0

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in

(এক)

খাঁ খাঁ করছে মাঠ! রোদ্দুর গিলে গিলে খাচ্ছে তার প্রাণের রস! নির্জনতায় পাকা ধানের গন্ধ, গরম বাতাসে পাক খেতে খেতে শুকনো পুকুর সাঁতরে পাড়ের গাছে এসে ধাক্কা মেরে একটা আঁচলকে যতদূর পারে ততদূর ওড়াচ্ছে! এর বেশি পারবেই বা কি করে?

শরীরটাও দুলছে গাছের থেকে ঝুলে। পরনের শাড়ির অর্ধেক অংশ দিয়ে কখন ঝুলে পড়েছে কে জানে? পাড়ের ছেঁড়া কলাপাতা এই গরম হাওয়ায় জোরে জোরে কিছু একটা বলতে চাইছে! কিন্তু শোনাবে কাকে? যে গেল সে তো গেলই!

পাড়ের কলা, শিরীষ, খেজুর গাছরা বউটার চোখের জল দেখে অনেক বারণ করেছিল। কিন্তু তার অভিমান-বেদনা কোনো কথাই শোনেনি! তারাও যেন সমবেত হয়ে তাকে অর্ধেক কাপড়ে ফাঁস করে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিয়েছে!

খেজুর পাতা কলাপাতা ঐ শিরীষ গাছটাকে দুষছে আর কত কথাই যেন বলছে! মাঠের নাড়াগুলো মুখ উঁচিয়ে কান পেতে আছে! যদি কিছু শোনা যায়।

এসব কথা শোনার থেকে কাউকে শোনাতে পারায় তার কদর যে বেশি বাড়ে! আর প্রথম কাউকে শোনাতে পারা? এ যে শোনায় সে ছাড়া আর ঠিক করে কাউকে বোঝানো সহজসাধ্য নয়! তবে কথায় আর ঘটনায় নিজের অভিসন্ধি ও প্রকাশ ভঙ্গি কোথাও কোথাও সীমান্ত অতিক্রম করবেই!

এখন একটা শরীর ছাড়া আর তো এ জগতে তার কোনো সম্পর্ক নেই! কাপড়ের ফাঁসে আটকে রয়েছে!

ধান তুলে নেওয়া নাড়াভরা মাঠের মধ্যেই ঘুঘু পাখি গা ফুলিয়ে ফুলিয়ে ধান খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে! কে আছে, আর কে নেই তাতে তার কি আসে যায়? একটা ফিঙে পাখি স্যত্ করে উড়ে গেল পুকুরের পাড়ের উপর দিয়ে! একটু হলেই ধাক্কা লেগে যেত ঝুলন্ত শরীরটার সঙ্গে!

কড়া রোদে নাড়াগুলো খড়খড়ে হয়ে আছে! ঘুঘু পাখির পায়ে গায়ে লেগে যে আওয়াজ হচ্ছে তাতে কলাপাতা, খেজুর পাতার সব কথা যেন ঐ নাড়াগুলোর কানে এসেও ঠিক পৌঁছতে পারছে না!

একটু আগেই তো দুজনকে নির্জন মেঠো রাস্তায় খালের পাড়ে দেখা যাচ্ছিল! কাছেই খালের উপর শুকনো গাছের গুঁড়ি জলের সঙ্গে মিশে দুই পাড়কে ধরে রেখেছে! এই সাঁকোই এপারের ধান বা ওপারের ধান মাথায় করে নিয়ে পার হওয়ার অন্যতম মাধ্যম| পাড়ের গা ধরে ঝাউ, আকাশবানী আর কাঁটা বাবলা সারি সারি হয়ে রোদে ঝিম মেরে আছে| চাষীরা এখনও মাঠের দিকে পা বাড়ায়নি।

খাঁ খাঁ মাঠে কাটা বিছালি কোথাও বা দাঁড়ানো ধান গাছ নিরন্তর শুকিয়ে শুকিয়ে দড়ি পাকিয়ে উঠছে!

এখানে মজুরেরা দুবেলা কাজ করে... সকাল সাড়ে এগারোটায় কাজ ছেড়ে দুপুরে বিশ্রাম করে আবার তিনটেয় তারা মাঠে বেরিয়ে পড়ে! কিন্তু ঘরের বিছালি খামার বাড়িতে তোলার জন্য তুলসী ও তার স্বামী অসীম অনেক আগেই বেরিয়ে পড়েছিল! বোশেখ মাসের আকাশ ঝড় বৃষ্টি হতে কতক্ষণ? ধান ভিজলে চাষীর কপালে হাত!

খাল পেরিয়ে ওপারে যাওয়ার আগেই দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বেশ জোরে জোরে হাত নাড়ছিল! কিছুক্ষণের মধ্যেই অসীম গাছের গুঁড়ি সাঁকো বেয়ে ওপারে চলে গেল... তুলসী নেমে এল এপারে! জমির আল ধরে ঐ পুকুর পাড়ে শিরীষ গাছের তলায়।

বসে কান্না আর চেপে রাখতে পারলো কই? চিবুক বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে টপ টপ করে বুকের কাপড়ে। কাপড়ের খুঁটটা হাতেই ধরে রইল। বেদনায় গলাটা তার আরো ভারি হয়ে উঠেছে। চাপা কান্নায় ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠছে থেকে থেকে।

আবেগ আর শোক কতক্ষণ স্থায়ী হয়? কিন্তু আঘাত বা অভিমান কি কি যে করতে বা করাতে পারে তার হিসেব কে কবে সব লিপিবদ্ধ করেছে? তুলসীও তার বাইরে বা যাবে কেন?

ঝপ করে এগিয়ে গেল শিরীষ গাছটার দিকে। সে গ্রামের মেয়ে। গাছে চড়ার অভিজ্ঞতায় অভিমান আর আঘাতে ভর করে ডালের সঙ্গে কাপড়ের ফাঁস করে নিমেষের মধ্যে ঝুলে পড়ল। ছটফট করে, বিস্ফারিত চোখে যেন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পুকুরে গাছেদের ছায়া পড়া গভীর কালো পাঁকের দিকে!



(দুই)

ঘুঘুর ঘুর-র-র-র-র-র ঘুর-র-র-র-র-র ডাক কিলবিল করা রোদের গরম হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ। ডাকপাখির দল জমির আলে, পাড়ের গায়ে খাবারের অন্বেষণে যেন দৌড় প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। পাতারা কখন যে চুপ করে গেল কে জানে!

হঠাৎ এসবের তাল ভঙ্গ হল... কযেকজন প্রায় হুড়মুড়িয়ে আসছে তাদের দিকে। ঘুঘু গেল ফুড়ুৎ করে উড়ে! ডাকেরা দৌড় দিল আত্মরক্ষার তাগিদে। পাতারা পত্ পত্ করে উঠল তাদের দেখে।

কেউ ভয়ে আঁতকে উঠল। একটা বউ হাঁউ মাঁউ করে বসে পড়লে একটু দূরে আর তাকিয়ে রইল সে ঝুলন্ত শরীরের বিস্ফারিত চোখের দিকে!

জন-মজুর-চাষীরা তখন কেউ কেউ বেরিয়েছে মাঠের উদ্দেশ্য ফসলের টানে।

কালবোশের গতির চেয়ে দ্রুত সে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল... পথে, মাঠে, পাড়ায়, বাড়িতে বাড়িতে... 'অসীমের বউ গলায় দড়ি দিয়েছে জগাদের পুকুর পাড়ে!'

মাঠের ফসল রইল পড়ে মাঠে! ফসলের টানের চেয়ে বউমানুষের প্রাণের টানে নাকি কৌতুহলে লোকের জমায়েত আরো ঘনীভূত হল!

অসীম ধানের বোঝা মাথায় করে সাঁকো বেয়ে খালের পাড়ে এসে এত লোকের জড়ো হওয়া দেখেই চমকে ওঠে! মাথার বোঝা ফেলেই দু’একজনকে ধাক্কা মেরে দৌড়ে গাছের তলায় গিয়ে মাটিতে আছাড় খেতে লাগল। হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে গাছে উঠতে গেল!

দুজন তাকে টেনে নামিয়ে নিল জোর করে। তাদের পাঁজাকোলায় আটকে গিয়ে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ল সে।



বাতাসে ভাসে বেড়াতে লাগল

...'ঢং'!

…'ন্যাকামি আর কি'!

…'ছেনাল'!

…'বেটা, কষাই! লোভী কোথাকার'!

কোনো কথাই আজ তার আর কানের মধ্যে যেন প্রবেশ করতে চাইছে না। পুলিশ না আসা পর্যন্ত অসীম বা কাউকে ঐ শরীরে হাত দিতে দিল না তারা। অপেক্ষায় রইল সবাই! এমনকি অসীমও।

সেও যেন শোকে আর উদ্বেগে নাকি অপরাধবোধে কেমন একটা হয়ে রয়েছে! পরনের লুঙ্গি ঢিলে হয়ে গেছে, মাথায় জড়ানো গামছা খুলে পড়েছে কাঁধের থেকে মাটিতে!

কিন্তু সবার মুখ বন্ধ করবে কে?

কৌতূহলের হাত ধরে এ জনরব চলতে চলতে চড়া রোদ তা একটু মিইয়ে গেছে| পুকুরপাড়ে, ধানের খেতে, আলের উপর, খাল-রাস্তায় এখন শুধু কচি-কাঁচা, জোয়ান, বুড়ো! কেউ সমালোচক, কেউ পরামর্শদাতা, কেউ বা নিন্দুক, কেউ কেউ বা তুলসীর পক্ষে, কেউ বা অসীমের পক্ষে বাদানুবাদে নিমগ্ন! কেউ কেউ হায় হায় করছে শুধু!

তবে সত্যিই এই গ্রাম্যজীবনে এর কোনো প্রভাব পড়বে কিনা জানি না| তবে প্রভাব পড়ল মায়ের উপর! খাল-রাস্তা থেকে নামতে গিয়ে লোকের কথা তাঁর কানে যত না এসেছে, তার চেয়ে ভয় ও এমন অস্বাভাবিক ঘটনায় তাঁর পা যেন হোঁচট খেতে খেতে আড়ষ্ট হয়ে উঠেছিল!

আল ধরে হাঁটতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়লেন দাঁড়ানো ধানের খেতে! বছর পাঁচেকের নাতনির হাত ধরেই আসছিলেন তিনি। তার হাত ধরেই কোনো রকমে উঠে দাঁড়ালেন।

...'মর, মর'! বলেই চেঁচিয়ে উঠল এক মহিলা।

...'পরের মেয়েকে মেরে আশা মিটলো তো? তোকে কি যমেও টানে না রে?' বলতে বলতে এক বুড়ি তাঁর দিকে তেড়েই গেলেন প্রায়।

কারো কথায় কান না দিয়ে নাতনির হাত ধরে এগিয়ে চললেন পুকুরের পাড়ে মৃত বউমার দিকে।

লোকের শাসনি আর ঠাকুমার অবস্থা দেখে সেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে চলল ঠাকুমার হাত ধরে। তখনও সে জানেও না সবাই বা তার ঠাকুমকে কেন এমন বলছে?



তিন)

ঘটনার কেন্দ্রে সাধারণের প্রবেশাধিকার বিধাতা কোনো দিন কাউকে দেয়নি। আজও না। দর্শকের ভূমিকায় থেকেই কেবল তা দেখেছে বা মন্তব্য করে মুখ ফিরিয়ে চলে গেছে। কিন্তু বরাবর কেন্দ্রীয় চরিত্রদের ঘটনার কেন্দ্রে প্রবেশের জন্য রাস্তা করে দিয়েছে। সেই পথেই তুলসীর মেয়ে তার ঠাকুমার হাত ধরেই ঝুলন্ত শরীরের নীচে এসে উপস্থিত হয়।

মেয়ে ও মাকে দেখে অসীম হাউ হাউ করে কেঁদে মেয়েকে জড়িয়ে ধরল। মঞ্জুরীও বাবার কান্না দেখে কেঁদে উঠল। তখনও তার চোখ পড়েনি ঝুলন্ত শরীরটার দিকে। পরনের শাড়িটা তখনও আলতো আলতো করে উড়ে আসছে তার দিকে।

অসীম কেঁদে কেঁদে হাত বাড়িয়ে মঞ্জুরীকে দেখাল।

...'মা-আ-আ-আ-আ.....'

মঞ্জুরীর এই ডাকের অসহায় আর্তি পুকুরপাড়, গাছপালা, মিইয়ে যাওয়া রোদ ও সকলের কোলাহলকে ছাপিয়ে চলল অনেক দূরে। বাতাস বয়ে নিয়ে চলল সেই মা হারা ডাকের বেদনার ভারকে।

কিন্তু কার বেদনায় কে কতখানি ব্যথাতুর হয়েছে?

...'এইটুকু মেয়ে ছেড়ে যেতে তোর মায়া হল না রে' কাস্তে হাতে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলেই উঠল।

...'মেয়েটাই বা কেন এ বঞ্চনার শিকার হবে লো? কে দেখবে ওকে...' কাপড় দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলেই চলল প্রতিবেশী এক মহিলা। অথচ ঐ মহিলাই তাকে একদিন এ বাড়িতে বিয়ে দিয়ে এনেছিলেন। একটা অপরাধবোধ এখন তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে!

খাবেই তো!

তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠেছে তুলসীদের গ্রামের রাতের সেই বিচার সভা।

কুমারী অন্তঃসত্ত্বা তুলসী ওড়নায় মুখ ঢেকে তার বসে রয়েছে। সঙ্গে তার এক কাকিমা। কেরোসিনের ল্যাম্প মাদুরের উপর বসানো। গ্রামের মাথারা তার চারপাশে গোল করে বসে। মৃদু আলোয় মুখগুলো কেমন রসিকতার মোড়ক পরে বিজ্ঞের মত বিড়ি ফুঁকছে মাঝে মাঝে। কেউ বা বর্তুলাকার ঠোঁট করে ধোঁয়া ছাড়ছে শূন্যে।

পাড়ার মোড়লের একচালা পাকা দরজায় যেন রসের বৃন্দাবন আজ। আর তাকে কেন্দ্র করে উৎসুক গ্রামবাসীরা গাছের তলায়, বাড়ির গলিতে, কেউ ঘোমটা টেনে, গামছা মাথায় দিয়ে খড় বা চট পেতে বসে পড়েছে দলে দলে। মাঝে মাঝে বিড়ির লাল আলো আরো লাল হয়ে জ্বলে উঠছে। পুরুষদের কারো খালি গা, পরনে লুঙ্গি, কারো গায়ে গামছা জড়ানো। অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরা একটু আড়াল করে দূরে দূরে দাঁড়িয়ে।

আবছা অন্ধকারে একফালি চাঁদ এ ঘটনার সাক্ষী থাকার জন্যে তখনও আকাশে উঁকি মারেনি।

এসব ব্যাপারে গ্রামবাসীদের উপস্থিতি অন্য কোনো বিচারের চেয়ে যে বেশি হয় তা সবার জানা। শুরু হল এ 'রাসলীলার' রসালো বিশ্লেষণ।

...'তা যে তপন, তোমার মেয়ের এ পাপ কয় মাস ধরে চলছে?'

...'তোমাকে যে এক ঘরে করে দেওয়া উচিত!'

...'মেয়ের রোজগারে বুঝি সংসার চালাও নাকি হে?'

...'তা এই কাজের কাজী কে? তুমি কি কিছুই জানতে না?'

...'তা এর শাস্তি কী তা তোমার জানা আছে বাছাধন?'

কেউ যেন থেমে থাকতে চাইছে না। বিদ্রুপের তীরে খোঁচা মারতে থাকল। তপন গরীব বটে। কিন্তু মেয়ের শরীর বেচে খাওয়া! অপমানে অসহায়ের মত গলায় কাপড় দিয়ে জড়ো হাতে কেঁদে চলেছে নীরবে। একটু দূরেই লজ্জায় মাথা হেঁট করে বসেছিল সে। এ অপমানের উত্তর কি হবে সে ঠাওর করতে পারেনি। শুধু কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে এল গলা কান্নায় ভরে উঠল ...'মেয়েটা যে আমার মরে যাবে, যে বিধান দেবে আমি মাথা পেতে নেব।'

তাকে ছেড়ে প্রশ্ন ঘুরলো অন্য দিকে।

...'তা হে রতন, তোমাকে যে তুলসীকে বিয়ে করতে হবে।'

...'নইলে গ্রাম ছাড়া হতে হবে যে।'

...'আহা! অনুরোধের কি আছে? পাড়ার মেয়ের সঙ্গে এমন করে পার পেয়ে যাবে?'

...'কত মাস ধরে এসব করলে? একেবারে মানে ইয়ে করে ছাড়লে! একে তো ছাড়লে চলবে না! তা কবে বিয়ে করছো? '

রতন মাথা নীচু করে থাকে। কী বা উত্তর দেবে। মাস তিনেক হল বিয়ে করেছে বাপের আদুরে ছেলে। বড়লোকও বটে।। সকালে তার বউ গলায় দড়ি দিতে গিয়েছিল সতীনের ঘর কৰৱে না বলে। দুপুরে তাদের বাড়িতে এক প্রকার সিদ্ধান্ত হয়ে যায় টাকার বিনিময়ে এ বিপদ থেকে কিভাবে মুক্ত হবে।

বাবার কথা, বউয়ের মুখ তুলসীর করুণ অসহায় মুখকে নিমেষে ভুলিয়ে দিল।

কি বলতে গিয়ে বলেই ফেলল... 'আমি দোষী বটে। কিন্তু ওকে আমি বিয়ে করতে পারবো না। টাকা দিতে রাজি আছি।'

তার মুখের কথা শেষ না হতে হতে কয়েক জন ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল রতনের উপর। কিল, ঘুষি, লাথি মারতে মারতে বলল...

... 'টাকার গরম বড্ড, না!'

...'শালা পরের মেয়ের সম্মান নিয়ে চিনিমিনি খেলা? '

আজ তাদের গায়ের জ্বালা কিছুটা তারা মিটিয়ে নেবেই। কয়েক মাস ধরে তারা তক্কে তক্কে ছিল। গতকাল ভোরেই দুজনকে তুলসীদের বারান্দায় একই বিছানায় পাকড়াও করে। রতনের বউ আর্ত চিৎকারে দৌড়ে এসে একবার এর পা, একবার ওর পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে তাদের শান্ত করতে চায়। তারা সকলেই এ অদ্ভূত ব্যাপারে কেমন ক্ষান্ত হয়ে গেল।

হঠাৎ পরিবেশটা কেমন হয়ে উঠল। মেয়েরা প্রমাদ গুনে দূরে পালিয়ে গিয়েছিল। তারাও পরে কাছে আসে। এর পরিণতি না দেখে কেউ বাড়ি ফিরতে চায় না।

শান্ত হয়ে পুনরায় বিচার শুরু হল। আইনের ধারাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এমন দেশে রোজ কত কত বিচাবের পর্ব ঘটে সে হিসাবে কে বা রাখে।

প্ৰশ্ন উত্তর , পাল্টা জেরা, কটূক্তি ও কদর্য ভাষায় চলল চুলচেরা বিশ্লেষণ।

চলতে চলতে বাঁকা চাঁদ তালগাছের ফাঁক থেকে কখন যে নেমে এল এ বিচারের সাক্ষী থাকার জন্য, তা কারোর খেয়াল হল না।



(চার)

বিচার শেষ হল প্রায় মাঝরাতে। নানান জটিলতার কথা , সম্মানের কথা, তুলসীর ভাবী সন্তানের কথা, রতনের বিউয়ের কথা ভেবে বিচারের সিদ্ধান্ত দিয়েই তবে সভা ভঙ্গ হল। হতেই মেয়েরা কেউ ল্যাম্প জ্বেলে, পুরুষরা কেউ টর্চ নিয়ে রাস্তা ধরে, কেউ পুকুরপাড় ধরে যে যার বাড়ি ফিরছে।

কিন্তু বিচারের রায় গুলো তাদের মাথায় ঘুরতে লাগল।

...তপনের জরিমানা হল পাঁচ হাজার টাকা। তা জমা হবে পাড়ার সরকারি তহবিলে।

...তুলসীর সন্তান নষ্টের সময় অতিক্রান্ত। আর কোনো উপায় না থাকায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হল তার বিয়ের ও সন্তানের জন্য ষাট হাজার টাকা দেবে রতন ও তার বাবা।

...এক সপ্তাহের মধ্যে তুলসীর বিয়ে দিতে হবে অন্যত্র।

এই প্রতিবেশী মহিলাই তাঁর আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ফিরেই পাশের বাড়ির অসীমের সঙ্গে পরের দিনই বিয়ে দিয়েছিলেন। এত কথা আজ তাঁর মনে পড়ছে যত, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছেন ঐ মৃত শরীরের নীচে দাঁড়িয়ে।

তা সে বিয়ে আজ নয় নয় করে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে বই কি! অসীম তালপাতা দিয়ে নানান কারুকার্যময় জিনিস তৈরি করে সংসার চালায়। সে গরিব হলেও সৎ। তুলসীও সেই কাজ শিখেছে। পারদর্শী বটেও।

তবে সংসার এসব করলেও কোথায় যেন একটা কিন্তু তাকে তাড়িয়ে বেড়াত। এদিকে তার মেয়ে মঞ্জুরী দিন দিন যত বড় হয়েছে তার আতঙ্ক তত বেড়েছে। নিজেও যায়নি বাপের বাড়ি আজও পর্যন্ত। এমনকি মঞ্জুরীর না।



(শেষ)

নিজের ভাগ্য নিজে লেখবার কল্পনা শক্তি মানুষের থাকলেও, নিয়তি কিন্তু কলম তার হাতে তুলে দেয়নি। তুলসীর হাতেও না। হলে জীবন হয়তো অন্য রকম হত।

হয়তো এ দুপুরে নিয়তি নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে তুলসীকে বেছে নিত না।

হঠাৎ মেয়ের জেদ পূরণ করার জন্যে অসীমই মঞ্জুরীকে তার মামার বাড়ি এই প্রথম পড়ন্ত বিকেলে দিয়ে চলে এসেছিল। তুলসীর আপত্তি মেয়ের জেদ ও আবদারের কাছে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি।

কিন্তু পরের দিন দুপুর হওয়ার আগেই মঞ্জুরী মুখ গোমরা করে ছোটো মামার সাইকেলে চেপে ফিরে আসে। ফিরে কারোর সঙ্গে কোনো কথা নেই।

মুখ খুলল দুপুরে খেতে বসে।

...'মা, আমার বাবা কে? '

অসীম-তুলসী চমকে ওঠে। কোনো কথা তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসার সাহস পেল না! তবে কি মামার বাড়ি থেকে সে তুলসীর ইতিহাস জেনে এসেছে? কিছু ঠিক করে ভেবে ওঠার আগেই মঞ্জুরী আবার জানতে চায়

...'আমি কি রতনের মত দেখতে? আমি কি তার ফস্টিনষ্টির মাল? '

বারান্দায় তাদের খেতে দিয়ে পাশেই বসে ভাত-তরকারি দিচ্ছিল স্বামী-শাশুড়ি-মেয়েকে। হাতা করে সবে তরকারি দিতে যাচ্ছিল শাশুড়ির পাতে। এ কথা কানে প্রবেশ করা মাত্রই হাত থেকে খসে পড়ল হাতা। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে মুখে আঁচল চেপে দৌড়ে গিয়ে ঘরে দরজা ভেজিয়ে দিল।

অসীম পাতে জল ঢেলে উঠে গিয়ে দেখে দরজা ভেজানো। ভেতরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে তুলসী ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। তার বুকে একটু বল আসে কিন্তু সংশয় দূর হয় না। তবুও সেও একটু ঘাটের দিকে বেরিয়ে গিয়ে গাছের তলায় বসে।

মঞ্জুরী কেমন থতমত খেয়ে এসব দেখতে থাকে। তার ঠাকুমা হাত তুলে মারতে গিয়ে রাগ সামলে হাত নামিয়ে নিলেন। একটা মায়া হল তাঁর। ছোটো থেকেই কোলে পিঠে করে মানুষ করছেন তাকে। এখন বেশি খুনসুটি, আবদার তাঁরই কাছে। এমন প্রশ্ন ও ছেলেবউ-এর এই ভাত ফেলে চলে যাওয়ায় তাকেই দোষী মনে হয়েছিল।

এখন কাছে উঠে গিয়ে তাকে খাইয়ে দিতে লাগলেন।

এমন কথা তার মুখে তাঁরা কেউ শোনেননি।

কিন্তু আজ সকালে সে তার মামার ছেলের সঙ্গে খেলতে খেলতে রাস্তায় খেজুর গাছের তলায় বাঁশের মাচার কাছে আসে।

তার মামার ছেলে তার সমবয়সী। সে এখানে খেলতে আসে রোজকার মত। আজ বেশি উদ্দীপনা। তার এই পিসির মেয়েকে নিয়ে আসে।

কিন্তু আজ সেখানে কয়েকজন চোলাই মদের ঠেক বসিয়েছে।

আজ যেন এ লোক গুলো সকাল সকাল আসর পেতে বসেছে মাচার থেকে একটু দূরে অন্য খেজুর গাছের তলায়।

...'কি-রে পা-ট-লা, এ-টা কে রে?' মদের নেশায় চুর। কথা আটকে আটকে বের হচ্ছে ঐ মাঝবয়সী লোকটার।

...'জান না, ও তুলসী পিসির মেয়ে। '

রতন মুখে গ্লাস তুলতে গিয়ে থমকে যায়। তাকিয়ে থাকে মঞ্জুরীর দিকে।

...'কিরে রতনা, মালটা তো তোর মুখের আকার পেয়েছে রে। একটু কোলে নিবি নাকি রে?' বলেই খপ করে ধরে এনে মেয়েটাকে রতনের কোলে বসিয়ে দিল।

মঞ্জুরী তার নাগপাশ ও বাহুর বন্ধন মুক্ত হওয়ার নিস্ফল প্রয়াশ করতে থাকল। এমন সময়

একজন তার গাল টিপে রতনের উদ্দেশ্যে বলল... 'তোর ফস্টিনষ্টির মাল এত সুন্দরী? ভাবা যায়!'

'মাল', 'রতনের মেয়ে', 'ফস্টিনষ্টির মাল' শব্দ গুলো তার পরিচিত বলেও মনে হল না।

অতর্কিতে লোকটার বন্ধন ছাড়িয়ে দু ভাইবোন দৌড়ে বাড়ি এসে বাড়ি ফেরার জন্য কাঁদতে শুরু করল। কিছুতেই সামলাতে না পেরে তার ছোটো মামাই তাকে বাড়িতে দিয়েই চলে যায়।

তারপর খেতে বসেই এ প্রশ্ন গুলো যা এতক্ষণ তাকে কষ্ট। দিচ্ছিল তা বলেই ফেলে।

ঘন্টা খানেক পর অসীম ফিরে এসে তুলসীকে খাওয়া জন্য তোষামোদ করে নিষ্ফল হয়। মাঠে ফসল তার উপর আর এ অভিমানের দরজায় মাথা ঠুকে তারও মাথা গরম হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ পরে গেঞ্জি পরে, গামছা কাঁধে ফেলে হাতে দড়ি নিয়ে মাঠের দিকে রওনা হয়।

তুলসীও পিছু পিছু আসে। কালবৈশাখীর আকাশ, বৃষ্টি হলে ফসল ভিজে নষ্ট হবে। তাই সেও বেরিয়ে পড়ে।

খিদের পেট তার চি চি করলেও মেয়ের কথাগুলো আত্মগ্লানি হয়ে তার পেট ভরিয়ে দিচ্ছে।

আর অসীমের চুপ করে থাকাটা তাকে আরো ক্ষতবিক্ষত করছিল এতক্ষণ ধরে।

খালপাড়ে এসে গাছের তলায় এসে সে অসীমকে বলে

...'বাবা পরিচয় দিতে লজ্জা করে ঝুঝি? নাকি টাকার লোভে আমাকে বিয়ে করেছিলে? বলতে পারলে না, তুই আমার মত দেখতে? নাকি আমাদের দুজন কে ঘৃণা করো?'

অসীম কোন প্রশ্নের উত্তর দেবে? আজ এত প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে সে বাস্তব জ্ঞান হারাল। রেগে বলেই ফেলল... 'ও পাপের দায়ভার আমি নেব কেন? উত্তর তো তোমার আজানা নয়। নেহাত মরতে বসেছিলে, তাই তোমাকে উদ্ধার করেছিলুম।'

বলেই খাল পার হয়ে এগিয়ে যায় তার নিজের ধানের জমির দিকে।

তুলসীর চোখ জলে ভরে আসে। সমস্ত রোদ্দুর যেন তার মাথার উপর এসে পড়ে। দিনের আলো নিমেষে অন্ধকার করে এল তার সামনে। পায়ের তলার মাটি খুঁজে পাচ্ছে না সে।

এতদিনের সংসার সব কি তাহলে মিথ্যে! একজনের প্রতারণায় উচ্ছিষ্ট হয়ে সে বেঁচে রইল আর এক ধর্ষকের কাছে। রেঁধে বেড়ে খাওয়াল, আর ভোগের শরীর হয়ে চাহিদা মিটিয়ে এল।

এ আত্মগ্লানি তাকে টেনে নিয়ে গেল পুকুর পাড়ে শিরীষ গাছের তলায়। আর তার নারীত্বের অভিমান-বেদনা তাকে ঝুলিয়ে দিল পরনের কাপড়ে। কেবল মঞ্জুরী রইল পড়ে

আর তুলসী মরে যেন প্রমাণ করে দিয়ে গেল, ধর্ষিতাদের উদ্ধার বা সম্মান বলে কিছু হয়না, তারা কেবল বিছানাতেই মানানসই।

0 comments: