3

গল্প - পার্থ পাল

Posted in


পুরাকালে সমুদ্রমন্থনের ফলে উত্থিত হলাহল ধারণ করে নীলকন্ঠ হয়েছিলেন মহাদেব। হলাহল ছাড়াও আরও অনেক কিছু পাওয়া গেছিল সমুদ্রের জলকে মন্দার পর্বত দিয়ে নাড়াচাড়া করে - ঐরাবত, উচ্চৈশ্রবা আর কামধেনুর মত হাতি, ঘোড়া আর গরু, কৌস্তুভ মণি, পারিজাত ফুল, এমন কি বেশ কয়েকটা অপ্সরা! সেগুলি দেবতা আর অসুররা সব ভাগাভাগি করে নিয়েছিল শোনা যায়। নিন্দুকে অবশ্য বলে দেবতারাই অধিকাংশ কব্জা করে নিয়েছিল -- ঐরাবত, উচ্চৈশ্রবা, কামধেনু, কৌস্তুভ, পারিজাত আর অপ্সরাকুল কোনও কালে অসুরদের কবলে পড়েছিল বলে শোনা যায় কি? হয়তো অসুরদের বিশেষ কিছু করার ছিল না - কোনও কিছু দাবী করলেই দেবতারা মহাদেবকে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন - রম্ভা আর কৌস্তুভ চাই? তাহলে আমাদেরও একটু বিবেচনা করতে হয়। রম্ভা আর মণিটি ছাড়া বেচারা মহাদেব আর কতক্ষণ বিষটা ধরে রাখতে পারবেন!

এই পর্যন্ত লিখে জগদীশবাবু থামলেন। গত বেশ কয়েক মাস ধরে এই সমুদ্রমন্থনের ব্যাপারটা তাঁর মাথায় ঘুরছে। কেন এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না। যেমন ধরুন, খবরের কাগজে পড়ছেন টক্সিক অ্যাসেটের কথা - আর তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠছে গোল্ডম্যান স্যাক্স আর চেস ব্যাঙ্ক নিউ জার্সি টার্নপাইক-এর দুদিক ধরে টানাটানি করছে ‌- এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং মন্দার পর্বতের জায়গা নিয়েছে - আর ওয়াল স্ট্রীট থেকে গল গল করে উঠে আসছে মর্টগেজ ব্যাকড সিকিউরিটি, ক্রেডিট ডিফল্ট সোয়াপ। কালো ধোঁয়া। পিল পিল করে মানুষ মরছে। আবার টিভিতে যদি দেখছেন ইরাক বা আফগানিস্তানের খবর, তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠছে একদিকে ওবামা আর অন্য দিকে ওসামা - সেই সমুদ্র মন্থন, কালো ধোঁয়া, আগুন, মৃত্যু। এবারে অবশ্য মন্থনদণ্ডের জায়গায় টুইন টাওয়ার্স - কিন্তু সেটা কি ভাবে যেন পাকিস্তানে গিয়ে পৌঁছেছে।

কিন্তু এটাও তিনি লক্ষ্য করেছেন যে, কোথাও একটা খটকা থেকে যাচ্ছে। যা ধনসম্পত্তি, সুন্দরী নারী উঠছে মন্থনের ফলে, তা নিয়ে যে দুই পক্ষ প্রচণ্ড দড়ি টানাটানি করছে, তাদের মধ্যে কোনও হেলদোল নেই। কোনও অদৃশ্য হাতের ইশারায় সেগুলো কি ভাবে যেন ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে দু পক্ষের মধ্যে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, বিষ ধারণ করার মত মহাদেব জাতীয় কারো টিকি বা জটা কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

যা জানতেন আর আজকাল দিবাস্বপ্নের মত যা যা দেখছেন, তার মধ্যে এই যে ফারাক - এটাই আজকাল তাঁর অবসর জীবনের অফুরন্ত সময়ের একটা বড় অংশ নিয়ে নিচ্ছে। মাঝে মাঝে তাই আজকাল এই সব গাঁজাখুরি কোলাজগুলো একটু আধটু করে লিখে রাখছেন। ইচ্ছে আছে মনোবিদ বন্ধু রাজীব সান্ডেল কে দেখাবেন এর পর যে দিন দেখা হবে।

তা আজ এই পর্যন্ত লিখে তিনি উঠে পড়লেন। রাত অনেক হয়েছে। একটু জল খেয়ে বাথরুম ঘুরে গুটি শুটি মেরে বিছানায় গেলেন। পরিবর্তন সেখানেও। পাশে চল্লিশ বছরের পুরানো বৌ অনামিকা আলু থালু হয়ে শুয়ে রয়েছে। বয়সকালে কি তিনি এমনি ঘুমাতে দিতেন? আজকাল আর পেরে ওঠেন না। কিন্তু মনটা মাঝে মাঝে চন মন করে ওঠে - তবে বার কয়েক ডিসাসটারাস ঘটনার পর তিনি আর ও রাস্তা মাড়ান না। অনামিকা মাঝে মাঝে আভাসে ইঙ্গিতে টি ভির অ্যাড ফ্যাডের কথা বলে বটে, কিন্তু তিনি খুব একটা আগ্রহ দেখাননি।

ঘটনাচক্রে পরের দিনেই জগদীশবাবুর সঙ্গে রাজীব সান্ডেলের দেখা হয়ে গেল। সুযোগ পেয়ে বন্ধুকে বললেন সব কথা। সব শুনে রাজীব মুচকি হেসে বলল - লাস্ট কবে হয়েছিল? জগদীশ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন - কি হয়েছিল?

- নাঃ, তুই শালা সেই ন্যাকা চণ্ডীই রয়ে গেলি। কি আবার হবে? লাস্ট কবে অনামিকাকে ঠিক ঠাক ভাবে আদর করেছিলি?

রাজীব চিরকালই ঠোঁটকাটা। মুখে কিছুই আটকায় না। এক বার এক সদ্যবিবাহিত সুন্দরী বন্ধুপত্নীর টুকটুকে ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বলেছিল - আহা, কি সুন্দর লাল! অভয় দেন তো একটা খাই। সে নববধু লজ্জায় রাঙা হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে চোখ বুজে ফেলে বলেছিল - ও যদি দেখতে পায়? রাজীব ততক্ষণে টেবিল থেকে একটা আপেল তুলে নিয়ে ঘচাত করে এক কামড় বসিয়ে দিয়েছে। শব্দ শুনে বন্ধুর বউ চোখ খুলে দেখে রাজীব এক চোখ বুজে হাসতে হাসতে আপেল খাচ্ছে আর বলছে - আপনি কি সত্যিই ভেবেছিলেন? পরে অবশ্য রাজীব বলেছিল, এই আইডিয়াটা নাকি তারাপদ রায়ের একটা লেখা থেকে ঝাড়া।

যাই হোক, জগদীশ রাজীবের প্রশ্নের উত্তরে বললেন - তার সঙ্গে এই হ্যালুসিনেশন এর কি সম্পর্ক?

- আছে আছে। মনে কর কবে থেকে তুই এই সব দিবা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিস?

জগদীশ চুপ।

রাজীব ঘস ঘস করে একটা কাগজে কি সব লিখে দিয়ে বলল, যাবার সময় ফার্মাসি থেকে নিয়ে যা। তোর এই মন্থনে অনামিকাকে ইনভল্ভ কর। সমুদ্রমন্থনের ভূত মাথা থেকে নামবে।

3 comments: