0

ভৌতবাক - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in

ভৌতবাক


শেষ কাজ
দীপারুণ ভট্টাচার্য 



ঘড়ি যদিও বলছে দুপুর দু'টো কিন্তু চারপাশের পরিবেশ দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই। আকাশ অন্ধকার, ঝির ঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে এক নাগাড়ে আর তার সঙ্গে চলছে হাওয়া। মনে হচ্ছে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। পুষ্কর সরোবরের কোটা ঘাটে এই অকাল সন্ধেবেলা বসে আছে এই ঘাটেরই পাণ্ডা বিনোদ বিহারী ভট্টাচার্য এবং তার ভাইপো সুকুমার। যদিও ভাইপো বলছি যাকে সেই সুকুমারের সঙ্গে বিনোদ বিহারীরির কোন রক্তের সম্পর্ক নেই। বিনোদ বিহারীরা কয়েক পুরুষ ধরে এই পুষ্কর তীর্থের বাঙালি পান্ডা। বহু দিন আগে কোটা’র মহারাজ বিনোদ বিহারীর বৃদ্ধ প্রপিতামহ নিত্যানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়কে এখানে কাজে লাগিয়েছিলেন। তখন থেকেই চলে আসছে এই পারিবারিক পেশা। তবে এখন এই কাজে নতুন প্রজন্মের ছেলেদের বিশেষ উৎসাহ নেই। তাই বিনোদ বিহারী আর তার স্ত্রী ছায়াই এখন পুষ্করে থাকেন। তাদের বাকি আত্মীয় স্বজন সকলেই বাইরে। কেউ জয়পুর আবার কেউ থাকে নতুন দিল্লিতে। অবসর সময়ে নিঃসন্তান বিনোদ বিহারী পরিবারের এসব কথাই চিন্তা করতো। আর প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে প্রার্থনা করতো যেন তিনি পুষ্কর তীর্থকে বাঙালি পান্ডা শুন্য না করে দেন। 

প্রজাপতি ব্রহ্মা হয়তো শুনেছিলেন বিনোদ বিহারীর এই প্রার্থনা। তাই একদিন খুব ভোরের ট্রেনে জয়পুর যাওয়ার সময় তার স্ত্রী ছায়া কাপড়ে জড়ান অবস্থায় সুকুমার কে আবিষ্কার করে। “কি নিষ্ঠুর মানুষ, দুধের শিশুকে এমন ভাবে কেউ ফেলে যায়!” চিৎকার করে উঠেছিল ছায়া। প্রথমে বিনোদ বিহারী ভেবেছিল শিশুটি নিশ্চয়ই মেয়ে। কন্যা শিশুর জন্মকে এদেশে অনেকেই ভাল চোখে দেখে না। কিন্তু যখন বিনোদ বিহারী বুঝল শিশুটি ছেলে তখন সে শতকোটি প্রণাম জানিয়েছিল ঈশ্বরকে। শিশুটিকে ব্রহ্মার মানস পুত্র হিসাবেই মেনে নিয়েছিল বিনোদ ও ছায়া। নাম দিয়েছিল সুকুমার। স্নেহ আর মমতা দিয়ে তাকে মানুষ করেছে তারা। সমাজে পরিচয় দিয়েছে ভাইপো হিসাবে। যেন কেউ তাকে কুড়িয়ে পাওয়া সন্তান হিসাবে তাড়িয়ে না দেয় এই পেশা থেকে। প্রাণ ঢেলে সুকুমারকে সব কাজ শিখিয়েছে বিনোদ বিহারী। বলেছে, “নিজের সব টুকু ব্রহ্মাকে নিবেদন কর। তাহলেই তিনি যজমানের প্রার্থনাও তোর হাতে গ্রহণ করবেন”। পৃথিবীতে পুষ্করই এক মাত্র স্থান যেখানে প্রজাপতি ব্রহ্মার পুজো হয়। মন্দিরের সামনে বিশাল পবিত্র পুষ্কর সরোবর। আর এই সরোবরকে ঘিরে রয়েছে বাহান্নটি ঘাট। সেখানে স্নান যেমন হয় তেমন হয় পূজাপাঠ এবং পিণ্ড দানের কাজ।

আজ অবশ্য কেউ আসেনি কোন কাজ নিয়ে। ক্ষতি নেই, এক একদিন এমন হয়। বৃষ্টির তেজ এমনই যে মোটর সাইকেল চেপে বাড়ি যাওয়াও সম্ভব নয়। কাজেই ছাওনির নিচে ঘাটের সিঁড়ি উপর বসে গল্প করছিল তারা। খুবই তুচ্ছ সেই কথাবার্তা। ঘাট আজ একেবারেই জনবিরল। সাধারণত বাঙালি যজমানরা খুঁজে খুঁজে আসেন এই ঘাটে। বিনোদ বিহারীর কাছে অনেক পুরনো খাতাপত্র আছে। বহুবছর আগে পিণ্ড দেওয়া হয়েছে এমন পূর্ব পুরুষদের নাম এই খাতায় দেখতে পেয়ে অনেকে প্রসন্ন হয়ে বেশি বেশি দক্ষিণা দিয়ে থাকেন। বিষয়টা বিনোদ বিহারীকে বেশ তৃপ্তি দেয়। 

দুজনের কথার মধ্যে হঠাৎ সঞ্জয় এসে উপস্থিত হল। সঞ্জয় স্থানীয় এক হোটেলের বাঙালি কর্মী। সঞ্জয়কে দেখে বিনোদ বিহারী বলল, "কি রে এই বৃষ্টিতে, কি মনে করে?"

-"আর বলবেন না ভট্টাচার্য মশাই, আমাদের হোটেলে কোলকাতা থেকে এক বাঙালি পরিবার এসেছে বাবার পিণ্ড দিতে। ভদ্রলোকের মায়ের অবস্থা ভালো নয়। তিনি নাকি ঘরে একা থাকলেই তার মৃত স্বামীকে দেখতে পাচ্ছেন। মৃত আত্মা নাকি পুষ্কর ধামেই পিণ্ড চাইছে।"

-"তা, সঙ্গে করে নিয়ে এলেই পারতিস। কাজ সেরে দিতাম।"

-"ছেলেটা বৃষ্টির মধ্যে আসতে কিছুতেই রাজি হল না। আপনি কি ফেরার পথে হোটেলে এসে একবার কথা বলে যাবেন। তাহলে কাল সকাল সকাল নিয়ে আসবো।"

বিনোদ বিহারীর মুখে একটা প্রসন্ন ভাব ফুটে উঠল, "ঠিক আছে তুই যা। আমি ফেরার পথে দেখা করে যাবো।" সঞ্জয় যেমন এসেছিল ঠিক তেমন ভাবেই বৃষ্টির মধ্যে মিলিয়ে গেল।

সঞ্জয় চলে যেতেই সুকুমার প্রশ্ন করলো, "কাকা, এমন হয় নাকি, মৃত মানুষ কি পিণ্ডের জন্য স্বপ্নে দেখা দেয়?”

বৃষ্টি ভেজা আকাশের দিকে একটু তাকিয়ে থেকে বিনোদ বিহারীর বলল, “কিছুই অসম্ভব নয় রে। মাদ্রাজে মন্মথবাবুর বাড়িতে স্বয়ং বিবেকানন্দের সঙ্গেও এমন একটি ঘটনা হয়েছিল। প্রেতাত্মারা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইতো। তাদের কথা শুনে বিবেকানন্দ বুঝতে পারেন তারা মুক্তি চাইছে। কিন্তু তখন তাঁর নিজের খাওয়ার পয়সা নেই। পিণ্ড সামগ্রী কিনবেন কিভাবে। তাই বালি দিয়েই পিণ্ড দিয়েছিলেন”। একটু থেমে বিনোদ বিহারী বললেন, “ভক্তিটাই বড় কথা বুঝলি। পিণ্ডদানের সময় যজমানের বাবা মা কে নিজের বাবা মা ভেবে কাজ করতে হয়। তবেই সেটা আত্মা গ্রহণ করেন। বিশ্বাস ছাড়া লোকাচার অর্থহীন”। একটা পান মুখে দেয় বিনোদ বিহারী। তারপর আবার বলতে থাকে, “কাজ সঠিক হলে আত্মা যেমন যজমানকে আশীর্বাদ করেন তেমন আমাদেরও করেন”।

একটু নড়ে বসে সুকুমার; প্রশ্ন করে, “এই আশীর্বাদ তুমি কি বুঝতে পারো?”

-“মাঝে মাঝে পারি। কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলাম, উঁচু টিলার উপর একটা ছোট্ট মন্দির। আমি মন্দিরের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেছি। মেঝের উপর পুজারি শুয়ে আছেন। তাকে ডাকতে গিয়ে দেখলাম, দেহে প্রাণ নেই। আর তখনই কে যেন বলল, আমায় মুক্তি দে। স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেল। তখন থেকেই মনের মধ্যে কেমন যেন করছিল। এখন সঞ্জয়ের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টা পরিষ্কার হল। হতেও তো পারে, সঞ্জয় যার কথা বলে গেল সেই আসলে আমার স্বপ্নে দেখা পুজারির”।

-“তুমি কি যে বলো না কাকা, কোলকাতায় উঁচু টিলা আর তার উপর মন্দির।”

একটু হাসে বিনোদ বিহারী, “সব মিলবে এমন তো নয়! তাছাড়া উঁচুটা তো তিনি শিক্ষায়, ভক্তিতে বা অন্য কোন গুনেও হতে পারেন, না কি? নইলে বউ ছেলে এতদূর আসবে কেন? কোলকাতার কজন গয়া ছেড়ে পুষ্করে আসেন, বল”।

একটু দমে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুকুমার। বিনোদ বিহারী আবার বলেন, “অন্ধ যেমন পথ দেখতে পারে না, তেমন কোন কোন আত্মাও পথ খুঁজে পায় না। তখন সে সহানুভূতিশীল একজনের খোঁজ করে। যে তাকে পথ দেখাবে।“

-“এই খোঁজ কি শুধু স্বপ্নের মধ্যেই হয় নাকি?”

সুকুমারের প্রশ্নের শেষ নেই। দুই ঢোক জল খেয়ে বিনোদ বিহারী বলে, " তা কেন, বাস্তব জীবনে এসেও তারা সাহায্য প্রার্থনা করে। আমরা সব সময় তাদের চিনতে পারিনা।"

-“কি বলছ কাকা! তার মানে মানুষের বেশে ভুতরাও চলে ফিরে বেড়াচ্ছে আমাদের সমাজে? কিন্তু, তাদের চেনার উপায় কি?” 

-"একটা ঘটনা বলি শোন। বিষয়টা প্রায় বছর ত্রিশ আগের। তখন তিলরা বাজারে স্বপন মাহেশ্বরীর দোকানে রাজু নামে, বছর পনেরোর একটা ছেলে কাজ করতো। ছেলেটাকে স্বপন খুবই ভালবাসতো। বৃদ্ধ স্বপন মাহেশ্বরীর সাত কূলে কেউ ছিলনা। বাজারের মধ্যেই ছিল তার দোতলা বাড়ি। তারই এক তলার দুটো ঘরে ছিল দোকান। এই রাজুই ছিল মাহেশ্বরীর একমাত্র সম্বল। সে ভেবেছিল গঙ্গা প্রাপ্তির আগে রাজুকেই সব কিছু দিয়ে যাবে। এ কথা মাহেশ্বরী নিজেই আমাকে বলেছিল। আমি তার দোকানে তখন মাঝে মধ্যে যেতাম। একদিন শুনলাম রাজু গাড়ীর ধাক্কায় মারা গেছে। এই ঘটনায় মাহেশ্বরী একেবারেই ভেঙ্গে পড়ল। যাই হোক, ঘটনার কয়েক মাস পরে এমনই এক বৃষ্টির সন্ধেবেলা মাহেশ্বরীর দোকানে গিয়ে দেখি একটা নতুন ছেলে কাজ করছে। ভারি ভালো লাগলো ছেলেটিকে দেখে। দেখলাম মাহেশ্বরীও খুব খুশি এই নতুন কর্মচারিকে পেয়ে। আমি হাসি মুখে প্রশ্ন করলাম, তোমার নাম কি বাবা? ছেলেটা আমার দিকে কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। তারপর সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেল।”

-“তারপর?”

-“বিষয়টাতে আমি আর মাহেশ্বরী দুজনেই অবাক হয়ে গেলাম। প্রশ্ন করলে মাহেশ্বরী বলল, ঘন্টা কয়েক আগে ছেলেটা নিজেই এসে বলেছে, সে দোকানে কাজ করতে চায়। মাহেশ্বরী অবশ্য তার নাম ধাম না শুনেই তাকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সে কিছু না বলে এভাবে দোতলায় উঠে গেল কেন? এরপর আমি আর মাহেশ্বরী দোতলার সব ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে ও ছেলেটাকে পেলাম না। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না”।

-“পাওয়া গেল না মানে; সে গেল কোথায়?”

-“মানুষ হলে তো পাওয়া যাবে! কেউ কোন দিন তাকে খোঁজ করতেও আসেনি।“

-“তাহলে হলটা কি?”

-“আসলে কি জানিস, ভূতেরা মিথ্যা বলতে পারে না। তাই তারা নিজেদের নাম বলতে চায় না। বলতে গেলেই নিজের নামের আগে চন্দ্রবিন্দু বেরিয়ে যাবে কি না। মনে হয় এই ভয়েই ছেলেটা সেদিন পিঠটান দিয়েছিল”।

একজনের কাশির শব্দে সম্বিত ফিরে পেল দুজনেই। লোকটা কখন যে এসে তাদের পিছনে বসেছে, তারা বুঝতে পারেনি। বয়েস চল্লিশ ও হতে পারে আবার পঞ্চাশ ও হতে পারে। চোখে একটা ভারী কাঁচের চশমা। শরীরটা আপদ মস্তক রেইন কোর্টে ঢাকা। লোকটি সম্পর্কে তেমন কিছু বোঝার উপায় নেই। আর একবার হালকা কেশে সে বাংলায় বলল, “বিনোদ বিহারী ভট্টাচার্য কি আপনিই?”

বিনোদ বিহারী হাত জোর করে নমস্কার করে বলল, “কি বিষয় বলুন?”

-“এক বন্ধুর পিণ্ড দিতে চাই। আপনি সাহায্য করবেন?”

-“কি যে বলেন, এটাই তো আমার কাজ। তা কি নাম আপনার বন্ধুর? গোত্র কি জানা আছে? তিন পুরুষের নাম? যেটুকু জানেন বলুন, বাকিটা ঈশ্বরের নামে, , ,”

কথা শেষ করার আগেই লোকটা ইশারায় পাশে সিঁড়ির উপর রাখা একটা খাতা দেখালেন, “এই খাতাতে সব লেখা আছে”।

বিনোদ বিহারী খাতাটা হাতে তুলে নিল। খাতার প্রথম পাতাতে নাম, গোত্র, তিন পুরুষের পরিচয়, কি কি দিয়ে পিণ্ড মাখতে হবে সব কিছু লেখা আছে। খাতার ভিতরে বেশ কয়েকটি টাকার নোটও রয়েছে। বিনোদ বিহারী লোকটার দিকে চোখ তুলতেই সে বলল, ”এই টাকাতে কাজটা হয়ে যাবে তো?”

-“নিশ্চয়ই হবে। আমি সামগ্রী জোগাড় করছি, আপনি ততক্ষণ সরোবরের জলে স্নান করে আসুন। তারপরেই কাজ শুরু করবো”।

-“আমি খুব অসুস্থ, আমার পক্ষে একাজ সম্ভব নয়”; লোকটা যেন ঝিমোচ্ছে।

-“তাহলে কে করবে এই কাজ?”

-“আপনি আর আপনার ছেলেই করে দিন না। বড় উপকার হয়”।

সাধারণত বিনোদ বিহারী কাউকেই ‘না’ বলে না। শেষ কাজে, না বলতে নেই। সে আর একবার খাতাটার উপর চোখ দেয়, মৃতের নাম গোপাল মজুমদার, বাৎস গোত্র। পরিবার পরিচয় পড়তে পড়তে চোখ তুলে লোকটি কে বিনোদ বিহারী প্রশ্ন করল, “আপনার বন্ধুকি অগ্রদানী ব্রাহ্মণ ছিলেন?” লোকটি মাথা নেড়ে কিছু একটা বললেন বটে কিন্ত সেটা হ্যাঁ কি না, ঠিক বোঝা গেল না।“

সামগ্রী জোগাড় করে কিছুক্ষণের মধ্যেই বিনোদ বিহারী আর সুকুমার কাজ শুরু করল। সূর্য আজ সারাদিন আছেন মেঘের আড়ালে তবু সেই সূর্য কে সাক্ষী করেই শুরু হল পিণ্ড দানের কাজ। লোকটা সিঁড়িতে ঠিক একই ভাবে বসে দেখতে লাগলেন সেই কাজ।

যে কোন যজমানকে দিয়ে কাজ করাতে অনেকটা সময় লাগে। কেন না তাদের সবটা বলে বলে দিতে হয়। সুকুমার এখন বেশ কাজ শিখে ফেলেছে। বিনোদ বিহারী শুধু পড়ে পড়ে নাম বলছে বাকিটা করছে সুকুমার নিজেই। একবার চোখ তুলে লোকটিকে দেখল বিনোদ বিহারী। কেমন উদাস ভাবে চেয়ে আছেন সরোবরের দিকে। নিশ্চয়ই প্রিয় বন্ধুকে শেষ বিদায় জানাতে বেদনা হচ্ছে। বিনোদ বিহারী লোকটির বেদনা নিজে অনুভব করার চেষ্টা করে। আর মনে মনে লোকটির জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে প্রার্থনা করে।

দেখতে দেখতে কাজ শেষ হয়। নিয়ম হল, কাজের পরে পিণ্ড, দুধ, কলা সরোবরের জলে বিসর্জন দেওয়া। কখনও কখনও ধর্মের ষাঁড় কলা খেয়ে যায়। আজ বৃষ্টিতে তাদেরও দেখা নেই। কাজের শেষে বড় পাত্রে সরোবর থেকে জল এনে কাজের জায়গাটা ধুয়ে দিতে থাকে সুকুমার। খাতার মধ্যে বেশ অনেকটা টাকা। সামগ্রী কেনার পরেও অনেক টাকা রয়েছে। কিছু টাকা ব্রাহ্মণ সমিতিতে দান করার নিয়ম। সেইটুকু রেখে বাকি টাকা বিনোদ বিহারী ফিরিয়ে দেবে সিদ্ধান্ত নিল। এতে যদি অসুস্থ লোকটার চিকিৎসা হয় তবে মন্দ কি। এই ভেবে পিছন ঘুরে বিনোদ বিহারী দেখল লোকটি হাঁটতে হাঁটতে চলেছেন রাস্তার দিকে।

বিনোদ বিহারী তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উপরের বড় চাতালে উঠে এল। লোকটা ততক্ষণে ছাওনি পার করে বৃষ্টিতে নেমে পড়েছে। তার রেইন কোর্টের উপর শব্দ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। ডেকে উঠল বিনোদ বিহারী, “ও দাদা, আপনার বাকি টাকাটা নিয়ে যান।“ লোকটা পিছন না ঘুরেই বলল, “ওটা আপনার পারিশ্রমিক, রেখে দিন।

-“না না এটা আপনি নিয়ে যান, আপনার চিকিৎসার কাজে লাগবে”। কথাটা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা। কিন্তু পিছন ফিরলো না। শুধু বলল, “ধন্যবাদ; তার দরকার হবেনা।

অবাক হল বিনোদ বিহারী, এমন যজমান সে কোনদিন দেখেনি। শেষ কাজ শেষ করে লোকটা পিছন ফিরতেও রাজি নয়। পরম প্রশান্তিতে বিনোদ বিহারী বলল, “ভাল থাকবেন। আপনার নামটা জানতে পারলে খাতায় লিখে রাখতাম!”

কয়েক মুহূর্ত এই ভাবেই কেটে গেল। কোন উত্তর নেই। তারপর বৃষ্টি ধোয়া চাতালের উপর হঠাৎ খসে পড়ল একটা রেইন কোর্ট আর চশমা। না, তার ভিতরে কোন মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায় নি।

0 comments: