undefined
undefined
undefined
সম্পাদকীয়
Posted in সম্পাদকীয়
ওরা চল্লিশজন কিংবা আরও বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে—রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে—রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়
ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য—বাংলার জন্য।
-মাহবুব উল আলম চৌধুরী
ওঁদের স্মরণ করেই আজ প্রকাশিত হলো ঋতবাক ষষ্ঠ বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা।
মাতৃভাষাকে লালন করার যে আন্দোলন সেই সেদিন শুরু হয়েছিলো, মনে হয় আজও চলছে তা সমান তালে...। মানে বলতে চাই, মাঝে মাঝেই শুনি 'গেল গেল' 'বাঁচাও বাঁচাও' রব। চিন্তিত বা প্রভাবিত হই নিশ্চয়ই; মানে চিন্তিত বা প্রভাবিত হওয়া উচিত অবশ্যই। তবুও পেঁচালো মন চেষ্টা করে একটু অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে বিচার করতে। বিস্তারিতই বলি...
আসলে, কথা হলো, মাতৃভাষা যদি রাষ্ট্রভাষা না হয়, তাহলে একটু অসুবিধা হয় বৈকি। অভিমান হওয়াটাও বিচিত্র নয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে একটা বিশেষ সুবিধা হলো, আরও একখান ভাষা বেশ ফাউতে শেখার সুযোগও পাওয়া যায় – এবং একাধিক ভাষা জানা থাকাটা যে কোনও পরিস্থিতিতেই মন্দ কথা নয়, সেটা সম্ভবত অনস্বীকার্য।
ভারতবর্ষের ভাষাগত অবস্থানের চাইতে বোধহয় এ বিষয়ের প্রকৃষ্টতর উদাহরণ আর কিছু নেই। যেমন ধরুন আমরা, মানে গড়পড়তা বাঙালিরা, ছোটোবেলা থেকে মাতৃভাষা বাংলা ও পিতৃভাষা ইংরিজি (এর মধ্যে আবার অশ্লীলতা বা লিঙ্গবৈষম্য খুঁজতে যাবেন না দয়া করে) শিখতে শিখতে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দুস্তর পারাবারগুলি পেরোতে পেরোতে এক সময়ে এসে টের পাই যে দু’টো ভাষার কোনওটাই সেভাবে শেখা হলো না। যদিও এই সমস্যা আমাদের মতন নিতান্তই সাধারণ মানুষের। প্রতিভাবানরা তার মধ্যেই এই দু’টো তো বটেই, সেই সঙ্গে আমাদের ভ্রাতৃভাষা, অর্থাৎ হিন্দিটিও দিব্যি রপ্ত করে ফেলেন। আর তেমন তেমন ক্ষুরধার মস্তিষ্ক হলে তো কথাই নেই। সাত-আটটি ভাষায় গড়গড় করে কথা বলতে, পড়তে এবং লিখতেও পারেন, এমন মানুষ চিরকালই ছিলেন এবং আজকের বিশ্বায়নের যুগে তাঁদের নিয়মিত সংখ্যাবৃদ্ধিও হচ্ছে; এ নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই বিশেষ।
আসল কথা সেটাই। আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞান বলছে, একজন সাধারণ মেধার মানুষ মোটামুটি স্বচ্ছন্দেই চার-পাঁচটা ভাষা শিখতে এবং প্রয়োজন মতন ব্যবহার করতে পারেন। তাহলে আর একটা বাড়তি ভাষা শিখতে অসুবিধা কোথায়? কোন পরিস্থিতিতে এই প্রসঙ্গের অবতারণা, সে কথা বলে দিতে হবে না নিশ্চয়ই। যে ভ্রাতৃভাষাটি আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া নিয়ে এত শোরগোল উঠছে মাতৃভাষাপ্রেমীদের মধ্যে, সেই হিন্দিকে তো আজ আর ফেলে দেওয়া যায় না। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে লেখাপড়া বা কর্মসূত্রে থাকতে হলে তো ওই হিন্দিই ভরসা। ইংরিজিটা যে এদেশের রাস্তাঘাটের নিত্য ব্যবহারিক বিনিময়ের ভাষা এখনও হয়ে উঠতে পারেনি বা অদূর ভবিষ্যতেও পারবে বলে মনে হচ্ছে না এবং সম্ভবত তেমনটা হওয়া বাঞ্ছনীয়ও নয়, সে কথা স্বীকার করতে তো কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। এবং এহ বাহ্য যে কাজের প্রয়োজনে আজকাল প্রায় অধিকাংশ মানুষকেই অন্য প্রদেশে যেতে হয়, বসবাসও করতে হয়। তাহলে সরকারি উদ্যোগে যদি হিন্দির মতো বহুল প্রচলিত একটি স্বদেশী ভাষা এই বেলা শিখে ফেলা যায়, তাতে তো অন্তত স্বদেশপ্রেমীদের বিশেষ আপত্তি থাকার কথা নয়! বাংলার বাইরে কাঁচুমাচু মুখে ‘‘হাম মদ নেহি খাতা হ্যায়’’ বলে হাসির খোরাক হওয়ার চাইতে গম্ভীর মুখে ‘‘হম শরাব নহী পীতে হ্যঁয়’’ বলে সসম্মানে সরে আসাটা বেশি বুদ্ধির কাজ নয় কি?
তবে এত সব যুক্তির পরেও কিন্তু যে কথাটা স্বতঃসিদ্ধ থেকেই যায়, তা হলো মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা শেখা বা না শেখা প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছাধীন বিষয়। কোনও ভাষাই কোনওদিন কোনও জাতির উপর জবরদস্তি চাপিয়ে দেওয়াটা সুস্থ প্রশাসনের লক্ষণ নয়... এবং আজকের দিনটা সেই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে অস্ত্র ধরার প্রতীক। যদিও সেই সংগ্রামে আমাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলো না, তবু আমরা বুক ফুলিয়ে বলতেই পারি – আমাদের ভাষা বাংলা ভাষা এবং সেই ভাষার অধিকারের সংগ্রামকেই আজ সারা পৃথিবী সসম্মানে উদযাপন করে।
তাই বাংলা ভাষার প্রত্যেক পাঠককে আজ বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসের অভিনন্দন!
সৃজনে থাকুন, আনন্দে থাকুন...
শুভেচ্ছা নিরন্তর।
0 comments: