ধারাবাহিক - সোমঙ্কর লাহিড়ী
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
পায়ের শব্দ
সোমঙ্কর লাহিড়ী
১৫
একটা শব্দ অনেক ঘণ্টা একসাথে বাজিয়ে দিতে পারে সেটা পরেশ সামন্ত বুঝতে পারলেন। পূর্ণবাবুর সাথে ওনার এজেন্সি শুরু করার এক সপ্তার মধ্যে আলাপ। সামান্য কাজ চাইতে এসেছিল তার অফিসে। আহেরীটোলায় এক বড় ফ্যামেলীর অকেজো ছেলে। বারোভূতের বাড়িতে একটা খুপরি ঘরে একাই থাকত। আর দিনের শেষে একটাই দোষ ছিল, চোলাই খাওয়া। ধীরে ধীরে কাজের ধরনটা বুঝে নিয়েছিল। আর সেই মতো বুঝেশুঝে কাজটাও করত বেশ ঠাণ্ডা মাথায়।
দীর্ঘ সময় একসাথে থাকার ফলে পরেশ সামন্তর একটু মায়াও পরে গেছিল পূর্ণবাবুর উপরে। সেই লোককে কে মারতে পারে বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিল না সামন্তর। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছিল না যে কি করে লোকটা পূর্ণবাবুকে চিনে ফেলে একেবারে জানে মেরে দিল।
রাতে ড্রাইভার নেই তাই ছেলেকেই বললেন গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যেতে। নিজে পিছনের সিটে বসে নিজ্জের মেল খুলে দেখলেন যে মিমি তার মেলে ফোটশপ করা ছবিগুলো পাঠিয়ে দিয়েছে।
বেলঘরিয়া থানায় পৌছে আই সির কাছে নিজের পরিচয় দেওয়ার পরে তিনি একটু অবজ্ঞার চোখে তাকালেন পরেশ সামন্তর দিকে, কার্ডটা দেখে ফিরত দিয়ে বললেন, প্রাইভাট টিকটিকি।
এগুলো পরেশ সামন্তর কাছে নতুন কিছু নয়, উর্দির রোয়াব একটা থাকবেই। তারপরে পরেশ সামন্তকে উনি প্রশ্ন করা শুরু করতেই সামন্ত বললেন,
আমি ফোর্সে ছিলাম, তাই এই সব স্ট্যান্ডার্ড ফ্রম্যালিটি শুরু না করে যদি স্ট্রেট কেসের ব্যাপারে আমরা কথা বলি তাতে নিশ্চয়ই আপনার আপত্তি হবে না?
আপনি ফোর্সে ছিলেন? শখের গোয়েন্দা নন?
দেখুন মিঃ মুখার্জী যিনি মারা গেছেন তিনি আমার অত্যন্ত আস্থাভাজন একজন মানুষ ছিলেন। ওনার ডিটেলস আপনাকে আমি পরে দিচ্ছি। কিন্তু আমি আপনাকে একটা ব্যাপারে আমি বলতে চাইছি যে এই মুহূর্তে আমরা বোধ হয় একটা মার্ডারের চেয়েও অনেক বড়ো একটা ব্যাপার নিয়ে ডিল করতে চলেছি।
সার্ভিসের এক্স শুনে আর পরেশ সামন্তের বলার ধরন দেখে উনি বুঝলেন যে ব্যাপার সিরিয়াস। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বললেন,
চা খাবেন?
হ্যাঁ।
চা এলো, আই সি পঙ্কজ মুখার্জী সিগারেট ধরিয়ে বললেন,
এবার বলুন।
প্রায় আধ ঘণ্টা দুজনে পুরো ব্যাপারটা মন দিয়ে আলোচনা করলেন, শেষে সামন্ত বললেন,
এই দেখুন আমার মেলে আজকে সকালে যে ভাবে আমার অফিসে এসেছিল লোকটা সেই ছবি, আর সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে নেওয়া ছবিকে ফোটো শপ করে যা চেহারা পাওয়া গেছে তার নমুনা।
পঙ্কজ মুখার্জী ওনার মোবাইলে সব ছবি দেখে বললেন,
বাহ, চেহারা তো পেয়েই গেছি, তাহলে সব থানায় পাঠিয়ে দিই। কি বলেন?
সেটাতো আপনি করে দিতেই পারেন, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে কাল সকালে লোকটা যে দুটো কাজ আমাকে দিয়ে করিয়েছিল, সেই কেস দুটো আগে আমাদের বা আমার নিজের একটু দেখার দরকার। তাহলে কনফর্ম হতে পারব যে পুর্নবাবুর খুনের পিছনেও এই লোকই রয়েছে। আর একটা রিকোয়েস্ট, পোষ্ট মর্টেম রিপোর্টে কি পেলেন সেটা যদি একটু আন অফিসিয়ালি আমায় জানান তো খুব ভালো হয়।
মুখার্জী তাকে আস্বস্ত করলেন।
পরেশ সামন্ত বাড়ি ফিরে যখন শুতে যাবেন তখন দেখলেন ভোর হব হব করছে।
এজেন্সি থেকে বেরিয়েই সঞ্জয়ের মনে হল কিছু একটা ভুল হয়ে গেছে তার। কিন্তু কি ভুল সেটা মনে করতে পারছে না। ভেতরের খচখানিটাও যেতে চাইছে না। কি ভুল কি ভুল, খালি একই প্রশ্ন মনের মধ্যে কাঁঠালের মাছির মতো ঘুরে ফিরে আসছে। সঞ্জয় একটা চায়ের দোকানে ঢুকে চা নিয়ে বসে ভাবতে লাগল ভুলটা কোথায় করে ফেলেছে।
প্রায় দু কাপ চা খাওয়ার পরে সে বুঝতে পারল একসাথে তার কনট্যাক্ট ডিটেলস আর ফোন নম্বর দুটোই সে দিয়ে ফেলেছে কথা বলতে বলতে। যদিও দুটোই ভুয়ো। কিন্তু যদি ফোন করে? বা লোক পাঠায়? কিন্তু সেটাই বা করতে যাবে কেন? ও এজেন্সিকে একটা কাজ দিয়েছে, ডিটেলস ও দিয়েছে, তিনদিন বাদে একবার এসে জিজ্ঞাসা করে যাবে নিজে, যে কিছু খবর হল কি না। আর পাঁচদিন বাদে তো এজেন্সি নিজেই তাকে আসতে বলেছে। তাহলে এরমধ্যে ফোন করার কোন দরকার তো নেই এজেন্সির। আর ফোন করলেও তো সুইচড অফ পাবে। তাহলেও তো কোন প্রবলেম নেই। এইসব ভাবতে ভাবতে চায়ের দোকান থেকে বেরনর সময় একটা বেরিয়ে থাকা চেয়ারে হোঁচট খেল সঞ্জয় আর তারজন্যে খানেকটা পথ তাকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হল। আর সেই হাঁটা তাকে মনে করিয়ে দিল সে যখন সামন্তর চেম্বারে ঢুকেছিল নিজেকে বয়স্ক দেখানর জন্য বেশ খানেকটা পা ফা টেনে হেঁটেছিল। আর কাজটা হয়ে গিয়ে বেরনর সময় সোজা হেঁটে বেরিয়েছিল। নিজেকে গালি দিতে ইচ্ছে করছিল সঞ্জয়ের।
সে কি করে এই ভুলটা করে বসল। গেছিল একটা ডিটেকটিভ এজেন্সিতে সেখানকার মালিক আর যাই হোক মাথামোটা হবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। এখন দেখার সেই সামন্ত লোকটা তার এই হাঁটা ব্যাপারটা খেয়াল করেছে কি না। তারপরেই মনে হল ফী এর ব্যাপারটা। এবারে সঞ্জয় বুঝল তার আজ পরের পর ভুল হয়েছে। আর এই ভুলগুলো যদি কোনো ডিটেকটিভ এজেন্সি ধরতে না পারে তবে তারা ঐ কাজটাও করতে পারবে না। কারণ সঞ্জয়ের এবারে শিকার বেশ ঘুঘুমাল। আর টাকাটাও নেহাত কম পাচ্ছে না তার জন্য।
এখন শুধু দেখতে হবে এজেন্সি তার উপরে কোনো গোয়েন্দাগিরি করছে কিনা। যে নম্বরটা দিয়েছিল সেই সিমটা ফোনে দিয়ে অন করে রাখল, যদি ফোন করে তবে যাতে সন্দেহ না হয়। তারপরে ফিরতি পথে একটা শপিং মলের ওয়াসরুমে ঢুকে নিজের উইগ খুলে স্বাভাবিক রুপে ফিরল। তারপরে যে ঠিকানা দিয়েছিল সেই খাটালের ঢোকার গলির মুখে একটা চায়ের দোকানে ঘাপটি মেরে বসে রইল কেউ খোঁজে আসে কিনা দেখতে।
একটা অতি সাধারণ চেহারার লোক এসে চায়ের দোকান ঠিকানাটা যখন জিজ্ঞাসা করল সঞ্জয় বুঝে গেল এটা নির্ঘাত এজেন্সির টিকটিকি। কারণ যে ঠিকানা চায়ের দোকানের মালিক জানে না সেই রাস্তার বাসিন্দা হয়ে সেই ঠিকানা আনকা একটা লোক এসে খুঁজবে এর থেকে দুয়ে দুয়ে চার করতে বেশী বুদ্ধি বা সময় দুটোর কোনটাই লাগে না।
সঞ্জয় নিশ্চিন্ত হল যে এই লোক তাকে চিনতে পারবে না কারণ সে এখন একেবারে সাধারণ পোষাকে, সকালের সেই শুড্ডা বুড়োটা এখন হাওয়া। সে নিজেই বলল,
এই গলির ভেতরে ঢুকে যান দুটো ডান হাতি বাঁকের পরেই দেখতে পাবেন, গোলাপী দেওয়াল আর সবুজ দরজা। কিন্তু ওটা তো একটা খাটাল, ওখানে কাকে খুঁজছেন?
চায়ের দোকানের লোকটা উৎসাহ নিয়ে তাকাল, লোকটা বলল,
অফিস থেকে পাঠিয়েছে একটু দরকার আছে।
চায়ের দোকানের লোকটা একটু ব্যাঙ্গ করে বলল,
গরুদের আধার হবে বলে শুনেছি সেই ব্যাপারে?
লোকটা কোন উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেল।
সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে চায়ের দোকানের লোকটা এমন ভাব করল যেন বিরাট একটা ইয়ার্কি করেছে। সঞ্জয় একটু হেসে চায়ের দাম মিটিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে চেলে গেল। লোকটাকে এই পথেই ফিরতে হবে।
হিসেবমতো লোকটা ফিরল ঐ পথ ধরেই। লোকটা কোনদিকে যায় সেটা দেখতে হবে তাই একটু দুরত্ব রেখে সঞ্জয় তার পিছনে পিছনে চলল।
লোকটা বাস রাস্তার দিকে না গিয়ে যখন রেল লাইনের দিকে চলল, তখন সঞ্জয়ের একটু ধন্দ লেগেছিল, মালটা যাবে কোথায়, কিন্তু যখন লাইনের ধারে চোলায়ের ঠেকের দিকে গেল, ও নিশ্চিন্ত হল। শুধু একটা ব্যাপার খটকা র্যেই গেল, লোকটা মোবাইলে অফিসে ফোন করে দেয়নি তো?
রেল লাইনের পাথরের ঘা কপালের মাঝখানে মারার আগেই সঞ্জয় লোকটার শার্টের পকেটে বা প্যান্টের পকেটে মোবাইল নেই সেটা দেখে নিয়েছিল। কিন্তু লোকটার চোখের আতঙ্কটা দেখতে পাওয়ার পরেই সঞ্জয় বুঝতে পারল তার আর কিছু করার নেই, তাকে হাল্কা হতেই হবে না হলে মাথাটা বোধ হয় ফেটেই যাবে দপদপানিতে। অন্ধকার রেললাইন আর বোঁজা খালের মাঝে যে নির্জনতা পাওয়া যাবে সেটা সঞ্জয় ভাবতেও পারেনি। রোগা লোকটার উপরে যখন সে নিজেকে হালকা করতে পারল তখনও লোকটার পা দুটো ঝটকাচ্ছিল। মাথায় শেষ আঘাতটা করার পরে যখন নিজের মাথাটা শান্ত হল তখন বুঝল আপাতত কালকের মধ্যেই এই বাড়ি ছাড়তে হবে। সাবধানের মার নেই। গণেশকে ফোন করে বলল,
গণেশদা দেখা করতে হবে যে কাল সকালে।
ফোনের উল্টো দিকে গণেশের উত্তর শুনে এবারে ঠিকানাটা নিজেই জানাল গণেশকে।
বাড়ি ফিরে সেই মায়ের ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে শুনতে মনে হল, এবারে তার নিজের হিসেব বরাবর করার সময় এসেছে।
যে লোকটা তাকে তার জীবনের অন্ধকারতম অধ্যায়ের ঠিকানা দিয়েছে সেই জানিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে যে কে তার এই হীন জীবনের জন্য দায়ী। লোকটা সব কিছু তাকে বলে গেছে। কি কি করলে সে আবার ফিরে পাবে তার হারিয়ে যাওয়া জীবন সেটার হদিস ও সেই লোকটা দিয়ে গেছে। এখন দিনকতক তার মাকে একটা নার্স বা আয়ার জিম্মায় রেখে দিয়ে তাকে প্রতিশোধ নিতে হবে।
হাতে এখন অনেক টাকা। আর মনে এখন অনেক রাগ। আর অনেক না মেলা অঙ্ক যেগুলোকে মেলাতে পারলেই সে পাবে তার গৌরবের জীবন।
0 comments: