ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক
৯)
কালসর্পযোগ!
কাঠঘোরা থানার থানেদার বা স্টেশন অফিসার অজয় ডোঙ্গরের মেজাজটা সকাল থেকেই খিঁচড়ে আছে। আজ মহাশিবরাত্রি। গিন্নি উপোস রেখেছেন। সকালে এক কিলোমিটার দূরে আহিরণ নদীর পাড়ে শিবমন্দিরে গিয়ে ভোলেনাথের মাথায় জল ঢেলে ঘরে ফিরে তবে দাঁতে কিছু কাটবেন। এদিকে ডোঙ্গরেজীর বেশিক্ষণ খালি পেটে থাকা পোষায় না। তবে বেটার হাফ যখন না খেয়ে রয়েছে, পুলিশ বলে কি চক্ষুলজ্জা থাকবে না? কাজেই উনি অপেক্ষা করছেন কখন অর্ধাঙ্গিনী কপালে আশীর্বাদি ফোঁটা লাগিয়ে প্রসাদ নিয়ে ফিরবেন, তখন পুরি-সব্জি সাঁটিয়ে খাতায় রওয়ানগি লিখে ছুরি গাঁয়ে যেতে হবে। একটা কাজ আছে।
আজ ওখানকার স্কুলের মাঠে ছাত্র বনাম সরকারি অফিসারদের একটা ক্রিকেট ম্যাচ খেলার কথা, সরকারি টিম বলতে ন’জন টিচার, তার আদ্দেক কোনদিন ব্যাট ছুঁয়ে দেখে নি। হয়ত বচপনের দিনে ডান্ডা-গিল্লি খেলেছে। তবে উনি কলেজ টিমের প্রাক্তন কীপার প্লাস ব্যাটসম্যান, আর গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজার ভদ্রলোক নাকি ভিলাইয়ের স্কুলের অফস্পিনার ছিল।
এর মধ্যে এক উটকো আপদ; ছুরি গাঁয়েতেই কাল একটা খুন হয়েছে। গতমাসে একটা বানিয়া বুড়োর সন্দেহজনক মৌত, তারপরে এই কান্ড!
থানেদারের কি দোষ! উনি মাত্র গত বছর পুলিশের চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। কয়েক মাস শিক্ষানবিশীর পর প্রত্যন্ত এলাকায় একটা থানায় কিছুদিন ছোটবাবু, তারপর এই বিলাসপুর জেলার আদিবাসী তহসীল বা মহকুমা স্তরের থানায় পুরোদস্তুর দায়িত্ব। এখানে পয়সা আছে। কাছেই কয়লা পাওয়া গেছে। ওপেন কাস্ট মাইনিং শুরু হচ্ছে। আর মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে গোপালপুরে বারুদ ফ্যাক্টরি-- নাইট্রোগ্লিসারিন তৈরি হয়। সেখানে আবার এন টি পি সি'র থার্মাল পাওয়ার স্টেশনের স্টাফেদের জন্যে কোয়ার্টার তৈরি হবে, সার্ভে চলছে।
এইসব কর্মকান্ডের একটাই মানে। সমানে বাইরের লোক আসবে। বিশেষ করে বিহার বর্ডার থেকে। অন্তররাজ্য ক্রিমিনাল গ্যাং গুলো আস্তানা গাড়বে। সংগঠিত অপরাধের সংখ্যা বেড়ে যাবে। তার সংগে পাল্লা দিয়ে বাড়বে থানেদারের কামাই। বছর তিনেক পরে নীলামে এই থানার রেট বাড়বে। তখন অন্য কেউ বেশি দাম দিয়ে এই থানায় পোস্টিং পাবে, অজয়কে যেতে হবে আরো পিছিয়ে পড়া কোন থানায়। সে যখন হবে, তখন হবে। আপাতত: তিন বছর কিছু তো কামিয়ে নেয়া যাবে।
ঘটনাচক্রে ছুরির গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজার ওর চেনা বেরিয়েছে, একসঙ্গে ভিলাইয়ের প্ল্যান্টের স্কুলে পড়ত, বিয়েশাদি হয় নি। ওর জন্যেই আজ স্কুলের ছাত্র বনাম সরকারি কর্মচারির প্রীতিম্যাচে ওকে অনুরোধ করা হয়েছে উইকেট কীপিং করার জন্যে। ব্যাংক ম্যানেজার রূপেশ সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে যে থানেদার ডোঙ্গরেজি দুর্গ গরমেন্ট কলেজের হয়ে টুর্নামেন্টে নিয়মিত কীপিং করত। ম্যাচের পরে রূপেশের স্টাফ মেসে স্ট্যাগ পার্টি- দেশি মুর্গার রোস্ট ইত্যাদির কথা হয়ে আছে।
কাল বিকেলে স্কুলের মাঠে একটু প্র্যাকটিস করেছিল। শরীরের আড় ভাঙছিল। কিন্তু সকালে মোটর সাইকেল চড়ে ব্যাংক ম্যানেজার রূপেশ হাজির।
-- যা তা ব্যাপার! আমি কাল বিলাসপুরে হেড অফিসের মিটিং সেরে অনেক রাত্তিরে ফিরেছি। সক্কালে ব্যাংকের চাপরাশি জানাল যে গতকাল সন্ধ্যেয় কে বা কারা সুদখোর আজিজ পালোয়ানকে বীভৎস ভাবে খুন করেছে। কে করেছে কেউ নাকি জানে না। সবার মুখে কুলুপ আঁটা। সরপঞ্চের সঙ্গে কথা বলে জানলাম যে সন্দেহের বশে লুচুকদাসকে ধরে এনে বেওয়ারিশ গরুমোষকে রাখার ঘর বা কাঞ্জি হাউসে বেঁধে রাখা হয়েছে, আপনি বল্লে কোতোয়ালের দল এখানে ওকে হাজির করবে।
ছোটবেলার চেনা হলেও গঙ্গারাম অজয় ডোঙ্গরেকে আপনি করেই বলে। ডোঙ্গরে মানে জাতে হরিজন, কোন কথায় ইগো হার্ট হবে কে বলতে পারে! থানেদার বলে কথা।
ওরা দুজন থানার আঙিনায় মিঠে রোদ্দূরে চেয়ারে বসে কাঁচের গ্লাসে গরম চা খাচ্ছে এমন সময় তিন কোতোয়াল হাজির। তিনটেরই পরণে রেলের খালাসীদের মত নেভি ব্লু হাফ প্যান্ট আর শার্ট; তবে কোমরে চওড়া বকলেস লাগানো বেল্ট, আর মাথায় একই রঙের টুপি।
তিন জনে এসে সার বেঁধে দাঁড়ায়, স্যালুট মারে, ঠিক যেন কোন কমিক স্ট্রিপের ক্যারেক্টার।
-- কি ব্যাপার? তিনমূর্তি একসাথে? তোমাদের না বডির পাশে থাকার কথা?
-- সরকার! আসামীকো লানা থা, বহুত খতরনাক আসামী, খুনী! ইসীলিয়ে--।
-- কোথায় সেই খতরনাক আসামী?
তিনমূর্তি মাথা চুলকোয়।
বয়স্কটি কিন্তু-কিন্তু করে বলে -- ও হুজুর পরের বাসে আসছে, আমার ছেলেটা সঙ্গে আছে।
রূপেশের মুখ হাসি চাপার অসম্ভব কষ্টে বেগুনি হয়ে যায়। কিন্তু থানেদারের চেহারা হিংস্র হয়ে ওঠে।
-- মেরে সাথ মজাক? চুতিয়াপনার জায়গা পাস নি? সবকটার পাছায় হান্টার লাগালে তবে এদের ট্রেনিং পুরো হবে। আসামী যদি পালিয়েছে তো তোদের দিন খুব খারাপ যাবে, দেখে নিস্।
ইতিমধ্যে পরের বাস এসে গেছে। বুড়ো কোতোয়ারের ছেলের সঙ্গে নেমেছে কোমরে দড়ি বাঁধা কথিত আসামী লুচুকদাস।
অজয় একপলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নেন। ন্যালা ক্যাবলা আধপাগলা গোছের একটা লোক। উস্কোখুস্কো চুল, শার্টের হাতাটা ছেঁড়া। চোখের কোণে পিঁচুটি, হলদেটে দাঁত, মুখ থেকে বাসি মদের টোকো গন্ধ, আর নিম্নাংগের পাজামাটা অনেক পুরোনো,পায়ের কাছে ফাঁসা। এ মেরেছে আজিজ পালোয়ানকে? কি করে?
জিগ্যেস করতেই হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে লুচুকদাস। ও কিচ্ছুটি জানে না। কাল ছিল শঙ্করজীর দিন। ও গাঁজায় দম একটু বেশি চড়িয়ে মন্দিরেই ভোম হয়ে সারারাত্তির কাটিয়েছে।
অজয় দুই ধমক দিয়ে মুন্সীকে বলেন খাতায় এন্ট্রি করে ব্যাটাকে লক আপে ভরতে। ডাক্তারকে খবর করা হয়, সঙ্গে গিয়ে প্রাথমিক পরীক্ষা করে বডি অ্যাম্বুলেন্সে করে কাঠঘোরা মর্গে নিয়ে আসার জন্যে, কাল পোস্ট মর্টেম করতে হবে। আজ হবে না। কারণ ডোম সুখিয়া মহাশিবরাত্রির ছুটিতে মাতাল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তিন তিগাড়া, কাম বিগাড়া!
পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট এসে গেছে। রিপোর্ট পড়ে থানেদার ডোঙ্গরে'র চক্ষু চড়কগাছ। মৃতদেহের শরীরে অন্তত: ২৯ টি ছোট বড়ো আঘাতের চিহ্ন। কিছু ধারালো অস্ত্রের ঘা', কিছু ভোঁতা ভারী জিনিসের আঘাত, আর ডাক্তার মিশ্র বল্লেন-- এই ১১টা চোট দেখুন! একটাও ফ্যাটাল নয়। ব্লেড বা ছুরি অথবা অমনি কিছু দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে পুচিয়ে পুচিয়ে কাটা হয়েছে। মনে হয় আজিজ পালোয়ানের ওপর হত্যাকারীদের খুব রাগ ছিল; অনেকক্ষণ ধরে যন্ত্রণা দিয়ে মেরেছে।
-- হত্যাকারীরা? একাধিক লোক বলছেন?
--- হ্যাঁ, কোন একজনের পক্ষে আলাদা আলাদা হাতিয়ার দিয়ে এতক্ষণ ধরে আজিজকে যন্ত্রনা দেয়া?--ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। একাধিক লোক, আজিজকে বাগে পেয়েছিল। মানে, কোথাও বেঁধে রেখে টর্চার করেছে। দুটো হাত ও পায়ে গোয়ালঘরের দড়ি দিয়ে বাঁধার দাগ আছে। আর কোন রেজিস্ট্যান্সের চিহ্ন নেই।
অথচ বডি পাওয়া গেছে গাঁয়ের প্রান্তে গরুমোষ ধোয়ানোর পুকুরপাড়ে, পাকুড় গাছের তলায় পড়েছিল।
এবার ব্যাংক ম্যানেজার রূপেশ বলে-- পুকুরপাড়ে পাকুড় গাছের তলার জমিটা? ওটা কার?
-- ওতে কি বোঝা যাবে? ওটা সরকারি জমিন। পঞ্চায়েতের রক্ষণাবেক্ষণে আছে। তবে আশেপাশে রক্তের দাগ নেই। জমিতে কোন ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই। তার মানে হলো-
-- খুনটা অন্য কোথাও করে এখানে বডি ফেলা হয়েছে। কিন্তু কে বা কারা আজিজকে এমন নৃশংস ভাবে মারল? কেন মারল? ম্যানেজার কিছু বল। আরে সায়েব তুমি তো এখানে বছরখানেক ধরে আছ। গাঁয়ে কার কার সঙ্গে ওর দুশমনি ছিল।
ডাক্তার মিশ্র হেসে ফেলেন।
-- কার সঙ্গে ছিল না সেটা জিগ্যেস করুন। কি হে ম্যানেজার সাহেব? সেই ছড়াটা শোনাবে নাকি? আরে লজ্জা কিসের? শুনিয়ে দাও। হতে পারে ওই ছড়াটা থেকেই আমাদের থানেদার সাহেব কোন ক্লু পেয়ে যাবেন?
অজয় ডোঙ্গরে স্পষ্টত: বিরক্ত। ম্যানেজার আর উনি ঘন্টা দুই হলো মহকুমা হাসপাতালে এসেছেন পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট নিতে আর ডাক্তারের মতামত শুনতে। রিপোর্টে ইশারা একাধিক খুনীর, অথচ গাঁয়ে কেউ কিছু জানে না। মনে হচ্ছে লুচুকদাসকে ছেড়ে দিতে হবে। ও শালা পাঁড় মাতাল আর নিঠল্লা আদমী। রহস্য ঘনীভূত। কাল কোরবার অ্যাডিশনাল এসপি শ্যাম সায়েবের কাছে রিপোর্ট পাঠাতে হবে। উনি আবার মহা হাঁউ-মাঁউ-খাঁউ, পয়সার গন্ধ পাঁউ। আর এই ডাক্তার বয়সে বড়ো বলে এয়ারকি দিচ্ছে! ছড়া শোনাবে?
শুরু হো জাও ম্যানেজার!
ভ্যাবা- গঙ্গারাম ম্যানেজার নিরুত্তাপ ভঙ্গীতে শুরু করে:
" দরস কা লন্দফন্দ, যোশী কে সলাহ্,অউর আজিজ কী গবাহী,
এ তিনোমেঁ রহবে তো ঝাঁট চাট জাহি।''
"ফাঁদ পেতেছে দরস,তায় বুদ্ধি যোগায় যোশী,
আর আজিজ সাক্ষী? বাপ!
এ ত্র্যহস্পর্শে ফেঁসেছিস কি
ঝাঁটশুদ্ধু সাফ!"
-- দরসরাম? যোশীজি? এরা কারা?
-- সবই জানবেন, ক্রমশ: প্রকাশ্য। দরসরাম হলো ব্যাংকের মকানমালিকের চচেরা ভাইয়া। অতি সাধারণ অবস্থা থেকে নিজের বুদ্ধি আর সাহসের জোরে গাঁয়ের প্রচুর জমির মালিক হয়েছে। আসলে অংগুঠা ছাপ। কিন্তু শুরুতে ছুরি গাঁয়ের জমিদার বাড়ির লাঠিয়াল এই আদিবাসী মানুষটি মুখে মুখে বলে দিতে পারে এত ফিট রাস্তা বা এত উঁচু ইঁটের দেয়াল বানাতে কত ইঁট, কত গরুর গাড়ি বালি আর কত ব্যাগ সিমেন্ট লাগবে। কম কথা নয়।
-- আর যোশীজি?
-- যোশী মহারাজ রাজস্থান থেকে আসা মাড়োয়ারি ব্রাহ্মণ; সব মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীদের পুরুত। বুড়ো শকুনের মত দেখতে। কিন্তু বিষয়বুদ্ধিতে প্রখর। রেভিনিউয়ের সব আইনকানুন,মায় অধুনা পাস হওয়া সংশোধনী,- সব খবর রাখে। পাটোয়ারি, রেভিনিউ ইনে্স্পক্টর সবাইকে খুশি করতে পারে। সরকারি জমিন কেমন করে অবৈধ কব্জা করে নামমাত্র ফাইন দিয়ে নিজের করে নেয়া যায় তা ও তহশীলদারকে শেখাতে পারে।
-- বাকি রইলো আজিজ পালোয়ান। ওর সম্বন্ধে আমার থানায় ফাইল আছে। লোককে ধমকানো, মারপিট, চোলাই মদের ধান্ধা আর গুন্ডাগর্দি, রংদারি ট্যাক্স ইত্যাদি। সব সময় জামিন পেয়েছে। আর কোর্টে কিছু প্রমাণ করা যায় নি, তাই খোলা ষাঁড়ের মত ঘুরে বেড়ায়, বহাল তবিয়তে।
-- ফাইল যদি মন দিয়ে পড়ে থাকেন তবে এও হয়তো আপনার চোখে পড়েছে যে অধিকাংশ সময় ওর জামিন হয়েছে হয় দরসরাম তঁওর নয়তো যোশী।মহারাজ।
ত্র্যহস্পর্শযোগ, বল্লাম না! তিনব্যাটার সাঁটগাঁট!
প্রথম জালটা ফেলবে দরসরাম, তারপর ফাঁস গলায় এঁটে বসলে গেঁয়ো চাষী দৌড়ে যবে যোশীমহারাজের কাছে শলাপরামর্শ নিতে। ওনার মনোহারী পরামর্শে ফাঁসটা আরো ভালো করে গলায় আটকাবে। শেষে কোর্টে গেলে তহসীলদারের সামনে আজিজের শপথ নিয়ে মিথ্যে সাক্ষ্য বা গবাহী দেয়া। ফলম্ -ভিটেমাটি চাটি হয়ে যাওয়া। এই তিন শয়তানের দাঁও-প্যাঁচে কতজন যে পথে বসেছে। আর এরা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে সম্পত্তি বাড়িয়ে গেছে। এই লোকোক্তিটি হাসির নয়, অনেক লোকের হাহাকারের শ্বাস।
-- ওসব সেন্টিমেন্ট ছেড়ে আপনারা বলুন তো --যখন আজিজ এমন ভাবে মারা গেলো,তখন বাকি দুই মাস্কেটিয়ার্স কি করছিলো বা কোথায় ছিলো?
-- এটা আমি বলতে পারবো না। আমি তো সদরে থাকি। রূপেশ সাহেব জানলে বলুক। ও তো ছুরি গাঁয়েই থাকে।
-- হ্যাঁ, প্রশ্নটা আমার মনেও এসেছিল। খোঁজ নিয়ে জানলাম যে ওই দিন ওঁরা দুজনেই গাঁয়ে ছিলেন না। যোশীমহারাজ চাঁপা নগরে ওনার যজমানের ছেলের পৈতের শুভকর্ম সম্পন্ন করতে দুদিন আগেই চলে গিয়েছিলেন। আর দরসরাম ওর শ্বশুরবাড়ি পেন্ড্রায় গিয়েছিল।
কুমারসাহেব! কুমারসাহেব! করছ তুমি কী?
ইংরেজ রাজত্বে ছত্তিশগড় সিপি অ্যান্ড বেরার স্টেটের মধ্যে বিদর্ভ (বেরার) রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। তখন ওর রাজধানী ছিল নাগপুর। সেখানে কমিশনার বসে সুদূর ছত্তিশগড়ে শাসন চালাতেন। ওনার লেখা একটি বইয়ে ছুরি গাঁয়ের ও সেখানের করদাতা রাজাদের কথা আছে।
আবার বিংশ শতাব্দীতে চল্লিশের দশকে বর্গীদের বংশাবতংস মারাঠা রাজবংশীয়দের উদ্যোগে বিলাসপুর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে প্রাচীন রাজধানী রত্নপুর, বর্তমান রতনপুর, এর কাছে মা তুলজা ভবানী মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই প্রতিষ্ঠা করার সময় আয়োজিত বিরাট যজ্ঞের স্মারিকা গ্রন্থে যে আশী জন জমিদার তাতে দান দিয়েছিলেন তাদের মহিমাকীর্তন করা আছে। আমাদের গল্পের ছুরির রাজপরিবার তাদের অন্যতম।
কাটঘোরার থানেদার অজয় আজ হাজির হয়েছেন সেই রাজপরিবারের প্রাসাদের আঙ্গিনায়। কারণ এই পরিবারের সেজকুমার উদ্যমেশ্বরশরণ মণিপালপ্রতাপ সিংহ এই গ্রাম পঞ্চায়েতের বর্তমান সরপঞ্চ।
লাল ইঁটের বিশাল প্রাচীরে চুণ সুড়কির পলস্তারা খসে পড়ছে। ওপরে কোট অফ আর্মস এখনো পড়া যায়। ১৮৯০ এর কাছাকাছি কোন বছর লেখা। কিন্তু অজয় চারদিকে চোখ বুলিয়ে পিচ করে পিক ফেলে ব্যাংক ম্যানেজারকে ঠেট হিন্দিতে যা বল্লেন তার বাংলা অনুবাদ হলো -- নামে তালপুকুর, তায় ঘটি ডোবে না।
খবর পেয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছেন সেজকুমার, ছত্তিশগড়ি বোলি তে " সঝলাকুমার''। সাদা টেরিকটের সার্টের বুকপকেটের কাছে পানের পিকের লাল দাগ ধোবার হাত ফেরতা হয়েও পুরোপুরি ওঠেনি।
এখনো মুখের পান থেকে কথা বলার সময় কিঞ্চিৎ রঙীন ফোয়ারার ছিঁটে ওনার জামার গায়ে লাগছে, কিন্তু সেজকুমার নির্বিকার।
থানেদার ইতিমধ্যেই জেনেছেন যে এই ব্যক্তিটি একেবারেই আজকের হিসেবে সরপঞ্চ হওয়ার উপযুক্ত নন। সজ্জন, বন্ধুবৎসল, আমোদপ্রিয় উদ্যমেশ্বরশরণ কুমারসাহেব আসলে ব্যক্তিত্বহীন। তাই সবাইকেই খুশি করতে চান, কাউকেই করতে পারেন না। উপরন্তু চালু লোকেরা,যেমন দরসরাম বা তার ছেলেরা ওনার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায়। গতবারও মন্দিরের পাশ থেকে পুকুরপাড় অব্দি রাস্তাটা বানানোর ঠিকে ওনাকে পটিয়ে দরসরাম হাতিয়ে নিয়েছিল, কাজ পুরো হওয়ার আগেই চাপ দিয়ে বিল পাশ করিয়ে নিয়েছিল। কাজ পুরো না হওয়ায় অডিটের পর বাকি টাকাটা সেজকুমারকেই ভর্তুকি দিতে হয়েছিল।
-- আসুন, আসুন! কি সৌভাগ্য, সাহেব নিজে এসেছেন! আবার ম্যানেজার সাহেবও! ভাল হলো। আজ দিন ভাল যাবে।
যথারীতি কাঠের রং ওঠা চেয়ার পেতে সবাইকে ভেতরের বাগানে বসানো হলো। চা-সিগ্রেট, শেষে মুখশুদ্ধির মশলা সব এল।
ওঠার আগে অজয় জিগ্যেস করলেন-- কুমার সাহেব! আপনি তো জানতেন যে লুচুকদাস নির্দোষ, তাই না?
হটাৎ এই অপ্রত্যাশিত বাম্পারে সেজকুমার ধরাশায়ী। ঘাবড়ে গিয়ে তো-তো করতে থাকেন।
-- না,মানে আমি কি জানি- কে দোষী আর কে নির্দোষ? ওসব তো, মানে আপনি ঠিক করবেন।
--বেশ কথা। লুচুকদাসকে ধরে বেঁধে কাঞ্জিহাউসে আনা হয়েছিল আপনার হুকুমে।
তাহলে আপনি জানতেন যে ওই খুনী?
-- না, না! আমি কিছু জানি না। আমি ঘরে বসে রেডিও শুনছিলাম। আসলে আমি এখানকার রেডিও শ্রোতা সংঘের প্রেসিডেন্ট তো। তখন সবাই এসে বললো-- কুমারসাহেব, খুনী ধরা পড়েছে, আপনার আদেশ পেলে চৌকিদার চেতন সিং ওকে আজ কাঞ্জি হাউসে বেঁধে রেখে সারারাত পাহারা দেবে, সকাল থানায় খবর দিয়ে তারপর ওখানে সুপুর্দ করে দেবে। তাই আমি--।
-- আচ্ছা? তা এই সবাই কারা?
-- কার কার নাম নেব সাহেব? সবাই মিলে মিশে থাকি, দুশমনী বাড়বে। সবাই বলেছিল।
-- অন্তত: পাঁচটা নাম বলুন। আর ওদের হিসেবে খুনটা কখন হয়েছিল?
-- কর্মনলাল, হরিরাম, মদন গুণাইত, টেলু-মেলু-মহেত্তররাম ভাইয়েরা। অমৃতলাল দেবাংগন। আর সবাই বলল-- রাত বারোটার অনেক পরে। মানে তিনজন তখন লুচুকদাসকে তালাওয়ের পাড় থেকে,মানে যেখানে খুনটা হয়েছিল সেখান থেকে দৌড়ে আসতে দেখেছে।
-- তা সেই তিনজন অত রাতে ওখানে কি করছিল? আর আপনিই বা সেই রাতে কোথায় ছিলেন?
-- ওরা তালাওয়ের পাড়ে ছিল না, নিজেদের বাড়ির সামনে ঘুম ভেঙে পেচ্ছাপ করছিল। জানেনই তো, অজ পাড়াগাঁয়ে আপনাদের ভিলাই-রায়পুরের মত ঘরে ঘরে বাথরুম-পায়খানা নেই। পুরুষেরা সবাই রাত্তিরে নিজেদের ঘরের বাইরেই রাস্তার ওপর সেরে নেয়।
-- আর আপনি?
-- আমি? আমি ঘটনার একসপ্তাহ আগে থেকেই বাইরে ছিলাম। মাকে নিয়ে সপরিবারে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম। ঘটনার পরের দিন ফিরেছি। স্যার, আমি সবসময় পুলিশের সঙ্গে কো-অপারেট করব, কিন্তু প্লীজ আমার ওই নাম বলার ব্যাপারটা--?
ফেরার পথে রূপেশ বলে-- আপনার কি মনে হচ্ছে যে ও সব সত্যি বলছে? ওর পুরী থেকে ফেরার সময়টা একটু ভেরিফাই করলে হয় না,অজয়জী?
অজয় হাসেন। না, না, ওসবের দরকার নেই। ও সত্যি কথাই বলছে, মোটের ওপর।
চমকে ওঠেন ম্যানেজার।-- আপনি জানলেন কি করে?
অজয়ের হাসি রহস্যময় হয়ে ওঠে।
-- আমি জানি, মানে খুনীদের জানি। কিন্তু কেউ সাক্ষী দেবে না। এখন ধরলে সবাই বেকসুর খালাস হবে। তাই একটা কিছু করতে হবে যাতে সাক্ষী পাওয়া যায়।
রূপেশের হাঁ-মুখ বন্ধ হয় না। তাই দেখে থানেদারি স্টাইলে মুচকি হেসে অজয় বলেন-- চলুন! আজ আপনাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো।
অনেক কাজ হলো আজকে। এখন একটু রিল্যাক্স করতে হবে না? আচ্ছা, আপনি কখনো বেশ্যাগমন করেছেন?
রূপেশ এবার পুরোদস্তুর ভ্যাবাগঙ্গারাম হয়ে যায়।
নগরবধু, শুধুমুধু?
কাঠঘোরা বাসস্ট্যান্ডের তেমাথার মোড়। একটা রাস্তা গেছে বিলাসপুর থেকে এসে ২৩ কিলোমিটার দূরে কোরবা থার্মাল পাওয়ার কেন্দ্রের দিকে। আর এর থেকে নব্বই ডিগ্রি কোণ করে আর একটি রাস্তা গেছে বাঙ্গো জলাশয় হয়ে অম্বিকাপুরের দিকে। এই রাস্তা ধরে গোটাকয় খাবারের দোকান, ফলমূল-শাকসব্জির দোকান, ট্রাকের টায়ার সারানোর, চাকায় হাওয়া ভরার দোকান ইত্যাদি ছাড়িয়ে প্রায় দু'শ পা হাঁটলে একটি ছোট চা আর ফুলুরির দোকান, স্থানীয় ভাষায় বলে ভাজিয়া।
আপনি ছোট থেকে ছোট গাঁয়ে ঘুরে বেড়ান একটি ভাজিয়ার দোকান ঠিকই পাবেন। ছত্তিশগড়ের সম্পন্ন বা গরীব-গুর্বো মানুষ -- সবার সহজ জনপ্রিয় জলখাবার হলো ভাজিয়া। সময়ে অসময়ে অতিথ-অভ্যাগত এলে তাদের খাতিরদারি করতে চাই ভাজিয়া।
ছত্তিশগড়ের লোকজীবনে ভাজিয়ার গুরুত্ব বোঝাতে এই ইতরযানী লোকোক্তিটি যথেষ্ট।
যেমন, আপনি যা ইচ্ছে করুন,চুলোয় যান, বোঝাতে ছত্তিশগড়ের লোকে বলবে--" চাহে ভাজিয়া খায়ে, চাহে গাঁড় মারায়ে।''
অথবা দেখুন গ্রামীণ শ্রমজীবি মানুষের মুখে মুখে তৈরি দদরিয়া লোকগীতের জনপ্রিয় এই পংক্তিটি:
" চানা কে দার রাজা, চানা কে দার রাণী,
চানা কে দার গোঁদলী মেঁ কড়কয়থে,
আরে টুরা রে পর-বুধিয়া, হোটেল মেঁ ভাজিয়া ঝড়কয়থে।।''
ছোলা ডালের রাজা, ছোলা ডালের রাণী,
ডাল আর পেঁয়াজ গরম তেলে নেচে নেচে ওঠে।
আমার ছেলে বড়ো হাঁদা, টিকি অন্যের ঘরে বাঁধা,
চেটে পুটে ভাজিয়া খেতে হোটেলেতে ছোটে।'
এখন বেলা বাজে তিনটে; রোদের তাপ গায়ে লাগছে। বাসের সংখ্যা কমেছে। ফলে এদিকটা একটু বেশি ফাঁকা। ওই ভাজিয়ার দোকানেও উনুনের ছাই নিভু-নিভু; চাকর-বাকরেরা খেতে বসেছে। আর থানেদার অজয় ডোঙ্গরে ও তাঁর স্কুল জীবনের বন্ধু রূপেশ,( যিনি ব্যাংকের টেবিলে বেশিক্ষণ বসে থাকতে না পেরে কিছু নতুন বিজনেস ধরার বাহানায় খালি ছুরি- কাটঘোরা রুটে বড়ো রাস্তায় বা তার পাশের গ্রামগুলোতে একটি পুরনো রাজদূত মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়ান), জীপ থেকে দোকানের সামনে নাক কুঁচকে নামলেন।
পুলিশ অফিসারের ধরাচূড়া পরা অজয়কে দেখে ছেলে-ছোকারাদের ডাল- ভাতের গ্রাস মুখের সামনে থেমে গেল।
কিন্তু রাঁধুনী বুড়ো বিশালদাস যাদব তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে দুটো চেয়ার টেনে ওদের বসতে অনুরোধ করে। টেবিলের ওপর কাঁচের গ্লাসে জল দিয়ে জিগ্যেস করে-- কি খাবেন হুজুর?
অজয় মাছি তাড়ানোর মত হাত নেড়ে বলেন-- তোদের মালকিন মালতী বাঈকে গিয়ে বল, দারোগাবাবু দেখা করতে এসেছেন।
বুড়ো দৌড়ে ভেতরে গিয়ে প্রায় তক্ষুণি ফিরে এসে বলে--- ভেতরে আসুন, সরকার! মালকিন বসে আছেন।
প্রায়ান্ধকার গলির মধ্যে দিয়ে ভেতরের উঠোনে পৌঁছুবার সময় অজয় রূপেশকে বল্লেন-- এখানে একদম মুখ খুলবে না, ম্যানেজার! আজ শুধু শুনে যাও। আর ভুলে যাও।
ভেতরের উঠোনটা বেশ বড়ো, গাছের ডাল আর তারকাঁটা দিয়ে ঘেরা। একপাশে সবুজ রঙের কিছু চানাবুট আর রেড়ির তেলের বীজ ডাঁই করে রাখা, অন্যদিকে দুটো মুর্রা মোষ জাবনা খাচ্ছে। চোখ গেল আঙিনার উল্টো দিকে জং ধরা একটি জীপের দিকে। তার পেছনে রং দিয়ে বড়ো করে লেখা-- পোঙ্গা লা বাজা না গা! অর্থাৎ হর্ন প্লীজ!
একটা হাফপ্যান্ট পরা ছেলে গোবরলেপা উঠোনের রোদ্দূরে একটা খাটিয়া টেনে এনে তারপর আধময়লা কাঁথা পেতে দিল। আর সামনের একটি কাঠের টুলে কাঁসার বাটিতে করে লাড্ডু, পেঁড়া ও কালাকাঁদ। একটি শ্রীময়ী মেয়ে নিয়ে এসেছে কাঁসার লোটায় খাবার জল ও সঙ্গে দুটো ঝকঝকে মাজা গেলাস।
থানেদারের ইশারায় রূপেশ একটি কালাকাঁদ তুলে নিয়ে চিবুতে থাকে। বড্ড মিষ্টি। এক লোটা জল দুজনের দুই চুমুকে শেষ। এবার আসে পানামা সিগ্রেট ও দু'খিলি পান, মিঠি পাত্তি ও মিঠা মশলা। কিন্তু গুলকন্দ দিয়ে স্বাদটা খারাপ করে দিয়েছে।
অজয় ডোঙ্গরে প্রায় একবছরের থানেদারিতেই স্থুল ব্যাপারগুলো আয়ত্ত করে নিয়েছেন। ওখানে বসে উঠোনেই পিচ্ করে থুতু ফেললেন। লাল পিকের দাগ মাটি শুষে নিতে অপারগ।
কখন পেছনের দরজাটা খুলে গিয়েছে আর সেখান থেকে গঙ্গারামকে প্রায় চমকে দিয়ে বেজে উঠেছে একটি চড়া খনখনে কন্ঠস্বর-- প্যার লাগথন, ও সাহাবমন্! আজ কেইসে আয়ে হো মোর জেইসে গরীব বেসহারা আওরতকে দুয়ার মা? রদ্দা ভটক গইসে কা? গড় করি গো সাহেবেরা! আজ আমার মত গরীব অসহায় মেয়েমানুষের দরজায় কি মনে করে? রাস্তা হারিয়েছ নাকি?
মুচকি হাসেন অজয়। -- অসহায় মেয়েমানুষ বটে! চাইলে গোটা কাঠঘোরাকে কিনে নিতে পারে। বাসস্ট্যান্ড পাড়ার কোন শেঠ আছে যে আজ অব্দি তোর ঘাটে মাথা মুড়োয় নি? বল্, তার নামটা বল্। আমার বন্ধুটিকে সত্যি কথাটা বল্!
--- বললে কি করবে গো তুমি সায়েব?
--- গ্রেফতার করে নিয়ে এসে তোর সামনে ফেলে দেব। আমি থাকতে কার এত সাহস যে আমার মালতী বাঈয়ের দরবারে হাজিরা দেয় নি!
ফিল্মি লফ্ফাজিতে অজয়ের জুড়ি মেলা ভার। দারোগা বটে! গঙ্গারামের অস্বস্তি বাড়ে। মালতী কিছু বলে না। বড়োমানুষের বারফট্টাইয়ের সময় কিছু বলতে নেই যে!
রূপেশ তাকিয়ে থাকে মালতী বাঈয়ের দিকে। ছরহরে বদন মহিলাটির তেলতেলে কালো চেহারায় বেশ জৌলুষ আছে, মানতে হবে। বয়স? আটাশ বছরের ভ্যাবাগঙ্গারাম রূপেশের চেয়ে একটু বেশিই হবে। তেলমাখা কালো চুল শস্তা ফিতে দিয়ে আঁটোসাঁটো করে বাঁধা। পরনে ছাপা শাড়ি আর কালো ব্লাউজ, কপালে একটি কাঁচপোকা টিপ।
হঠাৎ গলায় সুর পাল্টায় অজয়ের। এবার উনি পুরোদস্তুর থানেদার।
-- তো খবর পাক্কি?
-- জী সাহাব! ঝুঠ নহী বোলথন্।
--- কে বাজে কী বাত? কোন কোন রইসে?
মালতী অস্বস্তিভরা চোখে রূপেশের দিকে তাকায়। কিছু বলে না। অজয় সেটা খেয়াল করে বলেন-- এ হামার খাস মিত্র। এখর সামনে কুছু ছিপাইকে জরুরত নো হে। অব্ বোল, খুলকে গোঠিয়াবে ও।
এ হলো আমার বিশেষ বন্ধু; এর সামনে খোলাখুলি কথা বলতে পারো।
তারপর ম্যানেজারকে উদ্দেশ্য করে বল্লেন--শী ইজ এ প্রস্টিটিউট্, নজদিগকে দশ গাঁও মেঁ মশহুর। কিন্তু এ আবার আমাদের পে-রোল্ এ আছে, চালু শব্দে -- পুলিশের খবরী বা মোল্। বাকিটা আপনি ওর মুখেই শুনুন।
মালতী বাঈ মুখে একখিলি পান ঠুঁসে বলতে থাকে।
- আপনারা ওই ছড়াটা তো জানেনই? সেই যে ‘দরস কী লন্দফন্দ’?
ওকে হাত নেড়ে থামিয়ে দিয়ে অজয় বলে ওঠেন--হ্যাঁ, হ্যাঁ,সেই ‘ঝাঁট চাট জাহি' তো? ওসব ফালতু কথা ছেড়ে কাম কী বাত শুরু কর্।
--সেই তো বলছি। খুনটা অনেক দিন আগেই হত। শুধু সুযোগের অপেক্ষা।
তিনটে শয়তানের মধ্যে সবচেয়ে হারামী ছিল আজিজ। এক্নম্বরের আওরতখোর। গাঁয়ের বহুবেটির দিকে হাত বাড়াতে কোন লিহাজ করে না। একটা বউ মরেছে, আর একটাকে ও নিজে তালাক দিয়েছে। ওর কু-নজর পড়ায় ছেলেটা বৌ নিয়ে কোরবা শহরে চলে গেছে। সেখানে মোটর সাইকেল মেরামতের গ্যারেজ চালায়। বাপের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই।
গড়বড়ো হলো যখন আজিজের নজর গেল রসেলু যাদবের মেয়ের দিকে। রসেলুরা চার ভাই। দুধের ব্যবসা, ভাল ক্ষেতিও আছে। মেয়েটাকে জামাই ছেড়ে দিয়েছে, বাপের বাড়িতে আছে কিছু দিন। রসেলু সম্বন্ধীবাড়িতে লোকজন পাঠাচ্ছে- একদিন জামাইয়ের মন গলবে,এসে মেয়েকে নিয়ে যাবে এই আশায়। কী করে যেন শয়তান আজিজ বশ করল ওই বাচ্চা মেয়েটাকে। নিঘ্ঘাৎ জাদুটোনা করেছিল। জানেনই তো, ছুরি গ্রামকে দশকোশের মধ্যে জাদুটোনার জন্যে সবাই জানে। ব্যাংকের পাশের বাড়ির গোঁড় পরিবারের বৌ, লাইনপাড়ার ডোমনের বিধবা, রহসবেড়ার টেঁটকি কোস্টিন(তাঁতিবৌ টেটকি)-- সবকটা ডাকসাইটে টোনহি।(ডাইনি)। একবার যদি লংকাপোড়া হাতে নিয়ে আপনার দিকে তাকিয়েছে--! সেবার হরেলি-অমাবস্যার রাতে--।
-- ফের ফালতু বকবক শুরু করেছিস? কাজের কথা বল। আমার সময় নেই।
ধমক খেয়ে মুষড়ে পরে মালতী বাঈ। গঙ্গারামের আগ্রহ হচ্ছিল টোনহি-উপাখ্যান শুনতে। কিন্তু থানেদারের চোখের দিকে তাকিয়ে চেপে যায়।
-- সেই কথাই তো,আপনি বলতে দিচ্ছেন কই? গতবছর হরেলি-অমাবস্যার রাতে সহেলুরা সদলবল লাঠিসোঁটা নিয়ে আজিজকে ওদের ঘরের পেছনে কোলাবাড়িতে ( বড়োসড় কিচেন গার্ডেন, যাতে শাকসব্জি-লংকা-টম্যাটো-পেঁপেগাছ ও অন্তত: একটি পাতকূয়ো থাকবে) মেয়েটার সঙ্গে ঘিরে ফেলে। কিন্তু আজিজ ন্যাংটো অবস্থায় চাড্ডি হাতে পাঁচিল টপকে পালিয়ে যায়। কথা চাউর হয়ে যায়। মেয়ের শ্বশুর আর ভাসুর বাড়ি বয়ে সহেলুদের যা-নয়-তাই বলে যায়। দুমাস পরে মেয়েটা ভেদবমি হয়ে মরে।
একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে মালতী বাঈ একটু দম নেয়, জল খায়।
সেই সুযোগে অজয় ডোঙ্গরে সরু চোখে তাকান ওর দিকে।
-- ভেদবমি? আমি তো শুনেছিলাম জ্বরজারি!
-- সত্যি সত্যি কী হয়েছিলো আমিও জানিনা। কু-লোকে বলে ঘরের লোকই খাবারের সঙ্গে ধান কে কীড়ে মারনে কী দাওয়াই মিলিয়ে মেয়েটাকে মেরে ফেলেছে, ওকর পেট হো গয়ে রইস না? দু মাহিনাকে। কা লা কা বোলবে তঁয় সহাব! কাকে কী বলা যায়?
রূপেশ জিগায়-- কোন হল্লা হয়নি? থানা-পুলিশ? চীড়ফাড়?
-- আরে গাঁওকে আর এম পি ডাক্তার সার্টিফিকেত লিখ দিস্, পহলে কে থানেদার সাহাব ঘলো কুছ খুরচন-পানি লেকর মান গইস্। কা লা কা বোলবে, সাহাব?
তারপর রসেলুরা সবকটা ভাই গাঁয়ের ঠাকুরদেবের থানে গিয়ে কসম খেল যে ওরা একদিন আজিজকে মারবেই মারবে। যদ্দিন না পারে তদ্দিন নিরামিষ খাবে। আজিজও সতর্ক ছিল। বিনা হাতিয়ার চলা ফেরা করত না। তবু রাত্তিরে কাঠঘোরা থেকে ছুরি ফেরার পথে দুবার হামলা হলো। একবার জেজরা গাঁয়ের নালার পাশে,আর একবার ধনরাস গাঁয়ের ভাটায়। অন্ধকারে ওৎপেতে ছিল রসেলু আর তার দলবল। কিন্তু দু'বারই দরসরাম আগেভাগে খবর পেয়ে আজিজের বডিগার্ড বাড়িয়ে দেয়। ওদের কাছে কাট্টা ( দেশি পিস্তল) থাকে।
--- এবার কি করে ভুল হলো?
-- এবার যোশীমহারাজ আর সহসরাম কেউ গাঁয়ে ছিল না। সরপঞ্চ সঝলাকুমার সাহেব ও নেই। সহসরাম পইপই করে মানা করে গেছিল-- ওরা ফিরে না আসা অব্দি আজিজ যেন ঘর থেকে না বেরোয়। আজিজ ও বেরোয় নি,-- একদিন, দুদিন, তিনদিন। তারপরই জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুলটা করে বসল।
দারু কা চক্কর।
দারু কা লত তো থা পর ও দিন শর্মা গুরুজী লে পইসা মাঙ্গ বইঠে। গুরুজী ইন্কার কিয়ে তো ওলা মা-বহিন কী গালি দে দিস অউর কসকে দু’ তামাচা লাগাইস। ওকর লেইকা মন কে সামনে।
গুরুজী লাজশরম কে মারে ফুট-ফুট কর রো দিস। খানা-পিনা ছোড় দিস। ফির পঞ্চকে পাস জাকে বোলিস -- তুমন ন্যায় কর। মোলা ন্যায় চাহিয়ে, তব তক অন্নজল গ্রহণ নহী করহুঁ।
গুরুজী থাপ্পড় খেয়ে আর মা-বোনের গালি শুনে কেঁদে কেটে এক শা’। পঞ্চদের কাছে গিয়ে বিচার চাইলেন, বললেন এর একটা বিহিত না হলে উনি অন্নজল গ্রহণ করবেন না।
-- ফির?
-- ফির ক্যা? সরপঞ্চ পুরী গিয়ে ছিলেন। তাই উপসরপঞ্চ কর্মনলালের বাড়িতে বৈঠক হলো। সবাই বললো-- পাঠানের বড্ড বাড় বেড়েছে। বাহমণ গুরুজীর( ব্রাহ্মণ স্কুলটিচার) গায়ে হাত? গালি গালাজ? পাপ কে ভান্ডা ফুট গয়ে। অব কুছু করনা পড়ি। সব মিলকর এক পিলান কীস। শ্যামলাল পটেল, সমেলাল সারথী অউ ইতোয়ারু যাদব লা পাঠান লা খাল্লাস করে কে ঠেকা দে দিস। জব তক ওমন জেল মা রহি ওমনকে মাইপিলাকে র্যাশনপানি কী জুগাড় হো জাহি। ছুরি গাঁওকে দামাদ কাঠঘোরাকে পরসন উকিল বিনা ফীস ওমনকে কেস লড়ি।
শ্যামলাল পটেল, সমেলাল সারথী ও ইতোয়ারু যাদবকে ঠিকে দেওয়া হলো পাঠান ব্যাটাকে খাল্লাস করতে। ওরা যতদিন জেলে থাকবে ততদিন ওদের বৌ-বাচ্চাকে খাওয়ানোর ভার বাকি সবার। ছুরি গাঁয়ের জামাই কাঠঘোরার পরসন উকিল বিনে পয়সায় ওদের কেস লড়বে।
থানেদার ও ব্যাংকার যেন মালতী বাঈয়ের জাদুটোনায় পাথর হয়ে গিয়েছে।
-- সব বুঝলাম। কিন্তু ওকে মারল কখন? আর কি করে?
--আজিজ পাঠানকে লাইনপাড়ার ভাট্টিতে মদ খাইয়ে চুর করে নিয়ে এল ওরা তিনজন। তারপর বাজারের তেমাথায় ইতোয়ারুর পানঠেলার সামনে সিমেন্টের বিজলীখাম্বার গায়ে পিছমোড়া করে বাঁধল। সারা গাঁয়ের লোক ফিরিতে মজা দেখল। কেউ কেউ থুতু ছেটাল, কেউ দু-ঘা জুতোর বাড়ি লাগাল। ওরা তিনজন ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে মদ খেল আর ওকে একটু একটু করে পুচিয়ে পুচিয়ে কাটল। কয়েক ঘন্টা ধরে। ও মরলো সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ। তখন নিয়ে গিয়ে পুকুর পাড়ে ফেললো।
-- এত লোক দেখেছে, কেউ কিছু বলবে না?
-- না সাহেব! উকিল এবং উপ-সরপঞ্চ শিখিয়ে পড়িয়ে রেখেছে-- কেউ কিছু দেখেনি।
তবে একটা উপায় আছে। ঐ মোড়ের মাথার সিন্ধি দোকানদারদের ধরুন। ওরা বাইরের লোক, এদিকের গাঁয়ের কেউ নয়। একটু চাপ দিলে উগরে দেবে। তায় ওদের মাথা রামচন্দর সিন্ধিটা বড্ড ভীতু। ওকেই আগে ধরুন।
শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি তো কী?
না, মালতী বাঈয়ের ফর্মূলা খাটে নি। কালোগাড়ি ও একঝাঁক পুলিশ দেখেও গাঁয়ের কারো হেলদোল নেই। কেউ কিচ্ছু দেখেনি।
সিন্ধি দোকানদারেরাও মনে হয় কয় দশক ধরে ছুরি গাঁয়ে থাকতে থাকতে ওদেরই একজন হয়ে গেছে। রামচন্দর সিন্ধি বললো-- এই তেমাথায় ওরকম বীভৎস কিছু হয় নি।
ওকে যখন বলা হলো যে পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী মৃত্যু হয়েছে সন্ধ্যে ছ'টা থেকে রাত ন'টার মধ্যে তখন ও বলল-- সন্ধ্যে ছ'টা? আমাদের তো হুজুর পাঁচটার পর মানে সূর্য ডুবতেই দোকান বন্ধ হয়ে যায়। একি কাঠঘোরা না বিলাসপুর? এ হলো হদ্দ পাড়া গাঁ। এখানে সন্ধ্যে হতেই সব সুনসান, সন্নাটা।
ফিরে গেল কালো ডগ্গা বা গাড়ি নিয়ে পুলিশবাহিনী। কিন্তু থানেদার অজয় ডোঙ্গরের গোঁফের ফাঁকে যেন হাসির রেখা!
কেটে গেল আরো দশটা দিন।
তারপর এল এক বেস্পতিবার, স্থানীয় ভাষায় গুরুবার,-- বৃহস্পতি যে দেবগুরু! রাত্তির আটটা হবে। দরজা বন্ধ করে রূপেশ সেভিংস ব্যাংক লেজারগুলোর ব্যালান্সিং করতে ব্যস্ত ছিল। এমন সময় চ্যাঁ-চ্যাঁ করে কলিং বেজে উঠল। খুলে দেখে নেভি- ব্লু সোয়েটার গায়ে থানেদার ডোঙ্গরে স্বয়ং।
-- চলো দোস্ত! বন্ধুকৃত্য কর। উইটনেস হতে হবে।
-- সে কি? কোথায় যাব?
-- ঐ বাজারের তিগড্ডায়। রামচন্দর সিন্ধির দোকানে। কালো গাড়ি গাঁয়ের বাইরে রেখে পেছনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে এসেছি। এখন তোমার রাজদূত স্টার্ট কর। তবে তো " জানদার সওয়ারি, শানদার সওয়ারি'' স্লোগানটার কোন মানে হবে!
রাত সওয়া আটটার সময় মোটরবাইক থেকে নেমে দুজনে এগিয়ে গেলেন সিন্ধির দোকানে। আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। সবকটা দোকানে চলছে কেনাকাটা, গ্রাহকের ভীড় একেবারে কম নয়। পান দোকানে ফিল্মি গানের ক্যাসেট বাজছে। কথামত ম্যানেজার এক প্যাকেট পানামা আর এক ডজন ডিমের অর্ডার দিলেন।
একগাল হেসে দোকানদার মাল প্যাক করে দেয়। রূপেশ পয়সা দিতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে অন্যদের ঠেলে এগিয়ে আসেন অজয় ডোঙ্গরে। খপ করে চেপে ধরেন রামচন্দর সিন্ধির কব্জি।
--- কী রে! শালা সিন্ধি! সেদিন কী বলেছিলি? পাঁচটায় সব দোকান বন্ধ হয়ে যায়? চারদিক সুনসান হয়ে যায়। সবাই ঝাঁপ ফেলে ঘরে ঢোকে? এখন ঘড়িতে কটা বাজে? কটা বাজে ঘড়িতে? ঠিক করে বল হারামখোর!
ওয়াকি টকিতে নির্দেশ পেয়ে পাঁচমিনিটের মধ্যে এসে যায় কালো গাড়ি। হাতকড়ি পরিয়ে গাড়িতে তোলা হয় সবকটা সিন্ধি দোকানদারকে।
পরের দিন দুপুর বেলা। রূপেশ গেছে লাঞ্চের ফাঁকে স্থানীয় আর এম পি ডাক্তার চন্দু কাশ্যপের ডিসপেন্সারিতে। ডাক্তার নেই, কলে গেছেন ভিন গাঁয়ে। আধঘন্টার মধ্যে এসে পড়বেন। ও চেয়ার টেনে বসে কম্পাউন্ডার ধলা সদনের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়। সদন মহা ফক্কড়। সাইনবোর্ডে লেখা আছে--" হম সেবা করতে হ্যায়,ঈশ্বর চাঙ্গা করতে হ্যায়।'' আমরা চিকিচ্ছে করি, ঈশ্বর ভাল করেন।
সেদিকে চোখ পড়তেই শংকর মিচকে হাসে।
-- ভুল লেখা আছে ম্যানেজার সাহেব। লেখা উচিত--" ঈশ্বর চাঙ্গা করতে হ্যাঁয়, হম নাঙ্গা করতে হ্যাঁয়।''
ঈশ্বর সারিয়ে তোলেন, আমরা ন্যাংটো করি।
দুজনের হাসির ফাঁকে হটাৎ রাস্তা থেকে একটা হৈ-চৈ এর আওয়াজ, এদিকেই এগিয়ে আসছে। ওরা বারান্দায় বেরিয়ে আসে। রাস্তা দিয়ে চলেছে একটা ভীড়, তাতে গাঁয়ের গণ্যমাণ্য ভদ্রজন ছাড়াও তাতে আছে ছোট ছোট বাচ্চার দল। সবার আগে কোমরে দড়ি আর হাতে হাতকড়ি বাঁধা অবস্থায় চলেছে শ্যামলাল, সমেলাল ও ইতোয়ারু। গন্তব্য বড়ো রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো পুলিশ ভ্যান।
রূপেশের মন খারাপ হয়ে যায়। মাত্র তিনমাস আগে এই তিনজনকেই ও গ্রুপ-গ্যারান্টিতে আই আর ডি স্কীমের লোন দিয়েছিল। প্রত্যেক কে পাঁচ-পাঁচ হাজার। তখন এদের বেশ শান্ত, ভদ্র মনে হয়েছিল। এরা কি করে অমন কাজ করতে পারলো?
হটাৎ ওর দিকে চোখ পড়তেই শ্যামলাল হাত তোলে, হাতকড়ায় বদ্ধ জোড়াহাত।
-- প্যার পরথন হো সাহাব। শ্বশুরাল যাথন। ব্যাংক লোন বর চিন্তা ঝন করবে। ও পইসা পট জাহি।
ব্যাংক লোন নিয়ে ভাববেন না। শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি তো কী? কিস্তি ঠিক আদায় হবে।
তিনজনই হেঁটে যাচ্ছে মাথা উঁচু করে। নীচু গলায় নিজেদের মধ্যে কোন চুটকি শুনিয়ে হেসে উঠছে। চেহারায় কোন গ্লানির চিহ্ন নেই।
জায়।
১০)
‘রঙ পিচকারি, সন্মুখ মারি,
ভিগি আঙিয়া, অউর ভিগি শাড়ি’
বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক অনেক সহজ হলেও এতদিনের আড়ষ্টতা কি সহজে কাটে? তবু ভেবেছিল হোলিতে এবার দিন দুইয়ের ছুটি নিয়ে ভিলাই যাবে। কিন্তু ভেতর থেকে কোন উৎসাহ পাচ্ছে না রূপেশ। আসলে ওর চাকরি পাকা হয়ে যাওয়ায় বাড়িতে একটা বিয়ে বিয়ে হাওয়া উঠেছে। মায়ের চিঠিতে ইঙ্গিত স্পষ্ট, বড়ী ভাবীর কোন মাসতুতো বোন নাকি খুব গুণের মেয়ে, রূপে গুণে অপ্সরী ও বিদ্যাধরী। আবার ভিলাইনগরের সিরিয়ান ক্রিশ্চানদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল হোলি ক্রস থেকে পাশ করে গার্লস ডিগ্রি কলেজ থেকে মাইক্রো-বায়োলজি নিয়ে মাস্টার্স করেছে। আবার ভাতখন্ডে সংগীত মহাবিদ্যালয় থেকে তিনবছর গান শিখেছে।
তা বেশ, কিন্তু অমন গুণবতী কন্যে এই অজ আদিবাসী বহুল পাড়াগাঁয়ে কেন আসবে রূপেশ ভেবে পায় না।
তবে মাতারাম জানিয়েছেন যে ওই পরিবারের মেয়ে সব জায়গায় মানিয়ে নিতে পারবে। অমনই ট্রেনিং পেয়ে বড়ো হয়েছে, তাছাড়া আজ নয় কাল ছেলের প্রমোশন হবে,তখন নিশ্চয় কোন শহর বা মহকুমা সদরে ওর ট্রান্সফার হবে, গ্রামীণ ব্যাংক বলে কি সারাজীবন বনবাসে কাটাতে হবে? তাই হোলিতে দু’দিন ছুটি নিয়ে ঘরে আসলে দু’পক্ষেই ভাল রকম দেখাশোনা হতে পারে।
আর এই সম্ভাবনাকেই ভয়। মেয়েটিকে ঠকানো ! কী করে একটি অচেনা মেয়েকে প্রথম দেখাতেই বলবে যে ও যেখানে চাকরি করে সেখানে ব্যাংকের কোয়ার্টারে কোন সেপটিক ট্যাংক নেই,আধুনিক কিচেন নেই,রান্না হয় কেরোসিনের জনতা স্টোভে? সামনের রাস্তাটিতে নুড়ি পাথর বিছানো, স্নান করতে হবে দোতলার পেছনের বারান্দায় পর্দা টাঙিয়ে, রাস্তায় বেরোলে দশজোড়া চোখ এমন হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে যেন কোন মাদারির ভালুক অথবা বহুরূপীর সঙ দেখছে। পেছন থেকে মহিলাদের ছুঁড়ে দেওয়া কমেন্ট ভেসে আসবে,‘কেইসন বেশরম অউরত! মুড় নাহি ঢাকে ও?’
কেমন মেয়েছেলে গো, লাজ-লজ্জার বালাই নেই ? মাথায় ঘোমটা নেই গো!
মেয়েটির জন্যে কোন সিনেমা হলো নেই,ইংরেজি পত্রিকা নেই,সারাদিন ওপর তলায় বন্দী হয়ে থাকতে হবে? আলাপ করার মত কাউকে পাওয়া যাবে না। একটা ট্রানজিস্টর রেডিও আছে গান ও খবর শোনার জন্যে, আর বিয়ের কথা শুরু হতেই রূপেশ টি ই বিলের পয়সা জমিয়ে একটা প্যানাসোনিক টেপ রেকর্ডার কিনেছে; কেন? তা নিজেই জানে না।
রোজ রোজ বাজার হাট হবে না। তবে উইক এন্ডে বাসে বা মোটর বাইকে স্বামীর পেছনে বসে কোরবায় মালগুদামের মত সিনেমাহলে ভ্যাপসা গন্ধওলা সীটে বসে সিনেমা দেখে কোন রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেয়ে গাঁয়ে ফেরা যেতে পারে।
রূপেশের রকম সকম দেখে নতুন জয়েন করা ফিল্ড অফিসার ভগতরাম ধৃতলহরে জিজ্ঞেস করেই ফেলল—স্যার, হোলিতে বাড়ি যাবেন না ?
--ভাবছি; কিছু কাজ পেন্ডিং আছে।
-- আরে কাজ তো সারাজীবনই থাকবে; একটা শেষ হলে আরেকটা। ওর কি শেষ আছে? কিন্তু আগের দিন সন্ধ্যেয় হোলিকা দহন করে সকাল বেলায় বন্ধুদের সঙ্গে এ’পাড়া ও’পাড়া বে’পাড়া সে’পাড়া করা, হাসিমুখে গাল পাড়া ও গাল শোনা –এর মজাই আলাদা!
রূপেশ হেসে ফেলে। বিলাসপুরের চাটাপাড়া, জুনি লাইন, তিলক নগর, সাত্তাইশ খোলি, তারবাহার –এ’সব জায়গায় রঙ মেখে সাইকেলে চেপে দল বেঁধে হো-হো করে ঘুরে বেড়ানো, লালাপড়ায় যোগেশ শ্রীবাস্তবের বাড়িতে ভাঙের পকোড়া এবং হুইস্কির অবাধ আচমন; আর একটা টুলের ওপর অ্যামপ্লিফায়ারের বাক্স বসিয়ে বাজারচলতি হিন্দি গানের সঙ্গে ধিড়িং ধিড়িং নাচা এসব দশ বছর আগেও করেছে।
কোন পঁহুচা হুয়া বন্ধু হয়ত ধরতাই দেবে —‘লালাজি কা লাল গাঁড় পিত্তল কা পৌয়া’,
এরা সঙ্গে সঙ্গে কোরাসে চেঁচিয়ে উঠবে—‘লালা জহাঁ গাঁড় মারাবে তহাঁ নাচে কৌয়া।‘ সেই পরীক্ষা হলে মোবাইল স্কোয়াডের টুকলি ধরার ঘটনার পর থেকে বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক ‘কাচ্চি’ হয়ে গেছে। তবু কোন কোন হোলিতে বাড়ি গেছে। রঙে অ্যালার্জির অজুহাতে খেলা এড়িয়ে বাবাপ-মাকে দাদা- বৌদিকে প্রণাম সেরে ঘরে বই পড়ে আর রেডিওতে বিবিধ ভারতী শুনে নমো নমো করে ছুটির দিনটা কাটিয়ে দিয়েছে।
এবার জুটেছে নতুন ফ্যাকড়া। বৌদির ভগিনীটি ও তাহার মাতা ঠাকুরাণীর একান্ত ইচ্ছা প্রস্তাব অধিক অগ্রসর হইবার পূর্বে পাত্র-পাত্রীর চারিচক্ষের মিলন, আলাপচারিতা ইত্যাদি হঊক।
আজকাল কী পড়িলিখি লড়কী। খুদ নাপতোল কে দেখনা চাহতী হ্যাঁয়—ছেলেটা ঠিক কতটা গেঁয়ো,আর ছেলের মুখ থেকে শুনে বুঝে নিতে চায় ছুরিকলাঁ গ্রাম ঠিক কত অজ পাড়া গাঁ!
রূপেশের পিত্তি চলে যায়। ঠিক করে ফেলে হোলির সময় এখানেই থাকবে। মেয়েপক্ষ জোরাজুরি করলে পরে কোন উইক এন্ডে, সে দেখা যাবে’খন।
হোলিকা দহন অথবা একদিন আগে ‘হোলিকা’ রাক্ষসীকে পুড়িয়ে মারার অনুষ্ঠানের দিন ও সবাইকে তিন ঘন্টা আগে ছেড়ে দিল। সূর্য ডুবলেই বাসের সংখ্যা কমে যায়, কারণ বিভিন্ন মোড়ে নির্জন পথের বাঁকে খালের ধারে বাসরাস্তায় কে বা কাহারা বোল্ডার দিয়ে ব্যারিকেড করে বাসের রাস্তা আটকে দেয়। ড্রাইভার কন্ডাকটর খালাসী ও যাত্রীরা মিলে ‘দম লগা কে হেঁইসা’ করে পাথর সরায়। কোথা থেকে ছুটে আসে ঢিল।
এই খেলাটা বহু দশক ধরে পরম্পরা অথবা রীতি-রেওয়াজের নামে সবার গা সওয়া হয়ে গেছে। তাই ঘরে ফেরা সরকারি কর্মচারির দল সন্ধ্যের আগেই ঘরে ফিরতে চায়।
তবে ছুরি গাঁয়ের সরকারি চাকরিজীবিদের আরও একটা তাড়া আছে। প্রতি বছর এই রাতে কয়েকজন সরকারি কর্মচারিদের বন্ধ দরজার সামনে ‘মটকি ফোঁড়’ খেলা হয়। অর্থাৎ একটা মাটির হাঁড়ি ওদের বারান্দায় আছড়ে ফেলে ক’জন দুদ্দাড় করে ছুটে পালায়। আর ভাঙা হাঁড়ি থেকে গড়িয়ে পরে থকথকে হলদে পূতিগন্ধময় আবর্জনা, যা কয়েকদিন ধরে এই উপলক্ষে জমিয়ে রাখা ছিল। এ নিয়ে নালিশ করে লাভ নেই। সবাই বলবে—‘বুরা না মানো, হোলি হ্যাঁয়’।
গত দুই বছরে রূপেশ ছাড় পেয়েছে, কারণ ও ব্যাচেলর! কিন্তু ঠুল্লু এসে বিকেলের চা দেবার সময় জানিয়ে গেল, কানাঘুষোয় শুনছে এবার ছাড়া নাও পেতে পারে।
--সাহাব, আজ রাত বারো বাজে তক জাগতে রহনা, অউ বারান্দা কী বাত্তি রাতভর জ্বলনে দীজিয়ে।
সকালে ঠুল্লুর দরজা খটখটানোয় ঘুম ভাঙে। ও কলিং বেল বাজায় না। রূপেশেরই বারণ; এর আওয়াজটা বিচ্ছিরি, ঠাস ঠাস! বুকে এসে লাগে।
নাঃ,রাতটা ভালোয় ভালোয় উতরেছে; এবারেও ছাড়। কিন্তু সকাল ন’টা দশটা নাগাদ রঙ খেলার দল বেরিয়ে পড়বে, মিছিল করে নাচতে গাইতে। ঠুল্লু চা-জলখাবার দিয়ে একঘন্টার মধ্যে ভাতে-ভাত, ডাল, আলুসেদ্ধ ও ডিমের ঝোল রেঁধে ফেলে। যাবার আগে বলে যতই দরজা বন্ধ করে রাখুন, ইয়ার-দোস্ত এলে খুলতেই হয়। ধরুন, যদি রামখিলাওন, গিরীশ, সদনলাল, কুমারসাহেব এরা এসে ডাকতে থাকেন?
তাই একটা পুরনো কুর্তা আর পাজামা পরে রেডি হয়ে থাকুন। আজ সবার সঙ্গে মিলিয়ে মিছিলে হাঁটুন, রঙ মাখান, রঙ লাগান। তারপর সবাই মিলে বড়া তালাওয়ে বেলা একটা নাগাদ ডুবকি লাগিয়ে সাফ সুতরো হয়ে নেবেন। যদি ভাঙ খাবার ইচ্ছে থাকে তো আমাকে বলবেন, সদনলালের ঘরে ভাঙের শরবত,ভাঙের পকৌড়া –সব বন্দোবস্ত হয়েছে। আর পকেটে রাখুন লাল গুলালের এই ছোট্ট প্যাকেটটি—জোশী মহারাজ মন্ত্র পড়ে শোধন করে দিয়েছেন, আপনার এলার্জি হবে না
ঘন্টাদুই পরে গাঁয়ের সদর রাস্তা দিয়ে হোলির মিছিলের চলা শুরু হলো। কে নেই তাতে? সদনলাল, রামখিলাওন, দুই বিদুষক ঠিবু ও রসেলু, পান ঠেলার ইতোয়ারু, আয়ুর্বেদিক ডাক্তার জৈন, স্কুলের দুই গুরুজি ধীরহে স্যার ও মিশ্রজি- সবাই চলেছে নাচতে গাইতে।
মাঝে মাঝে হররা উঠছে,হোলি হ্যাঁয়, হোলি হ্যাঁয়।
হ্যাঁ রে বাবা! সবাই জানে আজ হোলি, এত বলার কী আছে? রূপেশ কী একটু বিরক্ত হচ্ছে! ও কি ইদানীং একটু বুড়োটে হয়ে পড়েছে? সদনলাল ইতিমধ্যেই বেশ ক’পাত্তর চড়িয়েছে। ও এক ডিগ্রি গলা চড়িয়ে শূন্যে ঘুষি ছুঁড়ে বলছে – মা কসম, আজ হোলি হ্যাঁয়।
সেই শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ছে মিছিলের ছেলে বুড়ো। ভিড়ের থেকে এগিয়ে এসেছে একটি ছেলে। তার হাতে একটি আধখানা আলুর টুকরো। সে এসে রূপেশের বুকে স্ট্যাম্প মারার মত করে টুকরোটা চেপে দেয়। তাতে কিছু লেখা, রূপেশ পড়ার চেষ্টা করে। ভিড়ের মধ্যে গর্জন উঠে—চোদা লে!
রূপেশ চমকে ওঠে, হাসির হররার মধ্যে ডাক্তার জৈন বলেন—এ হে হে! একদম গ্রামীণ ব্যাংক কা স্ট্যাম্প লগ গয়া। কিউঁ ম্যানেজার সাহাব।
অপ্রস্তুত রূপেশ বুঝতে পারে যে ওই প্রাকৃত শব্দযুগ্ম ওর জামার বুকে লেগে আছে। ছেলেটিকে চিনতে পারে-- ডাক্তার জৈনের ছেলে, বিলাসপুরের কলেজে পড়ে। গতমাসে ‘শিক্ষিত বেরোজগার’ স্কিমের নাম করে পঞ্চাশ হাজার লোন চাইতে এসেছিল; খালি হাতে ফিরে গেছে।
মিছিল এগিয়ে চলে, এবার সহিস মহল্লা হয়ে বাজারের দিকে। রাস্তার দুদিকের বারান্দায় মেয়েরা এসে ভিড় করে হাসিমুখে মিছিল দেখছে। তবে এই গাঁয়ে নারীপুরুষের প্রকাশ্যে রঙ খেলার চলন নেই।
একটা হট্টগোল। সহিস মহল্লার পাশে একটা এক কামরার টালির ঘর থেকে ঘাসীরাম আগরওয়াল ও ঠিবু টেনে বের করছে এক পাকাচুল ষাটের ঘর ছোঁয়া বুড়োকে। সাদা খাদির কুর্তা ও একই কাপড়ের পাজামা পরা মানুষটি লজ্জা ও সংকোচে নুয়ে পড়েছেন।
একটু তোতলা এই ভদ্রলোক স্থানীয় মানুষ ন’ন। দু’বছর হলো এখানে একটি হাতকর্ঘা সঙ্ঘের ছোট্ট বিপণি খুলেছে, উনি তার প্রতিনিধি এবং একমেবাদ্বিতীয়ম সেলসম্যান। ব্যাংকে জমাখাতা খোলার সুবাদে রূপেশ জানতে পেরেছে উনি গোয়ালিয়রের অধিবাসী। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোন ঝামেলা হওয়ায় চাকরিটা যেতে বসেছিল। শেষে কিছু পলিটিক্যাল মুরুব্বি ধরায় চাকরি যায় নি, তবে ঝাঁসি থেকে একহাজার কিলোমিটার দূরে এই আদিবাসী এলাকায় আসতে হয়েছে।
রূপেশ টের পেয়েছে যে ওঁর বিক্রিবাটার হিসাব-কিতাব পাকা ও সাফ সুতরা নয়। কিন্তু রূপেশ কী করতে পারে,গোটা দুনিয়ার ভালোমন্দের বোঝা কি ওর কাঁধেই ভগবান চাপিয়েছেন? না; এত অহংকার ভাল নয়।
আর উনি একটু লক্ষ্মীট্যারা। এই নিয়ে গাঁয়ের স্কুলে দু’পাতা পড়া ছেলে ছোকরার দল ওঁর নাম দিয়েছে ‘ লুকিং লণ্ডন, টকিং টোকিও’।
কিন্তু ঘাসীরাম সদনলাল এদের উৎসাহের পেছনে অন্য কারণ। সামান্য আয়ের এই মানুষটি দেশের বাড়িতে যান বছরে একবার,দীপাবলীর সময়। এখানে গাঁয়ের সমাজ ওকে আপন করে নেয় নি; পরদেশি ছাপ লাগিয়েই ছেড়েছে। এই বয়েসে হাত পুড়িয়ে খেতে ইচ্ছে করে না। তাই এখানকার নীরস জীবনে একটু খানি মাধুর্্যের ছোঁয়া পেতে উনি চুড়ি পরিয়ে ঘরে তুলেছেন একটি জোয়ান মেয়েছেলেকে; সহিস মহল্লার। একে এখানে বলা হয় ‘চুড়িহাই পত্নী’। তবে এর জন্যে সমাজের বৈঠক ডেকে মেয়ের বাপ-মাকে মোটা টাকা ফি দিতে হয়েছে। তবে মেয়েটির বয়েস তিরিশেরও কম। সবাই হাসে; বলে – বুড়ো দাদু নাতনিকে বে করেছে।
কিন্তু সেদিন মেয়েটি আবদার ধরল যে ওকে একটা ট্রাঞ্জিস্টার কিনে দিতে হবে, নইলে ও ফিরে যাবে। ভদ্রলোক, অর্থাৎ পেন্ডারকরজি মেয়ের বাপ-মার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করে শেষে মাসিক কিস্তিতে একটা এনে দিলেন। সেটাই কাল হলো। রেডিও পেয়ে ওর ফুর্তি গড়ের মাঠ। সন্ধ্যে বেলা হস্তকর্ঘা শিল্পের, মানে হ্যান্ডলুমে তৈরি জামাকাপড়ের দোকান বন্ধ করে উনি ঘরে ফিরে দেখলেন যে ওনার দু’বোতল মহুয়া ফাগনী বাঈ একাই মেরে দিয়ে টুন হয়ে আছে। ভাতের হাঁড়ি বাড়ন্ত, উনুনে জল ঢালা। রাগের চোটে মুখ দিয়ে কথা বেরোল না। তোতলাতে তোতলাতে এসবের মানে কি জিজ্ঞেস করায় ফাগনী বাঈ ওঁর থুতনি নেড়ে গেয়ে উঠল—‘লারে লাপ্পা, লারে লাপ্পা, লাই রাখদা”!
পেন্ডারকর বুড়ো হলে কী হবে, পুরুষ বটেন! তাই নেভা উনুনের চ্যালাকাঠ তুলে মেয়েটাকে বেধড়ক পেটালেন। ফল ভাল হলো না। হাজার হোক, উনি পরদেশি আর ফাগনী বাঈ ছোটজাত হলেও এই গাঁয়েরই মেয়ে। ও রেডিও কাঁধে ঝুলিয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করল।
সে রাতেই জাতি পঞ্চায়েতের বৈঠক বসল। আর পেন্ডারকরকে ৫০০ টাকা জরিমানা করল। উনি ব্রাহ্মণ, নইলে নিঘঘাৎ মার খেতেন।
পুরো ব্যাপারটা গাঁয়ে জানাজানি হয়ে গেলে যত আমোদগেঁড়ে তামাশবীন ওঁকে কাকের পালে ফেঁসে যাওয়া শালিকছানার মত সময়ে অসময়ে ঠোকরাতে লাগল।
তবে রূপেশ ওঁর অন্য একটি পরিচয় ও জানে। ভদ্রলোক অসাধারণ সুরে গান গাইতে জানেন। তখন একেবারে তোতলাতে হয় না। হোলির একপক্ষ আগে থেকে যখন ছেলে ছোকরার দল সকাল বিকেল নাগাড়া বাজিয়ে বেসুরো গলায় চিৎকার করে ‘ফাগ’ (হোলি বিষয়ক লোকসংগীত) গাইতে থাকে, তখন উনি এক সন্ধ্যায় ইমন ও ছায়ানটে উত্তর ভারতের লোকসংগীত এবং বিহারের চৈত্রমাসের গান ‘চৈতা’ এবং ‘চৈতি’ গেয়ে রূপেশের মনমেজাজ একদম ‘গার্ডেন- গার্ডেন’ করে দিয়েছিলেন।
ওঁর হেনস্থা সহ্য করতে না পেরে রূপেশ বলে – আরে আপনি চলুন আমাদের সঙ্গে, কোন সংকোচ করবেন না। আমাদের হোলির গান শুনিয়ে মাহোল উমদা করে দেবেন।
সবাই অবাক। এই ঘাটের মড়া বুড়ো হাবড়া গান গাইতেও জানে? খালি মেয়েবাজি নয়? ঠিক আছে, ম্যানেজার সাহাব যখন নিজে বলছেন।
উনি রূপেশের দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকিয়ে হেসে তুতলে তুতলে বললেন—তাহলে একটু পেট্রল ভরে নিই?
হাসির হররার মাঝে মিছিল দাঁড়িয়ে পড়ে। উনি মাথা নীচু করে একটি ঝোপড়ার মধ্যে ঢুকে যান ও মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বেরিয়ে আসেন। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে ভিজে গোঁফ মুছে সবার দিকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চোখ মেলে তাকান।
আর স্পষ্ট উচ্চারণে বলেন—একটি শর্ত আছে, আমি এক লাইন গাইব, তারপর সবাইকে সেটা রিপিট করতে হবে।
হুঁ হুঁ করে সুর ভেজে শুরু করেন—রাধা গয়ে হ্যাঁয় মেলে, শ্যাম অকেলে।
মিছিল সরু মোটা আওয়াজে গলা মেলায়।
মিছিল এগিয়ে চলে—এবার রহসবেড়া হয়ে গাঁয়ের শেষপ্রান্তে রাজবাড়ির দিকে।
মিছিল মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে এক জলদ গম্ভীর কন্ঠস্বরে শ্যাম নামের নটখট রাখাল যুবকের প্রণয়লীলা, ছলাকলা, রাধার অবর্তমানে অন্য গোপিনীদের সঙ্গে রাসলীলা।
রাধা মেলায় যান, একলা ঘরে শ্যাম
ক্রমশঃ ছুরিকলাঁ গাঁয়ের অধিবাসীদের মানসে ধরা পরে তাদের বহুপরিচিত এক চালচিত্র। এই লীলা, এই কিশোরীকে বাঁশির ডাকে ভোলানো, তারপর একদিন অন্য কারও দিকে ঢলে পরা—এ তো বহুবার ঘটেছে। কারও কারও নিজেদের জীবনে, কারও চেনা পরিবারের মধ্যে।
এইভাবে মিছিল পৌঁছে যায় রাজপরিবারের সিংহদরজার সামনে। জোরে জোরে বাজতে থাকে মাদল, বাজে ঝাঁঝ।
‘রঙ পিচকারি, সন্মুখ মারি,
ভিগি আঙিয়া, অউর ভিগি শাড়ি’
খবর পেয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন যুবরাজ সাহাব। চন্দ্রচুড় অনঙ্গপাল সিং। মুখে বসন্তের দাগ, পরিষ্কার করে কামানো গাল, আজ পরনে সিল্কের ধুতি ও কুর্তা।
সামনে পেতলের বিশাল থালায় ফাগ ও পেঁড়া নিয়ে দু’জন নৌকর।
সবাই ওঁর পায়ে আবির দেয়,উনি মাথায় হাত রাখেন ও নৌকর সবার হাতে একটি করে পেঁড়া তুলে দেয়। শেষের দিকে পেঁড়া ভেঙে আধখানা করা হয়। মিছিলে লোক যে অনেক!
রূপেশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে সিংহ দরজার মাথায় খোদাই করা ওঁদের কোট অফ আর্মস দেখছিল। সাল লেখা ১৯০৩।
উনি খেয়াল করে হাত তুলে ডেকে নিজহাতে গুলাল লাগিয়ে কোলাকুলি করলেন আর ওঁর ইশারায় নৌকর ওকে দিল এক গেলাস ঠান্ডাই মেশানো শরবত। ভ্যাবাচাকা রূপেশ চোঁ চোঁ করে গেলাস খালি করে ফেরৎ দিল। ওর একটু লজ্জা করছিল, দু’মাস আগে যুবরাজ সাহেবের দশ হাজার টাকার লোনের আবেদন ও খারিজ করে দিয়েছে যে! জানে, ওই পয়সা ফেরৎ পাওয়া মুশকিল। কারণ, এঁর রাজওয়াড়ার ভেতরে হাঁড়ির হাল।
এবার ফেরার পালা। সবাই গাইছে—“ হোলি মেঁ ঝুম গয়ে শ্যাম, আরে হোলি মেঁ!”
ফেরার পথে সবাই জোরাজুরি করলে রূপেশ একটু নেচে দিল। হো-হো ও হাততালি!
ও বুঝতে পারল যে শরবতে সিদ্ধি মেশানো ছিল।
অনেকদিন পরে আবার পুকুরে স্নান। এই গাঁয়ে সাতটা পুকুর। তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড়ো, মাঝখানে প্রায় দু’বাঁশ গভীর। গ্রীষ্মকালেও এর জল শুকোয় না। সবাই বলে পুকুর পাড়ে বটগাছের তলায় যে বাড়রাণীর মন্দির, তার মহিমায় এই জল অতল অথৈ।
জামাকাপড় পারে রেখে ডোরাকাটা আন্ডারওয়ার পরে জলে নামার সময় ওর হাত টেনে ধরে ডাক্তার কাশ্যপের ‘ভুরা’ কম্পাউন্ডার। বলে সাঁতার না জেনে বেশি এগোনো ঠিক নয়। বুক জলে নেমে সাবান মেখে ডুব দিলেই হবে। গরুমোষ ধোয়ানো? হ্যাঁ,তা হয় বইকি। তবে এ পাশে নয়, ঠিক উলটো পাড়ে। ভাঙাঘাটের দিকে। এদিকে নব্বই ডিগ্রি কোণ করে দুটো ঘাট বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে শুধু স্নান করার জন্যে, ছেলেদের ও মেয়েদের ডুব দিয়ে উঠে গা মুছতে শুরু করেছে কি কানে এল অশ্রাব্য গালাগাল। গরু ধোয়ানোর ঘাট থেকে ঘাসীরাম চেঁচাচ্ছে ভুরা কম্পাউন্ডারের উদ্দেশে। সম্পর্ক জুড়ছে এর বোন ও বৌয়ের সঙ্গে। রূপেশ ভয় পায়, এবার কি একটা হাতাহাতি শুরু হবে? এ ভাবেই একটা সুন্দর দিন নষ্ট হবে?
কিন্তু ভুরা যে হেসেই খুন। তারপর ও কিছু পালটা দিল, তবে ঘাসীর সঙ্গে খিস্তি করায় পেরে ওঠা দুষ্কর।
রূপেশের বিব্রত ভাব দেখে ভুরা আশ্বস্ত করে।
ঘাবড়াবেন না,ও আমার বন্ধু।
বন্ধু? তা বলে ওইসব সম্বোধন? ওই ইতর ভাষা?
আরে এটা হোলি যে! আজ সাতখুন মাপ। হোলির দিন এই দিয়েই শেষ হয়। আপনি ওই দোঁহাটি শোনেন নি?
“ হোলি মেঁ হম ঝুম গয়ে সব,
মুঁহ মেঁ ভাঙ কী গোলি হ্যাঁয়।
অগর কিসীকা পোল খোলে তো
বুরা না মানো হোলি হ্যাঁয়।“
ভিজে পোষাকে ঘরে ফেরে রূপেশ। মাথাটা ভার ভার, সিদ্ধির প্রভাব টের পাচ্ছে। তালা খুলে ঘরে ঢুকে কাপড় মেলে খাবারের ঢাকনা খুলে গোগ্রাসে খেতে থাকে। ঠুল্লু একটা বাটিতে করে খানিকটা ক্ষীর (পায়েস) দিয়ে গেছে।
এবার ঘুমনোর পালা। ঘুম, ঘুম। শ্রান্ত শরীরের ক্লান্তিহরা ঘুম। আজ রূপেশ কোন স্বপ্ন দেখে না। কতক্ষণ কেটেছে জানে না। কলিংবেল বাজাচ্ছে কেউ। অনেকক্ষণ ধরে। ভারি চোখের পাতা এঁটে বসেছে। এই অসময়ে কে এল? বিছানায় উঠে একটু বসে নেয়, তারপর দরজা খোলে। খুলে পাথর হয়ে যায়।
কারুকাজ করা রুমালে ঢাকা একটা থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দ্রুপতী বাঈ; এবার ওর অবস্থা দেখে প্রায় ঠেলা মেরে ভেতরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। টেবিলের উপর থালা নামিয়ে বলে ঢাকনা খুলে দেখায়—এক বাটি মাংস আর পায়েস, ওরা বলে ‘ক্ষীর’।
চোখে ঝিলিক দিয়ে বলে –আমি নিজে রেঁধেছি, আপনার খারাপ লাগবে না।
তারপর আঁচলের খুঁট থেকে একটু আবির নিয়ে নীচু হয়ে রূপেশের পায়ে দিতে গেলে ও বাধা দেয়। কিন্তু ও দ্রুত হাতে পায়ে হাত দিয়ে মাথা তোলার সময় রূপেশের থুতনিতে টক্কর লাগে। অপ্রস্তুত দ্রুপতী থুতনিতে হাত বুলিয়ে শুধোয়—সাহেবের লেগেছে কি না ?
তারপর হাসিমুখে রূপেশের দিকে নিজের আঁচলের ফাগ এক চিমটি দিয়ে অপেক্ষা করে আশীর্বাদী রঙ লাগানোর।
রূপেশ কেঁপে ওঠে, সারা শরীরের তার ঝন ঝন করে। এমন অনুভূতির সঙ্গে ওর পরিচয় ছিল না। দু’আঙুলে রঙ নিয়ে কোথায় লাগাবে ভেবে পায় না। চোখে পড়ে মেয়েটির এগিয়ে আসা মুখ, কপালে কাটা দাগ। কোনরকমে তড়িঘড়ি করে সেই কাটা দাগের উপর লেপে দেয় লাল আবির। চমকে উঠে পিছিয়ে যেতে গিয়ে দ্রুপতীর পা হড়কায়; আর কিছু না ভেবেই রূপেশের ক্রিকেট খেলা হাত ওকে স্লিপ ফিল্ডারের মত ধরে সামলে নেয়। কিন্তু রূপেশ যে ওকে ছেড়ে দিতে পারছে না,ধরেই আছে। ওর মাথায় ছবি আসে, বিহারী টকিজে দেখা রাজ কাপুরের ‘আর কে ফিল্মস’ এর লোগো।
হাত ছাড়িয়ে মুক্ত হয় দ্রুপতী। ওর চোখে বিস্ময়।
তারপর শাড়ি ঠিক করতে করতে অন্য দিকে তাকিয়ে বলে – এ গাঁয়ে আপনাকে সবাই দেবতা বলে, আমিও। আপনি চাইলে না করতে পারব না। আপ বহুত বড়ে হ্যাঁয়, সেই পিকনিকের সময় দেখে নিয়েছি। অব আপ যো কহতে হ্যাঁয়—
রূপেশের শরীর ঝিমঝিম করে।
অবশ শরীরে ও মাথা নেড়ে পাশের চেয়ারে বসে পড়ে। দ্রুপতী চলে যাওয়ার সময় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যায়।
0 comments: