0

গল্প - সুধাংশু চক্রবর্তী

Posted in

গল্প


খেজুরের রস 
সুধাংশু চক্রবর্তী


ভোরবেলায় চা খেয়ে ফুলের সাজি হাতে বাগানে। পূজোর ফুল তুলবো। সবে গুটিকতক ফুল তুলেছি তখনই দেখি কাঁধের বাঁকে দুটো মাটির হাঁড়ি ঝুলিয়ে একটি লোক বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁকতে হাঁকতে চলেছে, ‘খেজুরের-র-র র-স-স-স…।’ ভারী লোভ হলো। কতকাল খেজুরের রস খাইনি। হাঁক দিয়ে দাঁড় করালাম। এক গেলাস রস দশটাকা। এক হাঁড়ি খেজুরের রস কিনে নিলাম। রসের হাঁড়িটা গিন্নীর হাতে তুলে দিয়ে বললাম, ‘এই নাও টাটকা খেজুরের রস। হালকা আঁচে বেশ করে জ্বাল দিয়ে এক হাঁড়ি রসকে সিকি হাঁড়িতে নামিয়ে এনে সেই রসে পায়েস বানাও। অনেক দিন টাটকা খেজুরের রসের পায়েস খাইনি। সেই কোন ছেলেবেলায় খেয়েছি মায়ের হাতে।’

গিন্নী জ্বাল দিতে বসলেন হাঁড়ির রস। রস ঘন করে সেই রসে পায়েসও বানালেন বেশ যুৎ করে। এরপর একবাটি পায়েস ঠাণ্ডা করে এনে আমার সামনে ধরে হাসি হাসি মুখ করে বললেন, ‘এই পায়েস খেয়ে বলো কেমন হয়েছে?’

পায়েস মুখে দিয়েই ‘ওয়াক্‌ থু’ করে উঠলাম। খেজুরের গন্ধ কোথায়? পায়েস যে ভেজা খড়ের গন্ধে ম ম করছে! অবশ্য মিষ্টি তেমনটাই হয়েছে যেমনটা হবার কথা ছিলো। শুনে গিন্নীও মুখে দিলেন একচামচ। তাঁরও সেই একই দশা হলো। পরদিন সকালে লোকটাকে হাতের কাছে পেয়েই চেপে ধরলাম। লোকটা শুনে দেঁতো হাসি দিয়ে বললো, হি-হি-হি। ওই রস নিশ্চয়ই আমার ভাইয়ের কাছ থেকে কিনেছেন! ওর জন্যে আমার ব্যবসাটা দেখছিলাটে উঠবে বাবু। আজ বাড়িতে গিয়ে ওর মুণ্ডপাত করে ছাড়বো।’

আমি তবু গজোর গজোর করে চলেছি, ‘আমি কিন্তু তোমার কাছ থেকে কিনেছি। তোমাকে চিনতে এতটুকুও ভুল হয়নি আমার।’

লোকটা সেই একই হাসি দিয়ে বললো, ‘ছি-ছি বাবু, আপনিও দেখছি আর সকলের মতো ভুল করে বসলেন! আমরা দু’ভাই দেখতে যে প্রায় একই রকম বাবু। যেটুকু পার্থক্য রয়েছে সেটা সহজে নজরে পড়ার মতো নয়। তবু বলি, ওর থুঁতনিতে ছোট্ট একটা কাটা দাগ আছে। একেবারে গলার দিক ঘেঁষে। চট করে নজরে পড়বে না তেমন করে না দেখলে। আমার ভাই আজ আর বেরোয়নি রসের হাঁড়ি নিয়ে। দেখবেন কাল সকালে আবার হাঁক পাড়তে পাড়তে যাবে এদিক দিয়ে। তখন চেপে ধরবেন ওই ঠগবাজটাকে আহাম্মকটাকে। ছাড়বেন না বাবু। রসের দাম উশুল করে নেবেনই সঙ্গে দু-চারটা দাঁতও উপড়ে নিতে পারেন যদি খুব ভালো হয়। আমি তাহলে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো আপনার কাছে।’

লোকটা চলে যাবার পর মনে মনে রপ্ত করে নিলাম দু’ভাইয়ের মধ্যেকার পার্থক্যটুকু। আগামীকাল সকালে মিলিয়ে নিতে হবে। ওকে কিছুতেই ছাড়া যাবে না। হতচ্ছাড়া খেজুরের রসের পায়েস খাওয়াটাই যে মাটি করেছেড়েছে!

হায় রে, পরদিন থেকে তক্কে তক্কে থেকেও আজ পর্যন্ত ওই লোকটাকে হাতের কাছে পেলাম না যার থুঁতনিতে কাটা দাগ রয়েছে। অথচ প্রত্যেকদিনই শুনি পাড়া বেপাড়া থেকে ভেসে আসছে সেই চিরপরিচিত সুরেলা কণ্ঠেরহাঁক, ‘খেজুরের-র-র রস-স-স.....’ 

বছর দুয়েক তক্কে তক্কে থাকার পর আজ আবার ঠগবাজ লোকটাকে ধরলাম। ভালো মানুষ পেয়ে সেবছর খুব ঠকিয়েছিলো আমাকে। খেজুরের রস বলে খড় ভেজানো বাতাসার জল গছিয়ে গিয়েছিলো আমাকে। এবার হাতের কাছে পেয়েছি যখন খেজুর রসের দাম উশুল তো করবোই তারসাথে দু-চারটা দাঁতও ভেঙ্গে নেবো সুদ বাবদ।

লোকটাকে আদর করে ডেকে এনে ঘরে বসিয়ে মুখটা ভালো করে দেখলাম । ঐ তো থুঁতনিতে কাটা দাগ রয়েছে! তারমানে ওর ভাই ঠিক কথাই বলেছে। সন্দেহ দূর হতে একরাশ রাগ ঝরিয়ে বললাম, ‘দু’বছর আগে খেজুরের রস বলে খড় ভেজানো বাতাসার জল গছিয়েছিলে আমাকে। তারপর সেই যে বেপাত্তা হয়ে গেলে আর তোমার টিকিরও দর্শন পেলাম না! আজ ধরেছি যখন সুদ সমেত রসের দাম উশুল না করে ছাড়বো না।’

- কি যে বললেন বাবু? আমার ভাইকে আজও ধরতে পারেননি? কত করে বলে গেলাম ওর থুঁতনিতে কাটা দাগ রয়েছে। তবু না! ছি-ছি-ছি। লোকট দেঁতো হাসি দিয়ে জবাব দেয়।
- অমন কাটা দাগ যে তোমার মুখেও আছে দেখছি! তবু বলছো এই তুমি সেই তুমি নও?

- ওহ্‌ এই কাটা দাগটার কথা বলছেন? আর বলবেন না বাবু। গেল বছর খেজুর গাছ থেকে পড়ে গিয়ে থুতনিটা ফাটলো। এই দাগটা যে তারই সাক্ষী বাবু। এক বছর ব্যবসাও করতে পারিনি। অথচ এই কাটা দাগ দেখে লোকে ভাবে আমি বুঝি সেই আমি নোই! 
- তাহলে তোমার ভাইকে দেখছি না কেন?
- ও আর খেজুরের রস বেচে না বাবু। বেচবে কী? ওর যে একটাও খেজুরের গাছ নেই। অবশ্য কোনোকালেও ছিলো না। আমাকে দেখে দুর্বুদ্ধি হয়েছিলো বলেই না খড় ভেজানো বাতাসার জল বেচছিলো লোক ঠকিয়ে। ধরা পড়ে গিয়েছে বলে আজকাল অন্য ব্যবসা ধরেছে।
- আমি বিশ্বাস করি না তোমার কথা। তুমি মিছে কথা বলছো।
- সেকী বাবু! বিশ্বাস করছেন না আমার কথা ? ঠিক আছে, আপনাকে এক গেলাস রস মাগনাই খাওয়াচ্ছি। রস খেয়ে খাঁটী কি না নিজের মুখেই বলুন। 

ব্যাটাছেলে ওর একটা ছোট্ট হাঁড়ি থেকে এক গেলাস রস নিয়ে খেতে দিলো আমাকে। নাক-মুখ কুঁচকে গেলাসে একটা চুমুক দিতেই আমার গোটা শরীর চনমন করে উঠলো খাঁটি খেজুরের রসের স্বাদে। ‘আহ্‌’ শব্দটা স্বেচ্ছায় বেরিয়ে এলো গলা দিয়ে।
- কি বলেছিলাম বাবু? এবার বিশ্বাস হলো তো আমি ভেজাল জিনিস বেচি না। ওসব আমার ভাইয়ের কম্মো। ও ব্যাটা আজকাল না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মরছে নিজেরই দোষে। তা বাবু, বলেন তো এক হাঁড়ি রস দিয়ে যাইআপনাকে?

এক হাঁড়ি রস কিনে লোকটিকে বিদেয় দিয়ে রসের হাঁড়িটা গিন্নীর হাতে তুলে দিয়ে বললাম, ‘এবার আর ঠকার চান্সই নেই গিন্নী। একেবারে পরোখ করে দেখেশুনে কিনে নিলাম। এবার বানাও দিকি এই রসের পায়েস।’

সেই রসের পায়েস হলো। গিন্নী এক বাটি পায়েস ঠাণ্ডা করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘নাও ধরো তোমার খেজুরের রসের পায়েস। একটা কথা না বলে পারছি না বাপু। তেমন সুগন্ধ কিন্তু পেলাম না রস জ্বাল দেবার সময়।এবারও ঠকিয়ে গেল কিনা কে জানে! 

পায়েস মুখে দিয়েই ‘ওয়াক্‌ থু’ করে উঠলাম। খেজুরের গন্ধ কোথায়? পায়েস যে ভেজা খড়ের গন্ধে ম ম করছে! দাঁত কিড়মিড় করে বিরবির করলাম, ‘দাঁড়া ব্যাটাচ্ছেলে! কাল সকালেই তোর হচ্ছে।’ গোটা রাত প্রায় জেগেই কাটালাম একমাথা আগুন নিয়ে।

অবশেষে আজ সকালে ঠকবাজ লোকটাকে আবার ধরলাম। হতে পারে ওর কাঁধে কোনো বাঁক ঝুলে নেই। নেই কোনো রসের হাঁড়ি। তা’বলে লোকটাকে চিনতে ভুল করবো এমন মানুষ আমি নোই। ওকে চিনতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি আমার। ওই তো কাটা দাগটা জ্বলজ্বল করছে ওর থুঁতনিতে। কাছে আসতেই লোকটার কলার চেপে ধরলাম, হারামজাদা, গতকালও খেজুরের রসের বদলে খড় ভেজানো বাতাসার জল গছিয়ে গিয়েছিসআমাকে! আজ তোকে শেষ......’

লোকটা আচমকা আক্রমণের মুখে পড়ে ভয়ে আধমরা হয়ে আমার কথার মাঝেই হাউমাউ করে উঠলো, ‘এসব কি বলছেন বাবু! আমি তো খেজুরের রস বেচি না! কোনোকালেও বেচিনি অমন বস্তু। তাছাড়া শুনেছি আজকাল চোরেরা নাকি হাঁড়ির রস চুরি করে খেয়ে খালি হাঁড়িতে ইয়েটিয়ে করে আবার গাছে ঝুলিয়ে দিয়ে যায়! সর্বনাশ! সাতসকালে ওসব নোংরা ঘাটতে যাবো কোন দুঃখে? 
- আবার মিছেকথা বলছিস? কাল বলেছিস সেবার ভাই এসে ঠকিয়ে গিয়েছিলো। অথচ গতকাল তোর কাছ থেকে খেজুরের রস কিনেও সেই ঠকেই মরলাম। আজ বলছিস খেজুরের রস বেচিস না? ইয়ার্কি পেয়েছিস? 
- সত্যি বলছি বাবু। আপনার দিব্যি বলছি। অমন কাজ আমি করি না। বিশ্বাস করুন আমার কথা। তাছাড়া আমি তো এই পাড়াতেই থাকি না।

- এই পাড়ায় থাকিস না যে সেটা ভালোই জানা আছে আমার। নইলে তোকে কি ছেড়ে দিতাম? গতকালই গিয়ে পৌঁছোতাম তোর ডেরায়। গিয়ে সুদ সমেত দাম তুলে নিতাম তোকে ঠেঙিয়ে।
- সত্যি বলছি বাবু, আমি এদিকেই থাকি না। আমার বাড়ি তো সেই কেষ্টপুরের খালের ধারে।
- ওহ্‌ হালিশহর থেকে একেবারে কেষ্টপুরে খালে পৌঁছে গেলি মারধোর খাওয়ার ভয়ে?
- বিশ্বাস করুন বাবু। আমি কিন্তু তেমন মানুষই নোই। আপনাদের এই শহরতলিতে এসেছি খেজুরের গাছের সন্ধানে। যদি তেমন
- গাছের সন্ধান পাই তাহলে ইজারা নিতাম খেজুরের রসের জন্য। ও বাবু, আছে নাকি তেমন কোনো গাছ আপনার সন্ধানে?
- তুই যদি সেই লোক নোস তাহলে তোর থুঁতনির ওই কাটা দাগটা এলো কোত্থেকে শুনি?

লোকটা কিছু একটা জবাব দিতে যেতেই দূর থেকে ভেসে এলো সেই পরিতিচ গলার হাঁক, ‘খে-জু-রে-র র-স-স......’

ওই হাঁক শুনেই দোটানায় পড়ে গেলাম। এই লোক কি সেই লোক নয়? নাকি সেই লোকটার ভাই? নাকি ওর কথাই সত্যি? ওই যে বললো, কেষ্টপুরে না কোথায় যেন থাকে! দোটানায় পড়ে গেলেও কয়েক লহমায় নিজেকে সামলে নিয়েই ছুটলাম ‘খেজুরের রস’ বলে হাঁক দিতে দিতে হেঁটে যাওয়া লোকটাকে ধরার জন্য। ছুটতে ছুটতে দেখি এই লোকটাও ছুটছে আমার পেছন পেছন। ঝপ্‌ করে দাঁড়িয়ে পড়ে অবাক হয়ে শুধোলাম, ‘কি ব্যাপার?তুই ছুটছিস কেন?’
- আজ্ঞে, আমি কি ছাড়া পেয়ে গেলুম বাবু?
- মানে?
- কোনো শাস্তি না দিয়েই আমাকে ছেড়ে দিলেন কি দিলেন না আমি যে সেই দোটানায় পড়েছি বাবু। সেটা শুধোবো বলেই না আপনার পিছন পিছন ছুটছি। তা হ্যাঁ বাবু, ছাড়া পেয়ে গেলুম তো? নাকি দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করবো শাস্তির জন্য?

শুনেই পিত্তি জ্বলে গেল, ‘ওরে হারামজাদা । মসকরা করা হচ্ছে আমার সাথে?’
- ছি-ছি বাবু। অমন কাজ কি করতে পারি কখনো? তাও আবার বেপাড়ায় এসে! অবশ্য নিজেদের পাড়া হলে অন্য কথা ছিলো।
- নিজের পাড়া হলে কি করতিস শুনি?
- হেঁ হেঁ হেঁ, নিজেদের পাড়া হলে আপনার মস্তানি ঘুচিয়ে দিতুম না? বলা নেই কওয়া নেই ঝপ্‌ করে কলার চেপে ধরলেন কিনা তাই বলছি। কলার চেপে ধরার ফল হাতেনাতে পাইয়ে দিতাম।
- কি বললি? তুই আমাকে মারবি?
- সেটা আমাদের পাড়ায় পা রাখলেই টের পাবেন বাবু। ওসব ফালতু কথা ছাড়ুন। এবার বলুন দিকি আমি কি ছাড়া পেয়ে গেলুম? নাকি শাস্তির জন্য অপেক্ষা করবো? যদি ছাড়া পাই তাহলে আবার অনুরোধ করছি যদি কোনোখেজুরগাছের সন্ধান দিতে পারেন। আর যদি না......

মহা ঝামেলায় পড়লাম তো! ওদিকে ওই লোকটা যে ক্রমশই দূরে চলে যাচ্ছে হাঁক দিতে দিতে, ‘খে-জু-রে-র র-স-স-স-স-স ।’

রাগে অন্ধ হয়ে একটা কথাই বের করতে পারলাম মুখ থেকে, ‘চো-ও-ও-ও-প্‌-প-প..........’ 

এক ধমকে এই লোকটার বকবকানি থামিয়ে দিয়ে ছুটলাম ওই লোকটাকে ধরতে। আমাকে ছুটতে দেখে এই লোকটা গলা ছেড়ে হাসতে লাগলো হা হা করে। ওর হাসিতে কান না দিয়ে ছুটতে ছুটতে দেখি বেঁটে মোতা একটা লোক ‘খেজুরের রস’ বলে হাঁক দিতে দিতে অদৃশ্য হয়ে গেল রাস্তার বাঁকে। এই লোকটা সেই লোক নয় দেখে হতাশ হয়ে ফিরে এলাম বাড়িতে। সেই অবসরে এই লোকটা পালিয়ে বেঁচেছে। ঘরে এসে ঢোকা মাত্র গিন্নী হাসিমুখে এগিয়ে এলেন, ‘ধরেছো লোকটাকে? কি বললে ওকে? টাকাটা ফেরত দিয়েছে? গুনে দেখেছো ঠিক টাকাটাই ফেরত দিয়েছে কিনা?’

ঝাঁকে ঝাঁকে প্রশ্নবাণ ধেয়ে আসতে দেখে একেবারে চুপ মেরে গেলাম। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে গিন্নী সামান্য চড়া সুরে বললেন, ‘কি গো, মুখে কুলুপ এঁটে দিলে কেন? টাকাটা দাও। তুলে রাখবো আলমারিতে।’

কি জবাব দেবো সেই ভেবেই দাঁড়িয়ে দাঁড়য়ে ঘামতে থাকলাম দরদর করে। গিন্নী আমার দিকে তাকালেন বড়বড় চোখ করে। সেই চোখে যে-আগুন ঝরালেন তাতে নিমেষেই অর্ধেকটা ভস্ম হয়ে গেলাম। ভস্ম হয়ে গুড়োগুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ার আগেই গিন্নী চেপে ধরলেন আমার জামার কলার। তারপর প্রবল ঝাঁকুনি দিতে দিতে আবার তোপ দাগতে শুরু করলেন, ‘মিনসের মুখে কথা নেই যে বড়! লোকটাকে কি ধরতে পারোনি? নাকি ধরেও ছেড়ে দিয়েছো ভালোমানুষি দেখিয়ে? নাকি হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করে টাকা কমিয়ে ছেড়েছে? নাকি টাকাটা আমার হাতে দেবে না বলে নাটক করছো? কোনটা শুনি?’

আমি নির্বাক হয়ে গিন্নীর হাতের প্রবল ঝাঁকুনি সহ্য করছি। গিন্নী সামান্য থেমে দম নিয়ে আবার শুরু করলেন, ভালো করে শুনে রাখো মুখপোড়া মিনসে, টাকাটা যদি না এনে থাকো অথবা টাকাটা যদি কম এনে থাকো কিম্বাভয় পেয়ে লোকটাকে যদি ছেড়ে দিয়ে থাকো কিম্বা টাকাটা আমাকে দেবে না বলে যদি নাটক শুরু করে থাকো তাহলে কিন্তু আমার হাত থেকে............’

হায় রে, গিন্নীর হাত থেকে ছাড়া পেলে তবেই না লোকটাকে ধরবো! সেগুড়ে যে বালি পড়েছে! তাছাড়া এতগুলো প্রশ্নবাণের আঘাত সহ্য করা কি অত সহজ কাজ? সহজ নয় বলে আমিও অমনি জ্ঞান হারিয়ে ঝুলে পড়লাম গিন্নীর সবল হাতের মুঠোয়। জ্ঞান হারিয়েও নিস্তার পেলাম না গিন্নীর ক্রোধের হাত থেকে। তিনি চোখেমুখে জলের ছিটে দিয়ে আমাকে আবার জ্যান্ত করে তুলে কড়া গলায় বললেন, ‘একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো তুমি। ঠগবাজ লোকটাকে ধরে টাকাকয়টা উশুল না করা ইস্তক তোমার কিন্তু নিস্তার নেই আমার হাত থেকে।’

এর দিন কয়েক পর এক সকালে ঘরে বসে সংবাদপত্র পড়ছি মন দিয়ে। সহসা বাইরে থেকে একটা লোক আমাকে ডেকে বললো, ‘ও বাবু, কাকে যেন খুঁজছিলেন শুনলাম?’

তাকিয়ে দেখি শতচ্ছিন্ন পোষাকে একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। আমাকে দেখে দু’পাটি হলুদ দাঁত বের করে আবার শুধোলো, ‘শুনলাম ক’দিন ধরে কাকে যেন খুঁজছেন আপনি? কাকে বাবু?’
- যাকেই খুঁজি না কেন তাতে তোমার....... মাঝপথেই আমার কথা আটকে গেল। একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম ব্যাপারটা দেখে। আরে, এই লোকটার থুঁতনিতেও যে কাটা দাগ রয়েছে! তাহলে এই লোকটা নিশ্চয়ই সেই ঠকবাজ! 

আমাকে সন্দেহের চোখে তাকাতে দেখে লোকটা সাতহাত দূরে সরে গিয়ে গম্ভীর গলায় বললো, ‘জানতাম আপনি আমাকে সন্দেহ করবেন। শুনুন বাবু, আমি কিন্তু ঠকবাজ নোই। আমি হলেম গিয়ে ঐ ঠকবাজটার বাপ। আপনার মতো আমিও ওকে খুঁজছি।’
- তুমি যদি ঠিকবাজ নও তাহলে তোমার থুঁতনিতে কাটা দাগ কেন? অমনই একটা কাটা দাগ দেখেছি যে ঠিকবাজটার থুঁতনিতে।
- হেঁ-হেঁ-হেঁ। ওটা হলো গিয়ে আমাদের বংশগত দাগ বাবু। আমাদের বংশের প্রত্যেকের মুখেই এমন কাটা দাগ আছে। পারলে একদিন বাড়িতে এসে দেখে যাবেন বাবু। 
- বংশগত দাগ! জন্মেও শুনিনি এমন কথা। কথাটা না বলে থাকতে পারলাম না।
- আজ তো শুনলেন। এটাও জেনে রাখুন বাবু, প্রতিটা মানুষের শরীরেই কিছু না কিছু বংশগত দাগ থাকে। থাকতেই হবে। 

আমি হা করে শুনছি লোকটার কথা। লোকটা হঠাৎ বলে বসলো, ‘হলফ করে বলতে পারি আপনার শরীরেও কোনো না কোনো বংশগত দাগ নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে।
- কি আবোলতাবোল বকছো? তেমন কিছু থাকলে আমি কি জানতাম না ভেবেছো?
- মোটেও আবোলতাবোল বকছি না বাবু। ওই তো, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তেমনই একটা বংশগত দাগ রয়েছে আপনার শরীরে! হলফ করে বলতে পারি অমন দাগ খুঁজলে আপনার ছেলের শরীরেও পাওয়া যাবে।
- আমার শরীরে কোথায় দেখলে বংশগত দাগ? দেখাও আমাকে। দাঁড়াও, তার আগে ছেলেটাকে ডেকে আনি। বলেই হাঁক দিলাম, ‘ওরে নেপু, একবার বাইরে আয় তো বাবা।’

নেপু বেরিয়ে আসার পর লোকটা আমাদের দু’জনকে খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে সোল্লাসে বলে উঠলো, ‘ঐ তো! দু’জনের শরীরেই কালো জড়ুলের দাগ দেখতে পাচ্ছি বাবু।’ লোকটা ইশারায় আমাদের দু’জনেরই পায়ে কালশিটে পরা দাগটা দেখিয়ে দিয়ে হাসতে থাকলো হো হো করে।

ছেলে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো। দ্রুত ওর মুখ চেপে ধরে রেখে লোকটাকে বললাম, ‘তুমি এখন যাও বাপু। আমি এখন ব্যস্ত আছি। পরে একসময় কথা হবে এই বিষয় নিয়ে।

লোকটা যাবার আগে বলে গেল, ‘আমার ছেলেটাকে ধরতে পারলে খবর দেবেন বাবু। যদি আমি আগে ধরতে পারি তাহলে আপনার কাছে নিয়ে আসবো। আর আপনি যদি আগে ..... লোকটা বলতে বলতে মিলিয়ে গেল রাস্তার বাঁকে। 

লোকটাকে মিথ্যে কথা বলতে হলো। বলতে পারলাম না যে, এই কালো দাগটা জন্মগত নয় রে হতচ্ছাড়া। এটা আমারই গিন্নীর হাতের কারসাজি। গত পরশু রেগে গিয়ে বাপ-ব্যাটাকে খুব করে পিটিয়েছিলেন চ্যালাকাঠ দিয়ে। 

গিন্নীর কথার খোঁচায় ক্রমাগত ঝাঁঝরা হতে হতে অবশেষে মনঃস্থ করলাম ঠকবাজ লোকটাকে হাতের কাছে পেলেও আর ধরতে যাবো না। একটা বাইরের লোকের কাছে বারবার অপদস্ত হতে কার ভালো লাগে শুনি? যাই হোক্‌, আজ সকালে বাগানে জল দিচ্ছি রোজকার মতো। এমন সময় কানে এলো সেই পরচিত কণ্ঠস্বর, ‘খে-জু-রে-র র-স-স...।’ শুনেও না শোনার ভান করে জল ঢালছি ফুলগাছের গোড়ায়। সহসা কানের গোড়ায় ভেসে উঠলো ভোমরের ভনভনানি (তেমনটাই মনে হয়েছিল প্রথমটায়)। হাত নাড়া দিয়ে ভোমরটাকে তাড়াতে যেতেই হাতটা সপাটে আছড়ে পড়লো কারও গালে। চমকে গিয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখি গিন্নী দাঁড়িয়ে আছেন আমার পেছনে!

ব্যাস, গিন্নীকে দেখেই আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার যোগাড় হলো। আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছি গিন্নী তার আগেই জলদগম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন, কানের মাথা খেয়েছো নাকি? শুনতে পাচ্ছো না ঠকবাজ লোকটা হাঁক পাড়তে পাড়তে যাচ্ছে সামনের রাস্তা দিয়ে? যাও ছুটে গিয়ে ধরো ওকে। ধরে নিয়ে এসো আমার কাছে। তারপর তোমাদের দু’জনকেই দেখছি। ভুলেও ভাবতে যেও না আজ কি কি জুটবে তোমারকপালে। তবে কিছু একটা যে জুটবে সেবিষয়ে নিঃসন্দেহ হতে পারো। এখন যাও, দৌড়ে গিয়ে লোকটাকে ধরে নিয়ে এসো আমার কাছে।’

এই যাত্রায় চোরের গুঁতো খেতে হলো না দেখে খুবই পুলকিত হলাম। তবে সেই পুলকের বহিঃপ্রকাশ ঘটার আগেই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটলাম লোকটার পিছনে। লোকটা ততক্ষণে মিলিয়ে গিয়েছে পাড়ারই কোনো একটা গলিতে। হন্যে হয়ে বেশ কিছুক্ষণ এখানে সেখানে খুঁজেও তাকে ধরতে না পেরে খালি হাতে ফিরে আসতে হলো আমাকে। খালি হাতে ফিরে আসতে আসতে ভাবছি আরও একপ্রস্থ শাস্তি পাওনা হলো আমার কপালে।

যেমনটা ভেবেছিলাম ঠিক তেমনটাই ঘটলো। আমাকে খালি হাতে ফিরে আসতে দেখে গিন্নী দু’চোখ দিয়ে আগুন ঝরিয়ে দিয়ে বললেন, আজও ধরতে পারোনি? আবারও ফসকেছো? এর ফল যে তোমাকেই ভোগ করতেহবে। আজ তোমার দু-দুটো শাস্তি পাওনা হলো। একটা, ওই ঠকবাজটাকে ধরতে না পারার অপরাধে। অন্যটা আমার গালে সপাটে চড় মারার অপরাধে।’

গিন্নী কথাকয়টা বলে দ্রুত ঢুকে গেলেন ঘরের ভিতর। তাঁর বলে যাওয়া কথা শুনে এবং পা দাপিয়ে চলে যাওয়াটা দেখে ভয়ে কাঁপতে থাকলাম বাগানে দাঁড়িয়ে। হায় রে, গিন্নী যদি আজও চ্যালাকাঠ নিয়ে আসেন তাহলে আমার পায়ের এই কালশিটে দাগটার (ঠকবাজটার বাপ যাকে বংশগত জড়ুলের দাগ বলে চিনিয়ে দিয়ে গিয়েছে) যে আজই বংশবৃদ্ধি ঘটবে!

গিন্নী রেগেমেগে দু’দুটো শাস্তি দেবার কথা ঘোষণা করে আমাকে বাগানে দাঁড় করিয়ে রেখে সেই যে ঘরে গিয়ে ঢুকলেন ঘণ্টা খানেক ভয়ে কাঁটা হয়ে বাগানে দাঁড়িয়ে থাকার পরও তাঁর দর্শন পেলাম না। আমার ভয়ের ঠকঠকানিতে পশেই দাঁড়িয়ে থাকা পেঁপেগাছটা গুটিকতক পাতা খসিয়ে ফেললো আমার ওপর। মনে হলো যেন গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে সহানুভূতি জানাতে চাইলো।

এমনিতেই আমার হাঁটুদুটো খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে বয়সের ভারে। আজকাল বেশীক্ষণ শরীরের ভার বইতে পারে না। তার ওপর ক’দিন আগে গিন্নীর চ্যালাকাঠের ঝড়ঝাপটা সয়েছে দাঁতে দাঁত চেপে। ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থাকার পর আর থাকতে না পেরে হাঁক দিয়ে গিন্নীকে ডেকে বললাম, ‘হ্যাঁ গো, আর কতক্ষণ বাগানে দাঁড় করিয়ে রাখবে আমাকে? চ্যালাকাঠ খুঁজে পাওনি বুঝি? কাল বিকেলে নেপুকে দেখেছিলাম ওটা নিয়ে খেলতে। ওকেই একবার শুধোও না কোথায় রেখেছে। শাস্তিটাস্তি যা দেবার দিয়ে নিশ্চিন্ত হও। শাস্তি ভোগটোগ করে আমিও ঘরে গিয়ে থিতু হই।’

ঘরের ভিতর থেকে গিন্নীর গলা ভেসে এলো, ‘সঙয়ের মতো বাগানে দাঁড়িয়ে না থেকে ভিতরে ঢুকে এসো। একটা শাস্তি পাওয়া হয়ে গেল তোমার। চিন্তা কোরো না, দ্বিতীয়টাও সময়মতো পেয়ে যাবে। বাকী রাখবো না কিছুই।’ 

দুরুদুরু বুকে ঘরে ঢুকে এলাম। গিন্নী আমাকে দেখে গম্ভীর গলায় বললেন, 'দ্বিতীয় শাস্তিটা আপাতত তোলা থাকলো। এখন যাও, স্নান সেরে এসে চাট্টি খেয়েদেয়ে আমাকে উদ্ধার করো। আর কতক্ষণ ভাড়ার আগলে বসে থাকবো শুনি?'

বিনা বাক্যব্যয়ে দিনের বাকী সময় বাধ্য ছেলে থুড়ি বাধ্য স্বামীর মতো অক্ষরে অক্ষরে মেনে চললাম গিন্নীর সর্বপ্রকার আদেশ এবং নির্দেশ। গিন্নী শাস্তি নিয়ে কোনো কথা বললেন না দেখে আবার পুলক জাগলো মনে। যাক্‌ বাবা, নিস্তার পেলাম শাস্তির হাত থেকে। 

সেই পুলকে ভর করে রাত্রে বিছানায় এসে গিন্নীর কাছ ঘেঁসতেই চাপা ধমক খেলাম, ‘লজ্জা করে না তোমার? যার ঠকবাজ লোকটাকে ধরার মুরোদ নেই সে কোন সাহসে আমার কাছে আসে? দূর হটো-দূর হটো।’

- নাহ, মানে ..... বলতে বলতে দূরে সরে গেলাম। বলা যায় না এখন আবার কি নিদান হেঁকে বসেন তার ঠিক কি! এখনো একটা শাস্তি পাওনা আছে যে।

সবে ঘুম এসে দু’চোখে জাঁকিয়ে বসেছে তখনই গিন্নীর চাপা গলা ভেসে এলো অন্ধকার ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে, ‘কান খুলে আগাম শাস্তিটা শুনে রাখো। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে সোয়েটার না পড়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াবে। আর একটা কথা। ঠকবাজ লোকটাকে ধরে নিয়ে আসার পরই কিন্তু তোমার কপালে চা-বিস্কুট জুটবে। আর হ্যাঁ, যদি দু’ঘন্টার মধ্যেও না ফিরে আসো তাহলে দেখবো আমার হাত থেকে কে তোমাকে রক্ষা করবে।’

এতসব শাসানী শুনলে কারো চোখে ঘুম নামে কখনো? আমারও না। গোটা রাত কেটে গেল নির্ঘুম চোখে। অবশেষে কাকভোরে উঠে গায়ে পাঞ্জাবী চাপিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম রাস্তায়। ঘণ্টা দুয়েক কখন কেটে গেল টের পেলাম না। সহসা দেখি গিন্নী রণচণ্ডী মূর্তি ধারণ করে এগিয়ে আসছেন আমার দিকে। দেখেই বলির পাঁঠার মতো কাঁপতে লাগলাম ঠক্‌ ঠক্‌ করে। আমাকে কাঁপতে দেখে প্রাতঃভ্রমণকারী এক ব্যক্তি পাশ দিয়ে যেতে যেতে সহানুভূতি দেখিয়ে গেলেন, ‘আহা রে, দাদা যে শীতে কাঁপছেন ঠক্‌ ঠক্‌ করে! কাঁপনের আর দোষ কি? যা ঠাণ্ডা পড়েছে গত রাত থেকে। সোয়েটার ছাড়া লড়াই করতে নেমেছেন এই শীতের সাথে? সর্বনাশ! যান-যান, ঘরে গিয়ে সেঁধিয়ে পড়ুন লেপের তলায়।’

প্রাতঃভ্রমণকারী উপদেশ দিয়ে চলে যাবার পরপরই গিন্নী এসে হাত তুললেন আমাকে লক্ষ্য করে। গিন্নীকে হাত তুলতে দেখে ভাবলাম বিরাশি সিক্কার একটা চড়ের স্বাদ অনুভব করবো আমার এই তোবড়ানো গালে। সেই ভয়ে চোখদুটো বুজেও ফেললাম। কিন্তু একী! চড় মারার বদলে গিন্নী যে ঘাড় ধরে কোথাও টেনে নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে! ভয়েভয়ে চোখ খুলে দেখি, রাস্তার ধারেই দেড় মানুষ সমান গভীর নালাটার দিকে ভেসে চলেছি গিন্নীর সবলহাতে ঝুলে! দেখেই বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। হায়-হায়, গিন্নী বুঝি ঐ নালাতেই বিসর্জন দিতে চলেছেন আমাকে! 

সেই ভয়ে আবার চোখ বুঝে ফেললাম। হঠাৎ প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে চোখ খুলে দেখি নালাটার ওপর দিয়ে উড়ে চলেছি গিন্নীর সবল হাতের টানে। হে ঈশ্বর, এই নালার জলেই কি আমার বিসর্জন হবে! ভাবনাটা শেষ হবার আগেই আমাকে নালার ওপারে ধপাস্‌ করে নামিয়ে দিয়ে গিন্নী আদেশ দিলেন, ‘অনেক হয়েছে। এখন ঘরে চলো। আগে চা-বিস্কুট খাইয়ে ধাতস্ত করে নিই তোমাকে। তারপর কি শাস্তি দেবো সেকথা ভাবা যাবে। 

আবার কোন শাস্তির মুখে পড়তে হবে সেই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সবে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছি অমনি কানে এলো সেই পরিচিত হাঁক, ‘খে-জু-রে-র র-স-স-স।’ ওই তো ঠগবাজ লোকটা যাচ্ছে এই পথ দিয়ে! লোকটার হাঁক শুনে গদগদ হয়ে গিন্নীর অনুমতি চাইলাম, ‘ওগো শুনছো, ঠগবাজ লোকটা যে এই পথ দিয়ে যাচ্ছে। অনুমতি দাও তো চট্‌ করে গিয়ে লোকটাকে ধরে আনি।’

গিন্নী ‘যাও’ বলেও পরক্ষণেই ধমক দিয়ে বললেন, ‘থাক-থাক, অনেক করেছো তুমি। তোমাকে আর ছুটতে হবে না লোকটার পেছনে। ক’টা বেজেছে সেখেয়াল আছে তোমার? নাকি আজ অফিস কামাই করার ধান্দায় আছো?’

এরপর আর কোনো কথা চলে না বলে চা-বিস্কুট খেয়ে নির্বিকার চিত্তে অফিস যাওয়ার তোড়জোড় করতে থাকলাম। সেজেগুজে যখন বেরোতে যাচ্ছি গিন্নী তখনই হুকুম দিলেন, ‘অফিস থেকে ফিরে আসার সময় দামী একটা ট্যাব কিনে এনো কিন্তু। মনে রেখো, ট্যাব না আনলে আজ আর ঘরে ঢোকা হবে না তোমার। গোটারাত ওই রাস্তাতেই পড়ে থাকতে হবে পথের ভিকিরিগুলোর সঙ্গে। তারপরও কি ছাড় পাবে ভেবেছো? সকালে লোকটা যখন এখান দিয়ে যাবে ওকেও ধরে আনতে হবে আমার কাছে। তাহলেই এই বাড়িতে আবার স্থান হবে তোমার। নচেৎ......’

গিন্নীর মন পাবার জন্য গলায় অনুরাগ মিশিয়ে শুধোলাম, ‘ট্যাব দিয়ে কী হবে গো? ও দিয়ে কি করবে? সেলফি তুলবে? নাকি ফেসবুকে চ্যাট করবে বান্ধবীদের সঙ্গে?’
- ওসব জেনে তোমার কি হবে শুনি ? শুধু এটুকুই জেনে রাখো, ওই ট্যাব কাল সকাল তোমার কপালেই ঝুলবে। এখন যাও। যা বললাম নিয়ে এসো ফেরার পথে।’ 

শুনে আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার জোগাড় হলো। কথাটা একবার মুখ থেকে বার করেছেন যখন কিছু একটা গোল না বাঁধিয়ে ছাড়বেন না। অগত্যা সন্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে ব্যাজার মুখে হাঁটা দিলাম বাসস্ট্যাণ্ডের দিকে।হাঁটতে হাঁটতে ঈশ্বরকে ডেকে মনেমনে বললাম, ‘হে ঈশ্বর, এবার কোন বিপাকে ফেলতে চাইছো আমাকে? আমার কপালে ট্যাব ঝুলবে! হায়-হায়, আরও কিকি ঘটবে সেসব যদি আগাম বলে দিতে প্রভু।’

অফিস থেকে ফেরার পথে সবচেয়ে বড়ো ট্যাবটাই কিনে নিয়ে এলাম বাজার থেকে। রাতটা নির্ভাবনায় কেটে গেল। বাড়তি পাওনা হলো গিন্নীর হালকা ফুলকা আদর। তাতেই হাবুডুবু খেতে খেতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টেরপাইনি। সেই সুখের ঘুম ভাঙলো পরদিন কাকভোরে। গিন্নী ঠেলে তুলে দিয়ে গম্ভীর গলায় আদেশ দিলেন, ‘উঠে চোখেমুখে জল দিয়ে এসো। তোমাকে এখন রাস্তায় বেরোতে হবে সেজেগুজে।’

দ্রুত বিছানা থেকে নেমে চোখেমুখে জল দিয়ে এলাম। গিন্নী নিজের হাতে আমাকে সাজিয়েগুছিয়ে দিলেন ফুলহাতা সোয়েটারে। তারপর গতকাল যা বলেছিলেন ঠিক সেটাই করে ছাড়লেন। ট্যাবটা রবার ব্যাণ্ডে বাঁধা হয়ে শোভা পেলো আমার কপালে। গিন্নী ট্যাবের মুভি রেকর্ডারটা চালিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এবার যাও। গিয়ে পাড়াময় টহল দিতে থাকো। ওই ঠকবাজ লোকটার পিছন পিছন গিয়ে দেখে এবং ছবি তুলে নিয়ে এসো সে কোথায়থাকে। তারপর আমি সেখানে গিয়ে......’

ট্যাব কপালে ঝুলিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। খুব দুঃখ হচ্ছে। দুঃখ ভুলতে চেয়ে মনেমনে সেই গানটাই ধরলাম (যদিও নিজের মতো শব্দ বদলে নিয়ে) ‘এবার বিদায় দে আমায়, হই পরবাসী। আমি জনম দুঃখী...।’ 


আচমকা গান এবং হাঁটা থামিয়ে দিতে হলো আমাকে। সাতসকালেই এই তল্লাটের ডাকসাইটে গুণ্ডা কাল্লুমস্তান তোল্লা তুলছে বাজারের দোকানগুলো থেকে! তোল্লা দিতে অস্বীকার করায় কাল্লুর সাকরেদরা সদ্য দোকান খুলে বসা এক দোকানদারকে আড়ংধোলাই দিচ্ছে রাস্তায় পেড়ে ফেলে। দেখেই চট করে সেঁধিয়ে গেলাম পাশেরই একটা গলিতে। এবং তখনই গলির অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো সেই পরিচিত হাঁক, ‘খে-জু-রে-র-রস-স-স-স।’

লোকটাকে চিনে নিতে এতটুকুও অসুবিধা হলো না আমার। কিন্তু ওকে ধরলাম না। বরং ওকে সাবধান করে দিয়ে বললাম, ‘ও ভাই ঠকবাজ, ভুলেও বড় রাস্তায় যেও না। কাল্লুমস্তান গুণ্ডামি করছে। তোমাকেও ছাড়বে না।’ তারপর এ-গলি সে-গলি হয়ে ঘরে ফিরতেই গিন্নী এসে ছোঁ মেরে ট্যাবটা হাতিয়ে নিয়ে কি কি ছবি তুলেছি দেখতে বসলেন। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মিউমিউ করে বললাম, ‘ঠগবাজ লোকটাকে ধরতে মন চাইলো না গো। আহা কাল্লুমস্তানের ভয়ে বেচারা......’

গিন্নী ততক্ষণে ট্যাব খুলে দেখে নিয়েছেন কাল্লুমস্তানের কাণ্ডকারখানা। ট্যাব থেকে চোখ সরিয়ে এনে আমার দিকে একমুখ হাসি ছুঁড়ে দিয়ে আদুরে গলায় বললেন, ‘ধরোনি বেশ করেছো। এবার একটা কাজ করো দিকি।কাল্লুর এই ছবিটা এক্ষুনি জমা দিয়ে এসো টিভির সংবাদ চ্যানেলের দপ্তরে। বলবে গিন্নী পাঠিয়েছেন ‘গলির বৌদি রিপোটিং হিয়ার’ বিভাগের জন্য।

পরদিন সকালে সংবাদ চ্যানেলের লোকজন চলে এলেন গিন্নীর ছবি এবং বক্তব্য রেকর্ড করার জন্য। ব্যাপারটা পাড়ার কারও জানতে বাকী রইলো না। নিমেষেই মানুষে মানুষে ছয়লাপ হয়ে গেল বাড়ির উঠোন। সেই ভিড়ের মাঝে হঠাৎ শোভা পেতে লাগলো বাঁকে ঝোলানো মাটির হাঁড়িদুটো। দেখেই ঠকবাজ লোকটাকে ধরে করে এনে তুললাম বসার ঘরে। চা-বিস্কুট খাইয়ে ‘টিভিতে তোমাকে দেখা যাবে, তোমার রসের হাঁড়ি দুটোকেও...’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলে ভুলিয়ে রেখে ছুটলাম গিন্নীর কাছে।

সংবাদ চ্যানেলের লোকগুলো চলে যাবার পর গিন্নী এসে ঢুকলেন সেই ঘরে যে-ঘরে ঠগবাজটাকে বসিয়ে রেখেছি। হাতে বেশ কিছু উপহারের সামগ্রী নিয়ে। সেই ঘরে এসে উপহারে পাওয়া সামগ্রীগুলো শোকেসে গুছিয়ে তুলে রেখে প্রথমে ঠগবাজ লোকটার দুটো হাঁড়িরই রস চেখে দেখলেন এক এক করে। তারপর ঠগবাজ লোকটাকে.........

পরের দৃশ্য এবং গিন্নীর সংলাপগুলো আর নিতে না পেরে পালিয়ে এলাম ঘরের বাইরে। বাইরে বেরিয়ে এসে এক বুক স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। যাক্‌ বাবা, এতদিনে ঠকবাজ লোকটাকে বামাল সমেত তুলে দিতে পেরেছি গিন্নীর হাতে। আহ্‌ কি শান্তি।

0 comments: