1

সম্পাদকীয়

Posted in






অনেকদিন পর্যন্ত দিনটির অস্তিত্ব সন্ধান করতে পঞ্জিকার সাহায্য নিতে হতো অথবা হালখাতায় পাওয়া বাংলা ক্যালেন্ডারের বৈশাখ মাসের এই তারিখটির তলায় দেওয়া থাকতো দিনটির বিশেষ তাৎপর্যের সূত্র। এইমাত্র।

সত্যি কথা বলতে কী, হিন্দু পুরাণের আরেক মহানায়ক কৃষ্ণের জন্মদিনটি বরং উদযাপিত হয়ে এসেছে অনেক বর্ণাঢ্যরূপে। সেই বিচারে রাম যেন ছিলেন একটু ব্রাত্য। অন্তত বঙ্গদেশে তো বটেই। সে অবশ্য প্রাক অযোধ্যাপর্বে। রাম তখনও রাজনীতির ধারালো হাতিয়ার হয়ে ওঠেননি। বড় জোর বাঙালি সমাজ ঈষৎ দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন মধুসূদন-রচিত 'মেঘনাদবধ কাব্য' নিয়ে, যেখানে মহাকাব্যের এই নায়ককে 'আপন মনের মাধুরী মিশায়ে' অন্য চেহারায় হাজির করেছিলেন বিরল গোত্রের সেই স্রষ্টা।

কিন্তু সে ছিল সম্পূর্ণ বৌদ্ধিক এক শ্রেণীবিভাজন, যা নিয়ে তর্কের তুফান উঠলেও কখনও শোনা যায়নি অস্ত্রের ঝনঝনা!

অযোধ্যাকান্ডের পর সুকুমারী ভট্টাচার্য শাণিত এক নিবন্ধে প্রশ্ন তুলেছিলেন, কোন রামরাজ্যের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা? সর্বতোভাবে তা কাঙ্খিত তো?

সেই লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর কেটে গেছে তিনটি দশক। ভারতবাসী হিসাবে নিজেকে এর চেয়ে বিপন্ন কখনও মনে হয়েছে কি? সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবৃক্ষটি সেদিন রোপিত হয়েছিল, আজ সেটি পূর্ণবয়স্ক। প্রতিনিয়ত এটি থেকে নির্গত দূষিত বাতাস গ্রাস করে নিচ্ছে সমগ্র চরাচর। রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে হাত ধরাধরি করে সেই কলুষমণ্ডলে শোভাযাত্রায় মগ্ন।

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর।

1 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in







আমাদের দেশের যে রাজ্যটি আয়তনের দিক থেকে বৃহত্তম তার নাম ‘রাজস্থান’। আর, এই রাজস্থানের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর হল ‘জয়পুর’। জয়পুরকে আমরা ডাকি ‘পিঙ্ক সিটি' বা ‘গোলাপী শহর’ বলে। কেন? ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় যে, ১৮৭৬ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলস এবং মহারাণী ভিক্টোরিয়ার আগমন উপলক্ষ্যে গোটা জয়পুর শহরকে ও সেখানকার বেশিরভাগ ভবন বা ইমারতগুলোকে আতিথেয়তার রং গোলাপীতে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন সেখানকার মহারাজ রাম সিং। লর্ড অ্যালবার্ট প্রথমবারের মতো জয়পুরকে ‘পিঙ্ক সিটি’ বা ‘গোলাপি শহর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। সেই থেকে জয়পুর আমাদের কাছে ‘গোলাপী শহর’ হিসেবে পরিচিত। বলা হয়, আজও এই গোলাপী ঐতিহ্যকে বজায় রাখা হয়েছে। পুরনো জয়পুরের সমস্ত বাড়ির রং আজও গোলাপী রঙের এবং নগরবাসীও আইনতভাবে এই গোলাপী রং করতে বাধ্য হয়। সে যাই হোক, এক ‘গোলাপী শহর’ যে আমাদের দেশে রয়েছে তা নিয়ে আমরা সবাই বেশ গর্বই অনুভব করে থাকি। কিন্তু, বহুদূরের দেশের একেবারে পশ্চিম প্রান্তের এই গোলাপী শহরকে কেন্দ্র করে দেশের প্রায় পূর্ব প্রান্তের বিশেষত আমাদের বাঙালিদের গর্বের পরিমাণটা বেশি থাকা উচিত। কেননা, এই জয়পুর শহরের স্থাপত্যনকশা করেছিলেন যে একজন বাংলার মানুষ তথা বাঙালি— বিদ্যাধর ভট্টাচার্য।

বিধাতা ভট্টাচার্য ১৭শ শতাব্দীর শেষভাগে ১৬৯৩ সালে এই বাংলার নৈহাটিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সন্তোষরাম ভট্টাচার্য। বিদ্যাধর ভট্টাচার্য সম্পর্কে জানা যায় যে, তিনি গণিত, জ্যোতিষ (তখন জ্যোতির্বিদ্যাকেও জ্যোতিষ বলা হত), পূর্তবিদ্যা এবং রাজনীতিতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তিনি সদূর রাজস্থানের আম্বার বা আমের শহরে কনিষ্ঠ নিরীক্ষক হিসেবে কাজ পেয়েছিলেন। আর এই আম্বারে কাজ করার সময়ে তিনি প্রথম জয়পুরের মহারাজের সংস্পর্শে আসেন। মহারাজা সাওয়াই (বা সোয়াই) জয় সিং (দ্বিতীয়) বিদ্যাধরকে তাঁর নানা গুণের পরিচয়লাভ করে মন্ত্রীপদে নিযুক্ত করেন। জানা যায় যে, বিদ্যাধর রাজসভায় কোষাধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করতেন। তা একসময় মরুর শহর অম্বরে জলের সঙ্কট দেখা দেয় আর তার সাথে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দেয় জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যা। এরফলে, মহারাজা ঠিক করলেন যে তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত করা হবে অম্বর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে যে এখনকার জয়পুরে। মহারাজা বিদ্যাধরের বাস্তু ও পূর্তবিদ্যার পারদর্শীতার ব্যাপারে জেনে জয়পুর শহর নির্মাণের জন্য অনুরোধ করেন। এই জয়পুর শহরই দেশের প্রাচীনতম শহরগুলোর মধ্যে একটি এবং এর পাশাপাশি এই শহর দেশের প্রথম পরিকল্পিত শহর। প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সাহিত্য, জ্যোতির্বিদ্যা, বাস্তুবিজ্ঞান এমনকি বিদেশি গণিতজ্ঞ টলেমি ও ইউক্লিডের লেখা গাণিতিক বইগুলোর ব্যাপারে বিস্তর জ্ঞান রাখতেন বিদ্যাধর। সেখান থেকে উল্লেখিত জ্ঞান ও শহর গড়ার ব্যাপারে নানান পরিকল্পনা নিয়ে মহারাজা সাওয়াই জয় সিং (দ্বিতীয়)- এর সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ১৭২৭ সালে, প্রযুক্তি ও কৌশলগত পরিকল্পনার সাথে জয়পুর শহরটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। শহরটির প্রধান প্রাসাদ ও রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ করতে চার বছর সময় লেগে গিয়েছিল। পুরো শহরটাই নির্মিত হয়েছিল ভারতীয় শিল্পকলার শিল্পশাস্ত্রের রীতি-নীতি মেনে চলে। শহরের মডেল তৈরি করার জন্য তিনি শিল্পশাস্ত্র ও বাস্তুশাস্ত্রের বিভিন্ন নীতি প্রয়োগ করেন। পৃথিবীর বৃহত্তম মানমন্দির এবং নগর প্রাসাদ নির্মাণ করার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর সমস্ত স্থাপত্যবিদ্যার জ্ঞান প্রয়োগ করেন। ভারতে কর্মরত একজন সুপরিচিত প্রকৌশলী এবং স্থপতি স্যার স্যামুয়েল স্নিন্টন জ্যাকব-এর সাথে তাঁকেও জয়পুরের সিটি প্যালেসের স্থপতি হিসেবে গণ্য করা হয়। জয়পুর শহর তৈরির পাশাপাশি কোনও শহরের ক্ষেত্রে যা অপরিহার্য হয়ে ওঠে অর্থাৎ নিরাপত্তার ব্যাপারে মহারাজা জয় সিং বড়োই উদ্বিগ্ন ছিলেন। বিদ্যাধরের পরামর্শ মতো তিনি একটি নব্য বা কল্পিত শহর নির্মাণ করেছিলেন কিন্তু বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা শহরের নিরাপত্তার দিকটিও ভাবা হয়। কেননা, তখন বৈদেশিক ও দেশীয় অন্যান্য প্রদেশ থেকে হামলার সম্ভাবনা থাকত। তাই, শহরের নিরাপত্তার জন্যে দৃঢ় স্থাপত্য স্থাপন করা হয়েছিল। আর, এর পাশাপাশি দৃঢ় সাতটি দরজাযুক্ত বিশাল দুর্গ প্রাচীরও বানানো হয়েছিল। আজ এই আধুনিক যুগে দেশের আন্তর্জাতিক বর্ডারও বেশ কিছু অংশে তেমন দৃঢ় নয় কিন্তু সে যুগে একটা শহর গড়ে তোলার জন্য কত কিছু ভাবা হয়েছিল। তা মোটামুটি ভাবে ১৭৩১ কি ১৭৩২ সালে শেষ হয় সহ নির্মাণের কাজ। গোটা জয়পুর শহরকে সৌরমণ্ডলের নয়টি গ্রহের প্রতীক হিসেবে নয়টি বর্গক্ষেত্রে ভাগ করা হয়। যার মধ্যে দুটি ভাগ থাকে রাজা ও রাজকীয় কাজকর্মের জন্যে আর বাকি সাতটি ভাগ থাকে স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্যে। মহারাজ দ্বিতীয় জয় সিংয়ের নামেই শহরের নামকরণ হয় জয়পুর। তাঁর এই নতুন রাজধানী জয়পুর নকশাকার বিদ্যাধরের হাত ধরে হয়ে উঠল যেন স্থাপত্য, বিজ্ঞান ও সৌন্দর্যের মিশ্রণ।

বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের প্রস্তুত করা নকশা থেকেই জয়পুর শহর নির্মাণ করা হয়। এই মহান স্থাপত্যবিদ জয়পুর শহরের চেহারা বদলে দিয়েছিলেন। সেই যুগে, জয়পুরে স্থাপত্য ছিল অত্যন্ত উন্নত, বিজ্ঞানসম্মত ও তার স্থাপত্যশৈলী ছিল গোটা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। ১৭৫১ সালে ৫৮ বছর বয়সে মারা গেলেও, এই বাঙালি স্থাপত্যবিদকে জয়পুর তো বটেই এমনকি গোটা উপমহাদেশ মনে রেখেছে ‘শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী স্থপতি’ হিসেবে। স্থাপত্যের ক্ষেত্রে দেশীয় ও প্রথাগত পদ্ধতি এবং উপকরণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিদ্যাধর অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। রাজস্থানের জয়পুর শহরের স্থাপত্যের পাশাপাশি দেশের আধুনিক স্থাপত্যের প্রবর্তক হিসেবে তিনি সুপরিচিত হয়ে আছেন। বাংলার মানুষ তাদের এই প্রধান স্থপতি, গণিতজ্ঞ, বাস্তুশাস্ত্রী ও নগর পরিকল্পনাবিদকে একপ্রকার ভুলে গেলেও বা তাঁকে নিয়ে বিশেষ কোনও কিছু না বানালেও জয়পুর তথা রাজস্থানের সংরক্ষিত সেরা বাগানগুলোর মধ্যে একটি হল ‘বিদ্যাধর বাগান’ যা শহরের স্থপতিকারের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১৯৮৮ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল। জয়পুর শহরের গর্ব এই বাগানটি জয়পুরের ৮ কিলোমিটার পূর্বে জয়পুর-আগ্রা সড়কে অবস্থিত। প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্য সম্পর্কিত ‘শিল্প শাস্ত্র’ নামক গ্রন্থসমূহ বিদ্যাধর ব্যবহার করেছিলেন জয়পুর শহরের পরিকল্পনাকালে। সেই গ্রন্থসমূহ দ্বারাই বাগানটি নির্মাণ করা হয়। মনে করা হয় যে, সেসোদিয়া উদ্যানের আশেপাশে অবস্থিত ছিল বাগানের একটি দ্রাক্ষাক্ষেত্র বা আঙুরের ক্ষেত।

নৈহাটি অনেক কৃতি মানুষকে উপহার দিয়েছে যাঁদের মধ্যে আমাদের আলোচ্য দেশের অন্যতম কৃতি স্থাপত্যবিদ ও রাজস্থানের 'গোলাপী শহর' জয়পুরের নকশাকার বিদ্যাধর ভট্টাচার্য তো আছেনই আর আছেন দেশের স্বাধীনতা লড়াইয়ের মূলমন্ত্র ‘বন্দে মাতরম্'-এর রচয়িতা, বাংলার নবজাগরনের অন্যতম রূপকার, কিংবদন্তি উপন্যাসিক, গল্পকার তথা সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক, ভারততত্ত্ববিদ,চর্যাপদের পুঁথি আবিষ্কর্তা, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতা পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসু, জনপ্রিয় গায়ক শ্যামল মিত্র, বাংলায় ব্রাহ্ম আন্দোলনের তো বটেই এমনকি বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা কেশবচন্দ্র সেন।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - বেবী সাউ

Posted in

কবিতার মধ্যে যে কবি ব্যক্তিত্বের বীজ পুঁতে দিতে পারেন, সেই কবির কবিতা পরবর্তীকালের পাঠকদের কাছে সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে থাকে। কিন্তু তার জন্য দরকার পরে কবির অভিপ্রায়ের। কিন্তু সেই অভিপ্রায়টি কী? ব্যক্তিগত এক দর্শন এবং কাব্যভাষার এক ধারাবাহিক সন্দর্ভ ছাড়া হয়তো কোনও কবিই সময়ের কাছে তাঁর আঙুলের ছাপ রাখতে পারেন না। অনেক সময় সমসময় তাঁকে খুঁজে পায়, অনেক সময় পায় না। পরবর্তী সময়ের মানুষজন সেই কবিকে আগ্রহ ভরে পড়তে থাকেন। প্রবালকুমার বসুর কবিতা তাঁর ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তুমিই প্রথম’ থেকেই নিজস্ব এক ব্যক্তিত্ব নিয়ে আছে। দেজ্ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত ২০০৭ সালে প্রকাশিত এই শ্রেষ্ঠ কবিতার পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৯-এ। শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, “ এটা খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার যে, জীবিকার জন্য অনেক সময় ব্যয় করতে হলেও প্রবাল তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই নতুন নতুন আঙ্গিকের সন্ধান করেছেন।“ এই ক্রমপরিবর্তনশীল কাব্যধারার সঙ্গেই আমরা পরিচিত হই তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা পড়তে পড়তে। “ তুমি যদি স্পর্শ করো, আমি তবে গাছ হয়ে যাব”-এর মতো পংক্তি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থেই তিনি লিখেছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থে যে প্রবালকুমার বসুকে আমরা বিস্ময়ে লক্ষ করি, তিনি নিজেকে পালটে ফেলার ব্রত যে প্রথম থেকেই নিয়েছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না, যখন আমরা পড়ি, “ আমাদের কথাগুলি এতকাল বলেছি, যা / না বলা কথারই অবশেষ”। (অবশেষ)।

প্রবালকুমার বসুর কবিতা তার পর থেকে নিয়তই বাঁক নিয়েছে নানান ভাবে। ‘ব্যক্তিগত স্মৃতিস্তম্ভের পাশে’ কবিতায় তিনি লেখেন, “ যেভাবে বেঁচে আছি এভাবে বেঁচে থাকতে থাকতে আমি একদিন ভারতবর্ষ হয়ে যাব”। এই কবিতাটি রয়েছে তার পরের কাব্যগ্রন্থ “ ব্যক্তিগত স্মৃতিস্তম্ভের পাশে” নামক কাব্যগ্রন্থে। এই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের চার বছর পর। এই কাব্যগ্রন্থেই আমরা পাই এক নতুন প্রবালকুমার বসুকে, যিনি কাব্যভাষায় অনেক বেশি অভিনব। যেমন, ‘ব্যক্তিগত জীবনী’ নামক কবিতায় তিনি লেখেন, “ আমার প্রথম মৃত্যুর পর দ্বিতীয় মৃত্যু হতে সময় নিল কুড়িটি বছর।“ প্রবালকুমার বসুর কবিতা পড়তে পড়তে যেমন তাঁর সময়কে স্পষ্টুভাবে চেনা যায়, তেমন বোঝা যায় কীভাবে তিনি আত্মজৈবিনিক উপাদানকে সময়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছেন। এই কাব্যগ্রন্থে তিনি নানা ছন্দে, নানা আঙ্গিকে কথা বলেহেন। ১৯৮৯ সালে ‘স্থায়ী আবাস অস্থায়ী ঠিকানা’, ১৯৯৪ সালে ‘যাপনচিত্র’, ১৯৯৮ সালে “ ঈশ্বরের মুখ’ প্রবালকুমার বসুর কাব্যব্যক্তিত্বকে অনেক বেশি স্পষ্ট করে তোলে। একজন কবির অভিযাত্রাকে স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায় তাঁর ধারাবাহিকতা দেখলে। সমগ্র আট-এর দশক ধরে যে কবি লিখেছেন নিভৃতচারী এক ভাষায় কবিতা, তিনিই সমগ্র নয়ের দশক জুড়ে এক স্থিতপ্রজ্ঞ দার্শণিকের মতো কবিতার অন্তর্জগতে ডুব দিয়েছেন। ‘অন্ধের ঈশ্বর’, ‘পা’, ‘জানা রাস্তা’, দেয়ালচিত্র’ প্রভৃতি আশ্চর্য কবিতার সামনে নতজানু হয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। ভেবে দেখতে হবে ভুবনায়নের পর ভুবনায়িত সংস্কৃতির জোয়ারে কবি এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন। প্রযুক্তিবিদ এই কবির কাছে প্রযুক্তির বিস্ফোরণ অচেনা কিছু নয়। কিন্তু সময়টা পালটে যাচ্ছে। তার সঙ্গে সঙ্গে কবি পালটে ফেলছেন তাঁর কাব্যভাষা। কিন্তু ভিতরে রয়ে গেছে এক স্থিতপ্রজ্ঞ দ্রষ্টা।

এই ধারাবাহিকতারই অংশ হিসেবে আমরা পাই ‘ আপনাকেই ঠিক করতে হবে গন্তব্য’ যা প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৭ সালে। আমরা কল্পনা করে নিতে পারে, পূর্বের শ্রেষ্ঠ কবিতার সংস্করণটি এই গ্রন্থের পূর্বের কাব্যগ্রন্থগুলি নিয়েই হয়েছিল। কারণ ততদিনে চব্বিশ বছরের কাব্যজীবন তিনি অতিক্রম করে এসেছেন। পরিবর্ধিত এই শ্রেষ্ট কবিতায় তাই আমরা পেয়ে যাচ্ছি ‘ অধর্ম কথা’ (২০০৯), ‘ ভালো বলতে শিখুন’ (২০১১), ‘নির্বাচিত দূরত্ব মেনে’ (২০১৩), ‘এই যে আমি চলেছি’ (২০১৫), এবং ‘আমি তো বলতেই পারতাম (২০১৭) কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্য থেকে কবির নির্বাচিত কবিতাগুলি। আর আশ্চর্য ভাব দেখি, ১৯৮৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কথিত নিয়ত পরিবর্তনশীল কাব্যভাষার বিষয়টি ৩৪ বছরেও পরিবর্তিত হয়নি। ২০১৭ পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলিতেও প্রবালকুমার বসু অক্ষুণ্ণ রেখেছেন তাঁর চিরজায়মান কাব্যভাষা। এই পরিবর্তনশীলতাই একজন কবিকে জীবিত রাখে। ‘অভ্যাসবশত’ নামক কবিতায় যেমন তিনি লেখেন, “ ফিরে আসতে আসতে দেখি বদলে যায় বাড়ি/ রোজ কার কাছে ফিরি?” এই প্রশ্ন যেন অনুরণিত হতে থাকে শ্রেষ্ঠ কবিতার ৩৪ বছরের নির্বাচিত প্রতিটি কবিতায়। কবির রাজনৈতিক ভাবনা, সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব, শিল্প এবং নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কিত ভাবনা – সমস্ত কিছুই আমাদের সামনে ফুটে ওঠে। আমরা বুঝতে পারি, তাঁর কাব্যভাষা আন্তর্জাতিক আঙিনাকে স্পর্শ করে আছে। একই সঙ্গে আমরা অপেক্ষা করে থাকি শ্রেষ্ঠ কবিতার পুনরায় পরিবর্ধিত সংস্করণের জন্য। কারণ, কবি তো থেমে যাচ্ছেন না। তিনি নিজে পাল্টাচ্ছেন এবং নিজের কবিতাকেও বারবার পাল্টাচ্ছেন। কবির ব্যক্তিত্বের এই মানচিত্র এই শ্রেষ্ঠ কবিতার মধ্যে ধরা দিচ্ছে।


প্রবালকুমার বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা
দেজ পাবলিশিং
প্রচ্ছদ সৈকত সরকার
২৫০ টাকা

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সেবিকা ধর

Posted in









আমরা যত বিশ্বায়নের কথা বলছি, গ্লোবালাইজেশন- এর কথা বলছি, যত ভুবনগ্রামের কথা বলছি, বিশ্বায়িত পৃথিবীর কথা বলছি, তত কিন্তু মানুষ শিকড়হীন হয়ে পড়ছে। সীমা রেখাগুলো মুছে গিয়ে মিশে যাওয়ার বদলে আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। এবং কোথাও ধর্মের নামে,কোথাও রাজনীতির নামে,কোথাও রাষ্ট্রের চাপে,কোথাও যুদ্ধের জন্য, কোথাও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানুষ চলে যাচ্ছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়।নিজে বাঁচতে এবং পেটে ভাতের সন্ধানে, কাজের সন্ধানে।এবং এই ধারাবাহিকতা অনেক জায়গায় জনবিন্যাস বদলে দিচ্ছে।জনবিন্যাসের যে প্যাটার্ন,তার যে রৈখিক গতি তা কিন্তু বদলে যাচ্ছে।জনবিন্যাস বদলে যাওয়ার ফলে ভাষাও বদলাচ্ছে।খাদ্যাভ্যাস বদলাচ্ছে।তার চেয়েও বড় কথা খাদ্যের ভাঁড়ারে কিন্তু টান পড়ছে।আজকের পৃথিবীতে কিন্তু খাদ্যের ভাঁড়ার অফুরন্ত নয়।জলের ভান্ডার অফুরন্ত নয়।আগামী দিনে এমন হবে স্টার ওয়ার্সের কল্পনায় আমরা দেখতে পারি চাঁদের জল নিয়ে মারামারি হবে।

এই যে মানুষের চলাচল, মানুষের এই যে চলিষ্ণু জীবন, সেই জীবনটা কিন্তু ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াচ্ছে।আমরা দেখেছি ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ থেকে দলে দলে শরণার্থী এসেছে।এবং ভারতবর্ষ বুক পেতে তাদের জায়গা দিয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে যদি এটা চলে, তাহলে তো মুশকিল। দেশের অর্থনীতিতে টান পড়বে,অর্থের ভাঁড়ারে টান পরবে,খাদ্যের ভাঁড়ারে টান পড়বে,এবং অন্যান্য জায়গায় টান পড়বে।

১৯৪৬ সালে বিহার শরীফের দাঙ্গায় বাংলাদেশে বহু মানুষ গেছেন তখনকার পূর্ব পাকিস্থানে। যাঁরা ইসলাম ধর্মের বিহারী মানুষ, যাঁরা হিন্দি ভাষী।তাঁরা বাংলাদেশে কোনো মর্যাদা পান নি সেই ভাবে। তাঁরা ইসলাম ধর্মের কিন্তু মর্যাদা পান নি।একটা সাধারণ কলোনির মতো জায়গায় তাঁরা আটকে আছেন।এবং সেখানে তাঁরা মূলত কথা বলেন হিন্দিতে। আজ পর্যন্ত তাঁদের কোনো আর্থিক উন্নতি নেই। তাঁরা সেখানে ছোটখাটো সেলাইয়ের কাজ, রেডিও সারানর কাজ করে। এবং তাঁদের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ মেশেন না। ফলে জায়গাতেই ছোঁয়াছোঁত, ছোঁবনা ছোঁবনা- এরকম একটা ব্যাপার আছে। সেই ব্যাপারগুলোকে যদি আমাদের মাথায় রাখতে হয়,দেশকে আমাদের যদি এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়,দেশের প্রযুক্তিকে,দেশের মানুষকে, তাহলে এই ক্রমবর্ধমান উদ্বাস্তু সমস্যা কমাতে হবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে ২০১৫-১৬ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ হচ্ছে।রোহিঙ্গারা ইসলাম ধর্মের মানুষ। মায়ানমার থেকে তাঁরা সেখানকার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সরকার ও সেনাবাহিনীর তাড়া খেয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে।আমরা জানি মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ চলে যাচ্ছেন সবাই।আফ্রিকা, ফ্রান্স, তুরস্ক থেকে জার্মানিতে চলে যাচ্ছেন।যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলি থেকে মানুষ চলে যাচ্ছেন।সিরিয়া, ইউক্রেন থেকে চলে যাচ্ছেন। একটা ঘাড় ভাঙা ছেলের সমুদ্র পাড়ে পরে থাকার চিত্র আমরা দেখতে পেয়েছিলাম।তার গায়ে একটা গেঞ্জি এবং সমুদ্রের জল তার চারপাশে। যেটা খুব বেদনাদায়ক ছিল।

একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি গভীরভাবে উপলদ্ধি করেন ও দেখতে পান যে, তিনি বা তাঁরা জাতিগত হিংস্রতা ধর্মীয় উন্মাদনা, জাতীয়তাবোধ, রাজনৈতিক আদর্শ, সমাজবদ্ধ জনগোষ্ঠীর সদস্য হওয়ায় ঐ দেশের নাগরিকের অধিকার থেকে দূরে সরানো হচ্ছে, ব্যাপক ভয়-ভীতিকর পরিবেশ বিদ্যমান, রাষ্ট্র কর্তৃক পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে; তখনই তিনি শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হন। ১৯৬৭ সালের

সম্মেলনের খসড়া দলিলে উদ্বাস্তুর সংজ্ঞাকে বিস্তৃত করা হয়। আফ্রিকা ও ল্যাতিন আমেরিকায় অনুষ্ঠিত আঞ্চলিক সম্মেলনে যুদ্ধ এবং অন্যান্য হিংস্রতায় আক্রান্ত ব্যক্তি কর্তৃক নিজ দেশত্যাগ করাকেও অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

শরণার্থীকে প্রায়শঃই ভাসমান ব্যক্তিরূপে বা গোষ্ঠীরূপে অন্তভুর্ক্ত করা হয়। বাইরে থেকে যদি যুদ্ধের কারণে নির্যাতন-নিপীড়নে আক্রান্ত না হয়েও মাতৃভূমি পরিত্যাগ করেন অথবা, জোরপূর্বক নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হন - তাহলে তাঁরা শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হবেন।

মানুষের এই যে আসা-যাওয়া, এই যে যাতায়াত, সেটা আগেও ছিল।আগে কীরকম ছিল? আগে মানুষ অসুখের ভয়ে,কলেরা ম্যালেরিয়া মহামারীতে মানুষ গ্রাম ত্যাগ করত।অনাহারে খাবারের অভাবে মানুষ গ্রাম ত্যাগ করত।মানুষ লোকচাপে,ধর্মীয় চাপে,গ্রাম ত্যাগ করত দলকে দল।নয়ত গ্রামকে গ্রাম মরে ভুত হয়ে গেছেন না গ্রাম ত্যাগ করেছেন।

আজকের পৃথিবীতে ব্যাপারটা হচ্ছে এরকম- এলাকা থেকে এলাকান্তরে মানুষ চলে যাচ্ছে কিন্তু তার ছবিটা একদম আলাদা।এই নিয়ে ভারতে প্রচুর লোককাহিনী আছে।আমরা এমনই একটি লোককথা আলোচনা করব।আমরা একটি রিয়াং লোককথা বলব।

সে বহুকাল আগের কথা এক গ্রামে সুনা রইহা নামে এক ছেলে তার বুড়ি মায়ের সঙ্গে বাস করত।সে নদীতে স্নান করতে গিয়ে দূরে কিছু একটা ভেসে আসতে দেখল। প্রথমে সে চিনিতে পারে নি।পরে কাছে আসায় চিনতে পারে, এটি খুম্বা রাঙজাক ফুল।সুন্দর ফুলটি সে বাড়ি নিয়ে আসে।বাড়ি এসে মাকে বলে, মা এই ফুলটি যত্ন করে রেখে দাও।মা তার কথা মতো রেখে দিল।

সেদিন রাতে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল।রাতে তাদের ঘর ফুলের আলোয় আলোকিত হয়ে গেল।ফুলটির পাপড়ি থেকে জ্যোতি বেরোতে লাগল।দুজনের ভীষণ খুশি।প্রত্যেকদিন রাতে ফুলের আলোয় ঘর আলোকিত হতে দেখে গ্রামের মানুষেরা জানতে পারল।এই আলো তো রাজার ঘরেও নেই।তাই গ্রামবাসীরা রাজার কাছে আলোকবাতির খবর দিল।রাজা তা শুনে সিপাহি পাঠাল সুনা রইহাকে ডেকে আনার জন্য।

সুনা রইহা রাজার ডাক শুনে ভয়ে ভয়ে রাজার কাছে উপস্থিত হল।রাজা জানতে চাইলেন বাড়িতে আলোকচ্ছটার কারণ কী? সুনা রইহা খুম্বা রাঙজাক ফুলের কথা জানাল।মহারাজ আদেশ দিলেন রাজার এই ফুল চাই।মহারাজ একটা ছোট ডিঙি দিয়ে তাকে নদী থেকে এই ফুল এনে দিতে বললেন।

সুনা রইহা বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে কাঁদতে থাকে, কোথায় পাবে সেই ফুল।কিন্তু রাজার আদেশ, তাই পরের দিন ভোর বেলা মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পরে।সে ডিঙিতে ভাসতে ভাসতে কত গ্রাম,কত বন,কত পাহাড় পেরল।পরে সে ডিঙি বাঁধতে গিয়ে তউমসার বাড়িতে ধাক্কা মারে।তউমসা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে 'কে তুমি।তুমি এখানে কী করছ'?

সুনা রইহা বলে আমি রাজার আদেশে খুম্বা রাঙজাক ফুলের খোঁজে বেরিয়েছি।তুমি কি বলতে পার কোথায় পাব সেই ফুল।তউমসাকে যদি সুনা রাইহা বিয়ে করে তাহলে ফিল আনার পর দেখিয়ে দেবে। সুনা রইহা বিয়ে করে তউমসাকে।পরের দিন তউমসা পথ দেখিয়ে দেয়।সে বেরিয়ে পরে ফুলের উদ্দেশ্যে।

তারপর ভাসতে ভাসতে সে একইভাবে তাউকুরু,মাখমাই,তাউথুকে পায়,বিয়ে করে তিন জায়গার তিন কন্যাকেই।শেষে তাউথু এক রাক্ষসীর সন্ধান দিল।নদীর ওপারে থাকে এক রাক্ষসী,তার বিশাল বড় দাঁত,আর ভীষণ তার শক্তি। কেউ তাকে হারাতে পারে না। যে যায় তাকেই খেয়ে ফেলে।সুনা রইহা তার উপায় জানতে চাইল।তাউথু উপায় বলে দেয় যে,ওপারে ডিঙ্গি বেঁধে চুপি চুপি যাবে ,যাতে রাক্ষসী টের না পায় তুমি গিয়ে পেছন থেকে মা বলে জড়িতে ধরবে, সে আর তোমার খেতে পারবে না। সে সব শুনে বেরিয়ে পরে গন্তব্য স্থলের উদ্দেশ্যে ।

তাউথুর কথা মতো সুনা রইহা তাই করল।রাক্ষসী জানতে চাইল কেন এসেছ? সুনা রইহা সব জানাল রাজার কথা। রাক্ষসী তার উপায় বলে দেয় সমুদ্র পেরিয়ে আছে এক সুন্দর স্নানের ঘাট। সেই ঘাটে স্বর্গপরীরা রোজ স্নান করতে আসে।তার আগে তার সখিরা আসে। স্বর্গপরীরা স্নানের শেষে চলে যাওয়ার প্রস্তুতির সময় তাকে রাঙজাল দন্দ্রাই দিয়ে তাকে ধরে নিতে হবে। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, যে পরীর সোনার পাখা আছে তাকেই ধরতে হবে।

শুনে সুনা রইহা চিন্তায় পরে গেল। এতো ছোট ডিঙি দিয়ে সে সমুদ্র কীভাবে পার হবে? যাই হোক রাক্ষসী তার উপায়ও বলে দিল। সুনা রইহাকে এক জাদু বালিশ দিল।সেই বালিশই তাকে সমুদ্র পার করে দিল।রাক্ষসীর কথা মতো স্বর্গ পরীদের স্নানের শেষে বুদ্ধি করে পেছন থেকে স্বর্গপরীকে জড়িয়ে ধরল।

স্বর্গপরী জানতে চাইল কেন এখানে এসেছে সুনা রইহা।সে সব ঘটনা বলল।তখন স্বর্গপরী বলল তাহলে সুনা রইহাকে স্বর্গে যেতে হবে।কিন্তু কীভাবে যাবে সে? তাই স্বর্গপরী তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়।সুনা রইহা স্বর্গপরীকেও বিয়ে করে।পরে সুনা রইহাকে পরীর চুলের কাঁটা বানিয়ে স্বর্গে নিয়ে যায়। দিনের বেলা যে পরীর চুলের কাঁটা এবং রাতের বেলা সে মানুষ রূপে ফিরে আসে।সুনা রইহা তখন ফুলের কথা ভুলেই গেল।

হঠাৎ একদিন রাজার কথা মনে হল।তখন সে স্বর্গপরীকে বলল, চল আমরা রাজার কাছে যাই।

স্বর্গপরী বলল আমিই সেই খুম্বা রাঙজাক।যার খোঁজে তুমি এখানে এসেছ।সুনা রইহা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। যে স্বর্গপরীই খুম্বা রাঙজাক,সেই তার বিয়ে করা বউ।আবার তাকেই রাজার কাছে নিয়ে যেতে হবে। সুনা রইহা স্বর্গপরীকে সব জানাল।পরে স্বর্গপরী তার বাবার মতামত নিয়ে পৃথিবীতে চলে আসে।

তারা দুজনে উড়ে উড়ে সমুদ্র পার হয়ে সেই রাক্ষসীর কাছে এসে পৌঁছয়। রাক্ষসী খুব খুশি হয়ে তাদের ঘরে তুলে নেয়।সেখানে রাত কাটিয়ে তারা উড়তে উড়তে আসে তাউথুর বাড়িতে। সেখান থেকে তাউথুকে সঙ্গে নিয়ে তারা আবার উড়তে উড়তে মাখমাই-এর বাড়িতে আসে।সেখানে রাত কাটিয়ে মাখমাই কে সঙ্গে নিয়ে এলো তাউমসার বাড়ি।।তাউমসা সবাইকে দেখে খুশি হয়।সেই রাতে সবাই তাউমসার বাড়ি থেকে পরের দিন সবাই মিলে উড়তে উড়তে এসে পৌঁছুল সুনা রইহার গ্রামে।

সুনা রইহা তার পাঁচ বউ নিয়ে মায়ের কাছে গেল।বুড়ি মা এতদিন তার ছেলের জন্য পথ চেয়ে বসেছিল।সবাইকে পেয়ে মা খুব খুশি।সুনা রইহা গ্রামে আসার খবর গ্রামের সবাই জানতে পারে। রাজাও খবর পায় সুনা রইহা গ্রামে এসেছে। রাজা খবর পাঠায় খুম্বা রাঙজাক এনেছে কী না?এদিকে সুনা রইহা চিন্তায় পড়ে গেল।কী করে সে তার বউকে রাজার কাছে দেবে।

সব শুনে চিন্তা করে স্বর্গপরী বলল চিন্তা নেই, আমরা আছি।তুমি যাও রাজবাড়ি। সুনা রইহা রাজবাড়ি গেলে রাজা ফুল এনেছে কী না জিজ্ঞাসা করতেই সুনা রইহা উত্তর দিল কয়েকদিনের মধ্যেই নিয়ে আসবে। সুনা রইহা মনের দুঃখে বাড়ি ফিরল।স্বর্গপরী বলল চিন্তা নেই, আমি যখন আছি তখন একটা ব্যবস্থা হবেই।স্বর্গপরী পরের দিন স্নান করে ঘাট থেকে এসে চুল ঝাড়তে লাগল। সেই চুলের জলের ফোঁটায় অনেক খুম্বা রাঙজাক গাছ হল আর তাতে অনেক ফুল। সেই ফুল টুকরিতে করে সুনা রইহা রাজার বাড়ি নিয়ে গেল।রাজা খুব খুশি হলেন। তাই রাজার মেয়ের সঙ্গে সুনা রইহার বিয়ে দিতে চাইলেন।সুনা রইহা রাজার মেয়ে বিয়ে করল।তখন থেকে সুনা রইহা তার ছয় বউ নিয়ে সুখে বাস করতে থাকে।

এই গল্পটার মধ্যে রয়েছে বহুমাত্রিকতা।নদীতে একটা ফুল ভেসে আসছে। সেই ফুলটা কী ফুল? আলোর ফুল।এবার রাজা তাকে এই ফুল এনে দেওয়ার জন্য আদেশ দিলেন।চলে আসছে রাক্ষস,চলে আসছে গরীবের চালের ঘর,চলে আসছে সমুদ্র,সমুদ্র পেরিয়ে যাত্রা, বিবাহ,ছয়টা বিবাহ,রাক্ষসটাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরা,তাকে মা বলে ডাকার কথা, সব মিলিয়ে একটা গল্প।

জলের অপর নাম জীবন। এই জীবন তরঙ্গের মাঝে ভাসছে আলোর ফুল।আলো মানে আমাদের জীবনে যা শুদ্ধতা নিয়ে আসে।আলোর ফুলের যে সৌরভ, তা মানুষের জীবনকে আলোকিত করে। সেটা আলো থাকুক আর না থাকুক। অর্থাৎ কোনো একটা ভালোবাসা,কোনো একটি প্রেম,কোনো একটা প্রীতি, কোনো একটা সৌন্দর্য, ছেলেটা অর্জন করে নিল যার নাম সুনা রাইহা।

রাজা তাকে এবার বলল যে রাজাকে ফুল দিতে হবে।আমরা একটা গল্প জানি যে- এলাটিং বেলাটিং সইলো, কীসের খবর আইলো, রাজা একটি বালিকা চাইলো,কোন বালিকা চাইলো এরকম।এবার সে কাঁদছে।কিন্তু ফুল তো দিতেই হবে রাজাকে। ফলে রাজাকে ফুল দেওয়ার জন্য সে যাত্রা শুরু করে।এই যে যাত্রা সেটা হচ্ছে মানব জীবনের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আমরা সবাই সবাই একটা জার্নির মধ্যে থাকি সারাজীবন। মায়ের গর্ভ থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জীবনের একটা জার্নি।সুনা রাইহা সেই যাত্রা করছে।করতে করতে তাকে অনেক রকম বাধাবিপত্তির মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন জায়গা পেরতে হয়েছে।তাকে বিভিন্ন জায়গায় বিয়ে করতে হয়েছে,সংসার হয়েছে,কিন্তু সঠিক ঠাঁই কোথাও হয় নি।সে হয়ে গেল উদ্বাস্তু।হয়ে গেল শরণার্থী। বেরিয়ে পড়ে জীবনের নতুন নতুন ঠিকানায়।

তারপর সে পেয়ে যায় ডিঙি নৌকা।এই ডিঙি হচ্ছে জীবন তরী।কারণ তাকে ফুল সংগ্রহ করতেই হবে।তার জীবন বাজি রেখে পাড়ি দিল দূর থেকে বহুদূর।তারপর এক রাক্ষসীর সঙ্গে দেখা।তার বিরাট বড় দাঁত,বিশাল তার শক্তি। সেই রাক্ষসীকে পেছন থেকে 'মা' বলে ডেকে তার মন জয় করে নেয়। ভারতীয়দের বিশ্বাস মায়ের মতো আপন এই পৃথিবীতে কেউ হয় না।তাই মা ডাকলে সব অপরাধ ক্ষমা করে দেবে।রাক্ষসীও তাকে আপন করে নেয়।

জীবন তরী পার হওয়ার জন্য রাক্ষসী যে অরণ্যবাসী মানুষ সে জাদুমন্ত্র দিয়ে একটা বিশাল বালিশ বানিয়ে দেয়। এই বালিশ আমরা সাধারণত মাথায় দিয়ে শুই।এবং বালিশ আমাদের ঘুমকে আরামদায়ক করে তোলে। এই বালিশে শুয়ে আমরা নানারকম স্বপ্ন দেখি।এই জাদুবালিশ দেওয়া হল অর্থাৎ খানিকটা স্বপ্ন তার মধ্যে দিয়ে দেওয়া হল।সে সমুদ্র পেরিয়ে গেল।চলে গেল স্বর্গপরীদের কাছে। সে স্বর্গপরীর দেশে যাওয়ার কথা বললে স্বর্গপরী তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়।নইলে সে স্বর্গে যেতে পারবে না।যথারীতি সে বিয়ে করে স্বর্গপরীর চুলের কাঁটা হয়ে স্বর্গে পৌঁছল।চুলের কাঁটা করে রাখল মানে স্বর্গপরী তাকে হারাতে চায় না। চুলের ভেতর যত্ন করে রেখে দেয়। দিনের বেলা পরী তাকে লুকিয়ে রাখে। রাতের বেলা সে মানুষ হয়ে স্বর্গপরীর কাছে থাকে। রাতেই তাদের মিলন হয়। হঠাৎ তার একদিন মনে হল রাজার কথা। এত দিনের পরিশ্রমের পর সে এই স্বর্গপরী লাভ করল।তাই তাকে হারাতে চায় না।কিন্তু সে জানে না যে এই স্বর্গপরীই খুম্বা রাঙজাক। যাকে রাজার হাতে তুলে দিতে হবে। সুনা রাইহা স্বর্গপরীকে সব জানাল।স্বর্গপরী তার বাবাকে সব জানিয়ে পৃথিবীতে চলে এল স্বপ্নের ডানায় উড়ে।

একে একে তারা সবার বাড়ি এক রাত করে কাটিয়ে, বিয়ে করা পাঁচ বউ নিয়ে উড়তে উড়তে বাড়িতে এল।যেখানে বসে আছে তার বুড়ি মা। দ্রৌপদীর পঞ্চ স্বামীর মতো সুনা রাইহা পাঁচ বউ নিয়ে সংসার করতে থাকে।রাজা খবর পেল সুনা রাইহা এসেছে।কিন্তু ফুল কই? কী করে সে তার বউকে রাজার হাতে তুলে দেবে সুনা রাইহা ভাবে।কিন্তু স্বর্গপরী তো অসাধারণ বুদ্ধিমান। সে উপায় বের করল।স্বর্গপরী স্নান করে তার চুলের জল থেকে অনেক ফুল সৃষ্টি করে সুনা রাইহাকে দিয়ে রাজার বাড়ি পাঠাল।রাজা খুব খুশি হয়ে তার মেয়ের সঙ্গে সুনা রাইহাকে বিয়ে দিল।একটা মেয়ে জানে ফুল নিয়ে গেলেই রাজা তার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেবে,সে জানে তার ঘরে সতীন আসবে।একটা মেয়ে তার সর্বস্ব দিয়ে স্বামীকে রক্ষা করে।কিন্তু মেয়েদের ভালোবাসা এমনই, যে সে যদি কাউকে একবার মন প্রাণ সমর্পণ করে তাহলে মৃত্যুও তাকে আটকাতে পারেনা।তাই স্বামীকে বাঁচাতে তার পারিপার্শ্বিকভাবে সহায়তা করছে,নিজেকে খানিকটা সরিয়ে রেখে, তার সহজীবনের মানুষের সুখের জন্য এগিয়ে আসে।

আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে অন্যতম বড় সমস্যা হচ্ছে উদ্বাস্তু সমস্যা।নানা কারণ যেমন ধর্মীয় কারণ, রাজনৈতিক কারণ, যুদ্ধের কারণে দেশ ভাগ হচ্ছে । এক দেশের লোক চলে যাচ্ছে অন্য দেশে।দেশের সীমা রেখা মুছে যাচ্ছে। নতুন নতুন দেশ তৈরি হচ্ছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি এবং এশিয়ার কিছু কিছু অংশ সেগুলো নানাভাবে ভাগ হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর টুকরো টুকরো হয়ে গিয়ে অনেক ছোট ছোট দেশের জন্ম হয়েছে। ফলে সেই সব কথা মাথায় রেখেই আমরা রিয়াংদের যে উৎখাত হওয়া,এবং রিয়াংদের যে বাস্তচ্যুত হওয়া এই কথাটিকে নতুন করে একটি কাহিনির মাধ্যমে বলতে চেষ্টা করলাম।

আসলে মানুষ কিন্তু শিকড়হীন। মানুষ আসলে নো ম্যান্স ল্যান্ড-এ বাস করে। ফলে সে পথিক হয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দেয়। প্রাচীন পৃথিবীতে মানুষ খাদ্যের অভাবে,মহামারির প্রকোপে,ধর্মের চাপে,যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে ঘর ছাড়ত। সমস্ত গ্রাম,সমস্ত শহর,সমস্ত দেশ উজাড় হয়ে যেত।ফলে বিভিন্ন কারণেই দেশের মানচিত্র পালটে যায়। আর এই সব চির শরণার্থী মানুষের যাত্রাপথ সুখকর নয়।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - দিলীপ মজুমদার

Posted in






জন্মসূত্রে জে টি সান্ডারল্যাণ্ড ইংরেজ । ইংল্যাণ্ডের ইয়র্কশায়ারে ১৮৪২ সালে তাঁর জন্ম । কিন্তু অর্থনৈতিক কারণে ১৮৪৪ সালে তাঁর পরিবার চলে আসেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে । পড়াশুনো করেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে । তারপরে সেখানকার ব্যাপটিস্ট ইউনিয়ন থিওলজিকাল সেমিনারি থেকে লাভ করেন ব্যাচিলার অব ডিভিনিটি ডিগ্রি । ব্যাপটিস্ট সম্প্রদায়ের যাজকরূপে শুরু করেন কর্মজীবন । পরে তিনি একেশ্বর বিশ্বাসভিত্তিক ইউনিটারিয়েন মতবাদে দীক্ষিত হন ।

ইউনিটারিয়ান সমিতির কাজ নিয়ে সাণ্ডারল্যাণ্ড ভারতে আসেন ১৮৯৫ সালে । তিনি কলকাতায় ছিলেন দশ দিন । এখানে তিনি ব্রাহ্মসমাজের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনা করেন । ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গেও তাঁর আলোচনা হয় । শুধু বাংলা নয় , দেশের অন্যান্য স্থানেও ভ্রমণ করেন তিনি । এ দেশের নানা পত্র-পত্রিকা পাঠ করেন নিবিড়ভাবে । ভারত সম্পর্কে তাঁর আগেকার মনোভাব পরিবর্তিত হয় । আমেরিকা ফিরে গিয়ে তিনি ভারত সম্পর্কে যে দুটি প্রবন্ধ লেখেন তা হল : The Causes of Famine in India ও The New Nationalist Movement in India . সাণ্ডারল্যাণ্ড লিখেছেন যে ভারতে আসার আগে তিনি ভারতের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য উদগ্রীব ছিলেন । কিন্তু তা জানার জন্য যে সব বই তিনি দেখতে পান তা ব্রিটিশ লেখকদের লেখা , যাতে প্রতিফলিত তাদেরই দৃষ্টিভঙ্গি । ভারতে এসে তিনি সত্যিকারের ভারতকে চিনলেন , জানলেন ব্রিটিশ শাসন ও শোষণে ভারত কি রকম জর্জরিত ।

১৯১৩ সালে সাণ্ডারল্যাণ্ড দ্বিতীয়বার ভারতভ্রমণে আসেন । এবার তিনি প্রায় ১৩০০ মাইল ঘুরেছিলেন , শুধু শহর নয় , সুদূর গ্রামাঞ্চলেও গিয়েছিলেন তিনি । পরিচিত হন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় , জগদীশচন্দ্র বসু প্রভৃতির সঙ্গে । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও হয় পরোক্ষ যোগাযোগ । যোগ দেন ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল সোশাল কনফারেন্সে । ভারতকে ভালোবাসেন তিনি । নিজে ইংরেজ হয়েও ভারতে ইংরেজের অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে শুরু করেন , ভারতে স্বাধীনতার জন্য কলম ধরেন । জন এইচ হোমস তাই বলেছেন যে সাণ্ডারল্যাণ্ডের পরবর্তী জীবনের প্রধান লক্ষ্য বাইবেল বা ইউনিটারিয়ানিজম ছিল না , ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে ভারতবাসীর মুক্তি।

১৯২৮ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় সাণ্ডারল্যাণ্ডের বই ‘ ইণ্ডিয়া ইন বণ্ডেজ : হার রাইট টু ফ্রিডাম’ । বইটির প্রকাশক ‘প্রবাসী’ ও ‘মর্ডান রিভিউ’র বিখ্যাত সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় । বইটির বিভিন্ন অধ্যায়ের শিরোনাম তুলে ধরলেই লেখকের উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় স্পষ্ট হয়ে উঠবে :

ভারতভ্রমণ : ব্রিটিশ শাসনের রূপ , পরাধীন ভারত সম্পর্কে আমেরিকার বিখ্যাত লোকেরা কি বলেন, অন্যদেশ যদি স্বাধীন হয় তাহলে ভারত কেন স্বাধীনতা পাবে না , ভারতের মঙ্গলের জন্যই কি ব্রিটিশ ভারত শাসন করছে , ব্রিটিশের ঔদ্ধত্য ও ভারতের অবমাননা , বাবু ইংলিশ—রুডইয়ার্ড কিপলিং—অপমান , ব্রিটেন ভারতকে যে ধরনের সুবিচার দেয় , ব্রিটেন ভারতকে যে ধরনের শান্তি দিয়েছে , ভারতের আফিং অভিশাপের জন্য দায়ী কারা , ভারতের মদ্যাসক্তির জন্য দায়ী কারা , বিদেশি শাসন ভারতকে কিভাবে হীনবির্য করেছে , এক মহৎজাতির মহৎ ঐতিহ্যের বিনষ্টি, কেন জাপান ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে , ভারতের গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র , ভারতের জাতিভেদ কি স্বায়ত্ব শাসনের প্রতিবন্ধক , ভারতের নিরক্ষরতা কি স্বায়ত্বশাসনের প্রতিবন্ধক , ভারতের নানা জাতি ও ভাষা কি স্বায়ত্বশাসনের প্রতিবন্ধক, ভারতের সামাজিক ব্যাধি কি স্বায়ত্বশাসনের প্রতিবন্ধক , হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা কি স্বা্য়ত্বশাসনের প্রতিবন্ধক , ব্রিটিশ ভারত ত্যাগ করলে কি ভারতে রক্তপাত শুরু হবে , কোন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা ব্রিটিশ ভারতকে দিয়েছে , ভারত স্বাধীন হলে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হবে কি , ব্রিটিশ বা অন্য কোন বিদেশি জাতি কি ভারত শাসনের যোগ্য ? মোগল শাসনের সঙ্গে ব্রিটিশ শাসনের তুলনা , ভারতের ব্রিটিশ শাসন কি যোগ্যতাসম্পন্ন , ভারতবাসী কি নিজেরা শাসন করার উপযুক্ত , ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কিভাবে ক্ষুণ্ণ করছে ভারতের স্বার্থ , জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত সত্য , কেন ভারত প্রত্যাখ্যান করল দ্বৈত শাসন , স্বায়ত্বশাসনের জন্য ভারতকে শিক্ষিত করার ব্রিটিশ দাবি আসলে এক বিরাট প্রবঞ্চনা, ভারতকে পবিত্র ট্রাস্ট বলে ব্রিটেনের দাবি এক বিখ্যাত প্রহসন , শৃঙ্খলিত ভারত কিভাবে ইংল্যাণ্ডকে আঘাত করছে , শৃঙ্খলিত ভারত কিভাবে সমগ্র পৃথিবীর বিপদের কারণ ।

সাণ্ডারল্যাণ্ডের বইটি এদেশে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল । মাত্র ২ মাসের মধ্যে ১২০০ কপি বিক্রি হয়ে যায় । ১৯২৯ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত হয় । দ্বিতীয় সংস্করণের সময় টনক নড়ে ইংরেজ শাসকের । ১৯২৯ সালের ২৪ মে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার অফিসে খানাতল্লাশি হয় । অভিযুক্ত হন প্রকাশক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও মুদ্রাকর সজনীকান্ত দাস ।

এই বই শুধু ভারতে নয় , ইউরোপ আমেরিকাতেও সাম্রাজ্যবাদীদের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল । আমে্র্র্ররিকার কোন প্রকাশক এই বই প্রকাশ করতে রাজি হন নি । সাণ্ডারল্যাণ্ড ১৪ জন প্রকাশের দ্বারস্থ হয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন । শেষে একজন প্রকাশক রাজি হলেও সাণ্ডারল্যাণ্ডকে ৬ হাজার ডলার দিতে হয় ; বইটির কোন বিজ্ঞাপন দিতেও রাজি হন নি প্রকাশক । সাণ্ডারল্যাণ্ড নিজের খরচে সেই বই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গ্রন্থাগারে পাঠান ।

‘রামানন্দ ও অর্ধ শতাব্দীর বাংলা’ বইতে রামানন্দের কন্যা শান্তাদেবী লিখেছেন :

“ রামানন্দ বলিতেন , ভারতের বাহিরে কোন দেশে ডাঃ জে টি সাণ্ডারল্যাণ্ড অপেক্ষা বড় ভারতসুহৃদ কেহ ছিলেন না । কোন বিদেশি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভারতকে এমন করিয়া ভালোবাসেন নাই এবং ভারতের হিত চেষ্টায় এমন অক্লান্ত পরিশ্রম করেন নাই । ”

0 comments:

0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in










'শ্রীভোজদেবপ্রভবস্য বামাদেবীসুত শ্রীজয়দেবস্য।
পরাশরাদিপ্রিয়বন্ধুকণ্ঠে শ্রীগীতগোবিন্দকবিত্বমস্ত।।'

'গীতগোবিন্দম্ 'গৌড়ের রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি জয়দেব কর্তৃক সংস্কৃত ভাষায় রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ। রচনাকাল ১২ শতক। এই কাব্যে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের গোপিনীদের সঙ্গে রাসলীলা — রাধার বিষাদ বর্ণনা, কৃষ্ণের জন্য ব্যাকুলতা, উপালম্ভ বচন, কৃষ্ণের রাধার জন্য উৎকণ্ঠা, রাধার সখীদের দ্বারা রাধার বিরহ-সন্তাপের বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে ।

গীতগোবিন্দম্ বাংলা, হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া, মরাঠি ইত্যাদি ভারতীয় ভাষা ছাড়াও ইংরেজি, জার্মান, ল্যাটিন প্রভৃতি ইউরোপিয় ভাষায় অনূদিত হয়। এ থেকেই কাব্যের জনপ্রিয়তা এবং প্রাসঙ্গিকতা অনুমান করা যায়।

‘গীতগোবিন্দম্' ভারতবর্ষে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় কাব্য তার প্রমাণ মেলে উড়িষ্যার মন্দিরে ওড়িষি নৃত্যে ও সুরে গীতগোবিন্দ-গান উপাসনারই একটি অঙ্গ হিসাবে। দর্শকশ্রোতার মনে যে সাড়া জাগে তাতে নানা আবেগের মিশ্রণ ঘটে। অন্তঃসলিলা ভক্তিরস এই কাব্যে প্রবাহিত। অধিকাংশ গানে পূর্বরাগ, মিলন, বিরহ ইত্যাদি শৃঙ্গাররসের নানা অনুষঙ্গ বর্তমান। শ্রোতা বা দর্শক বুঝতে পারে কৃষ্ণভক্তিই শৃঙ্গাররসের মেলবন্ধনে সম্পৃক্ত।

জয়দেব বার’শ শতকের সংস্কৃত কবি। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার অজয়নদের তীরবর্তী কেন্দুবিল্ব বা কেঁদুলি গ্রামে তাঁর জন্ম। কেউ কেউ তাঁকে মিথিলা বা উড়িষ্যার অধিবাসী বলেও মনে করেন। তাঁর পিতা ছিলেন ভোজদেব, মাতা বামাদেবী। পদ্মাবতী নামের এক সুন্দরী তরুণীকে তিনি বিবাহ করেন।

জয়দেব সম্বন্ধে নানা কাহিনি প্রচলিত আছে। জয়দেব ছিলেন লক্ষ্মণসেনের (১১১৯-১২০৫) রাজসভার পঞ্চরত্নের অন্যতম; অপর চারজন হলেন গোবর্ধন আচার্য, শরণ, ধোয়ী ও উমাপতিধর। কারও কারও মতে তিনি কিছুকাল উৎকলরাজেরও সভাপন্ডিত ছিলেন।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, জয়দেবের বিখ্যাত রচনা গীতগোবিন্দম্। এটি একটি সংস্কৃত গীতিকাব্য। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা এর মুখ্য বিষয়। ২৮৬টি শ্লোক এবং ২৪টি গীতের সমন্বয়ে ১২ সর্গে এটি রচিত।

বর্ণিত বিষয়ের তত্ত্বনির্দেশক বারোটি ভিন্ন ভিন্ন নামে সর্গগুলির নামকরণ করা হয়েছে, যথা: সামোদ-দামোদর, অক্লেশ-কেশব, মুগ্ধ-মধুসূদন, স্নিগ্ধ-মধুসূদন, সাকাঙ্ক্ষ-পুন্ডরীকাক্ষ, ধৃষ্ট-বৈকুণ্ঠ, নাগর-নারায়ণ, বিলক্ষ-লক্ষ্মীপতি, মুগ্ধ-মুকুন্দ, মুগ্ধ-মাধব, সানন্দ-গোবিন্দ এবং সুপ্রীত-পীতাম্বর। কাব্যের নায়ক-নায়িকা রাধা-কৃষ্ণ হলেও তাঁদের প্রতীকে জীবাত্মা-পরমাত্মার সম্পর্ক এবং নর-নারীর চিরন্তন প্রেমই এর মূল বক্তব্য। রাগমূলক গীতসমূহ এ কাব্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। পরবর্তীকালের বাংলা পদাবলি সাহিত্যে এর গভীর প্রভাব পড়েছে। বৈষ্ণব সম্প্রদায় ও সাহিত্য-রসিকদের নিকট গীতগোবিন্দম্ এক সময় পরম শ্রদ্ধার বিষয় ছিল।
গীতগোবিন্দম্ এর সর্গের নামগুলো থেকে বোঝা যায় এ কাব্যের নায়ক শ্রীকৃষ্ণ।

এই গান বা পদ এবং শ্লোকগুলি কৃষ্ণ রাধা অথবা কোন এক সখীর উক্তি-রূপে ব্যবহৃত হওয়াতে সমগ্র কাহিনীটি একটি নাটকের পালার আকার ধারণ করে। বারোটি সর্গের প্রত্যেকটিরই একটি নাম আছে তা উপরে উল্লেখ্য করা হয়েছে।

দ্বাদশ সর্গে বিরচিত ‘গীতগোবিন্দ’ মূলত চব্বিশটি গানের একটি পালা, এ ছাড়া কাহিনী-সূত্র ধরিয়ে দেবার জন্য রয়েছে বিভিন্ন ছন্দে রচিত কতকগুলি শ্লোক। এই সর্গগুলোর উপর সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে।

প্রথম সর্গে বর্ণিত হয়েছে----'সামোদ দামোদর’ : কৃষ্ণসন্ধানে তৎপরা শ্রীমতী রাধিকা এক সখীর সহায়তায় দেখতে পেলেন, অপর এক নায়িকার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ আমোদে মত্ত।

দ্বিতীয় সর্গ— 'অক্লেশ কেশব' : নিজের উৎকর্ষ আর রইলো না ভেবে শ্রীমতী নির্জনে এক লতাকুঞ্জে ক্ষুব্ধ হয়ে সখীকে বল্লেন, শ্রীকৃষ্ণ অপর যুবতীর প্রতি আসক্ত হওয়া সত্ত্বেও আমার মন তাঁর প্রতি অনুরক্ত কেন? শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের বিলাসকলা দেখে হয়তো বা রাধার কথাই স্মরণ করেছেন, তাঁর সঙ্গে রাধা মিলন কামনা করেছেন—কেশব সকলের ক্লেশ দূর করুন।

তৃতীয় সর্গ—'মুগ্ধ মধুসূদন' : শ্রীকৃষ্ণ ও অপর ব্রজাঙ্গনাদের ত্যাগ করে রাধার সন্ধানেই তৎপর হলেন। নিজের অপরাধবোধে তিনিও অনুতপ্ত। রাধাভাবে তন্ময় মুগ্ধ মধুসূদন রাধার সঙ্গে মিলনের কথাই ভাবছেন।

চতুর্থ সর্গ – ‘স্নিগ্ধ মধুসূদন': যমুনাতীরে বেতসকুঞ্জে অসহায় উদ্ভ্রান্ত মাধবকে এক সখী জানালেন তাঁর বিরহে রাধা অতিশয় কাতর হয়ে পড়েছেন; কখনো তিনি রোমাঞ্চিত, কখনো বিলাপরত, কখনো বা মূর্ছিত। একমাত্র স্নিগ্ধ মধুসুদনের কথা ভেবেই তিনি এখনো জীবিত রয়েছেন।

পঞ্চম সর্গ – ‘সাকাঙ্খ পুণ্ডরীকাক্ষ': রাধাকে তাঁর কুঞ্জে নিয়ে আসবার জন্য কৃষ্ণ সখীকে রাধার কাছে পাঠিয়ে দিলে সেই সখী রাধার নিকট কৃষ্ণের বিরহ-কাতর অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে জানালেন যে কৃষ্ণ ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে রাধার নাম ধরে কাঁদছেন। অতএব রজনী প্রভাত হবার পূর্বে শ্রীমতী যেন পুশুরীকাক্ষের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেন।

ষষ্ঠ সর্গ—‘ধৃষ্ট বৈকুণ্ঠ’ : সখী শ্রীকৃষ্ণের কাছে ফিরে এসে জানালেন যে শ্রীমতীর দেহ কৃষ্ণবিরহে বিকল, তার চলবার শক্তি নেই। এতএব ধৃষ্ট বা নির্লজ্জ-রূপে কৃষ্ণের এখন কর্তব্য বিপরীত অভিসারে রাধাকুঞ্জে গমন।

সপ্তম সর্গ – 'নাগর নারায়ণ’কৃষ্ণের প্রতীক্ষায় সময় কেটে চলে শ্রীমতীর; পাতা পড়ার শব্দে মনে হয় বুঝি কৃষ্ণ আসছেন। এদিকে জ্যোৎস্না দেখা দিলে রাধিকা একান্ত হতাশ হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন। তার মনে ভয় হলো, কৃষ্ণ কি তবে সঙ্কেত-নির্দিষ্ট বেতস কুঞ্জে না এসে অপর কোন নায়িকার অভিসারে গিয়েছেন? বিপ্রলব্ধা শ্রীমতী বহুবল্লভ কৃষ্ণের নাগর-রূপের কল্পনায় সাতিশয় মনঃপীড়া বোধ করতে লাগলেন।

অষ্টম সর্গ—“বিলক্ষ লক্ষ্মীপতিঃ যামিনী অবসানে কৃষ্ণ শ্রীমতীর কুঞ্জদ্বারে উপনীত হলে তাঁর দেহে অপর নারীর সম্ভোগচিহ্ন দর্শন করে শ্রীমতী তীব্র ভাষায় তাঁকে বিদ্ধ করতে লাগলেন। খণ্ডিত নায়িকার ভর্ৎসনায় বিলক্ষ অর্থাৎ বিস্মিত কৃষ্ণ তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

নবম সর্গ – 'মুগ্ধ মুকুন্দ' : মদনসত্তপা ক্ষুব্ধা কলহান্তরিতা রাধাকে লক্ষ্য করে সখী নির্জনে তাকে বল্লেন যে কৃষ্ণ যখন অভিসারে এসেছেন তখন আর মান করে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত হবে না। তিনি এসে মধুর কথা বলুন, তোমার হৃদয় যন্ত্রণাও দূরীভূত হবে।

দশম সর্গ—'মুগ্ধ মাধব'। সন্ধ্যার দিকে রাধার ক্রোধ কিছুটা প্রশমিত হলে কৃষ্ণ কাছে এসে রাধার রূপগুণের প্রশংসা করতে লাগলেন এবং তাঁর মান ত্যাগ করবার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন। অতঃপর শ্রীমতীর চরণযুগলে মস্তক স্থাপন করে শ্রীকৃষ্ণ মানিনীর মানভঞ্জন করলেন।

একাদশ সর্গ – 'সানন্দ গোবিন্দ': এইভাবে শ্রীমতীকে প্রসন্ন করে কৃষ্ণ কুঞ্জশয্যায় গেলে সখী রাধিকাকে অনুসরণ করতে বললেন। সখীরা সকলে কুঞ্জ থেকে বাইরে চলে গেলে অভিসারিকা রাধিকার লজ্জাও অপসৃত হলো।

দ্বাদশ সর্গ – ‘সুপ্রীত পীতাম্বর': সখীরা চলে গেলে শ্রীকৃষ্ণ সাদরে রাধিকাকে গ্রহণ করলেন। স্বাধীনভর্তৃকা শ্রীমতী রাধা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হলেন।

বিভিন্ন সর্গের শ্লোকগুলোতে রাধার উপস্থিতি বিশেষ ভাবে পরিলক্ষিত হয়।রাধা প্রধান চরিত্র।এ কাব্যের বড় একটা অংশ জুড়ে রাধার কথা বর্ণিত হয়েছে।তাঁর প্রেমের পূর্বরাগ, মিলন, বিরহ এ গ্রন্থের মুখ্য বিষয়। গানে ধ্রুবপদ প্রায়ই ঘুরে ঘুরে আসে। নাচে ওড়িষি ভঙ্গিরই প্রাধান্য। এই সব আঙ্গিকে শৃঙ্গাররস ও ভক্তির আবেশ মিশে রয়েছে তার পশ্চাতে আনুমানিক কয়েক শ’ বছরের যাত্রা, গান ও নাচের পৃথক ও সম্মিলিত শিল্পরূপটি মন্দিরে অনুষ্ঠিত হত তার সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। যেহেতু নৃত্যগীতেরই প্রাধান্য ছিল তাই শব্দ ও অর্থ কিছুটা গৌণ।

গীতিকবিতার প্রথম স্রষ্টা হলেন কবি জয়দেব। তাঁর সুপ্রসিদ্ধ 'গীতগোবিন্দ' কাব্যের মূল বিষয় রাধাবিরহ। কৃষ্ণ রাধাকে এড়িয়ে অন্য গোপিনীদের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন জেনে রাধার বিরহ, মান, মানভঞ্জনে কৃষ্ণের অনুনয়, সখী-দূতীর মধ্যস্থতায় উভয়ের মিলনই হল কাব্যের বিষয়বস্তু।

বৈষ্ণব পদাবলি, মঙ্গলকাব্য ইত্যাদিতে কবির পরিচয় যেমন ভণিতাংশে পাওয়া যায় তেমনই 'গীতগোবিন্দ'-র তৃতীয় সর্গ, সপ্তম গীতিতে উল্লেখ আছে-
'বর্ণিতং জয়দেবকেন হরেরিদং প্রবণেন। কেন্দুবিল্বসমুদ্রম্ভবরোহিণীরমণেন।।'

এই ভণিতা অনুসরণে বলা যায় যে জয়দেবের জন্মস্থান কেন্দুবিল্ব। তিনি ছিলেন রাজা লক্ষ্মণ সেনের (শাসন পর্ব ১১৭৮-১২০৬ ) সভাকবি। এর সমর্থনে লক্ষ্মণ সেনের সভামণ্ডপের দ্বারে প্রস্তর ফলকে খোদিত শ্লোকের উল্লেখ পাওয়া যায়। অতীতের কেন্দুবিল্ব ছিল সেনপাহাড়ি পরগণার অন্তর্গত। এই কেন্দুবিল্বই অপভ্রংশ হয়ে কেঁদুলি বা কেন্দুলি হয়। পরবর্তীতে তা জয়দেব-কেঁদুলি নামে পরিচিত হয়। এটি বোলপুর মহকুমার ইলামবাজার ব্লকের একটি গ্রাম। স্থানটি বর্ধমান বীরভূম জেলার সীমা নির্দেশকারী অজয় নদের তীরবর্তী এলাকায়।

জয়দেবের জন্মসন, বাল্যকালের কথা, 'গীতগোবিন্দ'-র রচনাকাল, সভাকবি হিসেবে অবস্থান ইত্যাদি সমস্তই যেহেতু অজ্ঞাত, স্বাভাবিকভাবে সেগুলি আনুমানিক। তাঁর রচনা 'গীতগোবিন্দম্'-ই কেবল সংস্কৃত সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ। চক্রদত্তের সংস্কৃত 'ভক্তমাল', নাভজীদাসের 'ভক্তমাল', বীরভূমের কবি বনমালী দাসের 'জয়দেব-চরিত', 'শেকশুভোদয়া' প্রভৃতি গ্রন্থ রচিত হয়েছে জয়দেবকে নিয়ে। রচনাগুলি মূলত কিংবদন্তিকে আশ্রয় করে রচিত। কিংবদন্তির বহিরঙ্গে বহু পরিবর্তন ঘটে দিনে দিনে। কালে কালে তার অবয়বে কল্পনার রঙ লাগে।

পুরীতে পদ্মাবতীকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়া নিয়ে যেমন কিংবদন্তি আছে তেমনি সবচেয়ে জনপ্রিয় কিংবদন্তি হল 'দেহিপদপল্লবমুদারম্‌' লেখা নিয়ে। বিবাহের পর জয়দেব একটি কুটির নির্মাণ করে রাধাবিনোদ মূর্তি স্থাপন করেন এবং পদ্মাবতীকে মূর্তির পরিচর্যার দায়িত্ব দেন। প্রতিনিয়ত সেই যুগলমূর্তি দেখে ভক্তিপরায়ণ জয়দেবের মনে তার লীলা বর্ণনা করার একান্ত আগ্রহ জন্মায়। তিনি রচনা করে ফেলেন 'গীতগোবিন্দম্' নামক দ্বাদশ সর্গের অপূর্ব কাব্য।

এখানেও কিংবদন্তি আছে যে শ্রীকৃষ্ণ নিজের হাতে লেখনী ধারণ করে সেখানে অক্ষর সংযোজন করেছিলেন। রাধিকার মধুর-রস বর্ণনা করতে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর চরণে পতিত হন-জগতে এটি প্রসিদ্ধ। কিন্তু এ-বিষয়ে জয়দেব দ্বিধান্বিত ছিলেন। তিনি তাঁর প্রাণপ্রিয় প্রভুর লাঞ্ছনা বর্ণনা করতে পারছিলেন না। 'মম সিরসি মণ্ডনম্' পর্যন্ত লিখে দুঃখিত মনে সাগরে স্নান করতে যান। ইতিমধ্যে জয়দেবের রূপ ধারণ করে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ এসে 'দেহিপদপল্লবমুদারম্‌' অংশটি লিখে দেন। পদ্মাবতী তাঁর আহার এবং বিশ্রামের ব্যবস্থা করেন এবং নিজেও আহারে বসেন। ইতিমধ্যে জয়দেব ফিরে আসেন। স্বামীর আগে পদ্মাবতীর আহারপর্ব দেখে অবাকই হন জয়দেব। ততোধিক অবাক হয়ে পদ্মাবতী জিজ্ঞাসা করেন, আপনি আগেই ফিরে এসেছেন এবং অসমাপ্ত অংশ লিখে ফেলেছেন। বুদ্ধিমান জয়দেব এই ঘটনার গূঢ়ার্থ বুঝলেন এবং পংক্তিটি দেখে প্রেমাবেশে উন্মত্ত হলেন। পদ্মাবতীর চরণ ধারণ করে বললেন-তুমিই ধন্যা, তোমারই জীবন সার্থক। তুমি যাঁর দর্শন আজ পেলে তিনিই তোমার প্রকৃত স্বামী।

জয়দেব 'গীতগোবিন্দম্' রচনা করেছিলেন এটা প্রমাণিত সত্য। কিন্তু তাঁর জীবনের নানা ঘটনাবলি নিয়ে নানা মত প্রচলিত। সেই মতের ওপর ভর করেই বলা যায়-জগন্নাথধাম, জয়পুর, বৃন্দাবনধাম পরিক্রমার পর জয়দেব সস্ত্রীক ফিরে আসেন কেঁদুলিতে। এরপর জন্মভূমিতেই ধর্মানুমোদিত বিবিধ কার্যানুষ্ঠানের মধ্যে কাল যাপন করেন। তাঁর প্রয়াণকাল জানা যায় না। প্রায় ৫০০ বছর পর কবি জয়দেবের স্মৃতি জাগরুক রাখতে বর্ধমান রাজপরিবার কেঁদুলিতে নির্মাণ করায় নবরত্ন রাধাবিনোদ মন্দির। পৌষ সংক্রান্তিতে জয়দেব-কেঁদুলিতে মেলা বসে। লক্ষ মানুষের সমাগমে প্রাচীন এই মেলা মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয় আউল-বাউল-সহজিয়াদের আগমনে। রাধাবিনোদ মন্দিরের প্রধান উৎসব রথ, দোল, রাস ইত্যাদি। তবে কেঁদুলি মেলা এই মন্দিরের উৎসব নয়।

এই অসাধারণ শ্লোক দিয়ে এই কাব্য রচনা করেন----মেঘৈমেদুরমম্বরং বনভুব: শ্যামাস্তমালদ্রুমৈঃ। নক্তং ভীরুরয়ং ত্বমেব তদিমং রাধে গৃহং প্রাপয়। ইখং নন্দনিদেশতশ্চলিতয়োঃ প্রত্যধ্বকুঞ্জদ্রুমং, রাধামাধবয়োর্জয়ন্তি যমুনাকূলে রহঃকেলয়ঃ।।
বাংলা অর্থ----আকাশ মেঘে মেদুর হয়ে উঠেছে, বনভূমি তমালতরুতে শ্যামবর্ণ ধারণ করেছে। “(এখন) রাত্রি, এ (কৃষ্ণ) ভীরু, তাই রাধিকা তুমিই একে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এস,”নন্দের এই নির্দেশে রাধামাধব যমুনাতীরে পথে চলতে চলতে পথের প্রত্যেকটি কুঞ্জে যে কেলি করলেন তা-ই তোমাদের রক্ষা করুক।

ওই আশ্চর্য প্রথম চরণটি তার ধ্বনিমাধুর্যে নয়শো বছর ধরে শ্রোতা পাঠককে মুগ্ধ রেখেছে।
দ্বিতীয় শ্লোকে জয়দেব নিজের পরিচয় দিয়েছেন, এর তিনটি চরণই সমাসবদ্ধ এক-একটি পদ, খুব একটা বৈশিষ্ট্য নেই, শুধু বিষয়বস্তুটি নির্দেশিত হল : বাসুদেবের রতিকেলির কথাই এর উপজীব্য।

এই অংশটুকু দেখুন -- যদি হরিস্মরণে সরসং মনো/ যদি বিলাসকলাসু কুতূহলম। মধুর কোমলকান্ত-পদাবলীংশৃণু তদা জয়দেবসরস্বতীম।।
বাংলা অর্থ----যদি হরির স্মরণে মন সরস হয়, যদি শৃঙ্গার কলায় কৌতূহল থাকে তা হলে এই মধুর, কোমল, কমনীয় জয়দেবের কাব্য শোন। পড়তে পড়তে বোঝা যায় কবিতার বক্তব্য ও কোমলতা।

গীতগোবিন্দম্ এর নিচের এই বিখ্যাত শ্লোকটি প্রতি দৃষ্টি দিতে পারি।

‘চন্দনচর্চিতনীলকলেবরপীতবসনবনমালী।
কেলিচলন্মণিকুণ্ডলমণ্ডিতগণ্ডযুগস্মিতশালী।।’

বাংলা অর্থ -----কৃষ্ণের নীল শরীরে চন্দনচর্চা, গণ্ড দুটিতে স্মিত হাসি, প্রণয়কালে আন্দোলিত কানের মণিকুণ্ডল আন্দোলিত।

' ত্বমসি মম ভূষণং ত্বমসি মম জীবনংত্বমসি মম ভব-জলধিরত্নম।। ' গীতগোবিন্দম্ এই শ্লোকটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলা অর্থ-----
তুমিই আমার ভূষণ, তুমি আমার জীবন, এই জীবন-সমুদ্রে তুমিই আমার রত্ন।

এখানে ভূষণ, বা রত্ন প্রেমকে ব্যঞ্জিত করে না, করে কেবল ‘জীবন’ শব্দটি কিন্তু আড়ম্বর সর্বস্ব, অলংকার নির্ভর এ কাব্যে ভূষণ বা রত্ন প্রাধান্য পাবেই, তবু শ্লোকটি বেশই গভীরতায় পৌঁছোয়।

এই কাব্যের মনোরম রচনাশৈলী, ভাবপ্রবণতা, সুমধুর রাগরাগিণী, ধর্মীয় তাৎপর্য তথা সুললিত কোমল-কান্ত-পদাবলী সাহিত্যিক রসপিপাসুদের অপার আনন্দ প্রদান করে।
কবি জয়দেব রচিত ' গীতগোবিন্দম্' কাব্যটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত হলেও পৃথিবীর নানা ভাষায় তা অনূদিত হওয়ায় আজ তা বিশ্বসাহিত্যে চিরন্তন কাব্য হিসাবে বিবেচিত।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in








৩৯

বের্শেম আগে যে লেফটেন্যান্টকে পেয়েছিল গান কম্যান্ডার হিসেবে, তার নাম গ্রাশ্‌ট। যুদ্ধে যোগ দেবার আগে গ্রাশ্‌ট ছিল ধর্মযাজক। বের্শেম খুব বেশি ধর্মযাজকের সংস্পর্শে আসেনি সেভাবে কোনোদিন। তবে তার মতে গ্রাশ্‌ট বেশ ভালো মানুষ ছিল। গ্রাশ্‌ট সব সময় তার বরাদ্দ সাতটা গোলা হাইডেসহাইমের বাঁয়ে নদীর মোহনার দিকে ছুঁড়ত। সেখানে একটা কর্দমাক্ত বাদাবন ধরনের ব-দ্বীপ জেগে ছিল নদীর মুখে। উঁচু উঁচু ঘাসের বন, বেতের ঝোপ সেখানে। স্থানীয় বাসিন্দারা ওই জায়গাটাকে বলে কের্পেল। সেখানে ছুঁড়লে কারো আঘাত লাগার কথা নয়। বের্শেম তার নোটবইতে দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার লিখে রাখত… ‘নদীর মুখে সন্দেহজনক নড়াচড়া।’ লেফটেন্যান্ট এই বিষয়ে আর কিছু বলেননি। ফলে গ্রাশ্‌ট সাতটা গোলা ওই জায়গাটাতেই ছুঁড়ত। কিন্তু দিনদুয়েক হল আরেকজন সেনা মোতায়েন হয়েছে এখানে। সেই সার্জেন্টের নাম শ্নিভিন্ড; সে আবার সাতটা গ্রেনেডের প্রতিটার ব্যাপারে হিসেবী। জ্যাম ফ্যাক্টরির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমেরিকান সেনার গাড়িটায় অবশ্য সে গোলা ছোঁড়ে না। শ্নিভিন্ড-এর লক্ষ্য হল সব সাদা পতাকাগুলো। আসলে ভাইডেসহাইমের সব বাসিন্দাদের মনে এই আশা ছিল যে আমেরিকান সেনারা তাদের জায়গাটা হয়তো দখল করে নেবে। তাই অনেকেই সুরক্ষিত থাকবার জন্য বাড়িতে সাদা পতাকা টাঙ্গিয়ে রেখেছে। কিন্তু আমেরিকানরা কাছেই ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকলেও জায়গাটা দখল করেনি। আসলে ভাইডেসহাইমের অবস্থানটা একটু অদ্ভুত। নদীর বাঁকের মধ্যে; ফলে গোটা গ্রামের প্রতিটি বাড়ি দৃশ্যমান। সেই কারণে আমেরিকান সেনারা হাইডেসহাইম অবধি এসে তারপর থেমে গেছে। হাইডেসহাইমের অবস্থান আবার উল্টো। একটু ভেতরদিকে। ফলে চট করে বাইরে থেকে দেখা যায় না। সেইজন্য আমেরিকান সেনাদের আর এগোবার কোনো পরিকল্পনা নেই। জার্মানির বিভিন্ন জায়গায় মার্চ করতে করতে প্রায় ২০০ কিমি ভেতরে ঢুকে গেছে আমেরিকান সেনা; প্রায় দেশটার মাঝখানে পৌঁছে গেছে। কিন্তু শুধুমাত্র এই অঞ্চলে হাইডেসহাইম অবধি এসে তিন সপ্তাহ ধরে এখানে বসে আছে। একটা গোলা যদি হাইডেসহাইমের দিকে কেউ ছুঁড়েছে, তবে আমেরিকানরা একশখানার বেশি ছুঁড়ে প্রত্যুত্তর দেবে। সেইজন্য এখন কেউ হাইডেসহাইমের দিকে ছুঁড়ছে না গুলিগোলা। ফলে যে সাতখানা গ্রেনেড বরাদ্দ, সেই সবকটা ভাইডেসহাইম এবং তার আশেপাশে ছুঁড়তে হবে। ভাইডেসহাইমের যেসব বাসিন্দারা সাদা পতাকা টাঙ্গিয়ে রেখেছে, সার্জেন্ট শ্নিভিন্ড তাদের শাস্তি দিতে চায়। যারা সাদা পতাকা টাঙ্গিয়েছে, শ্নিভিন্ড-এর মতে তাদের না আছে সাহস, না আছে দেশপ্রেম। সে সাদা পতাকাগুলো সহ্য করতে পারছে না।

যাই হোক, বের্শেম আবার তার নোটবইতে লিখে রাখল, ‘৯ টা বাজে, নদীর মুখে সন্দেহজনক নড়াচড়া।’ ১০.১৫ এবং ১১.৪৫ নাগাদ সে আবার একই জিনিস লিখে রাখল। ‘হাইডেসহাইম থেকে আমেরিকান সেনার গাড়ি এসে জ্যামের কারখানার সামনে দাঁড়াল’। বারোটা নাগাদ সাধারণত সে কিছু সময়ের জন্য নিজের জায়গাটা ছেড়ে খাবার খেতে নামে। আজ যখন সে মই বেয়ে নামতে যাবে, নিচ থেকে শ্নিভিন্ড বলে উঠল …

‘এক মিনিট অপেক্ষা করুন। ওইখানেই থাকুন একটু।’ বের্শেম আবার হামাগুড়ি দিয়ে খামারবাড়ির জানালায় দূরবিনের কাছে ফিরে গেল। শ্নিভিন্ড তার হাত থেকে দূরবিনটা নিয়ে নিল। তারপর দূরবিনে চোখ রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে দেখতে লাগল। বের্শেম পাশে বসে তাকে লক্ষ্য করতে লাগল। আসলে শ্নিভিন্ড এমন একজন মানুষ, যে প্রায় কোনো কিছুই সহ্য করতে পারে না। কিন্তু আত্মবিশ্বাস প্রচুর এবং চারপাশের লোকজনকে বুঝিয়ে ছাড়ে যে সে অনেক কিছুই পারে। যেরকম উৎসাহ নিয়ে সে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে এবং দূরবিন তাক করে নির্জন, নিষ্প্রাণ ভাইডেসহাইমের দিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে, এই পুরো ব্যাপারটাই দেখানেপনা ছাড়া কিচ্ছু নয়। বের্শেম লক্ষ্য করে দেখল… যে তারামার্কা মেডেলটা বুকে আটকানো আছে শ্নিভিন্ডের, সেটা একদম নতুন। এছাড়া ঘোড়ার ক্ষুর মার্কা মেডেলটাও নতুন মনে হচ্ছে। শ্নিভিন্ড দূরবিনটা ফেরত দেয় তার হাতে, তারপর গজগজ করতে থাকে… ‘শুয়োর সব কটা, অপদার্থ, অভিশপ্ত শুয়োরগুলো সাদা পতাকা আটকে রেখেছে… দিন আমায়, আপনার নোটবুকটা দিন!’ বের্শেম দেয়।

শ্নিভিন্ড নোটবুকটার পাতা উল্টে উল্টে দেখতে থাকে… ‘অর্থহীন কাণ্ডকারখানা!’ বলে ওঠে সে… ‘আমি জানি না ওই নদীর মুখে বাদাবনে আপনি রোজ কী দেখেন! ওইখানে ব্যাঙ ছাড়া কিছু নেই। দেখি, দিন আমায়’… বলে সে দূরবিনটা আবার ছিনিয়ে নেয়। এবার তাক করে নদীর মোহনার দিকে। বের্শেম দেখতে থাকে লোকটার দিকে। সে দেখে যে লোকটার মুখের চারদিকে হালকা থুতুর লালা লেগে আছে… সরু সুতোর মত লালা ঠোঁটে লেগে নিচের দিকে ঝুলে আছে কিছুটা।

‘কিচ্ছু নেই’ বিড়বিড় করে শ্নিভিন্ড… ‘একেবারে কিছুই নেই ওই বাদাবনে… কিচ্ছুটি নড়ছে না… অর্থহীন ভাবনা!’ বের্শেমের নোটবই থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে নেয় লোকটা। নিজের পকেট থেকে এক টুকরো পেন্সিল বের করে। জানালা দিয়ে আবার দেখতে থাকে। তারপর কী যেন লেখে পাতায়… বিড়বিড় করে… ‘শুয়োর… শুয়োরের দল।’ তারপর কোনো রকম অভিবাদন না জানিয়ে উঠে চলে যায় লোকটা। নেমে যায় মই বেয়ে। এক মিনিট পরে বের্শেমও ওই জায়গা ছেড়ে উঠে চলে যায় নিজের খাবার খেতে।

--… ---… ---…



পাহাড়ের উপর থেকে, একটা আঙ্গুরক্ষেতের জমিতে দাঁড়িয়ে ফাইনহালস বুঝতে পারল যে ভাইডেসহাইম কেন আমেরিকান বা জার্মান, কোনও বাহিনী এখনও দখল করেনি। এই জায়গাটা দখল করে আদতে কোনও লাভ হবে না কোনও পক্ষেরই। গোটাপনেরো বাড়ি আর একটা বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা জ্যামের কারখানা… এছাড়া আর কিছু নেই। রেলস্টেশন এখানে নেই; সেটা হাইডেসহাইমে। নদীর উল্টোদিকে আউয়েলব্যার্গ, সেখানে রেলস্টেশন আছে। কিন্তু ওই জায়গাটা জার্মানরা দখল করে রেখেছে। ভাইডেসহাইম একটা নদীর বাঁকের মধ্যে, নদীটা এখানে দড়ির ফাঁসের মত বাঁক নিয়েছে। ভাইডেসহাইম এই দৃশ্যমান বাঁকের মধ্যে একেবারে ফেঁসে রয়েছে।

ভাইডেসহাইম আর পাহাড়ের মাঝে অপেক্ষাকৃত গোপন একটা ঢালের ফাঁকে রয়েছে হাইডেসহাইম অঞ্চলটা। ফাইনহালস দেখতে পেল ওই এলাকার মাঠে মাঠে অনেক ট্যাঙ্ক জড়ো করা আছে। স্কুলের মাঠে, গির্জার মাঠে, বাজারের চৌমাথায়, হোটেল, সরাইখানার আঙিনায় সর্বত্র ট্যাঙ্ক আর সেনাবাহিনীর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলো এমনকি গাছপালা বা অন্য কিছু দিয়ে ঢেকে ক্যামোফ্লাজ করাও নেই। পাহাড়ের ঢালে উপত্যকায় এখন গাছগুলো ফুলে ফুলে ভরে উঠছে। সাদা, গোলাপি, নীলচে সাদা ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে চারিদিক। বাতাস হালকা হয়ে গেছে। বসন্তের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। ফিঙ্কের জমি, বাড়ি, সব দেখা যাচ্ছে উপর থেকে। রাস্তার দু’ পাশে দু’টো চৌকো উঠোন, দাঁড়িয়ে থাকা চারজন প্রহরী… সব দেখতে পেল ফাইনহালস। কফিনের দোকানটার উঠোনে বসে একটা লোক কাজ করছে। বিরাট একটা সাদাটে হলদে বাক্স, একটু হেলে থাকা, নতুন একটা কফিন বানাচ্ছে লোকটা। সদ্য পালিশ করা কাঠ রোদ্দুরে চকচক করছে। লালচে হলুদ আভা ছড়াচ্ছে যেন। লোকটার বউ কাছেই একটা বেঞ্চে বসে আছে। রোদ্দুরে বসে সব্জি কেটেকুটে পরিষ্কার করছে।

রাস্তায় রাস্তায় লোকজন দেখা যাচ্ছে। মেয়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, দোকান বাজারে কেনাকাটা করছে। সেনাদের দেখা যাচ্ছে ইউনিফর্ম পরা। শহরতলির এক প্রান্তে স্কুলবাড়ি থেকে ক্লাসের শেষে এইমাত্র ছাত্রছাত্রীরা বেরিয়ে এল; দল বেঁধে পথে হেঁটে যাচ্ছে তারা। কিন্তু উল্টোদিকে ভাইডেসহাইমে সবকিছু নিস্তব্ধ, চুপচাপ। গাছের পাতায় কিছু কিছু বাড়ি ঢেকে আছে। তবে ফাইনহালস ওখানে সবাইকে চেনে। সব কটা বাড়ি তার চেনা। এক ঝলক দেখে সে লক্ষ্য করল ব্যার্গ এবং হপেনরাথ… এদের বাড়িগুলো গোলা লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু তার বাবার বাড়িটা একটাও আঁচড় লাগেনি। রাস্তার উপরে বাড়িটার চওড়া, হলুদ রঙের সুন্দর, শান্ত সামনের অংশটা দেখা যাচ্ছে। ফাইনহালস দোতলায় তার বাবা মায়ের ঘরের উপরের ছাদের অংশে সাদা পতাকা লাগানো দেখতে পেল। অন্যান্য বাড়ির তুলনায় তাদের বাড়ির পতাকাটা অনেক বড়। চারদিকে লিনডেন* গাছ সবুজে সবুজ হয়ে উঠছে। কিন্তু এলাকা একেবারে জনমানবশূন্য। একটিও প্রাণী কোনও জায়গায় দেখা যাচ্ছে না। সাদা পতাকাগুলো শক্ত করে লাগানো আছে বাড়িগুলোর গায়ে। অদ্ভুত শ্মশানের মত শান্তি বিরাজ করছে এলাকায়। জ্যামের কারখানার উঠোনটাও একদম খালি। মরচে ধরা খালি বালতিগুলোর স্তুপ দেখা যাচ্ছে। কারখানার শেডটা তালাবন্ধ। হঠাৎ ফাইনহালসের চোখে পড়ল যে হাইডেসহাইম স্টেশন থেকে উপত্যকা, ফলের বাগান পেরিয়ে একটা আমেরিকান গাড়ি দ্রুতবেগে ভাইডেসহাইমের দিকে যাচ্ছে। সাদা ফুলে ফুলে ঢাকা গাছের মধ্য দিয়ে মাঝে মাঝেই গাড়িটা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু অবশেষে দেখা গেল যে ভাইডেসহাইমের প্রধান সড়কের উপর দিয়ে যেতে যেতে গাড়িটা জ্যামের কারখানার গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

‘যাচ্চলে… একী!’ ফাইনহালস নিচুস্বরে বলে। তারপর আঙুল দিয়ে গাড়িটার দিকে দেখিয়ে বুড়ো ফিঙ্ককে জিজ্ঞেস করে… ‘এটা কী ব্যাপার?’

পাহাড়ের উপরে একটা শেডের সামনে বেঞ্চিতে বুড়ো ফিঙ্ক বসেছিলেন ফাইনহালসের পাশেই। মাথা নাড়েন তিনি… ‘কিছু নয়… সেরকম কিছু না… সেরকম অর্থপূর্ণ ব্যাপার নয়… এ হল ফ্রয়লাইন মের্ৎজবাখের প্রেমিক, রোজ একবার করে দেখা করতে আসে।’

‘একজন আমেরিকান?’

‘হ্যাঁ’ … বলে ওঠেন ফিঙ্ক… ‘আসলে স্বাভাবিক কারণেই ফ্রয়লাইন মের্ৎজবাখ বাড়ি থেকে বেরোতে ভয় পান। কারণ জার্মানরা মাঝে মাঝে ভাইডেসহাইমের উপরে গোলা ছুঁড়তে থাকে। সেজন্য লোকটিই আসে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে।’



(চলবে)



*লিনডেন গাছ বা লাইমউড ইউরোপের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় জন্মানো খুব পরিচিত ওষধিগুণসম্পন্ন গাছ। এই গাছ প্রতীকী অর্থে প্রেমপ্রীতি ও শান্তির বাহক। পাতাগুলি হৃদয়চিহ্নের আকারের।





ReplyForward


Add reaction

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in





বারো



রবিবাবুর স্ত্রীর নাম আলো। আলো পাশের বাড়ির বৌটার সঙ্গে মেশে।তার বরের নাম অভয়।

অনেকগুলো ছেলে মেয়ে জন্মের পর মরে যাওয়ায় অভয় এবারের ছেলের নাম রাখলো গু,য়ে। ভালো নাম রাকবো না রে। আবার যদি মরে যায়। পরের বছর যে হবে তার নাম রাকবো আকু। বললো,অভয়। গ্রামের পুরোহিত বললো,ঠিক করেছো। এইবার তোমার ছেলে,মেয়ে বাঁচবে।

ছেলে দুটো বাঁচার পরে আরও দুটো মেয়ে হলো। আর সন্তান নিলো না অভয়। অনেকে বললো,সংসার ছোটো রাকো,তাহলে অভাব হবে না। অভয় বললো,আমার বন্ধু রামুর তো নয়টা ছেলে আর দুটো মেয়ে। আছে তো দু বিঘে জমি। ওরা বুঝলো,তর্ক করে লাভ নেই। যে বোঝার নিজে থেকেই বোঝে।

তারপর বড় হয়ে স্কুলে ভরতি হওয়ার সময় আকুর নাম হলো সমর আর গুয়ের নাম হলো অমর। আর ভয় নেই। শিব ঠাকুরের কাছে মানত করে অভয়,ছেলেদের বললো,বছরে একবার গাজনের সময় ভক্ত হবি। তাহলে সব বিপদ কেটে যাবে। অভয় ভাবে,মেয়েরা তো তাড়াতাড়ি বাড়ে। বিয়ে দিতে হবে। অভাবের জন্য ওরা বেশিদূর পড়তে পারলো না। সমর মুদিখানার দোকানে কাজ নিলো। আর মেয়েরা বাড়ির কাজ করে। অমর পড়াশোনায় ভালো বলে স্কুল ছড়লো না। হেড মাষ্টার নিজে খরচ দিয়ে অমরকে পড়াতেন স্কুলে। তখনকার দিনে স্কুলে পড়তে গেলে টাকা,পয়সা লাগতো।কাদা, মাটির রাস্তা গ্রামে। বর্ষাকালে মুদিখানার মাল রেলস্টেশন থেকে সমর মাথায় করে নিয়ে আসতো। নুনের বস্তাও মাথায় করে আনতো। লোকে বলতো অভয়কে,অত খাটাস না ছেলেটাকে। চোখে, কোমরে রোগ ধরে যাবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা।

মেয়ে দুটোর একই দিনে বিয়ের ব্যবস্থা করলো অভয়। বড়ো মেয়ের বয়স সতেরো। আর ছোটো মেয়ের বয়স ষোলো। বেশ ধুমধাম হলো। কলা পাতা দিয়ে গেট বানানো হলো। সতরঞ্জি পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা হলো। গরীব মানুষ। তবু বাড়ির সকলে খুব আনন্দ করলো।বিয়ের দিনে বর পথে দুর্ঘটনায় মারা গেল। কপাল পুড়ল মেয়েটার।



তারপর চলে এল জগদ্ধাত্রী পুজো।এই গ্রামে ধূমধাম করে মশাল জগদ্ধাত্রী ঠাকুরের পুজো হয়। গ্রামের বাজারে বহু বছর যাবৎ এই পুজো হয়ে আসছে। পাটকাঠির মশাল জ্বালিয়ে এই পুজো মহা সমারোহে পালন করা হয়। কথিত আছে জ্ঞানের আলো এই দেবি জগতে ছড়িয়ে দেন। তাই আলোময় মশাল জ্বালিয়ে দেবির পুজো করা হয়। ভিন্ন মতও অনেক আছে।

তবে মতবাদের ককচকচানির উর্ধ্বে উঠে সকল গ্রামবাসী এক হয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হন এই কটা দিন।পাটকাঠির বোঝা বেঁধে বড় বড় মশাল তৈরি হয়। মশালে আগুন ধরিয়ে ঢাক ঢোলের তালে তালে নাচতে থাকে ভক্তের দল। চারদিকে আলোয় আলোময় হয়ে ওঠে পুজোমন্ডপ। মশাল জ্বালিয়ে গ্রাম ঘোরে প্রতিমাসহ মশালবাহির দল। বড় সুন্দর এই দৃশ্য। সব মানুষ ভেদাভেদ ভুলে মেতে যান এই উৎসবে।আর কোথাও এই পুজো আছে কি না জানা নেই রবিবাবুর।তবে তিনি বলেন,এই পুজোয় গ্রামবাসীর আনন্দ তাকেও আনন্দিত করে তোলে।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(১৫)

বেলগাছিয়ায় অকল্যান্ড সায়েবের সুদৃশ্য বাগানবাড়িটি সম্প্রতি নব্য শিল্পোদ্যোগী জমিদার বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রায় লাখ দুয়েক টাকায় কিনে একটি ব্যক্তিগত মজলিশের কেন্দ্রবিন্দু করে শহর কলকাতায় এখন বেশ জাঁক দেখাচ্ছেন। চোরবাগানের মল্লিকদের বাড়িটি শ্বেতপাথরের বলে তা এতদিন লোকের চোখে জ্বলজ্বল করত। আজকাল দ্বারকনাথের 'বেলগাছিয়া ভিলা' সেই দর্শনসুখের সামনে জোরালো একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।

এই সুরম্য অট্টালিকাটির সমস্ত আসবাব আনানো হয়েছে সুদূর ইংল্যান্ড, ও ইতালি থেকে। বিশেষ বিশেষ দিনে আলোর মালায় সেজে উঠে বাড়িটির রূপান্তর ঘটে যায় রূপকথার দ্বিতীয় অমরাবতীতে।

সেদিন ঈশ্বর গুপ্ত নামে এক রসিক নাগরিক কবিয়াল তার একটি বিদ্রুপাত্মক ছড়ায় সেদিন তো কাগজে কয়েকটি লাইন লিখেই বেশ শোরগোল ফেলে দিয়েছে। বাগবাজারে এখন রূপচাঁদ পক্ষীদের আখড়ায় গঞ্জিকা সেবনে টং হয়ে গায়েন পক্ষীদের দল ধুয়ো ধরে থেকে থেকেই ছড়াটি নানারকম ব্যঙ্গকন্ঠে সোচ্চারে গেয়ে উঠছে,

‘‘বেলগাছিয়ার বাগানে হয় ছুরি কাঁটার ঝনঝনি....

খানা খাওয়ার কি মজা আমরা তাহার কি জানি?...ও জানেন ঠাকুর কোম্পানী...!"

.....

আজকের নৈশভোজটি এক পার্সী জাতীয় শিল্পোদ্যোগী রুস্তমজীর সাফল্যের দরুণ তাঁর মিত্র ও ব্যবসায়ী অংশীদার বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুরের সৌজন্যে।

গোলগাল চেহারার এই পার্সী বণিকটি কার টেগোর এন্ড কোম্পানিতে কিছু মুদ্রা বিনিয়োগ করা ছাড়াও জলযানের ব্যবসাতেও সহযোগিতা চেয়ে কলকাতায় এসেছেন।

এসব বাণিজ্যসাধনে এখন বাঙালীদের মধ্যে দ্বারকানাথ অগ্রগণ্য বলে দুজনের মিত্রাভাষ ক্রমশ শক্ত ভিতের মধ্যে এসে দাঁড়াতে চলেছে। তাই সানন্দে এই মজলিশে দ্বারকানাথ স্বয়ং রামমোহনকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে তার বিশিষ্ট বন্ধুমহলের সাথে রুস্তমজীকে পরিচিত হতে সাহায্য করছেন।

হিমায়িত পুডিং এর পাত্র হাতে রামমোহন হাসিমুখে রুস্তমজীকে সম্ভাষণ জানিয়ে শিষ্টতা বজায় রাখলেন। তিনি অনর্গল পারস্যভাষায় জেন্দা-আবেস্তা' থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন দেখে রুস্তমজী বিস্ময়ে হতবাক।

এসবের ফাঁকেই রামমোহন দ্বারকানাথকে আলাদা ডেকে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের অগ্নিদহন সংক্রান্তটি সবিস্তারে জানালেন। তবে প্রতিষ্ঠানটি ক্রয়ের বিষয়ে এখুনি কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে আরও একবার লাটভবনে গিয়ে মন্ত্রণা করার বিষয়েই দ্বারকানাথ জোর দিল।

তবে রামমোহনের বিলাত গমনের বিষয়ে তার কোনও আপত্তি নেই। বরং দ্বারকানাথেরও খুব ইচ্ছা যে রাণীগঞ্জ-মানভূমে কয়লাখনির ব্যবসা সংক্রান্ত জটিলতা স্বল্পদিনের মধ্যে মিটে গেলে সেও রামমোহনের সাথে বিলাত যাত্রায় শরিক হতে পারে।

.....

গোলকপতি দেখল সামনের আকন্দ ঝোপের ফাঁক দিয়ে লাল রং এর শাড়ির পাড়ের কিয়দংশটি দেখা যাচ্ছে।

বোঝা গেল, ওই মেয়েটি ঝোপটিতে এখনও আত্মগোপন করে আছে। হিসেবমতন তার শৌচকর্মটি কিন্তু প্রায় আধঘন্টা আগে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।

সে ধীরপায়ে ঝোপড়াটির কাছে এসে দাঁড়াতেই মেয়েটি মুখে গোঁ গোঁ শব্দ করে মূর্ছিত হয়ে পড়ল।

গোলকপতি বুঝতে পারল দূর্বলদেহে ও অর্ধভুক্ত জঠরে ধুতুরার বীজের গুঁড়ো জলের সাথে অতিরিক্ত মাত্রায় পান করার কারণে অতি উত্তেজনার বশেই সে সংজ্ঞা হারিয়েছে।

এরপর কাছে এসে সে মেয়েটির আব্রু বাঁচিয়ে তার মাথাটি তার নিজের কোলে তুলে নিয়ে তাকে অনেকক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।

মেয়েটির ভ্রুযুগল কিঞ্চিৎ প্রগাঢ়। সে শ্যামবর্ণা ও দীর্ঘাঙ্গী। তবে তার মুখশ্রীটিকে এক অপরূপ দার্ঢ়্যতার সৌকর্যে সাজিয়ে তুলেছে তার চিবুক ও উন্নত নাসিকার আবেশটি।

গোলকপতির মনে হতে লাগল বৃদ্ধটির মৃত্যুর সাথে সাথেই এই রমণীরত্নটি ধর্ম ও লোকাচারের হাতে জীবন্ত পুড়ে মরতে চলেছে।

মেয়েটির জ্ঞান ফেরার জন্য অপেক্ষা করার সাথে সাথে সে নিজের মনেই নিজের উদ্দেশ্যে বসে বসে অনেক দুরূহ প্রশ্নবাণ ছুঁড়তে লাগল। সে ভাবতে বসল আজ তথাকথিত সমাজদ্রোহের পরিণতি সত্ত্বেও সে নিজে কি এই মেয়েটির জীবনের দায়িত্ব নিতে সক্ষম?

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১১

ছাতের কামরার সামনে টিনের শেড, টিনের নীচে রংগনাথ, ওর নীচে খাটিয়া। বেলা দশটা, এখন শুনুন আবহাওয়ার খবর।কাল রাত্তিরে আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল, এখন কেটে গেছে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। বিগত দিনে বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাত হচ্ছিল, এখন সেসব পরিষ্কার হয়ে যেতেই পৌষের শীতের কামড় টের পাওয়া যাচ্ছে। বাজারের নব্বই প্রতিশত মিষ্টি যেমন দেখতেই ভাল, খেতে নয়, তেমনই রোদ্দূরও পিঠে লাগানোর ছেয়ে দেখেই বেশি আরাম।রোদ চারদিকে ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু দেখলে মনে হচ্ছে শুধু নীমগাছের মাথাতেই আটকে রয়েছে। রঙ্গনাথ ওই নীমগাছের মাথায় পাতায় পাতায় রোদ্দূরকে মন দিয়ে দেখছে। শহরেও নীম গাছ আছে। সেখানেও রোদ এসে পাতায় পাতায় খেলা করে। কিন্তু তখন রঙ্গনাথ ওর দিকে তাকিয়েও দেখত না।কিন্তু ওই রোদ্দূরের রূপ ও গাঁয়ে এসে খেয়াল করে দেখল। এরকম অনেকের সাথেই হয়।

রঙ্গনাথের হাবভাব ওইসব ট্যুরিস্টের মত দেশে থাকতে যাদের পথঘাট, হাওয়া, ঘরবাড়ি,রোদ, দেশপ্রেম, গাছপালা, বদমাইসি, মদ, ওয়ার্ক কালচার, যুবতী এবং ইউনিভার্সিটি এসব চোখে পড়েনা, কিন্তু বিদেশে গেলেই দেখতে পায়। এর মানে রঙ্গনাথের চোখ রোদ্দুর দেখছে, কিন্তু মন আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতির গভীরে হারিয়ে গেছে। ওর অনেক কিছুই তো হারিয়ে গেছে, যা কেবল গবেষকরা খুঁজে বের করতে থাকে।

রঙ্গনাথ ওর রিসার্চের জন্যে এমনই এক সাবজেক্ট খুঁজে বের করেছে। হিন্দুস্তানীরা নিজেদের অতীতের খোঁজে ইংরেজদের সাহায্য নিয়ে এমনই এক বিষয় দাঁড় করিয়েছে যার গালভরা নাম-ইন্ডোলজি। এই বিষয়ের গবেষণা শুরুই হয় আগে এ’ব্যাপারে কারা কারা গবেষণা করেতাঁদের নামের গবেষণায়।রঙ্গনাথ ঠিক তাই করছিল।দু’দিন আগে শহরে গিয়ে ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি থেকে গাদাগুচ্ছের বই তুলে এনেছে। এখন নীমগাছের মাথায় বিছিয়ে যাওয়া রোদ্দুরের চাঁদোয়ার নীচে বসে ওই বইগুলো পড়তে শুরু করেছে। ওর ডাইনে মার্শাল, বাঁয়ে কানিংহ্যাম, আর নাকের ঠিক নীচে শোভা পাচ্ছেন উইন্টারনিজ।কীথ পাছার কাছে পায়জামায় গা’ ঘষটাচ্ছেন। ভিনসেন্ট স্মিথ সরে গেছেন পায়ের কাছে এবং কিছু উল্টেপাল্টে গড়াগড়ি খাওয়া বইয়ের ভেতর থেকে উঁকি মারছেন মিসেস রাইস ডেভিস। পার্সিভ্যাল ব্রাউন ঢাকা পড়েছেন বালিশের নীচে। এতসব পন্ডিতের ভিড়ে বিছানার দোমড়ানো মোচড়ানো চাদরের এক কোণে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছেন কাশীপ্রসাদ জয়সোয়াল। ভান্ডারকর চাদরে মুখ ঢেকে লজ্জা লজ্জা ভঙ্গিতে তাকাচ্ছেন।ব্যস্‌, ইন্ডোলজির রিসার্চের হদ্দমুদ্দ একেবারে।

এইজন্যেই হঠাৎ একটা ‘হাউ-হাউ’ আওয়াজ ওর কানে কোন ঋষির সামবেদ গানের মত বেজে উঠল। ‘হাউ-হাউ’ আরও কাছে এল। ওর মনে হল কোন হরিষেণ বোধহয় সমুদ্রগুপ্তের বিজয়গাথা একেবারে ফুসফুসের সমস্ত জোর দিয়ে শোনাচ্ছে। এবার ওই ‘হাউ-হাউ’ নীচের গলিতে পৌঁছে গেছে আর তার সঙ্গে ‘মেরে ফেলব শালাকে’ গোছের কিছু ওজস্বী বাক্য যুক্ত হয়েছে। রঙ্গনাথ বুঝল –ওসব কিছু নয়, এটা ওই ‘গঞ্জহা’দের কোন লফড়া।

ও ছাদের কার্নিশের কাছে এসে নীচে গলির দিকে উঁকি মারল—এক যুবতী মেয়ে, এলোকেশি, রুক্ষ চুল, পরনের কাপড়টিও এলোমেলো, কিন্তু সমানে মুখ চালাচ্ছে। কিন্তু এইটুকু শুনে ভাববেন না যে শহরের ফ্যাশনদুরস্ত মেয়ে চুইংগাম চিবুচ্ছে। আসলে ও হোল ঠেট দেহাতি মেয়ে, নোংরা পোষাক, আর মুখ নড়ছে কারণ ও সঙ্গের ছাগলগুলোকে ‘হলে-হলে-হলে’ করে তাড়িয়ে আনছে।চার-ছ’টা বকরী পাঁচিলের ফাটলে গজিয়ে ওঠা একটি বটের চারাকে চিবুচ্ছে বা চিবিয়ে শেষ করে আরেকটি পাঁচিলের গায়ে কোন বটের চারা গজিয়েছে কিনা তার খোঁজে ব্যস্ত। রঙ্গনাথ মন দিয়ে দেখল- না, ওই হাউ-হাউয়ের উৎস এখানে নয়। ওর নজর ঘুরে ফিরে ওই মেয়েটির চেহারায় আটকে গেল। যারা কোন মেয়েছেলের কথা উঠতেই তালি বাজিয়ে নাচতে গাইতে লেগে যায়, এবং মেজে থেকে লাফিয়ে ছাদে ধাক্কা খায় তাদের জন্যে সব মেয়ে বা যেকোন মেয়ে, এমনকি এই মেয়েটিও ভাল দেখতে। তবে সত্যি কথা বলতে কি, এই মেয়েটির তুলনায় ওই বকরীগুলো বেশি সুন্দর। হাউ-হাউ ধ্বনি র উৎস জানা যায়নি, কিন্তু লাগাতার ওই ধ্বনির অনুরণন শোনা যাছে। এই অবস্থায় রঙ্গনাথ পার্সি ব্রাউন, কানিংহামদের ছাদে ফেলে রেখে নিচে নেমে বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে পড়ল। বৈদ্যজী এখন ওঁর দাওয়াখানায় ওষুধ নিয়ে ব্যস্ত, চার-ছ’জন রোগী এবং শনিচর ছাড়া কারও টিকিটি দেখা যাচ্ছেনা। হাউ-হাউ আওয়াজ এতক্ষণে গলির ভেতরে সেঁধিয়ে গেছে।

রঙ্গনাথ শনিচরকে ইশারা করে শুধোল—শুনতে পাচ্ছ?

শনিচর রোয়াকে বসে একটা কুড়ুলে বাঁট লাগাতে ব্যস্ত ছিল। ও ঘাড় ঘুরিয়ে কান খাড়া করে খানিকক্ষণ ‘হাউ-হাউ’ শুনতে লাগল। হঠাৎ ওর কপালের চিন্তার ভাঁজগুলো মিলিয়ে গেল।ও শান্তভাবে বলল,’ হ্যাঁ, একতা হাউ-হাউ মত শোনা যাচ্ছে বটে। মনে হচ্ছে ছোটে পালোয়ান আর কুসহরের মধ্যে ফের ঝগড়া হয়েছে’।

এই খবরটা ও এমন নির্লিপ্তভাবে বলল যেন কোন মোষ কারও দেয়ালে একটু শিঙ রগড়ে নিল। ফের ও বাটালি দিয়ে কুড়ুলের বাঁট চাঁছতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

হঠাৎ হাউ-হাউ একেবারে জলজ্যান্ত সামনে হাজির! ষাট বছরের এক শক্তসমর্থ বুড়ো।খালি গা’, মালকোঁচা মেরে পরা ধুতিটা হাঁটু অব্দি ঢেকেছে। মাথায় তিনটে ক্ষত, তার থেকে রক্তের ধারা বইছে তিন আলাদা দিশায়, এরথেকে প্রমাণ হচ্ছে যে একজাতের খুনেরও নিজেদের মধ্যে মেলামেশা পচ্ছন্দ নয়। বুড়োটা জোরে জোরে হাউ-হাউ করে চেঁচিয়ে দুই হাত শূন্যে তুলে যেন সহানুভূতি কুড়োতে চাইছে।

রক্ত দেখে ঘাবড়ে গেল রঙ্গনাথ।কাঁপা গলায় জানতে চাইল-এই লোকটা? এ কে? কে মেরেছে এমনি করে?

শনিচর কুড়ুলের বাঁট ও বাটালি আস্তে করে মাটিতে নামিয়ে রাখল।আহত বুড়ো মানুষটার হাত ধরে মাটিতে বসাল। লোকটি ‘কোন সাহায্য চাইনে’ ভাব দেখিয়ে হাত ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিল, কিন্তু বিনা ওজর আপত্তি মাটিতে বসে পড়ল।শনিচর চোখ কুঁচকে মন দিয়ে চোটগুলো দেখে বৈদ্যজীর দিকে ঠোঁটের কোণ বেঁকিয়ে ইশারা করল যে চোট হালকা, বেশি গভীর নয়।ও্রদিকে বুড়োর ‘হাও-হাও’টাও দ্রুতলয় ছেড়ে বিলম্বিত লয় ধরেছে এবং শেষে কোন জটিল তালের সমে গিয়ে আটকা পড়েছে। এসব গায়কের ঘরানার হিসেবে বেয়াড়া চলন, কিন্তু ওর উদ্দেশ্যটি স্পষ্ট। ও রেগে উঠে চলে যাবেনা, বরং এখানে মৌরসীপাট্টা গেড়ে বসবে। শনিচর এবার নিশ্চিন্ত হয়ে এমন একখান শ্বাস টানল যেটা দূরের মানুষজন শুধু শুনতে নয়, দেখতেও পেল।

রঙ্গনাথের একেবারে পাঁজঞ্জুরিতে তিড়িতংক লেগে গেছে।শনিচর পাশের আলমারিটার থেকে তুলো বের করতে করতে জিজ্ঞেস মুখ খুলল,’ জিজ্ঞেস করছ ওকে কে মেরেছে? এটা আবার কেউ জিজ্ঞেস করে নাকি? এ হোল ছোটে পালোয়ানের বাপ। একে আর কে মারতে পারে, খুদ ছোটে পালোয়ান ছাড়া? কার ঘাড়ে ক’টা মাথা যে পালোয়ানের বাপের গায়ে হাত তুলবে’?

কথা বলতে বলতে শনিচর এক লোটা জল ও কিছু তুলো নিয়ে বুড়োর কাছে পৌঁছে গেল।

নিজের ছেলের এবংবিধ প্রশংসা শুনে ছোটে পালোয়ানের বাপ কুসহর বা কুসহরপ্রসাদের বোধহয় একটু জ্বালা জুড়োলো।সে ওখান থেকেই উঁচু গলায় বৈদ্যজীকে বলল, ‘মহারাজ, এবার তো ছোটুয়া আমায় মেরেই ফেলেছিল। আর তো সয়না।এবার আমাদের ভাগাভাগি করে দাও। নইলে কোন দিন ওই আমার হাতে খুন হয়ে যাবে’।

বৈদ্যজী এবার তক্তপোষ থেকে নেমে রোয়াকের দিকে এগিয়ে এলেন।ক্ষতগুলো মন দিয়ে দেখে অভিজ্ঞ কবিরাজের গলায় বললেন—‘চোট টোটগুলো তেমন গভীর নয়। এখানে চিকিৎসা না করিয়ে হাসপাতালে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়।ওখানেই পট্টি-টট্টি বেঁধে দেবে’খন’। তারপর দরবারের লোকজনকে শুনিয়ে বললেন- কাল থেকে ছোটের এখানে আসা বন্ধ। এমন নরকের বাসিন্দের এখানে স্থান নেই।

রঙ্গনাথের রক্ত টগবগ করছিল। বলল,’আশ্চর্য, এমনসব লোকজনকে বদ্রীদাদা পাশে বসিয়ে রাখেন’।

বদ্রী পালোয়ান ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখিয়ে বলল,’লেখাপড়া জানা লোকেরা একটু ভেবেচিনতে কথা বলে। আসলে কার দোষ, কে জানে?এই কুসহরও কোন কম যায় না। এর বাপ গঙ্গাদয়াল যখন মরল, এ ব্যাটা বাপের শব ঘর থেকে চালিতে করে বের করতেই দিচ্ছিল না। বলছিল নদীর ঘাট অব্দি হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসবে’।

কুসহর ফের হাউ-হাউ হল্লা শুরু করল, কিন্তু বেশ কষ্ট করে। যার মানে, বদ্রী এসব কথা তুলে আসলে ওর প্রতি ভয়ানক অত্যাচার করছে।একটু পরেই ও সোজা দাঁড়িয়ে উঠে হুংকার ছেড়ে বলল, “বৈদ্যজী মহারাজ, ছেলেকে সামলাও। ও এইসব পুরনো কথা তুলে ইচ্ছে করে তোল্লাই দিচ্ছে যাতে দু’চারটে লাশ পড়ে যায়।ওকে চুপ করাও, নইলে খুন না করে থামবো না । আমি হাসপাতালে পরে যাব, আগে থানায় যাচ্ছি। ছোটুয়াকে এবার যদি আদালতে টেনে না নিয়ে যাই, তবে তোমরা আমায় গঙ্গাপ্রসাদের সন্তান নয়, জারজ সন্তান বলে ডেকো। আমি তো তোমাকে খালি আমার আঘাত দেখাতে এসেছিলাম। দেখে নাও মহারাজ, তিন জায়গা থেকে খুন বইছে; দেখে নাও, তোমাকেই আদালতে সাক্ষী দিতে হবে”।

বৈদ্যজী ওর আঘাত না দেখে অন্য রোগীদের দিকে মন দিলেন। তার সঙ্গে বক্তিমে চালু। যেমন, নিজেদের মধ্যে কলহ শোকের কারণ হয়। এসব বলে উনি লাপরমান ফিয়ে ইতিহাসের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। তারপর পুরাণের ঝাড়বাতির আলোর ছটা থেকে এক লাফে বর্তমানে ফিরে এলেন।এবার পারিবারিক কলহকে শোক ও পশ্চাত্তাপের মূল কারণ প্রমাণ করে উনি কুসহরকে পরামর্শ দিলেন যে কোর্ট-কাচারির চক্করে পড়তে নেই। শেষে উনি আবার প্রমাণ করতে লাগলেন যে থানা-পুলিশও শোকের মূল কারণ।

কুসহর গর্জে উঠল,” মহারাজ, এসব জ্ঞান নিজের কাছে রেখে দাও। এখানে রক্তের নদী বইছে আর তুমি গান্ধীগিরি ঝাড়ছ? যদি বদ্রী পালোয়ান কোনদিন তোমাকে চিত করে বুকের উপর চড়ে বসে তখন দেখব তোমার ইহলোক-পরলোক লেকচার কোথায় থাকে”!

বৈদ্যজীর গোঁফ থরথর করে কাঁপছে, তার মানে উনি অপমানিত বোধ করছেন। কিন্তু মুখের হাসিটি এমন যেন অপমান কাকে বলে উনি জানেনই না। যারা হাজির ছিল তাদের সবার মুখের চেহারা শক্ত হয়ে গেল। বোঝা যাচ্ছে, কুসহরের এখানে আর সহানুভূতি জুটবে না। বদ্রী পালোয়ান ওকে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিল।

“ যাও যাও; মনে হচ্ছে ছোটুয়ার সাথে হাতাহাতি করে মন ভরেনি। গিয়ে ব্যান্ডেজ ফ্যান্ডেজ করিয়ে নাও। এখানে বেশি টিলটিলিও না”।

এখন পর্য্যন্ত যা নমুনা দেখা গেছে তাতে মনে হচ্ছে ছোটে পালোয়ানের বংশটি বেশ খানদানি।ওর প্রপিতামহের নাম পর্য্যন্ত মনে আছে! আর সমস্ত খানদানি বংশের ছেলেদের মত ও নিজের পরিবারের গৌরবগাথা শোনাতে ভালবাসে। কখনও কখনও কুস্তির আখড়ায় সাথিদের কিসসা শোনাতে থাকেঃ

‘আমার পরদাদার নাম ভোলানাথ। কথায় কথায় রাগ; রাগলে পরে নাকের পাটা ফুলে উঠত। রোজ সকালে উঠে আগে নিজের বাপের সঙ্গে একটু করে তারপর মুখ ধুতে যেত। ওই উস্তুম-ধুস্তুমটি না হলে ওনার পেটখারাপ হয়ে যেত’।

ছোটে পালোয়ানের বর্ণনায় পুরনো দিনের জন্যে এক ভালোলাগা ঝরে পড়ে। ওর কিসসা শুনতে শুনতে শ্রোতার চোখের সামনে ফুটে ওঠে একটি উনবিংশ শতকের গাঁইয়ের ছবি, যেখানে দরজার সামনে একগাদা গাইবলদ, গোবর ও চোনার ঝাঁঝালো গন্ধ, নিমের ছায়া আর যার নীচে খাটিয়ায় দুই মহাপুরুষ গড়াতে থাকে ও মাঝে মাঝে উঠে বসে গা’ থেকে নিমের পাতা ফুল ঝাড়তে ঝাড়তে একে অন্যকে এতক্ষণ শুয়ে থাকার অপরাধে গাল পাড়তে থাকে। ওই দুই মহাপুরুষের একজন বাপ, অন্যজন তার ব্যাটা। এরপর দুজন একে অপরকে মাটিতে জ্যান্ত পুঁতে ফেলার হুমকি দিতে দিতে খাটিয়া ছেড়ে উঠে দু’চারট্র আলতু ফালতু বকবক করে –‘যাও সবে নিজ নিজ কাজে’ হয়ে যায়। একজন বলদের লেজ মোচড়াতে মোচড়াতে নিজের খেতের দিকে রওনা হয়। অন্যজন মোষ চরাতে অন্যের খেতে চলে যায়।

এরকম একটা গল্প শেষ করার পর ছোটে হরদম বলত, ‘বাপটা মরে গেলে ভোলানাথ দুঃখে ভেঙে পড়েছিল’।

এই লাইনটা ছোটে ন্যাকামি করে বলত না। ভোলানাথ সত্যি সত্যি ছিভেঙে পড়েছিল।ওর বংশে এমনই রেয়াজ ছিল। ওদের খানদানে সব প্রজন্মেই বাপ-ব্যাটার সম্বন্ধ খুব ঘনিষ্ঠ হত। ওরা প্রেম করত শুধু নিজেদের মধ্যে, লাঠালাঠি? সেও ওই বাপ-ব্যাটার মধ্যে।ওদের ভেতরে ভালো-মন্দ, সুপ্ত প্রতিভা বা গুণ যাই থাকুক তার প্রয়োগ বাপ-ব্যাটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত।

বাবা ভোলানাথ নিজের বাপবুড়ো মরে গেলে সত্যি সত্যি বড় শোক পেয়েছিল। জীবনে এক নি;সংগতা এক শূন্যতা ছেয়ে গেল। সকালে উঠে কারও সঙ্গে ঝগড়া করতে না পেরে ওর পেট গুড়গুড় করতে লাগল। চোখে মুখে জল দেয়ার ইচ্ছেটাও মরে গেল।রাতদিন খেতে বলদের মত পরিশ্রম করেও খাবার হজম হচ্ছিল না। তখন ওর ছেলে গঙ্গাপ্রসাদ এগিয়ে এল। লোকে বলে যে ছেলে হোল বুড়ো বয়সে চোখের জ্যোতি। তা’ গঙ্গাপ্রসাদ সতের বছর বয়সেই নিজে বাপ ভোলানাথকে এমন একখান লাঠির ঘা কষাল যে তিনি মাটিতে চিৎপটাং।তাঁর চোখের মণি কড়ির মত বেরিয়ে এল এবং চোখের সামনে ফুলঝুরি জ্বলতে লাগল।

এরপর বাপ-ছেলের সম্বন্ধ পাকা হয়ে গেল।। ভোলানাথ সরে গেল ওর মৃত বাপের ভূমিকায়, ওর ছেলে গঙ্গাপ্রসাদ চলে এল ওর জায়গায়। কিছুদিন গেলে হাত-পায়ের ব্যথার চোটে ভোলানাথের পেট ঠিক হয়ে গেল বটে, কিন্তু কানের মধ্যে সারাক্ষণ একটা সাঁই সাঁই আওয়াজ চলতে থাকে। এটা বোধহয় গঙ্গাপ্রসাদের কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয়া গালির স্রোতের দান। যাই হোক, এবার সকাল বেলা ঘরের মধ্যে উস্তুম-ধুস্তুম করার আশায় গঙ্গাপ্রসাদের পেটের মধ্যে গুরগুর শুরু হোল।

ছেলে কুশহরপ্রসাদ হল ছোটু পালোয়ানের বাপ। কুশহরপ্রসাদ একটু গম্ভীর স্বভাবের। তাই বাপের সঙ্গে খামোখা গালাগালি করে সময় নষ্ট করত না। এছাড়া রোজ সকালে খেতে কাজ করতে যাওয়ার আগে বাপের সঙ্গে ঝগড়া করার যে কয়েক পুরুষের অভ্যেস সেটাও ও ছেড়ে দিল। তার বদলে আরম্ভ হোল মাসিক দরে মারপিট। গঙ্গাপ্রসাদের ছোটবেলা থেকেই নোংরা ছ্যাঁচড় গালির জন্যে এত নাম হোল যে নওজোয়ান গঞ্জহা’র দল রোজ বিকেলে ওর আড্ডায় হাজিরা দিতে লাগল। ওর মৌলিক এবং শিল্পসম্মত গালিগুলো শুনে ওরা পরে নিজের নামে চালিয়ে দিত। গালাগাল এবং গেঁয়ো গানের পদরচনার কোন কপিরাইট তো হয়না। এভাবে গঙ্গাপ্রসাদের গালিগুলো হাজার কন্ঠে হাজার পাঠান্তরের সঙ্গে ধ্বনিত হতে থাকল। কিন্তু বাপের এই প্রতিভায় কুসহর আদৌ প্রভাবিত হলনা। ও চুপচাপ গালি শুনতে শুনতে বাপকে মাসে একবার দু-চারটে লাঠির বাড়ি কষিয়ে ফের নিজের কাজে চলে যেত। দেখা গেল, বদহজমের পারিবারিক অসুখটি সারাতে এই পদ্ধতি বেশ কাজের। কারণ, বদহজমের সমস্যাটি গঙ্গাপ্রসাদের সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছল।

কুসহরপ্রসাদের আরও দুটো ভাই ছিল-বড়কু আর ছোটকু। ওরা দু’জন শান্তশিষ্ট, নিরস্ত্রীকরণের ভক্ত। সারাজীবনে একটা কুকুরকেও লাঠিপেটা করেনি। বেড়াল আরামসে ওর রাস্তা কাটে, ও তাদের একটা ঢিলও ছোঁড়েনা। কিন্তু ওরা বাপের থেকে গালি দেয়ার শিল্পকলা শিখে ফেলেছিল। আর তার দৌলতেই ওরা রোজ সন্ধ্যায় সমস্ত পারিবারিক ঝগড়ার সমাধান বিনা মারপিট করে সেরে ফেলত। রোজ সন্ধ্যে হলে দুই ভাই আর তাদের দুই গিন্নি মিলে যে ‘কাঁও কাঁও’ শুরু হত সেই অধিবেশন শেষ হতে হতে রাত দশটা। এই অধিবেশনগুলোর তুলনা দেশের সুরক্ষা সমিতির বৈঠকের সঙ্গে কয়রা যেতে পারে। কারণ ওই বৈঠকগুলোতেও বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা অনেকক্ষণ ‘কাঁও কাঁও’ করে যুদ্ধের সম্ভাবনা কিছুটা হলেও কম করে ফেলে।

এরকম দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কুশহরপ্রসাদ পরিবারের রোজকার হল্লাগুল্লাকে ঘৃণার চোখে দেখাটা প্রতিক্রিয়াবাদীর চিহ্ন, কিন্তু আশপাশের লোকজনের রাজনৈতিক চেতনা অতটা বিকশিত হয়নি যে, কী আর করা! ফলে যেই সন্ধ্যেবেলা ছোটকু ও বড়কুর গালি এবং হাহাকারের ধ্বনি গলির কুকুরের ভৌ ভৌকে ছাপিয়ে উঠে শিবপালগঞ্জের আকাশকে বর্শার খোঁচায় ফালাফালা করে ফেলে অমনই পড়শিদের টিপ্পনি শুরু হয়ে যায়ও।

‘ এখন এই কুকুরহাও’ (ঘেউ ঘেউ) মনে হচ্ছে আদ্দেক রাত অব্দি চলবে’।

‘ একদিন একটা ফাটা জুতো নিয়ে এদের উপর চড়াও হব, তবেই এরা শিখবে’।

‘এর জিভে ব্রেক ফেল হয়ে গেছে। চলছে তো চলছেই’।

এই ‘কুকুরহাও’ শব্দটা গঞ্জহাদের তৈরি। কুকুরের দল নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-মারামারি করে আর একটা আরেকটাকে উসকে দেয়ার জন্যে খানিকক্ষণ চেঁচায়, সেটাই ‘কুকুরহাও’।শব্দকোষের নিয়ম-টিয়ম দেখলে ছোটকু এবং বড়কুর আলাপকে ‘কুকুরহাও’ বলা বোধহয় উচিত হবেনা। আসলে এরা দুইভাই দুইবৌ যা করে সেটা হোল বান্দরহাও। এরা বাঁদরের মত খোঁ খোঁ করে একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং কোন রেফারির বাঁশি না বাজলেও নিজে থেকে পিছিয়ে আসে। যদি বাইরের কেউ মধ্যস্থতা করতে আসে বা ওদের শান্তির মহত্ত্ব বোঝাতে চাইবে তাহলে তক্ষুণি ওরা দুজনে এক হয়ে তৃতীয় ব্যক্তির উপর খোঁ খোঁ করে হামলা করবে। বান্দরহাও এর এই নিয়ম সব গঞ্জহা জানে। তাই ছোটকু-বড়কুর পারিবারিক অধিবেশনের সমালোচনা হয় লুকিয়ে চুরিয়ে, পেছনে আর ওদিকে ওদের ওই অধিবেশন মাঝরাত পর্য্যন্ত বাধাহীন চলতে থাকে।

ছোটে পালোয়ানের বাপ কুশহরপ্রসাদ হোল কম কথার কাজের মানুষ।ও ছোট দু’ভায়ের বাগীশ্বরী প্রবন্ধাবলীর ব্যাপারটা কোনদিন বোঝেনি।ওর স্বভাব হোল খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর হঠাৎ হঠাৎ হাত চালিয়ে দেয়া। এটা আবার অন্য ভাইদের জীবনদর্শনের সঙ্গে একেবারে খাপ খায় না। এইজন্যে ও বাবা গঙ্গাপ্রসাদ মারা যাবার কয়েকবছর পরে ভাইদের থেকে আলাদা হয়ে গেল। মানে, কোন কথা না বলে একদিন লাঠির জোরে ভাইদের বাড়ি থেকে খেদিয়ে দিল। ওরা বাধ্য হোল একটা ক্ষেতের মধ্যে ঝুপড়ি বানিয়ে বাণপ্রস্থ-আশ্রম মেনে নিতে, আর নিজে পৈতৃক বাড়িতে জোয়ান ছেলের সঙ্গে ওদের বাপছেলের খানদানি ঐতিহ্যের সঙ্গে গৃহস্থ-আশ্রম চালাতে লাগল।

মাসের মধ্যে অন্ততঃ একবার বাপকে লাঠিপেটা করে কুশহরের এমন অভ্যেস হয়ে গেছল যে বাপ মরে যাওয়ায় ওর হা্তে মাসে দু’চার দিন পক্ষাঘাতের মত হয়ে যেত।পক্ষাঘাতের ভয়ে ও একদিন আবার লাঠি তুলে নিল এবং ছেলে ছোটে পালোয়ানের কোমরে ত্যাড়া করে এক ঘা কষাল। ছোটে তখনও ছোট, পালোয়ান হয়নি, কিন্তু গাঁয়ের বাইরে রেললাইনের পাশে তার টানা বড় বড় লোহার স্তম্ভের উপর সাদা সাদা ইনসুলেটর ঢিল ছুঁড়ে ভাঙা অভ্যেস করছিল। ওর নিশানা ছিল অব্যর্থ। যেদিন কুশহরপ্রসাদ ছোটের কোমরে লাঠির ঘা কষাল মাত্র সেইদিনই ও রেললাইনের ফাঁকে বিছানো নুড়ির থেকে বেশ ক’টা তুলে নতুন একটা স্তম্ভের গায়ে লাগানো সবক’টা ইন্স্যুলেটর ভেঙে আবার লাইনের ফাঁকে বিছিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরেছিল। লাঠির ঘা’ খেয়ে ও রেললাইনের দিকে বিশ পা দৌড়ে গিয়ে একটা নুড়ি তুলে বাপের মাথাকে ইন্সুলেটর ভেবে তাক করল।ব্যস্‌ সেদিন থেকেই ওদের পরিবারে বাপ-ছেলের মধ্যে বংশপরম্পরায় চলে আসা সনাতন ধর্ম প্রাণ পেয়ে জেগে উঠল।ব্যস্‌ আরকি! এরপর প্রায় প্রতিমাসে কুশহরের চেহারায় দু’একটা ছোট ক্ষত পার্মানেন্ট দেখা যেতে লাগল। এভাবে অল্প দিনেই ও অঞ্চলের রানা সঙ্গার ( বাবরের সঙ্গে লড়াইয়ে আশিটা ঘা’ নিয়ে লড়ে যাওয়া মেবারের রাণা) টাইটেল পেল।

ছোটে পালোয়ান জোয়ান হয়ে উঠলে পরে বাপ-ব্যাটার মধ্যে শব্দের আদানপ্রদান থেমে গেল। ওরা উঁচুদরের শিল্পীর মত নিজের ভাবনার প্রকাশ চিহ্ন, প্রতীক ও ইংগিতের মাধ্যমে ব্যক্ত করতে শুরু করল।ওদের মধ্যে মারপিটের ঘটনাও কমে গেল। ওসব বড় বড় নেতাদের জন্মদিন পালনের মত ধীরে ধীরে এক বার্ষিক অনুষ্ঠানের রূপ নিল, যা জনতার দাবি হোক না হোক, নির্ধারিত সময়ে পালন করা হয়ে থাকে।

কুশহরপ্রসাদ চলে গেলে রোয়াকের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ফুট কাটল- এই হোল কলিযুগ! বাপের সাথে ব্যাটার ব্যভারটা দেখলে!

মাথার উপরের নীম গাছের ডালপালা সরিয়ে আকাশের দিকে চোখ তুলে লোকটা ফের বলে উঠল, ‘প্রভু তুমি কোথায়? কবে কল্কি অবতাত্রের রূপ ধারণ করে নেমে আসবে?

উত্তরে কোন আকাশবাণী তো দুর, একটা কাকের আওয়াজও শোনা গেল না। কল্কি অবতারকে আহ্বান করা লোকটির মুখ কালো হয়ে গেল। কিন্তু কুড়ুলের বাঁট পরীক্ষায় ব্যস্ত শনিচর তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠল, ‘যাও, তুমিও কুসহরের সঙ্গে সঙ্গে যাও। সাক্ষী দিও, সিকি-আধুলি কিছু না কিছু ঠিক জুটে যাবে’।

বদ্রী পালোয়ান মুচকি হেসে সায় দিল।রঙ্গনাথ দেখল কল্কি অবতারের বাতেলা করা লোকটি একজন পুরুতের মত দেখতে বুড়োমানুষ।চিমড়ে গাল, খিচুড়ি দাড়ি, বোতামহীন জামা, মাথায় একটা যেমন তেমন গান্ধীটুপি, তার পেছন থেকে টিকি এমনভাবে বেরিয়ে যেন আকাশ থেকে বাজ পড়লে আর্থিং এর কাজ দেবে।ওর কপালে লাল চন্দনের ফোঁটা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা।

লোকটা সত্যি সত্যি কুশহরের পেছন পেছন চলে গেল। শনিচর বলল,” ওই হোল রাধেলাল। সাক্ষী দেয়ার একনম্বর। কোন উকিল, যত নামজাদাই হোক, আজ অব্দি ওকে জেরা করে পেরে ওঠেনি।

শনিচরের পাশে একটা আমোদগেঁড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ভক্তিভরে বলে উঠল, ’রাধে্লাল মহারাজের উপর কোন দেবতার ভর হয়। মিথ্যে সাক্ষী চটপট দিতে থাকে। উকিলের দল চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে। বড় বড় লোকের হাওয়া টাইট হয়ে যায়’।

খানিকক্ষণ রাধেলালের তারিফ করে কাটল। শেষে শনিচর আর ওই আমোদগেঁড়ের মধ্যে তর্ক বেঁধে গেল। শনিচরের হিসেবে রাধেলাল বড্ড গোঁয়ার আর শহরের উকিলগুলো হাঁদারাম, নইলে ওকে জেরায় কাত করতে পারে না? উলটো দিকে আমোদগেঁড়ে এটাকে দেবতার আশীর্বাদ এবং বিভূতি প্রমাণ করেই ছাড়বে। যুক্তি আর বিশ্বাসের লড়াইয়ে বিশ্বাস যে ক্রমশঃ যুক্তিকে পেড়ে ফেলছে সেটা বলার দরকার নেই। ঠিক তখনই পাশের কোন একটা গলি থেকে ছোটে পালোয়ান উদয় হোল। বৈদ্যজীর দরজায় এসে এদিক সেদিক উঁকিঝুঁকি মেরে তারপর বলল,’ চলে গেছে’?

শনিচর বলল, ‘হ্যাঁ গেছে। কিন্তু পালোয়ান, এই পলিসিটা মনুষ্যত্বের বিরুদ্ধে’।

পালোয়ান দাঁতে দাঁত পিষে বলল,’তোর মনুষ্যত্বের ইয়ে করি’।

শনিচর কুড়ুল হাতে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচাল,’দেখো বদ্রী ভাইয়া! তোমার বাছুর আমাকে চাট মারছে! সামলাও’!

বৈদ্যজী ছোটেকে দেখে উঠে পড়লেন। রঙ্গনাথকে বললেন,’ এমন নীচপ্রবৃত্তির মুখ দেখাও পাপ! একে এখান থেকে ভাগাও’! এই বলে উনি ভেতরে চলে গেলেন।

ছোটে পালোয়ান বৈঠকখানার ভেতরে ঢুকে পড়ল। চারদিকে রোদের খেলা। সামনের নীমগাছে একগাদা টিয়েপাখি টে-টে করে ওড়াউড়ি করছে।রোয়াকের উপর শনিচর কুড়ুল হাতে খাড়া। বদ্রী পালোয়ান এক কোণে চুপচাপ একজড়া মুগুরের ওজন পরীক্ষায় ব্যস্ত।রঙ্গনাথ বৈঠকে পড়ে থাকা একটা বইয়ের পাতা ওল্টানোয় ব্যস্ত। ছোটে টের পেল যে হাওয়ায় বারুদের গন্ধ। এর জবাবে ও ছাতি ফুলিয়ে রঙ্গগনাথের পাশে ধপ করে বসে পড়ল আর চোয়াল নাড়িয়ে নাড়িয়ে মুখের ভেতর পুরে রাখা সুপুরির জাবর কাটতে লাগল।তারপর ছোটে রঙ্গনাথের দিকে এমন করে তাকাল যেন ও একেবারে নস্যি। তারপর তিরিক্ষি ভাবে বলল,’ তাহলে এই ব্যাপার! আমি তো আমার বদ্রীগুরুর ঘর ভেবে এসেছিলাম, কিন্তু যদি তোমাদেরই মাতব্বরি চলে তো এখানে আর পেচ্ছাপ করতেও আসছি না’।

রঙ্গনাথ হেসে পরিবেশ হালকা করতে চাইল। ‘আরে না না, পালোয়ান বসো দিকিনি! মটকা গরম হয়ে থাকে তো এক লোটা ঠান্ডা জল খাও’।

ছোটের গলার স্বর আগের মতই কর্কশ,’জল খাবো? আমি এখানে ছোঁচানোর জন্যেও জল চাইব না। সবাই মিলে আমায় ইল্লি করতে লেগেছে’।

বদ্রী এবার ছোটের দিকে প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর একটা মুগুর নিয়ে বাঁহাতে খেলতে খেলতে মুচকি হেসে বলল, ‘রেগে যাওয়া দুর্বলকে শোভা দেয়। তুমি কেন নাক ফোলাচ্ছ? তুমি মানুষ না পায়জামা’?

ছোটে পালোয়ানের সমর্থনের ইশারা বুঝতে দেরি হল না। আরও মেজাজ দেখিয়ে বলল,’ বদ্রী গুরু! আমার একটূও ভাল লাগছেনা। সবাই আমার পেছনে হাত ধুয়ে পড়েছে্‌, কাঠি করছে।খালি বলে-বাপের গায়ে কেন হাত তুলেছ? বাপকে কেন মেরেছ?যেন কুশহরপ্রসাদ শিবপালগঞ্জে সবার বাপ!আর আমিই খালি ওর শত্রু’।

বলতে বলতে ওর রাগ আরও চড়ে গেল। বলল,’ দেখ গুরু, শালা একটা বাপের মত বাপ হত, তাও বুঝতাম’।

খানিকক্ষণ সবাই চুপ।



রঙ্গনাথ ছোটে পালোয়ানের বাঁকা ভুরু মন দিয়ে দেখছে। শনিচর এবার রোয়াক থেকে দরবারের ভেতরে এল। ও পালোয়ানকে বোঝাতে চাইল,’এমন সব কথা মুখে আনতে নেই।একটু মাটিতে পা ফেল, খামোখা আকাশের বুকে খোঁচা মেরো না।কুসহর তোমাকে জন্ম দিয়েছে, পালন-পোষণ করে এত বড় করেছে, এটা তো মানবে’?

ছোটে কুড়কুড়িয়ে বলল,’আমি বুঝি স্ট্যাম্প লাগিয়ে দরখাস্ত পেশ করেছিলাম—আমাকে জন্ম দাও? ওরে আমার জন্মদেনেবালে রে’!

বদ্রী এতক্ষণ চুপচাপ কথাবার্তা শুনছিল। এবার মুখ খুলল,’অনেক হয়েছে ছোটে, এবার ঠান্ডা হ’ দিকি’!

ছোটে নিরুৎসাহ ভঙ্গিমায় বসে রইল।বোধহয় নিমগাছের মাথায় টিয়ে পাখির টে-টে কিচিরমিচির শুনছিল। শেষে এক লম্বা শ্বাস টেনে বলল,’তুমিও আমাকেই দোষী ঠাউরেছ গুরু! তুমি জাননা এই বুড়োটা কত বড় ব্জজাত!ওর জ্বালায় বৌ-ঝিরা আমাদের বাড়িতে জল ভরা বন্ধ করে দিয়েছে।আরও বলি? এরপর আর কী বলার থাকে? জিভ নোংরা হবে’।

0 comments: