0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in

ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত

                         দ্বিতীয় পর্ব      
                            
                                 [তিন মাস পর]
গোরাচাঁদ
শেষ অব্দি খুঁজে পেয়েছিলেন গোরাচাঁদ দুধঝর্ণার আড়ালে ওই বিস্তীর্ণ সবুজ ভ্যালি। বেশ কয়েকদিন অনেক ঘুরে ঘুরে বিপদসঙ্কুল ধাঁধা সমাধান করতে করতে এখানে আসার পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। অনাহারে অনিদ্রায় গভীর জঙ্গলে ভূল্ভুলাইয়ার কবলে পড়ে কিভাবে যে দিন কেটেছে ভাবতেই এখন ভয় হয় গোরাচাঁদের। তবে খুঁজে পাওয়ার পর প্রতি সপ্তাহে পাগলের মতো একবার করে ছুটে আসেন এখানে। আতিপাতি করে পাহাড়ের কালোসাদা গ্রানাইট পাথরগুলোর খাজে খাজে গোপন গুহাপথের সন্ধান করতে থাকেন। ঘুম হয়না তাঁর। এতোগুলো বনবাসী জেরেকা পেরো বেমালুম হাওয়া হয়ে যেতে পারেনা। নিশ্চয়ই ওরা সবাই বেঁচে আছে। বিশেষ করে এখান থেকেই যে তাদের নিস্ক্রমন এর জলজ্যান্ত প্রমাণ তিনি পেয়েছেন। ওদের ছেড়ে যাওয়া অনেক জিনিষ এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এতোগুলো মানুষ একসাথে কোথায় যেতে পারে? খুঁজে পেতেই হবে এই রহস্য।
    এখনো তাদের খুঁজে পাননি,তবে তাঁর নিজের জীবনে যা ঘটেছিল সেটা এতোবছর ধরে আবছা কুহেলিকা হয়ে রয়েছিল মনের ভিতর,এখন সেটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। জীবনের কয়েকটা দিনের স্মৃতি লুপ্ত হয়ে গেছে। সেটা চেষ্টা করেও ফিরিয়ে আনতে পারেননি। এখনো ঘন কুয়াশার মতো অস্পষ্ট। কিন্তু সেই শূন্যতার পর আবার যেখান থেকে তাঁর জীবনযাত্রা শুরু হয়েছিল সেটা এবার মনে পড়েছে। আজথেকে তিরিশ বছর আগেও শোষনতন্ত্র এখনকার মতই ছিল তুমুল। সেসময়ও শিমুলিয়ার আদিবাসীরা ছিল ভূমি অধিকার থেকে বঞ্চিত। তিন রাজ্যের সীমাবর্তী এলাকা। নো ম্যানস ল্যান্ড,এই ভেবেই প্রশাসনের কোনও গরজ নেই। তাই বনজ খনিজ কৃষিজ সম্পদ সুযোগসন্ধানীরা ইচ্ছেমতো বলপূর্বক কেড়ে নেওয়ার প্রবণতা ছিল,সরকার ও প্রশাসন কিছুই করতো না, না এখনো করে। মজার কথা প্রতিবার ভোটের সময় তিন রাজ্যের ভোট প্রার্থী ভিন্ন দলের। ওরা এখানের বাসিন্দা নিয়ে পরস্পর লড়াই করে কিন্তু কোনো উন্নতি প্রকল্প নেই। গোরাচাঁদ ভেবে অবাক হয়ে যান, এই এলাকা কি অভিশপ্ত? কতো বছর কেটে গেল সেই একই রকম অবস্থা। কোনোরকমের পরিবর্তন নেই কেন? গোরাচাঁদ নিজের জীবনের মুল্যবান চল্লিশ বছর এই শিমুলিয়া গ্রামের মানুষদের আপলিফ্টমেণ্টে আহুতি দিয়েছেন,কিন্তু এক চুলও এগোতে পারেননি। একসময় ছিল যখন সমু ও পেরো শিশু। গভীর জঙ্গলে এখানে সেখানে বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে থাকা বনবাসীদের জন্য শিমুলিয়াকে এক আধুনিক বর্ধিষ্ণু আদর্শ গ্রাম করতে একটা প্রকল্পের ছক বেঁধে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পেশ করেছিলেন। কেন্দ্র যে রাজ্য সরকারের মাধ্যমে অনুমোদন করল শিমুলিয়া এলাকার সেই এরিয়াটি খনিজ সমৃদ্ধ। তাই জনজাতির উন্নতি প্রকল্পের বদলে সরকারি আমলা ও লোভী ব্যবসায়ীরা ভূগর্ভে খনিজ সরজমিনে সরকারি বিস্তর টাকা খরচ করতে লাগলো। গোরাচাঁদ ও সেখানের মুখিয়ারা তাদের বসতি উচ্ছেদে প্রতিবাদ করতেই ওদের সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টিকারি ও উগ্রবাদী ঘোষণা করে ওদের পিছনে প্রশাসন ও আধাসৈন্যবাহিনী লেলিয়ে দেওয়া হল। এলাকার কয়েকজন যুবক মারা গেল। গোরাচাঁদ পালিয়ে গভীর জঙ্গলের ভিতরে দিশা হারিয়ে বেশ কিছুদিন ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। অনাহারে অনিদ্রায় আতঙ্কে প্রায় হতচেতন গোরাচাঁদ গভীরবনে এক টিলাতে জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে রইলেন। তারপর কতদিন কিভাবে ও কোথায় কেটেছে তাঁর কিছুই মনে নেই। অনেকদিন পর কোন পথ দিয়ে শিমুলিয়াতে পৌছলেন কিছুই মনে নেই। তারপর সজ্ঞানে তিনি বহুবার চেষ্টা করেছেন তাঁর রহস্যময় আগম নির্গম পথ চিনতে কিন্তু পারেননি। এই উন্মুক্ত ভ্যালিতে এসে সাদা কালো চকরাবকরা পাহাড় দেখেই সব মনে পড়ে গেল। বছর তিরিশেক আগে বহুদিন স্মৃতি হারানোর পর এখানেই নিজেকে ফিরে পেয়েছিলেন।
  একটা ছোটোখাটো পাহাড় প্রমাণ উঁচু দুধ সাদা পাথরের উপর বসে গোরাচাঁদ এইসব কথা ভাবছিলেন। হতাশ অবসন্ন। হাজার বছর ধরে মনে হয় এখানের আদিম মানুষের কোনোরকম উন্নতি বা বিবর্তন নেই। চেষ্টা করেও প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারছেনা। প্রকৃতি এখানে অঢেল সম্পদ দিয়েছেন কিন্তু লোভের মানুষকে ডেকেও নিচ্ছেন নয়ছয় করতে। কিন্তু আমি মানুষ হয়ে অমানুষকৃত শোষণ পীড়ন নির্যাতন কেন সইবো? গোরাচাঁদ উঠে দাঁড়ালেন। এর প্রতিকার করতেই হবে। হেরে গেলে চলবেনা। এবার হেরে যাওয়ার প্রশ্নই নেই।পৃথিবীতে ভাঙ্গাগড়ার কাজ একটু সচেতন হয়ে বিশ্লেষণ করে দেখলেই বুঝতে পারা যায় কখন কোথায় পরিবর্তন হতে চলেছে। আমার তো মনে হয় শিমুলিয়াতে দীর্ঘ অবসাদের পর এবার সময় এসেছে। এখানের ঘটনাক্রম তো সেটারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। কয়েক দশক ধরে যেভাবে জোরালো প্রতিবাদ কেউ করতে পারেনি,সরকারের প্রতিনিধি খনি ব্যবসায়ী প্রশাসন সেনা বাহিনী নিজের খুশিমতো যা পেরেছে তাই করেছে,এখন এক বিদেশী সেনাধক্ষ্য সেটা করে ফেললেন। শুধু তাইনয়,একেবারে উপর মহল অব্দি নাড়া দিয়েছেন। তাছাড়া সৈন্যদের ভিতরেও এই প্রতিবাদ বিদ্রোহের আকারে প্রকাশ পেয়েছে। সৌমাজিতের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে।  মিলিটারি কোর্ট অফ ল এবং সিভিল কোর্ট দু তরফ থেকেই সে এখন সাজার অপেক্ষায়। সেটা গোরাচাঁদের কাছে খুবই দুঃখজনক কিন্তু বাস্তব যতই কঠোর হোক তা মেনে নিতেই হবে। সবচেয়ে ভালো কথা হলো, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরনোর মতো অনেক সরকারি আমলা নেতা ও ব্যবসায়ীদের গোপন কারবার ও লেনদেন ফাঁস হয়েছে। সিবিআই তদন্ত ও ইনকাম ট্যাক্স রেড চলছে যা কখনো হয়নি। মিডিয়াতে শিমুলিয়ার খুব প্রচার হয়েছে। বিভিন্ন মিডিয়া টিম শিমুলিয়ার ভ্যালি ও পাহাড় দেখে দাবি করেছে এই জায়গাটা টুরিষ্ট স্পট করে দিলে এখানের উন্নতি অবশ্যই হবে। কিন্তু এখন শিমুলিয়াকে জনহীন দেখে সরকার যদি প্লট হিসেবে জনগণকে লিজ দিতে শুরু করে? তবে বনবাসীরা এলে কোথায় থাকবে? গোরাচাঁদ একেবারেই নিশ্চিত ওরা সবাই বহাল তবিয়তে আছে। ওদের কিছুই হয়নি।
   পড়ন্ত দুপুর। এখনি বাড়ির দিকে রওনা হতে হবে,না হলে এখানেই রাত কাটাতে হবে। গোরাচাঁদ পাথর থেকে সাবধানে নামতে লাগলেন। এই সাদা পাথরের পাশে একটা মসৃণ কালো পাহাড় প্রমাণ পাথর রয়েছে। সেটার ঠিক মাঝ বরাবর একটা লম্বা সরু লিকলিকে অশথ্থ গাছ। সেটার যতোনা ডালপালা তার চেয়ে বেশি একধরনের বুনো লতা তার গা বেয়ে নিচে নেমেছে। সেই লতাগুচ্ছ উজ্জ্বল রঙের ফুলে ছেয়ে রয়েছে। গোরাচাঁদ বিস্ময়ে অভিভূত হলেন। বিশাল পিছল কালো চাট্টানের উপর এতো বড় বৃক্ষ কিকরে হয়? ভাবা যায় না। প্রকৃতি এমন এক মনোরম দৃশ্য তৈরি করেছেন,মনে হচ্ছে কালো স্লেটের উপর কোনো শিল্পী রঙ তুলি দিয়ে এমন আশ্চর্য আকারের গাছ ও রঙিন ফুল লতাপাতা এঁকেছে।
  গোরাচাঁদ তন্ময় হয়ে দেখতে দেখতে হঠাত্‍ তাঁর চোখে পড়ল ভূমি সংলগ্ন ফুলে ফুলে ছাওয়া লতার ঝাড় ভেদ করে পিলপিল করে সাদা বুনো খরগোস বেরিয়ে আসছে,আর একটু দূরে একটা বিশাল গর্তে ঢুকে যাচ্ছে। উনি তাড়াতাড়ি নিচে নামলেন। ততক্ষণে খরগোসের পাল হাওয়া। রোদ তখন মসৃণ পাথর পাহাড়ের গায়ে সরাসরি পড়ছে আর প্রতিফলিত হচ্ছে। উনি লতার ঝাড়ের কাছে গেলেন। খুব কাছ থেকে ফুলের গন্ধ শুকলেন। এই ফুলের বর্ণ আছে গন্ধ নেই। লতা সরিয়ে দেখলেন একটা গুপ্ত গুহা। দুপুরের চড়া রোদ ঢুকতে দেখা গেল সেটা ততো অন্ধকার নয় আর নোংরাও নয়। তিনি লতা সরিয়ে সেখানে ঢোকার আগে একটু সতর্ক হলেন। দেখে তো মনে হচ্ছে ঠাণ্ডা সুরক্ষিত একটা আশ্রয়। সামনের দিকটা টানেলের মতো প্রশস্ত। কিন্তু বাঘের গুহা তো নয়? চারদিকে নাক ঘুরিয়ে শুকলেন, নাঃ বাঘ যদি পঞ্চাশ মিটার দূরে থাকতো তবে গন্ধেই বোঝা যেতো। কিন্তু বাঘ তো দূরের কথা কুকুর শেয়াল পর্যন্ত নেই। এইগুহার ভিতর থেকে কি ভালো মিষ্টি ফুলের গন্ধ। ঠাণ্ডা পরিবেশ আবেশে সকল ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। গোরাচাঁদ একটা মসৃণ চ্যাটালো পাথরের উপর পা মেলে শুয়ে পড়লেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের ঘুম দু চোখে নেমে এলো।    

0 comments: