গল্প - সমরেন্দ্র বিশ্বাস
Posted in গল্প
মোগল সাম্রাজ্য পতনের কারণ আমার বুকের উপর অগোছালো। এত অল্প রাতেই চোখে পাতালের টান। দুটো পাতাই বুঁজে আসছে। বাইরে লোকজনের আনাগোনা। আর্তস্বর, গোঙ্গাণি। এসব কিছুই কানে যাবার কথা নয়, তবুও যাচ্ছে।
শীতের রাত। অ্যানুয়াল পরীক্ষা সামনেই, আমি ইতিহাস পড়ছি। বাড়ির একটা আলাদা খোপ, সেখানেই অন্য একটা সাম্রাজ্যে শুয়ে আছে আমার অসুস্থ জেঠিমা। সহায়সম্বল হীন, নিঃসন্তান বিধবা, আমাদের সংসারেই থাকে। দেবর-বৌ এর সংসার। এই সংসারে কোনওমতে টিকে থাকতে থাকতে কি এক স্নেহ, মায়া আর মমতার বন্ধনে জেম্মা আমাকেও আষ্টেপিষ্টে বেঁধে নিয়েছে। আমিই হয়ে গেছি জেঠিমার একমাত্র সন্তান। আমি দুদন্ড চোখের আড়াল হলেই জেম্মার বুক হাফরের মতো ওঠেনামে। কোথায় গেল জটু?
এই জ্যেঠিমা রাত্রে এখন মৃত্যু সজ্জায়। কাঁথার বিছানা, ঘটিতে রাখা জল, ঢাকনাটা নীচে নামানো। আওয়াজ ভেসে আসছে- তুলসি পাতা নিয়ে আয়, বোতলে রাখা গঙ্গা জলটা ওদিকেই আছে, একটা ঝিনুক নিয়ে আয়। পাড়ার ফটিক ডাক্তার নাড়ি দেখে ফিরে গেছে। খোপের অন্ধকার বলছে, তাকে আর বাঁচানো যাবেনা। তবুও রাতের জোনাকিদের ভাবান্তর নেই, গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে সেগুলো নাচছে, অন্ধকারে জ্বলছে-নিভছে লুসিফেরিণের আলো।
ইতিহাস বই আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক ক্লান্তির দেশে, হাত ঝিমঝিম পা ঝিমঝিম, হাল্কা শীতের কাথায় ঘুম ঘুম শরীর, শিয়রের কাছে পুরোণো টেবিলে লন্ঠনের আলো। আলোর তেজ কমে আসছে। তেল কি ফুরিয়ে এলো?
রাত্রে কেউ যখন মারা যান, তখন তাঁর প্রিয় মানুষটির দুচোখে ঘুম নেমে আসে। ক্লোরোফর্ম গন্ধ; অ্যানাস্থেশিয়ার রুমাল নাকে উড়ে আসে। তাকে কেউ জাগিয়ে রাখতে পারে না। বুকের পাশে কাত হয়ে পড়ে থাকাবই, মোগল সাম্রাজ্য পতনের কারণ, নিভে যাওয়া লন্ঠন; আমি বিছানাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
পাশের বাড়ীর পিসি আমাকে ডেকে তুললো- ‘জটু , ওঠ, ওঠ রে বাবা, উঠে পড়, তোর জেম্মা মরে গেছে।’
রাত্রি তখন বোধ হয়সাড়ে দশটা। সেসব দিনে মৃত মানুষকে বেশীক্ষণ ঘরে রাখার রীতি ছিলো না। পিসিরা কাঁদছে, আত্মীয় পরিজনদের ভীড়। আমার মার সঙ্গে জেম্মার মাঝে মাঝেই লড়াই ঝগড়া হতো। এহেন মা’র দুচোখ বেয়ে নেমে আসছে জল! নিরাসক্ত ভালোমানুষ আমার বাবার মুখ রাতের চেয়েও গম্ভীর, বললো- ‘আমি আর শ্মশানে গিয়ে কি করবো? তোমরাই নিয়ে যাও!’
মুখাগ্নি করবে কে? এই তেরো বছরের জটু!সাম্রাজ্য পতন আর নিভে যাওয়া লন্ঠন পাশে রেখে যে জটু একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
‘হরিবোল, বলোহরি’! রাত তখন একটা। আমিও শ্মশান যাত্রীদের সঙ্গে পায়ে পায়ে, চলেছি মুখাগ্নি করতে। হাঁটা পথ, আমরা জনা পনেরো মানুষ। দুমাইল দূরেই শ্মশান ঘাট।
‘হরিবোল, বলোহরি’! রাস্তা ঘাটে কেউ নেই। মেঘহীন শীতরাত্রির খোলা আকাশে অসংখ্য নক্ষত্রের আলো, হাল্কা চাঁদ। উজ্জ্বলতা নিয়ে মাটির কাছে পৌঁছানোর আগেই সেইসব আলো ফুরিয়ে যাচ্ছে। একটা হ্যাজাক লাইট নিয়ে আগে আগে চলছে ছোড়দা, আমার পিসতুতো দাদা । কুত্তার জলন্ত চোখ, রাত্তিরের ঘেউ ঘেউ। ঘুমিয়ে থাকা শরীরে হ্যাজাকের আলো পড়তেই গাছগুলো চমক দিয়ে ধীরে ধীরে পেছনে সরে যাচ্ছে। একটা নিশিডাকা রাতকে মাথায় নিয়ে চলেছি। গ্রাম পেরিয়ে, পচাডোবা খালের পুলটা পেরিয়ে আমরা মফস্বল শহরের রাস্তায়।
রাত্রের ভূতে পাওয়া ঘরগুলো, রাস্তার পাশে চেন দিয়ে বাঁধা ঠেলা গাড়ি, চায়ের গুমটি - কারোরই আমাদের জন্যে ভ্রুক্ষেপ নেই, শোকপ্রস্তাব নেই, সবাই ঘুমন্ত। রাত্রিবাহিত খাটিয়ায় সত্তর বছরের বৃদ্ধার মৃতদেহ, জীবনে সহায় সম্বলহীন, মৃত্যুতেও তিনি তাই।
রাত্রের দেয়ালে ‘হরিবোল, বলোহরি’র প্রতিধ্বনি তেমন জোরালো নয়, ম্লান। ক্কচিৎ কোথাও দু একটা খোলা জানলা, লন্ঠনের নিভু নিভু আলো শরীরী সংকেতে জানান দিচ্ছে, এখনো কেউ কেউ জেগে আছে! যে জেগে আছে সেও কি জেম্মার মতো অসুস্থ বুড়োমানুষ, পুরুষ না মহিলা? নাকি ম্যাট্রিক পরীক্ষার কোনও ইমানদার ছাত্র? নাকি বিছানায় মা-বাবাদের জায়গাবদলের খেলা, ঘুমন্ত সন্তানের পাশে আলো-অন্ধকারের নিশিযাপন।
এতো রাতে ওই জানালার পর্দাটা এত দুলছে কেনো? এখন তো হাওয়া নেই। এই শীতের রাতে জানালাটা খোলা কেনো? হাসিদিদি বিয়ের পরে কতদূরে চলে গেছে, সেও কি এমনি পর্দা দেয়া জানালায় ম্লান আলো জ্বেলে অপেক্ষা করে? এক রাত্তিরে পাশাপাশি শুয়েছিলাম, হাসিদিদি আমার গোপনাঙ্গটির দখল নিতে নিতে বলেছিলো- ‘প্রমিস, একটা কথা, বল কাউকে বলবি না! তোকে না আমি খুব খুবভা-ভালোবাসি!’
‘হরিবোল! বলোহরি!’ শববাহীযাত্রীরা অন্ধকার থেকে দম নেয়। রাতের রাস্তায় কিছু খুচরো পয়সা, উড়ো খই, পড়ে থাকা গাছের শুকনো পাতা আর নিঃশেষিত ডাবের খোল। আমরা পৌঁছে যাই গঙ্গার পারে।
শ্মশানের লাল ইট! একটা চিতায় আগুনের আঁচ নিভু নিভু। ওদের দলের কয়েকজন, তখনো অপেক্ষায়।
আজ রাতে জেম্মাকে এখানেই পোড়ানো হবে। ভেবেই আমার বুকটা শিরশির করে উঠলো! সামনেই রাতের অন্ধকারে বয়ে যাচ্ছে নদী, শ্মশানের আগুন আর হ্যাজাকের আলোয় চিকচিক করে উঠছে জলস্রোতের কান্না। জেম্মার জন্যে কাঠের বিছানা সাজানো হচ্ছে। একটা পুরুত কিসব মন্ত্র আওড়াচ্ছে, আধো অন্ধকারের সেই অর্থহীন শব্দগুলো অশরীরী হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। একটা চাতাল বাঁধানো মোটা অশ্বথ গাছ, গুঁড়িতে সূতো প্যাচানো, থেবড়ে থাকা সিঁদুর, পাতায় পাতায় সরসর শব্দ। কিসের ডাক ওটা? প্যাঁচার। রাত্রে প্যাঁচারা আসে, আত্মাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় একগাছ থেকে অন্য গাছে, শেষমেশ জোনাকির দেশ ছাড়িয়ে আত্মা উড়ে যায় কোন মহাদেশে, কেউ কি জানে?
শ্মশানের আলোকিত অন্ধকার। কাঠ, ডালপালার বিছানায় উপুড় করে শুইয়ে দেয়া হলো জেম্মাকে। তার দায়মুক্ত শরীরে, মাথার পাশে শেষবারের মতো চাপানো হলো ভারী ভারী কাঠ। আমার হাতে তুলে দেয়া হলো মশাল, তার ডগায় মাখানো ঘি, ন্যাড়া খড় আর কাপড়ের টুকরো। জেম্মাকে ঘিরে মশাল নিয়ে পাক দিতে দিতে মনে পড়লো পরাজিত মোগল সাম্রাজ্যের পায়ের নীচে বসে থাকা এক সাম্রাজ্ঞী বা বাঁদীর কথা। আগুন জ্বলে উঠতেই চোখ মেললাম, রাতের খোলা আকাশ, প্রশ্ন চিহ্ন নিয়ে জেগে থাকা একফালি ম্লান চাঁদ। দাউ দাউ করে তীব্র আগুন ঘিরে ফেললো জেম্মার শরীর, কেউ যেন শেষবারের মতো ডেকে উঠলো – ‘জটু-জটু-অ্যাত্তো আত্তিরে আদাড়েবাদাড়ে কেনো আছস, কোথায় গেছস তুই...... ?’
স্ফুলিঙ্গগুলো উড়ে যাচ্ছে রাত্রির অসীমতার দিকে। কাঠ ফাটার শব্দ। কাছেই একটা ঠেক থেকে দিশি মদ নিয়ে ছোড়দারা বসে গেছে শ্মশানের এক কোণে। আমি বটগাছটার গুঁড়িতে মাথা হেলান দিয়ে উদাস তাকিয়ে আছি জাগরী মেঘের দিকে। চেনা মানুষের মুখগুলো আবছা আবছা, পরিচিত – অথচ কেমন অচেনা। তির তির করে বয়ে যাওয়া গঙ্গা। রাত্রির ওপাশে ঝাপসা গাছ গাছালি; ম্লান জোছনার হালকা আলোয় দুএকটা সফেদ চিহ্ন, ওপারের ঘর বাড়ি। নিশি রাতে জেগে ওঠা দু-একটা পাখীর আচমকা ডাক। একটা কাচের গেলাসে কেউ এক ছটাক দিশি মদ এগিয়ে দিল আমার সামনে, বললো-‘ধীরে ধীরে খেয়ে নাও, শরীরে বল পাবে’।
ঝাঁঝ লাগা গলা-জ্বালানো তরল। জীবনে এই প্রথম। হলদে মার্কা ঝাঁঝালো পানীয়টি চুমুক দিয়ে খেতে খেতেই আমি অন্য সবার মতো আরেকটু বড় হয়ে গেলাম। যেমনি অল্প কিছুদিন আগে পাশাপাশি শুয়ে থাকতে থাকতে আমাকে অনেকটাই বড়ো করে দিয়েছিলো হাসিদিদি! রাতের এক আকাশ থেকে এখন আমার জন্যে নেমে আসছে বোধ! আগুনের লকলকে জিভ, উড়ন্ত স্ফুলিঙ্গ, বহমান নদী, কাস্তে মার্কা ধারহীন ম্লান চাঁদ। অন্য এক আত্মজ্ঞানের রাত্রি। এমনি ভাবেই মানুষেরা রাতের অন্ধকারেও একটু একটু বড়ো হয়।
শুয়ে পড়েছিলাম বটের চাতালে। ঘুমের মধ্যে আমি দেখতে পেলাম আমার পাঁজরের উপর চিতা সাজানো। সেখানে আগুন ধরানো হচ্ছে। আগুনের রঙ্গ গোলাপী, ধোঁয়া উড়ছে! আমি ভয়ে কেঁপে উঠতেই ধোঁয়ার রহস্য ফেঁড়ে বেরিয়ে এলো, জেম্মা নয়, হাত নাড়লো হাসিদিদি, একান্ত রাত্রের গোপনীয় এক স্মৃতি!
ছোড়দার ধাক্কায় ঘুম চটলো। তখন ধোঁয়া ওড়া চিতাকাঠ আমার বুকে নেই, মগজে নেই বইয়ে পড়া মোগল সাম্রাজ্য পতনের কারণ। ছোড়দার হাত ধরে নেমে এলাম গঙ্গার ঘাটে, কোমর ডোবা খুব ঠান্ডা জল, একটা সরায় কিছুটা মাটি আর জেম্মার নাভিকুন্ড। নদীর জলস্রোত একটু দূরে গিয়েই গিলে ফেললো সেই ভাসমান সরা, নাভিকুন্ড। কিছুটা বুদবুদ। রাত্রি তখন ভোর ভোর। একটা জেলে নৌকা অন্ধকার তাড়িয়ে এদিকেই ভেসে আসছিলো নদীর বুকে, ভোরের কুয়াশাকে জালে লটকাতে।
0 comments: