা হয় এবং প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী তব্বুকে টাব্বু না লেখা হয়।
আমার মুখের চেহারা দেখে একজনের করুণা হয়। সে বোঝায়, দোষ বাঙালীদের নয়, আসলে ওদের বর্ণমালায় দুটো ব’য়ের আলাদা লিপিচিহ্ন নেই যে। এটি সংস্কার করে নিলেই ছোটবেলা থেকেই বাচ্চারা ঠিকমত উচ্চারণ করতে শিখবে।
ছোটবেলায় দাদুর দ্বিধা আমাকে আর অবাক করে না।
আমি মাটিতে পড়ে গেছি, তবু রেহাই নেই। ওরা বলে বাঙালীদের তিনটে শ’ই বেড়ালের তালব্য শ। উদাহরণ সন্দেশ। বাঙালী বলে শন্দেশ। ছোটবেলায় দাদু বা গুরুমশায়ের কাছে শেখে বটে তালব্য শ, মূর্ধন্য ষ, দন্ত্য স। কিন্তু উচ্চারণের সময় জিভটাকে ঠিক করে তালু, মূর্ধা বা দাঁতে ঠেকায় না। আলসে জিভ মূর্ধা অবধি কখনই পৌঁছয় না। দাঁতে জিভ একবারই ঠেকায়, ইয়ার্কি করে ‘সামবাজারের সসীবাবু সসা খেতে’ বলার সময়।
আরও আঘাত সইবে আমার!
বাঙালীরা তিনটে ‘র’কে প্রায় একইরকম উচ্চারণ করে।
শুয়ে শুয়েই মনে মনে প্রতিবাদ করি। ‘র’ আর ‘ড়’ তো আলাদা। কিন্তু ‘ঢ়’? ওটার উচ্চারণ? কেউ শেখায়নি।
এক মক্কেল শান্তিনিকেতনের কলাভবনের স্নাতক। সে আমার কাটাঘায়ে নুন ছিটিয়ে বলে যে আমাদের নাকি মাত্রাজ্ঞান নেই। আমরা সমস্ত দীর্ঘমাত্রাকেও নাকি একমাত্রার মত উচ্চারণ করি। অথচ সংস্কৃত এবং হিন্দিতে দীর্ঘমাত্রার উচ্চারণে দুইমাত্রা লাগানো হয়। (লাগা না যেখানে ইচ্ছে, আমি কি করব?)
রবীন্দ্রনাথের মতন এমন বহুমুখী প্রতিভা আর কোনও ভাষায় নেই।
(তাতে তোর কি রে শালা!)
দুটো দেশের জাতীয় সংগীত রচয়িতা, ভাবা যায়!
(নে নে; হিংসেয় পেট ফেটে মর!)
কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছ যে, দু’মাত্রা করে উচ্চারণ করলে ওঁর কবিতা তোমার বায়সনিন্দিত কন্ঠেও কেমন প্রাণ পায়? এই দেখ -
সন্ধ্যা-আ রা-আ গে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখা-আ নি বাঁ-আ কা-আ।
বা, জীবনানন্দের বা-আ-ং লার মুখ আ-আমি দেখিয়া-আ ছি।
কালীদা গো কালীদা!
সাতকোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী
আমার মাথায় টিউবলাইট জ্বলে। ভাষা কি আজ কোনও জাতির সবচেয়ে বড় চিহ্ন? এয়োতির শাঁখা-পলা-মঙ্গলসূত্র? তাই রোমে ভ্যাটিক্যান দেখতে আসা মা-মাসিকে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে দিশেহারা হওয়া দুই বাঙালী তরুণীকে দেখে একজন এগিয়ে এসে বলে –আসেন বইনেরা, আসেন কাকিমা; আমার সঙ্গে আসেন। আমিও রেজিস্টার্ড গাইড। আপনাগো অন্য লাইনে নিয়া তাড়াতাড়ি দেখাইয়া দিমু নে।
ভাষা কি ধর্মের চেয়েও বড় বন্ধন? দড়ির নয়, নাড়ির টান? না হলে কেন দ্রাবিড় কাজাগম মুন্নেত্রা বা ডিএমকে দলের নেতা আন্নাদু্রাই ষাটের দশকে রাজ্যসভায় ভারতের থেকে স্বাধীন এক তামিলনাড়ু রাজ্যের দাবি করবেন? তাহলে... তাহলে কি দুইবাংলা মিলে এক স্বাধীন বাংলা গড়া যায়? ভেবে দেখুন, তাহলে কত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিসের এন আর সি, কিসের ক্যা ক্যা? কে শরণার্থী আর কেইবা অনুপ্রবেশকারী? সবই অবান্তর হয়ে যাবে।
এই রে ! কেস খেয়ে যাব? শাহীনবাগের ধর্না যে এখনও চলছে!
না না, ওসব চলবে না। ওপারের বাংলা ঠিক আমাদের মত না। ওরা জল খায় না, ‘পানি’ খায়, স্নান করে না, ‘গোসল’ করে। আরও আছে, স্তনকে বলে ‘বুনি’! নাঃ, এবার এপারেই কেস খেয়ে যাব।
মনকে বোঝাই, তাতে কি? এপারেও তো কত ফ্যাকড়া। রাঢ় বাংলায় লোকে মুড়ি না খেয়ে ‘ভুজা’ খায়, কুমড়োর বদলে খায় ‘ডিংলা’। বীরভূমের পুলিশ বোলপুরে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে চেঁচায় – গুলিয়ে দেব! গুলিয়ে দেব!
তাবলে কি ওদের ভাষা বাংলা নয়? আলবাৎ বাংলা!
আঞ্চলিক বৈচিত্র্য ভাষাকে আরও ধনী করে। তাহলে স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কি? একটু সাহস করতে ক্ষতি কি?
মনীশ ঘটক লিখেছিলেন না “নেহেরু-প্যাটেল-জিন্নার দল বলে বুলেট না বাংলা”?
১৯৫২ সালের সেই ২১শে ফেব্রুয়ারি! যদি বার্লিন ওয়াল ধ্বসে যায়, যদি দুই আয়ারল্যান্ড ফের জোড় বাঁধতে চায়? তাহলে আজ আমরা কেন স্বপ্ন দেখব না?
“আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?”
0 comments: