0

সম্পাদকীয়

Posted in

সম্পাদকীয়



সবে পয়লা বৈশাখ গেলো। ঘরে ঘরে দেওয়ালে দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দ-নেতাজী-লক্ষ্মী-গনেশ-নারায়ণের ছবি সমেত ১৪২৬ বঙ্গাব্দের নতুন ক্যালেন্ডার ১৪২৫কে সরিয়ে জায়গা করে নিয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই। মনটা কেমন সংস্কৃতি-পরায়ণ  হয়ে উঠছে মাঝেমাঝেই। চওড়া পাড় সুতির শাড়ী, বড়ো টিপ, ঘন কাজল, খোঁপায় জুঁইয়ের মালা! আহা আহা!!

কিছুটা আগের প্রজন্মের বয়োবৃদ্ধদের মুখে প্রয়শঃই  শুনি, 'আমাদের সেই সময়টাই ছিলো নক্ষত্রপ্রসবা স্বর্ণযুগ, এখনকার ছেলেপুলেরা...' -বিকৃত মুখভঙ্গীর আক্ষেপসূচক অসমাপ্ত সংলাপ ফলোড বাই চরাচর কাঁপানো গভীর দীর্ঘশ্বাস -  এ অভিজ্ঞতা কমবেশি আমাদের সকলের আছে। না, তুল্যমূল্য করতে চাই না। শুধু ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ওঁরা যদি 'নাক্সাত্রা ডায়ামন্ড'-খচিত স্বর্ণযুগের মানুষ হন, তবে আমরা নিঃসন্দেহে শুধু সলিটেয়ার সেটিং প্ল্যাটিনাম এজে বিলং করি। হ্যাঁ, আমরা অনেক ভালো আছি। পঞ্চাশ বছর, এমনকি ত্রিশ বছর আগের তুলনাতেও।

আপনি বলবেন, 'মানেটা কি? যা হচ্ছে, সব ভালো?'

আরে উত্তেজিত হবেন না। যা খারাপ, তা খারাপই। আমি বলছি না, যা হচ্ছে, তা সবই ভালো। আমি বলছি, আমরা অনেকটা এগিয়েছি। সব দিক দিয়ে। আবার পেছিয়ে যাওয়াটা বিশেষ বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। সেটা চাই না। আর আমাদের আগের প্রজন্মের এই যে মনোভাব, তাই নিয়েও বিশেষ চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। কেননা, তাঁদের বাপ-জ্যাঠাও এমনই বলতেন। কারণ, যুগযুগ ধরে বাপ-জ্যাঠাদের কাজই এটা! তাই বলি কি, শুধু ক্যালেন্ডার নয়, পাল্টাক দিন! আসুন, এগোই সামনের দিকে!!

শুভেচ্ছা নিরন্তর... 

0 comments:

7

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - মনোজ কর

Posted in

প্রচ্ছদ নিবন্ধ


আমাদের সময়ের সাহিত্য ও সংস্কৃতি
মনোজ কর



সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি আমার অনুরাগ শুরু হয় স্কুলজীবন থেকেই। হাওড়ার বিবেকানন্দ স্কুলে পড়তাম। স্কুল শুরুর আগে স্তোত্রপাঠ হতো। 

'ওঁ ভদ্রং কর্ণেভিঃ শৃনুয়াম
দেবাং ভদ্রং পশ্যেমাক্ষ ভির্যজত্রাঃ
স্থিরৈরঙ্গৈস্তুষ্টুবাগ সস্তনূভি বয়শে ম
দেবহিতং যদায়ুঃ' (যজুর্বেদ ২৫/১১) 

অর্থাৎ, হে ঈশ্বর,আমরা যেন তোমার যজন করি,কান দিয়ে শ্লীল ও মঙ্গলময় কথাবার্তা শুনি,চোখ দিয়ে সুন্দর ও মঙ্গলময় দৃশ্য দেখি।তোমার আরাধনাতে যে আয়ুষ্কাল ও সুদৃঢ় দেহ প্রয়োজন তা যেন আমরা প্রাপ্ত হই।

'ওঁ সহনাববতু, সহনৌ ভুনক্তু, সহ বীর্যং করবাবহৈ।
তেজস্বীনাবধীতমস্তু, মা বিদ্বিষাবহৈ '
ওঁ শান্তিঃ, ওঁ শান্তিঃ, ওঁ শান্তিঃ।। (তৈত্তিরীয় উপনিষদ ৩।১) 

অর্থাৎ, 

আমাদের উভয়কে (আচার্য ও বিদ্যার্থী) সমভাবে রক্ষা করুন এবং উভয়কে তুল্যভাবে বিদ্যাফল দান করুন; আমরা যেন সমভাবে সামর্থ্য অর্জন করতে পারি; আমাদের উভয়েরই লব্ধবিদ্যা সফল হোক; আমরা যেন পরস্পরকে বিদ্বেষ না করি। আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক - এই ত্রিবিধ বিঘ্নের বিনাশ হোক। 

স্তোত্রপাঠের পর সিঁড়ি দিয়ে ওঠার মুখে দেওয়ালে খোদাই করা স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তি আর সেই মূর্তির দু’পাশে উদ্ধৃত শিক্ষা এবং ধর্মের সংজ্ঞা। " মানুষের অন্তর্নিহিত পূর্ণতার বিকাশের নামই শিক্ষা" এবং "মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বের বিকাশের নামই ধর্ম"। আজও আমাদের উদ্দীপিত করে, চেতনাকে করে সমৃদ্ধ। 

স্কুলে প্রতি শনিবার ছুটির পর নিয়মিত সাহিত্যসভা এবং বিতর্কসভা। স্বরচিত গল্প, কবিতা, প্রবন্ধপাঠ এবং গান, কবিতা, আবৃত্তি ও বিতর্ক ছিল এই সভাগুলির চর্চার বিষয়। এছাড়া স্কুল লাইব্রেরি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং আকর্ষণীয়। স্বামীজির ও রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন হত। নির্বাচিত প্রবন্ধগুলির বিচার করতেন রামকৃষ্ণ মিশনের কোনো সন্ন্যাসী এবং বাংলা সাহিত্যের কোনো নামী অধ্যাপক। প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানাধিকারী ছাত্রেরা পেতো নিজেদের পছন্দমত নানারকম বই। ক্লাস নাইন থেকে ইলেভেন পর্যন্ত নিয়মিত পুরস্কার জেতার সুবাদে অনেক বই পাওয়ার ও পড়ার সুযোগ হয়েছিল। 

মণিশঙ্কর মুখোপাধ্যায় (বিশিষ্ট সাহিত্যিক শংকর), মা-ঠাকুর-স্বামীজির শ্রেষ্ঠ গবেষক অধ্যাপক শঙ্করী প্রসাদ বসু, বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য বিশিষ্ট ঐতিহাসিক নিমাইসাধন বসু ছিলেন আমাদের স্কুলের প্রাক্তনী এবং শনিবারের সাহিত্যসভা ও স্বামীজির এবং রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে নিয়মিত আসতেন। ওনাদের বক্তৃতা শোনার, ওনাদের সান্নিধ্যে আসার এবং ওনাদের হাত থেকে পুরস্কার নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। বাবার সঙ্গে ওনাদের সৌহার্দ্রের সূত্রে ওনাদের স্নেহ পেয়েছি অনেক। ব্রজমোহন মজুমদার, বাংলার স্বনামধন্য বৈয়াকরণ শ্রদ্ধেয় বামনদেব চক্রবর্তী , বিশিষ্ট কবি ও নাট্যকার শ্রদ্ধেয় বটকৃষ্ণ দাস আমাদের শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষাক্ষেত্রে ওনারা ছিলেন একেকজন কিংবদন্তি। আমার জীবনে এই প্রবাদপ্রতিম শিক্ষকদের অবদান অনস্বীকার্য। বিশিষ্ট সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক ডঃ শিশির কর ছিলেন সম্পর্কে আমার দাদা। ওনার অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলাম আমি। কি পড়াশুনায়, কি কর্মক্ষেত্রে, কি সাহিত্যচর্চায় সর্বদাই উৎসাহিত করেছেন আমায়। উনি এবং বৌদি মুম্বাইতে আমার কাছে গিয়েছিলেন এবং কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। ওনার হঠাৎ চলে যাওয়া আমাকে অত্যন্ত গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। 

সন্দেশ, শুকতারা, কিশোর ভারতী অতিক্রম করে হাতে পেলাম স্বামীজি, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম আর প্রচুর ঠাকুর, স্বামীজি সংক্রান্ত রচনা এবং দেশি-বিদেশি নানান সায়েন্স ফিকশন্। বইয়ের যোগান দিত স্কুল এবং স্কুল সংলগ্ন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আশ্রমের লাইব্রেরি। মা রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আশ্রমের আজীবন সদস্যা এবং সেই সুবাদে আশ্রম লাইব্রেরিতে যাতায়াত ছিল অবাধ। রামকৃষ্ণ মিশন এবং শ্রদ্ধেয় শঙ্করীপ্রসাদ বসুর সহযোগিতায় এই লাইব্রেরির পুস্তক সম্ভার ছিল বৈচিত্র্যে ও প্রাচুর্য্যে অতুলনীয়। স্কুলজীবনের শেষ দুই বছর বিশিষ্ট কবি , নাট্যকার বটকৃষ্ণ দাসের কোচিং এ বাংলা ও ইংরেজি পড়তাম। উনি পেশাগতভাবে শিক্ষক ছিলেন এবং হাওড়ার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ওনার উৎসাহে পড়তে শুরু করলাম জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নীরেন চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সমরেশ বসু ও আরো অনেক সমকালীন কবি, সাহিত্যিকের রচনা। 

স্কুল ছাড়ার পর সামান্য মনোমালিন্যের জন্য ওনার সাথে আর দেখা হয়নি। আমি নিশ্চিত যে আমার কিশোরসুলভ অভিমান এবং অর্বাচীনতা উনি সস্নেহে ক্ষমা করেছিলেন। ওনার মৃত্যুসংবাদ যখন পাই তখন আমি কলকাতার বাইরে। নির্জনে অশ্রুপাত করেই ওনাকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছিলাম। ওনার চলে যাওয়ার বেশ কয়েকবছর পরে ওনার বাড়ীতে গিয়েছিলাম। ওনার ছেলে বৈদূর্য আমার অনুজপ্রতিম। ওর অকৃত্রিম আন্তরিকতা মন ছুঁয়ে গেল। পুরনো দিনের গল্প যেন শেষ হয়না। এখন সবই শুধু স্মৃতি। ওঁর সাথে আমার অনেক আগে দেখা করা উচিত ছিল। 

বাবার ছিল বই কেনার নেশা। প্রতি রবিবার হয় আমাদের নিয়ে যেতেন ধর্মতলায় সিনেমা দেখাতে, না হলে হুইলারের দোকানে বই কিনতে। সাউন্ড অব মিউজিক, টোয়েন্টি থাউস্যান্ড লিগস্ আন্ডার দ্য সি, ম্যাকেন্নাস্ গোল্ড ইত্যাদি অজস্র ইংরেজি, বাংলা , হিন্দি সিনেমা দেখেছি বাবার সঙ্গে। বাবার সঙ্গেই দেখেছিলাম শচীনশঙ্করের অনবদ্য ব্যালে প্রযোজনা 'শঙ্করস্কোপ' এ্যাকাডেমিতে। হুইলারের দোকানে গিয়ে কিনেছি কত পেপার ব্যাক তার ইয়ত্তা নেই। বাড়ীতে এসে গোগ্রাসে গিলতাম বইগুলো । এগুলো পড়া শেষ না হলে পরের সপ্তাহে বাবা কিনে দেবে না। যে ভাবেই হোক শেষ করতে হবে শনিবারের মধ্যে। না হলে যদি হুইলারের দোকানে যাওয়া হয় তা হলে বাবা নিজের জন্য কিনবে কিন্তু আমাদের নতুন বই হবে না। অগত্যা... 

স্কুল জীবনে সংস্কৃতিচর্চা বলতে ছিল আবৃত্তি এবং নাটক। ঈশ্বর আমার কন্ঠে সুর দেন নি। তাই গান বাজনা কোনোদিন করতে পারিনি। স্কুলের অনুষ্ঠানে যখন বন্ধুরা গানে, তবলায়, গীটারে, সেতারে, সরোদে মেতে উঠতো আর মাতিয়ে দিত তখন চুপ করে বসে শুনতাম আর ভাবতাম ' তুমি কেমন করে গান করো হে গুনী, আমি অবাক হয়ে শুনি।' 

নাটকের প্রতি আমার আকর্ষণ ছোটবেলা থেকেই। স্কুলজীবনের অব্যবহিত পরেই বন্ধুরা মিলে একটা নাটক করার প্ল্যান হলো। তখন কমার্শিয়াল এবং গ্রুপ থিয়েটারের তফাত বুঝতাম না। শৈলেশ গুহনিয়োগী তখন কমার্শিয়াল যাত্রা থিয়েটার দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ওনারই লেখা একটা নাটক, নামটা সম্ভবত: ' এ পৃথিবী টাকার গোলাম' বা এই জাতীয় কিছু চড়া সুরের নাটক। সমস্ত সংলাপ উচ্চগ্রামে। কেমন করে অর্থাভাবে একটি পরিবার শেষ হয়ে গেলো তারই গল্প। গল্পের নায়ক এই দরিদ্র পরিবারের ছেলে। পড়াশোনায় ভালো হওয়া সত্ত্বেও দারিদ্র্য তাকে অপরাধ জগতে নিয়ে এল এবং শেষে বোনকে ধর্ষণের প্রতিশোধ নিতে ধনী প্রেমিককে খুন করে জেলে গেল।সেই নিয়েই নাটক। নায়কের চরিত্রে আমি। 

এই নাটকের নির্দেশক ছিলেন বাণীকুমার। বাণীদা একটি সিনেমার নির্দেশনা দিয়েছিলেন এবং খুব গর্বের সাথে বলতেন যে ঐ সিনেমায় সাবিত্রী না মাধবী ছ’-ছ’ বার কেঁদেছিল। সিনেমাটা চলে নি। নাটক নির্বাচন থেকে শুরু করে মঞ্চ,আবহ, পোষাক এবং নির্দেশনা অব্দি সব ব্যবস্থার দায়িত্ব বাণীদার। আমাদের কাজ শুধু অভিনয় । যাই হোক বাণীদার কাছে শিখলাম কান্নাকে হাহাকারে, হাসিকে অট্টহাসিতে এবং সংলাপকে চিৎকারে পরিণত করার কলাকৌশল। শিখলাম কেমন করে লাইট ধরতে হয় এবং ছাড়তে হয় আর কেমন করে climax এর মূহুর্তে still হয়ে যেতে হয়। শিখলাম কেমন করে গলার স্বর কাঁপাতে কাঁপাতে ক্রমাগত উচ্চগ্রামে নিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ না প্রেক্ষাগৃহ করতালিতে ফেটে পড়ে। শিখলাম অভিনেতার আসল পুরস্কার দর্শকদের করতালি । যে যত বেশি ক্ল্যাপ ( করতালি) পাবে সে তত বড় অভিনেতা। 

মা এসেছিল নাটক দেখতে। বাড়ী ফিরতে বলল আমার অভিনয় ভালো হয়েছে কিন্তু নাটকটা রুচিসম্মত ছিল না। আমাদের শিক্ষা ও প্রত্যাশিত চিন্তাভাবনার নিরিখে নাটকটির গুনগতমান নিম্নস্তরের। আমাদের কাছ থেকে বুদ্ধিদীপ্ত আধুনিকতার আশা করেছিল মা। আর কোনোদিন ঐ ধরণের নাটক করিনি। ভাবলাম অন্তত একটা ভালো নাটক করে মাকে দেখাতেই হবে। 

স্কুলের বন্ধুরা মিলে একসাথে নাটকের দল খোলা হয়েছিলো। নাম 'হৈমন্তিকা'। কলেজে এসে বন্ধু সমীরের উৎসাহে এবং অনুপ্রেরণায় গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলাম। সময় পেলেই এ্যাকাডেমিতে নাটক দেখতে যেতাম বন্ধুদের সঙ্গে। রবীন্দ্রসদনে চাকরি করতো পাড়ার লাল্টুদা আর ভিক্ষু । ওদের ডিউটি থাকলে টিকিট কাটতে হত না। ওদের ভালোবাসা কোনোদিন ভুলবো না। নাটক দেখিয়ে, চা বিস্কুট খাইয়ে, বাসে তুলে দিয়েছে কতদিন তার হিসেব নেই। 

আমাদের কলেজের অধ্যাপক ছিলেন থিয়েটার ওয়ার্কশপখ্যাত শ্রদ্ধেয় অশোক মুখোপাধ্যায়। একবার আমরা কয়েকজন মিলে পৌঁছে গেছি এ্যাকাডেমিতে। নাটক: থিয়েটার ওয়ার্কশপের চাকভাঙা মধু। এ্যাকাডেমির চারপাশে ঘুরঘুর করছি। দশ টাকা করে টিকিট। পকেটে সবার মিলিয়ে কুড়ি টাকা। আমরা চারজন। পিছনে গ্রীনরুমের দরজায় গিয়ে স্যার কে একটু বলতে বললাম যদি অনুগ্রহ করে একটু দেখা করতে দেন। স্যার বেরিয়ে এলেন। গালে দাড়ি, পরনে লুঙ্গি। আমাদের আগ্রহ দেখে জিজ্ঞাসা করলেন সবাই মিলে দশ টাকা দিতে পারব কিনা? আমরা রাজি হয়ে গেলাম। উনি হেসে ভিতরে চলে গেলেন। একটু পরে এক ভদ্রলোক এসে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেলেন এবং একেবারে প্রথম সারিতে ভি.আই.পি দের জন্য সংরক্ষিত আসনে বসতে দিলেন। বিভাস চক্রবর্তী এবং অশোক মুখোপাধ্যায় এর অসাধারণ অভিনয় মনের মধ্যে গভীর ছাপ ফেলেছিল। নাটক শেষে হোস্টেলে ফিরে এলাম। বুঝলাম না কেন জিজ্ঞাসা করেছিলেন সবাই মিলে দশ টাকা দিতে পারবো কিনা? আর কেনই বা সেই টাকা কেউ চাইলো না। আজ মনে হয় পরখ করে দেখতে চেয়েছিলেন নাটকের জন্য টিফিন বাঁচিয়ে জমানো টাকা দিতে আমরা রাজি হই কি না? কয়েকদিন আগে গিরিশ মঞ্চে দেখা হয়েছিল। প্রণাম করেছিলাম। চিনতে পারেন নি। পারার কথাও নয়। 

সমীর আমাদের সঙ্গে যোগ দিল হৈমন্তিকায়। ঠিক হলো নিজেদের লেখা নাটক অভিনয় করবো একেবারে নতুন ভাবনায়, নতুন আঙ্গিকে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের যে পরম্পরা এবং শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে শোষিতের যে সংগ্রাম চলে আসছে যুগ যুগ ধরে তারই ভিন্ন ভিন্ন রূপ আমরা দেখেছি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। মধ্যযুগীয় ক্রীতদাস প্রথায় শোষণের যে নগ্নরূপ ছিল পরবর্তীকালে তার পরিবর্তন হয়েছে মাত্র কিন্তু শ্রেণী ভিত্তিক শোষণ এবং শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আজও অব্যাহত। এই সত্যকেই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম আমার এবং সমীরের যৌথ প্রয়াসে রচিত নাটক 'টিরানোসেরাস' এ। পুরোদমে এই নাটকের রিহার্সাল চলল বিভিন্ন জায়গায়। সাধারণতঃ শনিবার বা রবিবার রিহার্সাল হত। ছুটির দিনে আমহার্স্ট স্ট্রীট থেকে সবার আগে এসে পৌঁছে যেত সমীর। সমীর আজও সমান সময়ানুবর্তী । আজ পর্যন্ত কোনোদিন ওকে দেরী করতে দেখিনি। 

ঠিক হল নাটক মঞ্চস্থ হবে। দুদিনের অনুষ্ঠান । প্রথমদিন নিজেদের নাটক টিরানোসেরাস । দ্বিতীয়দিন চেতনা নাট্যগোষ্ঠীর নাটক জগন্নাথ। আমাদের নাটকের নির্দেশক ছিলাম আমরা নিজেরাই । সমীর ছিল আমাদের মধ্যে মুখ্য নির্দেশকের ভূমিকায়। শ্রদ্ধেয় নাট্য পরিচালক পীযূষ চক্রবর্তী প্রথমদিকে কিছুদিন আমাদের নির্দেশনার দায়িত্ব বিনা পারিশ্রমিকে পালন করেছিলেন।পরে শারীরিক কারণে সময় দিতে পারেন নি। তবে নাটকের পোস্টারে ওনার নামই ছাপা হয়েছিল। কিছুদিন পরে ঠিক হল একজন অভিজ্ঞ পরিচালকের মতামত নেওয়া প্রয়োজন। আমার ব্যক্তিগতভাবে পূর্বপরিচিত অভিজ্ঞ পরিচালক অখিল মজুমদারের শরণাপন্ন হলাম। আমাদের উৎসাহ দেখে রাজি হয়ে গেলেন। পরবর্তী সময়ে ওনার অত্যন্ত স্নেহভাজন হয়েছিলাম আমরা সবাই। একরকম ওনার পরিবারের অংশ হয়ে উঠেছিলাম আমরা। সস্নেহে ভুল-ত্রুটি শুধরে দিতেন। এমনকি সাময়িক ভাবে অর্থ দিয়েও সাহায্য করেছিলেন। ওনাকে অন্তরের শ্রদ্ধা জানাইা 

নাটক মঞ্চস্থ হল হাওড়া ইস্টার্ন রেলওয়ে প্রেক্ষাগৃহে। সকলে প্রশংসা করেছিলেন। মা এসেছিল। নাটকের শেষে মা’ এর মুখের স্নিগ্ধ হাসিতে তৃপ্তি আর স্নেহমাখা প্রশংসা খুঁজে পেতে অসুবিধে হয়নি । মুখে বলল এবার একটু মন দিয়ে পড়াশুনা কর। পরে এই নাটকের দু একটা কল শো হয়েছিল। এর পরে মঞ্চে অভিনয় করা হয়নি। পড়াশুনার চাপে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হৈমন্তিকা উঠে গেল। 

এই প্রসঙ্গে 'চেতনা' ও 'জগন্নাথ' সম্বন্ধে দু একটা কথা বলার লোভ সামলাতে পারছিনা। এই নাটকের পরিচালক ছিলেন অরুণ মুখোপাধ্যায় । জগন্নাথ চরিত্রে অভিনয় করতেন উনি নিজে অথবা বিপ্লবকেতন চক্রবর্তী। এই দলের সব কুশীলবেরাই হাওড়ার বাসিন্দা ছিলেন। বিপ্লবদা কে ব্যক্তিগত ভাবে চিনতাম। ওনার বাবা শ্রদ্ধেয় ঋষিকেশ চক্রবর্তী ছিলেন সুগায়ক এবং হাওড়া রামকৃষ্ণ শিক্ষালয়ের প্রধান শিক্ষক। বয়সে কিছুটা বড় হওয়া সত্ত্বেও বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং বিবেকানন্দ স্কুল সংলগ্ন আশ্রমে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। আশ্রমের অনেক অনুষ্ঠানে ওনার গান শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। মনে পড়ে আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল রামকৃষ্ণ শিক্ষালয়ে। যে ক্লাসরুমে পরীক্ষা দিচ্ছিলাম সেখানে আমি এবং দীপ্ত ছাড়া সবাই অন্য স্কুলের। প্রশ্নপত্র হাতে আসার সাথে সাথেই চীৎকার, হৈ হৈ শুরু হয়ে গেল। মনে হল এটা পূর্বপরিকল্পিত ছিল। ঋষিবাবু আমাদের দুজনকে ডেকে নিয়ে দীপ্তকে অফিস রুমে আর আমাকে লাইব্রেরিতে বসার ব্যবস্থা করে দিলেন। বিপ্লবদার মেয়েরা অত্যন্ত গুণী এবং অভিনয় জগতে নিজগুনে প্রতিষ্ঠিত এবং সুপরিচিত। অরুণবাবুর দুই পুত্র সুমন এবং সুজনও এখন নাটক ও অভিনয় জগতে খুবই সুপ্রতিষ্ঠিত। যে কথা বলছিলাম, সেই সময়ের নিরিখে কি মঞ্চসজ্জায়, কি আলোকপাতে, কি শব্দক্ষেপণে এবং কি মূকাভিনয়ের অভিনব প্রয়োগে জগন্নাথ ছিল সত্যিই এক ব্যতিক্রমী নাটক। বহুবার এই নাটক দেখেছি। একসময় এই নাটকের সমস্ত দৃশ্য এবং সংলাপ আমার মুখস্থ ছিল। 

আমরা যখন কলেজে পড়ি তখন শম্ভু মিত্র এবং তৃপ্তি মিত্র বেশী অভিনয় করতেন না। ওনাদের একেবারে শেষের দিকের কিছু অভিনয় দেখার সুযোগ হয়েছিল। মনে আছে বহুরূপীর নাট্যোৎসব দেখার জন্য আগের দিন রাত থাকতে টিকিটের জন্য লাইন পড়ত। ভোরবেলা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কিনে ওনাদের নাটক দেখার বিরল আনন্দ ও অভিজ্ঞতা ভোলবার নয়। ওনাকে শেষ দেখেছিলাম ‘গালিলেওতে। তখন একই নাটক ‘গালিলেও’র দুটো প্রোডাকশন হত। একটা বহুরূপীর যেটাতে গালিলেও চরিত্রে অভিনয় করতেন অমর গাঙ্গুলি। নির্দেশনায় ছিলেন কুমার রায়। 

আশির দশকের গোড়ায় কলকাতায় এসেছিলেন ফ্রিৎস বেনেভিৎস। সাবেক পূর্ব জার্মানির ওয়েইমার ন্যাশনাল থিয়েটারের নাট্যপরিচালক তিনি। ফ্রিৎসের পরিচালনায় শহরের তাবড় মঞ্চব্যক্তিত্বেরা একসঙ্গে মিলে অভিনয় করেছিলেন বের্টোল্ট ব্রেশট-এর নাটক ‘গালিলিওর জীবন’। নাম ভূমিকায় ছিলেন শম্ভু মিত্র। এই নাটকেই বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, অশোক মুখোপাধ্যায়, অরুণ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব। দুটি প্রযোজনাই দেখেছিলাম আমি। 

বাংলা গ্রুপ থিয়েটারে তখন বহুরূপী, নান্দীকার, থিয়েটার ওয়ার্কশপ , চার্বাক, শূদ্রক, চেতনা , পি এল টি ইত্যাদি সগৌরবে বিরাজ করছে। শম্ভু মিত্র -তৃপ্তি মিত্র জুটির সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিচ্ছেন অজিতেশ বন্দোপাধ্যায় -কেয়া চক্রবর্তী জুটি। এই সময় সাংগঠনিক কারণে নিজের তৈরী দল নান্দীকার ছেড়ে চলে গেলেন অজিতেশ। তৈরী করলেন নতুন দল 'নান্দীমুখ'। হঠাৎ কেয়া চক্রবর্তী চলে গেলেন এক দুর্ঘটনায়। আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অজিতেশ চলে গেলেন মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে। কেয়া চক্রবর্তী এবং অজিতেশ বন্দোপাধ্যায় এর অকালমৃত্যুতে বাংলা নাটকের অপূরনীয় ক্ষতি হল।শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্র, অজিতেশ বন্দোপাধ্যায় -কেয়া চক্রবর্তী, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়, নীলকন্ঠ সেনগুপ্ত, জোছন দস্তিদার ,মেঘনাদ ভট্টাচার্য, উৎপল দত্ত প্রমুখ নাট্যব্যক্তিত্ব সেই সময় আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। 

অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা মৌলিক নাটক ‘সওদাগরের নৌকা’ ১৯৭৬-এ প্রথম মঞ্চস্থ হয়।একজন যাত্রা শিল্পীর কারুবাসনা, তাঁর সংসারের টানাপোড়েন আর মোমবাতির মতো পুড়ে গিয়েও আলো দিয়ে যাওয়া শিল্পীসত্তা কীভাবে জনপ্রিয়তার বিপ্রতীপে নৌকা ভাসায়— এই নিয়েই নাটক। নাটকটির কথা খুব মনে পড়ে। 

আর একটি নাটক আমাকে নাড়া দিয়েছিল ঐ সময়। সেটি পিএলটির ‘টিনের তলোয়ার’। টিনের তলোয়ার নাটকটি উৎপল দত্তের পরিচালনায় ১২ই আগষ্ট, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পিপলস্‌ লিটল থিয়েটারের প্রযোজনায় কলকাতা শহরে রবীন্দ্র সদন মঞ্চে প্রথম অভিনীত হয়। পিপলস্‌ লিটল থিয়েটারের এটি প্রথম প্রযোজনা । জাতীয় সাহিত্য পরিষদ ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে এই নাটকটি প্রথম প্রকাশ করেন। 

ঊনবিংশ শতকে , অপরিসীম আত্মত্যাগে যাঁরা বাংলা পেশাদার রঙ্গমঞ্চ গড়ে তুলেছিলেন – এই নাটক তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি । এই নাটকের মুখবন্ধে, উৎপল দত্ত লিখেছেনঃ 'বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ের শতবার্ষিকীতে প্রণাম করি সেই আশ্চর্য মানুষ গুলিকে- যাহারা কুষ্ঠগ্রস্থ সমাজের কোন নিয়ম মানেন নাই, সমাজও যাহাদের দিয়াছিল অপমান ও লাঞ্ছনা । যাহারা মুৎসুদ্দীদের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকিয়াও ধনীদের মুখোশটা নিয়া খুলিয়া দিতে ছাড়েন নাই । যাহারা পশুশক্তির ব্যাদিত মুখগহবরের সম্মুখে টিনের তলোয়ার নাড়িয়া পরাধীন জাতির হৃদয় বেদনাকে দিয়াছিল বিদ্রোহ-মূর্তি। যাহারা বহু বাচষ্পতি-শিরোমণি, বহু রাজা মহারাজার শত পদাঘাতে জর্জরিত, যাহারা অপাংক্তেয় ছোটলোকের আশীর্বাদধন্য, যাহারা ভালবাসার বিশাল আলিঙ্গন উন্মুক্ত করিয়া জনগণের গভীরে ঘুরিয়া বেড়াইতেন। যাহারা সৃষ্টিছাড়া, বেপরোয়া, বাঁধনহারা। যাহারা মাতাল, উদ্দাম, সৃষ্টির নেশায় উন্মাদ। যাহাদের মদ্যাসিক্ত অঙ্গুলিস্পর্শে ছিল বিশ্বকর্মার জাদু। যাহাদের উল্লসিত প্রতিভায় সৃষ্টি হইল বাঙালীর নাট্যশালা,জাতির দর্পণ, বিদ্রোহের মুখপত্র। যাহারা আমাদের শৈলেন্দ্রসদৃশ " 

নাটকটি ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি বাস্তব চিত্র। ১৮৭৬ সালে, ব্রিটিশ সরকার কুখ্যাত নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ণ করেছিল। ব্রিটিশ সরকার , নাটকের মাধ্যমে সরকার বিরোধী মনোভাব গড়ে উঠতে দেখে শঙ্কিত হয়ে এই আইনটি করে । এই আইনের পটভূমিকায়, বাংলা নাটকের ফেলে আসা ইতিহাসের মধ্যে তৎকালীন সমাজের নিপীড়ন নিষ্পেষণের ছবি এই নাটকে আঁকা হয়েছে। রাজদ্রোহমূলক নাটকগুলিকে ব্রিটিশ সরকার অশ্লীলতার অভিযোগ তুলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল ও নাটকের উপর সরাসরি আক্রমণও চালান হচ্ছিল। এছাড়া, কিছু স্বল্পশিক্ষিত ধনপতির ব্যভিচারের ফণাও নাটকের ওপর থাকত। সেই যুগপরিবেশকে এই নাটকে ধরা হয়েছে। 

নাটকে, বীরকৃষ্ণ দাঁ মুৎসুদ্দী ধনপতি। তার কাছে নাট্যশিল্প এবং মঞ্চের পণ্যমূল্য ছাড়া আর কোন মূল্য নেই। সে সময়, এই বীরকৃষ্ণদের মত একধরণের ত্রিশঙ্কু সম্প্রদায় তৈরী হয়েছিল, যারা একদিকে ইংরেজদের স্বার্থ অটুট রাখত অন্যদিকে মেকি আভিজাত্যবোধে আর টাকার গরিমায় সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, নাটকে মাতব্বরি করত। 

বেণীমাধব ওরফে কাপ্তেনবাবু এ নাটকের সর্বপ্রধান চরিত্র। বেণীমাধব কোন একক অস্তিত্ব নন – তিনি যেন সেইযুগের অসামান্য নাট্যব্যক্তিত্ব গিরিশচন্দ্র ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ দাস, দীনবন্ধু মিত্র, অমৃতলাল বসুদেরমত মানুষের সমবায় উপস্থিতি। তিনি 'বাংলা থিয়েটারের গ্যারিক'। বেণীমাধবের কাছে সবার উপর শিল্প সত্য। শিল্পীর স্বাধীনতা তার কাম্য, সে স্বাধীনতা যে কোন মূল্যে লাভ করতে তিনি কুন্ঠিত নন। বেণীমাধবের মত মানুষকে আপস করতে হয় বীরকৃষ্ণের মত কদর্য, নারীমাংসলোভী বাবুদের সাথে। 

প্রিয়নাথ একজন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ। সে বাবু-সংস্কৃতির উত্তারাধিকার ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে ক্রমশ শ্রেণীচ্যুত অবস্থানে পৌঁছায়। ময়নাকে ভালবেসেও বীরকৃষ্ণের খপ্পর থেকে তাকে বাঁচাতে পারে না। প্রিয়নাথ নিরুপায় ক্ষোভে ও ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে - '...আমি অমৃতবাজার পত্রিকায় পত্র লিখবো। ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনে বক্তৃতা দেবো। বলব – ব্রিটিশ জলদস্যুর অত্যাচারে যখন দেশ গোরস্থানে পরিণত, তখন বাবুসমাজ হিন্দুয়ানি, মদ, পতিতা, বুলবুলি ও ময়ূরবাহন নাটক লইয়া কালাতিপাত করিতেছেন।' – প্রিয়নাথ তাই নাটক লেখে 'তিতুমীর'। লেখাপড়া না জানা গরীব মেথর মথুর ও প্রিয়নাথ – দুজন দুরকম ভাবে বেণীমাধবের সাংস্কৃতিক দুর্গে কামান দাগে। 

বসুন্ধরা, একজনের প্রতারণায় বেশ্যা হয়েছিল। তারপর থিয়েটারে সে তার আশ্রয় পেয়েছিল। থিয়েটারে সে পেয়েছিল বাঁচবার পথ। ময়নার মধ্যে দিয়ে, সে তার নিজের সম্পূর্ণতা পেতে চায় – সে চায় ময়না প্রিয়ব্রতকে নিয়ে ঘর বাঁধুক। কিন্তু ময়না, কপট মায়াকাননে থাকতে চায়। রঙ্গমঞ্চে অভিনয়-সাফল্য ময়নাকে বদলে দেয় – সে বীরকৃষ্ণ দাঁএর রক্ষিতা হয়েও থাকতে রাজী , কিন্তু থিয়েটার ছাড়া সে বাঁচবেনা। সেবলে - '...দারিদ্রকে আমি ঘৃণা করি। সোপান বেয়ে ধীরে উঠেছি এখানে, গায়ে উঠেছে গয়না, পায়ের কাছে হাতজোড় করে ধন্না দিয়ে পড়ে আছে কলকাতার বড়লোকের দল। আবার ধাপে ধাপে নেমে গিয়ে গেরস্তঘরে ঝি-গিরি আমি করতে পারবো না।' ময়না যাকে স্বাধীনতা ভাবছে, তা যে আসলে একটা রুচিহীন ব্যাধিগ্রস্থ মুৎসুদ্দির শয্যায় দেহদান, সেটা প্রিয়নাথ তাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে। ময়নার ট্রাজেডি সেকালের অধিকাংশ অভিনেত্রী জীবনের ট্রাজেডি। 

'দি গ্রেট বেঙ্গলের' প্রতিদ্বন্দী দল 'গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটার'। ম্যাম্বার্টসাহেব 'গ্রেট ন্যাশানাল' এর অভিনেতাদের পীড়ন করেছেন। কাপ্তেনবাবু তার দল নিয়ে মঞ্চে 'সধবার একাদশী' অভিনয় করছিলেন। সেখানে ল্যাম্বার্টসাহেবকে বসে থাকতে দেখে বেণীমাধবের ভেতরে অগ্নুৎপাত হয় – তিনি তিতুমীরের ভূমিকা নিয়ে সংলাপ বলতে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে , সহ অভিনেতারাও তাদের ভূমিকা পালটে নেন ও বদলে দেন মঞ্চসজ্জা। বেণীমাধবের সত্ত্বার ভেতরের সুপ্ত দেশপ্রেম বেরিয়ে আসে। সামাজিক অচলায়তনের আলো-আঁধারিতে জন্ম নেওয়া নিমচাঁদের রূপসজ্জা ও অনুষঙ্গকে নিমেষে পেরিয়ে বেণীমাধব পরিবর্তিত হয়ে যান বিপ্লবী চেতনায় সমৃদ্ধ তিতুমীরে। তিতুমীর বেশী বেণীমাধব তখন দেশপ্রেমিক বীরের কন্ঠে বলেন- 'যতক্ষণ একটা ফিরিঙ্গি শয়তান দেশের পবিত্র বুকে পা রেইখে দাঁড়গে থাকবে, ততক্ষণ এই ওয়াহাবি তিতুমীরের তলোয়ার কষাবদ্ধ হবেনা কখনও।' এভাবে সময়ের যাবতীয় সীমাবদ্ধতা, মালিন্য, কুশ্রীতাকে মেনে নিয়েও চরম মুহূর্তে বেণীমাধব কালোত্তীর্ণ কৃষ্টিনায়ক হয়ে ওঠেন। তবে শুধু বেণীমাধব নন, বসুন্ধরা, কামিনী, জলদ, ময়না সমস্ত নাট্যকর্মী জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় রূপান্তরিত হন। তাদের সমবেত গানে কেঁপে ওঠে প্রেক্ষাগৃহ– 

'শুন গো ভারতভূমি 
কত নিদ্রা যাবে তুমি 
উঠ ত্যজ ঘুমঘোর 
হইল হইল ভোর 
দিনকর প্রাচীতে উদয়।‘ 

তবে সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত করেছিলেন যে নাট্যব্যক্তিত্ব তাঁর নাম বাদল সরকার। সত্তর দশকের উত্তাল সময়ের শুরু থেকে ‘থার্ড থিয়েটার’ নামে ভিন্ন এক নাট্য আঙ্গিক ও দর্শনের এর উদ্গাতা, নাট্যকার, সংগঠক, পরিচালকের ভূমিকাতে পরবর্তী চার দশক ধরে নাট্যজগৎ তাঁকে দেখেছে। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের বর্ণময় নাট্যজীবনে তিনি হয়ে উঠেছেন বিজয় তেণ্ডুলকর, গিরিশ কারনাড, হাবিব তনবীরের পাশাপাশি ভারতীয় নাটকের এক বিশিষ্ট স্তম্ভ। 

আমাদের কলেজের প্রাক্তনী ছিলেন। অনেক বয়সে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে এম.এ পাশ করেন। তাঁর সবচেয়ে সাড়া জাগানো নাটক ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ – আধুনিক ভারতীয় নাটকের অন্যতম পথিকৃৎ। ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ ১৯৬৩ তে লেখা, যখন চিন ভারত যুদ্ধ আর কমিউনিষ্ট পার্টির মধ্যে আন্তঃ-পার্টি সংগ্রাম চলছে, কিছুদিন যে পার্টির সদস্য ছিলেন তিনি নিজেও। বাদল সরকার লিখছেন, “হাসাবার ক্ষমতা চলে যাচ্ছে আমার। ... আজগুবি সৃষ্টিছাড়া হয়ে উঠছে লেখা। আর সবচেয়ে মারাত্মক – এতো রূপক এতো আড়াল সত্ত্বেও সত্যি মানুষগুলো বড় বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে।’’ ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ সেই সময়ের দ্বিধা দোলাচলতার ওপর আধারিত। অমল বিমল কমল এর গতানুগতিকতার বাইরে দাঁড়িয়ে ইন্দ্রজিৎ কোন হিসাব খুঁজে পায়না জীবনের, কোন হিসাব মেলাতেও পারে না। প্রসেনিয়াম মঞ্চে বাদল সরকার নাট্যকার হিসেবে যখন সম্পূর্ণ সফল তখনই 'সারারাত্তির’, ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’, ‘বাকি ইতিহাস’, ‘প্রলাপ’, ‘ত্রিংশ শতাব্দী’, ‘পাগলা ঘোড়া’র মতো নাটকগুলির মধ্য দিয়ে সাত আট বছরের সময়কালের মধ্যে তিনি প্রসেনিয়াম থিয়েটার ছেড়ে সরে এলেন মানুষের সঙ্গে নাটকের আরো বেশি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। শুরু হল থার্ড থিয়েটার বা অঙ্গনমঞ্চের নাটকের পথ চলা। বাংলার রাজনীতিতে তখন নকশালবাড়ির বিপ্লবী রাজনীতির আবেগ, সত্তর দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করার স্বপ্ন, কৃষক শ্রমিকের সাথে একাত্ম হবার প্রেরণা। বাদল সরকারের মনে হল গ্রামীণ যাত্রা বা ফার্স্ট থিয়েটার বা ইউরোপীয় আদলের সেকেণ্ড থিয়েটার – উভয় নাট্যমাধ্যমেই দর্শকের সাথে নাটকের অনেক দূরত্ব থেকে যাচ্ছে। এখানে অভিনেতারা থাকেন আলোকবৃত্তের মধ্যে, আর দর্শকরা অন্ধকারে। তারা বসেন মঞ্চ থেকে নিচুতে ভিন্ন এক তলে। থিয়েটার থাকে প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে আবদ্ধ। শ্রমিকের কারখানায়, কৃষকের ক্ষেতে, হাটে বাজারে জনতার মাঝে প্রচলিত থিয়েটারকে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। প্রেক্ষাগৃহে দর্শককে ডাকলেই শুধু চলবে না, থিয়েটারের মাধ্যমে চিন্তার রাজনীতিকে ছড়িয়ে দিতে হলে দর্শক আর নাটকের যোগাযোগকে অনেক জীবন্ত আর প্রত্যক্ষ করতে হবে। প্রথমদিকে বদ্ধ ঘরের অঙ্গনেই থার্ড থিয়েটারের কাজ শুরু করলেও পরে খোলা মাঠে অভিনয় শুরু হয়। আশির দশকে গ্রাম পরিক্রমার মধ্যে দিয়ে শহর মফস্বলে আটকে থাকা নাট্যচর্চার পরিধিকে প্রত্যন্ত গ্রামেও ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলতে থাকে। সেট ,আলোর উপকরণগুলিকে দর্শকের সাথে প্রত্যক্ষ সংযোগে অনাবশ্যক বলে মনে ক’রে, অভিনয়ে শরীর, কন্ঠকে নানাভাবে ব্যবহার ক’রে তাকে জীবন্ত করার ভাবনায় এই নাট্যকলা উদ্বুদ্ধ। ব্যয়বহুল উপকরণের নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার ফলেই এই থিয়েটার করা সম্ভবপর হয়ে উঠেছে সস্তায়। থার্ড থিয়েটার হয়ে উঠতে পেরেছে ‘ফ্রি থিয়েটার’।মেহনতি সাধারণ মানুষের সঙ্কট আর লড়াইয়ের কথাকে বারবার তুলে এনে এই থিয়েটার ‘থিয়েটারের এক নতুন রাজনৈতিক দর্শন’ তৈরি করল। 

থার্ড থিয়েটারের জন্যেই লেখা হয়েছে সত্তর দশক ও তার পরবর্তী বাদল সরকারের বিখ্যাত নাটকগুলো। সাগিনা মাহাতো, স্পার্টাকুস, মিছিল, ভোমা, সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস, হট্টমালার ওপারে, গণ্ডী, একটি হত্যার নাট্যকথা- এরা কোথাও প্রচলিত রাজনৈতিক আধিপত্যের তীব্র সমালোচনাতে উচ্চকিত, কোথাও মানুষের দাঁতে দাঁত চাপা লড়াইয়ের সঙ্গী, কোথাও নতুন মানবিক সাম্য সমাজ প্রতিষ্ঠার মরমী স্বপ্নে বিভোর। অভিনয় এবং জীবন, মঞ্চ এবং ময়দান, দর্শক এবং কুশীলব একাকার হয়ে গেল থার্ড থিয়েটারে। বাদল সরকারের 'মিছিলে' দর্শকদের সাথে সামিল হলাম আমিও। বাংলা তথা ভারতীয় থিয়েটার তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অন্যতম হিসেবেই বাদল সরকারকে মনে রাখবে। 

বাদল সরকারের নাটক দেখার পর আমার চিন্তা ও চেতনার জগতে শুরু হল দ্বন্দ্ব । মনে হল এতদিন যে নাটক দেখেছি, যে নাটকে বাংলার প্রথিতযশা অভিনেতারা মঞ্চ কাঁপিয়ে অভিনয় করেছেন, যে নাটকের টানে ভোররাতে লাইনে দাঁড়িয়েছি, যে নাটকের জন্য টিফিনের পয়সা জমিয়েছি তা মুহূর্তের মধ্যে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল’। অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করল থার্ড থিয়েটার। বিশেষ করে আমাদের মত কলেজ , ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা এই আন্দোলনে সাগ্রহে সাড়া দিল। কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি ভালবাসা ছাড়তে পারলাম না। বাংলার নামকরা গ্রুপ থিয়েটার গুলিও এই আন্দোলনে সেইভাবে অংশগ্রহণ করল না। থার্ড থিয়েটার আন্দোলন আশানুরূপ সাফল্য পেলো না। পড়াশুনার চাপ এবং পরবর্তী সময়ে জীবিকার প্রয়োজনে না পারলাম কোনো নাট্য সংগঠনের সাথে যুক্ত হতে, না পারলাম শহর বা শহরের বাইরে থার্ড থিয়েটারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। 

আমার মনে হয় কম্যুনিস্ট আন্দোলন এবং থার্ড থিয়েটার অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এই দুঃসময়ে কম্যুনিস্ট আন্দোলন যতটুকু বেঁচে আছে থার্ড থিয়েটারও ততটুকুই বেঁচে আছে। শত বিপত্তি সত্ত্বেও যাঁরা এদের অল্প হলেও বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁদের সাধুবাদ জানাই। 

সিনেমা প্রসঙ্গে আসছি এবার। সেই সময়ের তিন প্রথিতযশা সিনেমা পরিচালকের কথা না বলা হলে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই তিনজন হলেন স্বনামধন্য সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন এবং ঋত্বিক ঘটক। ঐ সময়ে আলোড়ন তুলেছিল দুটি ট্রিলজি বা ত্রয়ী। প্রথমটি সত্যজিৎ রায়ের। প্রতিদ্বন্দী, সীমাবদ্ধ এবং জন অরণ্য। 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘প্রতিদ্বন্দী মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে। বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর অর্থাভাবে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিতে হয় সিদ্ধার্থকে। চাকরির ইন্টারভিউতে গত দশ বছরে বিশেষ ঘটনা কি ঘটেছে জানতে চাইলে সিদ্ধার্থ চাঁদে মানুষ নামার কথা না বলে ভিয়েৎনাম যুদ্ধের কথা বলে। চাকরি হয়না সিদ্ধার্থের। শহরের জীবন তাকে কিছু দিতে পারে না। অবশেষে জীবিকার প্রয়োজনে সব সম্পর্ক ত্যাগ করে কলকাতা ছেড়ে শহরতলীতে চলে যায় সিদ্ধার্থ। পাখীর কূজন শবযাত্রার ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়ে সিদ্ধার্থের আশা আকাঙ্খার সমাধির ইঙ্গিত বহন করে আনে। 

শংকরের কাহিনী অবলম্বনে ‘সীমাবদ্ধ’ মুক্তি পায় ১৯৭১ সালে। কাহিনীর নায়ক শ্যামল বিদেশী কোম্পানীতে সেলস্ ম্যানেজার এবং ডিরেক্টর হওয়ার স্বপ্ন দেখে। আধুনিকা শ্যালিকা মনে মনে শ্যামলের সাফল্যে অভিভূত এবং বোনের প্রতি কিছুটা ঈর্ষান্বিতও বটে। ঘটনাচক্রে কোম্পানীকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য অন্যায় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে কোম্পানীতে স্ট্রাইক করিয়ে দেয়। এই স্ট্রাইককে কারণ হিসেবে দেখিয়ে কোম্পানী কাস্টমার এর থেকে এক্সটেনশন্ আদায় করে নেয় এবং শ্যামলের পদোন্নতি হয়। কিন্তু শ্যালিকা এবং নিজের চোখে শ্যামল অপরাধী হয়ে যায় । 

শংকরের কাহিনী অবলম্বনে ‘জন-অরণ্য’ মুক্তি পায় ১৯৭৬ সালে। অনেক চেষ্টার পরেও চাকরি যোগাড় করতে না পেরে অর্ডার সাপ্লাই এর ব্যবসা শুরু করার প্রস্তুতি নেয় সোমনাথ। সোমনাথ এর বন্ধু সুকুমার চাকরি না পেয়ে শেষ অব্দি ট্যাক্সি ড্রাইভার এর কাজ বেছে নেয় । অর্ডার পাওয়ার আশায় নিজের নৈতিকতা বলিদান দিয়ে ক্লায়েন্টের হোটেলে এক দেহপোজীবিনীকে পাঠায় সোমনাথ। ঘটনাচক্রে মেয়েটি সোমনাথের বন্ধু সুকুমারের বোন। অসহায় সোমনাথ আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকে কিন্তু শেষ অবধি মেয়েটিকে ফিরিয়ে দিতে পারে না। 

এই ছবিগুলির নান্দনিক মূল্য অস্বীকার না করেও কিছু কথা বলতে চাই। জন অরণ্য ছবির প্রথম দৃশ্যে পুরো পরিস্থিতি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যা দেখে যে কারো মনে হবে যে ছাত্ররা সিপিআই-এমএলের রাজনীতি করে এই পরীক্ষাকেন্দ্রটি তাদেরই দখলে। ফলে এখানে কোনো নিয়মকানুন চলবে না। মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী দলটি সম্পর্কে প্রথমেই এমন একটি নেতিবাচক মনোভাব দিয়ে শুরু হয় সত্যজিতের ‘জন-অরণ্য’। 

এই ছবির নায়ক সোমনাথ প্রথম দৃশ্যে, মানে সেই গণটোকাটুকির সময়ে বেশ সৎভাবে পরীক্ষা দেয়, কিন্তু চোখে ভালো দেখে না, নতুন চশমা কেনার টাকাও নেই এমন এক দরিদ্র পরীক্ষকের হাতে সোমনাথের ছোট অক্ষরে লেখা পরীক্ষার খাতাটি পড়ে। এতে ঐ শিক্ষক গড়পড়তা একটা নম্বর দিয়ে দেয়। ব্যস এখান থেকেই শুরু হয় সোমনাথের হতাশা। সত্যজিৎ বাবু সোমনাথের এই হতাশার দু’টি কারণ নির্দেশ করলেন—এক যারা স্লোগান সম্বলিত কেন্দ্রে নকল করে পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফল করলো আর অন্যটি হলো পরীক্ষকের দারিদ্র। চাকরির জন্যে বিভিন্ন জায়গায় চেষ্টা করেও যখন চাকরি মিলছে না তখন সোমনাথেরই এক বন্ধু সুকুমার তাকে নিয়ে যায় পূর্ব পরিচিত এমএলএ’র কাছে। 

১৯৭০ সালে ‘কলকাতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত করুণাশঙ্কর রায়ের নেয়া এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘পলিটিশিয়ানস অ্যান্ড হোল গেম অব পলিটিকস খুব ডিজহনেস্ট, খুব ছেলেমানুষি (মনে হয়)। বহুরূপীর মতো রঙ বদলাচ্ছে, প্রায় খেই হারিয়ে যেতে হয়।’ রাজনীতিবিদদের ছেলেমানুষ ভাবার বহিঃপ্রকাশই ঘটে সেই এমএলএ’র চরিত্রে। দেখবেন এই ব্যক্তিটি যেভাবে কথা বলছেন, যা বলছেন সবটাই একটা ক্যারিকেচার। এটা একটা কমেডি দৃশ্য। এমনভাবে রাজনীতিবিদদের হেয় ও ব্যঙ্গ করার বিষয়টি একশ্রেণীর অভিজাত দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আসে। তারা মনে করেন রাজনীতি যারা করেন তাদের কোনো দাম নেই। অবশ্য এই মনে করার দায় যে রাজনীতিবিদদের একদম নেই সেটাও বলা যায় না। তবে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের ছাড়া রাষ্ট্র চলবে কি? এমন প্রশ্নের উত্তর সত্যজিৎ বাবু কোথাও দিয়েছেন কি না জানি না। তবে এটা বোঝা যায়, সত্যজিৎ বাবু রাজনীতি এড়িয়ে চলা মানুষ। কিন্তু চাইলেই কি রাজনীতিকে এড়িয়ে চলা যায়? 

গোটা সমাজব্যবস্থাকে আমূল পালটে দেওয়ার ধারণাটি এই ছবিগুলির নায়কদের মধ্যে কাজ করে না, তারা সমাজের সুবিধা ভোগ করতে চায় শুধু, কিন্তু সমাজ পাল্টানোর সংগ্রামে সামিল হতে চায় না। তারা চায় তাদের হয়ে বিপ্লবটা অন্যরা করে দিক, তারা সুফলটা ভোগ করবে। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কারণে খুব কম সংখ্যক মানুষের হাতে সম্পদ জমা হয়, সেই কারণেই দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ে, আর সেই জন্যেই এই ব্যবস্থার অবসান দরকার, দরকার বিপ্লব—এই ভাবনা ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবির সিদ্ধার্থের যেমন নেই, কলকাতা ত্রয়ীর আরেক ছবি ‘সীমাবদ্ধ’র শ্যামলের নেই, ‘জন-অরণ্য’-তে নেই সোমনাথের বাবারও, আর সোমনাথের তো নেইই। 

সোমনাথ পরীক্ষা সততার সঙ্গে দিলেও ঠিক পরেই কলার খোলায় পা পিছলায় এবং তার পতন হয়, আক্ষরিক ও নৈতিক—দুই অর্থেই। বিশুদাদা বলে ভদ্রলোকের সঙ্গে তো কলার খোলায় পা পিছলে পড়েই দেখা হয় সোমনাথের। সেখান থেকে দালালি শুরু, এরপর অর্থের জন্যে বন্ধু সুকুমারের বোনকেও অন্যের হাতে তুলে দিতে তার বাধে না। একটু অস্বস্তি হয় বটে তবে শেষ পর্যন্ত সে দালালিটাই গ্রহণ করে নেয়, যেহেতু তার মানসিক শক্তি নেই বিপ্লবী হওয়ার, শারীরিক শক্তি নেই কারখানার মজুর হওয়ার তাই দালালিটাই তার জন্য বরাদ্দ। এমন এক ‘অকাট্য’ যুক্তি তার সামনে হাজির করে নটবর মিত্র। এই যুক্তি সোমনাথ মেনেও নেয়, কারণ সে জানে আপোস করলে আর্থিক লাভ আছে। নীতি বর্জন করে সোমনাথ ঘরে ফিরে আসার পর সত্যজিৎ বাবু আমাদের শোনান ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’, কিন্তু এই ছায়া কেন ঘনিয়ে এল সেটার কারণ আর ব্যাখ্যা করেন না তিনি। যদিও এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় বলছেন, ‘আমি মনে করি না কোনো শিল্পীর পক্ষে এটা খুব একটা দরকার বা জরুরি অথবা তার বলার কোনো অধিকার আছে, যে এটা ঠিক, ওটা ভুল।’ তিনি এটাও বলেছেন, ‘একজন শিল্পী হিসেবে আমি প্রচারক হতে চাই না।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো আপনি না চাইলেও আপনার সৃষ্টি কিছু না কিছু প্রচার করে। আপনার সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আপনার রাজনৈতিক অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি দুটোরই প্রচার হয়ে যায়। সৃষ্টির মধ্য দিয়েই কোনো না কোনো ভাবনাকে হয় আপনি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন, নয় তো কোনোটাকে বাতিল করেন। আর এই গ্রহণ ও বাতিল করার প্রবণতা থেকেই প্রকাশিত হয় আপনার রাজনৈতিক অবস্থান। এই অবস্থানের কারণেই ছবিতে আড়ালে রয়ে যায় কলকাতার তৎকালীন অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধঃপতনের পেছনে আসলে কারা দায়ী। নকশাল বাড়ির আন্দোলন যখন চলছে তখন সত্যজিৎ বাবু মন্তব্য করেন, তিন বামপন্থী দল নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে,এ কথা বলে সত্যজিৎ বাবু পুরো সমস্যাটিকেই পাশ কাটিয়ে যান। এই পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা তাঁর কলকাতা ত্রয়ীতেও দৃশ্যমান। 

সিদ্ধার্থ, শ্যামলেন্দু ও সোমনাথ। এই তিন চরিত্রই গা বাঁচিয়ে ভালো থাকার পক্ষপাতী, অনেকাংশে নিজের ভালোর জন্য অন্যের ক্ষতি করতেও কসুর করে না তারা। তারা চায় সমাজের ভালোটা অন্যে করে দিক, সেই ভালোর ফল তারা ভোগ করবে। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে সিদ্ধার্থ মনে করে বিপ্লব হওয়া দরকার, কারণ এতে তার বেকারত্ব দূর হবে। ‘সীমাবদ্ধ’ ছবিতে শ্যামলেন্দু মনে করে তার উন্নতির জন্য অন্যে মূল্য দিক, তার বাসনা পূরণ হলেই হলো। ‘জন-অরণ্য’ ছবিতেও সোমনাথ ব্যর্থ হতে চায় না, বেকার থাকতে চায় না, সে চায় অর্থ, ধনী হতে চায় সে, এতে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বোনকে যদি অন্যের হাতে তুলে দিতেও হয় তাতে তার নীতিতে বাধে না। ব্যক্তির সুখস্বাচ্ছন্দ্যই মুখ্য এই তিন চরিত্রের কাছে, সত্যজিতের কাছেও। 

১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় নির্মিত ' অশনি সংকেত' ছবির কথা বলে সত্যজিৎ রায় প্রসঙ্গ আপাততঃ শেষ করব। 

অশনি সংকেত ছবিটির পটভূমি ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষপীড়িত বৃহত্তর বাংলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার সেনাবাহিনীর জন্যে অতিরিক্ত খাদ্য সংগ্রহ করলে বাংলার গ্রামীণ অঞ্চলে তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ফলে ৫০ লাখ মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হন। এই দুর্ভিক্ষ কিভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছিল, সেটাই এই ছবির মূল উপজীব্য। 

গঙ্গাচরণ নামে এক শিক্ষিত ব্রাহ্মণ সস্ত্রীক নতুন গাঁয়ে এসে বসতি স্থাপন করে। নতুন গাঁ ব্রাহ্মণবিহীন, সেই সুযোগে ধূর্ত গঙ্গাচরণ সেখানকার প্রধান পুরোহিত হয়ে টোল খোলার পরিকল্পনা করতে থাকেন। সরল গ্রামবাসীরাও নিজেদের মধ্যে একজন ব্রাহ্মণকে পেয়ে খুশি হয়ে ওঠে। তাঁর স্ত্রী অনঙ্গ নিজের মধুর ও স্নেহশীলা স্বভাবের জন্যে অচিরেই গ্রাম্যবধূদের ভালবাসা অর্জন করে। 

এই সময় দুর্ভিক্ষ লাগলে গ্রামে খাদ্যের আকাল দেখা যায়। চতুর গঙ্গাচরণ নিজের জন্য কিছু চাল সংগ্রহ করে নেয়। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয় না। অনঙ্গ যখন কায়িক শ্রমের মাধ্যমে কিছু উপার্জনের কথা চিন্তা করতে শুরু করে, তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও গঙ্গাচরণকে সম্মতি দিতে হয়। অনঙ্গ অন্যান্য গ্রাম্যবধূদের সঙ্গে কাজ করতে যায়। 

এই সময় যদু নামে এক পোড়ামুখ গ্রাম্যযুবক গ্রামের বউ ছুটকিকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে ছুটকি তাকে প্রত্যাখ্যান করে। অনঙ্গ তার সোনার বালার বদলে গঙ্গাচরণকে কিছু চাল নিয়ে আসতে বলে। গঙ্গাচরণ চলে গেলে, ছুটকি ও অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে অনঙ্গ আলু তুলতে যায় ঝোপে। কিন্তু কায়িক শ্রম অনঙ্গের ধাতে নেই। সে একটি ফুল দেখে আলু ফেলে সেই দিকে ছুটে যায়। এই সময় একটি লোক ছুটকিতে তুলে নিয়ে যেতে চাইলে, আলু তোলার হাতা দিয়ে আঘাত করে ছুটকি তাকে খুন করে। 

পরে ছুটকি পেটের জ্বালায় সেই পোড়ামুখ লোকটির সঙ্গে পালিয়ে যায়। এই সময় একটি তথাকথিত নিচু জাতের মহিলা মারা গেলে, গঙ্গাচরণ মানবিকতার খাতিরে তাঁর ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ত্যাগ করে সেই মহিলার সৎকার করে। 

ছবির শেষে অন্তঃসত্ত্বা অনঙ্গকে নিয়ে গঙ্গাচরণ ও অন্যান্য গ্রামবাসীরা গ্রামত্যাগ করে। শেষে ১৯৪৩ সালের মনুষ্যসৃষ্ট সেই দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর খতিয়ান দেখিয়ে ছবি সমাপ্ত হয়। 

মৃণাল সেন পরিচালিত ট্রিলজি বা ত্রয়ী ইন্টারভিউ (১৯৭১), কলকাতা-৭১ (১৯৭১) এবং পদাতিক (১৯৭৩)। 

‘পদাতিক’ ছবির গল্প এইরকম। 

পুলিশ হেফাজতে রয়েছে উগ্র-বামপন্থী নেতা সুমিত। থানা থেকে চালান দেওয়ার সময় সুমিত পালিয়ে যায় পুলিশ ভ্যান থেকে। দলের নেতার আশ্রয়ে লুকিয়ে থাকে শহরের একটি জমকালো বাড়িতে। যার মূল মালিক শিল্পী মিত্রও একজন বামপন্থী কর্মী। বিজ্ঞাপন সংস্থায় কর্মরত শিল্পী মিত্র মূলত একাই থাকেন এই বাড়িতে। প্রথমদিকে আশ্রয়ের পরিবেশ সুমিতের ভালোই লাগে। ফেরারি আসামি বলে দীর্ঘদিন গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হয় সুমিতকে। এক সময় চার দেয়ালের ঘর সুমিতকে অসুস্থ করতে শুরু করে। যাপিত জীবন ও রাজনীতিকে ঘিরে মনে জাগতে থাকে নানা প্রশ্ন। তাঁর রাজনৈতিক নেতারা কী ভাবছেন, কী করছেন, কেন করছেন- এসব প্রশ্ন সুমিতকে অস্থির করে তোলে। দলের আদর্শিক চিন্তা আর বর্তমান কাজের ফারাক সুমিতকে বিস্মিত করে তোলে। কলকাতার এক ক্রান্তিকালের ঘটনা নিয়েই নির্মিত হয়েছে 'পদাতিক' চলচ্চিত্রটি। বাংলার ইতিহাসে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রাজনীতিকে চোখের সামনে তুলে ধরেছেন যে কয়জন পরিচালক, 'মৃণাল সেন' তাঁদের অন্যতম। কলকাতার তৎকালীন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ, কিছু সুবিধাভোগী বামপন্থীর সন্দিগ্ধ আচরণ, প্রকৃত কর্মীদের হতাশা, আবার উঠে দাঁড়ানোর লড়াই- সবকিছুই উঠে এসেছে তাঁর পদাতিক চলচ্চিত্রে। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় সাদা-কালো এই চলচ্চিত্রটি। মুক্তির প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত পদাতিক তার ঘটনা ও সত্যতায় উজ্জ্বল। গোটা ভারতে মুক্তি পেলেও পদাতিক নির্মিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। কলকাতা ট্রিলোজির অন্যতম একটি চলচ্চিত্র 'পদাতিক'। 

‘ইন্টারভিউ’ও মুক্তি পায় ১৯৭১ সালে।মৃণাল সেন ইন্টারভিউ চলচ্চিত্রে কলকাতার এমন একটি সময়ের কথা বলেছেন যখন সবকিছু অযোগ্যদের অধিকারে যাওয়া শুরু করেছে। যখন যোগ্যতার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন বাহ্যিক চাকচিক্যের । আর দরকার ক্ষমতাশীল মানুষের লেজুড়বৃত্তি। রঞ্জিতের চাকরিটা হয়ে যেত। না হওয়ার কোন কারণই ছিলো না। বিলেতি প্রতিষ্ঠান, মোটা মাইনে, কমিশন, সামথিং আরো নানা সুবিধা ছিলো চাকরিটাতে। কিন্তু শিক্ষিত, মেধাবী, স্মার্ট তরুণ রঞ্জিত মল্লিকের শুধুমাত্র স্যুটের অভাবে এই নামজাদা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি হয় না!! আর এই স্যুটের পেছনে ছুটতে ছুটতে দিশেহারা হতাশাগ্রস্ত তরুণটি একটা সময় প্রতিবাদী হয়ে উঠে। ইন্টারভিউ দেখে দর্শক তরুণটির জন্যে চোখের জল ফেলবে তারপর প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ভুলে যাবে তার কথা, সিনেমাটির কথা। এমনটা ঘটাই ছিলো স্বাভাবিক। কিন্তু মৃণাল সেন তো দর্শককে চলচ্চিত্র দেখাতে চাননি। তিনি কলকাতার সাধারণ মানুষের জীবনের করুণ চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তাই চলচ্চিত্রটিতে যখন তরুণটি প্রতিবাদী হয়ে ওঠে তখন দর্শককে ভাবতেই হয়, যখন তরুণটি দর্শকের সঙ্গে বাক-বিতন্ডা আর প্রশ্ন-উত্তর খেলায় মেতে ওঠে তখন তাকে কি আমরা আর সিনেমা বলতে পারি? সিনেমাটি নির্মাণের পর প্রায় পাঁচ দশক গত হয়েছে। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর পরে শুধু কলকাতা নামক ব্যস্ত একটি শহরের অলিগলিতে নয়, বিশ্বের আনাচে-কানাচে গলি-ঘুপচিতে আজ অযোগ্যদের অধিকার। তাই কলকাতাকেন্দ্রিক হলেও 'ইন্টারভিউ' বিশ্বজনীন ছোঁয়া পায়। ছবিটির শেষাংশে ক্রুদ্ধ তরুণকে দোকানে সাজিয়ে রাখা ম্যানিকুইনকে বিবস্ত্র করতে দেখা যায়। এ একটি দৃশ্য দিয়ে কি অনায়াসেই না একটি প্রজন্মের, একটি সময়ের, একটি শ্রেণীর ক্ষোভ আর ঘৃণাকে তুলে ধরলেন মৃণাল বাবু। 
‘কলকাতা-৭১’ এর পটভূমি নকশাল আন্দোলনে উত্তাল কলকাতা। চারটি ছোট গল্প দিয়ে সাজানো হয়েছে কেমন করে দারিদ্র্য, দুর্নীতির কবলে ধ্বংস হয়ে গেল একটি যুগ।দেখলাম কেমন করে গৃহহীন হয়ে সব মানুষ একই ছাদের তলায় আশ্রয় নিল। কেমন করে দেহব্যবসায় নেমে গেল একটা পুরো পরিবার, কেমন করে লেখাপড়া ছেড়ে চালের চোরকারবারে জড়িয়ে পড়ে শেষ হয়ে গেল এক কিশোরের জীবন। শেষ দৃশ্যে পুলিশের গুলিতে এক যুবকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সত্যের পরাজয় ঘটে। 

এছাড়াও মধ্যবিত্ত সমাজের নীতিবোধকে মৃণাল সেন তুলে ধরেন তাঁর খুবই প্রশংসিত দু’টি ছবি ‘এক দিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯) এবং ‘খারিজ’ (১৯৮২)-এর মাধ্যমে। খারিজ ১৯৮৩ সালের কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার পেয়েছিল। ১৯৮০ সালের চলচ্চিত্র ‘আকালের সন্ধানে’। ওই ছবিতে দেখানো হয়েছিল এক চলচ্চিত্র কলাকুশলীদলের একটা গ্রামে গিয়ে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষের উপর চলচ্চিত্র তৈরির কাহিনী। কী ভাবে ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের কাল্পনিক কাহিনী মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সেই গ্রামের সাধারণ মানুষদের সঙ্গে, সেটাই ছিল এই চলচ্চিত্রের সারমর্ম। ‘আকালের সন্ধানে’ ১৯৮১ সালের বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার হিসাবে রুপোর ভালুক জয় করে। মৃণাল সেনের পরবর্তীকালের ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহাপৃথিবী (১৯৯২) এবং অন্তরীন (১৯৯৪)। 

মৃণাল সেন বাংলা ভাষা ছাড়াও হিন্দি, ওড়িয়া ও তেলুগু ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ১৯৬৬ সালে ওড়িয়া ভাষায় নির্মাণ করেন মাটির মনীষ, যা কালীন্দিচরণ পাণিগ্রাহীর গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়। ১৯৬৯-এ বনফুলের কাহিনী অবলম্বনে হিন্দি ভাষায় নির্মাণ করেন ভুবন সোম এবং ১৯৭৬-এ তৈরি করেন মৃগয়া। ১৯৭৭ সালে প্রেম চন্দের গল্প অবলম্বনে তেলুগু ভাষায় নির্মাণ করেন ওকা উরি কথা। ১৯৮৩ সালে ফের তৈরি করেন হিন্দি চলচ্চিত্র, খণ্ডহর। ১৯৮৫ সালে নির্মাণ করেন জেনেসিস, যা হিন্দি, ফরাসি ও ইংরেজি তিনটি ভাষায় তৈরি হয়। 

মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র জগতের দীর্ঘ জীবনে ছবির মূল পটভূমি ছিল প্রধানত রাজনৈতিক চলচ্চিত্র। জীবনের শুরু থেকেই রাজনীতি বিশেষত বামপন্থী রাজনীতির দিকে তার ঝোঁক ছিল। তার সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন “ সে সময় ছাত্র হিসাবে রাজনৈতিক স্ট্যান্ড নেয়া অনেক সহজ ছিল। সে সময় ইংরেজ আমল, আমরা জানতাম আমাদের বড় শত্রু ইংরেজ, বৃটিশ ইম্পিরিয়ালিজম, তার বিরুদ্ধে জড়ো হওয়া অনেক সহজ ছিল। এখন (অর্থাৎ ১৯৪৭ এর পর) সেখানে বহু দল, বহু ব্যাপার,শত্রুমিত্র চেনা বড় ভয়ংকর হয়ে উঠছে। এখন কে শত্রু, কে মিত্র চেনা বোঝা বড় মুশকিল।” 

রাজনৈতিক ছবি নির্মাণ করলেও তার ছবি কখনো রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েনি। অর্থাৎ রাজনৈতিক বিরূপ সমালোচনায় পড়তে হয়নি। কেননা রাজনীতির গভীরে গিয়ে তার মূল অন্বেষণ করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য, ছবির রাজনীতিকরণ নয়। তাই ‘ভুবন সোম’ এ তিনি আমলাতন্ত্রকে আঘাত করতে চেয়েছেন। আমলাতান্ত্রিকতার ভেতরের ফাঁপা দিকগুলো উন্মোচন করতে চেয়েছেন, যা সত্যের মতোই ফুটে উঠতে দেখি। 

মৃণাল সেন সম্বন্ধে লেখা অসম্পূর্ণ থাকে যদি ১৯৬৯ এ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ভুবন সোম সম্বন্ধে কিছু না বলা হয়। । ভুবন সোম’ এর নায়ক ভুবন সোম রেল বিভাগের উধ্বর্তন, ডাকসাইটে একজন কর্মকর্তা। অবিবাহিত, অত্যন্ত সৎ। সততার কারণে নিকট আত্মীয়কেও বরখাস্ত করতে দ্বিধাবোধ করেন না। তাই রেলের একজন অসাধু টিকেট কালেক্টার যাদব প্যাটেলের ঘুষ গ্রহণের কারণে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট তৈরি কোরে তার শাস্তির ব্যবস্থা করেন। ছবির শুরুতে দেখা যায় চার্জশিট তৈরি ক’রে কোন এক সকালে ক্লান্তিকর কাজ থেকে রেহাই পাবার উদ্দেশ্যে সোম সাহেব গুজরাটের এক গ্রামের উদ্দেশ্যে পাখি শিকারের পরিকল্পনা নিয়ে রওনা হয়েছেন। তার যাত্রার পদধ্বনি আমরা ছবির একেবারে শুরু থেকে পাই, চলন্ত রেললাইনের উপর টাইটেল ওঠার মধ্যে দিয়ে। গ্রামে পৌঁছবার পথে গুজরাটের নানান মনোরম দৃশ্যবলী পার হতে দেখা যায়। ছবিটির কিছু বৈশিষ্ট্য প্রথমেই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। প্রথম বৈশিষ্ট্য ভুবন সোম বাঙালি হলেও ছবিটি হিন্দি ভাষায় নির্মিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মৃণাল সেনের এটাই প্রথম হিন্দি ভাষার ছবি। হিন্দি ধারাভাষ্যে আমরা সোম সম্পর্কে জানতে পারি তিনি বাঙালি, বাঙালির দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দের ছবির দেখিয়ে ধারাভাষ্যে বলতে শোনা যায় ‘বাঙাল’, তারপর রবীন্দ্রনাথের ছবির ওপর শুনি ‘সোনার বাঙাল’, সত্যজিৎ রায় এবং রবি শঙ্করের ছবির ওপর ‘মহান বাঙাল’ এবং তারপরেই বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন ফুটেজের উপর ‘বিচিত্র বাঙাল’। এই ‘বিচিত্র বাঙাল’ নিয়েই হয়তো পরিচালকের আগ্রহ কেন্দ্রীভূত হয়। অর্থাৎ বাঙালির চরিত্রের বিভিন্নমুখীতা, অনিশ্চয়তা বা অনড়তা, যা আমরা ছবির বিশ্লেষণে খোঁজার চেষ্টা করবো। 

দ্বিতীয় যে বৈশিষ্ট্য দেখি তা হলো স্থান হিসেবে পরিচালক বেছে নেন গুজরাটের একটি গ্রাম। যে গ্রামের প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম দৃশ্য একটি শান্ত সহজ–সরল জীবনের নির্দেশ করে। কোন ধরণের ক্লেদ যেখানে স্পর্শ করেনা। তৃতীয় এবং সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য যে বৈশিষ্ট্য আমরা দেখি তা হলো ছবির নায়িকা হিসেবে এমন একটি নতুন মুখ বেছে নেয়া হয় (সুহাসিনী মুলে) যার চরিত্র প্রকৃতির মতো নির্মল, সরল আর পবিত্র আচরণ, সহজ কথাবার্তা, মন হরণ করা হাসি ভুবন সোমের মতো জাঁদরেল আমলার প্রতি যেন এক তীর্যক মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। মেয়েটির সরলতার কাছে গম্ভীর আমলাটি যেন তুচ্ছ হয়ে পড়ে। ছবির শুরুতে ধারাভাষ্যে শোনা যায় – ‘সোম সাহেব জীবনে দেখেছেন অনেককিছু কিন্তু শেখেননি কিছুই।’ 

গ্রামে পৌঁছানোর পর ভুবনের সঙ্গে নায়িকা গৌরীর সঙ্গে দেখা হয়। গৌরী,সদ্য বিবাহিতা এবং যার স্বামী রেলের সেই টিকেট কালেক্টার যাদব প্যাটেল। তারপর একের পর এক ঘটনার মধ্যে দিয়ে গৌরীর কাছে ভুবনের বিব্রত হবার পালা চলতে থাকে। গৌরীর সঙ্গে প্রথম দেখাটা বড় চমকপ্রদ ভাবে দেখানো হয়। প্রথমেই দেখা হয় গৌরীর মহিষের সঙ্গে, যে মহিষের তাড়া খেয়ে সোমের অবস্থা নাজেহাল হয়ে পড়ে। ছবির এই সামান্য সূত্রটুকু আমাদের বুঝিয়ে দেয় আরও কত নাজেহালের গল্প অপেক্ষা করছে কাহিনীতে। গৌরীর বাড়িতে এসে সোম জানতে পারে যাদবের কথা। যাদব চাকরি সূত্রে দূরে থাকায় গৌরীকে তার শ্বশুরবাড়িতে স্থান নিতে হয়। যাদবের কথা জানা সত্ত্বেও সোম গৌরীকে বুঝতে দেয়না যে যাদব তারই অধীনে চাকরি করে এবং সেই সঙ্গে আরও কিছু যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। সোম শুধু এইটুকু জানায় যে সেও রেলে চাকরি করে। গৌরী তার আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সোমকেই সে ভুবন সোম সম্পর্কে নালিশ করে। এমনকি ‘ঘুষ’ ব্যাপারটা যে একটা সামাজিক অপরাধ সেটাও সে জানেনা, স্বামী যে ঘুষ খায় সেটা তার স্বামী তাকে যেভাবে বুঝিয়েছে সে সেভাবে বুঝেছে। তাই গৌরী নির্ভয়ে বলে – “মানুষটা অন্য মানুষের সুবিধা করে দেয়, আরাম দেয় বিনিময়ে তারা তাকে কিছু পয়সা দেয় – এর মধ্যে অন্যায়টা কোথায়?” গৌরীর সরলতা আর গ্রামের সরলতা যেন মিলে মিশে এক হয়ে যায়। ছবির গতি যতই এগিয়ে যায় আমরা দেখতে পাই গৌরীর স্বাভাবিক, সহজ, সরল প্রাণোচ্ছলতা ক্রমেই ডাকসাইটে ভুবন সোমকে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত করে ফেলছে। কঠোর সোম যেন ‘মানুষ’ সোমে রূপান্তরিত হচ্ছে। এতোটাই রূপান্তর ঘটে যে শেষ পর্যন্ত একটা পাখিও সে শিকার করতে পারে না। ভুবন সোম যে মেয়েটির অধিগত হয়ে গেছে ছোট্ট এক টুকরো শটে পরিচালক বড় দক্ষতার সঙ্গে বুঝিয়ে দেন। পাখি শিকারের সময় গৌরী যখন সোমের কাঁধে মুহূর্ত্তের জন্যে হাত রাখে, তখনই বোঝা যায় পাখি শিকার তার দ্বারা হবে না। 

ছবির এই অংশ পর্যন্ত আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় ভুবন সোমের মতো একজন কঠোর মানুষ ভিন্ন পরিস্থিতিতে, ভিন্ন মানুষের সাহচর্যে কিভাবে রূপান্তরিত হয়েছে তা নিয়ে বেশ মজার একটা কাহিনী বটে। সোম সাহেবের জন্যে বরং একটু করুণাও জাগ্রত হয় দর্শক হৃদয়ে। কিন্তু ছবির শেষে গিয়ে দর্শককে যেন হতভম্ব করে দেন পরিচালক। যখন সোমকে দেখি অফিসে ফিরে গিয়ে যাদবের জন্যে একটা ফয়সালা করতে, কি সেই ব্যবস্থা? শেষ দৃশ্যে গৌরীর কাছে যাদবের চিঠি আসে এবং সেই চিঠিতে যাদবের কন্ঠে শোনা যায়, “আরো ভালো জায়গায় বদলি হয়েছি ,উসকো মাতলাব, আউর কামাই।” অর্থাৎ যাদবের দুর্নীতির কারণে যাদবের চাকরি চলে যাওয়া দূরে থাক তাকে আরও ভালো জায়গায় বদলি করা হয়েছে, যেখানে সে আরো অধিকতর পরিমাণে ঘুষ নিতে পারবে বা দুর্নীতি করতে পারবে। ভুবন সোম ছবির শ্লেষটা এখানেই। ঠিক এই জায়গাটিতেই আমরা পেয়ে যাই প্রকৃত মৃণাল সেনকে। অনেক প্রশ্ন এক সঙ্গে উঁকি দিয়ে যায়। একটা রাষ্ট্রীয় কাঠামো যখন দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়, তখন ভুবন সোমের মতো একজন সৎ, যিনি নিজে কখনো ঘুষ খান নি তিনিও কি তবে সেই কাঠামোর ভেতরে থাকেন বলে ঘুষকে প্রশ্রয় দেন? অথবা সোমের মতো সৎ মানুষের কাছ থেকে যদি এই ফলাফল আসে তাহলে প্রকৃত সৎ আমরা কাকে বলবো? অথবা আমলাতন্ত্র এমন একটা জটিল তন্ত্র যে তন্ত্রের অধীনে দুর্নীতি বা তদ্বিষয়ক কোন অন্যায়কে খুব স্বাভাবিক একটা বিষয় বলে ধরে নেওয়া হয়? অথবা একটা সমাজ ক্রমশ দুর্নীতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে কি এই ধরণের ফলাফল দেখা দেয়? 

মনে রাখা দরকার ছবিটা ১৯৬৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল। তারপর অনেক দিন–কাল– বছর গড়িয়ে গেছে, কিন্তু ভুবন সোমের সমস্যাটা শুধু সেই সময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা সহ তৃতীয় বিশ্বের নানা দেশে। ভুবন সোমের মতো কেজো মানুষেরা শুধু অফিসের ফাইলের বহিরাবরণে প্রবেশে অভ্যস্ত (ছবির প্রথম এবং শেষে, সারি সারি ফাইলের স্তূপ কার্টুনের ভঙ্গীতে চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করা হয়), ফাইলের অভ্যন্তরে প্রবেশে অপারগ। সরকার আসে সরকার যায়, ভুবন সোমেরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেন। তাদের সেই অনড়তায় নাড়া দেবার জন্যেই হয়তো পরিচালক মৃণাল সেন বাঙলাভাষী ভুবন সোমকে হিন্দী ভাষায় কথা বলান, কোলকাতার সোমকে নিয়ে যান গুজরাটের গ্রামে এবং সাক্ষাৎ করিয়ে দেন এমন এক সরলতার সঙ্গে যার সংস্পর্শে এলে কঠিন পাথরও গলে যায়। কিন্তু তারপরেও দেখা যায় ভুবন সোমদের কোনো পরিবর্তন হয় না। কেন পরিবর্তন হয়না সেটা না হয় মৃণাল সেনের ভাষাতেই জানা যাক, চিত্রবীক্ষণের আরেকটি সাক্ষাৎকারে – “আমি জানি এই জাত একেবারেই সংশোধনাতীত। আজকে এই মুহূর্ত্তে হয়তো একটা লোককে ছাঁটাই থেকে অব্যাহতি দিয়েছে, কিন্তু সে পরে আবার ঐ রকম করে যাবে। সেই ইঙ্গিত ছবিতে আছে। আসলে সে পরিস্থিতির হাতে বন্দী এবং সেটাই তার ট্রাজেডি।” অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কাঠামো যদি শক্ত পোক্ত হয়ে গড়ে না উঠে, ভুবন সোমেরাও শক্ত পোক্ত হয়ে গড়ে উঠতে পারেন না। তাই সৎ আর অসততার দোলাচলে দুলতে থাকে তাদের ব্যক্তিত্ব। বলাই বাহুল্য, দোলাচলের কোন অবস্থান কখনোই কোন স্থায়ী মাটি খুঁজে পায় না। শক্ত হয়ে দাঁড়াতে তো পারেই না। আর তাই ভুবন সোমের ব্যক্তিত্ব শুধু মৃণাল সেনের একার অপছন্দের নয়, সবার অপছন্দের হবার অভিপ্রায় নিয়ে সবাইকে নিয়ে তিনি দেখতে এবং দেখাতে চান, জানতে এবং জানাতে চান। তাই এতকাল পরেও ‘ভুবন সোম’ আমদের ভুবন থেকে হারিয়ে যায় নি। বার বার ফিরে আসে আমাদের বাস্তবতায় আর অপেক্ষায় থাকি একটি সুদৃঢ় রাষ্ট্রীয় কাঠমোর, যে কাঠামো ভুবন সোমদের দৃঢ় কিন্তু অনড় নয়, কাঠিন্য নয় বরং গৌরীর মতো সহজ, সরলতায় নিজেদের গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। 

সেই সময়ের সবচেয়ে বিতর্কিত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে ১৯৭৬ সালে মাত্র ৫১ বছর বয়সে উনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। 

১৯৫৫ সালে নির্মিত ছবি 'নাগরিক' বাণিজ্যিক কারণে মুক্তি পায়নি। নানান আইনি জট কাটিয়ে ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭৭ সালে, তাঁর মৃত্যুর এক বছর পরে। "এইভাবে, পৃথিবীর ইতিহাস বারবার বদলে গেছে,তবুও মানুষ, সবসময় বেঁচেছে,আমরা পাগলের মতো জীবন চালিয়ে গেছি, কিন্তু এটাই জীবন।" বলেছেন ঋত্বিক ঘটক। 

ইতিহাস বদলের সময় মানুষের বাঁচার লড়াই -এর গল্প এই “নাগরিক”। এক নাগরিকের বেঁচে থাকার পাগলামোই এই চলচ্চিত্রের মূল বিষয়।এই চলচ্চিত্রটি ১৯৫৩ সাল নাগাদ মুক্তিলাভের জন্য প্রস্তুত হয়েও একটি বিশেষ বাণিজ্যিক জটিলতার কারণে অবশেষে এর মুক্তিলাভ সম্ভব হয়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিন পরে থাকার ফলে এর নেগেটিভটাও হারিয়ে যায়। শেষে প্রায় ২৪ বছর পর অতি খারাপ একটা প্রিন্ট থেকে নেগেটিভ বার করে সেখান থেকে প্রিন্ট করানো হয় এবং ১৯৭৭ -এর শেষ দিকে “নাগরিক” মুক্তিলাভে সক্ষম হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়ছবিটির আলো-ছায়ার বৈপরীত্য ১৬ আনাই চলে যায়। সে সময় সাউন্ড ট্র্যাক এবং মেকআপ সেরকম উন্নত না থাকায় নতুন প্রিন্টটাতে তার অবস্থা আরও খারাপ হয়। স্বাভাবিক ভাবেই চলচ্চিত্র শিল্পে আলো-ছায়া থেকে যে চলচ্চিত্র ভাষার স্থান তৈরী হয় সেটা এই প্রিন্টটাতে প্রায় খুঁজেই পাওয়া যায় না। ছবিটাতে ক্যামেরা মুভমেন্ট এবং সম্পাদনা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কিছু অংশে সম্পাদনার যে স্বাভাবিক ছন্দ থাকে সেটাও অনেকটা হারিয়েছে। এই সবকিছু হারিয়েও “নাগরিক” কে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পে নব-তরঙ্গের সূচনা ধরা যেতে পারে। এটা একটা বড় প্রাপ্তি। 

ঋত্বিক ঘটকের কথায় “দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর বাংলার মধ্যবিত্তের জীবনযন্ত্রনার এটিই প্রথম বস্তুনিষ্ঠ শিল্পরূপ”। এটা একটা বাস্তববাদী চলচ্চিত্র। ১৯৫০-৫১ - এ চিত্রনাট্য রচনাকাল হলেও আজও এর যর্থাথতা আছে। 

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর কলকাতা শহরের মধ্যবিত্তদের প্রতিনিধি হিসাবে এক নাগরিককে বেছে নেওয়া হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। এই নাগরিকের নাম রামু। সে রোজ ইন্টারভিউ দিতে যায়। কিন্তু বিফল হয় বার বার, তবু আশা ছাড়ে না। রোজ সে স্বপ্ন দেখে, একটু ভালো থাকার, একটু নিশ্চিন্ততার। 

এই নাগরিককে কেন্দ্র করে আর যে সব চরিত্র আছে যেমন বাবা, মা,বোন ,পেইংগেস্ট,প্রেমিকা ইত্যাদি তারা কেউ অবসাদগ্রস্ত, কেউ উদাসীন, কেউ বাঁচার সহজ উপায় খুঁজতে গিয়ে হয়তো সবচেয়ে সস্তা উপায় খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু সবার উদ্দেশ্য একটু বাঁচা, একটু নিশ্চিন্ততা। রামু প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলে। কখনো ভেঙ্গে পড়ে, কখনো নতুন করে আশায় বুক বেঁধে আবার নতুন উদ্যমে লড়াই করে। কিন্তু প্রতিবার বিফলতা আসার ফলেও রামুর আত্মভিমান একটুও কমে না। মানুষ রামুর পরির্বতন হয় না। 

এই কাহিনীতে আমাদের বেঁচে থাকার অন্যান্য চাহিদাও দেখান হয়েছে। যেমন রামু উমাকে ভালোবাসে কিন্তু প্রতিদিনের অসফলতা তাকে ভীরু, কাপুরুষ করে তুলেছে। সে কারণে রামু তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চায়। এখানে ভগ্ন সমাজ ব্যাবস্থার রূপটাও খুব পরিষ্কার দেখানো হয়েছে। যেমন স্বজনপোষন নীতি, আর্থসামাজিক অবস্থার ভগ্নরূপ ইত্যাদি। এক কথায় সামাজিক অবক্ষয়ের দিকটা পরিষ্কার দেখানো হয়েছে। এখানে বাঁচার সমবেত লড়াইকে গণ আন্দোলন রূপে তুলে ধরা হয়েছে। এই কাহিনীর শেষপ্রান্তে এসে রামু অনুভব করেছে, তার এই লড়াইতে আর্থিক পরিকাঠামোতে আমূল পরির্বতন কিংবা তার রোজকার দেখা স্বপ্ন বাস্তবায়িত করা, কোনটাই সম্ভব নয়। এই কঠোর বাস্তবটা রামু তার নাতিদীর্ঘ লড়াইয়ের পথেই অনুধাবন করে। অভিজ্ঞতা তাকে মানসিক ভাবে বলিষ্ঠ করে তোলে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, আর স্বপ্ন নয়, এবার খালি লড়াই। তার এই লড়াইতে সে উমাকেও সামিল করতে চায়। ঠিক করে নেয় উমাকে সে বিয়ে করে নেবে। 

শেষ দৃশ্যে রামু যখন বাসা ছেড়ে আরও নিম্নমানের বাসাতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে সেই মুহূর্তে অপর আরেকটি পরিবার নিশ্চিন্ততার স্বপ্ন নিয়ে,ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে রামুদের ছেড়ে যাওয়া বাসাতে প্রবেশ করে। এই ভাবে ঘটনার নতুন আবর্তের সূচনা করে চিত্রনাট্যটি শেষ হয়। 

কাহিনীর মধ্যে একটা আশার আলো লুকিয়ে আছে, যেটা প্রত্যেক নাগারিককে লড়াই করার উদ্যম যুগিয়ে যায়। কাহিনীর চরিত্র বিন্যাসের মধ্যে বেহালা বাদক চরিত্রটি এবং তার চলচ্চিত্রায়ন ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। জীবনযোদ্ধার স্বপ্নের ছন্দপতনের রূপক হিসাবে বেহালার তার ছিঁড়ে যাওয়ার দৃশ্যটি অসাধারণ। 

তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে মেঘে ঢাকা তারা(১৯৬০), কোমল গান্ধার(১৯৬১) এবং সুবর্ণরেখা (১৯৬২) অন্যতম; এই তিনটি চলচ্চিত্রকে ট্রিলজি বা ত্রয়ী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, যার মাধ্যমে কলকাতার তৎকালীন অবস্থা এবং উদ্বাস্তু জীবনের রুঢ় বাস্তবতা চিত্রিত হয়েছে। সমালোচনা এবং বিশেষ করে কোমল গান্ধার এবং সুবর্ণরেখা'র ব্যবসায়িক ব্যর্থতার কারণে এই দশকে আর কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। 

ঋত্বিক ঘটক ১৯৬৫ সালে স্বল্প সময়ের জন্য পুণেতে বসবাস করেন। এসময় তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন ও পরবর্তীকালে ভাইস-প্রিন্সিপাল হন। এফটিআইআই-এ অবস্থানকালে তিনি শিক্ষার্থীদের নির্মিত দুটি চলচ্চিত্রের (Fear and Rendezvous) সাথে জড়িত ছিলেন। ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্রের জগতে আবার ফিরে আসেন সত্তরের দশকে অদ্বৈত মল্লবর্মন রচিত বিখ্যাত উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় চলচ্চিত্রে রূপদান সম্পন্ন হয়। এটি মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে। খারাপ স্বাস্থ্য এবং অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে নিয়মিত কাজ চালিয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাঁর শেষ চলচ্চিত্র ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো ‘(১৯৭৪) অনেকটা আত্মজীবনীমূলক এবং এটা তাঁর অন্যান্য চলচ্চিত্র থেকে ভিন্ন ধাঁচের। 

শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবি অথচ মাতাল নীলকণ্ঠকে মাঝ বয়সে স্ত্রী'র সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদে যেতে হয়। স্ত্রী, সন্তান আর কলকাতার গলিপথ ছেড়ে সে বেরিয়ে পড়ে। তার সঙ্গী হয় পাড়ার ছেলে তরুণ নচিকেতা। দু’জনের যাত্রা শুরু হয় অজানার উদ্দেশ্যে। পথে পরিচয় হয় বঙ্গবালার সঙ্গে। ১৯৭১-এর ৩০ মার্চ বাংলাদেশে পাকিস্তানি মিলিটারির বর্বরতার শিকার সে। তার সঙ্গে আছে টোলের পণ্ডিত। কলকাতায় তারা এসেছেন জীবন ও জীবিকার আশায়। এই চারজন এক সাথে পথ চলা শুরু করে। এক সময় তারা এসে পৌঁছায় পুরুলিয়ায়। ছৌ নাচের শিল্পীদের সঙ্গে সেখানে ভূমি দখলদারদের লড়াই চলছে। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে গুলিতে নিহত হয় পণ্ডিত। এরপর তারা তিনজন যায় বীরভূমে, সেখানে তার স্ত্রীকে সে অনুরোধ করে, কাল সকালে ছেলেকে একটু দেখতে দেওয়ার জন্য শালবনে পাঠাতে। বনের ভেতরে নীলকণ্ঠ মুখোমুখি হয় বিদ্রোহী নকশালদের। সশস্ত্র নকশালদের সঙ্গে পুলিশের বন্দুক যুদ্ধ হয়। গোলাগুলি শেষ হয়। এ সময় নীলকণ্ঠের ছেলে এসে পিতাকে ডাকে। তার ডাক শুনে পুলিশ আবার গুলি করে। নীলকণ্ঠ মারা যায়। 

আর দুটি ছবির কথা বলে সিনেমা প্রসঙ্গ শেষ করব।প্রথমটি উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর 'মুক্তি চাই'। বন্দীমুক্তি আন্দোলনের জ্বলন্ত দলিল। ভাষ্যে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। বিনাবিচারে বন্দী অসংখ্য মানুষের মুক্তির দাবিতে শহর উত্তাল। অন্যদিকে রেসের মাঠে সস্ত্রীক সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, বারের মধ্যে মিস্ শেফালীর উদ্দাম ক্যাবারে নাচ গণমুখী সংস্কৃতি আর গণবিরোধী সংস্কৃতির তীব্র বৈপরীত্যের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। 

দ্বিতীয়টি শংকর ভট্টাচার্যের ছবি সমরেশ মজুমদারের কাহিনী অবলম্বনে 'দৌড়'। নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে থাকার মিথ্যা অভিযোগে চাকরি যায় রাকেশের। চাকরি বাঁচাবার জন্য ওপর মহলে ধরাধরি করে রাকেশ। পরে জানা যায় ওর সহপাঠী অন্য এক রাকেশ নকশাল আন্দোলনে জড়িত ছিল এবং তাকে ধরিয়ে দিতে পারলে চাকরি বেঁচে যাবে রাকেশের। আত্মস্খলনের প্রায় অন্তিম জায়গা থেকে ফিরে আসে রাকেশ। স্বার্থ আর বিবেকের লড়াই এ বিবেকের জয় হয়। পুলিসকে ফিরিয়ে দেয় রাকেশ।  

দেখে মনে হয়েছিল 'দৌড়' 'জন-অরণ্য'র গালে এক জোর থাপ্পড় ! 

এবার আসি সাহিত্যের কথায়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র ছাড়াও পড়তে শুরু করলাম সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় , সমরেশ মজুমদার, বুদ্ধদেব গুহ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এবং আরো অনেক সমকালীন কবি সাহিত্যিক এর রচনা। বাড়তে শুরু করল সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ। কবিতার প্রতিও আগ্রহ ছিল প্রবল। কৈশোরের কল্পনা, প্রেম, আবেগ, বিরহ ইত্যাদিকে উপজীব্য করে যখন সাহিত্য সৃষ্টির চিন্তায় বিভোর তখন হাতে পেলাম মহাশ্বেতা দেবীর 'হাজার চুরাশির মা'। 

মহাশ্বেতা দেবীর লেখায় পেলাম সেই সমাজের ছবি যে সমাজটা ভেতরে ভেতরে সমস্ত মূল্যবোধ হারিয়েছে, গলে পচে দুর্গন্ধময় হয়ে গেছে। ‘‘সব যেন কীটদষ্ট, ব্যাধিদুষ্ট, পচাধরা, গলিত ক্যানসার। মৃত সম্পর্কের জের টেনে মৃত মানুষেরা বেঁচে থাকার ভান করছে। সুজাতার মনে হল অমিত, নীপা, বলাই, এদের গায়ের কাছে গেলেও বোধহয় শবগন্ধ পাওয়া যাবে। এরা ভ্রুণ থেকেই দুষ্ট, দূষিত, ব্যাধিগ্রস্ত। যে সমাজকে ব্রতীরা নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল সেই সমাজ বহুজনের ক্ষুধিত অন্ন কেড়ে নিয়ে এদের সযত্নে রাজভোগে লালন করে, বড় করে। সে সমাজে জীবনের অধিকার মৃতদের, জীবিতদের নয়।’’ ফলে ‘হাজার চুরাশির মা’ হয়ে ওঠে একদিকে মৃতের জন্য শোক, অন্যদিকে এই সব চলমান শবদের প্রতি ঘৃণার কাহিনী। 

মহাশ্বেতা দেবী ‘বাবু সাহিত্য’কে ঘৃণা করতেন।'বাবু সাহিত্য’ হলো সস্তা প্রেমের কচকচি আর ‘আহা উহু’ করা সাহিত্য, যা এই নিমর্ম বাস্তবকে নানান রঙ চড়িয়ে পোশাকি করে তোলে, আর যার মূলে ,কাণ্ডে ,শাখায় ফলে ,ফুলে ,বীজে সমাজ, ইতিহাস, সভ্যতার প্রতি কোন দায় নেই। দায় নেই সাহিত্য সৃষ্টির প্রতি, নান্দনিকতার প্রতিও। মহাশ্বেতা দেবী অবশ্য এ ব্যাপারে আরো একধাপ এগিয়ে থাকেন। তিনি নান্দনিকতাকে সাহিত্যের কোনো বিবেচ্য বিষয় বলেই মনে করতেন না। তাঁর কাছে সাহিত্য ছিল দায়বদ্ধতার বিষয়। ফলে তাঁর গদ্যটা কতটা গদ্য হলো, তাতে সৌন্দর্য ফুটল কি ফুটল না, তাঁর বলাটা মনোহরা হৃদয়কাড়া হলো কি হলো না– এসব তাঁর কাছে বিবেচ্য বিষয় বলে মনে হতো না। আমরা বলতে পারি এটা ‘মহাশ্বেতীয় ধরণ’– যে-আদলে তিনি একের পর বই উপহার দিয়েছেন। তিনি রাজনীতি ও ইতিহাসের সংমিশ্রণে যেমন তুলে আনেন ঝাঁসির রানীর বীরত্বব্যঞ্জক স্বাধীনতা সংগ্রামের চিত্র তেমনি মধ্যবিত্তের দ্বন্দ্বময় জীবনভাষ্য। 

এসব ভাবধারায় উল্লেখ্যযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো- মধুরে মধুর (১৯৫৮), আঁধারমানিক (১৯৬৬), হাজার চুরাশির মা (১৯৭৪), অক্লান্ত কৌরব (১৯৮২), মার্ডারারের মা (১৯৯২) প্রভৃতি। মহাশ্বেতা দেবী প্রান্তিক আদিবাসী জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাস রচনা করে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছেন। এ ধারার উপন্যাসগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য : কবি বন্দ্যঘটি গাঞির জীবন ও মৃত্যু (১৯৬৭), অরণ্যের অধিকার (১৯৭৫), চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর (১৯৮০), বিরসা মুন্ডা (১৯৮১), টেরোড্যাকটিল, পূরণসহায় ও পিরথা (১৯৮৭), সুরজ গাগরাই (১৯৮৩), বন্দোবস্তি (১৯৮৯), ক্ষুধা (১৯৯২) এবং কৈবর্ত খণ্ড (১৯৯৪)। 

হাতে এল 'ইস্পাত'। জানলাম কেমন করে রাশিয়ার পুরনো সমাজের উত্তরণ ঘটলো বিপ্লবের সাথে সাথে। প্রধান চরিত্র পাভেল করচাগিন, লেখক নিজেই। যৌবন-প্রেম-সংগ্রাম নিয়ে লেখা এই উপন্যাস সাহিত্য সম্পর্কে আমার সেই সময়ের ধারণাকে অনেকটাই পাল্টে দিল। নিকোলাই অস্ত্রভ্‌স্কির জন্ম ১৯০৪ সাল। ১৯১৭ সালে মাত্র তেরো বছর বয়সে তিনি বলশেভিক পার্টির সদস্য হন। পরবর্তীকালে তিনি একটি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হন যা তাকে কিছুদিনের মধ্যেই প্রায় অন্ধ এবং শয্যাশায়ী করে দেয়। যুদ্ধে অনেকবার আহত এবং গুলিবিদ্ধ হওয়ায় তিনি মারাত্মকভাবে অসুস্থ হন এবং অনেকবার চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হন। তাঁর নিজের লেখা জীবনীতে তিনি কখনই উল্লেখ করেননি যে তিনি রেড আর্মিতে কাজ করেছেন। অসুস্থতার দরুণ ১৯২৯ সালের দিকে তিনি চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারান। দৃষ্টিশক্তি না থাকার পরেও ১৯৩০ সালে তিনি তাঁর জীবনের প্রথম উপন্যাস 'হাউ দ্যা স্টিল ওয়াস টেম্পার্ড ' লেখা শুরু করেন। এই উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ 'ইস্পাত'। পরবর্তীকালে তাঁর উপন্যাস এবং লেখনীর জন্যে কমিউনিষ্ট বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান এবং ১৯৩৫ সালে ‘অর্ডার অফ লেনিন’ সম্মানে ভূষিত হন। বইখানা লেখা শেষ হলে নিকোলাই অস্ত্রভ্‌স্কি বলেছিলেন, "এবার বেরিয়ে পড়েছি লৌহকাঠের বেষ্টনীর ভিতর থেকে...এখন আমি আবার এসে দাঁড়িয়েছি যোদ্ধাদের সারিতে।" 

সেই সময়ে বিখ্যাত চিনা লেখক লু শুনের রচনা আমার সাহিত্য চিন্তাকে প্রভাবিত করেছিল। ১৯১৯ সালের ৪ঠা মে আন্দোলনের পরে সমাজবাদে বিশ্বাসী লু শুনের রচনা যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। মাও-সে-তুং স্বয়ং ওনার অনুরাগী ছিলেন যদিও লু শুন কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না। 

আরেকটি অন্য রকমের বই যা আমাকে নতুন ধরণের সাহিত্যের সন্ধান দিয়েছিল সেটি মৈত্রেয়ী দেবীর 'ন হন্যতে' , এক দু:সাহসিক আত্মজীবনী। ১৯৩০-সালে কালচে বাদামি রঙের ভারতীয় এক বালিকার সাথে রোমানিয়ার এক তরুণের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনি। তরুণটি মেয়েটির বাড়ীতে পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকতেন। মেয়েটি ছেলেটিকে বাংলা শেখাতেন এবং ছেলেটি মেয়েটিকে ফ্রেঞ্চ শেখাতেন। প্রেমের সম্পর্ক তাঁরা গোপন রাখতেও পারেন নি বেশিদিন। অল্পদিনেই অভিভাবকেরা বিষয়টি জেনে যায়। কিন্তু বিস্ময়কর ছিল সেই ১৯৩০-এর পৃথিবীর ধর্মনির্ভর সমাজ। জাতপাত তথা ধর্মীয় কারণে তরুণটিকে বাড়ি থেকে চলে যেতে হয় এবং আর কখনোই মেয়েটির সাথে যোগাযোগ না করতেও বলা হয় অত্যন্ত কঠিনভাবে। সন্ন্যাসজীবন শেষে পরবর্তীকালে সেই তরুণ পরিচিতি পান বিশ্বখ্যাত দার্শনিক হিসেবে। লেখেন একটি আধা-আত্মজৈবনিক উপন্যাস, যা ১৯৩৩-সালে রোমানিয়ায় প্রথম প্রকাশিত হয়। বইটি লেখা হয়েছিল বিশেষ করে একটি সাহিত্য পুরস্কারের জন্যেই। পরে তা "হট সেলার বুক" হিসেবে প্রচুর বিক্রি হয় এবং লেখকের জন্যে বিপুল অর্থ ও খ্যাতি বয়ে আনে। উপন্যাসটি তখন ইতালিয়ান, জার্মান, ফরাসি, স্প্যানিশ সহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয় অল্পদিনেই। 

রোমানিয়ার সেই লেখকের নাম মির্চা এলিয়াদ, আর ভারতীয় মেয়েটির নাম মৈত্রেয়ী দেবী। রোমানিয়ার উপন্যাসটির ইংরেজি নাম 'বেঙ্গল নাইটস'। মির্চা এলিয়াদ এরপর সংসারী হন।এদিকে বিশ বছর বয়সে অমৃতার বিয়ে হয়ে যায় কলকাতার মনমোহন সেনের সাথে। তাদের সন্তানও হয় দু’টো। এরপর তিনি লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন, প্রকাশ করতে থাকেন কবিতা ও গদ্যের বিবিধ বইপত্র। ১৯৩৯-সালে তার পিতা ড: সেনের ইউরোপ ভ্রমণের পরে উনি রোমানিয়ায় প্রকাশিত মির্চার লেখা 'লা নুই বেঙ্গলি' উপন্যাসটি সম্পর্কে জানতে পারেন। এ’ও জানতে পারেন, সেটি তাঁকেই উৎসর্গ করে লেখা হয়েছিল। ১৯৭২-সালের দিকে লেখকের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু কোলকাতায় এলে অমৃতা বুঝতে পারেন যে, বইটিতে তাদের দুজনের 'যৌন' সম্পর্কের বর্ণনা করা হয়েছে। ঐ বইতে মির্চা সহজাতভাবে লেখেন, তাদের প্রেমের এক পর্যায়ে প্রায়শ রাতে তার প্রেমিকা তার ঘরে চলে আসতো তথা তাদের মধ্যে স্থাপিত হতো শারীরিক সম্পর্ক। যদিও মির্চার বইয়ের উৎসর্গপত্রে অমৃতাকে লেখা ছিল "..... Tomar Ki moné acché? .... Yadi thaké, taholé Ki Kshama Karté Paro? ...." 'মির্চার এ বর্ণনা পরিপূর্ণ মিথ্যে' - এ সত্য প্রতিষ্ঠা করতেই পাল্টা আরেকটি বই লেখেন ভারতীয় নারী মৈত্রেয়ী দেবী বা অমৃতা। সে বইটিই হলো ‘ন হন্যতে’। বাংলা করলে ‘ন হন্যতে’-এর অর্থ দাঁড়ায়, "হত্যা করা যায় না" বা "নিহত হয় না" । মানবাত্মার আধার যে মানব-শরীর, তাকে হত্যা করা যায় কিন্তু আত্মাকে যায় না। উপন্যাসটিতে আসলে লেখিকা আত্মার অমরত্বের পাশাপাশি প্রেমের অমরত্বের কথাও বলেছেন। 

আরও দুজন রাশিয়ান সাহিত্যিক ছাত্রজীবনে আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। প্রথমজন ম্যাক্সিম গোর্কি -(১৮৬৮-১৯৩৬); "মা" উপন্যাসের জন্যে তিনি জগৎবিখ্যাত। যদিও মা ছেলের সম্পর্কই উপন্যাসটির মূলবিষয়, তবুও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্যে তৈরি হতে থাকা রাশিয়ার রাজনীতিক পরিস্থিতি বস্তুনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করার কারণে এই ঔপন্যাসিক বিশ্বসাহিত্যে বিশেষ স্থান পাবার দাবি রাখেন; যা তিনি ন্যায্যভাবেই পেয়েছেনও। "মা" উপন্যাসটির সামাজিক মূল্য এক কথায় তুলনাহীন। একটা উপন্যাস একটি জাতির বিবেককে ব্যাপকভাবে বদলে দিয়েছে, তুমুলভাবে আলোড়িত করেছে, এমন উদাহরণ বিশ্বসাহিত্যে বিরল। পেলাগেয়া নিলভনা নামের একজন অতিসাধারণ 'মেয়েমানুষ' কি করে সময়ের প্রয়োজনে আস্তে আস্তে রূপান্তরিত হন একজন রাজনীতিসচেতন 'ব্যক্তি'তে, বুঝতে শেখেন শ্রেণীনির্যাতন ও লিঙ্গগত অবস্থানের অসহায় শিকার হয়ে সারাজীবন কি ভাবে কাটিয়েছেন এর চমত্‍কার বর্ণনা করেছেন গোর্কি তাঁর দুর্দান্ত ভাষারীতিতে লেখা এই উপন্যাসটিতে। বুঝলাম কি ভাবে সমষ্টিগতভাবে বাস্তবায়িত হল অসংখ্য সাম্যবাদী যুবকের স্বপ্ন, পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র , সোভিয়েত ইউনিয়ন, অগণিত 'মা'য়ের আত্মত্যাগের বিনিময়ে। 

দ্বিতীয়জন ,ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কি, রুশ সাহিত্যের অনন্য আবেদন নিয়ে ম্যাক্সিম গোর্কি কিংবা লিও টলস্টয় যেমন আলো ছড়িয়েছিলেন বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গনে, ঠিক তেমনই ঔজ্জ্বল্য দস্তয়েভস্কির রচনায়। শৈশব কেটেছে অবর্ণনীয় দারিদ্র্যে। তাতেই বোধহয় দস্তয়েভস্কির লেখায় আজীবন ফুটেছে মেহনতি মানুষের অপ্রাপ্তির আকুতি। ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল থেকে পাস করতে না করতেই মহান এ সাহিত্যিক রচনা করলেন তাঁর প্রথম ছোট উপন্যাস ‘বেদনিয়ে লিউদি’, ইংরেজিতে যা 'পুয়র ফোক' নামে পরিচিত। বিশ্ব সাহিত্যের আরেক উজ্জ্বল জোতিষ্ক নিকোলাই গোগোল-এর ‘দ্য ওভারকোট’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রচিত এ উপন্যাসটির মূল চরিত্র মাকার দেভুশকিন নামের এক সামান্য কপিরাইটার। ১৮৪৬ সালে প্রকাশিত উপন্যাসটির কাহিনী রচিত হয়েছে মাকার ও তার বন্ধু/আত্মীয়া ভারভারা দোব্রোসেলোভার পত্রালাপ নিয়ে।নিজের লেখা দারিদ্র্য আর ভালোবাসার আঁটোসাটো সমঝোতার উপাখ্যান ‘পুয়র ফোক’-ই মাত্র ২৪ বছর বয়সে রীতিমতো খ্যাতিমান করে তুললো দস্তয়েভস্কিকে। 

১৮৪৯-এর এপ্রিলে নামলো দুর্যোগ। বিপ্লবী আর রাষ্ট্রবিরোধী হওয়ার দায়ে ওই সময়ের জার প্রথম নিকোলাস বন্দী করলেন লেখককে। দীর্ঘ পাঁচ বছর সাইবেরিয়ায় কারাগারে বন্দী থাকার পর ১৮৫৪ সালে মুক্তি পান ফিওদর দস্তয়েভস্কি। অবশ্য পুরোপুরি মুক্তি ঠিক বলা চলে না, পরের পাঁচ বছরের জন্য সাইবেরিয়ান রেজিমেন্টের সপ্তম ব্যাটেলিয়নে লেফটেনন্ট হিসেবে কাজ করতে হয়।এসব ঘটনাপ্রবাহ বিপুল পরিবর্তন আনে লেখকের চিন্তাধারায়। একই সঙ্গে শারীরিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হন কালজয়ী এই সাহিত্যিক। ১৮৬৬ সালে দস্তয়েভস্কি লিখলেন তাঁর বিশ্বজয়ী উপন্যাস ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’। পারিপার্শ্বিক সমাজ আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের গণ্ডি পেরিয়ে জন্ম নেয় উপন্যাসের মূল চরিত্র রোদিওন রোমানোভিচ রাস্কোলনিকভ। পুঁজিবাদী সমাজের দুষ্ট চরিত্রগুলোকে শাস্তি দিয়ে রাস্কোলনিকভ ডাক দিলেন সমাজ পরিবর্তনের জোয়ারকে। ‘দুষ্টের দমনে হত্যা’ নীতিতে কল্পিত এ চরিত্র হয়ে উঠলো নতুন নেপোলিয়ন। ১৮৭৯ সালে প্রকাশিত হয় সাহিত্যের মহানায়ক দস্তয়েভস্কির ‘ব্রাদার্স কারামাজোভ’। এটি তাঁর শেষ উপন্যাস। আজীবন দারিদ্র্য আর বাস্তবতার কষাঘাতে জর্জরিত দস্তেয়েভস্কির এ রচনায় লেখা হলো দর্শনের কিছু গূঢ় তত্ত্ব। অনেকের মতে, ব্রাদার্স কারামাজোভ-এর দর্শন দস্তয়েভস্কিকে আজীবনের মতো স্থান করে দিলো সিগমুন্ড ফ্রয়েড, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন আর পোপ পঞ্চদশ বেনেডিক্টের মতো দার্শনিকদের পাশে। 

নতুন ধরণের নাটক এবং ভিন্ন রকমের সাহিত্যের সংস্পর্শে এসে শুরু হল আমার কিশোর মনে তীব্র দ্বন্দ্ব। যা কিছু পড়েছি, জেনেছি, শুনেছি এবং শিখেছি এতদিন তা কি তবে ঠিক ছিল না? যে সাহিত্য, নাটক, গান সংগ্রামের সহায়ক নয়, বিপ্লবের জয়গান নয় সে সব কি অপসংস্কৃতি? এত দিনের অর্জিত শিক্ষা, ধ্যানধারণা, পঠনপাঠন, বেঁচে থাকার অভ্যেস সবই কি ভুল? গুলিয়ে গেল সুস্থ সাহিত্য এবং সংস্কৃতির সংজ্ঞা। 

১১ নং হোস্টেলের প্রোগ্রাম হচ্ছে ইনস্টিটিউট হলে। সমীর আর তপন অভিনয় করলো 'আদাব'। হিন্দু মুসলমান রায়টের সময় এক বিপন্ন হিন্দু এবং সমানভাবে বিপন্ন এক মুসলমানের একাত্মতার ওপর আধারিত এই নাটক। এর পরে গান গাইতে এল এক বন্ধু । বেশ কয়েকটি ফিল্মী গানের পর শুভেন্দু এসে বলল এসব সহ্য করা যায় না। এই অপসংস্কৃতি এখুনি বন্ধ হওয়া উচিত । আমি আর শুভেন্দু স্টেজে উঠে সংগঠকদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে গান বন্ধ করে দিলাম। উপস্থিত ছাত্র এবং অধ্যাপকেরা ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়ে। আমাদের আচরণ কিছুটা অসংলগ্ন বলেই ভেবেছিলেন সবাই। যাই হোক এর পরে গান গাইতে উঠে সমস্ত সভাগৃহ স্তব্ধ করে দিয়েছিল প্রলয়। শুভেন্দু আজ নেই। ওর কথা খুব মনে পড়ে। 

আজ পরিণত বয়সে এসে সুস্থ সাহিত্য এবং সংস্কৃতির সংজ্ঞা আমার কাছে অনেক পরিষ্কার । অন্তত এটুকু বুঝতে পারি কোন সাহিত্য বা সংস্কৃতি আমাদের সঠিক পথের সন্ধান দেবে আর কোনটা আমাদের পিছনের দিকে ঠেলে দেবে। কোনটা প্রাসঙ্গিক আর কোনটা চিরায়ত তাও বুঝতে পারি এখন। আগে ভাবতাম যে সাহিত্য বা নাটক বা গান আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার , প্রতিদিনের লড়াই এর কথা বলে তাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য। আজ মনে হয় অন্যায়, অবিচার, অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতি সাহিত্য ও সংস্কৃতির দায়বদ্ধতা যেমন অনস্বীকার্য তেমনি মানুষের অন্তর্নিহিত সুকুমার অনুভূতিগুলিকে জাগ্রত করা, সত্য ও সুন্দরের প্রতি মানুষকে আকর্ষণ করা এবং জাতি ধর্ম বর্ণ শ্রেণী নির্বিশেষে মনুষ্যত্বের জয় ঘোষণার দায়বদ্ধতাও সুস্থ সাহিত্য ও সংস্কৃতির কাছে অবশ্যই কাম্য। কেবল জীবন সংগ্রাম নয়, সব যুদ্ধের শেষে পরম আকাঙ্খিত শান্তি ও সাম্যের চিত্র তুলে ধরাও সুস্থ সাহিত্য সংস্কৃতির ধর্ম হওয়া উচিত। আমরা চাই সংগ্রাম ও তার বেদনা ক্ষণস্থায়ী হোক। শান্তি ও সাম্যের লক্ষ্যে যে যুদ্ধ তা যেন দ্রুত শেষ হয়। অর্জিত শান্তি আর সাম্যই হোক চিরায়ত সাহিত্য সংস্কৃতির মুখ্য উপজীব্য। 

7 comments:

0

প্রবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in


প্রবন্ধ


কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে নিয়ে দুটি কথা
রঞ্জন রায়



না; আমি আধুনিক কবিতা বা চিত্রকলা বুঝি এমন অপবাদ আমার অতি বড় শত্তুরেও দেবে না। তবে সব বঙ্গসন্তানই বড় হয় ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ আর ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ শুনে এবং গোঁফের রেখা দেখা দিতেই লুকিয়ে লুকিয়ে পদ্য লেখে, পাশের বাড়ির রাইকিশোরীর প্রেমে পড়ে। আমিও কোনও ব্যতিক্রম নই।

আমারও অভ্যেস ছিল রবীন্দ্রনাথের কিছু পদ্য ও জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ থেকে কিছু লাইন চুরি করে চিঠির মধ্যে গুঁজে দেয়ার।

কিন্তু এঁদের পরের কবিরা? সত্যিই বুঝতে পারি নি। মানে, কীরকম যেন লেগেছে — ক্যালকুলাসের অংকের মত। তবে সব নিয়মেরই ব্যতিক্রম আছে। প্রথম যৌবনে যে দু’এক জনের কবিতা ভাল লেগেছিল, নীরেন্দ্রনাথ তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। 

কেন ভাল লেগেছিল? বুঝতে পারতাম বলে। ভুল বললাম, কবিতা তো বুঝবার জন্যে নয় — বাজবার জন্যে। হ্যাঁ, ওঁর কবিতায় বুকের মধ্যে কিছু একটা বেজে উঠত। শব্দের মায়া ছাড়িয়ে মনে হত ওরা আমার কথা বলছে। আমার কথা? না, শুধু আমার কথা নয়; আমাদের কথা। মানে, ষাটের দশকের শেষের থেকে সত্তরের গোড়ার দিকে রুক্ষচুলে হাওয়াই চটি পায়ে কলকাতা চষে বেড়ানো ছেলেগুলোর কথা। ঠিক তা ও না; গুছিয়ে বললে তাদের চোখে দেখা কলকাতার কথা। 

একটু একটু করে নীরেন্দ্রনাথের কবিতা সেই সময়ের কলকাতার চালচিত্র হয়ে উঠলো।

সেই কলকাতায় বড় বড় শপিং মল ছিল না, ফ্লাই ওভার ছিল না। ঝাঁ-চকচকে গাড়ি, আইনক্সে সিনেমা দেখা – কিছুই ছিল না। আর চাকরিও ছিল না। ভিড় ছিল, ট্রামে বাসে বাদুড়ঝোলা হওয়া, ঘামের টকগন্ধে অভ্যস্ত হওয়া বিধি ছিল। আমরা ছিলাম দিশাহীন। আমরা ছিলাম উচ্ছন্নে যাওয়া। কিন্তু আমরা ভালবাসতাম। কেরিয়ারকে নয়, নারীকে—আসলে কলকাতাকে। সেখানে আমাদের জন্যে ‘বর্তমান মুক্তকচ্ছ, ভবিষ্যত হোঁচটেতে ভরা’।

সেই কলকাতা ধরা পড়ল নীরেন্দ্রনাথের কবিতায়। আমাদের যত ব্যর্থতা, আমাদের যত অভিমান আর হতাশা, সব বেঁচে উঠল, তবে উচ্চকিত নয়, শ্লোগান মুখর মুষ্টিবদ্ধ হাতের উত্তোলনে নয়; বরং সেতারের আলাপের মত আন্তরিক মৃদু আলাপনে।

আমাদের তখন সেই বয়েস, যা নিয়ে পুর্ণেন্দু পত্রী লিখে গেছেন — ‘ফুলের গন্ধ নেবার জন্যে, নারীর স্পর্শ পাবার জন্যে, ঘুমের মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে আমরা যখন যুবক হলাম’। 

এই কবিতাটি দেখুনঃ কলকাতার যীশু; একহিসেবে নীরেন্দ্রনাথের সিগনেচার কবিতা।

“লালবাতির নিষেধ ছিল না,
তবুও ঝড়ের-বেগে-ধাবমান কলকাতা শহর
অতর্কিতে থেমে গেল।
ভয়ংকর ভাবে টাল সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল
ট্যাক্সি ও প্রাইভেট, টেম্পো, বাঘমার্কা ডবল ডেকার
‘গেল-গেল’ আর্তনাদে রাস্তার দুদিক থেকে 
যারা ছুটে এসেছিল—
ঝাঁকামুটে, ফেরিওয়ালা, দোকানি ও খরিদ্দার-
এখন তারাও যেন শিল্পীর ইজেলে স্থিরচিত্রটির মত
লগ্ন হয়ে আছে।
স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে,
টালমাটাল পায়ে
রাস্তার এক-পার থেকে অন্য-পারে হেঁটে চলে যায়
সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক শিশু।
খানিক আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে চৌরঙ্গীপাড়ায়।
এখন রোদ্দূর ফের অতিদীর্ঘ বল্লমের মত
মেঘের হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে 
নেমে আসছে;
মায়াবী আলোয় ভাসছে কলকাতা শহর।

স্টেটবাসের জানলায় মুখ রেখে 
একবার আকাশ দেখি, একবার তোমাকে।
ভিখারী মায়ের শিশু,
কলকাতার যীশু,
সমস্ত ট্র্যাফিক তুমি মন্ত্রবলে থামিয়ে দিয়েছ।
জনতার আর্তনাদ, অসহিষ্ণু ড্রাইভারের দাঁতের ঘষটানি
কিছুতে ভ্রূক্ষেপ নেই;
দু-দিকে উদ্যত মৃত্যু, তুমি তার মাঝখান দিয়ে
টলতে টলতে হেঁটে যাও।
যেন মূর্ত মানবতা, সদ্য হাঁটতে শেখার আনন্দে
সমগ্র বিশ্বকে তুমি পেতে চাও হাতের মুঠোয়।
যেন তাই টালমাটাল পায়ে তুমি
পৃথিবীর এক-কিনার থেকে অন্য কিনারে চলেছ।।

দেখতেই পাচ্ছেন, কীভাবে কবিতাটি সেই সময়ের কলকাতার দৈনন্দিন একটি ঘটনার থেকে শুরু হয়ে এক মহত্তর আবেদনে পৌঁছে গেল।

১৯৬৯ সালে দু’টি শারদীয় সংখ্যায় উনি দু’টি কবিতা লেখেন — একটি উল্লিখিত ‘কলকাতার যীশু’, অন্যটি ‘চতুর্থ সন্তান’।

পরেরটির প্রেক্ষিত নিয়ে দুটো কথা বলি।

আমার প্রজন্মের লোকজনের মনে পড়বে, অর্ধশতাব্দী আগে সরকারী পরিবার পরিকল্পনা প্রোগ্রামের গোড়ার দিকে শ্লোগানগুলি একটু অন্যরকম ছিল। প্রথমে এল ‘দো ইয়া তিন, ব্যস’; তারপরে এল ‘ হম দো, হমারে দো’। শেষে ‘অগলা বচ্চা অভী নহী, দো কে বাদ কভী নহী’।

তো নীরেন্দ্রনাথের কবিতাটি সেই ‘তিন পর্য্যন্ত’ ফরমানের দিনে লেখা। তাতে দেখি-- কোনও পরিবারে জন্মানো অবাঞ্ছিত ‘চতুর্থ সন্তান’ অভিমানে মুখ ফিরিয়ে বসে।

নীরেন্দ্রনাথের সংবেদনশীল কবিমন বলে ওঠে ‘কে তোমাকে চায়!’

কবিতাটির শেষে ওঁর কলমে ফুটে ওঠে প্রাজ্ঞ ঋষির অমোঘ সত্যবচনের মত এই স্টেটমেন্ট — যে পৃথিবী ওই চতুর্থ সন্তানকে তার ইচ্ছের তোয়াক্কা না করে জন্ম দিয়ে এখন দূর-ছাই করছে, কাল সে অভিমানে প্রতিশোধ নিতে এই পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে।

চমকে উঠে টের পাই ওই শিশুটি তো আমি বা আমরা! 

আমরা যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই; আমরা, যাদের চাকরি নেই, পরিবারে ও পাড়ায় সম্মান নেই। আমরাই তো এক অর্থে শহর কলকাতার চতুর্থ সন্তান। আমাদের মধ্যে রয়েছে নিজেকে ধ্বংস করার প্রবণতা।

উনি চমকে দিলেন আবার—সত্তরের গোড়ায়। আনন্দবাজারের রবিবারের সাময়িকীতে লিখলেন ‘কবিতার কথা’ ধারাবাহিক, ‘কবিকঙ্কণ’ পেন-নেম নিয়ে।

প্রথমে অভিজ্ঞ মাস্টারমশাইয়ের মত ধৈর্য ধরে আমাদের বোঝালেন কবিতা কাকে বলে। অর্থাৎ, কী কী থাকলে একটি লেখা কবিতা হয়ে ওঠে। আবার সেগুলো না থাকলে শুধু মাত্রা গুণে ছন্দ মিলিয়ে অন্ত্যমিল দিয়ে লিখলেও সেটা কবিতা হয় না। উদাহরণ দিলেনঃ

সূর্য ব্যাটা বুর্জোয়াটা
দুর্যোধনের ভাই।
গর্জনে তার তূর্য বাজে
তর্জনে ভয় পাই।।

তবে বই হয়ে বেরোনোর পর বেস্ট সেলার হওয়া এই বইটি নামে ‘কবিতার কথা’ হলেও আসলে ছন্দের কথা-- বাংলা ছন্দের। এখানে আমরা পেলাম ছান্দসিক নীরেদ্রনাথকে।

এই লেখাগুলোর মাঝে প্রখ্যাত ছান্দসিক প্রবোধ চন্দ্র বাগচীর সঙ্গে ওঁর বিতর্ক, থুড়ি... মত বিনিময়, আমাদের মত হরিদাস পালেদের জন্য এক অতীব স্বাদু ও অবশ্য শিক্ষণীয় পাঠ হয়ে গেল। 

আমরা জানলাম – বাংলা ছন্দ মূলত তিনরকমের; অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও মাত্রবৃত্ত। এসব তো স্কুলে কেউ শেখায় নি! উনি এগুলোকে চেনার এবং মাত্রা গোণার পদ্ধতি দেখালেন; এবং বাংলা ছড়ার ছন্দটিও বাদ গেল না — ‘যোমনাবতী সরস্বতী কাল যোমনার বে’।

কবিতার ক্লাসের মাঝে মাঝে পেতাম বিশুদ্ধ হাস্যরসের চৌপদী।

‘ছন্দের গুঁতো খেয়ে পোড়োদের হায়,
চোখ থেকে অবিরল অশ্রু গড়ায়।
কহে কবিকঙ্কণ কান্না থামাও,
ক্লাস থেকে মানে মানে চম্পট দাও।।

নীরেন্দ্রনাথ পরবর্তী কবিতাগুলোতে আরও মিতবাক হলেন। অসহ্য দমবন্ধ সত্তরের দিনের বর্ণনায় লিখলেন—‘ দু’পায়ে ঢুকলে মনে হয় চারপায়ে বেরিয়ে যাই’।

এমন সময় এল বাংলা বানান সংস্কারের আন্দোলন। সংস্কৃতের অন্ধ নকলনবিশী ছেড়ে বাংলা বানান মুখের কথার কাছাকাছি আসতে চাইল। অনেক অপ্রয়োজনীয় মেদ ঝরিয়ে ফেলে তন্বী হল। অনেক র-ফলার পরের যুক্তাক্ষরকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় করা হল। অনেক বিতর্ক কমিটি, অনেক ‘পাত্রাধার কি তৈল , নাকি তৈলাধার কি পাত্র’ গোছের নব্যন্যায় শুরু হল। আমরা এ ওর মুখের দিকে তাকাই, বুঝভম্বুল হয়ে দু’দিকেই মাথা নাড়ি।

নীরেন্দ্রনাথ কলম ধরলেন; লিখলেন---‘বাংলাঃ- কী লিখবেন, কেন লিখবেন’।

ব্যস, আমরা হৈ হৈ করে উঠলাম। আধুনিক বাংলা লেখার চেষ্টায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলা অনেকের কাছেই বইটির স্থান বাইবেলের পরেই।

খবর ছড়িয়ে পড়ল। উনি নেই। কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। বয়স, স্ত্রীবিয়োগ—আর যেন টানতে পারছিলেন না।

তবু সকালবেলা বাঙ্গুর এভিনিউয়ের বি-ব্লকে আমার কাকিমার একতলার বারান্দায় মোড়া পেতে বসলে মনে হয় একটু পরেই দেখতে পাব দীর্ঘদেহী ছিপছিপে পাকাচুলের এক ভদ্রলোককে, ধুতি-পাঞ্জাবী পরে বাজারের থলি হাতে হেঁটে যাচ্ছেন — আদ্যন্ত সুভদ্র নম্রকণ্ঠ এক সংবেদনশীল বাঙালী কবি।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


সংস্কৃতি, সভ্যতা ও হিংসা
অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় 




আজ থেকে প্রায় সাড়ে ছ’ দশক আগের কথা। আমাদের পুরনো বাড়িতে দুর্গা পুজোর সময় পাড়ায় ক’ঘর তাঁতি বাড়ি থেকে বরণের ‘শ্রী’ গড়ে দিত। তারা কিন্তু ঠাকুর দালানে উঠত না। পুরোহিতের মানা ছিল। আমার ঠাকুমা ছিল সেই পুজোর সর্বেসর্বা। পুজোর গোছগাছ থেকে শুরু করে ভোগ রান্না, সবই ঠাকুমা করত। সেই বছর অষ্টমীর দিন পুজো শুরু হবার আগে যখন তাঁতি বাড়ির মেজ বৌ ‘শ্রী’ গড়ে নিয়ে এসে ঠাকুমার হাতে দেয়, তখন ঠাকুমা তার হাত ধরে ঠাকুরের সামনে নিয়ে এসে বলে, “মেজ, আজ তুই বরণডালা সাজাবি”। ঠাকুরমশাই হাঁ হাঁ করে উঠতেই ঠাকুমা তাকে বলে, “আজ থেকে সবাই এখানেই এসে অঞ্জলি দেবে, এই আমার বিধান। এতে যদি তোমার অসুবিধে থাকে, তুমি যেতে পার।”

না, কুলপুরোহিত যায় নি। ঠাকুমার কথা মেনে নিয়েছিল। আর পাড়ায় মেজদি, মানে আমার ঠাকুমা, সে সময়ে হিরো। সেই থেকে পুজোয় আর কোন বর্ণভেদ থাকল না। আমার তখন দশও পেরোয় নি। ঠাকুমা বলেছিল, এসবের কোন মানে নেই; কোনও মানুষকে ছোট করলে নিজেকেই ছোট হয়ে যেতে হয়। ধর্ম যে সংস্কৃতি শেখায়, তা হল সবাই মিলেমিশে থাকতে। আর এই সংস্কৃতিই সভ্যতা। তখন এসব কিছু বুঝিনি। অনেক পরে শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে যখন ধর্ম, সংস্কৃতি ও সভ্যতার উদ্ভব ও বিবর্তনের ইতিহাস জানলাম, তখন অনুভব করলাম এত বৈজ্ঞানিক তথ্য পড়ে আমি যা শিখলাম, একজন ক্লাস সেভেন অবধি পড়া মহিলা ভরা যৌবনে বিধবা হয়ে অক্লান্ত জীবনযুদ্ধে যুঝতে যুঝতে ছ’টা ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে কত সহজে জীবন দিয়ে তা আয়ত্ত করেছে। ভাবতে অবাক হয়ে যেতে হয়, বিংশ শতাব্দীর মধ্যলগ্নে কলকাতা শহরের প্রান্তিক আধা গ্রাম্য পরিবেশে বাস করে ঠাকুমা কী করে এত অফুরন্ত শক্তি ও আত্মমর্যাদা অর্জন করে সমাজের মাথাদের অসামাজিক বিধানের বিরুদ্ধে গিয়ে যুক্তি দিয়ে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। আজ যখন ধর্ম ও সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে সভ্যতা এক সংকটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন মনে হয় স্বার্থহীন শুভবুদ্ধি মানুষ সত্যিই এক বিপন্ন প্রজাতি। 

যাতে ধারণ করে, তাই ধর্ম। সে ব্রহ্মাণ্ডই হোক আর জড় বা প্রাণীই হোক, সবারই একটা ধর্ম রয়েছে। সব কিছু একটা সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে দিয়ে চলেছে। সে অণু-পরমাণু বা ইলেকট্রন হোক অথবা আস্ত একটা মানুষ। একটা নির্দিষ্ট আবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছে সব। এই আবর্তনটাই ধর্ম। উপযুক্ত পরিবেশে একটা ধর্ম থেকে বিবর্তিত হয়ে আর একটা ধর্মে গিয়ে যখন পড়ে, তখন হয় নতুনের সৃষ্টি। নতুন নবধর্মে উদ্ভাসিত। এভাবেই এগিয়ে চলেছে সব। বিবর্তনের হাত ধরে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর থেকে আমাদের সৌরজগৎ ও পৃথিবী। আবার বিবর্তনের হাত ধরেই নিউক্লীক অ্যাসিড থেকে অ্যামিবা বা এক কোষী প্রাণী থেকে মানুষ। প্রত্যেকটা প্রাণী তার নিজস্ব ধর্মের মধ্যে বেঁচে থাকে। এই ধর্মটা কি? উপযুক্ত পরিবেশ ও খাদ্য। এটা থাকলেই ওরা আছে, না থাকলে নেই। তবে এত সহজে থাকা যায় না। প্রতিটা মুহূর্তে জীবনযুদ্ধে লড়াই করে বাঁচতে হয় প্রতিটা প্রাণীকে। আর যারা না পারল, বিশেষ করে কোনও কারণে পরিবর্তিত পরিবেশে, তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। পরিবর্তিত পরিবেশে কি করে বাঁচবে? নিজেকে বদলে ফেলে, স্বভাব ও খাদ্যাভাস পাল্টে। এর ফলে জিনে পরিবর্তন হয় আর প্রাণীটির বিবর্তন হয়ে নতুন প্রজাতি বা গণ জন্ম নেয়। তারপর নতুন ধর্মে নতুন প্রাণী লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। এই নতুন প্রাণীটির মধ্যে কিন্তু আগের প্রাণীর জিন রয়ে গেছে, যার ফলে তার অনেক গাঠনিক চরিত্র শরীরে বর্তমান। এভাবে দেখলে দেখা যাবে মানুষের মধ্যে রয়েছে সেই আদিম অ্যামিবার জিন এবং তার পরবর্তী সব প্রাণীর জিন। আশ্চর্যের বিষয়, মানুষের নিজস্ব জিন বা ডি এন এ-র আনুপাতিক হার খুবই কম। প্রায় সব কিছুই পূর্ববর্তী কোনও না কোনও প্রাণীর থেকে চলে এসেছে। 

দু-একটা ছোট উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। যে মেরুদণ্ডের ওপর ভর দিয়ে আমরা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, প্রাণীজগতে তার আবির্ভাব প্রায় পঞ্চাশ কোটি বছর আগে। আমরা মুখে খাবার দিয়ে চিবাই, তার জন্য আমরা চোয়াল ব্যবহার করি। কেবলমাত্র নিচের চোয়াল ওপর-নীচ ওঠানামা করে। প্রাথমিক চোয়ালের উদ্ভব হয় মাছে প্রায় বিয়াল্লিশ কোটি বছর আগে। কিন্তু এর পাঁচ কোটি বছর পরে যে মাছ বিবর্তন হয়ে এল, তার চোয়াল শক্ত এবং নিচের চোয়াল নাড়িয়ে খাবার খেত, দাঁতও ছিল কামড়াবার ও ছেঁড়বার জন্য। নিচের চোয়াল নাড়িয়ে খাওয়া ও দাঁত দিয়ে কামড় বা ছেঁড়ার পদ্ধতি পরবর্তী সব উন্নত মেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে দেখা গেছে। মানুষের তো বটেই। জলে থাকার ফলে জল থেকে অক্সিজেন নিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া চালানোর জন্যে মাছেদের কানকো তৈরি এবং খাদ্যের জন্যে জলে চলাচল করতে তাদের শক্ত মাংসপেশির পাখনার উদ্ভব। একসময় সমুদ্রের জলের মাত্রা নেমে গেলে মাছ সমেত অন্য তীরবর্তী জলজ প্রাণীদের খাদ্যাভাব দেখা দেয়। সে সময় তাদের ডাঙায় পোকা খাবার জন্যে আসতে হত। তখন বাতাস থেকে অক্সিজেন নেবার জন্য তৈরি হোল ফুসফুস। একই প্রাণীর কানকো ও ফুসফুস নিয়ে উভচর প্রাণীর জন্ম হোল। এভাবে প্রয়োজনের তাগিদে পরিবর্তন ও সেই থেকে বিবর্তিত হতে হতে মানুষ তার পূর্বসূরীর অনেক কিছুই শরীরে বহন করছে। প্রাণী বিবর্তনের ইতিহাসে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা উন্নত মানের বলে ধরা হয়। মাতৃস্তন থেকে নির্গত দুধ সন্তান পান করে বলে স্তন্যপায়ী। এদের প্রজনন প্রক্রিয়ার বিবর্তন ঘটেছে সময়ের সাথে। তিন ধরনের প্রজনন দেখা যায়। প্রাথমিক কালে ডিম পেড়ে সন্তান আনার পর তাকে দুধ খাওয়াত। অস্ট্রেলিয়া, নিউ গিনিতে আজও এই গোষ্ঠীর শজারু ও প্ল্যাটিপাস বর্তমান। দ্বিতীয় পর্যায়ে সন্তান গর্ভে জন্মালেও খুব প্রাথমিক অবস্থায় প্রসব হয় এবং মায়ের পেটের নিচে একটা থলিতে বাড়তে থাকে। ক্যাঙ্গারু, কোয়ালা এই গোষ্ঠীভুক্ত। সবশেষ ধাপে সন্তানের বৃদ্ধি মায়ের গর্ভে সম্পূর্ণ হলে প্রসব হয়। যেমন বেড়াল, গরু, মানুষ। স্তন্যপায়ীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রাইমেট এবং উন্নত প্রাইমেটের স্তনের অবস্থান পেটের নিচ থেকে সরে বুকে এসেছে বসা অবস্থায় সন্তানদের দুধ খাওয়ানোর সুবিধের জন্যে। 

ধর্ম প্রাণীকে বাঁচার জন্যে ধারণ করছে, সেই প্রাণী যখন তার পরবর্তী প্রজন্ম বা প্রজাতি বা বর্ণে তার ধর্ম চারিয়ে দেয়, তখন সেটা হয়ে যায় সংস্কৃতি। বাঁচার ধর্ম সমবেত কাজে পরিণত হলে সেটা সংস্কৃতি। ফলে প্রতিটা প্রাণীর যেমন ধর্ম আছে, তেমন প্রত্যেক প্রাণীগোষ্ঠীর আছে তার নিজস্ব সংস্কৃতি। খাদ্যের প্রয়োজনে অনেক প্রাণীকেই একসাথে থাকতে দেখা যায়, যেমন মাছের ঝাঁক। আবার শিশুদের রক্ষার জন্য উন্নত স্তন্যপায়ী প্রাণীরা সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে থাকে, যেমন হাতি। এটা সংস্কৃতি। বাঁচার প্রয়োজনে যার শুরু সেটা ক্রমে সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। প্রাইমেটদের ক্ষেত্রে এই গোষ্ঠীবদ্ধভাবে থাকা উন্নত ধরনের। আবার খাদ্যের জন্য শিকার করাটাও সংস্কৃতি। মাটিতে হিংস্র প্রাণীদের থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য বানরদের বৃক্ষবাসী হওয়া আর গাছের ফল তখন তাদের খাবার হয়ে যাওয়া। সে সময়ে অনুকূল আবহাওয়ায় গাছের প্রাচুর্য ছিল। পরে আবহাওয়া পরিবর্তনে গাছের ঘনত্ব কমে যাওয়ায় প্রাইমেটদের পরবর্তী প্রজন্মরা মাটিতে নামে ও চতুষ্পদী থেকে বিবর্তিত হয়ে দ্বিপদী হয়। গাছে থাকা সুবিধেজনক ও নিরাপদ করার জন্য বানরদের অনেক শারীরিক পরিবর্তন হয়। যেমন, গাছের ডাল ধরে ঝোলার জন্য হাতের বুড়ো আঙুলের অবস্থান বদলে অন্য চারটে আঙুলের বিপরীতে এসে গ্রিপ তৈরিতে সুবিধে করে। লম্বা শুণ্ড ছোট হয়ে যায় ও নাকের দুপাশে থাকা চোখ সামনে চলে এসে স্টিরিও দৃষ্টি তৈরি হয়, যার ফলে সঠিক দূরত্ব ও উঁচু-নিচুর আন্দাজ অনুমান করতে সক্ষম হয়। এর জন্যে এক ডাল থেকে অন্য ডালে ঝাঁপ দিয়ে যেতে আর দুর্ঘটনা ঘটে না। চোখে রেটিনার পেছনে দণ্ড ও শঙ্কু পেশি উদ্ভাবনের ফলে বানররা তিনটে রঙ আলাদা করে চিনতে শিখল। খাবার জন্যে ফল চিনে নিতে আর অসুবিধে রইল না। আদি বানর থেকে বিবর্তন হয়ে পরের প্রাণীদের শিরদাঁড়া ক্রমে ছোট হতে হতে লেজহীন ও ভার বহন করার মত শক্ত হয়েছে। তারপরেই গিবন শিম্পাঞ্জীরা দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পেরেছে। প্রাইমেটদের মাথা শিরদাঁড়ার ওপর অবস্থান করে। স্নায়ুর শিরাগুলো একটা মহাবিবরের ভেতর দিয়ে মস্তিষ্কের কেন্দ্রীয় অবস্থানে পৌঁছেছে, যার ফলে মাথা ঘাড়ের ওপর সোজা থাকে। এটা সোজা হয়ে বসতে বা দাঁড়াতে সহায়ক। প্রাক-প্রাইমেট স্তন্যপায়ীদের মহাবিবরের অবস্থান মাথার পেছনে ছিল এবং তারা ছিল প্রধানত ঘ্রান নির্ভরশীল। বানরদের থেকে প্রাইমেটরা দৃষ্টি-নির্ভর হয়ে গেল, ঘ্রান শক্তি ক্রমশ হ্রাস পেল। দৃষ্টি অনেক বেশি তথ্য আহরণ ও সঞ্চয় করে বলে মস্তিষ্কে আর তার জন্য জায়গার পরিমাণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফলে মস্তিষ্কের আয়তন পরবর্তী প্রজাতি ও বর্ণে বাড়তে বাড়তে মানুষে এসে থামে। শিম্পাঞ্জির ৪০০ ঘন সেন্টিমিটার থেকে ক্রমোন্নতি হতে হতে মানুষের ১৩৫০ ঘন সেন্টিমিটারে এসে ঠেকেছে। জটিল স্নায়ুতন্ত্র তার নিজের কাজের প্রয়োজনে বাড়িয়ে দিয়েছে মস্তিষ্কের আয়তন। এরকম অনেক গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক পরিবর্তন প্রাণীদের ক্রমে ক্রমে ব্যবহারিক, সামাজিক শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রসার ও বিবর্তনে সাহায্য করেছে। এর থেকে উদ্ভব হয়েছে প্রযুক্তি আবিষ্কার, যুক্তি ও বিচার প্রসারণ।

প্রাইমেটদের সেরা মানব, আর মানবের সেরা মানুষ। তাই প্রাণীদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ। এই সেরার শিরোপা ক্রমে ক্রমে উন্নত প্রাণীর মাথায় চাপছে, তার কারণ ক্রমোন্নত সংস্কৃতি ও সামাজিক শিক্ষা। এক এক ধাপে সংস্কৃতির পরিবর্তন প্রাণীকে আরও আরও উন্নত করেছে। আর এটা পরিণতি পেয়েছে মানুষে। আজ মানুষের সংস্কৃতি যেখানে দাঁড়িয়ে, তার পেছনে সমগ্র প্রাণী জগতের অবদান। একমাত্র ভয়াবহ হিংসা ছাড়া। 

শিম্পাঞ্জি, গিবন, ওরাং ওটাং-দের পেরিয়ে এল অস্ট্রালোপিথেকাস। অনেক বিজ্ঞানীর অনুমান তারা পাথর ছুঁড়ে হিংস্র প্রাণীদের ভয় দেখাত বা ছোট প্রাণী মারত। তার মানে আত্মরক্ষার জন্য বা শিকারের জন্য পাথর ব্যবহার করা যায়, মাটি নয়, সেই প্রযুক্তিগত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান চল্লিশ লক্ষ বছর আগে তারা জেনেছিল অথবা পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করে দেখেছে পাথর অনেক ভারী এবং ছুঁড়লে অনেক বেশি দূর অবধি যায়। এখান থেকেই প্রযুক্তিগত সংস্কৃতির শুরু। এখান থেকেই সংস্কৃতি সভ্যতার স্তরে উন্নীত। এই উন্নত ধারণা নিয়েই ছাব্বিশ লক্ষ বছর আগে মানব গণের প্রথম প্রজাতি হোমো হ্যাবিলিসের আবির্ভাব পূর্ব আফ্রিকায়। এবার তারা পাথরকে পাথর দিয়ে ভেঙে ছুলে চেঁচে ঘসে অস্ত্র বানাল। শুরু হোল প্রস্তর যুগ। শুরু হোল অস্ত্র সংস্কৃতি। আত্মরক্ষা ও শিকার, উভয় কাজেই ব্যবহার হতে লাগল এই অস্ত্র। এই অস্ত্র তৈরি করতে আনুসঙ্গিক শারীরিক পরিবর্তন বিবর্তিত হয়েছে পরবর্তী প্রজন্মগুলোতে ও অবশ্যই পরবর্তী প্রজাতিতে। যেমন হাতের দুটো হাড় আর কব্জির হাড় শক্ত ভাবে জোড় লেগে কব্জির জোর বেড়ে গেল। এরপর পরবর্তী মানব প্রজাতি আরও উন্নত পাথুরে অস্ত্র তৈরি করেছে। আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে গেছে, প্রয়োজনানুসার নতুন পাথরে নতুন অস্ত্র তৈরি করে সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। পঞ্চাশ হাজার বছর আগে মানব নিয়েনডারথাল ছুরি, ব্লেড ইত্যাদি ধারালো অস্ত্র তৈরি করেছে। সাধারণ একঘেয়ে প্রযুক্তি ও তার উপকরণ অভ্যাস ছেড়ে মানব ক্রমশ জটিল প্রযুক্তি উদ্ভাবনে প্রবৃত্ত হয় সেই সময় থেকেই। এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে মানুষের মধ্যে। সংস্কৃতিতে প্রাথমিক পরিবর্তন দেখা যায় কিছু ক্রিয়া-কলাপের ভেতর, যেমন মৃত শরীর কবর দেওয়া, পশুর লোমশ চামড়া দিয়ে দেহ আবরণ, ফাঁদ পেতে অথবা উঁচু টিলা থেকে তাড়িয়ে নিচে নামিয়ে পশু শিকারের মত বুদ্ধিদীপ্ত কাজ, পাথর ও হাড়ের গয়না ও মূর্তি বানানো, গুহায় পাথরের গায়ে ছবি আঁকা এবং বিনিময় প্রথায় বাণিজ্য। 

আর এক মানব হোমো ইরেকটাস বিশ্বপরিক্রমায় বেরিয়ে পড়ে। নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশ ও বিচিত্র আবহাওয়া তাদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে। এই সময়ে তাদের সংস্কৃতিতে নতুন সংযোজন ঘটেছে। আত্মরক্ষার স্বার্থে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে থাকার সুবিধে তারা বুঝেছিল। শিশুদের মায়ের কাছে রেখে পুরুষেরা শিকারে যেত। বিপদের সময় বিভিন্ন সঙ্কেতবাহী আওয়াজ করতে শিখল। নিঃশ্বাসকে নিয়ন্ত্রন করে ভিন্ন প্রয়োজনে ভিন্ন সঙ্কেতবাহী আওয়াজ করার এই প্রথা স্বরযন্ত্রের আদি সূত্র। হিংস্র পশুদের থেকে বাঁচতে তারা জঙ্গলের প্রান্তে থাকা শুরু করে। জঙ্গলে আগুন লাগা দেখে প্রথমে দূরে পালাত। আগুন কমে গেলে ভেতরে ঢুকে দেখল আধপোড়া পশুর দেহ অন্য পশুরা খাচ্ছে। ওরাও তখন খেল এবং বুঝতে পারল এই ঝলসানো মাংস সহজে হজম হয়। শুকনো ডাল দিয়ে আগুন জ্বালানো সহজ এটাও জানলো। এবার তারা আগুন জ্বালিয়ে মাংস পুড়িয়ে খেতে লাগল। এ ছাড়াও তারা দেখল আগুন দেখে অন্য পশুরা কাছে আসে না, পালিয়ে যায়। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তারা রাতে থাকার জায়গার কাছে আগুন জ্বালিয়ে হিংস্র পশুদের দূরে রাখতে সক্ষম হল এবং নিশ্চিন্তে ঘুমলো। সংস্কৃতি এক ধাপে অনেকটা এগিয়ে গেল আগুনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার আয়ত্ত করার পর। সেই সাথে মানব সভ্যতা। মনে রাখতে হবে তখনও মানুষের জন্ম হয়নি। পাথর দিয়ে মৃত প্রাণীর মাথা ভেঙে ঘিলু অথবা হাড় থেঁতলে মজ্জা বের করে খাওয়ার শুরু এই ইরেকটাসের সময়েই। এটাও একটা বৈবর্তনিক প্রথা। এর থেকে তারা বেশি প্রোটিন পেত, বেশি শক্তি অর্জন করত। পশুদের দেখে শিখে তারাও শীতের সময় আচ্ছাদিত গুহার ভেতরে থাকতে শুরু করে। অনেক সময় পশুদের তাড়িয়ে আশ্রয় নিত। তবে কোনও প্রচেষ্টাই একবারে সফল হয়নি। বারবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চেষ্টা চালিয়ে তবেই এই সব সাফল্য। এর জন্যে বহু জীবন বলি দিতে হয়েছে। আগুন ও আশ্রয়ের উন্নত সংস্কৃতি আজ আমাদের সভ্যতার অঙ্গ।

গুহাবাস সফল করার অনেক পর আর এক মানব প্রজাতি হাইডেলবারজেনেসিস পাথরের ঘর বানালো। পাথরের ভাঙা স্ল্যাব দিয়ে গুহার মত নকল করে দেয়াল ও ছাদ বানালো। শখে নয়, অতি প্রয়োজনে। কারণ এদের সময় পৃথিবী জুড়ে চলছিল হিমবাহ-আন্তর্হিমবাহ খেলা। শীতল-উষ্ণের এই চক্রাকার পরিবর্তন তাদের জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা বাড়াচ্ছিল আর তারা সেই অভিজ্ঞতা প্রজন্ম ধরে বাহিত করছিল। উত্তরপ্রজন্মও এই শিক্ষা গ্রহণ করে কাজে লাগায়, আর তার ফলস্বরূপ পরীক্ষা করতে করতে একদিন তারা কাঠের ঘরও বানিয়ে ফেলল। জাপানের শিশিবু অঞ্চলে সেই স্বাক্ষর আজও শোভা পাচ্ছে। সাংস্কৃতিক বিবর্তনে এ এক বিশাল পদক্ষেপ এ নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। ইরেকটাসের উদ্ভাবনী সঙ্কেতবাহী আওয়াজ এবার হাইডেলবারজেনেসিসের মুখ দিয়ে ছোট ছোট সাঙ্কেতিক শব্দ উচ্চারণে রূপ পেল। এটাই হল যোগাযোগের ভাষা। মানবেতর প্রাণীরাও আওয়াজ করে, কোনও বার্তা প্রেরণ করে নিজেদের মধ্যে আবার অন্য গণের প্রাণীদেরও। কিন্তু ইরেকটাসের আওয়াজ ছিল উন্নত মানের আর হাইডেলবারজেনেসিসের শব্দ তো ইরেকটাসের চেয়েও উন্নতই শুধু নয়, রীতিমত ব্যঞ্জনবর্ণের শব্দ উচ্চারণ। স্বরবর্ণের প্রয়োগ অবশ্য অনেক পরে হবে। কিন্তু এই শব্দ উচ্চারণের সংস্কৃতি সভ্যতাকে আরও অনেকটা এগিয়ে দিল। প্রায় ছ’ লক্ষ বছর আগে তারা আফ্রিকা ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়ে এবং ইওরোপে চলে আসে। এদের এসব যুগান্তকারী আবিষ্কার ও অস্ত্র প্রযুক্তির নব নব উদ্ভাবন বিরল। এগুলোই পরবর্তী প্রজাতি নিয়েনডারথাল ও মানুষকে অনেক অনুকূল ও আধুনিক পরিবেশে উদ্ভবে সাহায্য করবে। এত কিছু জ্ঞান নিয়ে মানুষ যখন আসবে তখন তাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রগতির গতি অনেক দ্রুত যে হবে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। 

মানুষ বা হোমো সেপিয়েনস মানব গণের এবং প্রাণীজগতের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও বুদ্ধিমান জীব। বিবর্তনের ধারা মেনেই বুদ্ধিমান হয়েছে। প্রকৃতির পরিবর্তনে সাড়া দিয়ে অনেক প্রাণীই তার সংস্কৃতি বদলেছে। সহজ সামাজিক শিক্ষা গ্রহণ করেছে। বিবর্তনের ফলে ক্রমাগত শারীরিক গঠণের পরিবর্তন এবং ক্রমোন্নত জটিল মস্তিষ্কের ও জটিল স্নায়ুতন্ত্রের উদ্ভাবন মানুষের মস্তিষ্কর আয়তন বাড়িয়ে ১৩৫০ ঘন সেন্টিমিটার হওয়ার দরুন মানুষ বহুমুখী সংস্কৃতিবান হয়েছে। সভ্যতার অগ্রগতিকে শুধু বজায়ই রাখেনি, তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে। 

মানুষের বয়স মাত্র দু লক্ষ বছর। আর তার তিরিশ হাজার বছর আগে আসে নিয়েনডারথাল। এই দুই হোমো প্রজাতির প্রায় এক সময়ে উদ্ভব হলেও তাদের বিবর্তন ও জীবনধারন ঘটেছে সমান্তরাল ও ভিন্ন পরিবেশে, আবহাওয়ায় ও ভৌগোলিক অবস্থানে। নিয়েনডারথালের আগমন প্রধানত ইওরোপ ও তার সংলগ্ন এশিয়ায় এবং তখন পৃথিবী ছিল উষ্ণ। আর সেপিয়েনস সেই পূর্ব আফ্রিকায় বিবর্তিত হয়ে জন্মায়, কিন্তু পৃথিবী ততক্ষণে কঠিন হিমাবাহের কবলে। মানব বিবর্তনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে দুটো ভিন্ন মানব প্রজাতি দুভাবে সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। তবু মানুষের ক্ষেত্রে কাজটা হয়ে দাঁড়াল কঠিন। শুষ্ক আবহাওয়া বনাঞ্চল এলাকা কমিয়ে দিয়ে খাদ্যাভাব দেখা দিল। একদল মানুষ এক লক্ষ বছর আগে আফ্রিকার ইথিওপিয়া ছেড়ে বেরিয়ে এশিয়া ও ইওরোপে চলে আসে। এখানে এসে নতুন পরিবেশ, আবহাওয়া, খাদ্যসম্ভার, অপরিচিত পাথর যা দিয়ে অস্ত্র বানাবে দেখে নিজেকে মানিয়ে নিতে সময় নেয়। আর সর্বোপরি তখন সে ইরেকটাস, হাইডেলবারজেনেসিস ও নিয়েনডারথালের সম্মুখীন। প্রায় নিজেদের মতন দেখতে কিন্তু তাদের গোষ্ঠীর নয়। তবু নিজেদের মত ব্যবস্থা করে পূর্ব এশিয়ায় ঢুকে পড়ে। ভারতের সুরাত অঞ্চলেও চলে আসে। সেই সময়, সত্তর হাজার বছর আগে, ইন্দোনেশিয়ার টোবায় অগ্ন্যুৎপাত হয় এবং তার ছাই সারা আকাশ ঢেকে দেয়। অচিরেই প্রভূত খাদ্যসংকটের সম্মুখীন হয়ে সে সময়ে তারা পিছু হটে। অগ্রগতি স্তব্ধ হয়ে যায়। একেকটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে আর ততই তার বুদ্ধিকে উন্নত করে। এরপর আবার তারা আফ্রিকা ত্যাগ করে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে। তখন কিন্তু পৃথিবীতে হিমবাহ শুরু হয়ে গেছে। উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে অন্তত মেরু থেকে চল্লিশ ডিগ্রি অক্ষাংশ অবধি প্রচণ্ড শৈত্য প্রবাহ চলছে। সমুদ্রের জল টেনে নিয়ে মেরুতে বরফ জমছে। সমুদ্রের পতন হল ১২০ মিটার। কিন্তু মানুষ এবার সব বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হয় তার পূর্ব সঞ্চিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে। বিচিত্র ও ক্রমপরিবর্তিত আবহাওয়া ও পরিবেশ মানুষকে নানা উপায়ে জীবনধারণ করে চলতে শেখায়, মানুষ নিজেকে রক্ষা করতেও শেখে। এবার আর তার আগ্রগতিকে স্তব্ধ করে দিতে পারেনি কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা তার পূর্ব প্রজাতিদের বাধা। হ্যাঁ, বাধা পেতেই পারে কারণ প্রবল শৈত্য প্রবাহ খাদ্য ভাণ্ডারে খামতি ঘটাবেই। খাদ্য সংগ্রহের প্রতিযোগিতা শুরু হোল। মানুষ-পূর্ব প্রজাতিরা অত সহজে তাদের খাবার মানুষের হাতে নিশ্চই তুলে দেবে না। অযথা প্রতিযোগিতার মধ্যে, খুন-খারাপির মধ্যে না গিয়ে কিছু বুদ্ধিমান মানুষ সেই সময় নিরক্ষরেখা আর চল্লিশ ডিগ্রি অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থান করে পৃথিবী জয় করছে, কারণ সে জেনেছে এই অঞ্চলে শীতের প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম আর তাই খাদ্যের ততটা অভাব নেই। শস্য, ফল ও শিকারের যথেষ্ট যোগান আছে। 

সমাজবদ্ধ স্বভাব ও প্রযুক্তির ক্রমোন্নতি সংস্কৃতি বিবর্তনের ধারা বজায় রেখে মানুষ আরও উন্নত শিক্ষা অর্জন করেছে, যা মনুষ্যেতর প্রাণীদের দ্বারা সম্ভব হয় নি। জীবনযুদ্ধে প্রত্যেক প্রাণীই কিছু না কিছু শিক্ষা গ্রহণ করে। এই শিক্ষা দু প্রকার – সামাজিক ও ব্যক্তিগত। এইবার একটি প্রাণী তার অর্জিত শিক্ষার কতটা সামাজিক শিক্ষায় রূপান্তর ঘটাতে পারে তা নির্ভর করছে মস্তিষ্কের গঠণ ও ব্যবহারের ওপর। ব্যক্তিগত শিক্ষা প্রজন্ম ধরে বাহিত হতে হতে একসময় জিনে প্রবেশ করে। তখন সেটা সামাজিক শিক্ষায় পরণতি পায় যা প্রজন্ম ধরে বাহিত হয়, এমনকি পরের প্রজাতির মধ্যেও থাকে। মানুষের উন্নত মস্তিষ্কের জন্য সামাজিক শিক্ষার প্রচলিত হার অনেক বেশি। আর ভাষা হল সামাজিক শিক্ষার চূড়ান্ত রূপ। মানব সংস্কৃতির মতই ভাষা বিবর্তনের ধারা বয়ে এসেছে। 

সামাজিক শিক্ষা ও তদ্ভূত সংস্কৃতি জিন দ্বারা ও ব্যক্তিগত যোগাযোগ দ্বারা প্রভাবিত হয়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা ঝুঁকিপূর্ণ, সীমিত ও সময়সাপেক্ষ হলেও স্নায়ুতন্ত্র অতিরিক্ত সক্রিয় হওয়ায় গভীরতা আছে, কিন্তু ব্যাপ্তি কম বলে জিনে প্রবেশ করতে পারে না। অন্যদিকে সামাজিক শিক্ষা অল্পায়াসে নকল করেও শেখা যায়। বিস্তার থাকায় নির্ভরযোগ্য। উন্নত প্রাইমেটদের মধ্যে নকলের প্রবণতা বেশি, যার জন্য শিম্পাঞ্জিদের এপ বলা হয়। প্রত্যেক উচ্চ বর্ণের প্রাণী তার আগের প্রজন্ম বা প্রজাতি বা বর্ণের প্রাণী থেকে নকল করে। কিন্তু নিম্ন প্রজাতির প্রাণীরা তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত উন্নত মস্তিষ্কের উচ্চতর প্রাণীদের দেখে নকল করতে পারে না। ফলে জন্মের সময় থেকেই সে অনেকটা শিক্ষিত এবং আরও শিক্ষিত হয়ে ওঠায় কোনও বাধা থাকে না। দেখে দেখেই নকল করে শিখে যায়। যেহেতু মানুষ এখনও পর্যন্ত বিবর্তনের শেষ প্রজাতি, তাই সে প্রথমেই সকল প্রাণীর কার্যকলাপ ও ব্যবহার দেখে দেখেই অনেকটা শিক্ষিত হয়ে গেছে। তার ওপর রয়েছে নিজের অভিজ্ঞতা। তথ্য সংগ্রহের পরিমাণ ও গুণ উত্তরোত্তর বেড়েছে। তবে এসবের সাথে মানুষের দ্রুত অগ্রগতির জন্য প্রধান দায়ী স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বরযন্ত্র, তার জন্যে স্বরক্ষেপণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে স্বরবর্ণ যুক্ত করে কথা বলা, যা তাকে পূর্বের প্রজাতিদের থেকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। অস্ত্র তৈরিতে নিয়েনডারথাল মানুষের সমপর্যায়ভুক্ত হলেও শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা মানুষকে উন্নততর করেছে। আর তখনই মানুষ তার প্রতিবেশীদের প্রতিপক্ষ মনে করে তাদের ওপর অত্যাচার শুরু করে, এমন কি শত্রু মনে করে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করেনি। আর এখান থেকেই হিংসা ইন্দ্রিয়ের সূত্রপাত বলে মনে করা হয়।

এ যাবৎ প্রাণীরা অন্য প্রাণীকে হত্যা করত তাদের খাদ্যের জন্য। প্রাণীদের মধ্যে খাদ্য ও খাদকের সম্পর্ক আদিকাল থেকেই চলে আসছে। এতে প্রাণীজগতে সাম্য নষ্ট হয় নি। বাঘ, সিংহ ইত্যাদিদের আমরা হিংস্র প্রাণী বলি বটে কিন্তু এরা খাদ্যের অতিরিক্ত একটা বেশি প্রাণীও হত্যা করে না। অবশ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ও আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য বহু প্রজাতির প্রাণী নির্মূল হয়ে গেছে, কিন্তু দুই প্রজাতি প্রাণীর যুদ্ধে কোনও একটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি। প্রাইমেটদের মধ্যে দেখা যায় সন্তান গর্ভে ধারন করার পর থেকে সন্তান জন্মাবার পরও অনেক দিন পর্যন্ত স্ত্রী প্রাণীরা যৌন সঙ্গমে আনীহা দেখায়। এর জন্য পুরুষেরা তাদের সন্তানদের মেরে ফেলে। একটি স্ত্রী প্রাণীর সাথে যৌন মিলনের জন্য একাধিক পুরুষের লড়াই, এমনকি হত্যা পর্যন্ত দেখা যায়। কিন্তু স্রেফ নিজের অধিকার কায়েম করার জন্য শত্রুকে শেষ করে ফেলার আজকের যে প্রবণতা মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে তার সূত্রপাত সম্ভবত মানুষই করেছে। আমার মতন যাকে দেখতে নয়, আমার বিধর্মী, আমার স্বজাতি নয়, আমার বর্ণের নয় এরকম নানা অ-সম মানুষই আমার শত্রু আর শত্রু মানেই হত্যা। এই হিংসা মানুষ শুরু করে আফ্রিকা থেকে নির্গমেনের পর এশিয়া ও ইওরোপে এসে।

সামাজিক শিক্ষায় উন্নত ও অভিজ্ঞ অভিবাসিত মানুষ নতুন জায়গায় এসে পূর্ব প্রজাতিদের থেকে বাধা পায় প্রধানত এলাকা দখল ও খাবারে ভাগ বসানোর জন্য। আক্রান্ত ও কোণঠাসা মানুষ তার বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে নতুন জায়গায় প্রাপ্ত উপাদান দিয়ে উন্নত মানের অস্ত্র তৈরি করে আত্মরক্ষা ও শিকার উভয়েই অসামান্য সাফল্য পায়। মানুষের অস্ত্র তৈরির কৌশল ও তার যথাযথ প্রয়োগ করার কৌশল তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে উন্নত হওয়ায় এবার তারা বিপন্ন হয়ে পড়ে। মানুষের সাথে প্রতিযোগিতায় তারা হার স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ভয়ে পালিয়ে যায়। গুহায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু প্রতিহিংসাপরায়ন, হিংস্র মানুষ তাদের ক্ষমা করে না। হত্যা করে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয় পৃথিবীর মাটি থেকে। তারাও যে এই প্রকৃতির একজন, সে বুদ্ধি মানুষের ছিল না। এখনও কি আছে? মানুষ প্রথমে ইরেকটাস ও পরে নিয়েনডারথালকে শেষ করে মাত্র তিরিশ হাজার বছর আগে। অথচ দ্রুত পরিবর্তিত আবহাওয়ায় তারা নিজেদের কত কষ্ট করে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল, তার স্বাক্ষর আজও রয়েছে। নিয়েনডারথালই প্রথম পশুর চামড়াকে গাত্রাচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার করে শৈত্য প্রবাহের সময়ে। 

এরপর থেকে মানুষের জনসংখ্যা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার অগ্রগতি অব্যাহত থাকে। এদের বিস্ফোরণ ঘটে হিমবাহ যুগের শেষে বারো হাজার বছর আগে পৃথিবী যখন আবার গরম হতে শুরু করে। প্রথাগত চাষ দশ হাজার বছর আগে শুরু হয়। নগর সভ্যতা, লিপির উদ্ভব, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, বিনিময় প্রথা ও সাহিত্য একের পর এক মানব সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে অনেক দূর নিয়ে গেছে। আর এগিয়ে নিয়ে গেছে মানুষের সেই হিংস্র স্বভাবকে যার জন্যে সভ্যতা আজ বিপন্ন। মানুষ যখন দেবতা সৃষ্টি করল, তখন তারা একই সাথে দানব, রাক্ষস বা অসুর বানিয়ে ফেলল এবং তারা দেবতাদের শত্রু বলে চিহ্ণিতও হল। স্ব-জাতির মধ্যে এই অদ্ভূত বিভাজন চিরকালের জন্য মানুষের মধ্যে বিভেদ সঞ্চার করে দিল। নানা দেশের পৌরাণিক কাহিনীতে এবং তদ্ভাবাপন্ন সাহিত্যে দেবতা ও দানবের যুদ্ধ এবং শেষে দেবতার জয়োল্লাস নিয়ে দীপাবলি। নাম দেওয়া হল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের জয়। অথচ প্রাথমিক হিংসা-উদ্রেক করা অন্যায় তো সেই মানুষই করল।

মানুষের মনে দু ধরনের চিন্তার জগৎ - মৌলিক ও সম্ভ্রান্ত। দুটোই আত্মসচেতনতার অনুগত এবং জিন বাহিত। প্রথমটার উপাদান ষড় রিপু। প্রতিহিংসা, বিতৃষ্ণা, গর্ব, অহং, এগুলো সব মানুষের মধ্যেই আছে। আর সম্ভ্রান্ত বা উদার আবেগের মধ্যে আসে প্রেম, করুণা, সহানুভূতি, বন্ধুত্ব, সহযোগিতা, শান্তি। একটা ভাল, সুস্থ, সুন্দর, নৈতিক সমাজ পত্তনের আকাঙ্ক্ষা। প্রতিটি মানুষের ভেতরেই এই দুটো আবেগের সত্তা আছে এবং এদের মধ্যে অনবরত দ্বন্দ্ব হয়েই চলেছে। কিছু ব্যক্তির মনে মৌলিক আবেগ দখল করে বসে আছে আবার কারোর মধ্যে মহৎ আবেগ প্রাধান্য পায়। যুক্তিবাদীরা স্থান, কাল, পাত্র হিসেবে আবেগ প্রকাশ ও নিয়ন্ত্রন করে। যুক্তিহীনদের কেউ ভাবের আবেগে ভেসে যায় আবার কেউ হিংস্র হয়ে হত্যালীলায় মেতে ওঠে। এও মানব সংস্কৃতি ও সভ্যতার অঙ্গ। আজ বুঝি ঠাকুমার সেই যুক্তিবাদী কথা যে, সংস্কৃতি ও সভ্যতা সবাইকে মিলেমিশে থাকতে শেখায় কারণ, আমরা সবাই প্রকৃতির অংশ। সত্যি হলেও বাস্তবে অমিল।

0 comments: