0

গল্প - স্বরাজ চট্টোপাধ্যায়

Posted in

গল্প


আমিও  –উপলের কথা
স্বরাজ চট্টোপাধ্যায়



ছুটির দিন। সন্ধ্যা হয় হয়। বছরের এই সময়, দিনটা দ্রুত ছোটো হয়ে আসে।

অনিমেষের অবশ্য দৈনিকই ছুটি। আট বছর আগে স্বেচ্ছা অবসর নেওয়ার পর থেকে দিন দিন বুড়িয়ে যাচ্ছে। চন্দনা বলে - তখন কত করে বারণ করলাম, ভি আর এস নিওনা! নিওনা! এখন এই বাহান্নতেই বাহাত্তুরে ধরেছে! আসলে তেতাল্লিশেও আঁটোসাটো চন্দনার বুড়োটে অনিমেষকে বর বলতে লজ্জা করছে।

তিনতলার পশ্চিমের বারান্দায় এই আশ্বিনে সুখ নেই। চন্দনা রান্নাঘরে কালীপদকে কি যেন বলছে। এমন সময় একটা হলুদ ট্যাক্সি নিচে এসে দাঁড়াল। আবাসনে আড়াইশো ফ্ল্যাটে এখন শ’খানেক গাড়ি বা বাইক। তা ছাড়া App cab থাকতে হলুদ ট্যাক্সি? কে রে বাবা! 

মিনিট দুয়েক পরেই ডোর বেলে পাখির কিচিরমিচির। অনিমেষ উঠতে যাচ্ছিল। তার আগেই কালীপদ বিরস মুখে এসে বলল --স্যার একজন দিদিমনি এয়েছেন, আপনাকে খুঁজছেন। বছর সতেরোর কালীপদ চন্দনার আবিষ্কার। কালোর ওপরে বেশ স্বাস্থ্যবান। চন্দনা বেশ ধোপদুরস্ত রাখে। 

বাইরের দরজায় বছর ২৫\২৬ এর এক ছিপছিপে তরুণী। কাটা কাটা শ্যামলা মুখে সপ্রতিভ দৃষ্টি। কিন্তু দিদিমনি তো একলা নন, পেছনে ৩০\৩২ এর একটি পাতলা রুগ্ন চেহারার যুবক। চোখের দৃষ্টিতে কিছুটা যেন বিপন্ন ভাব।

---কে বাবা তোমরা? এই ভর সন্ধ্যায়? - চোখে এরকম একটা দৃষ্টি নিয়ে অনিমেষ ইতস্তত... তার আগেই ---'এই! এসো!' বলে মেয়েটি ঘরে ঢুকে ঢিপ করে একটা প্রণাম! ---আপনি আমাকে চিনবেন না। আপনি অনিমেষ কাকু তো? আমি অলকানন্দা। উপল কে চিনতে পারছেন?

উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টির ছেলেটিকে সাবধানে জরিপ করে অনিমেষ বিভ্রান্ত। ঠগ জোচ্চোর নয়তো? আজকাল তো অনেক...! 

ইতিমধ্যেই চন্দনার প্রবেশ। ওর সন্ধ্যার সাজগোজ সারা। সোফা থেকে উঠে আবার একটি 'ঢিপ'!

---কাকিমা! আপনি নিশ্চয়ই চিনেছেন। উপলকে তো আপনি খুউব ভালোবাসতেন! অবশ্য পনেরো বছর হয়ে গেল। ভুলেও যেতে পারেন! 

---মেয়েটা খুব চোখে মুখে কথা বলেতো! -অনিমেষ ভাবে।

--কাকু! আপনি রাগ করছেন নাতো? আমি একটু বাচাল আছি! অলকানন্দা হাসে। ---আপনাদের অফিসের সত্যেন মজুমদার, ঐ যে সামনের বিল্ডিংটা,আপনার বারান্দার ঠিক মুখোমুখি ফ্ল্যাটটাতে থাকতেন, উনি আমার শ্বশুর মশায়, মানে উপলের বাবা। 

অনিমেষ একটু চমকে ওঠে --ওঃ হো! তোমরা সত্যেনদার...! উপল... মানে বুবলাই না? তখন কতো ছোটো ছিলে! 

----ছোটো না কাকু! ছোটো না। উপল এখান থেকেই আই এস সি পরীক্ষা দিয়ে...!

----হ্যাঁ আমি তখন ওরিশার বারিপাদায়। তোমাদের কাকিমা একা থাকত, আমি দু সপ্তাহে একবার। তারপরই সত্যেনদা বাগুইআটিতে বাড়ি করে. ..।

চন্দনা এতক্ষণ তার স্বভাববিরুদ্ধ আড়ষ্ট হয়ে সোফায় বসেছিল। মুখটা একটু ফ্যাকাসে, বিব্রত। সেটা কাটাতে যেন কালীপদকে ডাকল।

---কালীপদ, ফ্রাইগুলো ভেজে ফেল। এখুনি টুবলু টিউশন থেকে ফিরে আসবে। এঁদের জন্য... তোমরা চা খাবে তো? এতক্ষণে অলকানন্দার সাথে কথা বলে।

----হ্যাঁ কাকিমা! আপনি যা খাওয়াবেন তাই খাব। উপলকে তো আপনি আদর করে কত কিছু খাওয়াতেন! বুড়ো খোকাকে প্রায় কোলে নিয়ে, নিজে হাতে খাইয়ে, মুখ মুছিয়ে...!

কালী বিরস বদনে চলে যাচ্ছিল। ----চল আমিও যাচ্ছি বলে চন্দনা উঠে পরে। 

---তোমরা এতদিন পরে? এদিকে কোথাও এসেছিলে? সত্যেনদা কেমন আছে রিটায়ার করে? সহজ ভাবে বলে অনিমেষ। 

----হ্যাঁ কাকু! বাবা ভালই আছেন। উপলকে ডাক্তার দেখাতে এসেছি এই বড় নতুন প্রাইভেট হাসপাতালে।

----কি হয়েছে ওর? অনিমেষ অলকানন্দার হাতের বড় প্লাস্টিক থলি টি লক্ষ্য করে।

----আর বলবেন না। অলকানন্দা থলি থেকে একগোছা কাগজ বের করে এগিয়ে দেয়। অনিমেষ কিছুটা ইতস্তত করে কম্পিউটারে ছাপানো প্রেসক্রিপশনে চোখ বোলায়। বিলেতের ডিগ্রিধারিনী এক মহিলা মনোবিদ। বাঁদিকে ডায়াগোনিসিস-এ লেখা HSDD++ Out of ISD +++Per DSM-5 Since দেড় বছর আগের একটা মাস। ডান দিকে 1, 2, করে পাঁচটা ওষুধ, একটা অনিমেষ চেনে। কড়া অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট। 6 নম্বরে লেখা – কাউন্সেলিং টু কন্টিনিউ। নেক্সট সীটিং আফটার ফোর উইকস্, উইথ প্রায়র অ্যাপয়েন্টমেন্ট অর এস. ও.এস.।

অনিমেষ কাগজ ফিরিয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে দুজনের দিকে তাকায়। উপল ভাবলেশহীন। একটু অস্থির হয়ে আঙুল দিয়ে সোফার হাতলে টোকা মারছে।

অলকানন্দা কাগজ ব্যাগে ভরে বলে ---'উপল তো এম. এ পাশ করেই ব্যাঙ্ক-এ পি. ও হয়ে ঢুকেছিল, জানেনতো! ছ বছর চাকরী করে বাবুর এই পেঁচীকে বিয়ে করার সময় হল। অ্যারেঞ্জড বিয়ে। ...ওর বোধ হয় আমাকে পছন্দ হয়নি, জানেন! 

কালীপদর হাতে ফিস ফ্রাই এর ট্রে, পেছনে চন্দনা। অলকানন্দা বলে চলে...

----ওর বোধ হয় আমাকে পছন্দ হয়নি! বিয়ের পর থেকেই কেমন আনমনা। একা থাকতে ভালোবাসে, যখন তখন অফিস কামাই। একবার তো কাউকে না বলে ওর পুরোনো জায়গা বালুরঘাট গিয়ে মাসখানেক বসে রইলো। শেষে অফিস বন্ধ। উপলের বাড়ি থেকে আমাকেই দোষ দিচ্ছে।

চন্দনার আড়ষ্ট ভাব বেড়েই চলেছে। উপলের নির্বাক অস্থিরতাও।

----আমার এক দাদা এই ডাক্তারের খবর দিল। উনি দেখে অনেক কথা বলে, কটা পরীক্ষা করে শেষে এই ডায়াগোনিসিস করলেন। Hypoactive Sexual Desire Disorder কারণ Inhibited Sexual Desire।

অবলীলায় বলে গেল অলকানন্দা। ---একবছর কাউন্সেলিং চলছে। আজ ডাক্তার ম্যাম সীটিং-এর শেষে বললেন ওর পুরোনো জায়গাগুলোতে নিয়ে যেতে। এতে নাকি কাজ হবে। তাই প্রথমেই এখানে এলাম।

ফিস ফ্রাই-এ কামড় দিল অলকানন্দা। উপল দু’হাত জড়ো করে সামনের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে।

----চন্দনা প্রায় কাঠের মত শক্ত। অনিমেষ চাটা শেষ করে উঠল।

----তোমরা একটু কথা বল, আমার সিগারেট ফুরিয়েছে। মোড় থেকে আসছি।

---চন্দনার মুখ পাংশু। অলকানন্দা তার কাছ ঘেঁষে হিস হিস করে বলল ----'কাকিমা বলব না জানোয়ার! নিন ফ্রাইটা উপলকে নিজে হাতে খাইয়ে দিন, আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে, জামা টামা খুলে দিন! সেই আই এস সি পরীক্ষার পর দৈনিক দুপুরে যেমন করতেন! আমি নাহয় বারান্দায় বসি. ...কাকু আর আপনার ছেলে আসার আগেই সব সেরে ফেলুন!'

চন্দনার মুখ প্রায় বুকে ঠেকেছে।

----আপনাকে কাকিমা বলতে ঘেন্না লাগে! চল উপল, আমরা এবার উঠি।

এতক্ষণে উপলের চোখে যেন একটা রাগ, লোভ, কষ্ট মেশানো দৃষ্টি ফিরে এল। সে চন্দনার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। উপলের হাত ধরে তুলে অলকানন্দা বলল ---আসি মিসেস রায়। আবার আসব। আসতেই হবে! 

ক মিনিট পর অনিমেষ ফিরে বলে ---ওরা কোথায়?'

----চলে গেছে। আবার আসবে।

পর্দার আড়াল থেকে কালীপদ বেড়িয়ে এল... ঠোঁটে এক চিলতে হাসি নিয়ে।

0 comments: